কবিতা সবার জন্য ভালোবাসার প্রস্ফুটিত ফুল

কবিতা হচ্ছে ভালোবাসার প্রস্ফুটিত ফুল। সাহিত্যকাননের সর্বাপেক্ষা সুন্দর ফুল কবিতা। আর সাহিত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী শাখাও কবিতা। বস্তুতঃ পৃথিবীতে আগে শুধু কবিতাই ছিল। পৃথিবীর সবকিছু তখন কবিতার মতোই সুন্দর ছিল। আর তখন সবকিছু কবিতার ভাষায় লিপিবদ্ধ হতো। মানুষ ছন্দে-ছন্দে কথা বলতে ও শুনতে ভালোবাসতো। রাজদরবারে শোভা পেতেন বড়-বড় কবি। তারা মনের আনন্দে কবিতা-রচনা করতেন। মানুষ তখন কবিতাই চিনতো। মানুষ তখন কবিতাই ভালোবাসতো। মানুষ তখন কবিতাই পড়তো। আর এই কবিতা ভালোবেসেই মানুষ রচনা করে গান। আজকের গীতিকবিতাও এই কবিতারই দান। সবখানে শুধু কবিতা। সেই সময় পৃথিবী ছিল কবিতাময়! সেকালে অনেক ধর্মগ্রন্থও কবিতার ভাষায় রচিত হয়েছে। তাও যাকে বলে একেবারে সঙ্গীতধর্মী-কবিতা। প্রমাণস্বরূপ পড়ে দেখতে পারেন প্রাচীনধর্মগ্রন্থ ‘যাবুর’।

বলছিলাম, প্রাচীনকালে মানুষ শুধু কবিতাই লিখতো। তখনকার সাহিত্য বলতে ছিল একমাত্র কবিতা। তখন মানুষ বৃহৎ কবিতাগ্রন্থরচনা করতো—বৃহৎ একটি কবিতা—বৃহৎ একটি কাহিনীকবিতা—যাকে বলা হতো কাব্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—বাল্মীকির ‘রামায়ণ’, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত ‘মহাভারত’, কাশীরাম দাসের অনূদিত ‘মহাভারত’, ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ আর কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’। প্রাচীনযুগের ধারাঅনুযায়ী মধ্যযুগেও রচিত হয়েছে বড়-বড় কাব্য। যেমন, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পদ্মাবতী ইত্যাদি। আর এই মধ্যযুগেই মুসলমান-কবিরা সৃষ্টি করলেন অনুপম গাঁথুনি ও সুরে ‘পুঁথিসাহিত্য’—এটাও কিন্তু কবিতার ভাষায়—আর তা ছন্দে-ছন্দে।

গদ্য এলো আধুনিকযুগে। আর তখনই সৃষ্টি হলো ‘ছোটগল্প’ আর ‘উপন্যাস’। আর এটি মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের বেশি জানার, বেশি পড়ার আর বেশি লেখার চিন্তাভাবনা থেকেই জন্ম নিলো গদ্য। আজ গদ্য সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ। মদীয় আলোচনা শুধু কবিতাকেন্দ্রিক।

কবিতা আজ অবধি সাহিত্য-নন্দনকাননের প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো অবিরাম গতিতে শুধুই সুবাস ছড়াচ্ছে। আর এই সুবাসে মোহিত হচ্ছে মানুষ—সর্বস্তরের পাঠক—আর কবিতাপ্রেমীপাঠকসমাজ।
কবিতার একটি শক্তি আছে—আর এই শক্তির দ্বারাই কবিতা তার পাঠকসমাজকে এখনও কবিতার মধ্যে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। আধুনিকযুগে বিলাসীমানুষের জীবনযাত্রায় কতরকমের ইলেকট্রনিক সামগ্রী! এর যন্ত্রণায় কবিতার মরে যাওয়ারই কথা! কিন্তু সকল আগ্রাসন মোকাবেলা করে কবিতা আজও নিজস্ব যোগ্যতায় ও শক্তিতে মানুষের মাঝে বেঁচে আছে—আর তা বেঁচে থাকবে চিরকাল।

কবিতার একটি নিজস্ব ভাষা রয়েছে। আর এই ভাষা সর্বসাধারণের মুখের ভাষার মতো নয়। এটি তার চেয়ে উন্নত ও শিল্পিত। আর এই ভাষাশৈলী আবিষ্কার করেছেন অগণিত কবি। পৃথিবীর সকল ভাষাই তার কবিদের কাছে ঋণী। কবি-লেখকরা যুগে-যুগে, সর্বকালে ভাষামাধুর্যের একমাত্র প্রতিনিধি ও নির্ভরযোগ্য আবিষ্কর্তা। তাঁদের হাতেই ভাষা পেয়েছে সৌন্দর্যবৃদ্ধির অতলীন স্পর্শ। আর কবিরা তাই সর্বকালে-সর্বদেশে ভাষার প্রকৃত-বন্ধু। কাজেকাজেই, আমরা যদি কায়মনোবাক্যে আমাদের ভাষাকে ভালোবাসি—তাহলে, সেইসঙ্গে আমাদের কবিদেরও ভালোবাসতে হবে। আর ভালোবাসতে হবে তাঁদের রচিত কাব্য ও গ্রন্থসমূহ।
কবিতার ভাষা একেবারে সাদামাটা বা অলংকারবিহীন হলে চলবে না। এখানে, একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, সাধারণ একজন স্ত্রীলোক কোনোপ্রকার গহনাপত্র পরলো না বা সামান্য গহনা পরলো, তাকে বেশি সুন্দর লাগবে? নাকি যে পরিমাণ মতো চমৎকার ডিজাইনের সব সোনার অলংকার পরলো তাকে? আপনিই বলুন কাকে? আর আপনার বিবেক কী বলে? নারীদেহ যেমন সোনাভরণে সুশ্রী হয়ে ওঠে, তেমনি সুষুমামণ্ডিত ভাষামাধুর্যে সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে কবিতাদেহ। আর এই কবিতাদেহকে নিয়মিত ভাষা-অলংকার দিয়েই সাজিয়েগুছিয়ে রাখতে হবে।
রমণী এমনি-এমনি সুন্দর হয় না। তার যোগ্য স্বামী তাকে সুন্দর আভরণে-ভূষণে সজ্জিত করে তোলে। তখন সে সবার চোখে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কবি স্বাধীন। আর তিনি ভাষারাজ্যের একজন সম্রাট। তার মধ্যে যেন কখনও ভাষাদীনতা বা ভাষাকার্পণ্য প্রকাশ না পায়। রমণীদেহের মতো কবিকে তার কবিতাদেহ ছন্দে, ভাবসম্পদে, চিত্তাকর্ষক-বিষয়বস্তুতে, নির্মাণ-সৌকর্যে ও সর্বোপরি ললিত-মাধুর্যে সাজিয়েগুছিয়ে তার পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। মনে চাইলেই একটাকিছু লিখে দিলেই তা কবিতা হয়ে যায় না। সাধারণ গদ্য লেখা সহজ। কিন্তু ছোটগল্প-রচনা করা অনেকের জন্যই তা একেবারে দুঃসাধ্য। কারণ, ছোটগল্পের ভাষাও যে কবিতার মতো! সবখানে প্রয়োজন কবিতার ভাষা—আর সবচেয়ে মূল্যবান এই কাব্যিকভাষা। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প কেন এতো জনপ্রিয়? কারণ, তিনি বাংলাভাষার শক্তিমান কবি। তাঁর হাতে কাব্যিকভাষা পেয়ে তাঁর রচিত ছোটগল্পগুলো যেন হয়ে উঠেছে একেকটি সুন্দর কবিতা।

আমরা যারা কবিতা-রচনা করছি, সর্বাগ্রে তাদের ভাষা ঠিক করতে হবে। ভাষাই হলো কবিতার মূল বা চালিকাশক্তি। আর ভাষাই হলো একজন কবির সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই, প্রয়োজনে কবিকে তার আগের ভাষা সংশোধন করতে হবে। কবিতার ভাষা হতে হবে কুমারীমেয়ের মতো আকর্ষণীয়। আর সুবোধ-সুন্দর বালকের মতো সুশ্রী।

কবিতার জন্য ছন্দের প্রয়োজন। আধুনিককালে বেশিরভাগ কবিই অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দে তাঁদের কবিতা বা কাব্য রচনা করেছেন। তবে উত্তর-আধুনিককালে অনেক কবিই ছন্দের বেড়াজাল ভেঙে গদ্যছন্দে কবিতানির্মাণ শুরু করেন। তাঁদের দেখাদেখি বর্তমানে গদ্যকবিতার সচল-প্রচলন ঘটেছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও গদ্যছন্দে কবিতা-রচনা করে গেছেন। তাঁর রচিত ‘পুনশ্চ’ ও ‘পত্রপুট’ নামক কবিতাগ্রন্থ দুটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তবে সেখানেও রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব একটি ছন্দ রয়েছে। তাই, ছন্দের ব্যাপারে একজন কবিকে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে।

কবিতায় ছন্দের চেয়েও জরুরি এর ভাবসম্পদ। আর এই ভাবসম্পদই হলো কবিতার মূলশক্তি। এর মধ্যে শক্তিশালী বক্তব্য থাকতে হবে। প্রত্যেক কবিতারই একটি বক্তব্য আছে। তবে সব কবিতার বক্তব্যই পাঠকের কাছে প্রাধান্য পায় না। আর সব কবির বক্তব্যই পাঠকের কাছে আবেদনসৃষ্টি করতে সক্ষম হয় না। একবার একজন বিশিষ্ট-কবি এক কথিত-কবির কবিতা-সমালোচনা করতে গিয়ে লিখলেন, “আপনার কবিতার বক্তব্য চমৎকার হয়েছে!” তিনি ঠিকই লিখেছেন। কিন্তু তখন সেই কথিত-কবি নামক অ-কবি ভয়ানক ক্রোধে লিখলেন, “আমি বক্তব্য দেইনি। আমি কবিতা লিখেছি!” মূর্খ আর কাকে বলে? কবিতার মধ্যে যে একটি বক্তব্য থাকে—তা এই অ-কবি মূর্খটি জানে না। এইজাতীয় মূর্খ যদি কাব্য-রচনায় নিয়োজিত হয়—তাহলে, কাব্যের ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার।

কবিকে হতে হবে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, উন্নতদৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ও ভাষাবিষয়ে দক্ষ। যাদের ভাষাজ্ঞান সীমিত ও দুর্বল—তারা কবি হবেন কীভাবে? আর কবিকে সারাজীবনের জন্য হতে হবে একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। কোনো সাম্প্রদায়িক অমানুষ কখনও কবি হতে পারবে না।

কবিতা সুগন্ধীফুলের মতো। আর কবিতার রয়েছে সুঘ্রাণ। এতে সর্বস্তরের পাঠক আমোদিত হয়ে থাকে। কিন্তু যে-ফুলের ঘ্রাণ নেই—সে ফুলে ভ্রমর বসে না, মধুমক্ষিকা সেখানে ছুটে যায় না। ভাষাহীন, শ্রীহীন ও রূপবিহীন শব্দের গাঁথুনি কখনও পাঠকের দৃষ্টিআকর্ষণ করতে সক্ষম হবে না। তাই, কবিতাকে সুগন্ধীফুলের মতো করে প্রস্ফুটিত করতে হবে। তাহলে, কবিতার সুঘ্রাণে আমোদিত ও বিমোহিত হয়ে পাঠকসমাজ একনিমিষে ছুটে আসবে কবিতার বিশাল সাম্রাজ্যে।

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১০/০৬/২০১৬

সাইয়িদ রফিকুল হক সম্পর্কে

সাইয়িদ রফিকুল হক ( Syeed Rafiqul Haque) তিনি একজন সাহিত্যসেবী, গ্রন্থপ্রেমিক ও রাজনীতি-সচেতন মানুষ। বাংলাদেশ, বাংলাভাষা ও বাংলাসাহিত্য তাঁর কাছে সবসময় প্রিয়, এবং এই তিনটি তাঁর কাছে চিরদিন পবিত্র শব্দ। তিনি বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তি। তাঁর লেখালেখিতেও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার ছাপ সুস্পষ্ট। আর তিনি সবসময় ঘৃণা করেন রাজাকার, ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ীচক্রকে। ধর্মবিশ্বাসে তিনি ত্বরীকতপন্থী সুন্নীমুসলমান। আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি একজন পুরাপুরি আস্তিক। তিনি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। একজন খাঁটি বাঙালি ও বাংলাদেশী। সাহিত্যচর্চা: তিনি নামে-বেনামে ও ছদ্মনামে লেখালেখি করছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। মূলত তিনি কবি, লেখক ও ঔপন্যাসিক। তিনি স্কুলজীবন থেকে আপনমনে সাহিত্যচর্চা করছেন। তখন লেখাপ্রকাশের তেমন-একটা সুযোগ না থাকায় তিনি তাঁর লেখাসমূহ প্রকাশ করতে পারেননি। বর্তমানে ‘শব্দনীড় ব্লগ’সহ বিভিন্ন ব্লগে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁর লেখার মূল বিষয়: মানুষ, মানবতা আর দেশ-জাতি-সমকাল। আত্মপ্রচারবিমুখ এক কবি তিনি। স্কুলজীবন থেকে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করে অদ্যাবধি কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ইত্যাদি রচনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। পনেরো বছর বয়সে কবিতা লেখার মাধ্যমে তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। তিনি লিখেছেন অনেক। কিন্তু প্রকাশ করেছেন খুব কম। ইতঃপূর্বে কয়েকটি সাহিত্যপত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর লেখাসমূহ আধুনিক-ব্লগগুলোতে প্রকাশিত হচ্ছে। এজন্য তিনি ব্লগগুলোর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তিনি বাস্তববাদী লেখক। আর তাঁর লেখায় কোনো কৃত্রিমতা নাই। তাঁর প্রায় সমস্ত লেখাই দেশ ও জাতির জন্য নিবেদিত। তাঁর লেখার বিষয়: কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ইত্যাদি। তিনি ‘মানবজীবনের গল্প’ রচনায় যথেষ্ট পারদর্শী। এ পর্যন্ত তাঁর রচিত গল্পের সংখ্যা ৩২টি। আর উপন্যাসের সংখ্যা ১৮টি। ছড়াসাহিত্যেও তিনি সমভাবে পারদর্শী। শিক্ষা: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ নাই। তাঁর কাছে সার্টিফিকেট-সর্বস্ব সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কঠোর সাধনায় অর্জিত প্রকৃত জ্ঞানের মূল্য অনেক বেশি। তিনি নিজেকে সবসময় একজন স্বশিক্ষিত মনে করেন। তবে প্রচলিত প্রথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক উচ্চতর গবেষণাকর্মে নিয়োজিত। জন্মস্থান: বাংলাদেশ। তাঁর জীবনের লক্ষ্য: লেখালেখির মাধ্যমে আমৃত্যু দেশ, মানুষ আর মানবতার পক্ষে কাজ করা।

1 thought on “কবিতা সবার জন্য ভালোবাসার প্রস্ফুটিত ফুল

  1. আপনার নিবন্ধটি বেশ মনযোগ দিয়ে পড়লাম। অনেক বিষয় চমৎকার ভাবে আলোকিত হয়েছে। কবিতার পুরোনা ভাব-বাচ্য থেকে সমসাময়িক বিষয় গুলোনও বাদ পড়েনি।

    বিশেষ করে যারা আলোচনা পড়তে ভালো বাসেন অথবা আপডেট রাখতে চান তাদের বিশেষ কাজে আসবে বিশ্বাস করি। ধন্যবাদ আপনাকে।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।