সস্তা এবং বাজারি লেখালেখিঃ হুমায়ূন আহমেদ থেকে কাশেম বিন আবুবাকার

হুমায়ুন আহমেদের মতন জনপ্রিয় সাহিত্যিক এই বাংলাদেশে জন্মেনি, তা চোখ বুজেই বলে দেওয়া যায়। আমার এই লেখার শুরুতেই হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর চার পূর্তি উপলক্ষে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে সাদত হোসাইন -এর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেবার লোভ সমলাতে পারছি না।

“হুমায়ূন আহমেদ এর ‘সস্তা’ এবং ‘বাজারি’ লেখালেখি নিয়ে ‘সাহিত্য পণ্ডিত’ এবং ‘বোদ্ধাদের’ তুমুল সমালোচনা দেখে যারপর নাই আপ্লুত। হুমায়ূন আহমেদ নাকি তরল সাহিত্য রচনা করেছেন, যার ফলে দেশে অজস্র তরল পাঠকের সৃষ্টি হয়েছে, সেইসব তরল পাঠক ‘বিদগ্ধ’ সাহিত্যিকদের আগুন গরম সাহিত্য পাঠ করতে গেলে সেইসকল সুগভীর, আগুন-গরম, ক্ল্যাসিক এবং একই সাথে ধ্রুপদী সাহিত্যের তাপে নিমেষেই বাষ্পীভূত হয়ে মিলিয়ে যাবেন…

এইবার আলোচনায় আসি, হুমায়ূন আহমেদ নিজে কি কখনোই দাবী করেছেন যে তিনি কালজয়ী সাহিত্যিক?

না, করেন নি। তিনি বরং অকপটে তার সাহিত্য নিয়ে হাস্যরস করেছেন। প্রকাশ্যে বলেছেন, জ্বী জনাব, আমি বাজারী লেখা লিখছি, সস্তা উপন্যাস লিখছি।”

তার লেখা থেকে আর একটু উদ্ধৃতি করেই চলে যাব আমার মূল আলোচনায়। সত্যি কি মিথ্যা তা জানি না, আমি বেশ মজা পেয়েছি। যদি রসবোধ থাকে তবে আপনিইও একটু মজা নিয় নিন। সাদাত হোসাইন সবশেষে লিখেনঃ-

বিঃদ্রঃ হুমায়ূন আহমেদ একবার বাংলা সাহিত্যের এক অধ্যাপক, বিদগ্ধ সমালোচককে তার একটি গল্প পড়তে দিয়ে মতামত জানতে চাইলেন। অধ্যাপক গল্পটি পড়ে বললেন, ‘মন্দ নয়। তবে এতে গভীরতা কম’।

হুমায়ূন আহমেদ পাণ্ডুলিপিটি ফেরত নিয়ে পকেটে ভরতে ভরতে বললেন, ‘গল্পটি আমার নয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আমি চরিত্রের নাম পাল্টে কপি করে দিয়েছিলে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় যখন গভীরতার অভাব, তখন আমার লেখা অগভীর হলে আমার দুঃখ নেই’।

প্রথমে একটু হাস্যরসের দিয়ে শুরু করে গভীরে যাওয়া যাবে। আর কে না জানে যতই গভীরে যাই ততই মধু। রাম, সাম, যদু বধু একটু অপেক্ষা করুন গভীরে যাওয়ার আগে আর একটু চটুল কথা শুনে নেই। সাদত হোসাইন থেকে-

“সাহিত্যের সস্তা পাঠক হিসেবে একটা সস্তা কথা বলি? – ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কারও মনোরঞ্জন করা নয়’।**
এবং ‘কারও মনোরঞ্জন করাও সাহিত্যের কাজ নয়, কাউকে শিক্ষা দেওয়াও নয়। সাহিত্য ছেলের হাতের মোয়াও নয়, গুরু হাতের বেতও নয়’।**

আপনারা আসলে চাচ্ছেন, সাহিত্য রচিত হোক কেবল মাত্র আঁতেল এবং বোদ্ধা শ্রেণীর মনোরঞ্জনের জন্য, কিংবা জ্ঞানতাত্ত্বিক দর্শন চর্চা ও শিক্ষণীয় মেসেজ প্রদানের জন্য। এটি আসলে আধিপত্যবাদি হেজেমনিক প্রক্রিয়ায় একধনের ডিসকোর্স তৈরির চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না।

বিঃদ্রঃ উপরের স্টার (**) চিহ্নিত উদ্ধৃতি দুটো আমার মতো সস্তা বাজারি পাঠকের নয়। উহা প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ থেকে নেয়া। কিঞ্চিত আশংকায় আছি, আপনাদের বিদগ্ধ মননশীলতায় এখন প্রমথ চৌধুরীও না আবার ‘সস্তা’ হয়ে যান!”

কে এই সাদাত হোসাইন যার লেখা থেকে উদ্ধৃতি করছি? নাম শুনেছেন কখনও? নাম না শুনলেও ক্ষতি নেই। এমন কেউতো আছেন যার নাম শুনিনি তবু তাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম এএফপি সংবাদ পরিবেশন করে, সে কথা পরে আসছি, তার আগে জানাশুনা প্রমথ চৌধুরী দুটি ভাল করে বুঝে নেই। খুব খেয়াল সামনে কাজে লাগতে পার।

প্রথম কথা হচ্ছে সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেয়া, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সাহিত্য শিক্ষামূলক ক্লাস নয়। সকলকে আনন্দ দেয়াই সাহিত্য! নিজের কিছু অর্জন নয়?

আমাদের দেশে অনেকেই হতাশ কণ্ঠে উপদেশ দেন, ‘লেখালেখি করে কী হবে? কবি, সাহিত্যিকদের জীবনে টাকা-পয়সা হয় না। শেষে না হবে সংসার, না হবে সুন্দর জীবন।’
আসলেই কি তাই? আমরা জানি, অতীতে অনেক বিখ্যাত লেখক, সাহিত্যিকদের কষ্টে দিন কেটেছে। অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণও করেছেন কেউ কেউ। তবে এখন দিন কিছুটা বদলেছে। তবে পরিস্থিতির ততোটা উন্নতি এখনও হয়নি যতোটা হলে লেখালেখিটাকে এ দেশে প্রধান পেশা হিসেবে নেয়া যায়। ব্যতিক্রম হয়তো আছে কিন্তু তাদের নাম আঙুলের কর গুনে বলে দেয়া যায়।

বিদেশে এ চিত্র কিন্তু একেবারেই ভিন্ন। পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রফেশনাল রাইটার আছেন। তারা লেখালেখি ছাড়া আর কিছুই করেন না। এবং এ করেই তাদের দিন দিব্যি কেটে যায়। এমনকি এদের কেউ কেউ চমকে ওঠার মতো ধনীও বটে। তাদের বই বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়। বই বিক্রির রেকর্ডও গড়েছেন অনেকে। ফলে লেখক স্বত্ব নিয়ে তাদের ভাবনা নেই। তারা লিখেই কোটিপতি।

বিশ্ব লেখালেখি থেকে আয়ের বিবরণ শুনে দেশে ফিরে আসব।ক’জন ধনী লেখককে নিয়ে লিখেছেন সাইফ বরকতুল্লাহ। আমরা তার থেকে নির্যাসটুকু দেখে নেই। লেখালেখি থেকে আয় ব্যাপারটা বেশ মজার, কি বলেন।

ধনী লেখকের কথা উঠলেই জে কে রাউলিংয়ের নাম উঠে আসে। তিনি বিশ্বের অন্যতম ধনী লেখক। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাজ্যে জন্ম নেয়া এই লেখকের আয় কত অনুমান করুন তো? জানি পারবেন না! তাহলে শুনুন তার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি টাকায় ১০৮ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ৩৫ টাকা। কী, চোখ কপালে উঠে গেল! এবার আপনিই হিসাব করে তার দৈনিক আয় কত হয় বের করুন। আরেকটি মজার তথ্য দেই, তার এই আয় কিন্তু মোটামুটি একটি সিরিজ দিয়েই। নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন কোন সিরিজ? ‘হ্যারি পটার’ সিরিজ লিখেই তিনি এ পরিমাণ আয় করেন।

পাঠক চলুন, আমরা লেখক স্টিফেন কিংয়ের গল্পটা শুনি। আমেরিকায় জন্ম নেয়া স্টিফেন কিং-ও ধনী লেখকদের একজন। এই লেখকের ৫০টিরও অধিক বেস্ট সেলার উপন্যাস রয়েছে। যা থেকে আয় হয়েছে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া সিনেমার স্ক্রিপ্ট ও অন্যান্য লেখা মিলিয়ে স্টিফেন কিং ৪০০ বিলিয়ন ডলারের মালিক। এক হিসাব অনুযায়ী তার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি ১৩২ কোটি ২ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৬ টাকা।

জেমস প্যাটারসনকে বলা হয়, তার বই নাকি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এ কি শুধুই কথার কথা? তা নয়, ২০০১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মুদ্রিত বই বিক্রির পরিসংখ্যান টেনে প্রকাশনা বিশ্লেষক সংস্থা নিলসেন এই তথ্য দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রাউলিংয়ের বই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণে বিক্রি হলেও, এখানে প্যাটারসন এগিয়ে। প্যাটারসনের বিগত ১৫ বছরে লেখা বইগুলো বাজারে হট কেক হিসেবে বিক্রি হয়েছে। তার গোয়েন্দা ধারাবাহিক ‘এলেক্স ক্রস’ এ পর্যন্ত তিন কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। ভাবা যায়! যেখানে এই বাংলাদেশে ৫০০ কপি বই বিক্রি করতে প্রকাশকদের নিরন্তর ঘাম ঝড়াতে হয়। জেমস প্যাটারসনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ, নিউইয়র্কে। তার বার্ষিক আয় বাংলাদেশি ৬৯১ কোটি ২০ লাখ ৭০ হাজার ৭৯৬ টাকা।

হা হা হা। ভাবছেন এত টাকা পয়সা দেখে পাগল হয়ে গেলাম নাকি? না না পাগল হইনি জনাব, তবে গোপনে একটা সত্যি কথা বলি, কাউকে বলনেন যেন! আমিও নিজেকে লেখক মনে করি। ব্লগে কিছু কবিতা পোষ্ট করেছিলাম, কেউ বলল দারুন, কেউ বলল অসাধারণ। আর যাই কই, ব্লগারস ফোরামের ব্যানারে নিজের একটি কবিতার বই বের করলাম। মাত্র ২০০ কপি ছাপা হয়েছিল, বই মেলায় বিক্রি হয়েছে ৮০ কপি। হা হা হা। আবারও হাসলাম। ভাবছেন ব্যাপার কি! হাসছি আপনি যে এখনও লেখাটি পড়ে যাচ্ছেন, আপনি জানেন কি আমি এই লেখার ভূমিকাটুকু এই মাত্র শেষ করেছি।

এতটুকু কষ্ট করে লেখাটির সাথে লেগে আছেন, পারেনও বটে!, আচ্ছা, আসেন একটু সামনে বারি। আপনারা সাহিত্যের বড় বড় উপন্যাস পড়তে পারেন আর আমার এই লেখাটি পড়বেন না এতটা হতাশবাদী আমি নই।

বাংলা উপন্যাসের জন্ম হয় পাশ্চাত্য প্রভাবে। এর আদর্শ-ভিত্তি প্রতিষ্ঠা পায় বঙ্কিমের হাতে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম দুটি উপন্যাস রাজর্ষি ও বউঠাকুরানীর হাট বঙ্কিম-প্রভাবিত। বাংলা উপন্যাস নতুন বাঁক নেয় চোখের বালির মাধ্যমে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে যোগ করেন নতুন মাত্রা। বঙ্কিমীধারার লেখক মীর মশাররফ হোসেন। মীর মশাররফ হোসেন অসাধারণ জীবনচেতনার বৃহত্তর সমাজ কাঠামোকে উপন্যাসে আনেন।

বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্যে -বিস্তৃতিও ঘটেছে অনেকদূর। সামাজিক বৈষম্য, বংশাভিমান, ভেদবিরোধী ব্যাপার, পীরপ্রথা, রোমাঞ্চকর অলৌকিকত্ব, ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃৃতি, অস্পৃশ্যতা, ধর্মন্ধাতা, অবরোধ, নারীনির্যাতন, কর্পোরেট পুঁজি ও অন্তর্জালবিষয়ক জটিলতা এ শতকে বাঙালি লেখকরা নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সমাজচিন্তায় শৈথল্য এসেছে। সংস্কৃতি পাল্টেছে। একুশ শতকের উপন্যাস এখন আরও জটিল বাস্তবতামুখর। এতে ধর্মান্ধতা, মনস্তত্ত্বও ভিন্ন মাত্রায় উপন্যাসে যুক্ত হয়েছে। ফলে জনপ্রিয়তার ক্ষেত্র উপন্যাসের কমেনি। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদ এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত। তিনি বাঙালি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রাখতে পেরেছিলেন। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগারে, শ্যামল ছায়া, কোথাও কেউ নেই, শ্রাবণ মেঘের দিন, এইসব দিনরাত্রি, আগুনের পরশমণি, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি ব্যাপকভাবে পাঠকনন্দিত উপন্যাস।

হুমায়ূন আহমেদের বই মানে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ব্যাপকভাবে বিক্রিত হয় তার বই। ব্যাপারটি দৃষ্টিগোচর হয় সকলের। অনেক সমালোচক যিনি আমাদের মতো লেখকও বটে তারা বিশুদ্ধ ধারার। আসুন শুনি আসিফ মহিউদ্দিন তার এক ব্লগে লিখেনঃ

আমাদের দেশে বই প্রকাশ এবং বই বিক্রি একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। পাঠক তৈরি এবং প্রতিবছর টন টন বই উৎপাদন করে আমাদের সাহিত্যিকগণ বর্তমানে প্রচুর টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন, লেখালেখিকে একটি লাভজনক ব্যাবহায় পরিণত করেছেন। একটা সময়ে আমরা বই কিনতাম নতুন চিন্তা, নতুন ভাবনা জানার জন্য, ইতিহাস দর্শন সাহিত্যের চমৎকার সব অংশকে ভালভাবে বোঝার জন্য। কিন্তু বর্তমানে বই প্রকাশ একটা গুরুত্ত্বপুর্ণ বাণিজ্য, সাহিত্য রীতিমত একটি পণ্যে পরিণত হয়েছে। এখন আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ বই কেনে ঘর সাজাবার উদ্দেশ্যে, দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়া করে হালকা চটুল সুড়সুড়িমার্কা বিনোদন পেতে। হুমায়ুন আহমেদ-ইমদাদুল হক মিলন এরা বহুদিন ধরেই এই ধরণের পাঠক ধরবার চেষ্টায় লিপ্ত, এই ধরণের মানুষের সংখ্যা বেশি হবার কারণে সাহিত্যের সত্যিকারের পাঠকদের কথা বিবেচনা না করে আমাদের জনপ্রিয় সাহিত্যিকগণ বর্তমানে জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস লিখে যাচ্ছেন। শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আজাদ যার নাম দিয়ে ছিলেন ‘অপন্যাস’, আর এই ধরণের সাহিত্যিকের নাম দিয়েছিলেন ‘অপন্যাসিক’।

আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ খুব শিক্ষিত নয়। তারা জটিল কথাবার্তা বোঝে না, সহজ সাধারণ জীবন যাপন করেন। এই ধরণের মানুষের মনস্তত্ত্বে হুমায়ুন আহমেদ নাড়া দিতে পারবেন খুব সহজেই। আসলে এই ধরণের পাঠক আকর্ষণ করতে খুব মেধাবী সাহিত্যিকের প্রয়োজন নেই, হুমায়ুন আহমেদের মেধা যে তাই অপাত্রে যাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।

আমাদের দেশে বই বিক্রি আর সাহিত্যকে ব্যবসায় পরিণত করার জন্যেও হুমায়ুন আহমেদকে অনেকাংশে দায়ী করা হয়। তিনি জনপ্রিয় থাকতে চেয়েছেন, সকল ধরণের পাঠক সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে অনেক পানি ঘোলাও করেছেন। আমরা বুঝি, জনপ্রিয়তার নেশা কাটানো মুশকিল, এবং দেশের প্রগতিশীলদের থেকে শুরু করে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হবার তার আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে তাকে একজন পতিত বুদ্ধিজীবীতে পরিনত করছে কিনা, সেটাও ভেবে দেখবার সময় হয়েছে।

আসিফ মহিউদ্দিন এর লেখা থেকে বুঝা যাচ্ছে শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদকে সস্তা লেখক বলেছেন, বলেছেন অপন্যাসিক। আজাদ স্যার বিদগ্ধ মানুষ ছিলেন, প্রতিভাবান, পন্ডিত মানুষ ছিলেন তিনি খুব সহজেই যে কাউকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেই পারেন। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তিনি সকলকেই হেয় জ্ঞান করতেন। আমি সেদিকে জেতে চাই না। আমি যে বিষয়টিতে দৃষ্টি দিতে চাই তা হলো হুমায়ূন আহমেদের পাঠকের কোয়ালিটি নিয়ে। আসিফ মহিউদ্দিনের ভাষায় এরা সকলে সহজ সরল, অল্প শিক্ষিত, জটিলতা বুঝার ক্ষমতা তাদের নাই।

ওদিকে আরেক বিদগ্ধ সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন হুমায়ূন আহমেদের মুত্যু পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বাংলাদেশি পাঠকদের কোয়ালিটি নিম্নমানের বলে আক্ষা দিয়েছেন। এই তুলনায় কলিকাতার পাঠকরা বিদগ্ধ বলেছেন কারণ বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদ কিম্বদন্তিতূল্য জনপ্রিয়, পক্ষান্তরে সুনীল, শীর্ষেন্দুর অনেক প্রচেষ্টার পরও ওপার বাংলায় তেমন পাঠকপ্রিয়তা পান নি।

হুমায়ূন আহমেদের এক লেখা থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি করা যেতে পারে। হুমায়ূন আহমেদ এর কাঠপেন্সিল থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি- তিনি লিখেছেন,

‘বাজারি লেখক- বিষয়টা আরও পরিস্কার করা দরকার। তেল-সাবান- পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেও বাজারি। যাদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তারা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশিরভাগের ধারণা তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন। তাঁদের আক্রমণে শালীনতা থাকে। তাঁরা সরাসরি কখনো আমার নাম নেন না। তবে বুদ্ধিমান পাঠকরা বুঝে ফেলেন কাকে ধরা হচ্ছে। তাঁদের আক্রমনের নমুনা, ‘অন্যপ্রকাশের সামনে জনৈক বাজারি লেখকের বইয়ের জন্য তরুণ-তরুণীর সমাবেশ দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে হয়। এরা সৎ সাহিত্য থেকে বঞ্চিত। কষ্টকল্পিত উদ্ভট চরিত্রের গালগল্পে বিভ্রান্ত। বাজারি লেখক এবং তার প্রকাশকের অর্থ জোগান দেওয়া ছাড়া এই তরুণ-তরুণীরা আর কিছুই করছে না।… ”

আমি নিজেকে এক মহান লেখক ভেবেছি, কারণ আমি মনে করি আমি কিছু কালজয়ী কবিতা লিখেছি। আমার বই বিক্রির পরিসংখ্যান তো আগেই দিয়েছি। ভাবছেন এই আলোচনায় কেন আমি নিজের কথা বলছি? শুনতে পাই যারা বিদগ্ধ লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত তাদের কারও কারও অবস্থা নাকি আমার চেয়েও করুণ। হুমায়ূন আহমেদের লেখা থেকে আবারো কোড করে এ প্রসঙ্গেটার ইতি টানতে চাই।

যাদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তারা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশিরভাগের ধারণা তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন।

আমাদের আলোচনা কোন মহান, মুক্তবুদ্ধি, কমিটেড, সত্যসন্ধানী লেখক নিয়ে নয়। আমরা বাজারি লেখকদের নিয়ে আলোচনায় করছি এবং এক আত্মস্বীকৃত বাজারে লেখক হুমায়ূন আহমেদকে বিশ্লষণ করেছি। এবার অন্যদিকে যেতে চাই।

এই সময়ে যে লেখক সবচেয়ে আলোচিত তিনি হুমায়ূন আহমেদ নন, তিনি কাশেম বিন আবুবাকার। এএফপি তাকে নিয়ে নিউজ করার আগে আমরা শুদ্ধবাধি লেখকরা অনেকেই তার নামই শুনি নি।

এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, কাসেম বিন আবুবাকার ১৯৭০ দশকের শেষের দিকে একজন বই বিক্রেতা হিসেবে প্রায় সব উপন্যাসের মধ্যে শুধু শহুরে অভিজাতদের জীবনযাত্রার কথা দেখতে পেয়ে নিজেই হাতে কলম তুলে নেন।

ইসলামী মূল্যবোধকে সামনে রেখে কাসেমের লেখা একের পর এক প্রেমের উপন্যাস প্রকাশিত হতে থাকে। এসব উপন্যাস দ্রুতই তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। লাখ লাখ পাঠকের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে তার উপন্যাস।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেক্যুলার লেখকরা এমন এক দুনিয়ার গল্প বলেছে, যেখান থেকে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রধান অংশের গ্রামীণ ও ধর্মীয় জীবনের অস্তিত্ব মুছে ফেলা হয়েছে। কাসেম এ শূন্যতার বিষয়টি অনুধাবন করে তার উপন্যাসের বাজার গড়ে তুলেছেন।

অনেকে আকাশ থেকে পড়ছি, কাশেম বিন আবুবাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় , কীভাবে? সত্যিটা হচ্ছে, পৃথিবীর সবদেশে সবসময় কাটতি বেশি যথাক্রমে রেসিপি, পর্নোগ্রাফিক এরপর ধর্মীয় বই।

গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার অরিজিত রায়চৌধুরী একবার বলেছিলেন প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে পঞ্জিকা অন্তত বিশ লাখ কপি বিক্রি হয় । অথচ বাংলা উপন্যাস পাঁচ হাজার বিক্রি হলেই বেস্টসেলার – আনন্দ পাবলিশার্সের সুবীর মিত্র বলেছিলেন সেবারই।

প্রশ্ন হচ্ছে কাশেম বিন আবুবাকার এর যে লেখাগুলি এত এত কপি বিক্রি হয় তা কি রেসিপি, পর্ণোগ্রাফি, ধর্মীয় পুস্তক বা পঞ্জিকা। এসব কিছুই নয়, এমনকি এগুলি হুমায়ূন অহমেদের অপন্যাস ও নয়, এগুলিকে চিহ্নিত করা হচ্ছে ইসলামি উপন্যাস হিসাবে।

বেশি বিক্রি হওয়া উপন্যাসের মধ্যে একটি ক্যাটাগরি হচ্ছে রোমান্স উপন্যাস।
রোম্যান্স উপন্যাস বা রমন্যাস পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে, বিশেষত ইংরেজি-ভাষী জগতে বিকশিত একটি সাহিত্যধারা। এই বর্গের উপন্যাসগুলির মূল উপজীব্য দুই ব্যক্তির প্রেম ও প্রণয়সম্পর্ক, যার পরিসমাপ্তি হবে “সর্বদা মানসিকভাবে সন্তুষ্টিবিধায়ক ও আশাব্যঞ্জক”

১৯৭২ সালে অ্যাভন বুকস প্রকাশিত ক্যাথলিন উইডিউইস রচিত দ্য ফ্লেম অ্যান্ড দ্য ফ্লাওয়ার উপন্যাসটি আধুনিক রোম্যান্সের সূচনা করে। এটিই ছিল মূল পেপারব্যাক আকারে প্রকাশিত প্রথম সিঙ্গল-টাইটেল রোম্যান্স উপন্যাস। ১৯৮০-এর দশকে এই ধারাটি সমৃদ্ধিলাভ করে। অনেকসংখ্যক ক্যাটেগরি উপন্যাসের পাশাপাশি সিঙ্গল-টাইটেল উপন্যাসের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। জনপ্রিয় লেখকগণ এই ধারার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং প্লট ও চরিত্রচিত্রণে আধুনিকতার ছোঁওয়া লাগে।

উত্তর আমেরিকায় ২০০৪ সালে বিক্রীত সমস্ত পেপারব্যাক বইয়ের ৫৫% রোম্যান্স উপন্যাস। এই অঞ্চলে আধুনিক সাহিত্যে জনপ্রিয়তম ধারা তাই এইটিই।

রোমান্স ক্যাটাগরীর উপন্যাসের মধ্যে যৌনতা, নগ্নতা ইত্যাদিও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। তবে ধর্মীয় ভাবধারায় ও রচিত হতে দেখা যায় অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স উপন্যাস যে সব উপন্যাস বিক্রির দিক থেকে সফল হতে দেখা যায়।

বর্তমান বিশ্ব বাজারে বিদ্যমান অনুপ্রেরণামূলক রোম্যান্স উপন্যাসগুলি খ্রিস্টান ভাবধারা ও প্রণয়সম্পর্কের বিকাশ কেন্দ্রিক কাহিনির সংমিশ্রণ। ২০০৪ সালে, এই উপবর্গে ১৪৭টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। এই উপন্যাসে সাধারণত অপ্রয়োজনীয় হিংসাত্মক কার্যকলাপ বা অশ্লীল বাক্যাদি ব্যবহৃত হয় না। কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলির প্রণয় হয় সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। যৌনতার উল্লেখ যদি বা থাকে, তবে তা ঘটে বিবাহের পর এবং তার বিস্তারিত বর্ণনাও বাদ রাখা হয়। অনেক উপন্যাসেই নায়ক বা নায়িকার বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়। যার হলে প্রেমকাহিনিটি পরিণত হয় “নায়ক, নায়িকা ও ঈশ্বরের সহিত তাদের সম্পর্ক নিয়ে গড়ে ওঠা একটি ত্রিভূজ”-এ। ক্ষমা, সততা ও বিশ্বাস এই উপবর্গের সাধারণ কয়েকটি থিম।

স্পষ্টত কাশেম বিন আবুবাকার এর উপন্যাসগুলি অনুপ্রেরণামূলক রোমান্স উপন্যাস। প্রশ্চাত্য জগতে খ্রীষ্টান ভাবধারায় রচিত হয়, আর বাংলাদেশে কাশেম বিন আবুবাকার রচনা করেছেন ইসলামি ভাবধারায় এবং তিনি ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা পেয়েছেন।