বিভাগের আর্কাইভঃ স্মৃতিকথা

ভারতের মেট্রো বা পাতালরেলে চড়ার আনন্দ অভিজ্ঞতার গল্প

nit

একসময় ভারতের মাটিতে পা রেখেছিলাম, ১৪০০ বঙ্গাব্দ। তখন বৈশাখমাস। বাংলাদেশ থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে দালাল মারফত অতি কষ্টে সীমান্ত পেরিয়ে বনগাঁ রেলস্টেশন পৌঁছেছিলাম। আমার সাথে ছিল, আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ওর দুই বোন। যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, জীবনটাকে একটু পরিবর্তন করার। কিন্তু না, জীবন তো পরিবর্তন করতে পারি-ই-নি, বরং ওখানে প্রায় দেড়বছর অবস্থান করে শেষাবধি শূন্য হাতে আবার ফিরে আসতে হলো। এরমধ্যে লাভ হয়েছিল, বিশাল ভারত-সহ ভারত ঘেঁষা ভুটানের কয়েকটা জায়গা দেখা হয়েছিল। তো যাক সেকথা, আসা যাক পোস্টের মূল কথায়।

ভারত যাবার পর আমার বন্ধু বাসায় অবস্থানের পর, আমার যেন কিছুই ভালো লাগছিল না। ভালো না লাগার কারণ ছিল, বাংলাদেশে ফেলে রাখা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চিন্তা। সেই চিন্তা মনের ভেতরে রেখেই কাটিয়ে দিলাম চার-পাঁচদিন। চার-পাঁচদিন পর একদিন সকালবেলা আমার বন্ধু কানাই বলল, “চল দুইজনে টাউনে গিয়ে ঘুরে আসি।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাবি?”
কানাই বলল, “আজ তোকে মেট্রো ট্রেনে চড়াব। আর সময় পেলে হাওড়া, তারামণ্ডলও দেখাবো।”

এ-তো খুশির খবর! কিন্তু খুশির বদলে আমার কান্না আসতে লাগল! চিন্তা শুধু একটাই, তা হলো এখানে আসলাম বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, হচ্ছে শুধু টাকা খরচ! এভাবে ঘুরে বেড়ালে কি হবে? আমার তো কিছু একটা করতে হবে। ভাবছি, কানাইর সাথে যাব কি যাব না! না গেলেও হয় না। শেষমেশ জামাকাপড় পড়ে কানাইর সাথে বের হলাম।

কানাই’র বাসা থেকে একটা অটো (সিএনজি) চড়ে গেলাম ধর্মতলা। এই ধর্মতলায় কোলকাতা শহরের বড় একটি বাসস্ট্যান্ডও আছে। আছে কোলকাতার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার ট্রাম ও বাস সার্ভিস। অটো থেকে নেমে একটা চা দোকানে গিয়ে চা-বিস্কুট খেলাম। দোকান থেকে বের হয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম। সিগারেট জ্বালিয়ে ফুঁকছি, আর হাঁটছি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছি। একসময় একটা রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি দুইজনে। দেখছিলাম, দুইটা দোকানের মাঝখানে মাটির নিচে যাওয়ার জন্য অনেক চওড়া জায়গা। নিচে যাওয়ার সুন্দর সিঁড়িও আছে।

কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “নিচে কী?”
কানাই বলল, ”এটি হচ্ছে কোলকাতা শহরের ভূগর্ভস্থ পাতাল রেলস্টেশন। যাকে বলে পাতাল রেল বা মেট্রো ট্রেন বা মেট্রোরেল। তাই অনেকে বলে, মেট্রো ট্রেনস্টেশন।

বললাম, “তা হলে আমরা কি এখন এই স্টেশনেই যাচ্ছি?” কানাই বলল, ”হ্যাঁ, তোকে তো বাসা থেকে বাইর হবার আগেই বলেছি। এখন চল, নিচে স্টেশনের ভেতরে যাওয়া যাক। গেলেই বুঝতে পারবি, পাতাল রেল কাকে বলে!”

সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিচে নামতে লাগলাম। যতই নিচে যাচ্ছিলাম, ততই স্টেশনের ভেতরকার সৌন্দর্য দেখে অবাকও হচ্ছিলাম! এই মেট্রো ট্রেন হলো, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতা পরিবহণ সেবার মধ্যে একটি। এটির পরিসেবা কোলকাতা শহরের পার্শ্ববর্তী উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা পর্যন্ত। দ্রুত পরিবহন সেবা প্রদানকারী পরিবহণ ব্যবস্থাও বলা যায়।

জানা যায়, কোলকাতা মেট্রো ট্রেনের পথ ২৭.২২ কিলোমিটার। এই ২৭.২২ কিলোমিটার পথে ২৩টি মেট্রো স্টেশন রয়েছে। যার মধ্যে ১৫টি স্টেশন ভূগর্ভস্থ আর বাদবাকিগুলো উড়াল। এই পরিবহন সেবা চালু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে এবং এটিই ভারতের প্রথম মেট্রো রেল পরিসেবা। এরকম পাতাল রেল সার্ভিস নাকি ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও আছে।

আমরা দু’জন নিচের দিকে নামছিলাম, যত নিচে যাচ্ছি ততই সুন্দর! ঝকঝকা আলো আর লোকে লোকারণ্য। স্টেশনের ভেতরে গার্ডের সাথে পুলিশও আছে। তাদের ডিউটি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা। কে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে এগুলো ফলো করা। মূল স্টেশনে প্রবেশ করতে হলে, চাই টিকিট।

কম্পিউটারে টিকিট শো করলেই গেইট খুলবে, যাত্রী প্রবেশ করবে। এ ছাড়া আর প্রবেশ করার মতো কারোর সাধ্য নেই। কানাই কাউন্টার থেকে দুটা টিকিট কিনে আনল। আমরা যাব, ধর্মতলা থেকে টালিগঞ্জ। টিকিটের দাম নিল, ৫ টাকা করে ১০ টাকা। দুটো টিকিটই একসাথে, মানে একটা টিকিট। টিকিটের গায়ে লেখা আছে টু ম্যান।

ট্রেন আসার সময় হয়েছে। হুইসেল শোনা যাচ্ছে। কানাই বলল, ”শিগগির আয়।”

আমরা কম্পিউটার সিস্টেম গেইটের সামনে গেলাম। কানাই গেইটের পাশে থাকা বক্সে টিকিট ঢুকাল। টিকিটখানা শোঁ করে বক্সের পেছনে চলে গেল। আমরা গেইট পার হলাম, টিকিটখানা হাতে নিলাম। গেইটখানা ধরে আমি একটু ট্রাই করে দেখলাম! গেইট আর একটুও নড়ে-চড়ে না। টিকিটের গায়ে দুইজন লেখা। ঠিক দুইজন পার হওয়ার পরই গেইট বন্ধ। ট্রেন স্টেশনে এসে থামল। যাত্রিরা ট্রেন থেকে নামল। আমরা ট্রেনে ওঠার জন্য রেডি হয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।

ট্রেন থেকে মাইকে বলছে, “টালিগঞ্জ যাওয়ার যাত্রিগণ ট্রেনে ওঠে আসন গ্রহণ করুন।” আমরা-সহ সব যাত্রী ট্রেনে ওঠে সিটে বসার পর ট্রেন থেকে আবার মাইকিং। বলা হচ্ছে, “যাত্রীদের অবগতির জন্য বলা হচ্ছে যে, আপনারা ট্রেনের দরজা ও জানালা থেকে দূরে থাকুন।” এর পরপরই ট্রেনের সব দরজা ও জানালা একসাথে শোঁ করে লেগে গেল! বুঝলাম, দরজার সামনে যদি কেউ দাঁড়ানো থাকত, তা হলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই আগে থেকেই যাত্রীদের হুশিয়ার করে দেওয়া হয়, যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে।

ট্রেন ছুটল দ্রুতগতিতে! জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ট্রেন যাচ্ছে মাটির নিচ দিয়ে। কিছু দেখা যাবে কী করে? শুধু একটু শব্দ শোনা যাচ্ছে, শোঁ শোঁ শব্দ। ১০ মিনিটের মতো বসে থাকার পর আবার মাইকিং।
বলা হচ্ছে, “আমরা টালিগঞ্জ পৌঁছে গেছি! ট্রেন থেকে নামার জন্য প্রস্তুত হোন।”

কানাই বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল, সাথে আমিও ওঠলাম। ট্রেন থামল। ট্রেন থেকে আমরা নেমে স্টেশনের বাইরে আসলাম। কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে চা-বিস্কুট খেয়ে তৈরি হলাম, ধর্মতলা আসার জন্য। এবার ট্রামে চড়ে আসব ধর্মতলা। ট্রাম দেখা হবে আর চড়াও হবে। তারপর ট্রাম দেখা হলো, ট্রামে চড়াও হলো। মেট্রোরেল বা পাতালরেলে চড়ার গল্পও শেষ হলো।

একরকম শূন্য হাতে ভুটান ফ্রুন্টসলিং ভ্রমণ করেছিলাম

niii

ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় একবার আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে ভারত গিয়েছিলাম। সময়টা ছিল ১৯৯৩ সাল। যেদিন বেনাপোল বর্ডার পাড় হয়ে ওপার বনগাঁ পৌঁছেছিলাম, সেদিন ছিলো পহেলা বৈশাখ ১৪০০ বঙ্গাব্দ।

সেদিনের ওই যাত্রায় আমরা ছিলাম চারজন। আমি, আমার বন্ধু ও বন্ধুর দুই বোন। বনগাঁও থেকে রাত দশটার ট্রেনে চড়ে দমদম নামলাম। রাত তখন প্রায়ই বারোটা। তারপর আমার বন্ধুর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর বাড়িতে গেলাম, রাত কাটানোর জন্য। সেই বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরবেলা দমদম থেকে শিয়ালদা। শিয়ালদা নেমে একটা অটো চেপে সোজা বন্ধুর বাসায়।

ওই বন্ধুর বাড়িতে রাত যাপন করে খুবই ভোরবেলা আবার দমদম রেলস্টেশনে এলাম, শিয়ালদহ যাবার জন্য। যখন দমদম রেলস্টেশনে এলাম, তখনও শিয়ালদাগামী ট্রেন দমদম রেলস্টেশনে পৌঁছায়নি। এই ফাঁকে আমার বন্ধু স্টেশন থেকে চারটে টিকেট সংগ্রহ করে ফেলল। ট্রেন আসতে তখনও মিনিট কয়েক বাকি ছিল।

একসময় শিয়ালদাগামী ইলেকট্রনিক ট্রেন দমদম স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। দমদম স্টেশনে নামার মতো যাত্রীরা ট্রেন থেকে নামলো আমরা চারজন শিয়ালদহ’র উদ্দেশে ট্রেনে ওঠে সিট নিয়ে বসলাম। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর যথাসময়ে ইলেকট্রনিক দ্রুতগামী ট্রেন শিয়ালদহ গিয়ে পৌঁছালো। আমরা ট্রেন থেকে নেমে চলে গেলাম রেলস্টেশনের বাইরে।

শিয়ালদহ রেলস্টেশনের বাইরে গিয়ে একটা অটো চেপে চলে গেলাম, বাঘা যতীন সংলগ্ন বন্ধুর ভাড়া বাসায়। বন্ধুর ওখানে ছিলাম, প্রায়ই একমাসের মতো। কিন্তু আমি যেই কাজের আশায় বাংলাদেশ থেকে ভারত গিয়েছিলাম, সেই কাজ আর হলো না। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, বন্ধুর এখান থেকে জলপাইগুড়ি বড়দি’র বাড়ি চলে যাবো। শেষাবধি তা-ই হলো।

বন্ধুর ভাড়া বাসায় মাসেক খানি অবস্থান করার পর চলে গেলাম, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া। জলপাইগুড়ি বীরপাড়া আমার বড় দিদির বাড়ি। একসময় এই বীরপাড়া পুরোটাই ছিলো চা-বাগান। এই চা-বাগানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ছোট্ট একটা বাজার। সেই বাজারের নাম হয়, “বীরপাড়া” বাজার। বীরপাড়া বাজার ঘেঁষেই তৈরি হয়েছিল, ভুটানের গুমটু যাবার রাস্তা।

ভুটান গুমটু যাবার রাস্তার এপাশ-ওপাশ দু’পাশে থাকা চা-বাগান ঘেঁষে জনবসতি গড়ে উঠেছিল তুলনামূলকভাবে। সেইসাথে যখন লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন চা-বাগানের কিছু অংশ হয়ে পড়ে বেদখল।
আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম, তখন দেখলাম চা-বাগান ঘেঁষা বড় দিদির বাড়ি। যেখানে বড় দিদির বাড়ি, সেই জায়গার নাম, রবীন্দ্র নগর কলোনী। এই রবীন্দ্র নগর কলোনী ছাড়াও আরও কয়েকটা মহল্লা আছে। সবগুলো মহল্লাই একসময় চা-বাগান ছিলো।

বর্তমানে চা-বাগানের বেদখল হয়ে পড়া জায়গা ব্যক্তিমালিকানাধীন। মানে যিনি ওই জায়গায় দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করছে, তিনিই ওই জায়গার মালিক। শোনা যায় প্রত্যেকেই চা- বাগান কোম্পানি হতে নামমাত্র মূল্যে দখলকৃত জায়গা দলিলের মাধ্যমে রেজিষ্ট্রেশন করে নেয়। সে হিসেবে বড় দিদির বাড়িটাও নিজেদেরই কেনা সম্পত্তি।

যাইহোক ৩০ বছর আগে যখন আমি বড় দিদির বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন আমার বড় দিদি আমাকে চিনতে পারছিলেন না। কারণ আমার বড় দিদির যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন আমি ছিলাম মাত্র দেড় বছরের এক কোলের শিশু। আমার বড়দি’র বিয়ে হয়েছিল ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে। আমার জামাই বাবু বড় দিদিকে নিয়ে সপরিবারে ভারতে চলে আসে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে। সেই আসা-ই-আসা, আর কখনো তারা বাংলাদেশে যায়নি। সেই দেড় বছরের আমি বড় দিদির বাড়ি গিয়েছিলাম, ত্রিশ বছর বয়সে। না চেনার কারণই ছিলো ওটাই। অবশ্য পরিচয় দেওয়ার পর খুব ভালো করেই চিনেছিল।

বড় দিদির ওখানে গিয়ে মাসেক খানেক ঘুরে-ফিরে সাথে নেওয়া টাকা-পয়সা শেষ করে উপায়ান্তর না দেখে ভাগিনাদের সাথে গ্যারেজে কাজ করা শুরু করি। গাড়ির গ্যারেজে কাজ করার সুবাদে ওখানকারই অনেক ড্রাইভারে সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছিলো।

যেখানে যাবার মন চাইত, ভাড়া ছাড়াই সেখানেই চলে যেতাম। গিয়েছিলাম ভুটান গুমটু, সামসি, শিলিগুড়ি, জল্পাইগুড়ি, সিকিম যাবার ভারত-সিকিম মেইন সংযোগস্থান সেবক’র মতো সুন্দর-সুন্দর জায়গায়।। কিন্তু যাবো যাবো বলেও কাজের চাপে যাওয়া হচ্ছিল না, ভুটান ফ্রুন্টসলিং।

ভুটানের ফ্রুন্টসলিং আমার বড় দিদির বাড়ি বীরপাড়া থেকে মাত্র বিশ টাকার ভাড়া। বীরপাড়া থেকে ফ্রুন্টসলিং যেতে সময় লাগতো, দু’ঘন্টার মতো। এতো সামনে থেকেও সেখানে যাওয়া হচ্ছিল না।

একদিন সকালে খাওয়া-দাওয়া করে আর গ্যারেজে যাইনি। এদিন সকালে জামা-কাপড় পড়ে কারোর কাছে কিছু না বলে বীরপাড়া বাসস্ট্যান্ডে চলে গেলাম। আমার সাথে টাকার অংক ছিলো মাত্র দুইশো টাকার মতো।
বীরপাড়া বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে একটু ঘুরা-ঘুরি করে দেখলাম পরিচিত কোন বাস আছে কি-নাই। ঘুরে-ফিরে খানিক পর দেখি আমারই পরিচিত একটা গাড়ি জয়গাঁও যাবার জন্য যাত্রী সংগ্রহ করছে। বাস কাউন্টার থেকে মাইকে বলা হচ্ছে, “জয়গাঁ জয়গাঁ”। আমি ভাবতে লাগলাম জয়গাঁ আবার কোথায়?

এই ভেবে বাসের সামনে যেতেই বাস ড্রাইভারের সাথে দেখা। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো, “মামা তুমি কোথায় যাবে?”
বললাম,“ফ্রুন্টসলিং ঘুরতে যাবো, মামা!”
ড্রাইভার বললো, “আমি-ও-তো গাড়ি নিয়ে জয়গাঁ যাচ্ছি, মামা। তো যাবে যখন গাড়িতে উঠে আমার সিটের পেছনের সিটে বসে থাকো। কিছুক্ষণ পরই গাড়ি নিয়ে জয়গাঁ’র উদ্দেশে রওনা দিবো।”
বললাম, “আমিতো ফ্রুন্টসলিং যাবো মামা।”
ড্রাইভার বললো, “আরে মামা জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং একই জায়গায়। জয়গাঁ হলো ভারত-ভুটান বর্ডার। জয়গাঁ ভারতের আর ফ্রুন্টসলিং হলো ভুটানের একটা শহর। যাও যাও গাড়িতে উঠে আমার পেছনের সিটে বসো।”

ড্রাইভারের কথা শুনে আমি তা-ই করলাম। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসলাম। একটু পরই গাড়ি ফুন্টসলিঙের উদ্দেশে ছুটে চললো।
বিরতিহীন গাড়ি। কোথাও থামা-থামি নেই। গন্তব্য ছাড়া যাত্রীও ওঠা-নামা করতে পারে না। গাড়ি চলছে-তো-চলছেই। প্রায়ই দু’ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম, ভারত-ভুটান সীমান্ত ঘেঁষা জয়গাঁও ফ্রুন্টসলিং বর্ডার।

বাস থেকে নেমে ভুটান ফ্রুন্টসলিং প্রবেশের সুবিশাল গেইটের সামনে একটা চা’র দোকানে গেলাম। আমার সাথে বাসের ড্রাইভার হেলপারও ছিলো। সবাই মিলে আমরা ছিলাম চারজন। চারজনেই চা-বিস্কুট খেলাম। দাম দিলাম আমি। কারণ বাসে তো ফ্রি এসেছি, তাই।

চা-বিস্কুট খাওয়ার পর ড্রাইভার তার হেলপারকে বললো, ‘“গাড়িতে বীরপাড়ার যাত্রী ওঠাও!”
আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “মামা তুমি কখন যাবে?” বললাম, “একটু ঘুরা-ঘুরি করে জায়গাটা দেখে বিকেলে রওনা দিবো, মামা।”

আমার কথা শুনে বাসের ড্রাইভার আমাকে সেখানকার আইন-কানুন সম্বন্ধে বুঝিয়ে বললো, “যা-ই করো, আর ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে যেখানেই যাও, সন্ধ্যার আগে আগে ভুটানের গেইট পাড় হয়ে ভারতের ভেতরে চলে আসবে। কারণ সন্ধ্যার সাথে সাথে ভুটানের বর্ডার গার্ড ফোর্স এই সুবিশাল গেইটটা বন্ধ করে দেয়। গেইট বন্ধ হয়ে গেলে তুমি যদি ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে থেকে যাও, তাহলে তোমাকে আটক করে জেলে ভেরে রাখবে। তাদের আইনে যে-ক’দিন সাজা হয়, তা-ই ভোগ করে বের হতে হবে। কাজেই সন্ধ্যার কথাটা তুমি মাথায় রেখে ঘুরা-ঘুরি করবে।”

আমি বাস ড্রাইভারের নির্দেশাবলী মাথায় রেখে বললাম, “ঠিক আছে মামা, তা-ই হবে। আমার জন্য চিন্তা করবেন না।”
বাস ড্রাইভার কয়েকজন যাত্রী সংগ্রহ করে বীরপাড়ার উদ্দেশে রওনা হলে, আমি আস্তেধীরে ভুটান ফ্রুন্টসলিঙের সুবিশাল গেইট পাড় হয়ে সোজা ফুন্টসলিঙের ভেতরে চলে গেলাম। গেইটে চার-পাচজন সিপাহী ছিলো। কিন্তু আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি যে, আমি কোথাকার এবং কোথা-ই-বা যাচ্ছি।

দেখলাম তারা এপার-ওপার হওয়া কাউকে কিছুই জিজ্ঞেস করছে না। গেইট দিয়ে অনবরত ভারত ভুটানের লোক আসা-যাওয়া করছে, নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে যার-যার নিজের মতো করে। এতে কারোর জন্য কোনও জেরার সম্মুখীন হতে হয় না। জিজ্ঞাসা আর চেক থাকে তখন, যখন ভারত থেকে গাড়িগুলো ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে ঢুকে।

মাঝে-মাঝে ভারত থেকে বিভিন্ন মালা-মাল বোঝাই বড়-বড়ে (লড়ি) ট্রাক ফ্রুন্টসলিং দিয়ে ভুটানে প্রবেশ করে। এই গাড়িগুলোর দিকেই থাকে সুবিশাল গেইটে সিপাহিদের তীক্ষ্ণ নজর!

এছাড়া সিপাহিরা মানুষজন আসা-যাওয়ায় কাউকে কিছুই বলে না। আমাকেও কিছু বলেনি। আমি হাঁটতে-হাঁটতে ফ্রুন্টসলিঙের বেশখানিক ভেতর চলে গেলাম, নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে!

ফ্রুন্টসিলিং, ভুটানের একটা বানিজ্যিক শহর। এই ফ্রুন্টসিলিং শহরটা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। ভারতের অংশ জয়গাঁও। এই জয়গাঁও আর ফ্রুন্টসলিং সমান উঁচু দেখা গেলেও, ফ্রুন্টসলিং জয়গাঁও’র চেয়ে অনেক উঁচু!
ফ্রুন্টসলিং আর জয়গাঁ একসাথেই মিলে-মিশে পাশা-পাশি। জনবসতি আর ছোট-বড় বিল্ডিং, শপিংমল থাকার কারণে জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং পাহাড় মনে হয় না। কিন্তু সমতল ভূমি থেকে জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং অনেক উঁচুতে। সমতল ভূমি থেকে জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং কতখানি উঁচুতে, তা বোঝা যায় ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে গেলেই।

ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে একটা বড় বৌদ্ধবিহার আছে। বৌদ্ধবিহারের সামনেই বড় ড্রামের মতো আছে। এই ড্রামটাকে বলা হয়, প্রার্থনা ড্রাম বা প্রার্থনা চাকা বা ঢোল। সেই ড্রামে বৌদ্ধদের ধর্মীয় শাস্ত্র-গ্রন্থের মন্ত্র ❝ওম মানি পদমে হুম❞ লেখা থাকে।

এই প্রার্থনা ড্রামের সামনে গিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মাথা নিচু করে দু’হাত জোড় করে ভক্তি করে। তারপর প্রার্থনা ড্রাম কয়েকবার ঘুরায়, আর মুখে মন্ত্রপাঠ করে।

বৌদ্ধ ধর্মে প্রার্থনা ড্রাম ঘুরানোর মানে হলো, ❝মানুষের হৃদয়কে করুণা ও ভালবাসায় পূর্ণ করতে সহায়তা করা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বিশ্বাস করে যে, নিজের হৃদয়ে আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে ঢোল ঘোরানো মানে প্রভুর হৃদয়ের সাথে নিজের হৃদয় স্থাপন করা। তাদের ধারণা এই প্রার্থনা ড্রাম বা চাকা বা ঢোল ঘুরানোর ফলে প্রভুর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এই ধরাধামে বেঁচে থাকা যায়।❞

এই বৌদ্ধবিহারের সামনে দিয়েই ভারত থেকে ভুটানের রাজধানী থিম্পু পর্যন্ত হাইওয়ে। ভারত-ফ্রুন্টসলিং টু থিম্পু হাইওয়ে ঘেঁষে একটা খালের মতো আছে। এটা আসলে খাল বা নর্দমা নয়! এটা ভুটানের কোনোএক পাহাড়ের ঝর্ণা। খালের মতো দেখতে সেই ঝর্ণা দিয়ে দিনরাত যেভাবে পানি নামে আসে, তা দেখেও মনে ভয় হয়!

ভয় হয় এই কারণে যে, ওই পানিতে নেমে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। পানিতে নামার সাথে-সাথে তীব্র স্রোতে মুহূর্তেই টেনে নিয়ে যাবে, অন্য কোথাও। এই পাহাড়ি ঝর্ণা ভুটানের কোন পাহাড় থেকে উৎপন্ন, তা-ও আমার অজানা থেকে যায়। শোনা যায় এই ঝর্ণার প্রবাহিত খালের পানি থেকে ভারত-ভুটান যৌথভাবে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, এই ফ্রুন্টসলিঙে।

ঝর্ণার পানি প্রবাহিত হওয়া খালটা ফ্রুন্টসলিং টাউন থেকে অনেক নিচে। এই ঝর্ণা খালের ওপারে যেতে ছোট একটা ব্রিজ আছে। খাল পাড় হয়ে যাওয়ার পর চোখে পড়লো, একটা কুমিরের খামার। কুমিরের খামারটাও অনেক বড়। দিনের বেলা খামারের চারপাশ দর্শনার্থীদের ভীড় থাকে।

দেখলাম, সেই খামারে কুমিরগুলো কিন্তু পানিতে থাকে না। থাকে শুকনো জায়গায়। পানির সামান্য ব্যবস্থা শুধু ছোটো একটা পুকুরের মতো। সেই কুমিরের খামারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কুমিরগুলো দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে এই ফ্রুন্টসলিঙে ছুটে আসে। লোকের ভীড় থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।

আর অনেক দর্শনার্থীদের সাথে আমিও ঘুরে-ফিরে খামারের সামনে অনেকক্ষণ সময় কাটালাম। তারপর ঝর্ণার খালটা পাড় হয়ে ফ্রুন্টসলিং টাউনের উপরে উঠে গেলাম। মনের আনন্দে ঘুরতে থাকলাম, ফ্রুন্টসলিং টাউনের এপাশ থেকে ওপাশ।

ফ্রুন্টসলিং টাউন খুবই সুন্দর! আমি যতক্ষণ সময় ফ্রুন্টসলিং টাউনে ছিলাম, ততক্ষণ আমার মনে হয়েছিল আমি গণচীন অথবা হংকঙের কোনোএক শহরে ছিলাম। উঁচুনিচু রাস্তা। রাস্তার পাশেই ছোট-বড় শপিংমল, বার, নামি-দামি হোটেল, আর বাহারি ফুল ও ফলের দোকান। ফ্রুন্টসলিং টাউনের এক কোণে প্রতিদিন বিকেলবেলা স্থানীয় বাসিন্দাদের সুবিধার্থে সন্ধ্যাকালীন বাজারও মেলে।

সেই বাজার রাত আটটা অবধি চলে। রাত আটটার পরপরই টাউনের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। আর ভারত-ভুটান বর্ডার গেইট বন্ধ হয় সন্ধ্যার একটু পরই।

ফ্রুন্টসলিং টাউনের বাইরেও জয়গাঁও সপ্তাহে দু’দিন স্থানীয়দের হাট মেলে। সেই হাটের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ভারতীয়। সপ্তাহিক এই হাটে ভুটানি ব্যবসায়ীও আছে। তাদের ব্যবসা নিজের জায়গায় ফলানো তরিতরকারি, নিজেদের গাছের সুপারি, পাহাড়ের ঝোপঝাড় থেকে নানারকম শাকসবজি আর তরতাজা ফলের।

হাটবারে ভুটানিরা জয়গাঁও আসে অনেক দূরদূরান্ত থেকে। ফ্রুন্টসলিঙে গাড়ি চলাচলের জন্য একটামাত্র রাস্তা যা, ভারত-ভুটান হাইওয়ে নামে পরিচিত। এছাড়া ফ্রুন্টসলিং টাউনের আশ-পাশ দিয়ে ভুটানি স্থানীয়দের চলাচলের জন্য আর কোনও রাস্তা চোখে পড়েনি। তারা হাটবারে যার-যার বাড়ি-ঘর থেকে পায়ে হেঁটেই আসে।

ফ্রুন্টসলিঙে আর জয়গাঁও ঘুরে-ফিরে বুঝেছি, তাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে ফল জন্মায়। ফলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফলন হয় কমলা। এর সাথে আপেল, আঙুর-সহ আরও নানারকম ফলও দেখা যায়। বেশিরভাগ বিক্রেতা ভুটানি মহিলা।

তারা ভারতের ভেতরে জয়গাঁও এসে ফল বিক্রি করে। আবার সন্ধ্যার আগে তাদের গন্তব্যে ফিরে যায়। কেউ কেউ ভারতের জয়গাঁও হাটে এসে বাজার-সদাইও করে নেয়।

এছাড়াও ভুটানের জনগণ সবসময়ের জন্যই ভারতে আসা-যাওয়া করতে পারে। আবার ভারতের জনগণও একইভাবে আসা-যাওয়া করে থাকে। ভুটানিরা শুধু আসা-যাওয়াই নয়, ভুটানিরা ভারতে এসে কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রতিদিন।

অনেক ভুটান নাগরিককে ভারত এসে স্থায়ীভাবে বসবাসও করতে দেখেছি। ভারতের ভেতরে তাদের বসবাস সবচেয়ে বেশি ভারত-ভুটান সীমান্ত ঘেঁষা এলাকাগুলোতে। তবে তুলনামূলকভাবে বেশি বসবাস গুমট আর ফ্রুন্টসলিং ঘেঁষা জয়গাঁও এলাকায়।

ভুটানি জনগণ খুবই মিশুক। তারা খুব সহজেই একজন মানুষকে আপন করে নিতে পারে। তাদের আচার-ব্যবহারও মনে রাখার মতো। তা বোঝা গেলো দুপুরবেলা ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে থাকা একটা খাবারের হোটেলে ঢুকে।
হোটেলটা বেশি একটা বড়সড় নয়। কিন্তু এই হোটেলে দিনের সারাটা সময় থাকে কাস্টমারের ভীড়। হোটেলের ক্যাশে বসা একজন যুবতী মহিলা। হোটেল বয় বলতে যাদের দেখলাম, তারা সবাই মহিলা। হোটেলের মালামাল সংগ্রহ করে আনার জন্য হয়তো পুরুষ কর্মচারী থাকতে পারে। কিন্তু হোটেলের ভেতরে কোনও পুরুষ দেখা যায়নি।

হোটেলের ভেতরে গিয়ে বসার জন্য আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, কিন্তু বসার সুযোগ হচ্ছিল না। একজন মহিলা কর্মচারী আমাকে ফলো করে সামনে এসে তাদের ভাষায় কি যেন জিজ্ঞেস করছিল। তার কথার উত্তর যখন আমি দিতে পারছিলাম না, তখন হোটেলের মহিলা বুঝতে পারলো আমি তার ভাষা বুঝিনি। তারা শুধু তাদের ভাষাই নয়, তারা ভারতের সবকটা প্রদেশের ভাষা জানে এবং যখন যেই ভাষার দরকার-সেই ভাষায় কথা বলে।

তাই আমি যখন তার কথার উওর দিতে পারছিলাম না, তখন ওই মহিলা আমাকে বাংলায় জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি ভাত খাবেন?”
আমি বললাম, “ইচ্ছে ছিলো ভাত খাওয়ার। কিন্তু কী করে খাবো? লোকের ভীড়ের জন্য তো ভেতরে যেতে পারছি না।”
আমার কথা শুনে ওই মহিলা বললো, “একটু অপেক্ষা করুন, আমি ব্যবস্থা করছি।”

দশ মিনিট পরই হোটেলের ভেতর থেকে ওই মহিলা আমাকে হাতে ইশারা দিয়ে ভেতরে ডেকে নিয়ে একটা সিটে বসিয়ে দিয়ে বললো, “কী খাবেন? মাছ না সবজি?” বললাম, “মাছ ভাত খাবো!”

দুই মিনিটের মধ্যেই একটা স্টিলের থালায় করে খাবার নিয়ে এসে আমার সামনে দিয়ে চলে গেলো। আমি খাবার দেখে অল্পক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম! থালার মাঝখানে অপ্ল দুমুঠো চিকন চালের ভাত। ভাতের চারদিকে সাজানো আছে সবজি কাটা আর তরকারির ছোট-ছোট বাটি।

এ-সবের মাঝে ডাল ছিলো তিন রকমের তিনটে বাটি, ভাজি এক বাটি। আর রুই মাছের তরকারি এক বাটি।

এসব দেখে আমি খাওয়ার ভা-ও পাচ্ছিলাম না। পাশে বসা কাস্টমারদের খাওয়া দেখে তাদের মতো করে খেলাম। তাদের রান্না করা তরকারিগুলো খেতে খুবই ভালো লেগেছিল।

খাওয়া-দাওয়া সেরে ক্যাশের সামনে যেতেই ওই মহিলা ক্যাশের সামনে গিয়ে তাদের ভাষায় খাবারের মূল্যের পরিমাণ বলে দিয়ে চলে গেলো। আমি আমার পকেট থেকে ভুটানি একশো টাকার একটা নোট বের করে ক্যাশে দিলাম। ক্যাশে বসা মহিলা আমাকে আশি টাকা ফেরত দিলো। আমি টাকা হাতে নিয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে সোজা ফ্রুন্টসলিং ত্যাগ করে জয়গাঁও চলে এলাম।

জয়গাঁ এসে দেখি চারটে বাজতে লাগলো। পকেটে টাকা ছিলো প্রায়ই একশো ষাট টাকার মতো। বীরপাড়া যেতে বাস ভাড়া বিশ টাকা খরচ হলেও আরও বেশ ক’টা টাকা আমার কাছে থাকে।

এই ভেবে এক ভুটানি ফল বিক্রেতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এক ঝুরি কমলার দাম কত?”
মহিলা ফল বিক্রেতা বললো, “একশো টাকা।”
আমি আশি টাকা দিতে চাইলে ফল বিক্রেতা মহিলা আমাকে আশি টাকায় এক ঝুরি ফল দিয়ে দিলো। এক ঝুরি ফল মানে ষোল হালি কমলা।

ফলের ঝুরি নিয়ে বাস কাউন্টারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্ট্যান্ডে একটামাত্র বাস দাঁড়িয়ে আছে। বাস ড্রাইভার আমার পরিচিত ছিলো না। এই বাস-ই বীরপাড়ার শেষ বাস। যাত্রী সীমিত! বাসে উঠে সিটে বসলাম। আরও কিছু যাত্রী উঠলো। এর কিছুক্ষণ পরই বাস বীরপাড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলো। সন্ধ্যার পরপরই পৌঁছে বীরপাড়া। সেখান থেকে কমালার ঝুরি হাতে নিয়ে চলে গেলাম দিদির বাড়ি।

বড় দিদি ফলের ঝুরি দেখে মাথায় হাত রেখে বললো, “এতো, কমলা খাবে কে-রে? কোত্থেকে এনেছিস, শুনি?” বললাম, “ফ্রুন্টসলিং গিয়েছিলাম, দিদি। হাতে কিছু টাকা ছিলো। তাই ঝুরি-সহ কমলাগুলো নিয়ে এলাম। এগুলো আশ-পাশের বাড়ির ছেলে-মেয়েদের হাতে কিছু দিয়ে নিজেরা খাবেন।”

আমার কথামতো বড়দি তা-ই করলো। নিজেদের জন্য কিছু কমলা রেখে, আমার বেয়াই বাড়ি-সহ আশেপাশে থাকা আরও বাড়িতে বাদবাকি কমলা বিতরণ করলো। এভাবেই শেষ হলো ফ্রুন্টসলিং থেকে আনা এক ঝুড়ি কমলা, আর শেষ হলো আমার শূন্য হাতে ভুটান ফ্রুন্টসলিং ভ্রমণের গল্প।

পিকনিকের হাসি-কাঁন্না

fd

১৯৮২ সাল। ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। কলেজের পিকনিক হয়, হবে করে করেও প্রথম বছর পেরিয়ে গেলো। আমাদের ক্লাসের বন্ধু-বান্ধবী সবার মনের মধ্যেই ইচ্ছের সাত রং পাখার প্রজাপতিটা মরতে শুরু করলো। সবায় চায় পিকনিক কিন্তু কোন শিক্ষক এগিয়ে এসে দায়িত্ব নেয় না। শেষে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে আমাদের কেমেস্ট্রি স্যারকে রাজি করালাম। স্যার রাজি হয়ে প্রমাণ করলেন রসায়নের টিচার বলেই হয়ত তার যথেষ্ট রস আছে এখনো। আমরা স্যারের নামে ধন্য ধন্য রব তুললাম। পিকনিকের স্থান নির্বাচিত হলো যশোরের পিকনিক কর্ণার। যারা পিকনিকে যাবে বলে কনফার্ম করেছে তাদের বুকের মধ্যে প্রতিদিনই একটা চিকন আনন্দ নূপুর পায়ে নেচে বেড়াচ্ছে। আমরা যাবো ট্রেনে করে। আমরা সবাই খুব খুশী বিশেষ করে ছেলেরা। লম্বা ট্রেন ভ্রমনে ক্লাসের মেয়েদের সাথে খুনসুটির এক মহা সুযোগ পাওয়া যাবে। স্যার সবাইকে নিয়ে মিটিং করলেন। বিভিন্ন দায়িত্ব ভাগ করে দিলেন দুই-তিন জনের একটি একটি গ্রুপ করে। আমি আর মুসা মিলে এক গ্রুপ এবং আমাদের দায়িত্ব পরলো পিকনিকের খাসী কেনার এবং দুইটা খাসীর দেখভাল করে পিকনিক স্পট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। এক কথায় আমরা হলাম খাসির কেয়ার টেকার।

নির্ধারিত দিনে আমরা সবাই জয়পুরহাট রেল স্টেশনে। কলেজের সামনেই রেলস্টেশন। যথা সময়ে পার্বতীপুর-খুলনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি এসে দাঁড়ালো প্লাটফর্মে। সবাই সবার মতো করে উঠে পড়লো ট্রেনে। সবার শেষে আমি আর মুসা পরম আদরের সাথে সর্ব শক্তি দিয়ে কোলে করে খাসী দুটিকে উঠলাম ট্রেনে কিন্তু এর মধ্যে যা হবার তাই হলো। কোলে করে ট্রেনে উঠবার সময় অতি আদরে আদোরিত হয়ে ব্যাটা খাসী আমার গায়ে দিলো হিসি করে। ইতিমধ্যে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। সারা গায়ে ছাগলের পেচ্ছাবের গন্ধ। বন্ধুরা কেউ পাশে বসতে নেয় না। পাশে বসা তো দূরের কথা, বান্ধবীরা তো আমাকে দেখলেই মুখে ওড়না চেপে ধরে। আমার সকল আশায় গুড়েবালি। যে বান্ধবীর পাশে বসবো বলে এতদিন মনে মনে ভেবেছি, ছবি এঁকে রেখেছি সেই কিনা গিয়ে বসলো স্যারের পাশে। হায়রে কপাল। হায়রে ছাগল, এতো আদর করে কোলে করে ট্রেনে উঠালাম আর সেই তুই কিনা দিলি আমার গায়ে পেচ্ছাব করে। কপাল আমার।

যাক, যথা সময়ে যশোর পৌঁছালাম। মাইকের দায়িত্বে যারা ছিলো তারা মাইক লাগিয়ে তাদের পছন্দ মতো গান বাজতে লাগলো। কখনো কখনো মনের না বলা কথাগুলো গানের ছলে নিজের পছন্দের মানুষটিকে বলার চেষ্টায় কেউ কেউ নিজেকে ব্যস্ত রাখলো। রান্নার আয়োজন শুরু করেছে একদল। কসাই এনে খাসি জবাই শেষ করেছি। কসাই উপর দায়িত্ব দিয়ে আমি আর মুসা কাউকে না জানিয়ে চুপ করে চলে এলাম রিক্সা নিয়ে সোজা সিনেমা হলে। এ-এক কঠিন নেশা তখন। নতুন সিনেমা কোন ভাবেই মিস করা যাবেনা। তা যা কিছুর বিনিময়ে হোক। আর তা যদি হয় সোহেল রানা আর সুচরিতার সিনেমা। আমরা মনে মনে হিসেব করে নিয়েছি রান্না-বান্না শেষ হতে কমপক্ষে ঘন্টা দুয়েক লাগবে। ইনশাল্লাহ আমরা তার আগেই ফিরে এসে এক সংগে খাবো কিন্তু সুচরিতার নাচ আর সোহেল রানার ফাইটিং আমাদের হিসেবে কখন যে গড়মিল করে দিয়েছে তা টের পাইনি।

যখন টের পেলাম তখন সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। ভয়ে ভয়ে ফিরলাম পিকনিকে। এসে দেখি খাওয়া-দাওয়া শেষ। সবাই সব কিছু গুছিয়ে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছে। আমাদের দুজনের প্রতি কারো কোন উৎসাহ নেই, কারো কোন কিছু জানবার আগ্রহ টুকুও চোখে পরলো না। এমনকি যে খুব কাছের বন্ধু সেও নির্বিকার। স্যারও কিছুই বলছে না। মনে সাহস আনবার চেষ্টা করছি কিন্তু ঠিক সে সময় এক বন্ধুর ইশারা জানিয়ে দিলো ঝড়ের পূর্বাভাস। এবার স্যার আমাদের দু’জনকে কাছে ডাকলেন। ভাবলাম হয়ত কিছু বকা দিয়ে আমাদের জন্য উঠিয়ে রাখা খাবার খেতে দেবেন। যত অপরাধ-ই করিনা কেনো ছাগল দুটিকে তো আমরাই এত সেবা যত্ন দিয়ে নিয়ে এসেছি। এখনো আমার গায়ে পেচ্ছাবের বিকট গন্ধ যার জন্য আজ সারাদিনে বান্ধবীর সান্নিধ্য পেলাম না। না পাই, আপাতত খাবারটা পেলেই চলবে। পেটে রাজ্যের ক্ষুধা। কিন্তু না, স্যার সব প্রত্যাশার গলা টিপে ধরে মাংশ রান্নার বড় দুটি হাড়ি দেখিয়ে বললেন- তোমারা দুজন ঐ দুটি হাড়ি খুব ভালো করে পরিষ্কার করে ডেকোরেটরকে দিয়ে সোজা স্টেশনে এসো। স্যারের এই নির্মম আদেশ পেয়ে এবার আমি সত্যি সত্যিই টের পেলাম আমার শরীরে ছাগলের পেচ্ছাবের বিকট দুর্গন্ধ। আমি বমি করে দিলাম সেই গন্ধে আর ক্ষমা করে দিলাম সেই সব বান্ধবীদের যারা আমাকে দেখলেই মুখে ওড়না চেপে ধরছিলো।

খাসির মাংশ রান্না করা হাড়ি পরিষ্কার করে কাঁদতে কাঁদতে স্টেশনে এলাম অনাহারে, রাগে, দুঃখে, অভিমানে। ট্রেন এক ঘন্টা লেট। মনে মনে স্যারের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছি আর প্ল্যান করছি দুজন মিলে, কি করে স্যারকে একটা ছ্যাঁকা দেয়া যায়। আবার ভয়ও পাচ্ছি। ওলট-পালট কিছু করলে স্যার যদি প্র্যাকটিক্যালে ফেল করিয়ে দেয়, তাহলে তো সব শেষ। ঠিক তখনি স্যারের ডাক। কাছে গেলাম ভয়ে ভয়ে। আড়ালে নিয়ে গেলেন। আরো ভয় পেলাম। স্যার এবার পকেটে হাত দিলেন। তারপর আমাদের দুজনকে তিনশো প্লাস তিনশো ছয়শো টাকা দিয়ে বললেন-সমানে বড় হোটেল আছে, গিয়ে যা ইচ্ছে হয় খেয়ে আয় তাড়াতাড়ি। স্যার হাসতে হাসতে আরো বললেন-হোটেলে যাবি কিন্তু, সিনেমা হলে নয়। ১৫০ টাকা পিকনিকের চাঁদা দিয়ে পেলাম ৩০০ টাকা। মূহুর্তেই আমাদের সব রাগ-অভিমান, দুঃখ-কষ্ট ধুয়ে মুছে গেলো আর আমার শরীরে ছাগলের বিকট পেচ্ছাবের গন্ধ যেন সন্ধ্যার ধুপের গন্ধ হয়ে বান্ধবীদের নাকে চেপে রাখা ওড়না সড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। মনের আনন্দে হাঁটতে লাগলাম হোটেলের দিকে।

পিকনিক-২০২২ এসে আজ ৪০ বছর পর স্মৃতিরা আমায় কাঁদিয়ে গেলো, ভাসিয়ে নিলো অন্যরকম সুখে। জানিনা, স্যার আজ কোথায়, কেমন আছে। বন্ধুরা আজ কোথায় কেমন আছে। মুখে ওড়না দেয়া বান্ধবীরা আমার কোথায় আছে কেমন আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনাদের মাঝে আমি আমার স্যারকে খুঁজি, বন্ধুকে খুঁজি, খুঁজি মুখে ওড়না চেপে রাখা বান্ধবীদের। এবার আমার পিকনিকে যাওয়া হয়নি। পৃথিবীর কোন এক নির্জন ছায়াতলে বসে তোমাদের খুঁজে পেতে চাই হাঁসতে চাই, কাঁদতে চাই, ভাসতে চাই স্মৃতির ভেলায়। পিকনিকে যেতে চাই।

নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রিয়জনকে লিখা পত্র

তারিখ: বুধবার, ০১ জানুয়ারি ২০২৩ ইং

প্রিয় বন্ধু রিপন (গিট্টু রিপন)
রাজপথের হে দীপ্ত সৈনিক সহযোদ্ধা তোকে জানাই সালাম। জানাই নববর্ষ ২০২৩ এর শুভেচ্ছা। তোর কথা, তোর রাজনৈতিক দর্শন, কথাকাটাকাটি, চা আসরে আড্ডা খুব মনে পড়ে। তুইতো এখন আমেরিকা আছিস।লসএঞ্জেলেসে। শুনেছি সেখানে খুব বরফ পড়েছে। বরফের চাদরে ঢেকে গেছে রাস্তাঘাট সব। তুই কেমন আছিস? ভালো তো। আজ নববর্ষের দিনে তোকে খুব মিস করছি। মনে আছে আমি আর তুই মিলে একবার নববর্ষে একটি ছাত্র সংগঠন থেকে পাহাড় ঘেরা কুমিল্লার ময়নামতি গিয়েছিলাম।সেখানে হঠাৎ আমরা দুজন এপথ ওপথ ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের লিডার নিপু ভাই কি টেনশনে না পড়েগিয়েছিল। পরে মসজিদের ইমাম সাহেব আমাদের নিয়ে আসে। হু ভাল কথা মসজিদের ইমাম সাহেবের একটা আমাদের বয়সিই হবে সুন্দর মেয়ে ছিল। পর্দার ফাঁক দিয়ে আমাদের পানি দিয়েছিল। আমি তখন তোকে বলেছিলাম এমন একটা মেয়েকেই বিয়ে করব। তুই এমন জোড়ে আমাকে একটা ধাক্কা দিয়েছিলি যে, হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে ভেঙ্গে গেল। আবার কাঁচের টুকরো তুলতে গিয়ে হাত কেটে রক্তারক্তি কারবার। আমাদেরকে সবাই মানিকজোড় বলতো। পাড়ার বন্ধুরা ছড়া কেটে ক্ষেপাতো-

রিপন স্বপন ভাই ভাই
পথে পাইলো মরা গাই
রিপন বলে খাইয়া যাই
স্বপন বলে লইয়া যাই

আজ আরেকটি নববর্ষ এল তোর সাথে থেকে দুজনের দুষ্টমি গুলো খুব মনে পড়ছে। মাসুম ভাইকে তুইতো চিনিস। খিলগাঁও পোস্ট অফিসের পিছনে থাকতেন। পাগলা কিছিমের মানুষ। আমাদেরকে শাহী মসজিদে রোজার দিনে গল্পের বই দিতেন। নানা প্রতিযোগতার আয়োজন করতেন। তারপর সাতাশ রমজানে ইফতার পার্টি হতো।

তার সাথেই আমার কর্ম জীবনের হাতেখড়ি।এইতো তার উদ্যোগে উনিশ সালের শেষ দিনটির সূর্যাস্ত ও বিশ সালের সূর্যোদয় দেখব বলে কদিন আগে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন ভ্রমন করে আসলাম।৩ দিন ৪ রাত্রির প্যাকেজ। ঢাকা থেকে বাসে রওনা করে আটলান্টিক নামক সী বোর্টে চরে স্বপ্নের দ্বীপ সেন্টমার্টিনে পৌঁছলাম।

উড়ন্ত সিবার্ড আর সাগর মিলে যেনো সৌন্দর্যের লীলাভূমি রচনা করেছে। বোর্ট থেকে এর সৌন্দর্য যে কি রোমাঞ্চকর ছিল বলে বুঝাতে পারবো না। খুব মজা করেছি। তুই সাথে থাকলে আরো মজা হতো। অবশ্য তোর মত একজন সাংবাদিক বন্ধু বলি বা কলিগ একজন কিন্তু ছিল। বেটা আর আমি হোটেলে একই রুমে ছিলাম। দারুণ মজার লোক। আমারা মোট তিন জন। আমাদের জন্য একটি রুম বরাদ্দ হল। এর মধ্যে একজন সাংবাদিক।সামুন ভাই। এছাড়া আমার সাথে আরো যে দুজন আছে তাদের একজন উকিল। তার নাম মোস্তাফিজ আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার নাম সাইফুল। চারজনের ক্ষণ কালের সংসার। গা- গোসল ধোয়ার জন্য রুমের বাথরুমে ঢুকে দেখি পানি নাই। ল্যা ঠ্যালা। প্রথম দিনেই এই অবস্থা। কটেজের মালিককে জানাতেই তিনি মটর ছাড়লেন। আমি একটু অবাক হলাম এই সাগর ঘেরা দ্বীপে বিদ্যুত এলো কিভাবে? জানলাম এখানে সৌর বিদ্যুত ব্যবহার করা হয়।

বিকেলে সৈকতের পথে হাঁটছি আমরা। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের বিখ্যাত “সমুদ্র বিলাস”। সন্ধ্যা হবার পথে সূর্য ডুবার জন্য প্রস্তুত সাগরের দূর দিগন্তে। আমারাও প্রস্তুত হলাম এই অপার সৌন্দর্যের লিলা অবলোকন করে স্বাক্ষী হতে এক অবিস্মরণীয় গোধূলি লগ্নের। কি সুন্দর দৃশ্য সূর্যটা আস্তে আস্তে সাগরের মাঝে বিলীন হয়ে গেলো।রেখে গেল এক স্বর্ণালী আভা। বিদায় ২০১৯ বিদায়। সবাই মিলে নতুন বছর এর জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করলাম।

রাতে গানের আসর বসল। চলল গান আর “মধু কই কই মোড়ে বিষ খাওয়াই লা” খ্যাত বাউল কবি রশিদ ভাইয়ের সাথে আড্ডা। আমাদের আড্ডা রাত দশটা পর্যন্ত চলল। এরপর বারবিকিউ দিয়ে ডিনার, সৈকতে ফানুষ উড়ানো দেখলাম।ঘরির কাটা রাত বারটা ক্রস করতেই শুরু হলো বর্ণালী আয়োজনে ২০২০ সালকে বরণ করে কেক কাটার উৎসব। সেদিন আমাদের প্রিয় মাসুম ভাইয়ের জন্মদিনও ছিল।

পরদিন আকাশ কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেল। আমোদের বছরের প্রথম সূর্যোদয় দেখার প্ল্যান বুঝি ভেস্তে গেল। কিন্তু না এর মাঝেও ক্ষনিকের জন্য রবি বাবু উকি দিলেন। আমরাও তাকে দেখে স্বার্থক করলাম নিজেদের। স্বাগত ২০২০।

বন্ধু এ সফর আরো দীর্ঘ ও রোমাঞ্চকর ছিল পরে অন্য এক সময় শেয়ার করব। আজ আর না। ভাল থাকিস। ভাবিকে আমার সালাম দিস। বাচ্চাদের জন্য রইল অফুরন্ত আদর ও ভালবাসা। দেশে কবে আসবি জানাস কিন্তু। তোকে নিয়ে আরেকটি রোমাঞ্চকর অভিযানে বেড়িয়ে পরব।

আল্লাহ হাফেজ।
শুভেচ্ছা অনন্ত,
স্বপন (ঘাউরা স্বপন)

জীবন যেখানে যেমন

বৃহস্পতিবার রাত এবং শুক্রবার সারাদিন মেস বন্ধ থাকে, যাদের সাথে মেসে খাই তাদের প্রায় সবার বাড়ি মোটামুটি কাছে হবার কারণে তারা সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে বাড়ি চলে যায় তারজন্যই মূলত মেস বন্ধ থাকে, আমার বাড়ি দূরে হবার কারণে যেতে পারিনা। সাধারণত এই সময়ের খাবারটা আমার হোটেলে খেতে হয়, শুরু থেকে ইচ্ছেটা এমন যে প্রতিবার নতুন নতুন হোটেলে খাবো এতে ঘুরাঘুরি হবে সাথে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদও পাবো।
.
প্রথম কয়েক সপ্তাহ এমনটাই করলাম কিন্তু এখন সেটা করিনা একটা ছেলের জন্য। মেস বন্ধ থাকলে এখন ওর ওখানেই যাওয়া হয়, আমি গেলে ওকে আর বলতে হয়না কখন কী খাবো। আর সম্ভবত ও আমার অপেক্ষা করে কারণ আজকে দুপুরে জিজ্ঞেস করলো “এত দেরি করলেন যে ?” আর আমাকে ও যতটা যত্নের সাথে খাওয়ায় আর কাউকে ততটা যত্নের সাথে খাওয়ায় কিনা জানিনা।
.
বিষয়টা পরিস্কারভাবে বোঝার জন্য একটু পিছনে যেতে হবে। সপ্তাহ দুই আগে ওই হোটেলে দুপুরে খাবার জন্য যাই, রীতিমতো খাওয়ার শেষের দিকে জিজ্ঞেস করলাম কোন পানীয় হবে কিনা ? একজন ওয়েটার বললো আমাদের এখানে নেই তবে বাইরে থেকে এনে দেয়া যাবে। যশোরে এতবেশী গরম যে দুপুরের দিকে ঠাণ্ডা পানীয় না খেলে চলেনা।
.
সে যাইহোক সর্দার টাইপের ওয়েটার একটা ছেলেকে ডেকে আমার জন্য পানীয় আনতে বললো। আমি ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে ছেলেটাকে দিলাম, বড় নোট দিলাম যাতে সেটা ভাঙতিও হয়। ছেলেটার বয়স ৯-১০ বছর, এই বয়সের একটা ছেলে পড়াশোনা আর খেলাধুলায় মত্ত থাকার কথা অথচ ও এই হোটেলের সবথেকে কনিষ্ঠ ওয়েটার, ছেলেটা রোদের ভিতর বাইরে চলে গেলো। এদিকে প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট পার হয়ে গেলো ছেলেটা আসছেনা, আমার খাওয়াও শেষ হয়ে গেলো।
.
যিনি তাকে বাইরে পাঠালেন তিনি এগিয়ে এসে বললেন হয়তো নোট খুচরা করতে পারেনি, আপনি ক্যাশে দিলেইতো খুচরা করতে পারতেন। আমি বললাম ওহ তাইতো আমার খেয়ালই ছিলোনা, মনে মনে ভাবলাম ছেলেটা কি চলে গেলো ? তারপর বললাম আমি তাহলে বাইরে যাই, পথেই নিয়ে নেবো ওর থেকে, আমার আবার একটু কাজ আছে। এই বলে বিল চুকিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম।
.
বের হয়ে একটু আগাতেই দেখি পাশের এক দোকানের বেঞ্চিতে বসে ছেলেটা কোলাকোলার বোতল ওর গালে, কপালে ঘাড়ে চেপে ধরতেছে। আমাকে দেখতেই হচকয়িয়ে গেলো, আমি জিজ্ঞেস করলাম দেরি করতেছো কেন ? ও কোন উত্তর দিলোনা, ওর থেকে বোতল আর টাকা বুঝে নিয়ে বললাম ঠিক আছে। আর মনে হলো হয়তো ওর কোক খেতে ইচ্ছে করতেছে তাই বললাম দাঁড়ায়ও আর আমি কিছুটা খেয়ে বাকিটা ওকে সাধলাম, ও বললো নিবেনা ওর জ্বর, ঠাণ্ডা খাওয়া যাবেনা। বললাম ওষুধ খাওনি ? মাথায় পানি দেওনি ? মাথা নেড়ে জানালো কিছুই করেনি।
.
কপালে হাত দিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি অনেক জ্বর, তখন বোঝলাম কেন কোকের ঠাণ্ডা বোতল ওইভাবে চাপতেছিলো। তারপর বললাম এই জ্বর নিয়ে তুমি কাজ করতেছো কেন ? মালিকরে বলে বাড়ি চলে যাও, ও বললো যেতে দিবেনা আর গেলে হাজিরা দিবেনা। তারপর ওর সাথে আরও কথা হলো, ওর বাবা বেঁচে নাই, ওর মা বাসায় কাজ করে, ও স্কুলে পড়েছে থ্রি পর্যন্ত আর ওর বাবা মারা যাবার পর থেকে এখানে আছে। জোর করে ওকে একটা নরমাল কোক আর নাপা এক্সট্রা কিনে দিলাম, ও নিবেইনা, কারণ হিসেবে বললো মালিক জানলে বকবেনি, আমি বললাম এখানে খেয়ে যাও কোন সমস্যা হবেনা। ছেলেটা দ্রুত কোক খেলো, আমার সামনে টেবলেট খেতে বললাম, তারপর টেবলেট খেলো আমি বললাম হোটেলে গিয়ে মাথায় পানি দিবা। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলো তারপর শরীরে জ্বর নিয়েই আবার হোটেলের দিকে চলে গেলো…
.
১০/০৬/২০২০

বন্ধুর শূন্যতায়…….

মন আজ ‘বিয়োগান্ত’ বেদনায় মলিন।
হারিয়েছে ছন্দ, হারিয়ে সুর, তাল লয়
হারিয়েছে হৃদয়ের যত ভাব ভালবাসা
হারিয়েছে সুখ স্বপ্ন, হারিয়েছে আশা।
আজ কোন সুসংবাদ নেই
আছে দুঃসংবাদ।
প্রেম কিছুটা মধুর, কিছুটা বেদনা বিধুর।
কিছুটা কাল্পনিক, কিছুটা বাস্তব।
কিছুটা হতাশার, কিছুটা আশার।
এগুলো নিয়েই তো জীবন।
তারপরও বন্ধুর শূন্যতা মাঝে মাঝে মনকে-
নাড়া দেয় অব্যক্ত বেদনায়……………….।

বন্ধুত্ব, সে অনেকটাই আদিম প্রবৃত্তি। একমাত্র সম্পর্ক যার নেপথ্যে কোনও কারণ নেই। মানুষের পৃথিবীর গণ্ডি ছাড়িয়েও যে ছিল, আছে এবং থেকেও যাবে।
“বন্ধু মানে মেঘলা দুপুর শিশির ভেজা ভোর
বন্ধু মানে মনের মাঝে অনেকখানি জোর
বন্ধু মানে ভীষন কষ্ট একটু অভিমান
মনের মাঝে কোথায় যেন অনেকখানি টান . . . . . . . . . ।”

এক অকারণ অনুভূতির নাম বন্ধুত্ব? হাতে হাত রেখে পাশাপাশি চলাটাই বন্ধুত্ব? বন্ধুত্ব মানে বয়সের সাথে বয়সের মিল নয়, বন্ধুত্ব মানে মনের সাথে মনের, গোপনে হয়ে যাওয়া পরিচয়…..বন্ধুদের। জীবনের সংকটে বন্ধুই ছুটে যান বন্ধুদের কাছে। আবার আনন্দ, উল্লাস কিংবা দিন শেষের অবসরেও এরা ভালোবাসেন বন্ধুত্বের কলতান শুনতে। বন্ধুত্বের পরিপূরক সম্পর্কের মাঝে এরা খুঁজে পান জীবনযাপনের ভিন্ন রস। সেই অকৃত্রিম বন্ধু যেন অকালে হারিয়ে না যায় সেই কামনাই করি। কারন বন্ধুত্ব মানে দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা, শ্রদ্ধা, আন্তরিকতা, সমালোচনা করা অপমান বা কটাক্ষ করার মানসিকতা না। একেবারে আলাদা মর্যাদা, আলাদা একটা আবেদন। বন্ধুত্ব এমন একটা সম্পর্ক যার সাথে কোন সম্পর্কের তুলনা হয় না।

স্মৃতিচারণ – ২ মেয়েবেলার মেয়েরা

খুব ছোট্টবেলা থেকেই আমি একটা গাছ খুঁজতাম, নিজস্ব গাছ। আমাদের পুরনো ঢাকার বাসাটাতে তখন এমন কোনো গাছ নেই যে ছিল না। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা এমন কি কলা গাছ পর্যন্ত। কলা গাছের ঊর্ধ্বমুখি বিস্তার আর সজীব রঙ আমাকে বেশ লোভাতুর করত ওকে আপন করে নেবার জন্যে। কিনতু দেখতাম ফল দেবার পর ওকে বেশীদিন আপন করে রাখা যায় না, একেবারেই মিইয়ে যায়। আমি কাউকে বলিনি আমার এ বাসনার কথা, এমনকি ভাই হাসানকেও নয়। একা একা ঘুরতাম আমাদের বাগানে। দিনের বেলা যাকে খুঁজে পাইনি এক রাত্তিরে তাকেও পেয়ে গেলাম অকস্মাৎ।

সন্ধ্যার পর তখন প্রায়ই কারেন্ট চলে যেত। আমাদের জন্যে বরাদ্দ ছিল রাত ন’টা থেকে দশটা পর্যন্ত বিটিভি দেখা। ওটুকু সময়ের মধ্যেই আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিতাম, কেননা টিভিতে তখন চলত আমার প্রাণের ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট, সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, বায়োনিক উয়োম্যান, ম্যাকগাইভার, দ্য এ টিম এইসব সিরিজ। আমরা তখন এইসব হলিউডি নায়ক নায়িকার জীবন যাপন করতাম স্বপ্নে। তো এমনি এক রাতে আমাদেরকে হতাশ করে দিয়ে কারেন্ট চলে গেল রাত ন’টায়। মনে প্রবল কষ্ট নিয়ে আমরা তখন বারান্দার সিঁড়িতে বসে ভাইবোনেরা সব গল্প করার ছলে কারেন্টের ফিরে আসবার অপেক্ষায় আছি। উঠোনে আমার আয়া মা’র পাতা চৌকি। আয়া মা’ও গরমে হাসফাঁস করছে চৌকিতে শুয়ে। আমি তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম আর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরও পাইনি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তীব্র সুন্দর এক ঘ্রাণে। চোখ মেলে দেখলাম, একরঙা জ্যোৎস্নার চাদর ছড়িয়ে আছে আমার গায়ে, আশেপাশে। শুধু ক’টা গাছের নীচে ছোপছোপ উদাস জ্যোৎস্না আমার চারপাশটাকে কেমন অপার্থিব করে রেখেছে। কেন জানিনা ঐ মূহুর্তে সব শব্দ, সব কোলাহল কোথায় গিয়ে লুকিয়েছিল! সেই সময় বাদামওয়ালার হাঁকডাক ছিল না, পাশের বাড়ীর শিরিন, মুক্তিদের চীৎকার করে নামতা মুখস্তের মহড়া ছিল না, ছিল শুধু নৈঃশব্দ। আর ছিল সেই তীব্র সুন্দর গন্ধ। আমি পাগলের মত চৌকিতে উঠে বসলাম। পাশ থেকে আয়া মা আমার হাত চেপে ধরে বলল, ‘ডররাও কিও, আমি আছি ন!’ আমি জিগ্যেস করলাম, মা ও মা, এটা কিসের গন্ধ? এত সুন্দর!’ মা হেসে বল, ‘ইতানের নাম ছাতিম ফুল রে মাইয়া।‘

সেই থেকে আমার নিজের গাছ হয়ে গেল ছাতিম গাছটা। ওটা এত্ত বড় ছিল যে ওকে কখনো আমি জড়িয়ে ধরতে পারিনি সম্পূর্নভাবে। তারপরও ওর গায়ে আমি হাত বুলাতাম সময়-অসময়ে। এরপর থেকে আমাদের আড্ডার স্থান হয়ে গেল ছাতিম তলা।

স্কুলগুলোতে তখন গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। পুরো মহল্লা জুড়ে আমাদের হৈ হল্লা। গরম এলে কিছু কিছু মানুষ নাকি পাগল হয়ে যায়। আমাদের ঐ সময়কার অবস্থা ছিল তেমনই। আমরা সব যেন পাগল হয়ে যেতাম। আমি তখন ঠিক কোন ক্লাসে পড়ি মনে নেই। শুধু মনে আছে নূর আসিয়া তখন দশ/এগার বছরের বালিকা। আমাদের মেয়ে গ্রুপের সব চেয়ে ছোট সদস্য নূর আসিয়া, ওর চেয়ে আমি কয়েক মাসের বড়। বাকীরা আমাদের চেয়ে কেউ এক, কেউ দুই, এমন কি তিন চার বছরের বড়রাও আছে এবং বড়রা অনেকেই তখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আসলে তখন পুরনো ঢাকার মেয়েরা পড়াশোনায় একটু পিছিয়েই ছিল। পুরো মহল্লায় শিক্ষিত পরিবার ছিল মাত্র দু’টো। একটা জুয়েলাদের বাসা আর অন্যটা আমাদের। তো দেখা যেত ছুটির দিনগুলোতেও জুয়েলা পড়ছে কিনতু আমি ছিলাম রাজ্যের ফাঁকিবাজ। আমি কোনো রকমে সকালের পড়া শেষ করে বেলা ১০ টার মধ্যে বেরিয়ে পড়তাম পাড়া বেড়াতে। আমার ভাই হাসান আর অন্য ছেলেরা আমাকে নিয়ে চলে যেত বলিয়াদি বাড়ী। বলিয়াদি বাড়ীটা ছিল বিশাল, প্রায় তিন চার বিঘা জুড়ে। আমাদের এই দিকে পাকিস্থান মাঠ আর ভেতরের দিকে বংশাল হয়ে মাহুতটুলি। বলিয়াদি বাড়ীর পেছনের অংশ ছিল পাকিস্থান মাঠের দিকে, সামনেটা মাহুতটুলি। ওদের বাড়ী যেতে হলে অনেক রাস্তা পেরিয়ে মাহুতটুলি হয়ে তবেই ও বাড়ীতে ঢোকা যায়। কিনতু আমরা এই পেছন দিক দিয়েই দিব্যি পাঁচিল গলে ঢুকে যেতাম ওদের বাড়ীতে। এই পেছন দিকটায় নেই এমন কোনো গাছ ওদের ছিল না। আম, জাম, পেরায়া, কাঁঠাল এসব তো ছিলই তবে কি না ওসব গাছ আমাদেরও ঘরে ঘরেই ছিল। ছিল না যে ফল সেটা হল তুঁত ফল। অনেকটাই দেখতে রাশিয়ান ব্ল্যাক বেরির মত, আর স্বাদেও তেমনি টক-মিষ্টি। বড়রা বলত, ওসব খেলে পাগল হয়ে যায়। আমরা তাই কাউকে না জানিয়ে ও বাড়ীতে ঢুকতাম। আর সুবিধার বিষয় ছিল বলিয়াদি বাড়ীতে কেউ থাকত না, পুরোই পোড়ো বাড়ীর মতন প্রানবান প্রানহীনতায় বসবাস করা এক প্রাসাদবাড়ী। কিনতু অসুবিধার বিষয় ছিল ও বাড়ীতে একটাই লোক থাকত, ওদের বুড়ো পাহারাদার। ওহ সেই এক লোক ছিল। যেমন কর্কশ ওর গলা, তেমনি বিশ্রী তার ব্যাবহার। যদি কোনোদিন ও তোমাকে ধরতে পারল তো বোঝো, সারাদিন ঐ জঙ্গলে বেঁধে তো রাখবেই আবার বাপ মাকে ডেকে বাপের মারটুকুও ভালভাবে খাইয়ে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করাবে যেন এ জীবনে আর কখনো ওমুখো না হও আর সত্যিই একবার যে ওর মার খেত সে আর দ্বিতীয়বার ও বাড়ীতে ঢোকেনি তাই আমরা ও বাড়ীতে ঢুকতাম লিস্টেড কিছু বন্ধু বান্ধব নিয়ে। এমন কি আমার ভাই হাসান আমাকেও কখনো ঐ জঙ্গলে নামতে দেয়নি। ছেলেবেলায় পোলিও হয়ে আমার একটা পা এমনিতেই কমজোর। কে জানে ঠিক সময়ে দৌঁড়ুতে না পারলে তো ধরা। সে কারনেই আমি থাকতাম পাঁচিলের উপর বসে পাহারায়। ওরা ভেতরে গিয়ে ছিঁড়ে আনত সেই মিষ্টি মধুর রসে মাখা ফল। হাসান তখন পকেট ভরে ওগুলো এনে আমার কোঁচড়ে ঢেলে দিয়ে যেত আরো আনতে। আমাদের দুই ভাইবোনের চেহারা ঐ মূহুর্তে যদি কেউ দেখে থাকে তো সে জানে সুখ স্বর্গে নয় এই মাটির পৃথিবীতেই আছে। আমরা বড় হবার আগেই ঐ গাছ ওরা কেটে ফেলেছিল। আজো আমি আর হাসান মনে মনে ঐ ফলগুলোকে খুঁজি।

পেটভরে তুঁতফল খেয়ে ভাইরা চলে যেত সিনেমা হলের দিকে বেলা ১২টা থেকে মর্নিং শো দেখবে বলে আর আমি চলে যেতাম মেয়েমহলের দিকে। ছুটির সকাল তখন কেবল শুরুর দিকে।

তেমনই এক ঝকঝকে সকালে সূর্য্যিটা সবে এঁকেবেঁকে মাথার উপরে গিয়ে বসবার জন্যে একটা যুতসই জায়গা খুঁজতে খুঁজতে আরো পশ্চিমের দিকে ঢলে যাচ্ছে। আর আমাদের কচি চামড়া ফুঁড়ে ঘামের রোঁয়া বেশ চিকন ধারায় অলরেডি ফুটে বেরুতে শুরু করেছে। এমন মধুর এক দুপুর লাগা সকালে দেখলাম নূর আসিয়া ছুটে আসছে। ওর পরনে কমলা রঙের কুঁচি দেয়া ইজের আর গায়ে একটা ভেজা গামছা এক হাতের নীচ দিয়ে বেরিয়ে অন্য কাঁধের উপরে ফেলে দেয়া। গরম এলেই নূর আসিয়ার এই বেশ। গরমে নাকি ওর অনেক কষ্ট হয় তাই ও তার গামছাটা ঘন্টায় ঘন্টায় ভিজিয়ে গায়ে মেলে দিয়ে রাখে। ও এসেই কলকল করে হাসতে হাসতে বলল, ‘অই তরা হোন, আইজকা রাইতে আমার বিয়া, আমি যামুগা, তগো লগে আর আহুম না।‘ শুনে সবাই হৈ হৈ করে উঠলাম, কছ কি! সেদিন সারাদিন আমরা নূর আসিয়াকে স্পেশাল ট্রিট দিলাম মানে গাছের কষ্টি পেয়ারাগুলোর মধ্যে যেটা একটু কম কষ্টি সেটা ওকে দিলাম, পুতুলের যে মালাটা ও পছন্দ করেছিল সেটা আমি ওকে অম্লান বদনে দিয়ে দিলাম। আমাদের মধ্যে প্রথম কারো বিয়ে হচ্ছে তা’ও দলের সব চেয়ে ছোট মেয়েটির। আমরা বিচ্ছেদ বেদনায় অস্থির আবার খুশীও। ‘বিয়ে’ শব্দটা শুনলেই তো কেমন খুশী খুশী লাগে, তাই না!

আমরা মুখহাত ধুয়ে পড়তে বসেছি। আশেপাশের বাড়ীতে কোরাস করে অন্যরাও পড়ছে।

শিরিনের বিয়েটা হল আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে ম্যাচুউরড অবস্থায়, সতের বছর বয়সে। আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী, দলের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিতা। কাজে কাজেই সবার কাছে আমার দামটা একটু অন্য ধরনের। বৌভাতের পর শিরিন নাইওর এসেছে। আর আমরা সবাই ওকে ঘিরে বসে আছি বাসরঘরের মিঠে স্মৃতিকথা শুনব বলে। শিরিন ফিসফিস করে তখন বলছে, ‘এরপর সবতে বাইর হইয়া গেছে ঘর থিকা আর হেয় ঘরের দরজা দিয়া আয়াই আমার পাও ধইরা দিল একটা টান। আমি ডরে কাঁইপা উঠছি আর ওই করল কি পকেট থিকা একজোড়া সোনার বিছা আমার পাওয়ে বাইন্ধা দিয়া কইল, এমুন সুন্দর পাও জমিনে ফেলবা না। আমি সরমায়া গিয়া আস্তে কইরা কইলাম, তয় কই ফেলমু? ওই হাইসা দিয়া কইল, কেলা আমার বুকে ফেলবা, ফেইলা লৌরাইবা, ফালাইবা, যা মন তাই করবা আর তুমারে এমতে কইরা সোহাগ দিমু। কইয়াই হেয় আমার পায়ে একটা চুমা দিল আর আমার মেন্দি দেওয়া পাও ঘুরায়া ঘুরায়া দেখতে লাগল। তুবা তো আমার পাওয়ে নেলপলিস দিয়ে আট কইরা দিছে, সবই হেয় ভালা কইরা দ্যাখতাছে আর এই দিকে আমার মাথার ভিতর তখন কেমুন জানি করতাছে, সইল ঝিমঝিম করতাছে। আমি ঐ সুময় বহুত খুসী হইছি, কেলা কি তরা তো দেখছস তগো দুলাভাইরে। ক’ অক্করে ইলিয়াস কাঞ্চনের মতন লাগে না অরে দ্যাখতে?’ আমরা ‘হুঁ হাঁ’ করে উত্তর দিচ্ছি। আমাদের মধ্যে সবাই তখন বিবাহিতা, কেউ কেউ বাচ্চার মা। নূর আসিয়ার মেয়েই তো তখন আমাদের আঙ্গুল ধরে হাঁটে। শুধু আমারই তখনো বিয়ে হয়নি। আমি শিরিনের বাসরঘরের সিন্দুক খুলে অজানা জড়োয়াগুলো তখন লোভীর মত গিলছি, আহা বিয়ে না জানি কি জিনিষ! বাসায় ফিরেই তাই সোজা মার কাছে গেলাম। ঘরে তখন অন্য ভাইবোনেরা আড্ডা দিচ্ছিল। আমি মাকে গিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা মা আমার যে বয়েস হচ্ছে তা তো দেখছ। কই আমার বিয়ের জন্যে তো তেমন কিছু করছ না, ছেলে দেখছ না! দেরী হয়ে গেলে ভাল ছেলে আর কি করে পাবে?’ মা তো মা, ভাইবোনেরা পর্যন্ত অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হাল ধরার ব্যাপারে মা’র জুড়ি নেই, মা মুখ টিপে একটু হেসে বলল, ‘আরে তোর মনমত বর না পেলে বিয়ে দেই কি করে বল!’

বিয়ে পাগল মেয়ে ছিলাম বলেই কি না আমার বিয়েও হয়ে গেল ইন্টারমিডিয়েটের পর পর। আমার উপর দিয়েও অনেক জল গড়াল। এরই মধ্যে শুনতাম, শিরিনের সোনার দোকানী বরের আরো অনেকগুলো দোকান হয়েছে তাঁতীবাজারে তবু পর পর তিনটে মেয়ের জন্মদানের কারনে সে নিজেই কুন্ঠিত হয়ে আছে শ্বশুরবাড়ীতে। ওদের বাড়ীর উঠোনটা বিক্রি করে দিতে হয়েছিল ওর যৌতুকের যোগান দিতে। নিজের মেয়ে তিনটের কথা ভেবেই বোধকরি শিরিন পরবর্তীতে দারুন হিসেবী হয়ে উঠেছিল। সে কারনেই বড় হয়ে ওর দেখা কদাচিৎ পেয়েছি। তার তুলনায় বরং নুর আসিয়ার সাথে দেখা হত বেশ। ও তখন এক মেয়ে নিয়ে চলে এসেছে বাপের বাড়ী কারন ওর স্বামী ড্রাগ এডিক্টেড হয়ে পড়েছিল শেষের দিকে। এবং এক সময়ে মারাও গেছে। মুক্তি, শিরিন, রানী ওরা আমাকে পরবর্তীতে দেখলে যেমন জড়োসরো হয়ে পড়ত নুর আসিয়া তাদের তুলনায় ছিল স্মার্ট। আমাকে দেখলেই এক গাল হেসে দাঁড়িয়ে পড়ত আর হড়বড় করে অনেক কথা বলত। আমি আড়চোখে নুর আসিয়ার মেয়েটাকে দেখতাম, আহা কলা গাছের মত মেয়ে, বাড়ছে তো বাড়ছেই। আমি বলতাম, ‘নুর আসিয়া একে যেন অত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিস না!’ শুনে নুর আসিয়াও শিউরে উঠে বলত, ‘ না না বইন দোয়া কইরো, আমি য্যান অরে তোমগো মতন শিক্ষিত করতে পারি।‘

পেরেছিল নুর আসিয়া, মেয়েকে কলেজ অব্দি পড়াতে। আরো হয়তো পারতো কিনতু মাত্র ৩৪ বছর বয়সে সুন্দর এক সকালে নুর আসিয়া হার্ট এটাক করে পাড়ি জমালো মৃত্যুর দেশে। পরবর্তীতে ওর মেয়েটির কি হয়েছিল জানিনা। জানতে খুব ইচ্ছে করে। হয়তো একদিন জানতেও পারবো তখন না হয় বাকী গল্পটুকু শেষ করবো। আজ এটুকুই থাক, কি বলো!

আক্কেল সেলামী

873947

শীতের কোনো এক সন্ধ্যা! বাড়ি থেকে চট্টগ্রাম যাবো, আমার অনেকদিনের ইচ্ছা বিনা টিকেটের যাত্রীদের মত আমিও ট্রেনে যাই। তাই ভাইয়ের গাড়িতে না গিয়ে চলে গেলাম ফেনী রেল ইস্টিশনে। অপেক্ষার প্রহর শেষে ১৮:০৫’র ট্রেন আসলো ১৯:১০টায়। টিকিট ছাড়াই উঠে পড়লাম ‘ঠ’ বগিতে। ভিতরে দেখা হল আমার এক বন্ধুর সাথে। সে সিলেট থেকে তার স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। তাদের সাথে কুশল বিনিময় করতে করতে ট্রেন ছেড়ে দিল। আমি যে বিনা টিকেটের যাত্রী তার বৌর সামনে কেমনে বলি তাই সিগারেট খাওয়ার নাম করে আমি চলে এলাম দরজার পাশে। শীতের সন্ধ্যা বেলার বাতাস লাগছে; আমি চাদর মুড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছি আর কল্পনার রাজ্যে নিজেকে হারিয়ে দিলাম। হঠাৎ চা ওয়ালার ডাক; আমার ঘোর কেটে গেলো। এক কাপ চা খেয়ে দরজার পাশে পা দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। জোৎস্না রাতে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগে মগ্ন ছিলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার পিঠের সাথে নরম কি যেন লাগছে, পিছনে তাকাতেই দেখলাম তিনটা মেয়ে আমার মাথার উপর দিয়ে বাহিরে উঁকি দিতে চেষ্টা করছে। আমি কিছু না বলে বাহিরের দিকে মনোনিবেশ করলাম। তারা আমাকে উঠানোর জন্য কখনো গণ্ডার ( ঠান্ডা পড়ছিল) আবার কখনো চাচা ( চাদর মুড়িয়ে বসেছিলাম) বলে কটূক্তি করছিল। অনেক চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে নরম সুরে ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকছিল। আমিও নাছোড় বান্দা, শুনেও না শোনার ভান করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। শেষ মেশ উপায় না পেয়ে আমার পিঠের উপর হাত রেখে ডাকছিল। তারপর আমি উঠে জানতে চাইলাম-

কি সমস্যা?
আমরা দরজার সামনে দাঁড়াবো, আপনি সরেন।
আমি বললাম- মাইয়াদের ইয়েনে আইয়ুন নিষেধ।
আন্নেরা ইয়েনতুন যান।
একজন বলল-
আমরা এইখান থেকে যাব না, any problem?
আমি- ইংরাজি বুঝিনা, বাংলায় কন।
তারা হাসতে হাসতে আমাকে ক্ষেত, পাগল-ছাগল বললো, আমরা না গেলে আপনার কি সমস্যা?
আমি- আঁরতুন সিট নাই, হিল্যেই আঁই ইয়নে বইছি।
তারা- আমাদের সিটে গিয়ে বসেন।
আমি – না।
তারা- তাহলে আমাদের পিছনে দাঁড়াই থাকেন।
আমি কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
তারা ইংরেজি বাংলা মিশ্রণে ছেলেদের নিয়ে বকবক করেই চলছে।

[১৫মিনিট পর]
আমি – এইযে আপনারা সরেন।
একজন- No.
আমি ইংরেজীতে কয়েকটা বাক্য তাদের উদ্দেশ্যে বললাম।
তাদের একজন- বাহ্ ! বেশি চালাক।
আমি- চেষ্টা করছি, এখন চলে যান।
আবার তারা ভুলভাল ইংরেজী বলছে।
আমি – আপনারা কি করেন?
অনেক ভনিতার পর তাদের একজন- আমি JSC দিলাম, উনি আগ্রাবাদ মহিলা কলেজে HSC 1st year আর অন্যজন অনার্সে ভর্তি হবে। আপনি কি করেন?
আমি – এম.এ, এল.এল.বি পড়ছি।
তারায় মাথায় হাত দিয়ে ভাইয়া অনেক ডিস্টার্ব করেছি, sorry..
আমি – its ok.
চলে গেলো তারা।

আমি সিগারেট ধরালাম আর মনে মনে হাসলাম, এই বয়সের মেয়েরা বুঝি পাখির বাসায় পাখা গোছানো ছোট পাখির মত উড়াউড়ি করতে চায়, এক পর্যায় হঠাৎ করে নিচে পড়ে যায়। যাইহোক, কিছক্ষণ পরে আসলো দুইজন। ( মনে হচ্ছিল ৩০ কি ৩২ বছরের দুইজন মোহনীয় মহিলা)
না তারা মহিলা নয় হিজড়া।
হিজড়া- এই দাঁড়া, দাঁড়া আমার পেয়ারে লাল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
হিজড়া এসে আমার একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো-
টাকা দে; নইলে তোর ঠোঁট কামড় ধরবো।
আমি তাড়াতাড়ি একশ টাকা বের করে দিলাম।
টাকা নিলো না। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো আমি কি শুরু করবো?
আমি ওদের হাত থেকে বাঁচার জন্য দুইশত টাকা দিলাম। তারপর আমার গালে একটা টোকা দিয়ে চলে গেল।

ট্রেন ও এসে ইস্টিশনে থামলো। ৮০ টাকা দিয়ে টিকেট না করে ২০০ টাকা হিজড়া কে দিতে হলো।

ফিরে দেখা অতীত: তখন বাংলাদেশে সোনার মানুষ ছিল

FB_IMG_1604

সাল ১৯৭৮ (আমার অদেখা)
ঢাকা মেডিকেলের যৌতুকলোভী ও চরিত্রহীন ডাক্তার ইকবালকে কাজের মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলে স্ত্রী সালেহা।

ফলাফল – ইকবাল ব্লেড দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে সালেহাকে। বলে আত্মহত্যা। অস্থায়ী বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ইকবালের পরিবারের। সালেহার পরিবার বলে হত্যা। সালেহার পক্ষে দেশবাসী। ঐ সময় জেলা শহরগুলিতে পত্রিকা পৌঁছাতো একদিন পরে।

কম্পিউটারের প্রচলন ছিল না।
– প্রথম ও দ্বিতীয় দফা ময়না তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় আত্মহত্যা।দেশবাসী মেনে নেয়নি। তৃতীয় দফায় কবর থেকে লাশ তুলে আবার ময়না তদন্ত। এবার কোথায়? নেয়া হয় সলিমুল্লাহ মেডিকেলে।

ফলাফল – হত্যা।
ইকবালের ফাঁসির আদেশ।

পুলিশ
কিভাবে প্রমাণ করেছিল জানেন?
সালেহার দেহে ব্লেড টানার ধরণ দেখে মত দেয় – এটি কোন বাম হাতি অর্থ্যাৎ ন্যাটা মানুষের কাজ। ইকবাল ছিলেন বাঁ হাতি। সেখানেই শুরু এবং পুলিশ এক বিন্দুও ছাড় দেয়নি।

সাংবাদিক
সাংবাদিকরা পত্রিকার প্রথম পাতায় ছোট করে হলেও প্রতিদিন খবর ছাপিয়ে গেছে ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত, দেশবাসীও ছাড়েনি। এই ফাঁসির পেছনে বড় অবদান সাংবাদিকদের ছিল বিধায়, ফাঁসির পরে সাংবাদিকরা ইকবালের পরিবারের সাক্ষাতকার নিতে গেলে লাঠি দা নিয়ে ইকবালের পরিবারের সদস্যরা সাংবাদিকদের তাড়া করেছিল।

প্রেসিডেন্ট
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তাররা গেলে, তিনি তাদের তিরস্কার করে বের করে দেন।

বাড়তি প্রাপ্তি
এই হত্যাকাণ্ডের ফলেই ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে যৌতুক বিরোধী আইন পাশ হয়।

সাল ১৯৮৯ (আমার দেখা)
বাংলাদেশের দুই কিংবদন্তী ডাক্তার দম্পতি গাইনির মেহেরুন্নেসা ও ঢাকা মেডিকেলের প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাশেমের কুলাঙ্গার পুত্র মুনির জড়িয়ে পড়ে খুকু নামের এক বিবাহিতা মহিলা ও মায়ের বয়সী নার্স মিনতির সাথে অবৈধ সম্পর্কে। এই সম্পর্কের কথা স্ত্রী জেনে গেলে মুনির ও খুকু পরামর্শ করে স্ত্রীকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। মুনির খুন করে স্ত্রী-
– মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক নিজাম উদ্দিনের কন্যা শারমীন রিমাকে।
দেশ আবার ফুঁসে উঠে। কম্পিউটার তখনও সেভাবে আসেনি। ইন্টারনেট মোবাইল নেই। আবার প্রতিবাদে ফেটে পড়ে দেশ। পত্রিকার কাভারেজ, জনতার একাত্মতা, রীমা হত্যা নিয়ে ধারাবাহিক চটি বই, ক্যাসেটে গান, পথে ঘাটে ট্রেনে বাসে শিল্পীরা রীমার পক্ষে গান গায়। সেই গান শুনে যাত্রীরা কাঁদে, গান অপছন্দ করা মুরুব্বীরা শিল্পীদের সেলামি দেয় – আমার সোনার বাংলায়।

মুনিরের ফাঁসির আদেশ হয়। জনগন তাতেও খুশী নয়, খুকুরও ফাঁসি চাই।

একাত্মতা
আওয়ামীলীগ, বিএনপি বলে কিছু ছিল না। ছিল, সাধারণ জনগণ। আমি নিজে দেখেছি ১৯৯১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা (আরিচা মহাসড়ক) ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এক হয়ে বন্ধ করে দেয়। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। বাধ্য হয়ে মুনিরের সাথে খুকুরও ফাঁসির আদেশ হয়। যদিও উচ্চ আদালতে খুকুর ফাঁসির আদেশ পরবর্তীতে বাতিল হয়। তবে, বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী পরিবারের পুত্র মুনিরের ফাঁসি কেউ ঠেকাতে পারে না। ফাঁসি হয়।

এই ছিল আমার সোনার বাংলা। সোনার বাংলায় সব ছিল । আর এখন নেই কিছুই, আছে ফেসবুক। আমরা সবাই মিলে চাইলে কি অপরাধী গুলো কে শাস্তি দিতে পারিনা? আইন আর বিচার ব্যবস্থার সার্বিক উন্নতি কামনা করতে তো দোষ নেই। চলুন বদলে যাই, বদলে দেই, আমাদের প্রিয় দেশটাকে। গড়ে তুলি স্বপ্নের বহু আকাঙ্খিত সেই সোনার বাংলা। ধর্মে নয়, কর্মে হোক মানুষের পরিচয়। সবার একটাই পরিচয়। আর সেটা হলো আমরা মানুষ।

ছেলেবেলার ঈদ আনন্দ


আমার ছেলেবেলা একটি অভাবী পরিবারে কেটেছে। পরিবারে অভাব থাকলেও ঈদের দিনে আনন্দের কোন কমতি ছিল না আমার মাঝে। আর সেই ছেলেবেলাটা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর থানাধীন ধরাভাঙ্গা গ্রামে কাটিয়েছি। এখানেই আমার জন্ম; তাই ছেলেবেলার ঈদ কেটেছে মা-মাটি ও প্রকৃতির সাথে, খেলার সাথীদের সাথে আনন্দ ফূর্তি করে। রোজা শুরু হতেই কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে যেত ঈদের আর কত দিন বাকি আছে। প্রতিদিন আঙ্গুলের কর গুণে গুণে হিসাব করতাম কত দিন পর ঈদ হবে। প্রথম ও শেষ রোজা রাখতাম। মা বলতেন, শিশুরা ফেরেশতার মত নিষ্পাপ। এই দুটো রোজা রাখলে সব রোজা রাখা হয়ে যাবে।
শহরের চেয়ে গ্রামের ঈদ অনেক আনন্দের। কারণ গ্রাম হচ্ছে মানুষের শিকড়। মানুষ নাড়ির টানে গ্রামে ফিরে ঈদকে ঘিরে। বছরের ক্লান্তি ভুলে প্রিয় মানুষের সাথে কিছু সময় অবসর কাটাবার জন্য মানুষের কি নিরন্তর চেষ্টা; তা উপলব্ধি করতাম গ্রামের পাশে মেঘনা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে। ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই শহর থেকে নৌকা ও লঞ্চের মাধ্যমে গ্রামের আসতেন সকল শ্রেণীর মানুষেরা। পাড়ার ছেলেরা মিলে সবাই মেঘনার পাড়ে দাঁড়িয়ে এসব দৃশ্য দেখতাম; কিভাবে হাজার হাজার মানুষ নৌকা, লঞ্চ বোঝাই করে গ্রামমুখী হচ্ছে। আমাদের ঘাটে যখন লঞ্চ থামতো তখন দেখতাম আমাদের চেনা জানা কেউ আছে কিনা। থাকলে দৌঁড়ে গিয়ে তাকে সালাম দিতাম। কৌশল জিজ্ঞাসা করতাম।
ঈদ এলে আমাদের এলাকায় পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যেত। বিশেষ করে ঈদ-উল ফিরত এর সময় চাঁদ উঠার একদিন পূর্বে প্রতি ঘরে ঘরে পিঠা বানানো হতো। বাড়ির আশে পাশের সবার মতো আমার মাও পিঠা বানাতেন। মা গায়িল, সায়িট দিয়ে গুড়ি কুড়তেন। তারপর পানি সিদ্ধ করে মাধা তৈরি করে পিঠা বানাতেন। আমি তখন আমার মাকে পিঠা বানানোর কাজে সাহায্য করতাম। আমি লতি বানিয়ে দিতাম। মা তখন নিপুণ হাতে সুন্দর করে পিঁড়ির উপর হাত ঘুরিয়ে সেয়ুই বানাতেন। আমার দাদিও তখন আমার মাকে সাহায্য করতেন।
আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে বিরাট বড় একটি বিল। ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় চাঁদ দেখার জন্য সেই বিলের পাড়ে সবাই ভিড় করতাম। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে আকাশে চাঁদ উঠবে, সেই চাঁদের জন্য অধীর আগ্রহে সবাই অপেক্ষা করতাম, কখন সেই চাঁদ বয়ে আনবে আনন্দের বার্তা। আকাশে শাওয়ালের একফালি চাঁদ কখন উঁকি দেবে সেই যে আকুলতা, চাঁদ আজ উঠবে, না কাল উঠবে সেই যে আনন্দময় অনিশ্চয়তা; সেটা এক অপার আনন্দেরই উপলক্ষ। কে কার আগে চাঁদ দেখবে এই নিয়ে চলতো প্রতিযোগিতা। যে আগে চাঁদ দেখতে পেত সে লাফিয়ে উঠে বলতো, ‘ঐ চাঁদ উঠেছে… ঐ চাঁদ উঠেছে…।’ তারপর শুরু হতো আনন্দ মিছিল। ‘এক দুই সাড়ে তিন রাত পোহালেই ঈদের দিন’ স্লোগানে মুখরিত হতো আমাদের মিছিল। পাড়ার সকল ছেলে-মেয়েরা এক সাথে মিছিল করতাম গ্রামের রাস্তা দিয়ে। চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রেডিওতে বাজতো আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ…’। পাড়ায়-মহল্লায় মসজিদের মাইকে ভেসে আসতো ঈদ মোবারক ধ্বনি ও নামাজের সময়সূচী।
ঈদের আগের রাতেতো উত্তেজনায় ঠিকমত ঘুমাতে পারতাম না। সারা রাত হৈ চৈ করতাম। সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল করতাম। আমাদের গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা নদী। সেই নদীতে পাড়ার ছেলে-মেয়ে, আবাল বৃদ্ধ, নারী পুরুষ সবাই সকাল বেলা দল বেধে গোসল করতে যেতাম। পিপঁড়ার সারির মতো দল বেঁধে এক সাথে মেঘনায় যাওয়া ও ফিরে আসা, সে যে কি আনন্দ তা ভাষায় বুঝানো যাবে না। তারপর নতুন কাপড় পড়তাম। অভাবের সংসার ছিল তারপরও আব্বার যতটুকু সাধ্য ছিল ততটুকু দিয়ে আমাদের জন্য নতুন কাপড় আনতেন। আমরা তিন ভাই এক বোন ছিলাম। মা ঈদের দিন সকালে গুড় দিয়ে সেয়ুই পাক করতেন। ভাই-বোন সবাই মিলে মায়ের হাতের সেয়ুই খেয়ে রোজা ভাঙ্গতাম। ঈদগাহে যাওয়ার সময় বাবা আমাদের সবাইকে ৫ টাকা করে দিতেন। মা আদর করে আমাকে জামা কাপড় পড়িয়ে দিতেন। সুন্দর করে আমার চুলগুলো আঁচড়িয়ে দিতেন। তারপর পরিবারের সবার সাথে জায়নামাজ হাতে নিয়ে পাঞ্জাবী পায়জামা পরে ঈদগাহে যেতাম।
ঈদগাহ এর বাইরে বসতো সাময়িক ঈদের মেলা। নানান হাবিজাবি নিয়ে গ্রামের ছেলেরা পসরা সাজাতো। সেখানে গিয়ে ২ টাকা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনতাম। বাকি ৩ টাকা দিয়ে ছোট ভাইবোন ও বন্ধুদের নিয়ে কিছু কিনে খেতাম। আমার সহপাঠীদের মধ্যে আল আমীন, আজিজুল, ইসমাঈল, অলিউল্লাহ্, আজহারুল এরা সব সময় আমার পাশে থাকত। ইমাম সাহেব যখন নামাজ শুরু করেন তখন আমরা সবাই দল বেঁধে নামাজে দাঁড়াতাম। নামাজ শেষে বন্ধু-বান্ধব ও পাড়ার মুরুব্বীদের সাথে কোলাকুলি করতাম। পরে আব্বার সাথে ঈদগাহের পাশে কবরস্থানে যেতাম। সেখানে আমাদের পরিবারের যেসব সদস্য শুয়ে আছে তাদের জন্য আল্লাহর নিকট হাত তুলে দোয়া করতাম। তারপর বাসায় এসে এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে ফিরনী সেমাই খেতাম। ঈদের দিন বিকালে সহপাঠীদের সাথে মাঠে খেলতে যেতাম। রাতেও উঠানে বসে বিভিন্ন ধরনের খেলা খেলতাম। এভাবে কেটে যেত ঈদের দিন।
ছেলেবেলার কুরবানির ঈদটা ছিল একটু বিব্রতকর! আব্বা কুরবানি দিতে পারতেন না। মুরগী জবাই করা হতো। পাশের বাড়ির লোকজন আমাদেরকে মাংস দিতেন। লজ্জায় অন্য বাড়িতে যেতাম না। ঈদগাহ থেকে এসেই ইমাম সাহেব গরু জবেহ করার জন্য প্রস্তুত হতেন। আমাদের সমবয়ী ছেলে-মেয়েরা গরু জবেহ দেখার জন্য ইমাম সাহেবের পিছে পিছে ঘুরতাম। কিছুক্ষণ পর পর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে হৈ চৈ শুরু হয়ে যেত। গরুকে যখন মাটিতে শুয়ানো হয় তখন আমরা সবাই গরুর কাছাকাছি চলে যেতাম। যখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ছুরি চালানো হয়; তখন লাফিয়ে দৌঁড়ে চলে যেতাম। এভাবে গ্রামের সকল গরু জবেহ করা দেখতাম। তারপর বাড়িতে এসে সেমাই খেতাম। বিকেল বেলা চুলার নিকট বসে থাকতাম কখন মাংস রান্না হবে আর কখন খাব। এভাবে কুরবানির ঈদটা কেটে যেত।
আমাদের সেই সময়ে ঈদ ছিল অত্যন্ত আনন্দের। ঈদ উপলক্ষে, আত্মীয়স্বজনদের হতো মিলন মেলা, তার যে কি আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তখনকার ঈদের স্মৃতিচারণ করলে মনে হয়, আবার যদি সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারতাম! আবার যদি সেই আনন্দের ছোঁয়া পেতাম! কী যে সেই আন্তরিকতা, মমতা, অকৃত্রিম ভালোবাসা, আনন্দঘন পরিবেশ, সামাজিক বন্ধন, সর্ম্পকের দৃঢ়তা, এখন কি আর তা আছে? ছেলেবেলার সেই ঈদের আনন্দ আর এখন পাই না। এখন আর মানুষের মধ্যে সেই আন্তরিকতা, মায়া, মমতা, ভালোবাসা নেই।

আমার প্রথম সিনেমা দেখা এবং বর্তমান চলচ্চিত্রের হালচাল ও সিনেমা হল!

images-6a
১৯৭২ সালে নির্মিতি ছায়াছবি ‘মানুষের মন’ এর পোস্টার। আমার জীবনে সিনেমাহলে প্রথম দেখা ছায়াছবি।

ক’দিন আগে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম আমার বড়দি’র বাসায়। বড়দি’র বাসা থেকে সামান্য একটু দূরেই গুলশান সিনেমা হল। এই সিনেমা হলের সামনে দিয়েই দিদি’র বাসায় যেতে হয়। যখন গুলশান সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যেতে থাকি, তখনই মনে পড়ে গেলো সেসময়ের কথা। যেসময় এই গুলশান সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে আসতাম। একটা টিকেট সংগ্রহের জন্য কতরকম চেষ্টা চালাতাম তা লিখে শেষ করা যাবেনা। তবু লিখবো একসময়ের সিনেমা দেখা আর এদেশে অতীত বর্তমান চলচ্চিত্র ও সিনেমা হল নিয়ে কিছু কথা।

IMG_10082021_143753_(500_x_400_pixel)
কোনো একসময়ের গুলশান সিনেমা হল। এর আশেপাশে সকাল থেকেই থাকত শতশত লোকের আনাগোনা। এখন নীরব, শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই সিনেমা হলটির সামনেই ডায়মন্ড সিনেমা হল, সেটিও এখন নেই। ডায়মন্ড সিনেমা হল এখন বহুতল ভবন নির্মাণাধীন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস আমার জন্মেরও ৭/৮ বছর আগের। যেহেতু আমার জন্ম ১৯৬৩ সালে। আর বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ ছায়াছবিটি মুক্তি পায় ৩ আগস্ট ১৯৫৬ সালে। এ অঞ্চলের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে আলোড়ন সৃষ্টি করে ‘মুখ ও মুখোশ’। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন আবদুুল জব্বার খান। আজ থেকে প্রায় ৬৫ বছর আগে বর্তমান আজাদ প্রেক্ষাগৃহে (তৎকালীন মুকুল প্রেক্ষাগৃহ) ছবিটির প্রথম প্রদর্শনী হয়। জানা যায়, প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। ছবিটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় একযোগে মুক্তি পেয়েছিল।

IMG_10082021_200544_(500_x_400_pixel)
বাংলাদেশের প্রথম ছায়াছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ এর পোস্টার। ছবি সংগ্রহ গুগল।

চলচ্চিত্রের কথা বলতে গেলে আগে বলতে হয় এর পূর্বসূরি বায়োস্কোপের কথা। যা আমরা ছোটবেলায় দেখতাম, হাটবাজারে বা কোনো ঐতিহ্যবাহী মেলায় অথবা নিজেদের বাড়ির উঠানে। বায়োস্কোপের সাথে বাঙালিকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মতো বিশেষ কোনোকিছুর দরকার নেই। বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের আগেপাছে গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে খুবই এক পরিচিত নাম বায়োস্কোপ। শুধু গ্রামেই এর পরিচিতি ছিলনা, শহরের অলিগলিতে আর বিভিন্ন লোকজ মেলায়ও ছিল এর পরিচিতি। ১৯৮০ দশকের পর যাদের জন্ম, তাদের কাছে মনে হতে পারে বায়োস্কোপ একটি খেলনার বাক্স। আসলে তখনকার সময়ে এই বায়োস্কোপ মোটেই খেলনার বাক্স ছিলনা। সত্যিকারার্থে এই বায়োস্কোপেই ছিল তখনকার আমলের গ্রাম বাংলার মানুষের সিনেমা হল। বায়োস্কোপের বাক্সটা মাথায় নিয়ে বায়োস্কোপওয়ালারা হাতে একটা ঝুনঝুনি বাজিয়ে রাস্তা দিয়ে যখন হেটে যেত, তখন তার পেছনে পেছনে ছোটছোট ছেলেমেয়েরা বায়োস্কোপ দেখার স্বপ্ন নিয়ে দৌড়াতে থাকতো।

91662_172
বাংলার বায়োস্কোপ, যা একসময় ছিল গ্রামবাংলার মা-বোনদের সিনেমাহল।

আমি নিজেও কোনো একসময় বায়োস্কোপ দেখার জন্য দৌড়াতাম। বায়োস্কোপ দেখতাম ধান না হয় চাউল দিয়ে। বায়োস্কোপওয়ালা থাকতে থাকতে দৌড়ে আসতাম বাড়িতে। প্রথমে মায়ের কাছে চাইতাম দুই আনা পয়সা অথবা ধান চালের জন্য। মা যদি দিতে অমত করতো, পরে আবদার করতাম বড়দি’র কাছে। ব্যাস, হয়ে গেল বায়োস্কোপ দেখার খরচ। দৌড়ে যাতাম বায়োস্কোপের সামনে। দেখতাম বায়োস্কোপ। এখন আর সেই বায়োস্কোপ চোখে পড়েনা। টিভি, ভিসিডি আর আকাশ প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে এই বায়োস্কোপ আজ হারিয়ে গেছে। কয়েকবছর পর হয়তো এই বায়োস্কোপ যাদুঘরে প্রদর্শিত করার জন্যও খুঁজে পাবেনা।

বায়োস্কোপের যুগ শেষ করে আমরা পা রেখেছি চলচ্চিত্রের যুগে। চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় সিনেমাহলে। এই চলচ্চিত্রও কোনো একদিন হয়তো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে কালের বিবর্তনের সাথে তালমিলিয়ে। যাক সেটা পরের কথা। এবার আসি নিজের কথায়।

সিনেমা হলে গিয়ে যখন সিনেমা দেখতাম, তখন চলচ্চিত্র কী এবং কীভাবে এর নির্মাণ কাজ তা আমার জানা ছিলনা। শুধু বুঝতাম চলচ্চিত্র হলো সিনেমা মুভি বা ছায়াছবি আর কী? বর্তমান ডিজিটাল যুগের অনলাইনে বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে বুঝলাম, চলচ্চিত্র এক প্রকারের দৃশ্যমান বিনোদন মাধ্যম। চলমান চিত্র তথা “মোশন পিকচার” থেকে চলচ্চিত্র শব্দটি এসেছে। এটি একটি বিশেষ শিল্প মাধ্যম। বাস্তব জগতের চলমান ছবি ক্যামেরার মাধ্যমে ধারণ করে বা এনিমেশনের মাধ্যমে কাল্পনিক জগৎ তৈরি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। বাংলায় চলচ্চিত্রের প্রতিশব্দ হিসেবে ছায়াছবি, সিনেমা, মুভি বা ফিল্ম শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়। এবার আলোচনায় আসি আমাদের দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে, কখন শুরু এবং বর্তমান অবস্থা কী?

ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণ
জানা যায় ১৯২৭-২৮ সালে ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নওয়াব পরিবারের কয়েকজন তরুণ সংস্কৃতিসেবী নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র সুকুমারী। এর পরিচালক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন ক্রীড়া শিক্ষক অম্বুজপ্রসন্ন গুপ্ত। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা ছিলেন খাজা নসরুল্লাহ ও সৈয়দ আবদুস সোবহান। উল্লেখ্য তখন নারীদের অভিনয়ের রেওয়াজ চালু হয়নি। নাট্যমঞ্চের নারী চরিত্রেও পুরুষেরাই অভিনয় করতেন। ছোটবেলায় আমি নিজেও দেখেছি অনেক যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক। দেখেছি সেসব যাত্রাপালায় ও মঞ্চনাটকে কোনো মেয়ে নায়িকা ছিলনা। অভিনয়ে যারা ছিল সবাই পুরুষ। ম্যাকাপ আর পরচুলা ব্যবহার করে মেয়ে রূপধারণ করে সেসব যাত্রা আর মঞ্চনাটকে অভিনয় করতো পুরুষেরা। আমি যখন কক্সবাজার সংলগ্ন মহেশখালী লবণের মিলে চাকরি করতাম, তখন সেই মিলে আমরা শ্রমিকেরা যাত্রাপালা করেছিলাম। যাত্রাপালার নাম ছিল ‘চাঁদ কুমারী ও চাষার ছেলে’। সেই যাত্রাপালায় নায়িকা চাঁদ কুমারীর অভিনয় করানো হয়েছে মিলের এক ২০ বছর বয়সী ছেলেকে দিয়ে। এমনভাবে মেকআপ করা হয়েছে, কেউ ধরতেও পারেনি যে এটা পুরুষ। পরদিন এলাকার সবাই আমাদের জিজ্ঞেস করছিলেন, এই নায়িকা আমরা কোত্থেকে এনেছিলাম। সেসব এভাবেই পুরুষদের দিয়েই মেয়েদের কাজ সামলানো হতো।

১৯৫৬ সালের কোনো একসময় আবদুল জব্বার খান পরিচালিত বাংলাদেশের প্রথম সবাক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তির মধ্যদিয়ে শুরু হয় এদেশের চলচ্চিত্রের পথচলা। পরিচালক নাকি নিজেই নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। নায়িকা চরিত্রে ছিলেন চট্টগ্রামের পূর্ণিমা সেন। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন ইনাম আহমেদ, নাজমা (পিয়ারী), জহরত আরা, আলী মনসুর, রফিক, নুরুল আনাম খান, সাইফুদ্দীন, বিলকিস বারী প্রমুখ। চিত্রগ্রাহক কিউ এম জামান, সুরকার সমর দাস, কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসানাত এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু, পরে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) এর উত্থাপিত বিলের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হলে এর সহযোগিতায় ১৯৫৯ সালে থেকে প্রতিবছর চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে। এফডিসি ছাড়াও পপুলার স্টুডিও, বারী স্টুডিও এবং বেঙ্গল স্টুডিও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিরাট ভূমিকা পালন করে।

এফডিসি প্রতিষ্ঠার পরে চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় অনেক যোগ্য ব্যক্তি এগিয়ে আসেন। ১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানীর ‘আকাশ আর মাটি’, মহিউদ্দিনের ‘মাটির পাহাড়’, এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ এই তিনটি বাংলা চলচ্চিত্র ছাড়াও এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ উর্দু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শুরুর দশকে নির্মিত পাঁচটি চলচ্চিত্রের প্রতিটিই নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শিল্পমানে উত্তীর্ণ বলেই চলচ্চিত্রবোদ্ধারা মনে করেন। অর্থাৎ আমাদের চলচ্চিত্রের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল শুদ্ধতার অঙ্গীকার নিয়েই। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। বেবী ইসলামের ‘তানহাও’ উর্দু ভাষার নির্মিত। এটি ১৯৬০ সালে সেন্সর সার্টিফিকেট পায় কিন্তু মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে। জানা যায় উইকিপিডিয়া থেকে।

১৯৭২ সালে মোস্তফা মেহমুদ পরিচালিত এফডিসি থেকে মুক্তি পায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ছায়াছবি ‘মানুষের মন’। এতে অভিনয় করেন নায়করাজ রাজ্জাক, ববিতা ও আনোয়ার হোসেন। আমার বয়স ৮/৯ বছর। অর্থাৎ ১৯৭২ সাল, দীর্ঘ নয়টি মাস যুদ্ধের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের একবছর অতিক্রম করছিল। সেসময় আমরা সপরিবারে আমাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে থাকি। বাবা আর বড়’দা থাকতো নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন আদর্শ কটন মিলে। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। ভালমন্দ বুঝার একটু-আধটু জ্ঞান তখন আমার হয়েছিল। একদিন আমার মাসিমা আর বড়মামা আমাদের বাড়িতে এসেছিল বেড়াতে। বড়মামাকে দেখে আমরা বাড়ির সবাই মামার কাছে আবদার করলাম সিনেমা দেখার জন্য। আমাদের আবদারে মামা রাজি হয়ে বাড়ির সবাইকে নিয়ে চৌমুহনী দর্পণ সিনেমা হলে নিয়ে যায় সিনেমা দেখানোর জন্য। আহ! কী আনন্দ সবার, সাথে মা, মাসিমা, আমার জেঠিমা, কাকী, দুইজন বড়দিদি। সকাল ৯ টায় মর্নিং শো, ছায়াছবি ‘মানুষের মন’।

তখন নোয়াখালীর দর্পণ সিনেমা হল ইট সিমেন্টের ছিলনা, ছিল টিনের বেড়া। মামা সবার জন্য টিকেট কিনে এনে সবাইকে নিয়ে সিনেমা হলের ভিতরে সিটে বসালো। সবাই সিটে বসলেও আমার ভাগ্যে আর সিট জুটেনি, আমি আমার মায়ের কোলেই বসে থাকলাম। তখন টাকার খুব দাম! সবাইকে সিনেমা দেখানো তো মামার দম যায়যায় অবস্থা। সিনেমার শো শুরু হলো, সিনেমা দেখলাম।

তার কিছুদিন পর আমরা সপরিবারে নোয়াখালী থেকে ঘরবাড়ী নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে চলে আসি নারায়ণগঞ্জে। বড় হতে থাকি আরো দশজন ছেলেপেলের সাথে হেসেখেলে। অনেক ছায়াছবি দেখেছি টেলিভিশনে আর সিনেমাহলে গিয়ে।

p20170604-1824272
আমাদের চৌধুরীবাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে প্রথমেই চোখে পড়ে ‘নিউ মেট্রো সিনেমাহল’ এটিও এখন বন্ধ। আগে সবসময় ছিল লোকে লোকারণ্য, এখন নীরব নিস্তব্ধ।

সেসময় একটা ছায়াছবি মুক্তি পাওয়ার একমাস আগে থেকে রেডিও টেলিভিশনে এডভার্টাইজিং করা হতো। মানে রেডিও টেলিভিশনের ছায়াছবির আংশিক সংলাপ ও কিছুকিছু গানের প্রথমাংশ শোনানো হতো। এর কারণ ছিলো সিনেমায় দর্শক বাড়ানো। তখন এমন একটা সময় ছিল যে, সিনেমা সবার কাছে ছিল গ্রহণযোগ্যতা। সিনেমা মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই একসাথে সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা উপভোগ করতো। তখন মানুষের মনে সিনেমা ছিল আনন্দের, শখের। আস্তে আস্তে সেই আনন্দ আর শখ নষ্ট হতে শুরু করে যখন ভিসিয়ারের আগমন ঘটে।

বেশিরভাগ মানুষ তখন ভারতীয় ছায়াছবির দিকে ঝুকে দেশীয় বাংলা ছায়াছবি থেকে মুখ ফেরাতে থাকে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে দেশের আপামর জনগণ কেন সিনেমা হল বিমুখী হলেন, তার একটা কারণ মোটামুটি সবারি জানা। এর কারণ শুধু একটাই। আর তা হলো ভিসিআর, স্যাটেলাইট চ্যানেল এর আগমনের পাশাপাশি দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে যখন সামাজিকতার ছোয়া ওঠে গেলো। আর ভারতীয় চলচ্চিত্র এদেশের ডিসএন্টেনায় সরাসরি দেখার সুযোগে সৃষ্টি হলো, তখন থেকে বাংলাদেশী দর্শকশ্রেণী আস্তে আস্তে দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে বিমুখ হতে শুরু করলো। এর ফলে দেশীয় চলচ্চিত্র হলো সবার কাছে একরকম অবহেলিত। আর দেশীয় চলচ্চিত্রের দৈন্যদশার যাত্রা হতে থাকলো শুরু।

আমাদের দেশের মানুষ যখন হল বিমুখী হওয়া শুরু করলেন, ঠিক তখন থেকেই সিনেমার সাথে সাথে হলগুলোর পরিবেশও খারাপ হওয়া শুরু করলো। অবস্থা এতটাই খারাপ হল যে, আমি নিজেও যদি কোনোদিন সিনেমাহলে যাই, তাহলে অন্তত কয়েকবার এদিক সেদিক ভালো করে দেখে নেই, কেউ আবার দেখে ফেললো কিনা। তাহলে তো বিপদ! মানে মানসম্মান যাবে যাবে বলে অবস্থা। আবার হলে গিয়ে সিটে বসে যদি দেখি পাশের সিটে বসা আমার ছেলের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু, তাহলে তো একেবারেই মানইজ্জত শেষ হবার পালা!

p20170604-182356
চৌধুরীবাড়ি ‘বন্ধু সিনেমাহল’ গত কয়েক বছর আগে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। এখন এই বন্ধু সিনেমা কমিউনিটি সেন্টার।

এর কারণ হলো বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বাংলা চলচ্চিত্রের নাম যদি হয় নগ্ন হামলা, খাইছি তোরে, বোমা হামলা, লাল কোট কালো চশমা ইত্যাদি ইত্যাদি, তাহলে বুঝাই যায় যে এসব ছায়াছবিতে কী দেখাবে। ছবিতে দেখা যায় বিশ্রী ভাষায় গালাগালি, অর্ধনগ্ন পোশাকে নাচগান আর কাটপিসের ছড়াছড়ি। আবার খ্যাতিমান নায়ক-নায়িকাদের দেশত্যাগ ও চিত্রজগত ছেড়ে দেওয়া, নায়ক-নায়িকার অভাব। বর্তমানে বাংলা চলচ্চিত্র শুধু শাকিব নির্ভরই বলা চলে। তিনি ছাড়া আর গুটিকয়েক তারকা হয়তো আছে এদেশের চিত্রজগতে।

তাহলে বোঝাই যায় বাংলা চলচ্চিত্রের হালচিত্র বুঝতে মোটেই বেগ পেতে হয় না। যদি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের মতো করে সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা না হয়, তাহলে আর কখনো বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালী সুদিন ফিরে আসবে না বলে মনে হয়। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ হয়তো একদিন সিনেমা হলের কথাও মনে রাখবে না। এই সময়ের মধ্যেই কিন্তু মানুষের মন থেকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে বাংলা ছায়াছবি দেখার ইচ্ছা আর স্বাদ ও আনন্দ। বেশিরভাগ সিনেমাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে দর্শকের অভাবে। অনেক সিনেমা হলের নাম চিহ্নও নেই। যা-ও আছে, তা কেবল গুটিকয়েক।

দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে তো এই অবস্থা চলছেই, প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রায় সবগুলো সিনেমাহল এখন আর নেই। কোনোকোনো সিনেমাহলের জায়গায় এখন সুবিশাল মার্কেট, নাহয় গার্মেন্টস। বুঝি করারও কিছুই নেই! দর্শক ছাড়া মাসের পর মাস সিনেমাহলের কর্মচারীদের বেতন, নানাবিধ খরচাদি বহন করা মালিক পক্ষের দ্বারা সম্ভবও নয়। যদি সিনেমাহলে দর্শকই না আসে, তাহলে হল মালিকরা তা পোষাবে কি করে? যারা দর্শক, তারা তো আজ ডিশএন্টেনা সহযোগিতায় ঘরে বসেই দিনেরাতে শ’খানেক ছায়াছবি দেখতে পারে। তাহলে কষ্ট করে হলে যাবে কেন? আর আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে তো আগের মতো সামাজিক কাহিনী নেই। আছে ডিজিটাল যুগের ফুফা আর নগ্ন নৃত্যের ঝলকানি। যা সপরিবারে একসাথে বসে দেখা যায়না।

একটা সময়ে অশ্লীল চলচ্চিত্রের দৌরাত্ম্য দেখা গিয়েছিল যে, সেই দুর্গন্ধটা যেন আজীবন বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের গায়ে থেকেই গেল। সেই দুর্গন্ধ দূর করতে হলে চাই সুস্থ্যধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ করা, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের তৈরি চলচ্চিত্রগুলি অনুসরণ করা, নতুন নতুন নায়কনায়িকা খুঁজে বের করাও জরুরী। তা নাহলে এদেশ থেকে একদিন বাংলা চলচ্চিত্রের নাম মুছে যাবে। সেই নাম আর কোনোদিন জেগে উঠবে না। তাই ভাবি আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি কবে দেখব? নাকি সেই দেখা এই জন্মেও দেখা হবে না। যেসব সিনেমাহল বিলুপ্তি হয়ে গেছে, সেই পরিমাণ সিনেমাহল কী এদেশে আর কখনো গড়ে উঠবে? নাকি যেগুলি আছে সেগুলিও বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

ছেলেবেলার ছেলেরা

আমাদের বাসাটা ছিল জল্লার পাশেই। জল্লার চিকন রেখার এপার থেকে ওপার লাফ দিয়ে যাওয়া যেত। আর হেঁটে গেলেও পানি মাত্র গোড়ালীর একটু উপরের অংশ পর্যন্ত ভিজিয়ে দিত। পানিও ছিল তেমনি নোংরা যা কহতব্য নয়। ব্যস ওটুকুই ছিল জল্লার কারিশমা। তবে দৈর্ঘ্যে এতটুকুন হলেও লম্বায় ছিল একেবারে সাত রওজা থেকে বংশাল পর্যন্ত। কেউ কেউ বলত, জল্লা গিয়ে মিশেছে নাকি বুড়ীগঙ্গার সাথে। আমাদের মহল্লার গামলা শহীদ, যে কিনা একবার ঘুড্ডি ওড়াতে ওড়াতে নুরুল হকদের তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে গিয়েও অম্লান বদনে নাটাইয়ের সুতো গোটাতে গোটাতে ঘরে ফিরে গিয়েছিল। সেই শহীদ একবার হারিয়ে গেল। তিনদিন পরে ওকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল ম্যানহোলের ভেতর। অবাক লাগে ভাবতে, ম্যানহোলের ভেতর তখন সেকি পানির স্রোত। একটু উঁচু এক কোনায় গামলা শহীদ গিয়ে পড়েছিল। তখনই শুনেছিলাম, এই ম্যানহোলের সংযোগ জল্লার সাথে আর জল্লাটা বুড়ীগঙ্গার গরীব বোন।

একটু বৃষ্টি হলেই জল্লাটা পানিতে উপচে উঠত। জল্লার চারপাশের উঁচু বস্তির ঘরগুলোতে ঢুকে যেত পানি। বস্তির লোকগুলো তখন আমাদের বাসার বারান্দায় এসে ঠাঁই নিত। আমাদের বাসাটা ছিল একবিঘা জমির উপর। পাঁচকাঠা জায়গা জুড়ে বড় বড় চার রুম, তিনভাগে বিশাল বারান্দা আর সিঁড়ির নীচেকার কিছু অংশ। বাকী সবটা জায়গা বেশুমার খোলা উঠান। জল্লায় বন্যা হলে আমাদের এই বিশাল উঠোনও পানির নীচে ডুবে যেত। আমরা বারান্দার সিঁড়িতে বসে জমা পানি দেখতাম। মা আফসোস করত, আহা গাছগুলো সব মরবে এবার। বন্যা হলে লাভের চেয়ে আমাদের মানে ছোটদের ক্ষতি হত বেশী। বস্তির লোকগুলো উঠে আসত আমাদের বারান্দায়। শুরু হত এদের হৈচৈ, চেঁচামেচি। বাচ্চাগুলোর অশ্লীল খিস্তি শুনতে শুনতে আমরাও মুখস্ত করে নিতাম কিছু। এখনো আমার গালির স্টক এত যে যদি গালির কম্পিটিশন হয় কখনো, আমি ফার্স্ট হব বিনা দ্বিধায়। তো আমার বিধবা মা তখন কোত্থেকে, কি ম্যানেজ করতেন জানিনা। বিশাল ডেকচি ভর্তি করে রান্না হত খিঁচুড়ি। সাথে সরিষার তেল অথবা ঘি কিংবা একটা ডিম ভাজার চার ভাগের এক ভাগ। এগুলোই খেতে হত অম্লান বদনে। একটু অনুযোগ তুললে মা খর চোখে তাকাতেন তবে নরম গলায় বলতেন, ‘তুমি বড় হয়েছ না? ওরা যা খাবে তোমাকেও তো তাই খেতে হবে, ওরা যে এখন আমাদের মেহমান মা।‘ আমি মনে মনে এইসব অতিথিদের গুষ্ঠি উদ্ধার করতাম। তা বলে আমিই কি খুব ভাল মেয়ে ছিলাম? আমিও কি বন্যা না থাকাকালীন সময়গুলোতে ছুটে যেতাম না বস্তিতে?

মনে পড়ে, সাফিয়া বুজি যে কিনা আমাদের বাসায় আগে রান্নার কাজ করত, পরবর্তীতে বস্তির এক জোয়ান ছেলেকে বিয়ে করে নিয়ে সুখেই ছিল। তবে ওর স্বামী জোয়ান হলে কি হবে, ছিল তো এজমার রোগী। ফি হপ্তায় দুএকদিন কামাই যেত রিকশা চালানোর কাজে। তখন বস্তিতে ঢুকলেই সাফিয়া বুজি ছুটে আসত আমার কাছে, হাত ধরে বলত, ‘ছোট আপা তোমার দুলাভাই তো কামে যায় নাই, ঘরেও কিছু নাই, আইজ খামু কি?’ তাই তো ওরা খাবে কি? নো চিন্তা, ম্যায় হুঁ না! আমি ছুটে চলে যেতাম বাসায়। বাড়ীর সবার চোখ এড়িয়ে চাল-ডাল-নুন-আলু কোঁচড়ে ভরে বিজয়ীর ভঙ্গিতে নিয়ে যেতাম সাফিয়া বুজির কাছে। বুজি জিগ্যেস করত, ‘আমি রান্ধলে তুমি খাইবা?’ আট বছরের মেয়ে আমি তখনো বুঝি না জাত-পাত, শুচি-অশুচি। তেলচিটে কাঁথা বিছানো চৌকিতে দুলাভাইয়ের পাশে শুয়ে বুজির ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুমাবার আগে শুনতাম দুলাভাই বলছে, ‘সাফিয়া তুমি কামটা ভালা কর নাই। ও ছোট মানুষ, ঘরের জিনিষ না কইয়া আনলে তো ওর অভ্যাস খারাপ হইব। তুমিই যদি এট্টু যাইতা আম্মার কাছে, আম্মা তো না করনের মানুষ না।‘ সাফিয়া বুজি ছোট্ট করে কেবল বলত, ‘আমার শরম করে।‘ এই দুলাভাই লোকটা ছিল অসাধারন রকমের একজন ভাল মানুষ। আজো তার কথা ভেবে চোখে একটু যেন জলই আসে।

ঘুম ভাঙ্গত সাফিয়া বুজির ডাকে। কলাই করা লাল-হলদে-সাদা ফুলতোলা বাসনে বুজি পাতলা খিঁচুড়ি ঢেলে আমাকে খেতে দিত। ওরে সে কি ঝাল! আমি উহ আহ করে খেতাম। আর হয়তো ঠিক সে সময়েই আমাকে খুঁজে খুঁজে আমার আয়া মা আর জাকিরের মা এসে হাজির হত মঞ্চে। আয়া মা তো ঠাস করে এক চড়ই বসিয়ে দিত গালে। জাকিরের মা আমাকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে সোজা গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিত মা’র সামনে। ততক্ষনে চ্যাংদোলা অবস্থায় ওদের হাত, চুল টেনে টেনে আমিও হয়ে পড়তাম ক্লান্ত। জাকিরের মা গর্বিত ভঙ্গিতে ফিরিস্তি দিত কত জায়গায় খুঁজে অবশেষে আমাকে কোথায় খুঁজে পেল। বলত, ‘আম্মাগো আমি যাইয়া দেখি আপা ওগোর বাসুন থিক্যা কাদার মতন কালা কালা ঢলঢলা খিচুড়ি খাইতাসে।‘ আশ্চর্য মা কিন্তু আমাকে বকতেনও না। শুধু বলতেন, ‘বুড়ি এভাবে ঘরের জিনিষ নিতে নেই, এটা অসৎ কাজ। সবই তো তোর, এই বাড়ীঘরদোর সব। আর মা আমি তোমার বন্ধুও, আমাকে বললেই বরং আমি তোমাকে দিয়ে আরো বেশী করে খাবার ওদের জন্যে পাঠাতাম।‘ কথাটা সত্যি। জীবনে পরের জন্যে মা’র কাছে যা চেয়েছি তা তো পেয়েছিই, নিজের জন্যে চাওয়া কোনো আশাও মা অপূর্ণ রাখেননি। মা’র জন্যে সালাম।

আমি যখন এগারোয় তখন আট আর দশ বছর বয়সী দু’জন সাঙ্গাত জুটে গেল আমার। একজন মিন্টু অন্যজন পন্ডিত। এরা ছায়ার মত আমার সাথে লেগে থাকত। যদি বলতাম ‘কারো ঘরে আগুন দিয়ে আয়’ ওরা বুঝি তাও পারত। আমাকে এত বস মানবার কারন ছিল নানাবিধ। যেমন আমি আমগাছের মগডালে উঠে দুই পা কোনো ডালে আটকে নিয়ে সার্কাসের মেয়েদের মত মাথা নীচের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে গান গাইতে পারতাম দিব্যি, চিকন দেয়ালে তিরতির করে দৌঁড়ুতে পারতাম। আবার এককোপে কারো লাট্টু ভেঙ্গে দেয়া ছিল আমার বাঁ হাতের কাজ। লাট্টু ভেঙ্গে কোঁচড় ভর্তি করতাম বাজী জেতা রঙ চঙে মার্বেল দিয়ে। তবে সবচেয়ে ভাল যা পারতাম তা হল ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেয়া। আমার সুতো ভাঙত না কিনতু হত এমন শক্ত! কত ঘুড্ডি যে কাটা পড়েছে সেই সুতোর ধারে আর আমাকে গাল দিয়েছে ঘুড়ি হারানো ছেলেরা তার ইয়াত্তা নেই। আমি ভাড়ায় খেটেও দুপুরের চড়া রোদে অন্যের সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে দিয়েছি। আমার দুই সাগরেদ মাঠের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে নাটাইয়ের সুতো চালাচালি করত আর মাঝখানে কাঁচের গুঁড়ো, শিরিষ আঠা এসব মুঠো থেকে আমি সুতোয় মাখিয়ে দিতাম অক্লান্ত ভাবে।

ক্লাস নাইনে পড়বার সময়ে মা যখন পুরুষালী ভাব আর জিন্স ছাড়ার জন্যে গালাগাল করত তখন একদিন আমার দুই সাগরেদ এসে বলল, ‘আপা তুমি যখন উঠানে আমগো লগে ব্যাডমিন্টন খেলো তখন চুড়িয়ালা গল্লির একপোলা তোমারে দেখে অগো তিনতলা ছাদ থিক্যা’……আমি টাসকি খেয়ে পড়লাম, বলে কি! আমাকে দেখবে কেন কেউ খামোখা? তারপর থেকে আমিও লক্ষ্য করলাম ছেলেটাকে। পন্ডিত খবর এনে দিল, এই ছেলের নাম শানু। ছেলেটা সিনেমা করে। নায়ক জসিমের গ্রুপের ডান্সার। দেখলাম, প্রতিদিন বিকেল হলেই হিরো হিরো চেহারার শানু তার দলবল নিয়ে জোরে ডেকসেট ছেড়ে ছাদেই খুব কসরত করে নাচ প্র্যাকটিস করে আর মাঝে মাঝে আমাদের উঠোনে তাকায়। আমার মনে কোনো রঙ লাগেনি তখনো কারন আমি বয়সের তুলনায় ছিলাম পুরোই ইম্ম্যাচিওর। যাহোক সেজভাইয়ার চড় চাপড় খেয়ে বুঝলাম নারী জন্ম আসলেই ভয়াবহ। সে থেকে বারান্দা বা উঠোনে যাওয়াও আমি নিজেই বাদ দিয়ে দিলাম। নিজের রুমে বসেই আমি ক্যারাম খেলি, তাস খেলি মিন্টু, পণ্ডিত আর আমার ভাই হাসানের সাথে।

অনেক মানুষই যেমন অবসট্যাকল দেখে মনের দুঃখে দমে যায় আমি তাদের দলে ছিলাম না কখনো। মনে আছে, খুব ছেলেবেলায় মানে আট/নয় বছর বয়সে আমি ভিড়ে গিয়েছিলাম আমার দুই বছরের বড় ভাই হাসান আর ওর বন্ধুদের সাথে। ওদের গ্রুপে ওরাও আমাকে কখনো মেয়ে বলেই গণ্য করেনি। ওরা বিড়ি ধরাত আমাদের বাসার পেছনের চিপা গলিতে। একটা বিড়িই ঘুরত হাসান, নুরু, আসলাম, শাহাবুদ্দিন, জয়নাল আর আমার হাতে। একদিন ওরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে করতে প্যান্টের জিপার খুলে একযোগে পেশাব করতে শুরু করল। পেশাব গিয়ে লাগছে দেয়ালে আর ওরা সেই চিহ্ন ধরে পেশাব কাটাকাটি খেলা খেলছে। আমিও প্যান্টের চেইন খুলে যেই করতে গেলাম সেই একই কাজ, দেখি আমার পেশাব দেয়াল না ছুঁয়ে দুই উরু হয়ে প্যান্টটাকেই ভিজিয়ে দিল। নুরু হোহো করে হাসতে হাসতে বলল, ‘ঐ তোর কি নুনু আছে? তুই না ছেড়ি? তুই ক্যাল্লা আমগোর মতন মুতবার চাস?’ সেদিন আমি চমকে গেলাম। সেদিন প্রথম বুঝলাম, আমি লিঙ্গবিহীন মানুষ! তবে বড়দের চেয়ে ছোটরা অনেক বেশী সহানুভুতিশীল বলে পরবর্তীতে ওরা আর আমার সামনে এই খেলাটা খেলেনি বরং আমি যে ওদের সব কাজেই একাত্ম হতে পারি না এটাকেই ওরা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিত। আমাকেও ওরা ট্রিট করত ছেলে হিসেবেই। অনেক পরে অবিশ্যি ক্ষোভ জমেছিল আমার ভেতরেও, মনে হয়েছিল, ছেলে হিসেবেই ট্রিট কেন পাব? মেয়ে হিসেবে কেন যোগ্যতার স্বীকৃতি পাব না? কিনতু সেগুলো অনেক পরের কথা। রঙিন দিনের কথায় আপাততঃ কালি ঢালছি না।

ইন্টারমিডিয়েট পরবার সময়ে আমার ভেতরে যাকে বলে ম্যাচিওরিটি, সেটা এল। আমি সালোয়ার-কামিজ পড়ি, নরম স্বরে কথা বলি আবার কাউকে কাউকে দেখলে লজ্জায় লালও হয়ে উঠি। মিন্টু আর পণ্ডিত তবু আমার সঙ্গ ছাড়েনি। মিন্টুটা পড়ালেখা করছিল তখনো কিনতু পণ্ডিত হাজিসাহেবের লেদমেশিন চালানোর কাজে যোগ দিয়েছিল। উপায়ও ছিল না কারন ঘরে ওর সৎ মা। জ্বালিয়ে ওর হাড়মাস একাকার করে দিচ্ছিল। তারপরও সন্ধ্যে হলেই ওরা দুজনে এসে হাজিরা দিয়ে যেত। আর শানু তখন নেশা করে, হেরোইনের নেশা। একদিন কলেজ থেকে বাসায় ফিরছি, রিকশা থেকে নামতেই দেখি শানু দাঁড়িয়ে আছে। হাড় জিরজিরে এ কোন শানু, এটা ভাবতে ভাবতেই আমি বাসার গেট পর্যন্ত চলে এলাম। দেখি শানু পাশের একটা ড্রেনের সামনে অবলীলায় লুঙি উঁচিয়ে বসে পড়ল প্রস্রাব করতে। যে আমি ছেলেবেলায় ছিলাম দারুন নিলাজ সেই আমিই আজ লজ্জায় পড়িমরি করে বাসায় ঢুকে গেলাম।

এর কিছুদিনের ভেতরেই আমি প্রেমে পড়লাম, চরম প্রেম। আমার প্রেমিক আমাকে জানল দারুন রূপবতী এক নরম পুতুল হিসেবে। সে তাই পুতুলটাকে নিজের করে যখন পেতে চাইল প্রেমে আকুল আমিও কোনো বাঁধা দেইনি। চারপাশে বেজে উঠল সুখের সানাই। আমি সানাইয়ের টুকরো টুকরো সুরগুলো কিছু চোখে, কিছু বুকে, কিছু ললাটে ঢুকিয়ে নিয়ে শুরু করলাম জীবনের নতুন পথচলা। আমার বর লনি তখনো ছাত্র। তাই বাস্তবতার নিরিখে জীবনকে দেখতে শুরু করলাম আমরা আরো অন্য ভাবে। আমি পড়ালেখা করি আবার চাকরীও করি, লনিও তাই। আমাদের জীবনজুড়ে এল ছেলে অর্ণব। এ সময়ে আমার ছেলেকে দেখাশোনা করবার জন্যে যে আয়া রেখেছিলাম তার ছেলে আজিজুলও এসে জুটল আমাদের জীবনে। এই আজিজুল এখন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বলা যায়, নিজের ছেলের চেয়েও আমার এই পালিত পুত্রটি আমাদের কাছে একটু বেশী প্রশ্রয়ই পায়। যাহোক অর্ণবকে রেখে চাকরী করাটা দুঃসাধ্য ছিল তাই আবারো ফেরত গেলাম পুরনো ঢাকায়। অর্ণব সারাদিন আমার মার কাছে থাকবে, সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরে ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে আসব এইসব সাতপাঁচ চিন্তা করে বাপের বাড়ীর কাছেই শানুদের বাসার ঠিক পাশের তিনতলার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম আমরা। ততদিনে শানুটাও মরে গেছে। শুনেছি, অতিরিক্ত নেশা করত বলে ওর মা ওকে দুইদিন বেঁধে রেখেছিল ঘরে। আফটার শক এড়াতে পারেনি ছেলেটা, মরেই গিয়েছে। অসৎ সঙ্গে ও আগেই পড়েছিল। নিজের জীবন দিয়ে সেই দায় সে পূর্ণ করে দিয়েছে। শুধু আফসোস হয় ওর মা’টার জন্যে। এই মহিলা নাকি কাঁদত আর বলতো, ‘ছেলেরে বাঁচাইলাম নাকি মারলাম আমি তো বুঝি না।‘ আমি কিনতু বুঝি, বেশ বুঝি, ও ছেলে মরেই বেঁচেছে।

পুরনো ঢাকায় প্রত্যাবর্তন আমাকে আবারো নতুন উদ্যোম দিল, শক্তি পেলাম আমার শৈশবের পদচারনায় মুখর এই ছোট্ট জায়গাটিতে ফিরে। অনেকেই এসে দেখা করে গেল। একদিন রাত একটায় হাসান এসে ডাক দিল নীচ থেকে। আমি বারান্দার রেলিং এ ঝুঁকে ওকে দেখলাম ওকে। দেখি ওর সাথে নুরু, জয়নালসহ আরো ক’টা পরিচিত মুখ। হাসান হাত নেড়ে বলল, ‘বুড়ি নেমে আয়, নেমে আয়’……আমি উড়ে যেতে থাকলাম। পাশ থেকে লনি বলল, এই আমিও কি যাব? আমি তখন আর লনিকে দেখছি না। আমি কারো কথা শুনছি না। আমাকে নামতে হবে নুরুদের সারিতে। আমার ভাই হাসান আমাকে ডেকেছে। ডাকছে আমার শৈশব, ডাকছে কৈশোর।

আমার বাসার ঠিক নীচেই মাজেদ সরদার কমিউনিটি সেন্টারের দেয়াল ঘেঁষে মিনুর ঠেলাগাড়ীটা রাতের বেলা পড়ে থাকে। আমরা সেই ঠেলাগাড়ীর উপর উঠে বসলাম। চা এল, সিগারেট এল। আমরা ধুমিয়ে ওসব খাচ্ছি, আড্ডা দিচ্ছি। মহল্লার মামা-চাচারা হাসিমুখে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ কুশল জিগ্যেস করছে। আমরা সিগারেট লুকিয়ে ফেলছি, সব মিলিয়ে অসাধারন সুন্দর একটা রাত। আমি কৃতজ্ঞ আমার ভাই হাসানের কাছে, কৃতজ্ঞ নুরু, গেসুদের কাছে। এই ছেলেগুলো আমাকে মেয়েজন্ম ঘৃণা করবার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। এই ছেলেগুলো আমাকে পুরুষ বিদ্বেষী হতে দেয়নি। আমি জেনেছি কর্মদোষে যে কোনো মানুষই খারাপ হতে পারে তাতে জেন্ডার লাগে না। আবার এও জেনেছি, ভাল বা মন্দ বোধটাও বড়ই আপেক্ষিক, যে তোমার কাছে ভাল সে আমার কাছে মন্দও হতে পারে তা বলে একটা মানুষ মাথা থেকে পা অব্দি ভালও যেমন হতে পারেনা, তেমনি পারে না শুধুই মন্দ হতে। আমাদের এই আড্ডা চলেছিল ম্যালা রাত অব্দি। পরে লনিও গুটিগুটি পায়ে নেমে এসে বসেছিল আমাদের পাশে।

একদিন সকালে আমি অফিস যাব বলে নীচে নেমেছি দেখি এক কলাওয়ালার সাথে পন্ডিত ঝগড়া করছে। ওকে দেখে আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করল। সেও আমাকে দেখে পালাবার পথ পায় না। এ কি অবস্থা ওর? টেনে ধরলাম ওর শার্টের কলার, ‘হারামজাদা একি হাল করেছিস নিজের?’ টপটপ করে জল গড়াল পন্ডিতের চোখে। বলল, ‘আপা তুমি তো জানোই ঘরে আমার সৎ মা। অত্যাচার আর সইতে পারি নাই তাই কখন যে এই নেশায় ডুবছি নিজেই জানিনা।‘ আহা, আমার পণ্ডিত! ওরে পণ্ডিত!! তোকেও হেরোইনের নেশায় খেলো!!! বললাম, ‘শোন আমি অফিস থেকে ফিরলে আজকে বিকেলে অবশ্যই আমার কাছে আসবি, কথা আছে।‘ বলে ওকে ক’টা কলা কিনে দিতে চাইলাম, ও নেবেই না। অথচ ওর চোখ-মুখ দেখেই আমি জেনে গেছি কতটা অভুক্ত এখন সে। প্রায় জোর করেই ওগুলো পণ্ডিতের হাতে গুঁজে দিয়ে আমি গাড়ীতে গিয়ে উঠলাম। যতদূর দেখা যায় আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়েই ছিলাম শুধু। আমার চোখে ছিল কান্না, ওর চোখে শূন্যতা।

গাড়ীতে বসে ভাবছিলাম, পন্ডিতের কথা ভুলে গিয়েছিলাম কি? কেন গিয়েছিলাম? ভুলে যাওয়াটা কি অপরাধ? ও কে আমার? ভাই? বন্ধু? নাকি তারো বেশী কিছু ছিল কোনোদিন? ছেলেবেলার নিষ্কলুষ এ সব সম্পর্কের কি আদৌ কোনো নাম দেয়া যায়? শুধু বুকের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া স্নেহের এক কলকলে নদীর ছলাত ছলাত শুনি। আমাদের সেই জল্লার মতন সরু অথচ আবর্জনায় ভরা।

অফিস থেকে বাসায় ফিরতে গুলিস্তানের জ্যাম পেরুতে হয়। তাই বেশ বিরক্তি নিয়েই যখন ফিরছি তখন দেখলাম কমিউনিটি সেন্টারের পাশে রাখা মিনুর সেই ঠেলাগাড়ী ঘিরে ছোট্ট একটা জটলা। আরো বিরক্তি নিয়ে ওদেরকে পাশ কাটিয়ে তিনতলায় উঠে এলাম। বাব্বাহ যা গরম! হাতমুখ ধুয়ে, হাতে পেপারটা নিয়ে যখন বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম নিজেকে বেশ সুখী সুখী মনে হল। নীচে ঠেলাগাড়ীর সামনে বুঝি অনেক মানুষ, হৈ চৈ চলছে এখনো। এবার খানিক কৌতুহল নিয়েই উঁকি দিলাম রেলিং এর ঐ পাশে। উপর থেকে স্পষ্ট দেখলাম পণ্ডিতের ভাবলেশহীন মুখটা, নিথর শরীর নিয়ে শুয়ে আছে ঠেলাগাড়ীর উপর। তবে ওর চোখ এখন আর সকালের মত শূণ্য নয়, অনেক অনেক কথা নিয়ে সে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে।

ছোটবেলার স্মৃতিগুলো

653681

নোয়াখালী জেলার মাহাতাবপুর গ্রামে ছিল আমার বাপদাদার ভিটেমাটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তখন ৮/৯ বছরের নাবালক শিশু। মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হবার আগে এবং পরের সময়েও এদেশে টাকার খুবই দাম ছিল। মানও ছিল। যাঁর-তার কাছে এতো এতো টাকা-পয়সা ছিলো না। কথায় আছে, “যাঁর কাছে হাজার টাকা ছিল, তাঁর টাইটেল ছিল হাজারী।” আর যাঁর কাছে লক্ষ টাকা ছিল, তাঁকে লোকে বলতো “লাখপতি।” তখনকার সময়ে কোটিপতির তালিকায় এদেশে কারোর নাম ছিল না বলেই মনে হয়।

যাক সে কথা। আসি নিজের কথায়! নিজের কথা হলো, আমার ছোটোবেলার কিছু সুখ-দুঃখ আনন্দের কথা। সেসব কথা মনে পড়লে আজও আমাকে কাঁদায়। এখনো যেকোনো পূজাপার্বণে ছোট ছেলে-মেয়েদের পূজোর আনন্দ উপভোগের সাজসজ্জা দেখে নিজের ছোটবেলার দিকে ফিরে তাকাতে হয়।

নোয়াখালী জেলার মাহাতাবপুর গ্রামে ছিল আমার বাপদাদার ভিটেমাটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তখন ৮/৯ বছরের নাবালক শিশু।আমি ছোট থাকতে দেখেছি, আমাদের গ্রামে দুর্গাপূজা হতো না। দুর্গাপূজা হতো টাউনে। গ্রামে হতো লক্ষ্মীপূজা। এর কারণ আগেই বলেছি যে, তখনকার সময়ের টাকার খুবই দাম ছিলো। মানও ছিলো। দুর্গাপূজা করতে হলে অনেক অনেক টাকা-পয়সার দরকার হতো। যা সেসময় পুরো একটা গ্রামে থাকা সব পরিবার মিলেও দুর্গাপূজার খরচ বহন করতে পারতো না।

তাই আমাদের গ্রামের মতো অনেক গ্রামেই তখন কেউ দুর্গাপূজা করতো না বা করার সাহসও পেতো না। যদিও দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব ছিলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রচলিত একটি ধর্মীয় উৎসব এবং দুর্গাপূজা সমগ্র হিন্দুসমাজেই ছিলো প্রচলিত। তবু্ও তখনকার সময়ে আর্থিক দুরাবস্থার কারণে হিন্দু সমাজের অন্যতম বিশেষ এই ধর্মীয় দুর্গোৎসবটি অনেক গ্রামেই বাদ থেকে যেতো।

এই ব্যয়বহুল সামাজিক ধর্মীয় উৎসবটি বাদ রেখে করা হতো লক্ষ্মীপূজা। তবে কিছু আর্থিক স্বচ্ছলতা পরিবার চৌমুহনী টাউনে গিয়ে দুর্গাপূজা দেখতো, আনন্দ করতো। আর যাঁদের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো ছিল, তাঁরা থেকে যেতো লক্ষ্মীপূজার আশায়। লক্ষ্মীপূজা হতো দুর্গাপূজার পরেই। অর্থাৎ আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শুরু হওয়া দুর্গাপূজার বিজয়াদশমীর শেষে প্রথম পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মীপূজা হয়ে থাকে। এই লক্ষ্মীপূজাতেই ছিলো সে-সময়ে আমাদের সবচেয়ে আনন্দ-উৎসব।

আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে যখন দুর্গাপূজা আরম্ভ হতো, তখন থেকেই আমাদের গ্রামের সবাই ব্যস্ত থাকতো লক্ষ্মীপূজার আয়োজন নিয়ে। এসব আয়োজনের মধ্যে থাকতো, পরিবারের সকলের জন্য যাঁর যাঁর সাধ্যমতো কম-বেশি নতুন জামাকাপড় কেনা বা বানানো এবং লক্ষ্মীপূজা সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যোগাড় করা। সাথে মা-বোনেরা সবাই চিড়ার মোয়া, মুড়ির মোয়া, নারিকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু ও নানারকম সন্দেশ বানানোর কাজে থাকতো বেশি ব্যস্ত। যাঁদের অভাব অনটন ছিলো না, তাঁরা লক্ষ্মীপূজার দিনে অনেক করতো। যাঁদের তেমন কিছু ছিলো না, তাঁরা নামমাত্র অল্পকিছু করতো। তবুও কষ্টেসৃষ্টে প্রতিটি ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপূজা করতো-ই-করতো। তা যেন ছিলো আমাদের গ্রামের হিন্দু সমাজে বাধ্যতামূলক।

তখনকার সময়ে আমাদের মাহাতাবপুর গ্রামে আমাদেরই ছিল বেশি অভাব। মানে অভাবী সংসার। তখন আমাদের ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। কারণ, আমার বাবা ছিলেন একজন চাকরিজীবী। তিনি থাকতেন নারায়ণগঞ্জ। চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণখোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলের গ্লাস ফ্যাক্টরিতে। তখনকার সময়ের টাকার যেমন দাম ছিল, শ্রমিকদের বেতনও ছিল যতসামান্য। বাবা বেতন যা-ই পেতেন, তা থেকে নিজের মাসিক খরচ রেখে বাদবাকি বাড়িতে ডাকে পাঠিয়ে দিতেন। আমার মাও বছরের বারোমাস বাবার পাঠানো টাকার আশাই থাকতেন। আমার বড়দাদাও বাবার সাথে নারায়ণগঞ্জই থাকতো। কিন্তু তখনো বড় দাদার পার্মানেন্ট চাকরি হয়েছিল না। বড়দা টেম্পোরারি হিসেবে আদর্শ কটন মিলে উইভিং ডিপার্টমেন্টে কাজ করতো। মাসে যা পেতো, তা বড়দা’র নিজেরই লেগে যেতো। তাই বাবার বেতনের উপরই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা।

সেসময় ধর্মীয় উৎসবের আগমণে মিল কর্তৃপক্ষ মিলে তৈরি কাপড় থেকে বের হওয়া রিজেক্ট কাপড়গুলো শ্রমিকদের মাঝে বিলি-বন্টন করে দিতো। যাতে শ্রমিকরা ওইসব রিজেক্ট কাপড় দিয়ে কিছু নতুন জামা কাপড়ের চাহিদা মেটাতে পারে। দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু হলেই আমার মা অপেক্ষায় থাকতেন বাবার আগমণের আশায়। আমার মা আশায় থাকতো, পুজো উপলক্ষে বাবা বাড়িতে আসলে, সাথে করে মিল থেকে পাওয়া সেই রিজেক্ট কাপড় নিয়ে আসবে। আর সেই কাপড় দিয়ে আমাদের লক্ষ্মীপূজার জামাকাপড় বানিয়ে দিবে।

মায়ের আশা কোনও বছর পূরণ হতো, আবার কোনও বছর অপূর্ণ থেকে যেতো। বাবা কোনও পূজায় ছুটি পেলে আসতো। আবার কোনও কোনও পূজায় আসতো না। কিন্তু আমার মা বাবার আগমণের অপেক্ষাই থাকতো বেশি। মা অপেক্ষায় থাকতেন মিলের সেই রিজেক্ট কাপড়ের আশায়। যদি আমার বাবা পূজা উপলক্ষে সময়মতো নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়িতে আসতো, তাহলে বাবা সাথে করে আনা সেই রিজেক্ট কাপড় দিয়ে আমার মা সবার আগে আমার জন্যই শার্ট ও হাফপ্যান্ট নিজ হাতে সেলাই করে বানিয়ে দিতেন। কারণ আমি ছিলাম আমাদের অভাবী সংসারে সবার ছোট। তাই আমারটা থাকতো সবার আগে। এ নিয়ে আমার বড়ো তিন বোন একটু টু-শব্দও করতো না। বরং তাঁরা এতে সবসময় খুশিই থাকতেন।

কোনও কারণবশত বাবা যদি পূজা উপলক্ষে বাড়িতে না আসতে পারতো, তাহলে অন্তত এক-দেড় মাস আগেই চিঠি দিয়ে মা’কে জানিয়ে দিতো। সে-বার আর নতুন জামা-প্যান্ট আর পেতাম না! ছেঁড়া ফাঁড়া পুরানো জামা-প্যান্ট পরেই পূজার আনন্দ উপভোগ করা হতো। কিন্তু লক্ষ্মীপূজা করা বাদ থাকতো না, যেকোনো একভাবে লক্ষ্মীপূজা করা হতো-ই-হতো।

প্রতিবারই লক্ষ্মীপূজাতে চিড়া- মুড়ির মোয়া তৈরি করার জন্য আমারা চার ভাই বোন মিলে গ্রামের কৃষকদের ধান ক্ষেতে ধান কুড়াতাম। আমরা মাঠে ধান কুড়াতাম তখন, যখন ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু হেমন্ত দেখা দিতো। মানে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ, এই দুই মাস। গ্রামের স্বচ্ছল কৃষকরা যখন ক্ষেতের পাকাধান কাটতো, আমরা তখন তাঁদের পেছনে পেছনে থাকতাম ঝরে পড়া ধন কুড়াতে। এই দু’মাস কৃষকদের ধান ক্ষেত থেকে ঝরা ধান কুড়িয়ে রেখে দিতাম, লক্ষ্মীপূজার চিড়া- মুড়ির মোয়া বানানোর জন্য। দুর্গাপূজার শুরু থেকেই আমার মা ও তিন বোন মিলে সেই ধান থেকে চিড়া মুড়ি তৈরি করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। ধান সিদ্ধ। ধান থেকে চাল। চাল থেকে চিড়া- মুড়ি। আর নাড়ু সন্দেশ তৈরি হতো নিজেরদের গাছের নারিকেল দিয়ে।

সেসময়ে আমার মতো ছোটো ছেলে- পেলেরা পূজা উপলক্ষে নতুন জামা- কাপড়, নাড়ু, সন্দেশ, চিড়া-মুড়ির মোয়ার চেয়ে বেশি খুশি থাকতো, পূজার দিন ফটকা বা আতশবাজি ফোটাতে পারলে। কিন্তু আমি আমাদের অভাবের কারণে গ্রামের আরও দশটা ছেলের মতো ফটকা বা আতশবাজি ফোটাতে পারতাম না। লক্ষ্মীপূজার দিন গ্রামে পাশের বাড়ির ছেলেরা যখন সন্ধ্যাবেলা ফটকা বা আতশবাজি ফোটাত, তখন আমি মায়ের কাছে গিয়ে কাঁদতাম, আমাকে ফটকা এনে দেওয়ার জন্য। মা তখন সামনের লক্ষ্মীপূজায় ফটকা বা আতশবাজি কিনে দিবেন বলে আমাকে শান্তনা দিয়ে রাখতো। আমার কান্নাকাটি দেখে মা আর বড় দিদিরা শান্তনা দিতেন, “সামনের লক্ষ্মীপূজার আগেই তোর বাবাকে জানিয়ে দিবো, বাড়িতে আসার সময় যাতে তোর জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে ফটকা বোম, বাজি এসব কিনে নিয়ে আসে।” মায়ের কথা, বড় বোনদের কথা মেনে নিয়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে চুপ করে থাকতাম, সামনের লক্ষ্মীপূজা আগমণের আশায়। এভাবে আশায় থাকতে থাকতে আরেক লক্ষ্মীপূজা শুরু হলেও আমার আর ফটকা ফুটানো কপালে জুটতো না, গ্রামের ছেলেদের ফুটানো ফটকার আওয়াজে নিজের ফটকা ফুটানোর স্বাদ মেটাতাম।

মায়ের আশ্বাস দেওয়া কথায় নিরাশ হয়ে একবার এক লক্ষ্মীপূজা সামনে রেখে নিজেই প্রস্তুতি নিলাম, লক্ষ্মীপূজার দিন ফটকা ফোটানোর। লক্ষ্মীপূজার আগমণের কয়েক মাস আগে থেকে বাড়ির চারদিকে জন্মে থাকা কচুর লতি-সহ সুপারি গাছ থেকে ঝরে পড়া সুপারি কুড়িয়ে হাটের দিন আমার বড় জেঠার সাথে হাটে গিয়ে বিক্রি করতাম। সেগুলো বিক্রি করে যা দুই পয়সা পেতাম, সেই পয়সাগুলো রান্নাঘরের বাঁশের খুটি কেটে জমা করে রাখতাম। উদ্দেশ্য লক্ষ্মীপূজার দিন ফটকা ফুটানোর জন্য। সময়টা তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার একবছর আগের কথা।

সেই লক্ষ্মীপূজার ঠিক চার-পাঁচদিন আগে মায়ের কাছে বলেকয়ে আমার জেঠাতো ভাইয়ের সাথে গেলাম চৌমুহনী টাউনে। উদ্দেশ্য ফটকা বানানোর পটাস(পটাসিয়াম)ও গন্ধক কেনার জন্য। তখনকার সময়ের গ্রামের অনেকেই এই গন্ধক বেটে পাউডারের মতো করে পটাসের সাথে মিশিয়ে একপ্রকার ফটাকা তৈরি করতো। এটা আমার জেঠাতো ভাইও পারতো। তাই আমি আমার জেঠাতো ভাইয়ের সাথে পটাস (পটাসিয়াম) ও গন্ধক কেনার জন্য গিয়েছিলাম। আমার সাথে মাত্র চার টাকা ছিল। এই চার টাকা থেকে দুই টাকার পটাস ও দুই টাকার গন্ধক। আমার জেঠাতো ভাই কিনেছে ১০ টাকার পটাস গন্ধক। তারপর দুইজনে চৌমুহনী টাউন থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি আসলাম।

পটাস (পটাসিয়াম) ও গন্ধক বাড়িতে এনে সেগুলো নিয়ে খুশিতে নাচতে শুরু করলাম। আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম, আর কয়েকদিন পর-ই তো লক্ষ্মীপূজা! এবার আমিও গ্রামের সব ছেলেদের শুনিয়ে দিবো ফটকার আওয়াজ। পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে দিবো, ফটকার শব্দে! পরদিন আমার জেঠাতো ভাইয়ের দেখাদেখি আমিও ফটকা (কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে বানানো বোমা) বানাতে লাগলাম! ফটকা বানাতে সাহায্য করলো আমার জেঠাতো ভাই। বানালাম বেশ কয়েকটা ফটকা। লক্ষ্মীপূজা আর মাত্র দুইদিন বাকি।

কিন্তু এই দুইদিন যেন দুই বছরের সমান! দুইদিন আর শেষ হচ্ছে না! ফটকাও ফুটাতে পারছি না। মনের ভেতরে কী যে একরকম যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেলো, তা আর লিখে শেষ করা যায় না। বানানো ফটকা সাথে করেই খাওয়া-দাওয়া-ঘুমানো। ফটকা আর চোখের আড়াল হতে দেই না, যদি কেউ নিয়ে যায় বা নষ্ট করে ফেলে, তাই। একসময় অপেক্ষার অবসান হতো। রাত শেষে ভোরে লক্ষ্মীপূজার সূর্য উদিত হতো। লক্ষ্মীপূজার দিন গত সন্ধ্যা হতেই শুরু করে দিতাম ধুমধাম, ঠুসঠাস! শুধু আমি একাই নয়। আমার মতন গ্রামের অনেক ছেলে-পেলেরা যাঁর যাঁর বাড়িতে ফটকা ফুটাতো। তখন পুরো গ্রাম নিজেদের বানানো ফটকার শব্দে কেঁপে উঠতো। এভাবে ঠুসঠাস চলতো রাতদুপুর পর্যন্ত।

এর পরের বছরই ১৯৭১ সাল। মার্চের শেষদিকে শুরু হয়ে গেলো মুক্তির যুদ্ধ! ৯ মাস তুমুল যুদ্ধের পর একসময় দেশ স্বাধীন হলো। এর একবছর পর ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ের আমরা সপরিবারে চলে আসি নারায়ণগঞ্জ। সেই থেকে আজ অবধি কতগুলো বছর গত হয়ে গেলো! কিন্তু আজও আমার মন থেকে সেসব কষ্টের কথা, আনন্দের কথা মুছে যায়নি। এখনো প্রতিবছর দুর্গাপূজায়, লক্ষ্মীপূজায় অতীতের কষ্টের মাঝে আনন্দের স্মৃতিগুলো মনের মাঝে জেগে ওঠে।

রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ‘বিটিভি’ এখন আর কেউ দেখে না

428_n

প্রতিদিন রাস্তাঘাটে চলাফেরার মাঝে অনেক জায়গায় থামতে হয়, অনেক চা’র দোকানে বসতে হয়। চায়ের দোকানে বসলেই চোখ যায় দোকানে চালু থাকা রঙিন টেলিভিশনের দিকে। চালু থাকা টেলিভিশনের পর্দায় দেখা মেলেনা রাষ্ট্রীয় ‘বিটিভি’ চ্যানেল। চলতে থাকে আর বসে থাকা কাস্টমাররা মনের আনন্দে ডিশ এন্টেনার ভারতীয় চ্যানেলগুলো। ওইসব দৃশ্য চোখে পড়লেই মনের টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠে ছোটবেলায় সাদাকালো টেলিভিশনে দেখা বাংলাদেশ টেলিভিশনের কথা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন (বিটিভি) যে আমরা সমবয়সীরা কতো আনন্দে উপভোগ করতাম, তা আর লিখে শেষ করতে পারবো না। তবে একটু-আধটু লিখে শেয়ার করা যায়।

সময়টা তখন ১৯৭৪ সাল। আমি চার কেলাসের (ক্লাস ফোর)-এর ছাত্র। তখন আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণ খোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলের ফ্যামিলি কোয়ার্টারে থাকতাম। সেসময় ঘরে ঘরে এতো টেলিভিশন ছিলো না। যা ছিলো, তা কেবল সেসময়কার কিছুকিছু পয়সাওয়ালাদের বাড়িতেই কাঠের বাক্সের মতো একটা সাদাকালো টেলিভিশন থাকতো।

তখন রঙিন টেলিভিশন ছিলোই না। লক্ষ্মণ খোলা পুরো গ্রামে হয়তো দু’একজনের বাড়িতে টেলিভিশন নামের বাক্সটা ছিলো। আদর্শ কটন মিল অভ্যন্তরে থাকা কোনও ফ্যামিলি বাসায় তো দূরের কথা, মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের ক্লাবেও একটা টেলিভিশন ছিলো না। শীতলক্ষ্যা নদীর এপার ওপার দু’পারে দু’টি টেলিভিশন ছিলো। একটা টেলিভিশন ছিলো লক্ষ্মণ খোলা জনতা ক্লাবে, আরেকটা ছিলো নদীর পশ্চিম পারে চিত্তরঞ্জন কটন মিলের শ্রমিকদের ক্লাবে। এই দুইটাও ছিলো সাদাকালো ১৭” ইঞ্চি টেলিভিশন।

সেসময়কার টেলিভিশনের ছোট্ট বাক্সটা বর্তমানে অনেক বড়সড় হয়ে গেছে। বর্তমানে টেলিভিশন প্রায় ৪০” ইঞ্চি। তাও আবার অ্যান্ড্রয়েড। সাথে থাকে ইন্টারনেট সংযোগ সিস্টেম। তা-ও আবার প্রায় ঘরে, হাটবাজারে, মহল্লার চায়ের দোকান-সহ বড়সড় সব দোকানেই দেখা যায়।

আর আমাদের সময়ে এই ১৪” ইঞ্চি, ১৭” ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশনই ছিলো মস্তবড় টেলিভিশন। টেলিভিশন দেখার জন্য শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ি দিতে হতো। তারপর সেসময়ের রুস্তম পাইন্না রুস্তমদের কতো যে মাইর, গুতা, খেতে হতো, তা আর লিখে শেষ করতে পারছি না। তবুও সেসময়কার কাঠের বাক্সের ভেতরে শাটানো কাঁচের পর্দার সামনাসামনি বসে থাকতে যে কতো ভালো লাগতো, তা একটু-আধটু লিখে স্মৃতি করে রাখছি মাত্র।

বলে রাখা ভালো যে, তখনকার সময়ে ইন্টারনেট আর ওয়াই-ফাই তো দূরের কথা, ডিশ অ্যানটেনা বা ডিশ লাইনও ছিলো না। ১৪” ইঞ্চি বা ১৭” ইঞ্চি টেলিভিশনের সামনে বসে আমরা যা দেখতাম, তা কেবল আমাদের স্বাধীন বাংলার বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত খবর, নাটক, সিনেমা, সিনেমার গান ও দেশীয় নৃত্যানুষ্ঠানগুলোই দেখতাম।

তখন সপ্তাহের ৭ দিনই রাত ৮ টা বাংলা সংবাদের পর কোনো-না-কোনো ইংরেজি সিরিজ শুরু হতো। সেসব বাংলা-ইংরেজি সিরিজের নামগুলো এখনো মনে আছে।যেই সিরিজগুলো দেখানো হতো সেগুলো থেকে কয়েকটা সিরিজের নাম এখানে উল্লেখ করছি। “হাওয়াই ফাইভও”, “টারজান”, “দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ল্ড ওয়েস্ট”, “সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান”, “বায়োনিক ওমেন”, “নাইট রাইডার”, “স্পেস নাইন্টিন নাইন্টি নাইন”।

বাংলা নাটকের সিরিজগুলো হলো, ‘সংশপ্তক’ এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’। আরও কিছু বাংলা-ইংরেজি সিরিজের নামগুলো এখন আর মনে নেই। তবে কিছুকিছু দৃশ্য এখনো মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। এইসব দর্শকপ্রিয় নাটকগুলোর নাম আর কথা মনে পড়লেই এখনো টেলিভিশনের রঙিন পর্দায় ফিরে তাকাই। কিন্তু না, সেরকম মনমাতানো নাটক আর ইংরেজি সিরিজ গুলো দেখা মেলেনা।

আগেকার মতো বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) ছায়াছবি, নাটক, ইংরেজি সিরিজ টেলিভিশনের সামনে বসে মনের আনন্দে কেউ উপভোগও করে না। সিনেমা হলে তো যায়-ই-না। এখন টেলিভিশনে ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে দেখা যায় ডিজে গান, ডিসকো ড্যান্স, গ্রুপ ড্যান্স, অর্ধনগ্ন পোষাকে হৈ-হুল্লোড়। সেগুলোই যোয়ান-বুড়ো সবাই দেখে। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ‘বিটিভি’ তো কেউ দেখেই না,  ‘বিটিভি’তে সম্প্রচার হওয়া অনুষ্ঠানও কেউ দেখে না।

সোনালী অতীত ক্লাবের জন্য শুভকামনা

20347966_n

ছোটবেলায় স্কুলে যাবার সময় কান্নাকাটি করেও দশ পয়সা তো দূরের কথা, পাচটি পয়সাও সময়তে পেতাম না। মায়ের কাছেও না, বড়দা ও বড় দিদিদের কাছ থেকে না। যা পেতাম, তা কেবল বাবা ও বড়দা বেতন পেলে। সবসময় না পাবার কারণ হলো, তখনকার সময়ে টাকার খুবই মান ছিলো। দামও ছিলো। সেসময়কার টাকার সাথে এসময়কার টাকা তুলনা করতে গেলে, সেসময়কার দশ টাকার সমান বর্তমান সময়ের ১০০/= টাকারও উপরে হতে পারে, তা আমি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত।

সেসময়ে টাকার ওইরকম দাম আর মানের জন্যই আমাদের ছোটবেলার সময়টাই ছিলো টাকার অভাব। টাকার সেই অভাবে দিনে লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুটবল খেলার খুবই শখ ছিলো, আমার। কিন্তু আমাদের সমবয়সী কারোর কাছেই ফুটবল ছিলো না। চামড়ায় মোড়ানো ফুটবল তো ছিলো সোনায় মোড়ানো এক হরিণ। সেই সোনায় মোড়ানো ফুটবল ছিলো সবারই কল্পনার বাইরে। বর্তমান বাজারে কমদামি প্লাস্টিকের মোড়ানো ফুটবলও তখন সবার কাছে ছিলো না। যে ক’জনের কাছে থাকতো, সামান্য একটু ঝগড়াঝাটি হলেই সে তার শখের প্লাস্টিকের ফুটবলটা আর খেলতে দিতো না।

তো কেউ কারোর শখের ফুটবল মন খারাপ করে না দিলেও সমস্যা হতো না। আমার মতো কাঙাল সমবয়সীদের ফুটবল খেলাও আর বন্ধ হতো না। প্রতিদিন স্কুল পর বই খাতা মাঠের কোণায় রেখেই শুরু হতো খেলা। তো অনেকেই প্রশ্ন করতে পারে, তাহলে বল পেলে কোত্থেকে?

ফুটবল ছিলো কাপড়ের মিল থেকে ফেলে দেওয়া সূতার জুট দিয়ে মোড়ানো। ফুটবল তৈরি করা হতো দু’এক দিন পরপর। প্রতিদিন স্কুলে যাবার সময় আমরা কেউ-না-কেউ একজন নিজেদের বানানো একটা ফুটবল সাথে করে নিয়ে যেতাম। তা লুকিয়ে রেখে দিতাম স্কুলমাঠের এক কোণায়, জঙ্গলে। দুপুরবেলা টিফিনের সময়ও শুরু করে দিতাম খেলা। আর স্কুল ছুটির পর তো পুরোদমেই চলতে।

সেই বলগুলো বানানো হতো বিশেষ কায়দায়। সূতার জুটগুলো প্রথমে টেনিস বলের মতো করে দলা করা হতো। তারপর এর উপরে শক্ত রশি দিয়ে পেচানো হতো, আর পেচানোর সাথে সাথে আরও আরও বাতিল জুট ঐ টেনিস বলের সাথে পেচানো হতো। দীর্ঘসময় পেচাতে পেচাতে একসময় খেলার উপযুক্ত এক চামড়ায় মোড়ানো ফুটবল আবিস্কার হয়ে যেতো। তার উপরে জুট থেকেই পাওয়া নোংরা ছেঁড়া-ফাড়া কাপড়ের টুকরা সুন্দরভাবে আরও ভালো করে পেচানো হতো। তাই সেটাকে অনেকই বলতো, “তেনার বল”।

তা দিয়েই আমরা কয়েকজন কাঙালি সমবয়সী মনের আনন্দে প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর স্কুলের মাঠেও খেলতাম, আদর্শ কটন মিলস্-এর মাঠেও খেলতাম। আমরা খেলতাম। আমাদের সেসময়কার খেলা মিলের শ্রমিকরা মাঠের চার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো। খেলা দেখে তারাও আনন্দ উপভোগ করতো, আমরাও আনন্দ পেতাম।

একসময় মিল অভ্যন্তরে থাকা শ্রমিক-কর্মচারীদের কয়েকজন নেতা আমাদের একটা চামড়ায় মোড়ানো ফুটবল কিনে দিলো। কথা থাকে, এই বল তাঁরাও খেলবে, আমরাও খেলবো। খেলা শেষ হবার পর ফুটবলটা থাকবে শ্রমিদের ক্লাবে। তা-ই হতো।

তাঁদের কথা মেনেই প্রতিদিন খেলা হতো। যেদিন কোনও কারণবশত সময়মতো ক্লাব থেকে ফুটবল বের করতে না পারতাম, সেদিন আমাদের নিজেদের তৈরি “তেনার বল” দিয়ে যথাসময়ে খেলা শুরু করে দিতাম।

তখন একটা সময় ছিলো, শুধু ফুটবলেরই সময়। বাংলাদেশে যে ক’টা সরকারি বড়বড় প্রতিষ্ঠান ছিলো, সব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব খেলার টিম ছিলো। শীতলক্ষ্যা নদীর এপারওপার থাকা প্রতিটি মিল ইন্ডাস্ট্রিরও নিজস্ব ফুটবল খেলার টিম ছিলো। আদর্শ কটন মিলেরও টিম ছিলো। তা-ও আবার মাসিক বেতনভোগী খেলোয়াড়। এখন আর সেসব মিল ইন্ডাস্ট্রিও নেই, ফুটবল খেলাও তেমনটা নেই। তখনকার সময়ের মতো ফুটবল প্রেমীও নেই। এখন শুধু ঘরে ঘরে ক্রিকেট প্রেমী।

মনে পড়ে, ঢাকা স্টেডিয়ামে যখন মোহামেডান আবাহনী খেলা হতো, তখন সেই খেলার উত্তেজনা আমাদের চারপাশেও বিরাজ করতো। যেদিন খেলা হতো, সেদিন সেই খেলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রেডিওতে সম্প্রচার করা হতো। সেই উত্তেজনাকর খেলা উপভোগ করতাম রেডিওতে সম্প্রচার শুনে। সেসময় ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিলো না। রঙিন টেলিভিশন তো দূরের কথা, দশ গ্রাম খুঁজে একটা সাদা-কালো টেলিভিশন পাওয়া যেতো না। দেশ-বিদেশের খবর, খেলার খবর শোনা হতো, একমাত্র রেডিওতে।

সে সময়ের সেই ফুটবল খেলা যেন দিনদিন পশ্চিমাকাশের সূর্যাস্তের মতো ডুবেই যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একদিন একসময়ের জনপ্রিয় ফুটবল খেলা হয়তো দেশ থেকে চিরতরে বিদায় নিবে। সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নেই। তো আমার মতো যারা আছে, তারা সবসময়ই সেসময়কার জনপ্রিয় ফুটবল খেলাকে মনে গেঁথে রাখবে বলে বিশ্বাস করি।

আজ আমি প্রায় বুড়ো। খেলার জো নেই ঠিক, কিন্তু ফুটবল খেলা দেখার স্বাদ মনে ঠিকই রয়ে গেছে।

তাই প্রতিদিন বিকেলবেলা গোদনাইল চৌধুরীবাড়ি চিত্তরঞ্জন ফুটবল খেলার মাঠে অন্তত একবার হলেও চুপি দিই। সময়তে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে খেলা দেখি। আমার চাকরির অফিসের মালিক দু’জনও ভালো খেলোয়াড়। উনারাও প্রতিদিন এই মাঠেই ফুটবল খেলে। তাই মাঠ ঘেঁষে যেতে আরও ভালো লাগে। তাই প্রতিদিনই যাওয়া হয়। যখনই মাঠের দিকে তাকাই, তখনই মনে পড়ে আমাদের সময়কার ‘তেনার বল’-এর (ফুটবল) কথা। বেঁচে থাকুক “সোনালী অতীত ক্লাব”, বেঁচে ফুটবল, বেঁচে থাকুক বিশ্বের ফুটবল ভক্ত বৃন্দরা। ফুটবল ও ‘সোনালী অতীত ক্লাব’র জন্য রইলো শুভকামনা।

ছবিটি আজ ৩০-০৬-২০২১ ইং, চিত্তরঞ্জন কটন মিলস্ ঐতিহাসিক ফুটবল খেলার মাঠ থেকে তোলা।

ছবিতে ‘সোনালী অতীত ক্লাব’র কয়েকজন খেলোয়াড় (ফুটবলার)।
ছবি উঠাতে উৎসাহদানে: “সোনালী অতীত ক্লাব”, গোদনাইল সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।