একদিন বিভুর সনে

কোনো এক সময়ের খুলনা শহর এবং এই মিল এলাকা নিয়ে আমার লেখা ‘একদিন বিভুর সনে’ নামে একটি কবিতা রয়েছে। আজ আবার মনে পড়লো আমার। এমন একটি কবিতা এই জীবনে আর আমার দ্বারা লেখা সম্ভব নয়।
________________________________

একদিন বিভুর সনে

বিভু! আপনি তো কিছুদিন
সুন্দরবন এলাকায় ছিলেন
খুলনা আপনার তাই ভাল-ই দেখা আছে।
আপনার অবস্থানের সময় শিল্পাঞ্চলের ভরা যৌবন!
মানুষ-যন্ত্রের মিলিত রসায়নে
আনন্দে ভারী এক বাতাসে ভেসেছেন আপনি।
.
আমার শৈশবে গিয়ে দেখে আসি চলুন
হৃদয়গুলির রক্তাক্ত হয়ে ওঠার ইতিহাস
একটা জনপদের ইতিহাসের আগেই লেখা হয়ে যায়।
হৃদয় আর জনপদের রক্তক্ষরণের
বীজ কিন্তু বিভু
পেছনের সেই কাঁচা রাস্তার মাথায়-ই লুকোনো ছিল।
.
ছিমছাম এক মহল্লা
ছবির মত সাজানো এক গ্রাম!
আসলে জায়গাটা ছিল
বিভাগীয় শহরের অন্যতম কেন্দ্র বিন্দু।
ইটের সলিং বিছানো প্রশস্ত রাস্তার পাশ দিয়ে
চওড়া ড্রেনের কাজ শুরু হবে বলে শুনছিলাম।
আমি তখন কলাপাতার ঘোড়ায় চড়ে
ইটের রাস্তা দাবড়িয়ে বেড়ানো বালক
আত্মহারা.. নিঝুম নিমগ্ন সুখে!
নিতান্ত-ই এক বালকের আলোয় ঝলমলে বাল্য জীবন!
.
কিন্তু কি জানেন বিভু?
শত আনন্দ মাঝেও
নিরানন্দ ঠিক-ই আনন্দের হাত ধরে ধরে হেঁটে চলে
বিষণ্ন করে তোলে মন!
আমাদের ঐ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে
খেলার ছলে দেখার মত করেই
আচমকা একদিন
সামনে এসে হাজির হয় পরিবারতন্ত্র!
নেতৃত্ব দিচ্ছে মানুষের খোলসে কিছু অমানুষ!!
তখন আমাদের মানুষ-ই বুঝে আসত না বিভু
অমানুষ বুঝব কিভাবে!
.
শেষে মানুষ- অমানুষে মিলানো
এক বিচিত্র সমাজে বড় হয়ে উঠতে লাগলাম।
যখন বুঝলাম একটু, শিখলাম ঢের বেশী
পেতে হলে ছিনিয়ে নাও, অন্যের নেবার আগে।
কোনোকিছুই কারোর একার নয়
অপেক্ষায় ও থাকবে না চিরকাল’।
.
আপনার কি মনে আছে বিভূ
দেশে পলিমার দানা ইম্পোর্টের কথা?
একটা দেশের প্রধান নির্বাহীর অদূরদর্শিতায়
কিভাবে একের পর এক
পাটকলগুলি বন্ধ হয়ে যেতে লাগল!
আদিগন্ত বিস্তৃত ইমারতগুলির নি:সঙ্গ ছায়ারা
কায়া হারিয়ে নির্বাক মৌণতার মৃতপুরীতে পরিণত হল।
সেখানে আরেক আঁধারের জগতে
কিছু নব্য ইম্পোর্টারদের নগ্ন উল্লাস
এখন কারো চেতনায় একটুও কি নাড়া দেয়, বিভু?
.
মিলগুলির শ্রমিকদের পাওনা টাকা বুঝে নেবার সময় এলো
কেউ পুরো কেউ আংশিক পেলো
অনেকেই পেল না কিছুই!
পাশের অন্য আরো অনেকগুলো পরিবারের মত
আমরাও পথে বসে গেলাম বিভু!
এক মৃত শিল্পাঞ্চলের হাহাকারের শব্দে
অনেক রাতে আমার ঘুম ভেংগে গেছে!
শব্দ শুনেছি কেবল.. কানে বেজেছে শব্দহীন আর্তনাদ
কিছুই করতে পারিনি তখন
সে এক দু:সহ সময় ছিল বিভু।
.
এরকম অনেকগুলি পরিবার
তাদের হাহাকারগুলো নিয়ে এক হল একদিন
বাঁচতে হবে বাঁচাতে হবে, প্রয়োজনে ছিনিয়ে নিতে হবে
না খেয়ে থাকা বড্ড কষ্ট বিভু!
তাই দিনবদলের কিংবা পরিবর্তনের নিঃশব্দ শ্লোগানে, রাতের ঘুম ভেংগে গেলে
এই পরিবারগুলোর কোমল যুবকেরা, হিংস্র হয়ে উঠতে থাকে।
ব্যবহারকারীরা ওদের ইচ্ছেমত ব্যবহার করে
যুবকদের চরিত্রগুলি ক্রমশ: মিথে পরিণত হয়।

এক সিনেম্যাটিক জীবন পর্দার বাইরে
ক্ষমতাধর অন্য পুরুষে রুপান্তরিত করে যুবকদের!
‘ফাইট না সাইড’ আহবানে নীরবে সরে যাওয়া
ঐ সময়ের প্রশাসনের নত মুখ
যুবকদেরকে আরো উদ্ধত..অহংকারী করে তুলেছিল।
কিন্তু একটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
কখনো বিচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকা যায় না
বুঝে আসেনি কারো।
.
তারপর.. বিভু?
কেবল-ই ইতিহাস! বলির.. খুনের..ক্রোধের!
না পাওয়ার বঞ্চনায় অক্ষম ক্রোধে তাড়িত হয়ে
অন্য এক সমাজের বাসিন্দা হয়েও দেখেছি বিভু!
কোথায়ও সত্য শিব সুন্দরের মূল্য নেই।
.
অনেক কথা বলে ফেললাম কি বিভু?
যাবার আগে তবে আরেকটু বলে যাই
প্রতিটি সময়ে এক রক্তাক্ত জনপদে
নীলচে স্বয়ংক্রিয় ধাতব ক্ষমতাবান যুবকেরা
একের পর এক বাতাসে মিলিয়ে যেতেই অন্যরা হিংস্র হয়ে উঠেছে।
একসময় ওরাও যখন হারিয়েছে সুদূরে
তখন আরো একদল জায়গা দখল করেছে নিরবে।
মারে আর মরে.. আবার জন্মায়!
এ ভাবে জড় থেকেই যায়!

বিপ্লবীরা কখনো-ই মরে না
তাই না, বিভু?
__________________

# বিভু: বড় ভাই/ সাঁওতাল দের দেবতাকে ও এই নামে ডাকা হয়।

_____________________________________________

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭ তে ‘এক রঙ্গা এক ঘুড়ি’ প্রকাশনী থেকে বের হয়েছিলো আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শেষ তৈলচিত্র’। কবিতাটি এই কাব্যগ্রন্থের।

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

7 thoughts on “একদিন বিভুর সনে

  1. আমার কাছে এই প্রয়াস এবং কবিতার আবৃতিটি অসাধারণ লেগেছে।
    শুভেচ্ছা আপনার জন্য। শুভেচ্ছা রাখি আবৃতিকার মি. আসিফ রেজওয়ানের জন্য।

    1. ধন্যবাদ প্রিয় ভাইয়া।
      কবিতাটির প্রেক্ষাপট এবং আবৃতিকার প্রিয় আসিফ রেজওয়ানের অসাধারণ কন্ঠের লালিত্যে এক অন্য আবহ পেয়েছে।

      ভালো থাকুন আপনি সহ শব্দনীড় পরিবারের সকলে।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

  2. বিপ্লবীরা কখনো-ই মরে না;
    অসাধারণ কবি ও গল্পকার মামুন ভাই !!!

    1. ধন্যবাদ প্রিয় আনিস ভাই।
      ভুলে চারুদা’র মন্তব্য আপনার কাছে চলে গেছে। দু:খিত।
      শুভেচ্ছা।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।