বাংলাদেশের ৮বিভাগীয় শহরের অলি, গলি, পাড়া, মহল্লার বাসা বাড়িতে বুড়ো মানুষের যত কষ্ট! সব বুড়োরা সারাজীবন চাকরি বাকরি করেছে ছেলে পেলের জন্য। চুরি দারি, আর ঘুষ খেয়ে মেদ ভূরি বাড়িয়েছে। বাড়ি করেছে। প্রতি কোরবানি ঈদে বড় সাইজের গরু কিনে কুরবানি দিয়েছে। ঈদের মার্কেট করেছে সিঙ্গাপুর, নাহয় থাইল্যান্ড গিয়ে। এই ছেলে পেলেদের সুখে দিকে চেয়ে কতো গরিব মানুষকে যে ঠকিয়েছে, তার কোনও ইয়াত্তা নেই। স্ত্রীর কথা শুনে নিজের মা বাবাকে নিজের সংসারে রাখেনি। রেখেছে গ্রামের বাটিতে, নাহয় টাকা দিয়ে কোনো এক নিকটাত্মীয়ের কাছে। মা বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে লোক দেখানো দুই ফোটা চোখের জল ফেলেছে মাত্র। মনে মনে আল্লার দরবারে শুকরিয়া আদায় করেছে শতবার।
চলে গেলেন জন্মদাতা পিতা আর গর্ভধারিণী মা। এখন নিজের পালা। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে বেশকিছু দিন গত হলো। নিজ তহবিলে যা ছিল, আদরের নাতি নাতকুরের পেছনে খরচ করতে করতে সব শেষ। সংসারের দায়িত্ব ছেলের বউয়ের কাছে। যাকে বলে সংসার পরিচালনাকারী। ছেলে ব্যাংকার। ছেলের ঘরে এক ছেলে, এক মেয়ে। সুখী সংসার যাকে বলে। দুখের মধ্যে হলো বুড়োটা। এ এক বাড়তি ঝামেলা। মুরুব্বি রিটায়ার হবার কিছু দিন পরেই গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে শহরে চার শতাংশ জায়গায় কোনরকম একটা বাড়ি করেছে। চারদিকে প্রাচীর ঘেরা। একতলা টিনসেড দুই রুম বিশিষ্ট দালান ঘর। সাথে গোসলখানা, বাথরুম, রান্নাঘরও আছে। তারপরও বুড়ো বুড়ির থাকার জায়গা হচ্ছে না। সমস্যা বেগতিক!
ছেলের বউয়ের নেকামি দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো। কাজের ছেলে আবদুল বলতে একমাত্র বুড়োই আছে। ছেলে বউয়ের কাপড় চোপড়ও সময়তে ধুইয়ে দিতে হয়। ছেলে বউ আবার এক নামী-দামী স্কুলের শিক্ষিকা। সংসারে আর সব কাজের মধ্যে বুড়োর বড় কাজ হলো, নাতি নাতিন দুটো কিন্ডারগার্টেন স্কুলে আনা নেয়া। সময় সময় হাল্কা পাতলা রান্নার কাজও করতে হয় বুড়োকে। যেমন: ডিম ভাজা, ডাল গরম করা, চা বানানো ইত্যাদি। বুড়ো করেও। বুড়ো কোনও কাজে অমত করে না। ছেলে বউ যা বলে, বুড়ো তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। বুড়ো নিজেও তো কোনো এক সময় নিজের বাবা মাকে এমন করেছিল। সেই করা এখন নিজে ভোগ করা। তা বুড়োর বেশ মনে আছে। মনে পড়লেই একা একা কাঁদে। বুড়োর কান্না কেউ দেখতে পায় না। দেখলেও মহাবিপদ হবে। তাই বুড়ো কারোর সামনে চোখের জল ফেলে না। কারোর কাছে মনের দুঃখও প্রকাশ করতে পারে না। এ-ভাবেই কেটে যাচ্ছে বুড়োর দিন আর রাত।
এখন অনেক সময় ঠাণ্ডা, জ্বর, সর্দি, কাশি হলে বুড়োর জন্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেট কেনার টাকাও থাকে না ছেলের বউয়ের কাছে। বউ বলে, ঠাণ্ডা জ্বর এমনিতেই সেরে যায়। সামান্য সর্দি জ্বরে ট্যাবলেট সেবন করা ঠিক না। এই বলে বুড়োকে শান্তনা দেওয়া হয়। হাড়ভাঙা খাটুনিতে বুড়ো একসময় দুর্বল হয়ে পড়লো। এখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারে না। তাই সংসারের বড় ঝামেলার বোঝা হলেন এই বুড়ো লোকটা। বুড়ো শারীরিকভাবে নিঃশক্তি হবার কারণে এখন আর নাতি নাতিন নিয়ে স্কুলেও যেতে পারে না। সে কারণে ছেলের বউয়ের আরও জ্বলা বেড়ে গেল।
বুড়োর এই অবস্থা দেখে ছেলের বউ বলে, “ওনাকে যে-কোনও বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে রাখো। ওনাকে দিয়ে তো আর সংসারের দুই পয়সার কাজ হচ্ছে না। তা ছাড়া ছেলে মেয়ে দুটো বড় হয়ে যাচ্ছে। ওদের জন্য আলাদা শোবার ঘর দরকার। তোমার বাবাকে যদি বলি বারান্দায় ঘুমান, তিনি মন খারাপ করে। তার চেয়ে বরং কোনও এক বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে রাখো। আজকাল অনেক বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হয়ে আছে। বৃদ্ধাশ্রমে খাওয়া দাওয়াও ভালো দেয়। সাথে চিকিৎসাও দেয়। বাড়ি থেকে দুইটি পয়সাও খরচ করতে হবে না। বরঞ্চ ঘরে আরও টাকা আসবে।”
স্বামী অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “তা কীভাবে ঘরে টাকা আসবে?”
স্ত্রী বললো, “কতো বড়লোকেরা সাহায্য সহযোগিতা করে। জামা দেয়, ঔষধ দেয়, টাকা দেয়, পয়সা দেয়। সেগুলো কি তোমার বাবা একা একা হজম করতে পারবে? খাওয়া- দাওয়াতো সরকারি। উপরি যা পাবে সবই তো আমাদেরই। তাই তাড়াতাড়ি করে একটা ব্যবস্থা করে ফেলো। নাহয় সামনে ওনাকে নিয়ে আরও বিপদ হবে।”
স্বামী তাঁর স্ত্রীর কথামত বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ নিলেন। রাখার ব্যবস্থা করলেন। দিন তারিখ ঠিক করলেন। স্ত্রীকে জানিয়ে রাখলেন। স্ত্রী স্বামীর কাছে বৃদ্ধাশ্রমের কথা শুনে খুবই খুশি হলেন। এই বুঝি বাড়ি থেকে এক ঝামেলার অবসান হতে লাগলো। তারিখ মত সকালবেলা ছেলের বউ বুড়োকে বলছে, “তাড়াতাড়ি দুমুঠো খেয়ে জামা কাপড় পড়ে নিন। দশটার আগে সেখানে যেতে হবে।”
নাতি নাতিন দুটো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে। নাতি ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করছে, “বাবা, দাদাকে কোথায় নিয়ে যাবে?”
বাবা বললো, “তোমাদের দাদার জন্য একটা ভালো জায়গা ঠিক করেছি। আজ থেকে উনি সেখানে থাকবে।” বাবার কথা শুনে ছেলে বললো, “তা কোথায় বাবা?” ছেলের কথায় বাবা বিরক্ত হয়ে সোজাসুজি বলে ফেললো, “বৃদ্ধাশ্রমে।”
ছেলে আবার জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা বাবা, মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে কি বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়? তাহলে তো একদিন তোমাকে আর মাকেও বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে। তাই না বাবা?”
ছেলের মা সামনে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। কিন্তু কোনও প্রত্যুত্তর নেই। ছেলের কথায় বাবার মুখও বন্ধ হয়ে গেল। বুড়ো বারান্দায় বসে সকালের নাস্তা খাচ্ছিলেন। বুড়োর মনটার খারাপ। কিছুক্ষণ পরই স্বাদের সংসার ছেড়ে বুড়োকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে, তাই।
নাতি বুড়ো দাদার সামনে এসে বললো, “দাদা, তুমি বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে যেখানে থাকবে, সেই জায়গাটা আমার বাবার জন্য সুন্দর করে রেখে দিও। আমার বাবাও তো একদিন বুড়ো হবে। বুড়ো হলে তো সবাইকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়। তা আগে থেকে যদি রেডি করা থাকে তো দোষ কী দাদা? চলো দাদা, আমিও আজ তোমার সাথে যাবো। তোমার সাথে গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমটা চিনে আসবো। বাবা বুড়ো হলে যাতে দৌড়াদৌড়ি করতে না হয়। চলো দাদা চলো। আমিও আজ তোমার সাথে বৃদ্ধাশ্রমে যাবো। বৃদ্ধাশ্রম কাকে বলে চিনে আসবো।”
এভাবে আমাকেও হয়তো একদিন বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে দাদা।
.
গল্পের ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কারোর জীবনের সাথে মিলে গেলে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে দায়ী থাকার কথা নয়।
'চলো দাদা চলো। আমিও আজ তোমার সাথে বৃদ্ধাশ্রমে যাবো। বৃদ্ধাশ্রম কাকে বলে চিনে আসবো।” এভাবে আমাকেও হয়তো একদিন বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে দাদা।' মর্মন্তুদ।
শ্রদ্ধেয় দাদা, হয়তো দেশে থাকা বৃদ্ধাশ্রমগুলোর মধ্য যে-কোনও একটিতে আমার ঠিকা হতে পারে। তখন আমার হাতে হয়তো কোনও মোবাইল ফোন থাকবে না। তখন লেখালেখি তো করতে পারবোই না, আপনাদের সাথে যোগাযোগই বা করবো কীভাবে? তখন কী এই অধমের খবর কেউ রাখবে, দাদা?
মনে সাহস রাখুন। আপনাকে নিশ্চয়ই মনে রাখবে।
এভাবেই আমরা ভাঙতে ভাঙতে ছোট ছোট দ্বীপ হয়ে যাবো কবি নিতাই বাবু।
একদিন আমাকেও হয়তো দেশের যে-কোনও একটা বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে দাদা। তখন হয়তো আর লেখালেখি করতে পারবো না। আপনাদের লেখা পড়বো কেমন করে? আমি যে আপনার একজন প্রিয় পাঠক, তাই বলছি দাদা।
এই জীবন আমাদের আশেপাশের। খুব চেনা কাহিনী। একান্নবর্তী পরিবারের কথা কেউ যেন ভাবতেই চায় না। সবাই একা থাকতে চায়।
এদেশে গড়ে ওঠা যে-কোনও একটা বৃদ্ধাশ্রমে আমাকেও হয়তো একদিন যেতে হবে দাদা। তা তো বলা যায় না দাদা। তা আগে থেকেই ভাবছি।
আমাদের একান্নবর্তী পরিবার গুলোকে আমরা ধরে রাখতে পারছি না।
সত্যি পারছি না শ্রদ্ধেয় দিদি।
সংসারকে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী করে ফেলেছি আমরা। ভালবাসা নেই।
শ্রদ্ধেয় কবি রিয়া দিদি, ভালোবাসা ধ্বংসের মূলে রয়েছে আমাদের হীনস্বার্থ। এই স্বার্থই আমাদেরর তিলেতিলে ধ্বংস করে ফেলছে।
কী নির্মম আমরা।
সত্যি আমরা দিন দিন হিংস্র জানোয়ার হয়ে যাচ্ছি দিদি।
সময় থাকতে বৃদ্ধাশ্রমে বুকিং দিয়ে রাখতে হবে আমাদের।
আমি যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি শ্রদ্ধেয় দিদি। একদিন আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হতে পারে। তাই আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে থাকছি।
অনুভব করলাম।
ধন্যবাদ আপনাকে..
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় দাদা। সাথে শুভকামনাও থাকলো।