আলাপন-৩

ক্যাডাভিয়া আজ ভোর পাঁচটায় উঠেছে। ফজরের আযান শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আর ঘুম এল না। এভাবে অহেতুক শুয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। ভোরে যখন উঠেই গেছে তাই আগে নামাজ পড়ল। তারপর ভাবল একটু হাটাহাটি করে আসলে কেমন হয়?
ক্যাডাভিয়া হাটতে বের হল।
আহা! কি অপূর্ব ভোরের বাতাস! কতদিন যে ভোরের আলো দেখাই হয়নি! হাঁটতে হাঁটতে সামনে একটি শিউলি ফুলের গাছ পড়ল। ফুল ফুটে গাছ ভরে আছে। গাছের নিচে অনেক ফুল পড়ে আছে। কি যে অপরূপ লাল-শাদার মিশ্রণ। চোখ জুড়িয়ে যায়। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। মাঝে মাঝে কেউ কেউ জগিং করতে করতে যাচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে বেশ কজন গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে।

এখন শীতের দিন। ক্যাডাভিয়া একটি র‍্যাংলার ব্র্যান্ডের নিটেড ট্রাউজার পড়েছে আর গায়ে নর্থফেস ব্র্যান্ডের জ্যাকেট। পায়ে একজোড়া রিবক কেডস।
হঠাৎ ওর প্রিয় মানুষটির সাথে দেখা হয়ে গেল। এম বি এ ক্লাসমেট।

ছেলেটিকে যখন কেউ নাম জিজ্ঞেস করে আর তখন যদি সেখানে ক্যাডাভিয়া থাকে তাহলে সে একটু অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকে।
কারণ যিনি নাম জিজ্ঞেস করেন উনি নাম শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবেন। এই ফাঁকে ক্যাডাভিয়া অন্য প্রসঙ্গ তুলে আলাপচারিতা শেষ করে।
ক্যাডাভিয়া তাঁকে অন্য নামে ডাকে। এই নামটি ক্যাডাভিয়াই দিয়েছে। ক্যাডাভিয়ার দেয়া নামটি হচ্ছে “আলিফ”।
ক্যাডাভিয়া যখন “এই আলিফ!” বলে ডাক দেয় তখন সে যত ব্যস্তই থাকুক ক্যাডাভিয়া ডাকে হুড়মুড় করে আরবি আলিফ হরফের মতো সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
ছেলেটি ক্যাডাভিয়া খুব প্রিয় হওয়ার একটা কারণ যে, ক্যাডাভিয়া আলিফ কে যা বলে সে তাই বিশ্বাস করে এবং শোনে।
একদিন ক্যাডাভিয়া জিজ্ঞেস করেছিল, আমি যা বলি তাই তুমি ঠিক মনে কর কেন? আমি কি ভুল বলতে বা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারি না?
আলিফ উত্তরে বলেছিল, আমি তোমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসি, এখন তুমি যদি ভালবাসার অন্ধ মানুষকে গর্তে ফেলে দাও আমি প্রস্তুত, ভালবেসে মানুষ কত কিছুই না করেছে।

আলিফ নামক এই ছেলেটি ট্যালেন্ট কিন্তু বুদ্ধি খাটায় না। এস এস সি এবং এইচ এস সি দুটোতেই গোল্ডেন এ প্লাস। তারপরও কেমন যেন একটু ভাবুক ধরণের।
পড়ালেখায় ভালো বৈষয়িক জ্ঞানও ভাল কিন্তু তার ধ্যান ধারণা একটু ভিন্ন ধাচেঁর।
কি সব সৃষ্টি-স্রষ্টা-পৃথিবী-সময় এগুলো নিয়ে ভাবে। কে আমি? কোথা হতে আসলাম। কেন আসলাম। কোথায় যাব। আসলাম যদি তাহলে কেন যাব। মৃত্যু কি? এসব আজগুবি ভাবনায় ডুবে থাকে।
একবার ক্যাডাভিয়া এবং আলিফ এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিল। দুপুরের খাবার। কাচ্চি বিরিয়ানির অর্ডার দেয়া হয়েছিল।
বিরিয়ানি দেয়ার আগে হোটেল বয় সালাদ, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ এবং গাঁজর টেবিলে রেখে গেল।
আলিফ কি যেন ভাবতে ভাবতে একটা কাঁচা মরিচ তুলে নিয়ে কামড় বসিয়ে দিল।

এই ধরনের অনেক কাণ্ড সে করেছে। এর কোনও কারণ ক্যাডাভিয়া খুঁজে পায়না। তারপরও এই ছেলেটিকে ক্যাডাভিয়া খুব পছন্দ।

আলিফ ক্যাডাভিয়া্র কিছুটা দূর সম্পর্কের আত্নিয়।
একবার আলিফ ক্যাডাভিয়াদের গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিল। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ক্যাডাভিয়া খুঁজতে গিয়ে দ্যাখে লেবু বাগানে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
ক্যাডাভিয়া ডাকল কিন্তু তার কোনও সাড়া নেই।
ক্যাডাভিয়া আলিফের চোখের দিকে তাকিয়ে তারপর বরাবর আকাশের দিকে তাকাল। দেখল বিশাল আকৃতির পূর্ণিমা চাদের চারপাশ দিয়ে শাদা শাদা মেঘ উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। আলিফ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ওদিকেই।
কিছুক্ষণ পর ক্যাডাভিয়া জিজ্ঞেস করল, কি দেখছ?

এবার আলিফ মুখ খুললঃ
কেন এই বিশাল পূর্ণিমা? শাদা মেঘেরা কোথা থেকে আসছে? কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? কেন এই দিন, রাত, সূর্য, আকাশ? কেন এই পৃথিবী? কেন পৃথিবীতে মানুষ আসে? কেন আবার চলে যায়? কোথায় যায়???????
বলতে বলতে চেঁচিয়ে উঠল আলিফ।
ক্যাডাভিয়া আলিফের দুহাত ধরে একটা ঝাঁকুনি দিল। তারপর আলিফ স্বাভাবিক হল এবং বাসায় ফিরে গেল।

আজ শিউলি গাছের পাশে মর্নিং ওয়াকে ওদের দেখা হয়েছে। কিন্তু আলিফ শিউলি ফুলের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল।

-এই আলিফ! ক্যাডাভিয়া একটু জোরে ডাক দিল।

হুড়মুড় করে নড়েচড়ে উঠল আলিফ আলিফ হরফের মত সোজা হয়ে গেল। তারপর ক্যাডাভিয়া দিকে তাকাল।
-তুমি কি প্রতিদিন মর্নিং ওয়াক করো? ক্যাডাভিয়া জানতে চাইল।
– হ্যাঁ! তুমি?
– মাঝে মদ্ধ্যে। তবে এখন থেকে নিয়মিত করব ভাবছি।
– আজকে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের ক্লাস আছে, আসবে না?
-হ্যাঁ আসব। এই ক্লাসটা তো করতেই হবে।
-আচ্ছা, দেখা হবে ক্লাসে। আমার অফিস টাইম হয়ে যাচ্ছে। চলি।
-খোদা হাফেজ। ভাল থেক।

আলিফ চলে গেল। ক্যাডাভিয়া বাসায় ফিরতে শুরু করেছে কারণ ওর অফিসও ৯টায় শুরু হয়।
ক্যাডাভিয়া সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অফিস করে তারপর এম বি এ ক্লাসে যায় কারণ ও ইভনিং এম বি এ করে। ক্লাস শুরু হয় ছয়টা থেকেই কিন্তু ও ক্লাসে পৌঁছায় সাড়ে ছয়টায়।
আলিফ! – এই নামটা আসলে ক্যাডাভিয়া দিয়েছে। ওর আসল নাম “গৌতমমূসা মোহাম্মদ কৃষ্ণঈসা”। এই নামটা যিনি শোনেন তিনি চুপ করে কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবেন।
ক্যাডাভিয়া একবার জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার নাম এমন বিচিত্র কেন?
আ্লিফ জবাব দিয়েছিল, আমিও একই প্রশ্ন আমার বাবাকে করেছিলাম এবং তিনি বলেছিলেন, “এগুলোতো সবই মানুষের নাম, আই ডিডিন্ট কীপ ইয়োর নেম ফ্রম আনিম্যালস, আই কেপ্ট ইয়োর নেম ফ্রম হিউম্যান, হোয়াটস রঙ হিয়ার?”
আলিফ উত্তরে তার বাবাকে বলেছিল, তুমি সব পয়গম্বরদের নাম একত্রীকরণ করে আমার নাম রাখলে কেন?
আলিফের বাবা বলেছিল, গৌতম কি মানুষের নাম নেই? মূসা নামেও অনেক মানুষ আছে, মোহাম্মদ নাম অনেক সাধারণ মানুষের আছে আর আমরা মুসলমানরা নামের আগে মোহাম্মদ যুক্ত করি, এই নামের অর্থ প্রশংসিত, অনেক মানুষের নাম কৃষ্ণ আছে, আর ঈসা আপটেকিন একজন পলিটিক্যাল লিডার ছিলেন, ঈসা সেলেবি ছিলেন অটোম্যান প্রিন্স, ঈসা কাইয়ুম ছিলেন তার্কিস ফুটবলার, ঈসা টেঙ্গব্ল্যাড সুইডিশ গায়ক।
আলিফ বলেছিল, বাবা নাম কিন্তু একটা অনেক বড় ফ্যাক্টর। আমি “গৌতমমূসা মোহাম্মদ কৃষ্ণঈসা” এই নামে একটি কবিতার বই ছাপিয়েছিলাম। বইয়ের ভেতরে কি আছে তা মানুষ দেখতেই চায় নি শুধু নামের জন্য। নাম দেখেই আর ঐ বইতে হাত দেয় নি। তুমি বাংলাদেশের মানুষ হয়ে বাঙ্গালিদের মানসিকতা না বুঝলে কি করে হবে?
আলিফের বাবা উত্তর দিয়েছিলো, ও সব বইটই ছাপিয়ে কি হবে? বিখ্যাত হতে চাস? বিখ্যাত হওয়ার দরকার নেই। আমিতো প্রথমে তোর নাম রেখেছিলাম, “লী জেমস চার্লস গার্নিয়ে রুশো শাহিন মোহাম্মদ শাহরিয়ার নিয়াজ সুমন” কিন্তু তোর মা বলল এতো বড় নাম রাখলে মানুষ মনে রাখতে পারবে না, তাই এই ছোট নাম রেখেছি।
আলিফ আর কথা বাড়ায় নি সেদিন।

আজ আলিফ একটু আগেই ক্লাসে চলে এলো। এসে দ্যাখে এখনও ক্যাডাভিয়া আসেনি তাই যে সিটে আলিফ বসল তার পাশের সিটে ওর ব্যাগ রেখে দিল। অফিস শেষ করে ক্যাডাভিয়া ক্লাসে এলো।

আজ প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্টের যে বিষয়ের উপর লেকচার হচ্ছে তা হোল, Basic Phases of Project Management.
টিচার এই ইউনিভার্সিটিরই প্রোফেসার। ইউএসএ এর ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে পি এইচ ডি করেছেন।

লেকচার চলছে………
There have 5 basic phases of the project management and these are accordingly 1) Project conception and initiation
2) Project definition and planning 3) Project launch or execution 4) Project performance and control and 5) Project close.

একটানা ৪৫ মিনিট লেকচার চলল। ক্যাডাভিয়া দুটি বিষয় ঠিকমত বুঝতে পারেনি। সেটা হল Project close point এর এক্ষেত্রে Project complete হওয়ার পর Client এর Approval এর বিষয়টি
এবং Project evaluation process কিন্তু আলিফ তাকে বুঝিয়ে দিল।

ক্যাডাভিয়া বাসায় ফিরল। অফিস এবং ক্লাস দুটোই যেদিন করতে হয় সেদিন বেশ ক্লান্ত লাগে। দ্রুত খেয়ে বিছানায় ঘুমতে গেল। কিন্তু কেন যে ঘুম আসছে না সেটা বুঝতে পারছে না।
সেলফের দিকে তাকাতেই চোখ পড়ল “আলাপন” বইটির দিকে। উঠে হাত বাড়িয়ে বইটি বের করল। আলাপন-১ এবং আলাপন-২ তো পড়া হয়েছে। আলাপন-৩ এ কি আছে একটু দেখা দরকার।

“আলাপন-৩”
একটি যুবক ঘুমবার চেষ্টা করছে কিন্তু ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। অনেকক্ষণ কেটে গেল। ঘুম আসছে না। বেশ রাত হয়েছে। ঘর অন্ধকার কারণ লাইট অফ।
হঠাৎ একটি মোলায়েম কণ্ঠ ভেসে এলো।

-কি ভাবছ হে যুবক?

যুবকটি চোখ খুলে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। লাইট টা অন করবে কিনা ভাবছে। সুইচটা একটু দূরে আছে। বিছানা থেকে নেমে গিয়ে অন করতে হবে কিন্তু একটু ভয় ভয় লাগছে।
আবার কণ্ঠস্বর টি ভেসে এলো।
-ভয় পেয়ো না হে যুবক
-কে কথা বলে?
-আমাকে তিনিই পাঠিয়েছেন যার কথা তুমি সর্বদা ভাব
-আমিতো স্রষ্টার কথা ভাবি, তুমি কে?
-ধরো তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন
-কেন পাঠিয়েছেন?
-তোমার মনে যে সব প্রশ্ন জমে আছে তার উত্তর দেয়ার জন্যচ
-আচ্ছা বলতো মানুষ কেন পৃথিবীতে আসে?
-আল্লাহর কাজ করার জন্য
-আল্লাহর কাজ কি?
-নামায, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত ইত্যাদি
-হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান – এরাতো নামায-রোজা করে না। এরা কেন আসে?
-তারাও আল্লাহর কাজই করতে আসে
-তারা তাদের যেসব ধর্মিয় কাজ করে ঐগুলোও কি আল্লাহর কাজ?
-অবশ্যই আল্লাহর কাজ
-তাহলে কাজের ধরণে পার্থক্য কেন?
-ওটা আল্লাহই ভাল জানেন।
-আচ্ছা বলতো মানুষ মরার পর কোথায় যায়?
-ওটাতো কেউ গিয়ে দেখে আসেনি
-আমিতো একবার মারা গিয়েছিলাম কিন্তু কিছুইতো দেখলাম না
-সেটা কেমন?
-আমার একবার কি এক অসুখ হয়েছিল। আমি বিছানায় শুয়েছিলাম
-তারপর?
-আর কিছু মনে নেই শুধু মনে আছে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম
-তারপর?
-আসলে কিন্তু আমি বুঝিনি যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম এবং সাথে সাথেই আমার মৃত্যু হয়েছিল
-তারপর?
-হঠাৎ আমার জ্ঞান ফিরে এল
-এটা কি করে সম্ভব?
-আসলে মানুষের হৃৎপিন্ড যতক্ষণ চালু থাকে ততোক্ষণ সে জীবিত
-আচ্ছা
-এই হৃৎপিন্ড চলা বন্ধ হয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত বলে
-বুঝলাম
-বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃৎপিন্ড আবার কোনও কারণে চালু হয়ে যেতে পারে
-ও
-আমার বেলায়ও তাই হয়েছিল
-তারপর?
-আমার জানাযার জন্য আমাকে গোসল করানো হচ্ছিল
-তারপর?
– ঠিক তার কিছুক্ষন আগে আমার হৃদপিন্ড চালু হয়েছিল এবং মনে হয় প্রায় ৫ মিনিটের মদ্ধ্যেই আমার জ্ঞান ফিরে আসল
-তারপর?
-জেগে অনুভব করলাম শরীরে খুব ব্যথা আর খুব ঠাণ্ডা লাগছিল
-তারপর?
-দেখলাম আমি আমাদের বাথরুমে শুয়ে আছি আর শাওয়ার ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আমার শরীর ভিজে চ্যাপচ্যাপা
-তারপর?
-একটু উঠে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম
-কি বুঝলে?
-দেখলাম এক মধ্য বয়স্ক লোক শাদা দাড়ি মাথায় টুপি। উনি সাবান দিয়ে আমার শরীর পরিষ্কার করছেন
-তারপর?
-আমি কথা বলার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পারছিলাম না। অনেক কষ্টে ভাঙ্গা গলায় কথা বললাম
-কি কথা?
-উনাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি আমাকে গোসল করাচ্ছেন কেন?
-তারপর?
-লোকটি এদিক ওদিক তাকিয়ে লা-হাওলা ওয়া কুয়াতা ইল্লাবিল্লা বলে আবার সাবান লাগাতে শুরু করল
-তারপর?
-আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম আপনি কে? আমাকে গোসল করাচ্ছেন কেন?
-তারপর?
-লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে দেখল আমি উঠে বসে আছি
-তারপর?
-আমি তখন ভাঙ্গা গলায় বললাম আপনি কে?
-তারপর?
-লোকটি বড় বড় চোখ করে একলাফে দাঁড়িয়ে গেল
-তারপর?
-দুই কানে আঙ্গুল চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলল “লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ”
-তারপর?
-দৌড় দিল
-তারপর?
-আমি আস্তে আস্তে গোসল সেরে বাথরুম থেকে বের হলাম,বাথরুমের সাথেই আমার বেডরুম তাই জামা কাপর পড়ে নিলাম
-তারপর?
-খুব ক্লান্ত লাগছিল আর খুব ক্ষুধা পেয়েছিল
-তারপর?
-পাশের রুমে এসে দেখি বেশ কজন কোরান শরীফ পড়ছেন
-তারপর?
-ওরা আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল এবং লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন বলতে বলতে দৌড় দিল
-তারপর?
-পাশের রুমে এসে দেখি মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন, বাবা এবং ডাক্তার সাহেব মা’র পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন
-তারপর?
-আমি বাবাকে বললাম আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে
-বাবা কি করলেন?
-বাবা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন কিন্তু ডাক্তার সাহেব এসে আমাকে ধরলেন এবং বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললেন আমি খাবার আনছি, তুমি একটু শুয়ে থাকো
-তারপর?
-আমার ঠাণ্ডা লাগছিল বুঝতে পেরে বাবা আমার শরীরে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন
-তারপর?
-ডাক্তার সাহেব এসে আমার হাত ধরে পালস দেখলেন এবং শরীরে স্যালাইন লাগিয়ে দিলেন কিন্তু আমি বললাম আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে
-খাবার দিয়েছিল?
-না। ডাক্তার সাহেব বললেন, তুমি এখন অসুস্থ তাই এখন মুখ দিয়ে কিছু খেতে পারবে না, যে স্যালাইন দিয়েছি দশ মিনিট পর আর ক্ষুধা থাকবে না, এটাই আপাতত তোমার খাবার
-তারপর?
-ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম কিন্তু প্রতিদিন বাসায় প্রচুর লোক আসত আমাকে দেখতে, সাংবাদিক এবং টিভি ক্যামেরা সবসময় থাকত, আমি বিরক্ত হয়ে উঠলাম
-তারপর?
-বাবা আমাকে ইন্ডিয়া নিয়ে গেলেন উনার এক বন্ধুর বাসায় এবং কোলকাতায় এক স্কুলে ভর্তি করে দিলেন
-তারপর?
-কোলকাতায় একদিন এক হোটেলে চা খেতে ঢুকলাম
-তারপর?
-আমি যে টেবিলে বসলাম সেই টেবিলেই দেখলাম সেই মধ্য বয়স্ক দাড়ি টুপি পড়া লোকটি চা খাচ্ছে যিনি আমাকে গোসল করাচ্ছিলেন
-তারপর?
-আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আমাকে গোসল করাচ্ছিলেন কেন?
-উনি কি বললেন?
– আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল লা বলতে বলতে চা’এর কাপ ফেলে দৌড় দিলেন
-তারপর?
-হোটেলের ভেতরে থাকা কয়েকজন মানুষ এসে আমাকে বলল কি হয়েচে দাদা বলুনতো
-তুমি কি বললে?
-আমি বললাম, কি হয়েছে তা তো বলতে পারব না, দেখলাম উনি চা খাচ্ছিলেন, কি যেন মনে হল হঠাৎ দৌড় দিলেন, এই যে দেখুন আমার শার্টে চা’এর দাগ লেগে আছে
-তারপর?
-শান্তভাবে চা শেষ করে বিল দিয়ে চলে আসতে চাইলাম।
-তারপর?
-হোটেল কতৃপক্ষ আমাকে আসতে দিলেন না, আটকে রেখে সিসি ক্যামেরা রিপ্লে করে কি যেন দেখছিলেন
-তারপর?
-একজন বলল, এই ছেলেটাকেতো চেনা চেনা লাগছে, কোথায় যেনো দেখেছি
-তারপর?
-বাবা, আগেই আমাকে বলে দিয়েছিলেন দাড়ি সেভ না করতে তাই আমার বেশ বড় বড় দাড়ি হয়েছিলো
-তারপর?
-হঠাত পুলিশ এসে হাজির হল
-তারপর?
-পুলিশ আমাকে থানায় নিয়ে গেল
-তারপর?
-ওসি সাহেব একটি পত্রিকা বের করে আমাকে দেখিয়ে বললেন, এটা আপনার ছবি না?
-তুমি কি বললে?
-বললাম, হ্যাঁ আমার ছবি
-পুলিশ কি করল?
-পুলিশ বলল, আপনার ব্যাপারটা এখন ঐ হোটেল কতৃপক্ষ জেনে গেছে এবং আজ দিনের মদ্ধ্যে পুরো কোলকাতা জেনে যাবে
-তারপর?
-ওসি সাহেব আমার বাবাকে ফোন করে বললেন, ব্যাপারটাতো জানাজানি হয়ে গেছে তবে আপনি চিন্তা করবেন না ও আমাদের হেফাজতে আছে, আমরা আজ রাতেই গোপনে ঢাকায় পাঠিয়ে দেব
-হুম, তোমার বিষয়টাতো বেশ জটিল দেখছি, আচ্ছা একটা কথা বলতো?
-কি?
-তুমি আমার কাছে জানতে চাইলে মানুষ মারা গেলে কোথায় যায়, তুমিতো নিজেই মারা গিয়েছিলে, তুমি কিছু দ্যাখনি?
-নাহ।
-কেন?
-জানি না, মৃত্যুর পরে মানুষ কোথায় যায় সেটা আমি দেখলে কি আর তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম?
-ঠিক আছে যুবক তুমি এখন ঘুমাও, আমি এখন যাই।
-না। তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে যেতে পারবে না
-কিছুদিন পর আমি আবার এসে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাব, তুমি এখন ঘুমাও, অনেক রাত হয়েছে। আমি যাই
-এর আগেও তুমি অনেকবার এসেছ কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারনি
-দেব, উত্তর দেব
– উত্তর দিতে না পারলে কিন্তু অহেতুক আসবে না, তোমাকে কি করে শায়েস্তা করতে হয় তা আমার জানা আছে
-ঠিক আছে যুবক! উত্তর নিয়েই আসব, ভাল থেকো, খোদা-হাফেজ।

9 thoughts on “আলাপন-৩

  1. ক্যাডাভিয়া। ৪৫ মিনিট লেকচার চলল। আদ্রি দুটি বিষয় ঠিকমত বুঝতে পারেনি। আলিফ তাকে বুঝিয়ে দিল। এই আদ্রিই কি ক্যাডাভিয়া ? নাকি মুদ্রণ বিভ্রাট !!

    আলাপন ০৩ এ বেশ কিছু বিষয় খোলাসা হয়েছে যেমন নাম এবং নামের যুক্তি। বাকিটা তো থাকলোই। বিশ্লেষণ দু' ধরণের হতে পারে। এক. নিজস্ব। দুই. সর্বজনীন। নিজস্ব ভাবনা শেয়ারিং এ সমস্যা বাঁধে, যুক্তি তৈরীর চাইতে শব্দ-ভাবে দ্বিতীয় তৃতীয়তে পৌঁছুতে কষ্ট বাড়ে। আর সর্বজনীন বা প্রচলিতে থাকে বিশ্বাস। দেখা বিশ্বাস নয়; কল্পিত বা বহুকাল শুনে অভ্যস্ত এমন বিশ্বাস। 

    যাই হোক; আলাপন যখন শুরুই হয়েছে; সহসা নিশ্চয়ই থামবে না। চলুক। ধন্যবাদ। :)

    1. সঠিক ধরেছেন প্রিয় শ্রদ্ধাষ্পদেষু, ওটা  মুদ্রণ বিভ্রাট হয়েছে। আলাপন-২ তে আদ্রিয়ান্না  এই নামটি ব্যাবহার করেছিলাম। আলাপন-৩ এসে শুধু ঐ অংশটুকু ক্যাডাভিয়ার পরিবর্তে আদ্রি লিখে ফেলেছি। আমি খুব কয়েকজন শ্রদ্ধাভাজনকে পেয়েছি উনারা যে কবিতা বা গল্প ধরেন সেটার প্রতিটা লাইন পড়েন। আজ প্রমান পেলাম আপনিও সেরকম একজন শ্রদ্ধাভাজন।

      আর আলাপন-৩ নিয়ে আপনার শিক্ষামূলক মন্তব্য পেয়ে আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ এবং আমি নিজে উপকৃত।

      জ্বী, আলাপন চলতে থাকবে ইনশা আল্লাহ!

  2. ভিন্ন ধারার একটি মজার গল্প পড়লাম।  নামগুলো বিচিত্র থাকায় পাঠক আকৃষ্ট হতে বাধ্য।  

    মৃত্যুকে ভয় প্রতিটি মানুষের ,সেটুকু চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।  শুভকামনা। 

    1. ধন্যবাদ জানবেন প্রিয় কবি রুকশানা হক।

      আপনার আন্তরিক মন্তব্যে আমি অনুপ্রাণিত!

      ওনেক শুভকামনা ও শুভেচ্ছা রইলোhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

  3. পড়লাম ইলহাম দা। মনে হলো এখনও মন্তব্যের সময় হয়নি। লেখাটি আরও খানিক এগোক। শুভ সকাল।

  4. প্রিয় লেখক রিয়া, আপনি একটি উত্তর চেয়েছিলেন "ঘুমন্ত যাত্রী" কবিতার একটি লাইন নিয়ে। উত্তর দিতে একটু বিলম্ব হয়ে গেলো।

    "এই জনমের আগে" কবিতাটির শেষে আবৃত্তির এম্পি-ফোর লিংক শেয়ার করেছি।

    আপনার মতামত চাই।

    শুভেচ্ছা নিরন্তর!!!!https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

  5. ক্যাডাভিয়া যখন এই আলিফ! বলে ডাক দেয় তখন সে যত ব্যস্তই থাকুক ক্যাডাভিয়া ডাকে হুড়মুড় করে আরবি আলিফ হরফের মতো সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
    ছেলেটি ক্যাডাভিয়া খুব প্রিয় হওয়ার একটা কারণ যে, ক্যাডাভিয়া আলিফ কে যা বলে সে তাই বিশ্বাস করে এবং শোনে।

    শত ব্যস্ততা এবং কর্মমুখর প্রতিকূল পরিস্থিতি মাড়িয়েও লেখনীতে দারুণ সাহিত্যরস খুজে পাওয়া যায়। শুভেচ্ছা অবিরাম প্রিয় লেখক।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।