সাইয়িদ রফিকুল হক এর সকল পোস্ট

সাইয়িদ রফিকুল হক সম্পর্কে

সাইয়িদ রফিকুল হক ( Syeed Rafiqul Haque) তিনি একজন সাহিত্যসেবী, গ্রন্থপ্রেমিক ও রাজনীতি-সচেতন মানুষ। বাংলাদেশ, বাংলাভাষা ও বাংলাসাহিত্য তাঁর কাছে সবসময় প্রিয়, এবং এই তিনটি তাঁর কাছে চিরদিন পবিত্র শব্দ। তিনি বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তি। তাঁর লেখালেখিতেও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার ছাপ সুস্পষ্ট। আর তিনি সবসময় ঘৃণা করেন রাজাকার, ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ীচক্রকে। ধর্মবিশ্বাসে তিনি ত্বরীকতপন্থী সুন্নীমুসলমান। আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি একজন পুরাপুরি আস্তিক। তিনি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। একজন খাঁটি বাঙালি ও বাংলাদেশী। সাহিত্যচর্চা: তিনি নামে-বেনামে ও ছদ্মনামে লেখালেখি করছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। মূলত তিনি কবি, লেখক ও ঔপন্যাসিক। তিনি স্কুলজীবন থেকে আপনমনে সাহিত্যচর্চা করছেন। তখন লেখাপ্রকাশের তেমন-একটা সুযোগ না থাকায় তিনি তাঁর লেখাসমূহ প্রকাশ করতে পারেননি। বর্তমানে ‘শব্দনীড় ব্লগ’সহ বিভিন্ন ব্লগে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁর লেখার মূল বিষয়: মানুষ, মানবতা আর দেশ-জাতি-সমকাল। আত্মপ্রচারবিমুখ এক কবি তিনি। স্কুলজীবন থেকে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করে অদ্যাবধি কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ইত্যাদি রচনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। পনেরো বছর বয়সে কবিতা লেখার মাধ্যমে তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। তিনি লিখেছেন অনেক। কিন্তু প্রকাশ করেছেন খুব কম। ইতঃপূর্বে কয়েকটি সাহিত্যপত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর লেখাসমূহ আধুনিক-ব্লগগুলোতে প্রকাশিত হচ্ছে। এজন্য তিনি ব্লগগুলোর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তিনি বাস্তববাদী লেখক। আর তাঁর লেখায় কোনো কৃত্রিমতা নাই। তাঁর প্রায় সমস্ত লেখাই দেশ ও জাতির জন্য নিবেদিত। তাঁর লেখার বিষয়: কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ইত্যাদি। তিনি ‘মানবজীবনের গল্প’ রচনায় যথেষ্ট পারদর্শী। এ পর্যন্ত তাঁর রচিত গল্পের সংখ্যা ৩২টি। আর উপন্যাসের সংখ্যা ১৮টি। ছড়াসাহিত্যেও তিনি সমভাবে পারদর্শী। শিক্ষা: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ নাই। তাঁর কাছে সার্টিফিকেট-সর্বস্ব সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কঠোর সাধনায় অর্জিত প্রকৃত জ্ঞানের মূল্য অনেক বেশি। তিনি নিজেকে সবসময় একজন স্বশিক্ষিত মনে করেন। তবে প্রচলিত প্রথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক উচ্চতর গবেষণাকর্মে নিয়োজিত। জন্মস্থান: বাংলাদেশ। তাঁর জীবনের লক্ষ্য: লেখালেখির মাধ্যমে আমৃত্যু দেশ, মানুষ আর মানবতার পক্ষে কাজ করা।

পৃথিবীতে ফুটবে শুধু ভালোবাসার ফুল

অদ্ভুত একটি কাব্যময় ফুল ফুটেছিলো আমার হাতে। আর কী সুন্দর সৌরভ ছিল তার! ফুলের সৌরভে আমোদিত হচ্ছিলো দশদিক। কত লোক দেখতে আসছিলো সেই ফুল। আর ফুলের সৌরভে ভরে উঠেছিলো আমার কাব্যমালঞ্চ।

অদ্ভুত সেই ফুলের সৌন্দর্যে হেসে উঠেছিলো আমার ভালোবাসার পৃথিবী। মধুময় ফুলের পবিত্র সুবাসে আরও পবিত্র হয়ে উঠেছিলো আমার অনেক সাধের বাগানখানি। আর সবার চোখের মণি হয়ে উঠেছিলো সেই ফুল! আমার মধুস্বপ্নের সেই মধুময় ফুল।

মানুষের ভালোবাসায় কাব্যকলি সুবাস বিলিয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিলো সবার হৃদয়মণিকোঠায়। এমন সুন্দর ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কেউ বলেছিলো: এটি নিশ্চিত পারিজাত। আবার কেউ বলেছিলো: এ যে স্বর্গীয় অপ্সরীসম পুষ্পকলি! স্বর্গীয় ফুলের তাইতে এতো স্বর্গীয় মহিমা! শুধু এক হিংসুক আড়ালে দাঁড়িয়ে সরোষে আর অপবিত্র চোখে চেয়ে ছিল আমার অনিন্দ্য সুন্দর ফুলের দিকে।

ফুলমণিটাকে কাব্যমালঞ্চে রেখে ঘুমিয়ে ছিলাম পরম নিশ্চিন্তে। আর কী মধুর স্বপ্ন দেখছিলাম রাতভরে। এমনতর আরও কত ফুল ফুটবে আমার কাব্যমালঞ্চে! আর বুকে বড় আশা জেগেছিলো স্বপ্নদেখা রাতগভীরে।

সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি: আমার কাব্যমালঞ্চ শূন্য। আর আমার অনেক সাধের সেই মোহনমধুর ফুলকলিটাকে গতরাতে ছিঁড়ে ফেলেছে এক নপুংসক! ভালোবাসার ফুল ছিঁড়ে সেই নপুংসক আমার বাগানে রোপণ করতে চায় হিংসাবীজের বিষবৃক্ষ! আমি একটানে উপড়ে ফেলেছি সেই বিষাক্ত-বিষবৃক্ষ। আর সেখানে আবার লাগিয়েছি ভালোবাসার ফুল।

আর পৃথিবীতে ফুটবে শুধু ভালোবাসার ফুল।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২১/০৭/২০১৭

তোমার মনটি কালো

তুমি কালো বলে তোমাকে ঘৃণা করছি না,
আমি দুঃখ পাচ্ছি তোমার মনটি কালো দেখে।
তুমি হতে পারতে সুগন্ধিময় কোনো কালোগোলাপ,
কিন্তু তুমি হয়েছো কালো কাল-কেউটে!
তোমাকে আমি কালো বলে অবজ্ঞা করছি না,
কিন্তু তোমার কালো-মনে বাসা বেধেছে কালব্যাধি!
তা-ই দেখে আমি এখন বড়ই বিমর্ষ,
বন্ধু, তোমার কালো-মনে কেন কালোব্যাধি?

আর তুমি তো বাইরে ভীষণ ফর্সা আর রাঙাপরী,
কিন্তু তোমার মনটি কেন এতো কালো?
তোমার ধবধবে-ফর্সা-রূপের আড়ালে কেন হাসে
অমাবস্যা-রাতের কালোজাদুর ডাইনী?
বাইরে তুমি ভীষণরকম সফেদশাদা,
আর ভিতরে জনমকালো বীভৎস-রূপের সমুদ্র!
বন্ধু, তোমাকেই বলছি:
হৃদয়টাকে কর তুমি আলোকিত-ফর্সা,
তোমার কালোর মাঝে হাসবে সফেদ-সুন্দর।
কালোভ্রমর ভালোবাসি, কালোচোখ ভালোবাসি,
কালোচুল ভালোবাসি, কালোগোলাপও ভালোবাসি,
কিন্তু কালো-মন কখনও ভালোবাসতে পারি না,
আর কালো-মন কেউ কখনও ভালোবাসে না।
বন্ধু, তোমার মনটি কেন এতো কালো?
আর কালোর মাঝে কবে হাসবে সফেদ-সুন্দর?

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
০৮/০৭/২০১৭

আমি তোমাকে যুবক বলি না

আমি তোমাকে যুবক বলি না
কারণ, তোমার মেরুদণ্ড সোজা নয়,
আমি তোমাকে যুবক বলি না
কারণ, তোমার বুকে সাহস নাই,
আমি তোমাকে যুবক বলি না
কারণ, তোমার মনে আত্মবিশ্বাস নাই।

আমি তোমাকে যুবক বলি না
কারণ, তুমি এখনও দেশবিরোধী-ধর্মান্ধ,
আর তুমি ভয়াবহ স্বার্থান্ধ আর কামান্ধ!
আমি তোমাকে যুবক বলি না
কারণ, তুমি দেশের দুর্দিন স্বচক্ষে দেখেও
যুবতীনারীর লোভে আজও মোহাচ্ছন্ন।
আমি তোমাকে যুবক মনে করি না
কারণ, তুমি এখনও রাজাকারদের দোসর,
আর তুমি এখনও আল-বদরদের দোসর,
আর তুমি এখনও আল-শামসদের দোসর,
আমি তোমাকে যুবক মনে করি না
আমি তোমাকে ঘৃণা করি।

আমি তোমাকে যুবক মনে করি না
কারণ, তুমি এখনও সাম্প্রদায়িকপশু,
আমি তোমাকে যুবক বলি না
কারণ, তোমার মনে দেশপ্রেম নাই,
আমি তোমাকে যুবক বলি না
কারণ, তুমি এখনও এই বাংলার চিরশত্রু
রাজাকারদের ঘৃণা করতে শেখোনি।
আমি তোমাকে যুবক বলি না
কারণ, তুমি দেশের শত্রুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছো,
আর হাসিমুখে তাদের গোলামি করেছো,
আমি তোমাকে যুবক বলি না
কারণ, তুমি বাংলাদেশের চিরশত্রু,
আর তুমি বাংলাদেশের কেউ না।
আমি তোমাকে কখনও যু্বক মনে করি না,
আর আমি তোমাকে চিরদিন ঘৃণা করি।

সাইয়িদ রফিকুল হক
পূর্বরাজাবাজার, ঢাকা,
বাংলাদেশ।
২১/০৬/২০১৭

হালছাড়া জীবননৌকা

মাতাল-নদে সাঁতার কেটে
খুঁজে পাই না কূল,
ভুলসাগরে ডুবে-ডুবে
খাচ্ছি বিষের হুল!
প্রেমসাগরে সাঁতার কেটে
হইছি ভীষণ ফতুর,
প্রেমিকা তাই বললো হেলায়
হও গে আরও চতুর।

ভেবেছিলাম সান্ত্বনারই
শরবতে তাই
ভিজবে আমার গলা,
এখন দেখি দুঃখনদীর
আগুনঝরা
পথটা ধরেই চলা।
মাতাল-নদে সাঁতার কেটে
পাই না খুঁজে চাতাল,
শপথ নিলাম এই জীবনে
আর হবো না মাতাল।

সাইয়িদ রফিকুল হক
পূর্বরাজাবাজার, ঢাকা,
বাংলাদেশ।
২২/০৬/২০১৭

সত্য এখন নির্বাসিত

সত্যকে তুমি ভালোবেসো না
সত্য এখন নির্বাসিত!
সত্য বললে তোমার পিঠে পড়বে চাবুক!
আর যদি ইচ্ছা করে কিংবা ভুলে
কিংবা তোমার শখের বশে
খুব ভালোবেসে একটুখানি বলো মিথ্যা
তাইলে তোমার নিশ্চিত পুরস্কার জুটবে!
আর তুমি পেতে পারো সরাসরি জাতীয় পুরস্কার,
আর তোমার জন্য একনিমিষে খুলে যেতে পারে
আন্তর্জাতিক পুরস্কারের দরজা সকল।

সত্য বলায় ইরানে হামলা করছে সৌদিআরব,
সত্য বলায় ইয়েমেনে হুতু-নিধনে ষড়যন্ত্র করছে
মধ্যপ্রাচ্যের তেলের টাকায় ধনী সৌদিআরব,
সত্য বলায় সিরিয়ায় বোমা-বারুদ-ক্ষেপণাস্ত্র ঢালছে
বিশ্বমুসলিমের হজ্জের টাকায় ধনী সৌদিআরব।
সত্য বললে বন্ধু তোমার বুকেও লাগতে পারে
একখানা মিসাইল কিংবা স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের গুলি!
অথবা, অনেক ক্ষেপণাস্ত্র তাক করা হতে পারে তোমার দিকে,
আর সত্য বললে যেকোনোসময় তোমার হতে পারে ফাঁসি।

সত্য বলে-বলে এখন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে—
আমার দেশের কত সাধারণ নাগরিক আর রোস্তম আলী,
সত্য বলে-বলে এখন খুব ক্লান্ত কত পরিশ্রমী-দিনমজুর,
সত্য বলে-বলে নিয়মিত মার খাচ্ছে কত চাষা-ভুষা,
সত্য বলায় দেশ থেকে বিতাড়িত আরও কত কবি-লেখক।
জগতে কেউ এখন সত্য শুনতে চায় না,
তবুও তুমি সত্য বলার স্পর্ধা দেখাচ্ছো!
তোমার সাহস তো কম নয় বাপু!
বুঝেছি, তোমার বুকে হচ্ছে এখন সত্যের চাষ,
তাই, চিরদিন সত্যের ফুল সেখানে ফুটবেই।
তুমি সত্য বলে যাও—মিথ্যার বিরুদ্ধে,
তুমি সত্য বলে যাও—শয়তানের বিরুদ্ধে,
তুমি সত্য বলে যাও—দুনিয়ার যতো ভণ্ডের বিরুদ্ধে।
সত্যের জ্যোতি একদিন যদি আমাদের পৃথিবীতে জাগে
তবে সেদিন পৃথিবীজুড়ে ফুটতেও পারে সত্যসুন্দরের ফুল,
তুমি হতাশ হয়ো না বন্ধু—আর জেগে ওঠো দীপ্ত-আশায়—
আর পৃথিবীর সকল জালিম খতম করার মতো
ঐতিহাসিক সাহসের সঙ্গে।
একদিন-না-একদিন ফিরে আসবে আমাদের মাঝে
সেই চিরকাঙ্ক্ষিত-সত্যসুন্দর—নির্বাসনের সকল জিঞ্জির ভেঙ্গে।

সত্য এখন নির্বাসিত—
তাই, বুঝেশুনে চলবে বন্ধু,
আর জানবে চারিদিকে সত্যের উপর আঘাত সবচেয়ে বেশি,
তবুও আমাদের সত্য বলতে হবে,
তবুও আমাদের সত্য মানতে হবে,
তবুও মানুষ হিসাবে চিরদিন আমাদের সত্য ভালোবাসতে হবে।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২৭/০৬/২০১৭

আজিজসাহেব ফাঁসির পরোয়ানা হাতে পেয়েছেন

আব্দুল আজিজসাহেব আজ ক্লান্তদেহে বাসায় ফিরলেন। তার মনটিও ভালো নাই। সেখানে নানারকম হতাশা আর দুশ্চিন্তা বাসা বেঁধেছে। এগুলো তাড়াবার মতো মনোবল তিনি যেন খুঁজে পাচ্ছেন না।

তিনি বেসরকারি চাকরি করেন। তার চাকরি এখনও আট-বছর আছে। তবুও তার মনে বিরাট দুর্ভাবনা আর বিশাল হতাশা। তার হতাশার কারণ নতুনকিছু নয়—প্রতিবছরের হতাশা পুনর্বৃদ্ধি মাত্র। আর এটির একমাত্র কারণ হলো: হঠাৎ-হঠাৎ মাত্রাতিরিক্ত বাসাভাড়াবৃদ্ধি। কিন্তু প্রতিবছর তার বেতন সে তুলনায় তেমন একটা বৃদ্ধি পায় না। তার দুশ্চিন্তাটা সেখানেই।

আজ কদিন যাবৎ তার কেবলই মনে হচ্ছে: তিনি যেন এই শহরে আর বসবাস করতে পারবেন না। জুয়ার আসরের মাতাল-জুয়াড়ীদের মতো ঢাকা-শহরের বাড়িওয়ালারা নিয়মিত বাসাভাড়াবৃদ্ধি করেই চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে তার বাড়িভাড়ার পরিমাণ একদিন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আর তার সামর্থ্যের বাইরে তা চলে যাবে নাতো? এমন কতকগুলো ভাবনা আজকাল তাকে ভীষণভাবে তাড়া করছে। তাই, তিনি আজও অফিসশেষে বাসায় ‍ফিরে মনমরা হয়ে বসে রইলেন। আজিজসাহেব এই বাড়িটাতে ভাড়াটিয়া হিসাবে আশ্রয় নিয়েছেন তিন-বছর হলো। প্রথমে তিনি বাসাভাড়া দিতেন তেরো-হাজার টাকা। আর এরই সঙ্গে সংযুক্ত থাকতো গ্যাস-বিদ্যু-পানি ইত্যাদি বিল। আরও আছে সার্ভিস-চার্জ। এরপর দুই-বছরে বাড়িভাড়াবৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে সতেরো হাজার টাকা। এ যেন মগের মুল্লুক! আর সবখানে যেন জীবন্তশয়তানের রাজত্ব! আর তাই, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেইসব আফগানি-কাবুলি সুদখোরদের মতো বাড়িওয়ালা নামক নতুনজাতের ভয়ানক সুদখোরগং বাসাভাড়াবৃদ্ধির জন্য প্রতিটি ভাড়াটিয়ার দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। এমনতর কষ্টে এই ঢাকা-শহরে আজিজসাহেবের মতো অনেকেই আজ দিশেহারা। তাদের মুখের সহজ-সরল সেই হাসি আজ হারিয়ে গেছে। আর সেখানে আজ ভর করেছে কৃত্রিম হাসি। সমাজে চলতে গেলে এখন দায়ঠেকে একটুআধটু হাসতে হয় আরকি!

আজিজসাহেব আজ ভগ্নমনে বাসায় ফিরে ভাবতে লাগলেন: তার বেতনের অর্ধেকের বেশি টাকা চলে যায় বাড়িওয়ালার পকেটে। আর বাকী টাকা দিয়ে তার পুরা-মাসের বাজারসদাই থেকে শুরু করে দুটি মেয়ের স্কুল-কলেজের খরচ চালাতে হয়। এই যখন অবস্থা, তখন নভেম্বর মাসের শেষদিকে বাড়িওয়ালার হুকুমনামা পেয়েছেন। বাড়িওয়ালা আগামীবছর বাড়িভাড়া আরও বৃদ্ধি করতে চায়। এমন একটা পরোয়ানা পেয়ে আজিজসাহেব সত্যি বড় বিচলিত হয়ে পড়েছেন। এ যেন তার কাছে ফাঁসির হুকুমনামা!

আজিজসাহেব ক’দিন পরে ভাবলেন: একবার বাড়িওয়ালার কাছে গেলে কেমন হয়! এরকম একটা চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। তবে এতে তিনি ভরসা পান না। কারণ, গতবছর তার স্ত্রী বাড়িওয়ালার স্ত্রীর কাছে অনেক অনুনয়বিননয় করেছিলেন বাসাভাড়াবৃদ্ধি না করার জন্য। কিন্তু বাড়িওয়ালা এতে কোনো কর্ণপাত করেনি। তিনি ভাবছেন: এবার হয়তো বললে কাজ হতেও পারে। তাই, তিনি নিজেই বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবতে লাগলেন। তার মনটা কিছুদিন হলো বিষিয়ে আছে। এই সমাজের নগ্নচেহারা দেখে তিনি ভীষণভাবে বিচলিত। আর রাষ্ট্রের নির্লিপ্তভাব দেখে তিনি ভয়ানকভাবে হতাশ। আর রাষ্ট্র যেন এইসব বাড়িওয়ালা-দস্যুর পৃষ্ঠপোষক! তাই, এদের বাড়াবাড়িটা সাধারণ জনগণের সহ্যের বাইরে চলে গেছে। মানুষ কত সহ্য করবে? মানুষ আর কত এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকবে? আর এই রাষ্ট্র অসহায় মানুষের এই দুর্দশাকবলিত চেহারা ও অবস্থা দেখেও আর কত নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকবে? তবে কি রাষ্ট্র আজ শয়তানের পক্ষে?

বাসার একচিলতে বারান্দায় বসে সন্ধ্যার পরে আজিজসাহেব এসবই ভাবছিলেন। তিনি কোনো হিসাব মেলাতে পারছিলেন না। দেশের সবখানে আজ ভীষণ গরমিল। আর সবখানে চিরচেনা সেইসব অর্থলোভীউলঙ্গশয়তানদের নগ্নদাপট! আর সবখানে যেন তাদেরই একচ্ছত্র-রাজত্ব। এখানে, আজ বিচার চেয়েও কোনো লাভ নাই। কে করবে বিচার? সর্ষের ভিতরেই যে ভূত!

সন্ধ্যার পরে আজিজসাহেব খুব মনমরা হয়ে বাসার একচিলতে বারান্দাটায় বসে ছিলেন। অন্ধকারের মুখোমুখি বসে তিনি জীবনের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত ছিলেন। আর ভাবছিলেন: কেন যে ঝোঁকের বশে সেই গ্রাম ছেড়ে এই শহরে চলে এসেছিলেন! এই শহর তো তার নয়। আর তার মতো সাধারণ মানুষের জন্য এই শহর তৈরি করাও হয়নি। এখানে থাকবে বড়-বড় চোর-টাউট-বাটপাড় আর নষ্ট-রাজনীতির ভণ্ডগুলো। আর এখানে যদি ভালোমানুষগুলো থাকতে চায়—তবে তাদের মুখবুজে সবকিছু সহ্য করে একেবারে জড়পদার্থ হয়ে থাকতে হবে।

আজিজসাহেব ভাবতে-ভাবতে একেবারে তন্ময় হয়ে পড়েছিলেন। এমন সময় তার স্ত্রী রোখসানা তার ধ্যানভঙ্গ করে বললেন, “তোমার চা নাও।” কথাটা বলে তিনি ভিতরে চলে যাচ্ছিলেন। আবার কী মনে করে একটু থেমে বললেন, “চা-টা শেষ করে তুমি আজ বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা কর। আর বাড়িভাড়ার বিষয়টা এখনই ফয়সালা করে ফেলা দরকার। আর ক’দিন পরেই তো তোমার ছোট মেয়েটির বার্ষিক পরীক্ষা। এইসময় বাসা নিয়ে সমস্যা হলে মেয়েদের পড়ালেখায় ক্ষতি হবে। তারচে তুমি একবার বাড়িওয়ালা অ্যাডভোকেট-সাহেবের কাছে যাও। তিনি এবার হয়তো একটু নরম হতেও পারেন।”
স্ত্রীর কথা শুনে আজিজসাহেব কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। আর দেখলেন: তার স্ত্রী এর একটা জবাব না-শুনে যাবে না। তাই, তিনি সবদিক ভেবেচিন্তে শুধু বললেন, “আচ্ছা। একটু পরেই আমি যাচ্ছি।”

আজিজসাহেব আবার ভাবতে লাগলেন: এই দেশের মানুষগুলো এতোটা বেপরোয়া আর জালিম হয়ে উঠছে কেন? আর তাদের অর্থমোহ একেবারে পাগল করে তুলছে! অথচ, কত আশা নিয়ে এই দেশের ত্রিশলক্ষ মানুষ অকাতরে জীবন দিয়ে দেশস্বাধীন করেছিলো। আর সেই দেশের একজন বাড়িওয়ালা অ্যাডভোকেট আব্দুর রশিদ আজ ডাকাতের মতো সাধারণ ভাড়াটিয়াদের উপর চড়াও হচ্ছে। আর তাদের দাবি মতো প্রতিবছর বাসাভাড়াবৃদ্ধি করতে না পারলে ভাড়াটিয়াদের বাসাছাড়ার নোটিশ হাতে নিয়ে চুপ হয়ে যেতে হয়! এই দেশে আজ এসব দেখার কেউ নাই। কী আজব দেশ এটা। এখানে, মানুষের আজ কোনো মূল্য নাই। সবকিছু আজ অর্থের দ্বারা পরিমাপ করা হচ্ছে। আর এখানে, আসলে মানুষের কোনো ধর্ম নাই। সব ভণ্ড আর জোচ্চোর। যৌবনকালে দুনিয়ার সমস্ত অকাম-কুকাম করে বৃদ্ধবয়সে মুখে চার-আঙ্গুল-পরিমাণ দাড়ি রেখে কিংবা এই দাড়িসমেত একবার হজ্জ করতে পারলে তারচেয়ে বড় ধার্মিক আর কেউ হবে না। এখানকার মানুষগুলো আজ ভয়ানক ব্যাধিগ্রস্ত। এদের কোনো মানবতা নাই। এদের কোনো মনুষ্যত্ব নাই। এদের জীবনে শুধু অধর্ম। কিন্তু এদেরই মুখে-মুখে আছে লোকদেখানো যত ধর্মের বুলি। এই দেশের মতো ভণ্ড আর কোন দেশে আছে? আর কোন দেশে আছে ধর্মের ভেকধারী এমন অধার্মিক?

বুকের ভিতরে একসাগর দুঃখ নিয়ে আজিজসাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তিনি দরজা খুলে বাইরে বের হলেন। তার স্ত্রী রোখসানা দরজা আটকিয়ে মনে-মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন: এবার যেন বাড়িওয়ালা তাদের কথাটা শোনে!

চারতলা থেকে দোতলায় নামতে আজিজসাহেবের বেশি সময় লাগলো না। মনে ইতস্ততঃভাব থাকা সত্ত্বেও আজিজসাহেব বাড়িওয়ালার বাসার কলিংবেল চাপলেন।
দরজা খুলে দিলো বাসার কাজের মেয়েটি। আজিজসাহেব বাড়িওয়ালার নাম করতেই মেয়েটি তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে চলে গেল।
একটু পরে আজিজসাহেব দেখলেন, বাড়িওয়ালাসাহেব আসছেন। তাকে দেখে আজিজসাহেব মনভরে সালাম দিলেন।
বাড়িওয়ালা রশিদসাহেব কয়েকগাল হেসে আজিজসাহেবকে ভিতরে বসতে বললেন।
বসার পরপরই রশিদসাহেব বেশ ব্যস্ততা দেখিয়ে বললো, “যা বলার তাড়াতাড়ি বলেন আজিজসাহেব। একটু পরেই আমি মসজিদে নামাজ পড়তে যাবো। আমি আবার জামাতে নামাজ আদায় না করে থাকতে পারি না।”
এতে আজিজসাহেব ভিতরে-ভিতরে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লেন। তবুও তার স্ত্রীর করুণ মুখের কথা মনে হতেই তিনি বলে ফেললেন, “বলছিলাম কি ভাইসাহেব, এবছর বাড়িভাড়াটা না বাড়ালে আমার বড় উপকার হয়। আপনি যদি একটু মেহেরবানী করে আগের ভাড়াটা বহাল রাখেন তাহলে আমার বড় উপকার হবে।”
এতে রশিদসাহেব বললো, “দেখেন, এখন নামাজের সময় হয়ে আসছে। অন্য সময় হলে আমি আপনার কথার ব্যাখ্যা দিতে পারতাম। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে: নতুন-বছরে আপনাকে দুই-হাজার টাকা বেশি ভাড়া দিতে হবে। কথাটা শেষ করে রশিদসাহেব উঠে দাঁড়ালো আর বললো: আমার মসজিদে যাওয়ার সময় হয়ে এলো। অন্য একদিন আসবেন, আপনাকে সিলেটের তাজা-চা খাওয়াবো। আজ আর আপনাকে সময় দিতে পারছি না।” এরপর লোকটি মাথার টুপি ঠিকঠাক করতে লাগলো।

বাড়িওয়ালার কথা শুনে আজিজসাহেব বিমর্ষচিত্তে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। তার মুখে যেন কোনো ভাষা নাই। তিনি যেন এইমাত্র বোবা হয়ে গেলেন। তবুও তিনি শক্তিসঞ্চয় করে উঠে দাঁড়ালেন। আর ভাবলেন: তিনি এতোক্ষণ একটা শূয়রের বাচ্চার সঙ্গে কথা বলেছেন।

আজিজসাহেব আর কালবিলম্ব না করে দ্রুত বাড়িওয়ালার বাসা থেকে বেরিয়ে এলেন। তার মনে হলো: তিনি যেন বড় ধরনের অপরাধী। আর এই মাত্র তার ফাঁসির হুকুম হয়েছে।
আজিজসাহেব খুব ধীরপদে সিঁড়ি-ভেঙে উপরে উঠতে লাগলেন। এইসময় দুঃখভারাক্রান্ত আজিজসাহেবকে দেখে মনে হলো: সত্যি-সত্যি তিনি যেন এই মাত্র তার ফাঁসির পরোয়ানা হাতে পেয়েছেন।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১০/১১/২০১৬

আগে ছিল ঈদ আর এখন ঈদের নামে শুধুই ফ্যাশন কিংবা অভিনয়

আগে ঈদ ছিল। আর মানুষ ঈদ করতো। সকল মানুষ মিলেমিশে মনের আনন্দে ঈদে শামিল হতো।
আগের ঈদে এখনকার মতো মার-মার, কাট-কাট, ধর-মার-খাও ইত্যাদি নেতিবাচক কোনো ভাব ছিল না। তখন মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঈদপালন করতো। আর তখনও ঈদের আয়োজন ছিল—আর ছিল যার-যার সামর্থ্যের মধ্যে আকর্ষণীয় সাজসজ্জা। কিন্তু সেখানে কোনোপ্রকার বিলাসিতা, ভণ্ডামি, লোকদেখানো অতিরঞ্জিত আয়োজন কিংবা লোকদেখানো চাকচিক্যময় সাজসজ্জা ছিল না। তখনকার ঈদে ছিল শুধু আন্তরিকতা আর মানবিকতা।

আর এখনকার ঈদে মানুষের লোকদেখানো জৌলুস বেড়ে গেছে। নিজেকে লোকের কাছে বড় কিংবা বাহাদুর কিংবা অভিজাত প্রমাণ করার জন্য মানুষ এখন ঈদের সাজসজ্জায় নিমজ্জিত হচ্ছে। আমাদের দেশের ধনিকশ্রেণীটি এখন সম্পূর্ণরূপে লোকদেখানো-আভিজাত্যপূর্ণ ঈদআয়োজনে ব্যস্ত। এদের কাছে এখন ঈদ মানে—সে কতটা ধনী তা সমাজের সবার কাছে নগ্নভাবে প্রদর্শন করা! আর তাদের এই নগ্নপ্রদর্শনীতে রয়েছে—দামি-দামি পোশাকআশাক, দামি ও লোভনীয় খাবার, আর কতরকমের ফ্যাশন! এরা একজোড়া জুতা কিনছে আট থেকে বারো হাজার টাকা দামের। আর এদের একজোড়া স্যান্ডেলের দাম তিন থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত। কিংবা এরচেয়েও বেশি হতে পারে।
আবার এই অমানুষের দল ঈদের কেনাকাটা করার জন্য বিদেশেও যাচ্ছে! কেউ-কেউ ইউরোপে পর্যন্ত পাড়ি জমাচ্ছে! অনেক অমানুষ নিদেনপক্ষে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ইত্যাদি স্থানে যাচ্ছে—আর দেশের টাকাপয়সা অকাতরে ঢেলে দিচ্ছে! এর নাম ঈদ নয়—এর নাম ভণ্ডামি আর শয়তানী। এখন দেশের একটি ধনিকশ্রেণী বিলাসিতার সাগরে হাবুডুবু খেয়ে নিজেদের সবচেয়ে বড় ভাবছে—আর যা-খুশি তা-ই করছে। এরা নিজেদের ব্যতীত অন্য-কাউকে আজ আর মানুষ ভাবছে না। দেশের এই অমানুষ ও ধনিকশ্রেণীটির হাতে এখন এসে গেছে অগাধ কালোটাকা—এগুলো হারামটাকা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের টাকা, চাঁদাবাজির টাকা, ধোঁকাবাজির টাকা আর কালোবাজারির টাকা। এই টাকাই এখন এদের পশুতে পরিণত করেছে।

টাকালোভী-সম্পদশালী-সম্পদলুটপাটকারী ও নষ্টচরিত্রের এই ধনিকশ্রেণীটি এখন বিদেশে গিয়ে ঈদ করছে। আসলে, এটি ঈদ নয়—এটি হলো তাদের ঈদের নামে ভণ্ডামি আর ফুর্তি! এরা সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপের অনেক দেশের হোটেলে সময় কাটাচ্ছে—আর সেখানে মদ ও মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করছে। ঈদ এখন এদের কাছে ফ্যাশন মাত্র। আর এই অমানুষের দলের কাছে দেশের সাধারণ ও গরিব মানুষের স্থান কোথায়?

আগের মানুষের চাহিদাও ছিল অল্প। তারা স্বল্প আয়ে, স্বল্প বসনে, অল্প ব্যয়ে, অল্প সুখে মানুষ ছিল বেশি পরিমাণে সুখী। তখনকার মানুষ ঈদের নতুন পোশাকআশাক কিংবা জামাকাপড় না পেলেও কোনোরকম মনখারাপ করতো না। তারা নিজের পুরাতন পোশাকটি বা জামাটি ধুয়েমুছে সাফ করে রেখে দিতো ঈদের দিনে পরার জন্য। আর এখন মানুষ ঈদের জন্য নতুন-নতুন একটার-পর-একটা জামাকাপড় কিনেও সুখী নয়—সুখী হয় না। তাদের আরও চাই। অমুকের মতো আর তমুকের মতো চাই! এদের আত্মা আজ সম্পূর্ণ কলুষিত। আর এরা এখন মানুষ কিনা সন্দেহ!

আগে ধনীমানুষেরাই শুধু ঈদের জন্য নতুন জামাকাপড় ক্রয় করতো। এরসঙ্গে কিছুসংখ্যক চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তশ্রেণীর মানুষও তাদের সাধ্যমতো স্বল্পমূল্যের পোশাকপরিচ্ছদ কেনার আয়োজন করতো। আর এখন প্রায় সকলেই ঈদে নতুন-নতুন পোশাকআশাক কিনছে! সবখানে এখন নতুন পোশাকের ছড়াছড়ি। কিন্তু ঈদ কোথায়?
এখন মানুষজন নতুন-নতুন পোশাকআশাক পরে ঈদের দিনটার বেশিরভাগ সময় নিজেদের বাসায় বা বাড়িতে বসে থাকে। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নাই! কিন্তু কেন? কারণ, আত্মীয়তার বন্ধন এখন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। দেশের একটি অমানুষশ্রেণী এখন টাকার গুনে আত্মীয়তা বজায় রাখছে। এদের বাড়িতে ঈদের দিনে এখন কে যাবে?

এখনকার ঈদে শুধু চোখধাঁধানো আয়োজন আছে, নানারকম জৌলুস আছে, আর বর্ণাঢ্য প্রস্তুতি আছে। কিন্তু কোথাও ঈদ নাই! মানুষের মধ্যে আগের মতো আন্তরিকতা নাই। কৃত্রিমতায় ভরে গেছে মানুষের মন। সেখানে এখন মানুষের জন্য ভালোবাসার ফুল ফোটে না—সেখানে আছে বিষাক্ত-হুল আর সেখানে আছে জীবনবিধ্বংসী ধুতুরাফুল!

ঈদ হলো আনন্দের বিষয়। আর আনন্দ কখনও একা-একা কিংবা কাউকে বঞ্চিত করে করা যায় না। সবাইকে নিয়েই আনন্দ হয়—আর সবাইকে নিয়েই আনন্দ করতে হয়। কিন্তু এখন শুধু নিজে খাওয়া-পরার নামই অনেকের কাছে সর্বাপেক্ষা সুখ! এখানে, কে বাঁচলো আর কে মরলো তা কেউ দেখছে না। শুধু নিজের ভবিষ্যতের সুখসন্ধানে অমানুষগুলো আজ হন্যে হয়ে ছুটছে আর ঘুরছে। এরা এখন ক্ষুধার্ত-শ্বাপদের মতো হিংস্র! এদের মনে কবে মনুষ্যত্ব জাগবে আর মানবতার ফুল ফুটবে?

দিন-দিন মানুষের আন্তরিকতা কমে যাচ্ছে। এখন মানুষ ঈদের দিনেও কারও বাড়ি যেতে ইতস্ততবোধ করছে। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ফোন না করে যাওয়া যায় না। কেউ যদি হুট করে কারও বাড়ি ছুটে যায় এতে অনেকে রেগে যান। কেউ-কেউ বাইরে তা প্রকাশও করে ফেলে। আবার কেউ-কেউ এটাকে ঘুরিয়েফিরিয়ে প্রকাশ করে থাকে। ধনিকশ্রেণীর আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ঢুকতে এখন কারও-কারও গরিব-স্বজনকে অনেক কষ্ট করতে হয়। এখন তাই, ধনীতে-ধনীতে ভারি মিল। আর তাদের ঈদের সমাজও আলাদা। সেখানে গরিবের জন্য একটুকরো আসন হয়তো আছে কিন্তু তাতে কোনোপ্রকার আন্তরিকতা নাই। অর্থাৎ, বসলে বসো—আর না বসলে সোজা চলে যাও। গরিবজন না এলেই এখনকার ধনিকশ্রেণী খুব আনন্দলাভ করে থাকে। সেখানে ঈদ এখন সত্যিকারের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। আর তাদের প্রতিযোগিতা: কে কার তেলেমাথায় কত বেশি তেল দিতে পারে! ঈদে এখন কে কত টাকাপয়সা খরচ করতে পারে তারই যেন বিরাট প্রতিযোগিতা চলছে। ঈদের নামে এরা অতীব দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করে যাচ্ছে। আসলে, এরা ঈদের আনন্দ ভোগ করতে জানে না। এরা আজকাল শক্তমজবুত অট্টালিকায় বসবাস করতে-করতে এদের অন্তরটাকেও কংক্রিটের দেওয়ালের মতো খুব শক্ত করে ফেলেছে। সেখানে আজ আর গরিবের জন্য বরফ গলে না। এদের বরফ এখন ডিপফ্রিজের মতো জমাটবদ্ধ হয়ে থাকে। এই ধনিকশ্রেণীর ঈদ মানে এখন নিজেদের সীমাহীন ভোগ-বিলাসিতা আর ফুর্তি! মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ থাকলে সেখানে মনের আনন্দে যেকোনো উৎসবপালনের চেষ্টা কিংবা ঈদের খুশি-আনন্দ-উপভোগের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ বৃথা। এখন মানুষ যন্ত্রের মতো একদিন অনুষ্ঠানপালন করছে মাত্র—কিন্তু খুশির ঈদ অনুপস্থিত।
ঈদ নিয়ে আজকালকার একশ্রেণীর অমানুষের ভণ্ডামি লিখে শেষ করা যাবে না। তবুও এরই মধ্যে নিম্নমধ্যবিত্তশ্রেণী ও গরিবমানুষগুলো নিজেদের সামর্থ্য-অনুসারে আজও হাসিখুশিভাবে ঈদপালন করছে। এদের কাছে আজও ঈদ আছে। এরা অল্পে তুষ্টপ্রাণ। আর এদের আত্মীয়তার বন্ধন আজও শিথিল হয়ে যায়নি।

এখনকার সময় ঈদের দিন কেউ-একজন গরিবের বাড়িতে গেলে হয় সমাদৃত। আর ধনীর বাড়িতে গেলে হয় উপেক্ষিত! গরিবের যা-কিছু আসে তা-ই নিয়ে সে হাসিমুখে মেহমানদারি করে। আর গরিব কেউ-একজন যদি ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কিংবা ভুলক্রমে কোনো ধনীর বাড়িতে গিয়ে তার ড্রইংরুমে বসে—তাহলে, ধনীপরিবারের লোকজন আগত-মেহমানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরিমাপ করে। তারা আগত গরিব-মেহমানের প্রথমে জুতা-স্যান্ডেল দেখে, তারপর শকুনের চোখে তার গায়ের পাঞ্জাবি-পায়জামা বা শার্ট-প্যান্ট দেখে! আর দেখে-দেখে ভাবে—এগুলো কত দামের! দামপরিমাপ করা হলে অনেকেই হাসে। তারপর তাকে একজন সামান্য মানুষ বলে বিবেচনা করে থাকে। আর তার সঙ্গে তারা খুব সামান্য ভদ্র ব্যবহারই করে থাকে। আর তার সঙ্গে মেহমানদারি? সেটিও করা হয় ধনসম্পদের বিচারে। কিন্তু মূর্খধনীগুলো কখনও গরিবের স্বল্পদামি পোশাকের আড়ালে তার ভিতরের মহামূল্যবান মনুষ্যত্বের নাগাল পায় না। এইসব অর্থলুটপাটকারী ও অহংকারী ধনীর চেয়ে একজন গরিব ও সাধারণ চরিত্রবান মানুষ এই পৃথিবীতে অনেক দামি। কিন্তু মূর্খধনীগুলো তা কখনও উপলব্ধি করতেও পারে না। এদের সঙ্গে সাধারণ ও গরিব মানুষগুলো কীভাবে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করবে? আর এদের সঙ্গে কে মিশবে? এর জবাব কি কারও কাছে আছে?

ধনী লোকগুলো এখন ছোটলোকে পরিণত হচ্ছে। আর দিনের-পর-দিন এদের আত্মা দূষিত, কলুষিত আর সংকুচিত হচ্ছে। আর তাদের অন্তর থেকে চিরতরে বেরিয়ে যাচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় ধনসম্পদ—মনুষ্যত্ব। তবুও আজ এই পশুশ্রেণীটির সেদিকে কোনো ভ্রক্ষেপ নাই। তাদের সংকীর্ণচিত্তে সাধারণ মানুষের কোনো জায়গা নাই—আর সেখানকার দরজাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গরিবের জন্য। এরা শুধু তেলেমাথায় তেল ঢালতে ওস্তাদ। আর দেখে তার মতো কোন ধনীর কয়খানা গাড়ি আছে! এদের কাছে আজ মানুষপরিমাপের একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে—ধনসম্পদ, টাকাপয়সা, গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, জায়গাজমি আর সোনাচান্দি। এরা এভাবেই আজ সম্পূর্ণ নীচপ্রকৃতির ও ছোটলোকে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু এদের কবে বোধোদয় হবে?

জীবনে অনেকবার ঈদের দিনে বড়মুখ করে ধনীর বাড়িতে গিয়ে অপদস্থ হয়েছি। তবুও গিয়েছি! যেতে ইচ্ছে করেছে। নিজের আত্মীয় হয় যে! রক্তের টান সহজে কি এড়ানো যায়? বারবার অপদস্থ হওয়ার পর একসময় বিবেক জাগ্রত হয়েছে। তারপর আর যাইনি।

সকলে মিলেমিশে হাসিমুখে কোলাকুলি করে পবিত্র ঈদউদযাপন করতে হবে। এখানে, কৃত্রিম ভেদাভেদসৃষ্টি করলে ঈদ হবে কীভাবে? ঈদ মানে তো আনন্দ। আর হিংসার মধ্যে তুমি আনন্দ কোথায় খুঁজে পাবে? তাই, মনের মধ্যে হিংসার বীজরোপণ করে তুমি মহান আল্লাহর সৃষ্টিজগতে ঈদবিনষ্টকারী হয়ো না। আর পবিত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা স্মরণ করো। তিনি কীভাবে ঈদ করেছেন? তিনি এতবড় মানুষ ছিলেন—তবুও তাঁর মনে কোনো হিংসা ছিল না।
ঈদের পবিত্র আনন্দ সকলে মিলেমিশে উপভোগ করতে হবে। আর সবসময় আমাদের মনে রাখতে হবে: ঈদ কোনো ফ্যাশন কিংবা অভিনয় নয়। আর ঈদের একটা দিন শুধু নিজের ধনসম্পদ জাহির করে অভিনয় করলে চলবে না। ঈদের দিন সবার কথা ভাবতে হবে। আমরা সবাই মানুষ। পবিত্র ঈদের আনন্দ হোক জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য।

ঈদমোবারক।

সাইয়িদ রফিকুল হক
পূর্বরাজাবাজার, ঢাকা,
বাংলাদেশ।
২৪/০৬/২০১৭

তিনি ভদ্রলোক

ন্যাংটা সকাল হেসে বললো
এসো, কথা বলি মন খুলে!
আর ন্যাংটা হই সংগোপনে
কিংবা প্রকাশ্যে গর্বসহকারে।
ন্যাংটা সকাল বড়মুখ করে
বললো আবার সহাস্যে—
আর কী আছে দেখার?
প্রায় সবাই এখন বসতে চায়
খুব আমোদে আমার বুকে।
এখন সকাল ন্যাংটা, বিকাল ন্যাংটা
আরও ন্যাংটা হলো গভীর রাত!
ন্যাংটার ভিড়ে খুব শক্ত করে
ধরে রাখি নিজের মনুষ্যত্ব
আর বিবেকের পোশাকআশাক।

জনসমুদ্রে দেখি ন্যাংটার বিশাল জোয়ার!
আরও কত ন্যাংটা মিছিল করছে আনন্দে,
আরও কত বুদ্ধিমান আফসোস করছে
এখনও ন্যাংটা হতে না পেরে।
ন্যাংটা সকালে ভিড় জমেছে খুব—
আর চারিদিকে পাচ্ছি বিবেক-পোড়ার গন্ধ,
আর দেখছি, মগজধোলাইয়ের মহোৎসব,
আর বুদ্ধিমানরা সব ন্যাংটা হচ্ছে দেদারসে!
এই ভিড়ে দেখলাম একজন খুব সাহস করে
জনসমুদ্র থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে,
বুঝলাম, যুগের হাওয়ায় তার বুদ্ধিসুদ্ধি খুব কম!
আর তিনি খুব অসহায় এক ভদ্রলোক।

সাইয়িদ রফিকুল হক
পূর্বরাজাবাজার, ঢাকা,
বাংলাদেশ।
২২/০৬/২০১৭

কবিতার ফুল ফুটেছে আষাঢ়ে

আষাঢ়ে ভেসে গেছে সবকিছু—
পুরাতন পাপ-তাপ আর নাই অবশিষ্ট,
মাঠ-ঘাট ছাপিয়ে পানি জমেছে উঠানে,
ভারি সুন্দর কবিতার ফুল ফুটেছে আষাঢ়ে!

বিশ্রী ময়লায় ভরে ছিল চারপাশটা
দাবদাহে মেজাজ হয়েছিলো খুব খিটখিটে
আর তাই মেজাজটা বিগড়ে
তাপমাত্রা উঠেছিলো একঠেলায়
একশ’ ত্রিশ ডিগ্রী সেলসিয়াস!
সবকিছু এখন ঠাণ্ডা,
আর চারপাশটা কী নীরব!
সবকিছু দেখতে লাগছে খুব ভালো,
জরা-জীর্ণ ধুয়ে-মুছে একেবারে সাফ!
আষাঢ়ের আগমনে শুভ্রসুন্দর
কবিতার ফুল ফুটেছে আজ বাংলার উঠানে!

কদমফুলটার হাসি দেখতে পাচ্ছি—
আজ সকালে কী সুন্দর স্নান-শেষে
অবিরত হাসছে আমাদের বাড়ির একপাশে।
হতাশা-গ্লানি-ক্রোধ ধুয়ে-মুছে
আমাদের মনটাকে শুভ্রসুন্দর করেছে আষাঢ়,
আজ সকাল থেকে অবিরাম গতিতে
আকাশ থেকে ঝরছে জলমুক্তাধারা!
এসো বন্ধু এসো হাসিমুখে—
দেখে যাও একটুখানি ভালোবেসে
সারাবাংলায় শুরু হয়েছে খুশির কাব্যপাঠ!
এই বাংলায় কবিতার ফুল ফুটেছে আষাঢ়ে।

সাইয়িদ রফিকুল হক
পূর্বরাজাবাজার, ঢাকা,
বাংলাদেশ।
১৮/০৬/২০১৭

তোমার হাসি দেখবো বলে

চাতকপাখির মতো কী এক আশায় বসে থাকি
দিনান্তে দেখবো তোমার মুখের হাসি,
সারাটি দিন কেটে যায় অপেক্ষার প্রহর গুনে
কখন বলবো তোমায় একটু ভালোবাসি!
তোমার হাতের একটু ছোঁয়া পেতাম যদি
একনিমিষে হয়ে যেতাম আমি ধন্য,
একটুখানি ভালোবাসা জাগবে কি এই দুনিয়ায়
তোমার মনে শুধু এই আমার জন্য?

তোমার মুখের মধুর হাসি দেখতে পেলে
মেঘ জমবে না আমার মনের আকাশে,
কদমফুলের মতো তোমার মনোলোভা হাসি
ভেসে আসে ঘ্রাণ যেন তাই বাতাসে!
দিনটি আমার কেটে যায় কঠিন-সংগ্রামে
তোমার হাসি দেখবো-দেখবো করে,
কত যে আশায় বুক বেঁধে বসে থাকি
তবু যে মেঘ জমে মনের আকাশ-ভরে!

আকাশের তারার সাথে ভাব জমালে এতোদিনে
একটি তারা দেখা করতো আমার সঙ্গে,
তুমি এমনই অধরা হলে আমার কাছে
তবু তো আমি দেবো না রণে ভঙ্গে!
তোমার মুখের মধুর হাসি দেখবো বলে
বসে আছি আশা নিয়ে চাতকপাখি হয়ে,
এবার বন্ধু তুমিই দাও না বলে হাসিমুখে
কবে পাবো তোমায় আরও দুঃখ সয়ে!

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।

ডিজিটাল-ডিজিটাল

ডিজিটাল-ডিজিটাল
নয় কোনো টালমাটাল!
আজকে দেশ উন্নত,
বাঙালির মাথা সমুন্নত।

ডিজিটাল-নাম শুনে
ভয় পায় যারা,
বলো তো এবার কোথায়
পালাবে তারা?
এদেশের মানুষ
চাইছে ভাগ্যের পরিবর্তন,
বিত্তবান-হৃদয়ে
দূর হবে তাই অধঃপতন।

null

ডিজিটাল-ডিজিটাল
উন্নয়ন হচ্ছে জোরসে
শুনে তুমি হয়ো না মাতাল!
এদেশের উন্নয়নে
তুমি যদি হতে চাও বন্ধু,
সবখানে তবে
বিরোধিতা কোরোনা শুধু।
আমাদের এই দেশ
জাগছে—জাগবে আরও,
বাঙালি ভয় পায় না
ভ্রূকুটি দেখে কারও।

ডিজিটাল-ডিজিটাল
নয় কোনো টালমাটাল!
আজ জাতির উন্নয়নে
মহাসুদিন-মহাকাল।

সাইয়িদ রফিকুল হক
পূর্বরাজাবাজার, ঢাকা,
বাংলাদেশ।
০৮/০৬/২০১৭

বাংলাদেশের উন্নয়নে

বাংলাদেশের উন্নয়নে
চোখ দুটি তোর যাচ্ছে পুড়ে,
তুই যে ভীষণ হিংসুটে রে
আদিমকালের কুঁড়ে।
দেশের জন্য তুমি কিছু
পারছো নাতো করতে,
যারা দেশের করছে কিছু
চাইছো তাদের টেনে ধরতে!

বাংলাদেশের উন্নয়নে
বুকটা তোমার ফাটে,
তাই বদনাম যে করছো তুমি
বিশ্বসভার হাটে।
তোমার মনে ব্যাধি অনেক
চাইছো দেশের ক্ষতি,
মানুষ হতে চাইলে তুমি
ঠিক করগে মতিগতি।
বিশ্বসভায় বাংলাদেশের
বাড়বে আরও প্রভাব,
হিংসা করে লাভ কী বলো?
ঠিক করগে স্বভাব।
দেশের খেয়ে দেশের পরে
করছে যারা মামদোবাজি,
এই দেশেতে বসত করে
তারা হলো বিশ্বপাজী।

বাংলাদেশের উন্নয়নে
বিশ্ব অবাক হয়!
তবে কেন দেশের মানুষ
তোমার এতো ভয়?
তুমি বুঝি মীরজাফরদের
হবে কোনো স্বজন,
তাইতো দেখি তোমার বুকে
বাজে ব্যথার ভজন।
বাংলা-মায়ের রক্ত যাদের
আছে সোনার দেহে,
বাংলাদেশের উন্নয়নে
হাসবে তারা স্নেহে।

সাইয়িদ রফিকুল হক
পূর্বরাজাবাজার, ঢাকা,
বাংলাদেশ।
০৮/০৬/২০১৭

দোজখের দরজাও খোলা আছে

মদ খাচ্ছো খাও
মাতাল হচ্ছো হও
আবোলতাবোল বকছো
যাও বকে যাও।

ভাবনা কী আর তোমার?
সুখ চারপাশে,
আরও কত ফুর্তি!
সুখের জোয়ার
বইছে তোমার হাতের কাছে,
তবুও জেনো
দোজখের দরজাও খোলা আছে।

মদ খাচ্ছো
মাতাল হচ্ছো
সবই তোমার ইচ্ছা,
কিন্তু এ যে ভীষণ বাজে কিচ্ছা।
মদের বোতল
খুলে দিচ্ছে
তোমার ফুর্তির স্বর্গদ্বার,
চেহারাটা রোশনাই হচ্ছে আর!
একটা কথা তবুও কি
তোমার মনে দেয় না দোলা?
দোজখের দরজাও খোলা!

মদে ভেসে যাচ্ছো
আর আনন্দে মেতে আছো
চারিপাশে এখন তোমার
কত মানুষ!
ভণ্ডগুলো তোমার টাকায়
রোজ-রোজ উড়ায় ফানুস!
তোমার সুখের দরজা
খোলা এখন চারপাশে,
আর জানো তো
দোজখের দরজাও খোলা আছে।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
০৩/০৫/২০১৭

এরই নাম বুঝি প্রেম

আশফাক ভাবছিলো: এবার ঈদের ছুটিতে সে গ্রামের বাড়িতে যাবে না। আর সে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে চুপচাপ বসে থাকেনি। তাই, ভার্সিটি বন্ধের কয়েকদিন আগেই সে ইশরাতকে তার মনের কথা সব জানিয়ে দিলো। আর ভাবলো: ইশরাত এতে খুব খুশি হবে।
আশফাক খুব হাসিখুশি-ভাব নিয়ে সেদিন বললো, “ভাবছি, এবার ঈদে আর গ্রামের বাড়িতে যাবো না। তোমার সঙ্গে ঢাকায় ঈদ করবো। জীবনে কখনও তো ঢাকায় ঈদ করিনি, তাই!”
কথাটা শুনে ইশরাত কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। আর সে ভীষণ মনমরা হয়ে বললো, “না-না, তা কেন করবে তুমি! এটা ঠিক নয়। তুমি গ্রামে যাও। সেখানে তোমার মা-বাবা আছে। তারা কী মনে করবে!”—এসব বলতে-বলতে ইশরাত হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেল।
সব শুনে আশফাক বললো, “আমি আরও ভাবছিলাম, আমার সিদ্ধান্তের কথা শুনে তুমি খুব খুশি হবে। এখন দেখছি একেবারে তার উল্টোটা!”
ইশরাত এবার সহজ হওয়ার ভান করে বললো, “তুমি থাকলে ভালোই হতো। কিন্তু আমি ভাবছি, তুমি গ্রামে না গেলে তোমার মা-বাবা কী মনে করবে! আর তারা হয়তো ভাববে—আমিই তোমাকে গ্রামে যেতে দেইনি। তারচে ভালো তুমি এবারও গ্রামেই যাও।”
এসব শুনে আশফাক কিছুটা মনমরা হয়ে গেল। তারপর একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো, “আচ্ছা, তুমি যখন বলছো, তখন তো আমাকে তা মানতেই হবে। কিন্তু আর নয়। এরপর থেকে কিন্তু আমি একটা ঈদ গ্রামে আর-একটা ঈদ শহরে করবো।”—কথাটা বলে সে ইশরাতের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।

আশফাকের দ্রুত সিদ্ধান্ত-বদলের কথা শুনে ইশরাত এবার বেশ হাসিখুশি হয়ে উঠলো। আর সে আগের অবস্থা থেকে দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগলো। ইশরাতের এমনটি করার কারণ কিছুই বুঝতে পারলো না সহজ-সরল আশফাক।

অনার্স-সেকেন্ড-ইয়ারে উঠার পর থেকে ইশরাতের সঙ্গে আশফাকের প্রেম। ইশরাতের প্রবল আগ্রহেই আশফাক এই পথে অগ্রসর হওয়ার সাহস পেয়েছিলো। নইলে, এমন সুন্দর একটা মেয়ে—তার উপরে এই শহরে তাদের একাধিক বাড়ি-গাড়ি আছে—এরকম একটা মেয়ের সঙ্গে আশফাক প্রেম করার সাহস পায়! ইশরাতের আগ্রহেই আশফাক এই প্রেমে ডুবে আছে।

তিন-বছর-যাবৎ তাদের প্রেম। সম্প্রতি তাদের অনার্স-ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ওরা দুজন একই প্রাইভেট-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তবে ওদের সাবজেক্ট ভিন্ন। আশফাক পড়ে ইংরেজি-সাহিত্যে, আর ইশরাত বিবিএ। অনার্স-ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পরও তারা একসঙ্গে নিয়মিত ক্যাম্পাসে যাতায়াত করছে।

তিনদিন পরে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আঠারোদিনের জন্য ওদের ভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধের আগের দিন ইশরাতের সঙ্গে সারাদিন ভার্সিটি-ক্যাম্পাসে ঘুরেফিরে কাটালো আশফাক। দিনটি আশফাকের জন্য সত্যি অনেক আনন্দের ছিল। সে ইশরাতের কাছে এইরকম আরও একটি দিন চেয়েছিলো, কিন্তু ইশরাত তাতে সায় দেয়নি। এতে মনখারাপ করে সেদিন নিজের মেসে ফিরে এসেছে আশফাক। তবে বন্ধের দিন ঘণ্টাখানেক সময় তাকে দিয়েছিলো ইশরাত। আর এতেই আশফাক ভীষণ খুশি। সে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সবসময় অল্পে তুষ্টপ্রাণ একটি যুবক।

সন্ধ্যার পরে ওরা যার-যার বাসায় ফেরার আগে ভার্সিটির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আশফাক খুব কাকুতিমিনতী করে ইশরাতের উদ্দেশ্যে বললো, “আমি কয়েকদিন পরে গ্রামের বাড়িতে যেতে চাচ্ছি। আর তোমার সঙ্গে আরও কয়েকটা দিন আমার থাকতে ইচ্ছে করছে।”
এতে ইশরাত এবার মনমরা হয়ে বললো, “সেটা করতে পারলে ভালোই হতো। কিন্তু আমি আগামীকালই মা-বাবার সঙ্গে চিটাগাং চলে যাচ্ছি। আমার এক মামা বিদেশ থেকে এসেছেন তো, তাই। তাছাড়া, ঈদের আগে সেখান থেকে আমার দাদাবাড়ি কুমিল্লায়ও যেতে হতে পারে। এমন একটা অবস্থায় তোমার এখনই গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়া ভালো। ঈদের পরে আবার আমাদের দেখা হবে।”
সব কথা শুনে আশফাক আর-কিছু বললো না। সে শুধু কষ্ট করে একটুখানি হেসে ইশরাতকে বিদায় জানালো। আর সে ভাবলো: ঈদের পরেই তো আবার তাদের দেখা হচ্ছে।

সন্ধ্যার অন্ধকারে ইশরাত মিলিয়ে যেতেই আশফাক তার মেসে ফেরার চিন্তাটা আপাততঃ বাদ দিয়ে এক বন্ধুর বাসায় গেল। ওর এই বন্ধুটি শ্যামলী থাকে। আর আশফাকের মেসটাও এরই ধারেকাছে।
অনেকদিন পরে বন্ধুকে পেয়ে আশফাক কিছু সময়ের জন্য ইশরাতের কথা ভুলে গেল। তবুও সে কথার ফাঁকে-ফাঁকে ইশরাতের কথা ভেবে-ভেবে একটু আনমনা হচ্ছিলো। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে রেজওয়ান একসময় বললো, “কার কথা ভেবে এতো মনখারাপ?”
এতে আশফাক হেসে ফেললো। আর বললো, “তুইতো সব জানিস দোস্ত। আর এই শহরে তুইই-তো আমার সবচেয়ে আপনজন।”—তারপর সে একটু থেমে আজকের দিন-সহ ইশরাত ও তার জীবনের গত কয়েকদিনের ঘটনাটা ওর কাছে খুলে বললো।
রেজওয়ান সব শুনে কেমন যেন একটা ভাব করে নিজেই মনমরা হয়ে গেল। আর ওর ভাবটা দেখে আশফাক আরও ঘাবড়ে গেল। সে জানে, তার এই বন্ধুটি মেয়েদের সাইকোলজি বোঝে ভালো। তাই, সে কিছুক্ষণ বন্ধুর দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়ে থেকে বললো, “বন্ধু, কোনো সমস্যা?”
রেজওয়ান মিথ্যা বললো না। সে শুধু বন্ধুকে অভয় দিয়ে বললো, “সমস্যা একটা হয়েছে? ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। মেয়েটির মতিগতি এখন হয়তো অন্যদিকে প্রবাহিত হতে পারে। নইলে, তোদের এতো ঘনিষ্ঠ-সম্পর্কের মাঝে হঠাৎ সোজা-রাস্তা ছেড়ে দিয়ে তার এই ইউটার্ন কেন?”
এতে আশফাক আরও ঘাবড়ে গেল। আর রেজওয়ান তাকে অনেকখানি অভয় দিয়ে বললো, “যা সত্য, তা-ই আমাদের মানতে হবে, বন্ধু। আর মানবজীবনে সত্যকে আড়াল করা মানে চরম-বোকামি।”
রেজওয়ান আর-কিছু না বলে বন্ধুকে একটু শক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে লাগলো।
সে আর-কিছুই বলছে না দেখে একটা সময় কিছুটা অধৈর্য হয়ে আশফাক হঠাৎ বলে বসলো, “তোমার কী মনে হয়, তা আমাকে সাফ-সাফ বলো বন্ধু। আমি শুনতে চাই। আমাকে সবকিছু খুলে বলো।”

রেজওয়ান এবার একটুখানি গম্ভীর হয়ে বলতে লাগলো, “মেয়েটি অন্য-কারও প্রেমে পড়েছে কিনা আমি পুরাপুরি নিশ্চিত নই। তবে সে তোমাকে না জানিয়ে একটাকিছু করতে চাচ্ছে। তাই, তোমাকে জোর করে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে ভুল করেনি। আর আমার মনে হয়: এই ঈদের আগে-পরে সে বা তার পরিবার একটাকিছু করতে চাচ্ছে। আর এই একটাকিছু হলো বিয়ে। তুমি ওদের বাড়িতে গিয়েছো কয়েকবার। ওদের বাড়িটা তোমার একেবারে চেনা। তুমি এখানে থাকলে ওদের বিরাট ক্ষতি। তাই, সে জোর করে ঈদের অজুহাতে তোমাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইছে। যাতে, সে নিরাপদে বিয়েশাদী করে মহাসুখে তার সংসারধর্মপালন করতে পারে। আর এটাই হচ্ছে এখনকার ওভার-স্মার্ট-মেয়েদের স্টাইল।”

বন্ধুর কথা শুনে আশফাকের ভিতরে হঠাৎ একটা আলোড়নসৃষ্টি হলো। সে এখন সব বুঝতে পারছে। আজ কয়েকদিন যাবৎ ইশরাত তার সঙ্গে ভয়ানক একটা লুকোচুরি খেলছে। আজ সে এখানে না এলে এই ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে পারতো না। সে ইশরাতের প্রেমে অন্ধ বলে তার সব কথা বিশ্বাস করে। কিন্তু এই পৃথিবীতে আর এই জীবনে এখন এই বিশ্বাসের কোনো মূল্য নেই। এখানে, সবকিছুতে চরম-অবিশ্বাসী-মানুষগুলোই খুব ভালো থাকে।

আরও কিছুটা সময় পার করে এবার আশফাক বলতে লাগলো, “এখন আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হচ্ছে, বন্ধু। আমি ও-কে নিয়ে অবিশ্বাসের সঙ্গে কখনও এতোটা ভাবিনি। কিংবা কখনও ও-কে অবিশ্বাস করিনি। আর তাকে আমি ষোলোআনাই বিশ্বাস করেছি। কিন্তু সে যে…।”
রেজওয়ান বন্ধুকে বাধা দিয়ে বললো, “তুমি ভালোমানুষ। তাই, একজনকে ষোলোআনা-বিশ্বাস করেছো। কিন্তু তোমার এই ষোলোআনা-বিশ্বাসের মূল্য দেওয়ার মতো ষোলোআনা-যোগ্যতাসম্পন্ন-মানুষ কোথায়? তোমাকে আমি ভালো জানি। তোমাকে আমি কয়েক বছর ধরে চিনেছি। একই ভার্সিটিতে পড়ার সুবাদে আমাদের পরিচয়। বিশাল পৃথিবীতে এটি ক্ষণিকের পরিচয় ব্যতীত আর-কিছু নয়। তবুও একজন মানুষকে চিনতে এটিই যথেষ্ট সময়। তবে তুমি মনখারাপ করবে না। জীবনটা শুধু একজন মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ার জন্য নয়। জীবন এরচেয়ে অনেক বড়। আর তার জন্য আমাদের ভাবতে হবে। তুমি বাসায় গিয়ে আরও ভাববে। আর বই পড়বে। একটুও মনখারাপ করবে না। তুমি নিজেকে সুদৃঢ়ভাবে দণ্ডায়মান-অবস্থায় রাখবে। একটা জীবন অনেক কষ্টের—আবার অনেক আনন্দেরও। তাই বলে এ-কে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। তুমি আজ থেকে নিজেকে ভালোবাসবে সবচেয়ে বেশি। আমি জানি, তোমার মতো ভালোছেলে আর-কয়টা আছে এই শহরে?”

বন্ধুর অনেক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও রাতে না খেয়েই উঠে পড়লো আশফাক। একসময় সে হাঁটতে-হাঁটতে আর খুব মনখারাপ করে নিজের মেসে ফিরে এলো। একটা আচমকা ঝড়ে যেন তার সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। আর সে নিজেকে এখন এই পৃথিবীর সবচেয়ে সর্বস্বান্ত মনে করছে।

আশফাক পরদিনই গ্রামের বাড়িতে গেল না। ঈদের বাকী এখনও আটদিন। তাই, সে ভাবলো, ইশরাতের সঙ্গে দেখা না হলেও তার নিজের বন্ধুদের সঙ্গে তো দেখা হবে। এই আশাতেই সে ঢাকায় রয়ে গেল। আর সে ভাবলো: প্রয়োজনে সে ঈদের আগের দিন গ্রামে যাবে।

আরও তিনদিন পরে আশফাক গাবতলী যাচ্ছিলো পাবনাগামী একটি বাসের টিকিট কাটতে—এমন সময় রেজওয়ানের ফোন পেয়ে মাঝপথে বাস থেকে নেমে শ্যামলী ফিরে এলো সে। আর সে ফিরে এসে রেজওয়ানের মুখে যা শুনলো তাতে তার হার্ট-অ্যাটাক হওয়ার জোগাড় হলো।

রেজওয়ান বলতে লাগলো, “আমি আজ ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম একটা কাজে। সেখানে আমাদের একটা গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ হলো। ওর মুখেই শুনলাম ঈদের পরদিন নাকি ইশরাতের বিয়ে। আর ওর এক মামাতো ভাই নাকি আমেরিকা থেকে এসেছে। তার সঙ্গেই নাকি পারিবারিকভাবে বিয়েটা হচ্ছে। মেয়েটি আমাকে বলেছে, ইশরাত নাকি তাকে নিজের মুখে দাওয়াত দিয়েছে। একটা অসুবিধার কথা বলে সেদিন সে বিয়ের কার্ডটা শুধু তাকে দেয়নি। আসলে, এটি কোনো কারণ নয়। তখন আমাদের ভার্সিটি খোলা ছিল—তাই, সে আমাদের ভার্সিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে বিয়ের কার্ড দিতে চায়নি। এখন ভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেছে। আর চিন্তা কী?”

আশফাকের মাথাটা ঘুরছিলো। তিন-বছরের বেশি সময় ধরে তাদের প্রেম। সে কত ভালোবেসেছে ইশরাতকে। আর ভালোবাসার শেষপরিণতি তো বিয়ে! কিন্তু ইশরাত এ-কী করছে! আশফাকের চোখে প্রায় জল চলে এলো। সে এই কয়-বছরে আর-কোনো মেয়ের প্রতি সামান্যতম দুর্বল হয়নি। সে শুধু ইশরাতকে ভালোবাসে। আর তার স্বপ্ন শুধু ইশরাত। আর সেই কিনা তাকে এরকমভাবে ভুলে সামান্য একটা আমেরিকাফেরত ছোকরার জন্য এতোবড় প্রতারণা করতে পারলো!
এবার আশফাকের চোখে জল এসে গেল। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। তার মনের বাঁধ ভেঙ্গে ভিতরে-ভিতরে একটা কান্নার জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
সে অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলো না। রেজওয়ান তার হাত ধরে ওদের বাসায় নিয়ে গেল। তখন দুপুর হতে কিছুটা বাকী। তবুও রেজওয়ান আগেভাগে খাবারের ব্যবস্থা করে ফাঁকে-ফাঁকে কথা চালিয়ে যেতে লাগলো।
রেজওয়ান অনেক বুঝিয়েশুনিয়ে আশফাককে ভাত খাওয়াচ্ছে। আর জোর করে আটকিয়ে রেখেছে তাকে খাবার-টেবিলে। ঘনিষ্ঠ-বন্ধুর এমন দরদমাখা আদরে-ব্যবহারে আশফাক মনের দুঃখ-কষ্ট বুকেচেপে কোনোরকমে চারটে ভাত মুখে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার শুধু বারেবারে গত তিন-বছরের কত ঘটনাবলী মনে পড়ছে। একজন হয়তো ভুলে গেছে! কিন্তু সে তো ভুলতে পারছে না।

দুপুরের অনেক পরে আশফাককে তার মেসে পৌঁছে দিলো রেজওয়ান। এর তিনদিন পরে ঈদ এলো। কিন্তু আশফাক গ্রামের বাড়িতে যেতে পারলো না। ঈদের দিনটা শুধু ঘুমিয়ে কাটালো আশফাক। পরদিন রেজওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে সে মেহেদি কমিউনিটি সেন্টারে গেল ইশরাতের বিয়ের নাটক দেখতে। তার যেন কিছুতেই এমন একটা অপকাণ্ড বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তাই, সে একটিবারের জন্য সবকিছু নিজের চোখে দেখতে চাইছিলো। রেজওয়ান তাতে আর অমত করেনি।

ওরা যেন লোকের ভিড়ে আর কিছুটা ছদ্মবেশে মিলেমিশে একাকার হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। বর-কনের মঞ্চে ইশরাত কী হাসিখুশি! বান্ধবীদের সঙ্গে সে খুব স্বাভাবিক। আর খুব খুশি।
আর ওরা দুই-বন্ধু একটু পরে নেমে এলো রাস্তায়।
আশফাক কোনো কথা বলছিলো না। তার দু’চোখে জল। কে বলে পুরুষমানুষ কাঁদে না? তারা ভুল বলে। আর তাদের পুরুষ-সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। এই তো আমাদের আশফাক কাঁদছে। না, সে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কাঁদছে না। সে কাঁদছে এই ভেবে যে, মানুষ কী করে এমন নিষ্ঠুর হয়?
একটা সময় চোখের জলে ডুবে আশফাকের কেবলই মনে হতে লাগলো: এ কেমন প্রেম? এরই নাম বুঝি প্রেম? আর এই কি প্রেম?

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
৩০/০৮/২০১৬

গল্প বলি

গল্প বলি গল্প বলি
শুনতে তুমি পারবে?
সত্য শুনে তোমার বুকে
আঘাত কিনা লাগবে!
গল্প বলি গল্প বলি
মিথ্যাচেনার গল্প,
তুমি আবার মিথ্যা বলো
যদিও তা অল্প!

গল্প শুনে মনটি তোমার
ভীষণ গেছে চটে,
সত্য ছাড়া মিথ্যাগল্প
নাই যে আমার ঘটে।
গল্প বলি গল্প বলি
সত্যচেনার গল্প,
তুমি আবার মিথ্যাবাদী
ঘটনা নয় কল্প!
আসল শুনে মনে তোমার
জমছে অনেক ব্যাধি,
জেনে গেছো বন্ধু তুমি
আমি ভীষণ প্রতিবাদী।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১৬/০৪/২০১৭