ট্যাগ আর্কাইভঃ ছোটগল্প

বর্ষার চিঠি

আমি কি গান গাব যে ভেবে না পাই-

উতল-ধারা বাদল ঝরে। সকল বেলা একা ঘরে। সত্যিই গত কয়েকদিন ধরে এমন অঝোর বৃষ্টি। সারাদিন। কখনো ঝিরিঝিরি তো কখনো মুষলধারে। মাঝেমধ্যে এক একটি দমকা হাওয়া যেন মনের মধ্যে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে চলে যায়। ভেতরটা মুচড়িয়ে ওঠে। হু হু করে। দক্ষিণের জানলাটা খোলা। ঠান্ডা বাতাসে একটা আরামে চোখ বুঁজে আসে। পূবের জানলা দিয়ে সামনের রাস্তাটা সোজা চলে গিয়েছে সেই রেলস্টেশন অব্দি। খুব বেশি দূরেও নয়। সারাদিন ট্রেনের শব্দেই ঘড়ির কাজ হয়ে যায় প্রায়। আজকাল ট্রেন বেশ সময় ধরেই চলছে দেখছি। এখান থেকে রেলস্টেশনটা দেখা যায় না ঠিক। কিন্তু দক্ষিণের জানলা দিয়ে ঐ দূরে ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ট্রেনের চলে যাওয়াটা দেখা যায় চেষ্টা করলে। ট্রেনের চলে যাওয়ার সাথে প্রিয়জনের চলে যাওয়ার একটি মিল আছে যেন। মনে হয় একই রিদিমে অনেকটা দূরত্ব সাথে নিয়ে চলে গেল যেন। ঠিক যেমন চলে গিয়েছিল পিয়ালী। সে অনেক দিন আগের কথা। এখন এই আধা শহরেই পাকাপাকি একটি বন্দোবস্ত করে নিয়েছি প্রায়। প্রায় এই জন্যেই যে জীবনে চিরস্থায়ী কিছুই নয়। আজ আছি। কাল কি হবে জোর দিয়ে কে বলতে পারে। পরশুর কথা তো দেব নঃ জনান্তি! এই বৃষ্টি ভেজা অলস দিন। কি বলবো আমিই জানি না। কি কথা আমার যা অন্য কাউকে বলা যায়। কিন্তু কাউকে না কাউকে যে অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে হয়। বিশেষ করে এমন দিনে। কিন্তু সত্যি বলতে কি আজকাল আর কথাই খুঁজে পাই না। অথচ অনর্গল কথা বলার একদিন ছিল। সেসব যেন ধুসর স্মৃতি আজ। এই বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে মনটাও কেমন উতলা হয়ে ওঠে। পুরানো স্মৃতির সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে যেতে চায় অনেক অতীতে। তবু প্রশ্ন জাগে জীবন কি সত্যিই অতীত হয় কখনো? কেই বা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে?

এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়-

সত্যিই তাই এ আমার জীবনেরই ইতিহাস যেন। কতযুগ আগের কথা। এরকমই এক উথাল পাতাল বৃষ্টিভেজা বিকাল। ইউনিভার্সিটির ক্লাসে আমরা দুজন। ভাষা শিক্ষার ক্লাস ছিল। বৃষ্টির মধ্যে কেউই আসতে পারেনি। শুধু আমরা দুজন বাদে। সে ছিল মোবাইল ফোন আবিষ্কারের আগের যুগ। খুব কম মানুষের বাড়িতেই তখনো ল্যাণ্ডফোন। আমাদের ভাষাশিক্ষার ক্লাসের অধ্যাপকও হয়তো আটকিয়ে গিয়েছিলেন সারাদিনের বৃষ্টিতে। কিন্তু সেই বৃষ্টিও আমাকে আটকাতে পারেনি। পারেনি কারণ সেই ক্লাসেই প্রথম দেখা মিতালীর সাথে। তাই একটি দিনও ক্লাস মিস করার উপায় ছিল না। আসতেই হতো। কিন্তু মিতালীও কি তাই এসেছিল? নিশ্চয়ই তাই। না হলে আর কেউ না এলেও শুধু আমরা দুজনেই বা কেন অমন অঝোর বৃষ্টির বিকালে গিয়ে উপস্থিত হবো। ইউনিভার্সিটির বিশাল বিশাল জানলার কাঁচের ওপারে তখন বৃষ্টি আর সবুজ গাছপালার যুগল নৃত্য। ভেতরে আমাদের চঞ্চল চোখের দুইকুলে। মিতালীর মতো সুন্দরী আমি সত্যিই আর দেখিনি। সব কিছু বাদ দিলেও অমন দুটি চোখ। যে কোন মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। আমার তো রোজই ঘুরতো। ভাষা শিক্ষার ক্লাসের অধ্যাপকের কথা উড়ে যেতো মাথার উপর দিয়ে। শুধু অবাক হয়ে দেখতাম মিতালী কি অবলীলায় নতুন একটি ভাষাকে দ্রুত তালে রপ্ত করে নিচ্ছে! সেই থেকে মিতালীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার শুরু। সেদিনের সেই বৃষ্টির বিকেলেই তাই ঠিক করে ফেলি, আর স্বপ্ন নয়। এবার স্বপ্নকে নামিয়ে আনতে হবে বাস্তবতায়। এমন মধুর লগ্ন সহজে আসবে না আর।

কিছু বলবো বলে এসেছিলেম, রইনু চেয়ে না বলে

হয়তো এটাই জীবন। এইভাবেই জীবনের নাগরদোলায় আমাদের ওঠা নামা। দূর থেকে দেখলে হাসিই পায়। কিন্তু যারা ওঠে নামে তাদের যে সবসময় অবিমিশ্র ভালোই লাগে তা নাও হতে পারে। সেদিন মিতালীর মনেও রং ধরিয়েছিল ঝরঝর বরিষণ। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই সহপাঠির কাছেই তার ভালোবাসার গল্পগুলি মেলে ধরেছিল। আমার মধ্যে ভরসা করার মতোই একজন মানুষকে খুঁজে পেয়ে অনর্গল উপুর করে দিয়েছিল তার মনের আদিগন্ত। তৃপ্তি পেয়েছিল। ঠিক যে ট্রেনটা ধরার জন্যে আপনি ব্যাকুল হয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন, সেটি আপনাকে না নিয়েই স্টেশন ছেড়ে বেড়িয়ে গেলে যেমন অসহায় দশা হয়, আমারও সেদিন সেই দশা। বাইরে আদিগন্ত উথাল পাতাল বৃষ্টি। ইউনিভার্সিটির জানালার কাঁচ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে জলপ্রপাতের মতো। ভিজে যাচ্ছি আমিও। আমার স্বপ্নগুলোও তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে ধ্বসে যাচ্ছিল গলে গলে। সেও তো রক্তজল করা কষ্ট না কি। একমনে কত কথাই বলে যাচ্ছিল মেয়েটি। কত তার স্বপ্ন। কতরকম পরিকল্পনা। হয়তো সেই প্রথম আমি আঁচ করতে পারছিলাম নারীর মন। কতরকম বিচিত্র তার নকশা। কতরকম বিচিত্র তার বুনন। কিন্তু ভরা বর্ষার নদীর মতোই যেন অবাধ তার গতি। একবার জল পেয়ে গেলে আর যেন দুকুল মানে না। সবিকিছুই ভাসিয়ে নিয়ে অভিমুখ তার সাগরসঙ্গমে। ভাষাশিক্ষার ক্লাসে সেই আমার শেষদিন। মনে মনে অধ্য়াপককে শুভকামনা জানিয়েই রওনা দিয়ে ছিলাম বাড়ি ফেরার পথে। সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে।

যায় দিন, শ্রাবণদিন যায়

সে শ্রাবণ বড়ো নিঃসঙ্গ। চারদিকে কান পাতলে শুধুই বৃষ্টির গোঙানি তখন। মেঘের তোরে যেন ধুলিস্মাৎ সব স্বর্ণালী স্বপনের রামধনু আশা। জলকাদা মাখামাখি শহরের গোলকধাঁধায় ভাষাহীন ব্যাথার নিরব প্রতিধ্বনি। রোজকার খবরের কাগজের মতোই নিরানন্দ পৃথিবী রোজকার ভেজারাতে উঁকি দিয়ে যায় জানলায়। নিবিষ্ট অন্ধকার জমে উঠতে থাকে দিনলিপির সব সাদা সাদা পাতা জুড়ে দুই মালাটের জীবনে। পথ চলতি রাস্তায় বেহঁশ গাড়ীর চাকায় জলকাদা ছিটকিয়ে ভিজে যাওয়ার মতো অসহনীয় সে অবস্থা। তবু স্মৃতিময় ঝরে পড়া স্বপ্নের আবেশ নিয়ে অলস সময়ের হাতছানি। চারিদিকে কেউ নাই। কিছু নাই। তবু মিতালীর সেই দুটি চোখ রয়ে গিয়েছে তখনো। যে চোখ তার সহপাঠীকে ভরসা করে ছিল। সেই স্মৃতিটুকু খড়কুটোর মতো ধরে নিজের দিকে চেয়ে নতুন ভাষা খোঁজা কেবল। মানুষের মন বেশিরভাগ সময়েই অবুঝ শিশুর মতো খেলা করে জীবনের চারকোণে। নিজের কাছেই তার যত বায়না। আর চাওয়ারও শেষ নাই, আশার ভাঁজে ভাঁজে।

মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো

গিয়েছিলাম বেড়াতে। পাহাড় ছিল। টলটল জলের নদী পাশ দিয়ে। মনে হয় হেঁটেই পার হয়ে যাওয়া যাবে। সঙ্গীসাথী কেউ নাই। একাই। বেশ কিছু ছুটি জমে গিয়েছিল সরকারী দপ্তরের। একটু ছুটি চাইছিলাম। নিরবে নিভৃতে নিজের সাথে বসার জন্যে।
সেও এমনই শ্রাবণ মাস। রোদ বৃষ্টির লুকোচুড়ি খেলা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির একটা মৌতাত আছে। যতটুকু গায়ে মেখে নেওয়া যায়। একাই বসেছিলাম নদীর ধারে পাহাড়ী ঢালে। সামনে সবুজে সবুজ। আর মেঘে ঢাকা বৃষ্টির আকাশ। না কোন কবিতার কথা মনে ছিল না। বেসুর গলা নিজের বশেই ছিল। ভাবাবেগের স্রোতও ভাটির টান, সেও অনেক দিন। শুধুই নিরিবিলি ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মুখোমুখি নিজের সাথে একা। দেখা হল ঠিক সেই সময়। নদীর জলে পা ডুবিয়ে নদীতে নামার জন্যে ব্যালেন্স ঠিক রাখার চেষ্টায়। আমি ছিলাম সামান্য বাঁদিকে। কখন যে কেউ সামনে এসে গিয়েছে খেয়াল করতে পারিনি। যখন পারলাম ততক্ষণে সে টাল সামলাতে না পেরে নদীর জলে হাবুডুবু। তারপর অনেকটা চিত্রনাট্যেরই মতোন। হবু শ্বশুর শাশুড়ীর অনেক আশীর্বাদ আর তাঁদের ডাকাবুকো মেয়ের স্পর্শ নিয়ে ফেরা একটা আস্ত গোটা রাত। বাঁধ ভাঙা বন্যার জলের তোড়ের মতো উচ্ছাসে উদ্দাম।

হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে

সত্যই তাই প্রায় নাচতে নাচতেই পিয়ালীর সাথে কেটে গেল বেশ কয়েকটা বছর। বেঁচে থাকা যে এমন মনোহর হতে পারে, সেটা জেনেছিলাম ওর কাছেই। যেমন ডাকাবুকো তেমনি উচ্ছল। সবেতেই ওর বিস্ময়। আর সবেতেই ওর আনন্দ। ঠিক যেন প্রকৃতির মতোই। মনে হয় না কোথাও কোন দুঃখ আছে। ছিল। থাকবে কোনদিন। গোটা জীবনের অর্থটাই যেন বদলে দিয়ে গেল। কি বিপুল উৎসাহ। কোন কাজেই পিছপা নয়। হাজার পরিশ্রমেও কোন ক্লান্তি নাই। বিরক্তি নাই। আর সারা মুখে সেই দুকুল ছাপানো হাসি। না পিয়ালী, আমি আজ এই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় তোমার ঢাক পিটাতে বসিনি মোটেও। তুমি যা তুমি তাই। যারা তোমাকে চিনতো তারাই তা জানে। কাউকে ডেকে ডেকে শোনানোর কোন প্রয়োজন নাই আমাদের কারুরই। জীবনের আনন্দ যে চলার ছন্দের মধ্যেই এ কথা প্রথম শেখা তো তোমার কাছেই। সেই ছন্দটাকেই চলিষ্ণু রাখাটাই প্রতিভা। বলেছিলে তুমি। সেদিন যখন তোমার সাথে প্রথম আলাপ। তোমার মায়ের অজস্র বকুনির উত্তরেই। সেই হয়তো আমার জীবনের প্রথম সহজপাঠ।

আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে

কবি বলেছিলেন; ‘জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না। কিন্তু আজ এতদিন পেরিয়ে এসেও আমি তো জানি। জানি কেন এমন পাগল করা বৃষ্টিও আমাকে আর ভেজাতে পারে না আগের মতো। আসলে ভিজতে চাওয়ার মতো মনটাই যে হারিয়ে গিয়েছে। হারিয়ে যাওয়া মানুষের মতো। যাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। যাবে না কোনদিন। মিসিং ডায়েরী করার সময়ও বুঝতে পারিনি, যা হারিয়ে যায় সে আর ফিরে পাওয়া যায় না হয়তো কোনদিন। গিয়েছিলাম আবার পাহাড়ে। সে হিমালয়ের সবুজ অরণ্যের অনেক গহন ভেতরে। গিয়েছিলাম শুধু দুজনেই। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির রাতে খেয়াল চাপলো তার বৃষ্টিতে ভেজার। আমিও যে নিষেধ করেছিলাম তেমনটাও তো নয়। কিন্তু পিয়ালী, বারণ করলেই কি তুমি শুনতে? আমিও তো তখন তোমারই মতো। তোমার আনন্দেই বিভোর। কি যে জাদু করেছিলে! গোটা জীবনটাই যেন একটা উদযাপন হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি ইচ্ছেই এক একটি উৎসব। বাঁধন ছেঁড়ার সাধন শুধু। শুধু জানতাম তুমি আছো আমি আছি।

আমার প্রিয়ার ছায়া
আকাশে, আজ ভাসে, হায় হায়!
বৃষ্টিসজল বিষন্ন নিশ্বাসে, হায়!
আমার প্রিয়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
সন্ধ্যাতারায় লুকিয়ে দেখে কাকে,
সন্ধ্য়াদীপের লুপ্ত আলো স্মরণে তার আসে। হায়!
বারি-ঝরা বনের গন্ধ নিয়া
পরশ-হারা বরণমালা গাঁথে আমার প্রিয়া।
আমার প্রিয়া ঘন শ্রাবণধারায়
আকাশ ছেযে মনের কথা হারায়।
আমার প্রিয়ার আঁচল দোলে
নিবিড় বনের শ্যামল উচ্ছ্বাসে, হায়।

শ্রীশুভ্র

আলাপন-৩

ক্যাডাভিয়া আজ ভোর পাঁচটায় উঠেছে। ফজরের আযান শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আর ঘুম এল না। এভাবে অহেতুক শুয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। ভোরে যখন উঠেই গেছে তাই আগে নামাজ পড়ল। তারপর ভাবল একটু হাটাহাটি করে আসলে কেমন হয়?
ক্যাডাভিয়া হাটতে বের হল।
আহা! কি অপূর্ব ভোরের বাতাস! কতদিন যে ভোরের আলো দেখাই হয়নি! হাঁটতে হাঁটতে সামনে একটি শিউলি ফুলের গাছ পড়ল। ফুল ফুটে গাছ ভরে আছে। গাছের নিচে অনেক ফুল পড়ে আছে। কি যে অপরূপ লাল-শাদার মিশ্রণ। চোখ জুড়িয়ে যায়। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। মাঝে মাঝে কেউ কেউ জগিং করতে করতে যাচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে বেশ কজন গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে।

এখন শীতের দিন। ক্যাডাভিয়া একটি র‍্যাংলার ব্র্যান্ডের নিটেড ট্রাউজার পড়েছে আর গায়ে নর্থফেস ব্র্যান্ডের জ্যাকেট। পায়ে একজোড়া রিবক কেডস।
হঠাৎ ওর প্রিয় মানুষটির সাথে দেখা হয়ে গেল। এম বি এ ক্লাসমেট।

ছেলেটিকে যখন কেউ নাম জিজ্ঞেস করে আর তখন যদি সেখানে ক্যাডাভিয়া থাকে তাহলে সে একটু অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকে।
কারণ যিনি নাম জিজ্ঞেস করেন উনি নাম শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবেন। এই ফাঁকে ক্যাডাভিয়া অন্য প্রসঙ্গ তুলে আলাপচারিতা শেষ করে।
ক্যাডাভিয়া তাঁকে অন্য নামে ডাকে। এই নামটি ক্যাডাভিয়াই দিয়েছে। ক্যাডাভিয়ার দেয়া নামটি হচ্ছে “আলিফ”।
ক্যাডাভিয়া যখন “এই আলিফ!” বলে ডাক দেয় তখন সে যত ব্যস্তই থাকুক ক্যাডাভিয়া ডাকে হুড়মুড় করে আরবি আলিফ হরফের মতো সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
ছেলেটি ক্যাডাভিয়া খুব প্রিয় হওয়ার একটা কারণ যে, ক্যাডাভিয়া আলিফ কে যা বলে সে তাই বিশ্বাস করে এবং শোনে।
একদিন ক্যাডাভিয়া জিজ্ঞেস করেছিল, আমি যা বলি তাই তুমি ঠিক মনে কর কেন? আমি কি ভুল বলতে বা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারি না?
আলিফ উত্তরে বলেছিল, আমি তোমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসি, এখন তুমি যদি ভালবাসার অন্ধ মানুষকে গর্তে ফেলে দাও আমি প্রস্তুত, ভালবেসে মানুষ কত কিছুই না করেছে।

আলিফ নামক এই ছেলেটি ট্যালেন্ট কিন্তু বুদ্ধি খাটায় না। এস এস সি এবং এইচ এস সি দুটোতেই গোল্ডেন এ প্লাস। তারপরও কেমন যেন একটু ভাবুক ধরণের।
পড়ালেখায় ভালো বৈষয়িক জ্ঞানও ভাল কিন্তু তার ধ্যান ধারণা একটু ভিন্ন ধাচেঁর।
কি সব সৃষ্টি-স্রষ্টা-পৃথিবী-সময় এগুলো নিয়ে ভাবে। কে আমি? কোথা হতে আসলাম। কেন আসলাম। কোথায় যাব। আসলাম যদি তাহলে কেন যাব। মৃত্যু কি? এসব আজগুবি ভাবনায় ডুবে থাকে।
একবার ক্যাডাভিয়া এবং আলিফ এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিল। দুপুরের খাবার। কাচ্চি বিরিয়ানির অর্ডার দেয়া হয়েছিল।
বিরিয়ানি দেয়ার আগে হোটেল বয় সালাদ, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ এবং গাঁজর টেবিলে রেখে গেল।
আলিফ কি যেন ভাবতে ভাবতে একটা কাঁচা মরিচ তুলে নিয়ে কামড় বসিয়ে দিল।

এই ধরনের অনেক কাণ্ড সে করেছে। এর কোনও কারণ ক্যাডাভিয়া খুঁজে পায়না। তারপরও এই ছেলেটিকে ক্যাডাভিয়া খুব পছন্দ।

আলিফ ক্যাডাভিয়া্র কিছুটা দূর সম্পর্কের আত্নিয়।
একবার আলিফ ক্যাডাভিয়াদের গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিল। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ক্যাডাভিয়া খুঁজতে গিয়ে দ্যাখে লেবু বাগানে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
ক্যাডাভিয়া ডাকল কিন্তু তার কোনও সাড়া নেই।
ক্যাডাভিয়া আলিফের চোখের দিকে তাকিয়ে তারপর বরাবর আকাশের দিকে তাকাল। দেখল বিশাল আকৃতির পূর্ণিমা চাদের চারপাশ দিয়ে শাদা শাদা মেঘ উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। আলিফ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ওদিকেই।
কিছুক্ষণ পর ক্যাডাভিয়া জিজ্ঞেস করল, কি দেখছ?

এবার আলিফ মুখ খুললঃ
কেন এই বিশাল পূর্ণিমা? শাদা মেঘেরা কোথা থেকে আসছে? কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? কেন এই দিন, রাত, সূর্য, আকাশ? কেন এই পৃথিবী? কেন পৃথিবীতে মানুষ আসে? কেন আবার চলে যায়? কোথায় যায়???????
বলতে বলতে চেঁচিয়ে উঠল আলিফ।
ক্যাডাভিয়া আলিফের দুহাত ধরে একটা ঝাঁকুনি দিল। তারপর আলিফ স্বাভাবিক হল এবং বাসায় ফিরে গেল।

আজ শিউলি গাছের পাশে মর্নিং ওয়াকে ওদের দেখা হয়েছে। কিন্তু আলিফ শিউলি ফুলের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল।

-এই আলিফ! ক্যাডাভিয়া একটু জোরে ডাক দিল।

হুড়মুড় করে নড়েচড়ে উঠল আলিফ আলিফ হরফের মত সোজা হয়ে গেল। তারপর ক্যাডাভিয়া দিকে তাকাল।
-তুমি কি প্রতিদিন মর্নিং ওয়াক করো? ক্যাডাভিয়া জানতে চাইল।
– হ্যাঁ! তুমি?
– মাঝে মদ্ধ্যে। তবে এখন থেকে নিয়মিত করব ভাবছি।
– আজকে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের ক্লাস আছে, আসবে না?
-হ্যাঁ আসব। এই ক্লাসটা তো করতেই হবে।
-আচ্ছা, দেখা হবে ক্লাসে। আমার অফিস টাইম হয়ে যাচ্ছে। চলি।
-খোদা হাফেজ। ভাল থেক।

আলিফ চলে গেল। ক্যাডাভিয়া বাসায় ফিরতে শুরু করেছে কারণ ওর অফিসও ৯টায় শুরু হয়।
ক্যাডাভিয়া সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অফিস করে তারপর এম বি এ ক্লাসে যায় কারণ ও ইভনিং এম বি এ করে। ক্লাস শুরু হয় ছয়টা থেকেই কিন্তু ও ক্লাসে পৌঁছায় সাড়ে ছয়টায়।
আলিফ! – এই নামটা আসলে ক্যাডাভিয়া দিয়েছে। ওর আসল নাম “গৌতমমূসা মোহাম্মদ কৃষ্ণঈসা”। এই নামটা যিনি শোনেন তিনি চুপ করে কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবেন।
ক্যাডাভিয়া একবার জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার নাম এমন বিচিত্র কেন?
আ্লিফ জবাব দিয়েছিল, আমিও একই প্রশ্ন আমার বাবাকে করেছিলাম এবং তিনি বলেছিলেন, “এগুলোতো সবই মানুষের নাম, আই ডিডিন্ট কীপ ইয়োর নেম ফ্রম আনিম্যালস, আই কেপ্ট ইয়োর নেম ফ্রম হিউম্যান, হোয়াটস রঙ হিয়ার?”
আলিফ উত্তরে তার বাবাকে বলেছিল, তুমি সব পয়গম্বরদের নাম একত্রীকরণ করে আমার নাম রাখলে কেন?
আলিফের বাবা বলেছিল, গৌতম কি মানুষের নাম নেই? মূসা নামেও অনেক মানুষ আছে, মোহাম্মদ নাম অনেক সাধারণ মানুষের আছে আর আমরা মুসলমানরা নামের আগে মোহাম্মদ যুক্ত করি, এই নামের অর্থ প্রশংসিত, অনেক মানুষের নাম কৃষ্ণ আছে, আর ঈসা আপটেকিন একজন পলিটিক্যাল লিডার ছিলেন, ঈসা সেলেবি ছিলেন অটোম্যান প্রিন্স, ঈসা কাইয়ুম ছিলেন তার্কিস ফুটবলার, ঈসা টেঙ্গব্ল্যাড সুইডিশ গায়ক।
আলিফ বলেছিল, বাবা নাম কিন্তু একটা অনেক বড় ফ্যাক্টর। আমি “গৌতমমূসা মোহাম্মদ কৃষ্ণঈসা” এই নামে একটি কবিতার বই ছাপিয়েছিলাম। বইয়ের ভেতরে কি আছে তা মানুষ দেখতেই চায় নি শুধু নামের জন্য। নাম দেখেই আর ঐ বইতে হাত দেয় নি। তুমি বাংলাদেশের মানুষ হয়ে বাঙ্গালিদের মানসিকতা না বুঝলে কি করে হবে?
আলিফের বাবা উত্তর দিয়েছিলো, ও সব বইটই ছাপিয়ে কি হবে? বিখ্যাত হতে চাস? বিখ্যাত হওয়ার দরকার নেই। আমিতো প্রথমে তোর নাম রেখেছিলাম, “লী জেমস চার্লস গার্নিয়ে রুশো শাহিন মোহাম্মদ শাহরিয়ার নিয়াজ সুমন” কিন্তু তোর মা বলল এতো বড় নাম রাখলে মানুষ মনে রাখতে পারবে না, তাই এই ছোট নাম রেখেছি।
আলিফ আর কথা বাড়ায় নি সেদিন।

আজ আলিফ একটু আগেই ক্লাসে চলে এলো। এসে দ্যাখে এখনও ক্যাডাভিয়া আসেনি তাই যে সিটে আলিফ বসল তার পাশের সিটে ওর ব্যাগ রেখে দিল। অফিস শেষ করে ক্যাডাভিয়া ক্লাসে এলো।

আজ প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্টের যে বিষয়ের উপর লেকচার হচ্ছে তা হোল, Basic Phases of Project Management.
টিচার এই ইউনিভার্সিটিরই প্রোফেসার। ইউএসএ এর ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে পি এইচ ডি করেছেন।

লেকচার চলছে………
There have 5 basic phases of the project management and these are accordingly 1) Project conception and initiation
2) Project definition and planning 3) Project launch or execution 4) Project performance and control and 5) Project close.

একটানা ৪৫ মিনিট লেকচার চলল। ক্যাডাভিয়া দুটি বিষয় ঠিকমত বুঝতে পারেনি। সেটা হল Project close point এর এক্ষেত্রে Project complete হওয়ার পর Client এর Approval এর বিষয়টি
এবং Project evaluation process কিন্তু আলিফ তাকে বুঝিয়ে দিল।

ক্যাডাভিয়া বাসায় ফিরল। অফিস এবং ক্লাস দুটোই যেদিন করতে হয় সেদিন বেশ ক্লান্ত লাগে। দ্রুত খেয়ে বিছানায় ঘুমতে গেল। কিন্তু কেন যে ঘুম আসছে না সেটা বুঝতে পারছে না।
সেলফের দিকে তাকাতেই চোখ পড়ল “আলাপন” বইটির দিকে। উঠে হাত বাড়িয়ে বইটি বের করল। আলাপন-১ এবং আলাপন-২ তো পড়া হয়েছে। আলাপন-৩ এ কি আছে একটু দেখা দরকার।

“আলাপন-৩”
একটি যুবক ঘুমবার চেষ্টা করছে কিন্তু ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। অনেকক্ষণ কেটে গেল। ঘুম আসছে না। বেশ রাত হয়েছে। ঘর অন্ধকার কারণ লাইট অফ।
হঠাৎ একটি মোলায়েম কণ্ঠ ভেসে এলো।

-কি ভাবছ হে যুবক?

যুবকটি চোখ খুলে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। লাইট টা অন করবে কিনা ভাবছে। সুইচটা একটু দূরে আছে। বিছানা থেকে নেমে গিয়ে অন করতে হবে কিন্তু একটু ভয় ভয় লাগছে।
আবার কণ্ঠস্বর টি ভেসে এলো।
-ভয় পেয়ো না হে যুবক
-কে কথা বলে?
-আমাকে তিনিই পাঠিয়েছেন যার কথা তুমি সর্বদা ভাব
-আমিতো স্রষ্টার কথা ভাবি, তুমি কে?
-ধরো তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন
-কেন পাঠিয়েছেন?
-তোমার মনে যে সব প্রশ্ন জমে আছে তার উত্তর দেয়ার জন্যচ
-আচ্ছা বলতো মানুষ কেন পৃথিবীতে আসে?
-আল্লাহর কাজ করার জন্য
-আল্লাহর কাজ কি?
-নামায, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত ইত্যাদি
-হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান – এরাতো নামায-রোজা করে না। এরা কেন আসে?
-তারাও আল্লাহর কাজই করতে আসে
-তারা তাদের যেসব ধর্মিয় কাজ করে ঐগুলোও কি আল্লাহর কাজ?
-অবশ্যই আল্লাহর কাজ
-তাহলে কাজের ধরণে পার্থক্য কেন?
-ওটা আল্লাহই ভাল জানেন।
-আচ্ছা বলতো মানুষ মরার পর কোথায় যায়?
-ওটাতো কেউ গিয়ে দেখে আসেনি
-আমিতো একবার মারা গিয়েছিলাম কিন্তু কিছুইতো দেখলাম না
-সেটা কেমন?
-আমার একবার কি এক অসুখ হয়েছিল। আমি বিছানায় শুয়েছিলাম
-তারপর?
-আর কিছু মনে নেই শুধু মনে আছে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম
-তারপর?
-আসলে কিন্তু আমি বুঝিনি যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম এবং সাথে সাথেই আমার মৃত্যু হয়েছিল
-তারপর?
-হঠাৎ আমার জ্ঞান ফিরে এল
-এটা কি করে সম্ভব?
-আসলে মানুষের হৃৎপিন্ড যতক্ষণ চালু থাকে ততোক্ষণ সে জীবিত
-আচ্ছা
-এই হৃৎপিন্ড চলা বন্ধ হয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত বলে
-বুঝলাম
-বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃৎপিন্ড আবার কোনও কারণে চালু হয়ে যেতে পারে
-ও
-আমার বেলায়ও তাই হয়েছিল
-তারপর?
-আমার জানাযার জন্য আমাকে গোসল করানো হচ্ছিল
-তারপর?
– ঠিক তার কিছুক্ষন আগে আমার হৃদপিন্ড চালু হয়েছিল এবং মনে হয় প্রায় ৫ মিনিটের মদ্ধ্যেই আমার জ্ঞান ফিরে আসল
-তারপর?
-জেগে অনুভব করলাম শরীরে খুব ব্যথা আর খুব ঠাণ্ডা লাগছিল
-তারপর?
-দেখলাম আমি আমাদের বাথরুমে শুয়ে আছি আর শাওয়ার ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আমার শরীর ভিজে চ্যাপচ্যাপা
-তারপর?
-একটু উঠে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম
-কি বুঝলে?
-দেখলাম এক মধ্য বয়স্ক লোক শাদা দাড়ি মাথায় টুপি। উনি সাবান দিয়ে আমার শরীর পরিষ্কার করছেন
-তারপর?
-আমি কথা বলার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পারছিলাম না। অনেক কষ্টে ভাঙ্গা গলায় কথা বললাম
-কি কথা?
-উনাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি আমাকে গোসল করাচ্ছেন কেন?
-তারপর?
-লোকটি এদিক ওদিক তাকিয়ে লা-হাওলা ওয়া কুয়াতা ইল্লাবিল্লা বলে আবার সাবান লাগাতে শুরু করল
-তারপর?
-আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম আপনি কে? আমাকে গোসল করাচ্ছেন কেন?
-তারপর?
-লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে দেখল আমি উঠে বসে আছি
-তারপর?
-আমি তখন ভাঙ্গা গলায় বললাম আপনি কে?
-তারপর?
-লোকটি বড় বড় চোখ করে একলাফে দাঁড়িয়ে গেল
-তারপর?
-দুই কানে আঙ্গুল চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলল “লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ”
-তারপর?
-দৌড় দিল
-তারপর?
-আমি আস্তে আস্তে গোসল সেরে বাথরুম থেকে বের হলাম,বাথরুমের সাথেই আমার বেডরুম তাই জামা কাপর পড়ে নিলাম
-তারপর?
-খুব ক্লান্ত লাগছিল আর খুব ক্ষুধা পেয়েছিল
-তারপর?
-পাশের রুমে এসে দেখি বেশ কজন কোরান শরীফ পড়ছেন
-তারপর?
-ওরা আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল এবং লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন বলতে বলতে দৌড় দিল
-তারপর?
-পাশের রুমে এসে দেখি মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন, বাবা এবং ডাক্তার সাহেব মা’র পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন
-তারপর?
-আমি বাবাকে বললাম আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে
-বাবা কি করলেন?
-বাবা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন কিন্তু ডাক্তার সাহেব এসে আমাকে ধরলেন এবং বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললেন আমি খাবার আনছি, তুমি একটু শুয়ে থাকো
-তারপর?
-আমার ঠাণ্ডা লাগছিল বুঝতে পেরে বাবা আমার শরীরে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন
-তারপর?
-ডাক্তার সাহেব এসে আমার হাত ধরে পালস দেখলেন এবং শরীরে স্যালাইন লাগিয়ে দিলেন কিন্তু আমি বললাম আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে
-খাবার দিয়েছিল?
-না। ডাক্তার সাহেব বললেন, তুমি এখন অসুস্থ তাই এখন মুখ দিয়ে কিছু খেতে পারবে না, যে স্যালাইন দিয়েছি দশ মিনিট পর আর ক্ষুধা থাকবে না, এটাই আপাতত তোমার খাবার
-তারপর?
-ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম কিন্তু প্রতিদিন বাসায় প্রচুর লোক আসত আমাকে দেখতে, সাংবাদিক এবং টিভি ক্যামেরা সবসময় থাকত, আমি বিরক্ত হয়ে উঠলাম
-তারপর?
-বাবা আমাকে ইন্ডিয়া নিয়ে গেলেন উনার এক বন্ধুর বাসায় এবং কোলকাতায় এক স্কুলে ভর্তি করে দিলেন
-তারপর?
-কোলকাতায় একদিন এক হোটেলে চা খেতে ঢুকলাম
-তারপর?
-আমি যে টেবিলে বসলাম সেই টেবিলেই দেখলাম সেই মধ্য বয়স্ক দাড়ি টুপি পড়া লোকটি চা খাচ্ছে যিনি আমাকে গোসল করাচ্ছিলেন
-তারপর?
-আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আমাকে গোসল করাচ্ছিলেন কেন?
-উনি কি বললেন?
– আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল লা বলতে বলতে চা’এর কাপ ফেলে দৌড় দিলেন
-তারপর?
-হোটেলের ভেতরে থাকা কয়েকজন মানুষ এসে আমাকে বলল কি হয়েচে দাদা বলুনতো
-তুমি কি বললে?
-আমি বললাম, কি হয়েছে তা তো বলতে পারব না, দেখলাম উনি চা খাচ্ছিলেন, কি যেন মনে হল হঠাৎ দৌড় দিলেন, এই যে দেখুন আমার শার্টে চা’এর দাগ লেগে আছে
-তারপর?
-শান্তভাবে চা শেষ করে বিল দিয়ে চলে আসতে চাইলাম।
-তারপর?
-হোটেল কতৃপক্ষ আমাকে আসতে দিলেন না, আটকে রেখে সিসি ক্যামেরা রিপ্লে করে কি যেন দেখছিলেন
-তারপর?
-একজন বলল, এই ছেলেটাকেতো চেনা চেনা লাগছে, কোথায় যেনো দেখেছি
-তারপর?
-বাবা, আগেই আমাকে বলে দিয়েছিলেন দাড়ি সেভ না করতে তাই আমার বেশ বড় বড় দাড়ি হয়েছিলো
-তারপর?
-হঠাত পুলিশ এসে হাজির হল
-তারপর?
-পুলিশ আমাকে থানায় নিয়ে গেল
-তারপর?
-ওসি সাহেব একটি পত্রিকা বের করে আমাকে দেখিয়ে বললেন, এটা আপনার ছবি না?
-তুমি কি বললে?
-বললাম, হ্যাঁ আমার ছবি
-পুলিশ কি করল?
-পুলিশ বলল, আপনার ব্যাপারটা এখন ঐ হোটেল কতৃপক্ষ জেনে গেছে এবং আজ দিনের মদ্ধ্যে পুরো কোলকাতা জেনে যাবে
-তারপর?
-ওসি সাহেব আমার বাবাকে ফোন করে বললেন, ব্যাপারটাতো জানাজানি হয়ে গেছে তবে আপনি চিন্তা করবেন না ও আমাদের হেফাজতে আছে, আমরা আজ রাতেই গোপনে ঢাকায় পাঠিয়ে দেব
-হুম, তোমার বিষয়টাতো বেশ জটিল দেখছি, আচ্ছা একটা কথা বলতো?
-কি?
-তুমি আমার কাছে জানতে চাইলে মানুষ মারা গেলে কোথায় যায়, তুমিতো নিজেই মারা গিয়েছিলে, তুমি কিছু দ্যাখনি?
-নাহ।
-কেন?
-জানি না, মৃত্যুর পরে মানুষ কোথায় যায় সেটা আমি দেখলে কি আর তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম?
-ঠিক আছে যুবক তুমি এখন ঘুমাও, আমি এখন যাই।
-না। তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে যেতে পারবে না
-কিছুদিন পর আমি আবার এসে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাব, তুমি এখন ঘুমাও, অনেক রাত হয়েছে। আমি যাই
-এর আগেও তুমি অনেকবার এসেছ কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারনি
-দেব, উত্তর দেব
– উত্তর দিতে না পারলে কিন্তু অহেতুক আসবে না, তোমাকে কি করে শায়েস্তা করতে হয় তা আমার জানা আছে
-ঠিক আছে যুবক! উত্তর নিয়েই আসব, ভাল থেকো, খোদা-হাফেজ।

ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন

অরুণ যে আমার বিশেষ নিকট বন্ধু তা নয়! তবে একেবারেই আলগা বন্ধুত্বও নয়! তাই ওর বিবাহে বরযাত্রীর যাওয়ার নিমন্ত্রণ না পেলেও বৌভাতে যাবার অনুরোধ এড়াতে পারিনি! কিন্তু মুশকিল হল কি দেওয়া যায় উপহার হিসেবে? যেটাই ভাবি সেটাই বড়ো খেলো মনে হয়! সাধারণ কেরানীপকেটের চৌহদ্দীতে যা হয় আর কি! যদিও উপহার যা দেব তা দেব ঐ অরুণের বৌকেই! পাক্কা ব্যবসায়ী অরুণ সামান্য তুচ্ছ উপহার নিয়ে মাথা ঘামাবে না জানি তবু ন্যূনতম ভদ্রতা রক্ষার দায় তো থাকেই! যদিও জানি অরুণের সাথে ওর ব্যবসায়ে লাভজনক কোনো বড়ো পার্টির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলে খুশি করা যেত ওকে! কিন্তু আমি ছাপোষা মানুষ, আদার ব্যাপারীও নই! এটা তেমন উপলক্ষও নয়!

তবে সুকন্যা থাকলে আজ আমায় এত ভাবতে হতো না! কোথায় কোনটা মানানসইসেটা বুঝবার একটা দারুণ ক্ষমতা ছিল ওর! রুচিশীল একটা মনের তন্বী মেয়ে! ডানাকাটা পরী নয়, কিন্তু অপরূপ একটা দ্যুতি ছিল টানা দুটি চোখে! দৃষ্টির সেই গভীরতায় ছিল আত্ম প্রত্যয়ের দীপ্তি! আর ছিল কাব্য প্রীতি! নিজে লিখত না! কিন্তু ভালো কবিতার কদর জানতো! ইউনিভার্সিটির তুখর ছাত্রী! ইংরেজী সাহিত্যের বর্ষসেরা! সাহিত্য আমার বিষয় নয়! তবু সুকন্যাই আমাকে সুসাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়! সেই থেকে আমারও কবিতা প্রীতি! সুকন্যা প্রেম! কবিতার মধ্যেই শ্বাস নিত যেন মনে হতো! আস্তে আস্তে আমাকেও ডোবালো ওতেই! ব্রাউনিঙের কবিতা ছিল ওর খুব প্রিয়! খুব আবৃত্তি করতো!

সুকন্যার আবৃত্তি যে খুব উচ্চমানের ছিল তা হয়তো নয়! কিন্তু ওর মুখচোখের দীপ্তি বলার ছন্দ মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো আমায়! তার কারণ যতটা কাব্য প্রেম ততটাই ওর প্রতি আমার দূর্বলতা! এই ভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালী দিনগুলোও একদিন স্মৃতির সরণীতে ঢুকে গেল! জীবিকার সন্ধানে কে কোথায় ছিটকে গেলাম! সুকন্যাও উচ্চতর বিদ্যার্জনের জন্য বাইরে চলে গেল! কিন্তু গেলেও যোগাযোগ যে রাখা যেত না তা হয়তো নয়! হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন সুকন্যা আর আমার মতো সাধারণ মানুষের প্রতি বিশেষ টান অনুভব করেনি বলেই ধীরে ধীরে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল আরও! ব্যাপারটা এতই স্বাভাবিক ছন্দে ঘটে গিয়েছিল যে বুঝতেই পারিনি কখন সুকন্যা সরে গেছে দূরে!

বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি এভাবেই মানুষের জীবনে কতো সহজেই যেন স্মৃতি হয়ে যায় একদিন! রোজকার বন্ধুদের, যাদের ছাড়া একদিনও চলে না, কালের গতিতে তারাও কোথায় হারিয়ে যায়! কিন্তু সুকন্যা! সেতো শুধুই বন্ধু ছিল না! তাকে ঘিরে ভবিষ্যৎ জীবনের সপ্নাভ আশার বিস্তার ছিল প্রতিদিনের শাখা প্রশাখায়! তবু সেও তো দূরে সড়িয়ে নিল নিজেকে! তবু এত দিন পরে আজ তাকেই মনে পড়ছে বড়ো বেশি করে! এই আগোছালো জীবন হয়ত আর আগোছালো থাকতনা! সামান্য একটা উপহার নির্বচন করতে কি বেহাল দশা আজ! এই সবই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল ওকে বলেছিলাম ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন উপহার দেব ওর জন্মদিনে! মহালয়ার দিন! দেবীপক্ষের সূচনায়! কিন্তু সে আর দেওয়া হল কই!

সত্যি সুকন্যাকে উপহারটা আর দেওয়ার সুযোগ ঘটেনি! এতদিন পর সেকথা মনে হতেই মনটা বড়ো বিষন্ন হয়ে গেল! মনে পড়ে গেল ব্রাউনিঙের দ্য লাস্ট রাইড টুগেদারের কথা! সুকন্যার আবৃত্তির সাথে আমিও গলা মেলাতাম কখনো সখনো! আসলে ব্রাউনিঙের মধ্যে যে দুরন্ত প্যাশানের সুতীব্র প্রকাশ ছিল, সেটা আমাদের উন্মন করে তুলত প্রথম যৌবনের তরুণ দিনে! হঠাৎ মনে হল, অরুণের বৌভাতে ব্রাউনিঙের সংকলন দিলে কেমন হয়? যদিও অরুণের জীবনে প্রফিট এণ্ড লসের ব্যালেন্স শীট ছাড়া অন্য কোনো কাগজের গুরত্ব নেই বিশেষ! তবে ওর বৌ হয়তো সাহিত্যপ্রেমী হতেও পারে! ওদের নবজীবনের শুভারম্ভ ব্রাউনিঙের রোমান্টিকতায় ভরপুর হয়ে উঠুক না কেন দাম্পত্যের প্রতিদিনের বাসরে!

অরুণদের পয়সা বুঝি মেঝেতে গড়াগড়ি যায়! এমন এলাহী ব্যাপার আগে কোনো বৌভাতে দেখিনি কখনো! গেটের সামনে দেশী বিদেশী কত রঙের ছোট বড়ো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে! আমন্ত্রীতদের পয়সার আভিজত্য পোশাকের গন্ধেই স্পষ্ট বোঝা যায়! এই রকম ধনদৌলতের ঐশ্বের্য্যের মাঝে নিজের কেরাণী গন্ধওয়ালা অস্তিত্বটা নিয়ে, একটা ব্রাউনিঙের কবিতার বই সম্বল করে ঢুকতে বড়ই সঙ্কোচ হচ্ছিল! নিজেকে এত অসহায় মনে হচ্ছিল যে ভাবছিলাম ফিরে যাব কিনা! অন্তত আসার জন্য বড়ই মর্মপীড়া অনুভব করছিলাম!

অরুণ বোধহয় কাউকে খুঁজতে বেড়িয়ে ছিল! আমায় দেখতে পেয়েই সহাস্যে এগিয়ে এলো! সাথে নিয়ে ভেতরে গেল! কিন্তু আমার সাথে কথা বলার অবসর নেই! আমায় বসিয়ে আবার কার সাথে চলে গেল বাইরে! আমি একা জড়সড় বসে হয়ে চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছিল্লাম! এই ধনৈশ্বর্য্যের বৈভবের মাঝে নিজেকে খুবই অপাঙতেয় লাগছিল! বেশ অনেক্ষণ পরেই অরুণের আবার আমার ওপর নজর পড়ল! আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! নিজের অস্বস্তিতে বেশ হাঁফিয়ে উঠছিলাম! অরুণ নিজেই আমায় নিয়ে দোতলায় উঠল! নববধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে! আমাকেও উপহারটা দিতে হবে! নববধুকে ঘিরে স্বভাবতই অপরূপা মায়াবিনী সুন্দরীদের ভিড়! উৎসবের আনন্দে উৎসাহিত মুখগুলির কলধ্বনিতে মুখরিত পরিবেশ!

আগেও দেখেছি এইরকম বিবাহ অনুষ্ঠানে সাজসজ্জার ভিড়ে নববধুটি যে কে তা বুঝে উঠতে কয়েক সেকেণ্ড দেরি হয়ে যায়! নববধু হয়তো কারুর সাথে গল্পই করছিলেন! এইরকম বৈভবে উচ্চবিত্ত সমাজের সুসজ্জিত বেশভুষার ঝাঁচকচকে মানুষজনের মধ্যে আমি এতই বেমানান যে, সঙ্কোচ আর লজ্জা আমায় পীড়া দিতে থাকল! কিন্তু আসরে নেমে পড়েছি, আর ভাবা চলে না! মুখে একটা কৃত্রিম কষ্টকলপিত হাসি টেনে এগোলাম! এই অবস্থায় নিজেকে আয়নায় কেমন দেখাতো ভেবে সত্যিই হাসি পেল! সেই নিদারুণ হাসি মুখেই নববধুর নিকটবর্তী হলাম! অরুণ ওর বৌয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে উদ্যত হল! অরুণের ডাকে ওর নব পরিণীতা বধু আমাদের দিকে ফিরতেই মুখে হাসি ঝুলিয়ে উপহারটি দিতে হাত বাড়ালাম!

ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন! যে উপহার একদিন সুকন্যার জন্মদিনে ওর হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল, আজ অরুনের বৌভাতে সেইউপহার তার বৌয়ের হাতে তুলে দিতে এসেছি! অরুণের গর্বিত হাসির লহড়াতেই দৃষ্টিবিনিময় হল নববধুর সাথে! আর তখনই বেনারসী আর স্বর্ণালঙ্কারের সজ্জায় সুকন্যাকে দেখে চমকে ওঠার পালা আমারই! কিন্তু সুকন্যা ওর, আমায় চেনার চমকটাকে কি অদ্ভুত সহজভাবেই না মনভোলানো হাসিতে ঢেকে দিলো! আরও আশ্চর্য ওর ঐ অভিজাত হাসির উপরেই ভর করে আমিও কত সহজেই সামলে নিলাম নিজেকে! তুলে দিলাম ওরই হাতে আমার ক্ষুদ্র উপহার ওর প্রিয় ব্রাউনিঙের কবিতা সংকলন! যেখান থেকে একদিন আবৃত্তি করতাম আমরা দ্য লাস্ট রাইড টুগেদার!

শ্রীশুভ্র