ভালবাসা শুধু ভালবাসা (নবম পর্ব)

ভালবাসা শুধু ভালবাসা (নবম পর্ব)

আশায় বাঁধি খেলাঘর
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

-হেই বাপ! তু মানুষ খুন করেছিস? ঝুমলি আঁতকে ওঠে।

-মানুষ নয় রে ঝুমলি, আমি যাকে খুন করেছি সে একটা ব্রিটিশের পা চাটা কুত্তা। পঞ্চাশ কোটি ভারতবাসীর আশা আকাঙ্খাকে যারা দুপায়ে মাড়িয়ে দিতে পারে তাদের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

-তুর কুথা হয়ত ঠিক। কিন্তু পুলিশ তুকে ছাড়বেক লাই। তুর জেহেল হতি পারে।

– না ঝুমলি। অরণ্যের ঘুম ভাঙছে। জেগে উঠেছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য উত্তাল হয়ে উঠেছে। একদিন ব্রিটিশদের এদেশ ছেড়ে যেতেই হবে। হুঁসিয়ার সাবধান।

-বাবুজি!

-এই কয়দিনে তোমরা আমার যা উপকার করেছো তার দাম হয়তো আমি কোন দিনই দিতে পারবো না। ভারতবর্ষের ইতিহাস যদি কোনদিন লেখা হয় তাতে হয়তো তোমার নাম লেখা থাকবে না। কিন্তু দেশের স্বাধীনতার জন্য তুমি যা করলে তার দাম অনেক। একজন তরুণ বিপ্লবীকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে না দিয়ে তাকে থাকার অধিকার দিয়ে তুমি আমার অনেক বড় উপকার করলে।

তারপর 1947 সালের 15ই আগস্ট। দেশ হল স্বাধীন। স্বাধীন ভারতবর্ষে উড়লো অশোক লাঞ্ছিত ত্রিবর্ণ পতাকা। স্বাধীনতার পর এক এক করে কতগুলো বছর কেটে গেল, কিন্তু বাবুজির কোন সংবাদ পেল না ঝুমলি। ঝুমলি আজও তাকে খুঁজে বেড়ায়। আজও সেই তরুণ বিপ্লবী তার হৃদয় জুড়ে আছে। ঝুমলির চোখে স্বপ্ন তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার। জীবনের বালুচরে বাঁধা এরকম কত ঘরই যে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে কে তার খবর রাখে?

অথচ আজও শাল পিয়ালের বনে মোরগেরা ডেকে ওঠে। বাঁশের বাঁশির সুরে সাঁওতালেরা মাদল বাজায়। মহুল বনে মহুলের নেশায় সবাই যখন মাতাল হয়ে ওঠে ঝুমলি ভাবে এটা সামাজিক রীতি নয়। মাতাল হওয়াটা আজ তাদের কাছে স্বাভাবিক বলেই আদিবাসী সমাজে স্বীকৃতি পেয়েছে।

ঝুমলি কিন্তু আজও বিয়ে করে নি। ঝুমলি তার বাবাকে দেখে নি। জন্মের পরে মাকে হারিয়েছে। তার মা মারা যাবার পর দাদু তাকে কোলেপিঠে মানুষ করেছে।

তার দাদু মংলি মাঝি তাকে শিখিয়েছে- “মত ডর বিটিয়া। তু জিন্দা বাঘের সাথে ঘর করবি, মহুলের নেশায় বুঁদ হয়ে পাহাড়ী চিতা বুকে লিয়ে লাচবি। তুই মংলি মাঝির লাতিন বুঠে। তুহার ডর করলে চলবেক নাই।”

সেই দাদুকে হারানোর পর অনেকেই তাকে বিহা করার জন্য কথা বলেছে কিন্তু ঝুমলি রাজি হয় নাই। বাকি জীবনটা সে এভাবেই কাটিয়ে দেবে।
শাল পিয়ালের বনের ধারে অজয় নদী তির তির করে বয়ে চলে।

মাঝিরা সুর করে ভাটিয়ালি গাইছে-
ও পরাণ বন্ধু রে……….
সাধ করে তুই বালুচরে কেন বাঁধলি খেলাঘর।
জীবননদীর ঝড় তুফানে ভাঙবে তোর সে ঘর।
আমি আশায় বাঁধি খেলাঘর।

গানের সুরে সুর মিলিয়ে ঝুমলি তারে আজও ডাকে- “বাবুজি তু ফিরে আয়, তু ফিরে আয়। হামি তুহার লাগি আজও বিহা করি লাই। তু ফিরে আয় বাবুজি তু ফিরে আয়”।
ঝুমলির দু’চোখ জলে ভরে আসে।

ঝুমলির কান্না ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে কান্না হয়ে নেমে আসে অজয় নদীর বাঁকে। বলাকারা পাখা মেলে নীল আকাশে উড়ে যেতে যেতে এখানে এসে থমকে দাঁড়ায়। হয়তো এখানে কোথাও লুকিয়ে আছে কোন এক অজানা তরুণ বিপ্লবী আর ঝুমলির নীরব ভালবাসার ইতিকথা।

ঝুমলি নীল আকাশের দিকে আজও চেয়ে থাকে। সোনালী আলোয় অজয়ের চর রঙিন হয়ে আসে। ধীরে ধীরে নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া। নীল আকাশে চাঁদ ওঠে। শাল পিয়ালের বনে জোছনার লুকোচুরি চলে। ঝুমলির চোখে ঘুম নেই। অজয় নদীর বাঁকে শেয়াল কেঁদে ওঠে।

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

10 thoughts on “ভালবাসা শুধু ভালবাসা (নবম পর্ব)

  1. আজকের অনুগল্পটি আপনার অন্যান্য লিখা থেকে বেশ স্বতন্ত্র। গুড জব। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    1. আপনার শুভাশীর্বাদ আমার চলার পথের পাথেয় হোক।
      সশ্রদ্ধ অভিবাদন করি, বিনম্র প্রণিপাত করি।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
      জয়গুরু!

    1. সুন্দর মন্তব্যে আপ্লুত হলাম কবিবার।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
      জয়গুরু!

      1. কবিবর হবে।

        প্রমাদ জনিত ত্রুটির জন্য মার্জনা চাইছি।

    1. সুন্দর মন্তব্যে হৃদয় ভরে ওঠে কবিপ্রতীম।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
      জয়গুরু!

    1. সুন্দর মন্তব্যে আরো ভালো লেখার অনুপ্রেরণা পেলাম প্রিয়কবি।
      সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। শুভেচ্ছা রইল।
      জয়গুরু!

  2. আজ ভালবাসা শুধু ভালবাসার প্রথম খণ্ডের শেষ পর্ব
    প্রকাশিত করার ইচ্ছা আছে। আপনাদের অকুণ্ঠ
    সহযোগিতাকে পাথেয় করে দ্বিতায়ার্ধে
    প্রকাশ দিতে পারব বলে আশা রাখি।
    সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
    জয়গুরু!

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।