বিশ্বের পরিকল্পিত যত রাস্তাঘাট

পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোতে পথগুলো হয় ভীষণ পরিকল্পিত। হরেক রকম গাড়িতে ঠাসা কয়েক লেনের সোজা, প্রশস্ত রাস্তা, রাস্তার পাশের বিচিত্র ল্যাম্পপোস্ট, ট্রাফিক লাইট এই রাস্তাগুলোর চিরাচরিত চেহারা। কিন্তু বড় বড় শহরেই আবার এমন সব রাস্তাঘাট আছে যেগুলোর চেহারা একেবারেই অন্যরকম। বিচিত্র আর অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের এই রাস্তাগুলো দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়।

ব্যাল্ডউইন স্ট্রিট, নিউজিল্যান্ড।
নিউজিল্যান্ডের নতুন শহর ডুনেডিনের নগর পরিকল্পনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল লন্ডনের ডিজাইনারদের। তারা ডুনেডিনের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে মাথায় রেখে পুরো শহরের সব রাস্তা তৈরি করেছিল গ্রিড প্যাটার্নে। ফলে এই শহরের অনেক রাস্তা খাড়া পর্বতের ওপর দিয়ে যাওয়ার কারণে রাস্তাগুলো হয়েছে ভীষণ খাড়া। ব্যাল্ডউইন স্ট্রিট হচ্ছে এর মধ্যে সবচেয়ে খাড়া। পৃথিবীর সবচেয়ে খাড়া রাস্তা। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, সবচেয়ে সোজা খাড়া সড়ক হিসেবে গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছে ব্যাল্ডউইন স্ট্রিট। অনেকেই অবশ্য একে সবচেয়ে খাড়া রাস্তা হিসেবে মানতে রাজি নন। তাতে কি? এর চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত একটি পর্যটন আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। রাস্তার দু’পাশে সুদৃশ্য রেস্তোরাঁ আছে। পর্যটকের ভিড় থাকায় অনেকে এখানে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য চাঁদা আদায় করেন। জোকার আর দর্শকের চিৎকার চেঁচামেচিতে মুখরিত থাকে ব্যাল্ডউইন স্ট্রিট।

লাম্বার্ড স্ট্রিট, যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত শহর স্যানফ্রান্সিসকোয় অবস্থিত লাম্বার্ড স্ট্রিট বিশ্বব্যাপী খ্যাতি কুড়িয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বাঁকানো রাস্তা হওয়ার কারণে। স্যানফ্রান্সিসকোর ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে রাস্তা তৈরি করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। লাম্বার্ড স্ট্রিট তৈরির দায়িত্ব পড়েছিল যার কাঁধে তিনি এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেন এবং বেশ ভেবে-চিন্তে রাস্তাটির পরিকল্পনা করেন। তিনি ভেবে দেখেন যে, সড়কটি যদি সোজা করে তৈরি করা হয় তাহলে অনেক খাড়া হবে যার ফলে রাস্তাটি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। তাই তিনি রাস্তাটিকে আঁকাবাঁকা করে বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে দৃষ্টিনন্দন লাম্বার্ড স্ট্রিট। এই সড়কটির সঙ্গে কিন্তু স্যানফ্রান্সিসকোর ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক নেই। লাম্বার্ড স্টিটের নামকরণ করা হয়েছে ফিলাডেলফিলার এক ব্যক্তির নামে। লাম্বার্ড স্ট্রিট অনেক দীর্ঘ একটি রাস্তা। রাশিয়ান হিলের চূড়ায় খাড়া অংশে এর একটিমাত্র ব্লকই কেবল বাঁকানো। বাঁকানো অংশে রয়েছে হেয়ারপিন প্যাটার্নের ৮টি বাঁক। প্রতিটি বাঁকে রয়েছে সুন্দর করে ছাঁটা ফুলগাছের নান্দনিক শোভা। রাস্তার পাশের রাশিয়ান হিলের রাজকীয় ম্যানশনগুলো রাস্তার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

আমব্রেলা স্ট্রিট, পর্তুগাল
পর্তুগালের এগুইডা শহরের একটি সরু গলি। বছরের একটি বিশেষ সময়ে গলির আকাশে রংবেরঙের ছাতার প্রদর্শনী লক্ষ্য করা যায়। বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এই শহরে একটি আর্ট ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়। তারই অংশ হিসেবে এই ছাতাগুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়। দেখে মনে হয়, এই বুঝি উড়ে চলে গেল ছাতা। কিন্তু যায় না। কারণ ছাতাগুলো তার দিয়ে বাধা থাকে। ছাতাগুলো রাস্তায় চলতে থাকা পথিকদের কাঠফাটা রোদ্দুরে শীতল ছায়াই দেয় না শুধু, এর বর্ণিল রঙের সৌন্দর্য দিয়ে মনও রাঙিয়ে দেয়। খুব বেশিদিন হয়নি এই উৎসব চালু হয়েছে, এরই মধ্যে ইন্টারনেটের কল্যাণে সারা পৃথিবীতে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। অদ্ভুত সুন্দর এই রাস্তা দেখতে তাই পর্তুগালে পর্যটকের ভিড় বাড়ছে।

ব্লু স্ট্রিট, মরক্কো
আফ্রিকা মহাদেশের আটলান্টিক পাড়ের দেশ মরক্কোর উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে রয়েছে জাদুকরী এক শহর। শহরটির নাম শেফশাওয়ান। এই শহরের বাড়িঘরের দেয়াল, দরজা, এমনকি রাস্তাঘাটও নীল রঙে রাঙানো। স্থাপত্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা বিচিত্র এই শহরের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। সেই ইতিহাস থেকে এই শহরের নীল নামকরণের ব্যাখাও পাওয়া যায়। মুসলমানরা স্পেন অধিকার করলে স্পেন থেকে অনেক ইহুদিরা মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে আসে। এদের কেউ কেউ মরক্কোতে আসে এবং শেফশাওয়ান শহরে বসতি গড়ে।

তাদের ঐতিহ্য ছিল দেয়াল, রাস্তাঘাট নীল রং করে রাখা। আকাশের নীল রঙের অনুকরণে তারা মর্ত্যরে বাড়িঘরে, রাস্তাঘাটেও নীল রং করত। এটি নাকি তাদের ঈশ্বরের শক্তির কথা মনে করিয়ে দিত। সেই ঐতিহ্য আজও প্রচলিত আছে এবং শহরটিকে আজকের বিখ্যাত ‘ব্লু সিটি’তে পরিণত করেছে।

দ্য জুলিও স্ট্রিট, আর্জেন্টিনা
প্রত্যেকটি বড় শহরের একটি প্রধান রাজপথ থাকে। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ারসের প্রধান রাজপথ হচ্ছে নাইন দ্য জুলিও স্ট্রিট। এটি পৃথিবীর প্রশস্ততম রাজপথ হিসেবে পরিচিত। আর্জেন্টিনার স্বাধীনতা দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে সড়কটি নির্মিত হয়। ১৮১৬ সালের ৯ জুলাই দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। সড়কের নাম নাইন দ্য জুলিও স্ট্রিটও রাখা হয়েছে দেশটির স্বাধীনতা দিবস অনুসারেই। সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৩০ এর দশকে এবং সমাপ্ত হয় ১৯৮০ সালে। ১৪০ মিটার প্রশস্ত, ১৮ লেনের এই রাজপথের কেন্দ্রে রয়েছে ৭০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট সূচালো স্মৃতিস্তম্ভ।

ট্রাফিক সিগন্যালে লালবাতি জ্বললে রাস্তায় বাজিকর, আগুনখেকোসহ বিচিত্র রকমের পথশিল্পীদের নানা কীর্তি দেখতে পাওয়া যায়। সড়কটি দেখতে গিয়ে আপনি যদি ব্যস্ত শহরের শব্দের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যান তাহলেও চিন্তার কিছু নেই। পুরো রাস্তাজুড়ে রয়েছে গুল্মঘেরা চত্বর এবং পার্ক। সবুজ বৃক্ষরাজির সমারোহে সাজানো পার্কগুলোতে বসার জন্য বেঞ্চও আছে, যাতে আপনি বসে বসে পুরো সড়কে ঘটতে থাকা সব ঘটনাই দেখতে পাবেন।

ম্যাজিক রাউন্ড এবাউট, ইংল্যান্ড
লন্ডনের সুইনডনে অবস্থিত ম্যাজিক রাউন্ড এবাউট পৃথিবীর সবচেয়ে বিভ্রান্তকর রাউন্ড এবাউট। অনেকগুলো রাস্তা এসে যখন একটি বৃত্তাকার রাস্তায় মিলিত হয় তখন এই বৃত্তাকার সংযোগ¯’লকে রাউন্ড এবাউট বলে। ম্যাজিক রাউন্ড এবাউটের কেন্দ্রে একটি বড় রাউন্ড এবাউটকে ঘিরে পাঁচটি ছোট রাউন্ড এবাউট রয়েছে। ১৯৭২ সালে নির্মিত এই রাউন্ড এবাউটের নাম নেয়া হয়েছে ব্রিটেনের একটি শিশুতোষ টিভি সিরিজ থেকে। এই রাউন্ড এবাউটটি সুইনডনের যানজট অনেকটাই হ্রাস করেছে। বিশ্বজুড়ে আরো নানারকম অদ্ভুত রাস্তা আছে। যেমন- সুইজারল্যান্ডের জিওমেট্রিক স্ট্রিট। এই রাস্তার পাশের দেয়ালে রয়েছে রংবেরঙের জ্যামিতিক নকশা। পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের পিঙ্ক স্ট্রিট আরেক অদ্ভুত সড়ক। এখানে পুরো রাস্তাটাই গোলাপি রং করা। অদ্ভুতুড়ে এসব রাস্তাঘাট সেসব দেশ আর শহরকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে আর পর্যটকদের উপহার দিয়েছে চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের আধার। সুযোগ পেলে রাস্তাগুলো ঘুরে দেখতে ভুলবেন না!

15 thoughts on “বিশ্বের পরিকল্পিত যত রাস্তাঘাট

  1. এর কোনো একটা পথে হেঁটে যাবার সুযোগ হবে কিনা কে জানে।

  2.  পরিকল্পিত রাস্তার বেশ কিছু অজানা তথ্য সংবলিত দারুণ পোষ্ট।

    শুভকামনা প্রিয় লেখিকা মিসেস সুরাইয়া নাজনীন।

    আপনার পোষ্ট পড়তে পড়তে আমাদের দেশের রাস্তা এবং জানজট নিয়ে মনের মাঝে কিছু একটা উকি দিচ্ছিলো।

    শুভকামনাhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

  3. বাহ চমৎকার আয়োজন। ছবি ও লেখা সব মিলিয়ে দুর্দান্ত 

    শুভেচ্ছা নিন 

  4. খুবই সুন্দর শেয়ারিং সুরাইয়া নাজনীন। এমন পোস্ট আরও পড়তে চাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  5. লন্ডনের কাছে সুইনডন round about দেখেছি, সত্যিই ওখানে ওভাবে না থাকলে M5 দিয়ে আসা যানবাহনগুলি বেশ অসুবিধায় পরতো। অন্যগুলি দেখার সুযোগ হয়নি।

    ধন্যবাদ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। গতকালই google মিয়াভাই এর সাহায্যে সবকটি দেখলাম। আপনার বর্ননা একেবারে সঠিক।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।