লড়াই- পর্ব ০১ এরপর।
দিনগুলো সোনার খাচায় বন্দি থাকে না! এই পড়ন্ত বেলায়, স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে টম। সে ছিল পূর্ণ যৌবনে, উঠতি সময়ে আর তারা ছিল অস্তমিত সময়ে। অনেক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তারা মুখোমুখি হয়েছিল টমের। টম মনে করতে পারছে সেই দিনের দৃশ্যকে, বাচ্চা ছেলের মতো ড্রেসিং রুমে কেদেছিল টসার বিল, আঠারতম রাউন্ডে টমের হুকে পরে গিয়ে বিল আর উঠতে পারে নি। ‘‘টসার বিল! বাড়ি ভাড়া বাকি পরেছিলো তোমার? তোমার স্ত্রী আর সন্তানদের খাদ্যাভাব তোমাকে বিষন্ন করে রেখেছিল? কিছু মাংসের জন্য কি হাহাকার করছিল তোমার ক্ষুধার্ত অনুভুতি?’’ স্মৃতিতে সাতার কাটতে কাটতে টম, বিলকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। টম এখন দেখতে পাচ্ছে, বিশ বছর আগে টম লড়ছিল সম্মানের জন্য আর সহজ উপায়ে টাকা উপার্জনের জন্য আর টসার বিল! কেন লড়ছিল সেদিন? কেন পরাজয়ের পর ড্রেসিং রুমে বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদেছিলো!
শুরু থেকেই মানুষকে লড়াই করেই এগুতো হয়। এটাই প্রকৃতির এক দৃঢ় কঠিন নির্দেশনা। শুক্রানু থেকেই শুরু এই লড়াইয়ের। তারপর প্রতিটি পদক্ষেপ সামনে এগুতেই একটি তীব্র লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয়। কেউ দীর্ঘ সময় লড়াইয়ে জয়ী হয়ে টিকে থাকে, কেউ হয়ত কিছুটা কম কিন্তু একসময় এই লড়াইয়ে হারতেই হয়। এই হেভী ওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা যদিও একটি খেলা, এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। কেউ হয়ত একশটি কঠিন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়, কেউ হয়ত মাত্র বিশটি। এটি একেক জনের অন্তর্গত শারিরীক দক্ষতার উপর নির্ভর করে। হ্যা, টম অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই লড়েছে। অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ ও কঠিন লড়াইয়ে সে টিকে আছে। তার সমকালীন আর কেউই রিং-এ নেই। সে প্রবীণদের শেষ প্রহরী। সে তাদের সকলের শেষ হয়ে যাওয়া অবলোকন করেছে এবং কাউকে কাউকে সে নিজ হাতে ধ্বংস করেছে।
প্রতিষ্ঠিতদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে তাকে এবং একে একে সব প্রতিষ্ঠিতদেরকে বিদায় করে দিয়েছে সে- প্রতিটি বিজয় এনে দিয়েছে ভরপুর আনন্দ আর হাসির উপলক্ষ্য, টম তখন হাসছিল যখন বিল ডেসিংরুমে বসে কেঁদেছে। এখন টম পুরানো প্রতিষ্ঠিত ফাইটার, নতুনদেরকে তার বিরুদ্ধে লড়েই এগুতে হবে। যেমন আজকের প্রতিদ্বন্ধী স্যান্ডেল। সে নিউজিল্যান্ড থেকে এখানে এসেছে, ওখানে তার স্মরনীয় রেকর্ড রয়ে গেছে কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে সে নতুন, অপরিচিত। তাকে পুরানো টমে মুখামুখি হতে হবে। যদি স্যান্ডেল দক্ষতার পদর্শনী দেখাতে পারে, তার সামনে এসে যাবে আরো বড় ধরনের সুযোগ, আরো বৃহত্তর প্রদর্শনীর। এটা নির্ভর করছে তার উপর সে কতটা দক্ষ লড়াকু, তা প্রমাণের উপর। সে ছিনিয়ে নিতে পারে অনেক কিছু- টাকা, সুনাম আর ক্যারিয়ার। আর টম কাটিয়ে এসেছে এ সব পদক্ষেপ, এখন এই ফাইট হতে তার কিছু অর্থ হস্তক্ষেপ হওয়া ছাড়া কিছুই পাবার নেই, যা দ্বারা সে বাড়িভাড়া ও দোকান বাকি পারিশোধ করবে। এবং যেহেতু টম স্মৃতি রোমান্থন করছে যৌবনের, যৌবনের রূপরেখা দেখা দেয় তার মানসপটে। যৌবন, সম্মানিত যৌবন, উৎফুল্লতায় মাধুর্যমণ্ডিত, অজেয়, মসৃন মাংসপেশী, টসটসে ত্বক, প্রাণবন্ত ফুসফুস, যাকে ক্লান্তি এসে কাবু করতে পারে না, হৃদয়োত্থিত কান্না থমকে থমকে হানা দেবার অবসর পায় না স্রোতস্বীনি হাসির স্রোতের গতিময়তায়। হ্যা, যৌবন ধ্বংসপ্রবন, সে ধ্বংস করে পুরাতন জং ধরা স্থবিরতাকে আর যদি তেমন না করে তবে সে ধ্বংস করে নিজেকে। যৌবন সর্বদাই উদ্দ্যেমী। পৃথিবীটা যৌবনের, উদ্যমের আর বিজয়ের। যৌবন কখনো পুরানো হয় না, মানুষের বয়সটা কেবল ক্রমাগত পরিণতির দিকে ধাবমান।
যখন টম কিং মঞ্চে প্রবেশদ্বার দিয়ে ভিতরে যাচ্ছে, যুবকদের চিৎকার ধ্বনি শুনতে পায় সে। সে শুনতে পায় একজন আরেকজনকে বলছে, ‘‘দেখো, দেখো, টম কিং। দ্যা, টম কিং’’
টম যখন তার ড্রেসিং রুমে প্রবেশ করল, ক্লাবের সেক্রেটারী তাকে স্বাগত জানাল, বলল, ‘‘কেমন বোধ করছো, টম?’’
‘‘সম্পূর্ণ প্রস্তুত আমি’’ টম বলল যদিও সে জানে সে সত্যটা বলছে না, বলছে না যে, এখন তার হাতে কিছু টাকা থাকলে সে কয়েক টুকরা ফ্রেস মাংস খেয়ে নিত।
ড্রেসিং রুম ছেড়ে টম কিং যখন মঞ্চে এসে দাড়াল তখন একটি হর্ষধ্বনি গমগম করতে লাগল সমস্ত গ্যালারী জুড়ে। প্রবেশ পথে কেউ কেউ হাত মিলাল। কিং লক্ষ্য করল যে, যারা তার সাথে হাত মিলাচ্ছে তার প্রায় সকলেই নবীন। টম কিং যখন প্রথম লড়াইয়ে নামে এবং জিতে যায় তখন এসব নবীনের অনেকে জন্মায়নি। মঞ্চে উঠে টম কিং ও প্রবীণ রেফারী, যিনি দশ বছর রিং-এ নেই, কিং- এর অনেক জানাশোনাও বটে, পরস্পর হাত মিলাল।
এরই মাঝে প্রবলতর গুঞ্জনধ্বনি, চিৎকার, হৈ চৈ-এর মাধ্যে দিয়ে আগমন ঘটল, টম কিং-এর আজকের প্রতিদ্বন্ধী স্যান্ডেলের। টসটসে ত্বক, দৃঢ় গাথুনি, চেহারায় একটি স্পষ্ট মায়াবী ভাব লক্ষ্য করল টম। টম কিং, নিজের প্রথম লড়াইয়ে ফিরে গেল স্মৃতিতে। মাত্র পাঁচ রাউন্ড টিকেছিল তার প্রতিদ্বন্ধী, নক আউট করে দিয়েছিল সে। তার দীর্ঘ লড়াইয়ের ময়দানে বহু প্রতিদ্বন্ধীকে নক-আউট করে দিয়েছে টম, তার হুকগুলো দুর্ধর্ষ, খুব কম ফাইটার তার প্রচন্ড আঘাতের পর উঠে দাড়াতে পারে।
ভাষ্যকারের নানা ধরনের উপস্থাপনার পর, ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠল। প্রথম দুই রাউন্ড পুরোটাই স্যান্ডেলের। টম কিং সমর্থকরা হতাশ হয়ে যাচ্ছে প্রথমেই কিন্তু টম কিং মোটেও নয়। সে প্রথম দুই রাউন্ড স্যান্ডেলকে লাফাতে দিয়েছে, যাতে শক্তির প্রাথমিক কিছুটা ক্ষয় হয়। টম কিং জানে শক্তিমত্তায় নবীনদের সাথে পেরে উঠা দুষ্কর কিন্তু অভিজ্ঞতা আর ব্রেনকে কাজে লাগাতে জানে টম কিং।
প্রথম দুই রাউন্ড শুধু নিজেকে বাচিয়ে স্যান্ডেলকে লড়তে দিয়েছে। দর্শকের চিৎকার আর হৈ চৈ এ স্যান্ডেল উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে বার বার। তৃতীয় রাউন্ডে এসে টম কিং পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল, যখন সে প্রচন্ড আঘাতে স্যান্ডেলকে ধরাশায়ী করে ফেলে। দর্শকের মাঝে সাঝ সাঝ রব উঠে গেল। একজন বাচ্চা ছেলে পিছল খেয়ে পরে গিয়ে পর মূহুর্তেই দাড়িয়ে যেমন আবার দৌড়াতে থাকে, স্যান্ডেল তেমনি এক ঝটকায় উঠে দাড়াল। তবে স্যান্ডেল সতর্ক হয়ে গেল, বুঝে গেল সে একজন কঠিন প্রতিদ্বন্ধীর মোকাবেলা করছে।
নবম, দশম রাউন্ডে এসে বোঝার কোন উপায় রইল না কে এগিয়ে রইল। টম অবশ্য বুঝতে পারছে যে সে কিছু পয়েন্টে পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ লড়াই চলল প্রায় সমানে সমানে। তরুন আর বুদ্ধি দীপ্ত প্রবীণ সফল লড়াকুর মধ্যে এই লড়াইয়ে সমস্ত গ্যালারী উল্লাসিত।
সতেরতম রাউন্ড স্যান্ডেল একটু বেশিই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। টম কিং লক্ষ্য করল এবং কিছুটা সুযোগ করে দিল টমকে আঘাত করার জন্য। বেশ কয়েকটি আঘাতের পর স্যান্ডেল জয়ের গন্ধ শুকতে শুরু করল আর একটু অমনোযোগিতা আর ঢিলামি পেয়ে বসল তাকে। টম এটার অপেক্ষায় ছিল। টম জানে প্রতিপক্ষ যদি একটু অসতর্ক হয়ে উঠে, তার হুকগুলোর আঘাতটা যদি সঠিক শক্তিতে পাঞ্চ করতে পারে, কারো সামর্থ্য নেই উঠে দাড়ানোর। জীবনে বহুবার টম পয়েন্টে পিছিয়ে পরে তার এই হুকে নক-আউট করে দিয়েছে অনেক প্রতিপক্ষকে।
সমস্ত গ্যালারী স্তব্ধ হয়ে আছে যেন একটি নিরবতা এসে ভর করেছে। টমের কানে কোন শব্দ প্রবেশ করছে না। এই লড়াইয়ের শেষ দিকে টম এই প্রত্যাশা করছিল। স্যান্ডেলের অতিরিক্ত আত্ম-বিশ্বাস আর অসতকর্তা। পর পর তিনটি আঘাত করল টম, সমস্ত শক্তি দিয়ে। তার অতীত অভিজ্ঞতা এই যে, কেউ উঠে দাড়াতে পারে নি। এবার টম প্রকৃতস্থ হলো, এবার সমস্ত গ্যালারী পিন পতন স্তব্দতা। রেফারী গুনছে এক, দুই, তিনৃ দর্শকের একাংশ সমস্বরে উচ্চারন করছে এক, দুই, তিন, চারৃ.. জয় থেকে টম আর মাত্র কিছু সময় দুরৃ. সাত, আট, নয়ৃ. আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড..
কিন্তু একমাত্র যৌবন উঠে দাঁড়াতে পারে। স্যান্ডেল, উঠে দাড়াল। স্তব্ধ টম, তার সমস্ত শক্তি নি:শেষ করে সবশেষ আক্রমন করেছে সে। কেউ যারা তার পূর্বসূরী, আর যারা তার সম-সাময়িক কেউ উঠে দাড়াতে পারেনি। কিন্তু নবীন উঠে দাড়ায়। তারুন্য উঠে দাড়াল। স্যান্ডেল আরো তীব্র হয়ে উঠল, টম কিং জানে, দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন তারুন্য আরো দারুন উদ্দিপীত হয়ে উঠে, বরং যত বেশি প্রতিকুলতা এসে ভর করে তত বেশি উদ্দীপনা কাজ করতে থাকে। আর প্রবীনের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন তাকে বিদায় নিতে হয়।
পরবর্তী দুই রাউন্ড টম কিং একটি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সৈনিক যেন। কেবল নক আউট হতে বেচে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেল। যদিও সর্বশেষ রাউন্ডে টম কিং, দ্যা টম কিং আরো একটি আক্রমন হানলো। আর স্যান্ডেল ছিটকে পরল, আছড়ে পরল মঞ্চে, কিন্তু উঠে দাড়াতে বেগ পেতে হয় নি স্যান্ডেলের।
খেলা শেষ। পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত টম সমস্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে হেলান দিয়ে বসে রইল। সকলেই ফলাফলের প্রতীক্ষায় অস্থির সময় কাটাচ্ছে। অবশেষে ভাষ্যকার মঞ্চে এলো। ভাষ্যকার বললেন,‘ প্রিয় দর্শক, যে লড়াই আজ আমরা দেখলাম, ইয়ং স্যান্ডেল আর ওল্ড টম কিং-এর মাঝে, দীর্ঘ দিন এমন লড়াই দেখা যায়নি। আমার দৃষ্টিতে এ লড়াই এ মঞ্চে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে শ্রেষ্ট। কিন্তু আমাকে ফলাফল ঘোষনা করতে হবে।’’
রেফারী দুইজন প্রতিদ্বন্ধীর দুই হাত ধরে আছে, আর প্রতীক্ষা করছে যার নাম ঘোষনা হবে তার হাত উচিয়ে ধরবেন।
ভাষ্যকার ঘোষনা করলেন, ‘‘বিচারকের দৃষ্টিতে আর তাদের বিচারে অতি সামান্য ব্যবধানে জয়ী হয়েছে স্যান্ডেল।
সমস্ত গ্যালারী আবারো থমকে গেল। ফলাফল ঘোষনার পর চেচামেচিতে গ্যালারী উল্লাসিত থাকে কিন্তু সকলেই থমকে গেল যেন। স্যান্ডেল, এই মঞ্চে প্রথম বিজয় তার, আনন্দিত বটে কিন্তু সে ভাষ্যকারের হাত হতে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল,‘‘ বিচারকের দৃষ্টিতে আমি জিতেছি, আমি আনন্দিত। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে এই লড়াইয়ে জয়ী টম কিং, দ্যা টম কিং’’
সমস্ত গ্যালারী টম কিং-টম কিং চিৎকারে কেপে উঠল। স্যান্ডেল এসে টমকে জড়িয়ে ধরল। টম তার হাতে হাত মিলিয়ে বিদায় নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এলো। সে মঞ্চ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। পিছন থেকে ভাষ্যকারে উচ্চারণ শুনা গেল, বলছেন,‘‘ টম কিং, দ্যা টম কিং, আ গ্রেট ফাইটার, হেরে গিয়েও যিনি সকলের হৃদয় জয় করে গেছেন।’’
অনেকেই টমের সাথে কথা বলতে চাইল, এক জন সাংবাদিক, ক্লাব সেক্রেটারীসহ আরো অনেকে কিন্তু টম সোজা বেরিয়ে এলো ড্রেসিং রুম থেকে। হাটতে হাটতে একটি নির্জন পার্কে এসে বসল টম। একটি অবিশ্রান্ত ক্লান্তি এসে ভর করল তার সমস্ত দেহ জুড়ে। টম কিং ভাবল, মঞ্চটা সব সময় কি আনন্দঘন! কিন্তু যারা মঞ্চায়িত করে এ আনন্দ দৃশ্যপট, তাদের মাঝে কত উত্থান আর পতন। শুধু থেকে যায় কিছু লড়াকু দৃশ্যায়নের ইতিহাস। কিন্তু যখন এই মঞ্চ হতে বিদায় নেয় একজন লড়াকু, কি নিঃস্ব আর একা।
মুখ ঢেকে ফেলল টম কিং, তার প্রিয়জনদের মুখ ভেসে উঠল, তার স্ত্রী, বহুদিনের পুরানো বন্ধু, দুই সন্তানের মুখ ভেসে উঠল। টম কিং, দ্যা টম কিং, কি নি:স্ব আর অসহায় তার ফিরে যাওয়া। মুখ ঢেকে টম হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
আর টম কিং এর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল কেন বিশ বছর আগে টসার বিল ড্রেসিং রুমে বসে বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদেছিলো!