বিভাগের আর্কাইভঃ শিল্পসংস্কৃতি

মাদারিং সানডে

images এক
ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ারের পটভূমিতে লেখা গ্রাহাম সুইফটের উপন্যাস ‘মাদারিং সানডে’। নাম না বদলে সিনেমা করেছেন ইভা হাসন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে দশ বছর হল, কিন্তু তার ছেটানো রক্ত লেগে নাগরিকের জীবনে। শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত নিভেন-পরিবারের সন্তানেরা যুদ্ধে নিহত, তাদের বন্ধু শেরিংহাম ফ্যামিলিতে শুধু বেঁচে আছে পল নামের ছেলেটা।

১৯২৪ সালের মাদারিং সানডে, এদিন বাড়ির প্রত্যেক কাজের লোককে ছুটি দেওয়ার নিয়ম যাতে তারা নিজেদের মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। নিভেন-পরিবারের হাউজমেড জেন ফেয়ারচাইল্ডও ডে-অফ পেয়েছে, যদিও জেন অনাথ, দেখা করার মতো মা নেই তার। দিনটাকে উদ্‌যাপন করার জন্যে নিভেনরা প্রতিবেশী শেরিংহাম আর হবডে-দের সঙ্গে মিলে পিকনিকের ব্যবস্থা করল।

এদিকে, পলের সঙ্গে জেনের গোপন যৌনসম্পর্ক। জেন ভালোবাসে তাকে। লন্ডনের আইন-কলেজের ছাত্র পল “পড়ার চাপ, একটু পরে যাচ্ছি” ব’লে আপ্‌লি টাউনে নিজের বাড়িতে একা থেকে গেল আর চুপিচুপি ডেকে নিল জেনকে। দুজনে গভীর শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় কাটাচ্ছে কয়েকটা ঘন্টা।

দুই
একশো বছর আগে ইংল্যান্ডের কাউন্টির সৌন্দর্য এই ছবির প্রথম তুক। সমান ক’রে ছাঁটা ঘাসের লম্বা মাঠ, ফুলগাছে সাজানো ফার্মহাউজ, পেশি-ঝলসানো ঘোড়ার চারণভূমি দেখতে দেখতে ইয়োরোপের সুস্বাদু শীত অনুভব করা যায় নিজের জিভে। আর অভিজাততন্ত্রের রেশ টেনে চলা ধনী ব্রিটিশদের বাড়ির ভেতরটাও যেন ঈশ্বরের মতো — পুরনো, সুমহান, নড়চড়বিহীন।

পল চড়ুইভাতির জন্যে রওনা হলে নগ্ন তরুণী সেই বাড়ি ঘুরে ঘুরে দ্যাখে। গোঁফদাড়িভরা তেলরঙের পূর্বপুরুষ পার হয়ে আলমারি খুলে পলের পোশাকের গন্ধে বিভোর হয়, পৌঁছোয় পারিবারিক লাইব্রেরিতে — চামড়ায় বাঁধানো, নিশ্ছিদ্র সার দেওয়া বইয়ের আবলুশ যক্ষপুরী। বেরোনোর আগে পল ব’লে গেছে এমা হবডে-র সঙ্গে তার আজ এনগেজমেন্ট, যে-এমা পলের বন্ধু ও নিভেনদের ছেলে জেমসের বাগদত্তা ছিল। প্রেমিকের সঙ্গে নিজের বিয়ে সে কল্পনাতেও আনেনি, তবু খবরটা শোনার পর জেন ক্যামন ভ্যাবলা মেরে গেছে। পল বলছিল, আমরা দুজন সারা জীবন খুব ভালো বন্ধু হয়ে থাকব, কেমন? জেন মরা চোখে তাকিয়ে পুতুলের মতো ঘাড় নেড়েছে। পলের সিগারেটের নেশা, কিন্তু এ-পর্যন্ত একটাও স্টিক না-ধরানো জেন পল-বিদায়ের পর থেকে নন-স্টপ ধোঁয়া টেনে যাচ্ছে (সিনেমার শেষ পর্যন্ত তার ঠোঁট থাকবে সিগারেটে)। এবং সে আর পোশাকও পরছে না (কী আসে-যায়)! আমরা যারা ছবির শুরুতে লিংকনশায়ারের ল্যান্ডস্কেপে রঙিন বৃক্ষবসন্তে ডুবে গেছিলাম — বাড়ির ভেতরে নিষ্পত্র ওকগাছের মতো, বরফভাসা ঝর্নাজলের মতো বাদামি খোলা চুলের আর এক প্রকৃতিকে দেখি। যৌবনের আদুল পরমাকৃতি যতদূর বিষণ্ণ হতে পারে ততখানি ফুঁপিয়ে ওঠে সংগীত-পরিচালক মরগ্যান কিবি-র পিয়ানো। কিছুক্ষণ পরে জেন আপ্‌লি থেকে নিভেনদের বাড়ি ফিরে যায় এবং শোনে পল গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। এবার তার দ্বিতীয় পরীক্ষা। উচ্চবংশীয় প্রেমিকের বিয়ে মেনে নিতে হয়েছিল, এখন সে মরে গেছে জেনেও আকাশ চুরমার করা কান্না গিলে ফেলতে হবে।

তিন
এই ছবির প্রথম অংশে ক্যামেরা দাঁড়িয়ে আছে তাক লাগানো নিসর্গদৃশ্য আর নারীশরীরের উদ্ভাসে, দ্বিতীয় অংশে বিদ্যুৎগতিতে এসেছে-গেছে ফ্ল্যাশ ব্যাক আর ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড।

জেন অসম্ভব পড়তে ভালোবাসে। তাকে একবার নিজের বাড়ির লাইব্রেরিতে স্টিভেনসনের কিডন্যাপড-এর পাতা ওলটাতে দেখে ফেলেছিল হতবাক নিভেন-কর্তা গডফ্রে। পল চলে যাওয়ার পরে সে পরিচারিকার পেশা ছেড়ে একটা বুকশপে কাজ নেয় এবং লিখতে শুরু করে। ওই দোকানেই বইয়ের তাকের গলিঘুঁজিতে জেনের পরিচয় দর্শনের ছাত্র অনুভূতিপ্রবণ কালো যুবক ডোনাল্ডের সঙ্গে। তাদের ভালোবাসা এবং বিয়ে হল। সে জেনকে জিগ্যেস করেছিল, তোমার লেখক হওয়ার পেছনের কারণ কী? জেন বলে, তিনটে। এক : তার জন্ম (না হলে লিখত কী করে?), দুই : টাইপরাইটার উপহার পাওয়া, তিন… তিন… তিন নম্বরটা থাকগে। ডোনাল্ডের ধরা পড়ল দুরারোগ্য ব্রেন টিউমার। মৃত্যুশয্যায় সে তৃতীয় কারণ জানতে চাইলে বউ কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল — আমি তোমাকে ভালোবাসি।

পরের ঘটনা সামান্য। জেন বড় লেখক হল, বৃদ্ধ হল (অভিনয়ে গ্লেন্ডা জ্যাকসন), প্রচুর পুরস্কার জুটল তার। এমনই এক স্বীকৃতি পাওয়ার দিন সাংবাদিকেরা বাইট নিতে এসেছে, এই দৃশ্যে সিনেমা শেষ।

চার
এ-ছবিতে খল নয় কেউ, পরিপ্রেক্ষিতের দাসদাসী যেন, শুধু শ্রেণিপার্থক্য বয়ে আনে দুঃখঅপমান। পল জোর ক’রে প্রেমিকাকে বশ করেনি, ক্যাপ পরলে গর্ভধারণ এড়ানো যাবে শুনে মেয়েটি চোখ কপালে তুললে সস্নেহে বলে, তোমার ইচ্ছে না হলে থাক। তখন মনে পড়ে, জেনের মাও গর্ভবতী পরিচারিকা ছিলেন। এদিকে, সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পলের এমাকে বিয়ে করতে হচ্ছিল, তাই তার মৃত্যু আদতে আত্মহত্যা কিনা এটা বারবার ভাবিয়েছে গডফ্রে নিভেনকে। আবার গডফ্রে-র স্ত্রী ক্ল্যারি যখন কাঁদতে কাঁদতে জেনকে চুমু খাচ্ছে, বলছে, তোমার সৌভাগ্য তুমি জন্ম থেকে অনাথ, আত্মজন নেই ব’লে বিচ্ছেদকষ্টও নেই (You’re comprehensively bereaved at birth — ঠিক এই বাক্যটা), তখন জেনের সঙ্গে আমরাও চমকে উঠি! তাই কি হয়, মানুষ তার দীর্ঘ জীবনে কত অপরিহার্য সংযোগ তৈরি ক’রে বসে, সেসব কি রক্তের বাঁধনের চেয়ে কিছু কম? এভাবে অভিজাত আর নিম্নবর্গের শোকস্রোত পাশাপাশি বয়ে যায়, কেউ কাউকে বুঝতে পারে না।

কত কত স্মরণযোগ্য দৃশ্য আছে ছবিতে! ঘন্টা-বাজা এক মিষ্টি চার্চ থেকে বেরনো নতুন দম্পতিকে দেখে জেন জিগ্যেস করছে, ওরা কি সব সত্যি বলবে একে অন্যকে? অথবা জেনের শরীর উন্মোচিত করতে করতে পল হাসিমুখে : You are slightly interesting than law books, বা ওই দৃশ্যটা যখন আদরকালীন জেন প্রেমিককে গুনগুনিয়ে বলল, তোমার বীজ মাটিতে ফ্যালো, আমরা দুজন তাতে সার-জল দেব, গাছ বড় হবে। আবার, আপ্‌লির বাড়ি থেকে বেরনোর আগে ফুলদানি থেকে একটা হোয়াইট ক্রিম ছিঁড়ে বুকের ভেতর ভ’রে নিল জেন। কিম্বা ধরো, এক পলকে গা কাঁপিয়ে দেওয়া খবরের কাগজের হেডলাইন — প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে ছ’লাখ ব্রিটিশ সেনা মারা গেছে!

এত নিখুঁত চিত্রনাট্য, এমন যত্নে বানানো ফিল্ম, পর্দায় সিগারেটের প্রত্যেক টানে শুকনো পাতা পোড়ার শব্দ। যেমন ‘অভি’ থেকে ‘নয়’ আলাদা হওয়ার নয়, আমার কাছে জেন মানেই ওডেসা ইয়ং। আবার, নগ্ন প্রেমিকের ধাপে-ধাপে পোশাকে সেজে ওঠা দেখে জোশ ওকনোর ছাড়া আর কাকেই বা সে বলত, তুমি বড্ড হ্যান্ডসাম? তেমনি শোপে ডিরিসু ছাড়া আর কারও মুখেই মিলত না উদারতা-সারল্য-প্রজ্ঞার থ্রি ইন ওয়ান।
তবু ছবির শেষ পর্যন্ত জেগে থাকে জেনের লেখক হওয়ার তৃতীয় অজুহাত… তারপর দেখি এক স্বপ্নদৃশ্যে পল জেনের পাশে ব’সে বলছে : তোমার লিখতেই হবে। আমার জন্যে এই অতীত পুনর্নির্মিত করো। তোমার নিজের জন্যেও।

সেই মুহূর্তে আরও একবার মনে হয় — আমাদের কীই বা করার আছে, এই ক্ষুদ্রমহৎ জীবন লিখে যাওয়া ছাড়া — যতদিন না ঘরের টেলিফোনে বাইরের অনন্ত ডাক পাঠায়, যে-শব্দে জেনকে তার প্রেমিক ডাকত। বৃদ্ধ জেনের পাদুটো আজও সেই বাজনা শুনলে থামে, কথা মুছে দিয়ে স্তব্ধ হয় সে।

শ্রেষ্ঠ শিল্পও দর্শককে এভাবে বারবার নিথর করবে।

mot

[সিনেমা : মাদারিং সানডে। কাহিনি : গ্রাহাম সুইফট। পরিচালনা : ইভা হাসন। ক্যামেরা : জেমি রামসে। সুর : মরগ্যান কিবি। অভিনয় : ওডেসা ইয়ং (জেন) , জোশ ওকনোর (পল), শোপে ডিরিসু (ডোনাল্ড)। মুক্তি : কান চলচ্চিত্র উৎসব, ২০২১। সময় : ১০৪ মিনিট। দেশ : ইউকে।]

কবিতা কি কবি কে?

কবি সেই ব্যক্তি বা সাহিত্যিক যিনি কবিত্ব শক্তির অধিকারী এবং কবিতা রচনা করেন। একজন কবি তাঁর রচিত ও সৃষ্ট মৌলিক কবিতাকে লিখিত বা অলিখিত উভয় ভাবেই প্রকাশ করতে পারেন। একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট, ঘটনাকে রূপকধর্মী ও নান্দনিকতা সহযোগে কবিতা রচিত হয়। কবিতায় সাধারণত বহুবিধ অর্থ বা ভাবপ্রকাশ ঘটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধারায় বিভাজন ঘটানো হয়। কার্যত যিনি কবিতা লিখেন, তিনিই কবি।

তবে বাংলা ভাষার প্রধানতম আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।” অর্থাৎ কবিতা লিখলেই বা কবি অভিধা প্রাপ্ত হলেই কেউ “কবি” হয়ে যান না। একজন প্রকৃত কবির লক্ষণ কী তা তিনি তাঁর কবিতার কথা নামীয় প্রবন্ধ গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। সেই অনাদিকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত যুগ-যুগ ধরে কবিরা তাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাগুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করে চলেছেন নিত্য-নতুন কবিতা। কবিতাগুলো একত্রিত করে তাঁরা কবিতাসমগ্র বা কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। কখনো কখনো কাব্যগ্রন্থটি বিরাট আকার ধারণ করে সৃষ্টি করেন মহাকাব্য। প্রায় সকল ভাষায়ই কবিতা রচিত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্ন ভিন্ন সময়কে উপজীব্য করে রচিত হওয়ায় এগুলোর আবেদন, উপযোগিতা এবং ভাবও সাধারণতঃ ঐ সময়ের জন্য উপযোগী।

তবে কতকগুলো কবিতা কালকে জয়ী করেছে বা কালজয়ী ভূমিকা পালন করেছে। প্রত্যেক সমাজ-সভ্যতা ও নির্দিষ্ট ভাষায় রচিত হওয়ায় কবিরা বহুমাত্রিক, বিচিত্র ভঙ্গিমা, সৃষ্টিশৈলী প্রয়োগ করেছেন তাদের কবিতায় যা কালের বিবর্তনে যথেষ্ট পরিবর্তিত,পরিমার্জিত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। পরবর্তীকালে এই প্রায়োগিক বিষয়াদিই ঠাঁই করে নিয়েছে বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসের পর্দায়। সাহিত্যের ইতিহাসে উৎপাদিত এই বৈচিত্র্যময় শিল্প শৈলীই বর্তমান সাহিত্যকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে।

কবি শব্দটি ‘কু’ ক্রিয়ামূলের বংশে প্রসূত একটি শব্দ। ‘কু’ অর্থ’ অ-সাধারণ (নবরূপে উত্তীর্ণ) কারী। এতেই বোঝা যায় কবি সেই মানুষ যিনি সাধারণ অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি অথবা প্রচলিত শব্দকে নতুন রূপে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম। ইংরেজী শব্দ ‘পয়েট’ (poet), ল্যাটিন ভাষার প্রথম শব্দরূপ বিশেষ্যবাচক পুংলিঙ্গ ‘পয়েটা, পয়েটে’ (‘poeta, poetae’) (আক্ষরিক অর্থ ‘কবি, কবি এর’) থেকে সংকলিত হয়েছে। ফরাসি কবি আর্থার রিমবোঁদ “কবি” শব্দের লিখিতভাবে সারাংশ প্রদান করেছেন,

“একজন কবি দর্শনীয় মাধ্যম হিসেবে নিজেকে অন্যের চোখে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি একটি দীর্ঘ, সীমাহীন এবং পদ্ধতিবিহীন, অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সকলের দৃষ্টিগ্রাহ্যতার বাইরে অবতীর্ণ হয়ে কবিতা রচনা করেন। সকল স্তরের ভালবাসা, দুঃখ-বেদনা, উন্মত্ততা-উন্মাদনার মাঝে নিজেকে খুঁজে পান তিনি। তিনি সকল ধরণের বিষবাষ্পকে নিঃশেষ করতে পারেন। সেই সাথে পারেন এগুলোর সারাংশকে কবিতা আকারে সংরক্ষণ করতে। অকথ্য দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণাকে সাথে নিয়ে তিনি অকুণ্ঠ বিশ্বাসবোধ রচনা করে যখন, যেমন, যেখানে খুশী অগ্রসর হন। একজন অতি মানবীয় শক্তিমত্তার সাহায্যে তিনি সকল মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হন। একজন বড় ধরণের অকর্মণ্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে কুখ্যাত অপরাধী, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিসম্পাতগ্রস্ত ব্যক্তি, এমনকি সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হিসেবেও তিনি অভিহিত হতে পারেন! যদি তিনি অজানা, অজ্ঞাত থেকে যান কিংবা যদি তিনি বিকৃত, উন্মত্ত, বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন – তারপরও শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গীর মাধ্যমে সেগুলো দেখতে পাবেন। তাই, কি হয়েছে যদি তিনি উৎফুল্লে ভেসে অ-শ্রুত, নামবিহীন অজানা বিষয়াদি ধ্বংস করেনঃ অন্যান্য আদিভৌতিক কর্মীরা তখন ফিরে আসবে এবং তারা পুনরায় সমান্তরালভাবে রচনা শুরু করবে যা পূর্বেই নিপতিত হয়েছিল!”

অবশ্য, এটি পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক কবিকূলের মধ্যে একজন কবি যিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করেছেন মাত্র। বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পাদিত কবিতা পত্রিকার একটি প্রবন্ধ সংখ্যার (১৩৪৫, বৈশাখ) পরিকল্পনা করেছিলেন মূলতঃ কবিদের গদ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে। এরই সূত্রে জীবনানন্দ তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন যার নাম ‘কবিতার কথা’। এ প্রবন্ধের শুরুতেই আছে “কবি” সম্পর্কে স্বীয় ধ্যান-ধারণার সারকথাঃ
সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি;
কবি কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে, এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ একবার কবিদের কাজ সম্বন্ধে বিবৃত করেছিলেন যে,
“গানের বিষয়বস্তুকে আনন্দের সাথে তুলে ধরা
বাইরে নির্গত হয়ে আমার আত্মাকে ঐদিন পরিশোধিত করবে
যা কখনো ভুলে যাবার মতো বিষয় নয় এবং এখানে লিপিবদ্ধ থাকবে। (দ্য প্রিলুড বুক ওয়ান)”
ম্যারিয়েন মুরে কর্তৃক কবিদের কাজ সম্পর্কে বলেছেন যে,
“তারা প্রকৃতই সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেন। (পয়েট্রি)”

অন্যান্য অনেক কবি যেমনঃ ‘এইনিডে’ ভার্জিল এবং ‘প্যারাডাইজ লস্টে’ জন মিল্টন বর্ণনা করেছেন যে, ‘গ্রীক পুরাণে বর্ণিত কাব্য ও সঙ্গীতাদির দেবীরা তাদের আবেগিক কর্মকাণ্ড প্রয়োগের মাধ্যমে কবিদের কাজে সহায়তা করেন’। কবির বেদনা-বিদ্ধ হৃদয়ই কবিতার জন্ম-ভূমি। অর্থাৎ, সময়-বিশেষে কোন একটি বিশেষ সূত্রকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ-বেদনা যখন প্রকাশের পথ পায়, তখন জন্ম। কবি বেদনাকে আস্বাদ্যমান রস-মূর্তি দান করেন। ব্যক্তিগত বেদনার বিষপুষ্প থেকে কবি যখন কল্পনার সাহায্যে আনন্দমধু আস্বাদন করতে পারেন, তখন বেদনা পর্যন্ত রূপান্তরিত ও সুন্দর হয়ে উঠে। বেদনার যিনি ভোক্তা, তাঁকে এটি দ্রষ্টা না হতে পারলে তাঁর দ্বারা কাব্য-সৃষ্টি সম্ভব নয়। কবির বেদনা-অনুভূতির এ রূপান্তর-ক্রিয়া সম্বন্ধে ক্রোচে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে –
“Poetic idealisation is not a frivolous embellishment, but a profound penetration in virtue of which we pass from troublous emotion to the serenity of contemplation.”

কবিতা বা পদ্য শব্দের ছন্দোময় বিন্যাস যা একজন কবির আবেগোত্থিত অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তাকে সংক্ষেপে এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্ভাসিত করে এবং শব্দের ছন্দায়িত ব্যবহারে সুমধুর শ্রুতিযোগ্যতা যুক্ত করে। কাঠামোর বিচারে কবিতা নানা রকম। যুগে যুগে কবিরা কবিতার বৈশিষ্ট্য ও কাঠামোতে পরিবর্তন এনেছেন। কবিতা শিল্পের মহত্তম শাখা পরিগণিত।

পাঠক এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে যা পড়েছেন, তা আমার লেখা নয়। এতো সুন্দর উপস্থাপনা, বিশ্লেষণ, এবং বিশেষণ এর কোনটা আমার না। অনলাইন থেকে সংগ্রহ করেছি। তবে নিজে দু এক লাইন লেখি বলে বা লেখার চেষ্টা করি বলে এর সাথে আরও কিছু নিজস্ব ধারণা, যা একান্তই আমার নিজের। তা যুক্ত না করে পারলাম না। ইদানীং অনেক নতুন কবির কবিতাই চোখে পড়ে। পড়ার চেষ্টা করি। অনেক কবি দেখা যায়। কিন্তু কে কবি আর কোনটা কবিতা সেটা বোঝা মাঝে মাঝে সংশয় দেখা দেয়। নিজেও লেখি আর ভাবি আমি কি সত্যিই কোন কবিতা লিখেছি? বা যা পড়ছি তা কি আসলেই কবিতা? প্রশ্ন থেকে যায় সমাধান খোঁজার চেষ্টা করি। এতোটুকু বয়সে যতোটুকু পড়েছি বা জানার চেষ্টা করেছি, বুঝেছি তার মাত্র সামান্যই। আর যা বুঝেছি তাই আপনাদের মাঝে দুই লাইন লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করার দুঃসাহস দেখাচ্ছি। প্রিয় পাঠক, আমার আমি নিতান্তই ছোট সবে মাত্র ২০ ঘরে পা দিয়েছি মাত্র। আর পড়েছি যৎসামান্যই। নিজের পড়াশোনা, সেই সাথে রুটি রুজির সংগ্রামেই পরে থাকতে হয়। তার মাঝে সাহিত্যর রূপ, রস, গন্ধ, উপমা, অলঙ্কার খোঁজার মধ্য দিয়ে চেষ্টা করি সাহিত্যর মননে নিজেকে প্রকাশ করার। আমি ব্যর্থ বা সফল এ কথা এখনই বলার কোন কারণ নেই। পাঠক উপরের লেখার মাধ্যমে যা বলতে চেয়েছি হয়তো বা বয়সের দোষে বা অপরিপক্কতার কারণেই পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারিনি। এর দায়ভার আমি নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছি। আর আপনাদের প্রতি আহ্বান রইলো যে আপনারা যথাসম্ভব বেশি গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে আমার এই জানা এবং জানানোর প্রয়াসকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিবেন।

পাঠক এবার আমি আমার নিজের মতামত ব্যক্ত করবো কবিতা কি আর কবি কে এই বিষয়ে। পাঠক আগেই বলেছি সাহিত্য বিষয়ে আমার পড়াশোনা যৎসামান্যই। তবুও বলছি, কবিতা হল ব্যক্তি মানুষের সেই চিন্তার প্রকাশ যা সে কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাস্তবতার নিখুঁত চিত্র তুলে আনে। যেখানে উঠে আসে চাওয়া,পাওয়ার গড়মিলে হিসাব। দেওয়া না দেওয়ার মর্মবেদনা। চিন্তা- চেতনার সৃজনশীল প্রকাশের মাধ্যমে কবিতা হয়ে উঠে সার্বজনীন এক আঁধার। যেখানে লুকায়িত থাকে বিরহ, প্রেম, দেশ ব্যক্তি,যুদ্ধ,বিগ্রহ। আর কবি হল সেই যিনি আঁধার থেকে আলো কুড়িয়ে দীপ্ততা ছড়ায় সর্বময়। কবির কাছে নির্দিষ্ট কোন দেশ থাকে না। নির্দিষ্ট কোন ধর্ম থাকে না। কবি সকলের এবং স্থান কাল পাত্র ভেদে কবি একজন সার্বজনীন পয়গম্বর। তিনি তার দার্শনিক দৃষ্টিতে কলমের খোঁচায় সত্যকে নির্মমভাবে উপস্থাপন করেন মূলত তিনিই কবি। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি সত্য, সুন্দর, ও মঙ্গলের পূজারী না হবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি আর যায় হোক কবি বলে অভিধা প্রাপ্ত হতে পারে না। কবি রাষ্ট্র আর ব্যক্তির মাঝে যে দন্ধ, এবং দন্ধের মাঝে যে বিকাশ তাই একজন কবির লেখনির মাধ্যমে আঘাত করবে ব্যক্তি মানসের অন্তরে। যেন মানুষ মনে করি আরে আমি তো এটাই ভাবছিলাম। এটা তো আমিই বলতে চেয়েছিলাম। অর্থাৎ কবির হবে মানুষের। কবি হবে মানবতার। কবি হবে সত্য ও সুন্দরের পূজারী। আর কবিতা হবে এই অমোঘ সত্যর নির্দেশক।

আমাদের বাংলা সাহিত্যে অন্যতম প্রধান কবি যিনি আমার প্রকৃতির এবং রূপসী বাংলার কবি বলে খ্যাত তিনি যেমন কবিতার সাথে প্রকৃতির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন, আবার নজরুল সুকান্ত মানবতার জয়গান গেয়েছেন অবিশ্রান্ত। অন্যদিকে রবি ঠাকুর হয়েছেন সাহিত্যর প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। ঐতিহাসিক যেমন ইতিহাসের নিদর্শনকে বিশ্লেষণ করে ইতিহাসকে করেন পূর্ণাঙ্গ, ঠিক তেমনিই একজন কবি হয়ে উঠেন সার্বজনীন আলোর উৎস। তাই কবিতাকে বলা হয় দর্পণ, আর কবিকে বলা যায় সভ্যতা গড়ার অন্যতম সারথি।

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (দশম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (দশম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভাদুপুজো নিয়ে নানা পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। ভাদুকে অনেকেই লক্ষ্মী হিসেবে পুজো করেন। বলা হয় শস্যের দেবী। ধান ওঠার পরই চাষিদের ঘরে তাই ভাদুর আরাধনা হয়। ভাদ্র সংক্রান্তির দিন একটি পাত্রে ফুল রেখে ভাদুর বিমূর্ত রূপ কল্পনা করে পুজো করেন গ্রামের মেয়েরা। আবার বহু জায়গায় লক্ষ্মীর আদলে ভাদু মূর্তিও তৈরি হয়। প্রসাদ হিসেবে তৈরি হয় বিশেষ জিলিপি আর খাজা। পুজোর পর শেষ রাতে নদীতে ভাসানো হয় ভাদুকে। ভাদুর অন্যতম আকর্ষণ হল ভাদুগান।

বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলার অধিকাংশ বাড়িতেই ভাদ্র মাস এলেই একটা উৎসব শুরু হয়ে যায়। মহিলা’রা ছোট ছোট দল বেঁধে ভাদু’র মূর্তি নিয়ে এ বাড়ি সে বাড়ি করে বেরাবে। সে মূর্তি’র হাতে থাকবে ধানের শীষ, মিষ্টি, পান, সঙ্গে থাকবে নাচ, গান, আনন্দ আর তলে তলে ভাদু চলে যাওয়ার বেদনাও। চলে যাওয়ার বলছি, কারণ ভাদুকে নিয়ে যত গল্প আপনি শুনবেন, প্রত্যেকটির শেষ হচ্ছে ভদ্রেশ্বরী বা ভদ্রাবতী’র আত্মহনন দিয়ে। মানে যত ক্ষণ রয়েছে, প্রাণোচ্ছ্বল, আর যাওয়ার বেলা, করুণ সুর।

গল্পে আছে, পুরুলিয়া’র কাশিপুর অঞ্চলের রাজা নীলমণি সিংহ খোঁজ পেয়েছিলেন এই ‘সাক্ষাৎ লক্ষ্মীঠাকুর’-এর। ছোট্ট ভদ্রেশ্বরীতে এমনই মজে গেলেন নীলমণি, যে তাকে মনে মনে রাজকন্যা ভেবে ফেললেন। কিন্তু তার পালক পিতা তো ভদ্রেশ্বরীকে কিছুতেই কাছছাড়া করবেন না, অতএব সে থেকে গেল, ওই গ্রামেই। বড় হয়ে সে প্রেমে পড়ল পাশের গ্রামের অঞ্জনের। নীলমণি মানস-কন্যাকে আরও ভাল হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন, তাই অঞ্জনকে কারাগারে আটক করে রাখলেন। দুঃখিনি ভদ্রেশ্বরী এ বার, দুই সখাকে নিয়ে সারা রাজ্য ঘুরতে লাগল। চোখ খুঁজে চলেছে অঞ্জনকে আর মুখে গান। যদি অঞ্জন এক বার শুনে চিনে ফেলে…যত দিনে অঞ্জনকে মুক্তি দিলেন নীলমণি, তত দিনে ভদ্রেশ্বরী আর নেই, ভাদু হয়ে গিয়েছে, আর তার ওই গান, ভাদু গান।

ওই সব অঞ্চলের রুখা মাটিতে এই ভাদ্র মাসেই আউশ ধান পাকে আর সেই আনন্দ আরও বাড়িয়ে তোলে ভাদু পুজো। ধান চাষ করে ঘরে তোলার কাজটা মূলত পুরুষ’রা করলেও, ভাদু কিন্তু নারী-উৎসব। সারা বছরের হাড় ভাঙা খাটুনির পর এই সময়টাই তো খানিক মুখ তোলার অবসর। আর মুখ তুলে ও দেশের মেয়েরা যা বলেন, তার থোক মানে হল, আজ তাঁদের কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না, এমনকী মরদ’রাও না। আজ শুধুই ‘র্যান্ডম ফুর্তি’। ভাদু গানে বলে ‘ভাদু পুজার দিনে, সারা রাত উড়াব ফুর্তি হে, কাটাব জাগরণে, বাকি আজ রাইখনা কিছু, যা ইচ্ছা মনে, রাখ লোক-লজ্জা, দাও দরজা, মহাপুজা এইখানে…’

যেটা বেশি করে চোখে পড়ছে, তা হল নারী’র মুখের, শরীরেরও, স্বাধীন ভাষা, ভঙ্গি। খেয়াল করলে হয়তো দেখবেন, এই অবস্থা, বছরের অন্য কোনও সময়ে পাওয়া যায় না। এই সময়ে, মহিলা’রা দল বেঁধে উঠোনে জমিয়ে গান বাঁধেন। গান শুরু হয় এক জনের মুখ থেকে, তার পর চক্কর খেতে খেতে যায় অন্যের কাছে, এমনটা চলতে থাকে, যত ক্ষণ না একটা গোটা গান তৈরি হয়ে যাচ্ছে। গান বানাচ্ছেন মেয়েরাই, কিন্তু এখন ও সব অঞ্চলে গেলে দেখবেন, অনেক চটি বই পাওয়া যায় (অনেকটা কিশোর-রফি’র লিরিক বইয়ের মতো), যেখানে ভাদু গানের কথা লিখে ছাপাচ্ছেন কিছু পুরুষও, অবশ্যই নারীর স্বরে। ঠিক যেমন বিচ্ছেদী গানে রাধা’র ব্যথার কথা লেখেন পুরুষ’রা। এই সব গানে যেমন ঝুমুর গানের প্রভাব খুব থাকে, তেমনই দেখা যায় যে রামপ্রসাদী সুরেরও অসম্ভব ঝোঁক। বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কিন্তু এটা, কারণ রামপ্রসাদী গানের ধুয়ো ধরে লোক সঙ্গীতে বিশেষ চর্চা হয় না।

পৌরাণিক ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়কেই ভাদু গানে তুলে ধরা হয়। মূলত পাঁচালির সুরেই চার লাইনের ভাদুগান গাওয়া হয়। সারারাত জেগে গান গাওয়ার পর শেষ রাতে সকলে মিলে ভাদুকে বিসর্জন দিতে যান। সেই সঙ্গে করুণ সুরে সকলে গেয়ে ওঠেন…

‘ভাদু যায়ো না জলে
কোলের ভাদু যায়ো না মোদের ছেড়ে
গটা ভাদর থাকলে ভাদু গো
মা বলে ত ডাকলে না
যাবার সময় রগড় লিলে
মা বিনে ত যাব না’।

www.youtube.com/watch?v=hicuD8Kl74Y

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (নবম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (নবম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

নদীর ধারে একটু জটলা। দূর থেকে ভেসে আসে গান – “কাশীপুরের রাজার বিটি/বাগদি ঘরে কী কর?/কলসী কাঁখে লয়ে পরে/ সুখ সাগরে মাছ ধর।” সারিবদ্ধ মহিলাদের কোলে-কাঁখে ছোট্ট মূর্তি। যেন কচি মেয়েকে কোলে নিয়ে জলাধারে গিয়েছেন মায়েরা। কার মেয়ে কত ভাল, সেই নিয়ে গান বেঁধে লড়াই চলে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই এই গানের রেশ কেটে যায়। জলে ফেলে মেয়ের বিসর্জন হয়ে যায়। চেনা লাগছে গল্পটা? দুর্গা বিদায়ের সঙ্গে মিল পাচ্ছেন?
দেবী দুর্গার আবাহন-বিসর্জনের মতো শস্যদেবী আসেন, আবার চলে যান।

উমার মতোই ভাদুও আমবাঙালির ঘরের মেয়ে। লোক উৎসবের কাহিনিতে কান পাতলে শোনা যায়, কাশীপুরে পঞ্চকোট রাজবংশের রাজা নীলমনি সিং দেও-র কন্যা ভদ্রেশ্বরী। যদিও এ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। সেই বিতর্ক সরিয়ে রেখেই শুধুমাত্র কাহিনির মাধুর্যেই এই পার্বণ হয়ে উঠেছে চিরায়ত, লোকায়ত। তো সেই রাজা নীলমণি সিং দেও কিশোরী কন্যার অকাল প্রয়াণের পর তাঁর স্মৃতি আঁকড়ে রাখতে ভাদু উৎসবের প্রচলন করেন। এখন তাই কাশীপুরেই সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে ভাদুর নিয়মনীতি পালন।

ভাদ্র সংক্রান্তির ঠিক আগে পুরুলিয়া, বাঁকু়ড়ায় পুরোদমে চলছে ভাদুর আরাধনা। তবে এই আনন্দের একতারাতেও আজকাল বিষাদ বেজে ওঠে। না আছে সেকালের গানের কথা, না আছেন গায়ক। ভাদু উৎসব যেন অনেকটাই পঞ্জিকায় পিঞ্জরাবদ্ধ। মেয়ে-বউদের প্রাণের সুর বসানো গানে গানে যেন হঠাৎই সজীব হয়ে উঠত চারপাশ। কিন্তু আজ গান আছে, প্রাণ নেই, সুর গেছে কেটে।

এখন ভাদুর সুরে শোনা যায় বিজ্ঞাপনের কথা – “সিম এসেছে জিও/ এবার কিন্তু যাবার আগেই আমায় একটা দিও/ গত বছর স্পিড ছিল না/ টুজি–থ্রিজির জন্য/ ফোর জি যখন এসে গিয়েছে/ এবার ব্যাপার অন্য।”
আগে পয়লা ভাদ্র থেকেই ভাদুর মূর্তি কিনে ফি সন্ধ্যায় প্রায় রাত পর্যন্ত গান গাইতেন মহিলারা। কাশীপুরের ন’পাড়ার বাসিন্দা শিবানী বাউড়ি বলেন, “আমাদের গান গাওয়ার সঙ্গীরা সব ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছেন। অনেকে মারাও গিয়েছেন। তাই আর আগের মত সমগ্র ভাদ্র মাস জুড়ে গান হয় না। এখন কেবল ভাদ্র শেষে জাগরণেই আটকে গিয়েছে ভাদু গীত।” লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায়ের কথায়, “তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর বলেছিল, ভাদু গানকে সংরক্ষণ করতে তারা একটা সংকলন করবে। কিন্তু আজও সেই কাজ এগোয়নি। তবে আমার কাছে সংগ্রহ করা আড়াইশো গান রয়েছে।” সেই গানে–গানেই হয়ত আজকের রাত্রি জাগরণ পঞ্চকোটের।

আর উৎসব মানেই তো পেটপুজো। তাই ভাদুকে সামনে রেখে খাজা, কোস্তা, লবঙ্গ লতিকা, গজা, মতিচুরের লাড্ডু, চিনির পুতুল। ভাদুর জাগরণ–বিসর্জনে এই হরেকরকম মিষ্টান্নতে ম–ম করত পঞ্চকোট। এই পঞ্চকোটের রাজসভায় ভাদু উৎসবে পঁচিশ কেজির লাড্ডু তৈরি হত। ভাদুকে দেওয়া হত একান্ন রকমের মিষ্টি। কিন্তু আজ সেসব অতীত। ভাদু জাগরণে মিষ্টি নিয়েও শোনা গেল গান। এই মিষ্টি নিয়েও রয়েছে ইতিহাস। এই পরবের মিষ্টি চেখে দেখতেন স্বয়ং ছোটলাটও। তাই ভাদু পরবের মিষ্টি বানানোকে ঘিরে কম তোড়জোড় ছিল না এই ভাদুভূমে।

সেইসময় পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজপরিবারে যে দোকান থেকে মিষ্টি যেত, সেই দোকানের বর্তমান মালিক চিত্তরঞ্জন দাস মোদক বলেন, “ভাদু–র সময় ছোটলাটের কাছে মিষ্টি পাঠানো হত। দু’কেজি ওজনের লাড্ডু, থালার মত জিলিপি দোকানে সুতোয় বেঁধে ঝোলানো থাকত। এমনকি লাড্ডু–জিলিপির নিলাম হত। সারা ভাদ্র মাস জুড়ে যে কত রকমের মিষ্টি তৈরি করতেন বাপ–ঠাকুরদা! এখন সেসব শুধুই স্মৃতি।”

www.youtube.com/watch?v=FL5GaUk_zXI

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (অষ্টম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (অষ্টম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভাদু উৎসব ভাদ্র মাসের উৎসব। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিনে ভাদু পুজো হয়ে থাকে। ব্রতের ক্ষেত্রে ভাদ্র মাসের প্রারম্ভেই শুরু হয় মেয়েলি ব্রত। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এবং লাগোয়া, বিহার, ঝাড়খণ্ডের দু-একটা জেলায় প্রধানত ভাদু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

আদিবাসী, সাঁওতালদের মধ্যে করম গান ও উৎসবে পালন করার রীতি রয়েছে বর্ষাকালে। তা-ও বিশেষ ভাবে ভাদ্র মাসে। বর্ষা উৎসবের এই করম গানের হিন্দু সংস্করণ হিসেবে ভাদু গানকে ধরেছেন আশুতোষ ভট্টাচার্য। তিনি ভাদু গানকে আর্যেতর সমাজ উদ্ভূত ধরে, হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতার প্রভাবজাত বলেছেন।

পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুরের কিছু অংশ, আসানসোল মহকুমা, ঝাড়খন্ডের রাঁচি, হাজারিবাগে পালিত হচ্ছে এই উৎসব। কথিত আছে, পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজকন্যা ভদ্রাবতীর বিয়ের দিন বিয়েবাড়িতে ডাকাত পড়ে। সেখানেই খুন হন বরযাত্রী সহ ভদ্রাবতীর স্বামী। আর সেই শোকেই আত্মহত্যা করেন ভদ্রাবতী।

এই ঘটনা স্মরণ করেই ভাদু পুজো।
যাছ যাছ যাছ ভাদু
ক্ষনেক দাঁড়াও আঙিনাতে।
সম্বৎসরের মনের কথা বলব্য তুমার সাক্ষাতে।।”

এই ভাদু পরবের ও মূল সম্পদ এই ভাদু গানগুলো।এই ঝুমুর গানগুলো বেশিরভাগই প্রচলিত।একসময় একমাসব্যাপী ভাদু গানের আসর বসত কাশীপুর রাজবাড়িতে।এই গানগুলোর মধ্যে বাড়ির মেয়েদের সাংসারিক,সামাজিক,গার্হস্থ্য জীবনের না সুখ-দুঃখ,হাসি-কান্না,আশা-নিরাশার কথা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়।

এই গানগুলোকেও বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা যায় –
১.আগমনী
২.ভাদু বন্দনা

তাই এই গানগুলো লোকসাহিত্যের অন্যতম সম্পদ। তাই এককথায় বলাই যায় মানভূমের এই পরব এক সার্বজনীন মিলনক্ষেত্র।

www.youtube.com/watch?v=FL5GaUk_zXI

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (সপ্তম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (সপ্তম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভাদু আদতে লোকজীবনের সঙ্গে লেপ্টে থাকা মেয়েদের গান। শুধু তাই নয়, ভাদু আসলে লোকউৎসবও। যে গান, যে উৎসবের গড়ন, রীতি ঐ রাজপরিবারের দরবার ছাড়িয়ে নেমে এসেছে মাটিতে। এ কেমন করে সম্ভব? ভদ্রাবতীকে নিয়ে আরেকটি গল্পে হয়তো রয়েছে এর ইঙ্গিত। সেই গল্পে ভদ্রাবতী রাজার ঔরসজাত রাজকন্যে নয়।

লাড়া গ্রামের মোড়ল এক ভাদ্রমাসে ধানখেতের আলের পাশ থেকে কুড়িয়ে পেলেন ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানকে। তাকে কোলে নিয়েই মোড়ল বুঝলেন, শিশুটি সদ্যোজাত। কে জানে, হয়তো এই উর্বরা ভূমিই জন্ম দিয়েছে তার। যেভাবে ভূমি জন্ম দিয়েছিল সীতারও। মোড়ল শিশুটিকে নিয়ে এলেন ঘরে। সেই ভাদ্র ছিল রোদে পোড়া, খটখটে। কিন্তু, এই মেয়ে ঘরে আসতেই বৃষ্টি এল ঝেঁপে। ধান হল খুব। সবাই বললে, এ মেয়ে ভারী লক্ষ্মীমন্ত। মোড়ল-দম্পতি মেয়ের নাম দিলেন ভদ্রাবতী। ডাকনাম ভাদু। ভাদুর রূপ হল খুব। চাষির ঘরে এমন রূপ মানায় না। রাজা নীলমণি সিংদেওর কানেও গেল ভাদুর কথা। মন্ত্রী ধ্রুবচাঁদকে রাজা বললেন, ওই মেয়েকে তিনি দত্তক নেবেন। রাজপরিবারই ওর যোগ্য স্থান। কিন্তু, ভাদু কিছুতেই যেতে চাইল না বাবা-মাকে ছেড়ে। তখন রাজা গ্রামে-গ্রামে ঢেঁড়া পিটিয়ে বলে দিলেন, রাজপ্রাসাদে না থাকলেও ভদ্রাবতী রাজকন্যেই।

ভাদু তখন ষোড়শী। তার কানে উজিয়ে আসে বাঁশির সুর। গ্রামের কবিরাজের ছেলে অঞ্জন সেই বংশীবাদক। মন দেওয়া-নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে, হইহই করে পঞ্চকোটেও এসে পড়ে ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের আগুন। বিদ্রোহে মদত দেওয়ার অভিযোগে ইংরেজদের হাতে বন্দি হন রাজা নীলমণি সিংদেও। রাজা বন্দি, এদিকে রাজকন্যে প্রেমে পড়েছে কবিরাজপুত্রর। মন্ত্রী ধ্রুবচাঁদের দুশ্চিন্তা বাড়ে। রাজা মুক্তি পেতেই সে জানায় সবটা। ক্রুদ্ধ রাজা বন্দি করেন অঞ্জনকে।

অঞ্জনের কয়েদের খবরে ছুটে আসে ভদ্রাবতী। তার করুণ আকুতিতেও মন গলে না রাজার। তখন ভাদু, দিনের পর দিন হৃদয় নিঙড়ানো করুণ গান গেয়ে ঘুরতে থাকে কয়েদখানার চারপাশে। সেই গানে একদিন মন গলল রাজার। অঞ্জনকে মুক্তি দিলেন তিনি। কিন্তু, ভাদুর খোঁজ আর মেলে না। কেউ বলল, ভাদু শোকে আত্মঘাতী হয়েছে নদীর জলে। কেউ বলল, আকাশ থেকে মাটিতে নেমেছিল ভাদু, আবার ফিরে গেছে আকাশেই। বাকিরা বলল, ভাদু ভেসে গেছে নদীর কান্নার সঙ্গে। সেই থেকে ভাদুর গান ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের নানান কোণে।

এই গল্প বিশ্বাস করতে বড়ো সাধ হয়। যদিও, বীরভূমে গেলে দেখা যাবে ভদ্রাবতী নাকি পুরুলিয়ার নন, হেতমপুরের রাজকন্যে। বর্দ্ধমানের রাজপুত্রকে মন দিয়েছিল সে। ইলামবাজারের কাছে চৌপারির শালবনে ডাকাতরা যখন মেরে ফেলল রাজুপুত্রকে, তখন তাঁর সঙ্গেই সহমরণে গেছিল ভদ্রাবতী। সেই যন্ত্রণার ইতিহাসই নাকি বোনা ভাদু গানে।

www.youtube.com/watch?v=HzCUvwC7fUg

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (ষষ্ঠ পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (ষষ্ঠ পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

কাশীপুরে দেখে আইলাম / দালান কোঠায় টিকটিকি / এমনই বাবার বিবেচনা / এক জামাইকে দুই বিটি। লালপাড় শাড়ি পরে কোমর দুলিয়ে ঢোলের নিখুঁত বোলের সঙ্গে গাইছেন শঙ্করী দাস, কুমকুম দাসরা। কাটোয়ার চুড়পুনি গ্রামের দাসপাড়ার অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মহিলারা বছর বছর ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন ভাদু গাইতে বেরিয়ে পড়েন। মাটির তৈরি ভাদু ঠাকরুণকে নিয়ে। কাটোয়া মহকুমার নানা গ্রাম ঘুরে পয়লা আশ্বিন গঙ্গায় স্নান করে ঘরে ফেরেন।

ভাদু গানের মতো পুরনো লোকগানকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে চুরপুনি দাসপাড়া। বিভিন্ন জায়গায় ভাদু দলে পুরুষরা মেয়ে সেজে গান–নাচ করেন। কিন্তু চুড়পুনির ভাদু গাওনার পুরো দলটিই মহিলাদের। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের ১৩ জন মহিলার দলটি ভাদ্র মাস পড়লেই সংসারের যাবতীয় কাজ সামলে মহড়া শুরু করে দেন। মূল গায়েন শঙ্করী দাস গান ধরেন, মাটি ফুঁড়ে জল সরে / ভাদুকে কে সাজাইছে। দলের অন্যান্য সদস্য সুমিত্রা দাস, কুমকুম দাসরা ধরতাই দেন, সেই জলে জমি আবাদ হছে / ভাদুকে কে সাজাইছে।

কাটোয়ার লোকসংস্কৃতি গবেষক রণদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ভাদুকে সামনে রেখে গাওনার দলের সদস্যরা তাঁদের রাগ–দুঃখ–জ্বালা–অভিমান–আনন্দ গানের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এই গানে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার প্রকৃত ছবিটা ধরা পড়ে। শস্যকন্যা ভাদুর মধ্যে নিজেকে খোঁজার এই ধারাটিই ভাদু গানের নজরটানা বৈশিষ্ট্য। শুধু কাটোয়া মহকুমাই নয়, দক্ষিণবঙ্গের বীরভূম, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, পুরুলিয়া জেলাতেও ভাদ্র মাসজুড়ে ভাদু গানের উৎসব চলে।’ গায়িকা শঙ্করী–কুমকুমরা প্রশাসনকে কুর্নিশ জানিয়েছেন। তঁারা বলেন, ‘আমাদের দলে সকলে মহিলা।

কিন্তু আমরা নিরাপদেই গ্রামে গ্রামে ঘুরতে পারছি। এটা খুবই ভাল ব্যাপার।’ ভাদুকে ফসলের প্রতীক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। শ্রাবণ মাসে ধান রোয়া–সহ চাষবাস শেষ হয়ে যায়। ভাদ্র মাসটা কৃষক পরিবারের সদস্যদের কাছে অখণ্ড অবসর। সেই অবসর যাপনের জন্য বিনোদন হিসেবে ভাদু গানের উৎপত্তি বলে মনে করেন লোক গবেষকরা। ভাদু–মূর্তিকে সামনে রেখে ফসল ভাল হওয়ার প্রার্থনা করেন শিল্পীরা। অঝোর বৃষ্টি চান গানে গানে, চল্ ভাদু চল্ / মেঘে এল জল / ভিজে গেল দামি শাড়ি / ভেঙে গেল মল। কাটোয়ার বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি বলেন, ‘বর্তমান রাজ্য সরকার ভাদু–সহ বাংলার বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি বঁাচাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন। লোকশিল্পীদের মাসোহারার ব্যবস্থা করেছেন। বাংলার লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতির শাখাগুলিকে বঁাচাতে এমন পদক্ষেপ এর আগে কেউ নেয়নি।’

ভাদু গান গেয়ে ঘুরে বেড়ানোর শিল্পীরা কোনও পারিশ্রমিক দাবি করেন না। যার যা মন চায় দেন শ্রোতা–দর্শকরা। তাতেই খুশি শিল্পীরা। তবে দক্ষিণা দাবির কৌশলটিও বেশ। দাবি করা হয় গানের কলিতেই, ভাদু লে লে লে পয়সা দু’আনা / কিনে খাবি মিছরিদানা। সেই আবেদনে পয়সার বটুয়া উপচে পড়ে। শিল্পীদের হাসি চওড়া হয়। টিভি–মোবাইলের যুগেও মানুষ ভাদু গান শুনছেন, এটাই শিল্পীদের প্রাপ্তি। সেই প্রাপ্তির আনন্দই গানে গানে ঝরে, এক পিঠ চুল ভাদুর / পিঠের পরে রহে না/ শাশুড়িতে তেল দেয় না / চুলের যতন জানে না।

www.youtube.com/watch?v=6hhY_72Olx0

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (পঞ্চম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (পঞ্চম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভাদুর রাত জাগরণ এই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণীয় অংশ।ত্রিশ দিন ধরে ভাদুকে পুজো করার পর কাল ভাদুকে বিদায়ের দিন।তাই পাড়ায় পাড়ায় চলে নিশি জাগরণ।ভাদুর উপাসক মেয়েদের কাছে ভাদু হয়ে ওঠে কখনও মা,কখনও মেয়ে আবার কখনও দেবী।তাই গানের মাধ্যমে তাদের আদরের ভাদুর কাছে নিবেদন করে তাদের সুখ-দুঃখ,অভাব-অভিযোগ।

অবিচ্ছিন্ন ভাবে সারারাত ধরে চলতে থাকে ভাদু গানের ফোয়ারা।রাত কেটে হয় ভোর,ভোর থেকে সকাল এগিয়ে আসে ভাদুকে বিদায়ের মুহূর্ত।

সারারাত ব্যাপী রাতজাগরণের পর বাড়ির মেয়েরা সকালে ভাদুকে বিসর্জন দেয়ার জন্য তৈরি হয়।এই সময় তা বড় আবেগঘন মুহুর্ত তাদের কাছে।তাই আবেগরুদ্ধ কন্ঠে গেয়ে ওঠে ভাদুর বিদায় সঙ্গীত।

“তিরিশ দিন রাইখলাম ভাদু তিরিশ টিফুল দিয়ে
আর ত রাইখতে লাইরবঅ ভাদু চাতা হইলঅ বাদী গো।”

ভাদু কে বিসর্জন দেওয়ার আগে ভাদু র মৃন্ময় মূর্তিকে বাড়ির ও গ্রামের সবাই বরণ করে। একে বলা হয় চুমানো। এরপর ভাদু কে মাথায় করে সারাগ্রাম ঘুরে ভাদু কে কোনও নদীতে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। জলাশয়ে আদরের কন্যাকে বিদায় দিয়ে সমস্ত গ্রামের মহিলারা সমবেতভাবে আবেগঘন কন্ঠে গেয়ে ওঠে-
আন্যেছি শখের ভাদু,রাখ্যেছি ঘরে।
পুরাব মনের আশা,ভাঁসাব জলে।।

ভাদুকে জলে বিসর্জন দেওয়ার পর চিড়া-গুড়-ঘি-মধু-বাতাসা মাখানো প্রসাদ বিতরণ করা হয় সকল গ্রামবাসীদের। ভাদু পুজোয় ভাদুকে ভোগ নিবেদন।
ভাদুর মূল প্রসাদই হল প্রমাণ সাইজের জিলিপি এবং মিষ্টি খাজা।

এই ভাদু পরবের ও মূল সম্পদ এই ভাদু গানগুলো।এই ভাদুর গানগুলো বেশিরভাগই প্রচলিত। একসময় একমাসব্যাপী ভাদু গানের আসর বসত কাশীপুর রাজবাড়িতে।এই গানগুলোর মধ্যে বাড়ির মেয়েদের সাংসারিক,সামাজিক,গার্হস্থ্য জীবনের না সুখ-দুঃখ,হাসি-কান্না,আশা-নিরাশার কথা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়।

https://www.youtube.com/watch?v=vdQE4RiU-xI&list=RDvdQE4RiU-xI&start_radio=1&t=24

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (চতুর্থ পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (চতুর্থ পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভাদুর সময়কাল ও ভাদু পালন:
ভাদু পুজো প্রতি বছর ভাদ্র সংক্রান্তিতে জাঁকজমক সহকারে অনুষ্ঠিত হয়। যদিও এর প্রস্তুতি শুরু হয়ে প্রায় এক মাস আগে থেকেই। ভাদ্র মাসের শুরু থেকেই গ্রামের বাড়ির একটি নির্দিষ্ট স্থানে ভাদুর পিঁড়ি বা চৌকি স্থাপন করে। প্রতিদিন স্নান করে এসে বাড়িয়ে সকল মেয়েরা ভাদু পিঁড়িতে ফুল দিয়ে, ধুপ জ্বালিয়ে ভাদুর উদ্দেশ্যে প্রণাম করে এবং ভাদু গান গেয়ে চলে আরাধনা।

এই ভাবে একমাসব্যাপী চলার পর অবশেষে আসে ভাদ্র মাসের সংক্রান্তি। তবে এর আগের দিন হয় ভাদু ‘রাত জাগরণ’। এই দিন সকাল বেলা বাজার থেকে পিঁড়িতে ভাদুর মৃন্ময় মূর্তি কিনে এনে, তাকে মনের মত করে ফুল-মালা দিয়ে সাজিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর সারারাত ধরে চলে গানের মাধ্যমে চলে ভাদু র আরাধনা।

“তিরিশ দিন রাইখলাম ভাদু তিরিশ টিফুল দিয়ে
আর ত রাইখতে লাইরবঅ ভাদু চাতা হইলঅ বাদী গো।”

তবে ভাদু কে বিসর্জন দেওয়ার আগে ভাদু র মৃন্ময় মূর্তিকে বাড়ির ও গ্রামের সবাই বরণ করে। একে বলা হয় চুমানো। এরপর ভাদু কে মাথায় করে সারাগ্রাম ঘুরে ভাদু কে কোনও নদীতে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

ভাদুকে বিসর্জনের আগে আরও একবার গ্রামের সবাই মেতে ওঠে ভাদু গান ও নাচে। এরপরই তাদের আদরের ভাদু ধন কে বিদায় দেওয়ার পালা, যদিও তাদের মন চায় না। তবুও নিয়ম তো মানতেই হয়।গ্রামের কোনো মহিলা ভাদুকে মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে জলাশয়ে।

জলাশয়ে আদরের কন্যাকে বিদায় দিয়ে সমস্ত গ্রামের মহিলারা সমবেতভাবে আবেগঘন কন্ঠে গেয়ে ওঠে-
“যাছঅ যদি ভাদুমনি কাঁদঅ কেনে অকারণ।
আর বছরে থাকি যদি আইনব গো প্রাণধন।”

www.youtube.com/watch?v=lrSzhR8f4pk

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (তৃতীয় পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (তৃতীয় পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

সমগ্র মানভূম এলাকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক উৎসব হল ভাদুপরব। এই পরবের উৎস সম্পর্কে নানা লোকগাথা প্রচলিত আছে। তবে বিশেষজ্ঞদের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত এর উৎস পুরুলিয়া জেলার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজবাড়ী। এই রাজবাড়ীর থেকেই এই ভাদু পরবের সূচনা। ধীরে ধীরে এই পরব ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র পুরুলিয়া জেলায়। আবার পাশাপাশি অবস্থানের জন্য এই পরব ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান জেলায়।

কিন্তু ভাদু পুজো কেন হয়? ভাদুর পরিচয়ই বা কি? এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকলেও সবচেয়ে জনপ্রিয় মতবাদটি হল-কাশীপুরের পঞ্চকোটরাজ নীলমণি সিং দেও-র এক কন্যা ছিলেন,যার নাম ভদ্রাবতী। খুব অল্প বয়সেই এই কন্যার মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় শোকে মুহ্যমান রাজা প্রজাদের আদেশ দেন তাদের প্রিয় রাজকুমারী কে নিয়ে গান রচনার। প্রজারাও সেই আদেশ মেনে রাজকুমারীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে গান গাইতে থাকেন ও উৎসবের আয়োজন করেন।

কাশীপুরের রাজার বিটি বাগদীঘরে কি কর।
হাতের জালি কাঁধে লয়ে সুখ সায়রে মাছ ধর।।

কাশীপুরের মহারাজা সে করে ভাদুপুজা
সন্ধ্যা হলেই ঝারইল বাজে থালে জিলিপি খাজা।

এই উৎসব কারা পালন করে সেই নিয়েও প্রচুর মতভেদ। তবে এটা বলা যায় যে এই উৎসব এই উৎসব সমগ্র মানভূম এলাকায় এক সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। ভাদু পুজোয় ভাদুকে ভোগ নিবেদন। ভাদুর মূল প্রসাদই হল প্রমাণ সাইজের জিলিপি এবং মিষ্টি খাজা।

আমার ভাদু মান কইরেছে, মানে গেল সারা রাইত।
খুল ভাদু মানের কপাট, পায়ে ধরে প্রাণনাথ।।

www.youtube.com/watch?v=KLuYvOpsDjg

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব-২০২০ (দ্বিতীয় পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (দ্বিতীয় পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

youtube.com/watch?v=-KgWdcD7f0A

ভাদু লে লে লে পয়সা দু আনা, কিনে খাবি মিছরির দানা। এই সেই জনপ্রিয় ভাদু গান, কয়েকবছর আগে পর্যন্ত এই গান গেয়ে এবং নিচে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত বেশ কিছু ভাদু শিল্পীদের ভাদ্র মাসে।

কিন্তু বর্তমান মুঠোফোন, অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম ইত্যাদির আড়ালে দুই দশক ধরে এই ভাদু গান এবং ভাদু শিল্পীরা লুপ্তপ্রায়। ভাদ্র মাসের দিনের বেলায় প্যাঁচপ্যাঁচে গরমে অথবা সন্ধ্যার পর আর সচরাচর দেখা যায় না এই সকল ভাদু শিল্পীদের। অথচ কয়েক বছর বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, পুরুলিয়ার মত রাঢ় বাংলায় গ্রামে গ্রামে দেখা যেত এই সকল ভাদু শিল্পীদের।

তবে বীরভূমে বেশকিছু গ্রামের সাধারণ দিনমজুর সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ এই ডিজের যুগেও টিকিয়ে রেখেছে এই ভাদু শিল্পকে। ভাদ্র মাসের পহেলা তারিখ থেকে একটি মেয়েকে ঘাগরার মত শাড়ি পরিয়ে ও মাথায় ওড়না দিয়ে ভাদু সাজিয়ে গানের সঙ্গে নাচানো চিরাচরিত রীতি। আর মাটির ভাদু মূর্তি কোলে করে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে টাকা পয়সা আদায় করে ভাদু শিল্পীরা। ভাদু শিল্পীরা মুখে মুখে রচনা করেন গান, তাদের গানে উঠে আসে তাদের জীবন যন্ত্রণার প্রসঙ্গ, উঠে আসে সামাজিক বিষয়। ঢোল, হারমোনিয়াম, কাঁসা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান শোনান ভাদু গানের লোক শিল্পীরা।

এই ভাদু গানের পিছনে আছে এক রাজকুমারীর করুণ কাহিনী। পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিং দেওরের কন্যা ছিল ভদ্রাবতী বা ভাদু। তাঁর বিবাহের ঠিক হয় বীরভৃমের এক রাজপুত্রের সঙ্গে। বিয়ের দিন বিবাহ করতে আসার পথে ডাকাতদলের হাতে খুন হন ভদ্রাবতীর হবু স্বামী।শোকে মুহ্যমান হয়ে ভদ্রাবতী আত্মঘাতী হয়।
কারও মতে ভদ্রাবতী বা ভাদু চিতার আগুনে আত্মাহুতি দেয়। আবার কারো মতে জলে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুকে বেছে নেয়।রাজার প্রিয় ভদ্রাবতীকে জনমানসে স্মরণীয় করে রাখতে রাজা নীলমণি সিং দেওর ভাদু গানের প্রচলন করেন। ভাদু একটা লোকগান কিন্তু তার প্রচলন রাজপরিবারের হাত ধরে।আর তা শুরু হয় পয়লা ভাদ্র থেকে ভাদু পুজোর মধ্য দিয়ে।

একসময় এই ভাদুগান এবং ভদ্র শিল্পীদের ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিপুল উত্সাবহ দেখা গেলেও বর্তমান প্রজন্ম আর এই ভাদু গান নিয়ে তেমন উত্সা্হ দেখায় না। ফলত এই সকল ভাদু শিল্পীদের আয় হয় যত্সািমান্য। তাই শিল্পীরাও বর্তমানে রোজগারের তাগিদে যুক্ত হয়ে পড়ছেন অন্য কাজে।

একসময় বীরভূমের রতন কাহার এর হাত ধরে ভাদু গান খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। মহঃবাজারের সুদন দাস এখনও পর্যন্ত ভাদ্র মাস এলে দলবল নিয়ে ভাদু গান শোনানোর জন্য বেরিয়ে পড়েন গ্রামে গ্রামে। বৃদ্ধ সুদন দাস ভাদু শিল্পী হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছেন, মাসে মাসে পান ভাতাও। কিন্তু তাঁর আক্ষেপ, আর আগের মত এই গান শুনতে লোক হয়না।
হিমাদ্রি মন্ডল, বীরভূম থেকে

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা-1
কথা – আঞ্চলিক সুর – অপ্রচলিত
(তাল- দাদরা)

ও ভাদু মা ও ভাদু মা ফেলছো কেনো চোখের জল,
কি হয়েছে বলো মা আমায় খেতো দেবো রম্ভা ফল।
ও ভাদু মা ও ভাদু মা……..

আমার ভাদু রাগ করেছে কথা সে আর কইবে না,
ও ভাদু মা এই বয়েসে রাগ করা আর সাজে না।
ও ভাদু মা ও ভাদু মা……..

ও পাড়া যেও না ভাদু মা, ও পাড়া যেতে মানা,
ও পাড়াতে সতীন আছে ধরলে পরে ছাড়ে না।
ও ভাদু মা ও ভাদু মা……..

ওপর কুলি নামু কুলি মাঝ কুলিতে গোল হচ্যা,
আমার ভাদু ছুটু ছ্যালা ঘরে ফিরতে লারিছ্যা।
ও ভাদু মা ও ভাদু মা……..

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- (প্রথম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদু গান ও ভাদু উত্সব- (প্রথম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

১৮৫৭ -র মহাবিদ্রোহে যে রাজারা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পঞ্চকোটরাজ নীলমণি সিংহ দেও। পুরুলিয়ার প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতি গবেষক দিলীপ গোস্বামী বলেন, ‘লোককথা অনুযায়ী, নীলমণি সিংহের কন্যা ছিলেন ভদ্রাবতী বা ভাদু। তাঁর অকালমৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিতে ভাদু উত্সবের প্রচলন হয় রাজবাড়িতে।’

ভাদ্র মাসের পয়লা দিনে রাজবাড়িতে ভাদুর মূর্তি স্থাপন করা হত। অন্তঃপুরের মহিলারা প্রতি রাতে ভাদুর সামনে বসে গান করে ভাদু উত্সব করতেন। ভাদ্র সংক্রান্তির দিন সারা রাত জেগে হত ভাদু উত্সব। এই দিনটিকে বলা হয় ভাদুর জাগরণ। পয়লা আশ্বিন ভাদু বিসর্জন। কাশীপুর রাজবাড়িতে সুনসান গেটের সামনে নির্লিপ্ত বসেছিলেন অবাঙালি দারোয়ান। ভাদুর কথা উঠতেই বলে উঠলেন, ‘এখানে কে ভাদু করবে ? রাজকন্যা লখনৌতে থাকেন। আসেন পুজোর সময়৷’

লোককথা অনুযায়ী, কারাবন্দি প্রেমিক অঞ্জনের খোঁজে গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে বেরিয়েছিলেন ভাদু। তাই মন্ত্রোচ্চারণ নয়, লোকায়ত সুরেই হয় ভাদুর বন্দনা। নিবেদন করা হয় খাজা -গজা, জিলিপি, লাড্ডু। নীলমণি সিংহের রাজত্ব বাজেয়াপ্ত করেছিল ব্রিটিশরা। সেই রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য নীলমণি ব্রিটিশ আদালতে আবেদন করেছিলেন। রাজার আইন উপদেষ্টার চাকরি নিয়ে সেই সময় পুরুলিয়া আসেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। রাজবাড়ির ভাদু উত্সবে যোগ দিতেন কবি। লিখেছিলেন কয়েকটি ভাদু গানও।

ঐতিহ্যের এই ভাদু উত্সব এখন রাজবাড়ি থেকে হারিয়ে গেলেও টিকে রয়েছে কাশীপুরের কিছু মহল্লায়। সঞ্জয় সূত্রধর, ষষ্ঠীপদ বাউড়ি, বাবলু মোদক, সুশীল শা -রা এখনও ভাদ্র সংক্রান্তিতে ভাদু গানের আসর বসান। তবে তা রাজকীয় মর্যাদা পায় না।

মানভূমের গ্রামাঞ্চলে ভাদ্র সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মা পুজোকেও ছাপিয়ে যায় ভাদু। মেয়েরা কুমোর বাড়ি থেকে ভাদু মূর্তি কিনে এনে গ্রামে স্থাপন করেন। ভাদু গানে কখনও দৈনন্দিন জীবন কখনও বা চাওয়া -পাওয়ার যন্ত্রণা ফুটে ওঠে।
‘ভাদু আমার ছোট ছেলে, কাপড় পড়তে জানে না’ (পুরুলিয়ায় শিশুদের লিঙ্গ নির্বিশেষে ছেল্যা >ছেলে বলা হয় )।
ভাদুর গীতে ক্রমশ উহ্য হয়েছেন খোদ ভাদুই। এসেছে রামায়ণ -মহাভারতের কাহিনি। ‘রামের মা সিনাতে গেল , রাম কাঁদে ধুলায় পড়ে / কেনে গরবি ধুলা দিলি / ধুলা ঝাড়ে লিই কোলে।’

বিদায় বেলায় যেন ডুকরে উঠলেন সেই অবাঙালি দারোয়ান, ‘সব উঠে গেল বাবু। ভাদু, আগমনী, পুজো, যাত্রাপালা সব …’তালাবন্ধ কাশীপুর রাজবাড়ি।

স্মরণে নজরুল

নজরুল তুমি কই ? বাজাও বিষের বাঁশি,
সত্য ন্যায়ের পাল তুলে দাও অসত্যেরে ফাঁসি।
দারিদ্রে পিষ্টে যে জন মরে দাও তারে সুখ আনি,
নিষ্পাপ জনের লৌহ কবাটে দিয়ে যাও আঘাত হানি।।
.
মুছে দাও তুমি বিভেদ মানুষে সকলে করো একজাতি,
ঘৃণার দেয়াল ধুলায় লুটায়ে দিয়ে যাও প্রেমের খ্যাতি।
অত্যাচারে ঘাতে ঘাতে আজ মরিছে অবুঝ শিশু,
সকলের হিয়ায় বাঁধিতে দরদ এসো হয়ে আজ যিশু।।
.
নীতির মঙ্গায় ঘৃণিত হচ্ছে দেশ ললাটের নেতা,
সাম্যের গান আবার শুনায়ে প্রীতি দিয়ে যাও যথা।
দূরে তুমি থেকোনা আজি এই বঙ্গ হারায় প্রাণ,
তাবেদারী রোধে বিদ্রোহ করে সার্বভৌম করো দান।।
.
২৭/০৮/২০১৬

বিশ্বত্রাস করোনা পৃথিবী জেলখানা যাত্রাদলের অবক্ষয় (দশম পর্ব)

বিশ্বত্রাস করোনা! পৃথিবী জেলখানা।
যাত্রাদলের অবক্ষয় (দশম পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

কুয়াশাচ্ছন্ন শিশিরভেজা শীতের রাত। অঘ্রাণের নবান্নের পর ধানকাটা ন্যাড়া মাঠ। অন্ধকার। তারই মাঝে টিউব, বাল্ব, টুনির আলোয় বৃত্তাকারে অথবা বর্গক্ষেত্রাকারে ঘেরা একটি প্রশস্ত অঞ্চল। মেলা বসেছে। বাংলার গ্রামীণ মিলনোৎসব। উপলক্ষ্য ধর্মীয় হতে পারে বা সামাজিক। তবে লক্ষ্য একটাই – যাত্রাপালা।

মেলার আলোর ঘেরাটোপের মধ্যিখানে তিনদিক খোলা বাঁশ আর পাটাতন দিয়ে তৈরি মাচা বা মঞ্চ। মাচার চাঁদোয়া সংলগ্ন বাঁশে পার লাইট, পিসি লাইট বাদুর ঝুলন্তিস। ঝুলছে বারো – চোদ্দোখানা মাইক্রোফোন। মঞ্চে বহুস্তর বিশিষ্ট রস্ট্রাম। মঞ্চের দুদিকে বাজনদাররা সিন্থেসাইজার, অক্টোপ্যাড, ঢোল, তবলা, ফ্লুট, কর্ণেট নিয়ে প্রস্তুত। মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট চলছে – “আজকের সাড়াজাগানো সূপার-ডুপার হিট যাত্রাপালা………”

অন্ধকার মাঠের আল বেয়ে বেয়ে জোনাকির আলোর মতো মিটমিটে টর্চ জ্বেলে গ্রাম গ্রামান্তর থেকে মানুষের ভীড় এসে জড়ো হয় যাত্রা আসরে। বাদাম, ঘটিগরম, চিপস বিক্রেতারা খদ্দের ধরতে নেমে পরে। জায়গা দখলের বচসা, বাচ্চার কান্না, ছোকরার সিটি সব মিলিয়ে শব্দকল্পদ্রুম। এমন সময়ে তিনবার ঢং – ঢং – ঢং করে ঘন্টা বেজে ওঠে। কনসার্ট শুরু। টাইটেল কনসার্ট। তারপরেই শুরু পালা।

করোনার আবহে থমকে গিয়েছে চিতপুরের যাত্রাপালা। কবে হবে ফের তাদের পালা তা তারা নিজেও জানে না। কেবলমাত্র অনাহারই নয়,যে অনিশ্চয়তার মেঘ ওদের জীবনে এসে পড়েছে তাতে করে সেই মেঘ যে কবে কাটবে তা নিয়ে রীতিমতো দ্বন্দ্বের মধ্যে দিন গুজরান করছেন ওরা। মানে যারা চিতপুরের যাত্রাপালার সঙ্গে যুক্ত, কেউ একা নয়,যতগুলো অপেরা আছে সকলেরই একই অবস্থা।

যাত্রাপাড়ায় গেলে অনেক হতাশ মুখের সাক্ষী হতে পারেন। নিয়মমাফিক রংবেরঙের পোস্টার সাজিয়ে বসে আছেন বিভিন্ন দলের ম্যানেজাররা। কিন্তু দিনের শেষে পকেট ভরছে কই? অধিকাংশ ম্যানেজারের বক্তব্য, লোকসানে চলছে চিৎপুর। কোনওরকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে যাত্রাপাড়াকে। এমনকী এখন টিকিট বিক্রি করে যাত্রা শো খুব কম হয়। অধিকাংশ যাত্রাই আজকাল ফ্রি-তে হচ্ছে, যা আর্থিক দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে বাংলার এই আদি লোকসংস্কৃতিকে। একদিকে এনআরসি, অপরদিকে করোনা। এই দুইয়ের ধাক্কায় জেরবার চিৎপুরের যাত্রাপাড়া। এনআরসি নিয়ে অসম এবং ত্রিপুরায় অস্থির পরিস্থিতি। যার ফলে পেরিয়ে গেছে দুটো মাস। সেখানে যেতে পারেনি চিৎপুরের কোনও দল। হয়নি কোনও বায়না। প্রতি বছর রথের দিন যে বায়নার দৃশ্য চোখে পড়তো চিৎপুরের গদি ঘরগুলোতে সেখানে এবারে থাবা বসিয়ে ছিল এনআরসি। আর এখন মরশুমের মাঝে হঠাৎই হাজির করোনা!

অন্য বছরগুলোতে এই দুটো রাজ্যেই দুমাস ধরে চিৎপুরের যাত্রাপালা নিয়ে ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন দলগুলি। যার থেকে তাঁদের রুজি রোজগারও হয় বেশ ভালোই। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। পার্শ্ববর্তী দুই রাজ্য অসম ও ত্রিপুরায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে যাত্রাপালা। যার ফলে ধুঁকতে থাকা বাংলার যাত্রাশিল্পে তা একটা বেশ বড় ধাক্কা বলেই মনে করছেন যাত্রা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীরা। তার ওপরে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এসে হাজির হয়েছে নভেল করোনা ভাইরাস। সতর্কতা হিসেবে বড় ধরণের জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। বন্ধ হবে গেছে সব ধরণের খেলা ও বিনোদনের অনুষ্ঠান।

সেই পরিস্থিতিতে যাত্রা শিল্পেও পড়েছে এর প্রভাব। সরকারি নির্দেশে বন্ধ হতে চলেছে সব ধরণের শো। আর শো বন্ধ হওয়া মানেই পেটে টান পড়া। তাই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার জেরে এখন চিন্তার ভাঁজ চিৎপুরের ছোট বড় সব যাত্রা পালার কাছে। ইতিমধ্যেই এবছরের বায়না নেওয়া হয়ে গিয়েছে। যাত্রাপালার দলগুলিও ঘুরছে রাজ্যজুড়ে। কিন্তু সেইখানেই রীতিমতো মাথায় হাত তাঁদের। আগামী ৩১ তারিখ পর্যন্ত কোনও রকম বড় ধরণের জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে যাত্রাপালাও করা যাবে না।

কারণ সেই একটাই করোনা ভাইরাস। যে শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে যে শিল্প শেষ হতে বসেছে, যাকে এখনও ভালোবেসে তারা বুকে আগলে ধরে এগিয়ে চলছেন তার ওপরে এই অযাচিত বাধায় ঘুম ছুটেছে পালাকারদের। রাজ্য সরকার যাত্রা শিল্পকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টার মধ্যেই এই ধরণের বাধাতে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীদের কাছে যে বিশাল ধাক্কা সে কথা অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছেন তারাই। চিৎপুরের আনন্দলোক অপেরার খোকন পোড়েল রবিবার কলকাতা টিভিকে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন তাঁদের এই আশঙ্কার কথা। সকলের সুস্থতা চিন্তা করে সরকারের এই উদ্যোগে সমর্থন জানালেও তাঁদের মনের কোণে কিন্তু এখনও উঁকি মারছে আশঙ্কার কালো মেঘ।

বিশ্বত্রাস করোনা পৃথিবী জেলখানা যাত্রাদলের অবক্ষয় (নবম পর্ব)

বিশ্বত্রাস করোনা! পৃথিবী জেলখানা।
যাত্রাদলের অবক্ষয় (নবম পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ঘরবন্দির আইন ভেঙে ওষুধের বাক্স হাতে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে করোনার চিকিৎসা করছেন ‘আইন ভাঙা বউ’। ‘ঘরে ফিরেছে দুর্গা’য় আবার মহিষাসুরের বদলে ‘করোনাসুর’কে নিধন করে সাধারণের বেশে ঘরে আসছেন দুর্গা। শুধু ভাইরাস জয়ের গল্পই নয়, ভয়াল ভাইরাসে কী ভাবে সারা দুনিয়ার ভোল পাল্টে গেল, তা-ও তুলে ধরার পরিকল্পনা ছিল ‘বিশ্বত্রাস করোনা’ যাত্রায়। ‘ছিল’, কেননা মঞ্চে সত্যিই তুলে ধরা যাবে কি না, রথের দিনে বায়নাশূন্যতায় সবটাই অনিশ্চিত। তুলনায় পটুয়াপাড়ায় কিছুটা হলেও আশার আলো ফিরেছে রথে। কিছু প্রতিমার বায়না পেয়েছে কুমোরটুলি।

রথের দিনটাই কার্যত হালখাতার চেহারা নেয় চিৎপুরের যাত্রাপাড়া। দপ্তর পরিষ্কার করে পুজোর ব্যবস্থা, প্রসাদ বিলি দিয়ে শুরু হয় সিজন। এতদিন এমনই হয়ে এসেছে। নতুন সিজনে করোনাকে খলনায়কের ভূমিকায় রেখে যাত্রার গাঙে জোয়ার আনার পরিকল্পনা করেছিলেন বিভিন্ন অপেরার কর্তারা। কিন্তু করোনাই সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়েছে। রথের দিন একটাও বায়না পায়নি চিৎপুর।

পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক ও রত্নদীপ, স্বর্ণদীপ এবং সন্ধ্যাদীপ অপেরার কর্ণধার কণক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘গত সিজনেও আমার একটা অপেরা ৭৪টা এবং অন্য একটা অপেরা ১১৪টা শো করেছে। এ বছর যা অবস্থা তাতে কিছুই হবে বলে মনে হচ্ছে না। এই সময়টায় দল, পালা সব ঠিক হয়। রথের দিন অফিসই খুলতে পারিনি।’
ভৈরব অপেরার মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, ‘এ বছর করোনাই হট টপিক। ওই নিয়ে দু’টো পালা ’আইন ভাঙা বউ’ আর ‘ঘরে ফিরেছে দুর্গা’ তৈরি। কিন্তু বায়না হল কোথায়? আর্টিস্টও ঠিক করা যায়নি।’ তপোবন অপেরার নীলকমল চট্টোপাধ্যায়ও পালায় করোনা রেখেছেন। নতুন সিজনে ‘বিশ্বত্রাস করোনা’ মঞ্চস্থ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। বলছেন, ‘বায়না না হলে ঘর থেকে টাকা বের করে আর্টিস্ট বুক করব কোন ভরসায়? উম্পুনে দক্ষিণ ২৪ পরগনা বিধ্বস্ত। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের হাল খারাপ, বর্ধমানও সন্ত্রস্ত। পালা দেখবে কে?’

তুলনামূলক ভাবে একটু হলেও আশার আলো দেখেছে কুমোরটুলি। রথের দিন উত্তর কলকাতার পুরোনো এই পাড়াতেও শুরু হয় দুর্গাপুজোর প্রতিমা বায়না। গত বছর প্রথম দিনে প্রায় দেড়শো বায়না হয়েছিল। এ বছর কিছু হবে না বলেই মন খারাপ করে বসেছিলেন শিল্পী ও কারিগরের দল। কিন্তু দিনের শেষে ৩৫টি বায়নায় কিছুটা হলেও স্বস্তিতে তাঁরা। কুমোরটুলি মৃৎশিল্পী সংস্কৃতি সমিতির পক্ষে বাবু পাল বলেন, ‘গত বছরের সঙ্গে তুলনায় যেতে চাইছি না। পুজো হবে কি না সেটা নিয়েই সংশয় ছিল। তবে বুধবার সকালেও দু’টো বায়না এসেছে।’ খানিক স্বস্তিতে সুনীল পাল, চায়না পাল, মহাদেব পাল, সনাতন পালের মতো শিল্পীরাও। কুমোরটুলিতে অন্তত ১৫০ স্টুডিয়োয় প্রায় ৪০০ শিল্পী কাজ করেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন সবাই। যার জন্য এত কিছু সেই করোনা কি এ বার অসুর হিসাবে দেখা দেবে মণ্ডপে?