ট্যাগ আর্কাইভঃ আন্‌ওয়ার এম হুসাইনের গল্প

কুকুর চক্রে

আপনারা হয়ত অনেকেই জানেন না আমাদের খেজুরতলার লোকজন বেশ কুকুরভক্ত। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অঞ্চলে কুকুর সংখ্যা লক্ষনীয় এবং রাস্তার পাশে তাদের বিষ্ঠাও সমান দর্শনীয়। মানুষের আদরে এরা খেয়ে-দেয়ে বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট, চমৎকার লম্ফ-ঝম্প দিতে পারে। দিনের বেলা আরামসে ঘুমায় আর রাতের বেলা গলা ছেড়ে ঘেউ ঘেউ করে। এইসব নিয়ে আমাদের কারোরই মাথা-ব্যথা নাই। পথের ককুর পথে আছে, আমরা আছি আমাদের কাজে। নিজেদের চিন্তারই কুল করতে পারি না, কুত্তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কই।

কিন্তু মাথা ঘামাতে হল। মহল্লার সকলকে কুকুর নিয়েই ভাবিত হতে হল। কুকুরদের সাম্প্রতিক কার্যক্রম যথেষ্ট ভাবনার উদ্রেক করে। রাতে এরা সবাই দল বেঁধে ৭৪ নাম্বার বাসার সামনে হাজির হয় এবং সেই বাসার সামনে এরা ঠ্যাং উচিয়ে হিসু করে। এলাকার সমস্ত কুকুর একজোট হয়ে কাজটি করছে। এর আগে কুকুরের বিষ্ঠা নিয়ে নিয়ে কেউ কেউ ভাবিত হলেও কুকুরের মুত্র নিয়ে ঠিক কাউকে ওভাবে চিন্তিত হতে দেখা যায় নি। সারাদিন কুকুরেরা যে যার মত ঘুরছে-ফিরছে খাচ্ছে দাচ্ছে যেখানে সেখানে প্রয়োজনমত প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারছে। ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা রাত দুটোয়। দুটার পরে সবাই চুয়াত্তর নম্বরধারী নাইটকুইন নামের বাসাটার সামনে হাজির হয়ে দলবেঁধে কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে, শুয়ে বসে থাকে। যেন তাদের নৈশ বিলাস। তারপর তারা ওখানে একসাথে ঠ্যাঙ উচিয়ে হিসু মেরে যে যার মত চলে আসে। দেখে মনে হয় চুয়াত্তর নম্বরের সাথে ওদের চরম শত্রুতা।

এটা নিত্যদিনের ঘটনা। প্রথমটায় কেউ খেয়াল করেনি। সবাই বিষয়টাকে ক্যাজুয়ালি নিয়েছিল। পরে সিরিয়াসলি না নিয়ে উপায় নাই। দরকারে বেদরকারে রাত্রিকালে কেউ ভয়ে বের হয় না। দারোয়ানরা দরজা বন্ধ করে চুপ মেরে বসে থাকে। দৈনিক মূত্রবিসর্জনের ফলে বাড়ির সামনে বিকট দুর্গন্ধ তৈরি হয়েছে। সে বাড়ি পার হতে গেলে নাকে হাত দিয়ে তবে পার হতে হয়। ৭৪ নম্বরের অনেক ভাড়াটিয়া বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়ে দিয়েছে।
সমস্যা আরো গুরুতর, মহল্লার মুখেই চুয়াত্তর নম্বর বাড়িটি। সুতরাং আসা যাওয়ার পথে কুত্তার মুতের গন্ধ গায়ে না মেখে উপায় কম। ঢাকা শহরে থাকতে গেলে নানা রকমের দূর্গন্ধ না খেয়ে কেউ থাকতে পারে না। পথে ঘাটতে এখানে সেখানে নানান গন্ধ-দূর্গন্ধ লেগেই আছে। তাই কুকুরের গন্ধ নিয়ে এত মাথা ব্যাথার কিছু ছিল না। কিন্তু কুকুরের দলবেঁধে প্রস্রাব করার বিষয়টা জনমনে সহজে আগ্রহ তৈরি করে। এর আগে কবে কুকুরেরা কখন ঠিক এই রকম কাজ কোথায় করেছে সেটা আমাদের কারোরই জানা নেই।

সিকিউরিটিরা কুকুরদের ছত্রভঙ্গ করতে গেলে তাদেরকে তাড়া খেতে হয়। এমনিতেই এলাকার কুকুরগুলো বেশ শান্ত নিরীহ প্রকৃতির। কাউকে তাড়া করে না, কামড়ায় না, কেউ শুধু হাত জাগালেই বরং দৌড়ে পালায়। কিন্তু রাতের বেলা দলবদ্ধ মূত্র বিসর্জনের সময় তারা বেশ মারমুখি ভঙ্গীতে নাকি থাকে। রাতের বেলা আশেপাশের কৌতূহলী লোকজন জানালাখুলে এই কুকুরকান্ড প্রত্যক্ষ করে।

শক্তি প্রয়োগে যখন ছত্রভঙ্গ করা গেল না তখন আসে কৌশলের কথা। তখন আমাদের হারিস ভাই আমদের বুদ্ধি দিল বাঁশের বেড়া দিয়ে দাও কুকুরেরা সেখানে যেতেই পারবে না। বিষয়টা নিয়ে হারিস ভাইয়ের উৎসাহ লক্ষ্যনীয়। চুয়াত্তর নম্বরের বাড়িওয়ালা রাসেল মিয়া নাকে তেল দিয়ে ঘুমালেও হারিস ভাই সেটা পারছেন না। তাঁর মতে খেজুরতলা সোসাইটির কমিটির মুরুব্বীরা কোন কাজের না। তাদের পক্ষে দুনিয়ার কোন সমস্যার সমাধান সম্ভব না। তারা তো মানুষের গু-মুতের সমস্যারই সমাধান করতে পারে না, কুকুরের গু-মতের সমস্যা কিভাবে দূর করবে! আমাদেরই বরই এই কমিটি পালটানো দরকার। এবং পরিবর্তিত কমিটিতে তাঁকে সেক্রেটারী করা দরকার। তার উৎসাহ দেখে নিন্দুকেরা বলল, ঘটনার পেছনে তাঁর হাত আছে, অর্থাৎ তার নির্দেশেই কুকুরেরা এই অপকর্ম সাধন করছে। হারিস ভাই চতুর মানুষ হলেও তাঁর কথায় কুকুরেরা কারো বাসার সামনে গিয়ে দলবেঁধে মূত্র বিসর্জন করবে, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। শুধুমাত্র চতুরতা দিয়ে দুনিয়াসুদ্ধ কুকুরদের বশ করা যায় না।

নিন্দুকের কথায় দমে যাওয়ার লোক হারিস ভাই না। তার মতে দুনিয়াতে একটা জিনিসের কোন অভাব নাই, আর তা হল নিন্দুক। সুতরাং চুয়াত্তরের বাড়িওয়ালা রাসেল মিয়াকে সকাল বিকাল দুটো করে গালি দিয়ে তিনি আমাদের মত উৎসাহী ছেলেদেরকে দিয়ে দুইটা অস্থায়ী বাঁশের বেড়া তৈরি করিয়ে নিলেন। আমরা রাতে বেলা সেগুলো দিয়ে দুদিকে দুইটা ব্যারিকেড দিয়ে দিলাম। কিন্তু রাতের বেলা দেখা গেল নানা চিপাচাপা দিয়ে ফাঁকফোকর গলিয়ে তারা ঠিকই জায়গামত মিলিত হচ্ছে।

চুয়াত্তর নম্বরের বাড়িওয়ালাকে বলেকয়ে সব ফাঁকফোকর বন্ধ করানো হল। এবার কুকুরদের আর আসার কোন উপায় রইল না। কিন্তু রাতের বেলা কুকুরেরা বাঁশের বেড়ার সাথে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে দিল। ওরা সবাই দলবেঁধে ছুটে এসে বাঁশের বেড়ার উপর আছড়ে পড়তে লাগল। এভাবে পড়ে পড়ে তারা সেই বেড়া ভেঙ্গে ফেলল। সে এক দেখার মত দৃশ্য। কেউ যেন ওদেরকে শিখিয়ে দিয়েছে, এক একটা কুকুর দূর থেকে ছুটে আসছে আর বেড়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ওদের উপর যেন জালিম ভর করেছে। সবগুলো যে পাগলা কুকুর। আর ঠিক এই জায়গায় এসে হিসু করতে না পারলে ওরা বোধহয় মরে যাবে এমন একটা বিষয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে ভয় পেয়ে গেল। অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে লাগল। সমস্যাটা এখন আর শুধু চুয়াত্তর নম্বরের নাই। সার্বজনীন হয়ে উঠল।

আমাদের খেজুরতলার শত বছরের ইতিহাসে এই ধরনের জটিলতার জন্ম কখনো হয় নাই। অন্যভাবে ভেবে দেখলে জিনিসটা হয়তো ভালই। আমরা সকলেই এই জটিলতায় জড়িয়ে যাচ্ছি। কমবেশি সবাই এই নিয়ে কথা বলছি, মতামত দিচ্ছি। আগে যেমন একজন আরেকজনকে দেখলে হনহন করে ছুটে চলে যেতাম এখন আর সে অবস্থা নাই। সবাই সবার সাথে দুটো কথা বেশি খরচ করছি। হোক না তা রাস্তার কুকুর নিয়ে তবু তো সবাই কথা বলছে। আমাদের পঁচা মবিলের মত একঘেয়ে নাগরিক জীবনে হঠাৎ একটা মৌমাছি এসে পাখা নাড়তে শুরু করল।

সুতরাং আমরা সবাই হারিস ভাইয়ের নেতৃত্বে দলবেঁধে খেজুরতলা সোসাইটির অফিসে গেলাম। সোসাইটির সভাপতি সেক্রেটারীও এলেন। নানা ধরনের ব্যাখা বিশ্লেষণ চলল। সাইন্টিফিক, শরীরী, অশরীরী নানামুখী আলোচনা চলল। কুকুরদের কোন অসুখ-বিসুখ থাকতে পারে। সুতরাং সেটা ডায়াগনসিস করা দরকার। বায়োলজির অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর আজমল স্যার এক অচিন্ত্যনীয় এক উপায় বের করলেন। তিনি বললেন, ভিনেগার এবং পেপারমিন্টের সংমিশ্রণ কুকুরের পক্ষে অসহ্য। চুয়াত্তর নম্বরের সামনে ভিনেগার ও পুদিনার মিশ্রণ প্রয়োগ করা দরকার।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারী রফিক সাহেবের বৃদ্ধ বাবা ফরিদ আংকেল বললেন, কুকুরদের উপর অশরীরী ভর করতে পারে। ভালো কোন তদবীর-টদবীর করা দরকার। পুরান ঢাকায় একজন কবিরাজ আছে। নজীর শাহ। বেশ কামেল লোক। আমাদের গ্রামের আজমল পাটোয়ারীর উপর একবার বদজ্বীনের নজর পড়ছিল। খুবই খারাপ অবস্থা। গায়ে কাপড়-চোপড় রাখত না। সবাইকে থুতু মারত। তখন নজীর শাহকে খবর দেয়া হয়। নজীর শাহ একরাতের মধ্যেই সেই জ্বীন বোতলে ঢুকায়ে মাটির নিচে পুঁতে ফেলল। পরদিন থেকে আজমল পাটোয়ারী সুস্থ। যেন কিছু হয় নাই। সবাই চাইলে আমি নজীর শার সাথে যোগাযোগ করতে পারি।
কেউ কেউ বললো, কুকুরদের সমস্যা থাকতে পারে। শারীরিক সমস্যা হতে পারে। মানসিক সমস্যাও হতে পারে। কুকুরদের প্রতি আমাদের আরো সহানুভূতিশীল হওয়া দরকার।

ইত্যাদি নানা মুখরোচক আলোচনা হল বটে তবে কোন সমাধান ও সিদ্ধান্ত ছাড়াই সভা শেষ হল। হারিস ভাই বললেন আমি আগেই কইছিলাম ছাগল দিয়ে কখনো হাল চাষ করা যায় না। এরা কিছুই করতে পারবে না। সবই কমিটির মুরুব্বিদের গাফিলতি। তারা চাইলে একটা সমাধান দিতে পারত। তবে তিনি হাল ছাড়লেন না। তাঁর ধারনা হল আজমল স্যারের সলিউশনটা বেশ কাজের হবে। তাঁর নির্দেশে কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড মিলে ড্রামভর্তি সিরকা আর পুদিনার রস মিক্স করল। রাতের বেলা সেইটা চুয়াত্তর নম্বরের সামনে স্প্রে করল। কুকুরেরা এটাকে পাত্তাই দিল না। রেগেমেগে পুরো ভিনেগার আর পুদিনার ড্রাম ছেড়ে দিয়ে বন্যা বইয়ে দেয়া হল। কুত্তারা মনের আনন্দে সেই ভিনেগারের উপরেই হিসু মেরে দিল।

হারিস ভাই তবু হাল ছাড়লেন না। এমনকি দিনের বেলা দুয়েকটা কুকুর ধরে নিয়ে মিটফোর্ডের কুকুর-বিড়াল হাসপাতালে নিয়ে টেস্ট করালেন। কুকুরেরা সম্পূর্ণ সুস্থ। কোন শারীরীক গোলযোগ নাই। কুকুরের মানসিক স্বাস্থ্য দেখার যেহেতু কেউ নাই সেহেতু সে লাইনে আর চেষ্টা করা গেল না। আর কুকুরের জ্বীন তাড়াতে পারে এমন কোন কবিরাজও পাওয়া গেল না। ফরিদ আংকেল বললেন, নজীর শাহ কুকুরের তদবির করে না। কুকুরের তদবির করা বহত দিকদারি ব্যাপার।

তবে এই সমস্ত কিছুর মধ্যে সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক হচ্ছে চুয়াত্তর নম্বর বাড়ির মালিক রাসেল সাহেব এখনো নির্বিকার। এমনকি সেদিনের সে মিটিংয়ে খেজুরতলার প্রায় সকলেই উপস্থিত থাকলেও তিনি ছিলেন না। অতি ব্যস্ত মানুষ তাঁর নাকি সময় হয় না। হাসির ভাই তার ব্যস্ততার বাপ-মাকে কিছুক্ষণ গালিগালাজ করে আমাদের ছোট একটা দল নিয়ে চুয়াত্তর নম্বরে গেলেন। রাসেল সাহেব আমাদেরকে চা-পানি খাইয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন, ভাই, আমার কি করার আছে? আমি কি কম বিপদে আছি। কুত্তার গুষ্টিকে কি দাওয়াত দিয়ে এনেছি আমার বাড়ী নোংরা করতে? তা কেউ কখনো করে বলেন? আপনারা যদি কিছু করতে পারেন তো ভালই। আমি আপনাদের সাথে আছি।

ঘটনা আগের মতই চলতে থাকল। আমরাও প্রায় অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি। বরং রাতের বেলা অনেকে শখ করে কুকুরের দলবদ্ধ মুত্রকান্ড দেখতে আসে। রিকশাওয়ালারা এই গলি পার হওয়ার সময় হাসতে হাসতে প্যাসেঞ্জারকে গল্প শোনায়। এলাকার নামই চেঞ্জ হয়ে যায় কিনা আমরা এই নিয়ে ভয়ে আছি। কিন্তু হারিস ভাই এখনো লেগে আছেন। এই গুরুতর সমস্যা নিয়ে তিনি ছাড়া আর কারো কোন মাথাব্যথ্যা নাই এই নিয়ে কিছুটা অভিমান করেছিলেন। তবে অভিমান নিয়ে বসে থাকলে তো আর তাঁর নেতৃত্বের বিকাশ হবে না। সুতরাং আবারো নতুন উদ্যমে লেগে পড়লেন। এবার তিনি আবার সবাইকে সোসাইটির অফিসে একত্র করলেন।

খেজুরতলার প্রায় সব বাড়ীওয়ালা উপস্থিত হল, শুধু রাসেল মিয়া আসেনি। লোকটা হারিস ভাইকে কোন পাত্তাই দেয় না। হারিস ভাইও উপস্থিত জনতাকে বললেন, কুকুরদের এই আচরণের জন্য চুয়াত্তর নম্বরের মালিক রাসেল মিয়াই দায়ী। চুয়াত্তর নম্বর বাড়িটা অভিশপ্ত এই বিষয়ে তাঁর কোন সন্দেহ নাই। রাসেল মিয়া নিজে চরম কুকুর বিদ্বেষী লোক। এর আগে নাকি সে একবার দু-তিনটা কুকুর মেরে ফেলেছিল। তারই প্রেক্ষিতে কুকুরেরা দলবদ্ধ প্রতিশোধ নিচ্ছে। আমরা উপস্থিত জনতার প্রায় সকলেই হারিস ভাইয়ের সাথে একমত হলাম। একমত না হয়েও উপায় নাই। হারিস ভাই ছাড়া তো আর কেউ তো কিছু ভাবনা-চিন্তাও করে না। আর কুকুর মারার ঘটনাও সত্য। সে ঘটনার দু-চারজন সাক্ষীও আছে।

সোসাইটির বর্তমান কমিটি যেন রাসেল মিয়ার উপর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয় তার দাবীও তিনি উত্থাপন করলেন। এতেও আমরা ভোট দিলাম। সিদ্ধান্ত হল, আগামী কাল থেকে এলাকার সমস্ত কুকুরে খাবারের আয়োজনে দায়িত্ব রাসেল মিয়ার। আর রাসেল মিয়া যেহেতু সভায় উপস্থিত নাই, হারিস ভাই কমিটির পক্ষ থেকে এই আদেশ রাসেল মিয়াকে পৌঁছে দেবেন।

আমাদের কেন যেন মনে হল এইবার হয়ত কুকুরদের এই আকাম বন্ধ হয়ে যাবে।
এবং সত্যি সত্যি তারা সেই দিন রাতেই কুকুরেরা চুয়াত্তর নম্বর বাড়ির সামনে মূত্র বিসর্জন বন্ধ করে দিল।
আর তারা নতুন জায়গা বেচে নিল মূত্রবিসর্জনের জন্য। সেটা ছাব্বিশ নম্বর বাড়ি। বাড়িটার মালিক আমাদের প্রিয় হারিস ভাই।

অমীমাংসিত

আজ বিকেলে নামিরার সাথে দেখা হবে। নামিরার সবচেয়ে বড় অভিযোগ আমি তাকে কখনো ফুল কিনে দিই না। দিই না ব্যপারটা একেবারে সেরকম না। যতবার ফুল কিনে দিই, নামিরা বলার পরে দিই। আগে থেকে কিনে নেয়ার কথা আমার মনে থাকে না। নামিরা বলে, নিজে থেকে কিনে না দিলে ফুলের কোন মান থাকে না। এই নিয়ে ছোট বড় মাঝারি সব ধরনে ঝগড়া হয়ে গেছে। আমি আগের মতই আছি। যাচ্ছিলাম চেরাগী পাহাড় থেকে নিউমার্কেটের দিকে। নজরুল স্কোয়ার আসতেই মনে হল চেরাগী পাহাড়ের ওখান থেকে তো ফুল কিনতে পারতাম।

রাস্তা ফাঁকা শুক্রবার দুপুরের রাস্তা। জুম্মার নামাজের পর রাস্তা আরো বেশি ফাঁকা থাকে। সুতরাং ঘুরে গিয়ে ফুল কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ইউ টার্ন নেয়ার জন্য গাড়ি স্লো করেছি, কোত্থেকে এক লোক উদয় হয়ে বাঁ পাশের লুকিং গ্লাস টা কট করে ভেঙে নিল। গ্লাস চোরেরা গ্লাস ভাংগাকে মোটামুটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এই নিয়ে তৃতীয় বার গাড়ির গ্লাস ভাঙল। আগের দুইবার ছিল অগোচরে। একবার নিউ মার্কেটে পাঁচ মিনিটের জন্য গাড়িটা রেখে ভেতরে গেছি আর আসছি, এসেই দেখি লুকিং গ্লাস টা নাই। পরের বার চকবাজারে। কিছুই করার নেই পকেটের গচ্ছা দেয়া ছাড়া। কিন্তু এইবার শালারে পাইছি সামনে। হার্ড ব্রেক কষে যখন নামলাম তখনো দেখি লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। এই ক্ষেত্রে সাধারনত যা হয় নিমিষেই তারা পগার পার হয়ে যায় ( এই পগার পারটা কোথায়, তা অবশ্য আমি জানিনা)। এই রকম হাবলার মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমিও যেন কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে গেলাম। সে দৌড় দিলে আমিও পিছু পিছু দৌড় দিয়ে তাকে ধরতাম, কিন্তু যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাতে কি করি! নিজেকে সামলে নিয়ে কলার চেপে ধরে টেনে হিঁচড়ে এনে গাড়িতে ঢোকালাম। সে বেশ নির্বিকার। গাড়িতে ঢোকানোর সময় বা টেনে আনার সময় কোন বাধা দেয়নি। গাড়িতে এমন ভাবে বসল যেন তাকে আমি লিফট দিচ্ছি। লোকটার দিকে ভালকরে তাকালাম এবার। টেকো মাথা। ভদ্র চেহারা, নাকের আগায় একটা দাগ আছে। খোঁচা খোঁচা তিন চার দিনের দাঁড়ি। গায়ে ফতুয়া। বুকের বোতাম খোলা। কিন্তু তার ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয় নি।

বনিকে ফোন দিয়ে বললাম, “তাড়াতাড়ি আমাদের বাসার গেটে আয়, সাথে বিটুকেও নিয়ে আয়।” আমাদের যাবতীয় কর্মকান্ডের অপারেশন মাস্টার বিটু। শুক্রবারের রাস্তা, সুতরাং নিমিষেই নিয়ে বাসার গেটে পৌঁছে গেলাম। বনি আর বিটু রেডিই ছিল, ‘ব্যাপার কি?’

সংক্ষেপে বললাম, ব্যাপার কি। বিটু বলল, মামাকে ছাদে নিয়ে চল। কিন্তু লোকটা এখনো নির্বিকার। চেহারার দিকে তাকালে মনে হয় যে আমাদের কর্মকান্ডে সে বেশ মজা পাচ্ছে। বনি তাকে কলার চেপে ধরে টানতে টানতে গাড়ি থেকে নামাল। দুগালে ঠাস ঠাস কয়েকটা বসিয়ে দিল। আমি বললাম, এখন থাক। ছাদে নিয়ে চল।

বনি আর বিটুর পরিকল্পনা হল ছাদে মুখ বেঁধে আচ্ছা মত বানানো। এর আগেও এ ধরনের অপারেশন আমরা ছাদেই করেছি। আমরা বলতে আসলে বনি আর বিটুই। মারামারি করার মত অত বেশি সাহস আমার নেই। অপারেশন আসলে বনি আর বিটুর। তারা মারামারি করে ঈদের আনন্দ পায়। শিকার ধরে এনে দিয়েছি আমার কাজ শেষ। সত্যি বলতে আমি যে ধরে আনতে পেরেছি এটাই বেশ। ছাদের নেয়ার জন্য কোন জোরজারি করা লাগেনি। নিজের মত স্বচ্ছন্দে ছাদে উঠে গেল।
ছাদে এসে লোকটা লুকিং গ্লাসটা খাওয়া শুরু করল। আমরা যেভাবে বার্গার খাই ঠিক সেভাবে। খাওয়ার সময় মুড়ি খাওয়ার মত কুড়মুড় আওয়াজ হচ্ছিল। খাওয়া শেষে লোকটা বলল, একটু পানি খাওয়ান। গলায় আটকে গেছে মনে হয়। আপনারা যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন, নজর লাগছে কিনা কে জানে। বিটু মারবে কি, নিজেই গিয়ে একগ্লাস পানি নিয়ে এল। পানি খেয়ে লোকটা বলল, বাথরুমে যাব। বাথরুমে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন, প্লিজ। আমি বাসায় বাথরুমে নিয়ে গেলাম। এতক্ষন পরে বনি বলল, জিনিস একখান। ওস্তাদ আদমি। কওয়া দরকার ফ্লাশ যাতে না করে। গ্লাস খাওয়ার পরে হাগামুতা কেমন হয় তা দেখা দরকার। তার কথাতে আমরা কেন জানি কেউই হাসলাম না।

এই দিকে নামিরা ফোন দিচ্ছে বারবার। আমি বের হলে সে রেডি হবে। বার বার শাসাচ্ছে দেরি করলে ফাইনাল বোঝাপোড়া হবে আজকে। বিটু আমাকে ধমক দিল, হারামজাদা! এইসময় পিরীতি না করলে হয় না! কিন্তু বনির ওস্তাদ আদমির তো বাথরুম থেকে বের হওয়ার কোন নাম নাই। আমরা ডাকাডাকি করলাম, ধরজা ধাক্কা দিলাম। কোন সাড়া নাই। শেষে মিস্ত্রী ডেকে দরজা ভাঙলাম।

দরজা ভেঙে দেখি ভিতরে কেউ নাই। কেউ ছিল, সে চিহ্নও নাই।

-০-

প্রিয় পাঠক, পেন্সিলে পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত আমার গল্পগ্রন্থ প্রত্যুষের গল্প পাওয়া যাচ্ছে রকমারি ডটকম এ https://www.rokomari.com/book/210151/prottusher-gollpo । অন্যান্য অনলাইন বুক শপেও পাবেন।

কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলো (শেষ কিস্তি)

বরযাত্রীরা চলে গেলে পাড়া-প্রতিবেশিরা কেউ আকারে ইঙ্গিতে, প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে দুয়ো দিতে লাগল। ‘এমন মেয়ে পেটে ধরার চেয়ে বিষ খেয়ে মরে যাওয়া ভাল। আমাদের ঘরে হলে কেটে দরিয়াতে ভাসিয়ে দিতাম। ছি ছি। ভাল ভাল ভাল, যেন কিছুই জানে না। ভাল’র এই নমুনা।‘ এতদিন সবাই পুতুল ভালবাসত। যেই মানুষের মত কথা বলা শুরু করলাম, পুতুল আর কারো ভাল লাগছে না।
এতদিন গাঁয়ের বাপ- মাদের কাছে আমি ছিলাম দৃষ্টান্ত। বড় হয়ে স্বভাবে চরিত্রে যেন আমার মত হয় এই কথা অনেক মেয়ে উঠতে বসতে শুনেছে। একদিনেই সেই চূড়া থেকে আস্তাকূড়ে নিক্ষিপ্ত হলাম। মা দোষ দেয় তাঁর কপালের। দোষ দেয় আমার বাবার, সে কেন মরে গেল। পাড়া প্রতিবেশি এত মারফতি কথায় নাই। তারা সরাসরি আমার দোষ দেখে। আমি তাদের সাথে একমত।
বিয়ে ভাঙার পরদিন শেফালি এসেছিল। শেফালি একসময় কাজে কর্মে মাকে সাহায্য করত। আমার স্কুল ড্রেস ধুয়ে দিত। ক’দিন আগে শ্বশুর বাড়ির তাড়া খেয়ে বাপের বাড়ি এসে জমা হয়েছে। ওর জামাই রিকসা চালক। ওর বাপ প্রতিজ্ঞা করেছিল জামাইকে একটা রিকশা কিনে দিবে। সেটা না দিয়েই বেচারা মারা গেল।
শেফালির জামাই ফরিদ প্রতিদিন ভাড়া রিকসা জমা দিয়ে বাড়ি আসলেই কথাটা মনে পড়ে আর শেফালিকে একচোট ঠেঙায়। নিত্যদিনের রুটিন। এতেও যখন কাজ হচ্ছিল না তখন সেদিন শেফালিকে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলে ফরিদ। তাকে অবশ্য খুব বেশি দোষ দেয়া যায় না। সারাদিন রিকসা টেনে সত্তুর-আশি টাকা রুজি হয়। এর মধ্যে কুড়ি টাকা দিতে হয়ে রিকসার মালিককে। নিজের একটা রিকসা থাকলে ডেইলি বিশ টাকা করে বাঁচত। মাসে ছয়শ টাকা। এদিকে বজ্জাত শ্বশুর রিকসা দিবে বলে মেয়ে গছিয়ে দিয়ে রিকসা দেয়ার নাম নাই। নিজেই মরে ভূত। এই ছয়শ টাকার হিসাবটা সেদিন একেবারে মাথাছাড়া দিয়ে উঠলে বউকে পিটিয়ে শুধু আধমরা করেনি, রিকসা করে মরা বাপের ভিটায় পৌঁছে দিয়ে গেছে।
শেফালি বলল, ‘মানুষ কত রকম কথা যে লাগাচ্ছে। এক সময় তোমাদের নিমক খাইছি। তাই খারাপ লাগে বুবু।’
বললাম, ‘শোন, যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা, আমি তার যোগ্য না। তার মোটর সাইকেল ছাড়া হবে না। আমার বাপেরও মোটর সাইকেল ছিল না। তার রঙিন টিভি ছাড়া চলে না, সে এম এ পাশ। আমার বিএ পড়াই এখনো শেষ হইল না। তার বাপ আছে, আমার বাপ নাই। অত যোগ্য লোকের ঘরে আমি যেতে চাই না।‘
‘আপা যে কি কন। আপনার মত মাইয়া এই গেরামে কয়টা আছে? ঐ বাপ-বেটা হইল আসলে বজ্জাত গুষ্ঠি। আমি মূর্খ মাইয়া মানুষ হইলেও এইসব বুঝি। কাজটা ভাল হইছে। বিয়ার নামে হাবিয়া দোযখে যাওয়ার দরকার কি। মানুষ বিয়া করে সুখ-শান্তির জন্য। সেইটাই যদি না থাকে তাইলে আর থাকল টা কি?‘
মা নাওয়া খাওয়া বলতে গেলে ছেড়ে দিয়েছেন। ছোট মামা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কারো সাথে কোন কথাবার্তা বলছেন না। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম।
তৃতীয় দিন বিকেল বেলা ঘরে শুয়ে আছি। অজস্র ভাবনা মৌমাছির মত মাথার চারপাশে ভোঁ ভোঁ করছে। হঠাৎ বাইরে থেকে ‘যুথী! যুথী!’ ডাক।
দরজা খুলে দেখি আমাদের স্কুল টিচার সিতারা আপা দাঁড়িয়ে। মাথায় ছাতা। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, আবহাওয়া যাই হোক না কেন এই ছাতা ছাড়া আপাকে কখনো দেখি নাই। হাতে হ্যান্ড ব্যাগ। দীর্ঘদিনের ব্যবহারে দুপাশে একটু চামড়া ওঠা। এটাও তাঁর সব সময়ের সাথী।
আপাকে দেখে বুকটা ধ্বক করে উঠল। খুব কড়া টিচার ছিলেন। মেয়েদের কাছে মূর্তিমান আতংক। একবার আমাকে সারাক্লাসে বেঞ্চের উপরে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। এখনো স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বুকে শিরশির করে। মনেহয় সিতারা আপা ডেকে নিয়ে কানমলে দিবেন।
আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘তোমার সাথে দেখা করতে চলে এলাম। আই এম প্রাউড অব ইয়ু।‘
আপা কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
‘এভাবেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। ব্রাভো! ব্রাভো! কাউকে না কাউকে তো দাঁড়াতে হবে। নইলে লড়াইটা শুরু হবে কি করে!’
মা’র সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে আপা বিদায় নিলেন।
সিতারা আপা আশায় অনেক কাজের কাজ হয়েছে। ভেতরে ভেতরে আমিও কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। তিনি একটা নাড়া দিয়ে গেলেন। আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। সবচেয়ে বড় উপকার যা হয়েছে তা হল মা স্বাভাবিক হয়েছেন। সিতারা আপা যাওয়ার পর থেকে তিনি আবার কথা-বার্তা খাওয়া দাওয়া শুরু করেছেন। আমি কল্পনাও করিনি সিতারা আপা ছুটে আসবেন আমার বাড়িতে। বলবেন, ‘এমন মেয়ে তৈরি করার ব্রত নিয়েই তো আমি শিক্ষকতা শুরু করেছিলাম।‘
সিতারা আপা যেন ফেরেশতা হয়ে এসে আমাকে পথ দেখিয়ে গেলেন। সিতারা আপার ‘ব্রাভো! ব্রাভো!’ যে কত বিশাল তা যারা আমাদের সাথে একস্কুলে পড়েনি তারা কেউ বুঝতে পারবে না। তিনি বলে গেলেন, ‘তুমি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-মন্ত্রী-এমপি হলেও এমন খুশি হতাম না।‘
তারপর দিন থেকে আমি কলেজে যাওয়া আসা-শুরু করলাম, পথে ঘাটের টিপ্পনি উপেক্ষা করে।

মাসখানেক পর।
আমি প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে দাঁড়িয়ে আছি। অনেক্ষণ ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার পর ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেলাম। পিয়ন বার বার এসে জিজ্ঞেস করেছে, কি চান? আমি স্যারের সাথে দেখা করতে চান কেন সেটা বলেন।
সেটা স্যার কে বলব। আপনাকে কেন বলব? আপনি কি স্যার।
দেখা হবে না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। নিষেধ আছে।
আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব। স্যার বের হলে কথা বলব।
প্রায় ঘন্টা খানেক দাঁড়িয়ে থাকার পরে স্যার ঢোকার অনুমতি দিলেন। আগে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম এখন ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। প্রিন্সিপালের অত্যন্ত রাগী এবং কড়া মানুষ। চেহারা স্কুলের হেডমাস্টারের মত ভয়ংকর। চোখে কুচকালো মোটাফ্রেমের চশমা। নাকের দুপাশে হিটলারি স্টাইলের গোঁফ। সেটা তাঁকে তিনি যত না ভয়ংকর তার চেয়ে বেশি ভয়ংকর করে তুলেছে। তাঁর চেহারার কথা বলে অনায়াসে যে কোন বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানো যায়। আমার ধারণা স্যারের আত্মীয়-প্রতিবেশিরা বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর সময় এই সুযোগটি হাতছাড়া করে না।
আমি প্রায় পনের মিনিট দাঁড়িয়ে আছি। স্যার কাজ করেই যাচ্ছেন। চেম্বারে আর কেউ আছে সেটা ভুলে গেছেন। স্যার কি ইচ্ছা করে আমাকে উপেক্ষা করছেন। বাইরে জোর করে দাঁড়িয়ে ছিলাম তাই শাস্তি। দেখি কতক্ষণ এ শাস্তি চলে।
বেশিক্ষণ চলল না। স্যার মুখ তুলে জজ্ঞেস করলেন কি চাও?
স্যার আমার একটা জরুরি কথা ছিল।
সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।
স্যার আমাদের কলেজে মেয়েদের জন্য কোন ক্যান্টিন নেই। ঐ দোকানটাতে সব ছেলেরা গিজ গিজ করে। চা-সিগারেট খায়। মেয়েরা যেতে পারে না। সারাদিন ক্লাস থাকলে মেয়েদের খুব কষ্ট হয়।
দেখ, আমাদের কলেজটা খুব ছোট। জায়গা নেই। আমাদের বিশেষ কিছু করার নেই। এই নিয়ে আগেও অনেকবার আলাপ আলোচনা হয়ে গেছে। এই চ্যাপ্টার শেষ। যাও।
যাওটা বেশ রাগ নিয়ে বললেন। এরপর না বের হয়ে পারা যায় না।
আমি তবু বললাম, স্যার, আমি তো এইটা বলতে আসি নি। আমি বলতে চাই স্যার, মেয়েদের কমন রুমে এক কোনায় একটা টেবিল বসিয়ে দিলে, কেউ এসে যদি ঘরে বানানো কিছু বিক্রি করে তবে—–
মানে?
স্যার আমি বলতে চাইছিলাম অমন কোন ক্যান্টিন না। জাস্ট একটা টেবিল বসিয়ে যদি একজন কিছু সিঙ্গারা টিংগারা বিক্রি করে আমাদের বেশ উপকার হয়।
বলছিনা হবে না। যাও।
যাও টা বেশ হুংকার দিয়ে বললেন। এরপর দাঁড়ানো মানে ফাঁসিতে ঝুলে পড়া।
দুদিন পরে আমি আবার গেলাম। এবার কথাটা অন্যভাবে পাড়লাম। বললাম, স্যার আমিই বাড়ি থেকে সিঙ্গারা এনে বিক্রি করব। আপনি যদি অনুমতি দেন। আমার এতে অনেক উপকার হবে, অন্যদেরও হবে। নিজেকে খুব বিপন্না হিসেবে উপস্থাপন করলাম।
স্যার রাজি হলেন। বললেন আগে সিঙ্গারা বানিয়ে এনে আমাকে খাইয়ে দেখাও। যদি পছন্দ হয় অনুমতি পাবে।
শেফালি, ফৈজি আর নাজু – এই তিনজনকে নিয়ে আমি একটা দল তৈরি করলাম। এদের সকলের ইতিহাস শেফালির মত। স্বামী পরিত্যাক্তা। এদেরকে সিঙারা বানানো শেখালাম। সকালে এরা তিনজন আলু কাটে। ভাজি করে। আমি আটা তৈরি করি। সেই আলু-সিঙারা শেফালির মাথায় চাপে। ও নিয়ে যায় কলেজে। মেয়েদের কমন রুমে। সেখানে কোনায় একটা ক্ষুদ্র টেবিলের পেছনে দাঁড়িয়ে ও সিঙ্গারা বিক্রি করে।
প্রথম দিন সিঙ্গারা নিয়েছিল তিরিশটা। শেষ হয়ে যাওয়ার পর মেয়েরা পই পই করে শেফালিকে বলে দিল পরের দিন যেন বেশি করে আনে। সিঙ্গারা বানাতে খরচ হয় দেড়টাকা। বিক্রি হয় দুইটাকা।
দিনকে দিন বিক্রি বাড়তে থাকে। আগে মেয়েদের জন্য কলেজে শুকনো বাদাম ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সিঙ্গারার উপরে তাই মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কলেজের গন্ডি ছাড়িয়ে বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে সিঙ্গারার খুশবু। বাজারের কনফেকশনারী দোকানগুলোও আমাদের সিঙ্গারা রাখতে চায়। আমরা সাপ্লাই দিয়ে শেষ করতে পারি না।
আসা যাওয়ার পথে ছেলেরা টিপ্পনি কাটে। বলে, সিঙ্গারাওয়ালী যায়। বলুক,তাতে কি আসে যায়।
আমি দল বাড়াই। গাঁয়ের মেয়েরা একের পর এক যুক্ত হতে থাকে। বাড়ির একপাশে একটা দোচালা বানাই। ওখানে ওরা সিঙ্গারা বানায়। সেলাই করে। জামা বানায়, কাঁথা তৈরি করে। আমি বাজারের গার্মেন্টস দোকানে দোকানে ঘুরে মেয়েদের বানানো জামার অর্ডার নিই।
আমরা শুধু সিঙ্গারা আর জামা-কাঁথাতে থাকি না। আমাদের খামার হয়। সেখানে হাঁস-মুরগি ডিম পাড়ে। গরু দুধ দেয়। একে একে অসহায় মেয়েরা আমার কাছে আসতে থাকে। এক দুই করে পঞ্চাশ, ষাট। যারা আসেনি তারা তাদের জামাই মার-ধোর করলে হুমকি দেয়, যুথী আপার কাছে চলে যাব।
ব্যাংকের লোকেরা আসে। তারা ঋণ দিতে চায়। আমাদের ঋণ লাগে না। তবু তারা ঋণ দিবেই। আমি একজনকে দেখিয়ে বলি, ওকে ঋণ দিন। ওর খুব দরকার। তার ঘর দরকার। একটা সেলাই মেশিন দরকার। তারা ওকে দেবে না। ব্যাংকের অদ্ভূত নিয়ম যার দরকার নেই তার পিছে ঘুরবে। যার দরকার তাকে দিবে না।
আমাদের পিছে লাগে এনজিও। আগে গ্রামের মেয়েরা তাদের জন্য জামা বানাত, কাঁথা বানাত। সেগুলো তারা সামান্য দামে কিনে নিত। এখন আমরা নিজেরাই সেগুলো দোকানে বিক্রি করি। বাজারে আমাদের একটা শো রুম আছে। সেখানে বিক্রি হয়। ছোট মামা সেই শো রুম বসেন।
এরপর আসে সাংবাদিক। আমাকে নিয়ে রিপোর্ট করতে হবে। আমি পাত্তা দিই না। কিন্তু একজন পিছু ছাড়ে না। সে রিপোর্ট করবেই। ভালকথা। সে ঘুরে ঘুরে আমাদের কাজকর্ম দেখে। মেয়েদের সাথে কথা বলে। আমাদের আয়-রোজগারের খবর নেয়। তারপর সে প্রস্তাব দেয় রিপোর্ট করার জন্য তার বেশ খরচাপাতি আছে। এই খরচ আমাদেরকেই জোগাতে হবে। বেশ মোটা অংকের খরচ।
আমরা বলি রিপোর্ট করার দরকার নাই। কিন্তু সে রিপোর্ট করবেই। আমরা খরচ না দিলে উল্ট-পাল্টা করবে। আমরা বলি, ‘মরেন গিয়া।‘
কয়দিন পরে সে একগাদা খবরের কাগজ বোঝায় হাতে হাজির হয়। আমি বলি সাংবাদিকতা ছেড়ে কি হকারি ধরলেন? জবাব না দিয়ে সে আমার দিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল। সেখানে এক বিরাট অনুসন্ধানী রিপোর্ট। সে রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, আমি কিভাবে গ্রামের সহজ সরল মেয়েদেরকে ফুসলিয়ে তাদের সংসার ভেঙ্গে ফেলি। তারপর তাদেরকে এনে বিনা পয়সায় খাটিয়ে আমি পয়সা কামাই করি। এমনকি আমি তাদেরকে দিয়ে নানা সমাজ বিরোধী কর্মকান্ড চালাই বলেও খবরে প্রকাশ। রাতের বেলা এখানে বখাটে লোকজন আসে। তাদের মনোরঞ্জনের জন্য আমি মেয়েদের লাগিয়ে দিই। লোকটা্কে গলাটিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হল।
আমি তবু ঠাণ্ডা মাথায় বললাম, ‘বানিয়ে বানিয়ে আপনি এসব কি লিখেছেন? এইসব জঘন্য কথা কিভাবে লিখতে পারলেন? বিবেক বলে কি কিছু নাই?
– আপনাকে তো বলেছিলাম, আপনি সহযোগিতা না করলে আমি নিজের মত রিপোর্ট করব।
– তাই বলে এভাবে জঘন্য মিথ্যা কথা লিখবেন।
– সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা তো করতেই হবে।
ঘৃণায় আমার গা রিরি করে উঠল। বললাম, তাতে আমার এমন কিছু যায় আসে না। আপনার এই কাগজ মানুষ বাচ্চাদের শুচু করানোর জন্যও ইউজ করে না। আমার মনে হয় না কেউ পয়সা দিয়ে এই কাগজ কেনে। এই পেপার নামও কেউ জানে না।
সে হাসল। শয়তানের হাসি। বলল, আপনি ঠিক বলেছেন। কেউ কেনে না। কেউ পড়ে না। কেউ নামও জানে না। সব ঠিক। তবে আমি এই গ্রামের ও আসে পাশের গ্রামের সবার কাছে এইগুলো ফ্রী ফ্রী বিলি করব।
রাগে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল। মনে হচ্ছিল, ছেলেটাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলি। বললাম, আপনি চান টা কি? সে বলল, কি চাই আপনি ভালো করে জানেন। আমার খরচাপাতি। সেটা দিয়ে দিলেই আমি আর এগুলো বিলি করব না। সব কাগজ আপনার কাছে রেখে যাব।
বললাম ঠিক আছে। আপনি বসেন, আমি ব্যবস্থা করছি। যা চান তাই পাবেন।
তাকে বসতে বলে আমি বের হয়ে গেলাম। গিয়ে শেফালি আর বান্টুলিকে ডাকলাম। বান্টুলি গায়ে গতরে বেশ বড়সড়। লম্বা চওড়া কালো শরীর। খান্ডারনি মহিলা বলে ওর কুখ্যাতি আছে। ওদের সাথে পরামর্শ করলাম।
ওরা চা নিয়ে সাংবাদিক ভাইয়ের কাছে গেল। চা হাতে নিয়ে ভদ্রলোক চুমুক দিতে গেলেন। আচমকা বান্টুলি ভদ্রলোকের মুখ চেপে ধরল। কাপছুটে গরম চা গায়ে পড়লে ভদ্রলোক চিৎকার করার অবসর পর্যন্ত পেল না। শেফালির হাতে থাকা ওড়না দিয়ে ভদ্রলোকের মুখ বেঁধের ফেলল। বান্টুলি লোকটাকে এমনভাবে ধরল, সে গোঁ গোঁ করা ছাড়া আর কিছু করার উপায় রইল না। তার হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখল।
সন্ধ্যার পরে যখন মেয়েরা সব বাড়িতে চলে গেলে তাকে আমরা মুরগির খোঁয়াড়ে ফেলে রাখলাম। আমি বল্লাম, ‘তুমি আমাকে চেন নাই। সাংবাদিক দেখে সম্মান দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি যে কি জিনিস তোমার জানা উচিত ছিল। এখানে আসার আগে ইতিহাসটা ভাল করে পড়ে আসলে ভাল করতে। আমার পিছে লাগতে আসার মজাটা তুমি টের পাবে।‘
রাতের বেলা মুখে কালি মেখে বাঁধন খুলে দিয়ে, আমরা চোর চোর বলে চিৎকার শুরু করে দিলাম। গ্রামের লোকজন এসে গণপিটুনি দিয়ে আধমরা করে দিল।
এরপর দিন ভালই যাচ্ছিল। তবু মাঝে দিন কাটে না। ভাল লাগে না। কাজ করতে ইচ্ছে করে না। সারা দিন শুয়ে থাকি। এর মাঝে আবার এক ব্যাংকার আমার পিছে লাগে। কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার।
কিন্তু তার উদ্দেশ্য ঠিক পরিষ্কার না। ঋণ দিতে চায় বলে মনে হয় না। বলে, এদিকে একটা প্রজেক্ট দেখতে এসেছি, তাই আপনার প্রজেক্টগুলোও দেখে যেতে চাই। অনেক কিছু শেখার আছে। আমি পরিষ্কার বলি, কোন লোন আমি নেব না। ভদ্রলোক বলে, সেটা আমি জানি না মনে করছেন। আপনার সবকিছু আমি জানি। আপনার সব খবরাখবর আমি জেনে গেছি। বললাম না অনেক কিছু শেখার আছে।
ভদ্রলোক মাঝে মাঝেই আসেন। নানান ছুতোয়। এদিকে একটা পার্টির সাথে দেখা করতে এসেছি। একটা প্রজেক্ট দেখতে এসেছি। বিকেলে একটু হাঁটতে বেরিয়েছি। এদিকে হাঁটাহাঁটি করলে বেশ ফ্রেশ এয়ার পাওয়া যায়।
এসে আমার সাথে গল্প করেন। কোন কজের গল্প না। হাবিজাবি। মার সাথেও বেশ জমিয়ে নিয়েছেন। সেই বিয়ে ভাঙার পর থেকে মা আমার সাথে স্বাভাবিক না। তিনি তাঁর মত থাকেন, আমি আমার মত কাজ করে যাই। মাঝে মাঝে আত্মীয় স্বজনের কাছে হা-হুতাশ করেন। আমি গা করি না।
কিন্তু এই ম্যানেজার এলে মা বেশ খুশি হন। আমার সম্পর্কে হাজারটা অভিযোগ করেন। যেন সে আমাদের আত্মীয়। ভদ্রলোক উল্টো মার কাছে আমার তারিফ করেন। মা তার কথা জিজ্ঞেস করেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ভদ্রলোকের বাবা মারা গেছে ছোট বেলায়। কষ্ট করে মানুষ হয়েছে। ভাই-বোনদের প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। এইসব করতে করতে কখন যে বেলা বেড়ে গেছে খেয়াল ছিল না। নিজে বিয়ে থা করার অবকাশ পান নি। এই খবরটা শুনে মা বিশদ খুশি।
লোকটা এলে যে আমারও যে খারাপ লাগে তা না। যেদিন আমার দিন কাটে না, সেদিন তার কথা মনে হয়।
দু একদিন না এলে মাও ছটপট করেন। ইদানিং মা বড় একা। লোকটা এলে যেন একটু দম ফেলে। মা একদিন আমাকে বলে, ভয়ে ভয়ে বলে, তুই সাইজুদ্দীনকে বিয়ে করে ফেল না।
সাইজুদ্দীন না টা কে।
ঐ যে ব্যাংকের ম্যানেজার।
আশ্চর্য আমি আধবুড়োটার নামটাই জানতাম না।
আধবুড়ো বলছিস কেন? একটু বয়স হয়েছে। এখনো দাঁড়ি-গোঁফ পাকেনি।
না, মা তা কি করে হয়।
ম্যানেজার তবু আমাদের আসে। গল্প করে। ভদ্রলোক আমাকে মুগ্ধ করার নানান উপায়ে চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি মুগ্ধ হই কি না, এ নিয়ে সারাক্ষণ দোটানায় থাকে।
কি জানি, হয়ত একদিন তাকে বিয়ে করেই ফেলব। এই কথাটা ভাবতে আমার খারাপ লাগে না।
—কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলো
—আন্‌ওয়ার এম হুসাইন

–সমাপ্ত–
[অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১ উপলক্ষ্যে পেন্সিল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হচ্ছে আমার গল্পগ্রন্থ ‘প্রত্যুষের গল্প’

কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলো

বিয়েটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। নম্র, ভদ্র বলে গ্রামে আমার যথেষ্ঠ সুনাম ছিল। সাতচড়ে রা না করা মেয়ে। সাধারণত এই ধরনের মেয়েদের বিয়ে ভাঙে না। পাড়া-প্রতিবেশি তো বটেই, আমাদের চরম শত্রুও জানে আমি বড় ভাল মেয়ে। তবে কালো। আমাদের গ্রামের ইতিহাসে আমিই একমাত্র আমার টাইপ মেয়ে যার বিয়ের আসরে বিয়ে ভেঙ্গে জীবিত মা ও মৃত বাবার মান ইজ্জত চুনাচুনা করে দিয়েছিল। ঘটনাটা তাই যথেষ্ঠ কুখ্যাতি পেয়েছিল। শুধুমাত্র আমার বাপ-মায়ের দুর্ভাগ্য নিয়ে আলোচনা করে গ্রামের মেয়েদের বহু বিকেল সন্ধ্যার আড্ডা সারা হত। বাপ-মায়েরা কায়মনো বাক্যে প্রার্থনা করত, তাদের কারো মেয়ের ভাগ্য যেন আমার মত না হয়। স্বীকার করি দোষটা আমারই।

মায়ের দিক থেকে সেই বিয়ের আয়োজনে কোন ঘাটতি ছিল না। দুটো দুগ্ধবতী গাভী ছিল। সেগুলো বিক্রি হয়ে গেল। বাবার রেখে যাওয়া সমস্ত ধানী জমি বন্ধক দেয়া হল। মাসিক দশটাকা হারে সুদের উপর টাকা সংগ্রহ হল। এমনকি আমাদের বাগানে যে সমস্ত ফলবতী নারিকেল বিথী তাদেরকে পর্যন্ত বন্ধক দিতে মা আলস্য করেনি। মেয়ে পার করার জন্য মা সমস্ত অসাধ্য সাধনে নেমে ছিলেন।
কারণ ছেলে ভাল। পান বিড়ি সিগারেট কিছু খায় না। এমনকি চায়ের দোকানে বসে আড্ডা পর্যন্ত দেয় না। এক চান্সে বিএ পাশ করেছে। সে সময় এক চান্সে বিএ পাস করাটাও একটা বিশেষ গুণ ছিল। মাস্টার্স পড়া শেষ, পরীক্ষা হয়ে গেছ। এটাও ভালই ভালই পাশ দিবে। বাপের একমাত্র পুত্র সুতরাং চাকরি বাকরি হইল কি হইল না সেই নিয়েও কোন চিন্তা নাই। বাপের বেশ জমি-জমা সহায় সম্পত্তি আছে। উঁচু বংশ। চেহারা রাজপুত্রের মত। ছেলেদের চেহারা অবশ্য তেমন কোন ব্যপার না। আমি তখনও তাকে দেখিনি, সেও আমাকে দেখেনি। বাপ-মায়ের পছন্দই তার পছন্দ, এমনি ভাল ছেলে।
ছেলের বাপ নিজে মেয়ে দেখতে এসেছিলেন। সাথে ছেলের বড় মামা। মেয়েদের মধ্যে এসেছিল তার মা আর বড় বোন। তারা আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। দেখে দেখে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল গায়ের রঙ ময়লা। এই নিয়ে আমার মায়েরও ভয়ের অন্ত ছিল না। এর আগে বেশ কটা সম্বন্ধ হয়ে হয়েও হইল না। কালো মেয়ে গ্যগপার করা বেশ কষ্টের। আমার মা অবশ্য কালো বলে না, বলে শ্যামলা। গড়ন সুন্দর। কিন্তু পাত্রপক্ষ সোজাসাপ্টা বলে দেয় গায়ের রঙ মন্দ।
তবে এবারে সুপাত্রের সুপিতা-মাতা আমার গায়ের রঙ কালো হলেও না করলেন না। রাজী হয়ে গেলেন। বাপ-মরা কালো-কুলো মেয়ের এমন কপাল দেখে আমার মায়ের চোখে আনন্দের বন্যা।
সেদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে ছেলের বাবার কাছে আমার ডাক পড়ল। ছেলের বাবা বললেন, ‘অনেক তো পড়ালেখা করেছ, কোরআন মজিদ পড়তে জান?‘
‘জ্বী জানি’
‘খুব ভাল, খুব ভাল। এই বিদ্যাই হল আসল বিদ্যা, মা।‘
‘সূরা ইয়াসীন মুখস্থ পার?’
‘জ্বি না’।
‘এইটা কি বললা? সূরা ইয়াসীনের কত ফজিলত তুমি জান না? এ সূরাকে কোরআন মজিদের হৃৎপিন্ড বলা হয়েছে আহা! বিয়ের আগেই সূরাটা মুখস্থ করে নেবে। সকাল বিকাল পড়বে। মনে থাকবে?’
‘জ্বী, মনে থাকবে।‘
‘বেশ বেশ।‘
তাদের দাবী দাওয়াও খুব একটা ছিল না। কিন্তু পাত্রপক্ষকে তো আমাদের সম্মান করাই লাগে। বিশেষ করে, তাদের আত্মীয় স্বজন আছে, বন্ধু-বান্ধব পাড়া-প্রতিবেশী আছে। পাঁচজনে যখন জিজ্ঞেস করবে ছেলে বিয়ে করিয়ে কি পেলে তখন তারা কি জবাব দেবে।
‘বুঝলেন, বেয়াইন সাহেব, আমি যৌতুক প্রথা একদমই পছন্দ করি না। একটা মেয়ের জন্য এটা মস্ত একটা অপমানজনক বিষয়। বিয়ের পরে আপনার মেয়ে মানে আমার মেয়ে, আর মেয়ের জামাই মানে তো আপনার ছেলে। আর আপনারও তো আর ছেলেপেলে নাই। সেই জন্য আমি বলি কি আপনি ছেলের জন্য একটা মোটর সাইকেলের ব্যবস্থা করে ফেলেন। বুঝেন তো, না হলে গ্রামবাসীর কাছে আমার মুখ থাকে না। শিক্ষিত একটা ছেলে। একেবারে খালি হাতে বউ নিয়ে গেলে নানান জনে নানান কথা বলবে।‘
মা বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।‘ হাসিমুখেই বলেন।
ছেলের বাবাও বলেন, ‘মাশা আল্লাহ, বেয়াইন, মারহাবা।‘
ছেলের মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি মারহাবা বল না কেন? তোমার মন খারাপ হইতেছে নাকি?’
ছেলের মামা বলল, ‘মারহাবা’।
তোমরা তো শুধু একটা ম্যানা গরু হাতে ধরিয়ে দিয়ে বোনকে পার করছিলা। আজীবনতো আমারটাই তো খেয়ে গেলা। কোনদিন তো দুই পয়সা বাইর করলা না।‘
ছেলের মামা কিছু একটা বলতে নিয়েছিল, তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওসব কথা থাক। যে কাজে আসছি, সেটাতে মনযোগ দাও।‘
ছেলেদের একটা সাদাকালো টেলিভিশন ছিল। তাদের গাঁয়ের আরো কারা যেন একটা রঙিন টেলিভিশন কিনে এনেছে। এখন তাঁদের ঘরে রঙিন টিভি না হলে তাদের মান-ইজ্জত থাকে না। আমার মার উচিত তাদেরকে একটা রঙিন টিভির ব্যবস্থা করা। বেয়াইর ইজ্জত মানে আমার মায়েরও ইজ্জত। বিয়ের পরে জামাই-বউ একসাথে নাটক-সিনেমা দেখবে এতে মিল মহব্বত বাড়বে। বড় আধুনিক শ্বশুর।
এভাবে মারহাবা লম্বা থেকে লম্বাতর হতে থাকে।
এছাড়া তারা বড় ঘর। সুতরাং আত্মীয় স্বজনের লিস্ট অনেক লম্বা। পাঁচশ বরযাত্রীর আয়োজন করা প্রয়োজন। মেয়ের হাতে কানে গলায় কিছু স্বর্ণ গয়নাও লাগে। কালো মেয়ে, খালি গা ভাল দেখায় না। আপনারই মেয়ে। স্বর্ণগয়না, জেওরপাতি তো তারই থাকবে। টাকাপয়সা আর কার জন্য? আমরা আর কয়দিন।
মা সকল কিছুতেই বলেন আলহামদুলিল্লাহ। কালো মেয়ে নিয়ে তিনি বড়ই বিপদে ছিলেন। ছেলের বাবার আজীবন গোলামী করতেও যেন রাজী ছিলেন।
ছেলের বাবা জানেন ফেয়ার এন্ড লাভলি কোন দিনই কালো মেয়ে ফর্সা করে না। কালো মেয়ে ফর্সা করতে উপযুক্ত দান-সামগ্রীর কোন বিকল্প নাই। তবে জাতের মেয়ে কালো ভাল।
ছোট মামা উপস্থিত ছিলেন। তিনি সোজা-সরল মানুষ। তাও মানতে পারছিলেন না। এত কি সম্ভব! কিন্তু আমার মা মরিয়া। মামাকে চোখ রাঙানি দিলেন। তিনি চুপ করলেন।
তবুও ছোটমামা সাহস করে একটা কথা পাড়লেন। বললেন, যুথী তো ডিগ্রী ক্লাসে ভর্তি আছে। সে কি পরীক্ষা দিতে পারবে? ছাত্রী ভাল ছিল। সুযোগ পেলে এক চান্সে পাস করে ফেলবে।
ছেলের বাবা সেটা হেসেই উড়িয়ে দিলেন। বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের আর পড়ার দরকারই বা কি! কালো বলেই না মেয়েকে এতগুলি ক্লাস গুণতে হয়েছে। নইলে তো ম্যাট্রিকের পরেই বিবাহ হয়ে এত দিনে বাচ্চা-কাচ্চার মা হয়ে যেত।
সবাই চলে গেলে মাকে বললাম, ‘তুমি যে বড় রাজি হয়ে গেলে? এইসব জোগাড় করবে কি করে?’
মা আমাকে চুপ করিয়ে দিলেন। ছোট মামাকে ডেকে তাঁকে দিয়ে সব আয়োজন করছেন।
বিয়ের দুদিন আগে, ছোটমামা নিজেই মুষড়ে পড়লেন। তিনি খবর পেয়েছেন, ছেলে সম্পর্কে যা শুনেছেন তার মধ্যে অনেক কিছুই ভুল আছে। ছেলে মাস্টার্সে পড়ে না। বিএ পাস করেই পড়ালেখা শেষ। কাজকর্ম কিছু করে না। বাপের হোটেলে খায়। বাপের যে খুব আহামরি অনেক কিছু আছে তা না। গ্রামে একটা মুদি দোকান আছে। খুব বেশি বেচাবিক্রি নাই। চেহারাও নাকি অত ভাল না। মাথায় চুল কম।
মা বিচলিত হন না। মেয়ে পার করা অতি জরুরি। বিয়ে হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কালো মেয়ে পার করা অত সহজ না।
মামা তবু সাহস করে বলে, নিজের মেয়েকে অমন কালো কালো করছ কেন? যুথী কি কাল? ও তো শ্যমলা।
তুই আর আমি শ্যামলা বললে তো হবে না। আর দশজনে বললেও হবে না। পাত্রপক্ষ বলতে হবে। আর শ্যামলা বলানোর জন্য যা করা দরকার তাই করছি।
বিয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে কবুল বলার আগে, আমি বললাম, ‘আমার একটা কথা আছে।’ কাজী সাহেব অনুমতি দিলেন। আমি বললাম, ‘আমার সূরা ইয়াসীন মুখস্থ করার কথা ছিল। আমি মুখস্থ করেছি।‘ ছেলের বাবা বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।
আমি সূরাটা শোনাতে চাই।
তার আর দরকার নেই মা। তোমাকে বাড়িতে নিয়ে একবারেই শুনব। কাল সকালে ফজরের নামাযের পরে তোমার মধুর সুরে তেলাওত শুনব, ইনশা আল্লাহ।
দরকার আছে বাবা। ঠিকমত হল কিনা সেটা যাচাই করা দরকার। আপনি মুরুব্বী মানুষ একটা আবদার করেছিলেন। বলেই আমি বিসমিল্লাহ পড়ে আবৃত্তি করা শুরু করলাম। ইয়া-সীন—‘
কেউ কেউ মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কেউ কৌতুহল নিয়ে শুনছে। কাজী সাহেব খাতায় নাম ঠিকানা লিখছেন। বরের বাবার চেহারায় অধৈর্য। আমি কোন দিকে কিছু ভ্রুক্ষেপ না করে পড়ে যেতে লাগলাম। বর মুখ থেকে রুমাল নামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি করবে বুঝতে পারছে না।
শেষ হয়ে গেলে বরের বাবা মারহাবা বলতে ভুলে গেলেন। তিনি হয়ত অন্য কিছু ভাবছিলেন। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম ঠিকমত হয়নি বাবা? তখন তাঁর সম্বিত ফিরে এল। তিনি বললেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ। অবশ্যই। কাজী সাহেব এবার শুরু করেন।
বললাম, আরেকটা কথা আছে। বরের বাবা অস্থির হয়ে বললেন, আবার কি?
সেদিকে না তাকিয়ে সরাসরি বরের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনি সূরা ইয়াসিন পারেন?’
ছেলে থতমত খেয়ে বলল, জ্বী।
‘সূরা ইয়াসীন পারেন?’
এইবার চারিদিকে ফিসফাস শুরু হয়ে গেল। ছেলে চুপ। ছেলের বাবা বলে, ‘এইসব কি শুরু হইছে? বিয়ের পরে তোমরা সারাদিন কোরআন মজিদ নিয়ে আলোচনা করতে পারবা। তোমার ধর্মভক্তিতে আমরা মুগ্ধ। এখন আগে বিয়ের ঝামেলাটা শেষ করি।
মা আমাকে বারবার চিমটি চিমটি দিতে দিতে সেটাকে খামচিতে রূপান্তর করে ফেললেন। এবার দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললেন, কি শুরু করলি। মাথা ঠিক আছে?
কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘জানেন কি জানেন না?’
ছেলে বলল, ‘না’।
জানা উচিত ছিল। এটা অনেক ফজিলতপূর্ন সূরা। এ সূরাকে কোরআন মজিদের হৃৎপিন্ড বলা হয়েছে।
এইসব আজাইরা কথা বন্ধ কর। কাজী সাহেব শুরু করেন।
না। উনি সূরা ইয়াসীন না মুখস্থ করলে হবে না। আগে উনি সূরা ইয়াসীন মুখস্থ করবেন তারপরে আমি কবুল বলব।
বেয়াইন সাহেবা, আপনার মেয়ের এই বেয়াদবী কিন্তু সহ্যের বাহিরে। আমার মা পারলে আমার দুই গালে দুইটা চড় দেন। নিজের দূর্ভাগ্যের জন্য আমাকে মনে মনে শত টুকরা করে দরিয়ায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন।
আমি আমার কথায় অটল। এত টাকা দিয়ে মা যে ছেলে আমার জন্য কিনে নিচ্ছে সে সূরা ইয়াসীন পারে না, তা কি করে হয়। এত ফজিলতপূর্ন একটা সূরা না জানলে হবে কি করে?
বরের বাবার মাথায় যেন বজ্রপাত হল। তিনি হুংকার দিয়ে কি বললেন আমি ঠিক বুঝলাম না। উঠান থেকে লোকজন ঘরে ঢুকে পড়ল। চারিদিকে একটা হট্টগোল। হৈ হৈ রৈ রৈ। ধর-মার-কাট। কে একজন যেন আমার দিকে তেড়ে আসল। আমার মা টেনে আমাকে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দুই গালে ইচ্ছে মত কষালেন। আর একটু হলে আমার দু-একটা দাঁত পড়ে যেত। মা একটু শান্ত হলে মাকে বললাম, যা হয়েছে ভাল হয়েছে। তিনি শুরু করে দিলেন, বিলাপ করে কান্না। আত্মীয় স্বজন পাড়াপ্রতিবেশি কেউ সান্তনা দিচ্ছে, কেউ গঞ্জনা।
মা পারলে আমার গলাটিপে শেষ করে দেন।
উঠানে বরযাত্রীরা সাজ-সজ্জা, হাড়ি-পাতিল, সামিয়ানা, তেরপাল যেখানে যা পাইল ইচ্ছে মত ভাঙচুর করল। বিকট সাইজের পোলাও, মাংসের ডেকচি উলটে ফেলে পথ ভাসিয়ে দিল। সেই অঢেল মাংসের সন্ধানে গ্রামের যত অনিমন্ত্রিত বেওয়ারিশ কুকুর ছিল তারা নিজেদের সৌভাগ্যে ঘেউ ঘেউ ঝগড়া পর্যন্ত ভুলে গেল।
উঠানে বড়সড় একটা কাগুজি লেবুর গাছ ছিল। আমার বাবার হাতে লাগানো। বাবা থাকতে সেই লেবু পেড়ে নিয়ে বলতেন, যা তো মা, চট করে শরবত করে নিয়ে আয়। শরবত নিয়ে এলে বলতেন, ‘আহ, আমার মায়ের হাতে জাদু আছে।‘
সেই লেবু গাছটা ভেঙেচুরে নাই করে দিল।
বরের বাবা বার বলতে লাগল, ‘বিষাক্ত সাপিনী। কাল নাগিনী। আল্লায় বাঁচাইছে। আমারে আল্লায় বাঁচাইছে। এরকম বেয়াদপ বেতমিজ মেয়েকে কোথায় বিয়ে দেয় দেখে নেব।‘
মা কখনো এত বিপন্ন এত শোকাক্রান্ত হন নাই। বাবা যখন মারা গেল তখনও না।
শুধু আমার মনে হল রাক্ষসের হা করা মুখ থেকে নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি।
—কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলো
—আন্‌ওয়ার এম হুসাইন

[চলবে]

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১ এ পেন্সিল পাবলিকেশন্স থেকে আসছে আমার গল্পগ্রন্থ ‘প্রত্যুষের গল্প’

গৃহভূতের কাণ্ড

গৃহভূতের কাণ্ড
আন্ওয়ার এম হুসাইন

আমাদের বাসায় ডাইনিং টেবিলের সাথে চেয়ারের সংখ্যা ছয়। এই ছয়টা চেয়ারের একটাকে নিয়ে একদিন হঠাৎ একটা গন্ডগোল উপস্থিত হল। চেয়ারটা পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টা যত সহজ মনে হচ্ছে আসলে তত সহজ না। সকালবেলা খেয়াল করলাম একেবারে পেছনে যে চেয়ারটা সেটা নাই। নাই মানে সারা বাসার কোথাও নাই। সেটা কবে থেকে নাই এটা বলা মুসকিল। চেয়ারের তুলনায় বাসায় লোক-সংখ্যার অনুপাত কম হওয়ায় সে চেয়ার সব সময় ব্যবহার হয় না। তাই ঠিক কখন থেকে নাই সেটা আঁচ করা মুশকিল। তবে সারা বাসা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একটা চেয়ার আর বের করা সম্ভব হল না। চেয়ার তো আর সূঁচ না যে লুকিয়ে পড়ে থাকবে!

একটা জলজ্যান্ত চেয়ার হাওয়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য কারণ খোঁজার চেষ্টা করলাম সবাই মিলে। কাজের মেয়ে, বুয়া এদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করা হল, কেউ কোন কাজে বাইরে নিয়েছে পরে আনতে ভুলে গেছে এমন কিছু হয়েছে কিনা। নিচের দুইজন দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, তারা কখনো কাউকে একটা চেয়ার নিয়ে বের হতে দেখেছে কিনা। অতিরিক্ত হিসেবে ড্রাইভারদেরকেও জিজ্ঞাসা করলাম। এই ধরনের অদ্ভুত প্রশ্নে তারা অবাক হল। আড়ালে হাসাহাসি করল। তবে তারা কেউ এ ধরনের চেয়ার নিয়ে যেতে বা আসতে কাউকে দেখেনি।

শেষে বিষয়টার একটা যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেষ্টা করলাম। হয়ত আমাদের কেউ কোন কাজে বাইরে নিয়ে গেছে আর নিয়ে আসেনি। পরে কেউ সরিয়ে নিয়েছে। এই কিসিমের নানান জোড়াতালি ব্যখ্যা দিলে সেটার কাউন্টার ব্যাখ্যাও হাজির হল। সুতরাং বিষয়টা অমীমাংসিত রেখে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। দেয়ার আর মোর থিংস ইন হ্যাভেন এন্ড আর্থ। একই ডিজাইনের আর একটা চেয়ার বানিয়ে নিয়ে সেট পুরা করে রাখলাম। আমার বড় মেয়ে ঐকিক নিয়মে অংক করে বের করল একটা চেয়ার হারানোর ফলে আমাদের পরিবারের ক্ষতির পরিমান কত।

ঘটনাটা প্রায় ভুলেই গেছি। হঠাৎ একদিন রাত তিনটার সময় ছোটভাই শামীম বিশদ ডাকাডাকি করে আমাদের সকলের ঘুম ভাঙিয়ে ফেলল। উঠতে দেরী হলে দরজা ভেঙ্গে ফেলবে এমন একটা অবস্থা। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে হুড়মুড় করে বের হতে গিয়ে আলমারীর সাথে ধাক্কা খেয়ে কপালের বামপাশ ফুলিয়ে ফেললাম। মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল। “কি হয়েছে? কি হয়েছে? ঘরবাড়ি সব ভেঙ্গে ফেলবি নাকি?”
সে ততোধিক উত্তেজিত হয়ে “কি হয়েছে দেখে যান” বলে সে আমাদেরকে তার রুমে নিয়ে গেল।
সেখানে গিয়ে যা দেখলাম তার জন্য আমরা কেউ কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। রাতের বেলা একটা প্রকাণ্ড ভূমিকম্প হয়ে গেলেও এতটা অপ্রস্তুত হতাম না। তার রুমে একটা ওয়ারড্রোব আছে। বিশুদ্ধ সেগুন গাছের তৈরি। রাঙামাটি থেকে অর্ডার দিয়ে বানানো। ওয়ারড্রোব না, যেন এক গাদা লোহা। খালি ওয়ারড্রোব নাড়াতে আটজন লোকের দরকার হয়।

সেই ওয়ারড্রোবটা ঘরে নাই। বাসার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। শামীম বারান্দার দরজা খুলে ঘুমায়। কিন্তু বাইরে তো গ্রীল আছে। কী আজে বাজে চিন্তা করছি গ্রীল থাক আর না থাক, একটা জলজ্যান্ত ওয়ারড্রোব কি গ্রীল কেটে পাঁচতলা থেকে বের করে নেয়া সম্ভব! তালগোল পাকিয়ে গেছে সব কিছুতে।

আর সব কিছু আগের মতই ঠিকঠাক। ওয়ারড্রোব এর জায়গাটা শুধু খালি। এখানে যে ওয়ারড্রোব ছিল এবং একটু আগে সরানো হয়েছে, সে আলামত পুরাটাই আছে। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে বাড়িওয়ালাকে ডেকে তুললাম। এতরাতে কেন ডাকছি ইত্যাদি জিজ্ঞাসাবাদের জবাব দিয়ে তাকে বাসায় ধরে নিয়ে আসলাম। বাড়িওয়ালা সরেজমিনে দেখেটেখে লা-জবাব। একটু বলতে চেষ্টা করেছিলেন, আমরা হয়ত ওয়ারড্রোব সরিয়ে দিয়ে—। মুখ থেকে বের করার আগেই আমরা সবাই রৈ রৈ করে উঠায় সেদিকে আর গেলেন না।

তবুও নিজে সমস্ত দরজা জানালা চেক করলেন। সিঁড়ি-লিফট পরীক্ষা করলেন এবং নিচে দারোয়ান-কর্মচারী যারা আছে সবাইকে রাতের বেলাতেই জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। এমনকি বিগত কিছুদিনের মধ্যে কোন ওয়ারড্রোব বাসা থেকে বের হয়েছে কিনা সেটার উত্তরেও নেগেটিভ শুনলেন।
শেষে একটু বলার চেষ্টা করেছিলেন যে আমাদের কোন ওয়ারড্রোবই ছিল না। কিন্তু সেটাতেও সুবিধা করতে পারলেন না, কারন গতবার বাড়িভাড়া নিতে এসে কথাপ্রসঙ্গে পাহাড়ী ফার্নিচারের কথা উঠায়, তিনি ওয়ারড্রোবটা চেখে দেখেছিলেন এবং ওটার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। কত দাম, কিভাবে কিনেছি ইত্যাদি নানান বিষয়ে শামীমের সাথে আলাপ করেছেন। শামীম পয়েন্ট বাই পয়েন্ট সে আলাপ তুলে ধরলে তিনি কিছুক্ষণ চুপচাপ হা করে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। যেন এতবড় ঘটনার পরেও ফ্যানটা কিভাবে ঘুরছে এইটা একটা আশ্চযের্র বিষয়।

শেষে বললেন, “বাসায় থাকেন আপনারা জিনিস কিভাবে হারিয়েছে সেটা টের পান নাই। আর আমি অন্যবাসা থেকে কিভাবে এর সমাধান করব?” তাঁর কথাও ঠিক। এর কোন সমাধান আমরা কেউই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

বাড়িওয়ালার কাছে এটা শুধু একটা ওয়ারড্রোব হারিয়ে যাওয়া আর আমাদের কাছে এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু। আমাদের মনের মধ্যে এমন একটা অস্বস্তি তৈরি হল যে আমাদের পক্ষে শান্তিতে ঘুমানো খাওয়া দাওয়া করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। সারাক্ষণ বাসার মধ্যে একটা গা ছমছম করা ভাব। এক অচেনা বাতাসে আমাদের হাসি-আনন্দ সব নিভে গেল। আর ভয় কাজ করতে লাগল, এরপর কি হয়! এর পর কি হয়! চেয়ার গেল, ওয়ারড্রোব গেল। এরপরে কি আলমারী টান দিবে? এটা ভাবতেই আলমারী থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র সব সরিয়ে ফেললাম। দরকারী কাগজপত্র, দলিল দস্তাাবেজ যা ছিল আলমারী থেকে সরিয়ে নিরাপদ জায়গায় রাখলাম। একাধিক কপি করে বিভিন্ন জায়গায় রাখলাম। স্ক্যান করে গুগলড্রাইভেও জমা করলাম। তবুও মন মানে না।

সবচেয়ে কষ্টে পেয়েছে আমার ছেলে। সে তার চাচার ওয়ারড্রোবের নিচের তাকের একটা অংশ জোর-জবরদস্তি করে দখল নিয়েছিল। সেখানে তার পছন্দের সব খেলনা আর দুনিয়ার সব হাবিজাবি নিয়ে জমা করত। এখন ওয়ারড্রোবের সাথে সাথে সেই সবও গায়েব। পুরো বিষয়টা তাকে কোনভাবেই বুঝানো যাচ্ছিল না। আর তাতেই তার জেদ বাড়ছিল। ওয়ারড্রোব গায়েব করার জন্য আমাদের সবাইকে সে কিভাবে শাস্তি দিবে বার বার তার বয়ান দিচ্ছিল।

বাড়িওয়ালা বলল, ‘এটা গৃহভূতের কাজ হতে পারে। এক ধরনের ভূত আছে, নিরীহ টাইপের। মানুষের ক্ষতি-টতি করে না। ঘরে থাকে। মাঝে-মধ্যে দুষ্টামি-টুস্টামি করে।’

গৃহভূত হোক আর যাই হোক, এইভাবে তো আর বসবাস করা যায় না। ওদের কাছে যা দুষ্টামী আমাদের কাছে তা তো মারাত্মক। এরপর কি কাণ্ড ঘটে কে জানে। বাড়ীওয়ালাকে নোটিশ দিয়ে দিলাম। এবার শুরু হল নতুন যুদ্ধ। ঢাকা শহরে যারা আছে, সবারই কমবেশি এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে। একেক বাসা দেখতে একেক অভিজ্ঞতা। অযাচিত, অভদ্র সব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়—
‘আপনারা কয়জন থাকবেন? কাজের লোক কয়জন? ছুটা বুয়া রাখবেন?’
‘বাচ্চা-কাচ্চা কি বেশি দুষ্ট নাকি? ওদেরকে শাসনে রাখবেন। শাসনে না রাখলে ওরা মানুষ হবে না বলে দিলাম (মনে হয় আমরা বাসা দেখতে যাইনি, কিভাবে বাচ্চা পালতে হয় তার ট্রেনিংয়ে গিয়েছি)। আপনাদেরকে দেখে তো মনে হয় না বাচ্চা-কাচ্চা শাসন করতে পারেন।’ (চেহারায় আফসোসের ছাপ)।
‘রাত এগারটায় গেট বন্ধ হবে। বাসায় কোন প্রোগ্রাম করলে বাড়িওয়লাকে জানিয়ে রাখতে হবে।’
‘তিনমাসের এডভান্স দিতে হবে।’
‘ছয়মাসের এডভান্স দিতে হবে। আমার নতুন বাসা কিছু কাজ বাকি আছে সেটা শেষ করে নিতে হবে তো। আপনারাই তো থাকবেন। কাজগুলো হয়ে গেলে আপনাদেরই সুবিধা হবে।’ (যেন ফ্রি থাকতে দেবে!)
‘চাকুরি করেন? নাকি ব্যবসা করেন? আপনার দেশের বাড়ী কোথায়? আপনার বাবা কি করেন? আপনার শ্বশুর কি করেন? (আমার দাদা আর নানার কথা জিজ্ঞেস করেনি, চাইলে তাও করতে পারত, কিন্তু করেনি, বাড়িওয়ালা নিশ্চয় উঁচু বংশীয় লোক!) । আপনার সাথে উনি কে? আপনার শালা? আচ্ছা উনি কি করেন? উনি কি বিয়ে করেছেন?’
‘আপনার অফিসের বসের নাম্বারটা দিবেন। তার সাথে কথা বলতে হবে। আপনার অফিসে ঠিকঠাক মত বেতন দেয় তো?’
‘আপনার আগের বাড়িওয়ালার সাথে একটু কথা বলিয়ে দিবেন।’
এই রকমের যত সব আজগুবি প্রশ্ন আর আজগুবি প্রস্তাব।
এক বাসার দারোয়ান গেট না খুলেই বলল, এখানে তো বিদেশিদেরকে ভাড়া দেয়া হয়। সেই সাথে ভড়কে দেয়ার মত বাসা ভাড়া উল্লেখ করে বলল, “আপনারা কি বিদেশি কারো জন্য বাসা খুঁজছেন?”
আমি বললাম, ‘আমি নিজেই বিদেশী। ইন্ডিয়ান। এজন্য বাঙলা কথা কই?’ দারোয়ানও কম যায় না বলল, ‘পাসপোর্ট আছে?’ পাসপোর্ট দেখিয়ে নিজের দেশে বাসা ভাড়া নিতে হবে এ কথা যদি আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা জানত!
শেষে বললাম, “না, আসলে জ্বীনদেরকে ভাড়া দেয় আমরা এমন বাসা খুঁজছি। আমাদের সাথে জ্বীন আছে! জ্বীনদের পাসপোর্ট লাগে না।”

মজার অভিজ্ঞতাও আছে, এক দারোয়ান কে জিজ্ঞেস করলাম, “বাসার কন্ডিশন কি?”
সে জানাল চমৎকার ব্যবস্থা আছে, “তিনটা হুইবার ঘর, একটা বইবার ঘর, একটা খাইবার ঘর, একটা চুলার দুয়ার আর তিনটা টাট্টিখোলা।”

এই ডটকম সেই ডটকম এ চেক করলাম। সুখকর অভিজ্ঞতা কোথায়? সবগুলোই পরিপূর্ণ আলোবাতাসে ভরপুর বারান্দাওয়ালা বাসা – শুধু লাইট আর ফ্যান চালিয়ে রাখতে হয় সার্বক্ষণিক, এই যা। সব যুদ্ধের শেষ আছে। বাসা খোঁজারও ইতি আছে। নতুন বাসা ঠিক করলাম। সে আরেক ইতিহাস, সেটা অন্যসময় বলা যাবে। তো যথাসময়ে নতুন বাসায় উঠে পড়লাম।

বাসা খোঁজা আর বাসা চেঞ্জের ঝামেলায় ওয়ারড্রোবের বিষয়টা মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। নতুন বাসায় উঠে ভয় হতে লাগল, যে ওয়ারড্রোব কিংবা চেয়ার নিয়ে গেছে সে যদি নতুন বাসা চিনে ফেলে! যদি নতুন বাসায়ও হানা দেয়! তাহলে কি হবে?
সে ভয় যে অমূলক না, সে যে আমাদেরকে ভুলে নাই, সেটা নতুন বাসায় উঠার দ্বিতীয় দিনেই টের পাওয়া গেল। সেদিনও শামীম মাঝরাতে চেঁচামেচি-চিৎকার করে আমাদের ঘুম ভাঙাল। আজকে আবার কোন কাহিনী হল সেই টেনশানে আমি বিছানা থেকে নামতে পারছিলাম না। সবাই ওর ঘরে গিয়ে দেখল, ওয়ারড্রোবটা চুপচাপ জায়গামত বসে আছে। খুলে দেখা গেল জিনিসপত্র যা ছিল সব একই আছে। কোন নড়চড় নাই। যেই তাকে যা ছিল তাই। এমনকি আমার ছেলের সব খেলনাগুলোও।

বুঝলাম আমরা বাসা ছেড়ে দিল গৃহভূতেরা আমাদের ছাড়েনি। আমাদের সঙ্গী হয়ে নতুন বাসায় চলে এসেছে। এ থেকে আর মুক্তি নাই। একদিন দিয়ে ভালই হয়েছে। ওয়ারড্রোবটা তো অন্তত পাওয়া গেল।

কিন্তু গৃহভূতের বিষয়টা আর কেউ বিশ্বাস করছে না। ভূতেরই যেখানে অস্তিত্ব নাই, সেখানে গৃহভূত আবার কি জিনিস? পরিচিত স্বজনেরা এটা বিশ্বাস তো করেই না উলটো মনে করে আমি ভাওতাভাজি করে এটেনশন নেয়ার চেষ্টা করছি। আমাকে নিয়ে হাসাহাসিও করে, বলে গাঁজাখুরি গুল ছাড়ছি। অবস্থাটা বোঝ! আমি আছি আমার যন্ত্রনায় আর মানুষ ভাবছে আমি এটেনশন নেয়ার ধান্ধা করছি। আমার বন্ধু রাকীব পরিচিত স্বজনের কাছে আমার নামে নানান কথা ছড়াচ্ছে। সেদিন আমাকে ট্যাগ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে, ‘সাপের মাথায় মনি আছে এ হয়ত বিশ্বাস করা যায়। সাপের পা দেখা সম্ভব হইলেও হইতে পারে। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে মানুষ যে গৃহভূত নামে আজগুবি কাহিনী বানিয়ে মানুষকে বোকা বানানো যেতে পারে তা আগে জানতাম না! কমেন্টে এসে সবাই আমাকে ধুয়ে দিচ্ছে। আমি তাদেরকে যতই বলি আমার পুরনো বাড়িওয়ালার সাথে কথা বল কিংবা আমার বাসায় এসে দেখে যাও তাদের একটাই কথা আমরা তো মিসির আলী নই যে রহস্য অনুসন্ধানে নেমে পড়ব। আমাদের অনেক কাজ আছে। বউ-বাচ্চা, ঘর-সংসার আছে। তোমার কল্পিত গৃহভূতের সন্ধানে নামা আমাদের কাজ না।

অথচ যদি বলতাম বটগাছের ভূতের কাহিনী সবাই বিশ্বাস করত, তেঁতুল গাছ কিংবা তালগাছ বললে তো কথাই নেই। শাকচুন্নী কি মেছো ভূতের কথা বলে কোন হিস্টিরিয়া রোগির কাহিনী শোনালে সবাই একবাক্যে মেনে নিত। একবারও কেউ কিন্তু এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করত না। মিসির আলীকে ডাকত না। আসলে ভূতে কারো সমস্যা নাই। সমস্যা গৃহ-ভূতে। সবাই ধরেই নিয়েছে ভূত থাকবে তালগাছে, তেঁতুল গাছে। বাস্তবতা হল গৃহ-ভূত আছে, আমার মত যারা এর শিকার তারা জানে যে আছে।

একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনাটা বলি। নতুন বাসায় ওঠার পরে বেশিদিন হয় নাই। একদিন শুক্রবার সকালবেলা চা খেয়ে আয়েশ করে পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছি। মেসি-নেইমার-বার্সেলোনা-ম্যানচেস্টার এইসব নানান করিৎকর্মা খবরাখবরে চমৎকৃত হচ্ছি। এর মধ্যেই আমার ছেলের মা, ‘ঐ ঐ – করে চিৎকার দিয়ে উঠল।’ পত্রিকার ভেতর থেকে মুখ উঠিয়ে ওদিকে তাকাতেই দেখি টেবিল থেকে একটা কাঁচের মগ মধ্যাকর্ষনের আহবানে সাড়া দিয়ে নিচের দিকে পতিত হচ্ছে। কিন্তু না——- যা দেখলাম, তা যে না দেখেছে সে জীবনেও বিশ্বাস করবে না। মগটা ফ্লোরের কাছাকাছি গিয়ে থেমে গেল, তারপর স্লো মোশনে গিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ল। অদৃশ্য কেউ যেন ক্যাচ ধরে তারপর নামিয়ে রাখল। আমরা স্পষ্ট দেখলাম মগটা শূণ্যে ভেসে রইল, তারপর গিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ল।
আমার স্ত্রী আমার দিকে তাকাল। বিষ্ময়ে তার চোখ হীরার মত জ্বলছে। ঘটনা সেও প্রত্যক্ষ করেছে। আমি একা হলে ভাবতাম এ বোধহয় আমার চোখের ভুল। দুইজনের চোখে তো ভুল হতে পারে না। আমার ছেলে বিকট আনন্দে চিৎকার দিল, ‘মা ভাঙ্গে নাই, ভাঙ্গে নাই।’ সে ভয় পাচ্ছিল মগটা ফেলে ভেঙ্গে ফেলায় মায়ের বকুনি খাবে। কিন্তু যখন ভাঙ্গেনি তখন তার উচ্ছ্বাসের সীমা নাই। নিজেই মগটা উঠিয়ে জায়গা মত রাখল।

এর আগে চেয়ার এবং ওয়ারড্রোব নিয়ে ঘটনাগুলো না ঘটলে আমরা হয়ত এটাকে চোখের ভুল কিংবা কাকতাল হিসাবেই মেনে নিতাম। কিন্তু ভূতপূর্ব ঘটনাগুলো আমাদেরকে বুঝিয়ে দিল এখানে নিশ্চয় কোন অশরীরী হাত আছে। ঘটনা যতই নিজেদের পক্ষে থাকুক ঘরের মধ্যে কিছু অশরীরী ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা ভাবতেই শরীর কেমন রিরি করে উঠে। কিন্তু আগেরবার বাসা পালটিয়ে এ বাসায় এসেছি। এখন তো দেখছি বাসা নয় সে বা তারা আমাদেরকেই বেছে নিয়েছে। স্বস্তি এটাই এখন পর্যন্ত তেমন কোন ক্ষতি করে নাই। ওয়ারড্রোব নিয়ে গিয়েছিল দিয়ে গেল। হ্যাঁ, চেয়ারটা পাইনি বটে। আজকে মুনিয়ার সাধের মগটা তো বাঁচল।

কদিন বাদে শুক্রবার বিকেলে গেলাম বসুন্ধরা সিটিতে। কেনা-কাটা ছিল কিছু। ওখানে বেশ দেরী হয়ে গেল। শপিং শেষে মুনিয়া বলল, এখান থেকে খেয়ে যাই। এখন আর যেয়ে রান্না করতে পারব না। শামীমও বাসায় নেই। ও গেছে গ্রামের বাড়ি। বাইরে খাওয়ার কথা শুনে ছেলে-মেয়ে দুটো লাফিয়ে উঠল। খেয়ে-দেয়ে যখন বের হলাম তখন তুমুল বৃষ্টি। অনেক কষ্টে রিকশা পাওয়া গেল। রাস্তার জ্যাম কাদা-পানি এইসব ঠেলে-ঠুলে বাসায় আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে গেল। সারাপথ মুনিয়া গজরাতে গজরাতে আসল বারান্দার সব জামা-কাপড় ভিজে গেল বলে। ও সেগুলো ঘরে রেখে আসতে চেয়েছিল। দোষটা আমারই। আমি বলেছিলাম, বৃষ্টি আসবে না। ঝকঝকে বিকালবেলা দেখে তো আর জানতাম না আকাশের ষড়যন্ত্র। আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসের মত আমিও ভুল ফোরকাস্টিং করে এখন বকা খাচ্ছি। বৃষ্টি-কাদা-জ্যাম সব কিছুর জন্যই দায়ী আমি! আমিই যেন এইসব দুর্ভোগ ডেকে নিয়ে এসেছি।

ঘরে ঢুকেই মুনিয়া ছুটে গেল বারান্দায়। ভেজা কাপড় দেখে আমার উপর আরেক চোট যাবে সেটা বুঝতে পারছি। অপরাধ হালকা করার জন্য নিজে থেকেই ছেলে-মেয়ে দুটোকে ঘুমানোর জন্য রেডি করতে থাকি। হঠাৎ মুনিয়ার চিৎকার, “তাড়াতাড়ি এদিকে আসো। তাড়াতাড়ি আসো। দেখে যাও।”
আমি ভয় পেয়ে দৌড় দিলাম। খাটের উপরে একগাদা শুকনা কাপড়। ঐ দিকে ইশারা করে বলল, “দেখ।’’
দেখ! আরে বাবা শুকনা কাপড় দেখার কি আছে। ও, বুঝলাম সে কাপড় ঘরে রেখে গিয়েছিল, তাই ভিজে নি, সেটাই সে দেখাতে চাচ্ছে। কিন্তু না, সে আসলে এটা বোঝাতে চায় নি। সে যা বোঝাতে চেয়েছিল তা আরো মারাত্মক। তা হল, এই কাপড় বারান্দাতেই ছিল। কেউ বৃষ্টির আগে ঘরে এনে রেখেছে। একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকালাম। আমি ভাবছিলাম আমাদের কি ভয় পাওয়া উচিত না আনন্দিত হওয়া উচিত!

রাতের বেলা মুনিয়া আমাকে ফিসফিস করে বলল, ‘ঘরের ভেতরে অশরীরী ঘুরে বড়াচ্ছে ভাবতেই কেমন যেন গা চমচম করে।’ আমি বললাম, ‘তা করে, কিন্তু আমাদের কোন ক্ষতি তো করছে না।’
‘তা করছে না। কিন্তু ঘরে বাচ্চা-কাচ্চা আছে আমার কিন্তু ভয় ভয় লাগছে। কখন যে কি হয়!’
ভয় তো আমারও লাগছে। আমি তবু সেটা প্রকাশ করলাম না। বরং মুনিয়াকে অভয় দিতে লাগলাম। সকাল থেকে আমরা সহজ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিলাম। কোথাও কোন ছন্দপতন লক্ষ্য করলাম না।

বেশ ক‘দিন বাদে রাকীব তার বাসায় আমাদেরকে দাওয়াত দিল। গিয়ে দেখি বেশ লোকজন। তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন। আমাদের কমন বন্ধুবান্ধবেরা তো আছেই। ছেলেরা সবাই ড্রইং রুমে লাগামহীন আড্ডা দিচ্ছে । আর মেয়েরা ভেতরের ঘরে। এর মাঝে সবাই আমাকে নিয়ে পড়ল। ‘ভাই আপনার পোষা ফার্নিচার-ভূতের কি অবস্থা?’ রাকীব বলল, ‘সবাই তোর ভূতের কাহিনী শোনার জন্যই আমাকে ধরেছে।’ মেজাজটাই বিগড়ে গেল। এখানে আসাটাই বিরাট একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ওদের চাপাচাপি তে শেষ পর্যন্ত শুরু করতে হল গৃহ-ভূতের কাহিনী। ওরা হাসে। ছোট বাচ্চারা অবিশ্বাস্য আজগুবি গল্প বললে আমরা যেমন হাসি। একজন বলে, ‘ওয়ারড্রোবটা বোধ হয় খাটের নিচে ধূলো ময়লার ভেতরে লুকানো ছিল।’ বাকীরা হা হা হা করে অট্টহাসি দেয়। আমি কি গোপাল ভাঁড় যে হাসির গল্পের আসর বসিয়েছি। করোটির নিচে নরম মেজাজ মোটেই বিষয়টি পছন্দ করছে না। কপালে ভাঁজ পড়ছে। সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আরেকজন বলল, ‘ভাই তালগাছে, তেঁতুল গাছে ভূত থাকে জানি। কিন্তু আপনার বাসারগুলো তো ভূত না কুলি। ওয়ারড্রোব নিয়ে টানাটানি। ঘরে এত লোকজন তবু কাউকে ধরে না। মাল-পত্র নিয়ে লুকোচুরি।’

ঘটনা যদি বিশ্বাসই না করবে তবে বলতে চাপাচাপি করা কেন বাবা। আমি আছি আমার যন্ত্রণায়, এরা আছে মজা করার তালে। রাকীবের এক বন্ধু বলল, ‘শুধু জামাকাপড় ঘরে এনে দেয়, রান্না-বান্না করে দেয় না? এই কাজের লোকের আকালের দিনে এমন গৃহপালিত ভূত পেলে তো ভালই।’ ওর এক কলিগ বলল, ‘ভাই ভূতের বাচ্চা-কাচ্চা থাকলে আমাদেরকেও দিবেন একটা করে।’ রাকীব বলল, ‘ওর বাসার এইসব ঘটনা যখন ঘটে তখন ওতো ঘুমিয়ে থাকে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে।’ হা হা হা। হাসির হল্লা বয়ে যাচ্ছে যেন। নিজেকে বেশ অপমানিত মনে হল। আমি তো কোন গল্প ফাঁদি নাই, যা সত্য তাই বলেছি। তবে কেন বাবা আমাকে নিয়ে এত হাসাহাসি। রাকীবের বউয়ের হাতের অতি সুস্বাদু সুখাদ্যগুলোও গলা দিয়ে নামতে চাইল না।

মেজাজ খারাপ করে বাসায় আসলাম। জামা কাপড় ছেড়ে সোফায় বসলাম। বসে বসে মোবাইল থেকে রাকীবের নাম্বার ডিলিট করলাম, ফেসবুকে আনফ্রেন্ড করলাম, মেসেঞ্জারেও ব্লক করে দিলাম। ওর সাথে আর কোন সম্পপর্ক নাই। হঠাৎ ফ্যানের দিকে চোখ আটকে গেল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। ঠাণ্ডা আবহাওয়া তাই ফ্যান বন্ধ। যা দেখলাম তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। কেউ একজন ফ্যানের ধূলো-ময়লা মুচছে। যে মুচছে তাকে দেখছি না। যা দিয়ে মুচছে তাও দেখছি না। শুধু কেউ যে এখন এটাকে ধূলো ময়লা পরিষ্কার করে সাফ-সুতরো করে দিচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। ধূলো-ময়লা উড়ে গিয়ে ফ্লোরে জমা হচ্ছে। আমি তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। ফ্যানটা আমার পরিষ্কার করার কথা ছিল। মুনিয়া ক‘দিন ধরেই বলছিল, এত ময়লা হয়েছে। আলসেমির জন্য করা হয় নাই। বিষয়টা কেন জানি আমার মধ্যে ভয়ের পরিবর্তে একটা ভাললাগা তৈরি করে দিল। ভুলে গেলাম রাকীবের বাসার মেজাজ খারাপ করা সময়।

পরদিন রাত তিনটার সময় এক অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন। বেশ ক‘বার ফোন দিয়েছে। এত রাতে কে অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন করে ঘুম ভাঙায়! ফোন দিয়েই যায়। মুনিয়া বলে হয়ত পরিচিত কেউ কোন বিপদে পড়েছে। ধর। ফোন ধরে কণ্ঠ চিনে ফেলি। রাকীবের গলা।
‘দোস্ত, তোর ওয়াড্রোবটা কিভাবে নিয়েছিল।’ মেজাজটা চূড়ান্ত রকমের খারাপ হয়ে গেল। নিশ্চয় রাত জেগে আড্ডা দিচ্ছে। আর ফোন করে আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে, মজা নিচ্ছে। বললাম ‘তুই এই কথার জন্য রাত-নিশিতে ফোন দিছস? ফাইজলামির একটা সীমা তো থাকে।’
‘দোস্ত প্লিজ, আমিও বিপদে পড়েই তোরে ফোন দিছি।’ মরিয়া হয়ে ও বলে চলল ‘আমার বাসার আলমারিটা খুজে পাচ্ছি না।’
‘খাটের নিচে খুঁজে দেখ, দোস্ত।’
‘দোস্ত, তোর বদদোয়া লাগছে। একটু হেল্প করনা প্লিজ।’
‘আমি কি করতে পারি দোস্ত।’
‘দোস্ত, সব ইম্পর্টেন্ট কাগজ, সার্টিফিকেট, দলিল-পত্র সব ওখানে। আমারে একটু হেল্প কর না, প্লিজ।’ একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে বেচারা।
আমি বললাম, ‘দোস্ত, আমার আসলেই জানা নাই এ ক্ষেত্রে কি করতে হবে। সত্যি বলছি, আমি জানি না। তবে অপেক্ষা করে দেখ, কি হয়। আমার ক্ষেত্রে যা হয়েছিল, হয়ত ফেরত আসতেও পারে। আল্লা আল্লা করা ছাড়া তো কোন রাস্তা দেখি না।’
আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। মিথ্যে বলব না, আমার একটা আরামের ঘুম হয়েছিল।
সকাল বেলা কাজের মেয়েটা ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে বিকট চিৎকার।
ড্রইং রুমে ঢাউস সাইজের একটা আলমারি।
রাকীব কে ফোন দিলাম। তাড়াতাড়ি বাসায় আয়। আসার সময় তোর আলমারির চাবিগুলো নিয়ে আসবি। সেদিনই আলমারি ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা হল। ওতে যা ছিল সব একই আছে।
যাওয়ার সময় বললাম, ‘আমার ভূতদের সালামি দিবি না?’
তার অবস্থা এমন যে, চাইলে সে রাজত্ব লিখে দিবে। আমি শুধু বললাম, ‘ওদের অপমান করিস না।’
এককান দুইকান করে ঘটনা বাড়িওয়ালা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। পরদিন সকালে বাড়িওয়ালা এসে বলল, ‘দেখেন ভূত-জ্বীন নিয়ে আমার কারবার না। আমার কারবার মানুষ নিয়ে। জ্বীন-ভূত নিয়ে বাড়ির বদনাম হোক এটা আমি চাই না।’
আরে একি আপদ। মাত্র বাসায় উঠার ঝামেলা শেষ করে যদি বাড়ি ছাড়ার নোটিশ পাই তবে কেমন লাগে বল! তাকে কোনভাবে বুঝানোই যাচ্ছে না। শেষে চালাকি করে আমি বললাম, ‘যা বলছেন ভেবে-চিন্তে বলছেন তো? ভূতেরা কিন্তু আমার পোষা বিশ্বাস না হয়, ওকে ফোন করে জিজ্ঞেস করুন, বলে রাকীবের একটা কার্ড দিলাম।
বাড়িওয়ালা ঘাঘু মাল, সেসবকে কোন পাত্তাই দিল না। বলল, তার নোটিশের কোন নড়চড় হবে না।
আমিও বললাম, ঠিক আছে, ‘ভূতেরা যদি মাইন্ড করে, পরে কোন কিছুর জন্য আমাকে দায়ী করবেন না যেন।‘
‘ওসব ভূত-পুত আমার দেখা আছে। আপনি বাসা খোঁজেন। আমার মনে হয় একটু পুরনো-ভাঙাচোরা টাইপের বাড়ি হলে আপনার জন্য ভাল হবে। আপনার পোষা ভুতেরা ওটা পছন্দ করবে বেশি।‘
কি আর করা। এমন যন্ত্রণায় আগে পড়িনি কখনো। আবার সেই বাসা পাল্টানোর বিশাল ঝক্কি। মনে মনে একটু আশা করতে লাগলাম ভূতেরা যদি একটু সাহায্য করে।
পরদিন ভোরবেলা কলিংবেলের পর কলিংবেল। দরজায় করাঘাত। ভেঙে ফেলবে যেন। বাইরে বাড়িওয়ালা। দেখে মন বিষিয়ে গেল। একবার মনে হল বলি, পরে আসেন। কিন্তু যা ভাবি তা সবসময় করতে পারি না। খুললাম।
খুলতেই সে আমার দুই হাত ধরে বলল, ‘হুসাইন সাহেব রাগ করবেন না, প্লিজ। বাসা খোঁজার দরকার নেই। কাল হঠাৎ কার কাছে কি শুনে কি বলেছি, না বলেছি; কিছু মনে করবেনা প্লিজ।
আমি বললাম, ‘কি হয়েছে, আপনি এমন করছেন কেন?’
‘হুসাইন ভাই, আপনি তো সবই জানেন। মাফ করে দিয়েন ভাই। যত দিন ইচ্ছা এই বাসায় থাকবেন। নিজের মনে করেই থাকবেন। বলে চলে গেল। বুঝলাম গৃহভূতেরা নিশ্চয় কোন না কোন থেরাপি দিয়েছে বাড়িওয়ালাকে।
মুনিয়া বলল, ‘গৃহ-ভূত একেবারে খারাপ জিনিস না।’
আগে আমি দেখলে হাত কচলে বাড়িওয়ালাকে সালাম দিতাম। এখন সে আমাকে তিন মাইল দূর থেকেই হাত উঁচিয়ে সালাম দেয়। হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।
যারা ঢাকা শহরে থাকে তারা জানে, বাড়িওয়ার কাছ থেকে এই ধরনের সমীহ পাওয়া যে, কত বড় পাওয়া।

[কিশোর বাংলা বিজয় দিবস সংখ্যা ২০২০ এ প্রকাশিত। ]