পূর্ব জেরুজালেম। আল আকসা মসজিদ। পর্ব-২।
ঘণ্টা-খানেক কষে একটা ঘুম দিলাম। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি দুটো কবুতর বসে আছে ব্যালকনিতে। ওরা ভালবাসায় ব্যস্ত আর ঘো ঘো করে চীৎকার করছে। অনেক জাতির কাছে কবুতর দেখা নাকি শুভ লক্ষণ। এসবে আমার বিশ্বাস না থাকলেও মনটা ভাল হয়ে গেল। ছবি তুলতে চাইলাম কপোত কপোতীর। কিন্তু কোত্থেকে একটা বিড়াল এসে সব পালটে দিল। কবুতর-দ্বয় ডানার পত পত আওয়াজ তুলে মিলিয়ে গেল শূন্য দিগন্তে।
সূর্যের তেজ খুব একটা কমেছে বলে মনে হল না। রুমে এসির কারণে প্রচণ্ড শীত। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পরলাম রুম হতে। উদ্দেশ্য দামাস্কাস গেইট।
মানুষ কিলবিল করছে ওখানে। ক্লান্ত টুরিস্টদের দল গেইটের সামনে গ্যালারিতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। অনেকে ছবি তোলায় ব্যস্ত। মূল এন্ট্রিতেই চোখে পরল চার জনের গ্রুপটা। ইসরায়েলি পুলিশ। সেমাই অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে বসে আছে। খুব একটা সিরিয়াস তা বলে যাবেনা। নিজেদের ভেতর হাসাহাসি করছে। একজন মোবাইল ফোনে কি যেন একটা করছে। নিজকে ইনসিগ্নেফিকেন্ট রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই করলাম। খুব দ্রুত গেইট হতে বেরিয়ে চলে গেলাম সামনের স্কয়ারে।
পাশাপাশি দুটো বাস ষ্টেশন। একটা বেথলেহেম ও অন্যটা রামাল্লা গামী। পাশেই কাঁচাবাজার। ক্রেতা-বিক্রেতার দরাদরি শেষ। বিক্রেতাদের সবাই ঘরে ফেরার আয়োজন করছে। ফিলিস্তিনি ছেলেরাও দেখতে খুব হ্যান্ডসাম। দেখলেই মনে হয় পরিশ্রম করছে বাঁচার জন্যে। গায়ে আধুনিক পোশাক হলেও মুখের হাল্কা হাসিটা বলে দেয় ওর ভেতরটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্ণবাদী সাদাদের মত নয়। বেশ কজনকে মাথা নুইয়ে সালাম দিলাম। উত্তরে ওরাও দিল এবং জানতে চাইল কোন উপকার করতে পারে কিনা। অনেকক্ষণ উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটির পর হোটেলের দিক রওয়ানা দিলাম।
পবিত্র শহর জেরুজালেমে সূর্য তখন শেষ রশ্মি ছড়িয়ে ডুবি ডুবি করছে। চারদিকে আরও একবার ভাল করে তাকালাম। পৃথিবীর এ প্রান্তে হয়ত আর কোনদিন আসা হবেনা। কিন্তু আজকের এই অভিজ্ঞতা আজীবন বয়ে বেড়াবো। গল্প করবো যতদিন বেঁচে থাকবো।
হঠাৎ করে নিজকে খুব ভাগ্যবান মনে হল।
১৬ কোটি বাংলাদেশির ঠিক কতজন ইতিপূর্বে এ শহর ঘুর যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে সমীকরণ মেলাতে গিয়ে মনে হল এ সংখ্যা নিশ্চয় খুব একটা বেশী না।
হোটেলে ফিরে এসে লবির কফি ভাণ্ডার হতে এক কাপ গরম কফি বানিয়ে গল্প করতে শুরু করলাম রিসিপশনিষ্ট ইয়াসিনের সাথে। ও প্রতিদিন রামাল্লা হতে বাস ধরে জেরুজালেমে আসে এবং কাজ শেষে ফিরে যায়। চেক পয়েন্টের ঝামেলা নিয়ে অনেকক্ষণ আলাপ হল। হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো আল আকসায় ঢুকতে পেরেছি কিনা। না বলতেই কিছু টিপস দিল। রাত নেমে এসেছে। অন্ধকারের চাদরে ডুবে আছে জেরুজালেম। আল আকসাও এক অর্থে বন্ধ। তবে তা মুসলমানদের জন্যে খোলা। সিকিউরিটি চেকপয়েন্টে লম্বা একটা সালাম দিলেই নাকি ওরা ধরে নেবে আমি মুসলমান এবং ঢুকতে ঝামেলা করবেনা।
খুব দ্রুতই বেরিয়ে পরলাম কালকের কথা ভেবে। আজ এ অভিযান শেষ করতে পারলে দিনটা খালি থাকবে এবং শহরের পশ্চিম দিকে খ্রিষ্টান এলাকায় ঘুরে বেড়াতে পারবো। বিকেলে বাস ধরে রামাল্লা যাওয়ার প্লানেও বাঁধা থাকবেনা।
দিনের আলো থাকায় আগের চেষ্টায় নিরাপত্তার ভয়টা মাথায় চাপেনি। কিন্তু এখন ব্যপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্ধকার চিপা রাস্তা। আলোও নেই তেমন। চাইলে যে কেউ আমাকে ঠেক দিতে পারে। ছিনতাই কাজে আমাদের উপদেশের জন্যে এ হতো আদর্শ লোকেশন। সাহস করে এগুতে থাকলাম। মানুষের চলাচলও কম। অনেকে তখনো দোকানপাট বন্ধ করছে। পুলিশ উপস্থিতিও বেড়েছে অনেক জায়গায়। দুপুরে যেখান হতে আমাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল সেখানে আবারও থামতে হল।
পুলিশ!
প্লান-মত লম্বা সালাম দেয়ার পরও জানতে চাইলো মুসলমান কিনা। ওরা সবাই ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি পুলিশ। এ সময়টায় কেবল মুসলমানদের জন্যে উন্মুক্ত থাকে এ পবিত্র মসজিদ। হাসি দিয়ে নিজের পুরো নাম বললাম। ওরা বোধহয় বিশ্বাস করলো না আমার পোশাকের কারণ। শর্টস ও টি শার্ট। মসজিদে প্রবেশের আদর্শ পোশাক না নিশ্চয়। একজন জিজ্ঞেস করলো কোরানের আয়াত জানি কিনা। অন্যজন জানতে চাইল কালিমা মুখস্থ আছে কিনা। এসবের সাথে যোগাযোগ নেই অনেক বছর। আমি ধার্মিক নই। এর চর্চাও করিনা স্কুল জীবন হতে।
ভড়কে না গিয়ে নিজকে সামলে নিলাম। প্রতিবাদ অথবা তর্ক করার জায়গা এটা না। চোখ বুজে সূরা ফাতেহা মনে করার চেষ্টা করলাম। গড় গড় করে বেরিয়ে এলো.. বিসমিল্লাহে রহমানের রাহিম…। আলহামদুলিল্লাহ রাব্বুল আলামিন। বেশ ক’লাইন বলার পর একজন থামিয়ে দিল। বলল, আমার উচ্চারণ নাকি যথেষ্ট কনভিনসিং না। এবার হতাশ হলাম। সাথে থাকা মার্কিন ড্রাইভিং লাইসেন্সটা এগিয়ে দিলাম। নিজকে মুসলমান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার এই চেষ্টা নিজের কাছে বড় ধরণের হিপোক্রেসি মনে হল। কিন্তু উপায় ছিলনা। ওদের একজন বলে উঠল, ‘সবকিছু দেখে তো মনে হচ্ছে মুসলমান, ছেড়ে দাও’। এবং ছেড়ে দিল।
একটু আগাতেই পথরোধ করে দাঁড়াল সিভিলিয়ান কেউ। গায়ে গতরে বিশাল। বিনয়ের সাথে জানতে চাইল মুসলমান কিনা। এবার মাশায়াল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ জাতীয় দুয়েকটা শব্দ ঝেড়ে দিলাম। মনে-হল সন্তুষ্ট করতে পেরেছি।
বাড়তি কোন ঝামেলা ছাড়াই পা বাড়ালাম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আল আকসা মসজিদের দিকে।
মসজিদ প্রাঙ্গণে অনেক ফিলিস্তিনিরা ঘোরাফেরা করছে। বাইরেটা ভাল করে দেখার পর পা বাড়ালাম ভেতরের দিকে। জুতা খুলে ভেতর ঢুকতে ঠাণ্ডা একটা বাতাস এসে সমস্ত শরীর জুড়িয়ে দিল। আমার মত অনেকে দেখতে এসেছে। ছবি তুলছে। দু’একজন নামাজও পড়ছে। অনেকটা সময় হতবাক হয়ে চিন্তা করলাম, এই সে আল আকসা মসজিদ যার অস্তিত্ব ছোটকাল হতে জেনে এসেছি। জেনে এসেছি এর ইতিহাস, এর বিবর্তন এবং সমসাময়িক পরিস্থিতিতে এর ভাগ্য। অবাক লাগলো এই ভেবে, চাইলেই তো এখানে আসা যায়। আগে আসেনি কেন!
বেশকটা ছবি তুললাম। একজন মহিলা আমার একটা ছবি তুলে দিল। বেশকিছুটা সময় কাটিয়ে দিলাম কিছু না করে। একদম নীরবে। স্মৃতির গলি হাতড়ে ফিরে গেলাম অনেক বছর পিছনে। আব্বা তখনো বেঁচে। দাদা বাড়ির ঘোড়া মাওলানা ওয়াজ শেষে মোনাজাত ধরেছেন… হে আল্লাহ, আল আকসা মসজিদের পবিত্রতা তুমি রক্ষ করো…”
জানিনা কি লেখা আছে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে। তবে তা যাই হোক, তাদের এ সম্পদ, তথা বিলিয়ন মানুষের বিশ্বাস, সন্মান ও শ্রদ্ধার এ স্থান যেন আসল মালিকদের হাতে থাকে এই কামনা করেই বেরিয়ে এলাম আল আকসা মসজিদ হতে। ততক্ষণে রাতের অন্ধকার আরও ঘন হয়ে চেপে বসেছে জেরুজালেমের বুকে। দুপুরের তপ্ত বাতাসের জায়গা করে নিয়েছে হাল্কা ঠাণ্ডা বাতাস। ফেরার পথটা মনে হল ঘোরের মধ্যে হেঁটেছি। মনে হচ্ছিল এ সত্য নয়, নেহাতই স্বপ্ন অথবা কল্পনা। হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাসের পুরানো পাতা উলটাচ্ছি আমি…
.
জেরুজালেম। ২২শে জুলাই, ২০১৯।
আল আকসা মসজিদ যার অস্তিত্ব ছোটকাল হতে জেনে এসেছি। জেনে এসেছি এর ইতিহাস, এর বিবর্তন এবং সমসাময়িক পরিস্থিতিতে এর ভাগ্য বিস্তারিত জানলাম।
মিশন ইজরায়েল যথেষ্ঠ মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে চলেছি ওয়াচডগ ভাই।
মুগ্ধ হলাম পর্বটি পড়ে।
অসাধারণ। চলুক ভাই। আমার ভীষণ ইচ্ছে ধারাবাহিকটি পড়বো বলে।
খুঁটিনাটি বিষয় আর ছবি গুলোন দেখলাম। কত কিছুই না অজানা থাকে। ধন্যবাদ।
বেশ সাজানোগোছানো সুন্দর লেখা।
ভীষণ ভালো লাগা।