অণুগল্পঃ প্রতীক্ষা

অদূরে একটা বড় বটগাছ দেখে জুলেখা সেদিকে হাঁটা দিলো। ঘড়ি ধরে সাড়ে চার মিনিটের রাস্তা। ওখানে ঘাসের ওপর বসে খাবার জলের বোতলটা হাতে নিয়েছে মাত্র- জটাধারী একটা লোক ওর চোখে পড়ল। কাছেই একটা প্রশস্ত ঠেসমূলের আড়ালে বসে আছে। গলা এগিয়ে জুলেখা লোকটাকে একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। তার চোখ দুটো অস্বাভাবিকভাবে ভিতরে ঢুকানো। সম্ভবত লম্বা সময় সে জল খায়নি। বোতল নিয়ে জুলেখা লোকটার কাছে গেল।

-এই নিন; জল
-আমার এসবের দরকার হয়না। কোনদিনই না।
চোখ তুলে জটাধারী জবাব দিলো

-“কোনদিনই না” মানে?
-এই ধর শত বছর ধরে না, হাজার বছর ধরে না, তারো বেশি বছর ধরে না

প্রথমে বেশ ভয় পেলেও জুলেখা অল্প সময়ের মধ্যেই তা কাটিয়ে ওঠলো। কিছু রোগ আছে তাতে আক্রান্ত মানুষগুলো এমন আচরণের হয়। স্কিজোফ্রেনিয়া। তবুও লোকটাকে নিয়ে ওর ভিতর কিছু সংশয় রয়ে গেলো।

-আপনার বয়স কত?
লোকটা কৃত্রিম ভদ্রাচারের উর্ধে। জুলেখা এটা খুব সহজেই বুঝতে পেরেছে। তাই ভনিতা না করে সরাসরি প্রশ্নটা করেছে।

-জন্ম তারিখ বলতে পারবো। বয়স তুমি নিজে হিসেব করে নিয়ো।
জটাধারী জবাব দিলো

-বলুন
-ভুল বলেছি জুলেখা। জন্ম নয়, আমার মৃত্যু তারিখ বলতে পারব

লোকটাকে মানসিক রোগী মনে করে জুলেখা এতক্ষণ কিছুটা নির্ভয় থাকলেও এবার ভয়ে কাঁপতে লাগল। নিজের মৃত্যু তারিখ নিজে বলবে! তার নাম জুলেখা- এটাও সে জানে!

ভয় কমাতে জুলেখা একবার মাটির দিকে; একবার ওপরের দিকে তাকাল। ওপরে যেন আকাশ জুড়ে বট গাছটার ডালপালা। এত্তো বড় গাছ! কিন্তু ওতে একটা পাখিও নেই। এতে ওর মনে আরও একটু ভয় যোগ হলো। তবুও জটাধারীর সাথে সে কথা চালিয়ে গেল;

-সেটাই বলুন।
জুলেখা লোকটার কথিত মৃত্যু তারিখ শুনতে চাইল

-বেথিংহামে যে মুহূর্তে যীশু জন্ম নিলো তার একদিন দুই ঘণ্টা পাঁচ মিনিট আগে আমার মৃত্যু হয়
-এভাবে মেপে মেপে সময় কেন?
-আমার মৃত্যুর বেদনা দিয়েই মা মেরির প্রসব বেদনা শুরু হয়েছিল

জুলেখা এবার নিজের গায়ে নিজেই একটা চিমটি দিলো। লোকটা তা খেয়াল করেছে। “তুমি কোন স্বপ্ন বা ঘোরের মধ্যে নেই” বলে লোকটা মুখ খুলে হাসলো। জুলেখা দেখল, লোকটার দাঁতগুলো শ্যাওলা রঙের। কোন মাড়ি নেই, জিহবাও নেই। চোখ দুটো গর্তের ভিতর থাকলেও ভিন্ন রকমের সুন্দর। সমুদ্রের ঢেউয়ের মত কিছু তার দুচোখে খেলে যাচ্ছে। সেই ঢেউয়ে কিছু স্বপ্ন আঁকা আছে- একটা এক কক্ষের ঘর এবং একজন রমণী। তবে সেই রমণীর চেহারা স্পষ্ট নয়।

-মৃত্যুর পর এই দুইহাজার আঠার বছর বছর সাত মাস ধরে আপনি কি করছেন?
-একজনকে খুঁজি।
-কাকে?

লোকটা কোন জবাব না দিয়ে মাটিতে একটা মুখ আঁকতে লাগলো। .

জুলেখা এক ঢোক জল পান করে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। কোথাও কেউ নেই। বামে দিগন্ত পর্যন্ত বালুচর। সম্মুখেও। ডানে অর্ধেক জায়গা জুড়ে তপ্ত লাভার উদগীরণ। বাকী অর্ধেকে একটা বাগান, অগনিত পাখি এবং একটা নীল জলের ঝর্ণা।

-কোথায় যাবে?
মাটিতে ছবি আঁকা শেষ করে জটাধারী জানতে চাইল

-জীবন নগর;
জুলেখা জবাব দিলো।

-এই পথে যাও
-কিন্তু ওদিকে তো লাভা, ফুলের বাগান এবং ওদুটোর মুখে সুউচ্চ পাহাড়ের দেয়াল
-তবুও যাও;
কথাটা বলে মুহূর্তেই জটাধারী নিরুদ্দেশ হল।

জুলেখা লাভা এবং বাগানের মাঝে সার্কাসের রশির মত সরু পথ দিয়ে এগুতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে সে পাহাড়টার কাছে পৌঁছল। হালকা বাতাসে গাছের পাতা যেমন নড়ে পাহাড়ের পাদদেশে তেমনি একটা পাথর নড়ছে। তার ফাঁক দিয়ে একটা সরু পথ দেখা যায়। জুলেখা কাঁপা বুকে সেই পথটাতে প্রবেশ করলো। অন্যপাশে পৌঁছে সে একটা বিরান মাঠ দেখতে পেলো। কাছেই একটা ধবধবে সাদা ঘোড়া দাঁড়িয়ে। একই রঙের কাপড়ে মুখসহ সারা শরীর ঢাকা একটা লোক; ঘোড়ায় বসে আছে।

-হুকুম আছে তোমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবার।
গম্ভীর গলায় লোকটা বললো।

জুলেখা ঘোড়ায় ওঠে বসলো।
-কে তুমি?

লোকটা জবাব দিলনা।

অদ্ভুত এক ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পাহাড় পর্বত মরুভূমি সমুদ্র সব পেরিয়ে জুলেখা আলোর গতিতে যাচ্ছে। এক সময় একটা অদৃশ্য ইশারায় লোকটা থেমে বললো,

-এসে গেছি
-এতো সেই জায়গা যেখান থেকে আমি যাত্রা শুরু করেছিলাম;
জুলেখা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলো

সাড়ে তিনহাত একটা জায়গা দেখিয়ে লোকটা বললো,
-আসলে তুমি ওই জমিটারই কাছাকাছি গিয়েছিলে। ভুল টিকেট; তাই আজ অন্দরে যাওয়া হলনা। তবে একদিন যাবেই।

কথাটা বলেই ঘোড়াসহ এই লোকটাও অদৃশ্য হল।

ক্লান্ত জুলেখার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। এর কিছু সময় পর চোখ খুলেই দেখে, সে একটা সাদা বিছানায় শুয়ে আছে। সম্মুখে বিশ্ববরেণ্য চিকিৎসক, দেশের রাজা, রাণী এবং উদ্ভিগ্ন স্বজনেরা বসে আছে। কারণ সুদীর্ঘ সময় কোমায় থেকে সে অবিশ্বাস্যভাবে ফিরে এসেছে।

কিন্তু ওদের কাউকে নয়! জুলেখার চোখ কেবল সেই মানুষটাকে খুঁজছে যীশুর জন্মের আগে থেকে যে তার প্রতীক্ষায় আছে!

11 thoughts on “অণুগল্পঃ প্রতীক্ষা

  1. অতিলৌকিক বলি আর কল্পনা বলি; লিখার শাব্দিক উপস্থাপনা অসাধারণ হয়েছে। অভিনন্দন মি. মিড ডে ডেজারট। ধন্যবাদ।

    1. যথার্থ বলেছেন। জীবন-মৃত্যুর মাঝের (কোমা) একটা কাল্পনিক চিত্র আঁকার চেষ্টা করেছি। ফোকাসটা হল একজন প্রেমিকের সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা।

      আপনার মন্তব্যে মুগ্ধ। অশেষ ধন্যবাদ!

    2. শুভ সকাল মি. মিড ডে ডেজারট। যদিও নামটা উচ্চারণে ভারী। :)

      1. শুভ সকাল !

        দশজনের দশজনই বলবে "মুরুব্বী"র মতো ওজনযুক্ত নাম শব্দনীড়ে নেই। খুব পছন্দ!

        আপনার দিন খুব ভালো কাটুক মিস্টার মুরুব্বী।

  2. আমার কাছে আপনার অণুগল্পটি বেশ ভাল লাগলো দাদা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

  3. * উপস্থাপনা কৌশল বেশ চমৎকার হয়েছে।

    শুভরাত্রি।

    1. আপনার মন্তব্যে মুগ্ধ হয়েছি। 

      শুভরাত্রি!

  4. বাহ! চমৎকার লিখেন আপনি।

    অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা মিঃ মিড ডে ডেজারডhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    1. মন্তব্যে মুগ্ধ হয়েছি।

      অশেষ ধন্যবাদ মিস্টার ইলহাম!

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।