ট্যাগ আর্কাইভঃ সাঈদ এর অণুগল্প

পৃথিবী

বাদল। আট বছরের বালক। বাড়ি সিরাজগঞ্জ। বাবা-মার সাথে টংগীতে এসেছে। বাবা ভ্যান চালায়, মা আর বাদল কার্টন বক্স বানানোর কারখানায় চাকুরী পায়। শুরু হয় নতুন জীবন, সুদিনের সংগ্রাম।

হরতাল চলছে। ভ্যান চালানো বন্ধ। কার্টনের কারখানায় কাজের চাপ। রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। একরাতে ঘটে যায় দূর্ঘটনা। বাদলের ছোট পা কারখানার বড় ফ্যানে আটকে যায়। হাটুর নিচের মাংস থেতলে যায় আর হাড় ভেংগে যায় কয়েক টুকরায়। কারখানার মালিক আর বাদলের মা মিলে বাদলকে নিয়ে আসেন ঢাকার পংগু হসপিটালে। বাদলকে হসপিটালে ভর্তি করিয়েই মালিক কেটে পড়েন। অবশ্য তার আগে বাদলের মায়ের হাতে দিয়ে যান কয়েক দিন কাজ করার মজুরী বাবদ পাঁচশো টাকা।

হসপিটালের দ্বিতীয় দিন। সকাল থেকেই বাদল বাবাকে দেখতে চাইছে। বাবা এলেন শেষ বিকেলে, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বিধ্বস্ত। টংগী থেকে হেটে হেটে আগারগাওয়ে এসেছেন। হাতে একটা মাত্র উজ্বল কমলা লেবু। হরতালে ভ্যান চালাতে পারেন নাই, কূলির কাজ করে সামান্য যা পেয়েছেন তাতে এর বেশী কিছু সাধ্যে কূলায়নি। ভূগোল বইয়ে আছে পৃথিবীর আকার কমলা লেবুর মত, বাদলের বাবার হাতের কমলা লেবুটাই যেন পৃথিবী হয়ে ওঠে।

(গল্প নয় সত্যি)

লংকা কিন্তু জ্বলছেনা

হনুমান ল্যাজে আগুন জ্বালিয়ে বসে আছেন। টিকেট কনফার্ম করা হয় নাই। অনেক আগেই লংকার ফ্লাইট চলে গেছে। আগুনের আঁচ গায়ে লাগতেই স্টেশন ম্যানেজার বললেন ‘কতদিন আলুপোড়া খাই না! এই আগুনে বার-বি-কিউ বেশ হত। অকাল কুষ্মান্ড দিয়ে অমাবস্যার চাঁদের চচ্চরি খেতে খেতে জিহ্বায় নির্ঘাত আলসার হয়ে গেছে, আলজিহবার জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যাথা।’

দরবেশ বাবা বগলে দুই ইট নিয়ে শেখ ফরিদের নাম জপছিলেন। তার জপের তেজে শেয়ার বাজার পুড়ে ছাই। ছাই চাপা দিতেই বগলের ইট কারুকার্যময় হলো হীরা-চুনি-পান্নায়। ইট থেকে দুটি হীরা সাদা পায়রা হয়ে পদ্মা সেতুর দক্ষিণে উড়ে গেল। নবাব সিরাজদৌলা বললেন, ‘কে দিবে এর জবাব? শুধুই কি তোমাদের নবাব!’ পলাশীর আম্রকাননের আমে ফরমালিন মিশাতে মিশাতে মোহনলাল বললেন ‘ধুত্তরি, টিভির রিমোট কমোডে পরে গেছে। বিটিভি দেখিছি, এনিমেল প্ল্যানেট দেখি নাই।’

তলোয়ার উচিয়ে চেঙ্গিস খান জিজ্ঞেস করলেন, ‘আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের হেড অফিসটা কোথায়?’ মাদার তেরেসা জানালেন তার হোমেই যুদ্ধ শিশুরা নিরাপদ। তৌমুর লং-এর খোড়া পায়ের চিকিৎসার কোন সমস্যা হবেনা। এ কথা শুনে চুরুটের বদলে ডিনামাইট ফুঁকতে ফুঁকতে আলফ্রেড নোবেল পাশ ফিরে শুলেন। সানি লিওন মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, ‘মিনসের ঢং দেখে আর বাঁচিনা। ভায়গ্রা কেনার টাকা নাই আবার ডিনামাইট ফুঁকে।’

চানক্য পন্ডিতের হিসেব কিছুতেই মিলছেনা। তেল মাখা বাঁশে পিছলে যাচ্ছে সুগ্রীব আর বিভীষণ। ড. ইউনুস বললেন বাঁশ, তেল এবং বানরের উচ্চাকাংখার উদ্যম নিয়ে জমজমাট সামাজিক ব্যাবসা হবে। তেল আর বাঁশের ব্রান্ডিংটা ঠিকমত করতে হবে।’ চানক্য বললেন ‘বিএসটিআই ম্যাগি নুডুলসে সীসা পায় নাই। লাইনঘাট জানা থাকলে তেল আর বাঁশও হবে আন্তর্জাতিক মানের। তবুও তো হিসেব মিলছে না, হনুমানের লেজ জ্বলছে – লংকা কিন্তু জ্বলছেনা।’

স্বপ্ন অথবা ঘোর

লম্বা বেঞ্চে বসে আছে ফয়সাল। নিজের সংগে কথা বলছে। খারাপ লাগছে না। মনে মনে চলছে নিবিড় কথোপকথন।

: তারপর?
: মেসের দুই মাসের ভাড়া বাকী। এক লাখ টাকা থেকে ভাড়া দিব। তিনমাসের ভাড়া অগ্রীম দিব। মাসে মাসে ভাড়ার চিন্তা ভাল লাগেনা। দিন যে কিভাবে যায়! মাস শুরু হতে না হতে আগামী মাস এসে হাজির।
: তারপর?
: চাকরী কপালে নাই। ছোট টং দোকান দিব। একটা পিচ্চি রেখে নিব। বেশী পরিশ্রম সহ্য হবেনা। এক লাখ টাকা থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরো আলাদা করে রাখতে হবে। পঞ্চাশ হাজারে জমপেশ টং দোকান হয়ে যাবে। ঢাকা শহরে বসবাস করা তখন কঠিন হবেনা।
: তারপর?
: ছোট বোনটাকে কিছুই দেয়া হয় নাই। শ্বশুর বাড়িতে সে ভালো আছে। একটা মাত্র ছেলে। সেই ছেলে মামা ভক্ত। ভাগ্নেকে একটা খেলনা গাড়ী দিতে হবে। পাঁচশো টাকার মধ্যে সুন্দর চায়না গাড়ী পাওয়া যাবে। এক লাখ টাকার মধ্যে পাঁচশো টাকা মানে ০.৫% ভাগ্নের জন্য বরাদ্দ।
: তারপর?
: তারপর টুকটাক খরচ আছে। টাকা পেয়ে মাথা নস্ট করলে চলবে না। একলাখ টাকা অনেক টাকা। খুব হিসাব করে, আচ্ছা দাড়াও পরে আলাপ করছি। আগে দেখি উনি কি বলেন।

পিয়ন এসে বলে- আপনি ভিতরে যান। ফয়সাল ভিতরে যায়। আরেফীন সাহেবের সামনে বসে।

আরেফীন সাহেব: ফয়সাল সাহেব, আপনাদের বয়সের ব্যবধান কিছুটা বেশী। মাস খানেক অপেক্ষা করুন। কাছাকাছি বয়সের পাওয়া না গেলে আপনি ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই। নিন চা খান।”

ফয়সাল চা খায়। বের হয়ে আবার বেঞ্চে বসে। আবার নিজের সাথে কথোপকথন শুরু হয়।

: তারপর?
: বয়সের ব্যবধান বেশী। কাছাকাছি বয়সের না পেলে আমাকে ছাড়া বিকল্প নাই। হা: হা: হা:
: তারপর?
: আমাকে ছাড়া সত্যিই কোন বিকল্প নাই। কোন বিকল্পই নাই।
: কেন?
: বিকল্প কোথায় পাবে ! আজকাল মাত্র একলাখ টাকায় কে কিডনী বিক্রি করবে!

নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বের হয়ে আসে ফয়সাল। একমাস। ত্রিশ দিন। দেখতে দেখতে চলে যাবে। একলাখ টাকা খুব কি কম!! হিসেব করে খরচ করতে হবে। আচ্ছা একলাখ টাকা কত টাকা! একলাখ টাকার স্বপ্ন তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

ঘুম ভেঙে গেলে স্বপ্নরা জেগে থাকে। স্বপ্নরা ঘুমকে জাগিয়ে রাখে।

অপঘাত

: ইন দ্য ইয়ার অফ ১৯৪২, আমাদের এই মিরপুরের শ্যাওড়া পাড়ার ঘটনা। অণুগল্পকার মোখলেস খন্দকার গভীর রাতে অণুগল্প লিখছিলেন।
: শফিক চাচা, তারপরে কি হলো?
: তিনি গল্প লিখে শেষ করার আগেই স্ট্রোকে মারা যান। তার সাথে অসমাপ্ত গল্পটারও অপমৃত্যু ঘটে।
: গল্পও মারা যায়!
: মারা গেলে ভালোই হত, কিন্তু গল্পটা পুরোপুরি মারা যায় না। আফটার অল অপমৃত্যুতো।
: তবে?
: ধর্মীয় নিয়মে মোখলেস খন্দকারের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। কিন্তু অপঘাতে মৃত্যু আর শেষ কৃত্য সম্পন্ন না হওয়ায় অসমাপ্ত অণুগল্পটা ভুতে পরিনত হয়। বাড়ির দক্ষিণ দিকের তমাল গাছে আশ্রয় নেয়। একা একাই থাকত। ঝামেলা করতো না।
: তারপর?
: একদিন সন্ধ্যায় এক প্রখ্যাত অণুগল্পকার গল্পের প্লট ভাবতে ভাবতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে তমাল গাছের পাশের দেয়ালে হিসু করছিলো। সেই হিসুর ছিটা গল্পভুতকে ভিজিয়ে দেয়। ভুতের ভিতরের ভুতোত্ব জেগে ওঠে।
: তারপর?
: অতৃপ্ত আত্নার মত অসমাপ্ত অণুগল্প ঐ অণুগল্পকারের কাধে সওয়ার হয়।
: তারপর?
: তারপরের অবস্থা ভয়াবহ। প্রায় সারাক্ষণ অণুগল্পের ভুত লেখকের কাধে আসর করে থাকে। সে অস্থির হয়ে ওঠে। কখনও কখনও ফেরোসাস, ভায়োলেন্ট। নিজে লিখে, সামনে যাকে পায় তাকে দিয়েই অণুগল্প লেখাতে চায়। না লিখলেই দায়ের কোপ।
: বলেন কি!
: কিছুদিন আগে পাংগাস মাছের ফেরিওয়ালাকে অণুগল্প লেখার জন্য রাম দা নিয়ে তাড়া করেছিল। সেই থেকে এই গলিতে ফেরিওয়ালারা ঢুকে না।
: তাই না কি! ভুতের গল্পের নামে আজগুবি কি এক গল্প শোনালেন। ভয় নেই, থ্রিল নেই, সাসপেন্স নেই। বানোয়াট গল্প, দূর্বল কাহিনী।
: ইয়ংম্যান, জানতাম, আপনি বিশ্বাস করবেন না। সোজা তিন তলায় উঠে কলিং বেল বাজান। সাসপেন্স, থ্রিলার আর ভূতের ভয় আপনার শরীরের প্রতিটি রোমকূপে অনুভব করবেন।
: তবে তিন তলাতেই যাই, ভুত দেখে আসি।

সেলিম সাহেব মুক্তমনা লোক। দ্রুত সিড়ি ভেংগে তিনতলায় উঠে গেলেন। পাঁচ মিনিট পরে বিশাল শোরগোল। সেলিম সাহেব ‘বাঁচাও…বাঁচাও’ বলে প্রাণপনে সিড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় দৌড়াচ্ছেন, তার পিছনে পিছনে ‘তুই অণুগল্প লিখবিনা! তোর বাপ লিখবে… তোর দাদা লিখবে… তোর চাচামামাখালুফুপা লিখবে.. ফোরটিন্ত দুগুনে টুয়েন্টিএইট গুষ্টি লিখবে…: বলে চেচাতে চেচাতে দুই হাতে শান দেয়া দুই রামদা নিয়ে প্রখ্যাত অণুগল্পকার বেলাল দৌড়াচ্ছেন। অণুগল্পের ভুত আজ একটু বেশীই ক্ষেপেছে, চৌদ্দগোষ্ঠীর সীমাকে অপঘাতে ঘায়েল করে আটাশগোষ্ঠীতে পৌছে গেছে।

এলবেন ডিএস

শেফা ফার্মেসী। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আড্ডা জমে। এলাকার বিভিন্ন বয়সী কয়েকজন নিয়মিত আড্ডা মারতে আসেন। ফার্মেসীর মালিক মজনুও যোগ দেয়। ফার্মেসী সামলায় রনি। রনির বয়স কম। ভীষণ করিতকর্মা। প্রাণবন্ত রসিক।

আড্ডার সদস্যরা ছোটখাটো স্বাস্থ্য সমস্যায় রনির শরণাপন্ন হন। রনির দেয়া ওষুধ খান। এক সকালে বিধ্বস্ত অবস্থায় শাহজাহান চাচা হাজির-
: রনি, মাথা ব্যাথায় মইরা যাইতাছি, বাবা রে বাচা।
: চাচা, নাস্তা খাইছেন?
: হ, বাবা।
: তেইলে টুলে বইসা এই ট্যাবলেটটা চুইসা চুইসা খান। দশ মিনিটে মাথাব্যাথা কইমা যাইবো।

শাহজাহান চাচা টুলে বসে চোখ বন্ধ করে ওষুধ চুষতে লাগলেন। দশ মিনিটের আগেই ব্যাথা কমে গেল। তিনি কৃতজ্ঞতার সুরে রনির কাছে জানতে চাইলেন-
: বাবা, এই ওষুধের নাম কি?
: চাচা, এইটা এলবেন ডিএস।
: মাথা ব্যাথার খুব ভালা ওষুধ।
: হে: হে: হে: এইটা মাথা ব্যাথার ওষুধ না।
: তবে কিয়ের ওষুধ?
: কৃমির ওষুধ হে: হে: হে:
: হারামজাদা, তুই আমারে কৃমির ওষুধ খাওইয়া মশকরা করস, ***বাচ্চা…
: চাচা, চ্যাতেন ক্যান! আপনার সমস্যাতো মাথায় না, সমস্যা অইলো কৃমিতে। প্যাটের কৃমি আশকারা পায়া পায়া মাথায় উইঠা গেছিল হে: হে: হে: তাগো নামায়া দিলাম হে: হে: হে:

শাহজাহান চাচা হঠাত শান্ত হয়ে যান। টুলে বসেন। রনিকে চা আনাতে বলেন। দৈনিক পত্রিকাটা হাতে নেন। হেডিংগুলো পড়তে পড়তে রনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,’বাবা, তুইতো আমার মাথা থেকা কৃমি নামায়া দিলি। যে কৃমিরগুষ্ঠীরে আমরা দ্যাশের মাথায় তুইলা দিছি তাগো নামানের লেগা এলবেন ডিএস খাওয়াইবো কেডা!’

সনোলোজিস্ট

রাতের খোলস থেকে কিভাবে বের হয় একটা সতেজ ভোর! জানালা দিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস। ফজরের আজানে মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে এত সুর কোথা থেকে আসে! ডাক্তার কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। খেলে কিছুটা সময়ের জন্য ঘুম আসে, তারপর কেমন এক অস্বস্তি আকড়ে ধরে। না ঘুম, না তন্দ্রা, না জাগরণ। কোনো ভুডু ওঝা যেন মন্ত্র পড়ে আমাকে জীবন্মৃত করে রেখেছে। তবু বাতাসের ঝিরিঝিরি শব্দ পাই, নরম শীতলতা পাই, রাতের কলি হতে একটা নতুন সকাল ফুটে ওঠার আভাস পাই, ঘোর অথবা জাগরণে ঘাস ও মাটির সোদা গন্ধ মিশানো সকালের দৃশ্যকল্প দেখি।

কোন এক কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে উপমা আমাকে দশটা গাঢ় লাল গোলাপ দিয়েছিল। বিন্দু বিন্দু শিশিরকণায় পাপড়িগুলো সিক্ত ছিল। সেই কবেকার কথা! বাস্তবিকই আমি তখন গোলাপের অর্থ বুঝতাম না। উপমা এখন নামজাদা আল্ট্রাসনোলোজিস্ট। আচ্ছা, গোলাপের কি আল্ট্রাসনোগ্রাফ করা যায়! মানুষের মত মৃত্যুর আগে কি প্রতিটা গোলাপ অন্তত একবার বেঁচে ওঠে! বাঁচার মত ক্ষণিকের জন্য বেঁচে ওঠা।

নোমিনেশন

: ফজু, একটা নমিনেশিন পেপার যে কিনতি হয়!
: বড় ভাই কি ইলাকশন করিবেন!
: না রে ফজু, বাণিজ্যি করিবো।
: নমিনেশিন পেপার কিনিবেন ক্যানে!
: বাণিজ্যি করিবো, নমিনেশিন পেপার লাগিবে না! নমিনেশিন পেপার কিনিবার পরে বড় বড় কইরে দুইটা মিছিল করিবো, পুস্টার সাটাইবো, জনসংযোগ করিবো, ইনভেস্টমেন্ট, বুঝিছিস!
: না, বড় ভাই। সব করিবেন, ইলাকশন করিবেন না! ক্যামন ঝাইপসা ঝাইপসা লাগে।
: নির্বাচন করিলে ফেল মারিবো। তাই বাণিজ্যি করিবো।
: মানে?
: মানে অইলো ফাইট করিবার মত আমাগো তিন ক্যান্ডোডট আছে, তাগো কাছ থেকি ৫লাখ টাকা করি নিয়ি বইসে পরিবো।
: এব্যা বুঝিছি, বাণিজ্যি বুঝিছি।
: ফজু, পরশু নমিনেশিন কিনিতে যাবো, লোকজন রেডি কর, ট্যাক্যার জন্যি চিন্তা করিস না। তুই আমার ম্যানেজর, সব দায়িত্বি তোর।

ফজু লোকজন যোগাড়ের বায়নার টাকা নিয়ে বেরিয়ে পরে। তার মনের ভিতর খচখচ করে- আহা, ইনভেস্ট করার মত টাকা থাকলে একটা নোমিনেশন পেপার কেনা যেত! বহুদিন পরে সে বড় ভায়ের শত্রু আনিস মাদবরের আড়তের উদ্দেশ্যে হাটা দেয়।

পারবি!

সময় তুই আমারে আবার সেই জীবনে নিয়া চল-

যেই জীবনে সব চাইতে বড় পাওয়া আছিল আটআনা দামের লেবেনচুষ, মালাই আইসক্রীম আর একটাকা দামের কুলফি বরফ…

যেই জীবনে আস্ত একটা ছুটির দুপুরে মহল্লার অন্য পোলাপাইনের লগে গিয়া ফুটবল খেলা মানেই আছিল স্বাধীনতা…

যেই জীবনে গুড্ডি উড়াইতে গিয়া বুন করতে না পারার মধ্যে আছিল বিকাল ভরা আনন্দ…

যেই জীবনে দোস্ত’গো লগে কাইজা কইরা সারা জীবনের লেগা কাট্টি লওয়ার মেয়াদ আছিল খুব বেশী হইলে দুই তিন ঘন্টা…

যেই জীবনে গুড্ডি ছিড়া গেলে, লাট্টুর লত্তি হারায়া গেলে আর খেলনা ভাইঙ্গা গেলে দু:খে চোখ ভইরা পানি আইতো…

যেই জীবনে আব্বার কান্দ আছিল দুনিয়ার সব চাইতে উঁচা পর্বত আর আব্বার কান্দে চইড়া শূণ্যে হাত বাড়ান মানেই আছিল আকাশ ছোঁয়া…

যেই জীবনে আম্মারে জড়ায়ে ধরলে আর কোন ভয়ডর থাকতোনা, আম্মা বুকের লগে চাইপা ধরলেই মনে অইতো দুনিয়ার কেউ আমারে কিছু করতে পারবোনা…

সময়, আমি তোর লগে ঐ জীবনে ফিরা যাইতে চাই। পারবি!- আমারে লয়া যাইতে!!

মায়ামুক্তি

: বুঝলি নগেন, মায়া সব মায়া। দারা পুত্র পরিবার, তুমি কার? কে তোমার?
: গুরুজী, মায়ার ছোট বোন ছায়াকে ছাড়া বাচপো নানে।
: ছায়ার কথা কচ্ছিস! সে যে আরো বড় মায়া রে… কঠিন মায়া…
: গুরুজী ছায়া ছাড়া বাঁচি থাকি কি হপে! আমি মরি যাপো।
: ধুর! মরবি ক্যানে! এত করে যখন জিদ ধইরেছিস তবে তোকে মায়ামুক্ত কইরে দিব।
: গুরুজী, আমাকে কি করতি হপে?
: তোর কিচ্ছু করতি হবেনানে। তবে আমার খরচ না দিলি, জিনিসপত্তরের খরচতো দিতি হবে, না কি নগেন!
: নিঘঘাত দিপো, নিঘঘাত দিপো।
: তুই বারো হাজার দিবি, আর আমার খরচ দশ হাজার- ইচ্ছা হলি দিবি, ইচ্ছা না হলি দিবিনা।

নগেন পরের দিন দুপুরে গঞ্জের হাটে গোয়ালের গরু বেঁচে। বিকেলে গুরুজীর পবিত্র হাতে একত্রে বাইশ হাজার টাকা তুলে দেয়। গুরুজী কথা রাখেন। সেদিন রাতেই ছায়াকে নিয়ে পালিয়ে মায়ার কষ্ট থেকে নগেনকে মুক্তি দিয়ে যান।

দোলনা

খুরশীদা আর মিজান রিকশা দিয়ে যাচ্ছে। সাথে তাদের প্রথম সন্তান। মিজান বাম হাতে খুরশীদার ডান হাত ধরে রেখেছে। ঢাকা শহরের জামে হোঁচট খেতে খেতে এগুচ্ছে রিকশা।

: আপনে বাবুরে একটা দোলনা কিন্যা দিবাইন?
: কিন্যা দিবাম, বুঝছুইন।
: বাবুরে একদিন চিড়িয়াখানায় লয়া যাইবাইন?
: হ, যাইবাইম, তুমারেও লয়া যাইবাইম।
: আমাগো বাবুরে কুনুদিন বকবাইন না, মারবাইন না।
: না, আমরা কি পাষান যে বাবুরে মারবাম!

দুজনে হুহু কান্না আটকে কথা বলে চলছে। প্রথম সন্তানের প্রতি অপার মমতায় আপ্লুত হচ্ছেন প্রথম মাতা-পিতা। অথচ তারা এখনও সন্তানের চেহারা দেখেন নাই। হয়তো কোনদিন দেখবেন না। কারন চরম অভাবের সংসারে দারিদ্র সবসময় স্নেহ আর ভালবাসাকে পরাজিত করে, খুন করে।

জাম কেটে কেটে রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে সস্তায় এবরশন করানোর ক্লিনিকের ঠিকানায়। খুরশীদা আর মিজান অশ্রুসজল। নিরুপায়। তাদের মনের গহীনে এক দোলনায় হাসতে হাসতে দোল খাচ্ছে প্রথম সন্তান, তাদের বংশধর।

গূঢ়গম্ভীর গ্রন্থ

বিজ্ঞজন কহিলেন পার’তো গূঢ়গম্ভীর বিষয়ে একখানা মোটাসোটা গ্রন্থ রচনা কর। এলেবেলে যাহা লিখিবার হুমায়ুন আহমেদ দুই হাতে লিখিয়া গিয়াছেন। তোমার না লিখিলেও চলিবে।

বলিলাম, “স্পনসর পাইলে সাড়ে চারিশত পাতার একখানা গূঢ়গম্ভীর গ্রন্থ লিখিয়া দিতে পারি। এই গ্রন্থ বিক্রয় করিয়া স্পনসরের অর্থ মুনাফা সমেত ফিরত আসিবে- শতভাগ লিখিত নিশ্চয়তাও দিতে পারি।”

বিজ্ঞজন সন্দেহযুক্ত মন আর বিষ্ময়যুক্ত দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসিলেন, “গূঢ়গম্ভীর গ্রন্থ রচনা করা কি এতই সহজ?”

বিনয়ের সহিত উত্তরিলাম, “সকলের নিকট সহজ নহে, কাহারো কাহারো নিকট অতি সহজ বটে। আজকালের কিছু কিছু গূঢ়গম্ভীর গ্রন্থ পড়িয়া আমার দৃঢ় আত্নবিশ্বাস জন্মাইয়াছে।”

বিজ্ঞজন কি বুঝিলেন তিনিই জানেন। অতিশয় মনযোগ সহকারে জিজ্ঞাসিলেন, “তোমার গূঢ়গম্ভীর পরিকল্পনা কিরুপ?”

কণ্ঠে সকল গাম্ভীর্য আনিয়া বলিলাম, আমার গ্রন্থের নাম হইবে “নান্দনিকতা ও খাদ্যপ্রানঃ রবীন্দ্র দর্শনে রেসিপি ভাবনা।” এই পুস্তকের ৩২৫ পৃষ্ঠা ভরিয়া কেকা ফেরদৌসীর সাক্ষাতকার থাকিবে। ২৮ পৃষ্ঠা জুড়িয়া দন্ত ভাঙ্গিয়া যায় এমন ভাষায় নান্দনিকতা আর খাদ্যপ্রাণ বিষয়ে আলোচনা থাকিবে, যেন অসীম সাহসী পাঠক তিন পৃষ্টা পাঠ করিবার পরে চতুর্থ পৃষ্ঠা পাঠ করিবার দুঃসাহস না পায়। ৬০ পৃষ্ঠা জুড়িয়া থাকিবে প্রাণময় খাদ্য আর খাদ্য গ্রহন করিবার কালে কিরুপ রাবীন্দ্রিক/নান্দনিক বাঙ্গালী পোষাক পরিধান করিতে হইবে তাহার রঙ্গীন ছবি। অবশিষ্ট ৩০ পৃষ্ঠা জুড়িয়া থাকিবে কোন খাদ্য গ্রহনের সময়ে কাহার কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের কোন গান শ্রবণ করিতে হইবে ও কোন মিউজিক ভিডিও দেখিতে হইবে তাহার তালিকা।”

বিজ্ঞজন ততধিক গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসিলেন, “তোমার ধারনা এই পুস্তক লোকে কিনিবে? কেনো কিনিবে!”

আত্নবিশ্বাসের সহিত বলিলাম, “অবশ্যই কিনিবে। কারন ইহাতে রবীন্দ্রনাথ আছেন, গূঢ়গম্ভীর নান্দনিকতা আর বিজ্ঞানময় খাদ্যপ্রাণ আছে, রেসিপি আছে, ফ্যাশান আছে, শোবিজ মানে সঙ্গীত আর মিউজিক ভিডিও আছে, তাতপর্যময় বাঙ্গালীত্ব আছে। এইসব লইয়া যদি বিশ-ত্রিশ’টা টিভি চ্যানেল বছরের পর বছর চলিতে পারে, দৈনিক পত্রিকা/সাপ্তাহিক/পাক্ষিক ম্যাগাজিনের সাহিত্য পাতা/ লাইফস্টাইল/ফ্যাশন/পুষ্টি/ঐতিহ্য বিভাগ অনায়াসে দশকের পর দশক চলিতে পারে তবে সকল কিছু লইয়া এক মলাটের ভিতর আমার রচিত গূঢ়গম্ভীর গ্রন্থ লোকে কিনিবে না কেন! আলবাত কিনিবে, লাইন ধরিয়া কিনিবে।”

বিজ্ঞজন প্রসন্ন চিত্তে বলিলেন, “আমি স্পনসরের ব্যাপারে মোবাইল কোম্পানী আর মসলা উতপাদনকারী কর্পোরেট কোম্পানীর সহিত যোগাযোগের চেষ্টা করিবো। এই পরিকল্পনা লইয়া আর কাহারো সহিত আলাপ করিওনা, গোপন রাখিও।”

আপনারা আমার নিকটজন বলিয়া সবিস্তারে জানাইলাম। তাহা ছাড়া এই বাজারে সাড়ে চারিশত পৃষ্ঠার একখানা গ্রন্থ কিনিবার জন্য পূর্ব প্রস্তুতির একটা ব্যাপার আছে, হোক না তাহা গূঢ়গম্ভীর গ্রন্থ।

গ্রাস

: আজ পূর্ণিমা, জানো?
: হি: হি: হি:
: পূর্ণিমা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান আছে-
: হি: হি: হি:
: হুমায়ুন আহমেদের হিমু পূর্ণিমা রাতে জোছনা খায়-
: হি: হি: হি:
: আজ সারা রাত তুমি আর আমি আর পূর্ণিমা
: হি: হি: হি:
: তুমি আমি আর কবিতা, গান, মুগ্ধতা..
: হি: হি: হি:
: দুজন হাত ধরে বসে থাকব সারারাত…
: হি: হি: হি:
: বারান্দার চেয়ারে বসে কেটে যাবে রাত, চন্দ্রাস্ত দেখার পরে তোমার ছুটি…
: তেইলে আসল কাম করবেন কখন?
: তুমি আজ বসে থাকবে, এটাই তোমার আসল কাজ।
: কন কি! হাত ধইরা বইয়া থাকনের লেগা কেউ মাইয়া মানুষ ভাড়া করে!
: আমি কবি, আমি করেছি।
: আপনে আপনার কবিতা ঠাপায়া মুড়ি খান। আমারে যাইতে দ্যান। দেরী অইলে কাস্টমার পামু না।
: যাবে কেন? থাকো। তোমার টাকা তুমি পাবে।
: আপনে আসল কাম না কইরা টাকা দিলে আমি নিমু ক্যান! চামেলি মাগী অইতে পারে, কিন্তু ফাউ ট্যাকা লয় না, গতর খাটায়া মজুরী লয়।

বারান্দার দুই চেয়ার এবং বেডরুমের ডিম লাইটের ঘোলা আলো জানে কবির রোমান্টিসিজম আর চামেলীর মজুরী তত্ব – কে কাকে গ্রাস করেছিল।

যোগী সোসাইটির মাঠ

ফাঁকফোকর পেলে ঢুকে পরাই আলোর স্বভাব, হাওয়ারও। যেখানে ঢুকতে পারেনা সেখানেই অন্ধকারের রাজত্বে উস্কানি দেয়, দমবন্ধ গুমোট করে তোলে। যোগী সোসাইটির মাঠেও আলো নিজ চরিত্র ভুলে শুদ্ধ হয়ে ওঠেনি, হাওয়াও।

হেমন্তের মিহি কুয়াশায় বিভোর মাঝরাত। ভরা পূর্ণিমা। জোছনায় ভেসে গেছে যোগী সোসাইটির চতুষ্কোণ মাঠ। মাঠের তিন দিকে ঘণ ঝোপঝাড়, বড় বড় ক’টা বট গাছ। ওখানে জোছনার জোড় খাটেনি। ওখানে ঘাপটি মেরে বসে আছে ভয় ভয় আবছায়া, ঝোপঝোপ অন্ধকার। সতর্ক সংকেতের মত জ্বলছে-নিভছে জোনাকি।

যোগী সোসাইটির সদস্যরা গোল হয়ে বসেছে। জোছনায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবার চেহারা। চেহারাগুলোতে গাঢ় ক্ষুধা আর সীমাহীন উত্তেজনার ছাপ। বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছে বৃদ্ধ এক নারী। তার হাত বাঁধা, পা বাঁধা, মুখ বাঁধা, শুধু চোখ দু’টো খোলা।

যোগী সোসাইটির জননী আতঙ্কিত চোখে আকাশ দেখছে। মিহি মিহি মেঘ জোছনায় ভেসে যাচ্ছে। ঝিঝি ডাকছে। হাওয়ায় পাকা ধানের মাতাল ঘ্রাণ। খুব দূর থেকে ভেসে আসছে কান্নার করুণ সুর। কান্নাটা কি ধীরে ধীরে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ধেয়ে আসছে! চমক ভাঙে, ঘিরে থাকা সন্তানদের দিকে তাকান জননী, ছলো ছলো চোখে ঝাপসা সব মুখ।

শুদ্ধতম এক রাজ্যের স্বপ্ন রক্তে রক্তে সংক্রামিত করেছিলেন জননী। তিনি শিখিয়েছিলেন তার পক্ষ ছাড়া বাকীসব অশুদ্ধ- হোক মানুষ, হোক নদী, হোক ফুল, হোক পাখি, হোক আকাশ, হোক গান, হোক কবিতা, হোক গান, হোক মত, হোক পথ। ‘শুদ্ধে রাজ্যে অশুদ্ধের কোন স্থান নেই’ ব্যাধিতে আক্রান্ত অনুসারীরা শুদ্ধতার নামে একের পর এক খুন করেছে নদী, পাখি, ফুল, ফল, ভ্রুণ, পিতা, মাতা, ভাই, বোন, বন্ধু, আত্নীয় স্বজন।

শুদ্ধতার বিষয়ে যেই সংশয়ে প্রশ্ন তুলেছে, সেই অশুদ্ধতার অভিযোগে খুন হয়ে গেছে। খুনের পর লাশের সৎকার অনর্থক ভেবেই তারা পান করতে শিখেছে রক্ত এবং মাংস। মাংস খেতে খেতে খেতে খেতে তারা অশুদ্ধ মানুষের মাংস ভক্ষণে আসক্ত হয়ে পরেছে।

প্রোটিন ও মদের কোনো শুদ্ধাশুদ্ধ ভেদ নেই জেনেই যোগীয়ানরা স্বগোত্রীয়দের মাংসও খায়। খেতে না পেলে উন্মাদ হয়ে ওঠে। এটি জেনেই জননী সবাইকে নিরামিষভোজী হবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু যে বাঘ পেয়েছে রক্তের স্বাদ তার জিভে কি আর শরবত রুচে!

গত দু’মাস ধরে মানুষের মাংস খেতে না পেয়ে যোগীয়ানরা দানবের মত ক্ষুধার্ত উন্মাদের। অবশেষে জননীকেই তুলে নিয়ে এসেছে। বহুদিন অশুদ্ধ মানুষদের মাংস খেয়ে খেয়ে শুদ্ধতার যতটুকু ঘাটতি, আজ তা পূরণ করে নেওয়া যাবে। জননী শুদ্ধতাময়ীর মাংসে আছে অশুদ্ধতা নাশের সব উপাদান।

বৃত্ত থেকে একজন উঠে এসে আমূল একটি ছুরি জননীর চোখে ঢুকিয়ে দেয়। জননী কেঁপে উঠেন, তার মুখ বাঁধা বলে আর্তচিৎকারটা শোনা যায়না। একটানে বের করে আনলে ছুরিটার কোনায় দেখা যায় চোখের খণ্ডিত অংশ লেগে আছে। পরম ভক্তিতে চোখটি খেয়ে যোগী বলে, “মা গো, তোমার চোখ বেঁচে রইলো আমার চোখে, নয়ানে নয়ানে।” মুহুর্তে সবাই হায়নার মত ঝাঁপিয়ে পরে জননীর মাংস খেতে। অবশ্য খাওয়ার আগে ভক্তি ভরে জননীকে জানায়, “মা গো, তুমি এখন আমাদের সবার রক্তে মিশে গেছো। এতোদিন তুমিই ছিলে আমরা, আজ আমরাই তুমি। শুদ্ধ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ছাড়বোই ছাড়বো।”

যোগী সোসাইটির চতুষ্কোণ মাঠে নেমে এসেছে অসীম ক্ষুধা। জননীর কঙ্কাল চুষতে চুষতে পরস্পরের শরীরের দিকে তাকাচ্ছে শুদ্ধতম যোগীর দল – আহ! ক্ষিধে! অসহ্য ক্ষিধে! ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার মত দানবিক ক্ষিধে।

#অণুগল্প

গিরগিটি

: চেরমেন, বেনার আনিছি। মিছিলের জন্যি রেডী হও।

: মেম্বর, বেনার কে লিখিছে?

: কে লিখিবে! ডিজিটাল বেনার বানিয়িছি। ৪০ টেকা ইসকুয়ার ফুট।

: কামের কাম করিছো। বেনারে লিখিছো কি?

: সন্ত্রাসীদের কালো হাত ভেংগে দাও, গুড়িয়ে দাও।

: মেম্বর, আমার ছবি দিয়িছো?

: কি যে কও! চেরম্যানের ছবি ছাড়া বেনারের দাম আছে নাকি!

: মিছিলের লোক আনিছো? কতজন আনিছো!

: দশ বারো জন। তারা ফজুর দোকানে বসি বসি বিনি পয়সায় চা গিলছি, বিড়ি টানছি। আর কয়জন আসিবি কে জানে!

: দশ বারো জন নিয়ি মিছিল করিবা! মান ইজ্জত থাকিবি?

: চেরমেন, কি করিবো কও। হারুণ মাস্টররে ছাত্রদের লয়ি আসতি কয়ছিলাম।

: মাস্টরে আসবি না!

: মাস্টরে কয় আমরা দুজন নাকি সন্ত্রাসীগো পালের গোদা, শামীম উসমান। আমাদের ঢংয়ের মিছিলে সে লুংগী তুলি মুতি দেয়। ভাবিতি পারো! তার কত বাড় বাড়িছে।

: মেম্বর, এক কাজ করো দেখিনি, তাজুলরে কও গোপুনে হারুণ মাস্টরের বাড়িতে চাইরটা ককটেল মারিতে, আর ফজুর দোকানের পিছনের দেয়ালে দুইটা…

: কী কও চেরমেন! লোকে সন্দেহ করবি যে!

: ধুত্তরী মেম্বর, লোকে সন্দেহ করবি কেন! ককটেল মারিবার সমুয় তুমি আর আমি ফজার দোকানে চা গিলিতে থাকিবো যে।

: এহন ককটেল পাবো কিবাই?

: তোমার ছাওয়ালের কাছে আছে, আমার ছাওয়ালের কাছেও আছে। কার থিকা নিবা সিটা তোমার বিবেচনা, বুঝিছো!

: চেরমেন, হারুণ মাস্টররে সই করি একটা মারিতে কবো না কী!

: মেম্বর, তুমিতো দেখি চেরমেনী চাল চালিতি চাচ্ছো!

বিকালের মিছিল সন্ধ্যা মিলাবার আগে বের হলো। চেয়ারম্যান নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মেম্বর আর এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা চেয়ারম্যানের দুপাশে ব্যানার ধরে দৃপ্ত পদে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিশাল মিছিল। লোকে লোকারণ্য। মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে শত শত কন্ঠে শ্লোগান ধ্বনিত হচ্ছে- সন্ত্রাসীদের কালো হাত ভেংগে দাও গুড়িয়ে দাও, সন্ত্রাসীদের আস্তানা ভেংগে দাও গুড়িয়ে দাও, হারুণ মাস্টরের রক্ত বৃথা যেতে দিবো না, হারুণ মাস্টর মরলো কেন সন্ত্রাসীরা জবাব দে।

তালাশ

রজবের চায়ের দোকান। সকাল সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত জমজমাট। কত কিসিমের লোক আসে। বসে। আড্ডা দেয়। ঝামেলা পাকায়, ঝামেলা সারায়।

মফিজ পুলিশের ইনফর্মার। চায়ে চুমুক দেয় আর ধূর্ত চোখে ধান্ধা তালাশ করে। মোবাইল ফোনে ইয়ারদোস্তের মত থানার সেকেন্ড অফিসারের সাথে কথা বলে।

তিন নম্বর রোডে আফসু ফেন্সি বেচে। সেখানে ফেন্সি গিলে কয়েকটা ছেলে কড়া মিষ্টি চায়ের তালাশে রজবের দোকানে আসে। চা খায়। চকোলেট চুষে। আফসু মাঝে মাঝে মফিজকে থানার মাসোহারা বুঝিয়ে দিতে আসে।

সলিম আর জব্বর জমির দালাল। জমি তালাশ করে, কাষ্টমার তালাশ করে। মুখে মুখে লাখ লাখ টাকা কমিশনের হিসাব কষে। হিসাব শেষে বিবর্ণ মুখে একটা গোল্ডলিফ কিনে দুজনে ভাগ করে খায়।

এগারোটায় দোকান বন্ধ করলে বারান্দায় এক পাগল এসে শোয়। তার নোংরা গা থেকে মাঝে মাঝে গোলাপের তীব্র গন্ধ বের হয়। রজব নিজে এই গন্ধ পেয়েছে। রজব পাগলের কাছে সুদিনের বিধান তালাশ করে। প্রায়ই পাগলের পা ধরে বসে থাকে। বুক ভাসিয়ে কাদে। পাগল হাসে আর ফিসফিসিয়ে বলে, ” মাইনষের বাচ্চারা উপায় জানি গেলি পাগল হয়্যি যায়। উপায় জানতি নাই। উপায় তালাশ করতি হয়। উপায় তালাশ করতি হয়।’

কি যেন কি তালাশ করতে করতে গুমড়ে গুমড়ে ভেসে যায় মধ্যরাতের ফতুর হাওয়া।