জীবনের গল্প

ওই যে কথায় বলে না ‘first impression is the last impression ‘. আমার ক্ষেত্রে সবসময় first impression worst impression হয়েছে। মাত্র তিনটে পয়েন্ট বললেই ব্যপারটা বোঝা যাবে।

১. এমনিতে আমি মানুষটা কথাকলি। অনর্গল কথা বলে যেতে পারি। কিন্তু ওই যখনই কোথাও গেছি, চেনাদের মাঝে টুকটাক কথা বললেও অচেনা কেউ সামনে পড়ে গেলেই হয়েছে – একেবারে স্পিকটি নট। হুম, হা করে কাজ চালিয়ে নেওয়া। আর শান্ত আমি কোনো কালেই ছিলাম না। মনে আছে ছোটবেলায় বাবা মায়ের সাথে কোথাও গেছি সব অচেনা মানুষের ভীড়। আর আমি একেবারে চুপ। সেইসব অবশেষে আমাকে সার্টিফাই করলেন, ভীষণ শান্ত, লাজুক স্বভাবের মেয়ে। ভীষণ কম কথা বলে।

২. কলেজে উঠেছি, মানে পড়ালেখা করে প্রোমোশন হয়েছে আর কি। অনেকদিন কলেজ করার পরে আমরা কয়েকজন বন্ধু হতাশ হয়ে পড়লাম। স্কুলের সাথে কোনো পার্থক্য পাচ্ছি না বলে। সবাই ক্লাস বাঙ্ক করে আর আমরা রোজ রোজ সবকটা ক্লাস করে যাচ্ছি। একদিন মনে সাহস নিয়ে, মুখে বিরক্তির ছাপ এনে বললাম -চল তো আজ কফি হাউজে যাবো। রিনা বললো আমার বয় ফ্রেন্ডকে ডেকে নিই? ও পাশেই থাকে। আমরা বললাম ডেকে নে। কলেজে পড়ার সময়ও আমিই একমাত্র পদার্থ যার বয় ফ্রেন্ড জোটেনি। যারা ঝরতি পড়তি এসেছিলেন একটা ফুঁ দিলেই উড়ে গেছে। তাই মনে মনে দুঃখ থাকলেও কাউকে বলতাম না। থাক সেইসব দুঃখের কথা। কফি হাউজে তো আমরা হেঁটে হেঁটে গেলাম। গিয়েই রিনার বয়ফ্রেন্ডকে দেখলাম যে বীর বিক্রমে বসে আছে। আসলে নাম তার বিক্রম। রিনা তার পাশে বসলো আর আমি ওদের উল্টো দিকের চেয়ারে। সবাই কফির অর্ডার করছে কে কি খাবে।

ততদিনে টিভিতে হিন্দি, তামিল, ওড়িয়া, মানে ভারতের যতো ভাষা আছে সেইসব সিনেমা দেখে এটা বুঝেছি যে কফি মানেই ব্ল্যাক কফি। তখনও কফির স্বাদ জানি না। মানে আমাদের বাড়িতে ছোটদের চা, কফি দেওয়া হতো না। যদি খুউউব বায়না করা হতো তাহলে এক কাপ দুধে কয়েক ড্রপ চায়ের লিকার ফেলে চা বলে আমাদের দেওয়া হতো। সেই আমি বললাম ব্ল্যাক কফি খাবো। যথা সময়ে আমাদের সামনে কফি এলো, সবাই ব্ল্যাক কফিই নিয়েছে। সাথে সিঙ্গারা। সবাই কফিতে চুমুক দিয়েছে। আমি কিন্তু দিচ্ছি না। রিনা লাজুক লাজুক মুখ করে বিক্রমকে দেখছে। অবশেষে আমি ভাবলাম। নাহ্, কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে এইবার খেয়ে নেওয়া দরকার। বলে যেই এক সিপ নিয়েছি! ও মা গো! কি তেতো! পুরো কফিই মুখ থেকে ফু করে বেরিয়ে এলো। বেচারা বিক্রমের সাদা শার্টে কফির ছিটে ভর্তি। আর আমি যারপরনাই লজ্জিত। বিক্রম তো ঠিক আছে ঠিক আছে বলতে বলতে হাত মুখ ধুয়ে এলো! রিনা সহ বন্ধুরা ভাবছে কফিতে কিছু পড়েছিল হয়তো। কিন্তু আমি তো জানি, যে মেয়ে তেতো খেতে হবে বলে ভাত জানলা দিয়ে গলিয়ে ফেলে দিতো সেই মেয়ে খাবে ওই তেতো কফি! যাকে মা ধরে বেধে হয়তো এক গরস নিম বেগুন বা উচ্ছেভাজা দিয়ে ভাত খাওয়াতে পারতো, সেই মেয়ে খাবে পুরো এক কাপ ওই তেতো কফি! কভি নেহী।

৩. বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমার হাতের বানানো চা খাবে। বিয়ের আগে কোনোদিন রান্নাঘর মুখো হই নি। রান্নার র জানি না, কোনো কাজ পারি না সেই মেয়েকে বাবা, মা সাহস করে বিয়ে দিয়েছে। মা অবশ্য আমার দস্যিপনা দেখে মাঝেমধ্যে বলেই ফেলতেন ‘তোর বিয়ের পরের দিনই শ্বশুরবাড়ির লোকজন তোকে ফেরত দিয়ে যাবে সাথে একটা ঝুড়ি দিয়ে। আর সেই ঝুড়ি ভর্তি থাকবে তোর নামে অভিযোগ! ‘ আমি তো সেই ছবি কল্পনা করেই শিউরে উঠতাম, না জানি কি কি অভিযোগে ভরা সব চিরকুট থাকবে! সেই আমাকে হঠাৎ বলা হলো চা করে আনতে। আমার পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠলো। হে ধরণী দুভাগে ভাগ হয়ে যাও আর আমি তাতে তলিয়ে যাই। কাঁপতে কাঁপতে রান্নাঘরের দিকে এগোলাম। রান্নাঘরে গিয়ে চুপকরে দাঁড়িয়ে আছি গ্যাস জ্বালাতে পারি না। আমার ভাসুর কিছু একটা আন্দাজ করে রান্নাঘরে গেছেন। অবশেষে আধঘণ্টার চেষ্টায় আমাকে গ্যাস জ্বালানো শিখিয়েছেন। তারপর বললেন, কাপ মেপে জল নেবে আর চা, চিনি সব এখানেই আছে। দাদা চলে গেলেন। আমিও একটা পছন্দসই বাসন নিয়ে তাতে কাপ মেপে জল নিয়ে অনেক খুঁজে কোনো পাতা জাতীয় কিছু না পেয়ে একটা কৌটোতে চা পাতা আন্দাজ করে সেই মাপা জলে চামচ মেপে চা পাতা দিতে জল ফুটতে দিলাম। দশ মিনিট হয়ে গেলো জল ফুটে প্রায় শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থায় কিন্তু জলের রঙ পাল্টাচ্ছে না। আবার জল দিলাম, এইবার সেই বাসন ভর্তি করে। আবার জল ফুটছে কিন্তু রঙ সাদাই। কেঁদে ফেলার আগের স্টেজে আমার শাশুমা রান্নাঘরে এলেন। আমার অবস্থা দেখে তিনি হাসবেন না কাঁদবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। অবশেষে নিজেকে সামলে তিনি বললেন এটা কি দিয়ে চা বানাচ্ছো? এটা তো কালোজিরে! ওটা চা পাতা। তখন আমার চোখে তো সবই একই রকম। তুমি কালোজিরে দিয়ে চা বানাচ্ছো? তখন তিনি আমাকে ধরে ধরে চা বানানো শেখালেন।

তাহলেই আপনারা বুঝুন প্রথম ইম্প্রেশন আমাকে কতখানি বিপদে ফেলে। তারপর তো প্রথম শাড়ি পরে হাঁটতে গিয়ে ধুপধাপ পড়ে যাওয়ার কথা আর নাই বা বললাম। সেই গল্প আর একদিন বলা যাবে।

22 thoughts on “জীবনের গল্প

  1. জীবনের কথা গুলোন আমাদের অনেকের জীবনের সদৃশ। জীবনের প্রতিটি ধাপ বোধকরি আমাদের অনেকের মধ্যে অনেকটাই মিল। শ্রেফ নাজারিয়া আলাগ্। শুভেচ্ছা বন্ধু। :)

    1. মন্তব্য করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় বন্ধু। :) https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  2. "জীবনের গল্প " পুরোটা পড়লাম। গল্পটা দারুণ ছিল।বাকীটুকুও চলুক ।

    দু'দিন শহরের কোলাহল ছেড়ে গ্রামের শান্ত সবুজ শান্তির নীড়ে ঘুরে এলাম। অনেকটা সেই জন্য ব্লগে সময় দিতে পারিনি । শুভেচ্ছা নিন রিয়া দিদি ভাই।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    1. ওহ্। তাহলে গ্রামে ছিলেন। নিশ্চয়ই দারুণ সব অভিজ্ঞতা জমা হয়ে আছে। আমাদের সাথে শেয়ার করবেন। ধন্যবাদ দিদি ভাই। :) 

  3. জীবনের এ গল্পটি আমার জীবনের কাছাকাছি চলে এসেছে।  তুমি লিখতে পেরেছো বলেই আমি নিজেকে অনুভব করতে পেরেছি ।

    আমার প্রথম শাড়ি পরার অভিজ্ঞতা মোটেই সুখপ্রদ ছিল না।  বহু যত্নে বড় বোন পরিয়ে দিয়েছিলেন। রিকশায় মহাসুখে কলেজ অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিলাম। পথিমধ্যে কি এক কারণে হঠাৎ রিকশা ব্রেক কষলে সিট থেকে পিছলে পা'দানীতে পড়ে যাই। উপস্থিত অপরিচিত শুভাকাঙ্ক্ষীরা সমবেদনা জানাতে এলে আমার বাঁচা মরা সমান হয়ে যায় https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_bye.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif                         

    1. তাই নাকি !! ভালো থাকুন কবি দি। আমাদের জীবনের অনেক গল্পই খুব বেশী দূরের নয়। :)

  4. কথাকলি রিয়াদি,

    কফি খাওয়া আর চা বানানোর গল্পো দুটো আগেও পড়েছিলাম। দারুন ঘটনা।

    চাপাতি ভেবে কেউ যে কালজিরা ফুটায় ইহা জীবনের প্রথম শুনিলাম। মজাও পাইলাম। ভাগ্যিস চা বানাতে পারতেন না। নয়তো এমন মজার পোস্ট পড়তাম কীভাবে?? নRating: 5.0/5
    এবার চায়ের দাওয়া চাই..https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Razz.gif.gif

    1. চায়ের দাওয়াত রইলো নিজু দা। চলে আসুন কোলকাতা। রেটিং এর জন্য কৃতজ্ঞতা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_yahoo.gif

  5. জীবনের গল্প। ভালো থাকবেন অনেক বেশী এই শুভেচ্ছা।

    1. আসলেই তাই কবি সুমন আহমেদ দা। ধন্যবাদ আপনাকে। :)

  6. সুন্দর জীবনধর্মী শিক্ষামূলক লেখা। পাঠে মুগ্ধ হলাম।
    ভাষা ও শব্দের যথাযথ প্রয়োগ লেখাটিকে
    পাঠকসাধারণের কাছে অধিক চিত্তাকর্ষক করে তুলেছে।
    আপনার প্রতি শ্রদ্ধা ও আন্তরিক প্রীতি আর শুভেচ্ছা জানাই।
    সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
    জয়গুরু।জয়গুরু!

    1. লেখার ফন্ট এতো ছোট হয়ে গেলো কিভাবে দাদা? Size লেখা বাটনে ফন্টের সাইজ বাড়িয়ে নিন। ধন্যবাদ। :)

  7. লেখাটি পড়ে সমৃদ্ধ হলাম । শুভকামনা।

    1. ধন্যবাদ ফারুক ওমর দা। শুভকামনা আপনার জন্যও। :)

  8. শ্রদ্ধেয় রিয়া দিদি, বর্তমানে আমার জামাইবাবুকে চা, কপি বানিয়ে খাওয়াতে পারছেন তো? আর মাওই মাকে ম্যানেজ করে চলবেন কিন্তু ! তা না হলে আর অভিযোগের কমতি হবে না। 

    আপনার লেখা পড়তে ভালোই গালে দিদি। আরও লিখবেন মনের কথা, প্রাণের কথা!

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।