ট্যাগ আর্কাইভঃ মামুনের অণুগল্প

অণুগল্প-৫৫৩ // কে এই কাশেম??

90

প্রচন্ড বৃষ্টি। আপাদমস্তক রেইনকোটে আবৃত শিহাব। বাইক নিয়ে একটা মার্কেটের সামনে আরো কয়েকজন বাইক রাইডারদের সাথে ভিজছে। বাধ্য হয়েই সবাইকে ভিজতে হচ্ছে। মার্কেটের ভিতরে এত পরিমান মানুষ, আর কেউ ঢুকতে পারছে না। বাতাসের বেগও অনেক, তাই সামনে না এগিয়ে বৃষ্টি কমার অপেক্ষায় খোলা আকাশের নিচে ভিজতে থাকে শিহাব।

একটা সিগারেট টানতে পারলে ভালো লাগতো। ভাবতেই বড্ড ‘ধুমপানের তেষ্টা’ জাগলেও নীরব থাকে সে। মফস্বল সাংবাদিকদের কখনো কখনো নীরব থাকতে হয়।

দ্রুত বেগে একটা সিএনজি অটোরিকশা রাস্তার জমা জল ছিটিয়ে শিহাবকে পাশ কাটায়। ভিজিয়ে দেয় শিহাবকে। কিছু ছিটা চোখে পড়ে, জ্বলে উঠে বাম পাশের চোখ। আপনাতেই অশ্রাব্য একটা গালি এসে যায়। কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দে পরিণত হবার আগেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে।

মফস্বল সাংবাদিকেরা একটু মন খুলে, ইচ্ছামত কাউকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিও দিতে পারে না। প্রকাশ্যে তো নয়ই। সবসময় একটা নিয়ন্ত্রণের ভিতরে থাকতে হয় তাদেরকে।

শিহাব যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তার ঠিক ওপাশেই সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। সেদিকে চোখ যায় শিহাবের। কেন জানি কাশেমের কথা মনে পড়ে। এই অফিসের পিওন। তবে পিওন হলেও খুব ক্ষমতাশালী। মূলত অফিসটির সার্বিক কার্যক্রম সে-ই আসলে নিয়ন্ত্রণ করে। কয়েকটা বাড়ির মালিক এবং নামে বেনামে ওর আরও অনেক সম্পত্তির কথা শুনেছে শিহাব।

কাশেমের এই অবৈধ প্রভাবের জন্য এই এলাকা এবং পাশের এলাকার মফস্বল সাংবাদিকদের কি কোনো ভূমিকা নেই? এরা প্রায় প্রতিদিন কিংবা যখন ইচ্ছা হলো অথবা কেউ কেউ মাসের নির্দিষ্ট কোনো দিনে কাশেমের সাথে ‘চা পান’ করতে আসে। চলে বন্ধুত্বপূর্ণ গল্পগুজব, চায়ের সাথে সিগারেট আর যাবার সময় খাম। এই তিন এর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একটা ‘সাইক্লিক অর্ডার’। তা থেকে মফস্বল সাংবাদিকেরা কেনো জানি আর সহজে বের-ই হতে পারেন না।

জমির শ্রেণি পরিবর্তন সহ নানারকম অবৈধ কাজে আসে প্রচুর অবৈধ টাকা। এই টাকা দিয়েই সিস্টেমের ভিতরে থেকে কাশেমরা নিজেদের জন্য এক আলাদা রাজত্ব তৈরী করে। সবাইকে ম্যানেজ করেই অবশ্য। মফস্বলে আবার সবাই কেনো জানি দ্রুত ম্যানেজ ও হতে পছন্দ করেন।

তবে কি কোনো সাংবাদিক এই কাশেমদের বিরুদ্ধে লেখেন না? সিস্টেমের এই অনিয়ম তুলে ধরেন না তাদের প্রতিবেদনে?

এরকম প্রশ্নে একটু বিব্রত হয় শিহাব। নিজের ভিতরের শিহাব আর মফস্বল সাংবাদিক শিহাবের ভিতরে চলে ক্ষণিকের টানাপোড়েন। শেষে ভিতরের শিহাবই উত্তর দেয় মফস্বল সাংবাদিকের পক্ষ হয়ে,

– হ্যা, নিউজ হয়তো। কেউ কেউ করে। এরা হলো যারা বছর ধরে প্রতিমাসে কাশেমের থেকে খাম নেয়। এভাবে জানুয়ারী থেকে অক্টোবর পর্যন্ত লাগাতার খাম গ্রহন শেষে, কোনো কারণে যদি নভেম্বর মাসে কাঙ্খিত খাম দেয়া বন্ধ করে কাশেম..

ঠিক এর পরের দিনই পত্রিকায় বক্স করে বিশাল নিউজ! শিরোনাম?

” সাবরেজিষ্ট্রি অফিসে সর্বময় ক্ষমতাধর কে এই কাশেম??”

বাইনচোত!! কে এই কাশেম?
এখন কাশেমকে আর চেনো না? মুফতে চা-সিগারেট খাওয়া আর মাসে মাসে খাম নেবার সময়তো কাশেমই ছিলো ধ্যান-জ্ঞান। এখন আর চেনো না?

ভিতরের শিহাবের গালিতে কিছুটা ম্রিয়মান হলেও নিজেকে সামলে নেয় মফস্বল সাংবাদিক শিহাব। কারণ ভিতরের দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত সাংবাদিক শিহাবেরই জিত হবে। সবসময় ভিতরের মানুষটার কথামতো চলে মফস্বল সাংবাদিকতা করা যায়না।

#মামুনের_অণুগল্প_৫৫৩

মামুনের অণুগল্প: রাজ ভিক্ষুক

608620

২৮ রমজান। ভোর সাড়ে ছয়টায় বাসা থেকে বের হয় শিহাব। সেহরি খেয়ে মাত্র দু’ঘন্টা ঘুমুতে পেরেছে। ঠিক ছ’টায় সহকর্মীর ফোন,
– ভাই, চেয়ারম্যান এর বাসায় সাতটায় যাবার কথা না? বের হলাম আমি।

ঘুম জড়ানো কন্ঠে ‘আচ্ছা’ বলেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে শিহাব। কিন্তু দশ মিনিট যেতেই আরেক সহকর্মীর ফোন। অগত্যা উঠতেই হয়। দ্রুত রেডি হয়ে বেরও হয়।

তিনজন মফস্বল সাংবাদিক যখন ঘুম জড়ানো চোখে মহাসড়ক ধরে বাইক নিয়ে তুমুল বেগে ছুটছে, ঘড়ির কাটায় সময় তখন ছ’টা পঞ্চাশ।

স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যান এর বাসার সামনে তিনজনের বাইক এসে থামে। ইতোমধ্যে সাতটা দশ পার হয়েছে। চেয়ারম্যান এর বাড়ির সদর দরোজা বন্ধ। দরজার সামনে কিছু ‘জেনারেল ভিক্ষুক’ অপেক্ষা করছে। ঈদ উপলক্ষে তাদের চেয়ারম্যানের থেকে কিছু আর্থিক সাহায্য নিতে এরা অপেক্ষা করছে সেই ভোরবেলা থেকে।

গেটের দারোয়ানকে তাদের আগমনের কারণ জানায় শিহাব। উত্তরে দারোয়ান জানায় চেয়ারম্যান ঘুম থেকে ন’টায় উঠবেন। এখন গেট খোলা যাবে না। নিজেদের ‘সাংবাদিক’ পরিচয় দেবার পরও গেটম্যান জানায় তার কিছু করার নেই।

অপেক্ষমান বাকি দুই সহকর্মীর কাছে এসে একটু রাগ হয় শিহাব। নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করতে জানায়,
– কামালের কথা শুনে এই ভোরবেলায় আসলাম। এখন নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে?

যে সহকর্মী ফোন দিয়ে শিহাবের ঘুম ভাঙ্গিয়েছিলো, বিব্রত কন্ঠে সে উত্তর দেয়,
– সাতটার পরে নাকি চেয়ারম্যানকে আর বাড়িতে পাওয়া যাবেনা, কামালই তো বললে আসতে।

‘ঘোৎ’ জাতীয় শব্দ এবং আরও কয়েকটি ‘চো’ মিশ্রিত শব্দ মিলিয়ে নিজের রাগ প্রকাশ করে শিহাব। এদিক ওদিক তাকায়। রোদ বেড়ে গেছে। ছায়া আছে এমন জায়গার খোঁজ করে সে। প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। বসার কোনো জায়গাই নেই। সদর দরজার শেডে কিছু ছায়া আছে, সেখানে ভিক্ষুকদের সারিবদ্ধ অবস্থান। ওখানে অপেক্ষা করার প্রশ্নই আসেনা।

ইউপি চেয়ারম্যান এর বাড়ির চারপাশে সিসি ক্যামেরা। সেদিক তাকিয়ে সামনের দিকে হেঁটে চলে শিহাব। ওর পিছু নেয় বাকি দুই সহকর্মী। বাড়ি পার হলে একটা মুদির দোকান। বন্ধ। সামনে দুইটা বেঞ্চ পাতা। সহকর্মী দু’জন বাইক নিয়ে সেখানে ‘স্ট্যান্ড’ করায়। শিহাব আগেই বেঞ্চে বসে গেছে। ঘুমে চোখ জ্বালা করছে তার।

জ্বলছে বুকের ভেতরেও। সামান্য ক’টা টাকার জন্য এত ভোরে এসে এখন কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। চাইলে দারোয়ান বিশাল বাড়ির ভিতরের ‘ওয়েটিং রুমে ‘ ওদের বসাতে পারতো। সেটা না করাতেই অপমানের তীক্ষ্ণ খোঁচা অনুভব করে শিহাব। মোবাইল বের করে চেয়ারম্যান এর নাম্বারে কল করে। মোবাইল ‘সুইচড অফ’।

বাকি দুই সহকর্মী নিজেদের মোবাইলে মগ্ন। মাথা নিচু করে f আকৃতি নিয়ে ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। মুদি দোকানের বেঞ্চে বসে অদূরে অপেক্ষমান ভিক্ষুকদের সারির দিকে তাকিয়ে থাকে শিহাব। ওদের তাড়া নেই। ওদের নিস্প্রভ চোখে হয়তো ঘুম না হওয়ায় জ্বালা ধরানো অনুভবও নেই। নেই হয়তো বুকের ভিতরে ‘অপমানের তীক্ষ্ণ খোঁচা। ওরা এভাবেই অপেক্ষা করতে অভ্যস্ত। ওরা ভিক্ষুক।

‘তুমি কি? ওরা যদি ভিক্ষুক হয়, তাহলে তুমিও তো ভিক্ষুক!’

নিজের মনের এই মন্তব্যে মৃদু হেসে মনকে শিহাব জানায়,
– না, আমি ‘রাজ ভিক্ষুক’।

আমাদের দেশে ঈদ এলেই মফস্বল সাংবাদিকেরা ভিক্ষুকে পরিণত হয়। ঈদকে সামনে রেখে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং জনপ্রতিনিধিদের থেকে ‘ঈদ সালামি’ গ্রহনের হিড়িক পড়ে যায়। যে যেভাবে পারে ‘ঈদ শুভেচ্ছা’ প্রদানের ছদ্মবেশে আসলে থাকে নগদ টাকা সংগ্রহের প্রচেষ্টা। এটা এখনকার মফস্বল সাংবাদিকতার এক ‘ট্রেন্ড’ এ পরিণত হয়েছে। এছাড়া আর করারই বা কী রয়েছে? সব মফস্বল সাংবাদিকেরা তো তাদের ‘হাউস’ থেকে বেতন পান না। নিজের টাকার তেল পুড়িয়ে সারা বছর সংবাদ সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে তারা। তাদের সংসার কীভাবে চলে? কিংবা ঈদ সহ অন্যান্য পার্বনে মফস্বল সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আনন্দ কীভাবে উদযাপন করে তারা? এই খবর যেমন তাদের কর্মস্থলের মালিক সম্পাদকগণও নেন না, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও সেসবের খোঁজ নেবার কোনো প্রয়োজন মনে করেন না। এক একসময় শিহাবের মনে হয়, ‘আদৌ মফস্বল সাংবাদিকেরা’ মানুষ কিনা?’

ঠিক পৌণে ন’টায় ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে শোরগোল শুনে সেদিকে আগায় শিহাব। এর ভিতরে মুদি দোকানদার এসে তার দোকান খুলেছে। দোকানের চারপাশে কাপড়ের পর্দা টানিয়ে দিয়েছে। এটা মুদি দোকান হলেও এখানে চা বিক্রী হয়। পর্দার আড়ালে ইতোমধ্যে কয়েকজন এসে চা ও সিগারেট পান করেছে শিহাবদের পাশে বসে। পর্দার ভিতরে থেকে তারা রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করেছে।

হট্টগোলের জায়গায় এসে শিহাব দেখে, একজনকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাকে ঘিরে অনেক নারী-পুরুষ লাগাতার চেচামেচি করে যাচ্ছে। বিশাল ভুঁড়িওয়ালা একজনের হাতে লাঠি। সে বেঁধে রাখা লোকটিকে মারতে গিয়েও মারছেনা। কেবল ভয় দেখাচ্ছে। এই লোক নাকি রিক্সা চুরি করেছিলো। আজ তাকে হাতেনাতে ধরতে পেরে এই বিচারের আয়োজন।

শোরগোল শুনে নিজের বাড়ির দো’তলার বারান্দায় আসেন ইউপি চেয়ারম্যান। কি হয়েছে জানতে চান। রিক্সা চোর ধরা পড়েছে শুনেই আগ্রহ হারান তিনি। তাঁর কাছে হয়তো এটা কোনো চুরিই না। আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই তো অনেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চাউল, গম এবং সর্বশেষ করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ চুরির অভিযোগ রয়েছে। কয়েকজনকে তো এই অভিযোগে শাস্তিও দেয়া হয়েছে।

চেয়ারম্যানকে দেখে সদর দরজার সামনে গিয়ে উপরে তাকিয়ে তাকে সালাম দেয় শিহাব। মাস্কে ঢাকা নিজের চেহারা দেখায় মাস্ক থুতনিতে নামিয়ে দিয়ে। সালামের উত্তর দিয়ে চেয়ারম্যান অন্দরমহলে প্রবেশ করেন। দুই সহকর্মীকে নিয়ে শিহাব দারোয়ানের সাথে আবার কথা বলে এবং ভিতরে প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু দারোয়ান এবারও তার অনীহা প্রকাশ করে। সে জানায় চেয়ারম্যান যতক্ষণ নিচে না নামবেন ততক্ষণ এই গেট খোলা হবেনা।

এবারও বিড়বিড় করে শিহাব মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে সদর দরজা থেকে সরে আসে। তবে এবার ‘চো’ শব্দের পরিবর্তে শিহাব ‘মা’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে।

সাড়ে ন’টার সময় দুইটা মটরবাইক গেটের সামনে আসে। এদের দেখেই দারোয়ান দরজা খুলে দেয়। এরা চেয়ারম্যান এর খাস লোক। এদেরকে সাধারণত ‘ভাইলোক’ বলা হয়। এই ‘ভাইলোক’দের একজন শিহাবের পরিচিত। মফস্বল সাংবাদিকদের সাথে ইউপি চেয়ারম্যানদের ‘টক-ঝাল-মিষ্টি’ জাতীয় সম্পর্ক। যদিও সাংবাদিকের কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে নেই, তারপরও অনেক সাংবাদিকই কোনো না কোনো দলের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। তবে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং জনপ্রতিনিধিদের কুকর্ম কিংবা কোনো ‘ফাঁক’ খুঁজে পেলে, সেখানে ‘ভরে দেবার লোভ’ অধিকাংশ সাংবাদিকেরাই সম্বরণ করতে পারেন না। আর এইসব ক্ষেত্রে ইউপি চেয়ারম্যানদের রক্ষা করতে সাংবাদিক ও ইউপি চেয়ারম্যানের মাঝে ‘মিডল ম্যান’ হিসেবে কাজ করেন এসব ‘ভাইলোক’।

পরিচিত সেই ‘ভাইলোক’ এর কল্যাণে শিহাবরা চেয়ারম্যান এর বাড়ির একতলার ‘ওয়াটিং রুমে’ বসার সুজোগ পায়। ঘড়ির কাটা তখন কাটায় কাটায় সকাল দশটার ঘরে।

ওয়েটিং রুমে বেশ বড় সোফাটায় শরীর এলিয়ে বসে পড়ে শিহাব। বাকি দু’জনও ওকে অনুসরণ করে। ভিতরে আরো অনেক লোক দেখতে পায় শিহাব। এরা কখন যেন ভিতরে প্রবেশ করেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ভিক্ষুকদের দল আরো অনেক বড় হয়েছে। ভিতরে এবং বাহিরে উভয় ‘ভিক্ষুক’ দলই চেয়ারম্যানের অপেক্ষায়।

সাড়ে দশটায় তিনি উপরমহল থেকে নেমে এলেন। ওয়েটিং রুমের সাথেই তার অফিস রুম। সেখানে ঢুকে যান তিনি। যাবার আগে শিহাবদের দেখে হাত দিয়ে বসার ইশারা করেন। তার পিছনে ‘ভাইলোক’রা অফিসে প্রবেশ করে দরোজা বন্ধ করে দেয়।

এভাবে অপেক্ষার প্রহর বাড়তেই থাকে। এর ভিতরে RAB এর ভেস্ট পরা এক কনস্টেবল পিছনে ব্যাগ হাতে এক ‘মুন্সি’কে নিয়ে চেয়ারম্যান এর অফিস দরোজায় নক করেন। দরজা খুলে যায়। ওনারা দু’জন প্রবেশ করতেই সব ‘ভাইলোক’রা বের হয়ে আসে। শিহাবদের সামনে প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে সেখানে বসে গল্পে মেতে ওঠে তারা।

একটু পরে স্থানীয় থানার গাড়ি এসে থামে চেয়ারম্যান এর সদর দরোজায়। এক এস আই সাথে একজন কনস্টেবলকে নিয়ে অফিস রুমে প্রবেশ করে। দরোজা বন্ধ হয়।

এরপর ঘড়ির কাটা ঘুরতে থাকে। RAB এবং পুলিশ সদস্যগণও বের হন না। শিহাবদেরও ভিতরে প্রবেশ করা হয়না। সোয়া এগারোটার সময় চেয়ারম্যান একা বের হন। শিহাব এবার এগিয়ে গিয়ে চেয়ারম্যানকে সালাম দেয়। চেয়ারম্যান বলেন,
– একটু বসেন ভাই। পুলিশ বিদায় করে আপনাদের ডাকতেছি।
একথা বলেই অফিস রুমের বাইরের বাথরুমে ঢুকে যান চেয়ারম্যান।

আবার সোফায় শরীর এলিয়ে দেয়া। শিহাবের ভ্রুর কুঞ্চন আরো গভীর হয়। সাথের এক সহকর্মী জানায়,
– বাথরুমে কয় ঘন্টা লাগায় এবার কে জানে?
– আরে, নোট আলাদা করতে গেছে টয়লেটে। আলাদা আলাদা খামে ভরতে যতক্ষণ। বেশীক্ষণ লাগবেনা।
দ্বিতীয় সহকর্মী উত্তর দেয়।

একবার ভাবে শিহাব যে চলেই যায়। কিন্তু সাথের এক সহকর্মীকে বলতেই সে জানায়,
– এতক্ষণ অপেক্ষা করলাম, খালি হাতে যাবোনা আজ। পরে যা করার করা যাবে। পুরা দিনটাই মাটি হবে আজ এখন এভাবে চলে গেলে।

সাড়ে এগারোটায় RAB কনস্টেবল তার মুন্সিকে নিয়ে বের হয়। এরপর এস আই তার কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে। এবার শিহাবদের অফিস রুমে ডাক পড়ে। কিন্তু দরজার কাছে যেতেই পরিচিত ‘ভাইলোক’ এসে জানতে চায়,
– কয়জন আপনারা?
শিহাবের সাথের সহকর্মী উত্তর দেয়,
-তিনজন।

শুনে ‘ভাইলোক’ আবার ভিতরে যায় শিহাবদের দরোজায় দাঁড়া করিয়ে রেখে। একমিনিট পরে বের হয় সে। এক হাজার টাকার তিনটা নোট হাতে নিয়ে এক এক করে শিহাবদের হাতে গুঁজে দেয়। ‘ওয়েটিং রুমে’ অপেক্ষমাণ সকল মানুষের সামনে হাতের মুঠোতে এক ইউপি চেয়ারম্যান এর ‘ঈদ সালামি’ এক হাজার টাকার নোট নিয়ে বিব্রত হয় শিহাব। এভাবে খাম ছাড়া টাকা দেয়ায় নিজেকে কেমন উলঙ্গ মনে হয় শিহাবের। একবার ভাবে টাকাটা ছুড়ে ফেলে দেয় ‘ভাইলোক’ এর মুখের উপর। কিন্তু সবসময় মন যা চায় আমরা কি তা করতে পারি?

কোনোমতে দরজায় রেখে আসা জুতো জোড়া পায়ে দেয় শিহাব। মানিব্যাগে নোটটা রাখে। সদর দরোজা দিয়ে বের হবার সময় আবারও বাইরে অপেক্ষমান ‘জেনারেল ভিক্ষুকদের’ দিকে তাকায় শিহাব নামের এক ‘রাজ ভিক্ষুক’। এরা এখনও অপেক্ষা করছে। হয়তো সারাদিনই অপেক্ষা করবে এরা। কিছু পাক বা না পাক।

নিজেদের বাইক স্টার্ট দেবার সময় থানার গাড়িটি শিহাবদের অতিক্রম করে। ড্রাইভারের পাশে বসা পরিচিত এস আই’র সাথে শিহাবের চোখাচোখি হয়। সে নির্লজ্জ হাসি হাসে। শিহাবের কাছে মনে হয় যেন ভেংচি কাটলো তাকে।

নিজের বর্তমান পেশাকে ঘিরে সামগ্রিক কর্মকান্ডে নানাবিধ ভাবের উদয় হয় শিহাবের মনে। অক্ষম ক্রোধ, আর্থিক অস্বচ্ছলতায় ঈদকে ঘিরে ভিক্ষাবৃত্তি, সত্য প্রকাশে মানসিক টানাপোড়েন সহ সদ্য প্রায় পাঁচ ঘন্টা অপেক্ষার পর সবার সামনে হাজার টাকার একটি নোট প্রাপ্তি- এসব কিছু মিলিয়ে মহাসড়ক ধরে ৮০ কি.মি. বেগে দ্রুত ছুটে চলা শিহাবের মনে হয় বাইক নিয়ে সোজা আইল্যান্ডে গিয়ে ধাক্কা দেয়। এই ‘রাজ ভিক্ষুক’ এর জীবন আর ভালো লাগেনা।

এবার ‘চো’ এবং ‘মা’ গোত্রের সাথে ‘খা’ জাতীয় শব্দের মিশেলে এক মফস্বল সাংবাদিকের নিজের ভিতরের ক্রোধ ও হতাশা বের হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু তাতে ঈদ ‘কালেকশনে’ বের হওয়া শিহাব নামের এক ‘রাজ ভিক্ষুক’ এর ভিতরের জ্বলুনি কি একটুও কমে?

#রাজ_ভিক্ষুক_মামুনের_অণুগল্প_৫৫৩

।। লোভ // মামুনের অণুগল্প ।।

কসাইয়ের দোকানটা মাছ বাজারের সাথেই। দুটি গোশতের দোকান পাশাপাশি। একই মালিকের। গরুর দুইটা রান ঝুলছে। এর বিপরীত দিকে রাস্তার ওপারে, এক বুড়ো কুকুর দুপায়ের উপর মাথা রেখে চুপচাপ হামাগুড়ি দিয়ে আছে। তবে দৃষ্টি গোশতের দিকে নিবদ্ধ। ওর হাত পাঁচেক তফাতে, এক পঙ্গু বৃদ্ধ ভিক্ষুক। সামনে ‘অ্যালুমিনিয়ামের’ পুরনো থালা নিয়ে বসে আছে। কিছু মলিন নোট আর খুচরা পয়সা দেখা যাচ্ছে।

একটা সাদা প্রাইভেট কার এসে রাস্তার পাশে থামে। মালিক মধ্যবয়ষ্ক। জুলফির কাছে কিছু শুভ্র কেশের উপস্থিতি তাকে কেমন আলাদা ভাবগাম্ভীর্যে ভারিক্কী করে তুলেছে। তিনি ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে মাছ বাজারে ইলিশ বিক্রেতার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। দরদাম করে মূল্য পরিশোধ করেন। এক হালি বড় সাইজের ইলিশ নিয়ে ওনার ড্রাইভার গাড়ির ‘বুটে’ রেখে দেয়। পঙ্গু ভিক্ষুকের নির্ণিমেষ দৃষ্টির সামনে মাছগুলি ‘বুটের’ ভেতর চালান হয়ে যায়। মুখটা লোভের লালায় ভরে উঠে ভিক্ষুকটির।

প্রাইভেট কারে বসে, ইলিশের ক্রেতা বিষয়টি লক্ষ্য করেন। পরক্ষণেই মানিব্যাগ থেকে দুটি বঙ্গবন্ধুর ছবিওয়ালা পাঁচ টাকার কয়েন, ভিক্ষুকের থালা লক্ষ্য করে ছুড়ে দেন। নির্ভুল লক্ষ্য!

ঝনঝন শব্দে সে দুটি থালায় গিয়ে পড়ে। এরকম গাড়িওয়ালাদের লক্ষ্য সবসময়েই নির্ভুল হয়। কয়েন দুটির যথাস্থানে পড়াতে, গাড়ির মালিকের চোখ দুটি আত্মতৃপ্তিতে বুজে আসে। তাকে নিয়ে সাদা গাড়িটি রাস্তার ধুলা উড়িয়ে সগর্বে চলে যায়।

ধুলার ভিতর আরো কিছু ধুলা মেখে বৃদ্ধ ভিক্ষুকটি কুকুরটির দিকে চেয়ে থাকে। এই মাত্র গোশতের দোকান থেকে এক টুকরা বাতিল হাড্ডি কুকুরটির সামনে ছুড়ে দিয়েছে কসাই লোকটা। কুকুরটি মুহুর্তে সজাগ হয়ে কান খাড়া করে। এগিয়ে হাড্ডিটা মুখে নিয়ে নিজের আগের জায়গায় ফিরে আসে। এরই ভিতর একবার কসাইয়ের দিকে তাকায়। সেই চোখে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি। দেখে কসাই ও আত্মতৃপ্তিতে ভোগে।

বৃদ্ধ ভিক্ষুকের চোখে জিঘাংসা! না পাওয়ার ক্ষোভ। সেই অকৃতজ্ঞ দৃষ্টি নিয়ে সে কুকুরটির দিকে চেয়ে থাকে। কল্পনায় ওর এক হালি ইলিশ। এই মাছগুলি ওর মুখে যে লোভের লালা তৈরী করেছে, সেগুলি একত্রীত করে সে। অদৃশ্য সাদা প্রাইভেট কারটির মালিককে উদ্দেশ্য করে এক দলা থুথু নিক্ষেপ করে। যদিও একটু আগে, সেই মানুষটি তাকে দশটি টাকা দান করেছে! কিন্তু কল্পনায় ভাজা ইলিশের সুঘ্রাণ তাকে সেটা বিস্মৃত করায়।

ওদিকে শুকনা গোশত বিহীন একটা হাড্ডি মুখে নিয়ে কুকুরটি লেজ নাড়ে… আর কিছুক্ষণ পর পর কসাইয়ের দিকে কৃতজ্ঞ চোখে চেয়ে থাকে।।

#মামুনের_অণুগল্প

পারুর রুপার কৌটো // অণুগল্পঃ ৫০৬

শিহাব পারুর চোখগুলো ভাল করে দেখে। শান্ত… স্নিগ্ধ.. শিহাবের পারু! ওর কথাগুলোকে মনে হলো বাতাস, শিহাবের চুল এলোমেলো করে দিয়ে কোথায় যেন উড়ে যাচ্ছে।

ভাবনায় পেয়ে বসে শিহাবকে। ভাবতে থাকে…

জীবন খুব সুন্দর! ভাল লাগার অসহ্য সুখ নিয়ে কত কাছাকাছি আছে দু’জন!! মুহুর্তগুলো চলে যাচ্ছে দ্রুত। জীবনে সময় এতো কম!! তবুও জীবন তো।

পারুর কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো শিহাব। তাঁর হাতে একটা বই… রবীন্দ্রনাথ… গল্পগুচ্ছ। পারু পড়ছে, শিহাব পাশে আছে। যতক্ষণ থাকা যায়।
এক জীবন কতটুকু সময়?

চোখ দিয়ে নেমে এল দু’ফোটা জল। শিহাবের ইচ্ছে করল, পারুর সযত্নে গড়া রুপার ‘প্যান্ডোরার বাক্সটির’ ভেতরে যত্ন করে তা রেখে দেয়। আশার সাথে নিরাশা মিশে একাকার হয়ে যাক!

কতটা কষ্ট পেলে অনুভূতি অশ্রু হয়? ঝরে পড়া প্রতিটি স্বেদ বিন্দুর ভিতর জমাট বাঁধা- এক একটি মহাকাব্য!
কষ্টগুলো নিজের চেতনার সব ক’টি অনুভবে ছুঁয়ে-দেখে অনুভব করা একজন শিহাব, নরম মোম হয়ে গলে যায়। ভেংগে যায়.. কুয়াশার অস্পষ্টতায় ডুবে যায়। আবার জেগে উঠে!

তবে একজন অনুভবক্ষম শিহাবের বেলায় বেদনারা কৃষ্ণচুড়ার সবুজকে লালের লালিমায় ছেয়ে দেয়। বিবর্ণকে বর্ণীল করে। অশ্রু কাব্য?

দূর থেকে ভেসে আসা সন্ধ্যা আরতি, শিহাবকে বিষন্ন করে.. আরও। মন উদাস করা প্রলুব্ধতায় সে ব্যথিত হয়। আবারও দু’ফোটা অশ্রু ওর অগোচরে ঝরে পড়ে পারুর রুপার কৌটায় নিরবে জমা হয়। এত কাছে থেকেও পারু কি শিহাবের ভাবনাগুলো বুঝতে পারে? সে কি শিহাবের অশ্রুগুলো ওর রুপার কৌটায় জমিয়ে রাখতে চাইছে?

বাউরি বাতাসে ভেসে বেড়ানো গল্পগুচ্ছে মগ্ন পারুর কয়েকটি অবাধ্য চুল শিহাবের চিবুক নিয়ে খেলে। আত্মবিস্মৃত শিহাবের দৃশ্যমান দশ দিক সহ অদৃশ্য সকল দিকগুলি মুহুর্তে বন্ধ হয়। একটি দিকই নিজেকে প্রকাশ করে সেদিকে শিহাবকে গিলে নেয়। ওটা পারুর দিক। শিহাবের পারু!

‘ওহ পারু! প্রিয়দর্শিনী আমার।’ ভাবতেই পারু প্রিয় বইকে আলতো করে পাশে রেখে দেয়। চোখ তুলে তাকায়। নিরবে জ্বলে ওঠে। চোখের তারায় ভালোবাসা। শিহাব ডুব দেয়।।

#পারুর_রুপার_কৌটো_মামুনের_অণুগল্প_৫০৬

ও কেন এত সুন্দরী হলো // অণুগল্প ৪৯৬

একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর করে বাবা-মার সাথে ছিলাম। দেশের অন্যতম এক সমৃদ্ধ বিভাগীয় শহরে। পরিপূর্ণ জীবন আমলা বাবার নিয়ন্ত্রণে বেশ আনন্দময়। ইচ্ছেঘুড়ির নাটাই বাবার হাতে থাকলেও যথেচ্ছা উড়াবার স্বাধীনতা ছিল আমার। উড়াচ্ছিলাম। বাউরি বাতাসে নিজেও ভেসে যাচ্ছিলাম।

এ অবস্থায় বর্ডার সংলগ্ন একটি স্কুল ও কলেজের দায়িত্ব চাপলো আমার ঘাড়ে। দায়িত্ব নিলাম। সুন্দরভাবে পালন করলাম। উপভোগও করলাম সেই সময়টুকু।

পরিবারের বড় ছেলে। লেখাপড়া শেষ। সুন্দর চাকরি। বিয়ের জন্য আদর্শ বয়স। বাবা-মা বিয়ের জন্য অত্যন্ত তৎপর। বাবা সরকারি চাকুরীজীবি হবার কারণে, আমাদের বেড়ে ওঠা এবং মেলামেশা ছিল বাবার কলিগ পরিবারগুলোর সাথেই। সবার ভিতরে থেকেও, এই বিশেষ সার্কেলটি ছিল ক্ষমতার দম্ভে পরিপূর্ণ প্রাচুর্যের অধিকারী এক আলাদা শ্রেণি। যেখানে অন্য শ্রেণির সাথে শ্রেণি সংঘাত ওভাবে না থাকলেও এক আলাদা সমীহ জাগানিয়া অনুভবে তাড়িত হত অন্যরা।

যাইহোক, মা-বাবা থেকে আলাদা আরেক শহরে চাকুরির কল্যাণে নির্বাসিত একাকি জীবন কাটাই সপ্তাহের ছয় দিন। আর আর্কের টুলুর গান শুনি, ‘এই একেলা জীবন, ভালো লাগে না আমার…’। নিজের ভিতরেও একজন প্রিয়দর্শিনীর অভাব অনুভব করছিলাম।

একদিন মায়ের ফোন। তখন গ্রামীন ফোনের পোষ্ট পেইড যুগ। আমার বর্ডার সংলগ্ন কলেজের আবাসিক ভবনে আ্যান্টেনা দিয়ে কোনমতে নেটওয়ার্ক পাই। মা আমাকে শহরের বাসায় চলে আসতে বললেন। খুবই নাকি ‘আর্জেন্ট’।

বাসায় পৌঁছাতেই আমাকে বলা হলো, ‘আমরা মেয়ে পছন্দ করেছি, আজ অমুক আংকেলের বাসায় তোমাকে দেখবেন মেয়ে পক্ষ।’ আমাকে শ্রেফ জানানো হলো। এক মুহুর্তে নিজেকে কোরবানির পশুর মত মনে হলো। একটু গাইগুঁই করার চেষ্টা করলেও লাভ হলো না। বাবার সামনে ‘না’ বলার মত সক্ষমতা তখনও অর্জন করিনি।

খুব কাছের ক’জন বন্ধু ছিল আমার। মনের কষ্টটা ওদেরকে শেয়ার করতে চাইলাম। আমাদের আবাসিক এলাকা থেকে একটু দূরে অন্য আরেক এলাকায় থাকতো তারা। এটাও এক সরকারি কলোনি। বাবার কলিগদের বাসস্থান।

এক ভরা দুপুরে গেলাম ওদের কাছে। সিগ্রেটের ধোঁয়ায় নিজেদেরকে ঝাঁপসা করে দিয়ে আমার টেনশনের কথাটা উপস্থাপন করলাম। বাবা মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছেন। এখন মেয়েপক্ষ আমাকে পছন্দ করলেই গেছি।

বন্ধুরা আমাকে টিপ্পনি কাটার পাশাপাশি হইহই করে আমাকে নিয়ে পড়লো। আমার অবস্থা কেন জানি ওদের আনন্দের খোরাক হলো। হয়ত এমনই হয় বন্ধুর বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে।

আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম ডি-টাইপের বিল্ডিং এর সামনের এক চিলতে সবুজের ওপর বসে। এল-টাইপের পিচের রাস্তা মাঠটাকে আবাসিক ভবনগুলির থেকে আলাদা করেছে। ফাগুনের পাতা ঝরার দিন। রাস্তার দু’পাশের প্রাচীন বৃক্ষগুলি এলোমেলো বাতাসে নিরবচ্ছিন্ন পাতা ঝরিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় তাকে দেখলাম!

ছেলেবেলা থেকেই সুন্দরের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ। নারীর সুন্দর মুখশ্রী এবং রঙ তাদের ফিগারকে উহ্য রেখেই আমার অনুভবে দোলা দিয়ে যেত। ‘দুধে আলতা গাত্রবর্ণ ‘ কিংবা টোকা দিলে যেসব নারীর শরীরে রক্ত জমে যায়, এমন লাল-সাদা বর্ণ আমার ভিতরে আলাদা আবেদন জাগাতো (আমাকে বর্ণবিদ্বেষী ভাবাটাও কিন্তু ভুল হবে)। আমার ভিতরের ভালোলাগাটা ওভাবেই প্রকৃতিগতভাবেই জন্মেছে, সেখানে আমার দায় কোথায়?

ডি-টাইপের এক তলা থেকে যখন সে বের হলো, প্রথম দর্শণেই আমার ভিতরের আমি নিজেকে জানালাম, ‘আমার পাঁজরের হাড় থেকেই একে বানানো হয়েছে! এ ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অসম্পূর্ন।’

পিচের রাস্তা দিয়ে গ্রীবা উঁচু করে উদ্ধত এবং নমনীয়’র মাঝামাঝি এক ভংগীতে সে হেঁটে যাচ্ছিলো। রাস্তার অপর পাশ দিয়ে আমাদের পাশ কাটানোর সময় সে আমাদের দিকে ফিরে তাকালো। ওর দৃষ্টিতে কি ছিল জানি না, আমি লুটপাট হয়ে গেলাম!

আমার ভিতরে কোথায় যেন বেজে চলছিল, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো’!

বাবার পছন্দের মেয়েকে দেখতে যেতে হবে, সে কেমন হবে, আমার তাকে কতটুকু ভালো লাগবে, তাদের আমাকে পছন্দ হবে কিনা ইত্যকার ভাবনা-চিন্তায় বিব্রত মন আমার। মনের আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে। ঝড় না উঠেও বাতাসটাতে ঘোর লেগেছে। ঠিক এমন এলোমেলো সময়ে আঁচল উড়িয়ে সে খোলা চুলে আমার সামনে এলো! আমি মুগ্ধ হলাম। ভালোলাগা ভালোবাসার আগুনে পুড়ে প্রেমে পরিণত হলো!

আমার ভাবনার চোয়াল শক্ত হতে থাকলো। জীবনে এই প্রথম ‘পছন্দের মেয়ে দেখা’ বিষয়ে বাবাকে ‘না’ বলার মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।

সেদিন। আসরের নামাজের পর। আমাদের পুরা পরিবার সেই ‘অমুক’ আংকেল’ এর বাসায়। বাবাকে না বলা হয়নি আমার। যেতেই হলো।

বসার ঘর। ভাইদের সহ বাবা-মা ভিতরে সবে আসন গ্রহন করেছেন। দরজার মুখে দাঁড়ানো আমি। নিজেকে নিয়ে প্রবেশ করব। ভিতরে একবার অলস দৃষ্টি বোলালাম। আবারও মুগ্ধতা!

তবে এবার আমি অবাক হলাম! দুপুরের বাউরি বাতাসে আমাকে লুটপাট করা হেঁটে যাওয়া এলোকেশী সেই মেয়েটি মাথায় সবুজ একটি ব্যান্ড পরে বসে আছে। আমাদের চার চোখের মিলন হলো ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’!

মুহুর্তে প্রাণে আমার মন জেগে ওঠে। এতদিনের পরিচিত পৃথিবীটা একটুখানি বদলে যায় ‘ওকে’ অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎ সামনে পেয়ে। অপুর হৈমন্তিকে ‘পাবার’ মত আমিও ‘পাইলাম’ অনুভবে তাড়িত হলাম!

এরপর.. অনেকগুলি বসন্ত কেটে গেলো পাওয়া-না পাওয়ার গোলকধাঁধার ধোঁয়াশা ভূবনে। তবে ভালোবাসা আর প্রেম আমাদের ছেড়ে যায়নি কখনো। আমরা মানে আমি আর আমার লাল বউ, জীবনের প্রতিটি কঠিন সময়ে, শ্রেফ ভালোবাসায় মেখে মেখে- হৃদয়ের এপিঠ ওপিঠ তন্নতন্ন করে সুখ খুঁজেছি। কখনও হতাশ হইনি। সে আমাকে আগলে রেখেছে। মায়ায়, ভালোলাগায় আর মুগ্ধতায় যে নিরন্তর প্রেমময় আবহ তৈরী করে রেখেছে সে, যার বাইরে আমার কখনোই যাবার প্রয়োজন পড়েনি। অচল আমার থেকে সকলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সে আমাকে আরো কাছে টেনে ওর বুকে ছোট্ট চড়ুই বাবুর মত আগলিয়েছে।

এখনো সে আমার ভালোলাগার প্রথম প্রহর! এখনও শীতের নরম রোদের মত মায়াবী কোমল! সে উষ্ণতায় চোখ মুদে যাওয়া এক শীতের সকালে রোদ আর সাদা মেঘের ভিতরের মৃদু খুনসুটি। এরকম আরও অনেক অনেক বহু অনেক কিছুই সে!

‘ওকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ ‘- হাসপাতালটির সামনে বাস থেকে নামার সময় ভাবে শিহাব। ভাবনার ভ্রান্তিবিলাসে ধীর পায়ে এলোমেলো শিহাব কখন যে বিশেষায়িত এই হাসপাতালের দেড় তলার ‘টেস্ট রিপোর্ট ‘ নেবার কিউতে দাঁড়িয়েছে.. ধীরে ধীরে পেছন থেকে কিউতে সবার সামনে এসেছে, বলতে পারবে না। সময় ছিল স্থির.. মনের ভিতর ঝড় উঠেছে। গভীর সমুদ্রে ডুবে যাবার প্রচন্ড ‘সাইনাস পেইন’ অনুভবের প্রখর সীমায়। কিন্তু খড় কুটো ধরে ভেসে থাকার মত কিছুই নেই। অন্য সব কিছুর মত শিহাবের লাল বউই ওর জন্য আঁকড়ে ধরার একমাত্র খড় কুটো। সে-ই ডুবে যাচ্ছে, কাকে আঁকড়ে ধরবে শিহাব?

বায়োপ্সি রিপোর্ট হাতে ভাংগাচুরা একজন শিহাব হৃদয়ের গভীরতম জায়গা থেকে নিজের ইশ্বরের কাছে মিনতি জানায়, ‘ওকে ছাড়া আমি একমুহুর্তও থাকতে পারব না, আমাকে একা করো না!’

এক বিশেষায়িত হাসপাতালের দেড় তলা একটি কক্ষে ইশ্বর নিজের আলো এবং আঁধার দিয়ে একজন শিহাবকে জড়িয়ে রাখে। বাইরে সুর্য ডুবন্ত প্রায়। চলে আলো-আঁধারের মাঝে নিরন্তর দখল নেবার অন্তহীন খেলা।।

অন্যের হয়ে গেলে খুব সহজেই : অণুগল্প-৪৩৩


অফিসার্স ক্লাবটির পশ্চিম পাশে লন টেনিস খেলার গ্রাউন্ডটি পুরোটা নেট দিয়ে ঘেরা। নেটের ওপাশে গাছপালা কেমন জঙ্গলের মত হয়ে আছে। বেশীরভাগই কাঁঠাল গাছ। লন টেনিস মাঠ আর জঙ্গলটির মাঝ দিয়ে পায়ে চলা পথটি কিছুদূর গিয়ে ডানে বেঁকে গেছে। এরপর সোজা হয়ে বিরাট দীঘিটার পাশ দিয়ে পুরনো কলা ভবনের দিকে গিয়ে অন্য পথগুলোর সাথে মিশেছে।
.
আমাদেরকে অত দূর পর্যন্ত যেতে হবে না। সোজা পথটির মাঝামাঝি দীঘির পার ঘেসে শান বাঁধানো লম্বা এক সিমেন্টের বেদী। দর্শনার্থীদের বসার জন্য। ঠিক এর বিপরীতে কদম গাছটি। নিঃসঙ্গ থাকে সারা বছর। এর গোঁড়ায় রাতের বেলায় গঞ্জিকা সেবীদের আড্ডা বসে। তবে কদম গাছটির এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। এরা সবাই নেশায় বুঁদ হয়ে বিভিন্ন আলোচনা করে। রাজনীতির আলাপ… সমাজ পরিবর্তনের বড় বড় বুলি আওড়ানো আর নিজেদের ভিতরে ইচ্ছাকৃত খুনসুটি। হেঁড়ে গলায় কয়েকজন গান ধরে… ভরাট গলায় কোঁকড়া চুলের সুন্দর ছেলেটি যখন কবিতা আবৃত্তি শুরু করে, কদম গাছটির নিজেকে তখন ওদেরই মাঝে বসে থাকা একজন মনে হয়। এই গঞ্জিকাসেবীদের জন্যই ওর নিঃসঙ্গতা তেমন অনুভুত হয় না।
.
মেয়েটি একা একা সেই সিমেন্টের বেদীতে এসে বসে। কদম ফুলে গাছটি ছেয়ে আছে। খুব সুন্দর লাগছে! সবুজ পাতার সাথে হলুদ গোল বৃত্তগুলো সাদা রেণুতে ভর্তি। মনটা আপনিতেই ভালো হয়ে গেলো।কদম ফুল দেখে নয়। একজন ওর কাছে কদম চেয়েছিল! সেটা মনে পড়াতে। বুকের গভীরে আনন্দের একটা স্রোত বয়ে যায়। শরীরের স্নায়ুগুলো উত্তেজিত হয়ে ওঠে। দুটি কান এতোক্ষণে নিশ্চয়ই লাল হয়ে গেছে তাঁর!
.
ছোট ছোট কয়েকটি ছেলে দীঘির অল্প পানিতে জলকেলি করছে। ওদের একজনের হাতে রেণুহীন দু’টি কদম ফুল দেখতে পেলো। নিশ্চয়ই ওরা এই গাছ থেকে পেড়েছে। ওদের ভিতর অপেক্ষাকৃত বড় ছেলেটিকে ডেকে গাছ থেকে ওর জন্য দু’টি কদম ফুল ছিড়ে দিতে বলে। ছেলেটি একটু ইতস্তত করতেই পার্স থেকে টাকা বের করে দিতেই রাজী হয়। মেয়েটির চোখের সামনেই তরতর করে গাছে উঠে। অনেকগুলো কদম ফুল ডালসহ নিয়ে আসে। মেয়েটি মাত্র দুটি কদম রেখে বাকীগুলো ছেলেটিকে দিয়ে দেয়। ওরা পানিতে বসে সেগুলোর রেণু ছেড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে আবার।
.
বৃষ্টির ভিতর দিয়ে হাতে দু’টি কদম ফুল নিয়ে মেয়েটি একা একা লম্বা একটি পথ ধরে এক নির্দিষ্ট জায়গার উদ্দেশ্যে হেঁটে যায়। বৃষ্টি ওকে আপাদমস্তক ভিজিয়ে ওর সারা শরীরকে কাপড়ের সাথে লেপ্টে দিয়েছে। ঠান্ডায় হুহু করে কাঁপলেও ভিতরের অন্য এক উত্তেজনায় সে শীত অনুভব করে না। এরকম বৃষ্টি ভেজা হয়ে শরীরের লেপ্টানো বাঁকগুলোকে নিয়ে একজনের কাছে যাবে সে… হাতে থাকবে বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল! একজনকে কথা দিয়েছিল। আজ সে অপেক্ষা করবে ওর জন্য। সেদিকেই যাচ্ছে এখন।
.
নির্দিষ্ট জায়গার সেই যাত্রী ছাউনিতে গিয়ে যার কাছে সে এসেছে তাঁকে সামনে দেখেও চিনতে পারে না মেয়েটি। প্রচন্ড বৃষ্টি… ছাউনিতে দু’জন। মেয়েটি বাইরে… ওর যেখানে থাকার কথা সেখানে অন্য এক অচেনা মেয়ে! পরিচিত ছেলেটি ভীষণ অপরিচিত হয়ে সেই মেয়েটির খুব কাছে… দু’জনের নাকে নাক ছুঁয়ে আছে। আশপাশের কোনো কিছুই ছাউনির যুবক-যুবতীকে ওদের এই মোহাবিষ্ট অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। এমনই মগ্ন তারা।
.
মেয়েটি কদম দুটি পথের ওপর রেখে নিঃশব্দে ফিরে যায়। সে যে এসেছিল ওগুলো তারই প্রমাণ।
.
বিষন্ন হাসে মেয়েটি। এখন আর প্রমাণে কিছু যায় আসে না। বৃষ্টি ওর চোখের জল ধুয়ে দেয়। কিন্তু হৃদয়ের কান্না? আরো বেগে ঝাপিয়ে পড়ে জলধারা ওর ওপর। ওর সিক্ত বসনকে একেবারে পিষে ফেলতে চায়… পুরনো পথ ধরে ফিরে যেতে যেতে মেয়েটি ভাবে, বৃষ্টি তবুও তো ওকে ছুঁয়ে দিয়েছে… জোর করে প্রেষণ করছে… দলিত মথিত করছে! কিন্তু যার এগুলো করার কথা ছিল, সে কি করছে?
.
বৃষ্টি ভেজা এক নির্জন রাস্তায় হৃদয়ে ভাবাবেগের পাগলা দিনের বাদল হাওয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ করা অনুভুতি নিয়ে একটি মেয়ে হেঁটে চলে।।

হারানো সুর : অণুগল্প-৪৩২


ডান চিবুকের নিচে একটি কালো তিল। ভালবাসার একজন মানুষ। আর ক্লান্ত কুহকী প্রহর- এই তিনের মিশেলে এক চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে মিলি। সামনে আঁধার। পর্দার ওপারে দৃশ্যমান আলো কেবল অনুভবে জ্বলে উঠে।
.

বারান্দায় শাহেদ। বিছানা থেকে ওর আর শাহেদের মাঝে কেবলই একটি কাঁচের পার্টিশন…দূরত্ব ?

থাই গ্লাসের ভিতর দিয়ে ওপাশের মানুষটিকে দেখা যায়। আবছা… পরিচিত অবয়ব ও কখনো কখনো অপরিচিত ঠেকে। আলোছায়ার কারসাজি?
.

শাহেদকেও কি তেমন লাগছে মিলির? নির্দিষ্ট এক ছন্দে ডানহাত ওঠানামা করছে। মানুষটি আবার সিগ্রেট ধরেছে। জীবনের কোথাও কি ছন্দপতন ঘটল?
.

একটু অবাক হয় মিলি। বাহ!
মধ্যরাতের ঘোরলাগা এক যুবতী অনুভব করে, কাছের মানুষকে একটু দূরে সরিয়ে দেখার চেষ্টা করলে, আসল মানুষটিকে চেনা যায়।
কাছে থাকার সময়ে এতোটাই কাছে-দুরে অনুভূতিতে বিভোর থাকে যে, নিজেদের একে অপরকে জানার বা দেখার সুযোগ সেভাবে হয় না।
.

স্থানিক দূরত্ত তবে কি মনের নৈকট্য এনে দেয়? মানুষের মন! মনের কখনো দূরত্ব হয়না।
.

বারান্দার আলোআঁধারি পরিবেশে শাহেদকে কেমন দীর্ঘ দেখায়। প্রতিটি মানুষই তার মনের মত বিশাল। এই বিশালতা ধরা পড়ে তার ছায়ায়। আলোর হৃদয়ের অধিকারীদেরকে দেখতে কি শেষ পর্যন্ত আঁধারের প্রয়োজন হয়?
.

এক হৃদয়বান পুরুষ এই এতোগুলো বছরে ক’বার তার হৃদয়বতীর হৃদয়ের খোঁজ নিয়েছে? মিলি ভাবে। সময় কত নিষ্ঠুর! কুহকী প্রহরগুলো কেন এত প্রলম্বিত? সবসময়ে পিছনের জীবনকেই কেন এতো মধুর লাগে! কি ছিল সেই জীবনে?
.

বিছানায় উঠে বসে যুবতী। মৃদু হাসে। চোখের কোণে কি ওর কষ্টরা ভাসে! সেই জীবনে একটি কালো তিলের জন্য এক হৃদয়বান পুরুষ অপেক্ষার প্রহর গুনতো অবলীলায়। কত কবিতা, উপমা, শব্দ – ভাষা! বিবাগী মনের আবেগী যাতনা। তখন হাসলে মিলির গালে টোল পড়ত। শাহেদের মুগ্ধতা আর দৃষ্টির খরতায় ফালাফালা হত মিলি। ভালো লাগত।
.

হাসলে এখনো মিলির গালের টোল পড়ে… চিবুকের তিলটি এখনো একই জায়গায়; কিন্তু মুগ্ধ দৃষ্টির খরতায় ফালাফালা করে দেয়, সেই চোখ দুটি আজ কেমন নিস্প্রভ! সময় অনুভূতিগুলোকে কেড়ে না নিলেও, অনুভূতিহীন করে রেখে গেছে।
.

এক অন্ধবধু তার হৃদয়বান পুরুষটিকে শুধু একবার পুর্ণভাবে দেখতে চায়! এক মধ্যরাতের নিশ্চুপ শহরে জেগে থাকা এক যুবতী ভাবে, ‘এ জীবনে বুঝি ওকে আর পাওয়া হল না’ …
.

তিলোত্তমা নগরীর কোষে কোষে এক একজন মিলির দীর্ঘশ্বাস। বয়ে চলে… হৃদয় গভীরে। তাদের হৃদয়বান পুরুষদেরকে আগের অবস্থায় ফিরে পেতে তাদের এই ব্যাকুলতা ইটপাথরের নগরজীবনের দেয়ালে দেয়ালে গুমরে মরে। মিলির জীবন যে মানুষটিকে ঘিরে, সে এখন এমন কেন? মিলি কি কখনো ভাবার চেষ্টা করেছে?
.

শাহেদের কাছে নিরব মিলি…মিলির পাশে নিরব শাহেদ… দৃশ্যমান একটি কালো তিল… হারানো মুগ্ধতা… লুক্কায়িত নিস্প্রভ দৃষ্টি!
.

সবই যখন আছে, মিলি কি আর একবার চেষ্টা করবে?

ফিরে এসো এই অন্তরে : অণুগল্প-৪৩২

এক শ্রাবণ মেঘের প্রচণ্ড ঘনঘটার দিন। প্রথম দেখেছিলেম তাঁরে। প্রথম দেখায়-ই সে হয়ে গেলো আমার হৃদয়ের আরাধ্য কাছের মানুষটি! এরপর আরো একটি ঘোর ঘন বরষায় ভিজে ভিজে একমাত্র কাছের মানুষে পরিণত করলাম তাঁকে!
.

কেউ কি জানো, কাউকে কাছের মানুষে পরিণত করতে কতটা সাধনা করতে হয়? কতটা অশ্রু ঝরালে তবে ভালবাসার নদী বয়ে যায়? আমার নদীটার ছিল কেবলই এক পাড়। সেখানে কেবলি ভাললাগায় ছুটে চলা.. অন্তবীহীন পথ ধরে.. প্রণয়ের উল্লাসে ফেটে পড়া.. আর প্রেয়সীর ভালবাসার নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায় ছুঁয়ে নুয়ে পড়ে মোহনার পানে ধাওয়া।
.

আমি মোহনার কাছাকাছি এসেই আমার গতি হারালাম। আমার জন্মের পূর্বের অভিশাপ ফারাক্কা হয়ে আমার প্রবাহ নিস্তেজ করে দিলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ডুবো চরের ভিতর থেকে আমার নদীটির অপর পাড়ের জেগে ওঠা। সে পাড়ে কেবলি নিরাশা, বিরহ আর কষ্টের তীব্র ফল্গুধারা! আর প্রিয় মানুষটির চলে যাবার অপেক্ষায় অপেক্ষমান এক সর্বনাশা পথ।
.

শরতের এক দিনে, বিষণ্ন বদনে সে আমায় ছেড়ে চলে গেলো সেই পথটি ধরে। আমায় জানালো না। নয় কোনো বিদায় সম্ভাষণ; কিংবা পলকের তরে ছুঁয়ে দিয়ে বলা, ‘আসি’। ‘যাই’ বললে ও মেনে নিতে কষ্ট হতো না আমার। কিন্তু সে নিরবেই চলে গেলো। কিছুই বললো না আমায়।
.

তোমরা কেউ কি কাউকে নীরবে চলে যেতে দেখেছ কখনো?
আমি দেখেছি। তাই বুঝি, কারোর নীরবে চলে যাওয়াটা- পথের মাঝে একা দাঁড়িয়ে থেকে দেখাটায় কতটা যন্ত্রণা। নিরব যন্ত্রণা সেই থেকে কুরে কুরে খেয়েছে আমায়।
.

তারপর ও নির্লজ্জের মত খুঁজেছি তাঁকে। তোমরা হলে কি করতে? খুঁজতে যেতে না? আমি প্রেমিক থেকে বিরহী, শেষে বেহায়া ও হলাম তাঁর জন্য। যদি তাঁর মন ফিরে! আমায় দেখে যদি একটু ফিরে তাকায়! মনকে এভাবে প্রবোধ দিয়ে চলেছি গত দু’টি মাস।
.

আজ হেমন্তের প্রথম প্রহর! খুঁজে খুঁজে তাঁকে পেলাম সেই মোহনার তীরে। যেখানে হারিয়েছিলাম আমার ভালবাসার প্রবল স্রোত। সে মেঘবতী কন্যা হয়ে সমুদ্রের তীর ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ছিল। পিছন থেকে দেখছি তার এলোচুলের গোছা- বাতাসে উড়ছে! তাঁর কানের পাশে গন্ধরাজ গোঁজা। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সব হারানোর অশ্রুধারা আমার দু’চোখ বেয়ে বয়ে বয়ে আমার শীর্ণ নদীটায় আবারো স্রোতের সৃষ্টি করল! তাঁর চুল পেছন থেকে বাতাসের দোলায় আমার চিবুক ছুঁয়ে দিয়ে গেলো! আমি দীর্ঘক্ষণ সেই ছুঁয়ে যাওয়া জায়গাটি আমার এক হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখলাম। যেন নদীর সেই নিষ্ঠুর পাড়টিতে জেগে উঠা পথ ধরে, এই পরশটুকুও মিইয়ে না যায়।
.

নিরবতার ও বিশেষ কোনো সুর থাকে। থাকে মধুর ব্যঞ্জনা। বাতাসের প্রবল শব্দের ভিতর দিয়েও আমি তাঁর হৃদয়ের ব্যকুল ধ্বনি শুনতে পেলাম। সে ফিরছে না আমার পানে। আমি কি ডাকব তাঁকে? সে কি ফিরবে?
.

দীর্ঘক্ষণ আমি তাঁর ছায়ার পিছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিষ্প্রাণ পাথরের ভাস্কর্যের মত! সে পিছু ফিরল না। কিছুদূর সামনে এগিয়ে গেলো। এরপর ডানে মোড় নিয়ে তটরেখা ধরে হেঁটে চলল। সাগরের ঢেউ তীরে এসে ফেনা হয়ে যায়। এরপর কিছু ফিরতি টানে সাগরে হারায়। বাকিটুকু ক্রমশঃ মিলায়.. শূন্যে। সে ও তটরেখা ধরে হেঁটে হেঁটে একসময় শূন্যে মিলিয়ে গেলো!
.

আসলেই কি? কেউ শূন্যে মিলায়? আজও আমি সেখানে দাঁড়িয়ে। তাঁর আসার অপেক্ষায়। যদি সে কখনো এসে ফিরে যায়!
.

‘যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর
ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্খার ঘর!’
-বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।*

#ফিরে_এসো_এই_অন্তরে_অণুগল্প_৪৩২

* বলিল অশ্বথ সেই- জীবনানন্দ দাশ

চোর : মামুনের অণুগল্প-৪৩১

প্রতিদিনের মতো অফিস ফেরত একজন বাবার ভূমিকায় শিহাব। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসে নিজের বেডরুমে। কণা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে গেছে। স্বাভাবিক নি:শ্বাস পতনের শব্দ এবং কিছু অঙ্গের উত্থানপতনে বুঝা যায় সে গভীর ঘুমে।
.

ঘুমের ভান নয়।
ভান শব্দটা এজন্যই শিহাবের মনে এসেছিলো রুমে প্রবেশের মুখে। কণা প্রায়ই এমন দুষ্টুমি করে ওদের ছোট বাবুটাকে সাথে নিয়ে। হঠাত করে নৈশব্দের নিঝুম নিমগ্ন ক্ষণে, একাকী বিচরণরত শিহাবকে চমকে দেয় কণা। কখনো ছোট বাবুটা। এভাবেই চলে নাগরিক জীবনে বেমানান কিছু বাবাদের সংসার সংসার খেলার মাঝে, কিছুটা আনন্দঘণ মুহুর্ত! কাছের মানুষদের থেকে পাওয়া। রিফ্রেশমেন্ট?
কণা ইচ্ছাকৃত করে?

.
সম্পর্কগুলি নিত্য নতুন টানাপোড়ণে ভোগে। দগ্ধ হয়। ক্ষয় হয়। তাই অনবরত এর পরিচর্যা প্রয়োজন হয়। কণা বুঝে? তাই সহজ করতে এমন করে? বিবাহিত জীবনের কুড়ি বছর পার করে এসে ও কি সেই প্রথম দিকের অনুভবকে জাগিয়ে তুলতে চায়?
.

শিহাব কি বুঝে?
কখনো কি নিজে কণার মতো সম্পর্কগুলির ক্ষতের মলম হতে চেয়েছে? সম্পর্কের মাঝের ক্ষয় রোধে তুমি নিজে কি ভূমিকা নিয়েছো? আদৌ নিয়েছো কি?
.

নিজের কাছ থেকে এমন প্রশ্নে বিব্রত শিহাব হাসে। নি:শব্দে। এটা নিজের মনে হাসা। ইদানিং এভাবেই হাসে অনেকে। নিজের থেকে লুকোতেই অনেক বাবারা ও এমন করেন।
.

ছোট্ট বাবুটা ঘুমন্ত মায়ের পাশে বসে হোমওয়ার্ক করছে। শিহাব নিরবে পাশে বসে। একটু দেখে। এটা মেয়ে বাবু। তবে পুরোদস্তুর ছেলেদের পোশাক পরে আছে। কান টুপি ও পরেছে একটা। দুষ্ট এক ছেলের পোশাকে দুষ্টু মেয়েটি স্কুলের কাজে মগ্ন। তার ভিতরেও বাবার পাশে বসাটা অনুভব করে। সে ও বাবার দিকে না তাকিয়ে নিজের মনে হাসে। ওর হাসি নিজের থেকে নিজেকে লুকোতে নয়। নিজেকে জাহির করতে। বাবার অনুপ্রবেশ তার ব্যস্ততার ভিতরেও অনুভবের নোটিফিকেশন এক্সিকিউট হয়েছে, ধরা দিয়েছে ঐ নিরব হাসির দ্বারা।
.

শিহাব মোবাইলে পাওয়ার ব্যাংকের সংযোগ দিতে দিতে স্বগতোক্তি করে,
– তরকারি চুরি করে খেয়ে এলাম।
বাবুটা এবার বাবার দিকে তাকায়। হাত কাজ করে চলে। ইরেজার দিয়ে পেন্সিলের লেখা মুছছে। সে প্রশ্ন করে,
– তুমি তো এমনিতেই খেতে পারো। চুরি করা লাগে কেনো?
.

মোবাইলে চোখ, কী’র উপর আংগুল, শিহাব প্রশ্নের উত্তর দেয়,
– আমার চুরি করে খেতেই ভালো লাগে। আমার ভিতরের চোরটা এই কাজ করে।
.

পাশের রুমে বড় কন্যাকে হাউস টিউটর পড়াচ্ছে। ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ছোট বাবুটা হেসে হেসে অল্প আওয়াজে বাবাকে বলে,
– আস্তে বলো পাপা, স্যার শুনবে।
– শুনুক। সবার ভিতরেই একটা করে চোর থাকে।
– সবার ভিতরে? স্যারের ভিতরে কি ও চোর আছে?
.

ছোট বাবুটার প্রশ্নের উত্তরে শিহাব একটু থামে। ভাবে? শেষে উত্তর দেয়,
– হ্যা। আছে।
– সে কি চুরি করে?
– ধরো, সে নিজের পাপাকে ফোন করে বললো যে বই কিনতে হবে, হাজার খানিক টাকা পাঠাও। তার বাবা টাকা পাঠিয়ে দিবে। সে আড়াইশো টাকা বইয়ের পিছনে খরচ করলে বাকী সাড়ে সাতশো’ টাকা বন্ধুদের কে নিয়ে বিড়ি ফুঁকে শেষ করবে। এটা তার ভিতরের চোরটা করে।
– এটা তো স্যারের বাবাকে মিথ্যে বলা হলো, তাই না পাপা? এই চোরটা তোমার চোরের চেয়েও খারাপ।
– হ্যা বাবা।
.

বাবুটার পরবর্তী প্রশ্নে শিহাব বিব্রত হয়,
– পাপা, তুমি কি কখনো দাদা ভাইয়ের সাথে এমন করেছো?
.

কি উত্তর দেবে ভাবতে সময় নেয় শিহাব। তবে বাবুটাই ওকে উদ্ধার করে। সে হোমওয়ার্ক করা অবস্থায় লজ্জিত হেসে বলে,
– আমার ভিতরেও একটা চোর আছে পাপা! :)
– হ্যা আছে। :) তোমার চোরটা কি করে?
– আমার চোরটা অনেক কিছু করে। তুমি ঘুমিয়ে গেলে তোমার মোবাইল দিয়ে গেমস ডাউনলোড করে। আপুর ভিতরের চোরটা ও আম্মুর মোবাইল দিয়ে ফেসবুকে ঢুকে ঘুরে ফিরে আবার তার একাউন্ট ডি-এক্টিভেট করে রাখে। ও মাই গড! আমি তো অনেকের ভিতরের চোরকে দেখতে পাচ্ছি পাপা! জান্নাতি, আমেনা, মিতু- ওদের ভিতরের চোরগুলি ক্লাসে কি করে আমি এখন জানি পাপা :)
.

শিহাব ছোট বাবুটার উচ্ছ্বাসিত অনুভবে ধীরে ধীরে ভালোলাগায় কোমল হতে থাকে। সময় বয়ে চলে। নিরুদ্বেগ সময়। আবারো প্রশ্ন বাবুটার,
– পাপা, সব চেয়ে বড় চোর কাদের ভিতরে থাকে?
.

উত্তর দিতে গিয়ে থামতে হয়। বাবাদের কখনো কখনো ভেবে চিন্তেও উত্তর দিতে হয়। শিহাবও দেয়,
– যারা একসাথে অনেক মানুষকে মিথ্যে বলে, কথা দিয়ে কথা রাখে না, তাদের ভিতরের চোরগুলি সবচেয়ে বড়।
– তারা কারা? আমি কি চিনি তাদের?
.

ছোট্ট বাবুটার মাথার চুল নেড়ে আদর করে শিহাব। মুখে বলে,
– আরেকটু বড় হলে তুমি নিজেই তাদেরকে চিনে নেবে। এটা মনে করো তোমার একটা এসাইনমেন্ট।
.

শিহাবের মন তখন নিরবে ভাবে, ওর বসবাসের ভূ-খন্ডে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে, নির্দিষ্ট কিছু মানুষ, একসাথে অনেক মানুষকে মিথ্যে বলে ক্ষমতায় যায়, সময় হলে কথা দিয়ে কথা রাখে না। এখন এটা একটা ‘ট্রেন্ডে’ পরিণত হয়েছে। এই নির্দিষ্ট মানুষগুলিকে ‘রাণী মৌমাছি’র মতো ঘিরে আমজনতার প্রদক্ষিণ এই ‘ট্রেন্ড’কে ‘সিস্টেমে’ পরিণত করেছে।
.

সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে নিত্য নতুন বড় চোরেরা শূণ্য জায়গাগুলি দ্রুত দখল করে নিচ্ছে ভেবে ব্যথিত হন একজন বাবা। উত্তরপুরুষের জন্য এমন চোরসমৃদ্ধ একটি ভূ-খন্ড রেখে যেতে হচ্ছে!
.

আচ্ছা, সিস্টেমটাকে পাল্টানো যায় না? শুরুর শুরুটা তো অন্ততো করে যাই?

কয়েকজন সাদা মানুষ : অণুগল্প-৪৩০

‘বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?
এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি,
আমরা সবাই যে যার প্রহরী
উঠুক ডাক।’*
.

চারিদিকে অবক্ষয়… নৈতিকতার চরম পদস্খলন! পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র কে ঘিরে রয়েছে অমানিশার কালোমেঘ। রক্ষক ভক্ষকের রূপে… দূর্নীতি আর দুঃশাসনে জনজীবন অতিষ্ট। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের উত্তরাধিকারের ‘সিস্টেমেটিক’ মুলো ঝোলানো সরল-গরল কথোপকথনের ‘কারিসমায়’ ‘হিপনোটাইজড’ দেশের মানুষ। গুম-খুন আর কালোবাজারীদের পরিকল্পিত সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় আত্মসমর্পন।
.

মাদকের মরণ ছোবলে যুবসমাজ… অসহায় বাবা-মায়ের গুমরে গুমরে কান্না আর কতদিন? ঘরে-বাইরে কোথায় নিরাপত্তা? প্রতিক্রিয়াশীল, বাম-ডান আর উদারপন্থীদের ঝাঁঝালো মিছিলে আমার সন্তানের বিক্রী হওয়া আর কতদিন? অতঃপর বোমায় উড়ে যাওয়া প্রতিহিংসার লাল ছোবলে বিধ্বস্ত- ছিন্ন ভিন্ন দেহের ঘরে ফেরা।
.

জননী-জন্মভুমিকে খুবলে খাচ্ছে অপশক্তি।
কি রেখে যাচ্ছি আমরা পরবর্তি প্রজন্মের কাছে?
কিছু একটা করনীয় কি নেই আমাদের?
.

‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পীঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব-তবু আজ যতক্ষন দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’*
.

কালো মানুষদের ভীড়ে কালো রাজপথ ধরে কয়েকজন সাদা মানুষের আগমনের অপেক্ষায় রয়েছি… নবজাতকের কাছে আমাদের অঙ্গীকারকে ‘এক্সিকিউট’ করায় ‘ওরা’ সাহায্য করবে… পথ দেখাবে।
.
আমি তো প্রস্তুত… আপনারা?

* সুকান্তের কবিতার লাইন।

ছিড়ে যায় নূপুর : অণুগল্প

একটা গল্প শুনবেন? আপনাদের কাছে গল্প মনে হলেও, এ একজন অতৃপ্ত নারীর গল্প। ‘অতৃপ্ত’ শব্দটি শুনে আবার ভুল বুঝলেন? না, ভুল বুঝবার অবকাশ নেই। শরীরের অতৃপ্তির সাথে সাথে আমার মনোদৈহিক অতৃপ্তি ও জড়ানো রয়েছে এখানে।
.

আমি কে? আমার নামটি না হয় নাই বললাম। ওটা কি এতোই জরুরী জানাটা? আমি একজন নারী- এটাই কি যথেষ্ট নয়?
.

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার। বাবার আদরের ছোট মেয়ে। প্রচন্ড সুন্দরী ছিলাম। সেই সাথে অনেক দুরন্ত ও মেধাবী। আমার গ্রামের সকল ছেলেদের ‘হার্ট-বিট’ ছিলাম আমি! রোজ বিয়ের প্রস্তাব আসতো। ছেলেরা বিরক্ত করতো।
যে জন্য মাত্র ১১ বছর ৪ মাস বয়সে বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেন সেনাবাহিনীর এক সেপাইয়ের সাথে!
.

আমি তখন নাবালিকা। পি এস সি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। আগে থেকেই কথাবার্তা চলছিলো, পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে দেখি বিয়ের আয়োজন। দোতলায় গিয়ে বসে একা কাঁদতে থাকি, কিন্তু কেউ দেখেনা সে কান্না। রাতে লোকজন ডেকে কলমা হলো। কাবিন হল ২০ হাজার টাকার। ঐ দিন আর এক জায়গায় থাকতে দেয়নি। সকালে ও চলে যায়।
.

শেষে ও আবার আসে একমাস পরে, আমি তখন ঘুমন্ত অবস্হায়, মা ওকে আমার কাছে দিয়ে যান। ও যখন আমাকে ঘুম থেকে উঠায় আমি তখন ভয়ে কান্না শুরু করি। তারপরও ওর কাছেই আমাকে থাকতে হয়। প্রথম বার অনেক ধস্তা ধস্তি করে সে, কিন্তু মিলন হয়নি। কিছুদিন পর আবার ছুটিতে আসে, আমিতো পালিয়ে বেড়াই, কাছে যাইনা ছুটে বেড়াই; কিন্তু রাত হলে বাবা মা ভাই সবার হাতে মার খাওয়ার ভয়ে ওর কাছে গিয়ে থাকতে হয়। তখন ও আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর কথা না শুনলে চাপা মার মারে, এভাবে ৩/৪ রাত ঘুম হয়না।
.

এরপর একদিন বেহুঁশের মত ঘুমিয়ে আছি। ও তখন আমাকে ঘুমন্ত অবস্হায় ভোগ করে। এরপরে আমি সাবালিকা হই। তারপর মা আমাকে বুঝাতে থাকে, তখন আস্তে আস্তে স্বামীকে মেনে নেই। কিন্তু প্রথম দিকে আমার খুব কষ্ট হতো। ও যখন আমাকে ভোগ করতো, আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তো, সর্বাঙ্গ ও মনের গভীরে জ্বলে পুড়ে যেতো, যন্ত্রনা হতো। কিন্তু লজ্জায় কাউকে বলতে পারতাম না! বাঙ্গালি নারী না আমি? কিছুদিন পর আস্তে আস্তে সহনীয় হয়ে উঠলো, তারপর আর কষ্ট পেতাম না। একদিন অনুভব করলাম, ওকে ভালবেসে ফেলেছি!
.

আমাকে বিয়ে করতে আসার আগে গ্রামের বাড়িতে ও আরো একটা বিয়ে করেছিল। আমার মা বাবা তা জানতেন না। পরে যখন সেই বৌ মামলা করে, তখন ওর সেনাবাহিনীর চাকরী চলে যায়। শুরু হয়ে গেল আমাদের কষ্টের জীবন। আমার পড়াশুনা চলছিল, যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, তখন বাচ্চা এলো আমার পেটে। আর পড়াশুনা হলো না, মা হলাম! শুরু হল সংসার জীবন। এক অনাগত ভবিষ্যতের পানে চেয়ে থাকা… আর কষ্টকর গ্লানিকর দিন দিন প্রতিটি দিন কাটানো।
.

দুই বছর স্বামী বেকার ছিলো। তারপর আজ এখানে, কাল ওখানে, এভাবে ছোট খাট চাকরি করতে লাগলো সে। কোনো জায়গায় ওর চাকরি স্হায়ী হতো না। এভাবে চললো দশটি বছর!। তারপরে ওর চাকরি হয় এক সিমেন্ট কোম্পানিতে অফিসার পোস্টে। টাকার মুখ দেখতেই সে আমাকে না জানিয়ে বাবুর্চির মেয়েকে আবার বিয়ে করলো। কেটে গেল আরো ছয়টি বছর! আমি যখন জানলাম তখন আর কিছুই করার ছিলো না।
.

রাবার যেভাবে টেনে লম্বা করে, আমাকে সে ভাবে টেনে বড় করেছে আমার মা বাবা ভাই, ঐ বুড়ো লোকটার সাথে সংসার করার জন্য। আর আমার বয়স্ক স্বামীও সুযোগ বুঝে ইচ্ছেমত আমাকে ব্যবহার করেছে। যখন সেক্সের কিছুই বুঝতাম না, তখন ঢেলে উপুর করে দিতো। আর যখন বুঝতে শুরু করি, জীবন যৌবন উপভোগের সময় এলো, যখন আমি আমি কানায় কানায় পরিপূর্ন; তখন থেকেই আমি একা, তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত!
তারপরেও আমি সেই গানটা শুনি, ‘ওগো যা পেয়েছি সেই টুকুতেই খুশি আমার মন, কেনো একলা বসে হিসেব কসে নিজেরে আর কাঁদাই অকারন’- শুনেছেন না হেমন্তের এই গানটি?
.

যখন তার টাকা ছিলনা তখন শুধু আমিই ছিলাম। আর সে যখন টাকার মুখ দেখলো, ওমনি আমায় ভুলে গেলো। পুরুষ! তোমরা এমন কেন?
.

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস জানেন? দারোয়ান থেকে যে লোক ম্যানেজার হয়েছিল, সে এখন আবার সিকিউরিটি ডিপার্মেন্টে চাকরী করছে! অসুস্থ, চিকিৎসা করানোর টাকা নেই তার, নাইট ডিউটি করে।
.

কিছু পুরুষ লোক হয় কন্যা রাশি, আর আমি বোধহয় পুরুষ রাশি! সেই ছোটবেলা থেকে এই পর্যন্ত এখনো, বয়স চল্লিশোর্ধ। তারপরেও এখনো মৌমাছির মত যেন ছেলেরা পিছু নেয় আমার। একেতো সুন্দরী, তারপরে নেই স্বামী। এখনো যে কত সতর্ক হয়ে চলতে হয়!
.

সারাটা জীবন ধরেতো একাই চলছি, যেদিকে যাই একা, যেদিকে তাকাই একা, নদিটা পার হতে গেলেও হাতটা ধরার জন্য কেউ থাকেনা। বাজারের ব্যাগটাও একা বইতে হয়! কি যে কষ্ট।
.

এখন মধ্যরাত! বাহিরে খুব সুন্দর চাঁদের আলো। জোৎস্না আমাকে খুব স্পর্শ করে, আমি আপ্লুত হই! ছাদে অথবা ব্যালকনিতে বসে জোৎস্না উপভোগ করতে খুব ভাল লাগে আমার!
.

সুখ কি? সেটা না জানলেও দুঃখ কি সেটা হারে হারে জেনেছি আমি। জীবনে অনুভব জিনিসটা কেমন? কিসের অনুভবের কথা বলবো? একজন সুন্দরী স্মার্ট, সেক্সি নারী হয়ে আমার নারী জীবনের অতৃপ্ত বাসনার অনুভব? স্ত্রী হয়েও স্বামীর কদর না পাওয়ার অনুভব? একজন অসুস্থ স্বামীকে রাতের পর রাত-দিনের পর দিন সুস্থ করার তীব্র অনুভব? সারারাত যন্ত্রনায় ছটফট করার অনুভব? দীর্ঘ ষোলো বছর ঘর করার পর নামে মাত্র ৩০/৩৫ বার দৈহিক মেলামেশা করার অনুভব? আর কত অনুভবের কথা শুনাবো বলুন? বেকার স্বামীর সব ভারবহন করার পরও সন্ধ্যায় বা রাতে তার পাশবিক অত্যাচারের অনুভব?
.

তাই এখন নতুন করে কারও কাছ থেকে অনুভবের কথা শুনলে ভয় হয়। কারন কোনদিন এমন অনুভবের ছোঁয়া পাইনি তো তাই। যদি ঐ বালুর তৈরী ঘরের মতো এই নতুন অনুভবও পানিতে তলিয়ে যায়? তাই ভয় হয়। তবে বড্ড মন চাইছে কারো খুব কাছে যেতে। ভাবতেই আমি যেন বেসামাল হয়ে যাই!
.

এত নারী থাকতে এখনো অনেকেরই আমাকে ভাল লাগে! বুঝিনা আমি- বুঝে না তারাও। আমি যে নিঃস্ব একটা মানুষ! মাথার তালু থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত নতুন করে কষ্টকে স্থান দেবো তেমন আর স্থান বাকী নাই আমার!
.

আমি মেয়ে! আমি দূর্বোধ্য! আমার নূপুরের অংশ ছিড়ে গেছে, কিন্তু আমি সেই ছেড়া নূপুরের নিক্কন শুনতে ভালোবাসি। আমি নূপুরের ছেড়া অংশ হাতে নিয়ে বসে থাকা এক নিঃসঙ্গ শংখচিল। যার সাথী থেকেও নাই।
.

‘কিনেছি অনেক দামী উপহার
বহু মনোহর কাগজের ফুল; ভালোবাসা দিয়ে হয়
নাই কেনা একখানি মেঘ একটি বকুল!
জমিজমা আর গৃহ আসবাব
অধিক মূল্যে করে রাখি ক্রয়, শুধু কিনি নাই
কানা কড়ি দিয়ে একজোড়া চোখ একটি হৃদয়!’ *
.

#ছিড়ে_যায়_নূপুর_অণুগল্প_৪২৭

* কবিতাঃ মহাদেব সাহা

** ছবিঃ পার্বতী ঘোষ এর স্কেচ

নষ্ট কষ্ট একটু একটু : অণুগল্প

নিউমার্কেটের চারটি প্রবেশদ্বার। পূর্বপাশের পার্কিং এরিয়ায়, বসা অবস্থায়ই বাইক স্ট্যান্ড করায় শিহাব। চাবি খুলে নিয়ে ঘাড় লক করে। নামে না, আকাশের দিকে তাকায় একপলক। ঘুমোট হয়ে আছে। ঘোমটার আড়ালে মেঘবালিকাদের ভ্রু কুঁচকে আছে, স্পষ্ট অনুভব করে শিহাব।
.

স্মরণকালের ভয়াবহ তাপদাহ। ঝুলফির দু’পাশ দিয়ে ঘামের ধারা বয়ে চলেছে। বুক ভেসে যাচ্ছে। ভেজা অসস্তিকর অনুভব। উফফ!একটু বৃষ্টি হতো।
.

আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত উঁচু করে ইশ্বরের কাছে অভিযোগ জানাতে উদ্যত হতেই, আচমকা ফ্রিজ হয়ে যায় সে।
হ্যা!
পারু!
পারুই তো!
আরো একটি তুলতুলে বাবু পারুর হাত ধরে মার্কেটের গেট দিয়ে বের হয়ে আসছে সে। এখনো দেখতে একই রকম আছে সে!
.

কোথায়ও কি কিছু পুড়ছে?
গন্ধ পায় শিহাব। মুহুর্তে আঠারো বসন্ত পিছনে গিয়ে, সেই পারু দৃষ্টিগোচর হয়। অনুভবে… কল্লনায়!
.

শিহাবের হৃদয় একটু কি জ্বলে ওঠে? অদৃশ্য পর্দা ভেদ করে আবার সেই মেয়েটির উপস্থিতিতে একটু কি বেসামাল হয় সে?
.

ভাবনার অবসরে ওরা কেউ কাউকে দেখতে পায় না। ইজি বাইকে পারু মেয়েকে নিয়ে হারায়। আবারো? সম্বিৎ ফিরতেই মোড়ের ওপাশের তিন রাস্তার যে কোনোটি দিয়ে ভিড়ের মাঝে গন্তব্য খুঁজে নেয় পারুকে বহনকরা যান্ত্রিক বাহনটি।
.

ডান পায়ের জোরালো কিক স্টার্টারে পড়ে। পারুকে অবচেতনে নিয়ে, গলির মোড়ের দিকে ধাবমান শিহাব। রাস্তা জুড়ে চলে যাওয়া পারুর শরীরের ঘ্রাণ অনুভব করতে চেষ্টা করে সে। সেই আগের মতো ঠিক যেভাবে পারুর হেঁটে চলা রাস্তা ধরে ধরে.. আরও পরে পারুর বুকের উপত্যকায় নিজেকে ডুবিয়ে ভালোবাসার ঘ্রাণ পাওয়ার জন্য যেভাবে .. ঠিক আঠারো বছর আগে যেভাবে.. আজও সেভাবেই!
.

মোড়ে এসে আবারো থেমে যায় শিহাব। হারানো মেয়েটির শরীরের সেই হারানো সুরে একটুও উদ্দীপ্ত হয়না সে। অনুভব করে, পুরো রাস্তা জুড়ে এখন কেবলি শিহাবের বউয়ের ঘ্রাণ! শিহাবের অনুভবের গভীরতর প্রদেশ এখন কেবলি বউময়।
.

শিহাবের শরীর জুড়েও এখন কেবল বউয়ের-ই ঘ্রাণ! বাইক ঘুরিয়ে ফিরে চলে সে। বউ অপেক্ষা করছে। হাসে নিজের মনে শিহাব।
হ্যা!
শিহাবের জীবন এখন কেবল বউময়!
থাকুক হারোনো মেয়েটি তার নিজের মতো। যা সে চেয়েছিলো।
.

তারপরও… শিহাবের কি একটু একটু কষ্ট হয়?

#নষ্ট_কষ্ট_একটু_একটু_মামুনের_অণুগল্প_৪২৬

ছবিঃ Parbati Ghosh এর স্কেচ

আবৃত্তি : মামুনের অণুগল্প

জীবনের এক বিষম সময়ে পারুর সাথে আমার পরিচয়। বেঁচে থাকার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। জীবন এক দুর্বিসহ দূর্ণিবার রুপে আমার সামনে উপস্থিত। শব্দে সেই রুপ আমি ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। এমনই সময় ছিলো তখন।
.

টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস ছিলো। এভাবে লিখতে গিয়ে লেখকদের এক গ্রুপের সদস্য হয়েছিলাম। আড্ডাবাজি আর লেখালেখির সমালোচনায় মূখর সময় কাটতো ওখানে। অনেকেই আসতো। সবার সাথে সেভাবে পরিচয় না হলেও, অনেককে মুখ চেনা চিনতাম। তাদের ভিতরে পারুও ছিলো!
.

তখনো মুঠোফোন যন্ত্রটি এদেশে আসে নাই। অ্যানালগ টেলিফোন দূরালাপনী যন্ত্র হিসেবে একমাত্র বিলাসিতা কিছু কিছু অবস্থাপন্ন মানুষের ঘরে। আমি যে মেসে থাকতাম, সেখানে এই যন্ত্রটি ছিলো। মেস ম্যানেজারের কৃপা দৃষ্টি ছিলো আমার প্রতি। কেন তা জানি না। কখনো জানতেও চেষ্টা করিনি আমি।
.

একদিন রাতে- ভয়াবহ ঝড়-বৃষ্টির রাত ছিলো সেটা। বিদ্যুত ছিলো না। তখন হ্যারিকেনের অস্পষ্ট আলোয় মেসরুমগুলির বাসিন্দারা নিজেদের যৎসামান্য কাজ চালাতো। আর মোমবাতির অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার আমাদের কাছে ছিলো বিলাসিতা। যাইহোক, মেস ম্যানেজার সেই রাতে আমাকে নিচে তলব করলেন। গেলাম।
.
কালো টেলিফোনের রিসিভারটি অবহেলায় ওনার সামনের নড়বড়ে চারপায়ার ওপরে পড়ে আছে। দাঁত খিলাল করতে করতে সেটার দিকে বাম হাতের অঙ্গুলি হেলন করে আমাকে বললেন,
– তোমার ফোন।

অবাক হলাম। কারণ এই শহরে আমাকে ফোন করার মতো কেউ থাকতে পারে, আমার কল্পনায়ও ছিলো না। বিস্ময়াভিভূত হৃদয়ে রিসিভার কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ঝড়-বৃষ্টির কোলাহলকে ছাপিয়ে মিষ্টি একটা কন্ঠ আমার কানে মধু ঢেলে দিলো!
.

টেলিফোনের ওপাশের মানূষটির সাথে আলাপ শুরু করতে প্রথমেই নাকি ‘হ্যালো’ বলতে হয়। আমিও ঐ বিজাতীয় শব্দটা উচ্চারণ করলাম। ওপাশ থেকে জলতরঙ্গের মতো দু’টি শব্দ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছেন?

সেই-ই পারুর সাথে আমার প্রথম আলাপ। বিনা তারে এক অদৃশ্য সংযোগের সেই-ই প্রথম সূত্রপাত।
.

পারু যে ওর নাম সেটা কীভাবে জানলাম? সে-ই বলেছিলো আমায়।
এরপর অনেক জল গড়ালো আমার সেই মফঃস্বল শহরটিকে ঘিরে বয়ে চলা একমাত্র নদীটির বুকের ওপর দিয়ে। দিনের পর দিন, অনেকগুলি রাত আমাকে মেস ম্যানেজার ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তার বিরক্তিভরা ভ্রুকুঠি অগ্রাহ্য করার মত মানসিক শক্তি আমাকে দিয়েছিলো, কালো রিসিভারের ওপাশের পারু নামের অচেনা একটি মেয়ে। নারী বললাম না; কারণ মেয়ে শব্দটি আমার কাছে খুব ভালো লাগতো। নারী বললে এক পূর্ণ যৌবনা সম্পূর্ণ কাউকে মনে হতো আমার সবসময়।
.

তবে পারু টেলিফোনে কথা বললেও কখনো নিজেকে ওর আসল পরিচয় তখনো জানায় নাই। আমার লেখা কবিতা ওর নাকি খুব ভালো লাগতো! সে আমাকে টেলিফোনে দু’একটা আবৃত্তি করেও শুনিয়েছিলো।
.

এরপর ওর লেখা চিঠি আমার মেসের ঠিকানায় আসা শুরু হলো। অসাধারণ হস্তাক্ষর! চিঠিগুলির কাগজে কেমন ভালোবাসার ঘ্রাণ জড়িয়ে ছিলো! হাসছেন? হাসুন। ভালোবাসারও নির্দিষ্ট ঘ্রাণ আছে। আপনারা যারা কখনো ভালোবেসেছেন, সহজেই অনুভব করতে পারছেন আমার সেই ঘ্রাণের অনুভূতিটুকু।
.

আমিও নতুন উদ্যমে পারুকে নিয়ে অনেক অনেক কবিতা লেখা শুরু করলাম। একটা কবিতার কয়েকটা লাইন শুনতে চান? শুনুন তবে,

প্রিয়দর্শিণী পারু! তুই কেমন আছিস?
তোর বুকের ওম মাখা প্রহরগুলি
এখন আমার শীতল ঘরের ফায়ারপ্লেস!
সেখানে আমি ইচ্ছেমতো পুড়ি-শীতল হই…
তুই কি বুঝিস?
.

প্রথম প্রেমের পাগলাটে কিছু অনুভব! তবে আমার মনে ঐ সময় একটাই ইচ্ছে ছিলো। আমার শহরকে আগলে রাখা সেই ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে, এক তারা জ্বলা রাতে, ঘাসের বুকে পাশাপাশি বসে , পারুকে নিয়ে আমার লেখা কবিতা ওর নিজের মুখে আবৃত্তি শোনার!
সেই কথাটি পারুকে লিখে জানালাম। ওর সাথে দেখা করার সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির অপেক্ষায় ওর দেবসাদ অধীর ভাবে অপেক্ষমাণ। চিঠি চালাচালির সেই সময়ে টেলিফোনে কথা বলাটা কমে গেছিলো। কারণ আমাদের দু”জনের এমন অনেক কথা ছিলো, যেগুলি আমাকে পছন্দ করা সেই মেস ম্যানেজারের সামনেও বলা যেতো না! এমনই সব কথাবার্তা। বুঝতেই পারছেন?
.

একদিন চিঠিতে পারু জানালো, সে দেখা করবে! সেই অনুভূতি শব্দে কীভাবে প্রকাশ করি বলুন তো? ইঁদুরের শরীরের গন্ধে ভরপুর আমার মেস রুমকে মনে হচ্ছিলো জান্নাতুল ফেরদৌসের সবুজ গালিচাময় স্থান! আমি ভেসে যাচ্ছিলাম… কি করবো,কখন সন্ধ্যা হবে সেই অপেক্ষায় সময়ই যেন কাটছিলো না।
.

হ্যাঁ! ঠিকই ধরেছেন। আগেই বলেছিলাম, নদীর তীরের সবুজ ঘাসের বুকে পাশাপাশি বসে ওর আবৃত্তি শুনবো।
.

নির্দিষ্ট সময়ে আমি নির্দিষ্ট স্থানটিতে পৌছালাম। ওখানে আগেই পারু বসে আছে দেখলাম দূর থেকে। কম্পিত হৃদয়ে গুটি গুটি পায়ে ওর সামনে হাজির হলাম। প্রথম প্রেমের প্রথম অভিসার! আমার পারু চুপচাপ বসে আছে। আকাশের তারাগুলির ধার করা আলোয় চারপাশটা দেখার মতো উজ্জ্বলতায় ভরপুর ছিলো। আমি পারুর পাশে বসলাম। ওর শরীর ছাপিয়ে কি এক অজানা সুগন্ধি আমায় গ্রাস করে চলেছিলো। আমি ডুবে যাচ্ছিলাম… ক্রমশঃ এক বিহ্বলতার গভীর থেকে আরো গভীরতর প্রদেশে প্রবেশ করছিলাম! একি ভালো লাগা! একি ভালোবাসা! এমনই অ-অনুভবেয় এক অনুভূতি আমায় গ্রাস করে চলেছিলো।
.

আমি পারুকে নিয়ে লেখা আমার সেই ঐতিহাসিক কবিতাটি নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা পারুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
– চোখ তোলো! চেয়ে দেখো আমায়।

পারু তাকালো আমার দিকে! নিঃশ্বাস রুদ্ধ এক মুহুর্তে আমার ভিতরের অন্তর্চক্ষু দিয়ে আমি ওর চোখের আলোয় জ্বলে উঠলাম। বললাম,
– নাও, আবৃত্তি করো।
.

মুহুর্তে দু’টি কম্পমান ঠোঁটের মৃদু নড়াচড়ার সাথে তারা জ্বলা আকাশ থেকে বর্ষণ শুরু হলো। আমার দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকা দু’টি নীল চোখ মুহুর্তে রঙ পালটে কালো হয়ে গেলো দেখলাম। সেখান থেকে বারিধারা টুপ টুপ করে পড়ছে। অবাক বিস্ময়ে আমি কম্পমান পারুর হাত থেকে এক টুকরো কাগজ নিলাম। গুটি গুটি অক্ষরের সেই আমাকে লেখা পারুর শেষ চিঠিতে ছিলো,

– টেলিফোনে তোমার সাথে আমার বান্ধবী কথা বলেছে। আমিই তোমার আসল পারু। আমি কথা বলতে পারি না। আমার ৪ বছর বয়সে গলায় কী যেন হয়েছিল। সেই থেকে আমি বোবা হয়ে গেছি। আমায় ক্ষমা করো গো! আমি আবৃত্তি করে তোমায় শোনাতে পারলাম না!
.

ভালোবাসার মানূষটির পাশে আমি চুপচাপ স্থানুর মতো বসে রইলাম। সে ও নিশ্চুপ। ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে রাতের নিঃশব্দতাকে আরো নৈশব্দের গভীরে নিয়ে চলেছিলো জলের বয়ে চলার শব্দ। হৃদয়ে ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে বইছিলো পারু! আমার পারু! তীব্র ইলেট্রিক ব্লু আলোয় মাখামাখি হয়ে আছে বিশ্বচরাচর। সেই রাতের নীলচে আলোয় পারু এবং আমাকে, হৃদয়ের অধিপতি আমাদের ঈশ্বর – সস্নেহ ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘক্ষণ !!

#আবৃত্তি_মামুনের_অণুগল্প_৪২৫

মামুনের তিনটি অণুগল্প


এক.
একদিন সান্ধ্যকালীন আড্ডায় কথাবার্তার এক পর্যায়ে শিহাব উত্তেজিত হয়। ওর নাকের ওপরটায় ঘাম জমে.. ডান পাশের কপালের শিরাটা লালচে হয়ে ওঠে পলকে।

গলার রগটা ফুলিয়ে সে ওদের বলে,
– যে দেশে গুণী একজনকে চক্ষুলজ্জা বিসর্জন দিয়ে নিজের মুখে চেয়ে নিজের জন্য পদক নিতে হয়… মূল্যায়ণটা করতে বলে দিতে হয়, ফরিদীর মত শক্তিমান অভিনেতার মৃত্যুর পরে পদক প্রাপ্তি ঘটে! সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে অন্তত সৃষ্টিশীলতার উল্লাসে মগ্ন হতে আমাকে বলো না।

#পদক_অণুগল্প

দুই.
আরেকদিন নিজের মনে হেসে, মেস রুমের দরোজা বন্ধ করতে করতে শিহাব ভাবে,
– পুরুষ মানুষ কেবল গরম হতেই জানে। নারী আর নির্জনতা দুই-ই পুরুষকে কামাতুর করে তোলে। অথচ নারী যখন মা, বোন কিংবা মেয়ের রুপে এই একই নির্জনতায় পাশে থাকে, তখন পুরুষ বালক হয়ে যায়। কেবল এই তিন রুপের ভিন্নতায় একজন বালকও সাহসী পুরুষে পরিণত হয়।

#রুপান্তর_অণুগল্প

তিন.
আকাশের এক প্রান্তকে চিরে দিয়ে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বিদ্যুতের চমকের পর পরই বজ্রপাতের প্রচন্ড শব্দে কানে তালা লেগে যায়। এই অবসরে ওর রুমে ঢুকে পড়া এক যুবতীর দরোজার হুক ভেতর থেকে থেকে আটকে দেবার শব্দটাও চাপা পড়ে যায়।

মুষলধারে বারিধারা ঝরে পড়ার এমন দিনে কোথায়ও কেউ নেই। এক আঠারো বছরে সদ্য পা দেয়া যুবক অতৃপ্ত এক রমনীর সামনে দাঁড়িয়ে ঢোক গিলে.. রমনী বড্ড রমনীয় ভাবে নিজেকে সামনে মেলে ধরে.. তাঁর বুকের আঁচল মাটিতে পড়ে যায়! প্রচন্ড এক অপ্রতিকূল আবহাওয়ায় একজোড়া আদম-হাওয়া, কাছে-দূরের অনুভূতি পার করতেই বুঝি নৈঃশব্দের প্রহর শেষের অপেক্ষা করে!

#ঝড়ের_রাতে_অণুগল্প

টিটি’র একদিন

বিমান বন্দর স্টেশন ছেড়ে ট্রেন খুলনা অভিমুখী। ধীরে ধীরে গতি বাড়ছে। সময়ের বুক থেকে বের হওয়া আরো অনেক কু-ঝিকঝিকের সাথে ট্রেনের গুলোও মিলায়.. বাতাসে.. শব্দ তরংগ।

যুবক ওরা চারজন। এক টেবিল মাঝে রেখে সামনাসামনি। টুয়েন্টি নাইন খেলছে। অপর পাশে ভিন্ন বয়সের নারী- পুরুষ শিশু। একেবারে শেষ মাথায় দুজন দুপাশের বন্ধ দরোজার ওপরের খোলা অংশ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সেদিকের অপর বগি থেকেই আসলেন টিটি।

বয়ষ্ক মানুষ। ইউনিফর্মের ভেতরের মানুষটার কথা বলছিলাম। অন্য বগিতে পা রাখার মুহুর্তেই দুই বিপরীত পাশে দাঁড়ানো যাত্রীদের দিকে তাকান। সময় কাটে..কথা বার্তায়.. আর শব্দবিনিময়ের সাথে সাথে গোপন লেনদেন টুকু চলন্ত ট্রেনকে শিউড়ে দিতেই তীব্র বাঁকে পৌঁছে ট্রেন কেঁপে ওঠে.. হুইশেলের শব্দে চারপাশ কাঁপিয়ে দিয়ে বাঁক নেয় ট্রেন।

একে একে চেক করে তাস খেলারত গ্রুপের নিকট থামেন। ওপাশে ছোট্ট বাবুটা তার বাল্যশিক্ষায় পড়ছে,
‘ ঘ – ঘুষ খাওয়া মহা পাপ
ঘুষ দূর্ণীতির বাপ।’
বাবুটা ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, ঘুষ কিভাবে খায়?’

আশপাশের সব কিছু কেমন নীরব মনে হতে থাকে টিটির কাছে। বুকের বাম পকেটের ওখানটায় কেমন জ্বলে ওঠে। ওপর নিচে সব দিকে।
ট্রেনের দুলুনিতে স্থির হতে একটু সময় নেন। বাবুটার সামনে হাঁটু ভেংগে বসেন।
‘ আসো বাবা আমার সাথে। আমি বলছি তোমায়।’

অবাক সবার সামনে দিয়ে ছোট্ট বাবুটার হাত ধরে এখন পোষাকের ভেতরের মানুষটি দুই বগীর সংযোগস্থলে দাঁড়ানো সেই দুই যাত্রীর সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বুক পকেট থেকে বের করা একটু আগের গোপন সময়, বর্তমানে এনে সেটার মোড়ক উন্মোচন করেন। অবাক যাত্রী দুজনের দৃষ্টির সামনে নিজের কঠোর দৃষ্টি আর নীরব চাহনি নিয়মকে বড্ড তীব্রভাবে রিয়্যাক্ট করালো এক আন্ত:নগর ট্রেনে।

বাবুটার থুতনি নেড়ে আদর করে টিটি বলেন,
‘ আমি যে টাকাগুলি ফেরত দিলাম, ওটা নেয়াটা ঘুষ খাওয়া ছিল। আমি মহাপাপ করেছি। আমার দুই কান জোরে মলে দাও। তারপর এই দুইজনের গুলিও মলে দিও। ওরা ঘুষ দিয়েছে আমাকে।’

সময় স্থির থাকে যেন। কেবল চলন্ত ট্রেনের এই আওয়াজ ভেসে আসে, ‘ঘুষ খাওয়া মহা পাপ… ঘুষ দূর্ণীতির বাপ’…।

একজন টিটি বেলাশেষের আবীর মেখে মেখে পরিশুদ্ধির পথে পা রাখেন। জানেন সময় একদম-ই নাই। তারপর ও শুরুটা করেন।
শুরু, যে কোনো সময়েই করা যায়। দরকার কেবল একটু সামনে পা বাড়ানো। আজ স্মিত হেসে একজন টিটি ভাবেন, তিনি শুরু করতে পেরেছেন.. জানালার বাইরে তখন সন্ধ্যা নামবে একটু পরেই।।