ধারাবাহিক গল্পঃ তিনি একজন মফস্বল সাংবাদিক

ধারাবাহিক গল্পঃ তিনি একজন মফস্বল সাংবাদিক // পর্বঃ ৩।।

মাঝে মাঝে আমাকে শয়তানে টোকা দেয়। অবশ্য হাত দিয়ে শরীরে না, ব্রেইনে আমার।

একজন মফস্বল সাংবাদিক হবার আগে থেকেই টুকটাক লেখালেখি করে আসছিলাম। একটা প্লট নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছিলাম। সেখানের মূল চরিত্রটি ছিল একজন চোরের। ওর বন্ধু ছিল একজন পকেটমার। তাই বাস্তবে একজন পকেটমার এবং ছিচকে চোরের ইন্টারভিউ নেবার ইচ্ছে হল। কিন্তু আমার বসবাসের এলাকা এবং কর্মক্ষেত্রে থাকাকালীন, কিভাবে যেন এটা হয়ে উঠলো না।

সময় বয়ে গেলো…
এর ভিতর, বেশ কিছু বছর পরে ঈদ করতে চিটাগং গেলাম। নিজের বেড়ে ওঠার একসময়ের প্রিয় শহরে নিছক একাকী ঘুরে বেড়াতে রাত বারটার পরে চট্টগ্রামের বাসা থেকে বের হলাম। বটতলী পুরনো রেলস্টেশনে অবস্থান নিলাম। যে সময়ের কথা বলছি, তখন রাস্তার সামনে প্রকাশ্যে গাঁজা বিক্রী করা হয়। আর পাইপের ভিতরে (বিশাল সাইজের পাইপ) ভ্রাম্যমান পতিতারা তাদের বাসস্থান বানিয়েছে। এটা এই ধরণের লোকদের (পকেটমার /চোর ) আদর্শ জায়গা হবে ভাবলাম।

এসময় লেখকের পাশাপাশি অবস্থান করা একজন মফস্বল সাংবাদিক প্রকট হলেন। একজন মানুষের ভিতরে আরো কয়েকজন অবস্থান করেন। আমার ভিতরের জনদেরকে আমি অনুভব করি। যাইহোক, মফস্বল সাংবাদিকের কিছু কিছু ভাবনা ব্রেইণে শয়তানের টোকা দেবার মত। কারণ এরুপ আসা ছাড়া তাদের করারও কিছু থাকে না।

ভাবনা-চিন্তায় শয়তানের টোকা না থাকলে এইসময়ে কেউ দক্ষ মফস্বল সাংবাদিক হতে পারেন না।

যাইহোক, লেখকের প্লট কে সামনে রেখে তিনি ‘ধান্ধা’ করার অভিপ্রায় জানালেন। টুইন ওয়ান। রথ দেখা, কলা বিক্রি- দু’টোই হলো। শহরের অন্ধকার জগত নিয়ে একটা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হতে পারে। মাদক এবং ছিনতাইকারী চক্র। কিন্তু আমি দেখতে চাইলাম, আমার ভিতরের মফস্বল সাংবাদিকের ব্রেইণে প্যারালাল আর কি ভাবনা চলছে। তিনি আসলেই কি ভাবছেন? শ্রেফ জনকল্যাণে প্রশাসন সহ সাধারণ জনগণকে সচেতন করতেই এই প্রতিবেদন? নাকি কিছু টাকা প্রাপ্তির সম্ভাবনা যা এই ‘ধান্ধা’ শব্দটির মাঝে লুকিয়ে আছে?

টিকে থাকতে একজন মফস্বল সাংবাদিককে ধান্ধা করতেই হয়। আছে কোনো বিকল্প? বেতন পায় না তারা। একটা পত্রিকায় ঢুকতে প্রথমেই তাদেরকে রেফারেন্স সহ এককালীন বেশ কিছু টাকা খরচ করতে হয়। এরপর নিজের উপজেলায় প্রতিদিন সংবাদের পিছু ধেয়ে দিন-রাত ছুটতে হয়। যাতায়াত ভাড়া সহ চা-নাস্তা, সামাজিকতায় দিন দিন প্রতিদিন টাকা ব্যয় হয়। ভালো অংকেরই। নিজের পরিবারের সদস্যদের পিছনে আছে ব্যয়। এরপর মাস গেলে বাড়ি ভাড়া, মুদি দোকান, মাছ বিক্রেতা, মুরগীর দোকান সব জায়গায়ই খরচ। এসবের মিলিত যোগফল আর মাস শেষে তাঁর আয়ের মিলিত যোগফল কেমন? যেখানে পেশা হিসেবে ‘বেতন নাই কোনো’ লাইনটি প্রযোজ্য। আয় শূণ্য।

ঋণাত্বক জীবনযাপনকারী একজন মফস্বল সাংবাদিকের সাথে তাই ‘ধান্ধা’ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। তাদেরকে ঘৃণা করার কিছু নাই। আপনার নাক কুঁচকে গেলে দয়া করে স্বাভাবিক অবস্থায় আনুন। নাহলে মফস্বল সাংবাদিকের পায়ে যে জুতো জোড়া, সেটা পায়ে দিয়ে তার জায়গায় এসে হাঁটুন।

যাইহোক, কোথায় যেন ছিলাম?
চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে পড়াকালীন এই স্টেশনটি নিজের বাসার থেকেও বেশী পরিচিত ছিল। ওখানে ‘গুজাইয়্যা’ নামের একজন গাঁজা বিক্রী করতো। ওর সাথে আমার (নাকি আমার সাথে ওর?) বেশ পরিচয় ছিল। এই ‘চোর’ প্রজেক্টে’ ওর হেল্প নেবার কথা মনে হল। সেজন্য প্রথমেই ওকে খুঁজে বের করলাম।

প্রায় ১০ বছর পরে গুজাইয়্যার সাথে দেখা হল। ছবিতে আমাকে যে লেবাসে আর অবয়বে দেখা যাচ্ছে, তাতে এতো রাতে অন্য কেউ দেখলে আমাকেই চোর মনে করাটা অস্বাভাবিক কিছু না। :) কয়েকদিনের শেভবিহীন চেহারা, টানা দশ ঘন্টা বাস জার্ণি করে নেমেই, লুংগি পরে বের হয়েছিলাম। চাঁটগার প্রাণকেন্দ্রে।

আমি দেখলাম গুজাইয়্যা ভ্রাম্যমান গাঁজা বিক্রেতা থেকে মেইন রোডের সাথেই একটা হোটেল দিয়েছে। সেখানে ভাত-তরকারির সাথে চা এবং অন্যান্য সবকিছুই পাওয়া যায়। আমি ভিতরে ঢুকে ওকে ডাকলাম। দেখলাম সে এখন বিশাল এক চেয়ারে বসে ক্যাশ সামলায়।

আমাকে দেখে ও ভাবল এই ১০ বছরে আমার ভীষণ সামাজিক স্ট্যাটাসের অবনতি হয়েছে। তাই আমি কি করি এটাই প্রথমে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু আমি কেমন আছি এটাই প্রথম প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল ওর। যাইহোক, আমি বললাম কিছুই করি না। সে শুধু ‘ও’ বলে অন্য এক কাষ্টমারের দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

অনেকক্ষণ পরে সে ফ্রি (!?) হলে আমি আমার ইচ্ছার কথাটি বললাম। খুবই স্বাভাবিক ভাবে সে ব্যাপারটি নিলো এবং একজনকে ‘সবুরের’ কাছে আমাকে নিয়ে যেতে বলল। ওকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি ওর দেখানো লোকটির (আসলে পিচ্চি এক ছেলে ছিল সে) পিছনে রওয়ানা হলাম। ছেলেটি আমাকে আমার বসে থাকা ছবির পাশে যে শুয়ে আছে, তাঁকে দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল।

সবুর নামের ঐ চোর বা পকেটমারের সাথে আর কথা বলা সেই রাতে আমার হয় নাই। কারন ততোক্ষণে রাত ১টা বেজে গেছে… বাসা থেকে বউ আর শাশুড়ি আম্মার বার বার ফোন আসছে। আর পাইপের ভিতর থেকে একজন মেয়ে বের হয়ে একবার আমার পাশ দিয়ে ঘুরে যেতেই, আমি সেখানে আর থাকাটা নিরাপদ মনে করলাম না।

লেখকের সেই ইন্টারভিউটিও নেয়া হলো না, তাই সেই লেখাটি লেখাও হল না। আর মফস্বল সাংবাদিকের সে রাতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা হলো না। এজন্য চিন্তার সমান্তরালে বয়ে যাওয়া ভিন্ন আর একটি কাজও হলো না।

কখনও কখনও মফস্বল সাংবাদিকদের কিছু ইচ্ছা অপূর্ণও থেকে যায়। সব পূর্ণ হয়ে যায়, এমন মানুষেরা সাধারণত মফস্বল সাংবাদিকতায় আসেন না।

(ক্রমশঃ)

#তিনি_একজন_মফস্বল_সাংবাদিক_মামুনের_ধারাবাহিক_গল্প_পর্ব_৩

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

6 thoughts on “ধারাবাহিক গল্পঃ তিনি একজন মফস্বল সাংবাদিক

  1. ঋণাত্বক জীবনযাপনকারী একজন মফস্বল সাংবাদিকের সাথে তাই ‘ধান্ধা’ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। তাদেরকে ঘৃণা করার কিছু নাই। আপনার নাক কুঁচকে গেলে দয়া করে স্বাভাবিক অবস্থায় আনুন। নাহলে মফস্বল সাংবাদিকের পায়ে যে জুতো জোড়া, সেটা পায়ে দিয়ে তার জায়গায় এসে হাঁটুন।

    অসাধারণ আবাহন মহ. আল মামুন ভাই।

    1. ধারাবাহিক গল্পটির সাথে থাকার শুভেচ্ছা রইলো প্রিয় কবিদা'।

      ধন্যবাদ।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  2. আগের দুই পর্ব সম্ভবত পড়া হয় নি। তৃতীয় পর্ব পড়লাম প্রিয় গল্প দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif.gif

    1. এ পর্বটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ রিয়া দিদি। আগের পর্ব দুইটিও আমার এই ব্লগেই আছে। শুভেচ্ছা রইলো।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  3. যাপিত জীবনের গল্প পড়লাম মি. মামুন। দুঃখ ব্যাথা বেদনা আমাদের সবার জীবনে আছে। এবং থাকবে। এর মাঝেই আমাদের চলতে হবে। কিছুই যেন করার নেই।

    1. সুন্দর বলেছেন ভাইয়া, এর মাঝেই চলতে হবে আমাদের। ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।