ট্যাগ আর্কাইভঃ মামুনের উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ দ্য গডফাদার পর্ব-৩

ও.সি মনোয়ার তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে আগে কখনো এমন অনুভূতির সম্মুখীন হননি। কেমন যেন তালগোল পাকানো। অনুভবের খরায় আক্রান্ত হলেন কিনা ভাবেন। গতকালের খুনের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলেন নিজের কক্ষে বসে।

টেবিলের উপর চা ঠান্ডা হয়ে আছে। সেদিকে খেয়াল নাই। তিনি আবার আগুন-গরম চা ছাড়া পছন্দ করেন না। বসে আছেন ‘পোষ্ট মর্টেম’ রিপোর্টের জন্য। ব্যাটা ড্রাগ-ডিলার নিজে মরে অন্য সবাইকে ঝামেলার ভিতর ফেলে গেছে। গতকাল থেকে প্রশাসনের বেশ উপর মহলের কর্তা ব্যক্তিরা দফায় দফায় তাঁর সাথে কথা বলছেন। নরম-গরম কথার দ্বারা সবাই-ই এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বের হয়ে আসতে চাইছেন, সেটা তাকে পরিস্কার ভাবে জানিয়েও দিয়েছেন। সেই থেকে ভাবছেন এই খুনের মোটিভ নিয়ে।

পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে হতে পারে? তবে সে সম্ভাবনা নাই। নিহতের পারিবারিক ইতিহাস ঘেঁটে, তেমন কিছুই সামনে আসেনি। এই পরিবারটির নিজেদের ভেতরের মিল ঈর্ষণীয়। এলাকায় আধিপত্য নিয়েও নেই কোনো কোন্দল। এমনিতেই তারা সম্পদশালী। রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে সাথে, এলাকাভিত্তিক প্রভাবের জন্য অন্য যে কারও তাদের সামনে দাঁড়াবার সুযোগই নেই বলতে গেলে।

দলীয় কোন্দল? তেমনও হতে পারে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তাকে সমর্থন করেছেন থানার দলীয় সভাপতিও। তিনি আরো এক কাঠি এগিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সবাই এক মায়ের সন্তানের মত। নিজেদের ভিতর কোনো বিভক্তি নাই।’

নারী ঘটিত কিছু হতে পারে? প্রতিহিংসা? কিংবা পরকীয়া কোনো ব্যাপার! তবে নিহতের কুন্ডলি ঘেঁটে দেখেছেন তিনি। অন্য অনেক খারাপ গুণ থাকলেও, নারী সংক্রান্ত এমন কোনো অতীত রেকর্ড নেই লোকটির। বিস্ময়কর ভাবে এটাই সত্যি, নিজের স্ত্রীর প্রতি গভীর অনুরক্ত ছিল মানুষটি। পারিবারিক গন্ডিতে সে ছিল এক আলাদা মানুষ।

তবে কেন?
কোন বালের জন্য কাউকে এভাবে মেরে ফেলা হল? অস্ফুটে ‘বিশেষণটি’ মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে তার।

কারও আসার শব্দে চিন্তার জাল ছিন্ন হয়।
এস আই জিল্লুর। পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টের কপি টেবিলে রাখে সে। কিছু না বলে তার দিকে তাকান মনোয়ার। নীরবে মাথা নিচু করেন সামান্য। চলে যাবার ইশারা।

এস আই চলে গেলে চিরতার অভিব্যক্তি নিয়ে রিপোর্টটি হাতে নেন। নিস্পৃহ দৃষ্টি ক্রমশ জ্বলে উঠতে থাকে। মৃত্যুর কারণ ওভারডোজ হেরোইন শরীরে ইজেক্ট করা। তবে চেতনা নাশক এমন কিছুও প্রথমে শরীরে প্রবেশ করেছে। ডার্ট-গান জাতীয় কিছু দিয়ে ঘাড়ের ডান পাশে বিদ্ধ করা হয়েছে। তাতে থাকা ক্যামিকেল দ্রুত স্নায়ুকে অবশ করে নির্বাক করে দেয়। অবশ্য ওটার পরিমান বেশী হলেও মৃত্যু ঘটতে পারে।

চমকে গেলেন পরবর্তী বিষয়টি জেনে। পাকস্থলীতে ফেটে যাওয়া ইয়াবার এক প্যাকেটের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে! যেভাবে কুরিয়াররা নিজের শরীরে টেপে
মোড়ানো ইয়াবার চালান নিয়ে আসে, সেরকমই কিছু।

কিন্তু বিস্ময়ের সাথে ভাবেন, নিহত এমন কাজ কখনোই করবে না। এসব কাজের জন্য তার আলাদা লোক রয়েছে।

তবে বসা থেকে প্রায় উঠে গেলেন রিপোর্টের পরের অংশে যেতেই। হেরোইনে বিষ মেশানো ছিল! এটাই যন্ত্রনাকর মৃত্যুর কারণ। সিরিঞ্জে করে শরীরে প্রবেশ করেছে বিষ মেশানো হেরোইন। আবার মুখ দিয়েও অন্ননালী হয়ে পেটে ঢুকেছে।

খুনির নৃসংশতায় ধাক্কা খান ওসি। চোখে ভাসে গতকাল দেখা চেয়ারে বসে থাকা লাশের ছবি। যন্ত্রণায় দেহ মুচরে যেতে চেয়েছে। কিন্তু চেয়ারের হাতলে দুই হাতের তালু পেরেকে বিদ্ধ থাকায় নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টাই করেছে শুধু। বিষাক্ত এবং ওভারডোজ হেরোইন কতটা নিষ্ঠুর ভাবে জীবনকে স্থবির করে
দিতে পারে, জানা আছে তাঁর। সে বেশ আগের কথা।

সব কিছু মিলিয়ে অবস্থা কি দাঁড়ালো? যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন। অস্থির ভাবে এক মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষে পায়চারি শুরু করেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা।

মোটিভ কী হতে পারে? কেন এভাবে কাউকে খুন করা হল? মারতে চাইলে আরো সহজ পথ ছিল। সেদিকে না যেয়ে খুনি কেন এমন নৃশংস পথ বেছে নিলো! কেন? সে কি কোনো ম্যাসেজ দেবার চেষ্টা করেছে? নিজের এত বছরের অভিজ্ঞতা আজ কোনো কাজেই আসছে না বলে মনে হয় ওসি মনোয়ারের। নিজের অজান্তেই কেন জানি এক অশুভ অশনিসংকেত বেজে ওঠে মনের গভীরে।

বেল চেপে কাউকে ডাকেন। নির্দিষ্ট কনস্টেবল এলে, এএসআই হারুনকে আসতে বলেন। এই অবসরে পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টের গোড়া থেকে আরো একবার চোখ বুলিয়ে যান। এমন কিছু বাদ পড়ল কিনা যা চোখে পড়েনি আগে। মনের চোখ।

এএসআই হারুন এলে তাকে পুলিশ স্কেচ শিল্পীর করা সম্ভাব্য খুনির স্কেচগুলো নিয়ে আসতে বলেন। গতকাল অপরাধ স্থলের চা’র দোকানে কথা বলে সাদা পোশাকের পুলিশেরা এক অচেনা আগন্তকের বর্ণনা জেনেছিল। শেষে নিজেদের স্কেচ শিল্পীকে দিয়ে কয়েকটি ছবি আঁকিয়েছে। দেখা যাক, এখান থেকে কিছু পাওয়া যায় কিনা। পুলিশ ডাটাবেজে সংরক্ষিত অপরাধী কারও সাথে চেহারা মিলে কিনা তাও দেখতে হবে।

টেবিলের উপর রাখা চা’র কাপের দিকে এবার মনোযোগ দেন। চিন্তা না করেই এক চুমুক দিলে, ঠান্ডা চা মনটাকেও কেমন বিস্বাদের কটু অনুভবে বিরক্ত করে তোলে। চা’র কাপের দিকে ভ্রু-কুঁচকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। মনের চোখ তখন অন্য কোনো জায়গায়..।
… …
আবাসিক এলাকার শেষ প্রান্ত। রাস্তাটা সব শেষের এই পাঁচ তলা বাড়ির সাথেই এসে শেষ হয়ে গেছে। এটা ডেড-এন্ড। মাঝে রাস্তা রেখে দু’পাশে সারি সারি বাড়ি। নানা রঙয়ের। ভিন্ন ডিজাইনের। এক বর্ণীল ছোট কংক্রিট নগর। এমনই মনে হয় তাঁর কাছে। টপ ফ্লোরে নিজের ব্যালকনিতে বসে অলস সময়ে আশপাশটাকে অনুভবে ছুঁয়ে চলেছেন এক পৌঢ়। অসহ্য অলস অবসর কাটাতেই এই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছেন গত মাসে। একা একজন মানুষ। সামনেও কেউ নেই। পেছনের মানুষগুলি সম্পর্কহীনতার মাঝে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছে। তাই এই একা থাকা। এমনই বলেছিলেন বাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে বাসা ভাড়া নেবার সময়।

হাতে আজকের পত্রিকা। নীরবে চোখ বুলিয়ে যান। বেশ বড় করেই ছেপেছে খবরটা। ইতোমধ্যে একবার পড়েছেন। আরও একবার চোখ বুলানো শুরু করেন। যেভাবে লিখেছে, আসল ঘটনা হয়ত তেমন নয়। সাংবাদিকেরা মূল ঘটনার চেয়ে নিজেদের কল্পনার ডানা অধিক মেলে দিতে পছন্দ করে।

এমন একটা এলাকা যেখানে নাগরিক সমাজ দ্বিধা বিভক্ত। নৈতিকতার ধার কেউ এখন ধারে না। ভাল গুণগুলি ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। সে জায়গা দ্রুত দখল করে নিচ্ছে আমাদের ভিতরে থাকা পৈশাচিকতা। এভাবেই কি আমরা এক একজন পিশাচ মানবে পরিণত হবো এক দিন?

ভাল লাগে না আর। নিজের রুমে চলে আসেন। আয়নার সামনে দাঁড়ান। যে মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে, তিনি কি এমনই? ভিতরের মানুষটা কেমন? আমরা বাহ্যিক চোখে যা দেখি, আসল দেখার ওপারের মানুষটি কি সেভাবেই থাকেন? দেখা আর না দেখার বাইরের বিমূর্ত রুপটি কেমন?

একটা ছিমছাম এলাকা। চর্ম্য চোখে এর অনাবিল সৌন্দর্য ভাললাগায় আপ্লুত করে মন। কিন্তু এই নগরের ভিতরের ছোট্ট নগরটির এমন অনেক কদর্য রুপ রয়ে গেছে যে, মুহুর্তেই বিরুপ মনোভাবে ছেয়ে যাবে যে কারও মন। এখানে রাতের আঁধারে চলে মরণ নেশায় মেতে উঠার মহা উৎসব। বয়সের কোনো সীমারেখা নাই সেখানে। উঠতি বয়সী কিশোর থেকে শুরু করে, মধ্য বয়স্ক কিংবা নারী! ইদানিং হচ্ছেটা কি এসব? এই এলাকাতেই রয়েছে ভদ্রবেশী পতিতাদের অবৈধ কার্যকলাপ। সভ্যতার মুখোশে ঢেকে থাকা এক আদিম সমাজে মুহুর্তেই কেন জানি চলে যাই আমরা সভ্য মানুষেরা। পদস্খলনের নিষিদ্ধ লোবানের আকর্ষণে পা পিছলাতে সময় লাগে না আমাদের। আবাসিক এলাকাগুলিতে প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন সম্মতিতে চলে অবৈধ নেশা সামগ্রীর অবাধ বেচাকেনা। এ এক বিশাল চক্র। কোটি কোটি টাকার ছড়াছড়ি। ভদ্রবেশী সমাজপতিরা অর্থের জোগানদার। ‘করাপ্টেড’ নেতারা রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে সব সামলে নেবার কাজে অতিশয় দক্ষ। দিনে দিনে তারা আরও দক্ষ হয়ে উঠছেন।

এমন এক নাগরিক সমাজে একজন অদক্ষ সাধারণ মানুষ, এক শেষ বিকেলে, রাতের অপেক্ষায় উন্মুখ থাকেন। নির্জনতার খোঁজে কিনা তা জানা যায় না। একেবারে ছাদে চলে আসেন। পাঁচতলার এই বাড়িটির ছাদ পাশের বাড়িটির ছাদের সাথে মিলানো। দু’টি বাড়ির মালিক একজনই। একটা করিডোর রয়েছে। গ্রিল দিয়ে ঘেরা।

আকাশে রংয়ের মেলা। ঈশ্বর তাঁর নিজের মত করে বর্ণে বর্ণে সাজিয়েছেন। অপুর্ব! আকাশের পানে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। কতক্ষণ থাকতেন বলা যায় না। পাশের ছাদে কারও উপস্থিতি তাঁর একাগ্রতা বিনষ্ট করে। ফিরে তাকান। এক মধ্যবয়সী। মাথায় পাকা চুলের আধিক্য বেশী। বেশ সুপুরুষ। অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছেন। প্রথম দেখাতে এমনই মনে হবে যে কেউ দেখলে। তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছেন। কিন্তু সুপুরুষটির চোখ দুটি হাসছে না। বাইরের খোলসটিকে আমরা পরিচ্ছদ আর অভিব্যক্তিতে যতই সাজাবার চেষ্টা করি না কেন, ভেতরে কদর্যতা থাকলে ঠিকই বের হয়ে আসে। চোখ হল সেই বের হবার পথ। মানুষের নিজেকে চেনানোর পথ।

হাসি হাসির জন্ম দেয়। তিনিও মৃদু হেসে অভিবাদন জানান। প্রথম পরিচয়ের মুহুর্ত কাটে নিরব অন্তরঙ্গতায়! দু’জন কাছাকাছি বয়সী মানুষ পরিচয় পর্ব সাঙ্গ করেন এক বেলা শেষের ক্ষণে। কথা হয় তাদের মাঝে আরও দীর্ঘক্ষণ। অতঃপর রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে প্রথম পৌঢ় নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে যান।

চোখ হাসে না এমন সুপুরুষটি, কৌতূহল নিয়ে পৌঢ়ের চলে যাওয়া দেখে। বাইরে তখন বিষণ্ণ সাঁঝের উলুধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ফেরা পাখিদের শেষ সংকেত জানায়।

(ক্রমশঃ)

আগন্তুক:ধারাবাহিক উপন্যাস// পর্ব-১০

FB_IMG_1487255081432
একে তো প্রচন্ড গরম। তার ওপর বাসে প্রচন্ড ভিড়। ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসতেই বাস থেকে নেমে এলো আসাদ। প্রচন্ড জ্যাম। বাসগুলি একইদিকে তিনটা লাইন করে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। বিপরীত দিক দিয়ে যে অন্য যানবাহনগুলি আসবে, সে পথও রাখেনি। তাই কোনো দিক দিয়েই কোনো গাড়ি আসা-যাওয়া করতে পারছে না। সন্ধ্যা নেমে এসেছে বেশ কিছু আগেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে কোনো তারা দেখতে পেল না। আজ আকাশের ও মন খারাপ। কেমন গুমোট হয়ে আছে। তাই গরমটা আজ অনেক বেশী। নিজের মনে হাসে আসাদ। আকাশের মাঝে মধ্যে মন খারাপ হয়। কিন্তু ওর নিজের মন তো সেই গত ছ’মাস থেকেই খারাপ। বাবার থেকে সব সম্পর্ক চুকিয়ে বের হয়ে এসেছে সে ছ’মাস আগে। সেই থেকে এক মন খারাপের বেলাভূমিতে একপ্রকার বন্দী হয়েই আছে সে। সবে আঠারো বছরে পড়ল সে।

আঠারো বছর!
সামনের বাসটির টেইল লাইট জ্বলে উঠতেই সবগুলি বাস-টেম্পু-ট্রাকের গর্জনে কেমন এক উন্মাতাল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যারা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের তাড়াহুড়ায় যার যার গাড়িতে উঠবার ব্যস্ততা দেখে আরেকবার হাসি পায় ওর। শেষে নিজেরও যে উঠতে হবে খেয়াল হতেই ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়া বাসটির দিকে আগাতে যেতেই বাঁধা পায়। কয়েকজন দরজার পাদানিতে ঝুলে রয়েছে। তাদের ঠেলে ভেতরে যাওয়াটা দৃষ্টিকটু এবং ভেতরের অবস্থা জানালা দিয়ে যা দেখতে পেলো, তাতে করে সেখানে ঢুকতে পারলেও সে ঢুকতো না।

আজ বৃহস্পতিবার। তার ওপর শনিবার কিসের যেন এক বন্ধ আছে। সেজন্য গোলামির জিঞ্জিরে বাঁধা সকলে জীবনের ঘানি টানা থেকে কিছু মুহুর্তের মুক্তির আশায় যার যার শেকড়ের টানে ফিরে চলেছে। তাই আজ এত বড় ট্রাফিক।

কিছু না ভেবেই লাফ দিয়ে চলন্ত বাসটির ছাদে উঠার লোহার সিঁড়ি ধরে ফেলে আসাদ। কাঁধে ঝোলানো সাইড ব্যাগ আর অন্য হাতে ছাতাটি দৃঢ় ভাবে ধরে উপরে উঠে যেতে থাকে। ছাদেও বেশ কয়েকজন বসে আছে। তাদের ভেতরে গিয়ে এক কর্নারে বসে পড়ল। কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে। সামান্য সময়ের জন্য এক দমকা হাওয়া ওকে সহ ওপরের সকলের দেহ-মন জুড়িয়ে দিয়ে যায়!

আঠারো বছরে পড়েছে সে। এই আঠারো বছর নিয়ে সুকান্তের একটা কবিতা আছে না? অসহ্য অলস গতিতে বাস থেমে থেমে চলছে। যানবাহনের বিচিত্র আওয়াজ আর মানুষের পারষ্পরিক কথা-বার্তার শব্দ মিলে মিশে এক জগাখিচুড়ি ‘সাউন্ড-সিস্টেমের’ ওয়েভে আশপাশটা ভরিয়ে তুলেছে। কেন জানি মনের ভেতরে ভালোলাগার আমজে ভরে উঠলো। সুকান্তের সেই কবিতাটি নিজের মনে আবৃত্তি করতে থাকে-

‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়–
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা … …’

আবৃত্তি শেষ হলে দেখতে পায়, ওর দিকে কয়েকজন তাকিয়ে আছে। যতই শব্দ হোক না কেন, তার ভেতরেও মানুষের গলার আওয়াজ পাশের মানুষের কানে পৌঁছায়-ই। লোকগুলি হরেকমাল বিক্রী করে। ভ্রাম্যমান ফেরিওয়ালা। ওদের পাশেই যার যার মালামালের গাট্টি। একটু লজ্জা পায় আসাদ। তবে অপরিচিত মানুষগুলির বিস্ময়বোধটুকু বেশীক্ষণ থাকে না। চলার পথে এরা এরকম অনেক কিছু দেখেই অভ্যস্ত। তাই কোনো কিছু-ই তাদের জীবনে বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। কেবল একটা জিনিস-ই তাদের মনে দীর্ঘস্থায়ী হয়। সেটা ক্ষুধার যন্ত্রণা। এই একটা জিনিসের তাড়নায়ই তারা এখান থেকে ওখান, এই দিক থেকে ঐ দিক ছুটে চলে। ঘরেতে অভুক্ত পেটগুলির নিরব চাহনি তাদেরকে এভাবে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

এই যে সে আজ নিজের মেস থেকে এত দূরে এসেছে, তা ও তো ক্ষুধা নিবারণের জন্যই। একজনের কাছে এসেছিল, ওর রুমমেটদের একজন ওকে একটা গ্যারেজে কাজ আছে বলে পাঠিয়েছে। সেখানে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত বসে থেকে থেকে কেবল হয়রান-ই হয়েছে; কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি। মালিক লোকটির শ্যালিকার ছেলের বার্থ-ডে। সেখানেই চলে গেছেন তিনি সেই দুপুর বেলায়। তাই আজকের দিনটা মাটি হলো আসাদের। টুকটাক কাজ যা পায় গত ছয় মাসে সেটা-ই করে নিজের পেট চালিয়েছে। সে কাজগুলির কথা না হয় না-ই ভাবলো।

ইন্টার পরীক্ষাটা আর দেয়া হল না। বাবার সাথে থাকাও হল না, পড়ালেখাও তুঙ্গে উঠলো। আর এখন দু’বেলা খাবারের জন্য ওকে কি কষ্টটা-ই না করতে হচ্ছে। অথচ ওকে ননীর পুতুল বললেও কম বলা হবে।

একই জায়গায় পঁচিশ মিনিটের মত দাঁড়িয়ে থাকার পর অস্থির হয়ে আরো কয়েকজনের সাথে বাসের ছাদ থেকে নামতে উদ্যত হয় সে। বসা থেকে উঠতে গিয়েই সাইড ব্যাগটির বেল্টের জয়েন্ট ছিড়ে যায়। মনটা আরো তেঁতো হয় ওর। এখন হেঁটে যেতে হবে। আর এই সময়-ই কি না ব্যাগটাও ছিড়ে গেলো। কি আর করা। ওর পাশের লোকটি তার মোবাইলের আলো জ্বেলে ওকে সাহায্য করলো। কোনোমতে ব্যাগের কাপড়ের হাতলের সাথে শক্ত করে বেঁধে নিলো। কোনো মতে কাঁধে নেবার ব্যবস্থা করে ছাতা হাতে ধীরে ধীরে বাস থেকে নেমে আসে। ঠিক এই মুহুর্তে ওকে দেখলে যে কেউ একজন বিয়ের ঘটক-ই মনে করবে ওকে। রাহেলাপু যদি দেখত!

অন্যদের সাথে একেবারে ফুটপাত ঘেঁষে হেঁটে চলার সময় নিজের দিদির কথা মনে করে হৃদয়ে এক প্রচন্ড ব্যথার জন্ম হয়। কেমন আছে দিদি এখন?

নিজের মেসে যখন ফেরে আসাদ, তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘন্টাখানিকের মত কেবল হাঁটতেই হয়েছে ওকে। পায়ের দু’জায়গায় ছড়ে গেছে স্যান্ডেলের নিচে। পরিশ্রান্ত দেহে যখন মেসের ঘুমন্ত বাকীদেরকে জাগিয়ে রুমে প্রবেশ করল সে, তখন দেহ-মন কেমন এক বিবশ শ্রান্তিধারায় নুয়ে পড়বে পড়বে করছে। দরজা খুলেছেন শিপন ভাই। ওকে দেখে চোখ কচলে বলে ওঠেন-
‘ এতো রাতে আসলা? আমরা তো মনে করছি আজ আর আসবা না। খাবার তো কিছু-ই নাই। কেমন ব্যাপার হলো দেখতো।‘
‘ আপনি চিন্তা করবেন না শিপন ভাই। আমি আসার পথে কিছু খেয়েছিলাম। ক্ষুধাও তেমন নাই।‘

মিথ্যা বলার জন্য নিজের ভেতরে একটু খচ করে উঠলেও এই ভালোমানুষটির লজ্জিত মুখ দেখে আসাদের কেমন মায়া লাগে। তাই মিথ্যা বলতেও সে কুন্ঠিত হয় না। এই লোকটি-ই ওকে বিপদের দিনে আশ্রয় দিয়েছেন। না হলে আজ মাথার নিচে এই ছাদটুকু-ই বা সে কোথায় পেত। সে অনেক লম্বা কাহিনী। এখন সেটা নিয়ে ওর ভাবতে ইচ্ছে হলো না। পেটের ভেতরে সর্বগ্রাসী ক্ষুধার আগুন। শরীরে নাই একফোঁটাও জেগে থাকার শক্তি। ঘুম আর ক্ষুধা মিলে ওকে কেমন নেশাতুর করে ফেলতে চায়। নিজের শরীরের মাপের চৌকিটায় গিয়ে সটান শুয়ে পড়ে। অন্ধকারে ছারপোকারা এসে ওকে ঘিরে ধরে। একটুও টের পায় না সে। ধীরে ধীরে চোখ বুজে আসতে চায়। কতক্ষণ এভাবে পার হয়েছে বলতে পারবে না। দরোজায় মৃদু আঘাত। আসাদের ঘুম খুব পাতলা সেই বাবু বেলা থেকেই। নিঃশব্দে উঠে দরজা খোলে। করিডোরের পঁচিশ পাওয়ারের আলোয় মধ্যরাতের এক নারীর মুখ দেখতে পায়। প্রথমটায় সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তবে কয়েক মুহুর্ত কেটে গেলে ওদের বিপরীত পাশের রুমের ভাবীকে দেখে একটু অবাক হয়। ওদের এই মেস বাড়িটি ব্যাচেলর এবং ফ্যামিলি মিলিয়ে মিশিয়ে ভাড়া দেয়া হয়েছে। আসাদদের পাশটা সব ব্যাচেলর। লম্বা এইচ টাইপের বিল্ডিং। ওপর পাশে ফ্যামিলি কোয়ার্টার। কোয়ার্টার মানে এক রুমের বাসা। ভেতরে টয়লেট। ব্যস, এই-ই। প্রতি পাঁচটি রুমের জন্য আলাদা রান্নাঘর। আর ব্যাচেলরদের জন্য রান্না করার বুয়া রয়েছে। এভাবেই চলছে হাবিব সাহেবের এই মেস-বাড়ি।

ভাবী এক ছেলে নিয়ে একা-ই থাকেন। তার হাজবেন্ড প্রচণ্ড নেশাখোর একজন মানুষ ছিলেন। নেশা করে এসে প্রায় রাত-ই ভাবীকে মারধোর করতো। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজে পাশের অন্য রুমগুলির মানুষেরও রাতের ঘুম নষ্ট হতো। এভাবে আর কতদিন সহ্য করা যায়। শেষে বাড়িওয়ালার হস্তক্ষেপে ভাবী তার স্বামীকে ডিভোর্স দেয়। নিজে পাশের একটা পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়ে একমাত্র ছেলে সহ এক অন্য ভূবনের বাসিন্দা হন। মরিয়ম ওনার নাম।

আসাদ মরিয়মের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এত রাতে? কোনো সমস্যা ভাবী?’
– নাহ, সমস্যা না। তোমাদের কথা শুনলাম তো। কিছু খেয়ে আসনি, তাই তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে এলাম।

ওনার হাতে একটা প্লেটের ওপর আর একটি দিয়ে ঢাকা। সেটা আসাদের হাতে তুলে দিয়ে চলে যাবার জন্য ঘুরে বলেন,
– তুমি খেয়ে নিও। সকালে এসে আমি নিয়ে যাব।

ভাবীর চলে যাওয়া দেখে আসাদ। এক যুবতী নারী আঠারো বছরের এক যুবককে খাবার দিতে এসেছে এক মধ্যরাতে। ভাবীর পেছনটা দেখতে দেখতে কেমন যেন এক বিহবলতায় আবিষ্ট হতে থাকে সে। ওর ভেতরের আঠারো বছরের পৌরুষ মুহুর্তে ওকে এক কঠিন পুরুষে পরিণত করে তুলতে চায়! ভাবী নিজের রুমে ঢুকবার আগে কেমন করে যেন ওর দিকে তাকায়। তাতে আরো জ্বলে ওঠে আসাদ। ওর ভেতরে ভাঙাচুরার খেলা চলে। ভাবের ক্রমশঃ উষ্ণতর সোপান থেকে আরো উর্ধতর সোপানে সে পারদের উর্ধগমনের মত উঠে যায়। হাতের থালার দিকে চোখ পরতেই অন্য এক অনুভবে প্রগলভ হয়ে উঠে সে। নিজের দিদির কথা মনে পড়ে। কত রাতে দিদিও ওকে এভাবে ঘুম থেকে জাগিয়ে বিছানায় খাবারের থালা নিয়ে পাশে বসে ওকে খাইয়েছে। ভেতরের পৌরুষের জ্বালা-পোড়া নিমিষে দূর হয়। সেখানে এখন এক বালকসুলভ অনুভূতি শান্ত এক নদীর জলে অবগাহনের অনুভবে আসাদকে শীতল করে তোলে।

নিজের মনে হেসে মেস রুমের দরজা বন্ধ করতে করতে সে ভাবে, ‘পুরুষ মানুষ কেবল গরম হতেই জানে। নারী আর নির্জনতা দুই-ই পুরুষকে কামাতুর করে তোলে। অথচ নারী যখন মা, বোন কিংবা মেয়ের রুপে এই একই নির্জনতায় পাশে থাকে, তখন পুরুষ বালক হয়ে যায়। কেবল এই তিন রুপের ভিন্নতায় একজন বালকও সাহসী পুরুষে পরিণত হয়।‘

(ক্রমশঃ)

আগন্তুক: ধারাবাহিক উপন্যাস// পর্ব-৯

FB_IMG_1487255081432
চিন্তা-ভাবনায় বিভোর মৌণ সময় কখন নিজেই যে ক্লান্ত হয়ে মহাকালের কোলে আশ্রয় নেয়, সময় নিজেও জানে কি? রাহেলা নামের মেয়েটি বাসের দুরন্ত গতির সাথে তাল মিলিয়ে ভাবনা-চিন্তার অলস মুহুর্তগুলিকে পাশ কাটিয়ে কখন যেন নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বাসটা থেমে যেতে এবং ওর পাশের সিটের সহযাত্রীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। কক্সবাজার এসে গেছে। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা বিবশ মনের এলোমেলো মুহুর্তগুলি কাটে কয়েক পলক। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে পাশের যাত্রিটি নেমে গেলে রাহেলা খেয়াল করে সে একা-ই রয়ে গেছে।

নিজের যৎসামান্য মালামাল হাতে নিয়ে নামার জন্য সিট সংলগ্ন করিডোরে পা রাখে। লাগেজ বাসের বক্সে রয়েছে। সেটার ট্যাগ পার্স থেকে বের করে হাতে নেয়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। এখান থেকে রিক্সা বা টমটমে করে ওর ‘বুক’ করা হোটেলে যেতে হবে। কি যেন নামটা হোটেলের?

নামটা মনে আসার আগেই জানালা দিয়ে আরো একবার তাকাতে-ই হোটেলটাকেই দেখতে পায়। চমৎকার সোনালী হরফগুলি মেটাল পালিশের কল্যাণে ঝকঝক করছে। সকালের সোনারোদ পড়ে সেটা আরো ঝলমলে লাগল ওর চোখে। কিন্তু বাস তো সরাসরি ওর-ই রিজার্ভ করা হোটেলের সামনে আসার কথা না।
বাবা! বাবার অপচ্ছায়া আবারো অনুভব করলো সে। এই লোকটি সব সময়ে-ই ওর আশেপাশে আছেন।

‘এটা-ই কি থাকার কথা নয়?’- নিজের প্রশ্নে একটু কি সংকুচিত হয়?

কিন্তু পরক্ষণেই অনেক আগে দেখা একটা ছবি ভেসে ওঠে মনে। নিজের জননীর মৃতদেশের পাশে বসে থাকা বাবা। বীভৎস মায়ের চেহারাটা আজো ওর মনে ভাসে। চোখ ঠিকরে বের হয়ে আছে… গলার কাছটায় কালচে-নীল দাগ… বাবার বেডরুমে ওনারা দু’জন-ই ছিলেন। তখন রাহেলার কত-ই বা বয়স। তবে মনে রাখার মত একদম কমও ছিল না। আসাদ তখন কোলের শিশু।
মা হারা দু’সন্তানের জন্য বাবার স্নেহ-ভালোবাসার কমতি কখনো অনুভব করে নাই ওরা দু’ভাইবোন। কিন্তু মনের ভেতরের মনের আরশিতে নিজের জননীর মৃত চেহারাটা রাতের পর রাত ভেসেছে… বাবা মাকে মেরেছেন… এমন অনুভূতির চেয়ে ‘কেন’ এই প্রশ্নটা-ই বার বার জেগেছে। কিন্তু না পেরেছে বাবাকে জিজ্ঞেস করতে, না পেরেছে ভুলে যেতে। এমন চরম মানসিক সংকট নিয়ে নিজের ভূবনে ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে ওরা দু’জন বেড়ে উঠেছে। প্রচণ্ড প্রাচুর্য্যের ভেতরে থেকেছে… ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও ওদের দুই ভাই-বোনের ভেতরে ছিল একদম সাদাসিদা মনোভাব। মায়ের মত এক সরল জীবনের প্রত্যাশায় ভেতরের মানুষ দু’জনের হৃদয় চাতকের মত তৃষ্ণার্ত ছিল। এখনো আছে। তবে রাহেলার অনুভূতির সমস্যার শুরুটা ওর সেই ছেলেবেলায় দেখা ঐ দৃশ্যটির পর থেকেই। ধীরে ধীরে যা বেড়েছে… বাবা দেশের বাইরের সব নামকরা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে দেখিয়েছেন। কোনও লাভ হয় নাই। কারণ মনের আসল কথাটা-ই রাহেলা কখনো-ই কাউকে জানায় নাই। জানতেও দেয় নাই। নিজের অবচেতন মনের চেতন অংশকেও বুঝতে দেয় নাই সে কি ভাবছে।

সেই বাবার থেকে দূরে দূরে যতই থাকতে চেয়েছে, ক্ষমতাধর মানুষটার ক্ষমতার হাত ক্রমশঃ ওর দিকেই এসেছে কেবল। ছোট ভাই আসাদ যদিও এক বছর হলো ওকে আর বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে। নিজের মত করে জীবনকে দেখবে বলে নিজের আলাদা ভূবনের বাসিন্দা হয়েছে সে। বাবাও অমত করেন নাই। আর আসাদের এই চলে যাবার পেছনে রাহেলার এক অসতর্ক মুহুর্তের কথোপকথনই দায়ী। কিভাবে যেন মায়ের মৃত্যুর পেছনে বাবার হাত রয়েছে কথাটা ওর মুখ দিয়ে বের হয়ে এসেছিল। ওটাই ছিল চলে যাবার মূল ইস্যু। কিন্তু বাবার ন্যাওটা ছেলেটি সম্পুর্ণ ভিন্ন কারণ দেখিয়ে প্রিয় মানুষটির থেকে দূরে সরে গেলো।

‘আপনার লাগেজ ট্যাগ টা কি দিবেন?’- বাসের সুপারভাইজারের কথায় বাস্তবে ফিরে আসে রাহেলা। চোখের ওপরে কয়েকগাছি চুল এসে পড়েছে, সেগুলি ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে জায়গামত ফেরত পাঠিয়ে সুপারভাইজারের দিকে তাকায়। কয়েকমুহুর্ত চুপ থেকে বলে,
– বাস তো এখানে থামার কথা নয়। এই হোটেলেই কি সব সময় বাস থামান আপনারা?’

চৌকশ সুপারভাইজার উত্তর দেয়,
‘আসলে আমাদের একজন গুরুত্বপুর্ণ যাত্রী এই হোটেলে উঠবেন, তিনি এখানে নতুন এসেছেন বিধায় আমাদের ম্যানেজারের ফোনেই তাকে এখানে নামিয়ে দেয়া।‘
– ও, আচ্ছা। বেশ ভালো সার্ভিস আপনাদের।

সুপারভাইজার হেসে নিজের প্রত্যুৎপন্নমতির গর্বটুকু বেশ উপভোগ করে মনে মনে। কিন্তু রাহেলার পরবর্তী কথায় ওর মনের হাসিটুকু নিভে যায়,
– এই নিন ট্যাগ। … আর শুনুন, মিথ্যা কথা আমি একদম পছন্দ করি না। তাছাড়া মিথ্যা বলাটাও একধরণের আর্ট। এই আর্ট বা শিল্পকলা আপনার ভেতরে একদম-ই নেই। তাই অহেতুক মিথ্যে বলার চেষ্টা করবেন না।

সুপারভাইজার বিব্রত বোধ করে। কিন্তু সামনে এগিয়ে হেল্পারের হাতে লাগেজ ট্যাগ দিয়ে বাস থেকে নেমে যেতে উদ্যত হয়। পরক্ষণেই কাঁচ ভাঙ্গার শব্দে হেল্পার, ড্রাইভার এবং সুপারভাইজার শব্দের উৎসমুখে তাকায়।

রাহেলা নিজের পায়ের হিল খুলে বাম পাশের একটা জানালার কাঁচ ভেঙ্গে দিয়েছে। জুতো পায়ে দিয়ে বেশ সপ্রতিভ ভাবে বাস থেকে নেমে যেতে যেতে সুপারভাইজারের উদ্দেশ্যে বলে,
– আপনাদের আতিথেয়তার জবাব এটা। পুরষ্কারও বলতে পারেন। আপনাদের সেই গুরুত্বপুর্ণ যাত্রীটির পেছনের মহাগুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তির কাছ থেকে এর ক্ষতিপূরণ নেবেন? না আমি-ই দিয়ে যাব?

রাহেলার প্রশ্নে অবাক সুপারভাইজার এবং ড্রাইভার একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুপারভাইজার জানায়,
‘জি না, তার দরকার পড়বে না। আপনি যেতে পারেন।‘
– ধন্যবাদ আপনাকে।

নেমে যেতে উদ্যত হতেই অচেনা পুরুষটি যে সিটে বসেছিল, সেখানটা পার হবার সময় অতি পরিচিত এক সৌরভে উদ্দীপ্ত হয় রাহেলা! প্রিয় একজনের স্মৃতিতে উদ্বেলিত এক যুবতী কিছুটা অনুভবে প্রগলভ হয়ে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবে, ‘নাহ! এটা মনের কল্পনা ছাড়া আর কি? সে এখানে!! কিভাবে?’

নিচে নেমে হেল্পারের হাত থেকে নিজের লাগেজটি নিয়ে হোটেলের মেইন গেটের দিকে এগিয়ে যায় রাহেলা।

হেল্পার ওপরে উঠে নিশ্চুপ সুপারভাইজার এবং ড্রাইভারকে দেখতে পায়। সুপারভাইজার ড্রাইভারকে বলে,
‘ দেখলেন ওস্তাদ, ব্যাপারটা কেমন হইলো? সব কিভাবে বুঝে ফেললো!!’
– হ্যা, দেখলাম। কঠিন মাইয়ামানুষ।
‘ হুম… কঠিন কঠিন মানুষেরা কিভাবে এর ব্যাপারে বার বার বলে দিছে, খেয়াল করেন নাই? হাইওয়ে ইনে চারজন এলো। আমাকে ডেকে কি করতে হবে সব বুঝিয়ে দিলো।‘
– বাসের ভেতরেও একজন ছিল। সিগ্রেট টানার সময় আমারে বললো যে, এই মেয়ের মাথায় গন্ডগোল আছে, একটু ভালোভাবে খেয়াল রাখতে।

ভাঙ্গা জানালার কাঁচের এক অংশ দিয়ে বাইরের মানুষ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে সুপারভাইজারের স্বগতোক্তি,
‘ মাথা খারাপ না হলে কে এমন কাজ করে!’

(ক্রমশ)

আগন্তুক: ধারাবাহিক উপন্যাস// পর্ব-৭

FB_IMG_1487255081432
পুকুর পাড় ঘেষে পায়ে চলা দুটি মেঠো পথ চলে গেছে। ডানদিকেরটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল ও কলেজের সামনে দিয়ে পিচের পথে গিয়ে মিশেছে। বামেরটি দু’পাশে নাম না জানা ঝোপকে পাশ কাটিয়ে ঘন জঙ্গলের ভেতর সামান্য এক না দেখা রেখ রেখে আঁধারে হারিয়েছে। এই বেলা শেষের অবেলায় আহসান সেই আঁধারের পথ ধরে হেঁটে চলেছে। দুর্ভেদ্য মানবমনকে সাথে নিয়ে এক নামানুষ নিজের একচিলতে আলো বিসর্জন দিতে চলেছে। এভাবেই প্রতিদিন… জীবনের দিন… দিন দিন প্রতিদিন… দিয়েই চলেছে। তবে তার বিসর্জনের সময় কোনো সন্ধ্যা আরতির সুর ভেসে আসে না। থাকে না কোনো উলু ধ্বনি কিংবা বিষণ্ণ নারীদের চোখের চকমকে আভা। এই জঙ্গলের এক নির্দিষ্ট জায়গায় ওদের আড্ডা। আড্ডা না বলে কয়েকজন অন্ধকারের জীবদের পারষ্পরিক মন্দ-লাগার অনুভবে প্রগলভ হয়ে ওঠা, কিছু কর্কশ ক্ষণকে উপভোগ করার কথা বললে কিছুটা সত্য বলা হবে। আজকাল সত্য কতটা সত্যি হয়ে প্রকট হয়? নিজের মনে ভাবনার এই অংশে এসেই অদূরে মাচার ওপর রায়হানকে দেখতে পায় আহসান। হৃদয়ে এক ভালোলাগা জেগে ওঠে। এই আঁধারে ওরা সাতজন জীব। যাদেরকে আশেপাশের সবাই এই ‘জীব’ই মনে করে। মানুষ হতে পারেনি ওরা কেউ এখনো। তাই মানুষের সমাজে থেকেও নিজেদের জন্য ওরা বেছে নিয়েছে এক ছায়াজীবন।

‘ কিরে বাইঞ্চোত! আমার আগেই চলে এলি?’ আহসানের কথার উত্তরে ওর দিকে তাকায় রায়হান। প্রিয় বন্ধুকে দেখে। ওর মনেও ভালোলাগা দোলা দেয়। দাঁত না দেখিয়ে নিঃশব্দে হাসে। উত্তরে ওর ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ এভাবেই বের হয়-
‘ হুম…। …গির পোলা তোর না আমার আগে আসার কথা। ফোন দিবি বলছিলি, দিছিস?’
– স্যরি দোস্ত! আমার মোবাইলে ব্যালেন্স ছিল না।‘
‘ কবেই বা তোর ছিল?’

দু’বন্ধু মাচার নিচে বেঞ্চের মত করে বানানো বাঁশের মাচায় বসে। উপরে-নিচে এরকম বসার জায়গা বানানো। তিনটা আম গাছকে ঘিরে এই আড্ডাস্থল। নিজেদেরই বানানো। এই সাতজন ভিন্ন বয়সী নামানুষের ভেতর একজন রয়েছে, সে কাঠের কাজ জানে। সে-ই বানিয়েছে। আহসান পাশে বসতেই রায়হান জিজ্ঞেস করে,
‘ মাল কার কাছে?’
– জাহিদের আনার কথা আজ।
একটু বিরক্ত হয় রায়হান। ওর ভ্রু’র কোঁচকানো দেখে আহসান। একটু হাসে নিরবে। ওর এই বন্ধুটি অপেক্ষা করতে একটুও পছন্দ করে না। আর আজ এই জিনিসটাই অনেক্ষণ থেকে করতে হচ্ছে তাকে। প্রসঙ্গ ঘোরাতে রায়হানের কাঁধে হাত রাখে। জিজ্ঞেস করে, ‘ নারিকেলের ছুবা তোর আনার কথা ছিল। এনেছিস?’ কথা না বলে নিজের টি-শার্ট ওপরে তুলে দেখায়। একপলক দেখে আহসান। এরপর দু’বন্ধু আশপাশের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে খানখান করে দেয় ক্রমশঃ বাড়তে থাকা হাসির এক একটা তীব্র ওয়েভে। রায়হান ওর কোমরে বেল্টের পরিবর্তে নারিকেলের তৈরী দড়ি ব্যবহার করেছে। একই সাথে বেল্ট এবং আগুন ধরাবার কাজে ‘ছুবা’র কাজও করবে।

ইতোমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে। এই ঘন জঙ্গলের সরীসৃপ জাতীয় প্রানীগুলোও এই সাতজনের শরীরের ঘ্রাণ চিনে। পারতপক্ষে ওগুলিও এই জায়গাটিকে এড়িয়ে চলে। যেভাবে সমাজের ‘ভদ্র মানুষগুলি’ এড়িয়ে চলে সেভাবে নয়। সরীসৃপদের ভেতরে ভয় এবং কিছুটা মমতার মিশেলে দূর্বোধ্য একটা কিছু থাকে। তবে ভদ্র মানুষদের ভেতরে কেবলি ঘৃণা থাকে। তাই এই সাতজন নামানুষ সবসময়েই ভদ্র লোকদের আবাসভূমি এড়িয়ে চলে। যদিও ওদের পরিবারের বাকীরা সেই সমাজে বাস করেন। এরা যার যার পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন… আউটসাইডার! দু’জন অন্ধকারের জীব আরো পাঁচজন জীবের আগমনী বার্তা শুনবার অপেক্ষায় বড্ড উন্মুখ হয়ে থাকে। এদের পরিচয় যথাসময়ে জানা যাবে।
… … …

জাহিদ অরুণাপল্লীর একটু উপরের ঢালের কাছে ভ্রাম্যমান পুলিশ দলের চেকিংয়ের সামনে পড়ল। কলমা থেকে রিক্সায় এই পর্যন্ত ভালোই এসেছিল। সি এন্ড বি পার হলেই এমএস হলের সামনের ভার্সিটি গেট দিয়ে ঢুকে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু তার আগেই বিপত্তি। পকেটে জিনিস। ইদানিং এই এলাকায় পুলিশের নজরদারী একটু বাড়াবাড়ি রকমের দৃষ্টিকটু।

দৃষ্টিকটু? হাসি পায় ওর। হ্যা, অন্ধকারের বাসিন্দা সে। ওর কাছে দৃষ্টিকটু বৈকি! ভাবনায় পলকের তরে আশপাশ সহ সবকিছু বিস্মৃত হয় সে। তাই হাবিলদারের প্রশ্ন প্রথমে সে শুনতে পায় না। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একটা মোটরবাইকের হর্ণের আওয়াজে ওর সম্বিত ফিরে। ওর দিকে তাকিয়ে হাবিলদার দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করে,
‘ আপনাকে নামতে বলেছি আমি।’ রিক্সা থেকে নামতে নামতে বলে জাহিদ,
– স্যরি, আমি শুনতে পাইনি।
উত্তরে কিছু না বলে আবারো হাবিলদার জানতে চায়,
‘ কোত্থেকে আসছেন? ‘
কি বলবে ভাবে জাহিদ। এরা চেক করতে পারে, আবার না ও করতে পারে। তবে সে সত্যি কথাটাই বলবে মনঃস্থির করে। অকপটে জানায়,
– কলমা থেকে আসছি। গাঁজা কিনতে গেছিলাম।

পকেট থেকে নিজেই চারটা পঞ্চাশের ছোট পোটলা বের করে হাবিলদারের দিকে বাড়িয়ে ধরে। টহল পুলিশের বাকী সদস্যরা হাবিলদারের দিকে তাকায়। হাবিলদার একটু ধান্দায় পড়ে যায়। এভাবে সরাসরি কেউ বলে না সাধারণত। সে কি করবে ভাবতে কিছুটা সময় নেয়। পাশ দিকে হেঁটে যাওয়া সাধারণ মানুষ কৌতুহলী হয়ে উঠছে। তবে কেউ থামছে না। এরা এরকমই। দূর থেকে দেখবে, মজা নেবে, তবে কাছে আসবে না। পুলিশ বলে কথা। হঠাৎ হাবিলদারের মনে হয়, পুলিশ বলে এরা আসে না সেটা ভয়ে না ঘৃণায়? তবে উত্তরটা জানার আগেই তার ভিতরের কর্তব্যবোধ মাথাচাড়া দেয়। আইন বলে একে ছাড়া যাবে না। আবার সে যেখান থেকে পুরিয়াগুলি সংগ্রহ করেছে, সেখানের বিক্রেতাকেও আইনের আওতায় আনতে হয়। কিন্তু সে জানে এটা সম্ভব না। আইনের ফাঁক ফোকর গলে সিস্টেমের ভেতরের অসাধু মনোভাবে লালন হওয়া কিছু কর্তা ব্যাক্তিদের অর্থলিপ্সু মনোভাব আর প্রভাবশালীদের পদলেহন মনোবৃত্তির জন্য অপরাধের মূল পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব না। বিনাশ তো বহু দূরের কথা। সাথে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র নেতারা তাদের কর্মীদের ব্যাপারে বড্ড সচেতন। এই যুবকটি তাদের কেউ একজন কিনা কে জানে। ধরে নিয়ে গেলে মোবাইলের পর মোবাইল আসবে। অনেক ভেজাল। আবার ছাড়তেও মন চাইছে না। কিছু টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া যায়। তবে তাতেও অনেক ভেজাল। নিজের উর্দির ভেতরের সাধারণ মানুষটা আজো মরে নাই। তাই হাবিলদার কষ্ট পেতে থাকে। শেষে বলে,
‘ আপনাকে ধরে নিয়ে যাবার পরে অনেক ফোন আসবে। তার চেয়ে এখনই ফোন করান কাউকে দিয়ে, আপনাকে ছেড়ে দেই।’

জাহিদ অবাক হয়। পকেট থেকে মোবাইল বের করে.. তখনও অবাক ভাবটা কাটে না ওর। ভাবে পুলিশটা কি মজা করছে ওকে নিয়ে।

হলে নিজের রুমে বসে কালকের প্রোগ্রাম নিয়ে ভাবছেন তিনি। সেই সাতজন অন্ধকারের জীবদের ‘ ভাই’। বেকার এই ছেলেদেরকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে খাটান, কাজে লাগান। তবে নিজের রাজনৈতিক খোলসের বাহিরে বের হলে একজন মানুষ হিসাবে তিনি তার হৃদয়ে ওদের জন্য মমতাও অনুভব করেন। আর রায়হান ওনার স্যারের ছেলে। ভার্সিটিতে তার শিক্ষক ছিলেন রায়হানের বাবা। টেবিলের ওপর চার্জে রাখা মোবাইলের রিং টোনের শব্দে বিরক্ত হন। অনিচ্ছা সত্তেও মোবাইল হাতে নেন। চার্জারের পিন আলাদা করতে করতে ভাবেন, ‘ ইচ্ছা অনিচ্ছায়ও নেতাদেরকে অনেক কিছু করতে হয়’। ডিসপ্লেতে জাহিদের নাম দেখে একটু আগের কুঁচকানো ভ্রু আরো বেঁকে যায়, তবে মনটা আনন্দের এক পল্কা হাওয়ায় জুড়িয়ে দিয়ে যায়। নেতারা এমনই। তাদের বুঝা দায়। তারা যেভাবে দেখান, ভেতরে আসলে তেমন তারা নন। কল রিসিভ করেন। ওপাশের কথা শুনেন। শেষে বলেন,
‘ তোরা আর শুধরাইলি না। কতটুকু গাঁজা? ‘

হাবিলদার কথা শেষ করে জাহিদের হাতে মোবাইল ফেরত দিয়ে দেয়। মাছি তাড়াবার ভংগিতে জাহিদকে চলে যেতে বলে। রিক্সায় ওঠে জাহিদ। রিক্সাওয়ালা এতক্ষণ পরে স্বাভাবিক হয়। বিপদ কেটে গেছে টের পায়। নিম্নশ্রেণীর অনেক প্রাণীর মত এই বিত্তহীনেরাও আগাম অনেক কিছু অনুভব করে। সেটা ঐ প্রানীকূলের মত একই ক্লাশের বলেই কি?
টহল পুলিশের যার হাতে পুরিয়া চারটি সে ওদের হাবিলদারকে জিজ্ঞেস করে,
‘ ওস্তাদ, এগুলা কি করবো?’
হাবিলদার জাহিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ কি আর করবি, যার মাল তাকে দিয়ে দিবি।’

আর দাঁড়ায় না সে। সামনের দিকে হাঁটা দেয়। পুলিশ কন্সটেবলটি পুরিয়াগুলি জাহিদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে কঠিন চোখে তাকায়.. যেন নিরবে বলতে চায়, ‘ পরের বার.. ‘। জাহিদ বাংলা পাচের মত মুখ করে মালগুলি হাতের মুঠোতেই রেখে দেয়। রিক্সা ক্যাম্পাসের দিকে আগায়। চকিতে জাহিদ ভাবে, অনেক দেরী হয়ে গেল, রায়হান এতক্ষণে চেইতে ফায়ার হয়ে আছে। তবে আজ যে মাল সে এনেছে, ঘ্রান শুকেই রায়হান সব রাগ ভুলে যাবে। জীবনের সময়গুলো এই সাতজনের জন্য এখন কেবলি একটু ভালো গাঁজার সন্ধানে ব্যাপৃত হওয়াতেই সার্থকতা খুঁজে বেড়ায়। অথচ অন্যরকম ও হতে পারত! পড়ন্ত বেলায় রিক্সায় বসে নিজের অদৃশ্য ছায়ার পানে তাকিয়ে থেকে এক আঁধারের জীব আরো অন্ধকারের অপেক্ষায় থাকে। রিক্সাটি ততোক্ষণে এমএস হলকে ছাড়িয়ে দু’ পাশের গাছগুলির মাঝ দিয়ে বয়ে চলা কালো পিচের বুকের ওপর দিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে এগিয়ে যায়।
… … …

রায়হান ক্রমশ: উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। আহসান ওর নাকের ওপরটা লালচে এবং ঘামে ভেজা দেখতে পেয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে না। ও জানে কি করতে হবে। গাঁজায় যদিও ‘উইথড্রয়াল সিম্পটম’ নেই, কিন্তু অনুভূতির গভীরে লুকানো মনের প্রতিদিনের সময়ের নিরবচ্ছিন্ন চাহিদা, এই সিম্পটমের থেকেও ভয়ানক। নিশ্চুপ থাকে আহসান। এই সময়ে নিরবতাই ভালো ফল এনে দেয়।

রায়হান বাবা- মা আর ভাইয়ের সাথে পাশেই থাকে। ওর বাবা এই সাথের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বাবার কথা মনে হতেই চোয়ালের দু’পাশ শক্ত হতে থাকে। জেদ?
জনকের প্রতি অভিমান?
অতিরিক্ত ভালোমানুষ বাবার নিরপেক্ষ ভূমিকা দেখে নিজের ভিতরের চাওয়াগুলোর পূরণ না হওয়াতে তৈরী হওয়া ভালোবাসায় মাখামাখি নিরন্ত অভিমানে কুহকী প্রহর গোনা?

সে, আহসান আর জাহিদ ভিন্ন সাবজেক্ট নিয়ে এখান থেকেই স্নাতোকোত্তর করেছে আজ দু’ বছর হলো!
‘ ওহ মাই গড!’ বলেই উঠে দাড়ায়। ‘ দুই বছর?’ বলে আবার আগের জায়গায় বসে পড়ে। আহসান অবাক হয় না। হয়.. এরকম প্রায়ই ওদেরকে শুনতে হয়। ওরা বুঝে। তবে বাবা- ছেলের মাঝে কখনো দূরত্ব এনে দেয়, এমন কিছুই এরা করে না, কেবল নিশ্চুপ থাকে। আর তাতেই অনেক কিছু প্রকাশ পায়। রায়হান কিংবা দিন দিন প্রতিদিন এক একজন রায়হানের জায়গাটা দখল করে। অভিযোগ বুকে নিয়ে পাল্টা অভিযোগগুলিকে ধরাসায়ী করতে এরা বড্ড সিদ্ধহস্ত।

‘ মাদারচোদ কি করে এতক্ষণ। শালায় মোবাইলটাও অফ করে রাখছে কেন? এবার আক্ষরিক অর্থেই সে ফেটে পড়ে।
– মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে মনে হয়।
আহসান উত্তর দেয়। ভ্রু- কুঁচকে রায়হান যখন কথা বলে ওকে বড্ড বাবু বাবু দেখা যায়। আহসান একটা বাবুর প্রতি অপার মায়ায় জড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। এই মায়া একদিনে হয়নি। ওরা এই সাতজন নেংটাকালের বন্ধু। সময়ের ঘ্রাণে জড়ানো অনুভূতিতে মেখে মেখে ওরা বন্ধু হয়েছে। একদিন বা কিছু দিনে নয়।
রায়হান বলতে থাকে,
‘ বালের মোবাইল ইউজ কর তোমরা, নাহ? তোমার ব্যালেন্স নিল থাকে সবসময়, আর ঐ…উয়ার পো’র চার্জ থাকে না।’
– ওর না, ওর মোবাইলের।
গম্ভীরভাবে আহসান শুধরে দেয়।

ঝি ঝি পোকা ডাকছে? রায়হানের এমন মনে হয়। আবার বাবার কথায় ফিরে যায়। একার সাথে একার কথা বলার এক অদ্ভুত রোগ এই সাতজনের। ব্রেইনের কোষে কোষে অনুভূতিদের নিজেদের ভেতরে যে অনুভব অনুভূত হয়, সেখানে অনেক আলোচনায় অংশ নেয় এরা যার যার মত। বাবা চাননি এখানে তার পরিচয় ব্যবহার হোক.. তার ছায়ায় ছেলে বড় হোক। বাবা কি চেয়েছিলেন ছেলে নিজের মত করে তার থেকেও বড় হোক? সবসময় বড়-ই বা হতে হবে কেন? বাবা কোনো সুপারিশ করলেন না কিংবা লাখ দশেক টাকাও দিলেন না। বছরগুলি পিতা- পুত্রের নীরব স্নায়ু যুদ্ধে কেটে গেলো। প্রশাসনিক অফিসারের চাকরিটা হতে পারত.. অতি সহজে। হলোই না। বাবা রাজনীতি পছন্দ করতেন না। রায়হান সেন্ট্রাল এর ভাইয়ের অনেক কাছের মানুষ হয়ে গেল। বাবা ধুমপান অপছন্দ করেন। সে নিয়মিত কল্কিসেবী হয়ে পড়ল। বাবার সুনাম নষ্ট করতে করতে রায়হানের আরেক পৃথিবীর বাসিন্দা হবার প্রতিটি পদক্ষেপ কি ওকে কাছের মানুষদের থেকে এক পা করে করে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল না? সে কি একবারও টের পেল না? বাবা ও কি বুঝেছিলেন? তিনিও কেন টের পেলেন না? ওর সাথের অন্য বন্ধুরা তরতর করে উঠে যাচ্ছিল, ওর মনের সেই কষ্টটুকু কেন বাবা অনুভব করতে চাইলেন না? নাকি বাবা অনুভব করেছিলেন! কিন্তু সে নিজেই বাবার প্রকাশকে বুঝতে পারেনি? বাবা নিজের সাথে যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত হয়েছিলেন, কিন্তু ছেলের জন্য নিজেকে পাল্টান নাই।

‘ এজন্য তো তোমার বাবার জন্য গর্ব করা উচিত!’
ব্রেইনের এক অংশের প্রশ্নের উত্তরে রায়হান আনমনে ‘ হুম’ বলে। চেতন মনের অবচেতনে অচেতন খেলায় জড়িয়ে যায় রায়হান। সে আলো হতে পারে নাই। তাই অন্ধকার হয়েছে। ও কিছু হতে পারে নাই দেখে পারুও ছেড়ে চলে গেছে!

‘ পারু আবার এই মুহুর্তে এলো কোত্থেকে?’
প্রচন্ড বিরক্তিতে আহসানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ আমার মোবাইল দিয়ে কল করে দেখ বাইনচোত মোবাইল খুলছে কি না? খুললে জিগা আর কতক্ষন লাগবে আসতে? ‘

( ক্রমশ:)

আগন্তুক: ধারাবাহিক উপন্যাস// পর্ব-৬

এ.এস.পি (সার্কেল) এর অফিসের গেট থেকে পুলিশের জিপটি বের হয়ে একটা ইউ-টার্ণ নেয়। সোজা হাইওয়েতে চলে আসে। দুরন্ত গতিতে সামনে এগিয়ে চলে ও.সি মনোয়ারকে বহন করা এই জিপটি। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসা মনোয়ার গম্ভীর। কিছুক্ষণ আগের সংক্ষিপ্ত আলোচনার জাবর কাটছে সে।

এ.এস.পি সালাহউদ্দিন ওদের দু’জনের মাঝে লিয়াজো বজায় রাখবে আই.জি.পি’র এমন নির্দেশে কিছুক্ষণ আগের এই মিটিং। মনোয়ারের আয়ত্তাধীন এলাকায় দু’টি খুন হয়েছে। পত্রিকাওয়ালারা তাদের গতানুগতিক কাটতি বজায় রাখতে বেশ সরগরম করে তুলেছে ঘটনা দু’টি নিয়ে। ওদেরও কোনো দোষ দেয় না সে। এটা-ই ওদের কাজ। এখন নিজের কাজটা বেশ ভালভাবেই করতে পারলে হয়।

এ.এস.পি (সার্কেল) বখতিয়ারের সাথে এবার দেখা হল অনেক দিন পর। এর আগে চাঞ্চল্যকর এক ট্রিপল-মার্ডারের কেসে দু’জন কাজ করেছিল। সেখানেই দু’জনের ভিতর সম্পর্কটা বৈরী ভাব নেয়। বখতিয়ার ওর সিনিয়র। সেভাবেই কাজটার ফলো-আপ তাঁর উপর ছিল। ফিল্ডের জন্য মনোয়ার। তবে নিজস্ব কিছু ধ্যানধারণা আছে বখতিয়ারের। সে অপরাধীদের বেলায় বড্ড নির্মম। বিশেষ করে খুন-ধর্ষণ এবং চাঁদাবাজি’র আসামীদের প্রতি। এমন একজনের সাথে কাজ করাটা শান্ত এবং ধীরে চলো নীতির মনোয়ারের জন্য বেশ কষ্টকর বৈকি। সেই কেসে আসামিদের একজনকে ধরেছিল ওরা। তার স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করে, অন্যদেরকে ধরার অভিযানে বের হয়েছিল ওদের টিম। খবরের সত্যতা সম্পর্কে বেশ নিশ্চিত হয়েই বের হয়েছিল। ইনফর্মাররা ও নিশ্চিত করেছিল। সহজেই তাদেরকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। কিন্তু তাদেরকে সরাসরি থানা হাজতে না নিয়ে সেখানেই ইন্টারোগেট করে বখতিয়ার। এক পর্যায়ে বাকি দু’জনের একজন মারা যায়। বাঁধা দিয়েছিল মনোয়ার। কিন্তু বখতিয়ারের তখন হুঁশ ছিল না। শেষে বাধ্য হয়ে বাকি এজনকেও শেষ করে দিতে হয়। সাজানো হয় সেই চিরাচরিত গল্প-ক্রস ফায়ারের।

নিজের উর্ধতন কতৃপক্ষকে সব জানিয়েছিল মনোয়ার। কিন্তু ওনারা সব চেপে যেতে বলেন। বখতিয়ারের আগের রেকর্ড বিবেচনায় এনে তাকে শ্রেফ মৌখিক সতর্কবানী দিয়েই দায় সারা হয়। এমন পরিস্থিতিতে অনেক দিক বিবেচনায় আনতে হয় কতৃপক্ষকে। হেডকোয়ার্টার থেকে বের হবার সময় বখতিয়ার মনোয়ারকে পাস কাটানোর সময় শুধু এইটুকু বলেছিল, ‘ভুলব না আমি।‘ উত্তরে মৃদু হেসে জানিয়েছিল মনোয়ার, ‘উইথ প্লেজার।‘ সেই-ই ছিল সম্পর্কের টানাপোড়ন ওদের দু’জনের।

আজ এ.এস.পি সালাহউদ্দিনের মধ্যস্থতায় এই ডাবল মার্ডারকে ঘিরে, ওদের দু’জনের ভিতর এক নিরব সমঝোতা হয়েছে। সেখানে মনের সায় যতটুকু-ই থাকুক না কেন, দায়িত্ব সামনে আসায় দু’জনেই অতীত ভুলে যেতে সম্মত হয়েছে। নিজের মনে হেসে ভাবে মনোয়ার, ‘আসলেই কি তাই?’

মডেল থানার প্রবেশ দ্বার দিয়ে পুলিশ জিপটি প্রবেশ করে। গেটের রক্ষী কনস্টেবলের এটেনশন হওয়াটা দেখেন এক পলক। গাড়ি থামতেই নিজে দরজা খুকে বের হন ও.সি মনোয়ার। সোজা নিজের রুমে ঢুকে যান। যেতে যেতে সামনে ডিউটি অফিসারকে পেয়ে, এ.এস.আই হারুনকে তাঁর কাছে পাঠাতে বলেন।

বয় চা’ নিয়ে আসে। সাথে গরম নিমকি। প্রিয় এই খাবার কেন জানি জিভে লালা ঝরায় না আজ। মনের ভিতরে কোথায় যেন কিছু একটা কুরে কুরে খাচ্ছে অনুভব করেন। অবশ্য সব সময় নতুন এসাইনমেন্ট পেলে এমনই অনুভব করেন তিনি।

এ.এস.আই হারুন আসেন। সামনের চেয়ারে তাকে বসতে বলেন মনোয়ার। কিছুক্ষন নীরবে অধস্তনের দিকে চেয়ে থাকেন। টেবিলের উপর রাখা ফাইল দু’টির দিকে এবার নজর পড়ে। হারুন সাথে নিয়ে এসেছেন। নিমকির প্লেটটি ঠেলে হারুনের দিকে বাড়িয়ে দেন। হেসে মৃদু মাথা নেড়ে সবিনয়ে প্রত্যাখান করে সে। খেয়াল করেন না মনোয়ার। ততক্ষণে একটা ফাইল হাতে নিয়ে তাতে নিমগ্ন হন। হারুন নীরবে উঠে চলে যায়। বসের স্বভাব ভালই জানা তাঁর। এখন আর ফাইল থেকে উঠবেন না।

সিরাজ আহমেদ। একজন ব্যবসায়ী। আবাসিকের তিন নাম্বার রোডের টপ ফ্লোরের দু’টি ফ্ল্যাট নিয়ে বাস করছেন তিনি অনেক বছর ধরে। সুদর্শণ। এক ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে সুন্দর সংসার। বন্ধু-বান্ধব এবং শুভানুধ্যায়ীর অভাব নেই। পুলিশের ব্যাড-বুকে কোনো নাম নেই। চরিত্রেও নেই কোনো কালিমা। নিজের অফিসেই বেশীর ভাগ সময় কাটাতেন। নিচের ফ্ল্যাটে বাসা। বাইরের লোকজন এলে সবাই অফিসে যেত। বাসায় পরিবারের একান্ত সদস্য ছাড়া কারও পক্ষে কখনো যাওয়া সম্ভব ছিল না।

এমন একজন মানূষ-নির্বিরোধী মানুষ; কেউ তাকে কেন এমন নৃশংসভাবে খুন করবে? হত্যার মোটিভ কি? আগের মার্ডারের সাথে লিংকটা কোথায়? এটা ভাবনাতে আসতেই টেবিলের উপর রাখা অপর ফাইলটিকে হাতে নেন। ওটার জায়গা দখল করে আগেরটি।

ফরিদ আলী। বয়স ৪২ বছর (আনুমানিক)। স্বাস্থ্যবান। পেটা শরীর। চিবুকের নিচে কাঁটা দাগ আছে। শ্যামলা। সুদর্শণ না হলেও কদাকার ও নয়। এলাকার স্থানীয়। সরকারি দলের রাজনীতির সাথে জড়িত। লেখাপড়া কলেজের গন্ডি পার হয়ে আর করেনি। সম্পদশালী। স্থানীয়ভাবে বেশ প্রভাব রাখতেন। থানার ডাটাবেজে মাদকের সাথে জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে। শেষ সারির একজন ড্রাগ-ডিলার। লোকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতো।
এই ফরিদ আলী এবং সিরাজ আহমেদ- এদের দু’জনের একে অপরের সাথে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ-কোনও ধরণের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দু’জনের ব্যবহৃত মোবাইল সিমের আইটেমাইজড বিল ও চেক করা হয়েছে। সেখানে ও কোনো সূত্র নাই। কারও মোবাইলে কখনো দু’জনের কেউ-ই ফোন করেন নাই। কোনো তৃতীয় পক্ষের মোবাইল ও ওদের দু’জনের মোবাইলের লিস্টে নাই।

তবে কেন?
‘সেটা-ই তোমাকে বের করতে হবে বৎস্য!’ নিজের মনের থেকে উত্তর আসে। কিন্তু তাতে মনোয়ারের প্রশ্নের উত্তর মেলে না। আবারও ফাইল দু’টির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে যান। তবে নতুন কিছু চোখে পড়ে না। সুন্দর করে এ.এস.আই হারুন তথ্যগুলি দিয়ে ফাইলটিকে সাজিয়েছে। নিজের অধস্তনের দক্ষতায় মুগ্ধ হব। তখনি নিমকির প্লেটের দিকে চোখ পড়ে। নেয়নি হারুন একটুও। নিজে একটিহাতে তুলে নেন। প্রিয় পরিচিত স্বাদে মন ভরে যায়। এবার অন্য এঙ্গেলে চিন্তা করবেন মনঃস্থির করেন। নিজের ফেলে রাখা নোটবুকে একটু ঝুঁকে কিছু লেখেন। সিরাজের ব্যবসার প্রকৃতি ও ধরণ সম্পর্কে আরও বিশদ ভাবে খোঁজ নিতে হবে। আর ড্রাগের সাথে সিরাজের কোনো লিংক আছে কিনা সেটাও দেখতে হবে।

সেদিন সিরাজের লাশটি বাথটাবে পড়ে আছে দেখতে পেয়েছিলেন। এবার যদিও রক্তাক্ত ছিল না। কিন্তু নৃশংসতার কোনো কমতি রাখেনি খুনি। পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টে খুনের কারণ সেই একই দেখানো হয়েছে। ওভারডোজ হেরোইনে মৃত্যু। বিষ মেশানো ছিল তাতে। আগের খুনের সাথে সাদৃস্য বলতে গেলে এটুকুই। তবে এবার খুনি নির্যাতন চালিয়েছে কারেন্টের শক দিয়ে। বাথ টাবের পানিতে ইলেক্ট্রিক আয়রণের তার ব্যবহার করেছে। প্লাগের সাথে সংযোগ দিয়ে পানিতে তারের ছেড়া প্রান্ত রেখে দিয়েছে খুনি। কিছু কি জানতে চেয়েছিল সে? কি জানতে এমন আগ্রহী হয়ে উঠেছিল সে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা খুবই জরুরী। এই খুনিকে যেভাবেই হোম থামাতে হবে তাতে। তৃতীয় কেউ খুন হয়ে যাবার আগেই। মনোয়ারের ইন্সটিংক্ট বলছে, আরো খুন হবে। এমন একটা ধারণা বেশ তীব্রভাবেই ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সেজন্যই দুশ্চিন্তা করছে সে। মন কখনো ওকে ভুল তথ্য দেয়নি। এবারও যেন ভুল না দেয়। এখন খুনিকে ধরার একমাত্র রাস্তা আরও একটি খুন। কিছু ভুল সে করবেই এটা নিশ্চিত। আর সেই ভুলের খেসারত দিবে ধরা পড়ে।

রুমানা আহমেদ। নিহত ব্যবসায়ির স্ত্রী। তাঁর কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। যে রাতে হত্যাকান্ডটি হয়, সেদিন কাউকে ডিনারের জন্য ডেকেছিলেন সিরাজ। তবে লোকটিকে সে কিংবা বাসার পুরনো কাজের মেয়ে- কেউ-ই দেখতে পান নাই। খাবার সাজিয়ে লোকটি আসার আগেই কাজের মেয়ে বাসায় ফিরে এসেছে।
টেবিলে অভুক্ত খাবার পাওয়া গেছে। একটা হুইস্কির বোতল ও পাওয়া গেছে। টিচার’স নাম। বেশ দামী এই স্কচ হুইস্কিটি। বোতলের থেকে সামান্য খালি হয়েছে। একটা-ই পেগ তৈরি করা হয়েছিল। আর সেটাও সিরাজের জন্যই। ওয়াইন গ্লাসে সিরাজের হাতের ছাপই ছিল। সম্পর্ণ ফ্ল্যাটটিতে সিরাজ, বাসার কাজের মেয়ে ছাড়া আর কারও হাতের ছাপ পাওয়া যায় নাই! এটা-ই ফরেনসিক দলের কর্মকর্তাকে অবাক করেছিল। অন্তত খুনির কোনও কোনও না জায়গায় হাতের ছাপ থাকার কথা। কিন্তু নেই। একজন মানুষ আর একজন মানুষকে টর্চার করে করে মেরে ফেলল, অথচ সে তার কোনো চিহ্ন রেখে গেল না?

ফরেনসিক টিম আরেকটি বিষয় উল্লেখ করেছে। ডান হাতের তালুতে একটি চিহ্ন প্যেছেন তাঁরা। খুবই সুক্ষ্ণ একটি ছিদ্র। সূচের অগ্রভাগের আঘাতের চিহ্নের মত। আগের হত্যাকাণ্ডটিতে খুনি ঘাড়ের কাছে ডার্ট গান ব্যবহার করেছিল। নিডলে স্নায়কে বিবশ করে দেবার মত যথেষ্ট পরিমানে রাসায়নিক ছিল। এবারও খুনি তাঁর শিকারকে নিস্তেজ করায় সেই একই কেমিক্যাল ব্যবহার করেছে। হয়ত তাঁর ডান হাতের আঙ্গুলের আঙ্গটি জাতীয় কিছুতে এই রাসায়নিক মেশানো ছিল। দু’জনে ‘হ্যান্ড-সেক’ করার সময়েই এই বিষ নিহতের শরীর ছড়িয়ে পড়ে। তবে প্রশ্ন জাগে, ড্রিংকটা সে নিয়েছিল কখন? খুনি আসার আগেই হয়ত। কারণ কেমিক্যাল শরীরে প্রবেশ করতেই একটা ঘোরের ভিতর চলে যাবে মানুষ। সব সেন্স ঠিক থাকবে; কিন্তু প্রতিরোধের কোনো শক্তি থাকবে না। সিরাজের সাথেই এমন-ই হয়েছিল। আর খুনির ফিঙ্গার প্রিন্টের ব্যাপারটা? হয়ত খুনি গ্লাভস ব্যবহার করেছিল। পায়ে ছিল সফট কোনো জুতো।

একজন সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশের বিল্ডিঙ্গয়ের পাঁচ তলার নিঃসঙ্গ এক ব্যক্তি। দু’মাস হল বাসা ভাড়া নিয়েছেন। একা থাকতেন। সিরাজের ফ্ল্যাটে সহজে প্রবেশ করা কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। দু’টো বিল্ডিং একই মালিকের। একটা সংযোগ ছিল এই পাঁচ তলাতেই। এক বিল্ডিং থেকে অপরটিতে যাবার। হয়ত এই লোকটিকেই সিরাজ সে রাতে ডিনারে ডেকেছিল?

তবে ওদের সন্দেহের কারণ, ঘটনার রাতের পর থেকে লোকটিকে আর পাওয়া যায় নাই। সে যেন একেবারে গায়েব হয়ে গেছে! তবে একজন মানুষের বিভিন্ন কাজ থাকতে পারে। এমন জরুরী কোনো কাজে হয়ত সে গেছে। দু’একদিনের ভিতরেই ফিরবে। তাই তাঁর সম্পর্কে কোনো ধারণা করাটা এইমুহুর্তে ঠিক হবে না। অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।

বাড়িওয়ালা এবং অন্য ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে যতটুকু তথ্য আদায় করা গেছে, তাদের সেই বর্ণনা শুনে পুলিশের স্কেচ শিল্পী ঐ লোকের স্কেচ তৈরী করেছে। সেটা এখন তাঁর সামনে। একজন পঞ্চান্ন কি ষাট বছরে বৃদ্ধ। চোখের মণি কালো। ফোলা গাল এবং সাদা চুলের একজন মানুষ। চুল পরচুলাও হতে পারে। আর গালে প্যাড লাগানো যেতে পারে। তবে চেহারায় বয়সের বলি রেখাটা করতে বেগ পেতে হবে। অসম্ভব যে তা ও না। কিন্তু তাতে করে তাকে দক্ষ একজন মেক-আপ ম্যানের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এলাকার দারোয়ান এবং নাইট গার্ডদের সাথে কথা বলে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। লোকটির বেঢপ সাইজের একটা ভুড়িও ছিল। এত কিছু যদি সবই ফেইক হয়, তবে একজন চতুর এবং ধুরন্ধর খুনির পিছনে লেগেছেন তিনি। নিজের মনে এমন চিন্তা আসতেই কেন জানি ভাল লাগে ও.সি মনোয়ারের। চ্যালেঞ্জ ভালবাসে বলেই কী?

ফরিদ আলীর খুনির স্কেচ এবং সিরাজের সম্ভাব্য খুনির স্কেচ দু’টি পাশাপাশি রাখে। দীর্ঘক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মনোয়ার।কোনো ধরণের মিল খুঁজে পায় না। একটু নিরাশ হয় মনোয়ার। কেবল একটা-ই প্রশ্ন এখন ওর মনে জাগে, ‘এই মুহুর্তে ঠিক কি করছে খুনি?’

ঠিক সেই মুহুর্তে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের ভিতরে একজন যুবক নিজের মোবাইলে নেট চালনায় মগ্ন। নারিকেল ছোবড়ার মত তাঁর চুলের রঙ। কন্ডাক্টর টিকেটের জন্য আসতেই সে মৃদু হেসে নিজের টিকেটটি দেখায়। হাসির উত্তরে কন্ডাক্টরও হাসে। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আমাদের মানুষের আচরণ ও কেন জানি পালটে যায়। নর্মাল বাসে ভিড়ে গাদাগাদি হয়ে নিত্য যাত্রী এবং কন্ডাক্টরের ভিতর বচসা চলে। আর এখানে এক সিট এক যাত্রী নীতিতে চলা বিলাসবহুল বাসে নেই কোনো হৈ হুল্লোড়। সুদর্শণ যুবকটি মাথা নিচু করে মোবাইলের ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে থাকে। মৃদু হাসি তাঁর অধর কোণে। বাস নিজের গতিতে রুট ধরে এগিয়ে চলে।

(ক্রমশঃ)

আগন্তুক: ধারাবাহিক উপন্যাস// পর্ব-০৫

FB_IMG_1487071836485
নিজের আসল রুপে হেঁটে চলেছেন তিনি রাস্তা ধরে। একজন মানুষের কতগুলি রুপ হয়? সবগুলো মিলালে ঠিক কতটা রুপে অপরূপ কিংবা ক্ষণে ক্ষণে রঙ পালটানো গিরগিটি হয়ে উঠে মানুষ। পিচের পথটি ঢাল বেয়ে অনেক উপরে উঠে গেছে। সেদিকে রিক্সা টেনে চলা রিক্সাওয়ালার পরিশ্রম চোখে পড়ে তাঁর। তবে আজকাল বের হয়েছে ব্যাটারিচালিত রিক্সা। তবে সেগুলোর সব রাস্তায় চলার অধিকার নাই। ঢাল থেকে দুর্বার বেগে রিক্সা পাশ দিয়ে বাতাসে ছুঁয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। যাওয়া আসাটা সবসময়েই কেমন যেন সুরেলা গুঞ্জনের সৃষ্টি করে।

গাছেরা পাশাপাশি সারিবদ্ধ। ওদের কান্ড-শাখাপ্রশাখা টানেলের সৃষ্টি করেছে। চোখের জন্য আরামপ্রদ! একজন অতি সাধারণ মধ্যবয়স্ক এমন এক টানেলের দিকে চলেন। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পথের দু’পাশে নজর। বৈকালিক ভ্রমনে বের হয়েছেন এমন লাগলেও আসলে তা নয়। আজ দেখতে এসেছেন। খোঁচা খোঁচা সাদা দাঁড়ি। এমন কোনো অবয়ব নয় তাঁর, যে একবার দেখলেই দ্বিতীয়বার দেখার আগ্রহ জাগে। তাই কেউ তাকে মনে রাখে না।
মৃদু হাসেন।
হ্যাঁ! এতেই তিনি খুশী।

পেছনে একটা বাজার ফেলে এসেছেন। গোল হয়ে বাজারের মধ্যভাগে কিছু মানুষ বসে আছে দেখেছেন। আলোচনা-সভা কিংবা অন্য কিছু হবে হয়ত। তবে কৌতুহলী মনের ইচ্ছেটুকু পূরণ করেন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে। এলাকার ছেলেরা সব নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। তাই কিছু একটা করতে অভিভাবকদের এই উদ্যোগ। একজন প্রস্তাব করলেন, ‘এখন থেকে কাউকে নেশা করতে দেখলে বা নেশার জিনিস সাথে পেলে, প্রকাশ্যে এই বাজারে বিচার করা হবে।‘ কয়েকজন তাঁর কথায় শব্দ করে সায় জানায়। বিরক্তিতে ভ্রুযুগল কুঁচকে উঠে। মনটা আরও তিতা হবার আগেই মস্তিস্ক পা দু’টিকে সামনে বাড়ার নির্দেশ দেয়।

এভাবে কিছুই হবে না। এই লোকগুলি মাথা ব্যথার জন্য মাথাটিকেই কেটে ফেলার জন্য ব্যস্ত। এতে কোনো সমাধান আসবে না। আর এই যারা নেশার বিরুদ্ধে এক হয়েছে, এদের ভিতরেই রয়েছে কয়েকজন, যারা এই আসরেও নেশা করে এসেছেন। তাদের ঝিম মারা লাল চোখ এবং কথার টোনেই তিনি অনুভব করেছেন। এ ব্যাপারে অন্য সবার চেয়ে তাঁর অভিজ্ঞতাও অনেক বেশী। এরা যে মূল বিষয়টির ধারে-কাছেও যাচ্ছে না, সেটাও বুঝতে পারছেন। হয় এরা এড়াতে চাইছে, না হয় এদের চিন্তার দৈন্যতায় এমন-ই হচ্ছে।

বিশাল এক খেলার মাঠ। এর বুক জুড়ে এখন শূন্যতা। এই সময়ে মাঠ ভর্তি কিশোর-যুবকদের কোলাহলে মূখর হয়ে থাকার কথা ছিল। কিন্তু কোথায় তাঁরা? কোণাকুনি মাঠ পেরিয়ে আসেন। মাঠকে ঘিরে তিনপাশে গাছপালা জঙ্গলের মত হয়ে আছে। বেশ নির্জন। ছায়াঢাকা পথ দিয়ে হাঁটেন। অদূরে আড়াল থেকে চাপা স্বরের আওয়াজ আসে। কিশোর কয়েকজনকে দেখতে পান গোল হয়ে বসে আছে। তাকে দেখে ওরা কেন জানি স্ট্যাচু হয়ে যায়। তিনি তাকান না। ওদের ওখানের বাতাসে মারিজুয়ানার মিষ্টি সৌরভ। তাঁর নাকে লাগে। এদেরই খেলার কথা ছিল এই সময়ে মাঠের বুক দাপিয়ে। অথচ এরা..

আরো সামনে আগান। বিশাল এক দীঘি। সেখানে পাড় ঘেঁষে চলে যাওয়া পথটি এঁকে বেঁকে কোথায় যেন মিশেছে। সেদিকে যেতে গিয়েও থমকে যান। একটা ভগ্নপ্রায় পাম্প হাউস। এখন পরিত্যক্ত। ইটগুলো যেন লাল দাঁত বের করে দর্শককে ব্যঙ্গ করছে। ওখানে মেঝেতে পেপার বিছিয়ে তিনজন মাথা নিচু করে বসা। একটা সিগ্রেট জ্বলছে। সিগ্রেটের ধোঁয়া চিকন রেখা হয়ে আকাশ ছুঁতে চাচ্ছে। জ্বলন্ত সিগ্রেট রাখা আরেকটা প্যাকেটের ওপরে। ফয়েল পেপারে কিছু একটা রাখা আছে। সেটার নিচে উত্তাপ দিচ্ছে একজন। অন্যজনের মুখে পাইপ। অপরজন লোভাতুর দৃষ্টিতে ওর পালা আসার অপেক্ষায়। পাইপধারী ফয়েল পেপারের উপর থেকে বের হওয়া ধোঁয়া টেনে নিচ্ছে। ওর দম ফুরিয়ে আসার আগেই সে হাত তুলে থামার সংকেত দেয়। তৃতীয়জন খুশী হয়। দ্রুত জ্বলন্ত সিগ্রেটটি এইমাত্র পাইপ রেখে দিল যে, তার ঠোঁটে গুঁজে দেয়। একটা টান দিয়ে সে ভেতরের ধোয়াকে সিগ্রেটের ধোয়ার সাথে মিলিয়ে ফুসফুসে পৌঁছে দেয়। এরা হয়ত হেরোইন কিংবা ইয়াবা সেবন করছে। তিনি না থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে বাড়েন। পরিত্যক্ত পাম্প হাউসের তিন যুবক- কিশোর-ই বলা যায় ওদেরকে, ঘোলা চোখে তাঁর চলে যাওয়াটা দেখে। কিন্তু সে দেখায় ওদের কোনো আগ্রহ ফুটে উঠে না।

নিজের একদার পরিচিত শহরে আজ একজন আগন্তুক তিনি! মানুষের যেমন যার যার একটা গল্প থাকে, নগরের ও কী গল্প থাকে না? তাঁর এই পরিত্যক্ত নগরের ও একটা গল্প রয়েছে। আর একে ঘিরে রয়েছে এক ভিন্ন গল্প। সেখানেও এক প্রিয় মুখ রয়েছে কেন্দ্রীয় চরিত্রে। হেঁটে হেঁটে নিজের গল্পগুলিকে সামনে আনেন। এ গল্প এক হারানো শহরের। এখানে সম্পর্কগুলি অনবরত হারিয়ে যায়। প্রিয়জনেরা অসময়ে মুখ লুকায় আঁধারে।

এ এক রক্তাক্ত জনপদ। এখানের মানুষগুলো, বড্ড স্বাধীনচেতা। আপাত শান্ত, মনের ভেতর অহর্নিশি ফুঁসে চলে একটা আনাম বিসুভিয়াস। তারপরও শান্ত এরা।
এখানের বাতাসে আনন্দ-আর দু:খ, হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলে। তাই জীবন বড্ড নিরুদ্বেগ এখানে।

এই শহরে হ্যালুসিনেটেড যুবকদের ছড়াছড়ি। এখানে নীল তীব্র বিষ সহজলভ্য। এখানে শহরের বুক জুড়ে বয়ে বেড়ায় বিভ্রান্তির বিষবলয়। কতটা নির্বিকার ভাবে আমরা দেখছি আমাদের সন্তানদের তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে!

তবুও এটা আমাদের শহর। এখানে নিশ্চুপ বাবাদের মৌণতার হাহাকারে ভারী বাতাস- শেষ বিকেলের আবিরে মিশে মিশে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। তাই এখানের বিকেলগুলি অন্য শহরের থেকে অধিক রক্তিম!

দিগন্তব্যাপী সবুজ বলয় এভাবেই দৃশ্যমান এই শহরে। এখানে প্রতিটি মুহুর্তই এমন ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ- উত্তাল! অণুক্ষণ এমন-ই উন্মাতাল। এই শহরের বাসিন্দাদের হৃদয়ে ও, এর থেকে প্রবল ঝড় বয়ে চলে সারা বেলা!

এক হারানো শহরে- বিষন্ন বেলায়, একাকি একজন মানুষ-হৃদয়ে বয়ে চলা অনুভবের ভাঙ্গাচুরায় ক্ষয়ে যেতে থাকেন। তবুও কতটা নির্বিকার! সময়ের গলন্ত মোম তাঁর জ্বলন্ত হৃদয়ে জ্বালা ধরিয়ে চলে.. তবুও রিয়্যাক্ট করতে পারেন না তিনি। চিৎকার করা যাবে না এখানে! এ এক নিষিদ্ধ নগরী।

এক নিষিদ্ধ মানব, কোনো এক হারানো শহরের শেষ মানুষ হয়ে অপেক্ষায় থাকে- আরেক সভ্যতার ঊষালগ্নের। কখন সুতীব্র চিৎকারে জন্ম নেবে, আরেক জীবন! সেই জীবনে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে বাবাদেরকে আর ভাবনা-চিন্তায় নীল হতে হবে না। বাবারা অফিস করবেন নিশ্চিন্তে। ওভারডোজ নেশার উপকরণে কোনো বাবুকে নিথর হয়ে ফিরতে হবে না বাবার কোলে!
হ্যাঁ! এমনই করে দেখাবেন তিনি।
শুরুটা করা গেছে…

অপরিচিত একজন বাবা যখন পিচ ঢালা পথের শেষ মাথায়, সাইরেন বাজিয়ে একটি পুলিশ জিপ ছুটে চলে এক নির্দিষ্ট গন্তব্যের পানে। দু’জন উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা, যারা একজন অন্যজনকে সহ্য করতে পারেন না, বিশেষ নির্দেশে আজ এক সাথে মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন।

(ক্রমশঃ)

আগন্তুক: ধারাবাহিক উপন্যাস // পর্ব-৪

14681780_695556147266520_3409118497473353499_n
প্রতিদিন সকাল হবার আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায় রুমানার। ঘুম ভাঙ্গতেই পাশে একমাত্র ছেলে সাকিবের দিকে চোখ পড়ে। পাশ ফিরে ছেলের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকায়। হাত দিয়ে ছুঁয়ে যায় একপলক। মায়ার সাগরে হাবুডুবু খায় আরো কিছুক্ষণ। এরপর ফ্রেস হতে উঠে যায়। যাবার সময়ও আরো একবার ঘুমন্ত ছেলেকে ফিরে দেখে। দাম্পত্য জীবনের অনেক পরে এই একমাত্র সন্তানটি এসেছে। তাই একটু বেশী-ই ওর প্রতি ভালোলাগা-ভালোবাসা আর অণুক্ষণ চোখে চোখে রাখা।

আবাসিকের ৩ নাম্বার রোডের এই শেষ বাড়িটায় দুটি ফ্ল্যাট নিয়ে ওরা থাকে। মাত্র চারজন মানুষ। স্বামী-সন্তান ছাড়া আর একজন কাজের মেয়ে রয়েছে। অনেক আগে থেকেই ওদের সাথে। এখন পরিবারের একজন সদস্যের মত হয়ে গেছে। চারতলায় থাকা। আর পাঁচ তলায় অফিস। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং রেসিডেন্স- পাশাপাশি রাখতেই পছন্দ সিরাজের। তবে আজ পর্যন্ত সে জানে না , সিরাজ কিসের ব্যবসা করে। এই ব্যাপারটি নিয়ে কখনো রুমানার সাথে আলাপ করেনি। পছন্দ ও করে না। সাফ বলে দিয়েছে, ব্যবসার ব্যাপারে জানার প্রয়োজন নাই তোমার। ঘর সামলাও তুমি। আমি দেখছি ওটা। তাই অফিসে বাসার কারও যাওয়াটা সুনজরে দেখে না সিরাজ। লোকজন যারা আসে, সবাই সোজা পাঁচতলাতে ‘ওভারসিজ এক্সপো’ নামের অফিসেই চলে যায়। কখনো বা ভুলে কেউ কেউ চারতলার কলিং বেল বাজিয়ে ফেলে। এমন ক্ষেত্রেই দু’ একজনকে যা দেখে রুমানা। তবে এমন খুব কমই হয়।

অনেক সময় ক্লায়েন্টরা আসে। নিচে তাদের গাড়ি অবস্থান করে। এদের গাড়ি বাসার গ্যারেজেও প্রবেশ করে না। রাস্তার পাশে পার্ক করা থেকে। অলস ড্রাইভারড়া ড্রাইভিং সিটের দরজা খোলা রেখে সিট বেন্ড করে ঘুমায়। কার সেটে বেজে চলে ড্রাইভারের পছন্দের গান । বাসায় ফেরার পথে এমন অনেক দেখেছে রুমানা। তাই ব্যাপারগুলো মনে এভাবে গেঁথে আছে।

সিরাজের ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ঠদের অনেকেই রাতে থেকে যায়। তখন তাদের খাবারের ব্যবস্থা রুমানাকে করতে হয়। কাজের মেয়ে খাবার সাজিয়ে রাখে অফিসের ডাইনিং রুমে। রুমানা যায় না কখনো। নিষেধ আছে। গত রাতেও একজনের জন্য ডিনারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে ওকে। এরকম হাজারটা বিধি-নিষেধের ভিতর দিয়ে সিরাজ-রুমানার জীবন বয়ে চলে। তারপরও মানুষটিকে বড্ড ভালবাসে রুমানা। ভালবাসা অনুভব করা যায়। রুমানা সেটা আবার একটু বেশী-ই অনুভব করতে পারে। তাই সে ও ফিরিয়ে দেয় ভালবাসা। এভাবে ভালবাসার লেন-দেন করে করে আজ জীবনকে এতদূর নিয়ে এসেছে এই দম্পতি।

প্রতিদিন মর্ণিং ওয়াকে যাওয়াটা সিরাজের নিত্যকার অভ্যাস। ঝড়-বৃষ্টি কোনো কিছুই এর কোণো ব্যত্যয় ঘটাতে পারে না। সিরাজ যাবেই। রুমানা সামনের ব্যালকনিতা দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট সময়ে সিরাজের চলে যাওয়াটা দেখতে পায়। প্রাতঃকৃত্য সেরে সেই সময়ের আগেই সামনে আসে রুমানা।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন সিরাজের বের হয়ে যাওয়াটা দেখতে পেলনা, একটু চিন্তার রেখা ফুটে উঠে কপালে। এমন কখনোই হয় না। রুমানা কি আজ সময়ের পরে এলো? নাকি সিরাজ আজ আগেই বেরিয়ে গেছে? ঘড়ি ধরে সব কিছুতে অভ্যস্ত হওয়া মানুষটা আজই কি নিয়মের ব্যতিক্রম করে ফেললো!

ছেলে সাকিবের ঘুম ভাঙ্গে। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রুমানা। তবে এর ভিতরেও ক্ষণে ক্ষণে প্রিয় মানুষটির কথা মনে পড়ে। প্রতিদিন এই সময়ের ভিতরে ছেলেকে সাথে নিয়ে সিরাজের সকালের নাস্তা পর্ব সারা হয়ে যায়।

বিষণ্ন হেসে নিজের এই অদ্ভুত জীবন সম্পর্কে ভাবে সে। বেশীর ভাগ সময় সিরাজ পাঁচতলাতেই থাকে। এর ভিতরেই চলে জীবন-যৌবনের গান! একান্ত কাছে পাওয়াটা নির্ভর করে সিরাজের উপর। রাতটা বেশ দীর্ঘ লাগে রুমানার আজকাল। যদিও ছেলে পাশে থাকে। কিন্তু সব চাইতে প্রিয় সুদর্শন মানুষটির অভাব বড্ড অনুভব করে। কখনো কখনো ঘুম ভেঙ্গে গেলে, বিছানার একটা নিঃসঙ্গ অংশ কেন জানি ‘কিছু একটা না পাবার’ আক্ষেপকে বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে থাকে রুমটা যতক্ষণ আঁধার মিলিয়ে না যায়।

আরও এক ঘন্টা পার হয়। এবার উদ্বিগ্ন হয় রুমানা। মোবাইলে কল করে। রিং বেজে চলে। কিন্তু ধরে না কেউ। কিছু না ভেবেই- সিরাজের সকল বিধি-নিষেধের বেড়া ডিঙ্গিয়ে আজ প্রথমবার নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় রুমানা ও। পায়ে পায়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে পাঁচতলার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ডোর বেলের সুইচে হাত স্পর্শ করে রুমানার। সুরেলা টুং টাং আওয়াজে মনটা আপনাতেই ভাল হয়ে যায় এই দিনের শুরুতে। কেউ আসে না। কি ভেবে ডোর-হ্যান্ডেলে মৃদু ধাক্কা দেয়। নিঃশব্দে খুলে যায় দরজা। রুমানা কয়েক পা হেঁটে গিয়েই থেমে যায়। আকাশ ভেংগে পড়ে যেন ওর মাথায়। জগৎ সংসার মুহুর্তে দুলে উঠে ওর চেতনাকে সাথে নিয়ে এলিয়ে পড়ে।
… …
আটচল্লিশ ঘন্টার ব্যবধানে একই থানার আয়ত্তাধীন এলাকায় আবারও খুন। সেইম প্যাটার্ণ। খুনি বোধহয় একজনই। আগের হত্যাকাণ্ডটির সাথে মিল রয়েছে। ও.সি মনোয়ার মাথার চুল ছিড়তে কেবল বাকি রেখেছেন। একতার সুরাহা করতে না করতেই দ্বিতীয় আঘাত এলো। কেউ কি বেছে বেছে তাঁর এলাকাতেই খুনগুলি করতে চাইছে? চাকরি সুবাদে কত ভয়ংকর ভয়ংকর লোকের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে। তাদেরই কেউ কি ওকে ফ্যাসাদে ফেলতে খুনগুলি করছে? না হলে সে এই থানার চার্জ গ্রহণ করতে না করতেই অল্প সময়ের ভিতরে দু’দুটি খুন! অবাক লাগে।

তবে আবাসিকের ৩ নাম্বার রোডটির শেষ বাড়িটার সামনে পুলিশ জিপ থেকে নামতে নামতেই সে একটু আগের ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়। নাহ! কেউ তাকে ফাঁসাতে গিয়ে এত ভয়ংকর কাজ করবে না। খুন দ্বারা ওকে কী বিপদে ফেলা যাবে? একটু চাপে থাকবে কিংবা তদন্তে সময় লাগবে একটু বেশী। এর বেশী আর কি হবে? কিন্তু নিজেকে নিয়ে ভাবছে না সে। দু’টি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। মানুষ খুন হয়েছে দু’জন। এখন আইনের শাসন নিশ্চিত করার প্রথম ধাপটাতে অবস্থান করছে সে।

বাড়িটার মেইন গেট দিয়ে প্রবেশ করার সময় নিজের দৃঢ় চোয়াল মনের ভেতরের অনুভবকেও দমিয়ে রাখতে চায় যেন। কেউ একজন খেলা শুরু করেছে। বুদ্ধির খেলা। সে খেলায় শেষে তারই জয় হবে এটা যেমন জানে, তেমনি এটাও জানে, এই খেলায় ব্যর্থ হওয়া যাবে না। জিতলে প্রাপ্তির খাতায় যা-ই থাকুক না কেন, হারলে ক্যারিয়ারে দাগ লেগে যাবে। ব্যর্থতার। এতগুলো বছর কখনো এমন অনুভবে বিলীন হয়নি সে। এবার ও হবে না। টপ ফ্লোরের সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে উঠতে আরো একবার আগের হত্যাকান্ডটির কথা মনে পড়ে। এবার কতটা বীভৎস হবে কে জানে?

দ্বিতীয় খুনটা সবাইকে হেলিয়ে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। সিরাজ নিজে রহস্যময় মানুষ হলেও, ওর কাছের মানুষেরা অত্যন্ত ক্ষমতাধর। বন্ধু-বান্ধব শুভানুধ্যায়ীরা ও যার যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে প্রশাসনের উপর মহলে তোলপাড় শুরু হল। এবার টনক নড়ে নির্দিষ্ট মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির। নড়ে চড়ে বসেন তিনি। যে দেশে গদাইলস্করি চালে ঘটনার নির্বাহ হয়, সেখানের প্রশাসনযন্ত্রও হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে যেন জেগে উঠল! প্রতিটি ইউনিট যার যার জায়গায় বিশেষ নির্দেশ পায়।

নিজের রুমে সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি। এই মাত্র আইজিপি’র সাথে কথা শেষ করেছেন। এখন এতক্ষণের আলোচনার চৌম্বক অংশটুকু নিয়ে ভাবছেন। দু’টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু কেন জানি মনে হল তার- কোথাও না কোথায়ও- ঘটনা দু’টি একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তবে সব কিছু ছাপিয়ে বিস্ময়ের সাথে একটা ভাবনাই তাকে বিহ্বল করে তুলতে চায়, দ্বিতীয় খুনের কথা আজকের সকালে জানা গেছে। পত্রিকাওয়ালারা আগামীকাল যে তুলোধুনো করে ছাড়বে ওদের নিজস্ব স্টাইলে, সেটা ভেবেই মন খারাপ হল তার। সব দায় তখন এসে পড়বে তার মন্ত্রনালয়ের উপর। কেবিনেট মিটিঙয়ে ব্যাপারটি নিয়ে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। ওখানে সবাই এক দল হলেও, এক মনের নন। তাই ভিতরে ভিতরে চলে রেষারেষি। হিংসা আর দলাদলি হাত ধরাধরি করে চলে সেখানের ক্ষমতাধর মানুষগুলির ভিতর।

একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মোবাইল হাতে নেন। একটা বিশেষ নাম্বারে কল করে অপেক্ষা করেন। ওপাশে রিং বেজে চলে। এই নাম্বারের মালিকের সাথে কথা বলতে গিয়ে, অপেক্ষার সময়টি তার কাছে কখনোই বিরক্তিকর মনে হয় না।

আইজিপি’র সাথে কথা শেষ হলে, পাশে অপেক্ষমান এ.এস.পি সালাহউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে মোবাইল টেবিলে রাখেন এস.পি লোকমান হোসেন। দু’জনে কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। শেষে সালাহউদ্দিন সিনিয়রকে জিজ্ঞেস করেন-
‘তিন নাম্বার রোডের ঘটনা, স্যার?’
এস.পি কে কেমন ক্লান্ত মনে হয়। বিষন্ন দৃষ্টি নিয়ে জুনিয়রকে দেখেন তিনি।
-হ্যা। সবাই তো এখন এই দুই খুন নিয়েই ব্যস্ত। … আচ্ছা, মনোয়ারকে তোমার কেমন মনে হয়?
‘কোন দিক থেকে মানে কোন এঙ্গেলে জানতে চাইচ্ছেন জানলে বলাটা সহজ হতো?’
– ওটা ওর এলাকা। নতুন পোষ্টিং হয়েছে। কতটা সামলাতে পারবে সেই ব্যাপারেই জিজ্ঞেস করছিলাম।
‘ তাঁর কাজের দক্ষতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই আমার স্যার। তবে অতিরিক্ত স্বাধীনচেতা মানুষ। একটু গোঁয়ার। তবে সেটা আইনের সীমার ভেতরে, আইনকে সামনে রেখেই। কিন্তু একবার যে কাজের পিছু নেবে সে, শেষ করেই ছাড়বে। তাঁর কাজের ধরণ অন্যদের থেকে একটু আলাদা। বিশাল কর্মপ্রস্তুতি এর ভিতরে একটা। সব কিছু গুছিয়ে জাল টেনে আনে সে। তাই সময় একটু বেশী লাগলেও, ফলাফল আসেই।’
– ওটাই তো সমস্যা। এই মুহুর্তে সময় আমাদের খুব অল্প। আচ্ছা, তুমি আর বখতিয়ার তো কোর্স-মেট ছিলে, তাই না?
একটু অবাক হয়ে সালাহউদ্দিন ওর বসের দিকে তাকায়। শেষে বলে-
‘ ওকে এই কেসে রাখতে চাইছেন না তো?’
এবারে হাসেন জুনিয়রের কথা শুনে এস.পি।
-হ্যা! আমি এই ঘটনার তদন্তে মনোয়ারের সাথে বখতিয়ারকেও রাখতে চাইছি।
‘সর্বনাশ হবে যে তাতে, স্যার! মনোয়ার আর বখতিয়ার-দু’জনের কর্মপদ্ধতি ভিন্ন। তা ছাড়া এর আগে মানিকগঞ্জের ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায়ও দু’জন এক সাথে কাজ করেছিল। ফলাফল আপনার জানা আছে নিশ্চয়ই, স্যার?’

একটু অসহিষ্ণু স্বরে জবাব দেন এস.পি,
-হ্যা, মনে আছে সব। কিন্তু দু’জনের যতই পদ্ধতিগত অমিল থাকুক, এই কাজে এবার দু’জনকে এক সাথে কাজ করতে হবে মিলেমিশে। আমি তোমাকে দায়িত্ব দিচ্ছি ওভারঅল দেখবার জন্য। তুমি আমার সাথে ওদের দু’জনের লিয়াজো রক্ষা করবে। আর ওদের দুজনকে জানাবে- এই কেসে নিজেদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে চাপা দিয়ে, একটা টিম হয়ে কাজ করতে। এটা আমার স্ট্রিক্ট অর্ডার- সেটা অফিসিয়ালি কি আন-অফিসিয়ালি যেভাবেই হোক, মানতে হবে ওদেরকে। জানিয়ে দিও তুমি।

যখন এ.এস.পি সালাহউদ্দিন এস.পি লোকমানের রুম থেকে বের হয়, বাইরে তখন রোদেলা দুপুর নিজের আগমনী বার্তা ঘোষণা করছে।
(ক্রমশঃ)

আগন্তুকঃ ধারাবাহিক উপন্যাস//পর্ব-৩

14681780_695556147266520_3409118497473353499_n
ও.সি মনোয়ার তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে আগে কখনো এমন অনুভূতির সম্মুখীন হয়নি। কেমন যেন তালগোল পাকানো। অনুভবের খরায় আক্রান্ত হল কিনা ভাবে। গতকালের খুনের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল নিজের কক্ষে বসে।

টেবিলের উপর চা ঠান্ডা হয়ে আছে। সেদিকে খেয়াল নাই। তিনি আবার আগুন-গরম চা ছাড়া পছন্দ করেন না। বসে আছেন ‘পোষ্ট মর্টেম’ রিপোর্টের জন্য। ব্যাটা ড্রাগ-ডিলার নিজে মরে অন্য সবাইকে ঝামেলার ভিতর ফেলে গেছে। গতকাল থেকে প্রশাসনের বেশ উপর মহলের কর্তাব্যাক্তিরা দফায় দফায় তাঁর সাথে কথা বলেছেন। নরম-গরম কথার দ্বারা সবাই-ই এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বের হয়ে আসতে চাইছেন, সেটা তাকে পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। সেই থেকে ভাবছেন এই খুনের মোটিভ নিয়ে। পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে হতে পারে? তবে সে সম্ভাবনা নাই। নিহতের পারিবারিক ইতিহাস ঘেঁটে, তেমন কিছুই সামনে আসেনি। এই পরিবারটির নিজেদের ভেতরের মিল ঈর্ষণীয়। এলাকায় আধিপত্য নিয়েও নেই কোনো কোন্দল। এমনিতেই তারা সম্পদশালী। রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে সাথে, এলাকাভিত্তিক প্রভাব, এই দৃষ্টিকোণ থেকে অন্য যে কারও সামনে দাঁড়াবার সুযোগ-ই নেই বলতে গেলে।

দলীয় কোন্দল? তেমনও হতে পারে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তাকে সমর্থন করেছেন থানার দলীয় সভাপতিও। তিনি আরো এক কাঠি এগিয়ে বলেছেন, আমরা সবাই এক মায়ের সন্তানের মতো। নিজেদের ভিতর কোনো বিভক্তি নাই।

নারী ঘটিত কিছু হতে পারে? প্রতিহিংসা? কিংবা পরকীয়া কোনো ব্যাপার! তবে নিহতের কুন্ডলি ঘেঁটে দেখেছেন তিনি। অন্য অনেক খারাপ গুণ থাকলেও, নারী সংক্রান্ত এমন কোনো অতীত রেকর্ড নেই লোকটির। বিস্ময়কর ভাবে এটা-ই সত্যি, নিজের স্ত্রীর প্রতি গভীর অনুরক্ত ছিল মানুষটি। পারিবারিক গন্ডিতে সে ছিল এক আলাদা মানুষ।

তবে কেন?
কোন বালের জন্য কাউকে এভাবে মেরে ফেলা হলো? অস্ফুটে ‘বিশেষণটি’ মুখ দিয়ে বেরও হয়ে আসে। কারও আসার শব্দে চিন্তার জাল ছিন্ন হয়।
এস.আই জিল্লুর। পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টের কপি টেবিলে রাখে সে। কিছু না বলে তার দিকে তাকান মনোয়ার। নীরবে মাথা নিচু করেন সামান্য। চলে যাবার ইশারা। এস.আই চলে গেলে চিরতার অভিব্যক্তি নিয়ে রিপোর্টটি হাতে নেন। নিস্পৃহ দৃষ্টি ক্রমশ জ্বলে উঠতে থাকে।

মৃত্যুর কারণ ওভারডোজ হেরোইন শরীরে ইজেক্ট করা। তবে চেতনা নাশক এমন কিছুও প্রথমে শরীরে প্রবেশ করেছে। ডার্ট-গান জাতীয় কিছু দিয়ে ঘাড়ের ডান পাশে বিদ্ধ করা হয়েছে। তাতে থাকা ক্যামিকেল দ্রুত স্নায়ুকে অবশ করে নির্বাক করে দেয়। অবশ্য ওটার পরিমান বেশী হলেও মৃত্যু ঘটতে পারে।
চমকে গেলেন পরবর্তী বিষয়টি জেনে। পাকস্থলীতে ফেটে যাওয়া ইয়াবার এক প্যাকেটের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে! যেভাবে কুরিয়াররা নিজের শরীরে টেপে মোড়ানো ইয়াবার চালান নিয়ে আসে, সেরকম-ই কিছু। কিন্তু বিস্ময়ের সাথে ভাবেন, নিহত এমন কাজ কখনোই করবে না। এসব কাজের জন্য তার আলাদা লোক রয়েছে।

তবে বসা থেকে প্রায় উঠে গেলেন রিপোর্টের পরের অংশে যেতেই। হেরোইনে বিষ মেশানো ছিল! এটাই যন্ত্রনাকর মৃত্যুর কারণ। সিরিঞ্জে করে শরীরে প্রবেশ করেছে বিষ মেশানো হেরোইন। আবার মুখ দিয়েও অন্ননালী হয়ে পেটে ঢুকেছে।

খুনির নৃসংশতায় ধাক্কা খান ও.সি। চোখে ভাসে গতকাল দেখা চেয়ারে বসে থাকা লাশের ছবি। যন্ত্রণায় দেহ মুচরে যেতে চেয়েছে। কিন্তু চেয়ারের হাতলে দুই হাতের তালু পেরেকে বিদ্ধ থাকায় নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা-ই করেছে শুধু। বিষাক্ত এবং ওভারডোজ হেরোইন কতটা নিষ্ঠুর ভাবে জীবনকে স্থবির করে দিতে পারে, জানা আছে তাঁর। সে বেশ আগের কথা।

সব কিছু মিলিয়ে অবস্থা কি দাঁড়ালো? যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন। অস্থির ভাবে এক মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষে পায়চারি শুরু করেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। মোটিভ কী হতে পারে? কেন এভাবে কাউকে খুন করা হল? মারতে চাইলে আরো সহজ পথ ছিল। সেদিকে না যেয়ে খুনি এমন নৃশংস পথ বেছে নিলো! কেন? সে কি কোনো ম্যাসেজ দেবার চেষ্টা করেছে? নিজের এত বছরের অভিজ্ঞতা আজ কোনো কাজেই আসছে না বলে মনে হয় ও.সি মনোয়ারের। নিজের অজান্তেই কেন জানি এক অশুভ সংকেত বেজে ওঠে মনের গভীরে।

বেল চেপে কাউকে ডাকেন। নির্দিষ্ট কনস্টেবল এলে, এ.এস. আই হারুনকে আসতে বলেন। এই অবসরে পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টের গোড়া থেকে আরো একবার চোখ বুলিয়ে যান। এমন কিছু বাদ পড়ল কিনা যা চোখে পড়েনি আগে। মনের চোখ।

এ.এস.আই হারুন এলে তাকে পুলিশ স্কেচ শিল্পীর করা সম্ভাব্য খুনির স্কেচগুলো নিয়ে আসতে বলেন। গতকাল অপরাধ স্থলের চা’র দোকানে কথা বলে সাদা পোষাকের পুলিশেরা এক অচেনা আগন্তকের বর্ণনা জেনেছিল। শেষে নিজেদের স্কেচ শিল্পীকে দিয়ে কয়েকটি ছবি আঁকিয়েছে। দেখা যাক, এখান থেকে কিছু পাওয়া যায় কিনা। পুলিশ ডাটাবেজে সংরক্ষিত অপরাধী কারও সাথে চেহারা মিলে কিনা তা ও দেখতে হবে।

টেবিলের উপর রাখা চা’র কাপের দিকে এবার মনযোগ দেন। চিন্তা না করেই এক চুমুক দিলে, ঠান্ডা চা মনটাকেও কেমন বিস্বাদের কটু অনুভবে বিরক্ত করে তোলে। চা’র কাপের দিকে ভ্রু-কুঁচকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। মনের চোখ তখন অন্য কোনো জায়গায়..
… …

আবাসিক এলাকার এটা শেষ প্রান্ত। রাস্তাটা সব শেষের এই পাঁচ তলা বাড়ির সাথেই এসে শেষ হয়ে গেছে। এটা ডেড-এন্ড। মাঝে রাস্তা রেখে দু’পাশে সারি সারি বাড়ি। নানা রঙয়ের। ভিন্ন ডিজাইনের। এক বর্ণীল ছোট কংক্রিট নগর। এমনই মনে হয় তাঁর কাছে। টপ ফ্লোরে নিজের ব্যালকনিতে বসে অলস সময়ে আশপাশটা অনুভবে ছুঁয়ে চলেছেন এক পৌঢ়। অসহ্য অলস অবসর কাটাতেই এই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছেন গত মাসে। একা একজন মানুষ। সামনেও কেউ নেই। পেছনের মানুষগুলি সম্পর্কহীনতার মাঝে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছে। তাই এই একা থাকা। এমন-ই বলেছিলেন বাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে বাসা ভাড়া নেবার সময়।

হাতে আজকের পত্রিকা। নীরবে চোখ বুলিয়ে যান। বেশ বড় করেই ছেপেছে খবরটা। ইতোমধ্যে একবার পড়েছেন। আরও একবার চোখ বুলানো শুরু করেন। যেভাবে লিখেছে, আসল ঘটনা হয়ত তেমন নয়। সাংবাদিকেরা মূল ঘটনার চেয়ে নিজেদের কল্পনার ডানা অধিক মেলে দিতে পছন্দ করে।

এমন একটা এলাকা যেখানে নাগরিক সমাজ দ্বিধা বিভক্ত। নৈতিকতার ধার কেউ এখন ধারে না। ভাল গুণগুলি ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। সে জায়গা দ্রুত দখল করে নিচ্ছে আমাদের ভিতরে থাকা পৈশাচিকতা। এভাবেই কি আমরা এক একজন পিশাচ মানবে পরিণত হব এক দিন?

ভাল লাগে না আর। নিজের রুমে চলে আসেন। আয়নার সামনে দাঁড়ান। যে মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে, তিনি কি এমনই? ভিতরের মানুষটা কেমন? আমরা বাহ্যিক চোখে যা দেখি, আসল দেখার ওপারের মানুষটি কি সেভাবেই থাকেন? দেখা আর না দেখার বাইরের বিমূর্ত রুপটি কেমন?

একটা ছিমছাম এলাকা। চর্ম্য চোখে এর অনাবিল সৌন্দর্য ভাললাগায় আপ্লুত করে মন। কিন্তু এই নগরের ভিতরের ছোট্ট নগরটির এমন অনেক কদর্য রুপ রয়ে গেছে যে, মুহুর্তেই বিরুপ মনোভাবে ছেয়ে যাবে যে কারও মন।

এখানে রাতের আঁধারে চলে মরণ নেশায় মেতে উঠার মহা উৎসব। বয়সের কোনো সীমারেখা নাই সেখানে। উঠতি বয়সী কিশোর থেকে শুরু করে, মধ্য বয়স্ক কিংবা নারী! ইদানিং হচ্ছেটা কি এসব? এই এলাকাতেই রয়েছে ভদ্রবেশী পতিতাদের অবৈধ কাজকলাপ। সভ্যতার মুখোশে ঢেকে থাকা এক আদিম সমাজে মুহুর্তেই কেন জানি চলে যাই আমরা সভ্য মানুষেরা। পদস্খলনের নিষিদ্ধ লোবানের আকর্ষণে পা পিছলাতে সময় লাগে না আমাদের। আবাসিক এলাকাগুলিতে প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন সম্মতিতে চলে অবৈধ নেশা-সামগ্রির অবাধ বেচা-কেনা। এ এক বিশাল চক্র। কোটি কোটি টাকার ছড়াছড়ি। ভদ্রবেশী সমাজপতিরা অর্থের জোগানদার। ‘করাপ্টেড’ নেতারা রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে সব সামলে নেবার কাজে অতিশয় দক্ষ। দিনে দিনে তারা আরও দক্ষ হয়ে উঠছেন।

এমন এক নাগরিক সমাজে একজন অদক্ষ সাধারণ মানুষ, এক শেষ বিকেলে-রাতের অপেক্ষায় উন্মুখ থাকেন। নির্জনতার খোঁজে কিনা তা জানা যায় না। একেবারে ছাদে চলে আসেন। পাঁচতলার এই বাড়িটির ছাদ সাথের বাড়িটির ছাদের সাথে মিলানো। দু’টি বাড়ির মালিক একজনই। একটা করিডোর রয়েছে। গ্রিল দিয়ে ঘেরা।

আকাশে রংয়ের মেলা। ঈশ্বর তাঁর নিজের মত করে বর্ণে বর্ণে সাজিয়েছেন। অপুর্ব!
আকাশের পানে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। কতক্ষণ থাকতেন বলা যায় না। পাশের ছাদে কারও উপস্থিতি তাঁর একাগ্রতা বিনষ্ট করে। ফিরে তাকান। এক মধ্যবয়সী। মাথায় পাকা চুলের আধিক্য বেশী। বেশ সুপুরুষ। অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছেন। প্রথম দেখাতে এমনই মনে হবে যে কেউ দেখলে। তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছেন। কিন্তু চোখ দুটি সুপুরুষটির হাসছে না। বাইরের খোলসটিকে আমরা পরিচ্ছদ আর অভিব্যক্তিতে যতই সাজাবার চেষ্টা করি না কেন, ভেতরে কদর্যতা থাকলে ঠিকই বের হয়ে আসে। চোখে হল সেই বের হবার পথ। মানুষের নিজেকে চেনানোর পথ।

হাসি হাসির জন্ম দেয়। তিনিও মৃদু হেসে অভিবাদন জানান। প্রথম পরিচয়ের মুহুর্ত কাটে নিরব অন্তরঙ্গতায়! দু’জন কাছাকাছি বয়সী মানুষ পরিচয় পর্ব সাঙ্গ করেন এক বেলা শেষের ক্ষণে। কথা হয় তাদের মাঝে আরও দীর্ঘক্ষণ। অত:পর রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে প্রথম পৌঢ় নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে যান। চোখ হাসে না এমন সুপুরুষটি, কৌতূহল নিয়ে পৌঢ়ের চলে যাওয়া দেখে।

বাইরে তখন বিষণ্ণ সাঁঝের উলুধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ফেরা পাখিদের শেষ সংকেত জানায়।
(ক্রমশঃ)

আগন্তুকঃ ধারাবাহিক উপন্যাস // পর্ব-২

14681780_695556147266520_3409118497473353499_n
লোকাল থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পৌছালো সকাল ন’টার পরে। একটু বেশী-ই তৎপর মনে হল তাদের। এর পিছনে কারণ তো অবশ্যই রয়েছে। পুলিশের গাড়িটি দেখে প্রথমে কেউ কেউ সরে যায়। পরে কৌতুহলের কাছে ভয় পরাজিত হলে, তারা আবার ঘুরঘুর শুরু করে। এতক্ষণ মাতম চলছিল ঐ বাড়িতে। এলাকার একেবারে কেন্দ্রস্থলে এমন একটি রোমহর্ষক হত্যাকান্ড – এলাকার সবাইকে ভীত এবং বিহ্বল করে তুলেছে।

সাদা পোষাকের আইনশৃংখলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরাও ভিড়ের মাঝে মিশে গেলো। সবাই মিলে একটা ‘টিম’ হয়ে কাজ করবে। স্থানীয় থানার ও.সি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) নিজেই এসেছেন। জোন এস.পি’র কড়া নির্দেশে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন সদ্য এই থানায় পোষ্টিং পাওয়া এই কর্মকর্তা।

ঘটনার সময়ে বাড়িতে ‘ভিকটিম’ একা-ই ছিলেন। অন্যরা এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিলো। সকালে দুধওয়ালা দুধ দিতে এসে মেইন দরজা খোলা পায়। অনেকক্ষণ বেল বাজালেও কেউ না আসায়, সে ভিতরে প্রবেশ করেই বীভৎস্য ব্যাপারটি দেখতে পায়। তাঁর চিৎকার-চেচামেচিতে সকলে জড়ো হয়। আত্মীয়স্বজনদের খবর দেয়া হয়। তাছাড়া নিহত ব্যক্তি এই এলাকারই। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছাড়াও তারা সকল ভাইয়েরা যার যার বাড়ি করে বসবাস করছে। অন্য ভাইয়েরা এসে মৃতের স্ত্রী-পুত্রকে ফোন করে জানায়। তারাও এই কিছুক্ষণ হলো এসে পৌঁছেছে।

একজন এ.এস.আই কে ডেকে নিলেন ও.সি মনোয়ার। সে কাছে আসতেই ওকে নিয়ে ‘ডেড-বডি’র কাছে গেলেন। নিজের বেডরুমে ‘ভিকটিম’ একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছে। তবে এমনভাবে দেহটা বেঁকেচুরে রয়েছে, প্রথম দেখাতেই তিনি বুঝতে পারলেন-মৃত্যুর আগে অসহ্য শারিরীক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে মানুষটিকে।

একটু কোলাহলের শব্দ কানে যেতেই পিছনে ফিরে তাকান তিনি। মৃতের স্ত্রী হবে বোধহয়। বিলাপ করতে করতে ভিতরে ঢুকবার চেষ্টা করে। তাকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে এক যুবক। নিহতের ছেলে হবে বোধহয়। এ.এস.আই আগুয়ান মহিলাকে দরজায়-ই নিবৃত্ত করে। তাকে তদন্তের কাজে বাঁধা না দিতে অনুরোধ করে। ছেলে নিজের মাকে জোর করে বাইরে নিয়ে যায়।

ও.সি সাহেব তাঁর অধীনস্থকে বলেন,
– সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি কর। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টদের খবর দেয়া হয়েছে?
লাশের দিকে তাকিয়ে থাকা এ.এস.আই ওর সিনিয়রের দিকে ফিরে উত্তর দেয়,
– স্যার! হ্যা, ফরেনসিক টিম যে কোনো মুহুর্তেই চলে আসবে।
– গুড। প্রথম যে লোকটি ডেড-বডি দেখেছে, তাকে নিয়ে এসো। আর আমরা আসার আগে, এই রুমে কেউ ঢুকেছে কিনা খোঁজ নাও।
– স্যার!

এ.এস.আই বের হয়ে যায়। ও.সি লাশের খুব কাছে যান। নিহতের পরণে লুঙ্গি। উর্ধাঙ্গ খালি। কাঠের চেয়ারের হাতলে দুই হাত চামড়ার স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা। পেরেক দুই হাতের তালু ভেদ করে কাঠের গভীরে প্রবেশ করেছে। যেখানটায় পেরেক ঢুকেছে, তার চারপাশ বৃত্তাকারে কালচে-নীল হয়ে আছে। শুকনা রক্ত দলা হয়ে আছে পেরেক দু’টিকে ঘিরে। মুখে অ্যাডহেসিভ টেপ লাগানো। এজন্যই লোকটির অমানুষিক চিৎকারের আওয়াজ বাইরে কারো কানে যায়নি। লাশের মুখে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। বাহ্যিকভাবে শরীরের অন্য কোথায়ও আঘাত এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। চোখ বিস্ফারিত হয়ে আছে। পিঙ্গল দু’টি মণি স্থির। সেখানে কোনো ভাব নেই। অনুভূতির অনেক উর্ধে চলে গেছে এই মানুষটি। মুখের কষা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ার দাগ দেখতে পান। কালচে রক্ত!

দুধওয়ালাকে বাইরের রুমে দাঁড় করিয়ে রেখেছে এ.এস.আই। দেখতে পেয়ে ও.সি মনোয়ার বাইরে আসেন। লোকটি বয়স্ক। চুল সাদা হয়ে আছে। মেহেদির রঙে রাঙ্গানো। মুখে কয়েকদিনের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। সব সাদা হয়ে আছে। লোকটি নার্ভাস হয়ে আছে। থেকে থেকে জিভ দিয়ে শুকনা ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে।

লোকটির সামনে এসে দাঁড়াতেই- ফরেনসিক টিম এসে পৌঁছায়। তাদেরকে নীরবে ভেতরটা নির্দেশ করে ও.সি দুধওয়ালাকে নিয়ে ভিতরের আরেকটি রুমের দিকে আগান। মুখে তাঁর প্রসন্ন হাসি। কিন্তু ফর্মাল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া। দুধ বিক্রেতা সেই হাসি দেখে আরও ভড়কে যায়। ঢোক গিলে সে ভাবে, আজ কপালে খারাবি আছে।

ফরেনসিক টিম তাদের কাজ শেষ করে বের হবার অনেক আগেই, ও.সি সাহেব দুধ বিক্রেতাকে ছেড়ে দিয়েছেন। তার কাছ থেকে তেমন কিছুই জানা যায়নি। যতদূর দেখে মনে হচ্ছে, খুনটা গভীর রাতে হয়েছে। আর দুধওয়ালা তার রুটিন মাফিক রোজকার মত আসাতেই সর্বপ্রথম দেখতে পায়। তাকে টুকটাক অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেন তিনি। শেষে এ.এস.আই’র কাছে নাম-ঠিকানা লিখে দিয়ে আপাতত চলে যেতে বলেন। লাশ ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে যাবার হুকুম দিয়ে বাইরে অপেক্ষমান অন্যদের কাছে ফিরে আসেন তিনি।

এলাকার মেম্বার এবং কাউন্সিলর এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে আগাতেই এস.পি সাহেবের ফোন আসে। দু’জনে কিছুক্ষণ কথা বলেন-
– মনোয়ার সাহেব, এবার বলুন?
-স্যার! ভিকটিম সম্পুর্ণ একা ছিলেন ঘটনার সময়। পরিবারের বাকিরা বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিলো। খুনের মোটিভ এখনো জানা যায়নি। দামি কোনো কিছু নেয়া হয়নি। আসলে জিনিসপত্র কিছুই নেয়নি খুনি… এমনটাই যতদূর বুঝতে পেরেছি। কোনো ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। তবে খুনি স্যাডিস্ট কিনা তাও সম্পুর্ণভাবে বুঝা যাচ্ছে না। ময়না তদন্তের রিপোর্ট এলে জানা যাবে।
– হুমম.. উপর থেকে আমার কাছে বারবার ফোন আসছে। হোমরা-চোমরা কেউ নাকি ভিকটিম?
– না স্যার। সরকারি দলের স্থানীয় নেতা।

এবার কণ্ঠস্বর একটু নিচু করে ও.সি তার উপরওয়ালাকে জানায়,
-তবে স্যার, ভিকটিম ‘ড্রাগ রিংয়ের’ একেবারে নিচের সারির একজন। এই এলাকায় ‘ড্রাগ-সাপ্লাইয়ের’ কাজটা সে-ই দেখাশুনা করে। স্থানীয়। এলাকায় পারিবারিক প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক। থানায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলেও, ব্যাড-বুকে তার নাম আছে।
– আমাকে উপরে জবাব দিতে হচ্ছে। যতই ব্যাড-বুকে নাম থাকুক, এর পেছনের মানুষগুলো অনেক ক্ষমতাধর। আমি কি বলতে চাইচ্ছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই?
-স্যার!
– আই ওয়ান্ট ইমিডিয়েট অ্যাকশন। যে কোনো ভাবেই হোক, ফাইন্ড আউট দ্য কিলার।
-সকল ফ্যাক্টস একত্রিত করা হচ্ছে। আশাকরি ভাল কিছু জানাতে পারব, স্যার।
– আই ডোন্ট নিড ফ্যাক্টস। আই ওয়ান্ট রেজাল্ট.. গট ইট? আমি খুনিকে চাই।
-স্যার! আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব।

ওপাশ থেকে লাইন কেটে দেয়া হলো। একটু বিরক্ত হন ও.সি মনোয়ার। উপস্থিত সকলের দিকে তাকান পালা করে। তার চোখে চোখ পরতেই সবাই চোখ নামিয়ে নেয়। এটা দেখে মনটা আরো বিষিয়ে উঠে তার। এরা সবাই যেন চোর! চোর স্বভাবের। না হলে চোখ নামিয়ে নেবার কী প্রয়োজন? এরকম দু’একটা ড্রাগ-ডিলার মারা যাওয়াটা সমাজের জন্য ভালো। নিজের দুই ছেলের কথা মনে পড়ে। ওরাও যে কোনো সময় এই ড্রাগের খপ্পরে পড়তে পারে। একজন বাবা হিসেবে নিজের ভেতরে কেমন এক অসহায় অনুভবে বিলীন হন। তবে একজন পোষাকধারী কর্মকর্তা যখন সামনে আসেন, ভেতরের বাবাটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।

আমাদের সিস্টেম গোড়া থেকে খোকলা হয়ে আছে। এই থানায় পোষ্টিং নিতে তাকে কোটি টাকার উপর ঢালতে হয়েছে। কেন ঢেলেছেন? নিজের প্রশ্নে নিজেই বিব্রত হন। অনেক কিছুই এমন আছে, যেগুলো নিজের কাছেও জানতে চাওয়া যায় না।

হাতের ইশারায় অদূরে দাঁড়ানো এ.এস.আই কে ডাকেন।
– খোঁজ নাও তো, কন্ট্রাক্ট কিলাররা কে কোথায় আছে? গত রাতে কোথায় ছিল, সেটার উপরে জোর দাও। কিভাবে কি করবে জানি না। প্রয়োজনে সবাইকে তুলে আনো। হাগায়ে দাও। কিন্তু আসল সত্যটা আমার জানা চাই।
-স্যার।

নীরবে বেরিয়ে যাওয়া এ.এস.আই’র পেছন দিকটা অনেকক্ষণ ধরে দেখেন ও.সি মনোয়ার।

বাজারে। চা’র দোকান। সাদা পোষাকের পুলিশ বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এলাকায় অচেনা কেউ এসেছিল কিনা, নিহত লোকটির কোনো শত্রু আছে কিনা, পারিবারিক সহায়-সম্পত্তি নিয়ে নিজেদের ভেতর কোন্দল আছে কিনা- ইত্যকার সকল এঙ্গেল থেকে কৌশলে জানতে চাওয়া হয়। তবে বাঙালি সহজে মুখ খুলতে চায় না। তবে একবার খুললে, তা আর বন্ধও হতে চায় না।

অচেনা কেউ এসেছিল কিনা? এই প্রশ্নের উত্তরে কয়েকজন একজনের কথা বলে। কিন্তু রাতের আঁধারে সেভাবে তারা মানুষটিকে দেখতে পায়নি জানায়। কেউ লোকটির গালে হাল্কা দাঁড়ি আছে জানায়, তো অন্যজন জানায় ক্লিন সেভড ছিলো সে। চোখের মণি কেউ কালো বললে, অণ্য একজন বলে নীল ছিল। এভাবে যে যার মত রঙ লাগিয়ে বর্ণনা করে যেতে থাকে। সাদা পোষাকের পুলিশেরা বিরক্ত এবং বিব্রত হয়। মনে মনে লোকগুলোকে জঘন্য গালি দিয়ে সরে আসে তারা। উপরওয়ালাকে কি জবাব দেবে, ভেবে ভেবে সেটার এক রুপরেখা দাঁড়া করায় তারা।

বয়স্ক মানুষটি বাজারের ব্যাগ হাতে সাধারণ এক আবাসিক এলাকার ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেন। জায়গায় জায়গায় রাস্তা এতটাই ভাঙ্গা, হাঁটতে কষ্ট হয় তাঁর। রিক্সা পান নাই। বাধ্য হয়ে হেঁটে আসা। গরমে ঘেমে গেছেন। শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। হয়ত হাঁফানির টান আছে। কেমন ঘোলা চোখের দৃষ্টি। বেশ মেদ জমেছে শরীরের মধ্য ভাগে। হাঁসফাঁস করার সেটাও একটা কারণ। রাস্তার দু’পাশের বাড়িগুলোতে এখন অখন্ড অবসর। অনেকেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, বসে কাছের মানুষদের সাথে অলস আড্ডায় মগ্ন। কেউ কেউ তাকিয়ে সাদা চুলের পঞ্চাশোর্ধ মানুষটিকে হেঁটে যেতে দেখে। অচেনা মানুষ। তবে এই নগর জীবনে কে কাকে চিনে। হয়ত প্রতিবেশী-ই হবে মানুষটি। চোখ ফিরিয়ে নিতে নিতেই বৃদ্ধ লোকটির কথা ভুলে যায় তারা।

হেঁটে চলা মানুষটি এমনই। মনে রাখবার মত কেউ নন।

(ক্রমশঃ)

আগন্তুকঃ ধারাবাহিক উপন্যাস // পর্ব-০১

14681780_695556147266520_3409118497473353499_n
লোকাল বাস। স্টপেজে থামতেই দু’দল মানুষের উঠানামা। ক্ষনিকের বিরতিতে এলোমেলো সময়। মানুষগুলোও পলকের দ্বিধায় ভোগে। কেউ অপেক্ষমান রিক্সার খোঁজে তাকায়। দূ’একজন চা’র দোকানের পানে চেয়ে ভাবে- তেষ্টা মেটানো জরুরী, না বাসায় ফেরা? সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে অনেক-ই। তবে কেউ কেউ, ডানে-বামে না তাকিয়ে, সোজা হাঁটা ধরে।

এমন-ই একজন হেঁটে চলেছে। মহাসড়কের সাথের শান বাঁধানো চত্বরের কদম গাছটির নিচে আসতেই, পুরা এলাকার বিদ্যুৎ চলে যায়। নিমেষে ঘিরে ধরে আঁধার।
লোডশেডিং।
নাগরিক বিড়ম্বনা। অথচ…দেশজুড়ে কত আগডুম বাগডুম এই নিয়ে।

ঘরে ফেরা সেলাই দিদিমনিদের পিছু হেঁটে সে ও সামনে বাড়ায়। পথ একটা-ই। সামনে এগিয়ে গেছে।
জীবনের মত?

অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। সামনে দিয়ে আঁধারে জোনাকির মত মিটমিটে বাতি নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলে যায়। পেছন থেকে যাত্রীবোঝাই অটোরিক্সাগুলি, ডানে-বামে হেলতে দুলতে তাকে পাশ কাটায়। অন্ধকারে মানুষগুলি কেন জানি নিশ্চুপ থাকে।

বাজারের একটা চা’র দোকানে অচেনা লোকটি বসে। অর্ডার দেয়। চায়ের। দোকানি একপলক তাকায়। দেখে কী? একজন খদ্দের চারটা গোল্ডলিফ চায়। চা বানাবার ফাঁকে দোকানি তাকে বিদায় করে।

চা’র কাপে আলগা পাতি দেবে কিনা জানতে চাইলে, লোকটি নিরবে মাথা নেড়ে জানায় লাগবে না। চা’টা খারাপ হয়নি। চুমুক দিয়ে কাপ হাতে নিয়ে সে ভাবে।
অনেক বদলে গেছে এই এলাকাটি। সময়ের সাথে আমরা ও যেমন পালটে যাই, অঞ্চল ও কি আমাদেরকে অনুসরণ করে?
সামনের মার্কেটটি নতুন হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে সে নিরবে কাপ মুখের কাছে আনে।

দুই যুবক আসে। একজন বাম পায়ে ভর দিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়ায়। দূর থেকে হেঁটে আসায় একটু রিল্যাক্স করতে চায় বুঝি। অন্যজন সিগ্রেট চায়। তিনটা গোল্ড লিফ আর ছয়টা ম্যারিজ। দাম পরিশোধ করে দ্রুত চলে যায় ওরা। তাড়া আছে। অন্য কেউ হয়ত ওদের জন্য অপেক্ষা করছে।

চা’র দোকানে বসেই পুরা এলাকার খবর জানা যায়। এই যে দুই যুবক, দু’ধরনের সিগ্রেট নিলো। হয়ত এরা গাঁজায় আসক্ত। ওদের চোখ দেখে তার এমনই মনে হয়েছে। সিগ্রেটের দামের তারতম্য এবং ভিন্ন ব্রান্ডের হওয়ায়, শ্রেফ ধুমপানের জন্য কমদামিগুলি নেয়া হয়নি। অনেক দেখেছে সে।

আরো দীর্ঘক্ষণ বাজারের ঐ দোকানটিতে, জেনারেটর বালবের আলোয়-অচেনা লোকটি বসে থাকে। কেউ কেউ তাকে দেখলেও মনে রাখে না। তিনি এমনই। মনে থাকার মত কেউ নন।

লোকটি দাম মিটিয়ে যখন আধাঁরে মিলিয়ে যায়, বাজারে তখনও যুবতী রাতের কোলাহল। বেশ জমে গেছে। প্রতিদিনই এমন এখানে।

পরের দিন সকালে এলাকার এক বাড়িতে, নৃশংসভাবে খুন হওয়া একজনের লাশ পাওয়া যায়।

(ক্রমশ:)