বিভাগের আর্কাইভঃ ভ্রমণ

দেশ হতে মহাদেশে … সাগর হতে মহাসাগরে!

fft

সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া।
সামার ব্রেকের পর পুরো-দমে ক্লাস চলছে। প্রকৃতিতে শরতের আগমনী বার্তা। একদিকে পাতা ঝরছে, অন্যদিকে দিনগুলো ছোট হয়ে আসছে। তেমনি এক দিনে ডিন অফিস খবর দিল আরও ৫জন বাংলাদেশি আসছে আমাদের কলেজে। ইউক্রেইনের ঝাপারোজিয়া শহর হতে রেলে করে আসছে ওরা। ষ্টেশনে কলেজের বাস যাচ্ছে ওদের আনতে। আমাদের কেউ যাবে কিনা জানতে চাইলে আমি রাজি হয়ে গেলাম।

ষ্টেশনেই পরিচয় ওদের পাঁচজনের সাথে। এই পরিচয় একে একে গড়াবে অনেক বছর। পাড়ি দেবে অনেক পথ, অতিক্রম করবে অনেক দেশ মহাদেশ। এবং সম্পর্ক তুই তুকারিতে গড়িয়ে চিরদিনের জন্যে স্থায়ী হবে।

সে পাঁচজনেরই একজন। ৪ বছরের তিন বছর একই কলেজে একই ডর্মে থেকে এক সময় ছিটকে যাই। ৩ বছর [পর আবারও দেখা হয় সেন্ট পিটার্সবার্গে। আমি যে বছর মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি সে তখন কম্যুনিকেশনের উপর ডক্টরেট করছে।
এরপর দুজনের পথ দুদিকে গড়িয়ে যায়…

ভাগ্যচক্রে আবারও আমাদের দেখা হয়। এ যাত্রায় খোদ বাংলাদেশে। ও আমারই মত ইউরোপের লম্বা পর্ব শেষ করে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে এসেছে। নতুন পরিবেশ পরিস্থিতিতে বন্ধুত্বের শিকড় আরও লম্বা হয়।

প্রফেশনাল তাগিদে ও চলে যায় মধ্যপ্রাচ্যের আবু ধাবিতে। আমিও পাড়ি জমাই তাসমান পাড়ের দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। যোগাযোগ অনেকটাই ফিকে হয়ে আসে।

আমাদের চলমান জীবন যেন কোথাও যেন স্থায়ী হতে চায়না…ভাগ্য আমাকে নিয়ে আসে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এক সময় জানতে পারি সে সপরিবারে মাইগ্রেট করেছে কানাডায় এবং চাকরি নিয়ে চলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে।

গোলাকার পৃথিবীর কক্ষপথ ধরে আমরাও হাঁটছি। এবং সে পথ আমাকে একসময় টেনে আনে মেগা শহর নিউ ইয়র্কে। কোন এক সুন্দর সকালে ও হাজির হল আমার দরজায়। দরজা খুলতে বাঁধভাঙ্গা আবেগ এসে আমাদের নিয়ে গেল কৈশোরে। কত বছর পর দেখা! শুরু হল নতুন এক জীবন। ওখানে আগ হতে যোগাযোগের মধ্যমণি রহমান ছিল। তিন জনই কাজ করি। কর্মদিন সহ প্রায় প্রতিদিনই দেখা হত আমাদের। আড্ডা হত কুইন্সে আমার বাসায়। এভাবে কেটে যায় একে একে ৫টা বছর…

এবার আমার পালা। ওদের দুজনকে নিউ ইয়র্কে রেখে আমি চলে আসি আমেরিকার বুনো পশ্চিমে। মাঝে মধ্যে কথা হলেও দেখা হয়না।

অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট নবায়ন করতে যে যাত্রায় নিউ ইয়র্ক যেতে হয়েছিল। তখন মধ্যরাত। শান্ত হয়ে গেছে মেগা শহর নিউ ইয়র্ক। ফ্লাইট হতে বেরুতেই দেখি ওরা দুজন দাঁড়িয়ে আছে। আবারও দেখা, আবারও সেলিব্রেশন।

শেষপর্যন্ত সেও ছেড়ে যায় নিউ ইয়র্ক। এ যাত্রায় তার গন্তব্য ছিল সূর্যস্নাত ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের অর্লান্ডো। আগে হতেই বাড়ি কেনা ছিল, তাই গুছিয়ে নিতে অসুবিধা হয়নি।

রাত প্রায় ১১টার উপর। আমি জানি সে সকাল সকাল বিছানায় যায়। এ যাত্রায় কথা ছিল গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্যে বাইরে অপেক্ষা করবে। নিউ ইয়র্কের মতই ফ্লাইট হতে বেরিয়ে কিছুটা পথ আগাতে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। সেই আগের মত…যেমনটা ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গে, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সাউথ ডেভনে, নিউ ইয়র্কে।

তিনটা দিন হুট করেই পার হয়ে গেল। এ যাত্রায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে চষে বেড়ালাম ইউনিভার্সাল স্টুডিও, ডিজনি এনিমেল কিংডম, ড্রিম পার্ক সহ অনেক জায়গা। ডেইটনা বীচের আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে আসতেই মনে হল আমাদের বিদায়ের এটাই পারফেক্ট ভেন্যু। এটাই যেন আমাদের শেষ দেখা না হয় তেমন প্রতিজ্ঞা করেই বিদায় জানিয়েছি একে অপরকে। আমি জানি বেঁচে থাকলে আবারও দেখা হবে…কে জানে হয়ত আফ্রিকার কোন গহীন জঙ্গল অথবা দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনে।

প্রাকৃতিক ও পার্বত্য সৌন্দর্যের শহর তায়েফ

2809a

মরুভূমি ও পাহাড় পর্বতের দেশে এক খণ্ড প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মণ্ডিত নগরী তায়েফ। ফুল, ফল ও ফসলের সমারোহ সেখানে। ভ্রমণপিপাসু মানুষের মনের খোরাক ইতিহাস-ঐতিহ্যের নগরীও বটে। পবিত্র মক্কা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত শহর তায়েফ। এ শহর ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। চমৎকার সাজানো গোছানো একটি শহর। মক্কা থেকে তায়েফের রাস্তাগুলো পাহাড়ের বুক চিরে তৈরি করা। এক পাশে উঁচু পাহাড় অন্য পাশে শরীর হিম করা গভীর খাদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এ শহর দেখতে হাজিরা কিছুটা সময় বরাদ্দ রাখেন।

পাহাড় কেটে বানানো রাস্তাটি একমুখী। অনেক উপরে ওঠার প্রতিক্রিয়ায় গাড়ির ভেতরে নিঃশ্বাস নিতে কিছুটা কষ্ট হওয়ার পাশাপাশি, কান বন্ধ হয়ে যায় আপনা-আপনি। তায়েফের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যায়, ঝক্‌ঝকে নীল আকাশ। মরুর দেশে এমন নীল আকাশের কথা চিন্তা করা যায়? পাহাড় দেখে মানুষ কেন আপ্লুত হয়, সেটা তায়েফের পাহাড় না দেখলে জানা হত না। পাহাড়ের সৌন্দর্য আর আকাশের সত্যিকারের নীল এক সাথে দেখতে হলে তায়েফের আকাশ দেখতে হবে।

ওমরার হাজীগন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এখানে আসতে হয়। তাই আমরা সেভাবেই মাইক্রো ভাড়া করে মক্কা নগরের মিসফালাহর হিজরা মসজিদ এর সামনে থেকে রওয়ানা দিলাম। মক্কা নগরের নানান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও আধুনিক স্থাপত্য অতিক্রম করে আমাদের গাড়ি চলছে। বিশাল উচ্চতার পাহাড়, তবুও সে সব জায়গায় পাথরের পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে প্রশস্ত সড়ক ও টানেল। আরো রয়েছে দীর্ঘতম উড়াল সড়ক। সত্যিই অবাক করার মতো দূরদর্শী পরিকল্পনা। কোথাও কোথাও এমনও আছে, কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বসতি নেই। শুধুই ধু ধু মরুভূমি। প্রাণীকুলের মধ্যে উট আর দুম্বা। বৃক্ষ বলতে শুধুই বাবলা গাছ। একটা সময় আবহাওয়ার তারতম্যেই বুঝা গেল আমরা তায়েফের কাছাকাছি।

শুরু হলো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সড়ক। গাড়ি চকচকে পিচঢালা পথ ঘুরে ঘুরে শুধু উপরের দিকেই উঠছে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ৬৯ ফুট উচ্চতায় আমাদের উঠতে হচ্ছে। সড়কের পাশে নানা কারুকার্যময় স্থাপনা। আরো রয়েছে বিভিন্ন কটেজ, রিসোর্ট ও শিষাবার। গাড়ির জানালা দিয়ে নিচে ও উপরে তাকালে বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এটিকে তায়েফের রিং রোড বলা হয়ে থাকে। সড়ক দ্বীপে বানরের দল নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়ায়। চারপাশে নির্মল সবুজের হাতছানি। যা আমাদের জন্য মায়াবী পথে চমৎকার এক যাত্রা। অপার্থিব ঘোরের মাঝে মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যেই তায়েফ শহরে পৌঁছে যাই।

তায়েফ সৌদি আরবের মক্কা প্রদেশের একটি শহর এবং গভর্নরেট। ১,৮৭৯ মি (৬,১৬৫ ফু) উচ্চতায় হেজাজ পর্বতমালার ঢালে অবস্থিত। যেটি নিজেই সারাওয়াত পর্বতমালার অংশ। ২০২০ সালের হিসাব মতে আনুমানিক শহরটির জনসংখ্যা ৬৮৮,৬৯৩ জন যা এটিকে রাজ্যের ৬ষ্ঠ জনবহুল শহর করে তুলেছে।

কুরআনে সূরা আয্‌-যুখরুফ (৪৩) এর ৩১ নং আয়াতে তায়েফকে পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। শহরটি ৭ম শতাব্দীর প্রথম দিকে কোন এক সময়ে নবী মুহাম্মদ (সা.) পরিদর্শন করেছিলেন এবং বনু ছাকিফ গোত্র বসবাস করেছিল এবং এখনও তাদের বংশধরদেরেরা বসবাস করা হয়েছে। হেজাজের একটি অংশ হিসেবে। শহরটি তার ইতিহাস জুড়ে অনেক ক্ষমতার হস্তান্তর দেখেছে। সর্বশেষটি ১৯২৫ সালে হেজাজের সৌদি বিজয়ের সময় হয়েছিল।

শহরটিকে সৌদি আরবের অনানুষ্ঠানিক গ্রীষ্মকালীন রাজধানী বলা হয়। কারণ এখানে গ্রীষ্মকালে একটি মাঝারি আবহাওয়া বিরাজ করে। আরব উপদ্বীপের বেশিরভাগ অঞ্চল থেকে এখানে ভিন্ন। শহরটির অনেক পাহাড়ি রিসর্ট এবং মাঝারি জলবায়ুর কারণে পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা রয়েছে। আইকনিক হাইওয়ে ১৫ (তাইফ-আল-হাদা রোড) এর মাধ্যমে নিকটবর্তী অবলম্বন শহর আল-হাদার সাথে শহরটি সংযুক্ত। এটি হেজাজ অঞ্চলের বাকি অংশ থেকে আলাদা কারণ এটি একটি শহর যা সৌদি আরবের কৃষি উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং আঙ্গুর, ডালিম, ডুমুর, গোলাপ এবং মধু চাষের জন্য পরিচিত একটি কৃষি অঞ্চলের কেন্দ্রস্থল। ঐতিহ্যবাহী ‘ ইত্তার ‘ তৈরিতেও খুব সক্রিয় এবং স্থানীয়ভাবে তায়েফ গোলাপের শহর নামে পরিচিত। তায়েফ ঐতিহাসিক সওক ওকাজও আয়োজন করে। রাস্তার পাশেই বিশাল ফলের মার্কেট আমাদের নজরে পড়ল।
তায়েফ গভর্নরেট ১৫টি ছোট পৌরসভায় বিভক্ত যার রাজধানী তায়েফ। শহরের প্রশাসন উত্তর তায়েফ, পশ্চিম তায়েফ, পূর্ব তায়েফ, দক্ষিণ তায়েফ এবং নিউ তায়েফ নামে ৫টি পৌরসভা দ্বারা পরিচালিত হয়।
তায়েফ আরবি শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ পরিভ্রমণকারী, বিচরণকারী বা প্রদক্ষিণ এবং তা কাবার প্রদক্ষিণ প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়। বনু সাকিফ গোত্রের দ্বারা নির্মিত প্রাচীর যা শহরটি প্রদক্ষিণ করে আছে। সংক্ষেপে তায়েফ নগরীর আক্ষরিক অর্থ হল ঘেরা শহর।

দেখতে দেখতে গভীর অনুভূতিতে চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। কোলাহলহীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর। সড়কের পাশেই পার্ক, যেখানে সবুজের সমারোহ। আমাদের গাড়ি থামায় একটি বিশাল আকারের গেইটের সামনে। এটা হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: মসজিদ। এটিই তায়েফের কেন্দ্রীয় মসজিদ। খুবই দৃষ্টিনন্দন একটি মসজিদ। এর পাশেই প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: চির শায়িত অছেন। এখানে আমরা দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করি। মসজিদের ভিতরে ঠান্ডা পানি ও খেজুর খেলাম। বাহিরে এসে ফটো তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই।

প্রাচীনকাল থেকে মক্কা ও তায়েফবাসীর মাঝে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। হজরত আব্বাস (রা.) তায়েফের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। পরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)ও তায়েফের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যান। এখানে আরও অনেক সাহাবির কবর রয়েছে। মসজিদ সংলগ্ন একটি লাইব্রেরি আছে। সেটা অবশ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। তবে সেখানে প্রাচীন অনেক কিতাবের সংগ্রহ আছে। রয়েছে হজরত আব্বাস (রা.)-এর হাতের লেখা কোরআনের কপিসহ বিভিন্ন সময়ে পাথর ও কাগজে লিখিত কোরআনের প্রাচীন কপি।

এরপর গাড়ি আবারো এগিয়ে যায়। ড্রাইভার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দক্ষ গাইডের মতোই আন্তরিকতার সাথে পরিচিতি করাতে লাগলেন।

একে একে দেখলাম হজরত আলী রা: মসজিদ। প্যাঁচানো সিঁড়ির দেয়ালের কারুকার্য, যা দেখে পর্যটকেরা অবাক না হয়ে পারে না। শত শত বছর আগের নীর্মাণশৈলী মনকে ভাবুক করে তোলে। তারপর মসজিদে আদম (আ.)। আঙ্গুরের বাগানের পাশেই মসজিদটি। এরপর কথিত বুড়ির বাড়ি। জায়গাটি পাথর দিয়ে ঘেরা। তার পাশেই বড় বড় দু’টি পাথর। ছোট্ট পাথর দ্বারা আটকে আছে। হুজুর সা:-কে হত্যার উদ্দেশ্যে পাহাড় থেকে এই পাথরগুলো বুড়ি ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ পাকের কুদরতের মাধ্যমে তা প্রতিহত হয়। যা আজো সেভাবেই রয়েছে। পাহাড়ের পাদশেই রয়েছে হুজুর সা: মসজিদ। সঙ্গীরা কেউ কেউ মসজিদে দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করল।

ইতিহাসের পাতায় তায়েফ আরও নানা কারণে আলোচিত। এই তায়েফের বনি সাকিফ গোত্রে নবী করিম (সা.) দুধমাতা হজরত হালিমা সাদিয়ার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। এখন সেই বাড়ি-ঘরের কোনো চিহ্ন নেই। তারপরও একটি পাহাড়ের পাদদেশকে অনেকে হালিমার বাড়ি বলে সেখানে যেয়ে নামাজ পড়েন। পাশের পাহাড়টিতে নবী করিম (সা.) বকরি চড়িয়েছেন বলে মনে করে সেখান থেকে মাটি আনা, সেখানে যেয়ে গড়াগড়ি খাওয়া শুরু করেন লোকজন। সাম্প্রতিত বছরগুলোতে খুব বেশি ভিড় বেড়ে যাওয়ায় গত দুই বছর ধরে সেখানে যাওয়া বন্ধ।

তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণের পরিবর্তে নবীকে অত্যাচার ও নিগ্রহ করেছে। রক্তাক্ত অবস্থায় নবী করিম (সা.) যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে নাম মসজিদে আদ্দাস। আমাদের গাড়ি আরো সামনে আগাতে থাকে। ড্রাইভার গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে কথাও চালিয়ে যাচ্ছে। ‘এখানের মরুভূমি যেন মরূদ্যানে রূপান্তরিত হয়েছে। ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা’রাই সেই পাহাড়ের উপত্যকায় খণ্ড খণ্ড বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মরু উপত্যকার বিভিন্ন এলাকা আজ সবুজে সবুজময়। কোথাও উপত্যকার সমতলে, কোথাও আবার একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় চাষাবাদ হচ্ছে বাংলাদেশের শাকসবজি এবং ফলমূল। ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, গাজর, মূলা, বেগুন, পটল, খিরা আর ধনেপাতা। মাচার নিচে ঝুলে আছে চালকুমড়া, লাউ, ঝিঙার মতো লতানো সবজি। বাংলাদেশি কৃষকের উৎপাদিত শাক-সবজি চলে যাচ্ছে মক্কা থেকে জেদ্দা পর্যন্ত নানান শহরে।’ ড্রাইভার যে বিভিন্ন সময় এখানে আসে তার এক ভাইও এখানে থাকে সেই গল্পের গতিতে ঘুরতে থাকে গাড়ির চাকা ও তার হাতের স্টেয়ারিং।

তাপমাত্রা মক্কায় যখন ৪০-৪২ তখন তায়েফে মাত্র ২৫-২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তায়েফ শহরে রয়েছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তৈরি করা চমৎকার সব রিসোর্ট, পার্ক আর অবকাশ যাপন কেন্দ্র। পর্যটকদের আনন্দ দিতে রয়েছে পাহাড়ে ক্যাবল কারের ব্যবস্থা।

যে দিকে চোখ যায় দু’পাশে সবুজ বনানী, ফসলের ক্ষেত আর নানা আধুনিক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা।

তায়েফের ঐতিহাসিক স্থাপত্যে মুগ্ধ হয়ে ইতিহাসবিষয়ক স্কলার মোনা উসাইরি বলেছেন, ‘তায়েফের এ পাথুরে স্থাপত্যগুলোর ভেতরে ও বাইরের রঙিন নকশাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পুরুষরা যখন দুর্গের নির্মাণ কাজে ব্যস্ত থাকত, নারীরা দুর্গের ভেতরে ও বাইরে তখন নকশার কাজগুলো করত। দুর্গগুলোর দেয়ালে বিভিন্ন রঙিন নকশা তাদের কারু কর্মেরই প্রতিচ্ছবি। তায়েফের এ দুর্গগুলো আমার মন শীতল করেছে। ইতিহাসপ্রেমী যে কোনো পর্যটকের জন্যই তায়েফের এ ঐতিহাসিক প্রাচীন দুর্গ গুলো দর্শন করা উচিত বলে আমি মনে করছি।

আমরা মিকাত জিল মাহরাম থেকে উমরার নিয়ত করে দ্বিতীয় বারের মত ইহরাম পরিধান করে মক্কায় ফিরলাম । সেই সঙ্গে মনে আফসোস থেকে গেল, যদি আরো কিছুটা সময় থাকা যেত! এক দেখাতে কি আর মন ভরে। শুধু স্মৃতিপটে ভাল লাগার দাগ কেটে যায় আর কল্পনায় শ্রদ্ধাভরে ভেসে আসে প্রিয় নবী (স.) এর ত্যাগ ও কষ্টের দিনগুলোর কথা।

মোঃ সুমন মিয়া,
লেখক: গহীনে শব্দ (কাব্যগ্রন্থ)
সম্পাদক, চান্দিনা দর্পণ।

আরব সাগরের শুভ্র ঢেউয়ে কিছু সময়

ala

সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলে লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত তিহামাহ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর জেদ্দা। এটি মক্কা প্রদেশের সর্ববৃহৎ ও সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। লোহিত সাগরের উপর অবস্থিত সর্ববৃহৎ সমুদ্রবন্দর এই শহরেই অবস্থিত। ৪৩ লক্ষ জনসংখ্যা নিয়ে শহরটি সৌদি আরবের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র।

জেদ্দা হল মুসলিম উম্মাহর জন্য পবিত্রতম নগরী মক্কা ও মদিনা শহরের অন্যতম প্রবেশদ্বার। অর্থনৈতিক ভাবে জেদ্দা সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে তথ্য প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রাচ্যের লোকদের বিশ্বাস অনুসারে, ইভের সমাধি অর্থাৎ মা হাওয়া (আঃ) এর কবর, যাকে মানবতার আদি মাতা বলে মনে করা হয়। ১৯৭৫ সালে কিছু মুসলমান সেখানে প্রার্থনা করার কারণে সমাধিটি কংক্রিট দিয়ে সিল করে দেওয়া হয়েছিল।

বিশ্ব বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৩০ সালের দিকে তার বিশ্ব ভ্রমণের সময় জেদ্দা পরিদর্শন করেন। তিনি তার ডায়রিতে শহরের নাম “জিদ্দা” লিখেছিলেন। ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস এবং ব্রিটিশ সরকারের অন্যান্য শাখাগুলি পূর্বে “জেদ্দা” এর পুরানো বানান ব্যবহার করত, অন্যান্য ইংরেজি-ভাষী ব্যবহারের বিপরীতে, কিন্তু ২০০৭ সালে, এটি “জেদ্দা” বানান পরিবর্তিত হয়। টি.ই. লরেন্স মনে করেছিলেন যে ইংরেজিতে আরবি নামের যে কোনো প্রতিলিপি ইচ্ছাকৃত। তার বই, রেভল্ট ইন দ্য ডেজার্ট, জেদ্দা প্রথম পৃষ্ঠায় তিনটি ভিন্ন উপায়ে বানান করা হয়েছে। সরকারী সৌদি মানচিত্র এবং নথিতে, শহরের নাম “জেদ্দা” প্রতিলিপি করা হয়।

ওমরাহ্ শেষ করে আমরা আরব সাগর দেখার উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে জেদ্দা রওয়ানা দিলাম। একটি ট্যাক্সি ভাড়া নিলাম বাঙালী ড্রাইভার দেখে। বাড়ি কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম। পাঁচ বছর হলো এখানে সে এই পেশায় নিয়োজিত। এখানকার রাস্তাঘাট তার পরিচিত এবং এদেশের ভাষা ও আইন কানুন সম্পর্কেও ভাল অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছে। এখনও বিয়ে করেনি। এবার ছুটিতে গেলে বিয়ে করবে। আমরা তার ও তার পরিবারের গল্প শুনতে শুনতে সুউচ্চ দালান কোঠা, ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্য, সুদৃশ্য মনোরম আইল্যান্ড দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। একসময় দেখতে পেলাম ‘হাওয়া গেট’। তেমন কোন কারুকার্য নেই অথচ হালকা হলুদ রঙের হাওয়া গেট দেখতে অপরূপ। আদি মাতা হাওয়া (আঃ) এখান দিয়েই নাকি প্রবেশ করেছিলেন মক্কা নগরে। সেই স্মৃতিতে হাওয়া গেট। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পাওয়া গেল মা হাওয়া (আঃ) এর কবরস্থান। মা হাওয়া (আঃ) এর কবর জিয়ারত করলাম।

হাল্কা বিরতি নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। ড্রাইভার বয়সে নবীন হলেও তার চিন্তা ভাবনায় গভীরতা আছে। নানা বিষয়ে সে কথা বলছে। বিভিন্ন পর্যটন এলাকা, এই দেশে ইসলামী রীতিনীতি, বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হাজীদের ইতিকথা সহ অভিজ্ঞতার ভান্ডার থেকে বাংলা ভাষাভাষী লোকজন পেলেই প্রাণ উজার করে গল্প করে। এই দেশে বাংলাদেশীদের অবস্থান, সৌদিদের বাংলাদেশীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, মাইগ্রেশন ও এ্যাম্বাসীর কার্যক্রম, এদেশে শ্রমিকদের অবস্থা সহ নানা বিষয়ে আমাদের সাথে গল্প আড্ডায় যোগ দিল। সে ভাল একজন গাইড হিসাবেও কাজ করছে। এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন হোটেল, পার্ক, হেরেম শরীফ, রাস্তায় পরিচ্ছন্ন কর্মী ও এই গরম উচ্চ তাপমাত্রায় কনস্ট্রাকশন থেকে শুরু করে সকল প্রকার নিচু পোষ্টে এমন কোন কাজ নেই যে বাঙালিরা করে না। কথার ফাঁকে এক সময় বললো বাংলাদেশ থেকে মেয়েরা যাতে এদেশে গৃহকর্মী হয়ে না আসে সেজন্য তারা মিটিং-মিছিল করেছে। কারণ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, মিসরের অবস্থা হলে বাংলাদেশের মান থাকবে না।

কারুকার্যময় সব স্থাপনা আরবদের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন আমলের দ্রব্যাদি সড়কদ্বীপের মাঝখানে সুদৃশ্যভাবে সাজানো আছে। সুরাই, চিকন কাঁধ যুক্ত মোটা পেটের হাঁড়ি কাত হয়ে শুয়ে যেন আরাম করছে। মহাসড়কের দু’দিকেই মনোরম দৃশ্যরাজি। কোনটার চেয়ে কোনটা কম নয়। একটি টানেল পাড় হতে হলো। ইসলামিক ঐতিহ্যের কৌনিক আর্টে সাজানো দু’পাশের দেয়াল। ওভার ব্রীজ গুলোতে আলো জমকালো আরবি অক্ষরে বিভিন্ন বাণী লেখা থাকে।

সাজানো গোছানো প্রশস্ত রাস্তাঘাট, ওভারপাস ও রাসুল (সঃ) এর স্মৃতি বিজড়িত এই পবিত্রভূমি; ভাবতেই অবারিত মুগ্ধতায় চোখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠছে। গাড়ি থেকে দৃষ্টি বাহিরে যেতেই একটি দৃশ্য খুবই অপূর্ব লাগলো। সৌদি আরবের বিশাল আকৃতির জাতীয় পতাকা বাতাসে ঢেউ খেলে উড়ছে। মধ্যখানে যে তরবারি ওটি বাতাসের দোলে এমন দেখাচ্ছ যেন সাগরের কোন অচেনা প্রাণী সাঁতার কেটে এগিয়ে চলেছে। কানে এলো সাগরের গর্জন আর বাতাসের শাঁ শাঁ শব্দ। মক্কার তুলনায় এখানের তাপমাত্রা অনেকটা কম। জানালার গ্লাসটা নামিয়ে দিলাম।

চলতে চলতে সামনে যেতে হাতের বামে চোখে পড়লো সাগর। এটিই সেই আরব সাগর। যার কথা শুনেছি গানে, গল্পে, কবিতায়। মরমী কবি লিখেছেন ‘আরব-সাগর-পাড়ি-দেব-নাইকো-আমার-কড়ি, পাখি-নইক-উড়ে-যাবো-ডানাতে-ভর-করি।’ কাজী নজরুল ইসলাম আরব সাগরের মনোহরণ বর্ণনা দিয়েছেন ‘বাঁধন হারা’ পত্রউপন্যাসে। ‘তোমার পানির সাথে লইয়া যাও রে আমার চোখের পানি, লইয়া যাওরে এই নিরাশার দীর্ঘ নিশ্বাস খানি।’ অনুরোধ কবিতা – কাজী নজরুল ইসলাম ।

আরব সাগরের জেদ্দা পাড়ও গাছপালা শূন্য। ভেবেছিলাম আমাদের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর মত বালুকাময় হবে কিংবা বিস্তৃত কোন খোলা জায়গায় ঢেউ এসে আচড়ে পড়বে পায়ের কাছে। আবেগে নেমে পড়ব ঢেউয়ের মোহনায় আর উল্লাসে মাতব। আসলে তা নয়। হয়তো ভঙ্গুর সাগর তীরে সেজন্যই বড় বড় পাথর ফেলে আছড়ে পড়া ঢেউ আটকে রাখা হয়েছে। যেখানে সাগর এগিয়ে, পিছিয়ে গেছে সেখানে পাথুরে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারণ ছিমছাম সাগর তীর দেখতে ভালই লাগে। পাশেই পায়ে হাঁটার পাকা রাস্তা। মাঝে মাঝে আফ্রিকান মহিলারা নানারকম খেলনা সামগ্রী নিয়ে বসে আছেন। পর্যটকরা হেঁটে হেঁটে পথ পেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ গাড়ি।

মনে হয় সাগর ভরা মাছ। আঁশটে গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। পানি কিছুটা কালচে মনে হলেও দুধের মত শুভ্রতা মাথায় মেখে ঢেউ ছুটে এসে তীরে আঘাত করে। ঢেউ-এর সাথে আসে ছোট মাছ, পাথরের উপর উঠে যেন নাচতে থাকে। অপূর্ব যে ঢেউ-এর নাচন-জলকণা উড়ে এসে বৃষ্টির মত ভিজিয়ে দেয় পাথরের উপরে বসে থাকা কাকড়া গুলোকে। পাথরগুলো কালো ও বেশ শেওলা জমে আছে।

এই অনবদ্য দৃশ্য আরো কাছ থেকে অনুভব করতে তীর থেকে সাগরের পানির মধ্যে পিলার দিয়ে রাস্তার মত করা হয়েছে। অনেকে সেখানে দাঁড়িয়ে গায়ে মাখছে সাগর জলের ঝাপটা বাতাস। আমরা নিজেদেরকে উজার করে ভাসিয়ে দিলাম বাতাসে। ফটো সেশন করলাম ফাঁকে ফাঁকে।

কক্সবাজারে সাগরে নেমে আমরা যেমন জলকেলিতে বিভোর হই এখানে তেমন দৃশ্য নেই। যে যার মত বসে বসে আড্ডায় মগ্ন।

সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমরা সাগর তীরে হাঁটছি। সামনে একটি মসজিদ দেখা যাচ্ছে। এ মসজিদও অর্ধেক মাটিতে অর্থাৎ সাগর তীরে বাকি অর্ধেক সাগর বক্ষে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। দেখলাম বঙ্গোপসাগরে যেমন রং ছড়াতে ছড়াতে সূর্য ডিমের আকার ধারণ করে সহসা ঝুপ করে ডুব দেয় সাগরে। এখানে রঙের ছড়াছড়ি তেমন নেই। সামান্য হলুদ আভা পানিতে দোল খেলে যায়। জাহাজ নেই, নৌকা নেই, কিছু নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। ঢেউয়ের প্রতিফলন। সাগরপাড়ে এমন চমৎকার সুউচ্চ বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে যে, তার উপরে হেলিকপ্টার পর্যন্ত নামতে পারে। মাঝে মাঝে সাগরের পানি আটকে কৃত্রিম জলাধার বানানো হয়েছে, সৌন্দর্য বাড়াতে দেয়া হয়েছে বাদশাহজাদির সাজ।

সাগর পাড়ের মসজিদে নামাজ পড়ে বাইরে এসে দেখি আরব সাগর আলোক সজ্জায় সজ্জিত হয়ে রানীর গরিমায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো দিনের চেয়েও তার রাতের রূপ কম না। একেক সাজে একেক সৌন্দর্য্য।
সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে একেবারে ঢালুতে সাগরের কাছাকাছি এক পর্যটক পরিবার বসে আছে, মুগ্ধ নয়নে দেখছে আরব সাগরের অপরূপ রূপ।

রাস্তার পাশেই আল-বাইক; সেখানকার জনপ্রিয় খাবারের রেস্তরা। আমরা সেখান থেকে খাবার মেন্যু দেখে কিছু খাবার নিয়ে পাশেই শানে বাঁধানো টুলে বসলাম। আমাদের সাথে আছে ড্রাইভারও। সে বল্ল আমাদের দেশের মত এখানে পানিতে কেউ নামতে পারে না। আর চারপাশে রেলিং দেওয়ার কারন; এখানে মেয়ে ছেলেরাও পানিতে নেমে পড়বে। উলঙ্গ হবে। তাই পানিতে নামা নিষেধ। ইদানিং ওয়েস্টার্ন কালচারে বেড়ে উঠা সৌদি মেয়েরা আপত্তিকর পোশাকে এখানে আসে। সরকার নারীদের জন্য অনেক আইন শীতিল করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে আরো কি যে হয়! আস্তাগ ফিরুল্লাহ্। আল্লাহ ভাল জানেন।

সন্ধা ঘনিয়ে আসছে। এবার ফেরার পালা। নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে মুগ্ধ দেহ ও মন নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম এবং ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করলো মক্কার উদ্দেশ্যে। কিসে যেন সুক্ষ্ন পিছুটান অনুভব হলো বুকের কোণে। গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। যেতে যেতে দূর থেকে চোখে পড়ল মক্কা টাওয়ারের মায়াবি সবুজ আলো । ধ্রুবতারার মত হাতছানি দিয়ে যেন কাছে ডাকছে। কন্ঠে আনমনেই বেজে উঠছে সেই ধ্বনি- লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক।

2822a

মোঃ সুমন মিয়া, লেখক- গহীনে শব্দ (কাব্যগ্রন্থ)
সম্পাদক- চান্দিনা দর্পণ।

3 - Kadam Rasul Dorga (10)

ঝটিকা সফরে নারায়ণগঞ্জ – কদম রসুল দরগাহ

গত বছর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৪ তারিখে গিয়েছিলাম নারায়ণগঞ্জ সফরে। সদস্য আমরা এক পরিবারের চারজন। উদ্দেশ্য ছিল নারায়ণগঞ্জের কিছু প্রাচীন ও দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা। সেই উদ্দেশ্যে আমরা সকাল সকাল বেরিয়ে যাই বাড়ি থেকে। বাড্ডা থেকে আসমানী পরিবহনের বাসে ১ ঘণ্টায় চলে আসি মদনপুর চৌরাস্তায়। রাস্তা পার হয়ে সকালের নাস্তা করে নিয়ে একটা সিএনজি অটোরিকশা রিজার্ভ করি ৩০০ টাকায় গোটা আটেক স্থানে যাবো বলে।

প্রথম লক্ষ্য ছিল বন্দর মসজিদ (মিলের মসজিদ) বলে একটি পুরনো ৩ গম্বুজ মসজিদ দেখার। কিন্তু সেটি খুঁজে বের করতে না পেরে চলে যাই কাছাকাছি থাকা ১নং ঢাকেশ্বরী দেব মন্দিরে। মন্দিরটি দেখে আমরা চলে আসি নারায়ণগঞ্জের নবীগঞ্জে অবস্থিত T Hossain House এর সামনে। শত বছররে পুরনো কিন্তু এখনো ঝকঝকে চমৎকার বাড়িটি দেখে আমরা চলে আসি “কদম রসুল দরগা”।

নারায়ণগঞ্জের একটি চমৎকার যায়গা হচ্ছে কদম রসুল দরগা। নারায়ণগঞ্জ শহরের বিপরীত দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে নবীগঞ্জে অবস্থিত কদম রসুল দরগাহ। চমৎকার এই দরগাহটিতে রয়েছে আশ্চর্য একটি জিনিস। কথিত আছে এখানে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর কদম মোবারকের ছাপ সংবলিত একটি পাথর রয়েছে। এর জন্যই দরগাহ এর নামকরণ হয়েছে কদম রসুল দরগাহ। একটি সুউচ্চ স্থানে কদম রসুল দরগাহ অবস্থিত।

এখানে দেখতে পাবেন বিশাল উঁচু একটি প্রবেশ তোড়ন। চমৎকার কারুকাজ করা সুন্দর সুউচ্চ এই স্থাপনা দেখে মনে হবে একটি সুন্দর মসজিদ বা দরগা। আসলে এটি একটি প্রবেশ তোড়ন। অনেকগুলি সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে আপনাকে উঠতে হবে উপরে। এই তোড়নটি মোটামুটি পাঁচতালা দালানের উচ্চতার সমান। সিঁড়ি দিয়ে উঠার আগে জুতা খুলে হাতে নিয়ে নিতে ভুলবেন না।

তোড়ন পার হয়ে ভিতরে ঢুকে দেখবেন উত্তর দিকে রয়েছে একটি মসজিদ আর দক্ষিণ দিকে আছে একটি কবরস্থান যেখানে রয়েছে ১৭টি পাকা কবর। এই দুইয়ের মাঝে আছে ছোট্ট একটি সাদা শ্বেতপাথরের এক গম্বুজ বিশিষ্ট মাজার। এখানেই রয়েছে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর কদম মোবারকের ছাপ সংবলিত পাথরটি। বড়সড় একটি খড়ম আকৃতির কালো পাথর এটি। আগে সব সময়ই দেখতে চাইলে দেখাতো কিন্তু এখন নির্দিষ্ট কিছু দিনেই শুধু কাচের বাক্স থেকে বের করে দেখায়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর কদম মোবারকের ছাপ। অবশ্য সত্যিই এটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর কদম মোবারকের ছাপ কিনা সেটা নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। আমাদের আলোচ্য বিষয় সেটি নয়। বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার। এখানে এই পাথরটি গোলাপজল মিশ্রিত পানির মধ্যে চুবিয়ে রাখা হয়, আর দর্শনার্থীদের একটি গ্লাসে করে সেই পানিয় পান করতে দেয়া হয়।

আগেই বলেছি মাজারের পাশে রয়েছে কবরস্থান। কবরস্থানের ভিতরে রয়েছে বিশাল বড় কেটি কাঠ গোলাপের গাছ। সেই কাঠগোলাপের গাছের একটি ডালে মহিলারা আজমির শরীফের লাল-হলুদ সুতা বাধেন কোন মানত করে। অনেক সুতা বাঁধা আছে, আরোও বাঁধা চলছে। কোন একটা মনোবাসনা পূরণের নিয়ত করে এই সুতো বাঁধা হয়। তাদের বিশ্বাস এতে করে তাদের সেই মনোবাসনা পূরণ হয়ে যাবে। কত বিচিত্র মানুষের মন।

মনে রাখবেন, আরবি সনের ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখ থেকে ১৫দিন ব্যাপী বিশাল এক মেলা বসে এখানে। এই কদম রসুল দরগার কাছেই আরেকটি মাজার রয়েছে, যেটি হানিফ চিস্তির মাজার নামে পরিচিত।

কথিত আছে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মেরাজের রাত্রে বোরাকে উঠবার সময় বেশকিছু পাথরে তার পায়ের ছাপ পরে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত পাথরটি আছে জেরুজালেমে। তাছাড়া আর কিছু পাথর রয়েছে ইস্তাম্বুল, কায়রো এবং দামেস্কতেও। আমাদের বাংলাদেশেও এমন দুটি পাথর রয়েছে, যার একটি আছে চট্টগ্রামে আর অপরটি রয়েছে নবীগঞ্জ কদম রসুল দরগায়।

মির্জা নাথান ১৭শ শতকে রচিত তার বিখ্যাত “বাহির-স্থানই গায়েবী” বইটিতে সর্বপ্রথম নবীগঞ্জের এই পাথরটির কথা উল্লেখ করেন। সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী আফগান সেনাপ্রধান মাসুম খান কাবুলি, পদচিহ্ন সংবলিত এ পাথরটি একজন আরব বণিকের কাছ থেকে কিনেছিলেন। তার অনেক পরে ঢাকার জমিদার গোলাম নবী ১৭৭৭-১৭৭৮ সালে নবীগঞ্জের একটি উঁচু স্থানে একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট দরগা নির্মাণ করে সেখানে পবিত্র সেই পাথরটি স্থাপন করেন। পরে কদম রসুল দরগার প্রধান ফটকটি গোলাম নবীর ছেলে গোলাম মুহাম্মদ ১৮০৫-১৮০৬ সালে নির্মাণ করেন।

সতর্কতাঃ
১। দরগার সামনের রাস্তায় অনেকেই দোকান সাজিয়ে বসেছে আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল, আতর, সুতা ইত্যাদি নিয়ে। চাইলে আপনি সেখান থেকে কিনতে পারেন, তবে কিনতেই হবে বা দরগায় এগুলি আপনাকে দিতেই হবে তা কিন্তু নয়।
২। জুতা খুলে মাজারে প্রবেশ করতে হয়।
৩। জুতা খুলে অবশ্যই হাতে করে নিয়ে যাবেন। বাইরে রেখে গেলে ফিরে এসে নাও পেতে পারেন।তবে এখন জুতা রাখার জন্য আলাদা ঘর ও লোক রাখা হয়েছে।
৪। ভেতরে প্রকাশ্য গঞ্জিকা সেবন হয়ে থাকে কখনো সখনো, মেলাতে অবশ্যই। তাই অপরিচিতদের সাথে না মেশাটাই ভালো সেখানে। বর্তমানে গঞ্জিকা সেবন কমেছে।
৫। কোন খাদেম বা অন্য কাউকে পাত্তা দেয়ার দরকার নেই, নিজের মত করে দেখে চলে আসুন। যায়গাটা নিরাপদ, অন্যান্য মাজারের মত টাউট বাটপারের ছড়াছড়ি নেই। তবুও সাবধান থাকতে কোন দোষ নেই।


দরগাহের সামনেই আছে কয়েকটি পুরনো বাড়ি।


দরগাহের সিঁড়িতে আমার দুই কন্যা।

জিপিএস কোঅর্ডিনেশন : 23°37’49.3″N 90°31’11.9″E

পথের হদিস : ঢাকা থেকে বাসে মদনপুর, মদনপুর থেকে শেয়ার সিএনজি বা ইজি বাইকে কদম রসুল দরগাহ এর সামনে।
তাছাড়া বাস বা ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে নৌকায় নদী পার হয়ে রিকসা নিয়ে চলে আসা যায় কদম রসুল দরগায়।

KB-01- 00 - Copy

ঐতিহ্য সফর : আড়াইহাজার ও সোনারগাঁ

২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের ২৮ তারিখ শুক্রবার ফেসবুক গ্রুপ Save the Heritages of Bangladesh তাদের ২৫তম ইভেন্ট পরিচালনা করছিলো। অন্য সব সদস্যদের সাথে আমি আমার বড় কন্যা সাইয়ারাও ঐদিন অংশ নিয়েছিলাম ডে ট্যুরে আড়াইহাজার ও সোনারগাঁয়ের কিছু প্রাচীন জমিদার বাড়ি, মন্দির, মঠ, মসজিদ ঘুরে দেখার জন্য। এখানে বলে রাখা ভালো এই ট্যুর গুলিতে শুধু প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যগুলি দেখার তালিকায় স্থান পায়। ঐতিহ্য সফরের ঐদিনে আমরা যে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যগুলি দেখেছিলাম তা হচ্ছে –

১। বালিয়াপাড়া জমিদার বাড়ি – আড়াইহাজার

২। বালিয়াপাড়া জমিদার বাড়ির পিছনে অন্য একটি বাড়ি

৩। বালিয়াপাড়া জমিদার বাড়ির কাছেই অন্য একটি প্রাচীন বাড়ি

৪। পালপাড়া মঠ – আড়াইহাজার

৫। বীরেন্দ্র রায় চৌধুরী জমিদার বাড়ি – আড়াইহাজার

৬। মহজমপুর শাহী মসজিদ – সোনারগাঁ

৭। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম – বারদী

৮। জ্যোতি বসুর বাড়ি – বারদী

৯। পথের ধারে নাম না জানা মঠ – সোনারগাঁ

১০। ঠাকুর বাড়ি যাবার পথে ছোট মঠ – সোনারগাঁ

১১। ঠাকুর বাড়ি – সোনারগাঁ

১২। ঠাকুর বাড়ি মঠ – সোনারগাঁ

১৩। দুলালপুর পুল – সোনারগাঁ

১৪। পানাম নগর – সোনারগাঁ

১৫। সর্দার বাড়ি – শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর

১৬। গোয়ালদি মসজিদ – সোনারগাঁ

১৭। আব্দুল হামিদ মসজিদ – সোনারগাঁ

আগামীতে আবার দেখা হবে অন্য কোন অঞ্চলের প্রাচীন কোন স্থাপত্যের সামনে।

সফর সংঙ্গী সকলে

1pirate - Copy

বান্দরবান ভ্রমণ – শৈলপ্রপাত

২৫ তারিখ রাতে ঢাকা থেকে ““খাগড়াছড়ির পথে…”” রওনা হয়ে ২৬ তারিখ সকালে পৌছাই খাগড়াছড়িতে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে রেস্ট নিয়ে আমাদের “খাগড়াছড়ি ভ্রমণ – শুরু” হয় “আলুটিলা গুহা” দিয়ে। আলুটিলা গুহা দেখে আমরা চলে যাই রিছাং ঝর্ণা দেখতে। ঝর্ণা দেখা শেষে আমরা যাই প্রাচীন শতবর্ষী বটবৃক্ষ দেখতে। সেদিনের মত শেষ স্পট ছিল আমাদের ঝুলন্ত সেতু দেখা।

পরদিন ২৭ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি থেকে রাঙ্গামাটির দিকে রওনা হই একটি চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করে। পথে থেমে দেখে নিই “অপরাজিতা বৌদ্ধ বিহার”। ২৭ তারিখ দুপুরের পরে পৌছাই রাঙ্গামাটি। বিকেল আর সন্ধ্যাটা কাটে বোটে করে কাপ্তাই লেক দিয়ে “সুভলং ঝর্ণা” ঘুরে।

২৮ তারিখ সকাল থেকে একে একে দেখে এলাম ঝুলন্ত সেতু, রাজবাড়ি ও রাজবন বিহার। দুপুরের পরে বাসে করে রওনা হয়ে যাই রাঙ্গামাটি থেকে বান্দারবানের উদ্দেশ্যে। রাতটা কাটে বান্দরবানে।

পরদিন ২৯ তারিখ সকালে একটি জিপ ভাড়া করে নিয়ে চলে যাই নীলগিরিতে। নীলগিরিতে অনেকটা সময় কাটিয়ে রওনা হই ফেরার পথে “শৈলপ্রপাত” দেখবো বলে।

নীলগিরি থেকে “শৈলপ্রপাত” যাওয়ার পথে সামনে পরবে চিম্বুক পাহার
এক সময় ধরা হতো বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম পাহাড় এই চিম্বুক। বান্দরবান শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরের চিম্বুক পাহাড় সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৫০০শ ফুট উঁচু। এখানে গিয়েছি আগে কয়েকবার তাই এবার আর কষ্ট করে উপরে সবাই উঠবো না ঠিক করেছি। শুধু স্বপন একা চিম্বুকের চুম্বক আকর্ষণে উপরে একটা ঢু মেরে আসে। এই ফাকে আমরা চিম্বুকের নিচে থাকা পাহাড়ি পেঁপে আর মালটা কিনে খেয়ে আবার রওনা হয়ে যাই। এবার থামবো বান্দরবান শহর থেকে সাড়ে ৭ কিলোমিটার দূরের শৈলপ্রপাতের সামনে। শৈলপ্রপাতটি একেবারেই পথের ধারে।


রাস্তার পাশেই আছে পর্যটকদের জন্য বিশ্রামাগার বা বসার ছাউনি, সেখান থেকে অনেক ধাপের সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে প্রপাতের ধারে।

বর্ষায় এই শৈলপ্রপাতের রূপ অপরূপ হয়ে ওঠে, বিশাল জলধারা ছটে চলে প্রচণ্ড গতিতে। সেই সময় এর কাছে যাওয়াটা কষ্টসাধ্য ও ভয়ংকর। পুরটা দেখার সুযোগই থাকে না তখন। পাথর থাকে মারাত্মক পিচ্ছিল, একটু এদিক-ওদিক হলেই পা পিছলে আলুর দম হতে হবে তখন।

আমরা যে সময় গিয়েছি (জানুয়ারি মাসে) তখন প্রপাতে জলের ধারা ক্ষিণ, অল্প জল পাথরের উপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ পাথরই শুকনো তাই অনায়াসেই তার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়।

প্রপাতের নিচের অংশের সমনেই একটা চওড়া ঢালু অংশ আছে, জল জমে আছে সেখানে। জলে না নামতে চাইলে এই অংশ টুকু লাফিয়ে পার হওয়া ছাড়া কোন উপায় নাই (মেয়েদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব)। শীতের সময় বলে আমরা এই অংশটুকু দেখতে পেলাম, বর্ষায় এর ধারে কাছেও যাওয়া যাবে না। শীতকাল হওয়াতে শৈলপ্রপাতের পুরটা হেঁটে দেখে আসতে পারলাম আমরা।

প্রপাতের শেষ অংশে এসে বেশ কয়েক ফুট নিচে জল গড়িয়ে গিয়ে একটি মাঝারি আকারের পুকুরের মত হয়েছে, সেখান থেকে জল চলে যাচ্ছে পাহাড়ি ছড়া বা খাল হয়ে।

এই প্রপাতের জলই আশপাশের পাহাড়ি গ্রামগুলির একমাত্র জলের উৎস, এই জলই ওরা পান করে, আবার এই জলেই চলে অন্যান্য সমস্ত কাজ‌ও।

প্রপাতের উপরে রাস্তার পাশে পাহাড়িরা তাদের নিজেদের হাতে তৈরি নানা সামগ্রীর পশরা নিয়ে বসেছে পর্যটকদের জন্য, আর আছে নিজেদের উৎপাদিত ফল আর ফসলের আসরও। চাইলেই কিনে নিতে পারেন, তবে অবশ্যই দরদাম করে।

ওরা যে আনারস বলবে মধুর মত মিষ্টি সেটা আপনি মুখেরও দিতে পারবেন না, আর যে মালটা বা কমলা বলবে চিনির মত মিষ্টি সেটা খেলে আপনার মাথার উকুনগুলি মাথা থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করবে। তবে ভালো পাকা পেঁপে আর কলা খেতে পারেন নিশ্চিন্তে।

আগামী পর্বে দেখা হবে নীলাচলে।

গুমটু ভুটানে ঘুরাঘুরির গল্প

একবার আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে ভারত গিয়েছিলাম। সময়টা তখন ১৯৯৩ ইংরেজি ১৪০০ বঙ্গাব্দ। গিয়েছিলাম মস্ত বড় আশা নিয়ে। কিন্তু মনের সেই আশা আর পূরণ হয়নি। খামোখা দেড়বছর নিজের পরিবারবর্গ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরেছিলাম। লাভের মধ্যে ভাল হয়েছিল আমার বড়দি’র বাড়ি যেতে পেরেছিলাম। আমার বড়দি’র বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া।

বীরপাড়া হলো কোলকাতা থেকে শিলিগুড়ি হয়ে মিজোরাম যাওয়ার পথিমধ্যে। বীরপাড়া ভুটানের পাহাড় ঘেঁষা চা-বাগানের লীলাভূমি জনবহুল একটা জায়গার নাম। আর আমার বড়দি’র বাড়ি হলো, বীরপাড়া এলাকায় রাবিন্দ্র নগর কলোনি। কোলকাতা থেকে বড়দি’র বাড়ি বীরপাড়া গিয়েছিলাম খুবই বিপদে পড়ে। এমনই এক বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম যে, তখন আমার বড়দি’র বাড়িই ছিলো একমাত্র ভরসা। কিন্তু বড়দি’র বাড়ি ছিলো আমার অচেনা। তবে আমার মনে খুবই সাহস ছিলো, মনের বিশ্বাস ছিলো, একভাবে-না-একভাবে আমি আমার বড়দি’র বাড়ি অবশ্যই খুঁজে বের করতে পারবো।

মনের সেই বিশ্বাস নিয়েই একদিন কোলকাতা ধর্মতলা থেকে উত্তরবঙ্গের রকেট বাসের টিকেট নিলাম। তারপর উত্তরবঙ্গের রকেট বাসে চড়ে প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর বীর পাড়ার মাটিতে পা রেখেছিলাম। যদিও কোলকাতা গিয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর সাথে, কিন্তু কোলকাতা থেকে আমার বড়দি’র বাড়ি গিয়েছিলাম আমি একা। তবে জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া জায়গাটি ছিলো আমার একেবারেই অপরিচিত অচেনা জায়গা।

তার উপর আবার আন্তর্জাতিক আইনের চোখে আমি ছিলাম পাসপোর্ট বিহীন এক অপরাধী। তবুও আমার মনের ভেতরে একটু ঢর-ভয় বলতে ছিলো না। আমি বাস থেকে বীরপাড়া নেমেই বীরদর্পে একটা মিষ্টির চলে গেলাম। মিষ্টির দোকান থেকে ৪ কেজি মিষ্টি কিনলাম। এরপর একটা রিকশা চেপে সোজা বীরপাড়া রাবিন্দ্র নগর কলোনি বড়দি’র বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। প্রথমে আমার বড়দি আমাকে চিনতে পারছিলো না। বাবা’র নাম, মা’র নাম, বড়দা’র নাম বলার পরই আমাকে চিনতে পেরেছিলো।

যাইহোক, যেদিন বড়দি’র বাড়ি গিয়েছিলাম, সেদিন আর ঘুরা-ঘুরি করার সময় হাতে ছিলো না। শুধু বড় ভাগিনার সাথে বীরপাড়া বাজার দেখতে গিয়েছিলাম। বড় ভাগিনা’র সাথে বীরপাড়া বাজারটি ঘুরে দেখার সময়ই ভুটান যাবার জীপস্ট্যান্ড দেখলাম। যখন ভুটান যাবার জীপ গাড়িগুলোর হেলপাররা ভুটান ভুটান বলে বলে চিল্লা-চিল্লি করছিলো, তখন আমার মনটা আর মানাতে পারছিলাম না। কিন্তু তখন ভুটান যাবার সুযোগও ছিলো না। কারণ, তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। তাই মনের আকাঙ্খা মনে চেপে ধরে বড় ভাগিনা’র সাথে বীড়পাড়া বাজারটির এদিক-সেদিক ঘুরে অনেক রাতে দিদি’র বাড়ি পৌঁছে ছিলাম। রাতে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমানোর জন্য শুয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু সারারাত আর চোখে ঘুম আসেনি। চোখ বন্ধ করলেই দেখতাম ভুটান যাওয়ার জীপ গাড়ির হেলপাররা যেন আমাকে ডাকছিল। এভাবে ছটফট করতে করতে একসময় ঠিকই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠেই মনস্তাপ করেছিলাম ভুটান যাওয়ার। কারণ বাংলাদেশ থেকে শুধু ভুটানের নামই শুনেছিলাম। কিন্তু একসময় যে ভুটানের এতো সামনা-সামনি চলে আসবো, তা কোনদিন কল্পনাও করিনি। তাই ভাবছিলাম, “যেভাবেই হোক, আর যেমন করেই হোক, আমি এখন ভুটানের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। ভুটানের এতো সামনে যখন চলেই এসেছি, তাহলে হেলায় সুযোগ হারাতে আমি রাজি নই! যেভাবেই হোক, আর যে করেই হোক ভুটান আমাকে যেতেই হবে। যদি ভুটানের ভেতরে না যেতে পারি, তাহলে তো আমার ভারত আসাই একরকম মাটি হয়ে যাবে।”

এই ভেবেই সাতসকালে নাস্তা করেই কারোর কাছে কিছু না বলে ভুটানের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম। তখন আমার সাথে ভারতীয় তিন-চার শো টাকার মতো অবশিষ্ট ছিলো। এই তিন-চার শো টাকা কিন্তু বাংলাদেশি টাকার মতো সস্তা দরের টাকা নয়! ওই টাকা ছিলো ভারতীয় মূল্যবান টাকা। তা-ও আবার প্রায় চারশো টাকার মতো! সব টাকা সাথে করে বড়দি’র বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেলাম বীরপাড়া বাজারের শেষপ্রান্তে, যেখানে থেকে জীপ গাড়িগুলো ভুটানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সময় তখন সকাল ৯ টার মতো।

আমি বীরপাড়া বাজারে গিয়ে একটা চা’র দোকানে গিয়ে বসলাম। চা- দোকানটা হলো বাজারের শেষ মাথায়, বীরপাড়া ভুটান জিপস্ট্যান্ডের সাথেই। চা-দোকানদারকে এক কাপ চা দিতে বললাম। চা-দোকানদার আমাকে চা বানিয়ে দিলো। আমি দোকানের বাইরে থাকা টেবিলের উপরে বসে বসে চা-পান করছিলাম, আর ভুটান যাওয়ার জীপ গাড়িগুলো ফলো করছিলাম।

জীপ গাড়িগুলো আমাদের দেশের টেম্পো’র মতো। একটা জীপ গাড়িতে ১০ জন করে যাত্রী বহন করে। আমি চা পান করতে করতেই একটা জীপগাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে গুমটু গুমটু বলে ডাকা-ডাকি করতে লাগলো। জীপের ভেতরে যাত্রী ছিলো অর্ধেকের মতো। ওখানে টাইম-বাই-টাইম ঘড়ির কাটা ধরেই যেকোনো যাত্রীবাহী যানবাহনগুলো চলাচল করে। টাইম হবে তো গাড়ি স্ট্যান্ড ত্যাগ করবেই। এতে যাত্রী কম হলেও হায়-আফসোস করার সুযোগ নেই। কম যাত্রী নিয়েই গাড়ি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। সেসময় বীর পাড়া বাজার থেকে গুমটু ভুটানের ভাড়া ছিলো মাত্র ৩ টাকা। বীরপাড়া থেকে ভুটান গুমটু ভুটানের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার মাত্র।

আমি তাড়া-তাড়ি করে চা’র দাম দিয়ে জীপ গাড়ির সামনে গেলাম। নিজের পকেটে হাত দিয়ে টাকার সংখ্যা দেখে নিলাম। দেখলাম, “আমার পকেটে অবশিষ্ট যা আছে, তা দিয়ে সুন্দর ঘুরা-ঘুরি হয়ে যাবে।”

এই ভেবেই মনে সাহস রেখে কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা জীপের ভেতরে গিয়ে বসলাম। প্রত্যেক জিপে ১০ জন করে যাত্রী বহন করলেও, আমি যেই জিপে করে যাচ্ছিলাম সেই জিপে আমি সহ যাত্রী হলাম সাত জন। পাঁচজন ভুটানি মহিলা। আর একজন পুরুষ যাত্রী। পুরুষ যাত্রী বীরপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা। যাবে ভারত-ভুটান সীমান্ত গেইট ঘেঁষা মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরে পুজো দিতে।

মাকড়া পাড়া হলো ভারত-ভুটান বর্ডার এলাকার জায়গার নাম। মাকড়া পাড়া ভারতের। আর ভুটানের ভেতরের জায়গাটার নাম হলো গুমটু। মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরে প্রতিদিন বীরপাড়ার আশপাশ থেকে অনেক মানুষ পূজা দিতে যায়। আমার সাথে বসা যাত্রী ভদ্রলোকটিও মাকড়া পাড়া পূজা দিতেই সেখানে যাচ্ছিল।

চলন্ত জিপে বসেই লোকটি শুধু আমার দিকেই বেশি তাকাচ্ছিল। লোকটার হাতে কয়েক রকম ফল-ফুল, আর একটা ঝুড়ি। জীপের ভেতরে থাকতেই তিনি আমাকে কি যেন বলবে বলবে ভাব! কিন্তু কিছুই বলার সুযোগ পাচ্ছিল না।

জীপগাড়ি চলছে উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে। রাস্তার দুই পাশে বন-জঙ্গল। মাঝেমধ্যে চা বাগান। এর ফাঁকে-ফাঁকে নেপালি শরণার্থীদের ঘরবাড়ি। নেপালিরা ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় শরণার্থী হয়েই থাকে। ওদের কোনও ভারতীয় নাগরিকত্ব নেই। যেই রাস্তা দিয়ে জিপ গাড়ি যাচ্ছিল, সেই রাস্তার দু-পাশেই গহীন বন-জঙ্গল। সেই বনে বন্য হাতিও আছে। ওই হাতিগুলো সবসময় দল বেঁধে চলে। এক বন থেকে আরেক বনে যাবার সময় রাস্তা পার হয়ে যেতে হয়। তখন যানবাহনগুলো দূরে থামিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখে। যাতে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হাতির কানে না যায়।

কারণ, সময় সময় গাড়ির শব্দে বন্য হাতিগুলো ভীষণ ক্ষেপে যায়। আর ক্ষেপে গেলেই ঘটে বিপদ। রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা পথচারীরা কখনো কখনো এসব বন্যহাতির কবলে পড়ে আহত নিহতও হয়। তাই বীরপাড়া টু গুমটু রোডে চলাচলকারী যানবাহনের ড্রাইভাররাও দেখে-শুনে গাড়ি চালায়। যাতে কোন প্রকার দুর্ঘটনা না ঘটে। বীরপাড়া থেকে ভুটান গুমটু যেতে সময় লাগে মাত্র ৩০ মিনিট। পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম গুমটু।

জীপ থেকে নামার পর যাত্রী পুরুষ লোকটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার বাড়ি কোথায়? কোথায় এসেছেন? কার বাড়ি? কোথায় যাবেন?’ লোকটির প্রশ্ন করা প্রতিটি কথারই ঠিক-ঠিক জবাব দিয়েছিলাম। তখন লোকটা আমার জামাইবাবু ও ভাগিনাদের চিনতে পেরেছিলো, আর আমি যে তাদেরই অতিথি সেটাও স্বীকার করে বললো, ‘আহারে দাদা, আমার হাতে সময় নেই। যদি সময় থাকতো, তাহলে আমি নিজের আমার সাথে করে গুমটু এলাকাটা আপনাকে নিয়ে ঘুরতাম।’ এই বলেই জীপের হেলপারকে ডেকে বললো, ‘এই লোকটাকে ভুটানের ভেতরে নিয়ে যাবে। তিনি আমাদের অতিথি। বাংলাদেশ থেকে এসেছে। উনার ভুটান দেখার খুব শখ! তাই এখানে এসেছে। তোমরা লোকটাকে একটু সাহায্য করবে।’

ড্রাইভার-হেলপার দুইজনেই বললো, ‘ভুটানের ভেতরে যেতে কারোরই পারমিশন লাগে না, দাদা। উনিও যাবে। কোনও সমস্যা হবে না! আপনি নিশ্চিত থাকুন। তারপরও আমরাতো আছি-ই।’ এই বলেই জীপের ড্রাইভার হেলপার আমার সাথের যাত্রী ভদ্রলোকটিকে বিদায় করলো। বীরপাড়া থেকে আসা সব যাত্রীদের ভাড়া আদায় করা হলো। তারপর ড্রাইভার-হেলপার দুইজন আমাকে সাথে নিয়ে ভুটানের ভেতরে যাওয়ার সুবিশাল গেইটের দিকে যেতে লাগলো।

ভারত-ভুটান কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখানে সুবিশাল একটা গেইট। চেকপোস্ট ছিলো। সীমান্তরক্ষী বাহিনীও ছিলো। সীমান্ত গেইটে দুইজন করে ভুটানি সীমান্ত রক্ষীবাহিনী থাকে। কে আসলো, কে গেলো তার দিকে তাদের কোনও নজর নেই। নজর থাকে তখন, যখন একটা গাড়ি ভেতরে বা বাইরে যাবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গেইট জনসাধারণের জন্য খোলা থাকে। রাতের বেলা বিশেষ কোনও জরুরি কাজে ভেতর-বাইরে যেতে পারমিশন প্রয়োজন হয়।

জিপ গাড়ির চালকের সাথে যখন সীমান্ত গেইট পাড় হচ্ছিলাম, ভয়ে তখন আমার শরীর কাঁপতে শুরু করলো। ভয়ের কারণ ছিলো, “যদি সীমান্তরক্ষী আমাকে ডাক দেয়, আর যদি পাসপোর্ট চায়, যদি আমাকে আটকে রাখে?” কিন্তু না, ওরা আমাদের দিকে একটু ফিরেও তাকায়নি। আরামে চলে গেলাম ভুটান গুমটুর ভেতরে। কী সুন্দর জায়গা! মন চায় রাস্তার মাঝখানে শুয়ে থাকি। খুবই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গা! শীতের দেশ ভুটান।

ভুটানিরা বারো মাস একরকম গরম জামা-কাপড় ব্যবহার করে। বারো মাসই ভুটানের আবহাওয়া একইরকম থাকে। তবে বৃষ্টির কোনও মৌসুম না থাকলেও মাঝেমধ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিতে ওরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কারণ, পাহাড়ি জমিগুলো পানির জন্য সবসময় খাঁ খাঁ করে তাই। ওরা বছরে দুই-একবার গোসল করে। ভুটানের বেশিরভাগ মানুষেই মদ্যপায়ী। মানে সবসময়ই মদপান করে থাকে। শুনেছি মদপান নাকি ওদের শরীর গরম রাখার একটা পন্থা।

ভুটানের গুমটুতে একটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। সেটা ভারত-ভুটানের যৌথভাবে নির্মাণ করা। বিশাল জায়গা নিয়ে ওই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। গুমটুতে পাথরের অভাব নেই। গুমটুর আশে-পাশে যতোগুলো পাহাড় আছে, সব পাহাড়ই পাথরের পাহাড়। পাথর নাকি এসব পাহাড়ে জন্ম হয়। সামান্য বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধ্বসে অনেক পাথর বের হয়। ঐ পাথরগুলোই সিমেন্ট ফ্যাক্টরির কাজে লাগায়। গুমটুতে সপ্তাহে একদিন হাট বসে। এটা গুমটু এলাকাবাসীর স্থানীয় সাপ্তাহিক হাট।

ওই হাটে বীর পাড়ার অনেক ব্যবসায়ীও অনেকরকম পণ্যসামগ্রী নিয়ে বিক্রি করে। একটা সিনেমা হলও আছে। সিনেমা হলটির নাম, ঔঁ (ওম) সিনেমা। ওই সিনেমাহলে ভারতীয় ছায়াছবি বেশি প্রদর্শিত হয়। ভুটানের নিজস্ব চলচ্চিত্রও আছে। তবে ওরা ভারতীয় চলচ্চিত্রই বেশি পছন্দ করে থাকে। গুমটুতে একটা বৌদ্ধমন্দির আছে। মন্দিরটি একটা পাহাড়ের চূড়ায়। অনেক উঁচু পাহাড়। তবে মন্দিরে ট্যাক্সি বা অন্য গাড়ি চড়েও যাওয়া যায়।

পুরো পাহাড়টা তিনটে প্যাঁচ দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। যাতে প্রাইভেট ছোট আকারের গাড়িগুলো মন্দিরের উপরে অনায়াসে উঠতে পারে, আর মানুষও আরামে পায়ে হেঁটে উঠতে পারে। বৌদ্ধমন্দিরটাও খুবই সুন্দর। মনোরম পরিবেশ। হেঁটে-হেঁটে পুরো মন্দিরের চারপাশ দেখলাম। বৌদ্ধমন্দিরের উপর থেকে এদিক-ওদিক তাকালেই চোখে পড়ে উঁচু-নিচু অসংখ্য পাহাড়। কোনও সড়ক মহাসড়ক দেখলাম না, নেইও। তবে একটা রেলস্টেশন আছে, যা দেখার মতো সুন্দর! এখানকার অধিবাসীরা দূর-দূরান্তের দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দেয় গাধার সাহায্য নিয়ে। ওইসব পাহাড়ি এলাকায় মালামাল বহন করা হয় একমাত্র গাধা দিয়েই। গাধাই ওদের মালামাল বহনের একমাত্র বাহন।

বৌদ্ধমন্দির থেকে যখন দূরে দৃষ্টি গেলো, তখন মনটা চাচ্ছিল, চলে যাই অজানার দেশে। কিন্তু যাওয়া আর হলো না। নিজের সন্তানাদির কথা ভেবে। নিজের ছেলে-মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে অনেক সময় পার করে দিলাম বৌদ্ধম মন্দিরের সামনে বসেই। একসময় দুপুরের সময় পেরিয়ে গেলো। দিদি’র বাড়ি ফিরে যাবার সময় হলো। তবুও গুমটু ছেড়ে বীর পাড়া যেতে মন চাচ্ছিল না। মন চাচ্ছিল ওখানেই থেকে যেতে।

বলে রাখা ভালো যে, ভুটান গুমটু এলাকায় আমি কিন্তু কয়েক ঘণ্টা ঘোরাফেরা করেছিলাম। কিন্তু কেউ আমাকে কিছুই বলেনি, কেউ কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি। এমনকি বৌদ্ধ মন্দিরে থাকা লোকজনও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বৌদ্ধ মন্দিরে অনেকক্ষণ ঘুরা-ফেরা করার পর বৌদ্ধমন্দির থেকে পায়ে হেঁটে নিচে নামলাম। আবার গেলাম গুমটু টাউনে।

আসলে আমার চোখে ভুটানের গুমটু এলাকা টাউন নয়। কিন্তু ভুটানিদের কাছে এটা তাদের খুব পছন্দের একটা মিনি টাউন। অনেক ভুটানি গুমটুকে গুমটু টাউনও বলে। ওম সিনেমা হলের সামনে একটা হোটেল ছিলো। হোটেলটি ছিলো খুবই পরিপাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সেসময় সেই হোটেলে ভাত-মাছ-সহ চা বিস্কুটও পাওয়া যেতো।

গুমটু জনশূন্য এলাকা হলেও, রাত ৮টা পর্যন্ত ওই হোটেলটি খোলা থাকতো। সিমেন্ট ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা ওই হোটেলেই বেশি সময় কাটাতো। সিমেন্ট ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা চা পান করা-সহ দুপুরবেলার খাওয়া-দাওয়াও ওই হোটেই করতো। কেউ কেউ রাতের খাওয়াও সেরে নিতো। হোটেলে তিন-চারজন কর্মচারী ছিলো। আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম, তখন দেখেছিলাম সব কর্মচারীই ছিলো ভুটানি মেয়ে।

হোটেলের সামনে সারিবদ্ধভাবে চেয়ার-টেবিল বসানো ছিলো। আমি সামনে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে আকার-ইঙ্গিতে চা-বিস্কুটের কথা ববলেছিলাম। পাঁচ মিনিট পরই মেয়েটা একটা প্লেটে করে দুটো বিস্কুট এনে দিলো, সাথে এক গ্লাস পানি। একটু পরে চা-ও এনে দিলো। চা পান করে হাতের আঙুল ঘেঁসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত?’ বললো, ‘দো রুপেয়া ৬০ পয়সা।’

চা বিস্কুটের দাম দিয়ে চলে এলাম ভারত-ভুটান সীমান্ত গেইটের সামনে। সময় তখন দুপুর পেরিয়ে বিকাল হতে চলছিল। সীমান্ত গেইটের বাইরে দেখলাম একটা জিপগাড়ি। ড্রাইভার হেলপার গুমটুর ভেতরেই ছিলো মনে হয়। হয়তো দুপুরের খাবার খেতে গিয়েছিলো। ড্রাইভার হেলপার কখন আসবে, আর কখন গাড়ি ছাড়বে কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারছিলাম না। জিপ গাড়ির সামনে-পেছনে কোনও মানুষও ছিলো না। এমনিতে জনশূন্য এলাকা। আবার দুপুরবেলা। অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরা-ফেরা করতে করতে ড্রাইভার হেলপার হেলে-দুলে গাড়ির সামনে আসলো।

সীমান্ত ঘেঁষা ভারতের ভেতরে কোনও দোকানপাট ছিলো না। ছিলো বনজঙ্গল আর চা বাগান। কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে হলে দাঁড়িয়ে থেকেই অপেক্ষা করতে হবে। না হয় মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরে গিয়ে সময় কাটাতে হবে। ড্রাইভার হেলপার জীপের সামনে এসে যাত্রীর খোঁজে যাচ্ছিল, মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরের দিকে। ওদের যাওয়া দেখে আমিও পেছন-পেছন হাঁটতে ছিলাম।

মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরটিও একটা পাহাড়ের চূড়ায়। খুবই সুন্দর! অনেক বড় জায়গা নিয়ে মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছে। কে-বা কারা এই উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় মন্দিরটি তৈরি করেছিল, তা জানা হয়নি। এ-বিষয়ে কাউকে জিজ্ঞাসাও করিনি। ড্রাইভার হেলপারের পেছনে পেছনে কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে দেখে চলে এলাম জীপের সামনে। বীর পাড়ার যাত্রী নেই। সেদিন সেসময় হয়তো ওদের বীরপাড়ায় জরুরি কাজ ছিলো। তাই ওরা আমাকে নিয়েই গাড়ি ছেড়ে দিলো। চলে গেলাম বীরপাড়া। বীরপাড়া নেমে একটা রিকশা নিয়ে চলে গেলাম দিদির বাড়ি। এর কয়েকদিন পর আবার ভুটানের আরেকটা জায়গায় দিয়েছিলাম। জায়গাটার নাম ফুলসিলিং। ফুলসিলিং জায়গাটিও দেখার মতো।

ছবি গুগল থেকে।

Breaking Bad শহরের জীবন

Breaking Bad শহরের জীবন

পৃথিবীর অনেক দেশের অনেক শহর নিয়ে লিখেছি। পাঠকদের সাথে শেয়ার করেছি নগর জীবনের অভিজ্ঞতা। সে তালিকায় যেমন আছে তারুণ্যের দীর্ঘ ১২ বছর কাটানো রুশ দেশের সেন্ট পিটার্সবার্গ, তেমনি আছে পাঁচ বছরের সিডনীর জীবন যুদ্ধ। নিউ ইয়র্কের ছয় বছরই ছিল ভার্চুয়াল দুনিয়ায় স্থায়ী হওয়ার লগ্ন। এ লগ্নেই পাঠকদের পরিচিত করেছি অধুনা বিশ্বের অর্থনৈতিক রাজধানী হিসাবে পরিচিত এ শহরের সাথে। কথার ফাঁকে ফাঁকে নিয়ে গেছি এন্ডিসের দেশ পেরু, বলিভিয়া, কলোম্বিয়া ও ইকুয়েডোরে। কিন্তু গেল ১২ বছর ধরে যে শহরটায় আছি তার দিকে ভাল করে চোখে ফেরানো হয়নি।

আলবুকেরকে, নিউ মেক্সিকো, ইউএসএ। ২০০৭ সালে প্রথম যখন এ শহরটায় পা রাখি মনে হয়েছিল রাজধানী ঢাকা হতে কর্ম উপলক্ষে নওগাঁয় চলে যাওয়ার মত। নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে নওগাঁর প্রথম রাতটা ছিল ঝড় তুফানের রাত। শহরের যে হোটেলটায় ঠাঁই নিয়েছিলাম সারা রাত মনে হয়েছিল তা কাঁপছে এবং যে কোন মুহূর্তে উড়াল দেবে। অবশ্য তেমন কিছু হয়নি। এক সময় পোটলা পুটলি গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হই আরও গভীরে। শেষ গন্তব্য পত্নীতলা, ধামুইরহাট এবং বদলগাছি। জন্মভূমিকে কাছ দেখার ও আবিষ্কার করার এ ছিল সোনালী ২টা বছর।

হিসাবে ভুল হওয়ায় হঠাৎ করেই নিউ ইয়র্ক শহরে নিজকে আবিষ্কার করি বেকার হিসাবে। যদিও তা ছিল জাস্ট ফর ব্রীফ পেরিয়ড অব টাইম। কিন্তু সেই যে মন উঠে গিয়েছিল তা আর ঠিকমত জোড়া লাগেনি। প্রফেশন বদলে পা রাড়ালাম টেলিকমের দিকে। শুরুটা টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের সান আন্তোনিও হলেও ফুল স্কেলে তা প্রস্ফুটিত হয়ে মিউ মেক্সিকোতে।

আলবুকেরকে। শহরের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রান্সিসকো ফার্নান্দেজ দ্যা কুয়েভা দ্যা ডিউক অব আলবুকেরকের নামে নাম রাখা হয় শহরের। স্প্যানিশদের দখল হতেই উত্থান এ শহরের। মার্কিন-মেক্সিকো যুদ্ধের শেষদিকে এ অঞ্চলটা কেড়ে নিয়ে মার্কিনীরা তাদের ইউনিয়নে যুক্ত করে এবং নাম দেয় নোয়াভো মেহিকো। অর্থাৎ নিউ মেক্সিকো। হিস্পানিকদের সংখ্যা এ রাজ্যে আমেরিকার যে কোন রাজ্যের চাইতে বেশী। স্প্যানিশ ভাষার ব্যবহার এখানে সার্বজনীন। অন্যদিকে আলাস্কার পর সংখ্যায় আদিবাসী আমেরিকানদের বাস। মরু এই এলাকা আমেরিকার হিংস্র পশ্চিমের অংশ। জীবন এখানে খুব একটা সহজ নয়। বেচে থাকার জন্যে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়। একদিক রুক্ষ প্রকৃতি, অন্যদিকে সামাজিক সমস্যা। তার অন্যতম হচ্ছে প্রতিবেশী মেক্সিকো হতে পালিয়ে আসা অবৈধ অভিবাসীরা। এবং স্বভাবতই ড্রাগ।

যতটা না প্রকৃতি অথবা রাজনীতি, শহর আলবুকেরকে বেশী পরিচিত করেছে ওয়ালটার হোয়াইট’এর নাম ভূমিকা সহ সফল মার্কিন টিভি সিরিজ ব্রেকিং ব্যাড। ২০০৮ হতে ১৩ পর্যন্ত এই টিভি সিরিজ অনেক ঘরে মার্কিনীদের দম আটকে রাখতো এর ঘটনা প্রবাহ দিয়ে। আমার অফিসটা তখন ডাউন-টাউনে। পাঁচতলার জানালা হতে লক্ষ্য করলে প্রায়ই দেখতাম নীচের রাস্তায় শুটিং হচ্ছে। অফিসের ঠিক উলটো দিকে অবস্থিত পুলিশ ষ্টেশনটাকে নিয়মিত ব্যবহার করা হতো সিরিজের পুলিশ অফিস হিসাবে। পাশের ক্যাফেটেরিয়া, রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন জাঙ্ক ফুডের দোকান, কোন কিছুই বাদ যায়নি তালিকা হতে। গোটা আমেরিকার মত এই পাঁচ বছর আমার শহরও মেতে থাকতো ব্রেকিং ব্যাড’এর এপিসোড নিয়ে। এ টিভি সিরিজ আলবুকেরকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক পরিচিতি। এমনকি বাংলাদেশেও আলবুকেরকে অনেকের কাছে এখন পরিচিত একটি নাম।

মরিচের বিশ্ব-রাজধানী হিসাবে ধরা হয় নিউ মেক্সিকোকে। এখানে শিশু বয়স হতে মানুষ ঝাল খাওয়া অভ্যাস করে। মরিচ হচ্ছে অঙ্গরাজ্যের সিম্বল। অবৈধ মেক্সিকান অভিবাসীদের জন্যে এ অঙ্গরাজ্য অভয়ারণ্য। আইন-আদালতের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এ অঙ্গরাজ্যে লুকিয়ে থাকা তাদের জন্যে কোন সমস্যা নয়। অনেকক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারও তাতে উৎসাহ দেয়।

আমার গন্তব্য-হীন চলমান জীবনের অনিশ্চয়তা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। ব্যাপক কোন পরিবর্তন না হলে এ শহরেই বোধহয় কাটাতে হবে জীবনের বাকিটা সময়। মেগা শহরের জীবন নিয়ে আর কোন আগ্রহ নেই। এখন জানালা খুললে চোখে পরে বিশাল আকাশ। তার নীল নীল রঙ। মরু এলাকার উত্তপ্ত বাতাস এসে দোল খায় ঘরের আঙ্গিনায়। এসব ভাল না লেগেই যায়না। দূরের সান্দিয়া পাহাড় আর আদিবাসীদের জীবনের সাথে কখন একাত্ম হয়ে গেছি টেরই পাইনি।

ফিলিস্তিনিদের গল্প … ৩


দামেস্কাস গেইট এবং আমি।

ভারতীয় চরিত্রের এইদিকটা অনেকের মত আমাকেও বিমোহিত করে। ওরা যেখানেই যায় তাদের বেনিয়া-বৃত্তি সাথে নিয়ে যায়। অনেকটা সুঁই হয়ে ঢুকে সাপ হয়ে বের হওয়ার মত। দৃঢ় বিশ্বাস ইসরায়েল হচ্ছে তাদের বাণিজ্য-লক্ষ্মীর নয়া দিগন্ত। তেল আবিব এয়ারপোর্টে নেমেই ব্যপারটা আঁচ করা যায়। ইমিগ্রেশন পার হওয়ার সময় পাশের বুথে একজন ভারতীয়কে প্রশ্ন করছিল ইসরায়েলই অফিসার। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল সে তেল আবিব ইউনিভার্সিটির ছাত্র এবং ছুটি কাটিয়ে ইসরায়েলে ফিরছে। দেখতে কোষ্ঠকাঠিন্য রুগীর মত হলেও ভারতীয় এই ছাত্রের সাথে কথা বলার সময় মনে হলো অফিসারের সুখ তেলতেলেয়ে মাটিতে পড়ছে। পুরানো জেরুজালেমের মুসলিম কোয়ার্টারে চোখে পরার মতে বিদেশী বলতে ভারতীয়রাই। গায়ে গতরে অগোছালো সাউথ ইন্ডিনিয়ানরাই সংখ্যায় বেশী। সংখ্যায় পশ্চিমা বিশ্বের রাস্তাঘাটে কিলবিল করার মত না হলেও সন্দেহ নেই ইসরায়েলও এদের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ একটা সময় যখন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো তাদের দুয়ার বিদেশী শ্রমিকদের জন্যে উন্মুক্ত করছিল একই ভারত তার দেশের মুসলিম জনসংখ্যাকে পুঁজি বানিয়ে ব্যাপক সুবিধা নিয়েছিল। পাশাপাশি ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক খারাপের অভিনয় করে আরব রাজা-বাদশাহদের আস্থা অর্জন করেছিল।

পৃথিবী এখন বদলে গেছে। ফিলিস্তিনি সমস্যা অনেক পশ্চিমা দেশের মত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জন্যেও এখন কোন সমস্যা নয়। এতদ অঞ্চলের রাজা-বাদশারা এখন ইসরায়েলের জিগরই দোস্ত। ওরা দেশে-বিদেশে একই পুঁজির যৌথ বিনিয়োগকারী। রাজধানী তেল আবিব আর বন্দর নগরী হাইফা হচ্ছে মদ আর পূর্ব ইউরোপীয় নারী ভোগের লীলাভূমি। ওরা আসে এবং সাথে নিয়ে আসে বস্তা-ভর্তি পেট্রো ডলার। সূরা আর সাকির আসরে বৃষ্টির মত ডলারে সিক্ত করে নারী দেহ। এখানেই ভারতীয়দের পার্থক্য। ওরাও আসে, তবে খরচের মানসে নয়, বরং টু-পাইস কামানোর ধান্ধায়। নিউজিল্যান্ডের গভীরে ছোট জনপদের শহরেও ওদের দেখা যায়। ডেইরি স্টোর বানিয়ে ব্যবসা করছে। অনেক দেশে একই বিনিয়োগ চলে কর্নার শপের নামে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে গুজরাটি ভারতীয়দের দখলে ফ্রীওয়ে সহ শহর-বন্দরের মোটেল ব্যবসা।


এবং কতিপয় ভারতীয়।

ঢালু ও পিচ্ছিল পাথরের রাস্তায় এহেন ধাক্কা সামলে নিতে একটু কষ্টই হলো। সামলে উঠে দাঁড়াতেই দেখি একদল ভারতীয়। তাদের কেউ একজন আমাকে ধাক্কা দিয়েছে। ধাক্কাটা ইচ্ছাকৃত ছিলনা, কিন্তু এর তীব্রতাই বলে দেয় এলোমেলো ও বেসামাল গতিতে হাঁটছিল মহিলা। ওদের কেউ ফিরেও তাকাল না আমার দিকে। আমিও অবাক হইনি। কারণ ভুলের জন্যে ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি এখনো পৌঁছায়নি পৃথিবীর অনেক প্রান্তে। আমাদের উপমহাদেশ তার অন্যতম। ক্ষণিকের জন্যে রক্তের চাপ উছলে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলাম। নিজেকে বুঝালাম, আমি এখন এমন একটা দেশে যে দেশে আমার ধর্মীয় পরিচয় গায়ে গতরে এলোমেলো ভারতীয়দের চাইতে অনেক বেশী ভীতিকর। সাহায্য চাইলেই যে ইসরায়েলই পুলিশ দৌড়ে আসবে এমন সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। এসব মেনে নিয়েই উঠে দাঁড়ালাম এবং ভাণ করলাম যেন কিছুই হয়নি। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করে খুব অবাক হলাম, ওরা ফুটপাথের উপর বসা ভেন্ডরদের কাছ হতে সবজি কিনছে। প্রমাণ করার জন্যে এটাই ছিল যথেষ্ট, ওরা আমার মত পর্যটক নয়। হয়ত জেরুজালেমেই বাস করছে। নিশ্চয় কাজ বলে কিছু একটা করছে এখানে। জানার কৌতূহলটা দমাতে পারলাম না। বেশকিছুটা পথ ওদের অনুসরণ করলাম। যেখানে থামছে, আমিও থামছি। উদ্বার করার চেষ্টা করলাম ওদের কথোপকথন। কিন্তু না, গুটিকয়েক হিন্দি শব্দ বাদে কথাবার্তার সবটাই ছিল দক্ষিণের ভাষায়। এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে মিশে গেলাম জনারণ্যে।


আর দশটা দিনের মত একটা দিন।

বেলা গড়াচ্ছিল। আজকের মেনুতে অন্য কোন শহরে ঢুঁ মারার পরিকল্পনা ছিলনা নিরাপত্তার কথা ভেবে। তবে ফিলিস্তিনি আরবদের ঢল নামা Suq Khan El Zeit রাস্তা দেখে তা বুঝার উপায় ছিলনা। জীবন এখানে আর দশটা দিনের মতই। লোকে লোকারণ্য। রাস্তায় দুই ধারে পশরা সাজিয়ে দোকানিরা গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন দোকান হতে ভেসে আসছে ভিন্ন রকমের গান। অনেক দোকানে বাজছে কুরানের আয়াত। এ রাস্তা যানবাহন চলাচলের জন্য নয়। তবে মালামাল পরিবহনের জন্যে ট্রাক্টর জাতীয় এক ধরণের ট্রাক সাপের মত একে-বেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে। জীবনের স্পন্দন অনুভব করতে এখানে কান পাততে হয়না। বরং এ স্পন্দন নিজেই চলে আসে কানের কাছে। শুধু চোখ আর কান দুটো একটু খোলা রাখতে হয়। পুরানো জেরুজালেমের রাস্তার এ জীবন কোনভাবেই দেয়ালের ওপারের ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতিফলন নয়। এখানে আছে ব্যস্ততা, উচ্ছলতা, আছে না পাওয়ার কষ্টকে ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ানোর সামর্থ্য। অধুনা ফিলিস্তিনের রাজধানী রামাল্লার চিত্রটা একটু ভিন্ন। ওখানে রাজত্ব করে দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা আর ইসরায়েলিদের প্রতি ঘৃণার আগুন। রামাল্লায় দেয়ালের লিখন পড়লেই আঁচ যায় ওদের বেঁচে থাকার গল্প। বাংলাদেশ হতে চোখ বেঁধে কাউকে পশ্চিম তীরে নামিয়ে দিলে প্রথমেই ভুল করবে এলাকাটা পুরানো ঢাকার কোন অংশ ভেবে। বিশেষ করে বিভক্ত দেয়াল পার হয়ে ফিলিস্তিনে পা রাখা দু’এক মাইলের মধ্যে। এর পর অবশ্য চিত্র কিছুটা হলেও বদলে যাবে। চোখে পড়বে উপরের দিকে ধাবমান স্কাই স্ক্রাপার। ঝকঝকে শপিং মল। বেশকিছু গাড়ির দোকান। যদিও এসবের উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের অনেকেই মূল ভূমির ইহুদি। রাস্তার ট্রাফিক অনেকটাই এলোমেলো। পথচারীরা অনেকটা ঢাকার ফ্রি স্টাইলে পার হচ্ছে।


দামেস্কাস গেইট।

দামাস্কাস গেইটে এসে পৌঁছলাম ঠিক মধ্য দুপুরে। জনশূন্য, অনেকটাই খা খা করছে সামনের স্কয়ার। হাতের ডানদিকে ছোট মত একটা ছাউনির নীচে বসা ইসরায়েলই পুলিশ কড়া নজর রাখছে চারদিকে। পুলিশদের বেশীর ভাগই যুবতী। লম্বায় অনেকটাই খাটো। দেখতে আকর্ষণীয়। প্রথম দেখায় হাতে ধরা অস্ত্রের হিংস্রতার চাইতে বেশী দৃষ্টি কাড়বে তাদের চেহারা ও গড়ন। চোখে মুখে উৎকণ্ঠা ও এক ধরণের বিষণ্ণতা। পূর্বাভাষ ছিল আজ এখানে গোলমাল হবে। ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদ করবে বিভক্ত দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে উঠা শতাধিক পাকাবাড়ি গুড়িয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে। পশ্চিম তীরে অনেকে বলেছিল, কে জানে, হয়ত আজই শুরু হতে পারে নতুন ইন্তেফাদার গোঁড়া পত্তন। মাঠের চিত্রে তার ছায়া মাত্র ছিলনা। সবকিছু ছিমছাম। চলাফেরার কিছুটা সতর্কতা। সামনের আ-ওয়াদ রোডে ব্যস্ততা বাড়ছে।


ফিলিস্তিনি জনগণ বনাম ইসিরায়েলি পুলিশ।

পাশের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে ড্রাইভাররা প্রতিদিনের মতই আড্ডা দিচ্ছে। অনেকে সিগারেট ফুঁকছ এবং চোখ রাখছে সম্ভাব্য যাত্রীর দিকে। গেইটের সামনেই কলোসিয়ামের মত গ্যালারি। ওখানে সব সময়ই টুরিস্টদের ভীর। আজ অবশ্য তেমন কাউকে দেখা গেলনা। মোবাইল ফোনের ক্যামেরাটা অন করে বসে পরলাম ফাঁকা একটা জায়গায়। আবারও একদল ভারতীয়। ওরা দলবেঁধে ঢুকছে মুসলিম কোয়ার্টারে। আরব কজন যুবক একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করতেই পুলিশ নেমে এলো ছাউনি হতে। হিব্রু ভাষায় কি বললো বুঝতে পারলাম না। তবে আন্দাজ করত পারলাম, এখানে যুবাদের জমায়েত আজ নিষিদ্ধ। ইচ্ছা থাকলেও সামনে যেতে সাহস করলাম না। ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরায়েলই পুলিশের সংঘর্ষ আমার মত অনেকের কাছে অপরিচিত নয়। আমরা যারা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের উপর দৈনিক পত্রিকা গুলোর হেডলাইন পড়ে বড় হয়েছি তাদের জানা আছে এর আদি ও অকৃত্রিম ইতিহাস।

২০ মিনিটের উপর খোলা আকাশের নীচে বসে থাকা সম্ভব হলোনা। সূর্যতাপের তীব্রতা ততক্ষণে সহনীয় সীমা অতিক্রম করে গেছে। সাথে বাতাসের আর্দ্রতা। শরীরের দিকে তাকাতেই খেয়াল হল, ঘামতে শুরু করেছি আমি। না, আজ আর এমনকিছু ঘটতে যাচ্ছেনা তা বুঝে নিলাম। হঠাৎ করেই রামাল্লায় আমার ট্যুর গাইড আবু আল নাসেরের কথা মনে পরল। জেরিকোর রেস্তোঁরায় বসে সে হর হর করে বলে যাচ্ছিল ফিলিস্তিনি কাহিনী। তার মতে পশ্চিম তীরের অনেককেই ইসরায়েলিরা কিনে নিয়েছে। এমনকি প্যালেষ্টাইনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে পর্যন্ত। ওদের দান-দক্ষিণার উপরই নাকি এরা বেঁচে থাকে। এ অভিযোগ হতে হানান আশরাফিকেও বাদ দেয় হলোনা। ফিলিস্তিনিদের প্রবাদ পুরুষ ইয়াসির আরাফাতের বিদেশী স্ত্রীর দিকেও আঙ্গুল তুলতে পিছপা হলোনা সে। যারা বিক্রি হতে অস্বীকার করে তাদেরই নাকি রাতের অন্ধকারে উঠিয়ে নেয়া হয়। তারপর নিখোঁজ হয়ে ঠাঁই নেয় ইতিহাসের পাতায়। আমি এদেশে এসেছি প্যালেস্টাইনের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে নয়। এই এসব চিন্তা মাথা হয়ে ঝেড়ে ফেলে ট্যুরের দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথায় যেন বাংলাদেশীয় রাজনীতির সাথে একটা সমান্তরাল খুঁজে পেলাম এখানে। কেবল ইসরায়েলের জায়গায় প্রতিবেশী ভারতে বসিয়ে দিলেই হিসাব মিলে যাবে।

বেলা বাড়ছিল। উঠে পরলাম এবং পাশেই ট্রাম ষ্টেশনের দিকে রওয়ানা দিলাম। গন্তব্য সেন্ট্রাল বাস ষ্টেশন। ওখান হতে গোলান হাইটসের দিকের বাস ধরার ইচ্ছা।

– চলবে।

ক্ষুদ্রের সমুদ্র দর্শন

ক্ষুদ্রের সমুদ্র দর্শন

সমুদ্রের কাছে গিয়ে জল না ছুঁয়ে ফিরে আসা কি পাপ! আমার তাই মনে হয়, সমুদ্রের কাছে গেলে ভীত হয়ে পড়ি, নিজের ক্ষুদ্রতার এমন উন্মুক্ত প্রকাশে শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়! বিশাল জলাধারের কাছে গিয়ে যদি অবজ্ঞা দেখাই, তার গা না ছুঁয়ে ফিরি, সারাজীবন অভিশপ্ত থেকে যাবো।

সুনীলের কবিতায় পড়েছিলাম সারাজীবন বয়ে বেড়ানো অভিশাপের কথা, সমুদ্রের গায়ে থুথু ফেলার দুর্দান্ত সাহস আমার কোনদিন হবে না তবু তাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে আমি বিন্দুমাত্র ফাঁক রাখতে রাজি না যদি অভিশাপ দিয়ে দেয়!

সমুদ্রের বিশালত্ব নিজের কাছে ফিরে যেতে সাহায্য করে। নিজেকে যাচাই করা যায়। প্রতিদিনের যে অহমিকা আমরা বয়ে বেড়াই, বুকের মাঝে দর্পের যে আগুন সারাক্ষণ পুড়িয়ে মারে তা দপ করে নিভে যায় সমুদ্রের ছোঁয়ায়। নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়, মনে হয় কত ক্ষুদ্র জীবন নিয়ে বাহাদুরি।

এক ফুঁকে নিভে যাওয়া জীবনের বাহাদুরি নিয়ে কিছু সময়ের জন্য সমুদ্র দর্শনে গিয়েছিলাম। আমার শহর থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরে ক্লির্থপ্স শহরে, সমুদ্র দেবী আজ সুপ্রসন্ন ছিলেন না। তার ভাটা চলছিল নিজের জলকে আড়াল করে তিনি রোদ্র পোহাচ্ছিলেন। ৪/৫ ঘন্টা অপেক্ষা করলে তিনি জলে পরিপূর্ণ হবেন। এতো সময় সময় আমাকে দিচ্ছে না। বড় লোকদের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা তারা সখ্যতা করে শুধু বড় লোকদের সাথে। সমুদ্র সূর্য, আকাশ, পাহাড়কে সখা ভাবে সব খাতিরদারি তাদের ঘিরেই। ক্ষুদ্রদের দেখেও দেখে না।

সমুদ্রে গিয়ে জলের দেখা না পাওয়া অসম্ভব না, জোয়ারভাটার খেলায় বিশাল সমুদ্রও অসহায়। বিশাল সমুদ্রের অসহায়ত্ব থেকে আমরা কি কিছু শিখতে পারি! অবশ্যই পারি! নিজেকে বিশাল ভেবে দর্প করো না, এক মুহূর্তে দর্প খর্ব হয়ে যাবে!

সমুদ্রে গিয়ে জল না ছুঁয়ে ফিরা আসা পাপ কিন্তু সমুদ্রই যদি জল লুকিয়ে ফেলে কি করা উচিৎ! আমি কোন অজুহাতেই পাপের অংশীদার হতে চাই না সিদ্ধান্ত নিয়ে সমুদ্রের বুকে প্রায় অর্ধ মাইল হেঁটে জল ছুঁয়ে তবেই ফিরেছি।

আশা করছি দেবী সমুদ্র তার ক্রোধ থেকে রক্ষা করবে, তুচ্ছাতিতুচ্ছের উপর ক্ষমতা দেখানো নিশ্চয় মহত্বের লক্ষণ না।

ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনের বৈপরিত্য সাদৃশ্যগুলো এই রকম

মিয়ানমার : ০১

ঢাকাতে রাস্তা ও গাড়ী দু’টোতেই জ্যাম হয়, মিয়ানমারে গাড়িতে জ্যাম হয় রাস্তায় না। ঢাকাতে অটোমেটেড ট্রাফিকের ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো কোথাও কোথাও কখনও কখনও ব্যবহার করা হয়। ইয়াঙ্গুনে অটোমেটেড ট্রাফিক ব্যবস্থায় ব্যবহার করা হয় কখনও কখনও নাকি ম্যানুয়াল ট্রাফিক ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। ঢাকাতে দামী খাবার আছে তেমনি দামও বেশি নেওয়া হয়, ইয়াঙ্গুনে দামী খাবার আছে তবে দাম বেশি নেওয়া হয়না।

ঢাকাতেও দূর্নীতি আছে, আছে ইয়াঙ্গুনেও, ঢাকাতে দোকানি কোন ভাবে দাম বেশী নিতে পারলে সেগুলো হজম করার সমস্ত আয়োজন করে, ইয়াঙ্গুনে, দোকানিকে ভুল করে ক্রেতার স্বীকৃতিতে টাকা নিলেও ভুল বুঝতে পারার সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্থ বিক্রেতাকে নিজ দায়িত্বে টাকা ফেরত দেয় (যদি সম্ভব হয়)।

ধর্মীয় গোঁড়ামি ইয়াঙ্গুনে আছে তবে আপনি ধর্ম বিশ্বাস না করলে ধর্ম বিশ্বাসী আপনার পাশ কাটিয়ে চলে যাবে, ঢাকাতে আপনি ধর্ম বিশ্বাস না করলে অন্য পাশ থেকে এসে ধর্ম বিশ্বাসীরা আপনার পাশ কেটে দিয়ে যাবে।

ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনের ধনীরা বিপরীত ধর্মী হলেও দরিদ্ররা কিন্তু একই শ্রেণীর। ইয়াঙ্গুনে সকল নারীই এমনকি Big boobs থাকলেও বক্ষ ঢাকার জন্য অতিরিক্ত কাপড় ব্যবহার না করেই দিন রাত একা একা ফাঁকা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, এমনকি ধর্ষণ যৎসামান্য হলেও নারীর পোষাককে দায়ী করে পুরুষদেরকে পাপমুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয় না। ঢাকাতে শিশু ধর্ষণ হলেও নারীদের পোষাককে দায়ী করা হয় এমনকি প্রেমিকের চরিত্র নষ্ট হলেও প্রেমিকার বক্ষ বেষ্টনীর সাইজকে দায়ী করা হয়।

ইয়াঙ্গুনের সাধারণ মানুষের ভাষ্যমতে- রোহিঙ্গাদের সরকার ও সাধারণ মানুষ বের করে দিতে না চাইলেও সেনাবাহিনী বের করে দিয়েছে, ঢাকার মানুষ না চাইলেও সরকার রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে।

ফিলিস্তিনিদের গল্প

বিশেষ কোন প্লান না থাকায় দিনটা হোটেলে বসে কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছা ছিল। তাই রাতে সকাল সকাল বিছানায় যাওয়ার ইচ্ছাটাও উঠিয়ে রাখতে হল। প্যালেস্টাইনে একদিনের ঝটিকা সফরে এমনি ছিলাম ক্লান্ত, তার উপর দুদিন আগে ইসরায়েলিরা ওয়েস্টার্ন ওয়াল বরাবর ফিলিস্তিনিদের শতাধিক বাড়িঘর গুড়িয়ে দেয়ায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠার সম্ভাবনা ছিল। পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে পা রাখতেই বাতাসে এর গন্ধ পাওয়া গেল। ট্যুর গাইড, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, বাস ড্রাইভার সহ অনেকেই এমন একটা সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিল না। রামাল্লার মূল রাস্তা ধরে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। উদ্দেশ্য খুব কাছ হতে ফিলিস্তিনিদের জীবনকে অনুভব করা। ট্যুর গাইড শহরের একটা গোল চত্বরে এসে ক্ষণিকের জন্যে থমকে দাঁড়াল। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালো এই এখান হতেই শুরু হয়েছিল তাদের বিদ্রোহের গল্প। ফিলিস্তিনিদের ইন্তিফাদা।

রামাল্লা হতে জেরিকো চল্লিশ মিনিটের বাস জার্নি। ছোট মিনিবাস ধরলে আরও আগে পৌঁছানো যায়। এগার হাজার বছর পুরানো এ শহরকে বলা হয় পৃথিবীর সবচাইতে বয়স্ক শহর এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে সবচাইতে নীচে। মধ্য দুপুরে শহরের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রী ছুঁইছুঁই করছিল। শহরের আঠার হাজার বাসিন্দাদের বলতে গেলে কাউকেই বাইরে দেখা গেলনা। ট্যুর গাইড জানালো এটাই শহরের জীবন! দিনে সাধারণত কেউ বের হয়না। সন্ধ্যা নামতেই শহরের বাজার বন্দর, ক্লাব, রেস্তোরা সব জেগে উঠে, রাস্তায় কিলবিল করে মানুষ। শহরের ভূতুড়ে রাস্তা ধরে কম করে হলেও পাঁচ কিলোমিটার হাটতে হল গাইডের কারণে। সামনে ভাল একটা রেস্তোরা আছে, এমন লোভ দেখিয়ে আমাকে সে টেনে আনল শহরের কেন্দ্রে। খা খা করছে বিশাল রেস্তোরাটা। খদ্দেরের কোন চিহ্ন নেই। কিন্তু রান্নাঘরের ব্যস্ততায় কোন কমতি নেই। গ্রিলে মুরগী ও আস্ত ভেড়া পোড়ানো হচ্ছে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে বিয়ে বাড়ির মেহমানদারীর প্রস্তুতি চলছে। ট্যুর গাইড জানাল সুর্যাস্তের পর রেস্তোরার চেহারা বদলে যাবে। সহজে সীট পাওয়া যায় না এখানে। খোদ ইয়াসির আরাফাতও এ শহরে বেড়াতে এলে এ রেস্তোরায় ঢুঁ মারতেন। দশজনের লম্বা টেবিলে আমাদের দুজনকে বসানো হল। মেনুর ছবি দেখে আমিই লাঞ্চের অর্ডার দিলাম।

রেস্তোরা হতে বের হয়ে আরও আধাঘণ্টা হাঁটতে হল বেথেলহামগামী বাস ধরার জন্যে। তাপমাত্রা তখনো ঊর্ধ্বগামী। কম করে হলেও ৫২ ডিগ্রী। আমি ঘামছি। বোতলের পর বোতল পানি খাচ্ছি আর হাঁটছি। এ শহর খ্রিষ্টানদেরও ঐতিহাসিক জায়গা। শহরকে ঘিরে জড়িয়ে আছে যীশু খ্রিষ্টের অনেক স্মৃতি। উত্তপ্ত মরু শহরে হাঁটছি আর শুনছি ট্যুর গাইডের বর্ণনা। এক মিনিটের জন্যেও সে ভুলে যায়নি তার কর্তব্য।

বেথেলহাম পৌছতে সূর্যের তাপ অনেকটাই কমে এলো। তাছাড়া উচ্চতাও বেড়েছে। হাল্কা মৃদু বাতাস স্বাগত জানালো যীশু খৃষ্টের জন্মভূমিতে। ন্যাটিভিট চার্চ ঘুরে আসার পর ফিলিস্তিনি একটা পরিবারের সাথে অনেকক্ষণ সময় কাটানো হল অনেকটা বাধ্য হয়ে। হাঁটার জন্যে যে শক্তি প্রয়োজন তার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট ছিলনা। বাড়ির বারান্দায় লম্বা একটা সোফার উপর কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নিলাম।

চোখ মেলতেই মনে হল অন্ধকার নামছে পশ্চিম তীরে। পাহাড় গুলোর চূড়া আর দেখা যাচ্ছেনা। মানুষও মনে হয় লম্বা একটা দিনের পর জেগে উঠছে। এবার ফেরার পালা। পথে হেবরন শহরে কিছুক্ষণের যাত্রা বিরতি। ট্যুর গাইডই উপদেশ দিল, জেরুজালেমে ফিরে আমি যেন মুসলিম কোয়ার্টার ছেড়ে ইহুদি কোয়ার্টারে চলে যাই। ফিলিস্তিনিরা রাস্তায় নামলে লম্বা সময়ের জন্য দামেস্ক গেইট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন ওখান হতে বেরুনো খুব একটা সহজ হবেনা। কিন্তু আমার ইচ্ছা করছিলোনা হঠাৎ করে এভাবে পালানোর। বরং ইচ্ছা করছিল খুব কাছ হতে দেখি ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ। কে জানে, হয়ত এ বিদ্রোহ হতেই শুরু হতে পারে নতুন এক ইন্তিফাদা।

ভোর ৩টার দিকে ঘুমাতে গেলাম। ইচ্ছা ছিল দশটার দিকে উঠে নাস্তা সেরে দামেস্ক গেটের সিঁড়িতে বসে চারদিকের জেরুজালেমকে দেখবো। কোথাও গোলমাল বাধলে ওখানেও যাবো। খুব কাছ হতে কিছু ছবি তুলবো।

ঘুম ভাঙ্গল খুব ভোরে আযানের সুরে। হয়ত পাশের আল আকসা মসজিদ হয়ে ভেসে আসা আযান। জানালার পর্দা খুলে জেরুজালেমের আকাশকে দেখার চেষ্টা করলাম। ভোর হয় হয় করছে। রাস্তায় কিছু বেওয়ারিশ কুকুর এদিক ওদিক হাটতে শুরু করেছে। পাশের বাড়িঘর হতে এক ঝাঁক পায়রা উড়ে গেল আকাশে। কে জানে, হয়ত ওরা উড়ে গেছে পশ্চিম তীরের শহর হেবরন, রামাল্লা অথবা বেথেলহেমে।

– চলবে

বিদায় জেরুজালেম বিদায় ইসরায়েল বিদায় প্যালেস্টাইন

Dead Sea – মৃত সাগর!

হিব্রু ভাষায় ইয়াম হা-মেলাহ, যার ইংরেজি অর্থ, সী অব সল্ট। পুব তীরে জর্ডান এবং পশ্চিমে তীরে ইসরাইল। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে পৃথিবীর সবচাইতে নিচু এলিভিশনে অবস্থিত এ সাগর। মিটারের হিসাবে প্রায় ৪৩০ মিটার। কোন মাছ নেই পানিতে। নেই কোন জলজ প্রাণী। লবনাক্ততাই এর মূল কারণ, যার পরিমাণ শতকরা ৩৪ ভাগ। লবণের কারণে এখানে স্বাভাবিক সাতার কাটায়ও সমস্যা। পানিতে নামলে ভেসে থাকতে হয়। জর্ডান রিফট ভ্যালিতে অবস্থিত মৃত সাগরে পানি সরবরাহের মূল উৎসও জর্ডান নদী। ইউনিক বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক ভিড় জমায় ডেড সীর তীরে। অনেকের কাছে এটা একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অনেকে সাগরের কালো কাদামাটি চামড়ার চিকিৎসার জন্যে ব্যবহার করে থাকেন। বলাহয় মিশরীয়রা মমিফিকেশনেও ব্যবহার করেছে এই সাগরের কাদামাটি।

মাসাদার পথে জেরুজালেম হতে বেরিয়ে কিছুটা পথ যাওয়ার পরই চোখে পরে ডেড সী’র অবস্থান। দূর হতে দেখলে অনেকটা বাংলাদেশের খালের মত মনে হবে। সাগরের লম্বা উপকূল জনমানবহীন। রাস্তার দুইধারে সাড়ি সাড়ি খেজুর আর জলপাই বাগান। লবণ তৈরির কারখানার বিস্মৃতি গোট কূল জুড়ে। অনেক পরিত্যক্ত উপকূল দখল করে নিয়েছে লবণের স্রোত। সূর্যের আলো লবণ স্তূপের উপর আছড়ে পর আয়নার মত চক চক করে। ওদিকে টুরিস্টদের যাওয়া নিষেধ। লবণ ও পানির রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তীর জুড়ে তৈরি হয়েছে বিশাল সব সিঙ্কহোল। বা গর্ত। যে কোন সময় মাটি সরে গিয়ে তৈরি হতে পারে এই গর্ত। তাই সাবধানতা অবলম্বনের জন্যে ওখানে যাওয়ার অনুমতি নেই টুরিস্টদের।


প্রবেশমুখে বেদুইনদের উট।

দুপুর ৩টার পর মাসাদা ফোর্ট ভ্রমণ শেষে আমাদের বাস থামল কালিয়া নামের একটা বীচে। ভেতরে এসির ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে বুঝা যায়নি বাইরের অবস্থা। বাসের দরজা খোলার সাথে মনে হল কেউ আগুনের গোলা ছুড়েছে আমাদের দিকে। এ যেন আগ্নেয়গিরি হতে নেমে আসা লাভার উত্তাপ। পানির বোতলটা হাতে নিয়ে নেমে পরলাম বাস হতে।

গাইড জানিয়ে দিল কালিয়া বীচের নিয়ম কানুন। বলে দিল যাদের ধারণা নেই তারা যেন সাতার কেটে বেশিদূর না যায়। মাথা নিচু করলে কি ধরণের বিপদ আসতে পারে তার ধারণা দিল। দৈবক্রমে চোখে লবণ ঢুকে গেলে কি করতে হবে তারও প্রেসক্রিপশন দিল। পাশেই দোকানপাট। ওখানে টাওয়েল সহ অনেক কিছুই ভাড়া করা যায়। পরিস্থিতির সামগ্রিক বিচার করে পানিতে না নামার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। একে সাতার জানিনা, দ্বিতীয়ত সূর্যের তাপে চামড়া পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। ছাতার মত একটা সেদের নীচে জুতা আর গায়ের গেঞ্জিটা খুলে এলিয়ে দিলাম শরীর। ক্লান্তি এসে ভর করছে। চোখ বুজে আসছে।

একটু পর পর পানি খেতে হল। দুই লিটারের বোতলটা শেষ হওয়ার পর এক বোতল কোক কিনে ফিরে এলাম ছায়াটায়। হরেক রকম মানুষ। হরেক রকম ভাষা। তাদের সাঁতারের পোশাকও ভিন্ন। বিপদজনক বিকিনি পরিহিত ইউরোপীয়ানদের পাশেই লম্বা জুব্বা-ওয়ালা আফ্রিকান মহিলারা পানিতে মাতামাতি করছে। কালো কাঁদায় গোটা শরীর লেপটে নিয়ে ভুতের মত শুয়ে আছে সূর্যের নীচে। সদ্য পরিচিত ট্যুর বন্ধু ফ্রেঞ্চ-ম্যান পিয়ের দূর হতে আমাকে হাত নাড়াল। পানিতে নামার ইশারা দিল। মাথা নেড়ে আমিও ধন্যবাদ দিলাম। এবং পানিতে নামার জন্যে আমি যে তৈরি নই, তা জানিয়ে দিলাম। সময় গড়াচ্ছে এবং সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। আমি ঘামছি। শরীরের সাথে লেপটে যাচ্ছে আমার টি-শার্ট। সূর্য দখল নিয়েছে আমার ছায়ার জায়গাটা। উঠতে হল। পাশের বারে ঢুকে বরফের মত ঠাণ্ডা আরও এক বোতল কোক কিনতে হল। এক পর্যায়ে মন হল আমি আর পারছিনা।


সদ্য পরিচিত ট্যুর বন্ধু ফ্রান্সের পিয়ের।

নির্ধারিত সময়ের পনের মিনিট আগেই বাসটা এসে গেল। কেবল আমি নই, আফ্রিকা উপমহাদেশের বেশ কজন টুরিস্ট এক লাফে উঠে গেল। ওখানে বেহেস্তের ঠাণ্ডা বাতাস! আমার পাশের সীটের মহিলাকে দেখলাম বাইরের জলপাই গাছের ছায়ায় বিকিনি পরে বসে আছে। চোখে চোখ পরতে আমাকে ইশারায় ডাক দিল। অনিচ্ছাসত্ত্বে আবারও নামতে হল। দুঃখ প্রকাশ করে জানাল সমুদ্র-পারের যে জায়গাটায় আমি শুয়ে ছিলাম ওখানে সে তার ব্যাগটা ফেলে এসেছে। এত রোদে তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। পারলে আমি যেন হেল্প করি। করতেই হল। এটাই ভদ্রতা। সিঁড়ি বেয়ে অনেকদূর নামতে হবে। ফেরার পথে উপরে উঠতে হবে। নিজকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। গুন গুন করে গান গাইতে শুরু করলাম। জানতাম সহজ হবেনা এ যাত্রা।

বিশ মিনিট পর ট্যুর গাইড ফিরে যোগ দিল আমাদের সাথে। সবাইকে ধন্যবাদ জানাল এবং আজ ট্যুরে কি কি দেখেছি তার উপর ছোট্ট একটা লেকচার দিল। এখানেই আমাদের ট্যুরের সমাপ্তি এবং ঘরে ফেরার পালা।

চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করলাম। অবশ্য আশেপাশের বাকি যাত্রীরাও তাই করছে। বাস ছুটে চলছে জেরুজালেমের দিকে। আমি জানি এ দেশে এটাই আমার শেষ ট্যুর। আগামীকাল রাতে আমাকে ফেরার ফ্লাইট ধরতে হবে। ঘরে ফিরে ভোজবাজির মত ভুলে যেতে হবে পৃথিবীর এ অংশে কাটিয়ে যাওয়া কটা দিন। অনেকসময় হয়ত স্বপ্ন মনে হবে। এদেশে ফিরে আসার আর কোন সম্ভাবনা নেই। হয়ত ইচ্ছাও নেই। হয়ত হঠাৎ করেই বদলে যাবে এর চেহারা। ট্যাংক আর বন্দুকের পদভারে থর থর করবে রামাল্লার মাটি। হয়ত জেরিকো শহরের নির্জন রাস্তাঘাট ভারী হবে প্রতিবাদীদের মিছিলে। কোনকিছুরই নিশ্চয়তা নেই এ দেশে। এ অনেকটা বারুদের গোলার মত। যেকোনো সময় দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে পারে। সেদিন দূর হতে আমিও হয়ত কষ্ট পাব এই ভেবে, রক্তস্নাত এই মাটিতে আমিও হেঁটেছিলাম।

বিদায় জেরুজালেম। বিদায় ইসরায়েল। বিদায় প্যালেস্টাইন।

.
২৭শে জুলাই, ২০১৯।
______________

ইসরায়েল সফরের উপর আমার লেখাগুলো অনেকটা তাড়াহুড়ো করে লেখা। আমি জানতাম সাথে সাথে না লিখলে ঘরে ফিরে সহজে লেখা হবেনা। সবার মত আমাকেও দিনের বড় একটা অংশ কাটাতে হয় অফিসে। বাসায় ফিরলে আমার দখল নেয় ছেলেমেয়েরা। ওদের ফেলে লিখতে গেলে গিন্নীর হতো মন খারাপ। তাছাড়া অন-গোয়িং এইজিং প্রসেসে ঘটনার অনেক কিছু মনে রাখা সম্ভব হতোনা। তাই প্রতিটা ট্রিপের পর রাত জেগে লেখার চেষ্টা করেছি। নিশ্চিত করে বলা যায় আমার লেখার সীমিত পাঠকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল লেখা শেষ করায় বিরাট একটা উৎসাহ। কোন ধন্যবাদই যথেষ্ট হবেনা। আমি কোন বিচারেই লেখক নই। আমার বাংলা ভাষার জ্ঞান সীমিত, কারণ ভাষা চর্চার পিক আওয়ারে আমাকে চলে যেতে হয়েছিল দেশের বাইরে। তৃতীয় একটা ভাষা রপ্ত করে সে ভাষায় লেখাপড়া শেষ করতে হয়েছিল। ভাষা চর্চা খুব একটা সহজ কাজ নয়, এর জন্যে মৌলিক উপাদানের পাশাপাশি চাই জন্মগত ট্যালেন্ট। এসব অনেক কিছুর ঘাটতি আছে আমার লেখালেখিতে। কেউ না বললেও আমি বুঝতে পারি।

তেল আবিব এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করছি ফ্লাইটের। পেছনে রেখে যাচ্ছি ঝটিকা সফরের অনেক স্মৃতি। সাথে নিয়ে যাচ্ছি এমন অনেক কথা যা জেরুজালেমে বসে বলতে পারিনি নিরাপত্তার কথা ভেবে। সময় করে লেখাগুলো আপডেট করার চেষ্টা করবো। সাথে থাকার জন্যে রইলো অশেষ কৃতজ্ঞতা।

মাসাদা এন্ড দ্যা ডেড সী…

মাসাদা এন্ড দ্যা ডেড সী…

আধুনিক প্যালেস্টাইনকে নিজেদের বলে দাবি করতে গিয়ে ইসরায়েলিরা ফিরে যায় তাদের অতীত ইতিহাসে। সে ইতিহাস দুই হাজার বছরের পুরানো। জুডাইজমের উত্থান, বিবর্তন ও পতনের সে কাহিনী রক্তাক্ত নির্মম ও করুণ। হ্যারড ছিলেন অধুনা অনেক রক্ত-খেকো স্বৈরশাসকদের মতই একজন ক্ষমতা-লিপ্সু কিং। যাকেই দরকার তাকেই শিরচ্ছেদ করতেন ক্ষমতার পথ নিষ্কণ্টক ও মসৃণ রাখতে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে আরাম আয়েশের জন্যে বানাতেন রাজকীয় প্রাসাদ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় জেরিকো শহরের শীতকালীন প্রাসাদ ছিল তাদের অন্যতম।

হিব্রু ভাষায় মাসাদা শব্দের অর্থ strong foundation, বা শক্ত ভিত্তি। ইতিহাসবিদদের মতে জুদাইয়ান মরুর শেষপ্রান্তে প্রায় ১৩০০ ফুট উপরে মাসাদা দুর্গের গোঁড়া পত্তন করেছিলেন জনাথন দ্যা হাই প্রিস্ট হাসমোনিয়ান কিং অ্যালেক্সান্ডার জানেউস। যিনি রাজত্ব করে গেছেন সাল ১০৩ হতে ৭৬ বি সি পর্যন্ত। জেরুজালেমের অনতিদূরে ইন গেদি ও সডমের মাঝামাঝি Dead Sea’র কাছাকাছি মাসাদা দুর্গ এখন ইসরায়েলের ন্যাশনাল হ্যারিটেজ। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ টুরিস্ট দেখতে আসে এই ঐতিহাসিক স্থাপনা।

কিং হ্যরড মাসাদাকে বেছে নিয়েছিলেন শত্রুর আক্রমণ হতে নিজকে রক্ষার জন্যে। হ্যারডের মৃত্যু বা অপমৃত্যুর পর জুদেয়ার দখল চলে যায় রোমানদের হাতে। মাসাদার দুর্গকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলে ওরা। ৬৬ এ,ডি’তে শুরু হয় গ্রেট ইহুদি রেভল্ট। ইহুদিরা দখল নেয় মাসাদার। এলেজার বিন ইয়ারিরের নেতৃত্বে একদল ইহুদি রোমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৭০ AD’তে রোমানরা জেরুজালেম শহরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। পাইকারি-ভাবে হত্যা করে ইহুদিদের। পুরুষদের পাশাপাশি নারী ও শিশুদেরও ওরা রেহাই দেয়নি। জেরুজালেম যখন জ্বলছে তখন ৯৬০ জন ইহুদি আশ্রয় নেয় মাসাদা দুর্গে। ওখান হতে শুরু করে প্রতিরোধ।

জেরুজালেমের চূড়ান্ত পতন ও ইহুদিদের নির্মূল করার পর রোমানরা চোখে ফেরায় মাসাদার দিকে। জেনারেল ফ্লাভিউস সিলভার নেতৃত্ব ৮০০০ রোমান সৈন্য অবস্থান নেয় মাসাদার চারদিকে। শুরু হয় অবরোধ। মাসের পর মাস চলতে থাকে এই অবরোধ। রোমানদের জানা ছিল পানি আর খাদ্যের অভাবের কারণ ইহুদিরা নেমে আসবে পাহাড় হতে। কিন্তু তা হয়নি। চলতে থাকে প্রতিরোধ। অনন্যোপায় হয়ে রোমানরা নির্মাণ শুরু করে চূড়ায় উঠার পথ। প্রতিরোধকারীরা বুঝতে পারে ঘনিয়ে আসছে তাদের দিন। তাদের নেতা বেন ইয়াইর শেষবারের মত সবাইকে একত্রিত করে পছন্দ দেন, হয় বেঁচে থেকে রোমানদের দাস হও, অথবা আত্মহত্যা করে। ৭৩ AD’র ১৫ই এপ্রিল পতন হয় মাসাদা দুর্গের। জেনারেল সিলভার সৈন্যরা দুর্গের চূড়ায় উঠে দেখতে পায় দুজন মহিলা ও পাঁচজন শিশু ছাড়া বাকি সবাই আত্মহত্যা করেছে। ওরা দখলদারদের দাস হয়ে বেঁচে থাকতে চায়-নি। তাই আত্মহত্যাকেই অধিকতর গৌরবের পথ হিসাবে বেছে নিয়েছে। বিদ্রোহীদের শেষ পরিণতিকে সন্মান জানিয়েছিল রোমানরা।
______________________

প্রায় দুটো দিন ছিলাম হোটেলে বন্দী। গোলান হাইটসে যাওয়ার ইচ্ছাটায় ইতি টানতে হয়েছিল এর দূরত্বের কথা ভেবে। ৪ ঘণ্টার বাস জার্নি। দিনে দুইটা মাত্র বাস যায় ইসরায়েলের উত্তরে সিরিয়া সীমান্তে। একই দিনে ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা না থাকায় ঐদিকটা সফরের ইচ্ছা তালিকা হতে বাদ দিতে হল। ছোট কোন শহর অথবা লোকালয়ে রাত কাটানো আমার বিচারে নিরাপদ ছিলনা অনেক কারণে। প্রথমত, যে কোন সময় ঝামেলা ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা থাকে এ দেশে। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলি সৈন্যদের গ্যংষ্টার টাইপ আচরণ। ওরা চাইলেই যে কাউকে খুন করতে পারে। এ অনুমতি তাদের দেয়া আছে। জেরুজালেমের পথেঘাটে অনেক সাধারণ মানুষকে কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে দেখেছি। শুট ফার্স্ট, আস্ক কোশ্চেয়েন লেইটার, এটাতে তাদের বৈধতা আছে। আরও একটা দিন হোটেলে বসে অলস সময় কাটানোর ইচ্ছা ছিলনা। অন্য কোথাও যাওয়া যায় কিনা তা পরখ করে রাত ২টার দিকে ঘুম হতে জেগে অনলাইনে অনুসন্ধান শুরু করলাম।

মাসাদা ও ডেড সী! ইসরায়েলি এসে কেউ এ দু’টো জায়গা না দেখে চলে গেছে এমনটা হয়না। আমি ভ্রমণের শুরুতেই ওখানটায় যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রামাল্লায় প্যালেষ্টাইনি গাইড আমাকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। জেরিকোর ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে ৫ কিলোমিটার ধকল সামলে উঠতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। আবু আল নাসের সাবধান করে দিল মাসাদা ও ডেড সী’তে তাপমাত্রা ৫০-৫২’তে উঠানামা করে। সাথে আর্দ্রতা। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম গোলান হাইটস যাওয়া হলে ডেড সী’র দিকে যাবনা গরমের কারণে।

শুক্রবার সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট আগে শুরু হয়। এবং চলে শনিবার সূর্যাস্তের পর যতক্ষণ না আকাশে তিনটা তারা দেখা যায়। এ সময়টা ইহুদিদের জন্যে Sabbath। ওদের ছুটি। কোন কাজেই হাত দেবেনা। তাই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হতে শুরু করে ট্যুরিজমের অনেক কিছুই বন্ধ থাকে। অনলাইনে মাসাদা ট্যুর টিকেট কিনতে গিয়ে হতাশ হলাম। প্রায় সব ট্যুরেই বিরতি। লম্বা সময় ধরে ঘাঁটাঘাঁটির পর পাওয়া গেল একটা যারা চালিয়ে যাবে তাদের ট্যুর। অতিরিক্ত মূল্য দিতে হল এর জন্যে। সকাল সাড়ে আটটায় ট্যুর বাস আমাকে হোটেল হতে নিয়ে যাবে। ফিরিয়ে দেবে সন্ধ্যার দিকে। ক্রয় প্রক্রিয়া শেষ করতে সকাল ৩টা বেজে গেল। সকাল ১১টায় আমার ম্যান্ডেটরি চেক-আউট। হিসাব করে দেখলাম এখন ঘুমাতে গেলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে।

খুব সকালে লম্বা মত একটা গোসল দিলাম। রুমেই রুটি ও কফির ব্যবস্থা ছিল। তাই দিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। এ যাত্রায় ছবি তোলার জন্যে মোবাইল ফোন বাদে সাথে অন্যকিছু না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। লবিতে নেমে আগের দিনের রিসেপশনিষ্টকেই পেলাম। খুলে বললাম আমার অবস্থা, এ মুহূর্তে নতুন কোন হোটেলে গেলে ট্যুর মিস করবো। প্রায় ৩০ মিনিট গুঁতোগুঁতির পর আমার ক্রেডিট কার্ড চাইল। পরিশোধ করে রুমে ফিরে আসলাম। সামান্য ধন্যবাদ দেয়ার যে রীতি তাও পালন করলো না মহিলা। পৃথিবীর কোন দেশেই এমনটা দেখিনি।

আসার কথা সাড়ে আটটায়, অথচ সাড়ে নটার আগে বাসের দেখা মিললো না। কোন কিছুতেই আর অবাক হচ্ছেনা। চমৎকার একটা মিনি বাস। ট্যুরিজমের জন্যে ওয়েল ইকুইপড। গাইড ইয়ায়ারের সাথে পরিচয় হল। আরও পরিচয় হল ফ্রেঞ্চ ম্যান পিয়ের ও কলোম্বিয়ান ফার্ণান্দোর সাথে। ওরাও যাচ্ছে আমার সাথে।


মাসাদার পথে সাময়িক বিরতী।


পাহাড়ের পাদদেশে ডেড সী।

ইসরাইল খুবই ছোট একটা দেশ। তাই এর এক শহর হতে অন্য শহরে যাওয়ার দূরত্ব খুব একটা বেশী না। মাসাদা পৌঁছতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে এমনটাই জানিয়ে দিল ট্যুর গাইড। ট্যুরের বিস্তারিত জানিয়ে ও ড্রাইভারের সাথে পরিচয় পর্ব সেরে রওয়ানা দিলাম নতুন গন্তব্যে। প্রথমে মাসাদা ও ফেরার পথে ডেড সী।


পাহাড় ও সাগর। ওপারে জর্ডান।

চল্লিশ মিনিট পর বাস হতে বেরুতেই আগুনের গোলার মত চোখে মুখে আঘাত হানল চারদিকের বাতাস। পথে পাহাড়, এক পাশে ডেড সী, আর পাহাড়ের চূড়ায় সেটল্যারদের বাড়িঘর, সব মিলিয়ে সেলুলয়েডের ফিতার মত দৃশ্যপটে ভেসে উঠল চারদিকের প্যানোরমা। মাইলের পর মাইল খেজুর আর জলপাই বাগান। ফাঁকে ফাঁকে বেদুইনদের বস্তি, আঙ্গিনায় ক্লান্ত উটদের নিদ্রা, ডেড সী হতে লবণ তুলে আনার সরঞ্জাম; হুট করেই কেটে গেল সময়টা। মাসাদার পাদদেশে এসে থামার পর আন্দাজ করতে পারলাম এর বিশালতা।

একটা ক্যাবল কার যাচ্ছে উপরে। ওটা ধরতে হবে। গাইড জানিয়ে দিল পানি ছাড়া ওখানটায় যাওয়া হবে আত্মঘাতী। দুই লিটারের একটা বোতল কিনে বগলে চাপিয়ে উঠে বসলাম কেবল কারে। সাবাথ হলেও টুরিস্টদের অভাব দেখলাম না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে ওরা আসছে। ৮০’র দশকের পিটার ও’টুল অভিনীত মাসাদা টিভি সিরিজের কারণে এর পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। মিনিট দশেকের ভেতর পৌঁছে গেলাম চূড়ায়।


মাসাদার চূড়ায়।


পানির অন্য নাম যে জীবন, এখানে না এলে ধারণা করা যাবেনা।

উপর হতে পৃথিবীটা এত সুন্দর দেখায় না দেখলে বুঝা যাবেনা। তিনদিকে জুদিয়ান মরু। সামনে ডেড সী। তার ওপারে জর্ডান। হঠাৎ করে পেরুর মাচুপিচুর কথা মনে পরে গেল। ২০০২ সালে দেখ পেরুর ঐ পাহাড় ছিল কাব্যময়। হাতের কাছে মেঘমালার ঘোরাফেরা। পাহাড়ে সবুজের সমাহার। এখানটায় ঠিক উলটো। তাতানো মরু আবহাওয়া। মাথার উপর জ্বলন্ত চুলার মত সূর্য। কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই। যতদূর চোখ যায় পাহাড় আর পাহাড়। নগ্ন এবং ক্ষমাহীন। একবার কেউ পথ হারালে মৃত্যু তার অবধারিত।

ইতিহাসের কোন পাতাই উলটানো বাকি রাখল না আমাদের গাইড। জুদাইজম ও এ মাটিতে ইসরায়েলের ঐতিহাসিক মালিকানা তত্ত্বও বাদ গেলনা। সন্দেহ নেই দুই হাজার বছর আগে এ মাটিতে ইহুদি রাজত্ব ছিল। কিন্তু অনেক সভ্যতার মত সেটাও ধ্বংস হয়েছিল, যাতে মুসলমানদের কোন হাত ছিলনা। এ মুহূর্তে মাসাদায় হরেক রকম মানুষ একত্রিত হয়েছে, অথচ নেই একজন প্যালেষ্টাইনি। ওরা দেয়ালের ওপাশে বন্দী। রোমানরা যেভাবে ইহুদিদের দাস বানিয়েছিল, একই কায়দায় ইহুদিরাও আজকে প্যালেষ্টাইনি মুসলমানদের দাস বানাতে চাইছে। এ সত্য ও বাস্তবতাটা এক মুহূর্তের জন্যে মাথা হতে দূর করতে পারলাম না।

ক্যাবল কার ধরে ঘণ্টা দুয়েক পর নেমে আসলাম মাসাদার চূড়া হতে। পাহাড়ের গোড়াতেই বাফে। ৭০ স্যাকেল খরচ করে পেট ভরে খেয়ে নিলাম। সাথে অতিরিক্ত দু’বোতল কোন নিলাম পরবর্তী গন্তব্য ডেড সী বীচের জন্যে। ওখানে আরও গরম। প্রচণ্ড অসহনীয় গরম। ডেড সী – সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৪৫০ মিটার নীচে। পৃথিবীর সর্বনীচু স্থান।

.
জেরুজালেম। ২৭শে জুলাই, ২০১৯।

দুই ধর্ম, দুই দৃশ্যপট: জেরুজালেমের গল্প

পুরানো জেরুজালেমের মুসলিম কোয়ার্টার ছেড়ে আজ নতুন জেরুজালেমের ইহুদি এলাকায় আসতে হল। আল হাশেমি নামের যে হোটেলটায় এতদিন ছিলাম তাতে আমার জন্যে খালি রুম পাওয়া যায়নি। গন্তব্যের অনিশ্চয়তার কারণে একরাতের বেশি কোথাও হোটেল বুক করিনা। যদিও একরাতের কথা বলে ঢুকি এবং পরেরদিন তা নবায়ন করি। এভাবেই চলছিল। আজ সকালে কাউন্টারে যেতেই পেলাম খবরটা। হোটেল বুকড! রিসিপশনিষ্ট সাজেষ্ট করলো পাশের আল-আরাবি হোটেলে খোঁজ নিতে। লাগেজ গুটিয়ে লবিতে রেখে গেলাম পাশেরটায়। সকাল বাজে প্রায় ১০টা। লবির টেবিলে লম্বা হয়ে কেউ একজন ঘুমাচ্ছে। জোরে কাশি দিলাম। তাতেও কাজ হলো না। অচেনা ঘুমন্ত কাউকে ডেকে উঠানো কোন সংস্কৃতিতেই ভাল উদাহরণ না। ইসরায়েলি এসেছি নিজকে ভাল নাগরিক হিসাবে তুলে ধরতে। তাই ফিরে এলাম। আধাঘণ্টা পর ফিরে গিয়ে দেখি একই অবস্থা। এদিকে চেক আউটের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত আল হাশেমিতে ফিরে অনলাইনে খুঁজতে থাকলাম নতুন কোন হোটেল। জেরুজালেমের রাস্তাঘাট আমি চিনি না, তাই কোন হোটেল কোথায় অবস্থিত তার কোন হদিস করতে পারলাম না। সময় নেই, তাই সস্তা যেটা পেলাম সেটাই বুক করলাম। চেক-ইন সময় দুপুর ৩টা। হাতে অনেক সময়। সবাই যা করে তাই করলাম। লাগেজ গুলো আল হাশেমির স্টোরে রেখে বেরিয়ে পরলাম। আজ আর মুসলিম কোয়ার্টারে ঘোরাফেরার ইচ্ছা ছিলনা, রওয়ানা দিলাম ইহুদি কোয়ার্টারের দিকে। ওদিকটায় না ঘুরলে জেরুজালেম শহর দেখা সম্পূর্ণ হবেনা।

অনেকটা চাঁদের অন্য-পীঠের মতই পুরানো জেরুজালেমের ইহুদি কোয়ার্টার। মুসলিম এলাকা হতে হাঁটা শুরু করলে কখন যে সীমানা অতিক্রম করা হয় তা চারদিক না তাকালে বুঝার উপায় নেই। হঠাৎ করেই বদলে যায় সবকিছু। লম্বা আলখাল্লা পরিহিত আরব পুরুষদের জায়গা করে নেয় নানান জাতির ইহুদিরা। এক্সট্রিম পশ্চিম ইউরোপিয়ান সাদা, সেন্ট্রাল এশিয়ার বাদামি, আফ্রিকার কালা, পূর্ব ইউরোপের অসুখী সাদা, সব মিলিয়ে গোটা বিশ্বের ইহুদিদের পাওয়া যায় পশ্চিম দেয়ালের কাছে। ওদের অন্যতম পবিত্র স্থান হচ্ছে এই দেয়াল। তবে মুসলিম কোয়ার্টারের সাথে পার্থক্যটা ধরতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়না। এ কোয়ার্টারে আরব মুসলমানদের প্রাণের স্পন্দন তার ছিটেফোঁটাও নেই। রাস্তায় মানুষ হাঁটছে, অথচ কেউ কথা বলছেনা। আরবদের মত অচেনা কাউকে সালাম দিচ্ছেনা। রুশ ইহুদিদের দেখলে মনে হবে ওরা তেড়ে আসবে। এখুনি জিজ্ঞেস করবে, – ইয়ব তোবায়ো মাত, পচিমু তি জদিয়েছ?
এ কোয়ার্টারের রাস্তায় নিজকে অপাক্তেয় মনে হলো। অনেকেই সন্দেহের চোখে চাইছে। আমি চোখে চোখ রাখা হতে বিরত থাকার চেষ্টা করলাম।

দুদিকের দোকানপাটেও পরিবর্তন চোখে পরার মত। সবকিছুতে ধর্মের প্রতিফলন। টুপি, হনুকা সাইন, বিভিন্ন সুগন্ধি যা হতে বেরিয়ে আসছে কটু গন্ধ। আরবদের মত গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে চীৎকার করছেনা। এক কথায় সব আছে, শুধু নেই চাঞ্চল্য, নেই উচ্ছ্বাস, নেই জীবন নিয়ে উচ্ছলতা। ওদের প্রতিটা সিনেগগে ঢু মারলাম। রাবাইদের সাথে ভালমন্দ কিছু একটা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথাও কোন রেসপন্স পেলাম না। সবাই কেমন নির্লিপ্ত। চোখের ভাষায় একটাই যেন জিজ্ঞাসা, তুমি এখানে কেন! বেশকিছু ছবি তুললাম। দুয়েকটা স্যুভেনির কিনলাম। অচেনা কাউকে থামিয়ে ছবি তুলে দেয়ার যে অভ্যাসটা মুসলিম কোয়ার্টারে প্রাকটিস করেছি এখানে তেমনটা করতে উৎসাহ পেলাম না।

মন কিছুটা হলেও বিষণ্ণ হয়ে গেল পুরানো জেরুজালেম ছেড়ে আসতে। অনেক কিছুই মিস করবো। রাস্তার হৈ-হোল্লা, দোকানীদের চীৎকার, উঁচু আওয়াজের আরবি গান, মধুর সুরের কোরান তেলাওয়াত। বিশেষ করে মিস করবো সকালের আজান। এই পরিবেশ এই কোলাহল কিছুক্ষণের জন্যে হলেও নস্টালজিক বানিয়ে নিয়ে যায় ফেলে আসা ঢাকায়।

নতুন হোটেলটা নতুন শহরের খুব চকচকে একটা জায়গায়। দেখলেই বুঝা যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনে ততটা অনিশ্চয়তা নেই যতটা দেখেছি পূর্ব জেরুজালেমে অথবা পশ্চিম তীরের রামাল্লায়। হোটেলের মূল ফটকেই মেটাল ডিটেক্টর। অনেকটা এয়ারপোর্টের লাগেজ চেকিং’এর মত। লাস্যময়ী এক তরুণী দাঁড়িয়ে মনিটর করছে সবকিছু। ভদ্রতার হাসি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলাম। উত্তরে কিছুই বললো না। আমিও আর কথা বাড়ানোর চেষ্টা করলাম না। কাউন্টারে একই অবস্থা। হোটেল ব্যবসার চিরাচরিত আপ্যায়ন একেবারেই অনুপস্থিত। কাগজপত্র দেখার আগেই জানিয়ে দিল, চেক-ইন’এর এখনো আড়াই ঘণ্টা বাকি। কথা যা বলার তখনি বলবে।

বিশাল একটা লবি। আধুনিক সুবিধাদির সুখময় সমাহার। আমি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম আশপাশের মানুষদের। ভুলে যেতে চাইলাম ওদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত আমি। না চাইলেও আমার মার্কিন পরিচয়টা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলাম। বলতে ইচ্ছা করলো…হতে পারি আমি জন্মগত মুসলিম, আমাকে তোমরা অপছন্দ করতে পার, কিন্তু ভুলে যেওনা আমার ট্যাক্সের টাকায়ই তোমাদের লালন করা হয়। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়ে আমার দেশই তোমাদের নিরাপত্তা দেয়। যদি ঘৃণা করতে চাও, তাহলে প্রথমে আমার ট্যাক্সের টাকাকে ঘৃণা কর।

চারদিকে অদ্ভুত সব সুন্দরীদের চলাফেরা। ওরা হিব্রু ভাষায় নিজেদের ভেতর কি বলছে বুঝতে পারছিনা। কারও কারও কোমরে দুই দুইটা পিস্তল। আসলে জীবন কোথাও থেমে থাকেনা। ওরা যেমন নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে স্বাভাবিক জীবন যাপন নিশ্চিত করতে চাইছে, তেমনি মুসলমানরাও নিজেদের শিক্ষা সংস্কৃতি বজায় রেখে চালিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকার যুদ্ধ। আমরা বাইরের মানুষরা সব সময়ই চাইবো শান্তি আসুক এ ভূমিতে। মিলেমিশে বেড়ে উঠুক ওদের শিশুরা। অনিশ্চয়তার বেড়াজাল হতে বেরিয়ে নতুন এক পৃথিবীর জন্ম হোক।

জেরুজালেম। ২৬শে জুলাই।