না মানুষ

এস আই বদরুল তিন মাস আগে ঢাকার এক থানায় ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন। ভালো জায়গায় ট্রান্সফার তো এমনি এমনি হয়না, সিস্টেম করতে হয়। এই সিস্টেমে সাত লাখ টাকা খরচ, কিন্তু বদরুল পাঁচ লাখ টাকার মধ্যেই কাজ সেরে ফেলেছেন। বদরুলের চাচা রুলিং পার্টির স্থানীয় নেতা, এমপির সাথে তুই তোকারি সম্পর্ক। বদরুল ছাত্রজীবনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল। সব মিলিয়ে সিস্টেম ব্যায় দুই লাখ টাকা কম হয়েছে।

বদরুল ঢাকার পোস্টিংয়ে যোগ দিয়েই সিস্টেম ব্যয় পাঁচ লাখ টাকা সুদে আসলে উসুলের মিশন শুরু করে দিয়েছে। চাকুরী পাবার জন্য যে টাকা ব্যয় হয়েছিল তা এখনও উঠে নাই। জনতার বন্ধু পুলিশ, বদরুল পুলিশ, সুতরাং সেও জনতার বন্ধু। তাই সিস্টেম ব্যয় তোলার জন্য সে তার বন্ধু জনতার উপরেই নির্ভর করছে। ওসি সাহেবের কসম- বাকীরাও একই কাজ করেন। আইজিপি স্যার ব্যাপারটা জানেন না- বদরুলের মোটেও বিশ্বাস হয়না।

বৃহস্পতিবার বদরুলসহ অন্য পুলিশদের চাঁদরাত। তারা এই পবিত্র দিনের বিকেলের শেষ হতেই থানা এলাকার অর্থশালী এবং সম্মানীত পরিবারের কিশোর ও তরুণ সদস্যদের আটকে ততপর হন। নিজের খরচে পকেটে ইয়াবা, গাঁজা বা ফেন্সিডিল ঢুকিয়ে দেন। মোবাইল চেক করার নামে নীলছবিপূর্ণ মেমোরীকার্ড ঢুকিয়ে দেন। তারপর অভিভাবকদের থানায় ডেকে আনেন। অবশ্য যাদের প্রভাবশালী আত্নীয় স্বজন আছেন তারা থানায় আসেন না, উল্টো ধমক-ধামকে থানার ওসিকে অতিষ্ট করে তোলেন। এই ধমকের চোটে প্রভাবশালী আটককৃতদের ছেড়ে দেন। কাউকে কাউকে দায়িত্ব নিয়ে বাসা পর্যন্ত পৌছে দিয়ে আসেন। যারা থানার বখরা বকেয়া রেখে বা না দিয়ে অবৈধ ব্যবসা করেন বৃহস্পতিবারে টার্গেট করে তাদেরও ধরা হয়। অতঃপর উভয়পক্ষের সৌহার্দ্যপূর্ণ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বখরার নতুন রেট নির্ধারিত হয়, বকেয়া বখরা পরিশোধ হয়। আড়ালে আবডালে একত্রে দ্রুত চুমুকে মোহনজল গিলাও চলে।

সাধারণ যারা আছেন, যে কোন মূল্যে নিজেদের মান সম্মান রক্ষায় সদা জাগ্রত-তারা প্রধান টার্গেট। বদরুল বাহিনী তাদের বিভিন্ন ধরনের ভয় দেখান। যেমন- শনিবার ও রবিবার কোর্ট বন্ধ- দুইদিন হাজতখানায় আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। চলবে অবিরাম পিটানি আর ডিম থেরাপি। রবিবারে আদলতে তুললেও লাভ নাই কারণ এই মামলায় জামিন হবেনা, উল্টো রিমান্ডে দেওয়া হবে। হাজিরা দিতে দিতে জীবন যাবে। সাত বছরের জেল থেকে খোদাও রক্ষা করতে পারবে না। এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে অভিভাবকরা চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেন তখন অন্য কোন সহযোগী বা থানার দালাল বন্ধু হয়ে এগিয়ে আসেন। নরম কণ্ঠে অভিভাবকদের ভরসা দেন, দৃপ্ত কন্ঠে জানান- টাকা পয়সা খরচ করতে পারলে ওসি সাহেবকে রিকোয়েস্ট করে ছাড়ানো যেতে পারে। অভিভাবকদের কেউ কেউ দর কষাকষি করেন, কেউ কেউ করেন না। বদরুল জানে শুধু তার থানাতেই নয়, ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি থানায় বৃহস্পতিবার বিকেল হতে মধ্যরাত পর্যন্ত জনতার সাথে পুলিশের এমন বন্ধু বন্ধু খেলা চলে।

বদরুল বহু পরিশ্রম করে গত তিন মাসে প্রায় দুই লাখ টাকা উঠাতে পেরেছে। একটা টার্গেটও ব্যর্থ হয় নাই। এভাবে চললে সিস্টেম ব্যয়ের অবশিষ্ট তিন লাখ টাকা আগামী চার-পাঁচ মাসের মধ্যে উঠে যাবে। চাকরী নেবার সময়ে যত খরচ হয়েছিল তা উঠাতে এমন কঠোর পরিশ্রম জারি রাখতে হবে। তারপর নিজের ভবিষ্যতের জন্য ক্যাশ জমাতে হবে- একটা বাড়ি, একটা ব্যবসা, সন্তানদের ভালো ইশকুলে লেখাপড়ার খরচ জোগানো কি মুখের কথা। এক একটা দিন বদরুল ভাবে বছর পাঁচেক মন দিয়ে ডিউটি করে চাকুরী ছেড়ে দিবে; ছোটখাটো ব্যবসা করবে বা বিদেশে চলে যাবে- যেন তার সন্তান বড় হয়ে জিজ্ঞেস করতে না পারে “বাবা, তুমি পুলিশ না মানুষ!”

5 thoughts on “না মানুষ

  1. “বাবা, তুমি পুলিশ না মানুষ!”

    * চমৎকার অনুগল্প…

    শুভরাত্রি।

  2. তা্ও ভালো বদরুল মানুষ হতে চায়,,,,,,,,,,,

    বড়ই ক্রানি্তকাল!!!!

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।