পাখি

খুব যত্ন করে পুষেছিলাম ছোট্ট পাখিটাকে… এত্ত ভালবাসতাম পাখিটাকে কখনও খাঁচায় রাখিনি, কষ্ট পাবে বলে। আমার পড়ার টেবিলটার পাশে ছোট্ট একটা ঘর বানিয়ে দিয়েছিলাম ওকে। যেন নিজের মত নির্ভয়ে থাকে।

আম্মুর অনেক বকাও খেয়েছিলাম সেবার, পাখিটাকে ঘর বানিয়ে দিতে কাঠমিস্ত্রিকে নিজের জমানো দু’শ টাকা দিয়ে দিয়েছিলাম বলে। এরপরও পাখিটা যখন ফুরুৎ করে ঘরটিতে ঢুকে আপন মনে পাখনা ছড়িয়ে বসত তখন আমার সমস্ত মন জুড়ে অদ্ভুত এক ভাল লাগা কাজ করত। এই বুঝি স্রষ্টার এক সৃষ্টির প্রতি আরেক সৃষ্টির নিবিড় টান.. কোন এক ঝড়ের রাতে আমি পড়তে পড়তে পড়ার টেবিলে ঘুমিয়ে পড়ি। জানালাটা বন্ধ করার কথাও ভুলে যায় সেদিন।

মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি পাখিটা আমার রুমের মেঝেতে পড়ে আছে। ঝড়ের ঝাপটায় পাখিটা একেবারেই নেতিয়ে পড়েছিল। ওড়ার শক্তিটুকুও ছিলনা।
ঐদিন থেকেই ও আমার কাছে। সেদিন ওকে ছোট্ট একটা কাপড় পেঁচিয়ে আমার বালিশে রেখেছিলাম খুব সাবধানে। সকাল হতেই নাওয়া-খাওয়া ভুলে ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম ডাক্তার দাদুর কাছে। আমাদের পাড়ার ডাক্তার ওনি। ছোটবেলা থেকেই ওনাকে ডাক্তার দাদু বলে ডাকি। প্রতিবার ওনার চেম্বারে গেলে একটা করে চকোলেট দিত দাদু। পাখিটাকে চেক করে ওর পায়ে একটা ব্যান্ডেজ করে দিল দাদু। পায়ে নাকি চোট পেয়েছে। কয়েকদিনেই সেরে যাবে বলল দাদু।

পাখিটাকে নিয়ে যখন বাসায় ফিরলাম তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। স্কুল বাসটা চলে গেছে অনেক আগে। আম্মুর বকা খেয়ে কানে আমার তালা লেগে যায় সেদিন। এরপর কেটে যায় অনেকটা সময়…

আজ আমার মনটা অনেক খারাপ। কারন আমার আদরের ছোট্ট পাখিটা আমায় ছেড়ে চলে গেছে। বেশ কয়েকদিন ধরেই পাখিটা সকালে জানালা দিয়ে ওড়াল দিত আবার সন্ধ্যাবেলায় ফিরে আসত। আজ আর ফিরেনি.. পাখিটার প্রতি অনেক রাগ জমছিল মনে একটু একটু করে। ও কি জানেনা ওর জন্য আমার খুব চিন্তা হয়?
কখন চোখের কোনায় পানি জমেছে জানিনা ওর কথা ভাবতে ভাবতে।
সত্যিই কি আর ফিরবেনা আমার পাখিটা?
জানালাটা খোলাই ছিল পাখিটার অপেক্ষায়…
সকাল বেলা আমার এক সহপাঠী নাম কিরণ ফোন দিয়ে বলল,
-আচ্ছা তোর পাখিটা কি কাল বাসায় ফিরেছিল?
বললাম,
– না তো!..কেন?
ও বলল,
– আচ্ছা, ওর পায়ে কি একটা নুপুর আছে?
বললাম,
– হ্যা, আছে ত!
ও বলল,
– তোর পাখিটাকে এখন আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের বেলকনি দিয়ে আমাদের পাশের বাসার বেলকনিতে। মা আমাকে কাল রাতেই বলছিল আমাদের পাশের বাসার দুষ্ট ছেলেটা নাকি কাল দুপুরে একটা পাখিকে ঢিল মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর ওটাকে খাঁচায় করে বাসায় এনে বেলকনিতে রাখে।
সারারাত গলা ফাটিয়ে চেঁচামেচি করেছে পাখিটা। আজ সকালে আমার চোখে পড়ল ওর পায়ের নুপুরটা।
মনে আছে? তুই আর আমি মিলেই কিনেছিলাম নুপুরটা তোর পাখির জন্য?

ওর কথা শেষ হতেই আমি লাফ দিয়ে উঠলাম।
বললাম,
-আমি আসছি।
এই বলেই ফোনটা রেখে আম্মুর কাছে গেলাম আর সব খুলে বললাম।
এই প্রথম আম্মু আমাকে বকলনা।
হয়ত আমার চোখে কিছু একটা দেখতে পেয়েছিল তাই…
আমাকে সাথে নিয়েই আম্মু কিরণদের বাসায় গেল।
আমার আম্মু অনেক রাগী এটা আমার সহপাঠীরা সবাই জানত। তাই আম্মুকে দেখে কিরণ একটু দমে গেল। আম্মু কিরণকে বলল পাশের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। ও চুপচাপ নিয়ে গেল আমাদের। আম্মু ঐ বাসায় গিয়ে গৃহকর্ত্রী কে জিজ্ঞেস করলেন ওনার ছেলের নাম কি। ওনি জানালেন তিমির। এবার আম্মু চেঁচিয়ে তিমিরকে ডাকলেন। তিমির নামের ছেলেটি কাঁচুমাচু হয়ে বেরিয়ে আসল। আম্মু ওকে পাখির কথা জিজ্ঞেস করলেন। ও স্বীকার করলনা।
বলল, ওদের বাসায় কোন পাখি টাকি নেই।

এবার আম্মু ওকে ইচ্ছামত ঝারি দিয়ে চট করে ওদের বেলকনির দিকে এগিয়ে গেলেন। আমরাও আম্মুর পিছন পিছন গিয়ে দেখলাম আমার ছোট্ট পাখিটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে খাঁচার ভিতরে! আমি এবার তিমিরের নাক বরাবর একটা ঘুষি দিয়ে বললাম,
– আমার পাখিটাকে কি করেছিস তুই?
আমরা ওখানে আর বেশি সময় নষ্ট না করে পাখিটাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
ছোট্ট পাখিটা আমার আধমরা হয়ে পড়ে আছে… চোখটাও খুলছেনা।
আম্মু আমাদের সাথে নিয়ে একটা পশু ও পাখি নিরাময় কেন্দ্রে গেলেন।
ওখানে আমার পাখিটাকে ভালভাবে পর্যবেক্ষন করা হল।
ওর ডানায় ব্যান্ডেজ করে দেয়া হল।
আর তাড়াতাড়ি সেরে ওঠার জন্য একটা অষুধ দেওয়া হল।
পাখিটা আমার চোখ মেলেছে।
কিন্তু এখনও অনেক দূর্বল।
অনেক ঝড়-ঝাপটার পর ওকে আবার ফিরে পেলাম।
মনটা আবার খুশিতে ভরে উঠেছে আমার।

12 thoughts on “পাখি

  1. আহা!! পাখিটার হদিশ তাহলে মিললো। স্মৃতিচারণের মতো করে লেখাটি খুব সুন্দর হয়েছে দিদি ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  2. মনের বাঁধন। মনটা ভরে গেলো এমন এক সারল্যে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  3. স্বস্তি পেলাম। পাখিটা নীড়ে ফিরলো। প্রচ্ছদ ছবি অসাধারণ হয়েছে। :)

  4. অসাধারণ সুন্দর লেখনীতে মুগ্ধতা রেখে যাই।

    ভালো থাকুন শ্রদ্ধেয়।

  5. মুনা

    ছোট একটা পাখি নিয়ে যে এতো সুন্দর করে একটা মায়ার লেখা লিখা যায় সেটা শিখলাম। অনেক ছোটবেলায় আমার একটা লাল মাছ ছিল একটা কাঁচের জারে রাখতাম ওটা আমরা। ছোট সেই আমিই তাকে খাবার দিতাম, পানি বদলে দিলাম জারের। আমার একটু ভুলেই মরে গিয়েছিলো মাছটা একদিন। সেই কষ্টটা এখনো মাঝে মাঝেই  হটাৎ করে ফিরে ফিরে  আসে। আপনার সুখী লেখা দেখে আমার কেন যেন মন খারাপ হলো দুর্ভাগ্যের কথা মনে হয়ে। আপনার হলুদ পাখিটার নামতো বললেন না ? কি পাখি ?

    1. শ্রদ্ধেয় খন্দকার ইসলাম,

      আপনার ছোটবেলার ঘটনাটি মনে দাগ কেটে দিল। আসলে জীবনের গল্প গুলো এমনই কখনও সুখের কখনও দুঃখের।

      আমার গল্পটি আংশিক কাল্পনিক। পাখিটি সত্যিই আর ফিরে আসেনি। এটি কি পাখি ছিল আমার জানা নেই তবে দেখতে একেবারেই ছোট ছিল বলে ওকে ডাকতাম ছোট্ট পাখি।

      শুভেচ্ছা রইল। ভালো থাকবেন।

      ধন্যবাদ।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।