বিভাগের আর্কাইভঃ প্রবন্ধ

মৃত্যু

মৃত্যু এমন একটা শব্দ এই শব্দ শুনে যারা ভয় পায় তারা আসলেই মৃত এমনকি তারা নিজের জীবন নিয়ে নিজেকে বিভক্ত রাখে। যখন আমরা জন্মগ্রহণ করেছি ঠিক তখনই আমাদের মৃত্যুর কারণ ও সময়ও লেখা হয়ে গেছে । শুধুমাত্র আমাদের না জানার মধ্যে আছে আমরা কোথায় কখন কিভাবে মারা যাবো। কিন্তু আমাদের সব সময় প্রস্তুত থাকা উচিত এই ভেবে যে আমরা যেকোন সময় মারা যাবো।

মৃত্যুর ভয়ে বেঁচে থাকাটা সত্যিকারের বেঁচে থাকা নয়। বেঁচে থাকাটা হলো মৃত্যুকে জয় করা। আমরা কে কখন কোথায় কিভাবে মারা যাবো অসুস্থতায় মারা যাবো নাকি দুর্ঘটনায় আত্মহত্যায় নাকি খুন হবো এটা কিন্তু আমরা জানি না আমরা শুধু জানি যেভাবেই হোক আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবো্ মৃত্যুর স্বাদ কেউ এড়াতে পারবেনা।

কিন্তু আমরা যদি খুন হই বা অন্য কারো শত্রুতার কারনে আমাদের মৃত্যু হয় তাহলে তার সেই কর্মের প্রতিক্রিয়া সেই ব্যাক্তি কিম্বা সেই সব পক্ষগুলোর পক্ষে এর দায় এড়ানো সম্ভব না। এমনকি যদি আমার কারনে কারো মৃত্যুও হয় তা আমার জীবনে একটা আঁচর কেটে যাবে এবং নিজের বিবেকের কাছে থেকে কখনোই আমি নিজেকে মুক্ত করতে পারবো না।

আমরা বলি লোকটা হুট করেই মারা গেলো কিন্তু মৃত্যু কখনোই হুট করে আসেনা মৃত্যু তার নির্দিষ্ট সময়েই আসে কারণ আমরা জন্মের সময়ই আমরা মৃত্যুর হুলিয়া মাথায় নিয়েই পৃথিবীতে এসেছি।

মৃত্যু তো হলো সেই ঘটনা যা আমরা দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়তই যার সম্মুখীন হই। একটা নির্দিষ্ট সময় না আসা পর্যন্ত এটি আমাদের সামনে আসেন। মৃত্যুর ভয়ে বেঁচে থাকাটা আসলে বেঁচে থাকা নয়। তাই মৃত্যুকে ভয় না করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সাহস সঞ্চয় করতে হবে। কে জানে আমি কখন মারা যাবো আজ নাকি কাল নাকি বার্ধক্যের পরে? মৃত্যুর ভয়ে বেঁচে না থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সাহস রাখা ভালো।

আলেম ভার্সেস আলেম

এখন ওয়াজের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে, গ্রাম-গঞ্জ, শহরের জায়গায় জায়গায় ওয়াজের নামে কিছু সুরওয়ালা গায়কের আবির্ভাব হবে, এদের বয়কটের উপযুক্ত সময় এখনই। ধর্ম সম্পর্কে জানার জন্য ওয়াজ মাহফিলে যাওয়ার আগে যার ওয়াজ শুনবেন তাকে জানুন। খোঁজ নিন তার জ্ঞানের পরিধি কতটুকু তারপর যান, অমুক তমুক নাম শুনে চিল্লা ফাল্লা শুনতে আর কমেডি দেখতে যাইয়েন না প্লিজ। আমরা এদের দাওয়াত করি আর এদের মাহফিলে ভীড় করি বলেই এরা ইসলামি জলসাকে নাটকের মঞ্চ বানিয়ে ফেলতেছেন দিনের পর দিন। ওয়াজের স্টেজে রাতভর কমেডি চলে আর এসবের কারণে ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মধু আহরণ করতে যেয়ে মগজে বিষ নিয়ে ফিরলে আপনারই বিপদ। এই যুগে মাহফিলে কী হয় সবাই জানার সুযোগ পায়, মূল ধারার মিডিয়ায় না আসলেও এসব সোশ্যাল মিডিয়ায় ঠিকই আসে, ইসলামের প্রতি অনেকের ভুল ধারণা তৈরি হয় এদের কারণেই। সাম্প্রতিক এক মুর্খের কথা শুনে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, এমন মুর্খের কিন্তু অভাব নাই। আমার আপনার দায়িত্ব এদের প্রতিহত করা।
.
অনেকদিন আগে একজন আলেম বলেছিলো যারা সাহিত্য চর্চা করে তারা নাস্তিক, উনি কথাটা যে কিছুটা আমাকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন আমি বুঝেছিলাম৷ তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “হুজুর, সাহিত্য কী আর নাস্তিক কী জিনিস…? কুরআন যে সময় অবতীর্ণ হয়েছিলো সেই যুগে কিসের প্রাধান্য ছিলো বেশি…? সুরা কাউসারের শানে নুযূল কী…? কেনইবা কুরআনের মতো আরেকটি গ্রন্থ বা কুরআনের সুরাগুলোর মতো আরেকটা সুরা অথবা একটা আয়াত তৈরির চ্যালেঞ্জ দেয়া হলো…? কুরআনের কোন গুণের উপর ভিত্তি করে…?”
উনি সঠিক কোন উত্তর দিতে পারেননি। পরে বললাম “হুজুর, কুরআন অবতীর্ণের সময় সাহিত্যের প্রভাব ছিলো বেশি ইতিহাস পড়ে জেনেছি, পৃথিবীতে আর কোন যুগে সাহিত্যের এত বড় প্রভাব ছিলোনা, সেই যুগে কুরআন নাযিল হলো আর মানুষ সেই সময়ের সাহিত্যকে ডিঙিয়ে কুরআনের কাছে নত হলো…! কুরআনের ভিতর সাহিত্যক শক্তি না থাকার কোন প্রশ্নই আসেনা, বরং সেই সময়ের বিখ্যাত কবি ইমরুল কায়েস পর্যন্ত কুরআনের ভিতর যে সর্বোচ্চ সাহিত্যিক ক্ষমতা আছে এবং এমন উচ্চ গুণ সম্পন্ন সাহিত্য চর্চা কোন মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয় সেটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সুরা কাউসারের শানে নুযূল পড়ে জেনেছি। তাহলে সাহিত্য চর্চা করলে কেউ নাস্তিক হয় কিভাবে…?” উনি গরম আচরণ করলেন তারপর তার সাথে আমার আর কোনদিন তর্ক হয়নি।
.
প্রচলিত অর্থে যাদের আলেম বলা হয় তাদের সাথে আমি কখনো তর্কে যাইনা, আমি এমন অসংখ্য প্রচলিত অর্থে বুঝানো আলেমদের সাথে কথা বলেছি, মিশেছি, যাদের ভিতর জ্ঞানের প্রচণ্ড অভাব। এরা মাদ্রাসায় কিছুদিন যাওয়া আসা করেছে, লম্বা জোব্বা-টুপি পরেছে আর কিছু মুখস্থ বিদ্যা আছে এটুকুর কারণে তাদের গর্বের শেষ নাই এরথেকে বেশি অর্জনও এদের নাই। এরা ভাবে জান্নাতে এদের এক পা আরেক পা দুনিয়াতে, এরা আপনাকে ঠাস করে জাহান্নামী বানিয়ে দিবে।
.
অথচ প্রচলিত অর্থে এদের আলেম বলা হলেও আল্লাহর ভাষায় কারা আলেম সেটা অনেকেরই অজানা। আল্লাহর ভাষায় আলেম তারাই যারা আল্লাহকে বেশি ভয় করে, আল্লাহ বলেন, “আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই কেবল তাঁকে (আল্লাহ) ভয় করে।” (সুরা ফাতির, আয়াতঃ ২৮) এটা সরল অনুবাদ, আপনি এই বাক্যের অর্থ কী বুঝলেন…? আলেমরা আল্লাহকে বেশি ভয় করে, এর মানে যাদের ভিতর আল্লাহর ভয় আছে তারাই আলেম। আল্লাহর প্রতি ভয় কখন তৈরি হবে…? যখন আপনি আল্লাহর পরিচয় পাবেন…? আল্লাহর পরিচয় আপনি কখন পাবেন…? যখন আপনি জ্ঞানার্জন করবেন ও জ্ঞানীদের সাহচর্যে থাকবেন। অথচ প্রচলিত অর্থে আলেম বলতে আমরা বুঝি যার মাদ্রাসার সনদ আছে। বিষয়টা একাধারে ভ্রান্ত এবং হাস্যকর ধারণা। এটা সমাজে এতবেশি প্রচলিত যে তা দূর করা সম্ভবপর নয়।
.
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, সূচনা লগ্ন থেকেই এক শ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিহীন বুদ্ধিজীবীরা ইসলামের সমালোচনা করে আসছে, ইসলামের আইনের ভুল ধরার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে, বারবার বলছে যে ইসলামে প্রচুর অসঙ্গতি আছে। আমাদের দাবী ইসলাম পরিপূর্ণ, এতে কোন অসঙ্গতি নেই, সাইন্টিফিক দিক থেকেও নির্ভেজাল। তবে এরা কিভাবে এসব বলে…? এর পিছনে অনেকগুলো কারণ থাকলেও অন্যতম একটি কারণ হলো ইসলামের সুমহান আদর্শ, ইসলামের মৌলিকত্ব আমরা তাদের সামনে উপস্থাপন করতে পারিনি এসব মূর্খদের কারণে বরং এরা ইসলামকে হাসির বস্তু বানিয়ে ফেলেছে।
.
আমাদের বোকামির দ্বারা আমরা ইসলামের সমালোচনাকারীদের প্রকারান্তে সহযোগিতা করতেছি। জ্ঞানার্জনের শেষ নেই, যতই আপনি সত্যের জ্ঞান আহরণ করবেন ততই আপনার মাঝে আল্লাহ ভীতি পয়দা হবে, ততই আপনি আলেম হয়ে উঠবেন। কেবল জানলেই যদি আলেম হওয়া যেতো তবে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের মাঝেও প্রচুর আলেম আছে।
.
মূল বিষয় হলো ইসলামে জ্ঞানার্জনের এত গুরুত্ব অথচ আমরা কুরআন মুখস্থ করি এটুকুই শেষ। না বোঝলাম এখানে কী বলা হলো, না বোঝলাম এর ভাবগত অর্থ না পেলাম এর ভিতরের রস। এদিকে আজীবন শুধু বলে গেলাম কুরআনে সব আছে অথচ বড় বড় উদ্ভাবন ও আবিষ্কার করতেছে অন্যরা, পরে ঠিকই বলতেছি এগুলো কুরআন থেকেই করে…!!
হাস্যকর না…???
মুসলিম জাতির উচিত জ্ঞান বিজ্ঞানের শাখা প্রশাখায় আবার বিচরণ করা, আমাদের অতীত সুন্দর ছিলো…
.
০৬/১২/২০২১

আশুরার ফজিলত, করণীয় এবং বর্জনীয়

Add

আরবি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাসের নাম হচ্ছে “মহররম”। মহররম মাসের দশম দিনকে বলা হয় “আশুরা”। আরবি “আশারা ” হচ্ছে দশ। সেই “আশারা ” থেকেই এসেছে “আশুরা ” তথা মহররম মাসের দশ তারিখ।

পৃথিবীতে মহরমের দশ তারিখে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী ঘটেছে। যেকারণে এই তারিখটি ইহুদী, নাসারা, মুসলিম সকলের কাছে খুবই সম্মানিত। আজ আমরা কুরআন হাদিসের আলোকে আশুরা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

ইসলামে আশুরার গুরুত্ব
আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে চারটি মাসকে সম্মানিত করেছেন। সেই চার মাসের একটি হলো মহররম।

আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গননায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন।” (সূরা: আত তাওবাহ, আয়াত: ৩৬)

উপর্যুক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘তিনটি মাস ধারাবাহিক; আর তাহলো জিলকদ, জিলহজ এবং মহররম। আর অপরটি হলো রজব। যা জমাদিউস সানি ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস।’ (বুখারি)

সুতরাং কুরআন হাদিসের আলোকে ইসলামে মুহররম একটি সম্মানিত মাস। আর এই মাসের দশম দিন তথা আশুরার গুরুত্বও অপরিসীম।

মুহররমের ফজিলত
পবিত্র হাদিস থেকে জানা যায় মুহররম এবং আশুরার দিনে ইবাদত বন্দেগীর অপরিসীম ফজিলত রয়েছে।

আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, রমাদান মাসের পর সর্বোত্তম সাওম হল মুহররম মাসের সাওম (আশুরার সাওম) এবং ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাত্রের সালাত।” (সুনানে আন-নাসায়ী ১৬১৩, ইবনু মা-জাহ ১৭৪২)

আবূ কাতাদাহ আল-আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আরাফাহর দিনে সওম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন-এর দ্বারা বিগত ও আগত এক বছরের গোনাহ (পাপ) মোচন হয়। “আশুরাহর দিনের সওম পালন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন-বিগত এক বছরের পাপ মোচন হয়।” (বুলুগুল মারাম ৬৮০, মুসলিম ১১৬২, তিরমিযী ৬৭৬, নাসায়ী ২৩৮২, আবু দাউদ ২৪২৫, ইবনু মাজাহ ১৭১৩, আহমাদ ২২০২৪)

আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন- “রমাদান মাসের সাওমের পরে আল্লাহ্‌ তা’আলার মাস মুহররমের সাওমই সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ।” (তিরমিজি ৭৪০)

উপর্যুক্ত হাদিস থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, রমাদানের পরে মুহররম মাস এবং এই মাসে পালন কৃত সাওমের ফজিলত ও গুরুত্ব অনেক বেশী। কেননা এই মাসের সাওমের বিনিময়ে আল্লাহ পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেন। আর মুহররম মাসের দশম দিন তথা আশুরা হচ্ছে ফজিলতপূর্ণ দিন। যেদিনে সাওম পালনের কথা হাদিসে এসেছে।

আশুরা এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন?
আমরা ইসলামী ইতিহাস, হাদিস পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন ইসরাইলী সূত্র থেকে আশুরার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারি। যেগুলো আল্লাহর প্রেরিত বিভিন্ন নবী রাসূলের সাথে সম্পর্কিত। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম পর্যন্ত অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে এই আশুরা। যেকারণে এই দিনটি সকল আহলে কিতাবিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা বুখারি ৩৩৯৭, ও মুসলিম ১১৩৯ নং হাদিস থেকে এই দিনে ঘটিত দুটি ঘটনা সম্পর্কে স্পষ্ট জানতে পারি।

যার একটি হলো ফেরাউনের নির্যাতনের কবল থেকে- হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের মুক্তি। যখন আল্লাহ সাগরে রাস্তা সৃষ্টি করে তাঁদের নিরাপত্তা দিয়ে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

অন্যটি হলো ফেরাউনের মৃত্যু। যখন আল্লাহ কতৃক সাগরের রাস্তা দিয়ে মুসা (আ.) ও তাঁর সাথীরা চলে যাচ্ছিলেন, তখন ফেরাউনও তার সৈন্যদল নিয়ে সেই রাস্তা দিয়ে তাদের ধরতে যাচ্ছিল। কিন্তু মাঝ পথে রাস্তা পানিতে একাকার হয়ে ফেরাউনের মৃত্যু হয়।

উপর্যুক্ত দুটি ঘটনার পরিপূর্ণ সত্যতা পাওয়া গেলেও- আরো কিছু ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন কিতাবে বিক্ষিপ্তাবে এসেছে। যার অধিকাংশেরই সূত্র হচ্ছে ইসরাইলী কাহিনী।

এইসব কাহিনী সুদীর্ঘকাল থেকে আমাদের উপমহাদেশের ইসলামে প্রচলিত আছে। সুন্নী বিশ্বকোষ ওয়েবসাইটসহ উপমহাদেশের অসংখ্য আলেম ওলামাদের বর্নণায় অসংখ্য কাহিনী প্রচারিত হয়। যার কোনো সঠিক তথ্যসূত্র সহিহ হাদিস থেকে পাওয়া যায় না। এমনসব কাহিনী গুলো হচ্ছে-

১) মহান আল্লাহ এই দিনে প্রথম মানব আদম (আ.) কে সৃষ্টি করেন এবং জান্নাতে স্থান দেন। পরবর্তীতে এই দিনেই আদম-হাওয়া (আ.) কে দুনিয়ায় পাঠানো হয়। একইসাথে এই দিনেই তাঁরা আল্লাহর ক্ষমা লাভ করেন।

২) মহান আল্লাহ পাক এই মুহররমের ১০ তারিখে সৃষ্টির সূচনা করেন।

৩) এই দিনে হযরত নূহ (আ.) এবং তাঁর সাথীরা বন্যা-প্লাবন থেকে মুক্তি পান।

৪) আশুরার দিন শুক্রবার ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।

৫) এ দিনই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র ওজুদ (সৃষ্টি) মুবারক হয় এবং ইছমত, সম্মান ও খুছূছিয়ত এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়।

৬) এই দিনে হযরত আদম আলাইহিস সালামের দোয়া কবুল করা হয়।

৭) এই দিনে হযরত ইদ্রিস (আ.) কে সম্মানিতস্থানে তথা আকাশে তুলে নেয়া হয়।

৮) আল্লাহ পাক এদিনে হযরত মূসা (আ.) এর সাথে কথা বলেন এবং তাঁর উপর তাওরাত শরীফ নাযিল করেন।

৯) মহররমের দশ তারিখ হযরত ইউনুস (আ.) ৪০ দিন মাছের পেটে থাকার পর মুক্তি লাভ করেন।

১০) এই দিনে হযরত মরিয়ম (আ.) এর গর্ভ হতে হযরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন।

১১) হযরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সুস্থতা লাভ করেন।

১২) এদিনে দীর্ঘ দিন বিচ্ছেদের পর হযরত ইউসূফ (আ.) তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.) এর সাথে মিলিত হন।

১৩) আল্লাহ পাক এ দিনে হযরত ঈসা (আ.) কে আসমানে তুলে নেন।

১৪) এদিনে হযরত ইবরাহীম (আ.) খলীল উপাধি লাভ এবং নমরূদের অগ্নিকু- থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন।

১৫) এ দিনে হযরত দাঊদ (আ.) এর দোয়া কবুল এবং তাঁর পুত্র হযরত সুলায়মান (আ.) কে বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে।

উপর্যুক্ত এইসব ঘটনাবলী ছাড়াও আরো অসংখ্য কাহিনী আমাদের সমাজে চালু আছে। যার কোনো সঠিক তথ্যপ্রমাণ নেই। উপর্যুক্ত কাহিনী গুলোর- কিছু কিছু বর্নণা বিভিন্ন কিতাবে দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।

বিশেষকরে এই দিনে হজরত আদম (আ.) এর তাওবা কবুল হয়েছে বলে আবুল কাসিম ইস্পাহানী (রাহ.) কর্তৃক সংকলিত “আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব ” কিতাবে ১৮৬৮ নং রেওয়ায়েতে একটি হাদিস এসেছে। তবে সনদ দুর্বলতার কারণে মুহাদ্দিসগণের বিশুদ্ধতার মানদন্ডে তা উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

অবশ্য ইমাম ইবনে রজব (রাহ.) কৃত “লাতাইফুল মাআরিফ” এবং আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমাদ (রাহ.) কৃত “আল-ইলাল ওয়া মারিফাতির রিজাল” গ্রন্থে কোনো কোনো তাবেয়ীর উদ্ধৃতি দিয়ে আদম (আ.) এর তাওবা কবুল হওয়ার কথা এসেছে।

হাদিস গ্রন্থ মুসনাদে আহমাদে, এই দিনে হযরত নুহ (আ.) এর নৌকা নোঙর সম্পর্কিত একটি হাদিস এসেছে যার সূত্র মুসনাদে আহমাদ ১৪/৩৩৫, হাদীস ৮৭১৭। যা শায়েখ শুয়াইব আরনাউতকৃত হাশিয়াযুক্ত নুসখা। যদিও তা মুহাদ্দিসগণের বিবেচনায় দুর্বল বলা হয়েছে।

“আত-তারগিব ওয়াত-তারহিবে” কিতাবে হজরত ঈসা (আ.) এর জন্ম আশুরার দিন হয়েছে বলে একটি সনদে এসেছে। এবং যথারীতি এই সনদও দুর্বল বলে প্রমাণিত হয়েছে।

উপর্যুক্ত ঘটনাবলী ইসলামী ভিত্তি না থাকলেও বিভিন্ন ইসরাইলী বর্নণায় উপমহাদেশের ইসলামে প্রবেশ করেছে। আর তা বিভিন্ন আলেম ওলামাদের দ্বারা সর্বব্যাপী প্রচারিত হয়ে আসছে।

আশুরার সুন্নাহ
পবিত্র আশুরার সুন্নাহ হলো সাওম পালন করা। রাসূল (সা.) হিজরতের আগে থেকেই আশুরার দিনে সাওম পালন করতেন এবং অন্যান্যদেরও তাগিদ দিতেন। পরবর্তীতে রমাদানের সাওম ফরজ হলেও আশুরা সাওম পালনের উৎসাহ দিতেন। শুধু তাইনয়, হিজরতের পরে যখন তিনি জানতে পারলেন- ইহুদী নাসারাও এই দিনে সাওম পালন করে। তখন তিনি দুটি সাওম পালনের নির্দেশ দিলেন যাতে তাদের সাথে সাদৃশ্য না হয়।

আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ‘আশুরার দিন সিয়াম পালন করেন এবং লোকদের সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এই দিনের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ইনশাআল্লাহ আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও সিয়াম পালন করব। বর্ণনাকারী বললেন, এখনো আগামী বছর আসেনি, এমতাবস্থায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইন্তেকাল হয়ে যায়। (সহিহ মুসলিম ২৫৫৬)

উপর্যুক্ত হাদিসের আলোকে বুঝা যায় যে, আশুরার দিনে গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ হলো সাওম পালন করা। এবং তা দুটি। একটি ৯ তারিখে এবং ১০ তারিখ। অথবা ১০ তারিখ এবং ১১ তারিখ।

সৃষ্টির শুরু থেকেই আশুরা সম্মানিত
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই আশুরার গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়। বিশেষকরে আহলে কিতাবের অনুসারীদের বিভিন্ন নবী রাসূলদের অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে আশুরা। যেকারণে ইহুদী, নাসারা, মুসলিম এমনকি মক্কার কুরাইশরাও সুদীর্ঘ কাল থেকে এই দিনকে সম্মান করে আসছে। শুধু তাইনয় রাসূলুল্লাহও (সা.) নবুওয়াত পাওয়ার আগে থেকেই এই দিনের সম্মানে সাওম পালন করে এসেছেন।

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিনী আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুম থেকে বর্ণিত: “আশুরা দিবস এমন একটি দিবস ছিল, যে দিবসে জাহিলিয়া যুগে কুরাইশগণ রোযা রাখত। জাহিলিয়া যুগে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও সে দিবসে রোযা রাখতেন। অতঃপর রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদীনায় এলে পরে তিনি সেই রোযা রাখলেন এবং লোকদেরকেও সেই দিনের রোযা রাখতে হুকুম করলেন। অতঃপর যখন রমযানের রোযা ফরয হল, উহাই ফরয হিসেবে রইল। আশুরা দিবসের রোযা ছেড়ে দেয়া হল। অতঃপর যে ইচ্ছা করত ঐ দিবসে রোযা রাখত, আর যে ইচ্ছা করত না সে তা ছেড়ে দিত।” (বুখারী ২০০২, মুসলিম ১১২৫, মুয়াত্তা ইমাম মালিক ৬৪৯)

উপর্যুক্ত হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, আশুরার দিনটি সকলের কাছেই পরিচিত এবং ফজিলতপূর্ণ ছিলো। যে কারণে মক্কার কাফের মুশরিকরাও এই দিনের সম্মানে সাওম পালন করতো।

আশুরার ইসলামিক ট্র্যাজেডি
সুদীর্ঘকাল থেকে আশুরা সুসংবাদের বার্তা বহন করলেও- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের প্রায় ৫০ বছর পর ইসলামে যোগ হয় এক মর্মান্তিক বিয়োগগাঁথা।

হিজরী সাল ৬১, যখন পৃথিবীর চারদিকে ইসলামের জয়জয়কার। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বিদায়ের পরে যখন ইসলামে নেমে এসেছিল দূর্যোগের ঘোর ঘনঘটা। সেই অস্থিরতা থেকে সবেমাত্র সবকিছু থিতু হয়ে আসছে। ঠিক সেই সময়েই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পৃথিবীর মানুষ কারবালার প্রান্তের দেখে নির্মম পাশবিক ঘটনা।

ক্ষমতালোভী ইয়াজিদের নির্মমতার শিকার হয় রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত হুসাইন (রা.)। বিশ্বের মানুষ অবাক নিস্তব্ধ! কীভাবে সম্ভব? একজন মুসলিম হয়ে কী করে সম্ভব হলো রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণভোমরার গলায় ছুরি দিতে?

৬১ হিজরির মুহররমের দশ তারিখ আশুরার পড়ন্ত বেলায় দিনে হত্যা করা হয় পিপাসার্ত হুসাইন (রা.) কে। পৃথিবীর ইতিহাসে যোগ হয় নতুন একটি অধ্যায়। যেখানে আশুরার আনন্দ উৎসবের সাথে রচিত হয় নির্মম শোকগাথা। আজও পৃথিবীর মানুষ সেই নির্মমতার চিত্র ভেবে শিউরে উঠে।

কারবালা এবং শিয়া সম্প্রদায়
ইসলামে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পরবর্তীতে, হযরত আলী (রা.) কে কেন্দ্র করে একটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। যারা আমাদের কাছে শিয়া নামে পরিচিত। এই শিয়ারা আলী (রা.) কে প্রধান করে নতুন একটি বিশ্বাস নিয়ে সরাসরি প্রকৃত ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়। যদিও তারা নিজেদের প্রকৃত মুসলিম এবং তাদের ধর্মই প্রকৃত ইসলাম বলে দাবি করে।

এই শিয়ারাই কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন ঈমান আকিদার জন্ম দেয়। কারবালার ইতিহাস দেখলে জানা যায়- এই শিয়ারাই হযরত হুসাইন (রা.) কে বারবার চিঠি দিয়ে তাঁকে কুফায় যেতে বাধ্য করে।

তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে হুসাইন (রা.) তাঁর পরিবার পরিজন নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আর পথিমধ্যে কারবালার প্রান্তেরে ইয়াজিদের সেনাবাহিনী তাঁকে আটকে দেয়। কেননা সেইসময় হযরত হুসাইন (রা.) ছিলেন প্রকৃত খিলাফতের অধিকারী। যদিও মুয়াবিয়া (রা.) তার ছেলে ইয়াজিদকেই খিলাফতের দায়িত্ব দিয়ে দেয়।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এইসব টানাপোড়েনে ইয়াজিদ কতৃক হুসাইন (রা.) কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেদিন কারবালার প্রান্তেরে হাজারো শিয়া মুসলিম থাকার পরও তারা হুসাইন (রা.) কে সাহায্য করার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি।

আর এইসব শিয়ারাই পরবর্তীতে হুসাইন (রা.) জন্য মায়াকান্না করতে থাকে। তারা প্রতিবছর আশুরার দিনে তাদের কৃতকর্মের জন্য শোক প্রকাশ করতে থাকে। তাদের শোক প্রকাশ আজ বিশ্ব বিবৃত। যদিও তারা নিজেদের ইসলামের অনুসারী দাবি করে। অথচ তারা আজও আশুরার দিনে শোক প্রকাশ করে ইসলামের বিরোধিতা করে। কেননা ইসলামে চারদিনের বেশী শোক প্রকাশ হারাম।

হুসাইন (রা.) হত্যাকাণ্ডের পরে ইসলামে আশুরার ব্যাখ্যা পরিবর্তিত হতে থাকে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্রের নির্মম হত্যাকাণ্ড কখনোই স্বাভাবিক এবং ছোটখাটো বিষয় হতে পারে না। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে পরবর্তীতে সাধারণ মুসলমানেরাও আশুরার প্রকৃত উদ্দেশ্য ভুলে শোকে নিমজ্জিত হয়ে যায়।

আশুরা বনাম কারবালা
আমরা ইতিমধ্যে কুরআন হাদিসের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে জানতে পেরেছি যে, আশুরার ইতিহাস সৃষ্টির শুরু থেকেই। বিভিন্ন নবী রাসূলগণ (আ.) এই দিনকে গুরুত্বের সাথে শুকরিয়া স্বরূপ আনন্দ উৎসব এবং সম্মান দিয়ে এসেছে।

একইসাথে আমাদের নবী মুহাম্মদও (সা.) এই দিনে মুসলিমের করণীয় কী তাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। রাসূল (সা.) এর পরবর্তীতে নতুন করে কোনো কিছু ইসলামী শরিয়তে সংযোজন বিয়োজন করা সম্ভব নয়। কেননা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার মালিক ছিলেন একমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.)।

সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ওফাতের ৫০ বছর পরে সংঘটিত ঘটনা কখনোই শরিয়ত হতে পারে না। অর্থাৎ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো আমল সৃষ্টি করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) আশুরার জন্য যেসব আমলের কথা বলে গেছেন, শুধুমাত্র সেই আমল ব্যতিরেকে নতুন কোনো আমল এই আশুরা উপলক্ষে করা যাবে না।

যদি কেউ আশুরা উপলক্ষে নতুন কোনো আমল চালু করে, যা রাসূলুল্লাহ (সা.) সৃষ্টি করেননি কিংবা নির্দেশও দেননি। তাহলে তা হবে “বিদআত”। আর ইসলামে বিদআত একটি জঘন্য অপরাধ।

সুতরাং আশুরা উপলক্ষে শোক প্রকাশ কিংবা আরও যেসব নতুন নতুন আমল আমরা করে থাকি তা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে হ্যাঁ এটা অনস্বীকার্য যে, কারবালা ঘটনা খুবই মর্মান্তিক এবং বেদনাদায়ক। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে যে, সত্যের জন্য আমাদের জীবন দিয়ে হলেও মিথ্যাকে প্রতিহত করতে হবে।

আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় রাসূলের (সা.) প্রিয় নাতিকে কেন সত্যের জন্য এই দিনেই তাঁর জীবন দানকে বেছে নিলেন? তার কারণ পৃথিবীবাসীকে এটাই জানাতে যে, আশুরার দিনে আল্লাহ তোমাদের সবাইকে দয়া করেছেন। আর আশুরার দিনেই আমি আমার বন্ধুর বন্ধুকে সত্যের জন্য কুরবানি দিলাম।

এই কুরবানীর কথা সকল ধর্মের সকল মানুষ কিয়ামত পর্যন্ত স্বরণ রাখুক। যাতে তারাও সত্যের জন্য কখনোই পিছপা না হয়। এই ঘটনা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। তাই এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়াটাই হচ্ছে প্রকৃত ইসলাম।

আশুরার করণীয় আমল
আমরা হাদিস থেকে আগেই জেনেছি যে এই দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে সাওম পালন করা। এবং তা শুধু একটি নয় বরং দুটি। আর এই সাওমের দ্বারা আল্লাহ আমাদের পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করবেন ইনশা আল্লাহ।

আশুরাসহ মুহররমের পুরো মাস বেশী বেশী তাওবা-ইসতেগফার করা। কেননা অতীতের সকল নবী এবং নবীর উম্মতকে এই দিনেই ক্ষমা করা হয়। সুতরাং আশাকরা যায় যে, আল্লাহও এইদিনে আমাদের সাগর পরিমাণ গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন ইনশা আল্লাহ।

এই বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহররম হলো আল্লাহ তাআলার (কাছে একটি মর্যাদার) মাস। এই মাসে এমন একটি দিন আছে, যাতে তিনি অতিতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন।’ (তিরমিজি)

সুতরাং আশুরা উপলক্ষে আমাদের বেশী দোয়া দরুদ পড়া এবং তাওবা-ইসতেগফার করা উচিত।

এইদিনে যেহেতু ইসলামী ইতিহাসে একটি চরম হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা হয়েছে- সেহেতু সেই ঘটনা থেকেও আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। এই ঘটনা আমাদের ঈমানকে জাগ্রত করে। সত্যের জন্য প্রয়োজনে জান দিয়ে দিতে হবে। তবুও মিথ্যার কাছে শয়তানের কাছে জালিম শাসকগোষ্ঠীর কাছে কখনোই মাথানত করা যাবে না।

হুসাইন (রা.) আত্মত্যাগ আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, নিজেদের ঈমান আমল ঠিক রাখার জন্য যথাসাধ্য আত্মনিয়োগ করতে হবে। কখনোই দুনিয়াবী লোভে, প্রবৃত্তির তাড়নায়, শাসকগোষ্ঠীর চাপে নিজেদের ঈমান বিলিয়ে দেওয়া যাবে না।

আশুরা সম্পর্কে ভুল ধারণা
ইসলাম সম্পর্কে বিশদ না জনার কারণে এবং জানার চেষ্টা না করার কারণেও উপমহাদেশে আশুরাসহ বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে অসংখ্য ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। যা কখনোই ইসলাম সমর্থন করে না। এইসব ধারণা সমূহ হলো:

১) এই মাসে বিয়েশাদি না করা।

২) নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ না করা।

৩) কোনো শুভ কাজ বা ভালো কাজের সূচনা না করা।

৪) গোশত না খাওয়া ও নিরামিষ আহার করা।

৫) পান না খাওয়া, নতুন কাপড় ও সুন্দর পোশাক পরিধান না করা, সাদা কাপড় বা কালো কাপড় তথা শোকের পোশাক পরা।

৬) সব ধরনের আনন্দ উৎসব পরিহার করা ইত্যাদি।

উপর্যুক্ত কাজগুলো হচ্ছে কুসংস্কার। এইসব কখনোই ইসলাতী রীতিনীতি নয়। ইসলামের সাথে এইসবের কোনো সম্পর্ক নেই।

আশুরার বিদআতী আমল
রাসূলুল্লাহ (সা.) কতৃক আশুরার আমল থেকে সরে গিয়ে আমরা দিনদিন নিত্যনতুন বিদআতে জড়িত হয়ে গেছি। বিশেষকরে হুসাইন (রা.) কে নিয়ে শিয়াদের বাড়াবাড়ির কারণে- সুন্নীদের মাঝেও এইসবের প্রচলন শুরু হয়েছে। যেমন:

১) হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এর স্মরণে কাল্পনিক তাযিয়া বা নকল কবর নিয়ে মিছিল করা।

২) এইসব নকল তাযিয়ার সামনে হাতজোড় করে দাড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা।

৩) এইসব নকল তাযিয়ায় বা কবরে নজরানা স্বরূপ অর্থ প্রদান করা।

৪) কারবালার শোক প্রকাশ করতে গিয়ে নিজেদের দেহে ছুরি ব্লেড ইত্যাদি দ্বারা আঘাত বা রক্তাক্ত করা।

৫) হুসাইন (রা.) শাহাদাতের স্বরণে হায় হুসেন, হায় আলি ইত্যাদি বলে শোক, মাতম কিংবা বিলাপ ইত্যাদি করা।

৬) যুদ্ধ সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে ঘোড়া নিয়ে প্রদর্শনী করা।

৭) বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ফুল দিয়ে সাজানো এসব নকল তাযিয়া বা কবরের প্রদর্শনী করা।

হুসাইনের (রা.) নামে শোকগাথার প্রচলন
আজ বিশ্বের শিয়াসহ সুন্নীদের কিছু অংশ আশুরার দিনে হুসাইন (রা.) কে নিয়ে শোক প্রকাশের যে পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে, তা হুসেইন (রা.) শাহাদাতের তিনশ বছরেও ছিলো না। আমরা ইবনুল আসীর কর্তৃক রচিত ‘আল-কামেল ফিত তারীখ’ ৭/২৭৯, ইবনে কাসীর (রাহ.) কর্তৃক রচিত ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ ‘১৫/২৬১ (৩৫২ হিজরীর ঘটনাবলী) ও হযরত মাওলানা হাবীবুর রহমান আযমী (রাহ.) কৃত ‘ইবতালে আযাদারী’ কিতাব থেকে জানতে পারি- আশুরা উপলক্ষে শিয়াদের এইসব তাযিয়া মিছিল, কান্নাকাটি, আহাজারি, বুক পিঠ চাপড়ানো, ছুরি বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেদের আঘাত করা ইত্যাদির সূচনা করেন “মুঈযযুদ দাওলা দাইলামী” নামে একজন শিয়া।

এই ব্যক্তি সর্বপ্রথম ৩৫২ হিজরীতে এইসব শোক তাযিয়া মিছিল করার হুকুম জারি করেন। যা পরবর্তীতে ৩৬৩ হিজরীতে আল-মুঈযযু লিদীনিল্লাহি ফাতিমী (বেদ্বীন কট্টর শিয়া) মিশরেও এই হুকুম জারি হয়।

সুতরাং এইসব শোক মিছিল কখনোই ইসলামের অংশ ছিলো না এবং নেই। যদি কেউ এইসব করে এবং সমর্থন করে তাহলে তার ঈমান সন্দেহে পতিত হবে।

সুতরাং আসুন পবিত্র এবং সম্মানিত মাস মহররমের দশ তারিখ আশুরার দিনকে আমরা ইবাদতের দিন হিসাবে পালন করি। সাওম পালনের পাশাপাশি যথাসাধ্য তাওবা-ইসতেগফারের মাধ্যমে নিজের পাপ সমূহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। একইসাথে আশুরার দিনে সত্যের জন্য হুসাইন (রা.) আত্মত্যাগের কথা চিন্তা করে নিজেদের ঈমানকে উজ্জীবিত করি।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
৩ আগস্ট, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

ঈমান ভঙ্গের কারণ সমূহ

639581

ঈমান ভঙ্গের কারণ
ঈমান হচ্ছে আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাস বিভিন্ন কারণে বিভিন্নভাবে নষ্ট হয়ে যায়। আর ঈমান নষ্ট হওয়া মানেই ঈমান ভঙ্গ হওয়া। আজ আমরা কী কী কারণে ঈমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে তা জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

প্রাককথাঃ
ঈমান ভঙ্গের কারণ জানতে হলে আগে পরিপূর্ণ ঈমান” কী সেটা জানত হবে। আর পরিপূর্ণ ঈমান কী জানার আগে “ইসলাম”কী সেটা জানা উচিত।

ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর পরিপূর্ণ বিধানে আনুগত্য করা। এই পরিপূর্ণ বিধানকে মুখে স্বীকৃতি, অন্তরে বিশ্বাস এবং কাজে পূর্ণ করাই হচ্ছে ঈমান। যার সহজ অর্থ হলো ইসলামের বিধানকে মুখে স্বীকার করা, অন্তরে বিশ্বাস করা এবং সেইমতে কাজ (আমল) করাই হচ্ছে ঈমান। যে এই কাজ অর্থাৎ ঈমান এনে ইসলামের প্রতি আনুগত্যশীল হয় তাকে বলা হয় মুসলিম।

সুতরাং ঈমানের অর্থ হলো আল্লাহ্ এবং আল্লাহ্ সম্পর্কিত সকল বিষয়ের উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস। এই বিশ্বাস মূলত তিন ভাবে তথা বিশ্বাসগত, কর্মগত এবং উক্তিগত ভাবে ভঙ্গ হয়ে থাকে। এখন আমরা পবিত্র কুরআন এবং হাদিসের আলোকে প্রধানত কী কী কারণে ঈমান ভঙ্গ তথা বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায় তা জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

১) শির্ক করাঃ

আল্লাহ্‌র সাথে শির্ক করার কারণে যেকোনো ঈমানদার তার ঈমান হারিয়ে ফেলে। শির্ক অর্থ হলো আল্লাহ্‌র সাথে অন্যান্য ইলাহ বা উপাস্য সাব্যস্ত করা। অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সমকক্ষ অন্য কাউকে মনে করা স্বীকার করা বা কাজে প্রমাণিত করা।

বিভিন্নভাবে শির্ক হয়ে থাকে।

ক) ইবাদতের শির্কঃ

আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কাউকে আল্লাহ্‌র সমকক্ষ মনে করে তার ইবাদত করা হচ্ছে ইবাদতের শির্ক। অর্থাৎ আল্লাহ্‌র জন্য যেমন সিজদা, সিয়াম, কুরবানি, তাওয়াফ ইত্যাদি করা হয়। ঠিক তেমনি অন্য কোনো উপাস্যকে যেমনঃ দেবদেবী, আল্লাহ্‌র কোনো বান্দার (পীরের) জন্য বা অন্য কারো (অলি, আউলিয়ার) উদ্দেশ্যে একইভাবে ভাবে জীবিত বা কবরের ব্যক্তির জন্য সিজদা, সিয়াম, মান্নত, কুরবানি, তাওয়াফ ইত্যাদি করা হচ্ছে সুস্পষ্ট শির্ক।

আল্লাহ্ বলেন,
” আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির কর না। তাহ’লে নিন্দিত ও (আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে) বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে ” (বানী ইসরাঈল ৩৯)।

অন্য আয়াতে রাসুল সাঃকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ্ বলেন,

“(হে নবী!) আপনি আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকবেন না। তাহ’লে আপনি শাস্তিতে নিপতিত হবেন ” (শু‘আরা ২১৩)।

আল্লাহ্ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন আল্লাহর সাথে শরিক করা যাবে না। শুধু তাইনয় আল্লাহ্ সরাসরি তাঁর রাসুলকেও নির্দেশ দিয়েছেন শরিক না করার জন্য। অথচ সকল নবী রাসুলগন হচ্ছেন নিষ্পাপ।

আল্লাহ্ এটা এইজন্যই বললেন যাতে মানুষ শির্কের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে। অথচ অনেকে শির্কের সম্পর্কে না জানার কারণে বিভিন্ন পীর অলি আউলিয়াদের দরবারে গিয়ে সিজদা, মান্নত, তাওয়াফ, কুরবানি ইত্যাদি করছে। যদিও এইসব ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য।

খ) আল্লাহর সিফাতের সাথে শির্কঃ

আল্লাহ্‌র গুণাবলীতে অন্য কাউকে গুণান্বিত করা। অর্থাৎ আল্লাহ্‌র যা করার ক্ষমতা আছে তা তাঁর অন্য কোনো বান্দা বা অন্য কেউ করতে পারে এমন বিশ্বাস রাখা হচ্ছে আল্লাহর সিফাতের সাথে শির্ক। অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতা হচ্ছে কাউকে জীবন দেওয়া, নেওয়া, সুখ দুঃখ , সন্তান, বিপদে উদ্ধার ইত্যাদি। এখন কেউ যদি আল্লাহর কোনো বান্দার বা অন্য কারো এমন ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করে তাহলে তা হবে শির্ক।

আল্লাহ্ বলেন,
“(হে নবী!) বলুন, তবে কি তোমরা আল্লাহ ব্যতীত এমন অভিভাবক স্থির করেছ, যারা ভাল ও মন্দের মালিকও নয়” (রা‘দ ১৬)

“আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা দান করেন পুত্র-কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান।” [ আশ শূরা ৪২:৪৯, ৫০ ]

“আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোন দুর্দশা (দুঃখ কষ্ট) দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি ছাড়া তা দূরকারী কেউ নেই। আর যদি কোন কল্যাণ (সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য) দ্বারা স্পর্শ করেন তবে তিনিই তো সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।” (সূরা আনআম ৬:১৭)

উপরোক্ত আয়াত গুলো দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, সবকিছুর উপরই আল্লাহর ক্ষমতা। তিনিই একক এবং একমাত্র ক্ষমতাবান। তিনিই মানুষকে দুঃখ, দূর্দশা, সুখ, শান্তি, সন্তান ইত্যাদি প্রদান করেন।

তিনি তাঁর ক্ষমতা কাউকে প্রদান করেননি যে অন্য কেউ তা দিতে পারবেন যেমন আল্লাহ্ দেওয়ার ক্ষমতা আছে। সুতরাং কোনো বান্দা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নিকট আল্লাহর ক্ষমতাসীন কিছু চাইলে তাহলে তার ঈমান চলে যাবে।

গ) আল্লাহর রাজত্বের সাথে শির্কঃ

আল্লাহ্‌ মানুষ সৃষ্টির সাথে তাদের জীবনযাপন করার জন্য বিভিন্ন বিধিবিধানও তৈরি করে দিয়েছেন। ইসলাম হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান। যে বিধান বা সংবিধান দিয়ে মুসলমানগণ তাদের সকল সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কাজ কর্ম পরিচালনা করবে।

এখন যদি কেউ আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে নতুন কোনো দুনিয়াবী বিধান (বাধ্যতামূলক না হলে আপোষে) মেনে নেয় বা প্রতিষ্ঠা করে বা করার জন্য সাহায্য করে তাহলে তা হবে আল্লাহর রাজত্বের সাথে শির্ক।

আল্লাহ্ বলেন,
“জেনে রেখো সৃষ্টি যেহেতু তার (আল্লাহর) সুতরাং সমগ্র সৃষ্টির উপর ক্ষমতা ও একমাত্র (আল্লাহর) তার”( সূরা আরাফ ৫৪”)।
অন্য আয়াতে বলেন,

“আল্লাহ ব্যতীত বিচার ফায়সালা ও শাসন করার ক্ষমতা কারো নেই”। (সূরা নাম আনাম ৫৭)

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহ্ সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য এহ ঘোষণা দিচ্ছেন যে, সবকিছুর মালিক হচ্ছেন আল্লাহ্। এবং তাঁর সৃষ্টির উপর তাঁর বিধিবিধানেরই ক্ষমতা চলবে। দুনিয়ার কারো কোনো বিধান বা সংবিধান এখানে প্রযোজ্য নয়। যদি আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কিছু তালাশ করে তবে তা হবে শির্ক।

২) কারো মাধ্যমে আল্লাহর কাছে চাওয়াঃ

আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা দেন যে তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি তাঁর বান্দাদের শোনেন এবং দেখেন। তাঁর বান্দাদের যেকোনো প্রয়োজনে তিনি সাড়া দেন। তারপরও কেউ যদি আল্লাহর কাছে কিছু চাইতে বা বিপদে উদ্ধার হতে আল্লাহর কোনো বান্দাকে মাধ্যম ধরে বা উছিলা মনে করে, তবে তা হবে শির্ক।

আল্লাহ্ বলেন,
“যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তবে আল্লাহর উপর ভরসা কর” (মায়েদাহ ২৩)।

” বলুন, (হে নবী!) আমার পক্ষে আল্লাহই যথেষ্ট। নির্ভরকারীরা তাঁরই উপর নির্ভর করে ” (যুমার ৩৮)।

অর্থাৎ যারা ঈমানদার তারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করবে। যারা সরাসরি আল্লাহ্কে ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহর কাছে মাধ্যম বানাবে তারা গোমরাহীতে লিপ্ত হয়ে ঈমানহারা হয়ে যাবে।

আল্লাহ্ বলেন,
“তারা আল্লাহকে ব্যতিত যার ইবাদাত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না,উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, ‘এইগুলি আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।’ বল, ‘তোমরা কি আল্লাহকে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর এমন কিছুর সংবাদ দিবে যা তিনি জানেন না?তিনি মহান, পবিত্র’ এবং তারা যাকে শরীক করে তা হতে তিনি উর্দ্ধে।”(সূরা ইউনুস ১০: আয়াত ১৮)

অন্য আয়াতে আল্লাহ্ বলেন,
“জেনে রেখ, আল্লাহর জন্যই বিশুদ্ধ ইবাদাত-আনুগত্য। আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা কেবল এজন্যই তাদের ‘ইবাদাত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে।’ যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে আল্লাহ নিশ্চয় সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না।” (সূরা যুমার : ৩)

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা এটা সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে, যারা আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া বা পাওয়ার জন্য অন্য কাউকে মিডিয়া বা মাধ্যম লাগাবে বা প্রয়োজন মনে করবে। তাহলে তা হবে আল্লাহর সাথে শির্ক। অর্থাৎ যিনি আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী হিসাবে কাউকে মাধ্যম মানবেন তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।

অর্থাৎ আল্লাহর কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশায় তথাকথিত পীর অলি আউলিয়া ইত্যাদির দরবারে গিয়ে তাদের নাম করে সিজদা মান্নাত কুরবানি করা হচ্ছে শির্ক। যা ঈমানদারের ঈমান নষ্ট করে শির্কে লিপ্ত করে।

৩) মুশরিক কাফিরদের কাফির মনে না করাঃ

কেউ যদি স্বীকৃত মুশরিক কাফিরদের কাফির মনে না করে তাদের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে তাদের খারাপ মনে না করে, তাহলে ঐ ব্যক্তির ঈমান চলে যাবে।

আল্লাহ সুস্পষ্ট বলেন,
‘নিশ্চয়ই মুশরিকরা অপবিত্র’ (তওবা ২৮)।

“নিশ্চয়ই আহলে কিতাবদের(ইহুদী, খ্রিস্টানদের) মধ্যে যারা কুফরী করেছে এবং শিরক করে তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং এরাই সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট সৃষ্টি” (বায়্যিনাহ ৬)।

অতএব আল্লাহর ঘোষণা চূড়ান্ত যে, ইহুদী, নাসারা, মুশরিক (যারা আল্লাহর সাথে শির্ক করে) তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী। তাদের ব্যাপারে কখনোই কাফির নয় (তারাও আল্লাহর বান্দা তারাও ভালো কাজে নাজাত পাবে) এমন সন্দেহ করা যাবে না। কেউ এমন করলে তার ঈমান থাকবে না।

৪) ইসলামের বিধানকে অচল মনে করাঃ

আল্লাহর দেওয়া বিধিবিধানকে প্রাগৈতিহাসিক পুরোনো অচল ইত্যাদি মনে করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা। অর্থাৎ আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রাসুলের দেওয়া বিধিবিধান না মেনে অন্য কোনো দুনিয়াবী বিধি বিধান সংবিধান মেনে চলা এবং ঐটাকেই যথার্থ মনে করা।

সোজা কথায় বর্তমান দুনিয়ায় ইসলামী শাসনতন্ত্রের প‌রিবর্তে মানব সৃষ্ট গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদি মেনে চলা হচ্ছে ঈমান বিধ্বংসী কাজ। যারা আপোষে কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়াই ইসলামী বিধি বিধান মানবে না এবং দুনিয়াবী বিধি বিধান প্রতিষ্ঠা করবে এবং মানবে তাদের ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।

আল্লাহ্ বলেন,
“আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার নারী-পুরুষের সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার নেই। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হবে ” (আহযাব ৩৬)।

অন্য আয়াতে আল্লাহ্ বলেন,
“যে কেউ রসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, তার কাছে সরল পথ (ইসলাম) প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সব মুসলমানের অনুসৃত পথের (রাসুলের সুন্নাহর) বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান”। (সূরাঃ আন নিসা, আয়াতঃ ১১৫)

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা এটা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহর কাছে ইসলাম ব্যতীত কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই কেউ যদি ইসলাম ব্যতীত অন্য কিছু মানে, ভালো লাগে বা মানানোর জন্য অন্যকে উৎসাহিত বা চাপ দেয়, তাহলে তার ঈমান বাতিল হয়ে যাবে। যেমন বর্তমান যুগের গনতন্ত্রের রাজনীতি। যেখানে প্রতিনিয়ত ইসলামী আইন বাতিল করে ইসলাম বিরোধী আইন হচ্ছে।

৫) ইসলামের কোনো বিধানকে অপছন্দ করলেঃ

যদি কোনো ঈমানদার ইসলামের কোনো একটি বিধান অপছন্দ করলে সাথে সাথে তার ঈমান চলে যাবে। কোনো অবস্থাতেই কেউ ই ইসলামের কোনো বিধানকে অপছন্দ করতে পারবে না।

আল্লাহ্ বলেন,
“আর মানুষের মধ্যে কিছু এমন আছে, যারা বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি’, অথচ তারা মুমিন নয়।” [ আল বাকারা ২ :৮]

“আর যারা কাফির তাদের জন্য রয়েছে দুর্গতি এবং তিনি তাদের কর্ম বিনষ্ট করে দিবেন। এটা এজন্য যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তারা তা পসন্দ করে না। অতএব তাদের কর্মসমূহ আল্লাহ ব্যর্থ করে দিবেন’ (মুহাম্মাদ ৮-৯)।

এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, ঈমান এনে বা না এনে আমল সমূহ বাতিল হওয়ার অন্যতম কারণ আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয় অপছন্দ করা। উক্ত বিষয়ে ঈমানদার হয়ে আমল করলেও অপছন্দ করার কারণে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। অর্থাৎ কারো পর্দার বিধান ভালো লাগে না যদিও সে পর্দা করে। অথবা কারো জিহাদের কথা ভালো লাগে না অথবা পুরুষদের একাধিক বিয়ের অনুমতিও ভালো লাগে না। যদি কারো বিশ্বাস এমন হয় তাহলে তার ঈমান চলে যাবে।

৬) দ্বীনের কোনো বিধান নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করাঃ

কোনো ঈমানদার ইসলামকে নিয়ে বা ইসলামের কোনো বিধি বিধান কাজ আমল নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করলে তার ঈমান চলে যাবে।

আল্লাহ্ বলেন,
“আর যদি তুমি তাদেরকে প্রশ্ন কর, অবশ্যই তারা বলবে, ‘আমরা আলাপচারিতা ও খেল-তামাশা করছিলাম। বল, ‘আল্লাহ, তাঁর আয়াতসমূহ ও তাঁর রাসূলের সাথে তোমরা বিদ্রূপ করছিলে’?”[ আত তাওবাহ্ ৯:৬৫]

“তোমরা ওযর পেশ করো না। তোমরা তোমাদের ঈমানের পর অবশ্যই কুফরী করেছ। যদি আমি তোমাদের থেকে একটি দলকে ক্ষমা করে দেই, তবে অপর দলকে আযাব দেব। কারণ, তারা হচ্ছে অপরাধী।[ আত তাওবাহ্ ৯:৬৬ ]

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহ্ স্পষ্ট করে দিলেন যে, আল্লাহ্, আল্লাহর রাসুল ও তাঁর আয়াত নিয়ে কেউ যদি খেল, তামাশা, বিদ্রুপ, মজা ইত্যাদি করে তাহলে তার ঈমান চলে যাবে। যেমনঃ অনেকে দাড়ি রাখা, টাকনুর উপর প্যান্ট পড়া, বিভিন্ন বিদআতী কর্মকাণ্ডে জড়িত না হওয়া নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে। যা কখনোই উচিত।

আল্লাহ্ আরো বলেন,
“সুতরাং যারা আমার সাথে সাক্ষাতের আশা রাখে না, আমি তাদেরকে তাদের দুষ্টামীতে ব্যতিব্যস্ত করে রাখি” (ইউনুস ১১)।

তারা আল্লাহ্ না চাইলে কখনোই হিদায়াত পাবে না। দুষ্টুমিতেই জীবন পার হবে। সুতরাং তাদের সাথে চলাফেরা যোগাযোগ রাখা যাবে না। এব্যাপারে আল্লাহ্ক বলেন,

“আর (আল্লাহ্) কুরআনের মাধ্যমে তোমাদের প্রতি এই হুকুম জারী করে দিয়েছেন যে, যখন আল্লাহর আয়াত সমূহের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন ও বিদ্রূপ করতে শুনবে, তখন তোমরা তাদের সাথে বসবে না, যতক্ষণ না তারা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে। অন্যথা তোমরাও তাদেরই মত হয়ে যাবে। আল্লাহ মুনাফিক ও কাফিরদেরকে জাহান্নামে একই জায়গায় সমবেত করবেন’ (নিসা ১৪০)।

তাদের বন্ধু রূপেও গ্রহণ করা যাবেনা। তাদের থেকে সবসময় দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

আল্লাহ্ বলেন,
‘হে মুমিনগণ! আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলা মনে করে, তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর না। আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা মুমিন হও। আর যখন তোমরা ছালাতের জন্য আহবান কর, তখন তারা একে উপহাস ও খেলা মনে করে। কারণ তারা নির্বোধ’ (মায়েদাহ ৫৭-৫৮)।

সুতরাং দ্বীন নিয়ে যারাই হাসি ঠাট্টা করবে তাদের থেকে তৎক্ষণাৎ দূরত্ব সৃষ্টি করতে হবে। কেননা দ্বীন নিয়ে তামাশাকারীরা হচ্ছে মুনাফিক। আর মুনাফিকদের জায়গা হচ্ছে জাহান্নামে।

৭) জাদু টোনা বা কুফরী কালাম করাঃ

আল্লাহর উপর বিশ্বাসের পরিবর্তে কেউ যদি জাদু টোনা বা শয়তানী কুফরি কাজের মাধ্যমে কিছু পেতে চায় বা কারো ক্ষতি করতে চায় তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ ঈামান খারিজের কাজ। কুফরি কাজের দ্বারা যত ভালো কাজই হোক না কেন। ইসলামে সকল প্রকার জাদু টোনা করা হারাম।

আল্লাহ্ সূরা বাকারার ১০২ নংং আয়াাতে বলেন,

“আর তারা অনুসরণ করেছে, যা শয়তানরা সুলাইমানের রাজত্বে পাঠ করত। আর সুলাইমান কুফরী করেনি; বরং শয়তানরা কুফরী করেছে। তারা মানুষকে যাদু শেখাত এবং (তারা অনুসরণ করেছে) যা নাযিল করা হয়েছিল বাবেলের দুই ফেরেশতা হারূত ও মারূতের উপর। আর তারা কাউকে শেখাত না যে পর্যন্ত না বলত যে, ‘আমরা তো পরীক্ষা, সুতরাং তোমরা কুফরী করো না। এরপরও তারা এদের কাছ থেকে শিখত, যার মাধ্যমে তারা পুরুষ ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাত। অথচ তারা তার মাধ্যমে কারো কোন ক্ষতি করতে পারত না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর তারা শিখত যা তাদের ক্ষতি করত, তাদের উপকার করত না এবং তারা অবশ্যই জানত যে, যে ব্যক্তি তা ক্রয় করবে, আখিরাতে তার কোন অংশ থাকবে না। আর তা নিশ্চিতরূপে কতই-না মন্দ, যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে। যদি তারা জানত।”

অতএব যারাই এইসব করে তাদের আর ঈমানের অস্তিত্ব থাকেনা। আজ উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষই কুফরি কালামে লিপ্ত।

৮) ইসলামের বিপক্ষে কাফিরদের সাহায্য করাঃ

কোনো ঈামানের দাবিদার যদি ইসলামের বিপক্ষে কাফির মুশরিকদের সাহায্য সহযোগিতা করে তাহলে তার ঈমান চলে যাবে।

আল্লাহ্ সূরা আত তাওবাহ্ ২৩ নং আয়াতে বলেন,

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরীকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম। ”

অন্য আয়াতে বলেন,

“তোমাদের মধ্যে যে তাদের (বিধর্মীদের) সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ তা‘আলা যালিমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না ” (মায়েদাহ ৫১)।

অতএব কখনোই বিধর্মীদের আন্তরিকভাবে বন্ধু করা যাবে না যতটুকু দুনিয়ায় প্রয়োজন। সেইসাথে যারা ইসলামের বিপক্ষে বা কোনো মুসলিমের বিপক্ষে বিধর্মীদের সাহায্য সহযোগিতা করবে তাদের ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।

৯) কাউকে দ্বীন ইসলাম এবং শরীয়তের ঊর্ধ্বে মনে করাঃ

কেউ যদি রাসুলুল্লাহ সাঃএর আনীত শরীয়তের বিধি বিধান মানার চাইতে অন্য কোনো পীর বুজুর্গের দেওয়া (শরীয়ত বহির্ভূত) কাজ করে বা করাকে জায়েজ মনে করে তাহ‌লে তাঁর ঈমান থাকবে না। কেননা শরীয়তের ঊর্ধ্বে কেউ নেই। ইসলামে যা কিছু চলবে সবই রাসুলুল্লাহর নির্দেশ এবং সম্মতিতে।

এখন কেউ যদি পীর অলি আউলিয়াকে শরীয়তের উৎস ধরে (স্বপ্নের বার্তা, কাশফ) সেইমতো বিভিন্ন বিধি বিধান চালু এবং পালন করে তাহ‌লে তার ঈমান থাকবে না। কেননা ইসলামে একমাত্র অনুসরণ হচ্ছে রাসুলুল্লাহ।

আল্লাহ্ বলেন,

“(হে রাসুল! আপনি) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর; তাহলেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল দয়ালু।” (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৩১)

অন্য আয়াতে আল্লাহ্ আরো বলেন,

“তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের(শরীয়ত বহির্ভূত কারোর) অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর”। ( আল আরাফ : ৩)

অর্থাৎ আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাইলে একমাত্র রাসুলের অনুসরণ করতে হবে। রাসুলের প্রদর্শিত পথ ছাড়া অন্য কারো অনুসরণ করা যাবে না।

১০) শরীয়তের বিধিবিধানে কম বেশী বা নতুনত্ব সৃষ্টি করাঃ

কেউ যদি মনে করে আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রাসুল কতৃক আনীত ইসলামের বিধানে নতুন করে কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করলে ভালো হবে। অথবা কেউ যদি রাসুলুল্লাহর দেওয়া শরীয়তের নির্ধারিত বিধি বিধানে (ঈমান, আকিদা, আমলে) কম বেশী বা নতুনত্ব ( বিদআত) সৃষ্টি করে বা জায়েজ মনে করে এবং সেইমতো আমলেও করে তাহলে তার ঈমান চলে যাবে।

নতুনত্ব আনা বা বাদ দেওয়ার মধ্যে তারা রাসুলুল্লাহ রিসালাতকে অস্বীকার করে। এর দ্বারা আল্লাহ্ যে তাঁর রাসুল সাঃ দ্বারা ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেটা মিথ্যা হয়ে যাওয়া। অথচ আল্লাহ্ বলেন,

‘যে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সব মুসলমানের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিকে সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান’ (নিসা ১১৫)।

এটা দ্বারা সুস্পষ্ট যে কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি মানুষকে একমাত্র রাসুলুল্লাহ সাঃএর অনুসরণে দ্বীন ইসলামে জীবনযাপন করতে হবে।

কেননা আল্লাহ্ বলেন,

” আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম” (সূরা মায়িদা ৫ : ৩)।

১১) ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্ম তালাশঃ

কেউ যদি আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে ছেড়ে অন্য কোনো ধর্ম তালাশ করে তাদেরও ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।

আল্লাহ্ বলেন,
“যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্মকে গ্রহণ করবে তার কোন আমল গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে”। (আলে ইমরান ৮৫)।

অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম ছাড়া আর কোনো ধর্মই আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্য নয়। সুতরাং ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম কেউ পালন করলে তাকে অবশ্যই জাহান্নামের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।

১২) দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াঃ

কেউ যদি দ্বীন ইসলামের বিধি বিধান বা আমল সমূহকে বোঝা মনে করে তা থেকে বিরত থাকে তাহলে তার ঈমান থাকবে না।

আল্লাহ্ বলেন,

“আর তার চেয়ে বড় যালিম আর কে, যাকে স্বীয় রবের আয়াতসমূহের মাধ্যমে উপদেশ দেয়ার পর তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নিশ্চয় আমি অপরাধীদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকারী।।[ আস সেজদাহ্‌ :২২ ]

অর্থাৎ যেসব ঈমাদারদের আল্লাহর বিভিন্ন বিষয়ের উপর ঈমান এবং আমল করতে বলা হয় তখন তাদের দ্বীনের হুকুম আহকামকে বোঝা মনে করে। তখন তারা দ্বীনের বিভিন্ন বিধি নিষেধ এবং আমল থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখে। এইসব ব্যক্তিদের ঈমান আর অবশিষ্ট থাকে না।

আল্লাহ্ আরো বলেন,

“আমার স্মরণ (ঈমান, আমল, জিকির ) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ (কষ্টে পতিত) হবে এবং আমি তাকে ক্বিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? আমিতো চক্ষুষ্মান ছিলাম। আল্লাহ বলবেন, এমনিভাবে তোমার কাছে আমার আয়াত সমূহ এসেছিল। অতঃপর তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে। তেমনিভাবে আজ তোমাকে ভুলে যাব’ (ত্ব-হা ১২৪-১২৬)।

অতএব দ্বীন ইসলাম থেকে আল্লাহ্ থেকে কেউ যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তার ঈমান বিনষ্ট হবে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী আক্বীদাহ ও তাওহীদ গ্রহণের পর যদি কেউ উপরোল্লিখিত বিষয়গুলিতে নিপতিত হয়, তবে সে ঈমান হারা হবে বা মুরতাদ হয়ে যাবে। তার উপর মুরতাদের হুকুম (মৃত্যুদন্ড) ওয়াজিব হবে। যা কার্যকর করার মালিক হচ্ছেন দেশের সরকার। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এই দন্ড কার্যকর করার অধিকার রাখে না।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

ঋতুস্রাব এবং আমাদের মস্তিষ্ক

মেয়েটির পিরিয়ডের আজ দ্বিতীয় দিন। তার আজকে পায়ে হাঁটার মতো শক্তি নেই, তার ঊরুগুলো পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। মেয়েটি পেটের ব্যথা ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে এবং সেই যন্ত্রণায় মেয়েটি কাঁদছে। মেয়েটি দাঁতের উপরে দাঁত দিয়ে প্রচন্ড ব্যথা সহ্য করে আছে। ফার্মেসি ভর্তি মানুষগুলোর নিথর চোখের মাঝেও গতকাল মেয়েটি যখন সাহস করে ফার্মেসিতে গিয়ে প্যাডের নাম ফিসফিস করে বলছিল, দোকানদার তাকে একটা কালো ব্যাগে প্যাডটি এমনভাবে মুড়িয়ে দিল যেন মেয়েটি এমন কোন কিছু চেয়েছে যা নিষিদ্ধ এবং তা সমাজ বা রাস্ট্রের জন্য ক্ষতিকর এবং মেয়েটিকে সেই প্যাড লুকিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অথচ দেদারসে বিড়ি সিগারেট মাদক প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে।

আজ মেয়েটির সমস্ত শরীরে নেশার মতো করে ব্যথা আঁকড়ে ধরে আছে। এমনকি মেয়েটি আজ তার অফিসে চেয়ারে দু’দন্ড স্থির বসে থাকতে পারেনি।

প্রতি মাসের এই পাঁচ দিনের রুটিনে মেয়েটি কখনো ছুটি নেননি শুয়ে থাকেননি। আজকে তার সহকর্মীরা তার দিকে আঁড় চোখে তাকিয়ে আছে, এবং মাঝে মাঝে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে, অন্যদের সাথে কথা বলে কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই গল্প তোলে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ গতকালের অসমাপ্ত কাজের জন্য মেয়েটিকে যাচ্ছে তাই বলে তিরস্কার করে অথচ মেয়েটি তার সকল কাজেই পারদর্শী কিন্তু গতকাল থেকে সে পিরিয়ডের ব্যাথায় কাতর।

গতকালের অসমাপ্ত কাজগুলো দ্রুত শেষ করে টেবিলে দিতে বলেন অথচ মেয়েটির গত পঁচিশ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা বেমালুম ভুলে যায়। মেয়েটিকে ধমকের সুরে বলে দিলো কাজটা দ্রুত শেষ করার জন্য। মেয়েটির মুখের ফ্যাকাশে, ক্লান্তি আর শরীরের অলসতা-দুর্বলতা চলতেই থাকে। কয়েক দিনের মধ্যে মেয়েটি কোন কাজে মন বসাতে পারেনি। মেয়েটি তার কেবিন ছেড়ে উঠতে পারেনি তার মনে ক্রমশ অস্বস্তির একটা ঢেউ উঠেছিল।
না এটা অন্য কোন উদ্বেগ ছিল না তার পোশাকের পেছনে কোনো ‘দাগ’ ছিলনা উঠতে বসতে মেয়েটি স্বস্তিতেই ছিল কারন আটটি প্যাড যে সে আশি টাকায় কিনেছে। সে এই ভেবে অস্বস্তিতে ছিল যে এখন পর্যন্ত তার পেছনে সেই নোংরা চোখগুলো পড়েছিল এবং কানাকানি করছিল আর হাসছিল।

ওহে পুরুষ! সেই মেয়েটি কি করে তোমার ভাবনায় ? পুরুষগুলো বেমালুম ভুলে যায় তার মায়ের, বোনেরও প্রতিমাসে পিরিয়ড হয় এবং তারাও অসহ্য রকম যন্ত্রণা সহ্য করে। পিরিয়ডের মতো একটা স্বাভাবিক ঘটনাই জানিয়ে দেয় আমাদের মন মানসিকতা কোন পর্যায়ে আছে।

মাসিকের ব্যথা থেকে মেয়েটি শিক্ষা নেয় এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে তাই তাকে নিয়ে হাসবেন না যখন সে এই যন্ত্রণার দ্বারা যন্ত্রণাদায়ক অবস্থায় থাকে কারণ এই ঋতুস্রাবেই কারনেই ‘ভ্রুণ’ তৈরির মাঠ তৈরি হয়।

শবেবরাত এবং আমাদের করণীয় বর্জনীয়

1646229857252

শবেবরাত এবং আমাদের করণীয় বর্জনীয়

পবিত্র “শবেবরাত” যা উপমহাদেশের সুন্নীরা যুগ যুগ ধরে খুব ধুমধামের সাথে পালন করে আসছে। যা পালন করা নিয়ে ইসলামে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। আজ আমরা তথ্য উপাত্তের সাহায্যে জানার চেষ্টা করব শবেবরাত আসলে কী? শবেবরাতের দালিলিক পর্যালোচনা। এই রাতকে ঘিরে আমাদের ভুল গুলো কী এবং আমাদের করনীয় কী?

শবেবরাত কী?

সুফি সুন্নীরা শাবান মাসের পনেরতম রাত্রিকে বলে শবেবরাত। “শবে” ও “বরাত ” এখানে দুটি শব্দ। এই শব্দ দুটি সরাসরি এসেছে ফার্সি তথা ইরান থেকে। ‘শব’ শব্দের এর অর্থ রাত। ” বরাত” শব্দের অর্থ বলা হয় যে “সৌভাগ্য”। দুটো কে মিলিয়ে হচ্ছে সৌভাগ্য রাত বা রজনী। উপমহাদেশের সুফি সুন্নীরা এই রাতকে বিশেষ মর্যাদায় পালন করে। যদিও কুরআন এবং হাদীসে শাবান মাসের কোনো রাতকে সৌভাগ্যের রাত বলে ঘোষণা করা হয়নি। ইসলামে সৌভাগ্যের রাত বলা লাইলাতুল কদরকে। তাই ইসলামে সুফিদের শবেবরাত নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

শবেবরাতের দালিলিক পর্যালোচনাঃ

শবেবরাত নিয়ে বিভিন্ন কিতাবে এবং অসংখ্য জাল, যইফ এবং সনদবিহীন হাদীস রয়েছে। সেইসাথে হাসান হাদীসও রয়েছে। আমরা খুব সংক্ষেপে তা নিয়ে আলোচনা করব।

তিরমিযী হাদীসে একটি হাদীস এসেছে যা মা আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি জানান, এক মধ্য শাবানের রাতে রাসুলুল্লাহ সাঃ কবর যিয়ারত করেছেন। এবং জানান যে, এই রাতে আল্লাহ্ নিকট আসমানে নেমে এসে অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করেন। (দুর্বল হাদীস)

মা আয়েশা রাঃ থেকে অন্য হাদীসে এসেছে, এই রাতে আল্লাহ্ ক্ষমা প্রার্থনাকারীকে ক্ষমা করে এবং রহমত প্রদান করেন। হিংসুকদের তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন। (বাইহাকী তার শুয়াবুল ঈমান কিতাবে বর্ণনা করেছেন। হাদিসটি মুরসাল)

হযরত আলী রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ বলেন, এই রাতে তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় কর এবং সিয়াম পালন কর। কেননা সূর্যাস্তের পরে আল্লাহ্ নিকট আসমানে নেমে আসেন। এবং বলেন, যে আমাকে ডাকবে তাকে আমি সাড়া দিবো। যে প্রার্থনা করবে তাকে দান করা হবে। যে ক্ষমা চাইবে তাকে ক্ষমা করা হবে। (ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী। দুর্বল এবং সহীহ্ হাদিস বিরোধী)

উসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসটি আলী রাঃ হাদিসের অনুরূপ। তবে এখানে এসেছে মুশরিক এবং ব্যবিচারী ব্যতীত সকলের প্রার্থনা কবুল করা হবে। (বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান। দুর্বল হাদিস)

কথিত শবেবরাত নিয়ে হাসান পর্যায়ের হাদীস রয়েছে। আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৩৯০)

উপরোক্ত জাল ও দূর্বল এবং হাসান হাদিস থেকে আমরা পাই, এই দিনের মধ্য রাতে আল্লাহ্ নিকট আসমানে নেমে আসেন। তিনি বান্দার প্রার্থনা কবুল করেন তবে মুশরিক এবং হিংসুকদের ছাড়া।

এইসব হাদিসের কোথাও শবেবরাত নামে কিছুই নেই। যা উপমহাদেশে ভাগ্যরজনী নামে পরিচিত। এই রাতের জন্য স্পেশাল কোনো সালাত নেই। কেননা এই রাতের যে ফজিলতের কথা এসেছে তা অন্যান্য দিনের মতোই। বিশেষকরে আল্লাহ্ প্রতি রাতে নিকট আসমানে নেমে আসেন এবং প্রার্থনা কবুল করেন (বুখারী ও মুসলিম)। সুতরাং যে ব্যক্তি নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে তার জন্য এইদিন কখনোই স্পেশাল নয়।

সেইসাথে এই রাতে যদি স্পেশাল সালাত থাকতো তাহলে তা রাসুলুল্লাহ সাঃ তার স্ত্রীদেরও আদায়ের নির্দেশ দিতেন। কিন্তু কোনো হাদীসেই এমনটা আসেনি। তাহলে এই রাত সম্পর্কে হাদীস থেকে আমরা যা পাচ্ছি তা হলো আল্লাহ্ এই রাতে নিকট আসমানে নেমে এসে প্রার্থনা কবুল করেন যা অন্যান্য রাতের মতো। সেইসাথে তিনি তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করেন।

সুতরাং এই রাতকে ঘিরে নতুন নতুন বিদআতী আমল সৃষ্টি করা অযৌক্তিক। অনেকেই বলে মানুষ এমনিতেই সালাত কালাম করে না। সেখানে এই দিনেও কেন আমরা সালাত আদায়ে নিরুৎসাহিত করি। যেখানে মানুষ এই রাতে খুশি মনেতে সালাত আদায় করতে চায়।

তাদের কাছে জিজ্ঞাস্য হলো, কোনো ব্যক্তি সারাবছর সালাত আদায় না করে বিশেষ বিশেষ রাতে সালাত আদায় করলে কি আল্লাহ্ তাকে মেনে নিবেন? তাও আবার এমন সালাত যা রাসুলুল্লাহ সাঃ থেকে স্বীকৃত এবং যা বিদআত।

সুফি সুন্নীদের শবেবরাতের বিশ্বাসঃ

যারা শবেবরাতের দলিল দেয়, তাদের দলিল বিশ্লেষণে আমরা যা পেয়েছি তার সাথে সুফি সুন্নীরা যে শবেবরাত পালন করে তার কোনো মিল নেই। আসুন দেখি সুফি সুন্নীরা এই রাতে কী বিশ্বাস করে এবং কী কী পালন করে।

১. শবে বরাত মানে ভাগ্য রজনী এই রাতে সবার ভাগ্য নতুন করে লেখা হয়।
২. এই রাতের সকালে দিনে অধিক সওয়াবের আশায় রোজা রাখা।
৩. এই রাতে আল্লাহ সাধারণ ক্ষমা করেন।
৪. এই রাতে বয়স ও রিজিক নির্ধারণ করা হয়।
৫. কবরবাসীকে আলোকিত করতে কবরে মোমবাতি আগরবাতি জ্বালানো।
৬. অধিক সওয়াবের আশায় এই দিনেই বেশি পরিমাণে দান খয়রাত এবং কাঙ্গালী ভোজের আয়োজন করা।

৭. এই রাত লাইলাতুল কদরের চাইতেও বেশি মর্যাদাবান।
৮. এই রাতে বিশেষ মর্যাদায় কবর জিয়ারত এবং সওয়াবের নিয়তে বিভিন্ন মাজারে মাজারে গিয়ে জিয়ারত করা।

৯. এই রাতে নির্দিষ্ট করে মৃতদের নামে বিশেষভাবে দান-খয়রাত করা।
১০. এই রাতে হালুয়া, রুটি ও মাংস পাকানো এবং তা পড়া প্রতিবেশীদের বিলানো।
১১. এই রাতে আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালানো, আলোকসজ্জা এবং আনন্দ উৎসবের মতো পটকা ফুটানো।

১২. এই দিনে সন্ধ্যায় গোসল করে নতুন কাপড় পরে সারারাত নামাজ পড়া সেই সাথে অধিক সওয়াবের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মসজিদে গমন করা।

১৩. এই রাতে সূরা ইয়াসীন তিনবার পাঠ করা। প্রথমবার বয়স বৃদ্ধির জন্য, দ্বিতীয়বার বালা-মসিবত দূর করার জন্য এবং তৃতীয়বার কোন মানুষেরমুখাপেক্ষীর না হওয়ার জন্য।

১৪. এই রাতে বিভিন্ন ধরনের বিদআতী অনুষ্ঠান করা।
১৫. এই রাতে বিধবাদের স্বামীর প্রিয় খাবার পাকিয়ে তার সাথে রুহানী সাক্ষাতের আশা করা।
১৬. গত এক বছরে মৃত মানুষের রুহগুলোর আগের রুহের সাথে জমিনে নেমে আসে।
১৭. এই রাতে সূরা দুখান পাঠকারীর জন্য সারা দিন ৭০ হাজার ফেরেশতা দোয়া করবে মনে করে তা পাঠ করা।
১৮. এই দিনে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে হালুয়া রুটি মুরগি পোলাও রান্না করে পাঠানো।
১৯. এই রাতে জমজমের পানি অন্যান্য দিনের চেয়ে বৃদ্ধি পায় ধারণা করা।
২০. এই রাতে শিয়া-রাফেযীদের মিথ্যা কল্পিত ইমাম মাহদীর জন্ম দিবস পালন করা।
২১. মনে করা হয় এই দিনে ওহুদের যুদ্ধে কাফেররা নবী [সা:]-এর দাঁত মোবারক ভেঙ্গে দিয়েছে।

উপরের উল্লেখিত বিশ্বাস গুলো অঞ্চল ভেধে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। সুতরাং উপরোক্ত বিষয় থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, সুফিরা শবেবরাতের নাম দিয়ে যা করে তা কখনোই কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। সেইসাথে উপরের উল্লেখিত সকল আকিদা ও কর্মকান্ড উভয়ই বিদআত। যা ইসলাম সমর্থন করে না।

উপমহাদেশে শবেবরাত পালনের কারণঃ

শবেবরাত নিয়ে সুস্পষ্ট দলিল না থাকার পরও, অধিকাংশ মানুষ এই রাতে ও দিনে অতিরিক্ত বিদআতী আমল ইবাদত করতে উৎসাহী। বিশেষ করে সুফি সুন্নীরা। যাদের শরীয়তের ইবাদতের প্রতি অনীহা । যাদের ঈমান আকিদা কখনোই রাসুলের ত্বরিকায় নয়।

সুফি সুন্নীরা এই দিনকে ইবাদতের বিশেষ দিন মনে করে। যারা সারাবছর পীর আউলিয়ার দরবারে খানকায় পড়ে থেকে জীবিত মৃত পিতামাতার খবর নেয় না। মাতাপিতার জন্য সালাত দোয়া নেই। কবর যিয়ারত নেই, দান সদকা ইত্যাদি কিছুই নেই। এই একদিনে সব করে সারাবছর করার সুযোগ নিতে চায়।

সেইসাথে সুফি সুন্নীরা হলো খুব উৎসব প্রিয়। তাদের সারা বছরই হাজার পীরের ওরস লেগে থাকে। তাই তারা শবেবরাতকে ঘিরে মসজিদ, কবরে, মাজারে ঘরে বাইরে নানারকম আলোকসজ্জা, বাজি, পটকা, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে। প্রতিটি দরবার খানকায় ব্যাপক আয়োজন হয়। যাতে দরবার গুলো হাদিয়া তোফা নজর মানতে আর্থিক লাভবান হতে পারে। এটা হিন্দুদের দীপাবলির মুসলিম সংস্করণ। যেহেতু আমাদের পূর্বপুরুষ সনাতন ধর্মীয় ছিলেন, সেহেতু এটা আমাদের জন্য খুবই সহজ হয়েছে ইসলামে প্রবেশ করার।

এছাড়াও উপমহাদেশের মুসলমানরা ভোজনপ্রিয় জাতি। কোনো না কোন উদ্দেশ্যে পেলেই আমরা খাওয়ায় মেতে উঠি। তাই এই রাতের দোহাই দিয়ে সবাই ব্যাপক খানাপিনার আয়োজন করে। যা পরবর্তীতে সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে এখনো চলমান।

উপমহাদেশে শবেবরাতের প্রভাবের আরেকটি কারণ হলো, শিয়াদের প্রভাব। রাজনৈতিকভাবে উপমহাদেশে শিয়াদের ব্যাপক প্রভাবে সুফি সুন্নীদের আকিদায় শিয়াদের আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। শিয়ারা শবেবরাত পালন করে তাদের ঈমাম মাহাদীর জন্মদিন উপলক্ষে। যা তারা কৌশলে সুফি সুন্নীদের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।

উপমহাদেশে শবেবরাত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কারণ হলো কুরআন হাদিসের জ্ঞান না থাকা। অতীত থেকেই সুফি দরবেশ দ্বারা সুফিবাদী ইসলাম প্রচার প্রসার হওয়ার কারণে এই অঞ্চল কুরআন হাদিসের সঠিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। ফলে অধিকাংশ পূর্বপুরুষদের অনুসরণে এখানে সঠিক ইসলামের প্রচার প্রসারতা লাভ করেনি।

শবেবরাতে যা বর্জনীয় করণীয়ঃ

ইসলামে শবেবরাত না থাকলেও মধ্য শাবানের কথা এসেছে। সুতরাং শবেবরাতের নামে সুফি সুন্নীরা যা করছে এবং তাদের অনুসরণে অধিকাংশ মুসলমান যা করে তা সম্পূর্ণ বর্জন করতে হবে। পূর্বপুরুষদের সকল রীতিনীতি বাদ দিতে হবে।

সেইসাথে ইসলামের নিয়মিত আমল ইবাদতের পাশাপাশি এই রাতেও নফল ইবাদত ও নফল সিয়াম পালনে কোনো বাঁধা নেই। তবে সারাবছর ইবাদত বন্দেগী না করে এক রাতের ইবাদত কখনোই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেন না। তাই ইবাদত বন্দেগী ছাড়া উপরের উল্লেখিত বাদবাকি সকল বিদআতী কর্মকাণ্ডকে বর্জন করতে হবে।

শেষকথাঃ

উপরোক্ত সকল তথ্য প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত যে, শবেবরাত নামে বা সমর্থনে কোনো কিছুই কুরআন হাদীসে নেই। বিশেষ করে এই রাত সৌভাগ্যের রাত। এই রাতে মানুষের হায়াৎ, মউত, রিজিক, ধন, দৌলত ইত্যাদি বন্টন করা হয় মনে করা।

এই রাতে যা করার নির্দেশ এবং ফজিলতের কথা সুফি সুন্নীদের দলিলে এসেছে, তা কখনোই এক দিন বা এক রাতের জন্য নয়। একই নির্দেশ এবং ফজিলত অসংখ্য সহীহ্ দ্বারা প্রতিটি রাতের জন্যও প্রমাণিত। সুতরাং এই রাতে সালাত সিয়ামে কোনো সমস্যা নেই। তবে শুধু এই রাতকেই ফজিলত মনে করে বছরের বাকি দিনগুলিতে ইবাদতের ধারেকাছে না থাকা হচ্ছে গোমরাহী।

সুতরাং আসুন আগে চেষ্টা করি ফরজ সালাত প্রতিনিয়ত আদায় করার। সেইসাথে শুধু এই রাত বরং সারাবছর যতটুকু সম্ভব তাহাজ্জুদের সালাত নিজ ঘরে আদায় করার। নিজ আত্মীয় স্বজনদের কবরে গিয়ে তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করার। সিয়াম পালনের উদ্দেশ্যে প্রতি মাসের চাঁদের ১৪,১৫,১৬ তারিখে সিয়াম পালন করা। যা সহীহ্ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। ইনশাআল্লাহ পরম করুণাময় অবশ্যই আমাদের ক্ষমা এবং রহমত দান করবেন।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২ মার্চ, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

মানুষ হওন, অনন্য মানুষ …

মানুষের ঘরে জন্মেছি বলে মানুষ!
কুকুরের ঘরে জন্মালে কুকুর হতাম; আল্লাহতাহলা তো পৃথিবীর সকল রুহ একিই সাথে সৃষ্টি করেছিলেন। এটা তো আমাদের সৌভাগ্য আমরা মানুষ হয়ে জন্মেছি।
হ্যাঁ তার মধ্য বেশ কিছু মহা সৌভাগ্যবান আর কিছু হতভাগ্য ভাগ করে দিয়েছেন।
কেউ কালো কেউ সাদা
কেউ সুন্দর কেউ কুৎসিত
কেই পরিপূর্ণ কেউবা বিকলাঙ্গ; আবার কেউ জন্মেই সোনার চামচ মুখে পেয়েছেন
আর কেউ কিছুই না! কিন্তু সর্বোপরি সবাই মানুষ
আল্লাহর চোখে সবিই সুন্দর সবিই সমান, তিনি যাকে যেমন খুশি সৃষ্টি করেছেন, যাকে খুশি সম্মানিত করেছেন; যাকে ইচ্ছে বে হিসেব রিজিক দিয়েছেন।
আপনি সুন্দর
রূপসী, ধনী, কিংবা আপনার অনেক ক্ষমতা
অথবা আপনি অনেক জ্ঞানী, অনেক কিছু বুঝেন। চোখের ইশারায় অন্যকে বশ করে ফেলেন
যাকে ইচ্ছা আপনা যাকে ইচ্ছা পর করে দেন।
ইচ্ছে করলে বুকে তুলে নেন
আবার ইচ্ছা করলে লাথি মেরে ছুড়ে ফেলছেন;
আপনি যা বলছেন তা সবার উপরে, তার উপরে কিছু থাকলে সেটা মিথ্যা বলে নাক কুঁচকাচ্ছেন।
নিজেকে বিশাল শক্তি ধর
কিংবা অশেষ ক্ষমতাবান মনে করে এই যে আপনিও যাচ্ছে তা করে যাচ্ছেন, আপনি কি জানেন?
আপনার এই দাম্ভিকতায় এই অহমিকায় কত প্রাণ নিঃস্ব হচ্ছে?
জানেন যদিও
তবু না জানার ভান করছেন। উল্টা উপহাস করছেন তার নিঃস্বতা নিয়ে।
কেন আপনার এত ক্ষমতা এতো দাম্ভিকতা?
আল্লাহ আপনাকে সব দিয়েছেন বলেই? না কি আপনি আল্লাহ কে অস্বীকার করবেন?
করতেই পারেন!
কিন্তু নিজেকে মানুষ দাবী করা যাবেনা আর
হয় নিজেকে খোদা ঘোষণা করতে হবে নাইলে এক আল্লাহর দেয়া ক্ষমতা রিজিক আর রূপ গুনের শোকরিয়া আদায় করতে হবে।
এই শোকরিয়া আবার মুখে বলে আদায় করলে হবেনা
হয়না
শোকরিয়া আদায়ের জন্য আপনাকে কাজ করতে হবে, বিনয়ী আর প্রেমময় হতে হবে। আরেক জন কে
শোকরিয়ার রাস্তায় আনার চেষ্টা করতে হবে।
কারণ আপনি ধনী বলে মানুষ
আমি হত দরিদ্র বলে অমানুষ না।
আপনি আরাম আয়েশের জীবন ভোগ করছেন বলে অন্যের কষ্ট, অন্যের অভাব, দুঃখ, কিংবা অন্যের মন বুঝতে না পারলে আপনার কোন দোষ নাই
কিন্তু আপনি যখন সব বুঝার ভান করেন আর সত্য অস্বীকার করেন, মিথ্যাকে চাপিয়ে দেন তখন আপনার মনে রাখা উচিত আপনি যার সাথে এসব করছেন সেও মানুষ।
তারও জীবন আছে
ঈমান আছে
ধর্ম আছে
মন আছে
তারও স্বপ্ন আছে
আছে কোন না কোন আদর্শ।
আপনি জান না হয়তো-
আপনি যে বিষয় টা কে জুতার ধুলো মনে করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছেন।
অন্যের কাছে সেই ধুলো পাক মাটির আশীর্বাদ।
আপনি কিছুই ভাবছেন না
ভাবতে হচ্ছে না
কারণ আপনার আছে, অনেক আছে
কিন্তু যার বালির প্রাসাদ ভেঙ্গে দিলেন তার হয়তো কার কিছুই ছিলো না
সেই বালির প্রাসাদই তার কাছে শ্রেষ্ঠ সম্বল হয়তো।
হতে পারে জীবন আপনার কাছে ফেসবুকের স্ট্যাটাস এর মত। যখন খুশি পোষ্ট দিলেন আবার ডিলিট করে ফেল্লেন।
আর সব কিছুর মত আপনি আপনার কর্ম কে সেরা মনে করছেন
ঠিক আছে
কিন্তু অন্যের টা নগণ্য ভাবছেন কেন?
এসব অহমিকায় গড়া মানুষ আমরা-
নিজে হাসি বলে অন্যের কান্না কে উপহাস করতে পছন্দ করি।
কিন্তু আমরা জানি না সে কান্নাই তার সুখ।
তার আনন্দ।
তার বেঁচে থাকা!!

স্রষ্টা আমাদের অন্য সব সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করেন নি, আমাদের মেধা দিয়েছেন ভাল মন্দ বাছ বিচারের জন্য বিবেক দিয়েছেন।
অন্যের সুখে সুখী
অন্যের দুঃখে দুঃখী হবার জন্য একটা মন দিয়েছেন
এই মন টাই আমাদের চালিকা শক্তি
আর ব্রেন বা মেধা হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু, যার ধর্ম হচ্ছে মালিকের জন্য মালিকের মঙ্গলের জন্য কাজ করা।
কিন্তু তার জন্য আমাদের মেধাকে কাজে লাগানো শিখতে হবে
মেধাকে ভালো ভালো চিন্তা দিতে হবে কাজ দিতে হবে, যে যতো বেশী ভালো চিন্তা ইতিবাচক চিন্তা করবে মেধা ততো বেশী মঙ্গলজনক কাজ করবে।
আর সে ততো বেশী সফল হবে!
আমাদের জাতীয় অধ্যাপক আবদুল্লা আবু সাঈদের একটি চমৎকার উকি আছে, তিনি বলেন “মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়”
এই স্বপ্ন নির্মাণে আমাদের মন আর মেধার সঠিক সমন্বয় করতে হবে।
মেধা মননে অনন্য হতে পারলেই একজন মানুষ নিজেকে অনন্য মানুষের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
আর একজন অনন্য মানুষ একটি সমাজের জন্য, জাতির জন্য, দেশ তথা সমগ্র সৃষ্টিকুলের জন্য আশীর্বাদ।।

সুতরাং মানুষ হওন। অনন্য মানুষ।।

দাউদুল ইসলাম

মানুষের মর্যাদা কিসে?

মানুষের মর্যাদা কিসেমানুষ ভয়হীন, অশান্তিহীন, নিরাপদ সমাজে বাস করতে চায়। আসলে চূড়ান্ত সুখ-শান্তি (Ultimate happiness and peace) এখানে সম্ভব নয়। পরিপূর্ণ সুখ হলো জান্নাতে। এখানে অর্থাৎ পৃথিবী হলো মর্যাদা অর্জনের প্রতিযোগিতার স্থান, পরীক্ষাস্থল। মর্যাদা কীসে?
.
মর্যাদা হলো আত্মার সংর্ঘষে। আপনি যত বেশি সংর্ঘষে লিপ্ত হবেন তত বেশি মর্যাদাবান হবেন। যত বেশি নির্বিবাদী জীবনযাপন করবেন তত কম মর্যাদাবান হবেন।
.
এটা দু’রকমের হতে পারে। একটা হলো ইচ্ছা করে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হওয়া, এটার আমি বিরোধিতা করি। ইচ্ছা করে আত্মাকে সংর্ঘষে নেয়ার দরকার নেই। ইচ্ছা করে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া নিষেধ, আল্লাহর নীতিমালা পরিপন্থী। বরং কোরআনে আল্লাহ পরীক্ষা থেকে পানাহ চাওয়ার, ক্ষমা চাওয়ার দোয়া দিয়েছেন।
.
আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহের মাঝেই যে পর্বগুলো আসে সেগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। এটাই যথেষ্ট আপনার মর্যাদা অর্জনের জন্য। টেনে টেনে বিপদ ডেকে আনার দরকার নাই।
.
প্রশ্ন হলো- সমস্যা নিবেন কি নিবেন না, মোকাবিলা করবেন কি করবেন না। প্রকৃতপক্ষে মোকাবেলা আপনাকে করতেই হবে। কারণ সময় এবং ঘটনা দুইটা একসঙ্গে লাগানো। সময় এবং ঘটনা দু’টি নিয়েই সৃষ্টি। সময় অতিবাহিত হচ্ছে মানেই ঘটনা ঘটবে। কারো জীবনই সরলরেখায় পথ চলবে না।
.
জীবনে উত্থান-পতন থাকবেই। তিতা-মিঠা, রাত-দিন, আলো-আধাঁর, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সব মিলিয়েই জীবন। এর মাঝে থেকে সে আত্মাই বেশি মর্যাদাবান হবে যে আত্মা ক্রমাগতভাবে আসা সংঘাতগুলোকে সবরের সাথে মোকাবেলা করেছে। সংঘাতে না জড়ানো পর্যন্ত আত্মা মর্যাদা লাভ করবে না। পরীক্ষাটা হলো এখানেই। পরীক্ষা দিবেন কি না দিবেন সে ব্যাপারে জোরাজুরি নেই, আপনি স্বাধীন। কিন্তু পরীক্ষা না দিয়ে মর্যাদা লাভ হবে না।
.
যেই না আপনার সামনে কোনো সংকট আসলো সংকটের মোকাবেলা করলে আপনি মর্যাদাবান হবেন। সময় ও ঘটনা স্বাভাবিক গতিতেই চলতে থাকবে। অতিক্রান্ত সময় ও অতিক্রান্ত ঘটনা শত চেষ্টা করলেও আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। এটা একেবারে নির্ধারিত, হবেই হবে, এরই নাম ‘কদর’। সূর্য উঠছে, ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে, ১টা, ২টা, ৩টা আর থামবেনা চলবেই। ঘটনাও ঘটবেই।
.
কাজেই যে কোনো ঘটনাতেই হইচই করার বা হতাশ হবার কারণ নেই। আল্লাহর নির্দেশনা মতো সবর করেন, আপনি মর্যাদাবান হবেন। আর যে ব্যক্তি সবর করতে পারে নি, সে মর্যাদাও লাভ করতে পারে নি। এক সময় হয়তো দেখা গেল যে, ঘটনাও নেই, সময়ও নেই, মর্যাদাবান হবার সুযোগও নেই। অর্থাৎ প্রত্যেক ঘটনা, প্রত্যেক সময় প্রত্যেক মো’মেন বান্দার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সুযোগ।
.
এই হলো মানুষের মর্যাদার সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। সে দৃষ্টিতে মো’মেনদের কোনো ঘটনাই হতাশার নয়, দুঃখের নয়, কষ্টের নয়। যদিও আপনার দুই হাতের কামাই আর কদর, দুটো মিলিয়ে ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আপনার এ কামাইটাকে আপনি পরবর্তীতে সুখময় করতে পারবেন এখনকার সবরের কারণে।
.
হেযবুত তওহীদের পথ চলায় বহু ঘটনা ঘটছে এবং একইসাথে সময়ও চলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে কেউ মর্যাদায় উপরে উঠে যাচ্ছে, কেউ নিচে নেমে যাচ্ছে। এই যে সময়টা, এটা কিন্তু প্রত্যেকেই ব্যয় করছে। কেউ সেটাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছে কেউ পারছে না।
.
যারা এ সময়ের প্রত্যেকটি ঘটনাকে মোকাবেলা করে চলেছে, সংঘাত থেকে পলায়ন করে নি, তারা ক্রমাগত মর্যাদার সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। আর যারা সংঘাত থেকে পলায়নপর হয়েছে তারা মানব ইতিহাসের অনেক বড় সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেছে।
.
সুতরাং বোঝা গেল, মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় সংঘাতে। ভাল-মন্দের সংঘাত, ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত, গ্রহণ-বর্জনের সংঘাত। কাজেই সংঘাতপূর্ণ কাজ, অপ্রত্যাশিত কাজ, কষ্টের কাজ মো’মেনের জন্য দুঃখের নয়, এটা মর্যাদা বৃদ্ধির একটা উপায়।
.
সংঘাত কীভাবে মর্যাদা বৃদ্ধি করে? একটি উদাহরণ দেই। একজন দাবি করল- সে লোভী নয়। অর্থ-সম্পদের উপর তার কোনো লোভ নেই। এখন তার নির্লোভিতার কোনো পরীক্ষা না দিয়েই কি সে মর্যাদাবান হতে পারবে? না, পরীক্ষা তাকে দিতেই হবে। কারণ তার আত্মা তখনও সংঘাতে জড়ায় নি। যত ভালো ছাত্রই হোক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে সার্টিফিকেট পায় না।
.
ধরা যাক, জনগণের এক লক্ষ টাকা ওই নির্লোভ ব্যক্তির কাছে আমানত রাখা হলো। শুরু হলো তার সংঘাতের পালা, অর্থাৎ পরীক্ষা। এখন বোঝা যাবে সে লোভী না নির্লোভ। আবার যদি সে জনগণের ওই টাকা আমানত হিসেবে রাখতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে তার মানে সে মুত্তাকী বটে, কিন্তু আল্লাহ সংঘাত বা পরীক্ষা থেকে পলায়নমুখী মুত্তাকীকে পছন্দ করেন না।
.
আর যদি সে অন্তরের লোভকে দমন করে শেষ পর্যন্ত যথাযথভাবে সেই আমানত রক্ষা করতে পারে তাহলে ওই এক লক্ষ টাকা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিল। সে ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠিতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো। সময়ের নিরন্তর প্রবাহে একটি ঘটনাকে সে তার মর্যাদা বৃদ্ধির সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারল। কিন্তু যদি সে এই ঘটনা থেকে পলায়ন করত, তাতে তার মর্যাদা বাড়ত না, আর যদি পরীক্ষায় ব্যর্থ হতো তাহলে মর্যাদাহানি ঘটত।
.
সংঘর্ষ থেকে পলায়নমুখী সবসময় কাপুরুষ। তার দ্বারা না নিজের উপকার হবে, না মানবজাতির উপকার হবে। যারা বলে বেশি সম্পত্তির দরকার নাই, বেশি সম্পত্তি হলে বিপদ, সংঘাত, পরীক্ষা; সে হলো কাপুরুষ। অবশ্যই সম্পদ দরকার আছে। নিজের জন্য দরকার নেই তো কী হয়েছে, মানবতার কল্যাণের জন্য সম্পদ দরকার আছে।
.
সুতরাং মানুষের জীবন প্রবাহ যে কত মূল্যবান, কত অর্থবহ, তা কল্পনাও করা যায় না। এ জীবনপ্রবাহ পাওয়া বিশাল এক ভাগ্যের ব্যাপার। কোটি কোটি টাকার বিনিময়েও এ জীবনপ্রবাহ পাওয়া যাবে না। এ জীবনকে কি আপনি অভিশাপ হিসেবে নিয়েছেন? মরে গেলে ভাল হতো এমন ভাবছেন? তাহলে আপনি জীবনের অর্থই বুঝেন নি।
.
জীবনের বিশাল অর্থ। হাশরের দিন দেখবেন কত মর্যাদা। প্রকৃত মো’মেনরা সংঘাত দেখলে পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারণ ওখানেই মরতবা, মর্যাদা। যারা আধ্যাত্মিক সাধনা করে, হুজরা খানকার বাইরে বের হয় না, তার চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকে, পৃথিবীর যাবতীয় সংঘাত, সংঘর্ষ থেকে গা বাঁচিয়ে থাকে তাদের তো আত্মাই নাই। তাদের আত্মা মরে গেছে।
.
যে আত্মা ক্রমাগত ন্যায়-অন্যায়ের সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে আসছে এবং তার মোকাবেলা করছে সে আত্মাই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মা। মাহাত্মটাই হলো সংঘাতমুখী, জীবনটা নির্ধারিত হয়েছে সংঘাতের দিকে, মর্যাদা নির্ধারিত সংঘাতের মধ্যে, অথচ তারা সেখানে যায়ই নি। যত বেশি ছাত্র তত বেশি প্রতিযোগিতা। সেখানে ভাল করলে মর্যাদাও বেশি। যে ক্লাসে একজন মাত্র ছাত্র পড়ে, তাতে রোল নং এক হওয়ায় কোনো মর্যাদা আছে কি?
.
প্রতিযোগিতা যত কঠিন হবে ততই আপনার মর্যাদা বাড়বে। পৃথিবীতে যত বিকৃত সুফীবাদ আছে কখনই তা প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা নয়। প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা হলো মো’মেনদের জীবনে যেটা ঘটে। দুনিয়াতে লোভ, কাম, ক্রোধ, ঈর্ষা, অহংকার যা আছে এগুলোর কেন্দ্রে দু’টি বিষয়। জান ও মাল এ দু’টোই যখন মো’মেনরা আল্লাহর রাস্তায় অর্থাৎ মানবতার কল্যাণে অন্য মানুষের শান্তির জন্য বিলিয়ে দেবে তখন তার মর্যাদা কত উপরে উঠে যাবে কল্পনাও করা যায় না।
.
আমাদের পারিবারিক সংকট আসলে, ব্যক্তিগত সংকট আসলে আমরা মুষড়ে পড়ি। এটা ঠিক না। সংকট আসলো মানে মর্যাদা বাড়ার একটা সুযোগ তৈরি হলো। এটা বিরাট একটা সুযোগ। এগুলো মোকাবেলা করব সব আল্লাহর হুকুম মোতাবেক। এই মাপকাঠি (standard) নির্দিষ্ট করে দেয়ার জন্যই নবী-রসুলগণের আগমন ঘটেছিল। কারণ মাপকাঠি লাগবে। কতটুকু পর্যন্ত কাজ করবে, কতটুকু পর্যন্ত যাওয়া যাবে, এগুলোর মাপকাঠি।

ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন বর্তমান প্রেক্ষাপট ও আমাদের দায়

“আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে — কিছুই কি নেই বাকি?’
একটুকু রইলেম চুপ করে; তারপর বললেম, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।’
উপরোক্ত কবিতাটি কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত “হঠাৎ দেখা” কবিতার কিয়দংশ। এখানে বলে রাখা ভালো এই কবিতার বিষয়বস্তু হঠাৎ দেখা সাবেক প্রেমিকার সাথে প্রেমিকের কিছুটা নস্টালজিক, কিছুটা মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা পুরনো প্রেমের হঠাৎ আলোড়ন।

এবার আসি মূল বিষয়ে, বর্তমান বাজারে ব্যাপক আলোচিত বিষয়, বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা আন্দোলন। আবরার এক টগবগে তরুণ। অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে বুয়েটের মত প্রতিষ্ঠানে এসেছিল পড়াশোনা করে ইঞ্জিনিয়ার হবে বলে। কিন্তু হঠাৎ অমানিশার মত এক কাল বৈশাখী ঝড়ে যেন সব এলোমেলো। কিন্তু এই ঝড় কেন এলো? যারা আবরারকে নৃশংসভাবে মারল তারাও তো মেধাবী? তারাও সেই একই স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল বুয়েটে। ইঞ্জিনিয়ার হবে। দেশের প্রয়োজনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে হয়তো নব উদ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সামনের দিকে। তাহলে কেন ওরা খুনি হল? এর দায় কি শুধুই খুনিদের? আপাত দৃষ্টিতে বলা যায় খুনিদের কিন্তু, সামগ্রিক অর্থে এ দায় খুনিদের একার নয়। এ দায় আমাদের এই নষ্ট সমাজকেও নিতে হবে। নিতে হবে রাজনীতির নামে যারা অপরাজনীতি করে আসছে তাদেরও। এমন না যে বুয়েটে এই প্রথম কোন ছাত্রকে মারা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগেও বহু ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে।

“স্বাধীনতার পর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৫১ জন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৪ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ২ জন করে, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং হজরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন করে শিক্ষার্থী খুন হন।”
১৯৭৪-২০১৯ লাশ ও খুনি তৈরি করা ছাত্ররাজনীতি
“সোহরাব হাসান” প্রথম আলো।”

“১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল সূর্য সেন হলের ৬৩৫ নম্বর কক্ষ থেকে ছাত্রলীগের নেতা কোহিনুরসহ চারজনকে ‘হ্যান্ডস আপ’ করিয়ে নিয়ে আসেন মুহসীন হলের টিভিরুমের সামনে। অস্ত্রধারীদের আরেকটি দল ৬৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে আরও তিনজনকে একই কায়দায় সেখানে নিয়ে আসেন। রাত ২টা ১১ মিনিটে ওই সাতজন ছাত্রকে লক্ষ্য করে ‘ব্রাশফায়ার’ করেন তাঁরা। এরপর অস্ত্রধারীরা ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।”
১৯৭৪-২০১৯ লাশ ও খুনি তৈরি করা ছাত্ররাজনীতি
“সোহরাব হাসান” প্রথম আলো।”

“মুহসীন হলে যাঁরা খুন হলেন এবং যাঁরা খুন করলেন, তাঁরা সবাই ছাত্রলীগের। নিহত শিক্ষার্থীরা আওয়ামী যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির সমর্থক ছিলেন। প্রতিপক্ষ গ্রুপের উসকানিতে শফিউল আলম প্রধান এ কাজ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। পরদিন হত্যার বিচারের দাবিতে যে মিছিল হয়, তাতেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিন দিন পর প্রধান গ্রেপ্তার হন। হত্যাকারীদের মধ্যে যাঁরা রাজসাক্ষী হয়েছিলেন, তাঁদের বর্ণনায় উঠে আসে খুনের ভয়ংকর বিবরণ। আওয়ামী লীগ শাসনামলেই মুহসীন হলের সাত হত্যার বিচার হয়। বিচারে প্রধানের যাবজ্জীবন শাস্তি হয়। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাঁকে ১৯৭৮ সালে মুক্তি দিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিতে মাঠে নামান। এরপর ক্যাম্পাসে শুরু হয় ছাত্রদলের তাণ্ডব। মেধাবী ছাত্রদের জিয়া হিজবুল বাহারে নিয়ে গিয়ে কী তালিম দিয়েছিলেন জানি না। কিন্তু গোলাম ফারুক অভিসহ অনেক মেধাবী ছাত্রই সন্ত্রাসীতে পরিণত হন।”
১৯৭৪-২০১৯ লাশ ও খুনি তৈরি করা ছাত্ররাজনীতি
“সোহরাব হাসান” প্রথম আলো।”

একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৭৪ সালে মুহসিন হলে যে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার তার বিচার করেছিল এবং তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সফিউল আলম প্রধানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রধান করেছিল, কিন্তু ৭৫ পটপরিবর্তন প্রধানকে জেল থেকে জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে মুক্তি দিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিতে মাঠে নামান। সেই থেকে শুরু ছাত্ররাজনীতির কাল মেঘের ঘনঘটা। কিন্তু ইতিহাস তো বলে ছাত্রদের পক্ষে। বাংলাদেশের ইতিহাস তো প্রকারন্তরে ছাত্রদেরই গৌরবের ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু ৫৪ যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯ আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন, ৭০ নির্বাচন ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ মধ্য দিয়ে রক্তক্ষয়ী তুমুল গণযুদ্ধের আজকের বাংলাদেশ। ৯০ স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দ্বিতীয় জীবন লাভ করেছিল। ২০১৩ শাহবাগের উত্তাল গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন এ সবই সম্ভব হয়েছিল ছাত্রদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এই যে সোনালি ইতিহাস, এ ইতিহাস আপনি অস্বীকার করবেন কি করে? ইতিহাসকে অস্বীকার করা যায় না।

আর যদি কেউ করেও থাকে তাকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হয়। আজকে আবরার ইস্যুকে কেন্দ্র করে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের একটি হুজুগে দাবী উঠেছে। হুজুগে বললাম এই কারণেই, মাথা ব্যথা হলে মাথা কাটতে হবে কেন? সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধান করাই মুখ্য কাজ। আর এটা করতে হবে জাতীয় নেতৃত্বকেই। কেননা এর দায় তারা এড়াতে পারে না। আজ যারা জাতীয় নেতা তাঁরাই একদিন ছাত্রনেতা ছিল। সাবেক রাষ্ট্রপতি এডভোকেট জিল্লুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজুলুল হক মণি, কমরেড ফরহাদ, আ,স,ম আবুর রব, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, আব্দুল কুদ্দুস মাখান, শাহজান সিরাজ, নুরে আলম সিদ্দিকী, কাজী আরেফ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ছাত্ররাজনীতি করেই আজ তাঁরা জাতীয় রাজনীতির পাদপ্রদীপে এসেছেন।
একেকজন যেন একটি জ্বলন্ত ইতিহাস।

কিন্তু একটি কথা মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে, তাহলো ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে কেন? এটা কি সামগ্রিক দেশের মানুষের কথা? নাকি যারা রাজনীতির নামে ধর্মকে পুঁজি করি একটি উগ্র মৌলবাদী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে তাদের কথা? প্রগতিশীল মহল থেকে শুরু করে সুস্থ ধারার রাজনীতি যারা করেন তাঁরা অন্তত এটাই মনে করে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে ঐ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীরই লাভ হবে প্রকারন্তরে। তাহলে ক্যাম্পাসে তারা অবাধে বিচরণ করে মৌলবাদী রাজনীতির বীজ বপন করতে পারবে নিরাপদে। সাধারণ মেধাবী ছাত্রদের মগজধোলাই করে দেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার সেই হীন চেষ্টায় স্বাধীনতার পর থেকে বারবার করে আসছে। তাই আজ দাবী তুলেছে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ কোন সমাধান নিয়ে আসবে না। আগেই বলেছি সমস্যার ভিতরে গিয়ে সমাধান করতে হবে।

আগে তো অনেক ছাত্রকে প্রাণ দিতে হয়েছে তাহলে, আবরার হত্যাকে কেন্দ্র করে কেন এই “বিরাজনীতিকরণ”-এর আন্দোলন? কোথায় এমন কোন আন্দোলন তো আগে চোখে পড়েনি, তাহলে শুধু আবরার ইস্যুকে কেন্দ্র করে কেন এই আন্দোলন? ভেবে দেখার সময় এসেছে, কারা ও কেন এই দাবী তুলছে এবং কেন ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করতে চায়।

শুরু করেছিলাম কবি গুরুর কবিতার কিয়দংশ দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের ঐ “হঠাৎ দেখা” কবিতার মতোই বলতে ইচ্ছে করছে, যেদিন গেছে একেবারেই কি গেছে আমাদের? কিছুই কি নেই বাকী? না যায়নি, এখনো অনেক বাকী। আমি নিজে একজন ছাত্র রাজনীতির কর্মী হিসেবে বলছি, ছাত্র রাজনীতির অনেক ইতিবাচক দিক আছে। এবং সেই ইতিবাচক দিকটিই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। যা কিছু অন্যায় তাকে বর্জন করতে হবে। তাহলেই আমরা অতীতের মতোই ছাত্র রাজনীতির সুফল ঘরে তুলতে পারবো। ছাত্র রাজনীতির কল্যাণেই আজকে বঙ্গবন্ধু ও আজকের বাংলাদেশ।

ছাত্র রাজনীতির কল্যাণেই বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের অন্যতম মর্যাদা সম্পন্ন ভাষা। বাংলাদেশের ইতিহাস ছাত্র রাজনীতিরই ইতিহাস। এ ইতিহাসকে আপনি কীভাবে অস্বীকার করবেন?

মননগত পুঁথিগত

স্কুলে শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর ফলে পুঁথিগত বিদ্যাই মননগত বিদ্যাতে পরিণত হবে। শিক্ষার প্রারম্ভ তো পুঁথি দিয়েই শুরু করতে হয়। তাছাড়া পুঁথিতেই সব লেখা আছে। শিক্ষকের হাত ধরে, শিক্ষাগুরুর তত্ত্বাবধানে সেই পুঁথিগত বিদ্যা খুব সহজে মননগত হয়। শুধুমাত্র শিক্ষকদের শিক্ষাদানের মাধ্যমে।
আমি যদি নিজে নিজে কোন বই পড়ি সেটা হল পুঁথিগত বিদ্যা। আর আমাকে যদি কেউ সেই বই অনুসারে বলে বা বুঝিয়ে দেয় সেটা হল মননগত। শিক্ষক যদি শ্রেণিকক্ষে না পড়ায় তাহলেও শিক্ষার্থী পড়ে নিচ্ছে। তাহলে তা হয়ে যাচ্ছে পুঁথিগত বিদ্যা। যেহেতু শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পড়াচ্ছে না তাই এই পুঁথিগত বিদ্যা মননগত হচ্ছে না। এই পুঁথিগত বিদ্যা মননগত করতে না পারলে সমাজের অবক্ষয় অবশ্যম্ভাবী। দায়িত্ব শিক্ষকের।
বোধ জন্মানোর পরে মানুষের জীবনে একটা সময় তো পুঁথি নিজেই শিক্ষক হয়ে যায়। পুঁথিকে সাথে করে কত প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ ব্যক্তি চরিত্রগতভাবে অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে গেছেন। তার মানে পুঁথিই তখন মননগত।
কিন্তু বোধ জন্মানোর আগে শিক্ষক বা শিক্ষাগুরু থাকা দরকার। সেই সাথে শিক্ষা দেওয়াও জরুরী। মননগত শিক্ষা দেওয়া জরুরি।
সেইজন্য সমস্ত অবস্থানে শিক্ষক জরুরী। প্রতিভা যতই থাক, যত বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন হোক সঠিক অবস্থানে, সঠিক দিশায় এবং সঠিক শিক্ষকের হাতে না পড়লে প্রতিভা বিনষ্ট হতে সময় লাগে না। খেলাধূলা, নাচ, গান, আঁকা, আবৃত্তি ইত্যাদি প্রতিভা প্রস্ফুটিত হওয়ার ক্ষেত্রেও শিক্ষক বা শিক্ষাগুরু জরুরী।
এবং সেই শিক্ষা দিতে হবে সঠিক স্থানে। খেলাধূলা শেখাতে হবে খেলার মাঠে, নাচ শেখাতে হবে নাচের ক্লাসে, গান গানের প্রতিষ্ঠানে, আঁকা আঁকার পরিবেশে এবং স্কুলে শ্রেণিকক্ষে। না হলে হবে না। অন্য কোথাও (যেমন টিউশন) ছড়িয়ে ছিটিয়ে শিক্ষা হয়তো নেবে, প্রতিভা বুদবুদের মত হয়তো ফুটে উঠবে কিন্তু মানুষের মত মানুষ হবে না। স্পোর্টম্যান স্পিরিট পাবে না। শেখাকে মননগত করতে পারবে না।

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীজি (দ্বিতীয় পর্ব)

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীজি (দ্বিতীয় পর্ব)
তথ্য-সংগ্রহ ও প্রবন্ধ রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে……

শুরুর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সৈনিকদের চিকিৎসাকেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেন। ভাগ্যের ফেরে গান্ধী একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে দেনা আদায়কারীর চাকুরি পেয়ে যান। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিটিশ এবং ডাচ শাসনাধীন। ভারতীয়রা সংখ্যালঘু হওয়ায় বর্ণ বৈষম্যের শিকার হত। গান্ধী বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এবং সত্যাগ্রহের ধারণা সেখান থেকেই শুরু। যে ঘটনাটি গান্ধীর ভেতরকার নেতৃত্বের আগুনটি জ্বালিয়ে দেয় –

• ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট থাকা সত্ত্বেও তাকে কালো এবং ভারতীয় বলে ফার্স্ট ক্লাস কামরায় বসতে তো দেয়নি বরং বিষয়টি নিয়ে বিবাদ করায় তাকে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়। এই ঘটনাটি গান্ধীর মনে দাগ কেটেছিল।

স্বদেশী আন্দোলনের সময় সকল বিদেশী পণ্য বিশেষত ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা হয়। এর পথ ধরে তিনি সকল ভারতীয়কে ব্রিটিশ পোশাকের বদলে খাদি পরার আহ্বান জানান। তিনি সকল ভারতীয় পুরুষ ও মহিলা, ধনী ও গরিব মানুষকে দৈনিক খাদীর চাকা ঘুরানোর মাধ্যমে স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন করতে বলেন। এটি এমন একটি কৌশল ছিল যা নিয়মানুবর্তিতা ও আত্মত্যাগের অনুশীলনের মাধ্যমে অনিচ্ছা ও উচ্চাকাঙ্খা দূরীকরণের পাশাপাশি আন্দোলনে মহিলাদের যুক্ত করে, এ সময়ে মহিলাদের করা এ সকল কাজকে অসম্মানজনক বলে মনে করা হত।
লবণের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করায় গান্ধী হাজার হাজার ভারতীয়দের সাথে পায়ে হেঁটে ডান্ডির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ইতিহাস একে Salt March বলে থাকে। শুধু মাত্র নিজ হাতে লবণ তৈরির জন্য পায়ে হেঁটে ১২ই মার্চ থেকে ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি পৌছান। এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি প্রায় ২৪১ মাইল। সে সময় ব্রিটিশরাজ সেই অপমানের বদলা নিতে ৬০,০০০ ভারতীয়কে গ্রেপ্তার করে। ৬০,০০০ ভারতীয়!

হাঁটা নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। গান্ধী জীবনে এত হেঁটেছেন যে তাতে পুরো পৃথিবী দুইবার চক্কর দেয়া সম্ভব। অর্থাৎ দিনে প্রায় ১৮ কিলোমিটার করে হাঁটতেন তিনি।

গান্ধী তার জীবদ্দশায় দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতে সব মিলিয়ে ১৩ বার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় সাজার আদেশ পেয়েছিলেন ১৯২২ সালে Young India পত্রিকায় ব্রিটিশ বিরোধী জ্বালাময়ী আর্টিকেল লেখার জন্য তাকে ৬ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয় কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ১৯২৪ সালেই মুক্তি দেয়া হয়।

গান্ধী আমেরিকা যাননি কখনো। তিনি মনে করতেন, তিনি যেহেতু জাতির পিতা (ভারতীয়রা গান্ধীকে বাপু বলে ডাকতেন), জাতির অধিকাংশ মানুষই গরিব, সেই গরিবের পিতা হয়ে তিনি কিভাবে বিমান ভ্রমণ করবেন? দেশ বিদেশে গান্ধীর অনেক ভক্ত তৈরি হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট হেনরি ফোরড ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম গান্ধী যাকে নিজের সাক্ষরযুক্ত একটি চরকা উপহার দিয়েছিলেন।

গান্ধী নিয়মিত তলস্তয়কে চিঠি লিখতেন। হিটলারের সাথেও বেশ চিঠি চালাচালি দেখা গিয়েছিল। যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ করে গান্ধী হিটলারকে একটি চিঠি লিখলেও তা আর হিটলারের কাছে পৌছায়নি। কারণ ব্রিটিশ সরকার এতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন।

আমরা ভালো কাজকে পুরস্কৃত করে থাকি। কিন্তু কিছু কিছু কর্ম থাকে, কিছু কিছু মানুষ থাকেন যারা সকল পুরস্কারের ঊর্ধ্বে, বরং পুরষ্কার তাদের মহৎ কর্মকে খাটো করে। গান্ধী হলেন তেমনি পুরস্কারের ঊর্ধ্বের মানুষ। যাকে নোবেল কমিটি ৫ বার নোবেল মনোনয়ন দিয়েছিল। ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯ এবং ১৯৪৭ সালে মনোনয়ন দিলেও ১৯৪৮ সালে শান্তিতে নোবেল গান্ধিরই পাবার কথা ছিল। কিন্তু ২ অক্টোবর আততায়ীর গুলিতে মৃত্যু হওয়ায় গান্ধীকে পুরষ্কার দিয়ে খাটো করা যায়নি।

যে দেশের বিরুদ্ধে গান্ধী সারাজীবন যুদ্ধ করেছিলেন সেই গ্রেট ব্রিটেন তার মৃত্যুর ২১ বছর পর তার সম্মানার্থে স্ট্যাম্পে গান্ধীর ছবি ছাপায়।

গান্ধীর সম্মানে ভারতে ৫৩ টি বড় রাস্তা এবং সারা পৃথিবী জুড়ে ৪৮ টি রাস্তার নামকরণ করা হয় গান্ধীর নামে। শুধু তাই নয়, Time Magazine এর Man of the Year 1930 হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী।
1948 সালের 30 শে জানুয়ারি নাথুরাম গডসে ব্ল্যাক পয়েন্ট রেঞ্জ থেকে মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো হত্যা করার পর নাথুরাম গডসে সেখান থেকে পালানোর কোন চেষ্টাই করেনি। কারণ সে চেয়েছিল তার এই জঘন্যতম হত্যার কথা সারা দেশবাসী যাতে জানতে পারে। এবার আপনাদের যেটা জানাবো সেটা অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা। গান্ধীজী কে হত্যা করার জন্য তিনি একটা নয় দুটো নয় মোট 150 টি কারণ দেখিয়েছিল।

তবে সেই সময় কংগ্রেস সরকার এই সমস্ত কারণগুলি প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি। কিন্তু নাথুরামের দাদা গোপাল গডসের দীর্ঘতম আইনি লড়াইয়ের পর তা প্রকাশ পায়। গান্ধীজী কে হত্যা করার পেছনে নাথুরাম গডসে জেড এর সঠিক কারণ তুলে ধরা হয়েছিল তার মধ্যে সবগুলি এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়, তাই দশটি উল্লেখযোগ্য কারণ দেওয়া হলো।

1. 1919 সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মূল জেনারেল ডায়ারের গোটা দেশ শাস্তি চেয়েছিল। কিন্তু গান্ধী সেই দাবি খারিজ করেন।
2. ভারতবাসী চেয়েছিল যে বিপ্লবী ভগৎ সিং এবং সুখদেবের ফাঁসি আটকানোর জন্য গান্ধী কিছু পদক্ষেপ করুক। কিন্তু এই সব কিছু তিনি করেননি। উল্টা আবার গান্ধী বলেন, এরা পথ ভ্রষ্ট বিপ্লবী, এরা যে পথে হাঁটছিল সেগুলি সন্ত্রাসের পথ, তাদের ফাঁসি তিনি আটকাবেন না।
3. 1986 সালের 6 ই মে যখন দেশের নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে সেই সময় গান্ধী হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলেন যে তারা যেন মুসলিম লিগের লোকের বিরুদ্ধে যেন না লড়াই করে। সেই সময় মুসলিম লীগের লোকেরা কেরালায় প্রায় 1500 হিন্দুকে হত্যা করেছিল। এছাড়া আরও 2000 হিন্দুকে জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করানো হয়।
4. কাশ্মীরের রাজা হরি সিংকে কাশ্মীর ছেড়ে দিতে বলেন গান্ধী। কারণ কাশ্মীরে মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল।
5. অনেকবার ভারতের মহান যোদ্ধা শিবাজী মহারাজ, রানা প্রতাপ এবং গুরু গোবিন্দ সিং কে পথ ভ্রষ্ট ভারতীয় বলেছিলেন গান্ধী।
6. ত্রিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু গান্ধী নিজের ক্ষমতা বলে নিজের অনুগত পট্টভি সিতারামাইয়াকে কংগ্রেসের সভাপতি করেন।
7. 1947 সালের 15 ই আগস্ট কংগ্রেস সরকার ঠিক করে যে তারা ভারত বিভাজনের বিরোধীতা করবে। তবে যে সভাতে এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হবে সেই সভাতে গান্ধী একদম শেষ সময়ে পৌঁছান এবং দেশভাগের বিষয়টিকে তিনি সমর্থন করেন। এর আগে গান্ধী নিজেই বলেছিলেন দেশ ভাগ তার নিজের লাশের উপর দিয়ে হবে।
8. ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর সর্দার প্যাটেল প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু গান্ধীর নির্দেশে নেহেরুকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়।
9. এরপর নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে ভারত সরকার সোমনাথ মন্দির আবার নির্মাণ করবেন, কিন্তু সেই সময় গান্ধী সরকারে না থাকা সত্ত্বেও সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করান। আবার ঠিক একই সময়ে অর্থাৎ 1948 সালের 13 জানুয়ারি তিনি দিল্লির মসজিদ যাতে সরকারি টাকায় নির্মাণ করা হয় তার জন্য তিনি অনশনে বসেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি তার দাবি মানতে বাধ্য করান সরকারকে।
10.1947 সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তান কাশ্মীরে হামলা করলে গান্ধী আবার ভারত সরকারের বিরুদ্ধেই অনশনে বসেন। এর ফলস্বরূপ ভারত সরকার পাকিস্তানকে 55 কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। গান্ধীর এমন সিদ্ধান্ত দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে সেই সময় ভারতের মুসলিমদের খুশি করতে হিন্দুদের নানা ভাবে প্রতারিত করেছেন তিনি।

সর্বশেষে নাথুরাম গডসে এবং তার সঙ্গে নারায়ণা আপ্তেকে 1949 সালের 15 ই নভেম্বর পাঞ্জাবের আম্বালা জেলে দুজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। উপরের এই মন্তব্যগুলি নাথুরাম গডসে আদালতে করেছিলেন।

গান্ধীর শেষকৃত্যে ১০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছিল যা প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ হয়েছিল। কেন মানুষ ভালবাসবে না এমন মানুষকে?

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীজি (প্রথম পর্ব)

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীজি (প্রথম পর্ব)
তথ্য-সংগ্রহ ও প্রবন্ধ রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। এই উপমহাদেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যিনি মহাত্মা গান্ধীর নাম শুনেনি। কেউবা তাকে বাপু বলে ডাকতে পছন্দ করেন। ধুতি আর চাদর পরিহিত কালো ছোটখাটো শুকনো মানুষটা ভারতের জাতির পিতা। অহিংস মতবাদ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রবক্তা গান্ধী। মহাত্মা তার উপাধি। মহান আত্মা যার। উপাধিটি দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আজ আমরা মহাত্মা গান্ধীর জীবনের কিছু অজানা অংশের দিকে আলোকপাত করবো।

গান্ধী কিশোর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। করেছিলেন বললে খানিক ভুল হবে, করানো হয়েছিল। কাস্তবাইয়ের সাথে তার ৭ বছর বয়সেই বিয়ে ঠিক হয়। ১৮৮৩ সালে ১৩ বছর বয়সের গান্ধীকে ১৪ বছর বয়সী কাস্তবাইয়ের সাথে বিয়ের বন্ধনে বেঁধে দেয়া হয়। সেই বন্ধন গান্ধী সারাজীবন অটুট রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, গান্ধীর সকল আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণাদাত্রীও ছিলেন কাস্তবাই। যদিও ৩৭ বছর বয়সে গান্ধী নারী সংসর্গ পরিত্যাগ করেন। বৈবাহিক জীবনে কাস্তবাই এবং গান্ধী ৪ ছেলে সন্তানের জন্ম দেন।

ধুতি চাদর পরিহিত নিরামিষভোজী যে গান্ধীকে আমরা জানি তিনি লন্ডনে পড়াশুনাকালীন সময়ে পুরোদস্তর সাহেব ছিলেন। নিয়মিত নাচ এবং বেহালা শিখতেন। কোট টাই পড়ে সাহেবি কায়দার ছড়ি ঘুরাতেন।

গান্ধী সারাজীবনে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন। ইংরেজিতে Experiment যাকে বলে। তার মধ্যে একটি হলো ধুমপান এবং গোমাংস ভক্ষণ। মা পুতলিবাই এবং দেওয়ান পিতার ঘরে গান্ধীর জন্ম। পুতলিবাই ছিলেন কঠিন ধর্মানুরাগী নারী। তিনি প্রতিদিন উপোস করতেন এবং নিরামিষাশী ছিলেন। ধর্মীয় অনুশাসনে গান্ধী বড় হন। যার ফলে গান্ধীর কখনোই কোন বদভ্যাস ছিল না বরং ছোটবেলা থেকেই মা তাকে জীবে দয়া করা, অহিংসা এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কথা শুনাতেন।

বিদেশ যাবার কালে মা তাকে পইপই করে শপথ করিয়ে ছিলেন যে তিনি মদ, মাংস এবং নারী হতে বিরত থাকবেন। পরীক্ষা নিরীক্ষাবাদী গান্ধী বড় ভাইয়ের সাথে একবার ধূমপান করলেন কিন্তু ভালো না লাগেনি। এক মুসলিম বন্ধু, শেখ মেহতাব তাকে বুঝিয়েছিলেন যে, ইংরেজরা মাংস খায় বলেই এত বুদ্ধি তাদের, এত দেশ শাসন করতে পারে। আর ভারতীয়রা নিরামিষাশী বলেই এখনো তাদের প্রজা হয়ে আছে। গান্ধী সেই বন্ধুর কথায় প্রভাবিত হয়ে গরুর মাংস খেলেন।

সারাবিশ্বের সকল নেতার অনুপ্রেরণার ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী ছোটবেলায় খুবই অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। তিনি স্কুল শেষ হলে কোন রকমে দৌড়ে বাড়ি চলে আসতেন। কেননা সহপাঠীদের সাথে একেবারেই মিশতে পারতেন না। লজ্জায় মুখে কথাই আসতো না গান্ধীর, আর বন্ধুই বা বানাবেন কিভাবে। লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসেও গান্ধী সেই মুখচোরাই ছিলেন। ব্যবসায় প্রসার ছিল না। প্রসার হবেই বা কিভাবে? আদালতে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গেলে তার যে পা কাঁপত। বিপক্ষের উকিল কিছু বললে তিনি আমতা আমতা করে কোন উত্তরই দিতে পারতেন না। এমন উকিলকে কে চাইবে? অগত্যা দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি দিলেন গান্ধী। ( চলবে)
[আগামী পর্বে শেষ]

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (পঞ্চম পর্ব)

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (পঞ্চম পর্ব)
তথ্য-সংগ্রহ ও প্রবন্ধ রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময় পাল্কিতে বসে তিনি বর্ণপরিচয়-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। ১লা মে-তে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ছাড়াও মাসিক অতিরিক্ত ২০০ টাকা বেতনে দক্ষিণবঙ্গে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদে নিযুক্ত হন। ১৭ই জুলাইতে বাংলা শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে সংস্কৃত কলেজের অধীনে, ওই কলেজের প্রাতঃকালীন বিভাগে নর্ম্যাল স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন অক্ষয়কুমার দত্ত। এই বছরেই দক্ষিণবঙ্গের চার জেলায় একাধিক মডেল স্কুল বা বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন।

আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে নদিয়ায় পাঁচটি, আগস্ট-অক্টোবরে বর্ধমানে পাঁচটি, আগষ্ট-সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে হুগলিতে পাঁচটি এবং অক্টোবর-ডিসেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় চারটি বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন। অক্টোবর মাসে বিধবা বিবাহ বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করার পর্যাপ্ত শাস্ত্রীয় প্রমাণসহ ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ – দ্বিতীয় পুস্তক প্রকাশ করেন। বিধবা বিবাহ আইনসম্মত করতে ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ সরকারের নিকট বহুসাক্ষর সম্বলিত এক আবেদনপত্রও পাঠান। ২৭ ডিসেম্বর আরেকটি আবেদনপত্র পাঠান বহু বিবাহ নিবারণ বিধির জন্য।

১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি মেদিনীপুরে পঞ্চম বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। ৭ ডিসেম্বর কলকাতায় প্রথম বিধবা বিবাহ আয়োজিত হয়— ১২, সুকিয়া স্ট্রিটে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। পাত্র ছিলেন প্রসিদ্ধ কথক রামধন তর্কবাগীশের কণিষ্ঠ পুত্র তথা সংস্কৃত কলেজের কৃতি ছাত্র ও অধ্যাপক, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধু শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। পাত্রী ছিলেন বর্ধমান জেলার পলাশডাঙা গ্রামের অধিবাসী ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দ্বাদশ বর্ষীয়া বিধবা কন্যা কালীমতী।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে জানুয়ারিতে স্থাপিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সমিতির অন্যতম সদস্য তথা ফেলো মনোনীত হন। এই বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে হুগলি জেলায় সাতটি ও বর্ধমান জেলায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরের বছর জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে হুগলিতে আরও তেরোটি, বর্ধমানে দশটি, মেদিনীপুরে তিনটি ও নদিয়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। মোট ১৩০০ ছাত্রীসম্বলিত এই বিদ্যালয়গুলির জন্য তাঁর খরচ হতো মাসে ৮৪৫ টাকা। এই ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ নভেম্বর শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তার সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করেন।

১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ নভেম্বর প্রকাশিত হয় সোমপ্রকাশ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনার নেপথ্যে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম পত্রিকা, যাতে রাজনৈতিক বিষয় স্থান পেয়েছিল। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ১ এপ্রিল পাইকপাড়ার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুর্শিদাবাদের কান্দিতে প্রতিষ্ঠা করেন ইংরেজি-বাংলা স্কুল। কিছুকাল এই প্রতিষ্ঠানের অবৈতনিক তত্ত্বাবধায়কও ছিলেন তিনি।

২০ এপ্রিল মেট্রোপলিটান থিয়েটারে উমেশচন্দ্র মিত্র রচিত নাটক বিধবা বিবাহ প্রথম অভিনীত হয়। ২৩ এপ্রিল রামগোপাল মল্লিকের সিঁদুরিয়াপট্টির বাসভবনে সেই নাটকের অভিনয় দেখেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। মে মাসে তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে মিশে গেলে উক্ত সভার সভাপতির পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। ২৯ সেপ্টেম্বর গণশিক্ষার প্রসারে সরকারি অনুদানের জন্য বাংলার গভর্নরের নিকট আবেদন করেন।

১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে বোর্ড অফ একজামিনার্সের পদ থেকেও ইস্তফা দেন তিনি। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের সেক্রেটারি মনোনীত হন। এই বছর ডিসেম্বর মাসে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াণে, তিনি তাঁর সম্পদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার পরিচালনভার গ্রহণ করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণদাস পালকে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত করেন। এই বছর তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাণভট্টের কাদম্বরী। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁকে উৎসর্গ করেন স্বরচিতবীরাঙ্গনা কাব্য।

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (চতুর্থ পর্ব)

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (চতুর্থ পর্ব)
তথ্য-সংগ্রহ ও প্রবন্ধ রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র এবং ১৮৩৯ সালের মধ্যেই বিবিধ বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের পাণ্ডিত্যের জন্য ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করার পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন এবং ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। তাছাড়া প্রতি বছরই তিনি বৃত্তি এবং গ্রন্থ ও আর্থিক পুরস্কার পান।

তাঁর পাঠ্যপুস্তকগুলি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তিনি কেবল লেখাপড়া শেখানোর কৌশল হিসেবে এগুলি লেখেননি, বরং ছাত্রদের নীতিবোধ উন্নত করা এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানও তাঁর লক্ষ্য ছিল। যেমন চরিতমালায় তিনি প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষিদের জীবনী লেখেননি, বরং ইউরোপের ষোলোজন বিখ্যাত ব্যক্তির পরিচিতি দিয়েছেন। তেমনি জীবনচরিতে তিনি কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন এবং হার্শেলের মতো বিজ্ঞানীদের এবং উইলিয়ম জোনসের মতো পন্ডিত ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচিতি লিখেছেন। নীতিবোধেও একই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। এতে তিনি আনুষ্ঠানিক ধর্ম এবং আচার-অনুষ্ঠানের কোনো উল্লেখ করেননি, বরং যেসব নীতিবোধ সকল মানুষের থাকা উচিত, তার কথা লিখেছেন।

কথামালায় তিনি নীতিমূলক গল্প সংগ্রহ করেছেন। আর তিন খন্ড আখ্যানমঞ্জরীতে সংগ্রহ করেছেন ইউরোপ-অ্যামেরিকার (এবং চারটি আরব দেশ ও পারস্যের) সত্যিকার এবং জনপ্রিয় গল্প। এসব গল্পের শিরোনাম—মাতৃভক্তি, পিতৃভক্তি, ভ্রাতৃস্নেহ, গুরুভক্তি, আতিথেয়তা, পরোপকার এবং সাধুতার পুরস্কার—থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি কেবল ছাত্রদের নীতিবোধ উন্নত করতে চাননি, সেই সঙ্গে চেয়েছিলেন তাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে। তাঁর পাঠ্যপুস্তকগুলি দীর্ঘদিন বঙ্গদেশের সর্বত্র পাঠ্য ছিল। এগুলোর মাধ্যমে তিনি একই সঙ্গে প্রামাণ্য ভাষা ও বানান যেমন শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন, তেমনি পেরেছিলেন নীতিবোধ উন্নত করতে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত শেষ করার পর, ২৯ ডিসেম্বর মাত্র একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলা বিভাগের সেরেস্তাদার বা প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত হন। সে সময় তাঁর বেতন ছিল মাসে ৫০ টাকা। সংস্কৃত কলেজের রামমাণিক্য বিদ্যালঙ্কারের মৃত্যুতে একটি পদ শূন্য হলে, তিনি ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ এপ্রিল সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন। কিন্তু কলেজ পরিচালনার ব্যাপারে সেক্রেটারি রসময় দত্তের সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় তিনি ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই তারিখে সংস্কৃত কলেজের সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর এই বছরের ১ মার্চ পাঁচ হাজার টাকা জামিনে, মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। এই বৎসরেই তিনি স্থাপন করেন সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি নামে একটি বইয়ের দোকান।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বন্ধু ও হিতৈষীদের সহযোগিতায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যে স্থাপনা করেন ‘সর্ব্বশুভকরী সভা’। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহযোগিতায় তিনি সর্ব্বশুভকরী নামক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কাজে ইস্তফা দেন এবং ৫ ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন।

১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারি তারিখে তিনি সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ ছাড়াও কলেজের অস্থায়ী সেক্রেটারির কার্যভারও গ্রহণ করেন। ২২ জানুয়ারি ১৫০ টাকা বেতনে কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এই সময় থেকেই সংস্কৃত কলেজে সেক্রেটারির পদটি বিলুপ্ত হয়। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার নিয়ে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেন। ৯ জুলাই, পূর্বতন রীতি বদলে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়াও কায়স্থদের সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেন। ২৬ জুলাই প্রবর্তিত হয় রবিবারের সাপ্তাহিক ছুটির প্রথা। উল্লেখ্য এর আগে প্রতি অষ্টমী ও প্রতিপদ তিথিতে ছুটি থাকত। ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজকে সকল বর্ণের সম্ভ্রান্ত হিন্দু সন্তানদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।

১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে ২৬ অনুচ্ছেদ সম্বলিত নোটস অন দ্য সংস্কৃত কলেজ প্রস্তুত হয়। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর নিজের বেতন বৃদ্ধি পেয়ে তিনশো টাকা হয়। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের প্রাচ্য ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভেঙে বোর্ড অফ একজামিনার্স গঠিত হয়। বিদ্যাসাগর এইবোর্ডের সদস্য মনোনীত হন।

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (দ্বিতীয় পর্ব)

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (দ্বিতীয় পর্ব)
তথ্য-সংগ্রহ ও প্রবন্ধ রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

সংস্কৃত পন্ডিত, লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, জনহিতৈষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৮২০- ২৯ জুলাই, ১৮৯১) আক্ষরিক অর্থেই একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন, আদর্শ মানব ছিলেন। বিদ্যাসাগরের জীবন কেটেছে বাংলার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালে। দারিদ্র্য ও শোষণ বাঙালির সমাজজীবনকে ক্ষয় করে ফেলেছিল। শিক্ষা, ইংরেজ শাসন ও সামাজিক কুসংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে রামমোহন রায় থেকে শুরু করে অনেকেই বাংলার নবজাগরণে ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন শহুরে বণিক পরিবারের। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। সাত ভাই আর তিন বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। মায়ের প্রতি ছিল বিদ্যাসাগরের অগাধ শ্রদ্ধা। মায়ের প্রতিটি ইচ্ছা অকাতরে পূরণ করতেন।

তাঁর মাতৃভক্তি নিয়ে অনেক জনশ্রুতিও শোনা যায়। বাংলা গদ্য সাহিত্য যার হাতে পেল গতি ও শ্রুতি তিনিই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সাহিত্যিক হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রয়েছে যথেষ্ট অবদান। তিনি সাহিত্যে সৃজনী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি যখন অধ্যাপক ছিলেন, তখন বাংলায় উন্নত পাঠ্য পুস্তকের অভাব বোধ করেছেন। নিজের সাহিত্য প্রতিভাবলে বাংলা গদ্যের ভান্ডার শক্ত করেছেন তার জন্যই বাংলা গদ্যরীতি আপন পথ খুঁজে পায়। আর এ জন্যই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। এই তিনিই আবার বৃটিশ ভারতে বাঙালির সমস্যাসমূহ টের পেয়েছিলেন বলেই সেসব সমস্যা সমাধানে আমৃত্যু নিরন্তর কাজ করে গেছেন। জীবনে কম কষ্ট পাননি তিনি তাঁর আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে।

নিজ পরিবার, সমকালীন সমাজ এবং ওপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে। অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে অর্থনৈতিকভাবে বেশ সম্পদের অধিকারী হয়েও তিনি ব্যক্তিগত ভোগ বিলাসীতায় কখনো নিজেকে নিমজ্জিত রাখেননি। বিত্ত অর্জনে কষ্ট করেছেন কিন্তু চিত্তের উদারতায় মানব কল্যাণে ব্যয় করতে কখনো সংকোচ কিংবা দ্বিধা করেননি। ফলে সমকালেই তিনি জ্ঞানের বা বিদ্যার সাগরের পাশাপাশি করুণার সাগর হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

বিদ্যাসাগর উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলায় শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি হিন্দু সমাজের বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করেন। তার প্রচেষ্টায় ২৬ জুলাই ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। নিজের ছেলের সাথে এক বিধবা কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে অন্য হিন্দুরাও বিধবা বিবাহে উৎসাহ বোধ করে।