তানভীর সিকদার এর সকল পোস্ট

তানভীর সিকদার সম্পর্কে

তানভীর সিকদার একজন তরুণ কবি, আবৃত্তি শিল্পী ও ছড়াকার। নিদারুণ বাচনভঙ্গিতে করা তাঁর আবৃত্তিতে দর্শকের হৃদয়ে মুগ্ধতা ছড়ায়। বয়সের হাঁড় বেশ শক্ত না হলেও শব্দের গাঁথুনি ঠিকই শক্ত। এরই মধ্যে দুইটি কাব্যগ্রন্থের লেখক তিনি।

কবিতা ‘পুরুষের কোনো সতীত্ব নেই’

তুমি বললে মা বাড়ীতে নেই, এসো গল্প করি-
অতঃপর: আমরা কাছে আসার নাম করে শরীর ছুঁলাম।
তোমার উষ্ঠের পাশে পুষ্পতুল্য তিলটি বাড়িয়ে দিয়েছিলো আমার চুম্বনের ইচ্ছেশক্তি।
বুঝতে পেরে লজ্জায় গ্রীবা বাঁকিয়ে অন্যদিকে চোখ ফেরালে তুমি,
লজ্জা নারীকে রূপসী করে তোলে;
তোমাকে তারও অধিক রূপসী…
আগুন নিয়ে খেলতে কারনা ভালো লাগে!
পুড়ে যাওয়ার ভয় তোয়াক্কা না করে আমরাও খেললাম।
সেই খেলাতে তোমার চিবুক থেকে নূপুর-পা অবধি ছড়িয়ে পড়লো সুখের স্ফুলিঙ্গ।

— হঠাৎই তোমার মায়ের অসুস্থ আগমনে
আমরা মাংশের মানচিত্র থেকে ছিটকে পড়লাম দু’জন দু’দিকে।
প্রথমে তোমার মা, তারপর প্রতিবেশীর কান পেরিয়ে সমাজ… আমাদের কথাটা ছড়িয়ে পড়লো বাতাসের গতিতে।
তোমাদের দু’বাসা পরের শিউলী আন্টি,
যার লক্ষ্মী ছেলেটি রোজ রোজ স্কুল যেতে তোমাকে টিজ করতো
সেও মুখে দুর্গন্ধের ভাব এনে বললো,
‘ছি: ছি: ঘরে মরদ এনে এইসব…?’

লজ্জায় ঘৃণায় অপমানে তুমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলে,
বন্ধুদের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখলে না;
না না ভুল বলেছি, রাখতে চেয়েও পারলে না।
ওরা সবাই একবার এসেছিলো খোঁজ নিতে
— ‘এই সব অলক্ষ্মী মাগিগুলোই আমার অবুঝ মেয়েটার মাথা খেয়েছে, এখন আবার নাটক দেখতে এসেছে…’
তোমার মা ধুর ধুর করে তাড়িয়ে দিলো তাদের।
কোথাও কেউ নেই, ভীষণ অন্ধকার একঘরে
একবুক অপমান আর নীরব কান্নাতে
সংগোপনে ভেঙে চলেছে তোমার পাঁজর।

সতেরো বছরের কিশোরী বয়সে কাঁধে তোলা সেদিনের দুর্নাম বয়ে বেড়াতে বেড়াতে তুমি আজ
নির্জীব আর জরাজীর্ণ চব্বিশে এসে দাঁড়ালে।
তোমার এ বেড়ানোর ইতিরেখা কে টানবে মিহি?

সেদিন মাকে তোমার কথাটা বলতেই,
বললো— ও পাড়ার জইল্লার মেয়ের কথা বলছিস তো?
ছি ছি পাড়ার বদনাম! ওই নষ্টা আমার ঘরে তোলা যাবে না। শুনেছি কোন একটা লম্পটের সাথে…,
আমার চাঁদের মতো কলঙ্কশূন্য ছেলেটার জন্য কি মেয়ের অভাব পড়েছে?

.
পুরুষের কোনো সতীত্ব নেই
— তানভীর সিকদার।

বহুগামী

খুব ছোট ছিলাম যখন
শরীরের বৃত্ত-ব্যাসার্ধ তখনো আয়ত্বের বাইরে;
আমি আর বড়দি একঘরে শোতাম রাতে।
বড়দির মুখে গল্প শুনতে– এটা-ওটা জানতে, জানাতে
গলাগলি দিয়ে আমরা তালিয়ে যেতাম ঘুমে।
নিস্তব্ধরাতে কখনো ঘুম ভাঙলেই দেখতাম- বড়দি ঘরের কোণের টেবিলটায় মিট মিট মুম গলিয়ে মাথা বাঁকিয়ে
কী একটা লিখছেন। সম্ভবত চিঠি।
মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে, নয়তো
আমাকে কোলে করে ঘুরিয়ে আনার ছলে বড়দি পোঁছে যেতেন
গ্রামের শেষ মাথায় রহিম কাকুর লালরঙা ডাকঘরে;
আশপাশ তাকিয়ে খুব যত্নে বুক থেকে বের করে বাক্সে ফেলতেন চিঠিটা।
আমি শুধু দেখতাম। বুঝতাম না কিছুই।
ফেরার পথে বড়দির ঠোঁটে একটা তৃপ্তির হাসি ফোঁটতো।

একদিন বিকেলে বড়দি স্কুল থেকে ফিরে
আমাকে জড়িয়ে ধরে আচ্ছামতো কাঁদছিলেন,
আর আমি মুর্তির মতো অপলক তাকিয়ে দেখে যাচ্ছি নয়নজল।
জানা হলো না কাঁন্নার কারণ।
বিকেল গড়িয়ে রাত… আমাদের গল্পশোনা, তারপর ঘুম।
সেদিন হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো
খেয়াল করে দেখলাম আমি মায়ের কোলে।
ঘরের উঠোন, তার দক্ষিণে কাঁঠাল গাছ
বাড়ীর সবাই হারিকেন আলোয় বড়দি’কে ঝুলতে দেখলেন সেগাছে।
সবাই চুপচাপ দাঁড়ানো; শুধু মায়ের ভেতরের ঘুর্ণিঝড় কিছুটা টের পেয়েছিলাম আমি।
মধ্যরাতে নিষ্পাপ দুটি চোখ বড় বড় করে আমিও দেখলাম বড়দির ঝুলন্ত পা, তার ফরখ…

সময়ের হাতধরে সেই আমি এখন বড় হতে চলেছি নিরন্তর।
এখন বুঝি, বড়দির মৃত্যুর পেছনে দায়ী কোনো এক পুরুষ, কোনো প্রেমিক।
যার কাছে রাখা ছিলো স্বপ্নের রোড়ম্যাপ,
যাকে ভেবেছিলো শেষ আশ্রয়স্থল;
হয়তো পুষেছিলো– সকালের নরম রোদে ঘুমন্ত প্রেমিককে
তীব্র আবেগে চুমো খাওয়ার স্বপ্ন;- ঠোঁটে, গালে, কপালে।
কিন্তু কে জানতো
দূরত্বের নির্জনতা বাড়িয়ে এক্ষুণি চলে যাবে বড়দি?
সে জানতো!
যে কিনা বড়দির চোখভর্তি জল, বুকভর্তি হাহাকার,
আকুল ভালোবাসায় ভরা আস্ত একটা শরীর ফেলে; গিয়েছিলো অন্য নারীর কাছে।
সেদিনই বড়দির চোখ থেকে নিভে গেলো পৃথিবীর সমস্ত আলো,
চারিদিকে নেমে এলো ঘোর অমানিশা।
খুব আগ্রহ ভরে অন্ধকারকে প্রশ্ন করা হলো:
ভালোবাসা কি কেবলই একটা শব্দ?
তার নব্য প্রেমিকা কি তাকে আমার মতো করে চুমো খায়? ডুবে যায় চোখের নদীতে?
একপলক দেখার আশায় তারও কি ধড়পড় করে বুক?
সেও কি অসহ্য অবহেলার যন্ত্রণায়
ছটপট করতে করতে বলে– ভালোবাসি?
আমার মতো এমন নির্বিবাদে সেও ভালোবাসে?
তবে কি আমার চিরচেনা হাত, চেনা চোখ, চেনা হাসি
সত্যিই আজ অন্যকারো হলো?
এমন অজস্র প্রশ্ন আর অখণ্ড নিস্তব্ধতাকে বুকে নিয়ে বড়দি খুব সন্তর্পণে গলায় পড়েছিলো মৃত্যুর দড়ি।
জানিয়ে দিয়ে গেলো সব প্রেমিকই পুরুষ,
আর প্রেমিকের মুখোশ পরে স্বপ্ন নিয়ে খেলছে অগনিত প্রতারক।
আমাদের বাড়ীর উঠোনের দক্ষিণে-
আত্মহত্যা করেছিলো যে গাছাটায়; তার নিচে গিয়ে দাঁড়ালে
এখনো আমার বড়দির মৃত্যুতে কষ্টের চেয়ে লজ্জা বেশি লাগে!
কারণ, আমিও পুরুষ।