চকবন্দি চরাচর (৪)

গোরুরগাড়িটা বাড়ির সামনে এসে থামতেই,নামতে গেল কৃষ্ণা। ওকে অবাক করে, তক্ষুনি এক গিন্নীবান্নি মহিলা পাঁজা কোলে করে তুলে নিয়ে এসে একটা মাঝারি ঘরের খাটের ওপোরে বসিয়ে দিলেন। অমনি চতুর্দিক থেকে ছ’ মাস থেকে ছিয়াত্তর বছরের বিচিত্র সব মেয়েরা ঘন হয়ে ছেঁকে ধরলো ওকে। ভীষনই অস্বস্তিতে পড়ল কৃষ্ণা। কেউ ঘর ঝাঁট দিতে দিতে, কেউ গোয়াল পরিষ্কার করতে করতে, কেউ মাছ বাছতে বাছতে, কেউ ছেলেকে বুকের দুধ দিতে দিতে,—- যে যেমন ছিল সেই অবস্থাতেই ছুটে এসেছে নতুন বউ দেখতে। যতো না নতুন বউ দেখতে,তার হাজার গুন বেশি কৌতুহল হেঁদুর মেয়ে দেখার। বলা তো যায়না, হাত- পা- নাক- কান- মাথা কোন্ না দু- চারটে বেশি তো থাকতেই পারে। হেঁদুর বিটি এ্যাতো কাছ থেকে দেখার সুযোগ কি চট্ করে আসে!

ওদের গায়ের পায়ের ধুলোতে ঘর- বিছানা ভরে গেছে। কোন বাচ্চা কৃষ্ণার কোলে গড়িয়ে পড়ছে,কেউ কৃষ্ণার শাড়ি টেনে টেনে দেখছে,কেউ মনোমতো জায়গা দখল করতে না পেরে পরস্পর ধাক্কাধাক্কি করছে। তাদের গায়ের ঘাম, কাদা, নাকের শিকনি লেগে যাচ্ছে কৃষ্ণার গায়ে, শাড়িতে। তাদের মায়েদের অনর্গল বকবকানিতে অজস্র থুতু ছড়িয়ে পড়ছে চারিধারে। কাজ করুনীদের হাতের মাছের, গোবরের ক্ষারের গন্ধ, মুখের – বগলের দুঃসহ দুর্গন্ধ টিকতে দিচ্ছিল না কৃষ্ণাকে। মনে হচ্ছিল এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। ভয়ে, কষ্টে চোখ বুজে ফেলেছিল কৃষ্ণা। কিছু পর এক মাঝবয়সী মহিলা এসেই তাড়া দিয়ে বার করতে থাকলো সব্বাইকে :
— এই, যা সব এখন। পরে আবার আসবি।

–কেনে? বউকে আমাদের দেখতে দেবেনি?
— এতক্ষণ ধরে তো দেখলে, এবার ওকে একটু জিরেন দাও।
–পালঙ্এর উবরি বসে তো জিরেনই খেচে..
এবার একটু রাগত স্বরে : — বলছি না তোমাদের ঘর খালি করে দিতে…

কেউ কর্নপাত করলো না দেখে মহিলা তখন বাধ্য হয়েই কৃষ্ণাকেই হাত ধরে তুলে অন্য ঘরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন, অমনি পিছু পিছু ধাবমান ছেলে- কাঁখে- কোলে পিলপিল করে মহিলাকুল। তখন আশমানি কৃষ্ণার হাত ধরে নতুন ঘরটায় ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতে চাইলো, কিন্তু বাইরে থেকে হাত দিয়ে দরজা টিপে আটকে আছে কয়েকজন। বাধ্য হয়ে গলা তুললো আশমানি : — এ্যই, কপাট ছাড় বলছি,ছাড়। নইলে এই আমি কপাট দিলাম। কারুর হাত কাটুক,কি পা কাটুক, কি রক্তগঙ্গা বয়ে যাক আমি কিন্তু দায় নোব না।

বলে, যেই না আশমানি সপাটে দরোজা বন্ধ করেছে,বাইরে থেকে ভেসে এল জনতার গর্জন, —- গঙ্গা বওয়াবে না তো, আর কীই বা বওয়াবে তুমরা! হেঁদুর মেয়ে ঘরে তুলিছো এখুন গঙ্গাপানি লাগবেনে?

কৃষ্ণা অবাক হয়ে গেল শুনে। সেই তখন থেকে এতো এতো কথা হলো,আর লুফে নিল কিনা ওই একটি মাত্র শব্দ – ‘ গঙ্গা ‘?
তাও আবার ‘রক্ত ‘ অর্ধেক বাদ দিয়ে!! ও বুঝতে পারলোনা, হাসবে না কাঁদবে।

তখনো শোনা যাচ্ছে জনতার তর্জন, — তুমাদের ভাগিনবৌ বাপু খুব গিদিরি। আমাদিকে হাতে ধরে বার করি দিল। হেঁদুর বিটি, তাতিই দেখতে এলুম…..নালে, এই মরোম মাসে কেউ লোতুন বউ-র মুখ দ্যাহে!

ভীড় পাতলা হ তে হতে কৃষ্ণাকে ড্রেস চেঞ্জ করিয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে ফ্রেস করে নিল আশমানী। কৃষ্ণার সম্পর্কিত জা। তারপর একে একে বাড়ির গিন্নিবান্নিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল,– এঁরা তোমার শাশুড়ি মা, আমারও।

চাচি শাশুড়ি, মামীশাশুড়ী, নানিশাশুড়িদের এক এক করে প্রনাম করার পর, নিজের শাশুড়িকে প্রনাম করতেই অন্যান্যদের মতো তিনিও ওর কপালে চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করলেন। বললেন,—- মরোম মাস তো মা। তাতিই এখুন তুমাকে মুখ – দেখানি সুমসারের কিচু দিয়া গেলনি। এই বড়োচিজ্ খানি বুকে করি ধরি রেখো, মা। এঁর থিকেই মান- সম্মান – ইজ্জত – ইমান সব মিলবে। পারো তো দিনে দু-এক রুকু করি তেলাওয়াত্ করবা। সব দুঃখু দূর হয়ি যাবে। স্বামী – পুত্তুর নিয়ি দুধে- ভাতে থাকবে, মা।

বিশেষ কটা শব্দ থেকেই কৃষ্ণা বুঝে গেছে যে, শাশুড়িমা তাকে একটি কোরানশরিফ উপহার দিলেন। ঘরে যারা ছিলেন তাঁরাও যোগ করলেন,– এমুন দামীকি বড়ো চিজ্ ই দুনিয়ায় দুর্লভ, মা। যতন করি বুকে করি ধরি রেখি দিবা চেরডা দিন। তুমার যেকন ব্যাটার বউ আইসবে, কেবল তারি হাতে তুলি দেবা। তা ভেন্ন আর কারুরে এ চিজ্ কক্ষুনো দেবা না— মনে রাখবে কিন্তুক।

এ পর্ব শেয হলে, আশমানি কৃষ্ণার বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে লাগলো, — নাও, এবার একটু জিরিয়ে নাও দিকি। দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে নাও তো। আর হ্যাঁ, যত্ন করে তুলে রাখো কোরানটা। পুরোটা সোনার জলে লেখা। কোটি টাকা দিলেও আর পাওয়া যাবেনা কোথাও। এটা এদের পারিবারিক সম্পদ। আমার শোনা কথা যদি সত্যি হয়,সৈয়দ বংশের, খোদ বড়পির সাহেবের আমলে বাগদাদে হাতে লেখা এই সোনার কোরানটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ। যত্ন করে তুলে রাখো।

যথার্থ হাঁ হয়ে গেল কৃষ্ণা আশমানির কথা শুনে। উড়ে গেল তার উন্মনা ভাব।দরজা বন্ধ করে কোরানটা কোলে নিয়ে নিবিষ্ট ভাবে বসে পড়লো সে। সে হরফ চেনে না। ভাষা বোঝেনা। কিন্তু প্রতিটি শব্দের ওপোর দিয়ে পরম মমতায় হাত বোলাতে বোলাতে সময়ের উজান বেয়ে সে ক্রমশ গিয়ে পড়তে থাকলো প্রাচীন সেই বাগদাদ শহরে.. সেই যে– সেই ট্রানজিশনাল সময়ে– একটার পর একটা গুপ্ত হত্যায় প্রান হারাচ্ছেন ইসলামের খলিফারা– উমাইয়া শাসকদের পঙ্কিল রাজনীতি এবং বসরা ও কুফার জনগনের অনিশ্চিত ও লঘুচিত্ত মেজাজ— উত্যক্ত করে তুললো আল্ মনসুরকে।

(ক্রমশ)

6 thoughts on “চকবন্দি চরাচর (৪)

  1. গ্রামীন সমাজ জীবনের বাস্তবচিত্র। চতুর্থ খণ্ড পড়লাম প্রিয় বন্ধু।

  2. * দিদি ভাই, আপনার লেখা নিয়মিত পড়ে যাচ্ছি… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।