গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

পনেরো (ক)

“ট্র্যাডিশান অ্যান্ড দা ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট” প্রবন্ধে এলিয়টের কথাঃ
The necessity that he shall conform, that he shall cohere, is not one-sided; what happens when a new work of art is created is something that happens simultaneously to all the works of art which preceded it.

অরিজিৎসিংগীত নামের “নিউ ওয়র্ক অফ আর্ট” তার অস্তিত্বের চূড়াবিন্দুতে বসিয়েছে প্রেমকে — নিজেকে ডুবিয়ে মিশিয়ে গুলে সে-দ্রবণ বিকিয়ে দেওয়া প্রেম। তবে কিনা এই অবস্থায় আসতে একটু সময় লাগে, প্রথম স্তরে স্বয়ংকে খুঁজে পাওয়া যায় না — পকেটের পেন বা হাতের ছাতার মতো হারিয়ে বসেছি কোথাও। তখন প্রেমিকাকেই জিগেস করতে হয়, দেখেছ আমায়?

লাপতা সা মিল জায়ুঁ কঁহী তো
মুঝসে ভী মুঝে মিলা দে জরা
(গানঃ ইশক মুবারক)
[অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ জানতে চেয়েছিলেন, একেলা আপন-মনে দিন কি কাটিবে না (গানঃ গেল গো)]

অথবা,
ঢুঁঢলো তুম, খো গয়া হুঁ ম্যায় কঁহি
ঢুঁঢলো তুম, খুদ পে হ্যায় নহি একীঁ
(গানের নামঃ ঢুঁঢলো )
[কবিগুরুর বক্তব্য ছিলঃ পলক পুলকরস-ভরা রেখে যাই, নাহি দিই ধরা (গানঃ কে ডাকে)]

পুনরপি,
ম্যায় চাহুঁ মুঝে মুঝসে বাঁট লে
জরা সা তূ মুঝমেঁ ঝাঁক লে
ম্যায় হুঁ ক্যা
(গানঃ কভী যো বাদল বরসে)
[অথচ রবীন্দ্রনাথ গেয়ে গেছেন, নিমেষের তরে শরমে বাধিল, মরমের কথা হল না (গানঃ নিমেষের তরে)]

এমনও হতে পারে যে, যাকে জিগেস করছি সেও নিজের অস্তিত্বে নেই মোটেই!

তুম থে ইয়েহি ফির ভি তুম গুম থে
অর ম্যায় লা পতা
(গানের নামঃ আজ যাও না)
[কিন্তু গুরুদেবের ধারণা, তোমারে আমি দেখিতে পাই, তুমি পাও না মোরে (গানঃ অনেক কথা যাও যে বলে)]।

এভাবে অরিজিতসিংগীতের মিউজিক টুল ব্যবহার করে আমরা রবি ঠাকুরের প্রেমগীতির নাটবল্টু খোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি, যেহেতু আর এক গুরুদেব বলে গেছেন, নতুন কোনও শিল্পকর্ম তৈরি হ’লে যা ঘটে সেটা তার আগের সব শিল্পকর্মের বেলাতেও ঘটে যায়।

পনেরো(খ)
অরিজিতের আগের গানটায় নারীপুরুষ দুজনেই গায়েব ছিল। কাজেই ওদেরই দায়িত্ব নিতে হবে একে অন্যকে খুঁজে দেওয়ার, আর যতক্ষণ না অপরের সন্ধান মেলে — যে “অপর” খুব দ্রুত বিয়িং-এর সমীপবর্তী হয়ে পড়ছে — ততটা সময় নিজেকে অন্বেষণও মুলতুবি।

তুঝমেঁ খোয়া রহুঁ ম্যায়, মুঝমেঁ খোয়ি রহে তূ
খুদকো ঢুঁঢ লেংগে ফির কভি
(গানের নামঃ ফির কভি)

কেন না, নিজের হারিয়ে ফেলার শর্ত একটাই — আত্মকে বিসর্জন দিয়ে তোমায় পেতে চাই। তবেই বাঁচবো আমি।

খুদকো খো কর তুঝকো পায়া
ইস তরহা সে মুঝকো জিনা আয়া
(গানের নামঃ তেরে ন্যায়না জব সে মিলে)

লক্ষ করা যাক, দুটো সত্তার খুদকো-তুঝকো ভেদ মিটে এসে এখানে আত্মবিনিময় উৎসব চলছে। বুকের খাঁচার মধ্যে প্রাণপাখির পালটাপালটি। আমাদের সর্বোচ্চ দূরে থাকা “অপর” তো ঈশ্বরই। প্রেমিকার সঙ্গে হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন খেলার ভেতর দিয়ে আসলে আমি হৃদয়ে বসিয়ে নিচ্ছি পরমব্রহ্মকে।

এই আভ্যন্তরীণ ট্রান্সপ্ল্যানটেশানের পরে পায়ে পায়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কাকে দেখবো? তোমাকে, অভিয়াসলি!

আইনা হো কোয়ি, নজর আয়ে মুঝকো তূ হী
ম্যায় ভী তেরা চেহরা হো গয়া
(গানঃ ম্যায় হুঁ সাথ তেরে)

ওই যে প্রেমিক প্রথমে খুব কনফিডেন্স নিয়ে বলেছিল না, “খুদকো ঢুঁঢ লেংগে ফির কভি”, সে এখন নিজের আধার কার্ডটি হারিয়ে ফেলেছেঃ

ঢুঁঢনে সে মিলতে নহী হ্যায় হম
বস আপহী আপ বাকি হ্যায়
(গানের নামঃ দেখা হজারোঁ দফা)

শুধু একটা আলোরশ্মি অথবা এক সুগন্ধের ইশারা ইন্দ্রিয়তে ধরা পড়ে, কিন্তু কার সেই সংকেত, কোত্থেকে আসছে, ব্যোমকেশও ব্যোমকে যাবেন খুঁজতে গিয়ে।

কোই রওশনি সী হ্যায় ইয়া কোই খুশবু হ্যায়
মেরা তন-বদন মেঁ হ্যায় কৌন ম্যায় ইয়া তূ হ্যায়
(গানের নামঃ আলবিদা)

এ-হল নির্ভেজাল সুফিয়ানা, অথচ তৈত্তিরীয় উপনিষদেও কাছাকাছি কথা বলা আছে। সেখানে আত্মার যে পঞ্চকোশের বর্ণনা, যা কিনা আত্মজ্ঞান লাভের পাঁচ উপায়, তার শেষ স্তর আনন্দময় কোশে দ্যাখা যায় ভিন্ন ভিন্ন আত্মার অস্তিত্ব আর তাদের মধ্যে সম্পর্কের মূলে আছে এক অখণ্ড আনন্দময় আত্মা। তিনিই জগতের মূল কারণ। অব্যক্ত অবস্থা থেকে তিনি সৃষ্টিতে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে হলেন সৎ অর্থাৎ ব্যক্ত। তিনি রসস্বরূপ আনন্দ। আনন্দ অভয়ে, আনন্দ পরম সাম্যে [ব্রহ্মানন্দবল্লীঃ দ্বিতীয় অধ্যায়; পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম অনুবাক]।

উল্টোদিকে রবীন্দ্রনাথে প্রেম প্রায়ই অচেনা, উদাসীন, সন্দিগ্ধ, বিদায়প্রবণ — প্রেমিকার মধ্যে ব্রহ্মস্বরূপ দেখা তো দূর, আত্ম-পর অভেদ রচনা নিয়েও হৃদয় ঘামাচ্ছে না। “ধরা দেবার খেলা এবার খেলতে হবে” মর্মে ঘোষণার পর “আমি আমার ভুবন শূন্য করেছি তোমার পুরাতে আশ” ব’লে বিবৃতি, কাউকে ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে ঘরে ডেকে নেওয়া, অন্ধকারের অন্তরধন-এর কাছে “আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া” ব’লে প্রার্থনা — সবই চমৎকার আত্মনিবেদন, কিন্তু “আমি তোমারই বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস” ব’লে একবার নাভির শেকড় পর্যন্ত চমকে তোলা ছাড়া আর কোনও ফকিরি ভাষ্য নেই ছাড়া রবি ঠাকুরের প্রেমের গানে।

কাজেই, রবীন্দ্রনাথের চরণ থেকে কোনও উত্তরাধিকার বর্তায়নি অরিজিতসিংগীতে, বরং সে পেট থেকে পড়েছে মধ্যযুগে ছড়ানো উত্তরভারতীয় ভক্তি আন্দোলনের — রামানন্দ, নিন্বার্ক, গুরু নানক, দাদূ দয়াল, মীরাবাঈ, সুরদাস, মলুক দাস, সুন্দর দাস, বীরভান, আর…

সন্ত কবিরের এই পদটা তো জানেন সবাইঃ

ইয়হ তট ওয়হ তট এক হ্যায়
এক প্রাণ, দুই গাত
অপনে জীয়ে সে জানিয়ে
মেরে জীয়ে কী বাত
[এই তীর, ওই তীর আসলে তো একই — দুই শরীর, এক প্রাণ। নিজের হৃদয় থেকে জেনে নিও আমার হৃদয়ের ব্যাখ্যান]।

(চলছে… )

2 thoughts on “গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

  1. অসম্ভব ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এখানে। মুগ্ধ না হয়ে পারছি না দাদা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. বারকয়েক পড়লাম। আত্মস্থ করা চেষ্টা করলাম। যেহেতু আলোচনাটি থেমে যায়নি, তাহলে ধরেই নিলাম আর কিছু জানার আছে আগামী পোস্টে। ধন্যবাদ চন্দন দা। :)

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।