ওয়াচডগ এর সকল পোস্ট

দেশ হতে মহাদেশে … সাগর হতে মহাসাগরে!

fft

সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া।
সামার ব্রেকের পর পুরো-দমে ক্লাস চলছে। প্রকৃতিতে শরতের আগমনী বার্তা। একদিকে পাতা ঝরছে, অন্যদিকে দিনগুলো ছোট হয়ে আসছে। তেমনি এক দিনে ডিন অফিস খবর দিল আরও ৫জন বাংলাদেশি আসছে আমাদের কলেজে। ইউক্রেইনের ঝাপারোজিয়া শহর হতে রেলে করে আসছে ওরা। ষ্টেশনে কলেজের বাস যাচ্ছে ওদের আনতে। আমাদের কেউ যাবে কিনা জানতে চাইলে আমি রাজি হয়ে গেলাম।

ষ্টেশনেই পরিচয় ওদের পাঁচজনের সাথে। এই পরিচয় একে একে গড়াবে অনেক বছর। পাড়ি দেবে অনেক পথ, অতিক্রম করবে অনেক দেশ মহাদেশ। এবং সম্পর্ক তুই তুকারিতে গড়িয়ে চিরদিনের জন্যে স্থায়ী হবে।

সে পাঁচজনেরই একজন। ৪ বছরের তিন বছর একই কলেজে একই ডর্মে থেকে এক সময় ছিটকে যাই। ৩ বছর [পর আবারও দেখা হয় সেন্ট পিটার্সবার্গে। আমি যে বছর মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি সে তখন কম্যুনিকেশনের উপর ডক্টরেট করছে।
এরপর দুজনের পথ দুদিকে গড়িয়ে যায়…

ভাগ্যচক্রে আবারও আমাদের দেখা হয়। এ যাত্রায় খোদ বাংলাদেশে। ও আমারই মত ইউরোপের লম্বা পর্ব শেষ করে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে এসেছে। নতুন পরিবেশ পরিস্থিতিতে বন্ধুত্বের শিকড় আরও লম্বা হয়।

প্রফেশনাল তাগিদে ও চলে যায় মধ্যপ্রাচ্যের আবু ধাবিতে। আমিও পাড়ি জমাই তাসমান পাড়ের দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। যোগাযোগ অনেকটাই ফিকে হয়ে আসে।

আমাদের চলমান জীবন যেন কোথাও যেন স্থায়ী হতে চায়না…ভাগ্য আমাকে নিয়ে আসে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এক সময় জানতে পারি সে সপরিবারে মাইগ্রেট করেছে কানাডায় এবং চাকরি নিয়ে চলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে।

গোলাকার পৃথিবীর কক্ষপথ ধরে আমরাও হাঁটছি। এবং সে পথ আমাকে একসময় টেনে আনে মেগা শহর নিউ ইয়র্কে। কোন এক সুন্দর সকালে ও হাজির হল আমার দরজায়। দরজা খুলতে বাঁধভাঙ্গা আবেগ এসে আমাদের নিয়ে গেল কৈশোরে। কত বছর পর দেখা! শুরু হল নতুন এক জীবন। ওখানে আগ হতে যোগাযোগের মধ্যমণি রহমান ছিল। তিন জনই কাজ করি। কর্মদিন সহ প্রায় প্রতিদিনই দেখা হত আমাদের। আড্ডা হত কুইন্সে আমার বাসায়। এভাবে কেটে যায় একে একে ৫টা বছর…

এবার আমার পালা। ওদের দুজনকে নিউ ইয়র্কে রেখে আমি চলে আসি আমেরিকার বুনো পশ্চিমে। মাঝে মধ্যে কথা হলেও দেখা হয়না।

অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট নবায়ন করতে যে যাত্রায় নিউ ইয়র্ক যেতে হয়েছিল। তখন মধ্যরাত। শান্ত হয়ে গেছে মেগা শহর নিউ ইয়র্ক। ফ্লাইট হতে বেরুতেই দেখি ওরা দুজন দাঁড়িয়ে আছে। আবারও দেখা, আবারও সেলিব্রেশন।

শেষপর্যন্ত সেও ছেড়ে যায় নিউ ইয়র্ক। এ যাত্রায় তার গন্তব্য ছিল সূর্যস্নাত ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের অর্লান্ডো। আগে হতেই বাড়ি কেনা ছিল, তাই গুছিয়ে নিতে অসুবিধা হয়নি।

রাত প্রায় ১১টার উপর। আমি জানি সে সকাল সকাল বিছানায় যায়। এ যাত্রায় কথা ছিল গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্যে বাইরে অপেক্ষা করবে। নিউ ইয়র্কের মতই ফ্লাইট হতে বেরিয়ে কিছুটা পথ আগাতে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। সেই আগের মত…যেমনটা ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গে, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সাউথ ডেভনে, নিউ ইয়র্কে।

তিনটা দিন হুট করেই পার হয়ে গেল। এ যাত্রায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে চষে বেড়ালাম ইউনিভার্সাল স্টুডিও, ডিজনি এনিমেল কিংডম, ড্রিম পার্ক সহ অনেক জায়গা। ডেইটনা বীচের আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে আসতেই মনে হল আমাদের বিদায়ের এটাই পারফেক্ট ভেন্যু। এটাই যেন আমাদের শেষ দেখা না হয় তেমন প্রতিজ্ঞা করেই বিদায় জানিয়েছি একে অপরকে। আমি জানি বেঁচে থাকলে আবারও দেখা হবে…কে জানে হয়ত আফ্রিকার কোন গহীন জঙ্গল অথবা দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনে।

আমেরিকা, land of the free, home of the brave!

34 বাহির হতে দেখলে মনে হবে এ আর এমন কি সমস্যা যা নিয়ে জাতি হিসাবে আমাদের ভাবতে হবে? আমেরিকা তার দেশে প্রবেশের উপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যার চলমান কোন ইমপ্যাক্ট নেই। সবটাই সামনের নির্বাচনকে ঘিরে। ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়ে বর্তমানকে বিষাদময় করার কোন কারণ সাধারণ বাংলাদেশিদের নেই। অতীতেও ছিলনা বর্তমানেও নেই।

আমেরিকান ভিসা! বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির জন্যে এটাও কি একটা ফ্যাক্টর? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলনা। আর দশটা দেশের মত আমেরিকাও দূরের একটা দেশ। যুব সমাজের অনেকের কাছে আকর্ষণীয় হলেও কোটি কোটি সাধারণ বাংলাদেশির কাছে আমেরিকা একটি দেশের নাম। ভিসা নিয়ে ঐ দেশে যাওয়ার কোন কারণ নেই তাদের জন্যে। অথচ দেশে তোলপাড় হচ্ছে ভিসা নিয়ে মার্কিনীদের নতুন সিদ্ধান্তে। অনেকে এটাকে দেশটার চলমান নির্বাচনী রাজনীতিকে বদলে দেয়ার ইঙ্গিত হিসাবে দেখছেন।

একটা দেশের ভিসা নীতি তৃতীয় বিশ্বের আরেকটা দেশের রাজনীতি বদলে দেবে অবাক হওয়ার মত ঘটনা বৈকি। আসুন কাহিনীর ভেতর যে আরেক কাহিনী আছে সেখান হতে ঘুরে আসি। আলী বাবা ৪০ চোরের কাহিনীর সাথে আমাদের কমবেশি সবার পরিচয় আছে। এই কাহিনীর যদি একটা ম্যাথম্যাটিক্যাল মডেল তৈরি করি আমেরিকা হবে সেই গুহা যাকে চল্লিশ চোরের দল তাদের লুণ্ঠিত সম্পদ সংরক্ষণের নিরাপদ জায়গা হিসাবে ব্যবহার করে আসছে।

অনেকে প্রশ্ন করবেন গণতন্ত্র নিয়ে আমেরিকার আহাজারির শুরুটা হতে পারে নিজ দেশে চল্লিশ চোরের গুহার প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে। বাস্তবতা হচ্ছে আমেরিকা এটা কোনদিনই করতে যাবেনা। যেমনটা করবে না নিজ দেশে ঘাপটি মেরে থাকা চল্লিশ চোরদের কাউকে আইনের আওতায় আনতে। এর কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে আমেরিকার ফাউন্ডেশনে।

১৫০০ বিসি’র শুরুর দিকে আদিবাসীদের আগমন শুরু হয় আমেরিকায়। ইউরোপিয়ানদের আগমন আরও পরে। পৃথিবীর বিভিন্ন কোনা হতে মানুষ ছুটে এসেছিল ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। দেশটার মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা সোনা আহরণ ছিল অন্যতম কারণ। এভাবে লতায় পাতায় বেড়ে উঠেছে আমেরিকা। ১৭৬০ সালের মধ্যে ২৩ লাখ মানুষ নিয়ে ব্রিটিশরা ১৩টা কলোনি গঠন করে আটলান্টিক সাগরের পাড় ঘিরে। সাউদার্ন কলোনি গঠনের মূল ভিত্তি ছিল কৃষিকাজ। এই কলোনিই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ হতে মানুষ ধরে এনে দাস প্রথার প্রচলন করে। এই সাউদার্ন কলোনির এলাকা গুলোই পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিল গৃহযুদ্ধে পরাজিত হয়ে। এইসব অঙ্গরাজ্য গুলোই আজকে রেড সত্যায়িত হিসাবে পরিচিত, যার বাসিন্দারা ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রিপাবলিকান দলীয় সমর্থক।

লং স্টোরি শর্ট, আমেরিকা অভিবাসীদের দেশ। এ দেশে মানুষ এসেছিল ও আসছে ভাগ্যের সন্ধানে। আসছে লোভের বশবর্তী হয়ে। সময়ের বিবর্তনে এ দেশে ফাউন্ডাররা ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করে এমন একটা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন যার ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কথিত অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তার মত নিশ্চয়তা নেই আমেরিকান শাসনতন্ত্রে। এখানে বাঁচতে হলে লড়তে হয়, আয় করতে হয়, শ্রম দিতে হয়।

আমেরিকায় আপনি বাহির হতে কত আনলেন আর কত নিয়ে গেলেন এ নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। বরং আনা-নেয়ার পথ সুগম ও মসৃণ রাখার নামই আমেরিকান ফ্রীডম। এই ফ্রীডমের সুযোগ নিয়েই বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের করাপ্ট মানুষ আমেরিকাকে নিজেদের অন্যায় ও অবৈধ উপার্জন সুরক্ষা করার গুহা হিসাবে ব্যবহার করে থাকে।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ছেলের কথা নাই-বা টানলাম, বরং নীচের লেভেলে অনেকে যেভাবে অর্থ পাচার করেছেন তার ক্ষুদ্র একটা উদাহরণ হিসাবে উপস্থাপন করা যায় দেশটার এক কালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মরহুম মোহম্মদ নাসিমের সন্তানের কথা। নিউ ইয়র্ক প্রবাসী এই ছাত্র ইতিমধ্যে ঐ শহরে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

বর্তমান আওয়ামী সরকারের প্রায় সবার বিনিয়োগ আছে আমেরিকায়। এর সাথে যোগ হয়েছে দেশটার আমলা, সেনা, পুলিশ সহ সরকারী প্রতিষ্ঠানের অনেক হোমরা চোমরা। রাজনৈতিক ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট-খোরদের অনেকের পরিবার এখন আমেরিকায়। সন্তানরা লেখাপড়া করছে। স্ত্রীরা পানির মত অর্থ উড়াচ্ছে। ওরা আর দশটা খেটে খাওয়া বাংলাদেশির মত আমেরিকা হতে দেশে অর্থ পাঠায় না, বরং দেশ হতে অর্থ আনে। ওরা অর্থনীতির সবকটা খাত হতে লুটছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট ভেঙ্গেও অর্থ সরাচ্ছে। এসব জাতীয় লুটেরাদের মতে দেশ এখন পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতিকেও নাকি হার মানিয়েছে। হ্যাঁ, হার মানিয়েছে সত্য, তবে তা সাধারণ মানুষের জন্যে না, বরং তাদের নিজেদের জন্যে।

আমেরিকা কি খুব একটা কেয়ার করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে?
সহজ উত্তর হবে, মোটেও না। আমেরিকা দেশে দেশে ছড়িয়ে থাকা এক ব্যাক্তি, এক দলীয় ও এক পরিবারের শাসনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। এই তালিকায় যেমন আছে মধ্য প্রাচ্যের রাজা-বাদশার দল, তেমনি আছে সামরিক শাসকদের দল। নিজদের স্বার্থ অবিচ্ছিন্ন রাখার জন্যে আমেরিকা দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে স্বৈরশাসকদের। সেই আমেরিকা বাংলাদেশের মত দুর্বল ও বিশ্ব জিও-পলিটিক্স খেলার ইনসিগ্নিফিকেন্ট খেলোয়াড়কে নিয়ে খেলা শুরু করেছে। রহস্যটা কোথায়?

আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন আগ্রহের অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশটার চীন প্রীতি। বিশ্ব রাজনীতিতে চীন তার ফুট-প্রিন্ট শক্ত করার মানসে তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে দেদারসে বিনিয়োগ করছে। এবং এসব বিনিয়োগ দেউলিয়া বানাচ্ছে অনেক দেশের অর্থনীতি। চীনা বিনিয়োগের অন্যতম কম্পোনেন্ট হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের দুর্নীতি। যেহেতু চীনা অর্থের মালিক দেশটার সরকার, তাই পদ্মা সেতু প্রকল্পের মত মেগা প্রকল্পে নিজদের হিস্যা আদায়ে রাজনীতিবিদদের বিশ্ব ব্যাংকের মত প্রাইভেট এনটিটিতে ধর্না দিতে হয়না। চীনা প্রকল্পে লেনা-দেনা রাজনীতিবিদদের জন্যে সুস্বাদু ও পানির মত মসৃণ। কারণ তা হয় অতি গোপনে উচ্চ পর্যায়ে।
চীনের সাথে মার্কিনীদের বৈরী সম্পর্ক। তার সাথে মরার উপর খরার ঘায়ের মত কাজ করেছে রুশদের ইউক্রেইন আক্রমণ। এই আক্রমণ পশ্চিমা বিশ্বকে এক করেছে। ইউরোপ ও আমেরিকা একহাট্টা হয়ে ইউক্রেইনকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিচ্ছে। এবং এই জোট চাইছে বাকি বিশ্বও তাদের সাথে থাকুক।

এখানেই সমস্যা বাংলাদেশের। বাংলাদেশ জাতিসংঘ সহ অনেক উঁচু পর্যায়ে রুশদের পক্ষ নিয়েছে। ভোট দিয়েছে রুশদের অবৈধ আক্রমণ জাস্টিফাই করতে। আমেরিকা চোখ রেখেছে এসব রুশ মিত্রদের দিকে। নিশ্চিত ভাবে বলা যায় বাংলাদেশ উঠে এসেছ এ তালিকার অনেক উপরে।

মার্সিয়া বার্নিক্যাটের উপর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলা আমেরিকা হালকা ভাবে নিয়েছে ভেবে থাকলে আমরা ভুল করব। তার উপর যোগ হয়েছে বর্তমান রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঘেরাও অধ্যায়। বর্তমান সরকার গায়ে পড়ে আমেরিকার সাথে ঝগড়া বাধিয়েছে। পা দিয়েছে চীনের অনৈতিক অর্থনীতির ফাঁদে। বাংলাদেশ আমেরিকার চোখে এমন কোন দেশ নয় যা নিয়ে তাদের মাথা ঘামাত হবে। কিন্তু খোঁচা দিয়ে ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে দিলে কিছুটা যে ভয় পেতে হয় তার কিছু নমুনা ধেয়ে এসেছে সরকারের দিকে।

আমেরিকার সাথে ইটের বদলে পাটকেল ছোড়ার লড়াইয়ে নেমেছে বাংলাদেশের আপাদমস্তক করাপ্ট সরকার। ভিসা বিধিনিষেধের বদলা নিতে উঠিয়ে নিয়েছে রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে ইসলামী সন্ত্রাসীরা যদি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উপর হামলা চালায় তার দায়-দায়িত্ব হাসিনা সরকারকেই নিতে হবে। এমন কিছু হলে আমেরিকার বদলা হবে আরও কঠিন।

মোরাল অব দ্যা স্টোরি হচ্ছে, জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে গেলেও তা বৈধ হবেনা আমেরিকার চোখে। তার প্রতিক্রিয়া কি হবে তা তারা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। সমস্যা এখানেই শেখ হাসিনার। দেশে হয়ত উচ্ছিষ্ট-খোরদের নিয়ে বহাল তবিয়তে রাজত্ব করতে পারবেন কিন্তু এই রাজত্বের মূল্য দিতে হবে তার আমেরিকা প্রবাসী ছেলেকে। মন্ত্রী সভার সদস্যরা যার বিনিয়োগ করেছেন আমেরিকায় তাদের। এই তালিকায় যোগ হবেন আমলা, সেনা অফিসার সহ আরও অনেকে। হারাবেন লুটের সম্পদ। এক কথায় আমেরিকার হাতে চলে যাবে সিসিম ফাঁক মন্ত্র। আর এই মন্ত্র বলে তারা উন্মুক্ত করবে শেখ হাসিনাদের ডার্টি লন্ড্রি।

আরও একটা বাস্তবতা আমাদের মনে রাখতে হবে; আমেরিকা একক একটা দেশ হলেও তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিশ্বব্যাপী। আমেরিকানদের ভিসা বিধি-নিষেধের উত্তাপ যে ইউরোপ সহ উন্নত বিশ্বের বাকি দেশেও ছড়িয়ে পারবেনা তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়?

স্মৃতির গলিতে একঘণ্টা…

3

সময় নদীর মতই বয়ে যায়…কেবলই বয়ে যায়। নদী এদিক ওদিক ধাক্কা খেলেও সময়কে ধাক্কা দেয়ার কেউ নেই। এ যেন অনন্ত কালের চলা। এ চলার শুরু ও শেষ কোথায় কারও জানা নেই।

সময় গুনে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টালে ৪৫ বছর আগে ফিরে যেতে হবে। সেন্ট পিটার্সবার্গে সে বছর শীত নেমেছিল ক্ষমাহীন রূঢ়তায়। হিমাংকের নীচে ৪৫ ডিগ্রী। সাথে উত্তর মেরুর শীতল বাতাস। রাস্তাঘাট অচল। স্কুল কলেজে মনুষ্য পদচারণা নেই অনেকদিন। আমি ও আমরা ডর্মের জানালায় বসে কেবল প্রহর গুনি কবে বরফ গলা শুরু হবে।

আবুল ফজল মোহম্মদ আকা এএফএম ভাই আমাদেরই একজন। বয়সে দুই বছরের বড় হলেও এক বছর পরে এ দেশে আসায় আমার জুনিয়র হয়ে গেছেন। অবশ্য এ নিয়ে আমাদের বন্ধুত্বের সমীকরণে কোন দাগ লাগেনি।
বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার এলাকার কোন এক গ্রামে।
যে কোন বিচারে ভদ্র ছেলে। আমরা সবাই যখন যৌবনের উদ্দাম ঢেউয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি এএফএম ভাই তখনও পরে আছেন সিলেটের কোন এক কলেজ আঙ্গিনায়। কট্টর না হলেও ধার্মিক। সোভিয়েত দেশের নির্বাসিত ধর্মের লাল চক্ষু উপেক্ষা করে প্রায়ই জায়নামাজে বসে পরেন সৃষ্টিকর্তার ধ্যানে।
বাংলা বলেন সিলেটী সুরে। রান্নাবান্নায় পাকা হাত। খারাপ অভ্যাসের ভেতর এক সিগারেট খাওয়া ছাড়া আর কিছু ছিলনা। মদ মেয়ে মানুষের দিকে সলজ্জ দৃষ্টিতে তাকান।
আমরা সবাই যখন একাধিক মেয়ের শিডিউল নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি এএফএম ভাই তখন অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা। সে পৃথিবীতে সাদা মেয়ে মানুষ নেই। লম্বায় কিছুটা খাটো হওয়ায় কোন মেয়ের সাথে আলাপ করতে দ্বিধায় করতেন যদি রিজেক্ট করে দেয়!

শীতের প্রচণ্ডতা উপেক্ষা করে সে রাতে আমরা বের হয়েছিলাম। নেভা নদীর কোল ঘেঁষে একটা রেস্তোরা আছে। সপ্তাহান্তে ওখানে যৌবনের হাট বসে। সে হাটে অনেক সদাই হাত বদল হয়।
এএফএম ভাইকে অনেকটা জোর করে ওখানটায় নিয়ে যাই। সাথে গেলেও ভদকার বদলে গ্লাসে অরেঞ্জ জুস নিয়ে উপভোগ করেন নৈশ জীবন। ভাল করে দেখলে মনে হবে নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন। এ নিঃসঙ্গতার মূলে যে নারী সহচর্য তা বুঝতে অসুবিধা হয়না।

পাতাল রেলে চড়ে ডর্মে ফিরছি। অন্য সময় হলে যাত্রীর পদভারে মুখরিত হয়ে উঠত ট্রেনের বগি। কিন্তু এ সময়ের শীত অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে শহুরে জীবন হতে, যার অন্যতম শনিবারের ব্যস্ততা।

বগির প্রায় সবকটা সীট ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও মেয়েটা কেন এএফএম ভাইয়ের পাশ বসল এ নিয়ে আমরা সবাই কৌতূহলী হয়ে পরলাম। ঘটনা প্রবাহ কোন দিকে গড়ায় তা দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম।
সামনের শনিবার বিকেল ৫টায় পাতাল রেলের নির্দিষ্ট এক ষ্টেশনে অপেক্ষায় থাকবেন এএফএম ভাই এভাবেই পরিচয় পর্বের সফল সমাপ্তি ঘটে। ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা নাতাশার সাথে সম্পর্কের শুরু এভাবেই।

দৃশ্যপটে উদয় হল নতুন এক এএফএম ভাইয়ের। নিঃসঙ্গতার বলয় হতে বেরিয়ে তিনি এখন অদম্য এক তরুণ। সুখের সাগরে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছেন অচেনা সব নগর বন্দরে।

বহুল কাঙ্ক্ষিত শনিবার দৃশ্যপটে হাজির। এএফএম ভাই সেদিন আর ক্লাসে যাননি। ডর্মে বসেই উপভোগ করছিলেন আগত সুখের শিহরণ।
দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পরলেন।
সুখনিদ্রার পর চেহারায় নাকি অলৌকিক পরিবর্তন আসে। সবকিছু প্রেমময় হয়ে উঠে। চেহারার পাশাপাশি শরীর মনও কাব্যিক হয়ে উঠে। এএফএম ভাই এ বিষয়ে এত গভীর জ্ঞান রাখেন এ ছিল আমাদের জন্যে বিস্ময়কর এক আবিষ্কার।

দুষ্টুমিটা প্রথম আমার মগজে জন্ম নেয়। পল্লবিত হয়ে একে একে সবাইকে গ্রাস করে নেয়।
ঘুমচ্ছেন এএফএম ভাই। সময়মত ঘুম ভাঙ্গার জন্যে ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রেখেছেন। একঘণ্টা আগে বিছানা ছেড়ে প্রস্তুতি নেবেন মাহেন্দ্রক্ষণের। অপেক্ষার সমাপ্তি হতে যাচ্ছে ভেবে তিনি ছিলেন উচ্ছ্বসিত।

এলার্ম ঘড়িটা একঘণ্টা পিছিয়ে দিয়ে বাতি নিভিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে আসি এএফএম ভাইয়ের রুম হতে। এ নিয়ে আমাদের বাকি সবার হাস্য রসের শেষ নেই।
সময় ঘনিয়ে আসার সাথে কোথায় যেন অপরাধ-বোধ জন্ম নিতে শুরু করে। একজন মানুষের এতদিনের অপেক্ষাকে এভাবে হাল্কা করে দেয়ার ভেতর তৃপ্তি নেই ভাবনাটা মাথায় ঢুকতে আবারও ঢুকে পরি রুমে।
তবে শয়তানি বুদ্ধি একেবারে বিদায় নিয়েছে সেটাও না। এ যাত্রায় এলার্ম একঘণ্টা এগিয়ে দিয়ে কেটে পরি।

এএফএম ভাই সব প্রস্তুতি সমাধা করে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে রওয়ানা দিলেন গন্তব্যে। আমরাও এডভেঞ্চার কোন পথে গড়ায় তা জানার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকি।

আধাঘণ্টা অপেক্ষা করে ফিরে এলেন এএফএম ভাই। চোখে মুখে বিষাদের ছায়া। জীবনে ও পথে আর পা বাড়াবেন না এমন একটা প্রতিজ্ঞা করে মুখ লুকালেন।
অপরাধ-বোধটা আরও তীব্র হয়ে উঠল। সহজ সরল এএফএম ভাইয়ের এহেন চেহারা দেখে নিজকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। অকপটে সব স্বীকার করে ক্ষমা চাইলাম। বিছানা হতে টেনে নামিয়ে গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার তাগাদা দিলাম। ৫টা বাজতে তখনও কিছু সময় অবশিষ্ট ছিল।

রাত প্রায় ২টার দিকে ফিরে এলেন। শীতের তীব্রতার কাছে হার না মেনে কি করে এত সময় কাটিয়েছিলেন তা আজও আমার জন্যে রহস্য হয়ে আছে।

এএফএম ভাই ও নাতাশার সাথে দেখা হয়েছিল ৩২ বছর পর তাসমান পাড়ের এক দেশে। ছেলেমেয়ে নাতিপুতি নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছেন।
বাকি সব স্মৃতি রোমন্থনের পর ভয়ংকর শীতের সে সন্ধ্যার স্মৃতি টেনে আনলাম…
‘আচ্ছা আবু ফজল মোহম্মদ ভাই, সেদিন সন্ধ্যায় ঘড়ির ঘণ্টা এক ঘণ্টা পিছিয়ে থাকলে জীবন আপনার কোন বন্দরে ঠাঁই নিত ভেবে দেখেছেন কি?
সে প্রশ্নের উত্তর ছিল একান্ত ব্যক্তিগত যা পাবলিক করা যায়না। তবে জীবন যে একটা জটিল সমীকরণ মেলানোর প্রেক্ষাপট তা অকপটে স্বীকার করলেন। আরও স্বীকার করলেন নাতাশার আগমনে জীবন সুখের সায়রে ভেসে গেছে এমনটা নয়। হয়ত ঘড়ির কাটা উলটো দিকে না ঘুরালেই ভাল হত।

নীপা নদীর গল্প…

3117

অনেক কিছু চাইলেও আর মনে করতে পারিনা। অথবা মনে করতে ইচ্ছে করেনা। সময়ের সাথে বোঝাপড়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আমরা আর আগের মত বন্ধু নই, বরং রেললাইনের মত পাশাপাশি বয়ে যাওয়া অন্তহীন যাত্রার সহযাত্রী মাত্র।

কিছু ঘটনা আছে যার দাগ মুছার নয়। চাইলেও পাতা উলটে অধ্যায়ের ইতি টানা যায়না। নীপা নদীর গল্প তেমনি এক অধ্যায় যা কোনদিনও পুরানো হবেনা। পাতা উলটে অধ্যায়ের ইতি টানা যাবেনা।

আসলে নীপা নামের কোন নদী নেই। মানচিত্র ঘাঁটলে এ নামের কোন নদীর সন্ধান পাওয়া যাবেনা। এ ছিল কৈশোরের একখণ্ড চপলতা, চাঞ্চল্যে ভরা কিছু আবেগের অভয়ারণ্য।

জাপারোঝিয়া। ইউক্রেইনের দক্ষিণ-পূব দিকের অখ্যাত এক শিল্প শহর। কারখানার চিমনি হতে বেরিয়ে আসা ধোঁয়ার চাদরে মুখ ঢেকে রাখে এ শহর। এবং তা বছরের প্রায় ৩৬৫ দিন। শহরের বাতাসও ভারী। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। প্রকট এক উটকো গন্ধ শরীরের সবকটা অঙ্গে লেপটে থাকে। তেমনি এক শহরে লেখা হয়েছিল আমার লম্বা প্রবাস জীবনের প্রথম অধ্যায়।

আঠার বছরের টগবগে তরুণ আমি। অনেকটা মায়ের কোল হতে বেরিয়ে এসে পা রেখেছি বিস্ময়কর এক জীবনে। সকালে ঘুম ভাঙ্গলে কেউ আর টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে অপেক্ষায় থাকেনা। বেলা গড়ানোর আগে দৌড়াতে হয় ক্লাসে। লড়াই করতে হয় হিমাংকের নীচে ২০ ডিগ্রী তাপমাত্রার সাথে। ক্লাস হতে ফিরে আয়োজন করতে হয় রাতের খাবারের। পরদিন ক্লাসের হোম-ওয়ার্ক করতে গিয়ে অনেক সময় মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। জাগতিক অনেক চাহিদাকে বিদায় জানাতে হয় পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার কারণে।

এর পরেও শনিবার আসে। রাজ্যের স্বস্তি নিয়ে ঘরে ফিরে ভুলে যাই ফেলে আসা ছয় দিনের ক্লান্তি। ডর্ম হতে বেরুলেই একটা বড় স্টেডিয়াম। দিনের বেলা খেলাধুলার বিদ্যাপীঠ হলেও রাতে তা পরিণত হয় মানব মানবীর মিলন মেলায়। আরও একটু হাঁটলে দেখা মিলবে ওপেন এয়ার ডিস্কোটেক। বাদামি চামড়ার এমন আদমদের সাথে এই প্রথম সাক্ষাৎ এ অঞ্চলের মানুষদের। আগ্রহের সীমা নেই। বিশেষকরে তরুণীদের।

ভাষা স্কুলের ছাত্র আমরা। সংখ্যায় ১৭ জন। এক বছর স্থায়ী এ কোর্সের শুরুতে প্রায় সবাই জড়িয়ে যায় সম্পর্কে। একজনের সাথে এক শিক্ষিকার সম্পর্ক বলে দেয় পরিবেশের। জীবন কঠিন ও রুক্ষ হলেও তাতে রঙের কমতি ছিলনা।

প্রথম স্কলারশিপের রুবেল হাতে আসতে নড়েচড়ে বসি সবাই। এতদিনের জমানো সমীকরণ মেলানোর তাগাটা হঠাৎ করে জীবন্ত হয়ে উঠে। এ সমীকরণ একেক জন্যে ছিল একেক রকম। বান্ধবীদের নিয়ে বেরিয়ে পরার মেনুটা ছিল সবার উপরে। আমি ও আমার রুমমেট সজল দুজনেই ছিলাম ঘরকুনো। স্থায়ী বান্ধবী আমাদের বড়শিতে তখনও ধরা পড়েনি। রুবেল হাতে কি করা যায় এ নিয়ে দুজনেই গবেষণায় বসে যাই।

মদের দোকানটা আমাদের ডর্ম হতে খুব একটা দূরে ছিলনা। ট্রামে চড়লে একটা স্টপেজ। ভাড়া ৫ কোপেক। অবশ্য ৫ কোপেকে যতক্ষণ না ট্রাম হতে বেরিয়ে আসছি শহরের শেষ মাথা পর্যন্ত জার্নি করা যায়। আমাদের দুই বন্ধুর সিদ্ধান্ত ছিল ফেলে আসা ১৮ বছরের জীবনকে চ্যালেঞ্জ করা। এক বোতল ভদকা কেনার সিদ্ধান্তটা ছিল সে চ্যালেঞ্জেরই অংশ।

দোকানে ঢুকতেই ধাক্কা। ভাষা জ্ঞান কম হওয়ার কারণে ইতিপূর্বে রেকি করে যাওয়া দোকানের ভাষা বুঝতে পারিনি। শনিবার সন্ধ্যা ৬টার পর ভদকা বিক্রি বন্ধ। এমনটাই শহর কম্যুনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত। শহরের জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ শ্রমিক হওয়ার কারণে এখানে এলকোহল সমস্যা আকাশচুম্বী। তাই এ সিদ্ধান্ত।

এক বোতল সস্তা লাল ওয়াইন নিয়ে ডর্মে ফিরে আসি। এখানেও সমস্যা। ডর্মে মদ্যপান বৈধ না। ধরা পরলে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার মত কঠিন শাস্তিরও বিধান আছে। কিন্তু তাই বলে স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীরা মদ্যপান হতে বিরত থাকবে এমন দেশ এটা নয়। মদ্যপান এখানে অনেকটা বাধ্যতামূলক। শিশুর জন্ম যেমন উৎযাপন করা করা হয় মদ্যপান দিয়ে একই শিশু বেড়ে উঠে কবরের দিকে রওয়ানা দিলে সেটাও সেলিব্রেট করা হয় মদ দিয়ে।

রাতের খাবারে অতিরিক্ত কিছু যোগ করে তৈরি হই নতুন অধ্যায়ের। দরজা বন্ধ করার আগে বাকি সবাইকে অনুরোধ করি কিছুটা সময়ের জন্যে বিরক্ত না করতে।

সজলের চোখে মুখে দুশ্চিন্তার রেখা ধরতে আমার সময় লাগেনি। বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সজলের চেহারায় ছিল শিশু সুলভ একটা ভাব। বুঝা যায় জীবনের অনেক অধ্যায়ের সাথে দেখা হয়নি।
কারণ জানতে চাইলে সে ভেঙ্গে পরল। তার গলায় ঝুলে থাকা দুটো তাবিজের দিকে ইঙ্গিত দিল। চোখ আর নাকের পানিতে ভেসে কোলের সন্তানকে বিদায় দেয়ার আগে মা অনেক কষ্ট করে যোগার করেছিল তাবিজ দুটো। সজলের ভয় তার গলায় তাবিজ নয়, খোদ মা ঝুলে আছেন এবং চোখ কান খোলা রেখে দেখছেন তার কর্ম।
তাবিজ শরীরে থাকা পর্যন্ত সে মদের গ্লাসে হাত দিতে পারবেনা, এমনটাই তার সিদ্ধান্ত। আমিও বাধা দিতে পারলাম না। কারণ মার স্মৃতি আমারও তখন অনেক কাছের। উঠিয়ে রাখলাম মদের বোতল সে যাত্রায়।

পরদিন প্রস্তাবটা দিতেই সজল রাজী হয়ে গেল।
ট্রাম ধরে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। ঘণ্টা খানেকের পথ। অন্য কোন বিকল্প নেই। ওখানে গেলেই দেখা মিলবে নীপা নদীর। আমার প্রস্তাব ছিল নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে তাবিজ দুটো। মদ্যপানে পাপ বলে কিছু থাকলে তারা তার সাক্ষী হবেনা। বরং নদীর পানিতে ডুবে আরও পুত পবিত্র হয়ে যাবে।
সজলের পছন্দ হয়েছিল আমার বিশ্লেষণ। এবং পরের রোববার খুব ভোরে কাউকে কিছু না বলে দুজনে বেরিয়ে পরি নীপা নদীর সন্ধানে।

নীপা নদীটার আসল নাম না। এর নাম দিনেপ্রর। বিশাল এক নদী। লম্বায় ইউরোপের ৪র্থ বৃহত্তম। ভালদাই পাহাড়ে জন্ম নিয়ে রাশিয়া, ইউক্রেইন ও বেলারুশ হয়ে মিশে গেছে কৃষ্ণ সাগরে। ভলগা, দানিয়ুব ও উরাল নদীর পরেই লম্বার বিবেচনায় দিনপ্রর স্থান। স্থানীয়রা আদর করে এর নাম দিয়েছিল নীপা।

বিশাল একটা হাইড্রোলিক পাওয়ার স্টেশনের বাঁধে এসে থামে আমাদের জার্নি। নদীকে আটকে বিদ্যুৎ তৈরির এমন কারখানার সাথে এটাই আমাদের প্রথম পরিচয়। লেনিনের নামে তৈরি এ বাঁধও সোভিয়েত দেশের গর্ব। বাঁধটার ঠিক মাঝেমাঝে এসে দুজনে থেমে যাই। গলায় ঝোলানো স্বর্ণের চেইন হতে তাবিজ দুটোকে খুলে ছুড়ে ফেলি নদীতে। আমি নিজেও অংশ নেই এ অভিযানে। সজলকে নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম পাপ বলতে কিছু থাকলে তা বন্ধুর সাথে ভাগাভাগি করতে আমার আপত্তি নেই।

এবং এখানেই শেষ ও শুরু দুই জীবনের। বলা চলে সীমান্ত অতিক্রম করা। সীমান্তের ওপারে ছিল মা-বাবা ভাই-বোনদের আদর স্নেহ ও ভালবাসা, আর এপারে ছিল নতুন এক জীবনের হাতছানি।

নীপা নদীর কাছে আশ্রয় চাওয়ার এ ছিল কেবল শুরু। এ নদীতে অনেক পানি বইবে। তার সাথে আমি ও আমরাও পাড়ি দেব অনেক অজানা অচেনা ঘাঁট। নদী পাড়ের এক বছরের জীবন নিয়ে লিখতে গেলে হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাস লেখা যাবে। যেখানে থাকবে জীবন যুদ্ধে বেড়ে উঠার সব উপাদান।

নীপা নদীকে এ লেখাটা লেখার তাগাদাটা এসেছে আজকে একটা খবর পড়ে। জাপরোঝিয়ার একটা বিরাট অংশ দখলে নিয়ে পুতিন বাহিনী ওখানে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। কেবল হাইড্রোলিক পাওয়ার ষ্টেশনই না, ইউরোপের বৃহত্তম পারমাণবিক পাওয়ার ষ্টেশনের দখল নিয়ে ব্লাকমেইল করছে স্থানীয়দের জীবন। শহরের পাবলোকিসকাস এলাকার যে মদের দোকানটায় শুরু হয়েছিল জীবনের নতুন এক অধ্যায় তার খুব কাছে দুটো মিসাইল আঘাত হেনেছে। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে ওখানকার সবকিছু।

শান্ত যে নদীতে এক সময় তাবিজ ডুবিয়ে পুত পবিত্র হওয়ার চেষ্টা করেছি সে নদী এখন অশান্ত। কৈশোর যৌবনের অনেক অলিগলি এখন ক্ষতবিক্ষত। কষ্টটা এখানেই।

এন্ডিসের অসমাপ্ত গল্প…

31459

ভ্রমণ মানেই উপভোগ। অজানাকে জানার অচেনাকে চেনার হাতছানি। সীমিত সামর্থ্যের ভেতর যতটুকু সম্ভব ততটুকুই আমি ঘুরে বেড়াই। অন্যদের তুলনায় এই ঘুরে বেড়ানোর পরিসরটা আমার বেলায় একটু প্রসারিত সুযোগ ও সময়ের কারণে। উপভোগ করি বলেই ভ্রমণ করি। কিন্তু এই উপভোগ মাঝে মধ্যে নাইট্মেয়ার হয়ে দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করে। চাইলেও স্মৃতির পাতা হতে মুছে ফেলা যায়না।

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর উত্তর দিকে Churin নামের ছোট একটা শহর আছে। ছবির মত সুন্দর। চারদিকে এন্ডিস পর্বতমালা। অনেকটা উপতক্যার মত এই শহরে বছর জুড়েই রাজত্ব করে সুনসান নীরবতা।

শীতকালে পর্যটকরা ভিড় জমায়। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ন্যাচারাল জলপ্রপাত প্রকৃতি প্রিয় মানুষদের হাতছানি দিয়ে টানে। হোটেল মোটেলেরও অভাব নেই। এ ছাড়া পেরুভিয়ানদের জন্যে আকর্ষণের আরও একটা কারণ হচ্ছে দেশটার লো-ল্যান্ডে যখন শীত এন্ডিসের উচ্চতায় তখন গ্রীষ্মকাল। এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা আমার জানা নেই। শুধু জানি একই দেশে একই সময় শীত ও গ্রীষ্মকাল পাশাপাশি দাপিয়ে বেড়ায়।

প্রস্তাবটা ছিল আমার গিন্নীর। মধ্য জুনের কনকনে শীত রাজধানী লিমা কাবু হয়ে থাকে। কুয়াশার ঘোমটা হতে দিনে একবারের জন্যেও মুখ খোলেনা। চারদিকে একধরণের স্থায়ী বিষণ্ণতা। এমন এক পরিবেশে বেশীদিন বাস করলে ডিপ্রেশন চেপে ধরে। গিন্নীর তা জানা ছিল। লিমার মন খারাপ করা আবহাওয়া হতে বেরিয়ে ঝলমলে রোদে যাওয়ার জন্যেই Churin নামটা সামনে আসে। আমার কোন আপত্তি ছিলনা। নতুন কিছু দেখতে নরকে যেতেও প্রস্তুত আমি।

লিমা হতে প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টার পথ Churin। একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর অন্যদিকে মাইটি এন্ডিস পর্বতমালা, যে কারও মন কাড়াতে বাধ্য। যাত্রার শুরুতেই সমস্যা। ঘন কুয়াশায় বাসের গতি ডেড-স্লো করতে বাধ্য হচ্ছে ড্রাইভার। এমন ভৌতিক পরিবেশে বাস জার্নি ভয় ধরিয়ে দেয়। যে কোন সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নিয়েই বাসগুলো রাস্তায় নামে। বুকে অসীম সাহস না থাকলে এ পথে পা বাড়ানো খুব কষ্টের।

লিমা ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই জনবসতির ঘনত্ব কমে আসতে শুরু করল। শহরের চাকচিক্য ছাপিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করল পেরু নামের দেশটার বিবর্ণ চেহারা। ঘণ্টা খানেক চলার পর পীচ-ঢালা রাজপথ ছেড়ে আমাদের ধরতে হবে ইট-সুরকির কাঁচা রাস্তা। গিন্নীর এমন ঘোষণায় অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। মূল কারণ, আমাদের বাস ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। SYAN নামের এক জরাজীর্ণ শহরে আমাদের প্রথম স্টপেজ। এক ঘণ্টার মত বিরতি। দুপুরের খাবার সেরে নেয়ার শেষ সুযোগ।

প্রশান্ত মহাসাগরের ফ্রেশ মাছ, সাথে ফ্রাইড পটেটো দিয়ে খাওয়া শেষ করে বিল দিতে গিয়ে অবাক। রেস্টুরেন্টের সবাই আমার গিন্নীকে চেনে। কারণ জিজ্ঞেস করতে জানাল এক সময় এই রেস্টুরেন্টের মালিক ছিলেন গিন্নীর নানী। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে রাস্তায় বের হতে গিন্নী তাড়া দিল দৌড়ানোর। কিছু বুঝে উঠার আগে শুরু করলাম গিন্নীর পিছু নেয়া। দৌড়ে আরও উচ্চতা ডিঙ্গচ্ছি আমরা। মুখ হতে জিহ্বা বেরিয়ে আসার উপক্রম। কিছুটা পথ পাড়ি দেয়ার পর একটা পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে থামলাম আমরা।

বাড়ির সামনের গোপন কুঠুরি হতে ভোজবাজির মত বেরিয়ে এলো একটা চাবি। এবং সেই চাবি দিয়ে মূল ফটকের তালা খুলে ঢুকে পরলাম এন্ডিসের মতই বিবর্ণ চেহারার বাড়িটাতে। এই বাড়ির মালিকও গিন্নীর নানী। তিনি বেঁচে থাকতে বার বার অনুরোধ করে গেছেন আমরা যেন কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও এখনটায় থামি। অযত্ন অবহেলার সাক্ষী বাড়ির সবকিছুতে। বুঝা যায় অনেকদিন এখানটায় কেউ আসেনি।

কিছুটা সময় বিছানায় আরাম করে পথের ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করলাম। বাথরুম শেষে রওয়ানা দিলাম উলটো পথে।

এবং এখানেই ছিল পীচ-ঢালা পথের শেষ এবং সমস্যার শুরু।
আকাশের দিকে উঠছি আমরা। হিসাব কষলে ৪৫ ডিগ্রী হবে হয়ত বাসের জিয়োমেট্রি। ঠিক যে ডিগ্রীতে বিমানবন্দর হতে বড় বড় বিমান উড়ে যায়। তলপেটে একধরণের চাপ অনুভব করতে শুরু করলাম। অস্বস্তি বাড়তে লাগলো। সাথে সীমাহীন ভয়। প্রয়োজনে ব্রেক কষলে বাসটা থামানো যাবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ হল।

গিন্নীর দিকে তাকালাম। নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। এন্ডিসের বিশালতায় এক ধরণের মায়াবী টান আছে। একবার প্রেমে পরলে সহজে উঠে আসা যায়না।

মাচু পীচুর উচ্চতার কথা মনে হল। একই কায়দায় উপরে উঠেছিলাম। তবে রাস্তা ছিল মসৃণ। ছিল আধুনিক যানবাহনের সব সুবিধা। কিন্তু এ যাত্রায় এ সবের লেশমাত্র ছিলনা। অথচ জানামতে এদিকটায়ও পর্যটকরা নিয়মিত ভিড় জমায়। বিদেশি না হোক স্থানীয়দের সংখ্যাও কম না। জীবনে এই প্রথম বাস জার্নিতে বমির ভাব অনুভব করলাম। কখন কোথায় বেরিয়ে আসবে ভাবতে অস্থির লাগলো। গিন্নীকে বলতে ব্যস্ত হয়ে পরল ড্রাইভারকে বুঝাতে। সময়মত না থামলে নোংরা কাজটা হয়ত ভেতরে সমাধা করতে হতো।

বাসের বাইরে পা রাখতে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। আমি কি রাস্তায় পা রাখছি, নাকি এন্ডিস পর্বতমালার খোলা ফাঁদে পা দিয়ে চিরদিনের জন্যে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছি বুঝতে পারছিলাম না। নীচের দিকে তাকাতে মাথা ভো করে ঘুরে উঠল। গিন্নী পাশে না থাকলে হয়ত পরেই যেতাম। নিজকে কিছুটা আড়াল করে হর হর করে বমি করে ফেললাম। ড্রাইভারের কাছ হতে যথেষ্ট সময় নিয়েছি তাই গিন্নীর গো-এহেড সিগন্যাল পেয়ে প্যান্টের বোতাম খুলে বাকি কাজটা সেরে নিলাম।

এ যেন অনন্তকালের যাত্রা। ধীরে পিপড়ার গতিতে চলছে আমাদের বাস। ভেতর আমি শক্ত হয়ে প্রহর গুনছি। এক একটা বাঁক পাড় হচ্ছি আর নতুন নতুন ভয় এসে ভর করছে। কি হবে যদি এখানেই আমার ইতি হয়!
বাসের বাকি যাত্রীরা ছিল নির্বিকার। চোখ মুখ ভাবলেশহীন। আমার মত এদিক সেদিক চোখ ঘুরাচ্ছে না। ইট সুরকি আর পাথরের রাস্তা দিয়ে বাসের ভার্টিকেল জার্নিতে ওরা হয়ত অভ্যস্ত। কিন্তু সমতলের মানুষ। কিছুতেই সহজ হতে পারলাম না।

চার ঘণ্টার জার্নি সাত ঘণ্টায় এসে ঠেকল। শেষ কখন তার কোন ইঙ্গিত নেই। গিন্নী ইতিমধ্যে বিরক্ত হয়ে গেছে একই প্রশ্ন বারবার শুনতে গিয়ে। শুধু আশা দিচ্ছে, এই সামনেই আমাদের যাত্রার শেষ।
এন্ডিসের কোল ঘেঁষে শুয়ে আছে ছবির মত সুন্দর একটা লোকালয়। পর্বতমালার বুক-চিড়ে শেষ বাঁকটা পার হতে চোখের সামনে আছড়ে পরল চুরিনের প্যানোরমা।

314699

এত লম্বা লেখা আমিও লিখতে পারি ভুলে গেছি প্রায়!

3115

প্রকৃতির পরিবর্তন কত দ্রুত ঘটতে পারে পূর্ব ইউরোপের ঐ অংশে বাস না করলে হয়ত বুঝতে পারতাম না। শীতের রাজত্ব ঐ অঞ্চলে প্রশ্নাতীত। সেই যে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তুষারপাত শুরু হয় তার শেষ কবে কেউ জানেনা। ডিসেম্বরের শুরুতে বরফ এসে জায়গা করে নেয় তুষারপাতের। জমজমাট শক্ত বরফ এতটাই শক্ত হয় নদীর পানি জমে যায়। সে নদীতে সাদা সাদা পাল তোলা নৌকার বদলে চলে যন্ত্রচালিত ট্রাক। মৎস শিকারীর দল নদীর উপর তাবু গেড়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে দেয় শিকারের আশায়। আর আমার মত যারা পৃথিবীর অপর প্রান্ত হতে এ অঞ্চলে পাড়ি জমায় তারা ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে প্রহর গোনে বসন্তের। অনেক সময় বসন্তও কথা রাখেনা। মুষলধারার তুষারপাতের নীচে চাপা পরে যায় অপেক্ষার পালা।

মে মাসের নয় তারিখেও তুষারপাতের মোকাবেলা করতে হয়েছিল এক বসন্তে। শীতে তাপমাত্রা মাঝে মধ্যে হীমাংকের নীচে ৪০ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যায়। স্থবির হয়ে যায় জনজীবন। বরফ ডিঙ্গিয়ে স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয়না বাচ্চাদের। অঘোষিত ছুটিতে যেতে হয় তাদের। সাইবেরিয়ার দিকে অবস্থা আরও কঠিন, আরও কষ্টের। সোভিয়েত লৌহ শাসনের গোড়ার দিকে যারা বিরুদ্ধচারন তাদের অনেককেই নির্বাসনে পাঠাতো সাইবেরিয়ার কঠিন প্রকৃতির সাথে লড়াই করতে। ঐ দিকটায় শীতের দিকে যাওয়া আমার মত এশিয়ান কারও পক্ষে যাওয়া মানে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ানো।

কোন এক গ্রীস্মে ঘটনাচক্রে সৌভাগ্য হয়েছিল রুশ দেশের তুন্দ্রা অঞ্চলে ঘুরে আসার। মনুষ্য জীবন ওখানে কঠিন। বেঁচে থাকতে প্রতিদিন প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করতে হয়। এসব নিয়ে ঐ অঞ্চলের মানুষের খুব যে একটা অভিযোগ আছে তা নয়। বরং খাপ খাইয়ে নিয়েছে প্রকৃতির এসব রুদ্রমূর্তির সাথে।

বসন্ত হঠাৎ করেই চলে আসে। ছাদ হতে বরফের বিশাল সব চাই মাটিতে আছড়ে পরে। ডর্মের রুমটায় বসে সে আওয়াজ শুনলে মন হাল্কা হয়ে যায়। আমরা বুঝতে পারি বসন্ত আসছে। বরফ গলতে শুরু করে। রাস্তা-ঘাট পানি আর কাঁদায় ভরে যায়। তারপর একদিন সূর্য পূব দিগন্তে মুখ তুলে জানায় আগমনী বার্তা। কদিন একনাগাড়ে উত্তাপ ছড়ালে রাস্তা-ঘাট পরিস্কার হয়ে যায়। গাছে গাছে সবুজের সমারোহ কখন যে জায়গা করে নেয় টেরই পাওয়া যায়না।

পোল্যান্ড সীমান্ত ঢুকে গেছি অনেকক্ষণ হয়েগেছে। বেলাওয়াস্তকে ট্রেনের চাকা বদলানোর সময় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস হাজির হয়। ওদের চেক করার বিশেষ কিছু থাকেনা। কারণ দেশটায় আমার মত যাত্রীরা থাকতে আসেনা। ট্রানজিট ভিসা নিয়ে পাড়ি জমায় পশ্চিমের দিকে। যদিও ষ্ট্যুরিষ্টদের আকর্ষণ করতে সরকারী চেষ্টার অন্ত থাকেনা।

অদ্ভূত এক দেশ এই পোল্যান্ড। সোভিয়েত বলয়ের অন্যতম প্রধান দেশ। ওয়ারশ সামরিক প্যাক্টকে ঘিরে পল্লবিত হয়েছে সোভিয়েত সামরিক শক্তি। অথচ দেশটার সীমান্তে পা রাখলেই চোখে পরে এর দৈণ্যতা। চারদিকের বাড়ি-ঘরে ক্ষয়ের চিহ্ন। চোখে পরার মত কোন জৌলুষ নেই। একজন ইমিগ্রেশন অফিসার এসে যখন জিজ্ঞেস করে এক্সচেঞ্জের জন্য ডলার-পাউন্ড আছে কিনা, এক লহমায় ধরে নেয়া যায় দেশটার অর্থনৈতিক ভীত

ঘটনা আরও কয়েক বছর আগে। সে বছর গ্রীস্মকালীন ছুটি কাটিয়ে লন্ডন হতে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে যাচ্ছি। ওয়ারশতে আমার ট্রানজিট। ট্রেন বদলাতে হবে। ইউরোপের আর দশটা দেশ মনে করে কাউন্টারে হাজির হয়ে আমার ফিরতি জার্নির টিকেট দেখাই। রাতে ঘুমানোর মত একটা সীট দরকার আমার। কাউন্টারে মধ্যবয়সী এক মহিলা ম্যাগাজিন উলটে সাজগোজের কিছু একটা দেখছিল। আমাকে দেখে মুখ কুচকে ফেললো। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি চাই। পূর্ব ইউরোপের মানুষদের গায়ের রঙ নিয়ে এলার্জিতে ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই অবাক না হয়ে বিনয়ের সাথে একটা রাতের ট্রেনের একটা সীট চাইলাম। মহিলা কোনদিক না তাকিয়ে নিমিষের মধ্যা আমাকে জানিয়ে দিল আগামী ৭ দিনের জন্যে কোন সীট নেই। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো। আগামী ২৪ ঘণ্টায় আমাকে সোভিয়েত সীমান্তে পা রাখতেই হবে। নইলে কোনদিনই ঢুকতে পারবোনা দেশটায়। কঠিন আইনের দেশ এই সোভিয়ত ইউনিয়ন।

মন খারাপ করে প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে আছি। সম্ভাব্য সব সিনারিও বিশ্লেষন করছি। পাশে কেউ একজন বসেছে টের পেলাম। কালো আফ্রিকান একজন। হাতের পোটলা পুটলি দেখে বুঝতে পারলাম সে-ও আমার মত সোভিয়ত ইউনিয়নে যাচ্ছে। পার্থক্য হচ্ছে, ওর মুখে হাসি এবং প্রাণ খুলে মনের আনন্দে গান গাইছে।

আমার সমস্যা তুলে ধরতে সে হো হো করে হেসে উঠলো। মিনিটের ভেতর সমাধান দিল। কারণ সেও একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল।

বুক পকেটে একটা পাঁচ পাউন্ডের নোট রেখে আবারও গেলাম কাউন্টারে। একই মহিলা। আমার মুখ দেখার আগে দেখলো আমার বুক পকেট। লম্বা একটা হাসি দিয়ে আবারও জানতে চাইলো আমার প্রয়োজন। উদ্দেশ্য পরিস্কার করার পর জানতে চাইলো মূল্য পরিশোধ করবো কোন কারেন্সিতে। সদ্য পরিচিত আফ্রিকান বন্ধুর উপদেশ মত আঙ্গুল তুলে বুক পকেটের দিকে ইশারা দিলাম।

মন্ত্রের মত কাজ দিলো। তোতা পাখির মত উত্তর দিল, রাতের জন্যে অপেক্ষা করতে না চাইলে আধাঘণ্টার ভেতর একটা ট্রেন আসবে। গাদানক্স ঘুরে গ্রদনোর দিকে যাবে। রাতের সীটেই ফয়সালা করলাম। মূল্য ৫ পাউন্ড। সমাজতন্ত্র পৃথিবীর এ অঞ্চলের মানুষকে কতটা কলুষিত করেছিল তার চমৎকার একটা ডিসপ্লে এই ট্রেন জার্নি।

ঘণ্টা দেড়েক পর রাজধানী ওয়ারশ এসে থেমে গেলো আমার ট্রেন। এখানে লম্বা একটা বিরতি। রিফ্রেশমেন্টের জন্য সবাই ট্রেন হতে নেমে পরে। এই নেমে পরায়ও অনেক রকম বিপদ থাকে। এই যেমন পোলিশ মহিলাদের খপ্পর। ভুলিয়ে বালিয়ে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে সব কিছু রেখে উলংগ করে ছেড়ে দেয়ার কাহিনীও শুনেছি অনেকের মুখে। এ পথে এতবার জার্নি করেছি সবকিছু আমার মুখস্ত। কারও চেহারা দেখে বলে দিতে পারি তার উদ্দেশ্য। ষ্টেশনে নেমে কিছু কেনাকাটি করলাম। এখানে সোভিয়েত মুদ্রা রুবেলেও কেনাকাটি করা যায়। পকেটে বেশকিছু রুবেল ছিল, যতটা সম্ভব খরচ করে অতিরিক্ত কিছু খাবার ও পানি কিনে ফিরে গেলাম ট্রেনে।

এবার লম্বা একটা ঘুমের পালা। খুব ভোরে ট্রেন সীমান্ত শহর ফ্রাঙ্কফোর্ট-আন-ডের-ওডের দিয়ে পূর্ব জার্মানীতে ঢুকবে। অবশ্য মাঝখানে পোলিশ শহর পজনানে কিছুক্ষণের জন্যে ট্রেন থামবে যা আমি টের পাবোনা। আমাকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঢুকতে হবে সমাজতন্ত্রের ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার পূর্ব জার্মানীতে। শেষ রাতের দিকে জার্মান সীমান্তরক্ষীদের কর্কশ ডাকে ঘুম ভাঙ্গবে।

তুমি কি কেবলই ছবি?

3021

এ লেখাটা আমার পছন্দের লেখার একটা। যে রাস্তাটার কাহিনী নিয়ে লেখা তা এখন ফুলে ফেপে একাকার হয়ে গেছে…

চাইলে এই একটা ছবি নিয়েই লেখা যাবে বিশাল ক্যানভাসের গল্প। অনেকে বলবেন রাজনীতির গল্প, কারণ রাজনীতি বাদে আমি অন্যকিছু লিখতে জানি না। আপনারা সঠিক হলেও ক্ষতি নেই। অন্যের কাছে যা রাজনীতি আমার কাছে তা জীবন। আমি যা লিখি তা আমার জন্যে জীবনের গল্প।

চোখে পরার মত এমন কিছু নেই ছবিটায়। শূন্য একটা রাস্তা। উঁচু-নিচু ও আঁকাবাঁকা হয়ে চলে গেছে দুরে বহুদূরে। মনে হবে আকাশের সাথে মিশে গেছে দিগন্ত রেখায়। শখের ছবি নয় এটা, অফিসের প্রয়োজনে তোলা। আমার গল্প ছবিকে ঘিরে কি হচ্ছে বা কি হতে যাচ্ছে তা নয়, বরং এ রাস্তায় কি হচ্ছে না তা নিয়ে এ লেখা।

ছ’মাস আগের কথা। অফিসের কাজে প্রথম যেতে হয় রাস্তাটায়। রাস্তা বলতে খোলা মাঠ ধরে বয়ে যাওয়া সূক্ষ্ম একটা রেখা। বলা হল দুমাসের ভেতর ফুটে উঠবে এর আসল চেহারা।

টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে আমার কাজ হবে এলাকায় ল্যান্ডফোন ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ডিজাইন করা। একটু অবাকই হয়েছিলাম খোলা মাঠের জন্যে হাইস্পিড ইন্টারনেটের কথা ভেবে। দুই মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প। বাংলা টাকায় প্রায় ১৪ কোটি টাকা। টেন্ডার যেদিন চূড়ান্ত হয় অফিসের কোথাও কোন উত্তেজনা চোখে পড়ল না। প্রবেশ মুখে তরুণ, উদীয়মান ও উঠতি ব্যবসায়ীদের কাউকে জটলা করতে দেখা যায়নি। এ কাজে ৫০ বছরে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গে-হার্ড ইনক্‌ নামের কোম্পানি কাজ পাওয়ায় অস্ত্র হাতে কেউ ঝাঁপিয়ে পড়েনি তাদের উপর।

রিও রাঞ্চো শহরের মেয়র টমাস সুইসট্যাক, অঙ্গরাজ্যের নব নির্বাচিত সিনেটর টম উডাল অথবা বিদায়ী গভর্নর বিল রিচার্ডসনকে ফোন করতে হয়নি নিজ ক্যাম্পের কাউকে কাজ দেয়ার সুপারিশ নিয়ে। টেন্ডারের একটা অংশ লোকাল প্রতিনিধি মারফত প্রেসিডেন্ট ওবামার অফিস হয়ে তার ১৫ বছরের মেয়ে মালিয়ার পকেটে যাবে এমনটাও কাউকে বিবেচনা করতে হয়নি। টেন্ডার হেটে গেছে টেন্ডারের পথে। ও পথে ওঁত পেতে থাকেনি ডেমোক্র্যাট অথবা রিপাবলিকান দলীয় হায়েনা।

রাস্তাটার কোন নাম ছিলনা। আর থাকলেও আমার মত সাধারণ প্রকৌশলীর তা জানার কথা নয়। কাগজপত্র ঘাটতে গিয়ে জানা গেল নাম হবে 19th Street। এর সামনে পেছনে ১৮তম ও ২০তম রাস্তা। নামকরণ নিয়ে অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্রেট আর রিপাবলিকান নেতাদের মারামারি করতে হয়েছে এমন সাক্ষী কেউ দেবেনা। নাম হেটে গেছে নামের পথে।

ও পথে গভর্নর রিচার্ডসনকে দেখা যায়নি নিজের মা-বাবার কবর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। রাস্তার নাম নিয়ে যেমন কেউ মাথা ঘামায়নি তেমনি রাস্তা যেদিন খুলে দেয়া হবে রাজধানী সান্তা ফে হতে কারও আসার দরকার হবেনা। মোড়ে মোড়ে তোরণ নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দেবেনা। ১৯তম রাস্তায় নামবে না মিডিয়ার ঢল। রাস্তা হেটে যাবে রাস্তার পথে, কারণ এটাই জনপ্রতিনিধিদের কাজ। আপনি বলবেন এ তো আমেরিকা, পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী দেশ, এ দেশে এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক।

আপনি সঠিক হলেও আমার আপত্তি নেই। ঘুম ভেঙ্গে আয়নায় তাকালে যার মুখ দেখি সে একজন মানুষ। দুহাত, দুপা, দুকান আর দুচোখ ওয়ালা স্বাভাবিক মানুষ যার সাথে সামান্যতম পার্থক্য নেই রিও রাঞ্চো শহরের সাধারণ মানুষের।

অর্ধ শতাব্দী আগে যে আমেরিকায় সাদাদের বাসে কালোদের চড়ার সুযোগ ছিলনা সে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এখন কালো। চাইলে সবই সম্ভব, তবে তার জন্যে চাই মনের দরিদ্রতা হতে বেরিয়ে আসা। সন্দেহ নেই নিকট ভবিষ্যতে বদলে যাবে ১৯তম রাস্তার চেহারা। যে রাস্তার শুরুটা ছিল শূন্য হতে তাকে ঘিরে গড়ে উঠবে বিশাল এক জনপদ। মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে নিবিড় সম্পর্কের যে চিরন্তন ধারা তার প্রায় দোর গোঁড়ায় পৌঁছে যাবে এলাকার জীবন। এ সব নিয়ে কেউ কথা বলবে না, উচ্চবাচ্য করবে না, ক্রেডিট নেবে না রাস্তার জন্ম নিয়ে।

১৯তম রাস্তা হতে হাজার হাজার মাইল দুরে পৃথিবীর অন্য কোথাও হয়ত তৈরি হবে আরও একটা রাস্তা। এ রাস্তার টেন্ডার লাভে দু’একটা জীবন ঝরে গেলেও কেউ অবাক হবেনা, ফেলবে না দু-ফোঁটা চোখের পানি। টেন্ডার কমিশনের জন্যে হা হয়ে থাকবে ক্ষমতার শীর্ষে বসে থাকা রাজনীতিবিদদের সন্তান, হা হুতাশ করবে বিরোধী দলের সন্তান। রাস্তার নাম নিয়ে হয়ত হাঙ্গামা হবে, উত্তাল হবে মিডিয়া। মিছিল আর ভাংচুর হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

শেষ পর্যন্ত আসবে উদ্বোধনের দিন। ব্যানার আর তোরণে ঢেকে যাবে উপরের আকাশ।

ভাষণ হবে, মানুষের পদভারে সয়লাব হবে এলাকা। কবর হতে মৃত বাবা অথবা স্বামীকে উঠিয়েও অনেকে বিক্রি করবে ভিন্ন মেরুর ১৯তম রাস্তায়। সময়ের প্রবাহে একই রাস্তা হারিয়ে ফেলবে তার চেহারা, পদে পদে তৈরি হবে মৃত্যু খাদ। আবারও টেন্ডার হবে। তবে এ যাত্রায় নতুন নয়, পুরানো ১৯তম রাস্তার জন্যে। এ ফাকে ঘুরে যাবে শতাব্দি…

আবে শালে, তু জান্তা হ্যায় মে কৌন হো?

29841

ভোর ৩টা ৩০। প্ল্যান মাফিক এগিয়ে চলছে কুয়েত গামী ফ্লাইটের যাত্রা। যাত্রীরা একে একে প্রবেশ করছে। কেবিন ক্রুরা রোবট মার্কা হাসি দিয়ে তাদের স্বাগত জানাচ্ছে। উত্তরে কিছু একটা বলতে হয় এ অভ্যাসটা জাতিগত ভাবে আমাদের নেই, তাই ওদিকে মন না দিয়ে যাত্রীরা হাতের মালামাল নিয়ে পা রাখছে ভেতরে। তাছাড়া ওদিকে মনোযোগ দেয়ার মত মানসিক অবস্থায়ও নেই কেউ।

সবার মন খারাপ। বিমান বন্দরের বাইরে এখনো অপেক্ষা করছে পরিবারের অনেকে। শেষবারের মত কিছু একটা বলার চেষ্টায় হাতে ধরা মোবাইল ফোনের দিকে মনোযোগ সবার। আইলসে দাড়িয়ে উপরের কেবিনে হ্যান্ড-লাগেজ রাখার চেষ্টা করছে অনেকে। ধাক্কাধাক্কি কাড়াকাড়ির দিকে ভাল করে নজর দিলে মনে হবে সদরঘাট হতে রামপুরা গামী লোকাল বাসে উঠছে সবাই। চারদিকে এক ধরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

গোটা ফ্লাইটে এলোমেলো অবস্থা। এসব জায়গায় অলিখিত কিছু ভদ্রতা ও রীতিনীতি আছে। ওসবের তোয়াক্কা নেই কারও। কে কার আগে উঠবে এবং জায়গা দখল করে নিজের অবস্থান পোক্ত করবে তা নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ করে গর্জনটা শোনা গেল। তাকাতেই দেখি আমার পেছনে দুটো সারির পর এক ভদ্রলোক তেড়েফুঁড়ে আসার চেষ্টা করছেন। টার্গেট একজন হোস্টেজ। ইংরেজি ‘f…’ শব্দ সাথে বাংলায় কিছু নান্দনিক গালাগালি হতে ধরে নিলাম মধ্য বয়সী যাত্রীর শেষ গন্তব্য কুয়েত সিটি নয়, বরং অধুনা বিশ্বের অন্যতম উন্নত শহর নিউ ইয়র্ক। অর্থাৎ লম্বা সময়ের জন্য আমার সহযাত্রী।

কিছুতেই থামানো যাচ্ছেনা ভদ্রলোককে। কেবিন ক্রুদের প্রায় সবাই এসে গেছে ইতিমধ্যে। যা যার মত চেষ্টা করছে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ইতি টানতে। যাত্রীদের সবার মনোযোগও এখন ওদিকে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। বরং ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ রাজনৈতিক ভাষণের মত তীব্র হতে তীব্রতর হচ্ছে। এক মুখে হয়ে অন্য মুখে আসা তথ্যগুলো এক করলে যা দাঁড়াবে তার সারমর্ম হবে; আইলসে দাড়িয়ে উপরের কেবিনে হ্যান্ড লাগেজ রাখতে ভদ্রলোক অতিরিক্ত সময় নিচ্ছিলেন। তাতে সদ্য প্রবেশকরা যাত্রীরা আটকে যাচ্ছিল এবং লাইন লম্বা হয়ে ফ্লাইটের মূল ফটক পর্যন্ত চলে যাচ্ছিল। কাজ শেষ করে দ্রুত সিটে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করছিল হোস্টেজ। অনুরোধের ভাষায় নাকি যথেষ্ট বিনয় ও শালীনতা ছিলনা, তাই এ গর্জন।

সীটে বসে সবাই যার যার মত রায় দিচ্ছে… আলোচনা সমালোচনা চলছে। ভেতরের আবহাওয়া আরও উত্তপ্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে পাইলটও বেরিয়ে এসে যোগ দিয়েছেন দরকষাকষিতে। কিছুতেই থামছেন না নিউ ইয়র্ক গামী বাংলাদেশি যাত্রী। উনার দাবি কি সেটাও পরিষ্কার হচ্ছেনা। আমার পাশের ভদ্রলোকও নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন। মুখ তেনারও বন্ধ হচ্ছেনা। অনেকটা রানিং কমেন্ট্রি দিচ্ছেন আমার জন্যে। রাগত স্বরে অভিযোগ করলেন কুয়েত এয়ারওয়েজের এসব কেবিন ক্রুদের স্বভাব চরিত্র নিয়ে।

শুরু হতে আমি চুপ। এ নিয়ে নিজের মতামত শেয়ার করার মত পরিবেশ পরিস্থিতি ছিলনা। কিন্তু ভদ্রলোক অনেকটা জোর করলেন আমার মতামতের জন্যে। কোন ভণিতা না করে সরাসরি উত্তর দিলাম; আর কিছুক্ষণের ভেতর ঐ যাত্রীকে ফ্লাইট হতে বের করে দেবে। এবং তাতে স্থানীয় পুলিশের দরকার হলে সেটাও করা হবে। ভদ্রলোক বেজায় চটলেন আমার উপর।

ইতিমধ্যে দেড়-ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। যা আশ করা গিয়েছিল শেষপর্যন্ত তাই ঘটল; পাইলট এসে জানিয়ে দিল ভাইয়োলেন্ট এ যাত্রীকে নিয়ে তিনি আকাশে উড়বেন না।

এতক্ষণে হুঁশ হল রাজনৈতিক শক্তিতে বলিয়ান এই যাত্রীর। এই ফ্লাইট যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শক্তিমত্তা প্রদর্শনীর জায়গা না তা বুঝতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে গেল। ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে অনেক। ভদ্রলোক একা নন। সাথে আছেন স্ত্রী, দুই সন্তান এবং বয়স্ক একজন মহিলা। হবে হয়ত মা অথবা শাশুড়ি।

ঘটনার নাটকীয়তা মোড় নিলো অন্যদিকে। এই ফ্লাইটে স্বামীকে কিছুতেই যেতে দেয়া হবেনা বুঝতে পেরে স্ত্রী জ্ঞান হারিয়ে (ভান করলেন) ফ্লোরে শুয়ে পরলেন। চারদিকে হাহাকার পরে গেল। কেবিন ক্রুরা দৌড়ে এসে পরিচর্যা শুরু করে দিল। শুরু হয়ে গেল ঘটনার দ্বিতীয় অংক।

আমি মিটিমিটি হাসি আর পাশের সহযাত্রীকে নিশ্চিত করি, স্ত্রীর এসব নাটক কাজে আসবেনা। ইজ্জতে আঘাতপ্রাপ্ত যাত্রীকে নামতেই হবে। এবং তা যত দ্রুত ঘটবে ততই আমাদের জন্যে মঙ্গল। একে একে ৫ জন যাত্রী নেমে গেল। জোর করা হল একজনকে, কিন্তু বাকি চারজন নেমে গেল নিজেদের ইচ্ছায়। অনেকটা সনাতন ধর্মের সহমরণের মত।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সহযাত্রীর দিকে তাকালাম আমি। রাগে ফুঁসছেন ভদ্রলোক। মনে মনে খুশি হলাম, বাকি পথ নিশ্চয় চুপ থাকবেন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্যালাপ হতে আমাকে মুক্তি দিবেন। ফ্লাইট যখন আকাশে ডানা মেললো ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে। হয়ত ঢাকার আকাশ বাতাসে আজানের ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে। মেগা শহরে মানুষ হয়ত জেগে উঠতে শুরু করেছে কেবল।

কুয়েত সিটি হতে নিউ ইয়র্ক গামী কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে পারবো কিনা ভয়টা ততক্ষণে মগজে চেপে বসেছে।

একজন দেবতা ও কিছু স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্প

2971

29735

সময়টা ভাল যাচ্ছিল না আমাদের জন্যে। আব্বার মৃত্যু সাথে বড় ভাইয়ের সীমাহীন উদাসীনতা সব মিলিয়ে পঞ্চাশ বছর ধরে চলে আসা শিল্প-কারখানা ধ্বংসের মুখোমুখি চলে গিয়েছিল।

আমি তখন ঢাকায় একটা ম্যানুফেকচারিং কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক হিসাবে কাজ করি। ভাল চাকরি, আকর্ষণীয় গার্ল ফ্রেন্ড সহ জীবন ছিল স্বপ্নময়। বিদেশ চ্যাপ্টার মনে হয়েছিল অতীতের কিছু।

মা তখনও বেঁচে। দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থায় তখনও মহামারী লাগেনি। ঢাকা হতে ঘণ্টা খানেকের পথ। প্রায়ই বাড়ি যাই। কোন এক উইক-এন্ডে মা দরজা আটকে সবাইকে নিষেধ করলেন কেউ যেন ঘরে না ঢোকে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম বিয়ে করার তাগাদা নিয়ে আবারও সবক দেবেন এবং আমি শিং মাছের মত পিছলে যাব।

না, সে যাত্রায় বিয়ের কোন তাগাদা ছিলনা। মা যা বললেন তা শুনে আমি হতবাক। অব্যবস্থার কারণে আমাদের শিল্প-কারখানা হুমকির মুখে। যে বড় ভাইকে দেবতার মত বিশ্বাস করে এসেছি তিনি এখন বেপরোয়া। আয়-রোজগারের সবটার দখল নিয়েছেন ইতিমধ্যে। উনার স্ত্রী একধাপ এগিয়ে যমুনার ওপার হতে বাপের বাড়ির সবকটা অকর্মণ্যকে এখানে আনিয়েছেন। এবং ধীরে ধীরে গ্রাস করা শুরু করেছেন।

মা জানালেন, ভৈরবের দিকে আমাদের জুট মিলে যে মালিকানা ছিল সেটাও বেহাত হওয়ার অবস্থা। বিবেচনার দায়িত্বটা আমার উপরই ছেড়ে দিলেন। এবং আশ্বাস দিলেন আমি যে সিদ্ধান্ত নেই তার সাথে গোটা পরিবার থাকবে। শুরু হল জীবনের অপ্রত্যাশিত ও অপরিকল্পিত এক অধ্যায়।

চাকরি ছেড়ে চলে আসি পৈত্রিক ভূমিতে। পরিবারের সবাইকে ডেকে জানান দেই নিজের সিদ্ধান্ত। এখন হতে আমিও অংশীদার হবো পারিবারিক আয়-রোজগারে। জীবনের ভাল সময়টা বোধহয় এখানেই কাটাই। মা’র পাশাপাশি পরিবারের সবাই আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। ক্ষয়িষ্ণু একটা শিল্প-কারখানার শুরু হয় পরিবর্তন ও পরিবর্ধন। সাথে যোগ দেন আমাদের বড়ভাইও। ভুলটা বোধহয় এখানেই হয়েছিল।

৩ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বাকি সবাইকে নিয়ে গড়ে তুলি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি। ১৫০ জনেরও অধিক শ্রমিক কর্মচারী নিয়ে শুরু হয় আমাদের নতুন যাত্রা। পরিবারকে নিয়ে যাই নতুন এক সামাজিক ও আর্থিক উচ্চতায়।
জেলা শহরের কোলাহলে কাটানো এ সময়টা আমার জন্যে ছিল অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। শ্রমিক-কর্মচারীদের দৈনন্দিন জীবন হয়ে যায় আমার জীবন। ওদের দুঃখ, কষ্ট ও আনন্দের অংশীদার হয়ে মিশে যাই জৌলুষ-হীন নতুন এক জীবনে। পাশাপাশি পরিবারের জন্যে উন্মোচিত হয় উন্নতির নতুন দিগন্ত। কদিন আগে হিল্লি দিল্লী, লন্ডন, মস্কো করা আমি বনে যাই জেলা শহরের যন্ত্রিক জীবনে।

বেশিদিন লাগেনি পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে। ঢাকা ত্যাগের কদিন আগে বন্ধুর তাগাদা ও সহযোগিতায় অস্ট্রেলিয়ায় স্কীল মাইগ্রেশনের জন্যে এপ্লাই করেছিলাম। বাড়ি গিয়ে তা ভুলেই গিয়েছিলাম।

হঠাৎ করেই ফোনটা পেলাম। থাইল্যান্ড হতে আমার নামে একটা প্যাকেট এসেছে। আমার সামান্যতম ধারণা ছিলনা কি ছিল ঐ প্যাকেটে। প্রাক্তন অফিসের হিসাবরক্ষক নিজেই হাজির হলেন। এবং সাথে ছিল মাইগ্রেশন কোয়ালিফিকেশনের সব কাগজপত্র।

কাউকে কিছু না বলে আমি প্রায়ই ঢাকা যাই। ইংরেজি পরীক্ষা সহ বাকি কাজ শেষ করি। এবং কোন এক সুন্দর সকালে বাড়ির মিশন শেষ করে উড়ে যাই আমার নতুন ঠিকানা সিডনি অস্ট্রেলিয়ায়।

বোধহয় এমন একটা মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন বড়ভাই ও উনার স্ত্রী। বাকি ভাইদের কাউকে কাউকে হাত করে আবারও বসে যান চালকের আসনে। এ যাত্রায় আর্থিক লেনাদেনা আগের তুলনায় ছিল প্রায় দশগুণ। মহোৎসব শুরু হয় অপচয়ের। দেনার বোঝা বাড়তে শুরু করে। একদিকে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং অন্যদিকে ব্যাংক। ত্রিমুখী চাপে ভেঙ্গেপরে উৎপাদন কাঠামো। শুরু হয় আন্তপারিবারিক কলহ। এবং এক সময় গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয় তাদের সংযোগ। পতন হয় বিশাল এক শিল্প প্রতিষ্ঠানের।

জরুরি ভিত্তিতে আমি যখন অস্ট্রেলিয়া হতে ফিরে আসি অনেক দেরী হয়ে গেছে। একসময়ের কোলাহল-মুখর শিল্প প্রতিষ্ঠান ততদিনে পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। অনেক কষ্টে বাঁচানো গেছে শিল্পের ছোট একটা অংশ। এবং সে অংশ এখনো ধুকে ধুকে টিকে আছে। যখনি এর সামনে দাঁড়াই সেলুলয়েডের ফিতার মত সামনে আসে ফেলে আসা জীবনের চারটা বছর। সামনে আসে দেবতার মত মানা বড় ভাই এবং তার শ্বশুর পক্ষের ক্ষুধার্ত হায়েনার দল।

ম্যারাথন মিটিং শেষে কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে এ যাত্রায়। সবাই খুশি তা নয়, মন খারাপ হয়েছে অনেকের। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী শিল্প প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থ ছিল সবার ঊর্ধ্বে।

জেলা শহরের এদিকটায় আমার ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ নিয়ে কাউকে কোন ইঙ্গিত দিইনি। কারণ দূরে থাকলেও শিল্পের চাকা ঘুরবে কিনা তার অনেকটাই নির্ভর করে আমার উপর। যে ৫০-৬০ শ্রমিক এখনও আমাদের ছেড়ে যায়নি তাদের অনেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে আমাকে স্বাগত জানিয়েছে। বলেছে কারখানার উত্থান পতনের কাহিনী। বলেছে তাদের জীবনের গল্প। এও বলেছে আমি ফিরে এলে এ ক্ষয়িষ্ণু প্রতিষ্ঠান কোন এক জাদুবলে আবারও জেগে উঠবে। আবারও শত শত শ্রমিকের পদভারে মুখরিত হবে এ প্রতিষ্ঠান।

কিন্তু হায়, ওরা জানেনা আমি এখন অন্য জগতের মানুষ, এক কালের সংসার ও সামাজিক বন্ধন হতে মুক্ত ঈগল পাখি এখন বাকি দশজনের মতই চাল ডাল তেল চিনির হিসাবে মিশে গেছে…।

মোরাল অব দ্যা স্টোরি: পৃথিবীতে দেবতার চেহারায় কোন বড় ভাই নেই। আছে জীবন যুদ্ধে সহজ রাস্তা খুঁজে বেড়ানো গ্রীডি কিছু মানুষ। সাথে আছে হায়েনার চেয়েও হিংস্র কিছু জীবন সঙ্গিনী। জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে চাইলে কথিত এসব দেবতা ও তার দলবল হতে দূরে থাকাই শ্রেয়।

ভাল থাকুক যৌবনের এসব অলিগলি। টিকে থাকুক মানুষ ও মানুষের ভাল-মন্দ লাগার কিছু স্বপ্ন।

নদী ও জীবন…

001

জন্মভূমি নিয়ে আমার কোন উচ্ছ্বাস নেই। নেই বিশেষ কোন টান। যে নাড়ির টান বছরের পর বছর ধরে দীর্ঘ ও শক্ত হয়েছিল তা ঢিলে ও সংকুচিত হয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। চাইলেও তা আগের মত জোরা লাগাতে পারিনা। লাগানোর ইচ্ছা আছে তাও নয়।তবু এখানে ফিরে আসি। কেন আসি তার কোন উত্তর নেই। হতে পারে বুকের ভেতর লুকানো কিছু দীর্ঘশ্বাস বাইরে এনে নিজকে হালকা করার তাগাদা।

সব বিবেচনায় কেন জানি মনে হচ্ছে এটাই হয়ত আমার শেষ আসা। দৈব ও অলৌকিক কিছু না ঘটলে এখানে তেমন কিছু করার নেই আমার। হুট হাট করে ছুটে আসার প্রেক্ষাপট গুলো এখন অতীত।

সে সব সোনালী অতীতের মূলে ছিলেন আমার মা। পৃথিবীর যে কোনায়ই ছিলাম না কেন তিনি ডাকলে আমি আসতাম না এমনটা ছিল অসম্ভব। বছরে দু’বার তিনবারও ছিল আমার আসা যাওয়া। হোক তা অস্ট্রেলিয়া অথবা দূরের দেশ আমেরিকা হতে। কেবল সোভিয়েত দেশের ১২ বছর ছিল ব্যতিক্রম। চাইলেও আসার সুযোগ ছিলনা সময়, সুযোগ ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে।

002

003

004

আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা নদী। শীতের জরাজীর্ণ দৈন্যতা, বর্ষার ভরা যৌবন, বসন্তের মৌ মৌ গন্ধ, সবকিছু পাশে নিয়ে আমি বেড়ে উঠেছি।

এ নদী ছিল আমার সবকিছুর সাক্ষী। নিজের কষ্টগুলো ভাগাভাগি করার একমাত্র মাধ্যম। প্রতি মাঘে নদীর তীর ঘেঁষে জমে উঠা বাউলের মেলা ছিল স্বপ্নের মত। এক মাঘ শেষ হলে অন্য মাঘের আশায় দিন গুনতাম তীর্থের কাকের মত। গুণটানা নৌকার পালে হাওয়া লাগার জন্যে প্রার্থনায় বসে যেতাম। যারা কাঁধে করে এ ভার বইতো তাদের কষ্ট চোখ ঝাপসা করে দিত।

সে নদী আজও আছে। বয়ে যাচ্ছে আগের মতই। বদলে গেছে অনেক কিছু। গুণটানা নৌকা এখন দৃশ্যপট হতে মুছে যাওয়া কিছু স্মৃতি। এ স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে গল্প করলে হয়ত বিশ্বাস করবেনা।

নদীর ওপারটা ছিল দ্বীপের মত। চর অঞ্চল হিসাবে জানতাম আমরা। আধুনিক সুবিধার ছিটেফোঁটাও ছিলনা ঐ এলাকায়। বিদ্যুতের আলো দেখতে নদী পাড়ি দিয়ে অনেকে আসতো এ পাড়ে। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকত ঢাকা হতে চট্টগ্রাম-গামী ট্রেনগুলোর দিকে।

005

006

007

008

এলাকার মানুষ ধরেই নিয়েছিল এটাই তাদের জীবন। নদী পাড়ি দিয়ে জীবিকার সন্ধানে শহরের অলিগলিতে ঢুঁ মারা, দিন শেষে সদাই করে ঘরে ফেরা… এভাবেই কেটে যেত পুরুষদের জীবন।

সে নদীতে এখন সাঁকো হয়েছে। বিদ্যুতের আলো এখন ঘরে ঘরে। নদীর এপার এখন আর দূরের দেশ নয়, বরং বাড়ির আঙ্গিনা। পরিবর্তনের ছোঁয়া ঘরে ঘরে।

ঘাটে হতে এখনও লঞ্চ ছেড়ে যায়। কোথায় যায় তা কোনদিনও জানা হয়নি। শুনেছি কুমিল্লার হোমনার দিকে যায়। একটা সময় ছিল যখন লঞ্চই ছিল দাদাবাড়ি যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। এখন হয়ত সে পথ বন্ধ। কারণ সড়ক পথের উন্নতি হয়েছে। শুক্রবার সকালে এক বিয়েতে যোগ দিতে দাদাবাড়ি যাচ্ছি। আমার ছোট ভাই নিশ্চয়তা দিল ওখানে পৌঁছতে বিশ মিনিটের বেশি লাগবেনা। আসলে বদলে গেছে মানুষের জীবন।

১০ বছর আগেও ছুটিতে বেড়াতে এলে রাস্তায় পরিচিত অনেকের সাথে দেখা হয়ে যেত। মেঘনায় যাওয়ার রাস্তা ধরলে একে একে অনেক সালাম দিত। আগ্রহভরে জিজ্ঞাস করত কবে আসলাম, কতদিন থাকবো। পাশের টং হতে বেরিয়ে এসে হাউমাউ করে লংকা কাণ্ড বাধিয়ে বসত কেউ কেউ। জোর করে টংয়ে ঢুকিয়ে এক কাপ চা আর একটা সিঙ্গারা খাওয়ার দাওয়াত দিত। অনেকের কাছে এ ছিল দেনা শোধের মত। মনে করিয়ে দিত আমি নাকি তাকে আমাদের শিল্প কারখানায় শ্রমিক অথবা দারোয়ানের চাকরি দিয়ে কৃতজ্ঞতায় দায়ে আবদ্ধ করেছি। এ চা, এ সিঙ্গারা সে দায় হতে মুক্তি পাওয়ার আকুল চেষ্টা।

আজ আবার সে পথে হেঁটে গেলাম। চারদিকের টং গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। ওদের ব্যবসা এখনো চালু আছে। এক দোকানে দেখলাম গরম গরম পরোটার সাথে ভাজি দিয়ে নাস্তা খাচ্ছে অনেকে। অনেক দোকান হতে কোরান তেলাওয়াত ভেসে আসছে। অথচ একটা সময় ছিল যখন হিন্দি গানের প্লাবনে ভেসে যেত গোটা এলাকা।

আজ একটু ধীরেই হাঁটলাম। আশায় ছিলাম হয়ত দোকান হতে কেউ বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করবে আমার কুশল। নাস্তা খাওয়ার জন্যে কেউ টানাটানি করলে আজ ইচ্ছা ছিল না করব না। বসে পরবো বিনা বাধায়। অথচ একটা সময় ছিল যখন আমাদের পরিবারের কারও জন্যে ওসব দোকানে কিছু খাওয়া ছিল ‘অসম্মানের’।

না, আজ আর কেউ ডাকেনি। কেউ সালামও দেয়নি।
বদলে গেছে প্রজন্ম। বদলে গেছে মানুষের জীবন। সাথে বদলে গেছে মানুষের বেঁচে থাকা।

সব বিবেচনায় নিজকে মনে হল আগন্তুক। জীবনের সমীকরণ মেলানো প্রবাসী কেউ। এমন প্রবাসী এখন ঘরে ঘরে। এসব নিয়ে কারও কোন কৌতূহল নেই। মানুষ চলছে জীবনের সন্ধানে। মিশে যাচ্ছে জীবন যুদ্ধে। সেখানে আমার মত কাউকে যেচে এসে সালাম দেয়ার যথেষ্ট সময় নেই কারও হাতে।

পরনের লুঙ্গিটা ছিল বিপদজনক সঙ্গী। সব সময় সচেতন থাকতে হয়েছে কখন ইজ্জতের সবকটা চেম্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়।

আমার একটাই লুঙ্গি। এর বয়স কম করে হলেও ২০ বছর। দেশে আসার সময় নিয়ে আসি। ফেরার পথে সাথে করে নিয়ে যাই। কেবল আমার শহরে এলেই আমি শহুরে লেবাস হতে বের হয়ে ফিরে যাই সোনালী অতীতে।
ভাল থেকো প্রিয় শহর। সুখে থেকো শহরের মানুষ। আমার কথা মনে হলে নদীর কাছে যেও। এ নদী ও আমি একই নাড়ির। দুজনকে আলাদা করে দেখতে যেওনা।

009

010

011

013

014

015

017

018

এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে… বলিভিয়ার পথে…

28202

উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে ১৮ জন যাত্রী নিয়ে বাসটা নড়তে শুরু করল শেষ পর্যন্ত। স্বস্তির পাশাপাশি এক ধরনের নীরবতা গ্রাস করে নিলো বাসের পরিবেশ। কারও মুখে কথা নেই। সবাই ক্লান্ত এবং সামনে কি অপেক্ষা করছে এ নিয়ে চিন্তিত।

প্রায় ৫ ঘণ্টার জার্নি। কথা ছিল সকাল ৮টায় পুনো হতে রওয়ানা হয়ে দুপুরের খাবার খাব লা-পাস গিয়ে। হাত ঘড়িটার দিকে তাকালাম। সকাল ১১টা। সবকিছু ঠিক ঠাক চললে বিকাল ৪টার ভেতর লা-পাস পৌঁছাবার কথা। মনে মনে হিসাব কসে সিদ্ধান্ত নিলাম একটু দেরী হলেও গন্তব্যে পৌঁছেই লাঞ্চ করব। সাথে ক’টা আপেল, কলা এবং দু’বোতল পানি আছে, চলে যাবে আপাতত।

বাসে হিটার চালু আছে, পরনের গরম কাপড় খুলে হল্কা হয়ে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃষ্টি হতে মিলিয়ে গেল সীমান্ত শহরটা। যানবাহন আর মানুষের এলোমেলো চলাফেরা বদলে দিল এন্ডিসের সুশৃঙ্খল চূড়াগুলো। পাহাড় আর পাহাড়! কোল ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা নদী। মাঝে মধ্যে ভূতের মত উদয় হচ্ছে দু’একজন আন্ডিয়ান তরুণ-তরুণী। হাতে চাষাবাদের যন্ত্রপাতি। কৃষিকাজ হচ্ছে হয়ত কোথাও। কিন্তু যতদূর চোখ যায় লোকালয়ের কোন চিহ্ন দেখা গেলনা।

আকাশটাকে আজ একটু বেশী রকম নীল মন হল। ভার্টিকেল এঙ্গেলে চোখ ঘোরালে শূন্যে উড়ে যাওয়া চিল গুলোকে মনে হবে স্থির হয়ে উড়ছে। দু’একটা চিল মাঝে মধ্যে গোত্তা মেরে নীচে নামছে শিকারের ধান্ধায়। রাস্তার সমান্তরালে বয়ে যাওয়া নদীটার দু’পাশে হঠাৎ করে আবাদি জমির উদয় হল। আলু, পেয়াজ আর ভুট্টার খণ্ড খণ্ড জমি। গাছের খোল ব্যবহার করে নদী হতে পানি উঠানোর ব্যবস্থা মনে করিয়ে দেয় জীবন এখানে বয়ে যাওয়া নদীর মত অত সহজ নয়। প্রতি খণ্ড চাষাবাদের পেছনে নিশ্চয় লুকিয়ে আছে পাহাড়ি মানুষের খেটে খাওয়া জীবনের দীর্ঘশ্বাস।

নেশা ধরে আসে প্রকৃতির এই অন্তহীন ক্যানভাস একাধারে গিলতে গেলে। বাসের একটানা যান্ত্রিক শব্দে তন্দ্রা-মত এসে গেল। সকালে ঘটে যাওয়া উটকো ঝামেলা গুলো এ ফাকে মাথা হতে নেমে গেল। পাশে বসা বিপদজনক সুন্দরীকেও এন্ডিসের বিশালতার কাছে ছোট মনে হল। গাঁটের পয়সা খরচ করে এতদূর এসেছি এন্ডিসের সান্নিধ্য পেতে, স্থানীয় মানুষ এবং তাদের জীবনের সাথে পরিচিত হতে। সে দিকে মনোনিবেশ করে ভুলে গেলাম সুন্দরীর উপস্থিতি।

এন্ডিস! শব্দটার ভেতর লুকিয়ে আছে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা সাথে অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার স্বপ্নিল হাতছানি। পাহাড় পর্বত ঘুরে বেড়ানো যাদের নেশা তাদের ধমনীতে এই নামটা এক ধরনের কম্পন তৈরি করে, যার উৎপত্তি প্রকৃতির প্রতি অকৃপণ ভালবাসা হতে। এন্ডিসের উপর শত শত বই, আর্টিকেল এবং ডকুমেন্টারি দেখেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করেছি এর কাব্যিক কল্পনায়। কিন্তু চোখে দেখার কাছে এগুলো এ মুহূর্তে অর্থহীন মনে হল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া রাস্তাটার বর্ণনাও মনে হল বই, আর্টিকেল অথবা ডকুমেন্টারিতে জীবন্ত করতে পারেনি। বাইরের স্তব্ধতাকে মনে হল অতি যত্নের সাথে কেউ লালন করছে হাজার বছর ধরে। পাহাড়ের চূড়া গুলোকে মনে হবে নীরব সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে কোটি বছর উপর। কোন একটা চূড়ায় উঠে চীৎকার দিলে হয়ত শত শত প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসবে, ভাঙবে সহস্রাব্দের ভৌতিক নীরবতা।
আমাদের বাসটা উঁচু নিচু এবং আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে ছুটে চলল প্রচণ্ড গতিতে।

’তুমি কি একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছ?’ ভিক্টোরিয়ার প্রশ্নে ছুটে গেল তন্দ্রা। নতুন কোন সমস্যার প্রসঙ্গ টানতে যাচ্ছে সে, গন্ধ পেলাম গলার সতর্ক সূরে।
’পাহাড় ছাড়া এ মুহূর্তে অন্যকিছু লক্ষ্য করছি না আমি’, অনেকটা তিরিক্ষি মেজাজে উত্তর দিলাম। উত্তরে সে যা বলল তা সত্যি ভাবিয়ে তুলল আমায়।

দু’লেনের রাস্তা, অথচ যানবাহন চলছে শুধু এক লেনে। অর্থাৎ বিপরীত দিক হতে কোন গাড়ি আসছে না। ভিক্টোরিয়ার ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা। বাংলাদেশের মানুষ আমি। কিছুদিন আগে হাসিনার লাগাতার পর্ব ’উপভোগ’ করে এসেছি মাত্র। পূর্বাভিজ্ঞতা হতে বলতে পারি, সামনে সমস্যা। আকাশের পাখী গুলোকেও দেখলাম শুধু একদিকে উড়ে যাচ্ছে। ভিক্টোরিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে, খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। অন্য যাত্রীদেরও দেখলাম নড়েচড়ে বসতে।

কৌতূহলী হয়ে উঠছে সবাই। দূর হয়ে যাওয়া উৎকণ্ঠা গুলো বিদ্যুৎ গতিতে ফিরে এলো নতুন করে। ছোট দু’একটা পাথর দিয়ে শুরু। কিছুদূর যেতেই বাড়তে থাকল পাথরের সংখ্যা এবং এর আকৃতি। নিবিড়ভাবে বিছানো আছে সমস্ত পথজুড়ে। যেন বিশাল আয়তনের শিলাবৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু তাতে বাসের চাকা বিশেষ কোন বাধা পেলনা। এগুতে থাকলাম আমরা।
বিশাল একটা বাঁক পেরুতেই দৃশ্যটা ভেসে উঠল দিগন্ত রেখায়।

হাজার হাজার গাড়ি। যতদূর চোখ যায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি। থেমে আছে লাইন ধরে মাইলের পর মাইল। ছোটখাটো পাথর নয়, বিশাল আকারের বোল্ডার দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে পথ। এক কদম সামনে বাড়ার উপায় নেই। আমাদের যমজ বাসটা পেছনে এসে হুমড়ি খেয়ে থেমে গেল। সোজা কথায় আটকে গেছি আমরা। এন্ডিসের এই গহীন রাজ্যে জিম্মি হয়ে গেছি গরীব দেশের গরীবিপনার কাছে।

আকাশ ভেঙ্গে পড়ল সবার মাথায়। আবারও আমার মাথা জুড়ে পুরানো চিন্তাটা ঘুরপাক খেতে শুরু করল, আজ শনিবার এবং সোমবার মধ্যরাতে লিমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে। ভিক্টোরিয়াকে দেখে মনে হল বেশ উপভোগ করছে সে নতুন বাস্তবতা। ‘আমি জানতাম এমনটা হবে, এ জন্যেই এদিকে আসা’, উৎফুল্ল হয়ে জানাল সে। কথা বলে জানা গেল ওকালতির পাশাপাশি দক্ষিণ আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে বই লিখছে। এ অঞ্চলে ভেনেজুয়েলান নেতা হুগো সাভেজের প্রভাব তার আগ্রহ। বলিভিয়ায় এবো মরালেস নামের নতুন এক নেতার উত্থান হয়েছে, যে আদর্শ হিসাবে বেছে নিয়েছে হুগো সাভেজের কথিত সমাজতান্ত্রিক পথ। তার উত্থানকে কাছ হতে দেখার জন্যেই এই জার্নি।

উদ্ভট পোশাক দেখে মেয়েটা সম্পর্কে আজেবাজে ধারণা করায় নিজকে অপরাধী মনে হল এ মুহূর্তে। ’চল সামনে গিয়ে দেখে আসি’, আহ্বান জানাল সে। বাসের ট্যুর গাইড ইতিমধ্যে সাবধান করে দিয়েছে এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চার হতে দূরে থাকতে।
’চল’, সায় দিয়ে নেমে পরলাম বাস হতে। সাথে যোগ দিল আরও গোটা তিনেক সহযাত্রী।
চারদিক চোখ বুলাতেই কেন জানি ঢাকার কথা মনে হয়ে গেল। রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে আটকে একদিন ৫ ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকতে হয়েছিল কাঁচপুর ব্রিজের উপর। সামনে শেখ হাসিনার সমর্থনে মিছিল, কিছুক্ষণ পর শুরু হল ধাওয়া আর পালটা ধাওয়া, সাথে নির্বিচার ভাংচুর।
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অজান্তেই।

এন্ডিসের শোঁ শোঁ বাতাস আর চোখে মুখে শীতের কনকনে ঝাঁপটা ফিরিয়ে আনল কঠিন বাস্তবতায়। হঠাৎ করে কেন জানি গান গাইতে ইচ্ছা করল আমার, প্রিয় সেই গানটা; ’নাই টেলিফোন নাইরে পিওন নাইরে টেলিগ্রাম…।

ভিক্টোরিয়া ফিস ফিস করে বলল, ‘মন খারাপ করে লাভ নেই, বরং উপভোগ কর যা দেখছ, এমন অভিজ্ঞতার সুযোগ জীবনে দ্বিতীয়টা নাও আসতে পারে‘।

ইনকাদের মাচু পিচু… পেরুর এন্ডিস!

280865

এ যেন অন্য এক পৃথিবী। ঘন মেঘমালা আকাশ আর মাটির ভালবাসায় সেতুবন্ধন হয়ে জড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় মেঘ দৈত্যদের অলস পদচারণা প্রকৃতির নৈসর্গিক স্তব্ধতাকে স্বপ্নিল ফ্রেমে বন্দী করে তৈরি করেছে বিস্ময়কর প্যানোরমা। প্রথম ক’টা মিনিট কারও মুখে কোন কথা ফুটে না। এ যেন সূরা আর সাকির অনাদিকালের মিলন-মেলা। মাচু পিচু – ইন্‌কাদের হারিয়ে যাওয়া শহর। স্প্যানিশ দখলদারদের হিংস্রতা হতে বাঁচতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই তৈরি করেছিল বর্তমান বিশ্বের আন্যতম আশ্চর্য এক স্থাপনা।

চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। চূড়াগুলো বাহু লগ্না হয়ে ডুবে আছে মেঘ সমুদ্রে। ইচ্ছে করলেই এক খণ্ড মেঘ হাতে বাড়িয়ে কাছে টানা যায়, আদর করা যায়। গলার সূর উঁচু করে হাঁক দিলে সে হাঁক পাহাড়ে পাহাড়ে আছড়ে পরে, ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে তীর ভাঙ্গা তরঙ্গের মত। চারদিকে এক ধরনের ভৌতিক নীরবতা, সাথে প্রকৃতি এবং মানুষের নীরব বোঝাপড়ার বিশাল এক ক্যানভাস।

ইনকা সাম্রাজ্যের বিশালতার কাছে গিজ গিজ করা পর্যটকদের ফিসফাস হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাসের কথাই মনে করিয়ে দেয়। নিপুণ কারিগরের নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনায় হাতেগড়া পাথরের প্রাসাদগুলো সময়ের স্তব্ধ সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে। প্রথম যে ধাক্কাটা এসে মগজে আঘাত হানে তা হল, কি করে এত উচ্চতায় এই বিশাল পাথরগুলোকে উঠানো হল! প্রযুক্তি বলে জাগতিক পৃথিবীতে কিছু থাকতে পারে এমন ধারণা ঐ নিষিদ্ধ অরণ্য পর্যন্ত পৌঁছানোর কথা নয়। হাত এবং মগজের চাতুর্যপূর্ণ নৈপুণ্যে পাথরগুলোকে উঠানো হয়েছে একটার উপর আরেকটা, শক্ত কাদামাটি দিয়ে আটকানো হয়েছে হাজার বছরের বন্ধনে।

একদিকে রাজপ্রাসাদ, অন্যদিকে সাধারণ ইনকাদের বসতি এবং পাশাপাশি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নয়নে গবেষণাগার সবকিছু মিলে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বলা হয়ে থাকে পেরুর মাটিতে স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের আগমনের একশত বছর আগেই এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কারও মতে দখলদার বাহিনীর নৃশংসতার হতে বাচার জন্যে ইনকারা পালিয়ে আশ্রয় নেয় মাচু পিচুতে। পরবর্তীতে বসন্তের মত মহামারিতে বিলীন হয়ে যায় জনসংখ্যা। পরিত্যক্ত হয়ে গাছপালা, পাহাড়ের আড়ালে চাপা পরে যায় ইনকাদের আশ্চর্য সৃষ্টি মাচু পিচু।

১৯১১ সালে মার্কিন ইতিহাসবিদ হিরাম বিংগ্নহাম ইনকা সভ্যতার উপর গবেষণা চালাতে গিয়ে বেশ ক’বার এলাকাটিতে জরিপ চালান। এমনই এক আর্কিওলজিক্যাল জরিপে স্থানীয় কুয়্যেচোয়া গোত্রের ১১ বছর বয়সী বালক পাবলিতো আলভারেজ হিরামকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় মাচু পিচুর ট্রেইলে। আধুনিক সভ্যতা বিস্ময় এবং হতবাক হয়ে স্বাগত জানায় হিরামের এই আবিষ্কারকে।

চারদিকে হরেক রকম ভাষা আর ক্যামেরার ক্লিক শব্দে নেশা ধরে আসে নিজের অজান্তেই। সরু এবং সংকীর্ণ পথ বেয়ে অনেকে পাহাড়ের চূড়ার দিকে হাঁটছে ইনকা ট্রেইল জয়ের লক্ষ্যে। এমনই এক মিশনে গেল সপ্তাহে দু’জন ইংরেজ পর্বতারোহী পা পিছলে হারিয়ে গেছে পাহাড়ের মৃত্যু খাদে। কোন কিছুই মানুষের অজানাকে জানার আর অচেনাকে চেনার অদম্য বাসনা আটকাতে পারেনা, মৃত্যুভয় জেনেও কিশোর হতে শুরু করে বুড়োর দলও নিজকে সাক্ষী করতে চাইছে সভ্যতার এই মহা বিস্ময়ের সাথে।

বেলা গড়াতে ঘন মেঘ কুণ্ডুলি ক্লান্ত বলাকাদের মত উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। পাহাড়ের চূড়াগুলো সহসাই মুক্তি পেল মেঘের আগ্রাসন হতে। সাথে সাথে সূর্যের আলো ভাসিয়ে নিলো লোকালয়। কেউ যেন ছবি তোলার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিল ক্ষণিকের জন্যে। ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক শব্দ আর ফ্ল্যাশ লাইটের ঝলকানো আলোতে মায়াবী পরিবেশে হতে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমাদের নিয়ে এলো জাগতিক পৃথিবীতে।

কিছুক্ষণ আগের কনকনে শীত ছাপিয়ে এবার ঝাঁকিয়ে বসল ভ্যাপসা গরম। ট্যুর গাইডের বিরামহীন বর্ণনা একসময় রাজ্যের বিরক্তির নিয়ে এলো। ভাল লাগছিল না ভাঙ্গা ইংরেজিতে ইন্‌কাদের ইতিহাস। মনে হল যাবার আগে প্রকৃতিকে নিজের মত করে কাছে না পেলে এ যাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ছিটকে পরলাম গ্রুপ হতে।

এবার উঁচুতে উঠার পালা। একটার পর একটা বিপদজনক সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে শেষ পর্যন্ত সূর্যঘড়ির চূড়ায় এসে হাঁপিয়ে পরলাম। এটাই ছিল জনবসতির সবোর্চ্চ চূড়া। সামনে, পিছনে, ডানে এবং বায়ে শুধুই মৃত্যুফাঁদ। ভারসাম্যের সামান্য হেরফের হলেই আমার আমিত্বে নামবে অমেঘো পরিণতি, ডেথ উদআউট ট্রেইস! চোখ দু’টো বন্ধ করে নিজকে হাল্কা করে নিলাম। পাখীর ডানার মত হাত দু’টো ছড়িয়ে জোড়ে চীৎকার দিতেই সে চীৎকার লক্ষ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো নিজের কাছে। কেন জানি মনে হল আমি এবং আমার ঈশ্বর এখন খুব কাছাকাছি এবং আমার চীৎকার ঈশ্বরের দরবারে পৌছাতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা।

বেলা পরে আসছিল, তাই ফেরার আয়োজন করতে হল।
প্রধান ফটক পার হয়ে বাইরে বেরুতেই দেখা মিলল ২০ ডলারের একটা বাফের। ক্ষুধায় পেট উঁচু-স্বরে কথা বলতে শুরু করে দিল। ঢুকে পরলাম ডান বামে না তাকিয়ে। ইনকাদের পোশক পরা বেশকজন তরুণী মায়াবি হাসি দিয়ে স্বাগত জানালো তাদের আস্তানায়।খুব রসিক মেজাজে ভূরিভোজনের পর উল্টো পথ ধরলাম।

পাহাড় হতে নামতে হবে বাসে চড়ে, তারপর ট্রেন। কুস্‌কো পৌছাতে রাত হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ রইল না।

ট্রেনে বসে হঠান করেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। চারদিকের শুনশান নীরবতা দেখতে ভাল লাগছিল না। নিজকে বুঝাতে পারলাম না কেন এই বিষণ্ণতা! তবে কি এতদিনের লালিত স্বপ্ন আর কোনদিন দেখব না বলেই এই ভাবাবেগ? পৃথিবীর এই অঞ্চলগুলোতে আর কোনদিন পা ফেলব না বলেই হয়ত এ সাময়িক আচ্ছন্নতা। কিন্তু কে জানত দু’বছর পরেই আবার আমাকে আসতে হবে এখানে। মাচু পিচুর পাহাড় এবং মেঘদের লুকোচুরির কোন এক বাঁকে নতুন করে পরিচয় হবে এন্ডিসের দেশ পেরুর সাথে! সে অন্য এক কাহিনী, অন্য এক অধ্যায় যার সাথে এ লেখার কোন সম্পর্ক নেই।

হোটেলে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল। রাতের খাবার শেষে সকাল সকাল শুয়ে পরার সিদ্ধান্ত নিলাম। খুব সকালে বাস ধরতে হবে। পরবর্তী ঠিকানা লেক টিটিকাকা, পেরুর সীমান্ত শহর পুনো।

বলিভিয়ার এন্ডিস …

28056

বেলা পরে আসছে। রওয়ানা হওয়ার উৎকণ্ঠা সবার চোখে মুখে। সূর্যাস্তের পর এন্ডিসের এ এলাকাটা মোটেও নাকি নিরাপদ নয়। বন্য হায়েনা আর অপহরণকারীদের অভয়ারণ্যে পরিনত হয় অরক্ষিত মাঠ ঘাট। বলিভিয়া পৃথিবীর অন্যতম গরীব দেশ। দুর্নীতির হিংস্র থাবায় ক্ষতবিক্ষত এর রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো। সামরিক শাসনে দেশটির রয়েছে বিশ্ব রেকর্ড।

এতগুলো বিদেশী পর্যটক এমন একটা অরক্ষিত এলাকায় আটকে থাকা মানে অপহরণকারীদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার মত। ব্যাপারটা ভাল করেই জানা ছিল ট্যুর গাইডদের। চাকা বদল এবং ঠেলেঠুলে বাসটা রাস্তায় তুলতে প্রায় ঘণ্টা খানেক পেরিয়ে গেল। ড্রাইভার জানাল বেলা অনেক গড়িয়েছে, যে পথ ধরে যাচ্ছি সে পথটা সামনে আরও বিপদজনক। ফিরে যেতে হবে আসল পথে। রাস্তার অবরোধের তীব্রতাও নাকি কমে এসেছে ইতিমধ্যে। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে রওয়ানা হলাম শেষ পর্যন্ত। তবে এ যাত্রায় পিছন দিকে। আমার কেন জানি মনে হল এ কাহিনীর কোন শেষ নেই। সামনে পেছনে করে অনন্তকাল ধরে চলবে আমাদের যাত্রা! ভাগ্যকে নিয়তির কাছে সঁপে দিয়ে এন্ডিসের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দিকে মন ফেরানোর তাগাদা অনুভব করলাম।

আবারও সেই বিভীষিকা। একই লোমহর্ষক জায়গা!!! তবে গাড়ির সংখ্যা দেখে পরিস্থিতি সকালের মত ততটা জটিল মনে হলনা। গাইড এসে জানাল ভয়ের কিছু নেই, কিছু লেনদেন করতে হবে শুধু। তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবী আন্দোলন! সবকিছুর শেষ মনে হয় একটা জায়গায় এসে আটকে যায়, পকেট! চোখের সামনে নতুন এক বাংলাদেশকে আবিষ্কার করলাম মনে হল। বিছানো পাথরগুলো রাস্তা হতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। যদিও বাঁশ জাতীয় কিছু একটা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে গোটা হাইওয়ে। হাতে লাঠি আর মাথায় লাল পটকার বিপ্লবীরা সিংহের মত গর্জন করছে। দেখে মনে হচ্ছে ইশারা পেলে খুব দ্রুত ঝাঁপিয়ে পরবে।

ডান হাতের ব্যাপারটা খুব দ্রুতই সম্পন্ন হয়ে গেল। গাইড‌ জানাল দেসাগুয়াদে্‌রতে যাত্রী প্রতি ১০ ডলার উঠানো হয়েছিল এমন একটা আশংকায়। এ মুহূর্তে কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলোনা। সবাইকে মনে হল একই চক্রের সদস্য, পর্যটকদের পকেট খসানোর সংঘবদ্ধ নীল নক্সা। দৈত্য-দানব আর রাক্ষস-খোক্কসদের তাণ্ডব হতে মুক্তি পেলাম শেষ পর্যন্ত। সামনে নতুন কোন ঝামেলা নেই, এমনটা বলে ট্যুর গাইড আশ্বস্ত করল সবাইকে।

সারাদিনের মধ্যে এই প্রথম বুক ভরে শ্বাস নিলাম। চোখ বুজে কল্পনা করলাম নিউ ইয়র্কের ছোট রুমটার কথা।

আরও প্রায় ২ ঘণ্টার পথ। পেছনের ঝামেলা মাথা হতে নামিয়ে যাত্রীদের অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পরল জানালার বাইরে রূপকথার এন্ডিসকে নিয়ে। ভেজা মুরগীর মত ঝিমুতে শুরু করলাম আমি। রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভিড় করল শরীরে। পাশের সিটটা খালি, দু’পা উঠিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরলাম। পাক্কা এক ঘণ্টা পর ঘুম ভাঙ্গল। সূর্যটা নেতিয়ে পরেছে ততক্ষণে। চারদিকে শুন শান নীরবতা। এন্ডিসের চূড়াগুলো ডুবে গেছে হাল্কা কুয়াশার কোলে। সূর্যের রক্তিম আভায় কুয়াশা গুলোকে আগ্নেয়গিরির রাক্ষুসে লাভার মত দেখাল।

মাঝে মধ্যে দু’একটা বাড়ি ঘরের চিহ্ন দেখা গেল পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। যতই এগুচ্ছি বাড়তে থাকল জনবসতির ঘনত্ব। সামনের সহযাত্রী জানাল ’বিপ্লবীরা’ মাঝ পথে আরও একবার বাসটা থামিয়েছিল। কি একটা কাগজ দেখাতে ছেড়ে দিয়েছে বিনা বাধায়। সহযাত্রীদের জানার কথা নয়, কিন্তু এই বাংলাদেশীর ভাল করেই জানা ছিল ঐ কাগজটার অর্থ এবং মূল্য কি।

রাশিয়ায় পড়াশুনা শেষে ব্যবহারের জিনিসপত্র এবং একগাদা বই পাঠিয়ে ছিলাম জাহাজে করে। চট্টগ্রাম বন্দরের ঐতিহাসিক কালো অধ্যায় সমাপ্তি শেষে ট্রাকে করে বাড়ি ফিরছি। বন্দর হতে বেরুতে না বেরুতে পুলিশ বাহিনী আটকে দিল আমাদের যাত্রা। ড্রাইভার জানাল টাকা দিতে হবে। গাই গুই করে কাজ হলোনা, পরিশোধ করতে হল পুলিশের ’পাওনা’। সব শেষ হতে একটা ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিল ড্রাইভারের হাতে। এটাই নাকি সেই যাদু-মন্ত্র যার বলে পার হওয়া যাবে সামনের সাত সমুদ্র তের নদী।

ঘটনাটা মনে হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকা, কাছের প্রতিবেশী দুই মহাদেশ, অথচ একেবারে উলটো তাদের জীবন যাত্রার মান!

ট্রাফিকের সংখ্যা দেখেই ধারণা করা যায়, আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। পাহাড়ের বিপদজনক শেষ বাঁকটা পার হতেই চোখে পরল শহরটা, লা পাস। পাহাড়ি উপত্যকার খাদ ঘেঁষে থরে থরে সাজানো বাড়ি ঘর আর উঁচু দালান নিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে শহরটা। প্রায় ৮ লাখ লোকের বাস সমুদ্র পৃষ্ট হতে ৩৬৬০ মিটার উচ্চতার এই শহরে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতম শহরের ভিত্তি স্থাপন করেছিল স্প্যানিশ দখলদাররা। সময়টা ছিল ১৫৪৮ সাল। এর আগে ইন্‌কাদের কাছে এলাকার পরিচিতি ছিল চকেয়াপো হিসাবে।

গ্রামটার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চকেয়াপো নদীতেই প্রথম সোনা খুঁজে পায় উপনিবেশবাদীরা। ১৮৯৮ সালে লা পাস’কে বলিভিয়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৪ সাল হতে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মার্কিনীদের সহায়তায় একটা পর একটা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে থাকে সে দেশে। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের উচ্চাভিলাষ ব্যাহত করে বলিভিয়ার গণতান্ত্রিক যাত্রা। সোনা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের মালিক হয়েও দেশটার সাধারণ মানুষ কখনোই দারিদ্র সীমা হতে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

সূর্যটা ডুবু ডুবু করছে প্রায়। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দেয়ার মত কণ্টকাকীর্ণ বিশাল এক পথ পাড়ি দিয়ে শহরের প্রবেশ মুখে ঢুকতেই পরিচিত দৃশ্যটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। খোলা আকাশের নীচে আবর্জনা ফেলার বিশাল আয়োজন। সব বয়সের শিশু, নারী এবং পুরুষের দল পিঠে ঝোলা চাপিয়ে হুমড়ি খেয়ে হাতড়াচ্ছে আবর্জনার স্তূপ। উচ্ছিষ্ট নিয়ে শকুন, কুকুর আর মানুষের কামড়া কামড়িতে বিষাক্ত হয়ে উঠছে চারদিকের পরিবেশ।
দারিদ্রের এমন কুৎসিত চেহারা দেখা হয়নি অনেকদিন। এক সময় ঢাকার প্রবেশ মুখ যাত্রাবাড়ীতে দেখা যেত দারিদ্র্যের একই রূঢ় ছবি। পশ্চিম দুনিয়ার পর্যটকের দল হুমড়ি খেয়ে পরল ছবি তোলার জন্যে। আমি দু’চোখ বন্ধ করে ফিরে গেলাম জন্মভূমিতে।

বোমা বিস্ফোরণের মত ভয়াবহ শব্দে কেঁপে উঠল আমাদের বাসটা। অনেকের হাত হতে ছিটকে পরল ক্যামেরা। কিছু বুঝার আগেই ড্রাইভার জানাল পেছনের চাকা পাংচার হয়ে গেছে। একই সাথে জানিয়ে দিল দুঃসংবাদটা, চাকা বদলানোর কোন আয়োজন নেই বাসে।

মূল শহর এখনো মাইল খানেকের পথ। ’এবার আমাদের নামতে হবে এবং নিজ খরচে স্থানীয় যানবাহন ধরে পৌঁছতে হবে শহরের কেন্দ্রবিন্দু সানফ্রান্সিকো প্লাজায়’। ট্যুর গাইড মৃত্যু ঘোষণার মত সংবাদটা প্রকাশ করে মিলিয়ে গেল জনারণ্যে।

ছবিঃ সংগৃহিত।

স্মৃতির গলিতে এন্ডিস… এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে

2800

বাঁকটা পার হতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। মাইল দুয়েক দূরে সাদা সাদা বিন্দুর মত দেখাচ্ছে অপেক্ষমাণ বাসগুলোকে। মনে হল স্বপ্ন দেখছি! যেন অমল ধবল মেঘরাজ্যে সপ্ত ডিঙ্গায় চড়ে উড়ছি আমি, সাথে বসন্তের পাগলা হাওয়া।

জ্যাকেটটা খুলে মাথার উপর ঘুরাতে শুরু করলাম। দূর হতে কেউ-না কেউ দেখে থাকবে নিশ্চয়ই। দু’মাইলের পথ। ইচ্ছে হল দু’মিনিটে পাড়ি দেই। এ মুহূর্তে বিশ্রাম দরকার আমার, সাড়া জীবনের বিশ্রাম। কিন্তু বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ আর হাড্ডি কাঁপানো কনকনে শীত বাধা হয়ে দাঁড়াল বাস এবং বিশ্রামের মাঝে। মাথার উপর সূর্যটাকেও কেমন যেন ক্লান্ত মনে হল। পুরানো চিন্তাটা আবারও ঘুরপাক খেতে শুরু করল মগজে, আজ শনিবার এবং সোমবার মধ্যরাতে লিমা হতে নিউ ইয়র্কের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে আমাকে। এ মুহূর্তে কোন ভাবেই ক্লান্ত হওয়া চলবে না।

দূর হতে দু’মাইলের পথ মনে হলেও দূরত্ব বোধহয় এক মাইলের বেশী ছিলনা। ক্লান্ত, শ্রান্ত এবং বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে বাসটার কাছাকাছি আসতেই স্বাগত জানাল পটকা মাছের মত ফুলে উঠা কতগুলো মুখ। ডায়নামাইটের মত বিস্ফোরিত হল ট্যুর গাইড। সাথে গলা মেলাল ড্রাইভার এবং তার হেল্পার। দুএক জন যাত্রীও ইনিয়ে বিনিয়ে কি যেন বলতে চাইল। এতকিছু শোনার মত শরীর ছিলনা। বসে পরলাম ধপাস করে এবং ভুলে যেতে চাইলাম গত কয়েক ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ।

পাসপোর্টের কথা মনে হতেই হুস ফিরে এলো। লাগেজ খুলে জায়গা মতো হাত দিতেই অনুভব করলাম মূল্যবান ডকুমেন্টটার উপস্থিতি। সব আগের মতই আছে, শুধু জীবন হতে খসে গেছে ৩টা ঘণ্টা। হেল্পার পানি এগিয়ে দিল নাক-মুখের রক্ত পরিষ্কার করার জন্যে। অনিচ্ছা সত্যেও নামতে হল বাস হতে। পরিষ্কার হয়ে বাসে ফিরতেই হাজারো প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল সহযাত্রীরা। মূল প্রশ্ন, মেয়েটা কোথায়? ট্যুর গাইড সবার হয়ে অফিসিয়ালি করল প্রশ্নটা।

আমি সাফ জানিয়ে দিলাম ভিক্টোরিয়া ছিল আমার সহযাত্রী মাত্র। বাসে পরিচয় এবং তার সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আমার বক্তব্যের পক্ষে সমর্থন পাওয়া গেল দুএক জন যাত্রীর।
বাস ড্রাইভার জানাল আর মিনিট দশেক অপেক্ষা করবে, মেয়েটা না ফিরলে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন গতি নেই। ব্যাপারটা ভাবতেই আমি শিউরে উঠলাম, কি হতো বাসটা যদি এই জনশূন্য এলাকায় আমাকে ফেলে চলে যেত!

এবার আমার প্রশ্ন করার পালা। ভেতরের সব রাগ দলা করে ছুড়ে দিলাম ট্যুর গাইডের মুখে। কঠিন গলায় জানতে চাইলাম, আমাদের ফেলে বাসটা কেন পালিয়েছিল? এই প্রথম জানলাম একটা বাসের মূল্য আমার জীবনের চেয়ে অনেক বেশী। এমন একটা তথ্য দিতে ট্যুর গাইডের গলাটা সামান্য একটু কাঁপল না। হজম করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। এ ধরনের কথাবার্তা তৃতীয় বিশ্বের অনৈতিক এবং মানষিকভাবে পঙ্গু মানুষগুলোর পক্ষেই বলা সম্ভব, এমনটা ভেবে নিজকে সান্ত্বনা দিলাম।

আরও আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করল আমাদের বাসটা। কিন্তু ভিক্টোরিয়ার কোন হদিস পাওয়া গেলনা। যমজ বাসটা ইতিমধ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। ট্যুর গাইড জানাল, মূল রাস্তা হতে বের হয়ে মাইল খানেক গেলে নতুন একটা ট্রেইল পাওয়া যাবে এবং সে পথটা ধরতে পারলে আরও স্বল্প সময়ে লা-পাস পোঁছানো সম্ভব হবে।

আমার কাছে এসব কথা রূপকথার মত মনে হল। এখান হতে জাহান্নামের দিকে রওয়ানা দিলেও আমার কিছু আসে যায়না। মনে মনে ঠিক করলাম লা-পাস পৌঁছার আগে বাস হতে নামছি না আর। অপেক্ষা শেষে বাসটা রওয়ানা দিল উলটো পথে। যতক্ষণ সম্ভব জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম ফেলে আসা পথটার দিকে। রহস্যময়ী ভিক্টোরিয়ার হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়ে হারিয়ে গেল এন্ডিসের রহস্যময় বাঁকে।

তন্দ্রা মতো আসছিল। কিন্তু সামনে একটা নড়বড়ে সেতুর কারণে বাসটাকে থামতে হল। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল সেতুর চেহারা দেখে। দৈত্যের তাণ্ডবে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা নদীটা পার হতে গেলে সেতুটা অতিক্রম ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। ড্রাইভারের তাগাদায় নামতে হল প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে। দূর হতে যতটা দুর্বল মনে হয়েছিল বাস্তবে ততটা দুর্বল মনে হলোনা।

কোন দৈব ঘটনা ছাড়াই পারাপার পর্ব শেষ হল। শরীরটাকে ঠেলেঠুলে কোন রকমে বাসে ওঠালাম এবং আবারও ধপাস করে বসে পরলাম আগের জায়গায়। শুরু হল আমাদের যাত্রা। চোখ বুজে মৃতের মত পরে রইলাম অনেকক্ষণ। রাজ্যের ঘুম এসে ভর করল শরীরের উপর।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি টের পাইনি। চোখ খুলে জানালার বাইরে যে দৃশ্য চোখে পরল তা দেখে দূর হয়ে গেল সারাদিনের ক্লান্তি। মাঠ আর মাঠ। ঠিক বুক বরাবর চলে গেছে কাচা পাকা ট্রেইলটা। একদিকে বরফ আচ্ছাদিত এন্ডিসের চূড়াগুলোর নৈসর্গিক প্যানোরমা, অন্যপাশে অঘটনে ভরা পাকা হাইওয়ে। খোলা মাঠে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে ভেড়া এবং আলপাকার দল। মাঝে মধ্যে দুএক জন রাখাল অবাক হয়ে লক্ষ্য করছে এন্ডিসের দুর্গম অঞ্চলে আমাদের অনিশ্চিত যাত্রা।

নদীটাকে দেখা গেলনা কাছাকাছি কোথাও। খণ্ড খণ্ড জমিতে ভুট্টার চাষাবাদ দেখে আন্দাজ করা যায় খুব কাছ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে হয়ত। বন্য পশুর লাশ নিয়ে টানাটানি করছে শকুন, চিল আর কায়োটির দল। জানালার বাইরে সূর্যটাকে আগ্নেয়গিরি হতে বেরিয়ে আসা লাভার মত দেখাচ্ছে। বাইরে কি আসলেই এত গরম? জানালাটা সামান্য খুলতেই এন্ডিসের শোঁ শোঁ হাওয়া আর তীব্র শীত এসে ভরিয়ে দিল বাসের ভেতরটা। সামনের সিটে বসা অস্ট্রেলিয়ান স্বামী-স্ত্রী বিনীত অনুরোধ করল জানালাটা বন্ধ করতে।

ভিক্টোরিয়ার কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে থাকলে বিরামহীন ধারাবর্ণনায় মাতিয়ে রাখত বাসের নীরবতা। বিন্দু হতে বৃত্তের মত দিগন্তরেখায় ফুটে উঠলো সাদা ধবধবে বাসটার চেহারা। আমাদের যমজ বাস। ট্রেইলটাকে আড়াআড়িভাবে আঁটকে রেখে ঠায় দাড়িয়ে আছে মাঝ পথে। অভিজ্ঞ মন বলছে, সামনে বিপদ!

আসলেই বিপদ, সামনের চাকা ফুটো হয়ে বাসটা প্রায় ছিটকে পরেছে ট্রেইল হতে। কাছাকাছি এসে নিথর হয়ে গেল আমাদেরটাও। যাত্রীরা নেমে গেল অনেকটা জীবন্ত কঙ্কালের মত। আমি বসে রইলাম অনাগত আশংকার হতাশা নিয়ে। কিছুক্ষণ পর ট্যুর গাইড এসে জানাল চাইলে নীচে নামতে পারি।

দুঃসংবাদ যে আসবে তা আমার আগেই জানা ছিল। চাকা বদলানো জ্যাকটা ভেঙ্গে গেছে ! বাস হতে নেমে পরলাম ঘোর নেশাগ্রস্থের মত। মনে হল এ ওঠানামা অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে।
নিজেকেই দায়ী করলাম এমন গোলক ধাঁধায় আটকে যাওয়ার জন্যে। তবে ভাল সংবাদ বলতে যা বুঝায় তার একটা হল, রাস্তার ঠিক পাশেই ছোট একটা লোকালয় দেখা যাচ্ছে। এবং হাত পাওয়ালা দুএক জন আদমকে দেখা গেল ঘুরাফেরা করতে।

ইতিমধ্যে স্থানীয় একজন বাইসাইকেল নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেছে কোন এক রহস্যপুরী হতে নতুন একটা জ্যাক আনবে বলে। সময় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সে রাজপুত্রের আর দেখা নেই। ততক্ষণে ক্ষুধা বাবাজি পেটে ঢোল বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। শক্ত কোন খাবার পেটে যায়নি অনেকক্ষণ। আমার হাতে মাত্র দু’টা আপেল। পানির শেষ খালি বোতলটা এখনো ডাস্টবিনে ফেলা হয়নি।

হঠাৎ করে চমৎকার একটা দৃশ্য দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। দু’টা বাসের সব যাত্রীদের স্টকের খাবার এক জায়গায় করা হচ্ছে। দু’টা আপেল দিয়ে আমিও যোগ দিলাম অসময়ে গড়ে উঠা আন্তর্জাতিক সংহতিতে। আমি ছাড়া বাকি সবাইকে মনে হল আপদ-কালীন সময়ের প্রস্তুতি নিয়েই যেন ভ্রমণে বের হয়েছে। সবাই পেট পুরে খেয়ে বেরিয়ে পরল পাশের লোকালয় দেখবে বলে। পরনের জ্যাকেটটা বিছিয়ে মাটিতে শুয়ে পরলাম একটু ঘুমবো বলে।

১৩ই অক্টোবর, ১৯৭২ সালে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করলাম। ৪৫ জন যাত্রী নিয়ে চিলি গামী উরুগুয়ের একটা বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল এন্ডিসের চূড়ায়। ১২ জন সাথে সাথে মারা যায়। বাকিরা মাইনাস ৩০ ডিগ্রী সেঃ তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে শুরু করে বাচার লড়াই। খাবার হিসাবে মৃত সহযাত্রীদের মাংস ভক্ষণ করতেও বাধ্য হয় অনেকে। এভাবে একটানা ৭২ দিন লড়াই করে শেষ পর্যন্ত ১৬ জন জীবন্ত ফিরে আসে মূল ভূখণ্ডে। পৃথিবী চমকে উঠে এমন একটা লোমহর্ষক ঘটনার খবর পেয়ে। আমাদের ভাগ্য কি শেষ পর্যন্ত এমনটাই হতে যাচ্ছে?

আবোল তাবোল ভাবনায় মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। প্রথমত আমরা এন্ডিসের চূড়ায় নই, দ্বিতীয়ত পাশেই আছে লোকালয়। মূল রাস্তাটাও বেশী দূর নয়। তাছাড়া এটা ২০০৪ সাল, – এমন কতগুলি যুক্তি দাড় করিয়ে নিজেই নিজকে বোঝালাম আমাদের ভাগ্য অতটা অনিশ্চিত নয়। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যোগ দিলাম বাকি যাত্রীদের কাফেলায়। এই প্রথম ক্যামেরাটা বের করলাম ছবি তুলব বলে।

শীতের দাপট মানুষগুলোর শরীর ঝলসে দিয়েছে বাদামী কাবাবের মত। অনেকেরই দাঁত নেই, নাক দিয়ে বেরুচ্ছে হরেক রকম তরল পদার্থ। দরিদ্রতার সাথে রুক্ষ প্রকৃতি যোগ হলে মানুষের জীবন কতটা দুর্বিষহ হতে পারে এন্ডিসের এ অঞ্চলটায় না এলে বোধহয় বুঝা যেত না।

শত বছর বয়সী এক বৃদ্ধার বেশ কটা ছবি তুল্‌লাম। সেশন শেষ না হতেই হাত বাড়িয়ে দিল কিছু পয়সার জন্যে। সাথে কিছু স্থানীয় মুদ্রা ছিল, দশ বলিভিয়ানো দিয়ে বেরিয়ে এলাম আঙ্গিনা হতে। পানির কুয়া পাওয়া গেল একটা জায়গায়। সবার মত আমিও ভরে নিলাম আমার খালি বোতলটা। পানি মনে হল উত্তর মেরুর বরফ গলিয়ে কেউ জমা করেছে। নিথর হিম শীতল ঠাণ্ডা! সময়টা মন্দ কাটল না এমন অনিশ্চয়তার মাঝেও।

এ ফাকে সহযাত্রী অনেকের সাথে নতুন করে পরিচয় হল। এক অপরের সাথে ছবি তুলে বিরল মুহূর্ত গুলো ধরে রাখার চেষ্টা করল অনেকে। বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ আর ধোঁয়াটে আবহাওয়ার ফাঁক গলে হলিউডের নায়কের মত বেরিয়ে এলো স্বপ্নের সে রাজপুত্র। হাতে বিশাল একটা জ্যাক। এ যেন শত বর্ষ অপেক্ষার পর এক পশলা বৃষ্টির আগমন। খুশীর ফোয়ারা বয়ে গেল যাত্রীদের মাঝে।

28008

কাহিনীর ভেতর কাহিনী…

2762

ব্যক্তিগত একটা গল্প দিয়েই শুরু করি লেখাটা। কথা দিচ্ছি খুব একটা লম্বা করবো না।

স্তেলার সাথে পরিচয়টা ছিল অনেকটা প্রি-এরেঞ্জেড। আমার রুমমেট আন্দ্রেই শনিবার ক্লাসে যাওয়ার আগেই বলে রেখেছিল সন্ধ্যায় যেন কোথাও না যাই। তার সাথে একটা অপরিচিত জায়গায় যেতে হবে। নিজের সেরাটা প্রকাশ করার প্রস্তুতি নিয়েই যেন তৈরি থাকি এমন একটা তাগাদাও ছিল।
আন্দ্রেই সেন্ট পিটার্সবার্গে নতুন। এসেছে প্রশান্ত মহাসাগরের রাশান দ্বীপ সাখালিন হতে। বড় শহরে আসার আগে সে কোনদিন বিদেশীর সাথে কথা বলা দূরে থাক, সামনে হতেও দেখেনি। আমি নাকি প্রথম এবং তা-ও আবার রুম-মেট হিসাবে।

রাতে একটা পার্টিতে যেতে হবে। মেয়েদের পার্টি। পার্টি করার মত যথেষ্ট ছেলে নেই তাদের হাতে। আন্দ্রের গার্ল-ফ্রেন্ড তাদেরই একজন। দুজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ছেলে যোগাড়ের। আমি তাদেরই একজন।

ওখানেই আন্দ্রের মাধ্যমে পরিচয় স্তেলার সাথে। গায়ে গতরে একফোঁটা চর্বি নেই, যা রুশ মেয়েদের জন্যে কিছুটা অস্বাভাবিক। সে রাতে বলতে গেলে হুর-পরীদের আসর জমেছিল। সৌন্দর্যের রহস্য উন্মোচন করতে অবশ্য খুব সময় লাগেনি। মেয়েদের সবাই ছিল স্থানীয় ব্যালে স্কুলের ছাত্রী।
এ প্রফেশনে আসতে শরীর ও সৌন্দর্য ছিল বাধ্যতামূলক। জমায়েত মেয়েদের কারোরই ঘাটতি ছিলনা এসবের।

স্তেলার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর ধরে নিয়েছিলাম লৌকিকতা রক্ষার জন্যে কিছুটা সময় ব্যায় করে ও চলে যাবে অন্য ধান্ধায়।

সে রাতে তা আর ঘটেনি। গভীর রাত পর্যন্ত এক সেন্ডের জন্যে সে আমাকে ছেড়ে যায়নি। আপনি হতে তুমি পর্যন্ত আসতে খুব একটা পথ পাড়ি দিতে হয়নি। এবং লম্বা এক কাহিনীর শুরু হয়েছিল সে রাতেই।

শনিবার বিকেল হলেই যে চলে আসত আমার এখানে। জানালার নীচে দাঁড়িয়ে বরফের ঢিল ছুড়ে জানান দিত নিজের উপস্থিতি। আমিও তৈরি হয়ে নীচে নেমে যেতাম।
আর দশটা রুশ মেয়ের মত সে নৈশ-ক্লাব, রেস্তোরা অথবা ভদকা পার্টিতে না গিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যেত ব্যালে অনুষ্ঠানে। ঢুঁ মারতো স্থানীয় ফিলারমনিতে। পরিচয় করিয়ে দিত চাইকোভস্কি, সেস্তাকভিচের কম্পোজিশনের সাথে। নিজের উচ্চাশা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতো না। তারও ইচ্ছা একদিন চাইকোভস্কির সোয়ান লেকের মূল চরিত্রে সে নাচবে।

এভাবেই ঘুরে গেল বছর। ততদিনে আমার অস্তিত্বের সবকিছুতে স্তেলার উপস্থিতি অবিচ্ছেদ্য। শনিবার সন্ধ্যা মানেই আমাদের।

হঠাৎ এক শনিবার তার আর দেখা নেই। আমি তৈরি হয়ে অপেক্ষায় আছি তার ঢিলের। কিন্তু না…বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল তবু তার দেখা নেই।
একটু অবাক হলাম। এমনটা হওয়ার কথা নয়। ধরে নিলাম নিশ্চয় শরীর খারাপ।
পরের শনিবারেও দেখা নেই। এবং তারপরের শনিবারেও না। অপেক্ষার প্রহর লম্বা হতে আরও লম্বা হওয়া শুরু করল। শীতের পর বসন্ত এলো এবং বসন্তের পর গ্রীষ্ম। যেন হালকা বাতাসে মিলিয়ে গেল জলজ্যান্ত একটা মেয়ে।
আস্তে আস্তে মেনে নিলাম এই অন্তর্ধান। ধরে নিলাম নিশ্চয় অন্য কারও বাহু-লগ্না হয়েছে ততদিনে। পৃথিবীর এ প্রান্তে এসব নিয়ে হা হুতাশ করার অবকাশ ছিলনা। আমিও হেঁটে গেলাম আমার পথে।
ধীরে ধীরে মুছে গেল স্তেলার স্মৃতি। আমার রুম-মেট আন্দ্রেই কোন হদিস দিতে পারল না।

প্রায় দেড় বছর পর সন্ধান পেলাম স্তেলার। সে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। ঠিকানা দেখে চমকে উঠলাম, হাইফা, ইসরায়েল।

আন্দাজ করতে পেরেছিলাম সে ইহুদি। কিন্তু এ নিয়ে কোনদিন প্রশ্ন করিনি। নিজেই লিখেছে ইসরায়েল যাওয়ার কারণ। গোটা পরিবার ইতালি হয়ে পাড়ি জমিয়েছে ওদিকে। তার একমাত্র ভাই এখন ইসরায়েল আর্মির সৈনিক। নতুন বয়ফ্রেন্ডও রুশ ইমিগ্রেন্ট এবং সে সেনাবাহিনীর মেজর।

এবার আসি এ লেখার মূল পর্বে।

ইসরায়েল নামের দেশটার মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ভাগ রুশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় ছলেবলে ওরা দেশ ছাড়তো। অনেক সময় ওদেরও ঠেলে দিত দেশের বাইরে। ইহুদিরা সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল ২য় শ্রেণীর নাগরিক। সমাজের সর্বক্ষেত্রে ওরা ছিল অবহেলিত। প্রতিটা রুশ ইহুদির কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন ছিল একসময় ইসরায়েল চলে যাওয়া।

প্যালেস্টাইনিদের দরদে উথলে উঠছে রুশ স্বৈরশাসক ভ্লাদিমির পুতিনের মন। তার এই মায়া অক্টোপাসের মত আঁকড়ে ধরছে ধর্ম-প্রিয় বাংলাদেশিদের মন। তাই রুশদের ইউক্রেইন আক্রমণে অনেক স্বদেশী জেহাদের মত কলম লড়াই করছেন রুশদের হয়ে। অনেকের জন্যে কারণ একটাই, প্যালেস্টাইনিদের প্রতি রুশ সমর্থন ও ইউক্রেইন প্রেসিডেন্টের অন্য শিবিরে অবস্থান।

এখানেই আসে স্তেলা, তার ভাই ও নতুন বয়ফ্রেন্ডের কাহিনী।
ফার্স্ট জেনারেশন রুশ ইহুদিদের অনেকেই নাম লেখায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে। তাদের মিশন এক ও অদ্বিতীয়; প্যালেস্টাইনিদের নির্মূল।
পশ্চিমে একটা কথা চালু আছে; ইসরায়েলি বর্বরতায় অর্থ ও অস্ত্রের যোগানদাতা যদি আমেরিকা হয় তবে সে অর্থ দিয়ে কেনা অস্ত্র চালাতে যে মানব সম্পদের দরকার হয় তার মূল যোগানদাতা রাশিয়া।
রুশ ইহুদিদের অনেকেই হাতে অস্ত্র নিয়ে হামলে পরে প্যালেস্টাইনি শিশুদের উপর। আকাশ হতে গুড়িয়ে দেয় গাজার বাড়ি-ঘর। পুরস্কার হিসাবে পায় প্যালেস্টাইনি এলাকায় সম্পত্তি। ওখানেই সেটলার হিসাবে বিষের কাঁটা হয়ে বাস করে প্যালেস্টাইনিদের নাকের ডগায়।