মীম মিজান এর সকল পোস্ট

চিঠি : প্রিয়সি স্বপ্না ভালো থেকো

স্বপ্নে খুজে পাওয়া স্বপ্না,

আশাকরি এ কাক চিলে মানুষ ভক্ষণের দিনে সুস্থ আছ। জানি তুমি সুখে নেই। গ্রামের পাক বাহিনীর দোষররা নিশ্চয় তোমার উপর লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তোমায় অস্বস্তিতে ফেলে। তুমি কোন এক অজানা ভয়ে যাও কুকড়ে। ভেতরটা তোমার চৈত্র মাসের ফসলের ক্ষেতের মত ফেঁটে হয় চৌচির। সেই ভয়ের ভয়াল থাবার কিছু নখ আঁচর করে এ কলিজায়। ঝোঁপের মাঝে ঘুম থেকে আঁচমকায় সেটা অনুভূত হয়। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ে অনেক দিন মুন্ডন বিহীন দাঁড়ি চুঁয়ে চুঁয়ে। সহযোদ্ধা ইদ্রিস টের পায় হাস-ফাস করা শব্দে। সান্তনা দেয় ধৈর্য ধরার। বলে দেশ স্বাধীন হলে বিজয়ী বেশে স্বপ্নাকে বউ করে ঘরে তুলি নিস।

পরদিন সকালে ছোট্ট আব্বাস সংবাদ নিয়ে এলো যে হাকিমপুর গ্রামের ঠিক হাই স্কুলের উত্তর পাশের বাঁশ বাগানে বাংকার করেছে পাকিস্থানি বাহিনী। এ সংবাদ শুনে আমাদের ক্যাপ্টেন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি আমাদের সবাইকে নিয়ে টিম মিটিং করলেন। সেখানে বললেন যে, আমাদের খবর যে কোনো মুহূর্তে পাকিস্থানি বাহিনীর কাছে পৌছে যেতে পারে। এই মুহূর্তে আমাদের কি করা উচিত? আমরা সবাই বললাম ক্যাপ্টেন স্যার আপনি জোনাল কমান্ডারের সাথে পরামর্শ করেন ও পাকিস্থানি বাহিনীর অস্ত্রের মজুদের পরিমাণ আব্বাসের মাধ্যমে জেনে নিন। তিনি একটি চিঠি লিখে আব্বাসের হাতে দিয়ে বললেন এটি স্কুল মাস্টার মোসলেম রে দিবি আর বলবি ৫৫৭০০৫(গোপন কোড যা দ্বারা সাব কমান্ডারের নাম বুঝিয়েছিল)।

রাতে আব্বাস এসে ফিসফিসিয়ে ক্যাপ্টেন কে কি জানি বলল? আব্বাস চলে গেলে ক্যাপ্টেন আমাদের ডেকে বললেন, পাক বাহিনী ইদ্রিসের বাড়িতে হামলা করেছিল। ইদ্রিসের মাকে অনেক অত্যাচার করেছে ইদ্রিস মুক্তিফৌজে যোগদানে। ইদ্রিস তো রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল তার মায়ের এসম্মান ও অপমানের খবরে। সে রাইফেল হাতে নিয়ে বলে স্যার অর্ডার দেন ওই কুকুরের বাচ্চাদের শেষ করে আসি। ক্যাপ্টেন বললেন, ইদ্রিস মাথা ঠান্ডা রাখ। আমরা অবশ্যই অপারেশন চালাবো তবে সাব কমান্ডারের আদেশ লাগবে তো। কিছক্ষন পড়েই মোসলেম মাস্টার আসলেন টর্চ লাইটের আলো দিয়ে পথ চিনে। এসেই ক্যাপ্টেনকে সাব কমান্ডারের চিঠি দিলেন। চিঠি পেয়ে ক্যাপ্টেন আমাদের নিয়ে মিটিং করলেন। তিনি অপারেশন চালানোর নির্দেশ পেয়েছেন। তাই তিনি আমাদের নয়জনের টিমকে তিনটি ভাগে ভাগ করলেন। ১ম গ্রুপে আমি ইদ্রিস আর ফজলু। ২য় গ্রুপে রমজান, ময়েন আর মমিন। ৩য় গ্রুপে ক্যাপ্টেন, রতন আর তালেব।

ক্যাপ্টেন গ্রুপ থাকবে স্কুলের কাছে। আমরা থাকব বাঁশ ঝোপের দক্ষিণে। রমজানেরা পূর্বে। পশ্চিম দিকে পুকুর এজন্য সেদিক কোন গ্রুপ লাগেনি। প্রথমেই ক্যাপ্টেন বলে দিয়েছিল যে তিনিই প্রথম আক্রমণ করবেন। অতঃপর পাক বাহিনী এ দিকে গুলি ছুড়া শুরু করলে দ্বিতীয় গ্রুপ আক্রমণ চালাবে। এভাবে প্রথম গ্রুপ। কেননা তারা বিভ্রান্ত হবে ও ভয় পাবে। আমরা যে মাত্র নয়জন এটা ওরা বুঝবেনা।

পরিকল্পনানুযায়ী জ্যোৎস্না বিধৌত রাতে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দে অপারেশন শুরু। যথারীতি ক্যাপ্টেনের আক্রমণ। পাক বাহিনী বিচলিত হয়ে স্টেন গান দিয়ে খই ফোটাতে শুরু করলো সে দিকে। অতঃপর রমজানেরা শুরু করল গুলি ছুড়তে। পাক বাহিনীর কিছু অংশ পূর্ব দিকে গুলি চালাতে লাগল। এবার আমরা শুরু করলাম রাইফেল চালাতে বাংকারের ভিতর। এরকম ত্রিমুখি আক্রমণ দেখে তো তারা দিশে হারা। জ্যোৎস্নার আলোয় প্রায় সব বুঝা যাচ্ছিল। পাক বাহিনী গুলি চালানো থামিয়ে দিল। ভাবলাম সব কি শেষ! না। হঠাৎ আবার গুলি শুরু করেছে তারা। আমরা মাথা নিচু করে গুলি চালাচ্ছিলাম। ইদ্রিস বলে উঠল আজগর দেখ ওরা মাথা উঁচিয়ে গুলি করছে। কি সাহস? হারামিরা আমার মায়ের উপর অত্যাচার করিস। দেখ। দেখ, ওই যে হেলমেট দেখা যাচ্ছে। ইদ্রিস ক্ষিপ্ত হয়ে দাড়ালো ও রাইফেল চালানো শুরু করলো।

না। না, ইদ্রিস। বসে পড়ো। ধ্বপাস করে আমার উপরে পড়ে গেল ইদ্রিস। বুক থেকে গড়িয়ে পড়তেছে তাজা রক্ত। ইদ্রিস আমার কোলেই চলে গেল পরপারে। একটু মাথা উঁচিয়ে দেখি পাক বাহিনী রাইফেলের মাথায় হেলমেট উঁচিয়ে আমাদের বোঁকা বানিয়েছে।

অপারেশন শেষে ইদ্রিসকে ঘাড়ে করে নিয়ে এসে এই দুহাতে শোয়ায়ে দিলাম মাটির কবরে। এখন ইদ্রিস নেই কেউ সান্ত্বনা ও দেয়না। প্রিয়সি স্বপ্না ভালো থেকো। নিজেকে সামলে রেখো। হয়তো দেখা হবে নয়তো বা মিশে যাব ইদ্রিসের সাথে।

ইতি

তোমারই
আজগর

চিঠি

প্রিয়তমা,
আকাশটা গতকাল সারাদিন কেঁদেছিল। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়াও বেগ বাড়িয়ে দিয়েছিল তার কান্নার। পরশু রাত যখন ঘুমোতে যাব দেখি হুহু করে কান্নার শুরু। রাতের ঘুমের আবহ কান্নার অশ্রুতে ভেজা ছিল। পানি চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ে সুউচ্চ তরুগুলোর অমসৃণ দেহকে তৃপ্তকরে মাটিতে মিশে কাদার সৃষ্টি করেছিল। ছয়তলা, সাততলা বাড়ির দেয়ালগুলো শুষে নিচ্ছিল পানি। যখন তাদের তৃষিত উদরপূর্তি হয়েছে তখন ঢাল হয়ে বয়ে যেতে দিয়েছিল জলরাশিকে।

বাতায়ন, গ্রিল আর বারান্দায় শুকোনোর জন্য দেয়া পরিচ্ছদ ভিজে শিক্ত হয়েছিল। সেগুলো ব্যবহার উপযোগী হতে প্রয়োজন প্রভাকর এক দিন। ভাস্বর আকাশে উদিত হয়ে তার প্রভা ছড়ালে বৃষ্টিজলের কনিকাগুলো বেড়িয়ে যাবে পরিচ্ছদ থেকে। আকাশটি মেঘমুক্ত হওয়া আবশ্যক। তাহলে সেই পরিচ্ছদ যদি পরনে থাকে ছ্যাঁত ছ্যাঁত অনুভূত হবে না। স্বস্তিপূর্ণ অনুভূতি প্রকাশ হবে।

গতকাল সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ জলঝরা বন্ধ হয়ে যায়।
আথিতিয়তা গ্রহণ করেছিলাম বড়বাবুর। তার আবাসনও বড়। সেই আবাসনের পাঁচতলার উত্তরাংশজুড়ে যে কক্ষটি তাতে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেই আবাসনের কাছাকাছি অনেকগুলি উঁচু উঁচু গাছ। তবে হৃদ্যতা যেমন খাটো হয়ে গেছে কৃত্রিমতার কাছে। তেমনি কংক্রিটের দেয়ালের উচ্চতার কাছে হার মেনেছে উঁচু উঁচু গাছগুলো। উত্তরীয়া কক্ষের বারান্দায় দাঁড়ালে সব দৃষ্টিগোচর হয়।

কয়েকটি শাদা বক। ডানা ঝাপটিয়ে মেহগনি গাছের শীর্ষভাগে খুনসুটি করছে। কালো পানকৌড়ির ঝাক কোয়াক কোয়াক ডাকে মাতিয়ে তুলেছে গাছের উম্মুক্ত মেঝে। পুষ্ট মেহগনি ফলগুলো তাদের মেঝের সাজসজ্জা। ইলেক্ট্রিক তারের সারিগুলো বেশ নিচুদিকে।

অধরা,
কালো বা রঙিন নেকাবে তোমার সুদর্শিনী, সুশ্রী মুখটি ঢেকে রেখেছিলে। আমি কোনদিন যেমনটি পারিনি তা দেখে তৃপ্ত হতে। তেমনি আজকের এই সকালে লেখা আমার অব্যক্ত প্রেমাশক্ত পত্রখানিও তোমার হস্তগত হয়ে আমার হৃদাবেগের ব্যঞ্জনাময় কথাগুলো উম্মোচিত হয়ে তোমাকে রাগান্বিত বা ঈষৎ পুলকিত করবে না। পানকৌড়ির বাস এইসব গাছে। যদি তারা জলায় না নেমে ঢের পানির মধ্যে ডুব না দেয় তারা কী পাবে বলো তাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তু? আর তোমার মাঝে যদি আমি অবগাহন না করি, তোমাকে যদি দেখতে না পারি তাহলে আমিও গাছের মগডালে বসা কোনো পানকৌড়ি। পূর্ণিমারাতের জোসনায় স্নাত হওয়ার জন্য এক উম্মাদ যে আবদ্ধ কোনো দুর্গম পাহাড়ি এলাকার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। হাজার হাজারবার ফুটে থাকা ফুল যার গন্ধনেয়ার জন্য আসে না কোনো অলি।

নতুন চাঁদের হাসি,
এই, এটি সেই শহর। তোমার কত কাজ করার জন্য শহরের অলিগলি ছুটে বেরিয়েছি। তোমার দেখা পাওয়ার জন্য কঠিন বৃষ্টি, ঝাঁঝালো রোদ কিংবা কনকনে শীত উপেক্ষা করেছি অজস্রবার। বিপণীবিতান, ব্যাংক, কুরিয়ার, পশ্চিমপাড়া ঘুরেছি অষ্টপর। অতপর কৃষ্ণপক্ষ পেরিয়ে একফালি চাঁদ হয়ে যখন হাসলে তখন তুমি দূরান্তের কোনো একজনের আকাশের গায়ে হাসলে।

আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। না জানি কখন থামবে এই বৃষ্টি। বৃষ্টির থেকে আপন আমার কেউ নেই প্রিয়তমা।

ও হ্যাঁ, সর্বশেষ একটা কথা শোনো। আমি গতকাল দুপুরে ঝমঝম বৃষ্টিতে আমাদের শিরাজি ভবনের ছাদে এক পুষ্ট যুবকের সাথে একজনাকে ভিজতে দেখেছিলাম। সেটা কী তুমি ছিলে? কেননা, আমি কোনোদিন স্বপ্নেও তোমার মুখটি আবিষ্কার করতে পারিনি।

ইতি
উপেক্ষিত ও উবে যাওয়া প্রেমনিয়ে অপেক্ষমাণ
নিরব নকিব
প্যারা মেডিকেল, লক্ষ্ণীপুর, রাজশাহী।
১২.১০.২০১৮