মামুনের_৫০০ তম_অণুগল্প : একটু_একটু_বেঁচে_আছি

লিখতে লিখতে আজ এই গল্পটির সাথে আমার ৫০০তম অণুগল্পটিও লেখা হয়ে গেলো। ‘মামুনের এক হাজার অণুগল্প’ নামে একটি বিশাল গল্পগ্রন্থের জন্য টার্গেট করেছিলাম ২০১৮ ইং সালটিকে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হলাম। এক হাজার পূর্ণ হলো না, অর্ধেক হলো। যাইহোক, গল্পগ্রন্থটি ২০২০ এর গ্রন্থমেলায় প্রকাশ করা যেতে পারে, তবে সেজন্য আরো ৫০০টি অণুগল্প লিখতে হবে।

কোনো ব্যাপার? মনে হয় না। লেখা হয়েই যাবে।

লেখক হিসেবে আমার ৫০০ টি অণুগল্প আমার জন্য একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫০০ উইকেট লাভ করার মতই আনন্দদায়ক মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে!

লেট’স সেলিব্রেট #মামুনের_অণুগল্প_৫০০
——————————————————–

বন্ধু!
তুই কেমন আছিস?
আগেরবার আমাকে লিখেছিলি, ‘আমার যা নেবার তোর কাছ থেকে নিয়ে নিতে। তোর পুকুরে ঝাঁপ দিতে বলেছিলি… তুই নাকি সবই আমাকে দিবি? ‘

আজ এ প্রসংগেই লিখছি তোকে।

তোকে আমার যে ক্লাশমেটের কথা বলতে শুরু করেছিলাম, তার সাথে শেষ পর্যন্ত আমার ধোঁয়াটে একটা ভালোলাগার সম্পর্ক হয়েছিল, যা খুব স্বাভাবিক ভাবেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। প্রেম হয়নি, তবে
অদ্ভুত একটা ব্যাপার কিন্তু অভিজ্ঞতায় আসলো। মনে পড়ে তোর, এর আগে মোবাইলে একদিন বলেছিলি, ‘তুই কি জানিস- প্রেম কি? প্রেম করতে হৃদয় লাগে যা তোর নেই। তুই তো হৃদয়হীনা!’

তবে বন্ধু, প্রেম বলতে আমি যা বুঝি তা হয়নি। আমার যা নেই তার জন্য আমি দু:খিত। আমার আরো অনেক কিছুই নেই। সবকিছুর জন্যই আমি দু:খিত।

এ কথা শুনে তুই বলেছিলি, ‘তোর দু:খ পাবার কিছু নেই। হয়তো তুই এমনই।’

হ্যা, হয়তো বা! ছেলেটার কথা বলি?

একটা জরুরী ব্যাপারে তার সাথে কথা বলছিলাম মুখোমুখি বসে। জীবনে খুব কম ছেলেরই পাশে বসেছি। বিয়ের পর বিপদ আপদ ছাড়া এই অভ্যাসটা একেবারেই চলে গিয়েছিলো। কথা বলতে বলতে হঠাৎ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলাম। খুব অপ্রস্তুত হয়ে আবিষ্কার করলাম, এমন কিছু ফিলিংস নি:শব্দে শেয়ার করে ফেলেছি যা নিয়ে আমরা কখনো কথা বলিনি। তার কাছে ব্যাপারটা কী ছিল জানা আমার জরুরী ছিল না। সেই মুহুর্তটা আরেকবার পাওয়ার প্রয়োজনটা প্রচন্ড ভাবে বোধ করতে লাগলাম।

এর আগেই তার দুর্বলতা বুঝতে পেরে একটা ইন্ডাইরেক্ট না-বোধক চিঠি লিখেছিলাম ওকে। আরও সমস্যা হয়েছে। কিন্তু সে চিঠির ভাষায় মুগ্ধ হয়ে মূল কথাটা আর মাথায় রাখল না।

আবার এখন এই অবস্থা। তোর সাথে!

আমাদের দু’জনের একজন কমন ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল।তারা পুরনো বন্ধু। আমি নতুন। জ্ঞানী এই বন্ধু সব জানল। সে তার বন্ধুকে জটিল এই সম্পর্কটা থেকে বাঁচানোর জন্য আমার সাথে আমার বিভিন্ন বাপারে কথা বলতে শুরু করলো।

কখনো আমরা দু’জন
কখনো তারা দুজন… কথা হতে থাকলো।
আমি নির্ভর করার মত একজনকে পেলাম।

এখন এই বন্ধুই আমার মনযোগের কেন্দ্রে। আমার মন বলছিল, প্রেম নয়- আমার বন্ধুই দরকার। প্রাণ খুলে কথা বলার জন্য, সুখ দু:খ ভাগাভাগির জন্য, আপদে বিপদে পাশে পাওয়ার জন্য……।

ইতোমধ্যে সে নিজের অপারগতা বুঝে সরে গেছে। পিছু ডাকার মন ছিল না আমার। আমি কিছু কাজ বেছে নিলাম। পছন্দের কাজ। একটা চাকরি নিলাম। মন প্রাণ সঁপে কাজ করতে লাগলাম। বন্ধুর সাথে অল্প যোগাযোগ রইলো। বছরে অন্তত একবার দেখা হত।

সংসারে ফাটলটা এক সময় বেশ দেখা যেতে লাগলো।
এক সময় সইতে না পেরে যখন তখন সেই বন্ধুর বাসায় গিয়ে সব শেয়ার করতে শুরু করলাম। সে প্রায় সময় বলতে গেলে একাই থাকতো। কিন্তু শান্ত, সৌম্য এই বন্ধুটাকে এতোটাই বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিলো যে কোনো সন্দেহ আমার মনের কিনারায় ও আসলো না। অনেকটা বেপরোয়া ভালোবাসতে শুরু করলাম তাকে! আমার মনে সুখ ফিরল।

কাজের ভিতর থেকে কাজ খুঁজে বের করতে থাকলাম। ব্যস্ত থাকলাম। সেই ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও এক সময় বন্ধুটাকে দেখার একটা তৃষ্ণা পেয়ে বসলো একদিন। সামান্য সূত্র ছিল, তাই নিয়ে খুঁজে পেতে ওকে বের করলাম। সীমাহীন অবাক হলো সে। আমি অবাক হলাম এর অনেক পর।

একদিন ও আমাকে একটা প্রায় অন্ধকার রেস্টুরেন্টে দাওয়াত করলো। আমার আলোর ভিতর চলাফেরার অভ্যাস। কেমন অস্বস্তি লাগলো। আরো অস্বস্তি লাগলো যখন দেখলাম পাশাপাশি ছাড়া বসার জায়গা নাই। এসব রেস্টুরেন্ট এর খোপে খোপে স্কুলের মেয়েদেরকে নিয়ে মাস্তান চেহারার মানুষকে ঢুকতে দেখেছি পরে। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠেছি কখনো কখনো।

প্রথম সেই বিকেলে, বাইরে যখন সোনালি রোদ, ওখানে তখন ঘোর অন্ধকার। আমাদের মনেও এই অন্ধকার জমা হচ্ছিলো, খেয়াল করতাম যদি!

বসার প্রায় সাথে সাথেই দেখি একটা বড় তেলাপোকা টেবিলের অন্য কিনারা বেয়ে চলে গেলো। আমি কেন সাথে সাথে বের হয়ে আসলাম না, এখনো জানি না।

সেদিন আমার হাত ধরে, আমার এতো প্রিয় বন্ধুটা শব্দ করে কেঁদে ফেলল, ‘আমি আর পারি না, কি করবো তুমি বল!’

আমি আর কি বলবো?
কিছুক্ষণ বাজ পড়া মানুষের মত বসে থেকে শেষে কোনমতে বললাম, ‘তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেল।’ ও নার্ভাস হয়ে হাসতে শুরু করলো। আমার হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। চিন্তা লাগলো খুব। কী হল এটা?

রিক্সায় ফেরার পথে সে খুব আস্তে তার একটা ইচ্ছা জানালো। আমি প্রচন্ড রাগ চেপে বাসায় ফিরলাম।এখান থেকেও ফিরতে পারতাম। পারলাম না।

নিজের উপর থেকে ধীরে ধীরে সবটুকু কন্ট্রোল চলে গেলো। আমার পক্ষে স্বাভাবিক ভাবে কাজ করা মুশকিল হয়ে গেলো। তার মৃদু কন্ঠ, দুই একটুকরা কথা মনের ভিতর দিয়ে সারা গায়ে ছড়িয়ে গেলো। আমার মনে হতে- একদিন তুই যখন সাপের কথা বললি, আমার সেই বিষাক্ত দিনগুলি মনে পড়লো।

আমি কি তোর কাছে এসব কিছু চেয়েছিলাম? তোকে কেন এই সাপ ছোবল দিলো? আমার ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।

আজ বল, কে তোর প্রতারক বন্ধু, আমি? পৃথিবীতে তোর জানা সবগুলি গালি দিচ্ছিস আমাকে। আমি কেমন আছি, জানিস তুই?

তবে, তোর চিন্তাগুলি সরল। আমার জীবন অনেক জটিল। তোকে যা কিছু কথা- না বুঝে, ভুল বুঝে দিয়েছি- সব ফেরত নিচ্ছি। আর এইসব কথা তোকে যত যন্ত্রণায় ফেলেছে, তার জন্য সারা জীবন গালি দিস। তবে আমার সামনে কিংবা নিজের মনের আংগিনায় দিস। মানুষের সামনে দিস না। অনেক প্রশ্ন জন্মায় মানুষের মনে। কেন লজ্জা দিবি?

একটু আগে যে সাপটার কথা বললাম, তার পরিণতি বলি। একদিন দুপুরে খুব সংক্ষেপে আমি আমার সেই বন্ধুর দাবী পূরণ করলাম। আসলে এসব সম্পর্কের ভিতরে বাহিরে ঘৃণা আর আক্রোশ ছাড়া কিছুই থাকে না। মানুষ অসহায় হয়ে এই সব সম্পর্কের কাছে হার স্বীকার করে। এখানে ভালো কিছুই নাই। ঘৃণা আর আক্রোশই ছিল সেই সম্পর্কটার পরিণতি। এখনো, চিরকালের জন্য তাই আছে, থাকবে। ক্ষমাও আছে। সবটুকু কেন যেন করা যায় না, তাকেও না, আমাকেও না, পৃথিবীকেও না।

তুইও আমাকে বাকি জীবন ঘৃণা করে যা।
শুভেচ্ছা রইলো।
অনেক।
স্যরি।

আমার এই লেখা পড়ে, হয়ত মনে মনে বলছিস, ‘তুই একটা পাগলি আছিস বড়! … তোকে অনেক ভালোবাসি… অনেক অনেক অনেক অনেক… তোর সব কষ্ট এই ভালোবাসায় ধুয়ে যাবে… দেখিস একদিন!’

আমি জানিই তো – তুই এ রকমই। এটাই বলবি!

আমার সাথে পৃথিবীর আর কারো কোন ব্যক্তিগত সম্পর্ক নাই। কিছুর সাথে নাই। আমি এক সম্পর্কহীনা! এক হৃদয়হীনা!!! কিছু একটা করে বেঁচে থাকতে হয়।

ভালোবাসিস না। আমিও কাউকে ভালোবাসি না। শুধু বেঁচে থাকি। আমার হাসি কান্নার কোনো অর্থ নাই। কোনো কথার কোনো অর্থ নাই। মনে রাখিস না।
স্যরি! …

_________________________________
#একটু_একটু_বেঁচে_আছি_মামুনের_অণুগল্প_৫০০

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

6 thoughts on “মামুনের_৫০০ তম_অণুগল্প : একটু_একটু_বেঁচে_আছি

  1. মামুনের_অণুগল্প_৫০০ তম পোস্টের অভিনন্দন মি. মামুন।

    এভাবেই আপনার লিখার হাত অব্যাহত থাকুক। পাঠক প্রিয় হোক সব লিখা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  2. হৃদয় ছোঁয়া একটি গল্প। পাঁচ শতাধিক অনুপম সৃস্টির অভিনন্দন গল্প দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  3. যতটুকু জানি আপনি ৬০০ এর অনেক উপর লিখেছেন মহ. আল মামুন ভাই। সহস্র লিখার শুভেচ্ছা জানবেন।  https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Claps.gif.gif

    1. অণুগল্প ৫ শতাধিক হয়েছে। ছোটগল্প এবং বড় গল্প মিলিয়ে ওরকমই হবে প্রিয় কবিদা'। আপনার অণুপ্রেরণা লেখায় উৎসাহ জুগিয়েছে। ভালো থাকুন সবসময়। শুভেচ্ছা..https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।