গাছ
বৃক্ষনিধন নিয়ে হইচইয়ের মধ্যে স্কুলের একটা দেওয়াল পত্রিকার কথা মনে পড়লো। ওই সংখ্যার বিশেষ বিষয়ই ছিল : ‘গাছ’। পঁচিশটা ছোট ছোট লেখা ছিল। তার থেকে দু- তিনটে পরিবেশন করছি।
(১)
সুমনা ভট্টাচার্য, দশম শ্রেণী, ‘ক’ বিভাগ।
।। এমন বন্ধু আর কে আছে…।।
আমার ঠাম্মারমতই, গাছ এক স্বপাকভোজী প্রাণী। নিজের খাবার নিজে তৈরি করে নেয় তো বটেই, পৃথিবীর তাবৎ প্রানীকুলের প্রত্যেককে খাওয়ানোর দায়িত্ব তার কাঁধে। কেউ যদি ভেজিটেরিয়ান হন, বা মাংসাশী, খাচ্ছেন কিন্তু ‘গাছ’ ই। ভাবছেন, শাকসব্জী বাদ দিয়ে শুধু দুধ- ছানা- মিষ্টি খেয়ে বাঁচবেন? গরু দুধ দেয় তো ঘাস- খড়- খোল খেয়ে। তবে তো দুধ – ছানা – মিষ্টি রূপান্তরিত গাছ মাত্র। মাংসও তাই। মাছ ও তো বেঁচে থাকে জলজ শ্যাওলা – কীট ইত্যাদি খেয়ে, যে গুলোকে অক্সিজেন জুগিয়ে বাঁচিয়ে রাখে গাছ। কোনো খাবার না খেয়ে শুধু বায়ুভুক হয়ে বেঁচে থাকবেন? অক্সিজেন যোগাবে কে? ওই এক গাছ ছাড়া?
(২)
কিংবদন্তি ঘোষ।দশম শ্রেণি, ‘খ’ বিভাগ
।। মরাগাছ লাখ টাকা।।
মরা গাছ কি ফ্যালনা? সরাসরি জ্বালানী, ভাস্কর্য, ফার্নিচার, দালান কোঠা, মাটির বাড়ি, ছিটেবেড়া কিছুই কি হবে গাছ ছাড়া? ঠাকুমার পুজো হবে মরা চন্দনের গাত্রকর্দম ছাড়া? গলার কন্ঠি, নাকের রসকলি, — সর্বত্রই মরা গাছ। যাগ- যজ্ঞি, হোম- হবিষ্যি,— যাই করো না কেন, মরা গাছ বাদ দিয়ে হবে না।
এখুনি হাতে- গরম কাজে লাগাবার পরেও, উদ্বৃত্ত মরা গাছ বহু যুগের ওপারে গিয়েও জ্বালানি কয়লা, এমন কি হীরে হয়েও মানুষের কাজে লাগে। আমাদের মালিনী ম্যাডামের যে হীরের কানের দুল, সেটাও তো রূপান্তরিত গাছই।
বৃক্ষ উদ্ভুত হীরে- জহরত নিয়ে এ যাবতকাল বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ঘটেছে ইতিহাসে। ইরাকের বুকে আমেরিকা যে কার্পেট – বম্বিং করলো, তারও কারন কিন্তু গাছ। কি বললেন? ওখানে গাছ কম, বালি বেশি?… হতেই পারে। কিন্তু যে তরল সোনার জন্য যুদ্ধটা ঘটল,— তা তো প্রচুর পরিমাণ বিশালাকায় জীবজন্তুর রূপান্তরিত চর্বিমাত্র। এবং জলেই হোক- কি স্থলে, জীবজন্তু মানেই তো ফের সেই গাছ। তাবৎ জীবকুলের প্রাণশক্তির জ্বালানি সাপ্লায়ার।
(৩)
নন্দিনী রায়। দ্বাদশ শ্রেণি, ‘ক’ বিভাগ।
।। একা এবং কয়েকজন।।
গাছ দুই প্রকার।– একা, এবং বোকা। বোকাদের কথাটাই আগে বলি। এরা অকারণে দলবেঁধে, শাখা- প্রশাখা বিস্তার করে, গলাগলি – ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে। ঠিক আমাদের ম্যাডামদের মতোই। সময়মত ফুল দেয়- ফল দেয়, অথবা কিচ্ছুটি না দিয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচায়। তারপর একদিন ‘টুপুস’ করে মরে যায়। একদিন হাফ ছুটি হয়, কনডোলেন্সে ফিসফাস হয়,
তারপর যে- কে- সেই…. জীবনতরী বহিয়া যায় নিরুদ্দেশের পানে। উদাহরণ হিসেবে ঘাস থেকে শুরু করে জোটবদ্ধ বাঁশ পর্যন্ত আনা যায়। এরা জোটবদ্ধ গাছ। বিপরীতে কেউ কেউ আবার তাল-ঢ্যাংরা লম্বা হয়ে একা একা শুধুই উঠে যেতে থাকে উপরে— উপরে— আরোই উপরে। সম্ভবত অন্যদের উপরে নজরদারির সুবিধের জন্যে, ঠিক যেমন আমাদের হেডম্যাম্। এই জাতীয় গাছের উদাহরন– নারকেল, তাল, সুপারি ইত্যাদি। আম- জামের মতন হাত বাড়িয়ে পাড়বেন, আর টুপ করে মুখে ফেলে দেবেন, অতটি সহজ কম্ম নয়। এইসব এক – ঠেঙে গাছেদের নিয়ে বিখ্যাত কবিতাটি :
তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।
ম্যাডামদের মতোই গাছকে আরো দু- ভাগে ভাগ করা যায়, নিরামিষাশী ও আমিষাশী। খুব কম গাছই আমিষাশী হয়। তাদের গোড়ায় মাছ- মাংস ধোয়া জল, হাড় গুঁড়ো প্রভৃতি খাবার দিতে হয়। কেউ কেউ ম্যাজিশিয়ানের মতো পাথর- কাঁকড় খেয়ে বাঁচে, যেমন ক্যাকটাস। আর সন্ন্যাসীর মতো ‘অর্কিড ‘ শুধু বাতাসেই পরিতৃপ্ত।
(৪)
পূর্ণিমা হেম্ব্রম। অষ্টম শ্রেণি, ‘ক’ বিভাগ।
।। আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ।।
গাছ আমাদের নিকটতম আত্মীয়। বন্ধু, সখা,অভিভাবক।
আমাদের সমাজে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী আমার দিদির বিয়ের সময় আগে- ভাগে এক বট গাছের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নামমাত্র নয়। রীতিমত বিয়ের সব লোকাচার মেনে,— গায়ে হলুদ, হাতে ধাগা বাঁধা, মালাবদল, কুটুম্ব ভোজন,— আরো কত শত আচার- অনুষ্ঠানে বটবৃক্ষকে জামাই করেছিলেন অভিভাবকরা। আশায় বুক বেঁধেছিলেন এই ভেবে যে, আমার দিদি বাস্তবে বটবৃক্ষের মতো গুনবান, পরোপকারী, সহনশীল, মাথাউঁচু স্বামীলাভ করবে। ওই যে একটা গান আছে না-
….. বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে,
মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে…..
কিন্তু দুঃখের বিষয়, দিদির বিয়ের পরে আমার দিদিটাই রাতারাতি বদলে গিয়ে বৃক্ষের মত সর্বংসহা স্বভাব পেয়ে গেছে।…
… জামাইবাবু নিত্যদিন নেশা করে দিদিকে বড্ড মারে।
ম্যান প্রোপোজেস্, গড ডিসপোজেস্ বলে একটা কথা শুনেছি। সেটাকে কি তার প্রত্যেকটা শব্দ-বর্ণ নিয়ে আমাদের জীবনেই ফলবতী হয়ে উঠতে হয়! দিন পাঁচেক আগে জামাইবাবু সরকারি চাকরিতে বিরাট একটা প্রমোশন পেলেন। সর্ব অর্থে ক্ষমতা তাঁর বেড়ে গেল। দিদির সামনেই অন্য এক মহিলা বিছানার দখল নিল।
আর…. আর গতকাল স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখলাম ঠিকেদারের লোকজন দিদির প্রথম বর নির্বিবাদী বটবৃক্ষকে টুকরো টুকরো করে কেটে চালান করে দিচ্ছে। জাতীয় সড়ক যাবে যে এই গাঁয়ের মাঝবরাবর।
(৫)
আয়েশা খাতুন। একাদশ শ্রেণি, ‘ক’ বিভাগ
।। গাছের আমি – গাছের তুমি।।
কুরান শরীফের সুরা আবাসায় আছে,—–
— হতভাগ্য মানুষ ধ্বংস হোক। সে কত অকৃতজ্ঞ। মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমি প্রচুর বারি বর্ষণ করি। অতঃপর আমি ভূমি বিদীর্ণ করি। এবং ওতে আমি শস্য, শাক- সবজি, জয়তুন, খেজুর — বহু বৃক্ষ বিশিষ্ট উদ্যান, ফল এবং গবাদির খাদ্য উৎপন্ন করি।—-
অর্থাৎ আল্লাতালা মানুষ ও অন্যান্য জীবজগতের জন্য যাবতীয় বৃক্ষ সকল সৃষ্টি করেছেন। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে সে কারনেই গাছ বহু প্রকার, প্রায় মানুষের মতোই। লম্বা, বেঁটে, সাদা, বাদামী, সবুজ, হলুূদ ইত্যাদি। স্বভাবও মানুষের মতো বহুবিধ। উপকারী, অনিষ্টকর, সাহসী, ভীতু, ঝগড়ুটে, পাজি, ছিঁচকাঁদুনে ইত্যাদি। উদাহরণ :
সাহসী : বট, অশ্বত্থ, পাকুর ইত্যাদি। শত – সহস্র ঝড়- ঝাপটা মাথা উঁচিয়ে- বুকচিতিয়ে পার করে দেয়। এদের হেলানো- দোলানো শক্ত।
উপকারী : প্রায় সব্বাই। ৯৯.৯৯%।
অনিষ্টকর : পার্থেনিয়াম ও তার সগোত্রীয়।
সাইলেন্ট কিলার।
ঝগড়ুটে : কুল, বাবলা, ধানি লঙ্কা। আঁচড়ে- কামড়ে-ঝালে- ঝাঁঝে- কন্টকে জীবন জেরবার করে দেয়।
ভীতু- লাজুক : লজ্জাবতী লতা।
পাজি : জলবিছুটি, আলাকুশি।
আমিষাশী : পাতাঝাঁঝি, সূর্য শিশির, কলসপত্রী।
ছিঁচকাঁদুনে : উইপিং ট্রি।সার্থকনামা।
একটা অতি পরিচিত ধাঁধাঁ দিয়ে শেষ করি :
আল্লার কী কুদরত্
লাঠির ভিতর শরবৎ।
… কি, পেটে আসছে মুখে আসছে না? ভেরি ভেরি সিম্পল্। —- ‘ আখ’।
(৬)
তৃণা বসু। একাদশ শ্রেণি, ‘ খ ‘ বিভাগ।
।। গাছ দিয়ে যায় চেনা।।
আদ্যিকাল থেকেই গাছ খাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্রও যুগিয়ে আসছে। মানুষের ভাত- কাপড়ের দায়িত্বে একমাত্র গাছ ই। যেকোন পরিধেয়, – তা বল্কল থেকে বেনারসি যাই হোক না কেন, রকমফেরে তা গাছই। সিন্থেটিক পরবেন? তারও তো উৎসমূলে গাছ ই। মূল উপাদান রবার তো গাছেই ফলে। গাছ হল একটা প্যারামিটার, — যা দিয়ে আপনি ঠাহর করতে পারবেন মানুষের সামাজিক তথা অর্থনৈতিক স্ট্যাটাস্।
যার সব আছে,বেশি বেশি আছে,তারচে’ বেশি আছে,পেট যার কাছে আতঙ্ক নয়, তার বাড়িতে শোভা পায় দুর্মূল্য বাহারি গাছ, পাথরকুচি, অর্কিড। সে সব গাছেদের ফুল- ফল না থাকলেও চলে। টাকার গরমে বৃহৎ বৃক্ষকে ফল- ফুল সমেত ‘বামন’ বানিয়ে বনসাই শিল্পের তকমা দেয়া চলে। একধাপ নিচে এসে দেখুন, মধ্যবিত্ত পরিবার, যাদের নিত্যি উনুন জ্বেলে রাখাটাই সাধনা, এবং তার সঙ্গে আছে শিল্প – সংস্কৃতির প্রজন্মবাহী বাতিক, তাদের বাড়ির সামনে ফুলগাছ, তো পিছনে কিচেন- গার্ডেন। পেট ও হৃদয়ের দূরত্ব খুব কিছু বেশি নয় এখনো।
আরো একধাপ নিচে এলে দেখা পাবো যাদের, তাদের পুরো পৃথিবীটাই পেট আর পেটময়। যাবজ্জীবন পেটাতঙ্কই সম্বল। জীবনের সামনে- পেছনে, আগে- পরে সমস্ত মাটি জুড়ে শুধুই পুঁই, ঢ্যাঁড়শ, মানকচু, চিচিংগে, ধুঁধুল গাছের মেলা। আর শুধু মাটি কেন, ছিটেবেড়ার দেওয়াল, খড়ের চাল, সব- স- ব ঢাকা পড়ে থাকে লাউ – কুমড়োর ফল- ফুল – পাতাতে। লক্ষ্যটা অবশ্যই ফল লাভের। তবে ফুলও যদি ফোটায় তবে তা বকফুল, বা টগরফুল, বা কুমড়োফুল, যা অনায়াসে উদরে চালান দেওয়া যাবে।
সবশেষ স্তরে যাকে পাবেন, যার ঘরবাড়ি – অন্নবস্ত্র কিছুমাত্র নেই, সেই সর্বহারার ও সম্বল বলতে স্রেফ ওই গাছ। সব হারালে শেষকালে তো গাছতলাটাই আশ্রয়।
ওরা কষ্ট করে লিখেছে আর আমরা হচ্ছি পাঠক। পাঠক হিসেবে মনে হলো তারা তাদের নিজস্বতায় নতুনত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। স্বতন্ত্র সব চেতনার বহির্প্রকাশ।
আমার প্রথমেই উল্লেখ করে উচিত ছিল, এটা আমার একটা বড় গল্পের অংশ।নতুন একটা ফর্মে গল্পটা লেখার চেষ্টা করেছিলাম।
পড়বার জন্য ধন্যবাদ।
এই শেয়ারিং অসাধারণ হয়েছে দিদি ভাই। অভিনন্দন আপনাকে।
এটা আমার মৌলিক একটা গল্পের অংশবিশেষ।
একটা নতুন ফর্মে লেখার চেষ্টা করেছি মাত্র ।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
ওহ্। তাহলে প্রকাশিত হবার অপেক্ষা নিয়ে রইলুম দিদিভাই।
প্রথম দিকে কয়েকটি পড়লাম, মনেই হয়টি ছোটরা লিখেছে।
এটা ছোটদের লেখা নয়। নতুম ফর্মে একটা বড় গল্প লিখেছি। এটা তারই একটা টুকরো।
পড়বার জন্য ধন্যবাদ।