একজন ক্লিনারের স্বপ্ন-এক

আজ সকাল থেকে মুরাদের মনটা খুব ভালো । ঘুমটা যদিও অনেক সকালে ভেঙ্গে গেছে কিন্ত তবুও তার অপূর্ণাঙ্গ ঘুমের ক্লান্তিটা কেন যেন আজ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারেনি । মন মেজাজ ফুরফুরে । খুশি খুশি একটা ভাব মনের মধ্যে । মাথাটা অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক হাল্কা মনে হচ্ছে । এই অনুভূতিটা তাকে কিছুক্ষণ যাবত ভাবাচ্ছে । কেন এমন লাগছে ? ভাবতে ভাবতে মনের মধ্যে একটা ভয় তার অস্তিত্ব জানান দেয়ার জন্য আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে জেগে উঠতে চাইছে বলে তার মনে হল । সে আরও বেশী ভয় পেয়ে গেল । তার হঠাৎ মনে হল এমন একটা সুন্দর সকাল সে অনেক দিন পর আজ পেয়েছে । এই সব কি ভাবছে সে ? যদিও বিছানা ছাড়ার পর পনেরো মিনিট যাবত সে বসে আছে চেয়ারে কিন্তু তার মনে হল এই মাত্র তার ঘুমটা পুরোপুরি ভাঙ্গলো । সে ভালোভাবে চোখ খুলতেই দেখল তার হাতে টুথ ব্রাশ ।

ইদানিং তার মাঝে মাঝেই এমন হয় । মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে তার মনে হয় তার বয়স এখন দেড় কি দুই বছর । কিছুক্ষণ খুব অসহায় বোধ করে সে । আগের দিনের কোন কথা মনে করতে পারে না সে। ঘুম থেকে জেগে ছোট বাচ্চারা যেমন কাদে তার ও তেমন কাদতে ইচ্ছে করে । বুকটা ভারী হয়ে আসে । তারপর হঠাৎ সে নিজেকে সাতাশ বছরের এক পুরনাঙ্গ যুবক হিসেবে আবিস্কার করে । কিছুটা লজ্জা এবং অনেকটা ভয় তাকে দ্রুত স্বাভাবিক হতে সাহায্য করে । যদিও তার এই সমস্যা অনেক দিন আগে থেকেই হচ্ছে তবে ইদানিং কেন যেন বেড়ে গেছে কিছুটা । সে কি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে ?

নাহ ! এটা অসুস্থতা হলে এতদিন পড়াশুনা, কাজ কর্ম, চাকরি এগুলো কনটাই সে এত ভালোভাবে করতে পারত না । এই ছোট্ট জীবনে তার প্রাপ্তি খুব কম নয় । তাও আবার নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রমে অর্জিত সব । কেউ তাকে দুই পয়সার সাহায্য করে নাই কোনদিন । এমনকি কোন পরামর্শ দিয়েও নয় । অবশ্য সে এসব আশা ও করে না কখনো । এসব ভেবে নিজেকে সান্তনা দেয় মুরাদ । সান্তনাও না । সে আসলে গর্ব বোধ করে । তার মধ্যে নিজের জীবন নিজের মত করে গড়ার মত একটা দুর্দম শক্তি আছে বলে । তার জীবন অন্যের পছন্দ ও খেয়াল খুশি মত চলে না । স্বাধীনচেতা সে । নিজের ইচ্ছে ও পছন্দের মূল্য তার কাছে অনেক বেশি । নিজের মত চলে জীবনকে উপভোগ করে সে । সে ভাবে এটাইতো স্বাধীনতা । এটাই তো সুখ । এটাই তো জীবনের আসল মানে । এটাই আসলে জীবন ।

দাত ব্রাশ ও গোসল করে তাকে দ্রুত অফিস যাবার জন্য তৈরি হতে হয় । নাস্তা করার সময় সে বেসির ভাগ দিন সকালে পায় না । সকাল সাতটা ত্রিশ মিনিটে তার অফিসের গাড়ি ইত্তেফাক মোড়ে অপেক্ষা করে । ড্রাইভার মামুন খুবই নিয়ম তান্ত্রিক মানুষ । সাড়ে সাতটা বাজার পর দুই মিনিটের বেশী সে অপেক্ষা করে না কোনদিন । কোন আদেশ কিম্বা অনুরোধ কিছুই কাজ করে না মামুনের উপর । সে একজন কর্পোরেট অফিসের ড্রাইভার । এটা তার জন্য অনেক বড় একটা গর্বের ব্যাপার । সারাদিনের এই একটা মাত্র সময় নিজের ক্ষমতাটুকুর পুরোপুরি সৎ ব্যবহার করে সে । তার উপর ট্রান্সপোর্ট সুপারভাইজার এর কড়া নির্দেশ । অনিয়ম হলে চাকরি নিয়ে টানাটানি । মুরাদের মনে হয় অফিস টাইম সকাল নয়টা হলেও তার অফিস আসলে সাড়ে সাতটায়ই শুরু হয়ে যায় । একদিন কোন ভাবে গাড়ি মিস করলে তাকে দুইশো পঞ্চাশ টাকা সি এন জি ভাড়া গুনতে হবে । যদিও এটা তার জন্য কোন বড় বিষয় না । এমনটি তার আগে প্রায়ই হতো । কিন্তু সে বিগত দুই বছর যাবত এই ব্যাপারে অনেক সতর্ক । একটা মানুষ তার মাঝে মাঝে লেট করে অফিস যাবার বদ অভ্যাসটা হঠাৎ করেই পালটে দিয়েছে । অথবা মানুষটার জন্য সে নিজেকে পালটে ফেলতে পেরেছে কিছুটা । মুরাদ এখন বুঝে টাকা মানুষের অনেক বেশী দরকার । যার আছে তার থেকে যার নাই তার কাছে টাকার মূল্য অনেক অনেক বেশী । কখনো কখনো জীবনের চেয়েও বেশী ।

গাড়িতে উঠে প্রতিদিনই মুরাদের মামুনকে এ সি ছাড়তে বলতে হয় । না বললে সে কোন দিনই নিজে থেকে ছাড়বে না । গাড়ীর গ্যাস বাঁচিয়ে কিছুটা বাড়তি ইনকাম করে নেয়ার ধান্দা মামুনের । মনে হতেই মুরাদ বিরক্ত হয় । না, তাকে তো আজ বিরক্ত হওয়া চলবে না । আজ তার ভালো দিন । নিজেকে মনে করিয়ে দেয় মুরাদ । বৈশাখ মাসের শুরুতে দিন দুই ঝর বৃষ্টির পর ভীষণ গরম পরেছে আজ । গাড়ীর সিটটা একটু হেলিয়ে নিয়ে মাথাটা কাত করে সে । গরমটা আজ একটু বেশী তাই না ? প্রশ্ন করে মুরাদ । ড্রাইভার মামুন মুরাদ গাড়িতে উঠার পর থেকে একটা কথাও বলে নাই । মুরাদের প্রশ্নের উত্তর সে এবার ও দিল না । ভাবুকের মত শুনলো শুধু । এ সি অন হল । বঙ্গবাজারের আগ পর্যন্ত গাড়িতে সে একা । এই সময়টা অন্যান্য দিন গাড়িতে উঠেই সে প্রথমে তার বাবাকে একটা ফোন দেয় । তার পর ভাই, বোন ভাতিজা, ভাতিজি, ভাগিনা, ভাগিনি, চাচা, ফুফু, মামা, খালা এদের মধ্যে থেকে অথবা অন্য যাকে দরকার তাকে ফোন করে । সারাদিন অফিসের কাজের ব্যস্ততায় কারো খোজ নেয়া হয়ে উঠে না । দিন শেষে মন মেজাজ চরম খিটখিটে হয়ে যায় । এই রকম অবস্থায় কারো সাথে কথা বলার মন মানষিকতা থাকে না ।

আজ মুরাদ ভাবলো সে প্রথম ফোনটা দিবে আলমগীরকে । ছেলেটা রাতে ভালো ভাবে শেরপুর পৌছুলো কি না খোজ নেয়া হয় নাই । কি ভুলো মন তার !

৫ মে, ২০১৭

( চলবে )

আনিসুর রহমান সম্পর্কে

এই যে আমি, এই আমার কি সত্যিই কোন অস্তিত্ব আছে ? বোধ করি অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বহীনতার এ প্রশ্ন প্রমান নির্ভর নয় । কেননা অতিশয় নগন্য এ অস্তিত্ব উপেক্ষণীয় এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞে । কিন্তু সেই মহা শক্তিতে একাত্ব এই সকল কিছুই সর্বদা বিরাজমান । বর্তমান অবস্হান ক্ষনিকের রুপান্তরিত অবস্থা মাত্র । অস্তিত্ববান সকল কিছুই দৃশ্যমান নয় । তবুও অস্তিত্বই চিরন্তন। অন্যথায় অস্তিত্ব হীনতা থেকে অস্তিত্বের সৃষ্টি সম্ভব কি ? অসীম অসংজ্ঞায়িত ∞

6 thoughts on “একজন ক্লিনারের স্বপ্ন-এক

  1. গল্পটা আরো বিস্তৃত হবে কি না! ভালো লেগেছে। শুভেচ্ছা রইলো।

    1. সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ মামুনুর রশিদ ভাই । আরও কিছুদুর আগানোর ইচ্ছে আছে । আশা করি আমাকে সাথে রাখবেন ।

  2. মধ্যবিত্ত জীবনের এই চিত্রপট পাঠক মনে দ্রুত দাগ কাটে।
    আমাদের অনেকের জীবন এমন। খুব সহজে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়।

    অণুগল্পটি আরও খানিকটা এগিয়ে নিয়ে গেলে খুব বেশী ক্ষতি হতো না। :)

  3. গল্পটা আরও দুই এক পর্ব আগাবে স্যার । দুঃখিত ধারাবাহিকতার কোন ঈঙ্গিত পূর্বে উল্লেখ করতে ভুলে যাওয়ার জন্য । সময় নিয়ে আমকে পড়ার জন্য ধন্যবাদ স্যার !

  4. সুন্দর প্রচেষ্টা। আসা করি সুন্দর করে এগিয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত।
    আমি পাঁচ তারকা দিয়েছিলাম কিন্তু মোবাইলে আঙুলের ছাপ ঠিকমত না পড়ায় সেটা চার তারকা হয়ে গেছে।

  5. ধন্যবাদ ভাই । চার তারা পাঁচ তারা কোন ব্যাপার না । আপনি সময় নিয়ে পড়েছেন এতেই আমি ধন্য । ভুল গুলো ধরিয়ে দিলে আরও খুশি হব ।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।