সাইয়িদ রফিকুল হক এর সকল পোস্ট

সাইয়িদ রফিকুল হক সম্পর্কে

সাইয়িদ রফিকুল হক ( Syeed Rafiqul Haque) তিনি একজন সাহিত্যসেবী, গ্রন্থপ্রেমিক ও রাজনীতি-সচেতন মানুষ। বাংলাদেশ, বাংলাভাষা ও বাংলাসাহিত্য তাঁর কাছে সবসময় প্রিয়, এবং এই তিনটি তাঁর কাছে চিরদিন পবিত্র শব্দ। তিনি বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তি। তাঁর লেখালেখিতেও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার ছাপ সুস্পষ্ট। আর তিনি সবসময় ঘৃণা করেন রাজাকার, ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ীচক্রকে। ধর্মবিশ্বাসে তিনি ত্বরীকতপন্থী সুন্নীমুসলমান। আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি একজন পুরাপুরি আস্তিক। তিনি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। একজন খাঁটি বাঙালি ও বাংলাদেশী। সাহিত্যচর্চা: তিনি নামে-বেনামে ও ছদ্মনামে লেখালেখি করছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। মূলত তিনি কবি, লেখক ও ঔপন্যাসিক। তিনি স্কুলজীবন থেকে আপনমনে সাহিত্যচর্চা করছেন। তখন লেখাপ্রকাশের তেমন-একটা সুযোগ না থাকায় তিনি তাঁর লেখাসমূহ প্রকাশ করতে পারেননি। বর্তমানে ‘শব্দনীড় ব্লগ’সহ বিভিন্ন ব্লগে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁর লেখার মূল বিষয়: মানুষ, মানবতা আর দেশ-জাতি-সমকাল। আত্মপ্রচারবিমুখ এক কবি তিনি। স্কুলজীবন থেকে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করে অদ্যাবধি কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ইত্যাদি রচনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। পনেরো বছর বয়সে কবিতা লেখার মাধ্যমে তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। তিনি লিখেছেন অনেক। কিন্তু প্রকাশ করেছেন খুব কম। ইতঃপূর্বে কয়েকটি সাহিত্যপত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর লেখাসমূহ আধুনিক-ব্লগগুলোতে প্রকাশিত হচ্ছে। এজন্য তিনি ব্লগগুলোর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তিনি বাস্তববাদী লেখক। আর তাঁর লেখায় কোনো কৃত্রিমতা নাই। তাঁর প্রায় সমস্ত লেখাই দেশ ও জাতির জন্য নিবেদিত। তাঁর লেখার বিষয়: কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ইত্যাদি। তিনি ‘মানবজীবনের গল্প’ রচনায় যথেষ্ট পারদর্শী। এ পর্যন্ত তাঁর রচিত গল্পের সংখ্যা ৩২টি। আর উপন্যাসের সংখ্যা ১৮টি। ছড়াসাহিত্যেও তিনি সমভাবে পারদর্শী। শিক্ষা: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ নাই। তাঁর কাছে সার্টিফিকেট-সর্বস্ব সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কঠোর সাধনায় অর্জিত প্রকৃত জ্ঞানের মূল্য অনেক বেশি। তিনি নিজেকে সবসময় একজন স্বশিক্ষিত মনে করেন। তবে প্রচলিত প্রথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক উচ্চতর গবেষণাকর্মে নিয়োজিত। জন্মস্থান: বাংলাদেশ। তাঁর জীবনের লক্ষ্য: লেখালেখির মাধ্যমে আমৃত্যু দেশ, মানুষ আর মানবতার পক্ষে কাজ করা।

কবিতার মানে

কবিতার মানে
সাইয়িদ রফিকুল হক

তোমরা সবাই কবিতাকে আজ ভাবছো খুবই সস্তা!
দিনেরাতে তাই আজেবাজে লিখে নিমিষে ভরছো বস্তা।
কবিতার কথা মনভাবনায় ভাবতে হয় যে ধ্যানে,
সাধক-প্রাণের ভাবুক-মনই বোঝে কবিতার মানে।
কবিতা নয়কো বিলাসী কারও খেয়ালখুশির বন্যা,
কবিতারা হলো হৃদভাবনার কৃষ্ট শব্দের কন্যা।
উৎকর্ষতা যখন কারও মনের গভীরে আসে,
হৃদয়খাতায় দেখবে তখন কবিতা তোমার ভাসে।
হৃদয়বেদনা খুব ভালোবেসে রক্তআখরে লেখো,
হৃদয়ের কাছে প্রতিদিন তুমি কবিতা-লেখাই শেখো।

ছন্দ তোমার মনের ভিতরে আজও বাঁধেনি বাসা,
কেমন করিয়া বন্ধু হে তুমি কবিতা লিখবে খাসা?
সবার আগে যে ছন্দসাগরে ডুব দিবে তুমি শুধু,
তারই সঙ্গে পান করবে হে ভাবসাধনার মধু।
দেখবে তখন কেমন হাসিয়া কবিতা তোমার আসে,
ছন্দজ্ঞানের হৃদ-ভালোবাসা কবিতা ফোটাবে খাসে।
কবিতাস্বর্গে ঢুকতে চাইলে কবিতা বুঝবে আগে,
মগজে তখন কবিতা আসবে রঙিন ফুলের রাগে।
ভালোবাসি আজ কবিতাবন্ধু, কবিতা বাসায় ভালো,
পৃথিবীটা আরো সুন্দর হবে, কবিরা জ্বালাবে আলো।

সাইয়িদ রফিকুল হক
১৮/০৮/২০২১

পেঁয়াজের দামবৃদ্ধিতে অনেকেই খুশি!

বাংলাদেশে এমন অনেকেই রয়েছে—যারা দেশের ভিতরে যে কোনো সমস্যা দেখলে খুব বেশি খুশি হয়। মানুষের আপদ বিপদ দেখে এদের মনে ভয়ানক আনন্দের উদ্রেক হয়। এরা মনের আনন্দে মানুষের দুঃখ, কষ্ট ও দুর্দশা দেখে পরম তৃপ্তিতে ঢেকুর তুলতে পারে। এখানে, কারও ঘর পুড়ে যেতে দেখলে কেউ আগুন নিভাতে আসে না—কিন্তু সেই আগুনে স্বার্থের আলুপোড়া দিয়ে খাওয়ার জন্য অনেকেই উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসে! যেকোনো সমস্যাকে এখানে নেতিবাচক-ইস্যুতে দেখা হয়। কোনো সমস্যা সমাধানে এদের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। এরা কিন্তু খুব নামকরা সমালোচক!

বাংলাদেশে কতরকম সমস্যা রয়েছে। সমস্যা রয়েছে পৃথিবীজুড়ে। তাই, বলে পৃথিবীর মানুষ বাঙালির মতো কোনো সমস্যা নিয়ে হঠাৎ-হঠাৎ এতো বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠে না। পৃথিবীর অনেক দেশেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ওঠা-নামা করে থাকে। তাই বলে, সেখানে মানুষগুলো কখনো সমস্যা বাড়িয়ে তোলার জন্য চেষ্টা করে না। তারা সবকিছু ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করে থাকে। আর সেখানকার জনসাধারণ ও সরকার মিলেমিশে দেশের সকল সমস্যা দূর করতে উদ্যোগী হয়।

সম্প্রতি আমাদের দেশে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে কিছুসংখ্যক মানুষ যেন ভীষণ খুশি! তারা মনের আনন্দে এই ব্যাপারে একটাকিছু বলার বা লেখার যেন বিরাট সুযোগ পেয়েছে! এই সুযোগে অনেকেই এখন সরকারকে (ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থহানির কারণে বা পূর্বের যেকোনো রাগবশত) প্রতিনিয়ত গালমন্দ কিংবা অযাচিত সমালোচনা করতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না। আর বর্তমানে দেশের এক বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলের নেতা তো এজন্য সরকারের পদত্যাগও চাইলেন! পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের পদত্যাগ দাবি করাটা যে কতটা হাস্যকর—তা যেকোনো বুদ্ধিমান মানুষই উপলব্ধি করতে পারবেন। হয়তো এরা অতিবুদ্ধিমান! তাই, মনে করছেন—সরকার পদত্যাগ করলে পেঁয়াজের দাম কমে যাবে! কিংবা নতুন সরকার এদের বিনামূল্যেও পেঁয়াজ দিতে পারে!

পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের কোনো হাত বা কারসাজি নাই—বরং এখানে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি করে সরকার বিরোধী-ইমেজ গড়ে সরকার বিরোধীদের ফায়দা লোটার একটা কুপরিকল্পনা থাকতে পারে। তার কারণ, পেঁয়াজের দাম বাড়লে সরকারের লাভ কী? এতে কি সরকারের দাম বাড়বে? অথবা, এতে সরকারের কোনো ভোট বাড়বে কিনা? না, কক্ষনো না। তবে সরকারকে কেন দোষারোপ করা হচ্ছে? পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির সুযোগে সরকারের চোদ্দোগোষ্ঠী-উদ্ধারের অপচেষ্টা করা হচ্ছে। পেঁয়াজের বাজার-নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। বর্তমানে সরকার, বাজারে পেঁয়াজের মূল্য কমাতে যারপরনাই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তবুও সরকারের নগ্নসমালোচনা কাদের স্বার্থে? আর যারা দেশবাসীকে জিম্মি করে মূল্যবৃদ্ধির এই নগ্নখেলা খেলছে—তাদের বিরুদ্ধে এ-পর্যন্ত আমরা কী করতে পেরেছি? আমরা তো বিবেকবান! তবুও ঘরে বসে রয়েছি কেন?

পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ থেকে একেবারে আরও সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়বে। কিন্তু ধনী কিংবা কালোটাকার মালিকদের কোনো সমস্যা নাই। এদেশে এখন এমনও লোক রয়েছে যে—একটি পেঁয়াজের দাম একহাজার টাকা হলেও তাদের কোনো ক্ষতি নাই। এরাই পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত। আপনারা এদের চেনেন না? চিনলে এদের কিছু বলেন না কেন? একজন বিবেকবান মানুষ হিসাবে সবারই তো দায়িত্ব-কর্তব্য হলো—দেশ-জনতার স্বার্থবিরোধী কোনো অপকাণ্ড দেখলে দলমত নির্বিশেষে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। কিন্তু আমরা কী করেছি, আর কী করছি? বিক্ষুব্ধ মানুষ হিসাবে কয়টি পেঁয়াজের গুদাম আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখিয়ে দিয়েছি? আর কয়টি দেশবিরোধী-মানবতাবিরোধী নরপশু মওজুদদারদের ধরিয়ে দিতে সাহায্য করেছি?

ইদানীং আমরা দেখতে পাচ্ছি, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে টনকে টন পেঁয়াজ (হাজার-হাজার মণ) গুদামে পচে যাওয়ায় সেগুলো এখন চাকতাই খালে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এই পশুগুলো মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। এদের বিরুদ্ধে লেখেন না কেন? নাকি এখন আপনাদের কলমের কালি নাই?

গুদামজাত করা পেঁয়াজ এখন এভাবেই ফেলে দেওয়া হচ্ছে! এদের বিরুদ্ধে দেশবাসী কবে রুখে দাঁড়াবে?

সরকার, পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিতে কোনো কারসাজি করেছে? না, করে নাই। এগুলো বাংলাদেশের একশ্রেণীর হারামখোর-মওজুদদারদের দুঃস্বপ্নবিলাস। এদের আপনি চেনেন না? চেনেন তো অবশ্যই। তবে লেখেন না কেন এদের বিরুদ্ধে? এদের জন্য মায়া করে লাভ কী?

পেঁয়াজ পচনশীল দ্রব্যসামগ্রী। এগুলো দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। আপনারা সরকারকে দোষারোপ না-করে কয়েকদিন একটু ভালোমানুষ হ’ন না—পেঁয়াজ খাওয়া কয়েকদিনের জন্য একটু ছেড়ে দিন। তখন বুঝা যাবে—আপনারা কতটা দেশপ্রেমিক! পেঁয়াজ না-খেলে কী হয়? এই মওজুদদার নামক নরপশুশ্রেণীকে একটু শিক্ষা দেওয়ার জন্য হলেও আপাতত কয়েকদিন পেঁয়াজ খাওয়াটা নাহয় ছেড়ে দিন।

লিখতে হলে এই দেশের কালোবাজারি, সুদখোর, ঘুষখোর, মওজুদদার, মুনাফালোভী ও সর্বস্তরের অসৎ-ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লিখুন। নাকি এরা আপনাদের আত্মীয় হয়? সরকার দেশের ভিতরে জনগণের জানমাল বাঁচাতে সামান্য দুই-চারটা সন্ত্রাসী-খুনীকে ‘ক্রসফায়ারে’ দিলে—অমনি চারিদিকে আপনাদের চিৎকার ও চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়—দেশে গণতন্ত্র নাই—মানুষের অধিকার নাই—দেশ এখন রসাতলে! তাইলে, এই দেশে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি করার দুঃসাহস এরা পাবে না কেন? আর এই দেশে এদের আশ্রয়প্রশ্রয় দেওয়ার তো লোক আছে। দয়া করে, এদের রাজনৈতিক কোনো পরিচয় জানতে চাইবেন না। এই নরপশুদের আবার রাজনীতি কী? এরা দেশ-জাতির শত্রু।

বাংলাদেশের একশ্রেণীর মানুষ সবকিছুতে আজকাল রাজনীতি খুঁজে বেড়ায়। এরা খুব ঘাপটি মেরে থাকা ও সুবিধাবাদী লোক। এদের সহজে চিনতে পারা যায় না। এরা ভয়ানক বর্ণচোরা, আর পেঁয়াজ-ব্যাপারীদের মতো খুব ধূর্ত।

আপনাদের চোখে—যত দোষ—নন্দ ঘোষ সরকার! যেকোনো সমস্যা ও ইস্যুকে পুঁজি করে আপনারা সরকারকে দুই-চারটা গালি দিতে পারলেই মনে করেন- দেশউদ্ধার হলো! আর এভাবে বুঝি দেশে সরকারের পতন হবে! তাই, পেঁয়াজ নিয়ে সরকার-পতনের এই সস্তা লেখালেখি!

আমি সরকারের পক্ষে বলছি বলে—সরকারের লোক তা কিন্তু নয়। গঠনমূলক সমালোচনা সবসময় সাদরে গৃহীত হয়। কিন্তু সমালোচনার নামে সরকারবিরোধী-ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটানো, রাজনৈতিক অসন্তুষ্টির কারণে পেঁয়াজের ওপর ভর করে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার, ভুয়াতথ্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করাটা—নিজের নৈতিকতার মানদণ্ডকে মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। আশা করি, আপনারা বিষয়টি বুঝবেন।

মনে রাখবেন: স্যাটায়ার বা বিদ্রুপাত্মক রচনা সবাই লিখতে পারে না। আপনি যেকোনো একটা অজুহাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে গালি দিলেন! নিজদেশের প্রধানমন্ত্রীকে গালি দিলেন! দেশের একজন মন্ত্রীকে অহেতুক তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেন—এটা স্যাটায়ার হলো না। এটা হলো ভাঁড়ামি। আর এটা বেআদবিও বটে। আপনি যদি সুকৌশলে কারও মন্দটাকে সূক্ষ্ণ (কখনো স্থূল নয়) বিদ্রুপের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারেন—তবেই তা স্যাটায়ারের মর্যাদা পাবে। আবারও বলছি: স্যাটায়ার সবাই লিখতে পারে না। সবার দ্বারা স্যাটায়ার লেখা হয় না। আর স্যাটায়ার লেখা এতো সহজও নয়।

বিগত কিছুদিন যাবৎ পেঁয়াজ নিয়ে কিছুসংখ্যক মানুষ যা-ইচ্ছে তা-ই লিখছে। এইসব লেখার মধ্যে সামান্যতম গবেষণা নাই। মূল্যবোধের বালাই নাই। দেশপ্রেমের চিহ্ন নাই। সেখানে আছে শুধু যত দোষ—নন্দ ঘোষ—দেশের সরকার। আর যত পারো—সরকারকে গালি দিয়ে যাও! ভাবখানা আজ সবার এমন—আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক—কে আমাদের কী বলবে? আর আমাদের কাছে স্বাধীনতার মানে হলো—তুমি অন্যের কাপড় জোর করে টেনে ধরবে—কিন্তু সে তা রক্ষা করতে পারবে না। তাহলে, তোমার গণতান্ত্রিক অধিকার নাকি বিঘ্নিত হবে! তোমাকে, অন্যের সম্মানহানি করার অবাধ সুযোগ ও সুবিধা দিতে হবে—তাই না?

এই দেশের মানুষগুলো যদি এতো সস্তা আর এতো আবেগপ্রবণ না হতো—তাহলে, এই দেশটা সিঙ্গাপুর কিংবা জাপান হতে বেশিদিন লাগতো না। আর সবকিছুতে আমরা অচিরেই সিঙ্গাপুর কিংবা জাপানের চেয়ে এগিয়ে থাকতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো—আমরা আজও ভালোকে ‘ভালো’ আর মন্দকে ‘মন্দ’ বলতে শিখিনি। আজ আমরা সাদা-কালোকে এক করে ফেলেছি—আর এক করে দেখছি! পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিতে অনেককে ঠোঁট বাঁকা করে—হেঃ হেঃ হেঃ করে হাসতে দেখেছি! আর বলতে শুনেছি: এবার সরকার বেকায়দায় পড়েছে!

দেশের ভিতরে একশ্রেণীর অধিক মুনাফালোভী-শুয়োর সর্বস্তরের জনসাধারণকে জিম্মি করে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি করেছে—এরা চিরদিন দেশ-জাতির শত্রু। এই নরপশুদের বিরুদ্ধে আমরা কি কোনোদিন মাঠে নেমেছি কিংবা প্রতিবাদসভা-সেমিনার করেছি কিংবা একদিনও এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি? তা না-করে আমরা ঘরে বসে শুধু সরকারকে দুই-চারটা গালি দিয়ে আজ দেশউদ্ধার করতে চাচ্ছি! হায় রে, আমাদের লোকদেখানো দেশপ্রেম!

দেশের প্রয়োজনে সরকারের যেকোনো ভুলসিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমাদের গঠনমূলক সমালোচনার অধিকার রয়েছে। কিন্তু আমরা যেন পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণকে কষ্ট দেওয়া শয়তানচক্রের সঙ্গে সরকারকে গালমন্দ করে নিজেদের দীনতাকে আরও প্রকটভাবে ফুটিয়ে না-তুলি। আর এই হোক: আমাদের আজকের দেশগড়ার শপথ।

জয় হোক মানুষ আর মানবতার। জয় হোক বাঙালি-জাতির।

সাইয়িদ রফিকুল হক
১৮/১১/২০১৯

সুখপাখিটা

ভগ্নছাদের কার্ণিশ বেয়ে কেমন করে যেন নেমে এলো দুঃখগুলো
জানলাগুলো বন্ধ করে রেখেছিলাম অনেক আগে থেকে
তবুও সুখপাখিটা পালিয়ে গেল দরজা খুলে!

ভালোবাসি না কাউকে আর কখনো ভুল করে
ভালোবাসার এখন কঠিন অসুখ, অনেক ব্যাধি প্রেমরাজ্যে
তবুও মন কেমন-কেমন করে হৃদয়ব্যাধির পরিত্যাজ্যে!

সুখপাখিটা ধরতে গিয়ে ফিরে এলাম কঠিন শাসানি খেয়ে
সবার নাকি ধরতে মানা সুখপাখিটার পুচ্ছ
ডাস্টবিনে পড়ে আছে অনেক সাধের রজনীগন্ধা একগুচ্ছ!

সুখপাখিটা কোথায় থাকে? কেউ বলে না তার ঠিকানা
অন্ধগুলোর সাবানমাখা তেলচকচকে চেহারায় সুখের ঝর্নাধারা
সুন্দর চোখের মানুষগুলো এখন দেখি সমাজের চোখে অন্ধকানা!

সাইয়িদ রফিকুল হক
০৪/১১/২০১৯

গল্প: আত্মহত্যার আগে

কলেজের শুরুতে আসিফের দিনগুলো ভালোই কাটছিল। এখানে, সে বেশ কয়েকজন নতুন বন্ধুবান্ধব পেয়েছে। এটা ছেলে-মেয়েদের সহশিক্ষার কলেজ। সে সবার সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে দিনগুলো বেশ আনন্দে পার করছিল। হঠাৎ একদিন তার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। তার স্বাভাবিক আনন্দময় জীবনে কেমন করে যে একটা ছন্দপতন ঘটে গেল! আর এইরকম একটি ঘটনার জন্য সে আগে থেকে কখনো প্রস্তুত ছিল না।

সময়টা তাদের কলেজের প্রথম বর্ষ সমাপনী পরীক্ষার কয়েকদিন আগে। একদিন শেরপুর থেকে একটি মেয়ে এলো তাদের কলেজে ভর্তি হতে। এতদিন সে শেরপুর কলেজে ছিল। কিন্তু তার পিতা হঠাৎ বদলি হওয়ায় নিতান্ত বাধ্য হয়ে তাদের এখানে আসতে হয়েছে।
ওর নাম অনামিকা। সবার পছন্দের একটি মেয়ে। কী যে হাসিখুশি সে!
অনামিকা এখানে ভর্তি হয়েই নিয়মিত ক্লাস করতে লাগলো। সে দেখতে খুব সুন্দর। প্রায় সব ছেলেই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়। সবাই তার সঙ্গলাভে খুব খুশি হয়। তবুও আসিফ ওর সঙ্গে মিশতে চায় না। প্রথম দেখাতেই অনামিকাকে তার বেশ ভালো লেগেছিল। তবুও সে তার কাছ থেকে সবসময় দূরে সরে থাকতে চাইতো। আর তখনও তাদের এত ভালোভাবে পরিচয় হয়নি। শুধু ক্লাসমেট হিসাবে ক্লাসে তাদের দেখাদেখি হয়েছে মাত্র।
কলেজের অনেক ছেলে যেখানে যেচে তার সঙ্গে কথা বলতে লাগলো—সেখানে সে একেবারে নীরব ও নিশ্চুপ। কেউ দেখলে ভাববে, তার সঙ্গে বুঝি অনামিকার ঝগড়া হয়েছে! অন্যরা এমনটি করলেও আসিফ কখনো যেচে কিংবা এমনিতে তার সঙ্গে কথা বলতে যায়নি। সে মন দিয়ে পড়ালেখার চেষ্টাই করছিল। তার পিতার একটি বড় স্বপ্ন রয়েছে: ছেলে বড় হয়ে এলাকার ম্যাজিস্ট্রেট হবে। আসিফও নিজেকে সেভাবে তৈরি করছিল। পড়ালেখার দিক দিয়ে এই কলেজে আসিফের স্থান প্রায় সবার কাছে ঈর্ষণীয়।
শুধু আসিফ কথা না বললে কী হবে? দিন-দিন কলেজে অনামিকার জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগলো। তার আশেপাশে সহপাঠী ও সহপাঠিনীরা সবসময় ভিড় করে থাকে। তবে সহপাঠিনীদের চেয়ে সহপাঠীদের সংখ্যাটাই সর্বাধিক। ছেলেরা খুব আগ্রহভরে একদিন তাকে কলেজের ডিবেট-সোসাইটির আহ্বায়ক করে বসলো। তবুও সেখানে আসিফের দেখা নাই!

মাত্র কয়েকদিনে অনামিকা যেন পুরা কলেজটা জয় করে ফেললো। তা সত্ত্বেও, আসিফ এসব থেকে কয়েকদিন একটু দূরেই ছিল। হঠাৎ একদিন অনামিকা ওর পাশে এসে বসলো। সেই থেকে ওদের প্রথম বন্ধুত্ব। তারপর ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে ওদের আলাপচারিতায় কেমন করে যেন ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। অনেকে বুঝতে পারলো, ওদের সম্পর্ক বুঝি বন্ধুত্বের সীমানা পেরিয়ে অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। নিয়তি কী চাইছিল আসিফ তা জানে না। তবে প্রথম বর্ষ সমাপনী পরীক্ষার পরে সে অনামিকার প্রেমে পড়ে গেল। এটা তার বন্ধুরাও সময়মতো ঠিক জেনে গেল। জমে উঠলো তাদের প্রেম। আসিফ কিছুতেই বুঝতে পারে না যে, কীভাবে কী হয়ে গেল! তবে সে এটা বুঝতে পারে যে, সে এখন মজনু।
অনামিকাও তাকে বেশ প্রশ্রয় দিচ্ছিলো। দুজনে ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে ক্যান্টিনে বসে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা আড্ডা দিতো। গল্প করতো। চা, সিঙ্গারা আর সমুচা খেত। তবে তাদের মধ্যে মাঝে-মাঝে পড়ালেখার বিষয় নিয়েও কথাবার্তা হতো। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হলো গভীর প্রেমের সম্পর্ক। এসব দেখেশুনে অন্যরা বলাবলি করতো, ওরা যেন নয়া-জামানার লাইলি-মজনু! এসব দেখে আড়ালে-আবডালে তাদের নিয়ে দুই-একজন হাসি-ঠাট্টা করলেও বাকীরা তাদের ভালোবাসতে লাগলো।

প্রেম কখনও গোপন থাকে না। কলেজে তাদের প্রেমের কথা বাতাসে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। এ-খবর অনামিকার বাবার কানেও গেল। তিনি স্থানীয় থানার দারোগা। প্রথমে তিনি তো রেগে একেবারে আগুন। কিন্তু পরক্ষণে যখন জানলেন, ছেলেটা স্থানীয়, এবং তার বাবা উপজেলার চেয়ারম্যান। তখন দারোগাসাহেব শান্ত হলেন। আর খুব শান্ত হয়েই রইলেন। তবে তার ভিতরটা বুঝা গেল না।
দারোগাসাহেব মনখারাপ করে সারাদিন গুম হয়ে বাসায় বসে রইলেন। তিনি কারও সঙ্গে তেমন-একটা কথাও বললেন না। এমনকি মেয়ের সঙ্গে বিন্দুমাত্র রাগারাগিও করলেন না। খুব নীরবে সারাটা দিন শুয়ে-বসে কাটালেন। অফিসে গেলেন একেবারে সন্ধ্যার পরে। তার হাবভাব দেখে মনে হলো, তিনি যেন আজ থেকে অন্য মানুষ। তবে তার মনে যে রাগ নাই—তা বলা যাবে না। মানুষের ভিতরটা পড়তে পারলে তো দুনিয়ায় এত আজাব, গজব, শয়তানী, ভণ্ডামি, নষ্টামি, কষ্ট ও বিপত্তি দেখা দিতো না। আসলে, এটা হলো বড়সড় ঝড়ের আগে একটা গুমোটভাব। তাই, দারোগাসাহেবের মনোভাব কিছুই বুঝা যাচ্ছে না।

অনামিকা পর-পর সাতদিন কলেজে এলো না। সবাই ভাবলো, হয়তো তার কোনো অসুখ হয়েছে। আসিফের বন্ধুরা বললো, “তোর একবার ওর খোঁজ নেওয়া উচিত। ওর কী হয়েছে তা জানা দরকার। মেয়েটি তোকে অনেক ভালোবাসে।”
আসিফ তেমন-একটা গা না করে বললো, “হয়তো আজকালের মধ্যে সে এসে পড়বে।”
এরপর সে কিছুটা চিন্তিতমুখে বললো, “তবে ওর মোবাইল-ফোনটাও বন্ধ পাচ্ছি আজ সাতদিন যাবৎ।”
সব শুনে সবার মনে কেমন যেন একটা সন্দেহের কালোমেঘ ঘনিয়ে আসতে শুরু করে। ওরা বিরাট ভাবনায় পড়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ করে ওদের বাসায় যাওয়াটাও ঠিক মনে করলো না। মানুষের মনে অনেক সন্দেহ, সংশয় ও অবিশ্বাস সবসময় খেলা করে। তাই, মানুষ অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না।

পরদিন বিকালে আসিফ সকল প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে থানার কাছে অনামিকাদের বাসায় গেল। সেখানে একজন কনস্টেবল ওদের বললেন, “স্যার তো এখানে থাকেন না। তিনি তো গতকাল রাতেই সপরিবারে ঈশ্বরদী না পীরগঞ্জ থানায় বদলি হয়ে চলে গিয়েছেন। তবে ঠিক কোথায় গিয়েছেন তা আমরা জানি না। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তার বদলির স্থান আমাদের কাছে গোপন করে রেখেছেন। আপনারা কারও কাছে খোঁজ নিয়েও তা হয়তো জানতে পারবেন না। পুলিশ-লাইনের বড় অফিসাররা শুধু তা জানেন।”
খবরটা শোনামাত্র আসিফের আনন্দময় জীবনে আঁধার ঘনিয়ে আসতে থাকে। হতাশায় তার বুকটা একনিমিষে ভরে যায়। তার বুকটা ভেঙে যায় নদীর পাড় ভাঙার মতো করে বারবার। আর তা বারবার ভাঙতেই থাকে। একসময় সে ভীষণভাবে মুষড়ে পড়ে।
তার টালমাটাল অবস্থা দেখে বন্ধুরা তাকে ধরাধরি করে বাসায় নিয়ে এলো। তারপর তাকে শুইয়ে দিলো বিছানায়। সবাই বুঝলো, ওর এখন পরিপূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন। তবে দুই-একজন বন্ধু সেদিনের মতো তার কাছে রয়ে গেল।
জীবনসম্পর্কে আসিফের খুব একটা বড়সড় বা বেশি কোনো ধারণা ছিল না। সে একজনের সঙ্গে সুন্দর একটা যৌথজীবন চেয়েছিল। অনামিকাকে খুঁজে পেয়ে তার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পথেই ছিল। কিন্তু হঠাৎ এই বিনা মেঘে বজ্রপাতে সে যারপরনাই মুষড়ে পড়েছে। সে নিজেকে কোনোভাবেই স্থির রাখতে পারছে না।

আসিফ কয়েকদিন কলেজে এলো না। বন্ধুরা ভাবলো, হয়তো সে দুঃখভারাক্রান্ত হয়েছে বলে বাসায় শুয়ে-বসে নিজেকে স্বাভাবিক করার কাজে নিয়োজিত। তাই, কেউ তার বাসায় যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো না। বন্ধুরা মনে করলো, একা থাকলে সে আরও ভালো থাকবে। ক্যাম্পাসে বসে সবাই তার মঙ্গল কামনা করতে লাগলো।

আটদিন পরে আসিফ কলেজে এলো। সঙ্গে তার প্রতিদিনের প্রিয় সেই ব্যাগটিও ছিল। বন্ধুরা তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলো। কিন্তু সে কারও কোনো কথায় কর্ণপাত না করে সোজা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকে। তার এই হতাশাগ্রস্ত মনোভাব লক্ষ্য করে একজন তাকে জাপটে ধরে পথ আগলে তাকে আটকাতে চেয়েছিল। এসময় সে কোথায় গিয়ে কী করে তার কোনো ঠিকঠিকানা নাই। কিন্তু এই বন্ধুটির চেষ্টাও সে দুহাতে দূরে ঠেলে বিমর্ষচিত্তে উপরে উঠতে লাগলো।। একসময় সে বন্ধুদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কলেজের আটতলার ছাদে উঠে আসে। তারপর নিচে অবস্থানরত তার বন্ধুদের দিকে চেয়ে বলতে লাগলো, “শোনো বন্ধুরা, এ-জীবন আমার কাছে এখন দুর্বিষহ। অনামিকার সঙ্গলাভ ব্যতীত আমার মনের দুঃখ কখনও ঘুচবে না। তাই, আমি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমি আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো। কেউ আমাকে ঠেকাতে পারবে না। আমার এই জীবনের কোনো প্রয়োজন নাই। আমি এখন সর্বস্বান্ত একজন মানুষ। আমার বেঁচে থেকে কোনো লাভ নাই। আমি চললাম বন্ধুরা। বিদায় ক্যাম্পাস। বিদায় পৃথিবী। বিদায় বন্ধুরা।”
তার কথা শুনে পুরা কলেজ হায়-হায় করে উঠলো। কেউবা তাকে নিষেধ করতে থাকে। আবার কেউবা কান্না জুড়ে দিলো। আবার বুদ্ধিমানদের মধ্যে দুই-একজন কোত্থেকে একখানা চাদর এনে কয়েক বন্ধুর সঙ্গে মিলে নিচে মেলে ধরলো। যাতে সে লাফ দিলেও তাকে বাঁচানো যায়। হায় রে মানুষের প্রচেষ্টা! আত্মহননকারীকে বাঁচাতে চায় ছোট্ট একটা চাদর মেলে! যার বুকের ভিতরে মরে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন বাসা বেঁধেছে তাকে কখনো ছোট্ট চাদর দিয়ে বাঁচানো যায়? ওর প্রয়োজন পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্নেহ, মমতা ও প্রেম। শুধু ভালোবাসা দিয়ে এবং নতুন স্বপ্ন ওর মনে জাগিয়ে আজ ও-কে বাঁচাতে হবে। কিন্তু সেই কাজটি করবে কে?

পুরা কলেজের ছেলে-মেয়ে নিচে জমায়েত হয়েছে। এমন সময় ভিড় ঠেলে ভবনের সামনে এসে দাঁড়ালেন কলেজের বাংলার সহকারী অধ্যাপক জামালউদ্দিন সাহেব ওরফে জামাল-স্যার। তিনি আসিফের দিকে তাকিয়ে একটা প্রচণ্ড হুংকারে বলে উঠলেন, “তুমি আত্মহত্যা করবে ভালো কথা। কিন্তু তার আগে তুমি আমার একটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাও। একজন শিক্ষক হিসাবে এটি তোমার কাছে আমার শেষ-অনুরোধ।”

আসিফ এখন মরণমুখী। সে কিছুটা চেঁচিয়ে বললো, “বলুন স্যার, আপনার কী প্রশ্ন?”
জামাল-স্যার বললেন, “তোমাকে নিচে এসে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।”
জামাল-স্যারের সঙ্গে আসিফের কথোপকথন চলছে|
ততক্ষণে কয়েকজন পিছনের সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে দিয়েছে।
আসিফ বললো, “আপনি প্রশ্ন বলুন স্যার। আমি এখান থেকেই উত্তর দিবো।”
জামাল-স্যার তার চশমাটা খুলে বললেন, “আসিফ, তুমি আমার প্রিয় ছাত্রদের একজন। তুমি কারও সঙ্গে কখনো বেআদবি করোনি। আমাকেও তুমি সদাসর্বদা ভক্তিশ্রদ্ধা করো। আজ তোমার জীবনের শেষদিনে তুমি আমাকে এতগুলো ছেলেমেয়ের সামনে অবজ্ঞা করবে? বাবা, আমি তোমাকে কোনো ধোঁকা দিচ্ছি না। তুমি একবার নিচে নেমে আসো। আর আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তারপর না হয় আত্মহত্যা করবে। কিন্তু আমার প্রশ্নটা তো গোপনীয়। আমি কথা দিচ্ছি এরপর তোমাকে আর বাধা দিবো না।”
আসিফ কী যেন ভাবতে থাকে। এমন সময় পিছন থেকে তাকে জাপটে ধরে ফেলে তার বন্ধুরা। সবাই মিলে তাকে পাঁজাকোলা করে নিচে নামিয়ে আনলো। আসিফ নিচে এসেও বন্ধুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে শেষে জামাল-স্যারকে দেখে মাথানিচু করে তার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। তাকে এখন একজন বড়সড় অপরাধীর মতো লাগছে।
জামাল-স্যার কোনোপ্রকার ভনিতা না করে সরাসরি তাকে বললেন, “এই জীবনটা কি তোমার?”
আসিফ সাধারণ এই প্রশ্নটা শুনে থতমত খেয়ে কিছুক্ষণ নীরব থাকে। শেষে বোকার মতো বলে বসলো, “জ্বি স্যার, এটা আমার জীবন।”
জামাল-স্যার বললেন, “তুমি মিথ্যা বলছো। তোমার এই জীবনের মালিক আল্লাহ। আর তোমার এই জীবনের ওপর সবচেয়ে বড় অধিকার রয়েছে মহান আল্লাহর, এবং তোমার জন্মদাতা ও জন্মদাত্রী পিতামাতার। তুমি আল্লাহর হক আদায় করোনি। আবার তোমার পিতামাতার আশা-ভরসা বিনাশ করে স্বার্থপরের মতো তুমি আত্মহত্যা করতে চলেছো! এই জীবন তোমার নয়। তাই, তুমি এ-কে হত্যা করতে পারো না। তুমি কখনও আত্মহত্যা করতে পারো না। তোমার আত্মহত্যা করার কোনো অধিকার নাই। আজ আত্মহত্যার আগে তুমি ভাবো—তোমার আত্মহত্যা করার কোনো অধিকার আছে কিনা? আর এই জীবন শুধু তোমার কিনা?”
তারপর জামাল-স্যার একটুখানি থেমে আবার বলতে লাগলেন, “আর সামান্য একটা মেয়ের জন্য কেউ কখনও এতবড় একটা জীবন বিনাশ করে! এই জীবনের কত মূল্য! এ-তো মহাজীবন। আর পরকালে এর মূল্য অপরিমেয়। তা তুমি জানো না। তুমি তোমার ভবিষ্যৎ না জেনেই মনগড়াভাবে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছো। অথচ, তোমার ভবিষ্যৎ তোমার মনোবাসনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণও হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে—তোমার সঙ্গে কোনো একদিন অনামিকার দেখা হবে। তোমাদের বিয়েও হতে পারে। কিন্তু তাই বলে ঝোঁকের বশে এভাবে আত্মহত্যা করাটা অনৈতিক ও বোকামি। এখন তুমিই ভেবে দেখো, তোমার কী করা উচিত। আর আমার শেষকথা: জীবনের পরিণতিসম্পর্কে আরও বেশি করে ভাবো। এতো তুচ্ছ বিষয়ের জন্য এই মহাজীবনকে এভাবে শেষ করার কথা কখনও ভেবো না। জীবনসম্পর্কে অত্যুচ্চ ধারণা পোষণ কর। আমাদের জীবনের পরিণতি যেন সৎভাবে, সত্য, সুন্দর ও মহাজীবনের পথে ধাবিত হয়—তা-ই আমাদের সবসময় ভাবতে হবে। আত্মহত্যার মতো পাপের পথ থেকে ফিরে আসো, যুবক। আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র মালিক মহান আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা ও ভরসা রাখো। আর আল্লাহর রহমত থেকে কখনও দূরে সরে যেয়ো না। আল্লাহর রহমত থেকে কখনো তোমার মুখটি ফিরায়ে নিয়ো না। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা তোমার।”
জামাল-স্যার চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ আসিফ বলে উঠলো, “স্যার, এছাড়া আমার আর-কিছু করার নাই।”
স্যার এবার যেন বাঘের মতো গর্জে উঠলেন। আর বললেন, “তোমার স্পর্ধা কত! তুমি আত্মহত্যা করতে চাও! তুমি তো স্বার্থপর বেঈমান। শুধু নিজের স্বার্থে আত্মহত্যা করে সুখ পেতে চাও। আর সংগ্রামমুখর জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চাও। কিন্তু যে পিতামাতা তোমাকে অনেক সুখের জন্য লালনপালন করেছেন, তোমাকে বড় মানুষরূপে খুব দেখতে চান, তুমি তাদের কথা একবারও ভাবছো না।! কতটা নরাধম তুমি হয়েছো! আরে, সামান্য একটা মেয়ের জন্য কেউ আত্মহত্যা করে নাকি? তুমি জীবন দিবে ভালো কথা। তবে দেশের জন্য জীবন দাও। জাতির পক্ষে জীবনবাজি রাখো। আর মানুষ ও মানবতার স্বার্থে তোমার এই অমূল্য জীবনকে বিসর্জন দাও। কিন্তু তাই বলে একটা মেয়ের জন্য এভাবে কেউ কখনো জীবন দিতে পারে? এগুলো গাধাদের কাজ। তুমি তো ভালো ছাত্র। তোমার জীবন কেন এভাবে নিঃশেষিত হবে? এই মহাজীবনের মূল্য উপলব্ধি করতে শেখো। আগে নিজেকে ভালোবাসতে শেখো। তারপর অন্যকে ভালোবাসবে। আর যে নিজেকে ভালোবাসতে পারে না—সে কখনো কাউকে ভালোবাসতে জানে না। তোমার আবেগ ও যাবতীয় প্রাক্ষোভিক চেতনা এখনই নিয়ন্ত্রণ করো। এই জীবন বড় মধুর ও সুন্দর। তুমি বেঁচে থাকলে একদিন-না-একদিন তোমার অনামিকার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু এভাবে মূর্খের মতো জীবনবিসর্জন দিলে তাতে তোমার বা অনামিকার কী লাভ বলো? আর অনামিকা যদি তোমাকে ভালোবাসে সেও তোমার এই আত্মহননকে একদিন ঘৃণা করবে। সে তো তোমাকে পেতে চাইবে। কিছু আবেগ, কিছু জেদ আর কিছু তুচ্ছবিষয়ে দুঃখের বশবর্তী হয়ে এই মহাজীবনকে নরকযন্ত্রণার পথে ধাবিত কোরো না। ভালো থেকো বাবা। বেঁচে থাকো দীর্ঘকাল। চেয়ে দেখো, পৃথিবী এখনও কত সুন্দর! তুমি কি জানো না—আর ক’দিন পরেই ফুটবে ভালোবাসার কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া। আরও কত নাম-না-জানা ফুল। ফাল্গুন আসছে পৃথিবীতে। আর তুমি চলে যাবে সব ফেলে? পৃথিবীর এত-এত শোভা রেখে তুমি কেন মরবে যুবক? ভুল করে তুমি কেন মরবে যুবক?”

কথাগুলো শেষ করে জামাল-স্যার বীরদর্পে বেরিয়ে গেলেন ভিড় ঠেলে। তিনি কোনোদিকে না তাকিয়ে শুধু সামনের দিকে হাঁটতে লাগলেন।
সবার মনে হলো: তিনি যেন একজন ফেরেশতা! তাইতো আসিফকে দেখিয়ে গেলেন মহাজীবনের পথ।

পুরা কলেজ আসিফের চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সে মাথানিচু করে কী যেন ভাবছে। আত্মহত্যা করার আগে তাকে আরও ভাবতে হবে। নাকি সেও ভাবছে মহাজীবনের কথা?

পুনশ্চ: জীবনের মানে কী—তা আসিফ আজও ভালোভাবে জানে না। তবে সে এসব এখন জানার চেষ্টা করছে। অনামিকার কথা সে এখন একটু কম ভাবে। আর সে-সব ভাবতে গেলে তার মাথাটা সবসময় ঝিমঝিম করে। তাই, সে দিনের বেশিরভাগ সময় বাসার বারান্দায় বসে বই পড়ে কাটায়। বই পড়তে তার এখন খুব ভালো লাগে। জামাল-স্যারের সংস্পর্শে থেকে সে দিনে-দিনে সাহিত্যবিষয়ক বই পড়তে শিখেছে। সাহিত্যের প্রিয় বইগুলো তার কাছে জামাল-স্যারের মতো মনে হয়। একটা বই পড়া শেষ হতে-না-হতেই সে জামাল-স্যারের কাছে গিয়ে আরেকটি নতুন বইয়ের নাম জেনে তা কিনে তবেই বাসায় ফেরে।
সে কৃতিত্বের সঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে। পছন্দমতো একটা বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হওয়ার জন্য সে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবখানে তার অভিভাবক হয়ে কাজ করছেন জামাল-স্যার। তাঁর নির্দেশনায় আসিফ ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে একজন মানুষের মতো মানুষ হতে চায়।
যদি কারও হাতে কখনো একটুখানি সময় হয়—তবে সে যেন যায় মির্জাপুরে আব্দুল জলিল মির্জার বাড়িতে। গিয়ে দেখবে, সেখানে খুব সুন্দর একটা দ্বিতল-ভবনের বারান্দায় বসে সকাল-বিকাল একাগ্রচিত্তে বই পড়ছে মির্জা মোহাম্মদ আসিফউদ্দিন বাহার আসিফ। তার মনে এখন…। থাক, আর লিখে কাজ কী?

© সাইয়িদ রফিকুল হক
০৬/১১/২০১৮

হে যুবক, তুমি আত্মহত্যা কোরো না

null

আজ তুমি আত্মহত্যা কোরো না হে যুবক,
আগামীকাল পৃথিবী ভেসে যাবে চতুর্দশীর পূর্ণিমায়!
জোছনাঝরা রাতটুকু দেখবে না একবার তুমি?
তোমার চোখে বুঝি এখন ঘুম নামতে চাইছে!
তবে তুমি শুয়ে পড় কোকিল-ডাকা দিনের কথা ভেবে,
তোমার বুক ভরে উঠুক বকুল ফুলের পবিত্র সুবাসে।

তুমি আত্মহননের দুশ্চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে
আমার সঙ্গে চাঁদ-জোছনার শোভা দেখবে ফাঁকা মাঠে বসে,
তুমি যদি আরও কাছ থেকে জোছনা দেখতে চাও—
তবে তোমাকে ভালোবেসে নিয়ে যাবো নিশিদের বাড়ির ছাদে!
তবুও তুমি আত্মহত্যা কোরো নাকো, হে বুদ্ধিমান যুবক।
তোমার যদি কষ্ট খুব বেশি হয়ে থাকে তবে তার থেকে
আশি ভাগ কষ্ট এখনই আমাকে দিয়ে দাও,
পারলে তোমার সবটুকু কষ্ট আমার বুকে চাপিয়ে দাও,
আমি পাথরবক্ষে পৃথিবীর সব কষ্ট ধারণ করবো হাসিমুখে,
তবুও তুমি আত্মহত্যা কোরো নাকো, হে বুদ্ধিমান যুবক।

এখনও বসন্ত আসতে অনেক বাকি, শীতের আগমন সবে,
ঘুম থেকে জেগে কুয়াশাঢাকা সকাল দেখবে না তুমি?
শিশিরভেজা ঘাসগুলো তোমার পায়ের স্পর্শ যে
পেতে চাইবে প্রতিদিন নরম রোদেভাজা সকালে!
তাদের আমি কী বলে বুঝাবো? তুমি আমাকে বলে দাও,
শীতের প্রায় অবসানে আবার আসবে পাতা-ঝরার দিন!
আবার আসবে খুব রঙিন হয়ে পৃথিবীর আলো ঝলমলে বসন্ত,
তবুও কি তুমি মরতে চাও এই সোনাঝরা পৃথিবীতে?
আর তুমি আত্মহত্যার কথা ভেবো না হে যুবক,
কেউ ভালোবাসুক-না-বাসুক, এই পৃথিবী তোমাকে ভালোবাসে।

বুকের ভিতরে দিনে-দিনে খুব কষ্ট জমেছে তোমার,
তাই কী হয়েছে বন্ধু? তুমি ভেঙে ফেল কষ্টের বিশাল পাহাড়,
কেউ তোমার ভালোবাসার স্বপ্নচুরি করেছে? তাই কী হয়েছে বন্ধু?
তুমি দুনিয়ার সব স্বপ্নচোরের সঙ্গ ত্যাগ করে এসো আমার সঙ্গে,
আমরা দুজন পাহাড়তলীর সবুজ ঘাসে বসে শুনবো ঝর্নার গান,
পাখির মনমাতানো কলতানে মুগ্ধ হয়ে ডুবে যাবো নতুন স্বপ্নে,
আর পৃথিবীতে আবার কত জোছনা ঝরবে ভালোবেসে হাসিমুখে,
এমন স্বর্গ ছেড়ে মিথ্যাঅভিমানে তুমি কোথায় যাবে বন্ধু?
আজ তুমি আত্মহত্যা কোরো না হে অভিমানী যুবক,
এই পৃথিবীর কেউ তোমাকে ভালোবাসুক-না-বাসুক
পৃথিবী কিন্তু তোমাকে পরম মমতায় আগের মতো ভালোবাসে।
তুমি ফিরে আসো যুবক ভালোবাসার বেঁচে থাকার চিরসবুজ স্বপ্নে,
তুমি কেন মরবে তোমার কষ্টের কারণ পাপীদের পথের কাঁটা হয়ে?
তারচেয়ে বন্ধু, এসো হাসিমুখে ভেসে যাই দুজনে নীলজোছনায়,
আগামীকাল হেসে উঠবে আমাদের পৃথিবী চতুর্দশীর পূর্ণিমায়!

সাইয়িদ রফিকুল হক
৩১/০১/২০১৯

ছোটগল্প: আফসারের চোখে জল

আফসার বাসস্ট্যান্ডে এসে আজ বড় ভাবনায় পড়ে গেল।
বাসে আজ খুব ভিড়। তার কাছে রাস্তায় আজ লোকজনের উপস্থিতি একটু যেন বেশি মনে হচ্ছে।
এদিকে অফিস-টাইম প্রায় হয়ে গেছে। আর-একটু দেরি করলে আজ তাকে নির্ঘাত বসের কড়াধমক কিংবা নিদেনপক্ষে কটুকথা শুনতে হবে।
সে দেখলো, একটা মিনিবাস আসছে। সে যেন চোখের সামনে হঠাৎই আশার আলো দেখতে পায়। বাসটা কাছে আসতেই সে তাতে ওঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। লোকজনের ঠেলায় তার গোরস্থানে কিংবা শ্মশানে যাওয়ার অবস্থা।
সে বুঝলো, আজকাল বাসে চড়তে হলেও একজন মল্লযোদ্ধা হতে হবে। আর নয়তো একজন সাধারণ কুস্তিগীর হওয়া চাই। নইলে, এই ঢাকা-শহরের বাসে চড়া ভয়ানক কষ্টের ব্যাপার।
এরপর এলো একটা সিটিংচিটিং-বাস। এখানেও মারাত্মক ভিড়। তাই, সে আগে থেকে অন্য গাড়ির তুলনায় এখানকার জন্য বেশি টাকা দিয়ে একখানা টিকিট কিনে ফেললো। তারপর সে নেমে পড়লো বাসে চড়ার প্রতিযোগিতায়।
টিকিট কেটেও আজকাল লোকজনের কোনো স্বস্তি নাই। সবখানে এখন কেবল ফাঁকি, অনিয়ম আর দুর্নীতি। ঢাকা-শহরের সিটিংচিটিং-বাসগুলো দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রতারক। এদের কোনো চরিত্র নাই—মনুষ্যত্ব নাই। এমনকি ধর্মও নাই। এরা জানোয়ার। তাই, এরা শুধু অর্থই চেনে। লোকজনের সঙ্গে আফসারও বাসে ওঠার চেষ্টা করছে। মানুষজন বাসে উঠছে। তারপরও এরা ঠিকভাবে যাত্রী না উঠিয়ে গাড়ি টানতে থাকে। প্রতিনিয়ত ইচ্ছাকৃতভাবে এরা যেন মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। আর সকালবেলার গাড়িগুলোতে এরা বেশি লোক নেওয়ার জন্য কৃত্রিমভাবে বাস-সংকটসৃষ্টি করে। এসবকিছু দেখেশুনে তাই আফসারের মনে হলো—দেশের পরিবহণ-সেক্টর এখন পশুদের হাতে।

সে লোকের ভিড় ঠেলে কোনোরকমে এই বাসটার গেটের কাছে একটু দাঁড়ানোর জায়গা পেলো। কিন্তু আর ভিতরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। তবে এটুকুতেই এখনকার মতো খুশি হয়েছে আফসার। সে সবসময় অল্পে তুষ্ট।
সে দেখলো, বাসের ভিতরে এখনও কিছু জায়গা আছে। কিন্তু গেটের একটু উপরে একটা জায়গায় দুনিয়ার লোকের ভিড় যেন! এই জায়গাটাতে এতো ভিড় কেন? সে কোনোরকমে ফাঁকফোঁকড় গলিয়ে আরও দেখলো, এখানে একটা সিটে বসা নিয়ে কয়েকটা লোকের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে। আর কে কার আগে বসবে—তারই দুর্বিনীত আয়োজন। একজন বয়স্কলোক কতিপয় জওয়ানের মারমুখীভাব দেখে পিছু হটতে লাগলেন।
আফসারের তখন মনে হলো: আহারে! এই লোকটাতো একজন মুক্তিযোদ্ধাও হতে পারে! আমরা কি তার কথাটা একটু ভাবতে পারি না?
কিন্তু এখন কে ভাবে কার কথা? গায়ের জোরে একটা ছোকরাবয়সী ছেলে সবাইকে প্রায় ঠেলেঠুলে নিজের দখল করা সিটটাতে বসে পড়লো। আর তার মুখে সে কী বিজয়ের হাসি! তার হাবভাব দেখে মনে হলো—সে যেন এইমুহূর্তে ভারতবর্ষ-জয় করেছে!

আফসার এসব দেখে ভিতরে-ভিতরে যেন লজ্জায় মরে যাচ্ছিলো। সে এতোক্ষণ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে এসব তামাশাই দেখছিলো। আর ভাবছিলো—মাত্র কিছুদিন আগে—১৯৭১ সালে, এই দেশটার জন্য ৩০লক্ষ মানুষ অকাতরচিত্তে জীবন দিয়েছেন। তাঁদের আত্মত্যাগের কথা ভাবলে আনন্দে আফসারের চোখে জল আসে। তাঁরা কী নিঃস্বার্থ আর কী মানবদরদী ছিলেন! কী পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী মহামানব ছিলেন আমাদের চিরগর্বের একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা! আর আজ আমরা সামান্য একটা বাসের সিটের জন্য সকলপ্রকার নীতিনৈতিকতা হারিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করে চলেছি। এটা তো মানুষ আর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আর মারাত্মক সীমালংঘন! এই জাতি এই দেশ কীভাবে বড় হবে?
লোকজনের মধ্যে এখন ত্যাগের মহিমা কমে যাচ্ছে। সামান্য একটা বাসের সিটের জন্য, আর বাসের সিটে কে কার আগে বসবে—কিছুলোক তা-ই ভাবছে! এরা কতটা নির্লজ্জ আর কী ভয়ংকর অসভ্য হয়ে উঠছে—তা হয়তো এরা এখনও বুঝতে পারছে না। সামান্য একটা বাসের সিটের জন্য এরা আজ নিজেদের মনুষ্যত্ব পর্যন্ত বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করছে না। এরা, একটা বাসে চড়া নারী, শিশু, বৃদ্ধ, পঙ্গু ও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা তো কেউ ভাবছে না! সবাই শুধু এখন ঠেলাঠেলিতে ব্যস্ত! এই কি স্বাধীনদেশে আমাদের মনুষ্যত্ব?
ভাবতে-ভাবতে আফসারের যেন চোখ ফেটে জল আসবে! এমনই একটা অবস্থা তার। সে মানুষের অধঃপতন দেখলে শিউরে ওঠে। মানুষের প্রতি দানবীয় আচরণ দেখে সে শিহরিত হয়। আর তার চোখে জল চলে আসে। সে মানবাত্মার পরাজয় দেখতে পারে না। সহ্য করতে পারে না। মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে তার চোখে জল আসে।

সে ড্রাইভারের পিছনে বাসের ডানদিকে পর-পর তিনটি আসনজুড়ে লালকালিতে লেখা দেখলো—এই নয়টি সিট—মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত! কিন্তু সেখানেও বসে আছে একশ্রেণীর বেশরম, অসভ্য ও দাঁতাল পুরুষ। এদের, মেয়েদের সিট ছেড়ে উঠতে বললেও এরা ওঠে না। বরং এরা আরও নির্লজ্জ হয়ে গায়ের জোরে নানারকম কুৎসিত যুক্তিপ্রয়োগ করার অপচেষ্টা করে থাকে।
এসব দেখে-দেখে আর ভেবে-ভেবে আফসারের চোখে সত্যি-সত্যি একসময় জল এসে গেল। তার বুকটা ফেটে যেন অমনি একটা দীর্ঘঃশ্বাস বেরিয়ে এলো—আজও আমরা মানুষের মতো মানুষ হতে পারলাম না। শুধু একেকটা পোশাকি মানুষ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি! এখানে, মানুষ কোথায়? আর আজ আমাদের মনুষ্যত্বই বা কোথায়?
সে যখন আপনমনে এসব ভাবছিলো, তখনও বুঝতে পারেনি, সামনে তার জন্য এরচেয়ে বড় ঘটনা ও চমক অপেক্ষা করছে।

বাসে ওঠা ও নামার সময় চাপাচাপিটা একটু বেশি হয়। এইসময় চরদখলকারীদের মতো বাসের সিটদখলকারীরা খুব বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
একটা লোক কলাবাগানের কাছে নামবেন। সেজন্য তিনি আগেভাগে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাসে ওঠার মতো নামার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিরাট ঝক্কিঝামেলা। লোকটা উঠে সামান্য দাঁড়ালেন। এমন সময় তার সিটটা দখল করার জন্য কয়েকটা লোক মল্লযুদ্ধে নেমে পড়লো। এদের হাবভাব দেখে আফসারের মনে হলো—এইমাত্র যেন পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল!
সে কারণটা বুঝলো আর-একটু পরে। এখানে, পাশাপাশি দুজন রমণী বসে রয়েছেন। তাদের পাশের এই সিটটা দখল করার জন্যই একদল অমানুষ তার চোখের সামনেই মল্লযুদ্ধ শুরু করে দিলো। সে দেখলো, এখানেও কয়েকজন বয়স্কলোককে পাশ কাটিয়ে তাদের ঠেলেঠুলে কোণঠাসা করে এক কর্পোরেট অফিসের হোমরাচোমরাগোছের একটা সেখানে বসে পড়লো।
তার বুকটা আবার ভরে উঠলো হতাশায়।
সে গেটের কাছের বাসের হ্যান্ডেলটা ধরে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে—এই লোকগুলো মানুষ হয়েই আজ এতো হিংস্র আর আগ্রাসী! এরা যদি নামকাওয়াস্তে মানুষ না হয়ে বনের হিংস্র নেকড়ে কিংবা হায়েনা হতো—তাইলে এদের নৃশংসতায় পৃথিবীতে বুঝি কোনো প্রাণিই বাঁচতে পারতো না।

আফসার ধীরে ধীরে বাসের মাঝামাঝি একটা জায়গায় ঠাঁই পেলো। এখনও বাসে অনেক ভিড়। তবুও এখানে দাঁড়িয়ে তার এখন কিছুটা ভালো লাগছে।
সায়েন্স-ল্যাবের কাছে এসে কয়েকজন যাত্রী নামলো। আর উঠলোও আরও কয়েকজন।
এক মহিলাযাত্রী বাসে উঠেই তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সিটগুলোতে বসে থাকা পুরুষদের দিকে চেয়ে ভদ্রভাবে বললেন, “ভাই, এগুলোতো লেডিস-সিট। দয়া করে সিট ছেড়ে দিন।”
মহিলাসিটে বসা লোকগুলো তার কথা শুনে পরস্পর মুখচাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। যেন কেউ তার ভাষা বুঝতে পারছে না। তারা একেবারে ভাবলেশহীন। আর কেউ সিট ছাড়ার নাম করে না। একটা লোক সিটে এমনভাবে বসে রইলো যে, সে যেন বিবাহের যৌতুক হিসাবে শ্বশুরবাড়ি থেকে এটি পেয়েছে!
এসব দেখে অনেকের মাথা ঠিক থাকে না। দুই-চারজন প্রতিবাদী সবজায়গায় দাঁড়িয়ে যায়।
আফসারের পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক এই অবস্থাটা দেখে মহিলাসিটে বসা লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে একটু জোরের সঙ্গে বললেন, “ভাই, আপনারা মহিলাসিটগুলো ছাড়েন না কেন? আপনারা কি সোজা কথাটাও বুঝতে পারেন না?”
কথাটা শোনার পর কারও কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। হঠাৎ আফসারের সামনের সিটে বসা মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান এক লোক বলে উঠলো, “কীসের সিট ছাড়বে? বাসের সিটে যে যেমন বসতে পারে। মহিলারা যখন আমাদের সিটে বসে থাকে তখন কিছু হয় না! কিছু লোকজন না বুঝেই আজকাল মহিলাদের পক্ষে দালালি করে।”
কথাটা ভয়ানক অশ্লীল এবং সামাজিক পরিবেশে শিষ্টাচারবহির্ভূত।
আফসার বুঝলো, বাসে এখন শূয়রও চড়ে! তার ইচ্ছে করছিলো, এই লোকটাকে এখানে, এইমুহূর্তে জুতাপেটা করতে। কিন্তু বাসের পরিবেশবিনষ্ট হতে পারে ভেবে সে নিজের ক্রোধসংবরণ করলো।
মহিলাদের পক্ষে কথা বলা সেই ভদ্রলোক এতে মনে খারাপ না করে তার কথার জবাবে অশ্লীলকথা বলা সেই লোকটিকে খুব আস্তে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কী করেন?”
লোকটি তখন খেঁকিয়ে উঠলো, “কী করি মানে? আমি বিদেশে থাকি।”
ভদ্রলোক বললেন, “কোন দেশে?”
সেই খেঁকিয়ে ওঠা আবার বললো, “মিডল ঈস্টে!”
তখন সেই প্রতিবাদকারী ভদ্রলোক আফসারের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, “বুঝলাম। এগুলো মিডল ঈস্টের পশু! এখনও মানুষ হয়নি।”
আফসার এইসময় ভদ্রলোককে সমবেদনা জানানোর জন্য বললো, “এরা মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করতে গিয়ে শুধু পয়সাটাই চিনেছে। মুনষ্যত্ব চেনেনি। আর আরবদেশে নারীদের সম্মান করাটা ওদের সিস্টেমের বাইরে! এজন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা লোকগুলো এরকম চাঁছাছোলা ও অভদ্র হয়ে থাকে।”
বাসে আরও কিছুসংখ্যক লোক মানবিক কারণে মহিলাদের সিটগুলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য ওই বসা লোকগুলোকে অনুরোধ করলো। কিন্তু মহিলাদের সিটগুলো জবরদখলকারীদের মনে এতে কোনো প্রতিক্রিয়াসৃষ্টি হলো না। এদের কেউই দখলকৃত সিটগুলো ছেড়ে উঠলো না। মধ্যপ্রাচ্যের ওই শ্রমিকের মতো আরও কিছু লোক এদের সমর্থনও করলো!
আফসার ক্ষুব্ধমনে ভাবলো, এই শূয়রগুলোকে বাসে ওঠার পারমিশন দিয়েছে কে?

অনেক যুদ্ধের পর আফসার ঠিকসময়েই অফিসে পৌঁছুতে পারলো।
সে অফিসে ঢুকে দেখলো, তার পাশের টেবিলে তারচেয়ে বয়সে অনেক সিনিয়র গুলজারসাহেব এখনও আসেননি। তার জন্য আফসারের খুব মায়া হলো। আর তার মনটা কেমন যেন করতে লাগলো।
লোকটা তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। হয়তো বাসের জন্য তিনি এখনও রাস্তায় যুদ্ধ করছেন।

আফসার যখন গুলজারসাহেবের কথা ভাবছিলো—তখন তিনি এসে অফিসে ঢুকলেন। এতে আফসারের মনটা আনন্দে ভরে উঠলো।
সে ভাবলো, যাক, ভদ্রলোক হয়তো আজ বেঁচে যাবেন। মাত্র দশ মিনিট লেট হয়েছে তার।

আফসার অফিসের কাজ শুরু করার আগে লক্ষ্য করলো, তাদের সিনিয়র-অফিসার তরুণী-সুন্দরী মাহজাবিন রশিদ এখনও অফিসে এসে পৌঁছায়নি। ইদানীং সে নিয়মিত দেরি করে অফিসে আসে। কিন্তু এতে তার অফিসিয়ালি কোনো সমস্যা হয় না। সমস্যা যতো তাদের। তারা দিনরাত খেটে মরলেও তাদের দোষ। আর তাদের কাজেকর্মে একটু পান থেকে চুন খসলে অমনি বসদের নানারকম নীতিকথা শুরু হয়ে যায়। দেশটা যে রসাতলে যেতে বসেছে তাতে আফসারের মনে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু তার খুব দুঃখ হয়—এটা যে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ! এতো মানুষের আত্মত্যাগ কখনও বৃথা যেতে পারে না। কবে ঘুরে দাঁড়াবে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা?
মাহজাবিন এখনও আসেনি। আফসার আজ এটা খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করতে থাকে। চল্লিশ মিনিট পার হওয়ার পরও সে এলো না।
আফসার এবার নিজের কাজে মন দিলো। সে কাজের মাঝে ডুবে যেতে চাইলো। কিন্তু বাসের লোকগুলোর কথা মনে পড়তেই তার মনটা কেমন যেন তিতা হয়ে গেল! তবুও সে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজে মন বসালো।

আফসার নিজের কাজ করছিলো। এমন সময় সে দেখলো, এমডি’র খাসপিয়ন এসে গুলজারসাহেবের কাছে খুব আস্তে কী যেন বললো। আর অমনি গুলজারসাহেব উঠে তার পিছনে বেরিয়ে গেলেন।

ঘণ্টাখানেক পরে মাহজাবিন খুব স্টাইল করে কড়া পারফিউম ছড়িয়ে অফিসে এসে ঢুকলো। এইসময় প্রায় সবাই তাকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। মেয়েটির যৌবন ভূমিকম্পের মতো! যেন সে এখনই একটিমাত্র কম্পনে দুনিয়ার সবকিছু লণ্ডভণ্ড ও তছনছ করে দিবে!
আফসার বুঝতে পারলো, অফিসে কারও-কারও কাছে তার কেন এতো কদর!
সে আবার কাজে মন বসালো। মাহজাবিনের যৌবন তার হৃদয়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করতে পারেনি। এজন্য সে নিজেকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালো। তারপর আফসার তার ডানপাশে চেয়ে দেখলো, গুলজারসাহেব এখনও আসেননি। সে কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেল। হঠাৎ তিনি গেলেন কোথায়?

একটু পরে খুব মনমরা হয়ে গুলজারসাহেব প্রায় ছলছল চোখে তার পাশে এসে বসলেন।
আফসার সঙ্গে-সঙ্গে হাতের কাজ ফেলে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো, “কোথায় গিয়েছিলেন? আর কী হয়েছে আপনার?”
গুলজারসাহেব বাঁহাতে চোখদুটো মুছে বললেন, “আজ অফিসে আসতে একটু লেট হয়েছে। বস আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন। আর তার রুমে ডেকে খুব খারাপ ভাষায় আমাকে ধমকালেন।”
তারপর তিনি আরও মনখারাপ করে আফসারের দিকে চেয়ে বললেন, “আমি কি রোজ-রোজ দেরি করে আসি! আপনিই বলুন তো!”
কথাটা বলে তিনি শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন।
আফসার নিজেও ছলছল চোখে তাকে সান্ত্বনা জানালো।
আজ সে আরেকবার বিধ্বস্ত হলো। এবার সে যেন ভেঙে পড়লো। সে ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। মানবতা ও ন্যায়বিচার কি দেশ থেকে উঠে যাচ্ছে নাকি? আফসারের মনটা একসময় বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এইমুহূর্তে দুনিয়ার সমস্ত অনিয়ম ও ভণ্ডামি তার ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো।

একটু পরে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় আফসার দেখলো, মাহজাবিন রশিদ তাদের বসের কাচের দেওয়ালঘেরা রুমের মধ্যে বসে বসের সঙ্গে কী-সব আলাপ করছে, কথা বলছে, আর খুব হাসছে! আর সে কেবলই হাসতে-হাসতে একেবারে লুটিয়ে পড়ছে। আর তার সামনে রয়েছে ধূমায়িত কফির মগ! দুজনে একসঙ্গে কফি-মগে চুমুক দিয়ে কী অপূর্ব স্বাদ অনুভব করছে!

মাহজাবিনের যৌবন তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তার যৌবনঝড়ে লণ্ডভণ্ড তার বড়কর্তা।

আর এপাশে একজন সৎ, বিশ্বস্ত ও আদর্শবান অধস্তন কর্মচারী আজ একটু বিলম্বে অফিসে এসেছে বলে তাকে জঘন্য ভাষায় তিরস্কার করেছে তারই ছেলের বয়সী, ছোকরাবয়সী একটা এমডি। তিনি মনঃকষ্টে শিশুর মতো কেঁদেছেন। হয়তো ভিতরে-ভিতরে এখনও গুমরে-গুমরে মরছেন!

আফসারের দিনভর কেবলই মনে হলো—গুলজারসাহেব এই ছোকরা-বসের পিতার বয়সী একজন মানুষ। তবুও তাকে লাঞ্ছিত করতে তার বুকে বাধলো না! সমাজটা এখন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!
একসময় আফসারের চোখ ফেটে যেন জল এলো।
হ্যাঁ, আফসার এখন কাঁদছে। তার চোখে জল।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১৯/১২/২০১৭

নিজের মুখে ঝাল খাও

পরের চোখে স্বপ্ন দেখে
হচ্ছো কেন গাধা?
আপনমনে স্বপ্ন দেখো
দিচ্ছে কেহ বাধা?

পরের মুখে ঝাল খেয়ো না
ঝাল যে বড় তিতা!
নিজের মুখে ঝাল খেয়ে যাও
জুটবে অনেক মিতা।

পরের দেখা স্বপ্ন কিনে
হবে তোমার পতন,
এবার থেকে স্বপ্ন দেখো
শুধু নিজের মতন।

হুজুগ দেখে মজবে কেন
তুমি যুগের ছেলে!
নিজের মতো স্বপ্ন দেখে
ওড়ো ডানা মেলে।

বুদ্ধি-বিবেক খোলা রেখে
খাবে নিজের মুখে,
পরের মুখে ঝাল খেয়ো না
থাকবে চিরসুখে।

সাইয়িদ রফিকুল হক
২৩/০৩/২০১৮

কবিতা সবার জন্য ভালোবাসার প্রস্ফুটিত ফুল

কবিতা হচ্ছে ভালোবাসার প্রস্ফুটিত ফুল। সাহিত্যকাননের সর্বাপেক্ষা সুন্দর ফুল কবিতা। আর সাহিত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী শাখাও কবিতা। বস্তুতঃ পৃথিবীতে আগে শুধু কবিতাই ছিল। পৃথিবীর সবকিছু তখন কবিতার মতোই সুন্দর ছিল। আর তখন সবকিছু কবিতার ভাষায় লিপিবদ্ধ হতো। মানুষ ছন্দে-ছন্দে কথা বলতে ও শুনতে ভালোবাসতো। রাজদরবারে শোভা পেতেন বড়-বড় কবি। তারা মনের আনন্দে কবিতা-রচনা করতেন। মানুষ তখন কবিতাই চিনতো। মানুষ তখন কবিতাই ভালোবাসতো। মানুষ তখন কবিতাই পড়তো। আর এই কবিতা ভালোবেসেই মানুষ রচনা করে গান। আজকের গীতিকবিতাও এই কবিতারই দান। সবখানে শুধু কবিতা। সেই সময় পৃথিবী ছিল কবিতাময়! সেকালে অনেক ধর্মগ্রন্থও কবিতার ভাষায় রচিত হয়েছে। তাও যাকে বলে একেবারে সঙ্গীতধর্মী-কবিতা। প্রমাণস্বরূপ পড়ে দেখতে পারেন প্রাচীনধর্মগ্রন্থ ‘যাবুর’।

বলছিলাম, প্রাচীনকালে মানুষ শুধু কবিতাই লিখতো। তখনকার সাহিত্য বলতে ছিল একমাত্র কবিতা। তখন মানুষ বৃহৎ কবিতাগ্রন্থরচনা করতো—বৃহৎ একটি কবিতা—বৃহৎ একটি কাহিনীকবিতা—যাকে বলা হতো কাব্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—বাল্মীকির ‘রামায়ণ’, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত ‘মহাভারত’, কাশীরাম দাসের অনূদিত ‘মহাভারত’, ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ আর কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’। প্রাচীনযুগের ধারাঅনুযায়ী মধ্যযুগেও রচিত হয়েছে বড়-বড় কাব্য। যেমন, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পদ্মাবতী ইত্যাদি। আর এই মধ্যযুগেই মুসলমান-কবিরা সৃষ্টি করলেন অনুপম গাঁথুনি ও সুরে ‘পুঁথিসাহিত্য’—এটাও কিন্তু কবিতার ভাষায়—আর তা ছন্দে-ছন্দে।

গদ্য এলো আধুনিকযুগে। আর তখনই সৃষ্টি হলো ‘ছোটগল্প’ আর ‘উপন্যাস’। আর এটি মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের বেশি জানার, বেশি পড়ার আর বেশি লেখার চিন্তাভাবনা থেকেই জন্ম নিলো গদ্য। আজ গদ্য সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ। মদীয় আলোচনা শুধু কবিতাকেন্দ্রিক।

কবিতা আজ অবধি সাহিত্য-নন্দনকাননের প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো অবিরাম গতিতে শুধুই সুবাস ছড়াচ্ছে। আর এই সুবাসে মোহিত হচ্ছে মানুষ—সর্বস্তরের পাঠক—আর কবিতাপ্রেমীপাঠকসমাজ।
কবিতার একটি শক্তি আছে—আর এই শক্তির দ্বারাই কবিতা তার পাঠকসমাজকে এখনও কবিতার মধ্যে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। আধুনিকযুগে বিলাসীমানুষের জীবনযাত্রায় কতরকমের ইলেকট্রনিক সামগ্রী! এর যন্ত্রণায় কবিতার মরে যাওয়ারই কথা! কিন্তু সকল আগ্রাসন মোকাবেলা করে কবিতা আজও নিজস্ব যোগ্যতায় ও শক্তিতে মানুষের মাঝে বেঁচে আছে—আর তা বেঁচে থাকবে চিরকাল।

কবিতার একটি নিজস্ব ভাষা রয়েছে। আর এই ভাষা সর্বসাধারণের মুখের ভাষার মতো নয়। এটি তার চেয়ে উন্নত ও শিল্পিত। আর এই ভাষাশৈলী আবিষ্কার করেছেন অগণিত কবি। পৃথিবীর সকল ভাষাই তার কবিদের কাছে ঋণী। কবি-লেখকরা যুগে-যুগে, সর্বকালে ভাষামাধুর্যের একমাত্র প্রতিনিধি ও নির্ভরযোগ্য আবিষ্কর্তা। তাঁদের হাতেই ভাষা পেয়েছে সৌন্দর্যবৃদ্ধির অতলীন স্পর্শ। আর কবিরা তাই সর্বকালে-সর্বদেশে ভাষার প্রকৃত-বন্ধু। কাজেকাজেই, আমরা যদি কায়মনোবাক্যে আমাদের ভাষাকে ভালোবাসি—তাহলে, সেইসঙ্গে আমাদের কবিদেরও ভালোবাসতে হবে। আর ভালোবাসতে হবে তাঁদের রচিত কাব্য ও গ্রন্থসমূহ।
কবিতার ভাষা একেবারে সাদামাটা বা অলংকারবিহীন হলে চলবে না। এখানে, একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, সাধারণ একজন স্ত্রীলোক কোনোপ্রকার গহনাপত্র পরলো না বা সামান্য গহনা পরলো, তাকে বেশি সুন্দর লাগবে? নাকি যে পরিমাণ মতো চমৎকার ডিজাইনের সব সোনার অলংকার পরলো তাকে? আপনিই বলুন কাকে? আর আপনার বিবেক কী বলে? নারীদেহ যেমন সোনাভরণে সুশ্রী হয়ে ওঠে, তেমনি সুষুমামণ্ডিত ভাষামাধুর্যে সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে কবিতাদেহ। আর এই কবিতাদেহকে নিয়মিত ভাষা-অলংকার দিয়েই সাজিয়েগুছিয়ে রাখতে হবে।
রমণী এমনি-এমনি সুন্দর হয় না। তার যোগ্য স্বামী তাকে সুন্দর আভরণে-ভূষণে সজ্জিত করে তোলে। তখন সে সবার চোখে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কবি স্বাধীন। আর তিনি ভাষারাজ্যের একজন সম্রাট। তার মধ্যে যেন কখনও ভাষাদীনতা বা ভাষাকার্পণ্য প্রকাশ না পায়। রমণীদেহের মতো কবিকে তার কবিতাদেহ ছন্দে, ভাবসম্পদে, চিত্তাকর্ষক-বিষয়বস্তুতে, নির্মাণ-সৌকর্যে ও সর্বোপরি ললিত-মাধুর্যে সাজিয়েগুছিয়ে তার পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। মনে চাইলেই একটাকিছু লিখে দিলেই তা কবিতা হয়ে যায় না। সাধারণ গদ্য লেখা সহজ। কিন্তু ছোটগল্প-রচনা করা অনেকের জন্যই তা একেবারে দুঃসাধ্য। কারণ, ছোটগল্পের ভাষাও যে কবিতার মতো! সবখানে প্রয়োজন কবিতার ভাষা—আর সবচেয়ে মূল্যবান এই কাব্যিকভাষা। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প কেন এতো জনপ্রিয়? কারণ, তিনি বাংলাভাষার শক্তিমান কবি। তাঁর হাতে কাব্যিকভাষা পেয়ে তাঁর রচিত ছোটগল্পগুলো যেন হয়ে উঠেছে একেকটি সুন্দর কবিতা।

আমরা যারা কবিতা-রচনা করছি, সর্বাগ্রে তাদের ভাষা ঠিক করতে হবে। ভাষাই হলো কবিতার মূল বা চালিকাশক্তি। আর ভাষাই হলো একজন কবির সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই, প্রয়োজনে কবিকে তার আগের ভাষা সংশোধন করতে হবে। কবিতার ভাষা হতে হবে কুমারীমেয়ের মতো আকর্ষণীয়। আর সুবোধ-সুন্দর বালকের মতো সুশ্রী।

কবিতার জন্য ছন্দের প্রয়োজন। আধুনিককালে বেশিরভাগ কবিই অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দে তাঁদের কবিতা বা কাব্য রচনা করেছেন। তবে উত্তর-আধুনিককালে অনেক কবিই ছন্দের বেড়াজাল ভেঙে গদ্যছন্দে কবিতানির্মাণ শুরু করেন। তাঁদের দেখাদেখি বর্তমানে গদ্যকবিতার সচল-প্রচলন ঘটেছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও গদ্যছন্দে কবিতা-রচনা করে গেছেন। তাঁর রচিত ‘পুনশ্চ’ ও ‘পত্রপুট’ নামক কবিতাগ্রন্থ দুটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তবে সেখানেও রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব একটি ছন্দ রয়েছে। তাই, ছন্দের ব্যাপারে একজন কবিকে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে।

কবিতায় ছন্দের চেয়েও জরুরি এর ভাবসম্পদ। আর এই ভাবসম্পদই হলো কবিতার মূলশক্তি। এর মধ্যে শক্তিশালী বক্তব্য থাকতে হবে। প্রত্যেক কবিতারই একটি বক্তব্য আছে। তবে সব কবিতার বক্তব্যই পাঠকের কাছে প্রাধান্য পায় না। আর সব কবির বক্তব্যই পাঠকের কাছে আবেদনসৃষ্টি করতে সক্ষম হয় না। একবার একজন বিশিষ্ট-কবি এক কথিত-কবির কবিতা-সমালোচনা করতে গিয়ে লিখলেন, “আপনার কবিতার বক্তব্য চমৎকার হয়েছে!” তিনি ঠিকই লিখেছেন। কিন্তু তখন সেই কথিত-কবি নামক অ-কবি ভয়ানক ক্রোধে লিখলেন, “আমি বক্তব্য দেইনি। আমি কবিতা লিখেছি!” মূর্খ আর কাকে বলে? কবিতার মধ্যে যে একটি বক্তব্য থাকে—তা এই অ-কবি মূর্খটি জানে না। এইজাতীয় মূর্খ যদি কাব্য-রচনায় নিয়োজিত হয়—তাহলে, কাব্যের ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার।

কবিকে হতে হবে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, উন্নতদৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ও ভাষাবিষয়ে দক্ষ। যাদের ভাষাজ্ঞান সীমিত ও দুর্বল—তারা কবি হবেন কীভাবে? আর কবিকে সারাজীবনের জন্য হতে হবে একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। কোনো সাম্প্রদায়িক অমানুষ কখনও কবি হতে পারবে না।

কবিতা সুগন্ধীফুলের মতো। আর কবিতার রয়েছে সুঘ্রাণ। এতে সর্বস্তরের পাঠক আমোদিত হয়ে থাকে। কিন্তু যে-ফুলের ঘ্রাণ নেই—সে ফুলে ভ্রমর বসে না, মধুমক্ষিকা সেখানে ছুটে যায় না। ভাষাহীন, শ্রীহীন ও রূপবিহীন শব্দের গাঁথুনি কখনও পাঠকের দৃষ্টিআকর্ষণ করতে সক্ষম হবে না। তাই, কবিতাকে সুগন্ধীফুলের মতো করে প্রস্ফুটিত করতে হবে। তাহলে, কবিতার সুঘ্রাণে আমোদিত ও বিমোহিত হয়ে পাঠকসমাজ একনিমিষে ছুটে আসবে কবিতার বিশাল সাম্রাজ্যে।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১০/০৬/২০১৬

তোমার হাতে গোলাপ দেখেও

তোমার হাতে গোলাপ থাকলেও ভয় পাই,
তোমার মনে ভালোবাসা দেখেও সন্দেহ তাই।
তোমার মনে গোলাপ ফোটে না
হাতে ফুল শুধুই অভিনয়,
তোমার সাথে ভালোবাসা করতে
তাইতো আমার এতো ভয়।
তোমার হাতে গোলাপ দেখেও আগের মতো
আর তো হই না শিহরিত,
তোমার মনে ভালোবাসা নাই যে
কথাটি ভেবে আর হই না বিস্মিত।
তোমার মনে ভালোবাসা জাগে না
চলছে শুধু অভিনয়ের পালা,
তোমার হাতে গোলাপ দেখে আজকে আমার
এই মনে বাড়ে আরও জ্বালা।
তোমার হাতে গোলাপ থাকলেও ভয় পাই,
তোমার মনে ভালোবাসা দেখেও সন্দেহ তাই।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
৩১/০৮/২০১৭

মানুষই শ্রেষ্ঠ ধর্ম—তাই মানবতাই হোক আমাদের সবার ধর্ম

পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় হলো মানুষ। আর মানুষই সবচেয়ে দামি। তাই, মানুষকে সবার উপরে স্থান দিয়ে তাঁকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে হবে। জীবনের একমাত্র অবলম্বন হিসাবে মানুষকেই প্রধান্য দিতে হবে। জীবনে-মরণে মানবহৃদযন্ত্রে একমাত্র মানুষকেই ধারণ করতে হবে। এই মানুষই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আর মানুষকে ভালোবাসলেই ধর্মপালন হয়ে যায়। এই মানবপ্রেমের চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নাই। মানবতাই মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম আর শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এর চেয়ে বড় কাজ আজ অবধি পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি।

আমার ধর্ম মানবতা। আর আপনার ধর্ম? আর আপনাদের? আশা করি সকলেই বলবেন: আমাদের ধর্ম মানবতা। আজকের দিনে মানবধর্মের চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নাই। আর এই যুগে এসে ধর্মের জন্য মানুষকে পর করে দেওয়া যে কতটা মূর্খের কাজ—তা একবার গভীরভাবে না ভাবলে আমাদের আজ আর চলবে না।

আপনি ধর্মপালন করবেন খুব ভালো কথা। সারাদিন আপনি ধর্মপালন করুন। কেউ আপনাকে বাধা দিবে না। আপনি নীরবে-নিভৃতে-একান্তমনে আপনার ধর্মসাধনা চালিয়ে যান। কিন্তু আপনি কোনো মানুষকে আঘাত করে আপনার ধর্মপালনের কাজ শুরু করবেন না। মানুষকে আঘাত করলে আপনার ধর্মই হবে না। আপনি ধর্মপালন করবেন কীভাবে? আর মানুষকে আঘাত করাটাই হলো এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অধর্ম।

সকল ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়। আর মানুষের চেয়ে পৃথিবীতে কোনো ধর্ম বড় নয়। মানুষ সবার সেরা। আর আপনি যে ধর্মের কথা বলেছেন তাও তো মানুষের জন্য। তবে আপনি কেন অন্যধর্মের বা যেকোনো মানুষকে আঘাত করে ধর্মপালন করতে চাইবেন? এটি অধর্মেরই নামান্তর। কাজেই, আপনি মানুষকে মেরে কখনও ধর্মপালন করতে পারবেন না। এতে ধর্মপালন হবে না। আর এতে শুধু অধর্মই বাড়বে।

আপনি আগে মানুষ হন পরে ধর্মপালন করতে আসবেন। এখন দেখি, অনেকেই ধর্ম না বুঝে এটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। শুনেছি, লেবু নাকি বেশি নাড়াচাড়া করলে বা কচলালে একেবারে তিতা হয়ে যায়। ঠিক তেমনিভাবে আজ একটি শ্রেণী ধর্মকে এতো বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে, আর এটি নিয়ে সীমাহীন নাড়াচাড়া করছে যে, এদের অত্যাচারে ধর্ম আজ তিক্ততার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এরা ধর্মকে সাধারণ মানুষের কাছে হাসির পাত্র করে তুলেছে। এদের জন্যেই মানুষ এখন ধর্মকে অশ্রদ্ধা করতে শুরু করেছে। আপনি যদি সত্যিকারের ধার্মিক হয়ে থাকেন—তাহলে ধর্ম নিয়ে বেশি চিৎকার ও চেঁচামেচি করবেন না। কারণ, এতে আপনার ধর্ম লোকসমাজে ঠুনকো হয়ে যাবে, আর হেয় প্রতিপন্ন হবে। আপনার ধর্মকে আপনি যদি সামান্য পরিমাণ ভালোবেসে থাকেন—তাহলে আজ থেকে আর ধর্ম নিয়ে এতো বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। আপনি ধর্মপালন করুন। আপনি আপনার ধর্মে একেবারে মশগুল হয়ে থাকুন। কে আপনাকে ধর্মপালনে বাধা দিচ্ছে? কিন্তু তাই বলে আপনার ধর্মকে আপনি অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করবেন না। এটি এই আধুনিকযুগের পৃথিবীর মানুষ মানবে না। এর ফল ভালো হবে না। এর ফল কখনও ভালো হয়নি। এই আধুনিকযুগে আপনি একজন মানবতাবাদী হয়ে উঠুন। আর সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন। দেখবেন, আপনি আপনার মনের অজান্তেই ধার্মিক মানুষে পরিণত হয়েছেন।

ধর্ম বাড়াবাড়ির জিনিস নয় কিংবা মাতামাতির কোনো বিষয়ও নয়। এটি নীরবে পালন করতে হয়। এটি আপনমনে সাধনা করতে হয়। আসলে, ধর্ম একেবারেই আপনমনে সাধনার জিনিস। আর
আপনি যদি ধার্মিক হয়েই থাকেন—তাহলে পৃথিবীর সকল ধর্মের ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন। এতে আপনার ও সকলের মঙ্গল হবে। আপনি যদি কারও ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চান কিংবা অবজ্ঞা করতে চান—তাহলে অন্যে আপনার ধর্মকেও অবজ্ঞার চোখে দেখতে শুরু করবে। এতে শুরু হবে ধর্ম নিয়ে সংঘাত। আর আপনি আপনার কদর্য ব্যবহারের দ্বারা নিজধর্মকে অপমান করলেন। আর পৃথিবীতে ধর্মের নামে অশান্তির বীজবপন করলেন। এই অপরাধ আপনার।

আপনি ধার্মিক হতে চাইলে সবার আগে মানুষকে ভালোবাসুন। মানুষকে অবজ্ঞা করে কেউ ধার্মিক তো দূরের কথা মানুষও হতে পারবে না। কারণ, মানুষ ধর্মের চেয়ে বড় সম্পদ।
আপনি যে-ধর্মেরই অনুসারী হন না কেন—আপনি সবার আগে সর্বধর্মের মানুষকে ভালোবাসুন। আর সকল ধর্মের উপরে মানুষ আর মানবতাকে স্থান দিন। তাহলে আপনি প্রকৃত ধার্মিক ও মানুষ হতে পারবেন।

পৃথিবীতে মানবতা শব্দটি এখনও টিকে আছে। কিন্তু মানবতা মানুষের মধ্যে কতখআানি রয়েছে তা আজ বিচার্য বিষয়। চারিদিকে এখন মানবতা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার দুঃসংবাদ শুনতে পাচ্ছি। আর মানুষের হাতেই এখন মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। মানুষ ধ্বংস করছে মানুষের শান্তির আবাসভূমি। এই মানুষ মানবতার মহাবাণী ভুলে লালনপালন করছে আর আশ্রয়প্রশ্রয় দিচ্ছে—মানবতাবিরোধী সাম্প্রদায়িকতাকে, ধর্মীয় উন্মাদনাকে, আর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রকে! এরচেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে?

মানুষের পৃথিবীতে মানুষের জন্য মানবতা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও জরুরি। কিন্তু কিছুসংখ্যক মানুষ এটি কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এরা ধর্মের নামে মানুষহত্যা করছে। এরা ধর্মের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ঘোষণা করে অসহায় মানুষকে হত্যা করছে। নারী ও শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করে পৃথিবীতে আরও বেশি পাশবিকতার জন্ম দিচ্ছে।

মনে রাখবেন: ধর্মের উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধি আর শ্বাশ্বত কল্যাণ। আর আপনি কী করলেন বা কী করছেন? আপনি জেনেশেুনে ধর্মের নামে মানুষহত্যা করছেন। আর এটিই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অধর্ম। আপনি ধর্মীয় উন্মাদনা বন্ধ করুন। মানুষকে ভালোবাসুন। আর সবার আগে মানুষকে ভালোবেসে মানবতাবাদী হন। আর এতে আপনি সত্যিকারের ধার্মিক হতে পারবেন। আর আপনি জোরেশোরে চেঁচিয়ে বলুন: আজ থেকে আমার ধর্ম মানবতা। আমি মানবতাবাদে বিশ্বাসী মানুষ। আমি মানুষকে ভালোবাসি। আর মানুষ ছাড়া আমার কোনো ধর্ম নাই। আজ থেকে মন্যুষত্বই হোক আমাদের পরম ও একমাত্র ধর্ম।

আপনার ধর্ম কিংবা ধর্মগুরু যদি আপনাকে সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গি হতে বলে—তাহলে, আপনি কালবিলম্ব না করে আজ-এক্ষুনি সেই ধর্মত্যাগ করুন। আর সেই মানবতাবিরোধী-বিধিবিধান আপনি স্বজ্ঞানে-সজ্ঞানে-স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করুন। ধর্ম মানে জীবনকে আরও সুন্দর করা। কিন্তু আপনার ধর্ম যদি আপনাকে আরও কুৎসিত কিংবা আরও অসুন্দর করে তোলে—তাহলে, আপনি সেই ধর্ম দিয়ে কী করবেন? আপনি ধর্মত্যাগ করুন। এতে আপনার ধর্ম ও সাধারণ মানুষজন উভয়ই রক্ষা পাবে। আপনি ধর্মের নামে কাউকে হত্যা করতে পারেন না। কারণ, ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়। আর ধর্মের চেয়ে মানুষকে বেশি ভালোবাসুন। এই পৃথিবীতে একমাত্র মানুষই আপনার আত্মীয়স্বজন। আপনার সমস্ত আপদেবিপদে একমাত্র মানুষই আপনার পাশে ছুটে আসবে। এক্ষেত্রে আপনার পাশে আপনি আর-কাউকে খুঁজে পাবেন না। তাই, ধর্মের চেয়ে আগে মানুষকে বেশি ভক্তি করতে শিখুন। আর ধর্মের জন্য কিংবা ধর্মগুরুর নির্দেশে আপনি মানুষহত্যা কেন করবেন? এতে আপনার কী লাভ? আপনার সবচেয়ে আপনজন কে? ধর্ম না মানুষ? অবশ্যই মানুষ। একমাত্র মানুষই আপনার পরমাত্মীয়। আর আপনি মূর্খের মতো সেই পরমাত্মীয়কে অবহেলা করে ধর্মের মতো একটি সাধারণ বিষয়কে মাথায় নিয়ে মানুষহত্যায় মেতে উঠবেন? এটি কোনো মানুষের কাজ নয়। আর এটি কোনো সভ্যসমাজের কোনো সভ্যমানুষের আচরণিক বৈশিষ্ট্য নয়। তাই, এইজাতীয় সমস্ত শয়তানী এখনই পরিত্যাগ করুন। আর জীবনে আরেকবার শুনে রাখুন: এই পৃথিবীতে সকল ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়। মানুষ বড়। আর মানুষ বড়। আজ তাই, এই পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে বড় আর-কিছু দেখছি না।

আপনার ধর্ম যদি আপনাকে বিপথগামী করে—তাহলে, আপনি নির্দ্বিধায় আপনার ধর্মের সেইসব অমানবিক বিধিবিধান পরিত্যাগ করে অতিসত্বর মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। মানুষই আপনার স্বজন। আর এখানেই আপনার মুক্তি মিলবে।

আপনাকে আমি অহেতুক ধর্মত্যাগ করতে বলছি না। কিন্তু আপনার ধর্ম কিংবা ধর্মগুরু যদি আপনাকে মানুষ হতে বাধা দেয়, আর জঙ্গি হতে সাহায্য করে—তবে আপনার ধর্ম রেখে লাভ কী? কারণ, ধর্মপালন করে শয়তান হওয়ার চেয়ে ধর্মত্যাগ করে মানুষ হওয়া অনেক ভালো। আপনি যদি ধার্মিক হতে চান—তবে আপনি আগে মানুষকে ভালোবাসুন। দেখবেন, এতে স্রষ্টা খুশি হয়ে আপনার দরজায় কড়া নেড়ে আপনার কুশল জিজ্ঞাসা করতে ছুটে আসবেন। এটাই ধর্ম। আর এটাই চিরসত্য। আর এটাই মানবতাধর্ম। আপনি সামান্য ধর্মের জন্য এই মানুষকে অস্বীকার না করে মানুষকে ভালোবাসুন। আর মনে রাখবেন: মানুষ আর মানবতাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আসুন, সবাই এই পবিত্র ধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করি।

আজ থেকে একমাত্র মানবতাই হোক আমাদের সবার ধর্ম।

জয় হোক মানবতার।
আর জয় হোক মনুষ্যত্বের।

সাইয়িদ রফিকুল হক
পূর্বরাজাবাজার, ঢাকা,
বাংলাদেশ।
১১/০৮/২০১৭

তোমার একটি চিঠির অপেক্ষায়

আজ কতদিন হলো!
তোমার একটি চিঠিও পেলাম না,
হয়তো বলবে, এই মোবাইলের যুগে
কেউ কখনও চিঠি লেখে?
কিন্তু আমার যে এখনও
তোমার চিঠি পড়তে খুব ভালো লাগে।

কতদিন হলো!
তোমার কোনো খবর জানি না,
বিছানার একপাশে অলসের মতো
সারাদিন শুয়ে থাকে
কত পরিচিত মোবাইলটা!
তবুও তোমাকে একদিনও
ফোন করতে ইচ্ছে করে না,
ফোন ধরতেও ইচ্ছে করে না।

আজকাল মোবাইল-ফোনে না
শুধু মিথ্যাকথার চালাচালি,
আমার এসব একটুও ভালো লাগে না।
তারচে আমার ভালো লাগে
তোমার রাত জেগে লেখা চিঠিগুলো
খুব যত্ন করে রাত জেগে পড়তে।

অনেকদিন তো হয়ে গেল!
তোমার একখানা চিঠি তবুও পেলাম না,
তোমার মনে এখনও ভালোবাসা আছে কিনা
জানি না, জানি না, জানি না।
আজ কতদিন হলো!
তোমার একটি চিঠির অপেক্ষায় বসে আছি,
আর শুধু একটি চিঠির অপেক্ষায় বসে আছি।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২০/০৮/২০১৭

ফুল ফোটে না হিংসার মনোভূমিতে

তোমার বুকের হিমশীতল গভীরে ফুল হয়ে ফুটতে চেয়েছিলাম। আর সুবাস ছড়াতে চেয়েছিলাম চিরদিন তোমার স্বপ্নের পৃথিবীতে। আমার সেই স্বপ্ন ঝরে গেছে অকালে শুধু তোমার ভুলে। তবুও তোমাকে কখনও ভুল বুঝিনি। আর আশায়-আশায় পার করেছি কত দিবস-রজনী।

ফুলের মালা হতে চাইনি, ছিঁড়ে যায় বলে। ফুল হতে চেয়েছিলাম তোমার মনের গভীরে। আর সুবাস ছড়াতে চেয়েছিলাম। আর শুধু ভালোবাসার ফুল ফোটাতে চেয়েছিলাম।

তোমার মনে ফুলের চাষ হয় না, তা আগে জানতাম না। ভুল করে তবুও সেখানে ফেলেছিলাম নাম-না-জানা কত সুগন্ধি ফুলের বিচি। তবুও ফুল ফোটেনি। হিংসাভূমিতে কখনও ফুল ফোটে না। জানলাম পরে, তোমার স্বপ্নের পৃথিবীটা ভরে আছে শুধু হিংসা-বীজে। সেখানে প্রতিনিয়ত জন্মাচ্ছে শুধু হিংসার বিষবৃক্ষ। তাই, সেখানে কখনও ফুটবে না ভালোবাসার ফুল।

তোমার মনে অনেক ব্যাধি। আর সেখানে হয়তো জমে আছে কোনো ভয়ানক কালব্যাধি। তাই, খুব সংগোপনে তোমার মনের গহীনে ঢুকে ফোটাতে চেয়েছিলাম সুগন্ধি ফুল। পৃথিবী অবাক করে দেওয়ার মতো ভালোবাসার ফুল।

পারিনি। আমি তোমার মনের গহীনে কোনো ফুল ফোটাতে পারিনি। কেউ পারে না, আর কেউ পারবে না হিংসার মনোভূমিতে ভালোবাসার একটি ফুলও ফোটাতে।

অনেক আশা, অনেক বিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে আবার নতুন করে পথ চলতে শুরু করেছি। এই জীবনে কখনও যদি খুঁজে পাই এমন কোনো পবিত্র হৃদয়ভূমি, সেখানে অনেক আশায় করবো ভালোবাসার চাষ। আর সেখানে ফুটবে আমার হাজার-হাজার সুগন্ধি ফুল হাসি মুখে। এমন একটি সুন্দর হৃদয়ভূমির জন্য বসে আছি অনেক আশায় বুক বেঁধে।

তোমার বুকের হিমশীতল গভীরে আর ফুটবে না ফুল। সেখানে এখন হিংসার বেশুমার আনাগোনা। আর সেখানে কখনও জাগবে না একটু ভালোবাসা।

ফুল ফোটে না হিংসার মনোভূমিতে।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২৩/০৭/২০১৭

শেখ মুজিবই বাংলার ইতিহাস

ইতিহাস কথা বলে
শেখ মুজিবের নামে,
ইতিহাসের পৃষ্ঠা ভরে যায়
শেখ মুজিবের নামে,
ইতিহাস সার্থক হয়
শেখ মুজিবের নামে,
ইতিহাস সত্য হয়ে ওঠে
শেখ মুজিবের নামে,
একাত্তরের সাতই মার্চ
শেখ মুজিবই ইতিহাস,
একাত্তরের সাতই মার্চ
বাঙালির মুক্তির ইতিহাস,
একাত্তরের সাতই মার্চ
বাঙালির স্বাধীনতায় বিশ্বাস।

ইতিহাস কথা বলে
শেখ মুজিবের নামে,
বাঙালির ইতিহাস জাগ্রত হয়
শেখ মুজিবের নামে,
মানুষের ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়
শেখ মুজিবের নামে,
বাংলাদেশের ইতিহাস সার্থক হয়
শেখ মুজিবের নামে,
বাংলাদেশ আজও ধন্য হয়
শেখ মুজিবের নামে।

ইতিহাস কথা বলে
শেখ মুজিবের নামে,
এই বাংলাদেশ জেগে ওঠে
শেখ মুজিবের নামে,
আজও দেখি তাই—
শেখ মুজিবই বাংলার ইতিহাস।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।

ঘাতক সরে যাও আমাদের পিতার সমাধি থেকে

ফুলে-ফুলে ঢেকে আছে
আজ পিতার সমাধি,
ফুলের ছড়াছড়ি চারপাশে,
শুধু ফুল আর ফুল
আজ আমাদের পিতার সমাধিতে!
আর ফুল হাতেই দাঁড়িয়ে আছে
এই বাংলার ঘাতক ক’জন,
ওরাও এসেছে পিতার সমাধিতে,
হোক না কুলাঙ্গার,
তবুও এসেছে পিতার সমাধিতে!

স্বার্থের বেড়াজালে আটকে পড়ে
কাঁপছে পাপীর দেহ থরথর,
ফুল হাতে এসেছে তবুও পিতার সমাধিতে,
অথচ পিতার ঘাতকদের সঙ্গে
সবসময় চলছে এদের ব্যবসায়িক লেনদেন!
এরা আমাদের জনকের নাম মুখে আনে
স্বার্থের নেশায়—আর অসংখ্য লোভে,
আমাদের জাতির জনকের স্বপ্নগুলো
মুছে দিতে চায় অচেনা প্রেমিকগুলো,
আর এরাই এখন ভিড় করেছে
আমাদের পিতার সমাধিস্থলে।

আমাদের জনকের জন্ম না হলে
আমরা পেতাম না নিজেদের পরিচিতি,
আর বিশ্ব থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতো
আমাদের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব,
আমাদের পিতা বাঙালির অস্তিত্বকে
বিশ্বে করেছেন সম্মানে সমাসীন,
তিনি আমাদের পিতা
তিনি আমাদের জাতির পিতা
নাম তাঁর শেখ মুজিব,
আর উপাধি আছে ‘জাতির জনক’ ‘বঙ্গবন্ধু’,
এশিয়া থেকে ইউরোপ তাঁকে কুর্নিশ করে
মহাসম্ভ্রমে আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসায়,
আফ্রিকা, আমেরিকার বিবেকগুলো
তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়ায় সসম্ভ্রমে,
আর সবাই বলে: জয় শেখ মুজিব,
আর জয় হোক বাঙালির।

আমাদের পিতা শুধু বাংলাদেশের,
আমাদের পিতা শুধুই বাঙালি-জাতির,
আমাদের পিতা শুধুই শোষিত-বঞ্চিত মানুষের,
আমাদের পিতা জন্মেছিলেন শুধু বাংলাদেশের জন্যে,
আর তোমরা পিতার নামে করছো
নিজেদের মহাসুখের স্বার্থ-আবাদ!
আজ তাঁর নামে দেশপ্রেমের অভিনয় করছে
মুখচেনা কিছু পাপী, আর কিছু সুবিধাবাদী,
সুবিধাবাদী-দালালগুলো ফুল হাতে আজ
সবার আগে-আগে যাচ্ছে
আমাদের পিতার সমাধিতে,
ওদের এখনই বের করে দাও
আমাদের জনকের সমাধিস্থল থেকে,
আর ওদের হাত থেকে তোমাদের প্রবল শক্তিতে
ওদের লোকদেখানো-মিথ্যাপ্রেমের ফুলের তোড়া
জোর করে কেড়ে নাও তোমরা,
আর জেগে ওঠো আজ বাংলার দেশপ্রেমিকেরা,
আর দেশবিরোধী ঘাতক সরে যাও
আমাদের পিতার সমাধি থেকে,
আর এখনই বেরিয়ে যাও তোমরা।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।

মানুষ-ভজো মানুষ

মানুষ-ভজো মানুষ
মানুষ-ভজলে মানুষ পাবে,
মানুষ-ভজলে স্রষ্টাও পাবে।

মানুষ-ভজো মানুষ
মানুষ-ভজলে পশুত্ব দূর হবে,
মানুষ-ভজলে তুমি মানুষ হবে।

মানুষ-ভজো মানুষ
মানুষ-ভজলে তুমি সুন্দর হবে,
মানুষ-ভজলে তুমি আবার মানুষ হবে।

মানুষ-ভজো মানুষ
মানুষ-ভজনা করলে তুমি সত্য হবে,
মানুষ-ভজনা করেই তুমি মানুষ হবে,
আর শুধু মানুষ-ভজনা করেই তুমি
মানুষ হতে পারবে।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২৯/০৭/২০১৭