কয়েদী নাম্বার ৪৪০৮৮৭

FB_IMG_1485096270095
সাড়ে পাচ বছর প্রায় আমি এই কন্ডেম সেলে। মৃত্যুর অপেক্ষায়।
সাড়ে পাচ বছর ঠায় কারো বা কিছুর জন্য অপেক্ষা করা তোমার কাছে কেমন মনে হয়?
মরছিলাম আমি প্রতি পলে পলে। মুহুর্তে। ঘন্টায়.. প্রতিটি সুর্যোদয় এবং সুর্যাস্তে!

দুর্ভাগ্য আমার। একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে আমি আয়েশ করে, একটা সুর্যোদয় কিংবা সুর্যাস্ত দেখতে পারিনি.. বিগত বছরগুলিতে।

নিজের সেলে একাকী। দুপুরের খাবার শেষ করে একটু ঝিমানি মত এসেছিল কেবল। ভাত ঘুমে ঢলে পড়া কোনো ক্লান্ত প্রহর কল্পনায় আনতে চাইছিলাম বোধহয়।

এমন সময় ওনারা এলেন। সমন নিয়ে। সময় হয়েছে। অবসান হয়েছে অপেক্ষার। আমি হাসলাম তাদের মুখের ওপর। স্বস্তির হাসি :)

একজন ডাক্তার এলেন। অনেক কিছু পরীক্ষা করে কেন জানি আমার বাম হাতের বৃদ্ধ আংগুলটিতে বেশী সময় লাগালেন।
আমাকে কি যেন পড়ে শুনালেন। আমি শুনলাম। ঘোরের ভিতর। আমার তখন ঘোর লাগা ঘোর! কয়েদি নাম্নার ৪৪০৮৮৭ এর ঘোর।

আসলে আমি তখন আমার ভিতরের পাহাড়, নদী আর সাগরকে বিদায় জানাতে মগ্ন ছিলাম।

সময় বয়ে চলে একসময় সন্ধ্যা পেরিয়ে মধ্যরাতকে সাথে নিয়ে এলো..

আমি নিজে শুদ্ধ হলাম।
একজন কিছু পাঠ করেছিলেন। আমি নির্ণিমেষ চেয়েছিলাম তার ঠোঁটের দিকে। মুগ্ধ হয়েছিলাম কিনা?

পাগল নাকি!
মুগ্ধ হবার ওটা যথার্থ সময় ছিল কি? এই শেষ সময়ে ও আমার মেজাজ বিগড়ে দিও না তো।

আমাকে শেষ ইচ্ছের কথা জানাতে বললেন কতৃপক্ষের দায়িত্বশীল একজন। ডেপুটি জেলার হবেন হয়তো। কারণ জেলার সাহেবকে চিনি আমি। আসলেই কি চিনি?

কিছু খেতে ইচ্ছে করছে কিনা জানতে চাওয়া হলেও নিশ্চুপ ছিলাম আমি। তারপরও কিছু একটা হাতে করে এনেছিল এক রক্ষী। আমি ফিরেও চাইলাম না সেদিকে।

সবশেষে প্রার্থণা করার সুযোগ দিতে চাইলে প্রশ্নকর্তার চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার কাছে করব?’ তিনি নিশ্চুপ রইলেন।

একসময় জল্লাদরা এলো। আমার হাত পেছনে ভদ্রভাবে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলো। বলল, ‘চলুন স্যার!’ আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেও, তারা ছিল নিস্প্রাণ। পাথরের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো পলকহীন চোখে। জল্লাদদের চোখ পাথরের-ই হতে হয়।

আমাকে যম টুপি পরাতে চাইলে, প্রথমবারের মত আমি সরব হলাম। বললাম, ‘ আমার এত বছরের থাকার পরিচিত জায়গাটুকু আমি খোলা চোখে যেতে চাই। আমাকে বধ্যভূমির প্রবেশদ্বারের আগে পরিয়ে দিও।’

আইনে নেই। তাই পরতেই হল। আমার দু’পাশে দু’জন জল্লাদ আমাকে শক্ত করে ধরে হাটিয়ে নিয়ে চলল। আমার আপন আধার ঘোর অন্ধকারের দিকে আমাকে টেনে নিয়ে চলল!

আমি হেটে যেতে যেতে, পাহাড়-নদী-ঝর্ণাদের মনে মনে ডাকলাম, ওরা দূর থেকে আবছা প্রচ্ছায়ার মত নিশ্চুপ রইলো। কাছে এলোনা।
তখন আমি কাছের মানুষদেরকে মনের চোখে দেখার চেষ্টা করলাম। বরাবরের মত আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, তারা আরো দূরে সরে গেলেন আমাকে দেখে। যেন একমাত্র অচ্ছুত মানুষটি যেন আমি।

সহকারী জল্লাদরা আমাকে সাথে নিয়ে, অল্প ক’টি ধাপ পার হয়ে- আমাকে প্রধান জল্লাদের হাতে হ্যান্ডওভার করল।

আমার কাছের মানুষদেরকে শেষবারের মত ভাবলাম। ‘আমি যাদের যাদের এই জীবনে সবচেয়ে বেশী ভালবেসেছি, সবচেয়ে বেশী আঘাত আমাকে তারা-ই দিয়েছে’, আমার গলায় ফাঁসির নট যথাস্থানে বাধার সময়ে এই কথাই মনে পড়ল।

সব চুপচাপ। সময় থেমে আছে। নির্দিষ্ট ক্ষণের অপেক্ষা করছে সময়কে ঘিরে অন্যরা।
‘কেবলমাত্র তোমাদের ঘৃণা অবহেলায়ই আজ ঝুলে যেতে হলো আমায়!’ পতনের নিম্নগতির প্রথম অণুমুহুর্তে এই ছিল কয়েদি নাম্বার ৪৪০৮৮৭ এর অণুভাবনা।।

★ ছবি: ফাসির মঞ্চের

★★ পরিস্থিতি দেখে কয়েক জায়গার চন্দ্রবিন্দু ভয়ে পালিয়েছে।

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

16 thoughts on “কয়েদী নাম্বার ৪৪০৮৮৭

  1. ‘চিঠি এলো জেলখানাতে অনেক দিনের পর…’
    https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_wink.gif
    গল্প পড়ে মনে হলো আমার নিজেরই ফাঁসি হচ্ছে! ধন্যবাদ মিতা।

    1. আমি যখন লিখেছি, আমারও তেমনই মনে হচ্ছিলো মিতা।
      ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।
      ভালো থাকুন বন্ধু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  2. সময় থেমে আছে – সময় থেমে থাকে – কি অদ্ভুত সময় –
    যে ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করে সেই জানে সময় কি !!
    ভালো লাগছে অনুগল্প । শুভেচ্ছা জানবেন ।

    1. জীবনের কিছু কিছু ক্ষণ আমাদের অনেকের-ই এমন ফাসির চরম মুহুর্তটির জন্য অপেক্ষার মতো-ই। সে-ই জানে সময় কি?- সহমত আপনার সাথে।

      ধন্যবাদ সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
      ভালো থাকুন। :)

  3. এই লিখার উপস্থাপনা স্বতন্ত্র ধারার। শিরোনাম থেকে গল্পের আঙ্গিক পর্যন্ত।
    অভিনন্দন মি. মামুন। গুড লাক। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. ধন্যবাদ প্রিয় ভাইয়া :)

      একজন মৃত্যুপথযাত্রী (যে তার আসন্ন শেষ সময় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল) কিভাবেন ভাবতে খুব ইচ্ছে হলো। এভাবেই অনুচব করার চেষ্টায় এই লেখনী।

      ভালো থাকুন।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  4. গল্পটি পূর্বে কোথাও পড়েছিলাম মনে হচ্ছে। খুব চেনা। আবারো পড়ে নিলাম। শুভকামনা প্রিয়ভাই।

    1. আমার টাইমলাইন এবং ফেবু গ্রুপগুলিতে পড়েছেন হয়তো।
      এই গল্প আমার গোলাম জীবন আকস্মিক হহেষ হবার মুহুর্তগুকিকে নিয়ে লেখা।
      ভালো থাকুন।

  5. স্বতন্ত্র ভঙ্গির উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয়েছি । অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা মামুন ভাই।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।