বাঙাল ঘটি – ঘটি বাঙাল

আমাদের ছোটবেলাতেও দেখেছি ঘটি বাঙাল মধুর বিতর্ক। মোহনবাগান – ইস্টবেঙ্গল তখনও বেশ প্রাসঙ্গিক। ফুটবল আজকের মতো ক্রিকেটের নীচে চলে যায় নি। যদিও আমি এই দুটো খেলার কোনোটাই খুব ভালো বুঝতাম না, কারন প্রত্যন্ত এলাকায় বাবা-মার সঙ্গে কোয়ার্টার্সে থাকায় সেখানে বাউন্ডারির মধ্যে এলিট সম্প্রদায় আর বাইরে হতদরিদ্র মানুষদের কেউই ওই দুটো খেলা খেলতেন না। বাউন্ডারির ভেতরে মূলতঃ ব্যাডমিন্টন, টেনিস, ভলিবল এসবই খেলা হতো বেশ সাজুগুজু করে। ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান সম্পর্কে জানার পৃথিবী সীমাবদ্ধ ছিল খবরের কাগজের পাতায়, যেটা প্রকাশের পরে সেইসব রুক্ষ এলাকায় পৌঁছাতে পাক্কা একদিন সময় নিত। মানে আজকের খবর আমরা পড়তাম কাল। আর ছিলো রেডিও। কি উত্তেজিত আর রোমহর্ষক সেইসব ধারাবিবরণী! আহা! মনে হতো নাটক শুনছি। যাইহোক, আসল কথা হলো বাঙাল ঘটি বা মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল নিয়ে মাতামাতি দেখতাম বাড়ি ফিরলে কিম্বা কোনো আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেলে। আজকের প্রজন্ম সেই মধুর উত্তেজনার স্বাদ আর কখনোই পাবে না।

আজকের দিনে আমাদের প্রজন্মের কাউকে কাউকে যখন বাঙাল ঘটি সংক্রান্ত তর্ক টেনে আনতে দেখি, তখন মনে হয় তাঁরা স্মৃতিচারণ করছেন। ব্যস্ত সাইবার এজ এ এখন কার অতিরিক্ত সময় আছে, অর্থকরী নয় এরকম বিষয় নিয়ে আলোচনা করার! তাছাড়া, দেশভাগের পরে কেটে গেছে প্রায় ৭০ বছর। তখন যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের পরে তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্ম এসে গেছে। তারা এদেশীয় ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে ওদেশীয় ভাষা সংস্কৃতি মিশিয়ে এক খিচুড়ি কালচার তৈরী করে তাকেই রপ্ত করেছে। এখন আর সেই বিগত দিনের মানকচু বাটা বা ইলিশের কারিকুরী নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কত রকমারি পিঠে ছিল এখন অনেকেই জানে না। ওই বিভিন্ন ধরনের পদ সবই বিভিন্ন তারা মার্কা রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায়। ফেলো নোট, খাও কোলেস্টেরল শূন্য, ফ্যাটলেশ পুরনো মেনু। এভাবেই আজকের জেনারেশন সেটা ঘটি বাড়ির হোক বা বাঙাল বাড়ির, রান্না ভুলে গেছে। তাছাড়া সময়ই কোথায় তাদের? বেশিরভাগই কাজের জন্যে সারা সপ্তাহ দৌড়ঝাঁপ করে। ছুটির দিনে ঘুম থেকে ওঠে আধাবেলা কাবাড় করে। সেদিন আর তাদের রান্নার ইচ্ছে যদি না হয়, তাহলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না।

ঘটি বাঙাল রসময় বিতর্কও আজ অপ্রাসঙ্গিক এই কারনে যে, আজ খাঁটি বাঙাল বা খাঁটি ঘটি পরিবার টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

3 thoughts on “বাঙাল ঘটি – ঘটি বাঙাল

  1. এটা সত্য যে …
    আজ খাঁটি বাঙাল বা খাঁটি ঘটি পরিবার টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।
    সমকালীন জীবন নিয়ে বহুদিন পর প্রিয় কবি সৌমিত্রের গদ্য লিখা পড়লাম। ভালো।

  2. ঘটি বাঙাল রসময় বিতর্কও আজ অপ্রাসঙ্গিক এই কারনে যে, আজ খাঁটি বাঙাল বা খাঁটি ঘটি পরিবার টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।
    https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_bye.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  3. ঘটি বাঙাল রসময় বিতর্কও আজ অপ্রাসঙ্গিক এই কারনে যে, আজ খাঁটি বাঙাল বা খাঁটি ঘটি পরিবার টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।

    তো হয়ে যাক… ঘটি বাঙাল রসময় বিতর্ক …

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।