ভেবেছিলাম চেন্নাই নিয়ে রিভিউ লেখা দ্বিতীয় পর্বেই শেষ করে ফেলেছি। কিন্তু নতুন কিছু জানার আনন্দে আর লেখক মনের উৎসাহে তৃতীয় পর্বও লিখতে বাধ্য হলাম…।
১) তামিল ভাষা আমার জন্যে দুর্ভেদ্য, এক শব্দও এখনো বুঝিনি। পুরাসাওয়াকাম হাই রোডের যেখানে আছি, সেখানকার ম্যানেজার বাবু অমায়িক লোক। খুব ভালো ইংরেজী বলতে পারেন, তাই রক্ষে। তার সাথে আমার আড্ডা জমে ভিনদেশী ভাষায়, ইংরেজীতে। আমি অবশ্য তেমন ভালো ইংরেজী বলতে পারি না। শুধু বিগেনার লেভেলে বলতে পারি, মাঝে মাঝে আটকেও যাই। যেমন অনেক চেষ্টা করেও ‘ঝিম ঝিম করা’ শব্দের ইংরেজী বোঝাতে পারি নি, হা হা…। ও হ্যাঁ, এখানে আরও তিনটে নেপালিও আছে। ছোটটা দু’এক শব্দ বাংলাও বোঝে। নেপালে নাকি প্রচুর বাঙালি ভ্রমণে যায়। এই নেপালিরা দেখলাম ইন্ডিয়ায় ভিসা ছাড়াই চলে এসেছে এবং এখানে কাজ করছে।
২) ম্যানেজার বাবুর সাথে চেন্নাই ও তামিল নাডু রাজ্য নিয়ে টুকটাক আলাপ হলো। এই রাজ্যের অনেক মানুষ নাকি হিন্দি ভাষা জানেই না! এখানে আমাদের দেশের মতোই সরকারি চাকরির অনেক ডিমান্ড। মানুষ সরকারি চাকুরির পেছনে অবিরাম ছুটছে। এখানেও সরকারি চাকুরি পেতে ঘুষ দেয়া লাগে, এমনকি বেসরকারি চাকরিতেও ৪-৫ লাখ রুপি ঘুষ নেয়। ভদ্রলোকের সাথে বাংলা ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও আলোচনা হলো। ভাষার জন্যে আমাদের অবদান, স্বাধীনতা প্রসঙ্গ নিয়েও বললাম। তিনি ভেবেছিলেন আমরা বাংলার পাশাপাশি উর্দুও বলি! বললাম, আমাদের দেশের মানুষ উর্দু ভাষা জানেনা বলতে গেলেই চলে, বরং হিন্দি কিছুটা জানে। এছাড়াও তাকে সারা বিশ্বের মুসলিমদের সংখ্যা সম্পর্কে বললাম, একই রকম সালাত পড়ি জানালাম। গর্বের সাথে বললাম, তোমাদের দেশের কিছু রাজ্যের সাম্প্রদায়িক অবস্থার চেয়ে আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক সম্পৃতি অনেক ভালো। তোমাদের দেশের মুসলিমদের চেয়ে আমাদের দেশের হিন্দুরা বরং বেশী সুখে আছে। তিনিও বোধহয় ব্যপারটা জানেন।
৩) চেন্নাইতে বাঙালি এরিয়া বলে খ্যাত- গ্রিমস রোড। এই রোডেই রয়েছে এ্যাপোলো হসপিটাল ও শংকর নেত্রালয়। তাই চিকিৎসার জন্যে ৯৫% বাঙালিই এখানে এসে উঠে। আমি অবশ্য মানি এক্সেঞ্জের জন্যে এই পর্যন্ত দু’বার গিয়েছিলাম গ্রিমস রোডে। এখানে কোলকাতার বাঙালি ও বাংলাদেশীদের দেখা পাবেন। প্রচুর মানি এক্সেঞ্জ, ট্রাভেল এজেন্সি, বাঙালি রেস্টুরেন্ট, হোটেল, লজে এ এলাকা ঠাসা। প্রায় হোটেল-লজের মালিকগন বাঙালি লোক রাখে, যাতে বাঙালি কাষ্টমারদের সাথে সহজে কমিউনিকেট করা যায়। তবে হোটেল-লজ এরিয়া একটু গিঞ্জি মনে হলো, যদিও থাকার ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে পুরাসাওয়াকাম থেকেও। এখানকার সব বাঙালি রেঁস্তোরার খাবার সুস্বাদু নয়। তবে হোটেলে উঠলে নিজেরা বাজার করে বাসার মত রান্না করার মত সুব্যবস্থাও রয়েছে।
৪) গ্রিমস রোড যেহেতু বাঙালি দিয়ে ঠাসা এবং পরিবেশটাও বাঙালি, সেহেতু সেখানে থাকলে চেন্নাইয়ের তামিলদের প্রকৃত পরিবেশ-সংস্কৃতি-খাবার-পোষাক ইত্যাদি সম্পর্কে তেমন জানা হবে না বলে ধারনা করছি। হয়তো বিদেশে এসে কুয়োর ব্যাঙই থাকা হয়ে যেতো, যদি গ্রিমস রোডে থাকতে হতো! পুরাসাওয়াকাম এ থাকায় চেন্নাইয়ের প্রকৃত পরিবেশটা বেশ পেয়েছি।
৫) বাঙালি এবং চিটিং, এই দুই শব্দের খাতিরটা বেশ, এমনকি বিদেশের মাটিতেও! চেন্নাই শহরের বিভিন্ন এরিয়া দাপিয়ে এলাম, কোথাও কোন চিটার-বাটপার দেখলাম না। কালো মানুষগুলোকে পেলাম সৎ ও আন্তরিক। যেখানে থাকি, সেখানে একবার আমার মানিব্যাগ বেখেয়ালে ড্রপ হয়। পরে ম্যানেজার বাবু মানিব্যাগে আমার ন্যাশনাল আইডির কপি দেখে, আমাকে খুঁজে তা ফিরিয়ে দেন। এক পয়সাও নড়চড় হয় নি। কিন্তু কোলকাতা ও গ্রিমস রোডের বাঙালি এরিয়া, দু’জায়গাই বাঙালি চিটিংবাজের খপ্পরে পড়েছি কিংবা চিটিংবাজি দেখেছি। মন খারাপ হয়েছিলো এদের চিটিং দেখে।
৬) একদিন গুগল ম্যাপে আবিস্কার করলাম, আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে ৩-৪ মিনিটের দুরুত্বে মসজিদ। এতদিন আযানের শব্দ কেন যে টের পাই নি, আল্লাহই মা’লুম! সেদিন আসরের সালাত পড়তে গিয়েছিলাম মসজিদে। অচেনা পরিবেশে মসজিদ পেলে আমার আবেগ বেড়ে যায়, খুব করে কান্না এসেছিলো সেদিন। জানিনা, কেনো! হয়তো একাকী থাকতে থাকতে আপন একটা পরিবেশ পাওয়ায়! বিদেশের মাটিতে মসজিদের পরিবেশটা কতোটা আপন মনে হয়, সেটা হয়তো পরবাসীরাই বেশ বুঝবেন।
৫) আসরের সালাত শেষ করে ইচ্ছে করেই পরিচিত হলাম স্থানীয় ক’জন মুসল্লিদের সাথে। ভালোলাগার ব্যপার হলো, চেন্নাইতে মোটামুটি সবাই ইংরেজী বোঝে। শিক্ষিতরা ভালো ইংরেজী বলতেও পারে। তাদের থেকে জানলাম যে, পুরাসাওয়াকাম এরিয়ায় ২৫০ টি মুসলিম পরিবার বাস করে, আলহামদুলিল্লাহ। এরা হানাফী মাজহাব অনুসরন করেন, আবার পুরো মসজিদ জুড়ে সবাই জোরে আমীন বলেন। আমাদের দেশের মত ‘জোরে আমীন বলা নিয়ে’ হাঙ্গামা ও মাযহাবী গোঁড়ামী দেখলাম না এখানে। আমার আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলো- সাম্প্রদায়িক সম্পৃতি। কেমন আছে আমার ভাইয়েরা! উনারা বললেন, চেন্নাইতে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ অনেক ভালো। মুসলিম-হিন্দুরা মিলেমিশে থাকে। তবে গোলমাল রয়েছে অন্যান্য কিছু রাজ্যে। তাদের থেকে জানলাম বাচ্চাদের দ্বীনী জ্ঞান শেখার জন্যে মক্তব হিসেবে এই মসজিদ-ই ব্যবহৃত হয়। এখানেও তাবলীগ আছে (ব্যক্তিগতভাবে আমি তাবলীগ সাপোর্ট করি না)। এদের মাঝে একজন মুরুব্বী পেলাম, যিনি আবার বাংলাদেশে থেকেও ঘুরে এসেছেন।
৬) মসজিদের গলিটা সুনসান, পরিচ্ছন্ন এবং চমৎকার পরিবেশ। এই গলিতে দেখলাম একজন পূর্ণ হিজাবী বোন তার দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে স্কুটি চালিয়ে যাচ্ছেন। আরেক হিজাবী বোনকেও দেখলাম স্কুটি চালাচ্ছে। আসলে ইচ্ছে থাকলে প্রয়োজনের খাতিরে পর্দার ভেতর থেকেও কাজ করা যায়, এই পরিবেশে সেটাও শিখলাম। এদেশের হিন্দু পুরুষদের চেয়ে প্রায় সব মুসলিমদের চেহারাই সুন্দর, পরিস্কার ও উজ্জ্বল। সম্ভবত এটি অযুর স্নিগ্ধ এক মায়াময়ী উপহার। মুসলিমদের সাথে আর কতটুকু মিশতে পারবো জানি না..। তবে সময় ও সুযোগ পেলে ভালোভাবে মেশার ইচ্ছে আছে। আমার ছোট বোনের সাথে আমার সম্পর্ক যতোটা না শ্রদ্ধার ও স্নেহের, তারচেয়েও বেশী বন্ধুতার। আমার মুখে এই শহরের পরিবেশ ও সহজ সরল মানুষের কথা শুনে, তারও নাকি এখানে এসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে!
আচ্ছা কি হয়,
যদি ছোট্ট এই মুসলিম সমাজের মাঝে একেবারে থেকেই যাই? যদি আর না ফিরি..!
২৫১ তম ঘরটি আমার হলে মন্দ কি..!!
জানুয়ারী ২০১৯,
পুরাসাওয়াকাম, চেন্নাই, তামিল নাডু।
আপনার ভ্রমণের কিছু কিছু অংশ আমি নোট করে রাখছি, যাতে চেন্নাই গেলে আমার কাজে লাগে। অসংখ্য ধন্যবাদ এবং শুভকামনা রইলো আপনার জন্য।
আপনার সাথে সাথেই যেন ঘুরে বেড়াচ্ছি তামিল নাডু। দারুণ সব তথ্য।
ভ্রমণ কাহিনী পড়লে জ্ঞান বাড়ে। আমি রীতিমত উৎসাহী হয়ে উঠেছি। ভালো লাগছে আমার কাছে।
অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
ভালোই লিখে চলেছেন। ইনফরমেশনও প্রচুর।
আপনার এই সিরিজটা পড়েছি। সুন্দর বর্ণনা