পর্যটকের ডায়েরীঃ ইন্ডিয়াতে টেনে ভ্রমণ (পর্ব ০২)

প্রথম পর্বের পর…
রাতে শোয়ার জন্যে ট্রেন কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে বালিশ, ধবধবে সাদা চাঁদর আর কম্বল দিয়েছিলো। বিছানাও ইতিমধ্যে তৈরি করে ফেলেছি। সবাই শোয়ার জন্যে তোড় জোড় করছে। অন্ধ্র প্রদেশের যে গ্রামীন দম্পত্তি (দেখে গ্রামীনই মনে হয়েছিলো) আমাদের সহযাত্রী ছিলেন, তারা দেখলাম নিজেদের ভাষায় জোরে জোরেই কথা বলছেন। কিন্তু এক বর্ণও বুঝি নি। একটু পর দিদিমনি (ভদ্রলোকের স্ত্রী) শুকনো খাবার বের করলেন। আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বললেন আর খাবার সাধলেন। বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন, খাবার নিতে। কিন্তু নিলাম না। বন্ধুবরও উপরের টায়ার থেকে ইশারা দিচ্ছে- নিস না, নিস না, খবরদার নিস না। যাইহোক পেটে ইশারা করে ভদ্রমহিলাকে বোঝালাম আমরা ঠেসে খাবার খেয়ে এসেছি। ইংরেজীতে বললেও তারা তেমন একটা বুঝেই না বলতে গেলে।

ভাব বিনিময়ের মাধ্যম ভাষা এক না হলে কি যে সমস্যা, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। তারা তাদের ভাষায় বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করে। আমি কখনো ইংরেজীতে বলি যে, তোমাদের কথা বুঝি না, কখনোবা ঠোঁট উল্টিয়ে হাতের ইশারায় বোঝাই- কি যে বুঝি না, তাও বুঝি না। যাইহোক ট্রেন ছাড়ার প্রায় দেড় ঘন্টার মধ্যেই সবাই শুয়ে পড়লো। কিন্তু ট্রেনের প্রচন্ড দুলুনিতে আমার তেমন একটা ঘুম হলো না। বারবারই মনে হচ্ছিলো যে, উপরের টায়ারের (শোবার সীট) শেকল ভেঙ্গে যাত্রী দুজন আমার ঘাড়ে এসে পড়বে অথবা প্রচন্ড দুলুনির চোটে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে যাবে। সারা রাতে মনে হয় ২ ঘন্টার মত ঘুম এসেছিলো। অথচ প্রচন্ড দুলুনিতেও ইন্ডিয়ানরা দেখলাম চোখ বুজে আরামে ঘুমুচ্ছে।

পরদিন খুব সকালে ঘুম জড়ানো আধো আধো চোখ মেলে দেখলাম- দিদিমনি মাঝের টায়ার (শোবার সীট) থেকে নেমে নীচের টায়ারে স্বামীর কম্বলের নীচে ঢুকলেন। হয়তো পরম আদরের স্বামীর উষ্ণ বুকে আশ্রয় খুঁজে নিলেন। বুঝলাম দু’জনেই দুটো পাখির ছানার মতো গলাগলি করে উষ্ণতা নিচ্ছেন। কি ঘটছে টের পাওয়া মাত্রই আমি লজ্জ্বায় চাঁদরের নীচে মাথা ঢুকিয়ে চুপচাপ পড়ে রইলাম….

♥ “তুই কাছে আয় দেখি, আয় একবার,
মুখ তোর রাখ্ দেখি বুকেতে আমার!
দেখি তাহে এ হৃদয় শান্তি পায় যদি!
কে জানে উচ্ছ্বসি কেন উঠিতেছে হৃদি!
দেখি তোর মুখ খানি, সখি তোর মুখখানি,
বুকে তোর মুখ চাপি, কেন, সখি, কেন
সহসা উচ্ছ্বসি কাঁদি উঠিলিরে হেন?” ♥
(-ভগ্নহৃদয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

আরো কিছুক্ষন পর বিছানা থেকে উঠে দেখি ট্রেন দুলকি চালে ধীরে ধীরে চলছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে ভালোই কুয়াশা পড়েছে। কোন প্রদেশে আছি ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। বাইরে ঠান্ডা আর ভেতরের এসির কারনে বেশ শীত করছিলো। পুরো কামরাকে মনে হচ্ছিলো যেন এক লাশের ঘর। সবাই সাদা চাদর মুড়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছে। এ যেন ডিপ ফ্রিজের তাকে তাকে সাজানো লাশের সারি। বেশ ভুতূড়ে লাগছে দৃশ্যটা। অবশ্য লেখক মন নাকি সবকিছুকেই খুঁটিয়ে দেখে। খুব সাধারণ দৃশ্যও তাদের কাছে অসাধারণ লাগে। আমি ভালো লেখক নই, তবে ছোট্ট একটি লেখক মন আছে, এই যা…।

(চলবে… )

10 thoughts on “পর্যটকের ডায়েরীঃ ইন্ডিয়াতে টেনে ভ্রমণ (পর্ব ০২)

  1. পাঠক মন সবকিছুকেই খুঁটিয়ে দেখে এবং পড়ে। খুব সাধারণ দৃশ্যও তাদের কাছে অসাধারণ লাগে। আমি ভালো পাঠক নই, তবে ছোট্ট একটি পাঠক মন আছে, এই যা…।

    অতএব যা বুঝবার বুছে নিয়েছি মি. কামাল উদ্দিন মেহেদী। ধন্যবাদ। … চলুক। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif.gif

  2. ভারত ভ্রমণের এই অংশখানিও পড়লাম। ভালো প্রকাশ। ধন্যবাদ।

  3. দেখি তোর মুখ খানি, সখি তোর মুখখানি,
    বুকে তোর মুখ চাপি, কেন, সখি, কেন
    সহসা উচ্ছ্বসি কাঁদি উঠিলিরে হেন?” ♥

    রবীবাবু বেঁচে থাকলে বেদনাহত হতেন নাকি আনন্দিত হতেন জানি না। আমার তো মনে হয় খুশিই হতেন। ভালোবাসা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    1. হা হা। সুন্দর মন্তব্য

    1. পড়ার জন্যে ধন্যবাদ দিদি

  4. ভ্রমণে ট্রেন জার্নি পড়লাম ভাই। সরস উপস্থাপনা।

    1. সরসই মনে রস আনে

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।