আগন্তুক: ধারাবাহিক উপন্যাস// পর্ব-০৫

FB_IMG_1487071836485
নিজের আসল রুপে হেঁটে চলেছেন তিনি রাস্তা ধরে। একজন মানুষের কতগুলি রুপ হয়? সবগুলো মিলালে ঠিক কতটা রুপে অপরূপ কিংবা ক্ষণে ক্ষণে রঙ পালটানো গিরগিটি হয়ে উঠে মানুষ। পিচের পথটি ঢাল বেয়ে অনেক উপরে উঠে গেছে। সেদিকে রিক্সা টেনে চলা রিক্সাওয়ালার পরিশ্রম চোখে পড়ে তাঁর। তবে আজকাল বের হয়েছে ব্যাটারিচালিত রিক্সা। তবে সেগুলোর সব রাস্তায় চলার অধিকার নাই। ঢাল থেকে দুর্বার বেগে রিক্সা পাশ দিয়ে বাতাসে ছুঁয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। যাওয়া আসাটা সবসময়েই কেমন যেন সুরেলা গুঞ্জনের সৃষ্টি করে।

গাছেরা পাশাপাশি সারিবদ্ধ। ওদের কান্ড-শাখাপ্রশাখা টানেলের সৃষ্টি করেছে। চোখের জন্য আরামপ্রদ! একজন অতি সাধারণ মধ্যবয়স্ক এমন এক টানেলের দিকে চলেন। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পথের দু’পাশে নজর। বৈকালিক ভ্রমনে বের হয়েছেন এমন লাগলেও আসলে তা নয়। আজ দেখতে এসেছেন। খোঁচা খোঁচা সাদা দাঁড়ি। এমন কোনো অবয়ব নয় তাঁর, যে একবার দেখলেই দ্বিতীয়বার দেখার আগ্রহ জাগে। তাই কেউ তাকে মনে রাখে না।
মৃদু হাসেন।
হ্যাঁ! এতেই তিনি খুশী।

পেছনে একটা বাজার ফেলে এসেছেন। গোল হয়ে বাজারের মধ্যভাগে কিছু মানুষ বসে আছে দেখেছেন। আলোচনা-সভা কিংবা অন্য কিছু হবে হয়ত। তবে কৌতুহলী মনের ইচ্ছেটুকু পূরণ করেন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে। এলাকার ছেলেরা সব নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। তাই কিছু একটা করতে অভিভাবকদের এই উদ্যোগ। একজন প্রস্তাব করলেন, ‘এখন থেকে কাউকে নেশা করতে দেখলে বা নেশার জিনিস সাথে পেলে, প্রকাশ্যে এই বাজারে বিচার করা হবে।‘ কয়েকজন তাঁর কথায় শব্দ করে সায় জানায়। বিরক্তিতে ভ্রুযুগল কুঁচকে উঠে। মনটা আরও তিতা হবার আগেই মস্তিস্ক পা দু’টিকে সামনে বাড়ার নির্দেশ দেয়।

এভাবে কিছুই হবে না। এই লোকগুলি মাথা ব্যথার জন্য মাথাটিকেই কেটে ফেলার জন্য ব্যস্ত। এতে কোনো সমাধান আসবে না। আর এই যারা নেশার বিরুদ্ধে এক হয়েছে, এদের ভিতরেই রয়েছে কয়েকজন, যারা এই আসরেও নেশা করে এসেছেন। তাদের ঝিম মারা লাল চোখ এবং কথার টোনেই তিনি অনুভব করেছেন। এ ব্যাপারে অন্য সবার চেয়ে তাঁর অভিজ্ঞতাও অনেক বেশী। এরা যে মূল বিষয়টির ধারে-কাছেও যাচ্ছে না, সেটাও বুঝতে পারছেন। হয় এরা এড়াতে চাইছে, না হয় এদের চিন্তার দৈন্যতায় এমন-ই হচ্ছে।

বিশাল এক খেলার মাঠ। এর বুক জুড়ে এখন শূন্যতা। এই সময়ে মাঠ ভর্তি কিশোর-যুবকদের কোলাহলে মূখর হয়ে থাকার কথা ছিল। কিন্তু কোথায় তাঁরা? কোণাকুনি মাঠ পেরিয়ে আসেন। মাঠকে ঘিরে তিনপাশে গাছপালা জঙ্গলের মত হয়ে আছে। বেশ নির্জন। ছায়াঢাকা পথ দিয়ে হাঁটেন। অদূরে আড়াল থেকে চাপা স্বরের আওয়াজ আসে। কিশোর কয়েকজনকে দেখতে পান গোল হয়ে বসে আছে। তাকে দেখে ওরা কেন জানি স্ট্যাচু হয়ে যায়। তিনি তাকান না। ওদের ওখানের বাতাসে মারিজুয়ানার মিষ্টি সৌরভ। তাঁর নাকে লাগে। এদেরই খেলার কথা ছিল এই সময়ে মাঠের বুক দাপিয়ে। অথচ এরা..

আরো সামনে আগান। বিশাল এক দীঘি। সেখানে পাড় ঘেঁষে চলে যাওয়া পথটি এঁকে বেঁকে কোথায় যেন মিশেছে। সেদিকে যেতে গিয়েও থমকে যান। একটা ভগ্নপ্রায় পাম্প হাউস। এখন পরিত্যক্ত। ইটগুলো যেন লাল দাঁত বের করে দর্শককে ব্যঙ্গ করছে। ওখানে মেঝেতে পেপার বিছিয়ে তিনজন মাথা নিচু করে বসা। একটা সিগ্রেট জ্বলছে। সিগ্রেটের ধোঁয়া চিকন রেখা হয়ে আকাশ ছুঁতে চাচ্ছে। জ্বলন্ত সিগ্রেট রাখা আরেকটা প্যাকেটের ওপরে। ফয়েল পেপারে কিছু একটা রাখা আছে। সেটার নিচে উত্তাপ দিচ্ছে একজন। অন্যজনের মুখে পাইপ। অপরজন লোভাতুর দৃষ্টিতে ওর পালা আসার অপেক্ষায়। পাইপধারী ফয়েল পেপারের উপর থেকে বের হওয়া ধোঁয়া টেনে নিচ্ছে। ওর দম ফুরিয়ে আসার আগেই সে হাত তুলে থামার সংকেত দেয়। তৃতীয়জন খুশী হয়। দ্রুত জ্বলন্ত সিগ্রেটটি এইমাত্র পাইপ রেখে দিল যে, তার ঠোঁটে গুঁজে দেয়। একটা টান দিয়ে সে ভেতরের ধোয়াকে সিগ্রেটের ধোয়ার সাথে মিলিয়ে ফুসফুসে পৌঁছে দেয়। এরা হয়ত হেরোইন কিংবা ইয়াবা সেবন করছে। তিনি না থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে বাড়েন। পরিত্যক্ত পাম্প হাউসের তিন যুবক- কিশোর-ই বলা যায় ওদেরকে, ঘোলা চোখে তাঁর চলে যাওয়াটা দেখে। কিন্তু সে দেখায় ওদের কোনো আগ্রহ ফুটে উঠে না।

নিজের একদার পরিচিত শহরে আজ একজন আগন্তুক তিনি! মানুষের যেমন যার যার একটা গল্প থাকে, নগরের ও কী গল্প থাকে না? তাঁর এই পরিত্যক্ত নগরের ও একটা গল্প রয়েছে। আর একে ঘিরে রয়েছে এক ভিন্ন গল্প। সেখানেও এক প্রিয় মুখ রয়েছে কেন্দ্রীয় চরিত্রে। হেঁটে হেঁটে নিজের গল্পগুলিকে সামনে আনেন। এ গল্প এক হারানো শহরের। এখানে সম্পর্কগুলি অনবরত হারিয়ে যায়। প্রিয়জনেরা অসময়ে মুখ লুকায় আঁধারে।

এ এক রক্তাক্ত জনপদ। এখানের মানুষগুলো, বড্ড স্বাধীনচেতা। আপাত শান্ত, মনের ভেতর অহর্নিশি ফুঁসে চলে একটা আনাম বিসুভিয়াস। তারপরও শান্ত এরা।
এখানের বাতাসে আনন্দ-আর দু:খ, হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলে। তাই জীবন বড্ড নিরুদ্বেগ এখানে।

এই শহরে হ্যালুসিনেটেড যুবকদের ছড়াছড়ি। এখানে নীল তীব্র বিষ সহজলভ্য। এখানে শহরের বুক জুড়ে বয়ে বেড়ায় বিভ্রান্তির বিষবলয়। কতটা নির্বিকার ভাবে আমরা দেখছি আমাদের সন্তানদের তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে!

তবুও এটা আমাদের শহর। এখানে নিশ্চুপ বাবাদের মৌণতার হাহাকারে ভারী বাতাস- শেষ বিকেলের আবিরে মিশে মিশে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। তাই এখানের বিকেলগুলি অন্য শহরের থেকে অধিক রক্তিম!

দিগন্তব্যাপী সবুজ বলয় এভাবেই দৃশ্যমান এই শহরে। এখানে প্রতিটি মুহুর্তই এমন ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ- উত্তাল! অণুক্ষণ এমন-ই উন্মাতাল। এই শহরের বাসিন্দাদের হৃদয়ে ও, এর থেকে প্রবল ঝড় বয়ে চলে সারা বেলা!

এক হারানো শহরে- বিষন্ন বেলায়, একাকি একজন মানুষ-হৃদয়ে বয়ে চলা অনুভবের ভাঙ্গাচুরায় ক্ষয়ে যেতে থাকেন। তবুও কতটা নির্বিকার! সময়ের গলন্ত মোম তাঁর জ্বলন্ত হৃদয়ে জ্বালা ধরিয়ে চলে.. তবুও রিয়্যাক্ট করতে পারেন না তিনি। চিৎকার করা যাবে না এখানে! এ এক নিষিদ্ধ নগরী।

এক নিষিদ্ধ মানব, কোনো এক হারানো শহরের শেষ মানুষ হয়ে অপেক্ষায় থাকে- আরেক সভ্যতার ঊষালগ্নের। কখন সুতীব্র চিৎকারে জন্ম নেবে, আরেক জীবন! সেই জীবনে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে বাবাদেরকে আর ভাবনা-চিন্তায় নীল হতে হবে না। বাবারা অফিস করবেন নিশ্চিন্তে। ওভারডোজ নেশার উপকরণে কোনো বাবুকে নিথর হয়ে ফিরতে হবে না বাবার কোলে!
হ্যাঁ! এমনই করে দেখাবেন তিনি।
শুরুটা করা গেছে…

অপরিচিত একজন বাবা যখন পিচ ঢালা পথের শেষ মাথায়, সাইরেন বাজিয়ে একটি পুলিশ জিপ ছুটে চলে এক নির্দিষ্ট গন্তব্যের পানে। দু’জন উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা, যারা একজন অন্যজনকে সহ্য করতে পারেন না, বিশেষ নির্দেশে আজ এক সাথে মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন।

(ক্রমশঃ)

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

10 thoughts on “আগন্তুক: ধারাবাহিক উপন্যাস// পর্ব-০৫

  1. চলতে থাকুক – আপনি সবসময়ই ভালো লিখেন ।
    শুভকামনা আপনার জন্য ।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।