স্বপ্নহীনের সাপলুডো(একাঙ্ক নাটক)- ১৩শ পর্ব
জগাই – হ্যাঁ স্যার, আমার সেই বাবা তাঁর লেখার টেবিলে রাখা দোয়াত আর কলমটা দেখিয়ে বলতেন, জগাই এই হলো সত্য আর বিশ্বাস। এই দুটোতে মন রাখিস। লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু। লোভ করিস না। লোভে যন্ত্রণা বাড়ে। হুজুর, বাবা ঠিক বলেননি বলুন! চোখের সামনে দেখলাম লোভের বীভৎস চেহারা। চোরেরা তাদের লোভের থাবায় কেমন করে যেন আস্তে আস্তে গ্রাস করে নিল
চারপাশের জগৎটা। আমি দেখেছি হুজুর রাস্তার মোড়ে হুল্লোড় করা মস্তানদের যারা মাথা, কেমন করে তাদের গায়ে উঠছে অন্য পোষাক! কেমন করে তারা ভদ্দরলোকদের ভয় দেখিয়ে চাপ দিয়ে আস্তে আস্তে ভদ্র পোষাক খুলে পরে ফেলেছে নিজেরা। থানা-পুলিশ-অফিস-কাছারী সর্বত্র যে কেমন করে তারা গড়ে তুলেছে তাদের জমিদারী, আমি দেখেছি হুজুর! ডিমওয়ালা আমি চতুর্থ জগাই, আমি সব দেখেছি। খাদ্য আন্দোলন, চালের জন্য মানুষের গুলি খাওয়া। দেখেছি কেমন করে সোনার টুকরো উজ্জ্বল ছেলেরা আমার মায়ের মুখের ভাষাকে বাঁচানোর জন্যে হাসতে হাসতে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দেখেছি সেইসব হীরের টুকরো ছেলেদের যারা পচে যাওয়া অবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে বুকে পিঠে গুলি নিয়ে নোংরা খালের জলে ভেসেছে। আমি দেখেছি, বদলে যাওয়া দিনের হাত ধরে কত চোর মস্তান রাজা হয়েছে। সভাপতির আসনে বসে বক্তৃতা দিচ্ছে। আমি, হ্যাঁ হুজুর আমিই দেখেছি। দেখেছি আর ভেবেছি চুরি তো কবেই শুরু হয়েছে। চুরি হয়েই চলেছে। মানুষের বুদ্ধি চুরি হয়ে গেছে। মানুষের মগজের চিন্তা ভাবনা চুরি হয়ে গেছে। বিবেক চুরি হয়ে গেছে। সাহস চুরি হয়ে গেছে। সম্মান চুরি হয়ে গেছে।
বিচারক – এই! কি সব বলছ?
জগাই – না হুজুর, এই সমস্ত চুরির কোনো রিপোর্ট কেউ লেখায় নি। কোনো থানাতেই কোনো রেকর্ডেই তার উল্লেখ নেই হুজুর! আর তাই ছুরি চালানো হাত কখনো আইন বানাচ্ছে, ধর্ষণ করা শরীর কখনো দেশ আগলাচ্ছে। ওরা দেশটাকে কিনে নিয়েছে স্যার! চুরি করে নিয়েছে। আত আমার মতো, এই চতুর্থ জগাইয়ের মত ঘরে ঘরে যত জগাই, সবাই জেগে জেগে দেখবে। বুকের মধ্যে তাদের ব্যাথা মোচড় দিয়ে উঠবে। কিন্তু পাছে প্রাণ যায় সেই ভয়ে ঘুমের ভাণ করে পড়ে থাকবে। আবার সকাল হবে। তারা খাবে, কাজে যাবে। দোল দুর্গোৎসব ঈদে নাচগান করবে। ১৫ই আগষ্ট ফ্ল্যাগ ওড়াবে। কেউ কোনো এফআইআর করবে না।
বিচারক – রাষ্ট্রবিরোধী কথা বোলোনা।
জগাই – হুজুর! বাড়ী ফিরে ছেলের মুখের দিকে তাকাবেন হুজুর! আর তাকাবেন আইনের কেতাবগুলোর দিকে। তারপর দয়া করে ভাববেন, আপনার ছেলের জন্যে ঠিক আছে তো সব! তার ঘর থেকে চুরি যাবে না তো কিছু! আপনার মোটা মোটা কেতাব পারবে তো সবকিছু বাঁচিয়ে রাখতে! পারবে তো আপনার আদরের ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ থেকে শুরু করে আপনার বিচারের রায় লেখা ওই কলমটাকে বাঁচিয়ে রাখতে! যে কলমের দিকে তাকিয়ে বাবা বলতেন, মিছিমিছিই বলতেন- জগাই! সত্য আর বিশ্বাস এই দুইই হলো আসল। একে ছাড়িস না। পারবেন তো হুজুর! পারবেন তো!
(আলো জগাইয়ের ওপর উজ্জ্বল হয়। বিচারক ও উকিলের ওপর আলো কমতে কমতে নিভে যায়। এর মধ্যেই বিচারক রায় ঘোষণা করতে থাকেন। কিন্তু রায়ের শেষ অংশ শোনা যায় না। জগাইয়ের গানে চাপা পড়ে যায়।)
বিচারক – দেশের দন্ডবিধির সাতশো সাতাত্তর নম্বর ধারার সাতের সাঁইত্রিশ উপধারা অনুযায়ী আসামী জগাই ওরফে চতুর্থ জগাইকে দোষী সাব্যস্ত করা হল এবং তার… (কন্ঠস্বর ও বিচারক মিলিয়ে যায়)
জগাই – (গান করে) দিন যায় রাত যায় সময়ের নৌকায়
মানুষ কি খুঁজে চলে জীবনের আয়নায়
ছোট সুখ শান্তির স্বস্তির অম্লান
হাসি গানে জীবন্ত ছবি যাতে আঁকা যায়।
দিন যায় রাত যায় সময়ের নৌকায়…
(এক চোর ঢোকে। আলোর বৃত্তের মধ্যে দুজন)
চোর – জগাই!
জগাই – কে?
চোর – আমি চোর।
জগাই – চোর! তার মানে?
চোর – হ্যাঁ আসলে আমি তোমারই মত একজন। (হাসে) আমি সব শুনেছি। ওই কোর্টঘরের বেঞ্চিতে বসে সব শুনেছি তোমার কথা।
জগাই – তাই!
চোর – হ্যাঁ, পেটের জ্বালায় সেদিন আমি তোমার ঘরে ঢুকেছিলাম ভাই।
জগাই – ও তুমিই সে!
চোর – হ্যাঁ। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি? আমি তো সেদিন একা ছিলাম। তুমি আমাকে ধরলে না কেন ভয়ে?
জগাই – না রে ভাই, মায়ায়। তোমার ওই চুরি করতে এসে গবগব করে মুড়ি খাওয়া দেখে কেমন মায়া হল। তাই… কিন্তু তোমাকে দেখে খারাপ লোক মনে হচ্ছে না! তবে তুমি এই লাইনে কেন গেলে ভাই?
চোর – (হাসে) এই লাইনে কি বেছে বেছে খারাপ লোকরাই আসে?
জগাই – তাহলে?
চোর – আসলে কি জানো, তোমার আমার মত অবস্থার লোক যারা তারা আসে অবস্থার বিপাকে পড়ে। যখন অন্য সমস্ত রাস্তা আমাদের সামনে বন্ধ হয়ে যায়, তখন।
জগাই – তবে যে শুনেছি যারা চুরি করে তারা খারাপ লোক?
চোর – ঠিকই শুনেছ। ন্যায় হোক, অন্যায় হোক যেকোনো উপায়ে রোজগার করা সম্পত্তি বাঁচাতে সম্পত্তিওয়ালারা এরকম পোস্টার লাগিয়েছে বটে। তবে কি জানো, ওরাই হচ্ছে আসল খারাপ লোক। ওরাই বড় চোর। আমরা চুরি করি পেটের দায়ে বাঁচার জন্যে। আর ওরা চুরি করে লোভে সম্পত্তি বাড়ানোর জন্যে।
জগাই – সেকি! সব বড়লোক কি চোর হতে পারে নাকি!
চোর – না না না, তা কেন হবে? সম্পত্তিওয়ালাদের মধ্যেও অনেক ভালো মানুষ আছে। তবে কি না আবার ওই খারাপ চোররাও সব সম্পত্তিওয়ালাই তো!
জগাই – তোমার কথা যেন কেমন কেমন ঠেকছে! ঠিক বুঝতে পারছি না।
চোর – (হাসে) বেশী বুঝে কাজ নেই। (চোর ঝোলা থেকে দোয়াত আর কলম বার করে জগাই কে দেয়) এই নাও।
জগাই – (চীৎকার করে ওঠে) একি! এ দুটো…এ দুটো তুমি…
চোর – হ্যাঁ, বিক্রী করার চেষ্টাও করিনি। তোমার ঘর থেকে ও দুটো নিয়ে গিয়ে কেমন যেন অস্বস্তিতে ভুগেছি। বিশ্বাস কর, এই সাত সাতটা মাস চুরি করতে পারিনি। মিথ্যে কথা বলতে পারিনি। কাউকে ঠকাতে পারিনি। কেন কে জানে!
জগাই – এ যে সত্য আর বিশ্বাস। হ্যাঁ, (কলম আর দোয়াত দুটোকে আদর করে) জানো বড় কষ্টে পড়েছিলাম। না না, তুমি আমার অন্য জিনিস বা টাকা নিয়েছ তার জন্য নয়, এই দুটোর জন্যে। এ দুটো যে আমার কাছে বড় জীবন্ত। চোরভাই, তুমি এগুলো নেওয়ার পরে আমি বিশ্বাস হারিয়ে
ফেলছিলাম যে! কেবলই মনে হচ্ছিল তাহলে কি ছোট থেকে যেসব কথা শুনেছি, যা ধ্রুব বলে জেনেছি, আসলে তা সত্যি নয়? মিথ্যে! আমার বাবা, যার জন্যে আমি গর্বে বুক সাত হাত ফুলিয়ে বাজারে বসে মাথা উঁচু করে ডিম বিক্রী করি, সেই বাবার সমস্ত জানা মিথ্যে! ভুল! বিশ্বাস কর আমি ছটপট করেছি। কেঁদেছি। বাবা! তোমার কথা মিছিমিছি নয় বাবা! সত্য আর বিশ্বাস চুরি হতে পারে কি! পারে না। কিছুতেই পারে না।
চোর – আঃ! তোমার জিনিস তোমাকে ফেরত দিয়ে কি হাল্কা লাগছে! এবার আমি চললাম।
জগাই – চললে? আবার চুরি করবে?
চোর – নাহ, ওসব আর আমার দ্বারা হবে না ভাই। দেখি অন্য কিছু করা যায় কি না। এই তোমার কাছে শ দু তিন টাকা হবে?
জগাই –কেন? কি করবে?
চোর – ধার নিতাম। ভয় নেই, শোধ করব। নাহলে তো ধার চাইতামই না। চুরি করতাম। ওই টাকাটা দিয়ে গামছা কিনে বিক্রী করব।
জগাই – (পকেটে হাতড়ে টাকা দেয়) এই নাও।
চোর – তুমি খুব ভালো মানুষ। চলি ভাই।
(চোর মিলিয়ে যায়।)
(চলবে)
অনেকদিন পর এই সিরিজ অংশ বিশেষ পড়লাম। অনবদ্য রচনা। আগের গুলো পড়া আছে জন্য সহজ মনে হচ্ছে। ___ অভিনন্দন প্রিয় কবি এবং নাট্যকার সৌমিত্র।