নিতাই বাবু এর সকল পোস্ট

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

তুমি কোথায়?

nit

তোমাকে খুঁজি!
পথেঘাটে, বনজঙ্গলে, পাহাড়ের কোণে,
হিমালয় পর্বতে, এখানে-সেখানে,
খুঁজেছি বহু এই পৃথিবীর সবখানে
পাইনি কোথাও, দেখি-ও-নি দু’নয়নে।

তুমি কোথায়?
খুঁজে পাই অন্তর দৃষ্টিতে,
আকাশে-বাতাসে, বজ্রপাতে, বৃষ্টিতে,
তুফানে, জলোচ্ছ্বাসে, সুস্বাদু ফলের মিষ্টিতে,
সাগর নদীতে আর তোমার সৃষ্টিতে।

তুমি সত্যি আছো!
পাহাড়-পর্বত হিমালয় বলে,
নদী বলে, পাহাড়ের ঝর্ণায় বলে,
পূর্ণিমার চাঁদ বলে, আকাশে তারা বলে,
মনের বিশ্বাস বলে, এ দেহের নিশ্বাস বলে।

নিতাই বাবু
২৬/০৮/২০২৩ইং।

মধ্য আয়ের দেশ

366

উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে দেশ,
দুর্মূল্যের বাজারে মানুষ হচ্ছে নিঃশেষ।
নেতারা খাচ্ছে পোলাও কাচ্চি বিরিয়ানি,
খেটে-খাওয়া মানুষ দিনদিন হচ্ছে ঋণী।

উন্নয়নের কারিশমা মাথায় ঋণের বোঝা,
জনগণ মরছে নেতা সাজে ওঝা।
দুর্মূল্যের বাজারে ভোজ্যদ্রব্য লাগামহীন ছুটছে,
অখাদ্য-কুখাদ্য গরিবের কপালে জুটছে।

নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায়,
তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে নাকে ডগায়।
দেশ উন্নয়নে আলোকিত হচ্ছে চারদিক,
বিদ্যুৎ বিহীন অন্ধকার এদিক-সেদিক।

গরিবের মাথার ঘাম গড়াচ্ছে পায়,
কৃষকের আর্তনাদ ধ্বনি মুখরিত গাঁয়।
মেহনতি মানুষের শরীর হচ্ছে রক্তশূণ্য,
দুর্নীতিবাজ নেতাদের জীবন হচ্ছে ধন্য।

দেশের টাকা মানে জনগণের রক্ত,
দুর্নীতিবাজরা তা বিদেশে পাচারে রপ্ত।
নেতারা বিদেশে বানাচ্ছে আলিসান বাড়ি,
দেশেও থাকে তাদের বুলেটপ্রুফ গাড়ি।

গরিব মরে মরুক না খেয়ে থাকুক,
করোনা রোগে ভুগে ডেঙ্গুতে মরুক।
যত রোগের পাদুর্ভাব নেতাদের লাভ,
রিলিফ মেরে দেখায় মানবতার ভাব!

দুর্নীতির রাহু গলা টিপে ধরছে,
রাহুগ্রাসে গরিবেরা ধুকে ধুকে মরছে।
উন্নয়ন আর দুর্নীতি সমানতালে চলছে,
তবুও নেতাগণ মধ্য আয়ের দেশ বলছে।

.
নিতাই বাবু
১৪/০৮/২০২৩ইং।

মাথায় ঋণের বোঝা

ni

এই জীবনে করিনি ঋণ তবুও আমি ঋণী,
মাথায় ঋণের বোঝা চেপে দিলেন যিনি।
তিনি আর কেউ নয় স্বয়ং আমার রাষ্ট্র,
দেশে ঋণের বোঝায় এখন আমি পথভ্রষ্ট।

এক নয় দুই নয় পঁচানব্বই হাজার টাকা,
তাইতো দেখি আমার পকেট হচ্ছে ফাঁকা।
এমনিতে চলে না সংসার দুর্মূল্যের বাজার,
সামান্য বেতন আমার মাত্র কয়েক হাজার।

কী করে চলি এখন কোথায়-ই-বা যাই,
কী করি ভেবে মরি পথ খুঁজে না পাই।
স্বল্প বেতন অল্প টাকায় চলি কী করে,
যদি হয় রোগ-ব্যধি যেন যমে টেনে ধরে।

মরি মরি করেও মরণ কেন হয় না,
বলি বলি করেও দুঃখ বলা হয় না।
যার কাছে বলবো সে-ও একজন দুখী,
ঋণের বোঝা মাথায় সবার কেউ নয় সুখী।

নিতাই বাবু
১৭/০৮/২০২৩ইং।

ডিজিটাল বাংলাদেশ

out.

নাম তার নিতাই চন্দ্র, ডাকে সবাই বাবু,
নেই কোনও জমিদারি, বাবু ডাকে তবু।
লেখাপড়া নেই তেমন, শুধু অল্পকিছু জানা,
ইচ্ছে ছিল লেখাপড়ার, সমস্যা ছিল আনা।

যা হয়েছে নিজের চেষ্টায়, তা দিয়েই চলে,
ঘরে খাবার না থাকলেও সত্য কথাই বলে।
কাজে ছিল পাকা, হিসাবে ছিল ঠিক,
বে-হিসাবে চলতে গিয়ে, সব হলো বেঠিক।

জায়গাজমি নেই কিছুই, পরের বাড়ি বাসা,
স্বপ্ন বলতে জীবনটুকু, বেঁচে থাকার আশা।
এখন বয়সে সে কাবু, মাথায় পেকেছে চুল,
স্মরণশক্তি কমেছে খুব, হিসাবে করে ভুল।

শরীরের চামড়া হচ্ছে ঢিলে, গুটিকয়েক দাঁত,
চোখের দৃষ্টি নেই তেমন, ঝাপসা দেখে দিনরাত।
একসময় দৌড়াত খুব, ক্যামি ঘড়ির পেছনে,
সারাক্ষণ বসে থাকতো, টিভির পর্দার সামনে।

সেইদিন নেই বাবুর, এখন ডিজিটাল দেশ-বিদেশ,
হাতে হাতে মোবাইল ফোন, আগের দিন শেষ।
ছোট একটা যন্ত্র মোবাইল, ভেতরে সব তার,
দুনিয়াটা হাতের মুঠোয়, চিন্তা কীসে আর।

লেখাপড়া লাগে না লিখতে, মুখে বললেই হয়,
কী লিখবে আমায় বলো, গুগল মামায় কয়।
তাইতো সবাই লিখে যাচ্ছে, হচ্ছে সবাই কবি,
স্টুডিওতে যায় না কেউ, নিজেই তোলে ছবি।

কমেছে ক্যামেরার মান, ধূলিসাৎ স্টুডিওর ব্যাবসা,
ফটোগ্রাফার সবাই এখন, মোবাইল ছাড়া সমস্যা।
দুঃখ করে বাবু বলে, মোদের দিন তো শেষ,
তথ্যপ্রযুক্তির এই দুনিয়ায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ।।

.
নিতাই বাবু:
১১/০৮/২০২৩ইং।

ভারতের মেট্রো বা পাতালরেলে চড়ার আনন্দ অভিজ্ঞতার গল্প

nit

একসময় ভারতের মাটিতে পা রেখেছিলাম, ১৪০০ বঙ্গাব্দ। তখন বৈশাখমাস। বাংলাদেশ থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে দালাল মারফত অতি কষ্টে সীমান্ত পেরিয়ে বনগাঁ রেলস্টেশন পৌঁছেছিলাম। আমার সাথে ছিল, আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ওর দুই বোন। যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, জীবনটাকে একটু পরিবর্তন করার। কিন্তু না, জীবন তো পরিবর্তন করতে পারি-ই-নি, বরং ওখানে প্রায় দেড়বছর অবস্থান করে শেষাবধি শূন্য হাতে আবার ফিরে আসতে হলো। এরমধ্যে লাভ হয়েছিল, বিশাল ভারত-সহ ভারত ঘেঁষা ভুটানের কয়েকটা জায়গা দেখা হয়েছিল। তো যাক সেকথা, আসা যাক পোস্টের মূল কথায়।

ভারত যাবার পর আমার বন্ধু বাসায় অবস্থানের পর, আমার যেন কিছুই ভালো লাগছিল না। ভালো না লাগার কারণ ছিল, বাংলাদেশে ফেলে রাখা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চিন্তা। সেই চিন্তা মনের ভেতরে রেখেই কাটিয়ে দিলাম চার-পাঁচদিন। চার-পাঁচদিন পর একদিন সকালবেলা আমার বন্ধু কানাই বলল, “চল দুইজনে টাউনে গিয়ে ঘুরে আসি।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাবি?”
কানাই বলল, “আজ তোকে মেট্রো ট্রেনে চড়াব। আর সময় পেলে হাওড়া, তারামণ্ডলও দেখাবো।”

এ-তো খুশির খবর! কিন্তু খুশির বদলে আমার কান্না আসতে লাগল! চিন্তা শুধু একটাই, তা হলো এখানে আসলাম বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, হচ্ছে শুধু টাকা খরচ! এভাবে ঘুরে বেড়ালে কি হবে? আমার তো কিছু একটা করতে হবে। ভাবছি, কানাইর সাথে যাব কি যাব না! না গেলেও হয় না। শেষমেশ জামাকাপড় পড়ে কানাইর সাথে বের হলাম।

কানাই’র বাসা থেকে একটা অটো (সিএনজি) চড়ে গেলাম ধর্মতলা। এই ধর্মতলায় কোলকাতা শহরের বড় একটি বাসস্ট্যান্ডও আছে। আছে কোলকাতার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার ট্রাম ও বাস সার্ভিস। অটো থেকে নেমে একটা চা দোকানে গিয়ে চা-বিস্কুট খেলাম। দোকান থেকে বের হয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম। সিগারেট জ্বালিয়ে ফুঁকছি, আর হাঁটছি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছি। একসময় একটা রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি দুইজনে। দেখছিলাম, দুইটা দোকানের মাঝখানে মাটির নিচে যাওয়ার জন্য অনেক চওড়া জায়গা। নিচে যাওয়ার সুন্দর সিঁড়িও আছে।

কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “নিচে কী?”
কানাই বলল, ”এটি হচ্ছে কোলকাতা শহরের ভূগর্ভস্থ পাতাল রেলস্টেশন। যাকে বলে পাতাল রেল বা মেট্রো ট্রেন বা মেট্রোরেল। তাই অনেকে বলে, মেট্রো ট্রেনস্টেশন।

বললাম, “তা হলে আমরা কি এখন এই স্টেশনেই যাচ্ছি?” কানাই বলল, ”হ্যাঁ, তোকে তো বাসা থেকে বাইর হবার আগেই বলেছি। এখন চল, নিচে স্টেশনের ভেতরে যাওয়া যাক। গেলেই বুঝতে পারবি, পাতাল রেল কাকে বলে!”

সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিচে নামতে লাগলাম। যতই নিচে যাচ্ছিলাম, ততই স্টেশনের ভেতরকার সৌন্দর্য দেখে অবাকও হচ্ছিলাম! এই মেট্রো ট্রেন হলো, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতা পরিবহণ সেবার মধ্যে একটি। এটির পরিসেবা কোলকাতা শহরের পার্শ্ববর্তী উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা পর্যন্ত। দ্রুত পরিবহন সেবা প্রদানকারী পরিবহণ ব্যবস্থাও বলা যায়।

জানা যায়, কোলকাতা মেট্রো ট্রেনের পথ ২৭.২২ কিলোমিটার। এই ২৭.২২ কিলোমিটার পথে ২৩টি মেট্রো স্টেশন রয়েছে। যার মধ্যে ১৫টি স্টেশন ভূগর্ভস্থ আর বাদবাকিগুলো উড়াল। এই পরিবহন সেবা চালু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে এবং এটিই ভারতের প্রথম মেট্রো রেল পরিসেবা। এরকম পাতাল রেল সার্ভিস নাকি ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও আছে।

আমরা দু’জন নিচের দিকে নামছিলাম, যত নিচে যাচ্ছি ততই সুন্দর! ঝকঝকা আলো আর লোকে লোকারণ্য। স্টেশনের ভেতরে গার্ডের সাথে পুলিশও আছে। তাদের ডিউটি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা। কে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে এগুলো ফলো করা। মূল স্টেশনে প্রবেশ করতে হলে, চাই টিকিট।

কম্পিউটারে টিকিট শো করলেই গেইট খুলবে, যাত্রী প্রবেশ করবে। এ ছাড়া আর প্রবেশ করার মতো কারোর সাধ্য নেই। কানাই কাউন্টার থেকে দুটা টিকিট কিনে আনল। আমরা যাব, ধর্মতলা থেকে টালিগঞ্জ। টিকিটের দাম নিল, ৫ টাকা করে ১০ টাকা। দুটো টিকিটই একসাথে, মানে একটা টিকিট। টিকিটের গায়ে লেখা আছে টু ম্যান।

ট্রেন আসার সময় হয়েছে। হুইসেল শোনা যাচ্ছে। কানাই বলল, ”শিগগির আয়।”

আমরা কম্পিউটার সিস্টেম গেইটের সামনে গেলাম। কানাই গেইটের পাশে থাকা বক্সে টিকিট ঢুকাল। টিকিটখানা শোঁ করে বক্সের পেছনে চলে গেল। আমরা গেইট পার হলাম, টিকিটখানা হাতে নিলাম। গেইটখানা ধরে আমি একটু ট্রাই করে দেখলাম! গেইট আর একটুও নড়ে-চড়ে না। টিকিটের গায়ে দুইজন লেখা। ঠিক দুইজন পার হওয়ার পরই গেইট বন্ধ। ট্রেন স্টেশনে এসে থামল। যাত্রিরা ট্রেন থেকে নামল। আমরা ট্রেনে ওঠার জন্য রেডি হয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।

ট্রেন থেকে মাইকে বলছে, “টালিগঞ্জ যাওয়ার যাত্রিগণ ট্রেনে ওঠে আসন গ্রহণ করুন।” আমরা-সহ সব যাত্রী ট্রেনে ওঠে সিটে বসার পর ট্রেন থেকে আবার মাইকিং। বলা হচ্ছে, “যাত্রীদের অবগতির জন্য বলা হচ্ছে যে, আপনারা ট্রেনের দরজা ও জানালা থেকে দূরে থাকুন।” এর পরপরই ট্রেনের সব দরজা ও জানালা একসাথে শোঁ করে লেগে গেল! বুঝলাম, দরজার সামনে যদি কেউ দাঁড়ানো থাকত, তা হলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই আগে থেকেই যাত্রীদের হুশিয়ার করে দেওয়া হয়, যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে।

ট্রেন ছুটল দ্রুতগতিতে! জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ট্রেন যাচ্ছে মাটির নিচ দিয়ে। কিছু দেখা যাবে কী করে? শুধু একটু শব্দ শোনা যাচ্ছে, শোঁ শোঁ শব্দ। ১০ মিনিটের মতো বসে থাকার পর আবার মাইকিং।
বলা হচ্ছে, “আমরা টালিগঞ্জ পৌঁছে গেছি! ট্রেন থেকে নামার জন্য প্রস্তুত হোন।”

কানাই বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল, সাথে আমিও ওঠলাম। ট্রেন থামল। ট্রেন থেকে আমরা নেমে স্টেশনের বাইরে আসলাম। কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে চা-বিস্কুট খেয়ে তৈরি হলাম, ধর্মতলা আসার জন্য। এবার ট্রামে চড়ে আসব ধর্মতলা। ট্রাম দেখা হবে আর চড়াও হবে। তারপর ট্রাম দেখা হলো, ট্রামে চড়াও হলো। মেট্রোরেল বা পাতালরেলে চড়ার গল্পও শেষ হলো।

গোদনাইলের গান গাই

niii

আমাদের গোদনাইল খুবই সুন্দর পরিপাটি,
পাকা রাস্তায় মানুষ করে হাঁটাহাঁটি।
পূর্বদিকে শীতলক্ষ্যা নদী বন্দর উপজেলা,
পশ্চিমে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা নারায়ণগঞ্জ জেলা।

গোদনাইলে আছে ছোট-বড় অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান,
আছে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস আর শিল্প-প্রতিষ্ঠান।
আরও আছে খেলার মাঠ নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র,
আছে বাজার মার্কেট যেন সুখের প্রাণকেন্দ্র।

নারায়ণগঞ্জ শহর ঘেঁষে গোদনাইল অবস্থিত,
গোদনাইলের সৌন্দর্য দেখে মানুষ হয় স্তম্ভিত!
শহরে আছে যা গোদনাইলেও আছে তা-ই,
তাইতো সবাই সুখে-দুঃখে গোদনাইলের গান গাই।

ছবিটি অনেক আগে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস্-এর পুকুর পাড়ে অবস্থিত ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ( ডিপিডিসি) নির্মাণাধীন ভবনের উপর থেকে তোলা।

নিতাই বাবু
২৩/০৬/২০২৩ইং।

রয়ে যাবে কিছু

nit

যদি বলি জীবনের গল্প
হবে নাতো বলা শেষ
কিছু রয়েই যাবে,
যদি শুরু করি লেখা
কাগজ ফোরাবে হবেনা শেষ
কলমের কালিও ফোরাবে।

তবুও থেকে যাবে কিছু-না-কিছু
কথা আর জীবনের গল্প
মানুষের কাছে অজানা,
হবেনা বলা আর লেখা
হবেনা গাওয়া জীবনের গান
মনের কামনা বাসনা!

ইচ্ছে করে

nii

ইচ্ছে করে আকাশে উড়ে যেতে,
পারি না পাখির মতো ডানা নেই বলে!
ইচ্ছে করে সব বিলিয়ে দিতে,
তা-ও পারি না কিছুই নেই বলে!

ইচ্ছে করে ভূমিহীনদের ভূমি দিতে,
পারি না নিজের ভিটেমাটি নেই বলে!
ইচ্ছে করে দুখীদের সুখ দিতে,
তা-ও পারি না কপালে সুখ নেই বলে!

একরকম শূন্য হাতে ভুটান ফ্রুন্টসলিং ভ্রমণ করেছিলাম

niii

ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় একবার আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে ভারত গিয়েছিলাম। সময়টা ছিল ১৯৯৩ সাল। যেদিন বেনাপোল বর্ডার পাড় হয়ে ওপার বনগাঁ পৌঁছেছিলাম, সেদিন ছিলো পহেলা বৈশাখ ১৪০০ বঙ্গাব্দ।

সেদিনের ওই যাত্রায় আমরা ছিলাম চারজন। আমি, আমার বন্ধু ও বন্ধুর দুই বোন। বনগাঁও থেকে রাত দশটার ট্রেনে চড়ে দমদম নামলাম। রাত তখন প্রায়ই বারোটা। তারপর আমার বন্ধুর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর বাড়িতে গেলাম, রাত কাটানোর জন্য। সেই বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরবেলা দমদম থেকে শিয়ালদা। শিয়ালদা নেমে একটা অটো চেপে সোজা বন্ধুর বাসায়।

ওই বন্ধুর বাড়িতে রাত যাপন করে খুবই ভোরবেলা আবার দমদম রেলস্টেশনে এলাম, শিয়ালদহ যাবার জন্য। যখন দমদম রেলস্টেশনে এলাম, তখনও শিয়ালদাগামী ট্রেন দমদম রেলস্টেশনে পৌঁছায়নি। এই ফাঁকে আমার বন্ধু স্টেশন থেকে চারটে টিকেট সংগ্রহ করে ফেলল। ট্রেন আসতে তখনও মিনিট কয়েক বাকি ছিল।

একসময় শিয়ালদাগামী ইলেকট্রনিক ট্রেন দমদম স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। দমদম স্টেশনে নামার মতো যাত্রীরা ট্রেন থেকে নামলো আমরা চারজন শিয়ালদহ’র উদ্দেশে ট্রেনে ওঠে সিট নিয়ে বসলাম। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর যথাসময়ে ইলেকট্রনিক দ্রুতগামী ট্রেন শিয়ালদহ গিয়ে পৌঁছালো। আমরা ট্রেন থেকে নেমে চলে গেলাম রেলস্টেশনের বাইরে।

শিয়ালদহ রেলস্টেশনের বাইরে গিয়ে একটা অটো চেপে চলে গেলাম, বাঘা যতীন সংলগ্ন বন্ধুর ভাড়া বাসায়। বন্ধুর ওখানে ছিলাম, প্রায়ই একমাসের মতো। কিন্তু আমি যেই কাজের আশায় বাংলাদেশ থেকে ভারত গিয়েছিলাম, সেই কাজ আর হলো না। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, বন্ধুর এখান থেকে জলপাইগুড়ি বড়দি’র বাড়ি চলে যাবো। শেষাবধি তা-ই হলো।

বন্ধুর ভাড়া বাসায় মাসেক খানি অবস্থান করার পর চলে গেলাম, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া। জলপাইগুড়ি বীরপাড়া আমার বড় দিদির বাড়ি। একসময় এই বীরপাড়া পুরোটাই ছিলো চা-বাগান। এই চা-বাগানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ছোট্ট একটা বাজার। সেই বাজারের নাম হয়, “বীরপাড়া” বাজার। বীরপাড়া বাজার ঘেঁষেই তৈরি হয়েছিল, ভুটানের গুমটু যাবার রাস্তা।

ভুটান গুমটু যাবার রাস্তার এপাশ-ওপাশ দু’পাশে থাকা চা-বাগান ঘেঁষে জনবসতি গড়ে উঠেছিল তুলনামূলকভাবে। সেইসাথে যখন লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন চা-বাগানের কিছু অংশ হয়ে পড়ে বেদখল।
আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম, তখন দেখলাম চা-বাগান ঘেঁষা বড় দিদির বাড়ি। যেখানে বড় দিদির বাড়ি, সেই জায়গার নাম, রবীন্দ্র নগর কলোনী। এই রবীন্দ্র নগর কলোনী ছাড়াও আরও কয়েকটা মহল্লা আছে। সবগুলো মহল্লাই একসময় চা-বাগান ছিলো।

বর্তমানে চা-বাগানের বেদখল হয়ে পড়া জায়গা ব্যক্তিমালিকানাধীন। মানে যিনি ওই জায়গায় দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করছে, তিনিই ওই জায়গার মালিক। শোনা যায় প্রত্যেকেই চা- বাগান কোম্পানি হতে নামমাত্র মূল্যে দখলকৃত জায়গা দলিলের মাধ্যমে রেজিষ্ট্রেশন করে নেয়। সে হিসেবে বড় দিদির বাড়িটাও নিজেদেরই কেনা সম্পত্তি।

যাইহোক ৩০ বছর আগে যখন আমি বড় দিদির বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন আমার বড় দিদি আমাকে চিনতে পারছিলেন না। কারণ আমার বড় দিদির যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন আমি ছিলাম মাত্র দেড় বছরের এক কোলের শিশু। আমার বড়দি’র বিয়ে হয়েছিল ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে। আমার জামাই বাবু বড় দিদিকে নিয়ে সপরিবারে ভারতে চলে আসে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে। সেই আসা-ই-আসা, আর কখনো তারা বাংলাদেশে যায়নি। সেই দেড় বছরের আমি বড় দিদির বাড়ি গিয়েছিলাম, ত্রিশ বছর বয়সে। না চেনার কারণই ছিলো ওটাই। অবশ্য পরিচয় দেওয়ার পর খুব ভালো করেই চিনেছিল।

বড় দিদির ওখানে গিয়ে মাসেক খানেক ঘুরে-ফিরে সাথে নেওয়া টাকা-পয়সা শেষ করে উপায়ান্তর না দেখে ভাগিনাদের সাথে গ্যারেজে কাজ করা শুরু করি। গাড়ির গ্যারেজে কাজ করার সুবাদে ওখানকারই অনেক ড্রাইভারে সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছিলো।

যেখানে যাবার মন চাইত, ভাড়া ছাড়াই সেখানেই চলে যেতাম। গিয়েছিলাম ভুটান গুমটু, সামসি, শিলিগুড়ি, জল্পাইগুড়ি, সিকিম যাবার ভারত-সিকিম মেইন সংযোগস্থান সেবক’র মতো সুন্দর-সুন্দর জায়গায়।। কিন্তু যাবো যাবো বলেও কাজের চাপে যাওয়া হচ্ছিল না, ভুটান ফ্রুন্টসলিং।

ভুটানের ফ্রুন্টসলিং আমার বড় দিদির বাড়ি বীরপাড়া থেকে মাত্র বিশ টাকার ভাড়া। বীরপাড়া থেকে ফ্রুন্টসলিং যেতে সময় লাগতো, দু’ঘন্টার মতো। এতো সামনে থেকেও সেখানে যাওয়া হচ্ছিল না।

একদিন সকালে খাওয়া-দাওয়া করে আর গ্যারেজে যাইনি। এদিন সকালে জামা-কাপড় পড়ে কারোর কাছে কিছু না বলে বীরপাড়া বাসস্ট্যান্ডে চলে গেলাম। আমার সাথে টাকার অংক ছিলো মাত্র দুইশো টাকার মতো।
বীরপাড়া বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে একটু ঘুরা-ঘুরি করে দেখলাম পরিচিত কোন বাস আছে কি-নাই। ঘুরে-ফিরে খানিক পর দেখি আমারই পরিচিত একটা গাড়ি জয়গাঁও যাবার জন্য যাত্রী সংগ্রহ করছে। বাস কাউন্টার থেকে মাইকে বলা হচ্ছে, “জয়গাঁ জয়গাঁ”। আমি ভাবতে লাগলাম জয়গাঁ আবার কোথায়?

এই ভেবে বাসের সামনে যেতেই বাস ড্রাইভারের সাথে দেখা। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো, “মামা তুমি কোথায় যাবে?”
বললাম,“ফ্রুন্টসলিং ঘুরতে যাবো, মামা!”
ড্রাইভার বললো, “আমি-ও-তো গাড়ি নিয়ে জয়গাঁ যাচ্ছি, মামা। তো যাবে যখন গাড়িতে উঠে আমার সিটের পেছনের সিটে বসে থাকো। কিছুক্ষণ পরই গাড়ি নিয়ে জয়গাঁ’র উদ্দেশে রওনা দিবো।”
বললাম, “আমিতো ফ্রুন্টসলিং যাবো মামা।”
ড্রাইভার বললো, “আরে মামা জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং একই জায়গায়। জয়গাঁ হলো ভারত-ভুটান বর্ডার। জয়গাঁ ভারতের আর ফ্রুন্টসলিং হলো ভুটানের একটা শহর। যাও যাও গাড়িতে উঠে আমার পেছনের সিটে বসো।”

ড্রাইভারের কথা শুনে আমি তা-ই করলাম। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসলাম। একটু পরই গাড়ি ফুন্টসলিঙের উদ্দেশে ছুটে চললো।
বিরতিহীন গাড়ি। কোথাও থামা-থামি নেই। গন্তব্য ছাড়া যাত্রীও ওঠা-নামা করতে পারে না। গাড়ি চলছে-তো-চলছেই। প্রায়ই দু’ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম, ভারত-ভুটান সীমান্ত ঘেঁষা জয়গাঁও ফ্রুন্টসলিং বর্ডার।

বাস থেকে নেমে ভুটান ফ্রুন্টসলিং প্রবেশের সুবিশাল গেইটের সামনে একটা চা’র দোকানে গেলাম। আমার সাথে বাসের ড্রাইভার হেলপারও ছিলো। সবাই মিলে আমরা ছিলাম চারজন। চারজনেই চা-বিস্কুট খেলাম। দাম দিলাম আমি। কারণ বাসে তো ফ্রি এসেছি, তাই।

চা-বিস্কুট খাওয়ার পর ড্রাইভার তার হেলপারকে বললো, ‘“গাড়িতে বীরপাড়ার যাত্রী ওঠাও!”
আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “মামা তুমি কখন যাবে?” বললাম, “একটু ঘুরা-ঘুরি করে জায়গাটা দেখে বিকেলে রওনা দিবো, মামা।”

আমার কথা শুনে বাসের ড্রাইভার আমাকে সেখানকার আইন-কানুন সম্বন্ধে বুঝিয়ে বললো, “যা-ই করো, আর ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে যেখানেই যাও, সন্ধ্যার আগে আগে ভুটানের গেইট পাড় হয়ে ভারতের ভেতরে চলে আসবে। কারণ সন্ধ্যার সাথে সাথে ভুটানের বর্ডার গার্ড ফোর্স এই সুবিশাল গেইটটা বন্ধ করে দেয়। গেইট বন্ধ হয়ে গেলে তুমি যদি ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে থেকে যাও, তাহলে তোমাকে আটক করে জেলে ভেরে রাখবে। তাদের আইনে যে-ক’দিন সাজা হয়, তা-ই ভোগ করে বের হতে হবে। কাজেই সন্ধ্যার কথাটা তুমি মাথায় রেখে ঘুরা-ঘুরি করবে।”

আমি বাস ড্রাইভারের নির্দেশাবলী মাথায় রেখে বললাম, “ঠিক আছে মামা, তা-ই হবে। আমার জন্য চিন্তা করবেন না।”
বাস ড্রাইভার কয়েকজন যাত্রী সংগ্রহ করে বীরপাড়ার উদ্দেশে রওনা হলে, আমি আস্তেধীরে ভুটান ফ্রুন্টসলিঙের সুবিশাল গেইট পাড় হয়ে সোজা ফুন্টসলিঙের ভেতরে চলে গেলাম। গেইটে চার-পাচজন সিপাহী ছিলো। কিন্তু আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি যে, আমি কোথাকার এবং কোথা-ই-বা যাচ্ছি।

দেখলাম তারা এপার-ওপার হওয়া কাউকে কিছুই জিজ্ঞেস করছে না। গেইট দিয়ে অনবরত ভারত ভুটানের লোক আসা-যাওয়া করছে, নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে যার-যার নিজের মতো করে। এতে কারোর জন্য কোনও জেরার সম্মুখীন হতে হয় না। জিজ্ঞাসা আর চেক থাকে তখন, যখন ভারত থেকে গাড়িগুলো ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে ঢুকে।

মাঝে-মাঝে ভারত থেকে বিভিন্ন মালা-মাল বোঝাই বড়-বড়ে (লড়ি) ট্রাক ফ্রুন্টসলিং দিয়ে ভুটানে প্রবেশ করে। এই গাড়িগুলোর দিকেই থাকে সুবিশাল গেইটে সিপাহিদের তীক্ষ্ণ নজর!

এছাড়া সিপাহিরা মানুষজন আসা-যাওয়ায় কাউকে কিছুই বলে না। আমাকেও কিছু বলেনি। আমি হাঁটতে-হাঁটতে ফ্রুন্টসলিঙের বেশখানিক ভেতর চলে গেলাম, নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে!

ফ্রুন্টসিলিং, ভুটানের একটা বানিজ্যিক শহর। এই ফ্রুন্টসিলিং শহরটা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। ভারতের অংশ জয়গাঁও। এই জয়গাঁও আর ফ্রুন্টসলিং সমান উঁচু দেখা গেলেও, ফ্রুন্টসলিং জয়গাঁও’র চেয়ে অনেক উঁচু!
ফ্রুন্টসলিং আর জয়গাঁ একসাথেই মিলে-মিশে পাশা-পাশি। জনবসতি আর ছোট-বড় বিল্ডিং, শপিংমল থাকার কারণে জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং পাহাড় মনে হয় না। কিন্তু সমতল ভূমি থেকে জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং অনেক উঁচুতে। সমতল ভূমি থেকে জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং কতখানি উঁচুতে, তা বোঝা যায় ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে গেলেই।

ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে একটা বড় বৌদ্ধবিহার আছে। বৌদ্ধবিহারের সামনেই বড় ড্রামের মতো আছে। এই ড্রামটাকে বলা হয়, প্রার্থনা ড্রাম বা প্রার্থনা চাকা বা ঢোল। সেই ড্রামে বৌদ্ধদের ধর্মীয় শাস্ত্র-গ্রন্থের মন্ত্র ❝ওম মানি পদমে হুম❞ লেখা থাকে।

এই প্রার্থনা ড্রামের সামনে গিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মাথা নিচু করে দু’হাত জোড় করে ভক্তি করে। তারপর প্রার্থনা ড্রাম কয়েকবার ঘুরায়, আর মুখে মন্ত্রপাঠ করে।

বৌদ্ধ ধর্মে প্রার্থনা ড্রাম ঘুরানোর মানে হলো, ❝মানুষের হৃদয়কে করুণা ও ভালবাসায় পূর্ণ করতে সহায়তা করা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বিশ্বাস করে যে, নিজের হৃদয়ে আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে ঢোল ঘোরানো মানে প্রভুর হৃদয়ের সাথে নিজের হৃদয় স্থাপন করা। তাদের ধারণা এই প্রার্থনা ড্রাম বা চাকা বা ঢোল ঘুরানোর ফলে প্রভুর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এই ধরাধামে বেঁচে থাকা যায়।❞

এই বৌদ্ধবিহারের সামনে দিয়েই ভারত থেকে ভুটানের রাজধানী থিম্পু পর্যন্ত হাইওয়ে। ভারত-ফ্রুন্টসলিং টু থিম্পু হাইওয়ে ঘেঁষে একটা খালের মতো আছে। এটা আসলে খাল বা নর্দমা নয়! এটা ভুটানের কোনোএক পাহাড়ের ঝর্ণা। খালের মতো দেখতে সেই ঝর্ণা দিয়ে দিনরাত যেভাবে পানি নামে আসে, তা দেখেও মনে ভয় হয়!

ভয় হয় এই কারণে যে, ওই পানিতে নেমে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। পানিতে নামার সাথে-সাথে তীব্র স্রোতে মুহূর্তেই টেনে নিয়ে যাবে, অন্য কোথাও। এই পাহাড়ি ঝর্ণা ভুটানের কোন পাহাড় থেকে উৎপন্ন, তা-ও আমার অজানা থেকে যায়। শোনা যায় এই ঝর্ণার প্রবাহিত খালের পানি থেকে ভারত-ভুটান যৌথভাবে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, এই ফ্রুন্টসলিঙে।

ঝর্ণার পানি প্রবাহিত হওয়া খালটা ফ্রুন্টসলিং টাউন থেকে অনেক নিচে। এই ঝর্ণা খালের ওপারে যেতে ছোট একটা ব্রিজ আছে। খাল পাড় হয়ে যাওয়ার পর চোখে পড়লো, একটা কুমিরের খামার। কুমিরের খামারটাও অনেক বড়। দিনের বেলা খামারের চারপাশ দর্শনার্থীদের ভীড় থাকে।

দেখলাম, সেই খামারে কুমিরগুলো কিন্তু পানিতে থাকে না। থাকে শুকনো জায়গায়। পানির সামান্য ব্যবস্থা শুধু ছোটো একটা পুকুরের মতো। সেই কুমিরের খামারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কুমিরগুলো দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে এই ফ্রুন্টসলিঙে ছুটে আসে। লোকের ভীড় থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।

আর অনেক দর্শনার্থীদের সাথে আমিও ঘুরে-ফিরে খামারের সামনে অনেকক্ষণ সময় কাটালাম। তারপর ঝর্ণার খালটা পাড় হয়ে ফ্রুন্টসলিং টাউনের উপরে উঠে গেলাম। মনের আনন্দে ঘুরতে থাকলাম, ফ্রুন্টসলিং টাউনের এপাশ থেকে ওপাশ।

ফ্রুন্টসলিং টাউন খুবই সুন্দর! আমি যতক্ষণ সময় ফ্রুন্টসলিং টাউনে ছিলাম, ততক্ষণ আমার মনে হয়েছিল আমি গণচীন অথবা হংকঙের কোনোএক শহরে ছিলাম। উঁচুনিচু রাস্তা। রাস্তার পাশেই ছোট-বড় শপিংমল, বার, নামি-দামি হোটেল, আর বাহারি ফুল ও ফলের দোকান। ফ্রুন্টসলিং টাউনের এক কোণে প্রতিদিন বিকেলবেলা স্থানীয় বাসিন্দাদের সুবিধার্থে সন্ধ্যাকালীন বাজারও মেলে।

সেই বাজার রাত আটটা অবধি চলে। রাত আটটার পরপরই টাউনের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। আর ভারত-ভুটান বর্ডার গেইট বন্ধ হয় সন্ধ্যার একটু পরই।

ফ্রুন্টসলিং টাউনের বাইরেও জয়গাঁও সপ্তাহে দু’দিন স্থানীয়দের হাট মেলে। সেই হাটের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ভারতীয়। সপ্তাহিক এই হাটে ভুটানি ব্যবসায়ীও আছে। তাদের ব্যবসা নিজের জায়গায় ফলানো তরিতরকারি, নিজেদের গাছের সুপারি, পাহাড়ের ঝোপঝাড় থেকে নানারকম শাকসবজি আর তরতাজা ফলের।

হাটবারে ভুটানিরা জয়গাঁও আসে অনেক দূরদূরান্ত থেকে। ফ্রুন্টসলিঙে গাড়ি চলাচলের জন্য একটামাত্র রাস্তা যা, ভারত-ভুটান হাইওয়ে নামে পরিচিত। এছাড়া ফ্রুন্টসলিং টাউনের আশ-পাশ দিয়ে ভুটানি স্থানীয়দের চলাচলের জন্য আর কোনও রাস্তা চোখে পড়েনি। তারা হাটবারে যার-যার বাড়ি-ঘর থেকে পায়ে হেঁটেই আসে।

ফ্রুন্টসলিঙে আর জয়গাঁও ঘুরে-ফিরে বুঝেছি, তাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে ফল জন্মায়। ফলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফলন হয় কমলা। এর সাথে আপেল, আঙুর-সহ আরও নানারকম ফলও দেখা যায়। বেশিরভাগ বিক্রেতা ভুটানি মহিলা।

তারা ভারতের ভেতরে জয়গাঁও এসে ফল বিক্রি করে। আবার সন্ধ্যার আগে তাদের গন্তব্যে ফিরে যায়। কেউ কেউ ভারতের জয়গাঁও হাটে এসে বাজার-সদাইও করে নেয়।

এছাড়াও ভুটানের জনগণ সবসময়ের জন্যই ভারতে আসা-যাওয়া করতে পারে। আবার ভারতের জনগণও একইভাবে আসা-যাওয়া করে থাকে। ভুটানিরা শুধু আসা-যাওয়াই নয়, ভুটানিরা ভারতে এসে কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রতিদিন।

অনেক ভুটান নাগরিককে ভারত এসে স্থায়ীভাবে বসবাসও করতে দেখেছি। ভারতের ভেতরে তাদের বসবাস সবচেয়ে বেশি ভারত-ভুটান সীমান্ত ঘেঁষা এলাকাগুলোতে। তবে তুলনামূলকভাবে বেশি বসবাস গুমট আর ফ্রুন্টসলিং ঘেঁষা জয়গাঁও এলাকায়।

ভুটানি জনগণ খুবই মিশুক। তারা খুব সহজেই একজন মানুষকে আপন করে নিতে পারে। তাদের আচার-ব্যবহারও মনে রাখার মতো। তা বোঝা গেলো দুপুরবেলা ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে থাকা একটা খাবারের হোটেলে ঢুকে।
হোটেলটা বেশি একটা বড়সড় নয়। কিন্তু এই হোটেলে দিনের সারাটা সময় থাকে কাস্টমারের ভীড়। হোটেলের ক্যাশে বসা একজন যুবতী মহিলা। হোটেল বয় বলতে যাদের দেখলাম, তারা সবাই মহিলা। হোটেলের মালামাল সংগ্রহ করে আনার জন্য হয়তো পুরুষ কর্মচারী থাকতে পারে। কিন্তু হোটেলের ভেতরে কোনও পুরুষ দেখা যায়নি।

হোটেলের ভেতরে গিয়ে বসার জন্য আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, কিন্তু বসার সুযোগ হচ্ছিল না। একজন মহিলা কর্মচারী আমাকে ফলো করে সামনে এসে তাদের ভাষায় কি যেন জিজ্ঞেস করছিল। তার কথার উত্তর যখন আমি দিতে পারছিলাম না, তখন হোটেলের মহিলা বুঝতে পারলো আমি তার ভাষা বুঝিনি। তারা শুধু তাদের ভাষাই নয়, তারা ভারতের সবকটা প্রদেশের ভাষা জানে এবং যখন যেই ভাষার দরকার-সেই ভাষায় কথা বলে।

তাই আমি যখন তার কথার উওর দিতে পারছিলাম না, তখন ওই মহিলা আমাকে বাংলায় জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি ভাত খাবেন?”
আমি বললাম, “ইচ্ছে ছিলো ভাত খাওয়ার। কিন্তু কী করে খাবো? লোকের ভীড়ের জন্য তো ভেতরে যেতে পারছি না।”
আমার কথা শুনে ওই মহিলা বললো, “একটু অপেক্ষা করুন, আমি ব্যবস্থা করছি।”

দশ মিনিট পরই হোটেলের ভেতর থেকে ওই মহিলা আমাকে হাতে ইশারা দিয়ে ভেতরে ডেকে নিয়ে একটা সিটে বসিয়ে দিয়ে বললো, “কী খাবেন? মাছ না সবজি?” বললাম, “মাছ ভাত খাবো!”

দুই মিনিটের মধ্যেই একটা স্টিলের থালায় করে খাবার নিয়ে এসে আমার সামনে দিয়ে চলে গেলো। আমি খাবার দেখে অল্পক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম! থালার মাঝখানে অপ্ল দুমুঠো চিকন চালের ভাত। ভাতের চারদিকে সাজানো আছে সবজি কাটা আর তরকারির ছোট-ছোট বাটি।

এ-সবের মাঝে ডাল ছিলো তিন রকমের তিনটে বাটি, ভাজি এক বাটি। আর রুই মাছের তরকারি এক বাটি।

এসব দেখে আমি খাওয়ার ভা-ও পাচ্ছিলাম না। পাশে বসা কাস্টমারদের খাওয়া দেখে তাদের মতো করে খেলাম। তাদের রান্না করা তরকারিগুলো খেতে খুবই ভালো লেগেছিল।

খাওয়া-দাওয়া সেরে ক্যাশের সামনে যেতেই ওই মহিলা ক্যাশের সামনে গিয়ে তাদের ভাষায় খাবারের মূল্যের পরিমাণ বলে দিয়ে চলে গেলো। আমি আমার পকেট থেকে ভুটানি একশো টাকার একটা নোট বের করে ক্যাশে দিলাম। ক্যাশে বসা মহিলা আমাকে আশি টাকা ফেরত দিলো। আমি টাকা হাতে নিয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে সোজা ফ্রুন্টসলিং ত্যাগ করে জয়গাঁও চলে এলাম।

জয়গাঁ এসে দেখি চারটে বাজতে লাগলো। পকেটে টাকা ছিলো প্রায়ই একশো ষাট টাকার মতো। বীরপাড়া যেতে বাস ভাড়া বিশ টাকা খরচ হলেও আরও বেশ ক’টা টাকা আমার কাছে থাকে।

এই ভেবে এক ভুটানি ফল বিক্রেতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এক ঝুরি কমলার দাম কত?”
মহিলা ফল বিক্রেতা বললো, “একশো টাকা।”
আমি আশি টাকা দিতে চাইলে ফল বিক্রেতা মহিলা আমাকে আশি টাকায় এক ঝুরি ফল দিয়ে দিলো। এক ঝুরি ফল মানে ষোল হালি কমলা।

ফলের ঝুরি নিয়ে বাস কাউন্টারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্ট্যান্ডে একটামাত্র বাস দাঁড়িয়ে আছে। বাস ড্রাইভার আমার পরিচিত ছিলো না। এই বাস-ই বীরপাড়ার শেষ বাস। যাত্রী সীমিত! বাসে উঠে সিটে বসলাম। আরও কিছু যাত্রী উঠলো। এর কিছুক্ষণ পরই বাস বীরপাড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলো। সন্ধ্যার পরপরই পৌঁছে বীরপাড়া। সেখান থেকে কমালার ঝুরি হাতে নিয়ে চলে গেলাম দিদির বাড়ি।

বড় দিদি ফলের ঝুরি দেখে মাথায় হাত রেখে বললো, “এতো, কমলা খাবে কে-রে? কোত্থেকে এনেছিস, শুনি?” বললাম, “ফ্রুন্টসলিং গিয়েছিলাম, দিদি। হাতে কিছু টাকা ছিলো। তাই ঝুরি-সহ কমলাগুলো নিয়ে এলাম। এগুলো আশ-পাশের বাড়ির ছেলে-মেয়েদের হাতে কিছু দিয়ে নিজেরা খাবেন।”

আমার কথামতো বড়দি তা-ই করলো। নিজেদের জন্য কিছু কমলা রেখে, আমার বেয়াই বাড়ি-সহ আশেপাশে থাকা আরও বাড়িতে বাদবাকি কমলা বিতরণ করলো। এভাবেই শেষ হলো ফ্রুন্টসলিং থেকে আনা এক ঝুড়ি কমলা, আর শেষ হলো আমার শূন্য হাতে ভুটান ফ্রুন্টসলিং ভ্রমণের গল্প।

বিশ্ব বাবা দিবস ও নিজের কিছু কথা

nita

ঘোষিত বাবা দিবস উপলক্ষে দেখা যায় বাবা’র প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা। শোনা যায় পৃথিবীর ছাদের সম জন্মদাতা পিতার গুনগান।

দেখা যায় প্রিয় বাবার সাথে কত রকমের কতো ছবি। সেসব ছবি দেখে বোঝা যায়, স্বর্গীয় বা জান্নাতি, জীবিত বা মৃত বাবার প্রতি সন্তানের উজাড় করে দেয়া ভক্তিপূর্ণ শ্রদ্ধা ভালোবাসা! তো যাই হোক, আমার জন্মদাতা পিতা বা বাবা মৃত্যুবরণের সময়ে বা এরও আগে-পরে হাতে হাতে মোবাইল অথবা ক্যামেরা ছিল না। ছিল, জরুরি কোনও কাজে ব্যবহারের জন্য নিজের দু’একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি তোলার সনাতনী পদ্ধতির স্টুডিও।

সেসব স্টুডিওতে গিয়ে যাদের ছবি দরকার হতো, কেবল তারাই তাদের কাজের জন্য কয়েকটা সাদা-কালো ছবি তুলেছিলেন। এছাড়া তখনকার সময়ে অনেকেরই নিজের ছবি তোলা হতো না। তাই তাদের মৃত্যুর পর তাদের নিজ ঘরেও ছবি টাঙানো হতো না। একারণে আমার মা-বাবার ছবিও আমার বা আমাদের পরিবারের কারোর কাছে তাদের ছবি সংগ্রহে নেই। তাই এই বিশ্ব বাবা দিবসে আমার স্বর্গীয় বাবার ছবি পোস্ট করে বাবার স্মরণে ভক্তিপূর্ণ শ্রদ্ধা নিবেদন জানাতে পারলাম না।

এই বিশ্ব বাবা দিবসে বাবার স্মরণে ভক্তিপূর্ণ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, জন্মদাতা পিতার সমাধি স্থানের ছবি দিয়ে। মানে আমার বাবাকে যেই শ্মশানে দাহ করা হয়েছিল, সেই শ্মশান ঘাটের ছবি দিয়ে বিশ্ব বাবা দিবসে বাবার প্রতি ভক্তিপূর্ণ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও বাবার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

সেই সাথে এই পৃথিবীর মৃত আর জীবিত, স্বর্গীয় বা জান্নাতি সকল বাবার প্রতি জানাচ্ছি, ভক্তিপূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। পৃথিবীর সকল স্বর্গীয় বা জান্নাতি বাবা পরপারে শান্তিতে থাকুক। জীবিত সকল বাবা সুখে-শান্তিতে থাকুক, এই কামনা করি।

আশা ভালোবাসার জীবন

ni জন্মের পর গর্ভধারিণী মায়ের ভালোবাসা থেকেই একজন মানুষের মনের মণিকোঠায় ছোট পরিসরে ভালোবাসার জন্ম হয়। একসময় ছোট্ট ভালোবাসা অনেক বড় হয়ে ভালোসার গভীরে চলে চলে যায়।

ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ে নিজ সংসারে। ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ে সমাজের মানুষের মাঝে। ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ে দেশ ও দশের মাঝে। সেই ভালোবাসা থেকেই ভালোবাসতে থাকে স্রষ্টার সৃষ্টিকে।

আবার সেই ভালোবাসা থেকেই শতসহস্র ছোটবড় আশা জন্ম হতে থাকে। সেই আশাই একজন মানুষকে একসময় সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দেয়।

কেউ প্রেমে সফলতার আশা করে। কেউ লেখাপড়া করে বিদ্যান হবার আশা করে। কেউ মহাসাগর পাড়ি দিতে আশা করে। কেউ দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার আশা করে। কেউ চাঁদের দেশে যাবার আশা করে।

কেউ ভিনগ্রহে জীবের সন্ধ্যানে মহাকাশের এই গ্রহ থেকে ওই গ্রহে ঘুরে সফলতার আশা করে। কেউ মহাসাগরের তলদেশ থেকে মণিমুক্তা কুড়ানোর আশা করে। কেউ মানুষকে নিঃস্ব করে নিজেই বিশ্বের বড় ধনীব্যক্তি হওয়ার আশা করে।

সেসব আশা কারোর সফল হয়। আবার কেউ আশা থেকে নিরাশ হয়ে নিজেই ধংস হয়ে যায়।

কিন্তু পৃথিবীতে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর মনের মণিকোঠায় জমে থাকা আশা ভালোবাসা চিরতরে ধংস হয় না। একজন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও বেঁচে থাকার আশা করে।

মোটকথা এই পৃথিবীর খারাপ ভালো সব মানুষই আশা আর ভালোবাসা মনে ধারণ করেই বেঁচে থাকে জন্ম থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। আমিও বেঁচে আছি আশা ভালোবাসা নিয়ে। বেঁচে থাকুক পৃথিবী, বেঁচে থাকুক স্রস্টার সকল প্রেরিত জীব।

.
নিতাই বাবু
১৪/০৬/২০২৩ইং।

মা-বাবার আশীর্বাদে মেয়ের বিয়ে ও কিছু অলৌকিক ঘটনা

out.

আমার বিবাহের তারিখ, ১৪ জুন ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ, পহেলা আষাঢ়, ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ। বিয়ে করেছিলাম, মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখাঁন থানাধীন সুবচনী সংলগ্ন নয়াবাড়ি গ্রামের এক দরিদ্র হিন্দু পরিবারের মেয়ে।

১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে আমার একমাত্র মেয়ে অনিতা’র জন্ম হয়। মেয়ে অনিতা ভূমিষ্ঠ হয়, নারায়ণগঞ্জ সিটির ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে। তখন আমার গর্ভধারিণী মা জীবিত ছিলো। বাবা ছিলেন পরপারে।

আমি তখন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ১০নং ওয়ার্ড গোদনাইলস্থ কো-অপারেটিভ মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলে নামমাত্র বেতনে চাকরি করি। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর পেয়ে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে গেলাম।

গিয়ে দেখি আমার স্ত্রী হাসপাতালের সিটে সন্তান পাশে রেখে শুয়ে আছে। মা স্ত্রীর সিটের পাশে বসা। আমি সামনে যাওয়ার সাথে সাথে মা হেসে বললো, “এতক্ষণে এলি? আয় দেখ তোর সুন্দর একটা মেয়ে হয়েছে।”

মেয়ের কথা শুনেই আমি কেঁদে ফেললাম! আমার দু’চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছিল। মা আমার কাঁদা দেখে এক ধমক দিয়ে বললো, “এ-ই, কাঁদিস কেন? মেয়ে হয়েছে বলে কাঁদছিস? কাঁদবি না, বলছি! যিনি মেয়ে দিয়েছে, তিনিই উদ্ধার করবে। নেয়, মেয়েকে কোলে নিয়ে আশীর্বাদ কর।”

মায়ের কথা শুনে তখনও আমার কান্না থামছিল না। আমি কেঁদে কেঁদে মেয়েকে কোলে নিয়ে বললাম, “মা, আমি মনে হয় মেয়ে বিয়ে দিতে পারবো না। যেই চাকরি করি, তাতে তো সংসারের খরচই হয় না। মেয়ে বড় হলে বিয়ে দিবো কীভাবে? বিয়ে দিতে হলে তো সোনা-দানা, টাকা-পয়সার দরকার হয়, তা কি আমি জোগাড় করতে পারবো, মা?”
এই বলেই আরও জোরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম!

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে বললো, “পারবি বাবা। তুই এ-নিয়ে চিন্তা করিছ না। দেখবি একভাবে-না-একভাবে তোর মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে।”

মায়ের কথায় শান্তনা পেলাম। মায়ের কথা মেনে নিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। বিধাতার উপর ভরসা রেখে মা আর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাসায় এলাম। মনোযোগ-সহকারে কাজ করতে লাগলাম। বেতন যা পেতাম, তা দিয়েই মা-সহ বোন মরা এক ভাগ্নি আর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চলতে থাকলাম। এরইমধ্যে আমার গর্ভধারিণী মা স্বর্গে চলে গেলেন।

এরপর ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে আমার একমাত্র ছেলে তপন’র জন্ম। ওরা ভাই-বোন দুই বছরের ছোট-বড়।ওরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে একসময় ওরা বড় হতে লাগলো। মেয়ে স্কুলে ভর্তি হওয়ার দুইবছর পর চেলেকেও স্কুলে ভর্তি করানো হলো।

অনিতা যখন নবম শ্রেণি পাস করে দশম শ্রেণিতে ভর্তি হলো, তখনই মেয়ের বিয়ের ঘর আসলো। বরের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার বৌলতলি বাজার সংলগ্ন করপাড়া গ্রামে। এতো দূর থেকে যে, মেয়ের ঘর আসবে তা আমাদের স্বামী-স্ত্রীর দুজনের কল্পনার বাইরে ছিলো।

আমি তখন সিরাজগঞ্জ বেলকুচি এক টেক্সটাইল মিলে চাকরি করি। তখন আমার স্ত্রী নিকটস্থ এক ফোন-ফ্যাক্স’র দোকান থেকে প্রতি মিনিট ৮টাকা রেটে সিরাজগঞ্জ বেলকুচি আমার মালিকের নাম্বারে কল করে। যখন আমার স্ত্রী আমার মালিকের ফোন নাম্বারে ফোন করে, তখন আমি মিলের বাইরে ছিলাম।

আমি মিলের বাইরে থাকার কারণে আমার স্ত্রী মালিকের কাছে সমস্ত বিষয় জানায়। আমি মিলে আসলে আমার মালিক আমাকে স্ত্রীর ফোনে বলা সমস্ত কথাগুলো আমাকে জানিয়ে দেয়। আমি মেয়ের মেয়ের ঘর আসার কথা শুনে রীতিমতো অবাক আর হতাশায় পড়ে গেলাম! ভাবতে লাগলাম, কী করি!

তারপর আমাকে যেই লোক বেলকুচি নিয়ে চাকরি দেয়, সেই লোকের কাছে মেয়ের ঘর আসার কথা জানালাম। ওই লোক ছিলো আমার শাগরেদ। তার নাম ছিলো, টিপু সুলতান। বাড়ি ছিলো কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। ওই লোক আমাকে সবসময় ওস্তাদ ওস্তাদ বলে ডাকতো। টিপু আমার কথা শুনে আমাকে বললো, “ওস্তাদ এ-তো খুশির খবর! মিষ্টি খাওয়াতে হবে।”

বললাম, “মিষ্টি তো খাওয়াবই, এখন আমি নারায়ণগঞ্জ যাবো কী করে, টিপু? আমার হাতে টাকা নেই। কিন্তু যেতে হবেই।”
শাগরেদ টিপু বললো, “আমি আপনাকে ১০০০টাকা দিয়ে দিচ্ছি, আপনি আগামীকালই নারায়ণগঞ্জ চলে যান। সেখানে গিয়ে মেয়ের বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেলেন। প্রয়োজনে আমাকে কল করবেন, আমি আপনার মেয়ের বিয়েতে কিছু করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।”

টিপু’র কথা মেনে নিয়ে পরদিন সিরাজগঞ্জ বেলকুচি থেকে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হলাম। আমার সাথে টাকা ছিলো শাগরেদ টিপু’র দেয়া মাত্র ১০০০টাকা। তা নিয়েই নারায়ণগঞ্জের মাটিতে পা রাখলাম। বাসায় গেলাম। মেয়েকে দেখে যাওয়ার বিস্তারিত ঘটনা জানলাম। স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করলাম, কী আছে আর কী লাগবে, ছেলে পক্ষের দাবিদাওয়া কী কী?

স্ত্রী বললো, “ছেলে পক্ষের কোনও দাবিদাওয়া নেই। যা পারি আর যেভাবেই পারি বিয়ের অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে শেষ করে মেয়ে উঠিয়ে দিতে পারলেই হলো। তারপরও অনিতা আমাদের একমাত্র মেয়ে। আবার হিন্দু বিয়ে বলে একটা কথা আছে। সামান্য সোনা-দানা না দিয়ে কি মেয়ে বিদায় করা যাবে। সোনা-দানার মধ্যে আমার কষ্টের টাকায় মেয়ের জন্য একজোড়া কানের দুল আছে মাত্র। এটা ছাড়াও মেয়ের নাকের লাগবে, হাতের চুড়ি লাগবে, পলা লাগবে, গলার লাগবে, হাতের শাঁখা সোনা দিয়ে বাঁধাই করে দিতে হবে। তারপর আছে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার খরচাদি।”

স্ত্রীর কথা মনোযোগ সহকারে শুনলাম! ভাবলাম, কী করা যায়! ভেবেচিন্তে পরদিন খুব ভোরবেলা আমার জন্মদাতা বাবাকে যেই শ্মশানে দাহ করেছি, সেই শ্মশানের উদ্দেশে ঘর থেকে রওনা হলাম। শ্মশান ঘাটটি হলো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন বন্দর থানাধীন ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলস্ ঘেঁষা শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়। যাওয়ার পথেই দোকান থেকে দুটো মোমবাতি আর এক প্যাকেট আগরবাতি কিনে নিলাম।

২নং ঢাকেশ্বরী গুদারাঘাট থেকে খেয়া নৌকায় নদী পার হয়ে চলে গেলাম, ১নং ঢাকেশ্বরী শ্মশানঘাট। শ্মশানে গিয়ে যেই চুলায় বাবাকে দাহ করা হয়েছিল, সেই চুলার সামনে দুটো মোমবাতি আর আগরবাতিগুলো জ্বালালাম। মোমবাতি আগরবাতি জ্বালিয়ে হাতজোড় করে শ্মশানের চুলার সামনে বসলাম। চুলার সামনে বসে হাতজোড় করে নিজের মেয়ের বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন করার জন্য জন্মদাতা পিতার আশীর্বাদ চেয়ে কান্নাকাটি করলাম। তারপর শ্মশানের চুলার সামনে থাকা কিছু ধুলোবালি হাতে নিয়ে গায়-মাথায় মেখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে নিজের বাসায় ফিরে এলাম।

তারপরদিন গেলাম গর্ভধারিণী মাকে যেই শ্মশানে দাহ করেছি, সেই শ্মশান ঘাটে। শ্মশানঘাট হলো, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কেন্দ্রীয় শ্মশানঘাট, মাসদাইর নামক স্থানে। সেই শ্মশানে গিয়ে বাবার শ্মশানে যেভাবে যা করেছি, মায়ের শ্মশানেও হাতজোড় করে মায়ের আশীর্বাদ চেয়েছি। যাতে আমার মেয়ের বিয়ের কার্যসম্পাদন সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারি।

এরপর থেকে নিজের পরিচিত ব্যক্তিবর্গের কাছে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করে যথেষ্ট সহযোগিতার আশ্বাস পেলাম। নিজের বড় বোনের স্বামী জামাইবাবু মেয়ের বিয়ের কথা শুনে হাতের পলা দিবে বলে জানিয়েছে। বড় বোন তার বড় মেয়ের বাড়ি গিয়ে তাদের নেমন্তন্ন করে আসতে বললে, বড়দাকে সাথে নিয়ে গেলাম বড় ভাগ্নীর বাড়িতে। নেমন্তন্ন করলাম ওদের সবাইকে।

বড় ভাগ্নী নেমন্তন্ন পেয়ে আমার মেয়ের গলার হার বানিয়ে দিবে বলে জানিয়ে দিলো। এভাবে কেউ টাকা, কেউ কাপড়, কেউ থালাবাসন, কেউ লেপ- তোষক দিয়ে সাহায্য করার আশ্বাস দিলে, একসময় মেয়ের বিয়ের দিনতারিখ পাকাপাকি করে ফেলি।

বিয়ের দিনতারিখ পাকাপাকি হলেও বিয়ের আনুষাঙ্গিক নিয়মনীতি পালনীয়-সহ বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রী আর নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের খাওয়া-দাওয়ার খরচাদি বাদ থেকে যায়। এসব আনুষাঙ্গিক নিয়মনীতির খরচাদি সামাল দেয়ার জন্য এক এনজিও সমিতি থেকে ৪০০০০ (চল্লিশ হাজার) টাকা উত্তোলন করি।

সেই টাকা থেকে মেয়ের বিয়ের কাপড়-চোপড়-সহ বিয়ের টুকিটাকি যা লাগে তা কেনাকাটা করে রেডি রাখি। বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রী-সহ নিজেদের আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে প্রায় ২০০ লোকের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও করে ফেলি। সিরাজগঞ্জ বেলকুচিতে থাকা আমার শাগরেদ টিপু সুলতানকেও ফোনে নেমন্তন্ন করে বিয়ের দিন যেভাবেই হোক আসতে বলি।

বিয়ের পাঁচদিন কাকি থাকতেই বৃষ্টি আর বৃষ্টি! বৃষ্টি আর থামছিল না। সেই বৃষ্টিতে যেই মহল্লায় থাকতাম সেই মহল্লা বন্যার মতো প্লাবিত হয়ে গেলো। বিয়ের বাকি দুইদিন। আমি আমার মা-বাবা’র স্মরণে কান্নাকাটি করে বিয়েতে বিঘ্ন না ঘটানোর জন্য প্রার্থনা করতে থাকি। একসময় বৃষ্টি থামলো। মহল্লায় জমে থাকা বৃষ্টি জল শুকিয়ে গেলো। ঝামেলা বাঁধে বিদ্যুৎ।

তখন সারাদেশে প্রচুর লোডশেডিং চলছিল। এমন লোডশেডিং চলছিল যে, একবার বিদ্যুৎ চলে গেলে আবার কখন আসবে তার কোনও নিশ্চয়তা ছিলো না। আবার বিদ্যুৎ আসলে কতক্ষণ থাকবে, তারও কোনও গ্যারান্টি ছিলো না।

এমন অবস্থাতেই আমার মেয়ের বিয়ে। তা দেখে আমি শুধু আমার গর্ভধারিণী মা আর জন্মদাতা পিতাকে স্মরণ করতে থাকলাম। মনে মনে প্রার্থনা করে বলতাম, “মা, এভাবে বিদ্যুৎ চলে গেলে মেয়ের বিয়ের সময় বিঘ্ন ঘটবে। তুমি মা আমার সহায় হও। বাবাকে স্মরণ করেও একই প্রার্থনা করতাম।”

এর ফলস্বরূপ তাঁদের আশীর্বাদে মেয়ের বিয়ের অধিবাসের দিন বিদ্যুৎ যাওয়া বন্ধ হলো। মানে বিয়ের আগেরদিন থেকে। এই যে বিদ্যুৎ যাওয়া বন্ধ হলো, মেয়ের বিয়ের পরদিন মেয়েকে বিদায় দেয়ার পর বিদ্যুৎ গেলো! তা দেখে মহল্লার সবাই বলতে লাগলো, “অনিতার বাবা মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে জেনারেটর চালু রেখেছে।”

মোটকথা বিশেষ করে বিদ্যুতের ব্যাপারে সবাই অবাক হয়ে গেলো! আমার মা-বাবার আশীর্বাদস্বরূপ এমন আরও অলৌকিক কাণ্ড ঘটতে লাগলো। তারমধ্যে অবাক হবার মতো একটা কাণ্ড ঘটলো, ধুতরা গোটা। যা ছাড়া আর হিন্দু বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন করা যায় না।

❝হিন্দু বিয়ে কার্যসম্পাদনের সময় নানারকম ফুল-ফল, কলাগাছ, ধান, দুর্বা, বেল-তুলসী-সহ আরও আরও অনেককিছুর প্রয়োজন হয়ে থাকে। তারমধ্যে একটি হলো, বিয়ের কার্যসম্পাদনের সময় ৮টি ধুতরা গোটার দরকার হয়। ওই ধুতরা গোটা মাঝখানে কেটে দুভাগ করে তার ভেতরের বিচিগুলো ফেলে ঘি’র প্রদীপ জ্বালানো হয়। ওই ধুতরা গোটা ছাড়া বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন হবে না। মোটকথা ওই বিয়ে অসম্পন্নই রয়ে যাবে।❞

বিয়ের আগেরদিন অধিবাস শেষে বিয়ের দিন সকালবেলা যথারীতি পুরোহিত বাসায় এসে বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন করার যা যা দরকার তা গোছাতে লাগলো। সবকিছু ঠিকটাক গোছগাছ করার পর বাকি থাকলো, ৮টা ধুতরা গোটা। পুরোহিত ধুতরা গোটা আর খুঁজে পাচ্ছিল না।

পুরোহিত ধুতরা গোটা হাতের কাছে না পেয়ে তাড়াতাড়ি ৮টা ধুতরা গোটা সংগ্রহ করতে বললে, আমার বড়দা ধুতরা গোটা সংগ্রহ করার জন্য ঘর থেকে বের হলো। এই ধুতরা গোটা সংগ্রহ করার জন্য আমার বড় দাদা প্রথমে পুরো মহল্লার আনাচে-কানাচে থাকা ঝোপঝাড় জঙ্গলে তল্লাশি চালালো। মহল্লার কোথাও ধুতরা গোটা না পেয়ে গেলো, শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়, লক্ষ্মণখোলা গ্রামে।

লক্ষ্মণখোলা পুরো গ্রামের আনাচে-কানাচে ঘুরে ধুতরা গোটা না পেয়ে গেলো নিকটস্থ দাসেরগাঁও গ্রামে। সেখানেও ধুতরা গোটা পেলেন না। গেলো, ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলে। সেখানেও ধুতরা গোটা পাওয়া গেলো না। বড় দাদা ধুতরা গোটা না পেয়ে মন খারাপ করে নিরাশ হয়ে বাসায় ফিরে এলো। আমি তখন বাসায় ছিলাম না। আমি একটু দূরের মহল্লার একটা চায়ের দোকানে ছিলাম।

বড়দা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে সেই চায়ের দোকানে গিয়ে আমার পাশে মন খারাপ করে বসলো। আমি বড়দা’র মনটা খারাপ দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “দাদা তোর মনটা খারাপ কেন?”
বড়দা মলিন স্বরে বললো, “ধুতরা গোটা পাইনি। শীতলক্ষ্যা নদীর এপার-ওপার দুপাড়ের অনেক অচেনা জায়গায়ও খুঁজেছি, কিন্তু কোথাও একটা ধুতরা গোটা পাওয়া গেলো না। এখন তোর মেয়ের বিয়ে কি করে হবে, সেই চিন্তাই করছি।”

বড়দা’র কথা শেষ হতেই আমি চা-দোকানদার জহির মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, “জহির ভাই ক’দিন আগে আপনার বাসার সামনে কয়েকটা ধুতরাগাছ দেখেছিলাম। সেগুলো কি এখনো ঠিক জায়গামতো আছে?”
আমার কথা শুনে চা-দোকানদার বললো, “দাদা গত পরশুদিন ওই গাছগুলো তুলে ফেলেছি। একটু কষ্ট করে গিয়ে দেখুন তো গাছগুলো আছে কি-না?”

দোকানদার জহির ভাইয়ের কথা শুনে দু’ভাই মিলে তাড়াতাড়ি জহির ভাইয়ের বাসার সামনে গেলাম। গিয়ে দেখি ধুতরাগাছগুলোর পাতা সামান্য শুকিয়ে গেছে। কিন্তু কয়েকটা ধুতরা গোটা দেখা যাচ্ছে। ধুতরা গাছের সামনে গেলাম। গাছগুলো ওলোট পালোট করে দেখি গাছগুলোতে ৮টা ধুতরা গোটাই আছে। একটা কমও নয়, একটা বেশিও নয়। তা দেখে সাথে সাথে গাছগুলো থেকে ধুতরা গোটাগুলো ছিড়ে বড়দা’র হাতে দিয়ে জহির ভাইয়ের বাসা থেকে বেরিয়ে চায়ের দোকানে এলাম।

দোকানে আসার সাথে সাথে চা-দোকানদার জহির ভাই জিজ্ঞেস করলো, “দাদা পেয়েছেন?”
বললাম, “হ্যাঁ দাদা, আমার মা-বাবার আশীর্বাদে আমার যেকটা গোটার দরকার, সেকটাই গাছগুলোতে ছিলো। আমি সেগুলো ছিড়ে নিয়ে এসেছি। আমি এখন একরকম চিন্তামুক্ত!”
আমার কথা শুনে চা-দোকানদার জহির ভাই-সহ কাস্টমার আরও অনেকেই অবাক হয়ে গেলো।

এর আগে অবাক হয়েছিল, আমার বড়দা! ধুতরাগাছ থেকে এক-এক করে যখন ধুতরা গোটাগুলো ছিড়ে আমার দাদার হাতে দিচ্ছিলাম, তখনই আমার বড়দা বলতে লাগলো, “এ কী অলৌকিক কাণ্ড! কত জায়গায় ঘুরে কোথাও একটা ধুতরা গোটা পাইনি। শেষমেশ এখানে আসে মরা গাছে ৮টা ধুতরা গোটা পেয়েছি। দরকারও ছিলো এই ৮টা ধুতরা গোটা, পেয়েছিও ৮টা। ছিলও ৮টা। সবই বিধাতার ইচ্ছা!”

তারপর চা দোকান থেকে দুইভাই চা পান করে বাসায় গিয়ে ৮টা ধুতরা গোটা বিয়ে কার্যসম্পাদন সম্পন্ন করার পুরোহিতের হাতে দিলাম। পুরোহিত সেগুলো হাতে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, “এখন আর কোনও টেনশন নেই, সবকিছু ঠিকটাকমত আছে।” বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন করতে আরও কোনও ঝামেলায় পড়তে হবে না।” বিয়ের লগ্ন রাত ১১টায়।

রাত ১০.৩০মিনিটের সময় বরযাত্রী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ১০নং ওয়ার্ড গোদনাইলস্থ চিত্তরঞ্জন কটন মিলস্’র আটপাড়া এসে হাজির হলো। ঢাক-ঢোল, সানাই বাজিয়ে বরযাত্রীদের স্বাগত জানিয়ে বিয়ের আসরে আনা হলো। তারপর একদিকে শুরু হলো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা, অন্যদিকে চলছিল খাওয়া-দাওয়ার পর্ব।

বরযাত্রী-সহ নিজের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত শুভাকাঙ্ক্ষী মিলে প্রায় ২৫০জন লোকের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব একসময় শেষ হলো। বিয়ের প্রথম পর্যায়ের পর্ব শেষে হতে রাত ভোর হয়ে গেলো। সকালবেলা বাসি বিবাহের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন হয়ে গেলে জামাই মেয়ে-সহ বরযাত্রীরা তাদের গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়। তখন দিনের ১১টা।

মেয়ে-সহ বরযাত্রীদের বিদায় করার কিছুক্ষণ পরই গোদনাইল এলাকা থেকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। এর পরই শুরু হলো আবার বৃষ্টি। মেয়ের জন্য আমরাও কাঁদছি, আমাদের সাথে যেন আকাশও কাঁদছিল! এই ছিলো আমার মা-বাবার আশীর্বাদস্বরূপ আমাদের একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কিছু অলৌকিক ঘটনা। যা কখনোই ভোলার মতো নয়।

তাই আমি এখনো যেকোনো আপদে-বিপদে মা-বাবার শ্মশানে গিয়ে দুটো আগরবাতি আর মোমবাতি জ্বালিয়ে হাতজোড় করে তাঁদের আশীর্বাদ চাই। তাঁদের আশীর্বাদের আমার সমস্যার সমাধান হয়।

ভালোবাসা মানে

cat

ভালোবাসা মানে, বেঁচে থাকার যত আশা
ভালোবাসা মানে, কেউ সফল, কেউ নিরাশা
ভালোবাসা মানে, চোখে দেখা ঝাপসা কুয়াশা
ভালোবাসা মানে, একরকম ভয়ংকর সর্বনাশা।

ভালোবাসা মানে, হাসি গানের কতো তামাশা
ভালোবাসা মানে, আনন্দ উল্লাসের রঙ্গতামাশা
ভালোবাসা মানে, কাঁদতে হয় দিনরাত হরহামেশা
ভালোবাসা মানে, পাগলের মতো হয় বেদিশা।

ভালোবাসা মানে, বাসর ঘরে আনন্দের মেলামেশা
ভালোবাসা মানে, মাদকের মতো মরণ নেশা
ভালোবাসা মানে, কতো অভিমান কত গোশশা
ভালোবাসা মানে, গুরুদশা ভগ্নদশা চল্লিশা মরণদশা!

এর নাম হলো, স্নেহভালোবাসা প্রেম ভালোবাসা!

ডিএনডি বাঁধের ইতিহাস ও বর্তমান ভবিষ্যত

gh01
ডিএনডি বাঁধের বর্তমান লেক। ছবিটি বার্মাস্ট্যান্ড থেকে তোলা।

প্রিয় পাঠক, আপনি জানেন কি ডিএনডি বাঁধের ইতিহাস? এবং কেন-ই-বা এই বাঁধ তৈরি করেছিলো? আর কি-ই-বা উদ্দেশ্য ছিলো তৎকালীন সরকারের? যদি আপনার জানা না থেকে, তো আমার এই লেখাটা শেষ পর্যন্ত পড়লে ডিএনডি বাঁধের ইতিহাস এবং বর্তমান হালহকিকত সবকিছু জানতে পারবেন, আশা করি। তো চলুন শুরু করা যাক!

ডিএনডি’র সারমর্ম:
ডি=ঢাকা, এন=নারায়ণগঞ্জ, ডি=ডেমর। মানে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরা, এই তিন জায়গার কিছুকিছু অংশ জুড়ে ডিএনডি বাঁধ। যা, বর্তমান ঢাকা-৪ ও ৫ এবং নারায়ণগঞ্জ-৩ ও ৪ সংসদীয় আসন নিয়ে ডিএনডি বাঁধের অবস্থান।

ডিএনডি বাঁধের ইতিহাস:
জানা যায়, ১৯৬৬ সালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা এলাকার ৮ হাজার ৩শ ৪০ হেক্টর জমি নিয়ে ইরীগেশন প্রকল্প তৈরীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তৎকালিক পূর্ব পাকিস্তান সরকার। যা বাস্তবায়ন করা হয় ১৯৬৮ সালে। নামকরণ করা হয় ডিএনডি বাঁধ।

তৎকালীন সরকারের উদ্দেশ্য:
তখনকার সময় শুধু ইরিধান চাষের জন্যই সরকার এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে তৎকালীন সরকারের ব্যয় হয়েছিল, ২৩৩ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা। এর অভ্যন্তরে জমির পরিমাণ ছিলো, ৫ হাজার ৬৪ হেক্টর। এই ৫ হাজার ৬৪ হাজার হেক্টর জমিই ছিলো সেচের আওতায়।

কি কি ছিলো এই ডিএনডি প্রকল্প অভ্যন্তরে?
ডিএনডি বাঁধ এলাকায় পানি সেচ দেয়া ও নিষ্কাশনের জন্য বড় ‘কংস নদ’ নামে একটি প্রশস্ত খাল ছিল। এ খালের সাথে আরো যুক্ত ছিল নয়টি শাখা খাল। ছাড়াও ২১০টি ছিল আউট লেক, ১০টি নিষ্কাশন খাল। এসব খালের দৈর্ঘ্য ছিল ১৮৬ কিলোমিটারের মতো।

এরমধ্যে নিষ্কাশন খালের দৈর্ঘ্য ছিলো ৪৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার। আর ইরীগেশন খালের দৈর্ঘ্য ছিল ৫১ দশমিক ২০ কিলোমিটার। ডিএনডি এলাকায় যদি বৃষ্টিতে পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, সেজন্য পানি সেচের জন্য তৈরী করা হয় শিমরাইল এলাকায় ডিএনডি পাম্প হাউজ।

বসানো হয় জাপানের তৈরী করা ৪টি বড় পাম্প, যা প্রতি সেকেন্ডে ৫’শ১২ ঘনফুট পানি নিস্কাশনের ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল। দুইটি প্রধান পানি নিষ্কাশনের খাল কাটা হয়েছিল প্রথম পর্যায়ে, তা ছিল ৫৫ পয়েন্ট ২০ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪৫ পয়েন্ট ৪০’ কিলোমিটার। এবং দুইটি প্রধান সেচ খাল কাটা হয় প্রথম পর্যায়ে ১৪’শ ১০ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪৪’ কিলোমিটার।

খড়া মৌসুমে জমিতে পানি সেচ দিতে ও বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশন করতে সরকার এ খাল গুলো তৈরী করেছিল। সেসব খালগুলো এখন প্রায় সবই অকেজো। তার প্রমাণ পাওয়া যায় চিটাগাং রোড সংলগ্ন সেচ পাম্পের সামনে গেলে। শীতলক্ষ্যা নদী থেকে সুবিশাল প্রশস্ত খাল এই পাম্পের সাথে সংযোগ, আছে সুইচ গেইট।

ডিএনডি বাঁধের বর্তমান:
সুখ-দুঃখ নিয়েই ভবসংসারে মানুষের জন্ম। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ যেমন সুখ খোঁজে, একদিন নিদারুণ কষ্ট জীবনে আসতে পারে সেই চিন্তাও মানুষ করে। তাই বলে বছর বছর লাগাতার কষ্ট করে জীবন চলবে এটা কোন ধরনের কষ্ট? এটা একটা বেড়িবাঁধ এলাকার স্থায়ী জলাবদ্ধতার কষ্ট।

যাদের প্রতিবছরই নিদারুণ কষ্টে থাকতে হয় জলাবদ্ধতার করণে। তারাই হলেন এক সময়ের ২৩৩ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ের প্রকল্প, ডিএনডি বেড়িবাঁধ এলাকার বসবাসকারী মানুষ।

বৈশাখ মাস থেকে শুরু হয় ডিএনডি বাঁধের ভেতরে জলাবদ্ধতা। থাকতে হয় তাদের বর্ষাঋতুর শেষ পর্যন্তই পানিবন্দী হয়ে। সামান্য বৃষ্টিতেই ১২ লাখ (বর্তমান এর সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি) ডিএনডিবাসী পানিবন্দি হয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যেই। একনাগাড়ে দুই-তিনদিন বৃষ্টি হলেই তাদের কষ্টের আর সীমা থাকে না। সেই কষ্টের চিত্র দেখা যায় সরেজমিনে গিয়ে। কীভাবে পানিবন্দি হয়ে ডিএনডিবাসী জীবনধারণ করছে।

এর কারণ শুধু একটাই, তা হলো, চাষের জমির সংখ্যা দিনে দিনে অনেক কমে যাচ্ছে। সাথে পানি নিষ্কাশনের খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে। সাথে বেড়েছে জনবসতি ও নীট গার্মেন্টস-সহ নানারকম কলকারখানা।

এই গড়া আর জমি কেনা শুরু হয়েছিল ১৯৮৮-১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর থেকে। তখন ঢাকার আশেপাশের মানুষ মনে করেছিল, একরকম ভয়াবহ বন্যা এই বঙ্গদেশে ধারাবাহিকভাবেই হতে থাকবে। সেই ভাবনা থেকেই মানুষ উঠেপড়ে লেগে যায়, ডিএনডি বেড়িবাঁধের ভেতরে একটি বাড়ি তৈরি করার জন্য। এখনও অনেক টাকাওয়ালা মানুষ মনে করে ডিএনডি বাঁধের ভেতরে একটি বাড়ি করা, আর চাঁদের দেশে বাড়ি করা সমান কথা।

কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য ছিল, এ প্রকল্পে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে ও অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যেই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন। একই সাথে রাজধানী ঢাকায় অবস্থানকারীদের জন্য সতেজ রবি শষ্য সরবরাহ করা। বর্তমানে এর ফল দাঁড়িয়েছে উল্টো। ভবিষ্যৎ হতে পারে হবে আরও ভয়াবহ, আর না-হয় আরও তৈরি হতে পারে সৌন্দর্যের লীলাভূমি।

ডিএনডি বাঁধের ভবিষ্যৎ :
প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণে নানা দুর্ভোগ আর বিড়ম্বনার শিকার হয় ডিএনডির ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা। এসময় জলাবদ্ধতার সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন কল-কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যালযুক্ত পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের পানি। ফলে বছরের প্রায় ৫ মাস জলাবদ্ধতার মধ্যেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয় ডিএনডি বাঁধবাসীদের।

02
ডিএনডি বাঁধের বর্তমান লেক। ছবিটি বার্মাস্ট্যান্ড থেকে তোলা।

এসব পরিস্থিতির উন্নয়নে ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট একনেক সভায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) সেচ প্রকল্প এলাকায় নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ৫৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ডিএনডি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন (ফেইজ-২)’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদিত হয়। ২০১৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ডিএনডি এলাকার পানি নিষ্কাশনের উন্নয়নে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী।

হাতিরঝিলের আদলে সাজবে ডিএনডি এলাকা:
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ডিএনডি এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পরিবেশগত মান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন-সহ ডিএনডি বাঁধের জনগণের স্বাভাবিক জীবনমান নিশ্চিত হবে বলে সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে।

হাতিরঝিলের প্রকল্পের কাজকে মাথায় রেখেই এগিয়ে চলছে প্রকল্পের কাজ। এখানকার খালগুলো দখলমুক্ত করার পর এর পাড়গুলো বাঁধাই করে দেওয়া হচ্ছে। দুই পাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। খালগুলোয় চলবে ওয়াটার ট্যাক্সি। ওই ওয়াটার ট্যাক্সিতে চড়ে ঢাকায় আসা-যাওয়া করা যাবে। এছাড়া ইটিপির (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট নিয়েও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

প্রকল্পটি ‘রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে’র কথা উল্লেখ করে এটি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রস্তাব পাঠায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অথবা সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়।

বর্তমানে প্রকল্পের কাজ পায়ই শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আশা করা যায় আর এক থেকে দেড়বছরের মাথায় শেষ হবে। প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হলে ডিএনডি বাঁধবাসী তাদের আগামী দিনের সুখের দিন হয়তো দেখতে পারবে।

শীতলক্ষ্যা নদীর উপর কালের সাক্ষী ভাসমান ডকইয়ার্ড

fghy
ভাসমান ডকইয়ার্ড, বন্দর, চৌরাপাড়া, নারায়ণগঞ্জ।

শীতলক্ষ্যা একটি নদীর নাম। যা নারায়ণগঞ্জ শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলছে, যুগযুগ ধরে। স্বচ্ছ পানির জন্য সুনাম অর্জনকারী শীতলক্ষ্যা নদী বঙ্গদেশের সবার কাছেই পরিচিত। স্বচ্ছ পানির সুনাম বর্তমানে না থাকলেও, নদীর দুই পাড় নিয়ে সুখ্যাতি আজও অখ্যাত রয়ে গেছে।

শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ে রয়েছে প্রচুর মিল-ইন্ডাস্ট্রি, ব্যবসা বাণিজ্য সহ আরও অনেককিছু। এসব নিয়ে লিখে শেষ করা যায় না। তাই আর কিছু লিখলামও না। লিখতে চাই শীতলক্ষ্যা নদীর পানির উপরে ভেসে থাকা বি.আই.ডব্লিউ. টি.সি’র ভাসমান ডকইয়ার্ড নিয়ে।

এই ভাসমান ডকইয়ার্ডটিও প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসের একটা ঐতিহ্য। যা যুগযুগ ধরে শীতলক্ষ্যা নদী, আর নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্য বহন করে চলছে। এই ভাসমান ডকইয়ার্ডটি পানিতে চলাচলকারী জাহাজ, লঞ্চ-ইস্টিমার, কার্গো, ট্রলার সহ আরও বহুরকম নৌযান মেরামত করার সময়োপযোগী স্থান।

আমরা সবাই সচরাচর দেখি ডকইয়ার্ড থাকে, নদীর পাড় ঘেঁষা খোলা জায়গায়। কিন্তু এটি নদীর পাড় ঘেঁষা কোনও খোলা জায়গা বা ভূমিতে নয়! এটি হলো পানির উপরে ভাসমান (ভেসে থাকা) অবস্থায়। নদীতে চলাচলকারী নৌযান মেরামত করার সহজ এবং উপযোগী স্থান।

জানা যায়, এরকম ভাসমান ডকইয়ার্ড এই বঙ্গদেশে আরও দু’টি আছে। একটি বরিশাল, আরেকটি বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। আর এটি হলো তৃতীয় ভাসমান ডকইয়ার্ড । এটির অবস্থান নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার চৌরাপাড়া গুদারাঘাট সংলগ্ন। এটি বি.আই.ডব্লিউ.টি.সির নৌযান মেরামতের ইর্মাজেন্সি বিভাগ হিসেবে পরিচিত ভাসমান ফ্লোটিং ডকইয়ার্ড ।

fgh
ভাসমান ডকইয়ার্ড, বন্দর, চৌরাপাড়া, নারায়ণগঞ্জ।

ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি এই বি.আই.ডব্লিউ.টি.সির নৌযান মেরামত করার ডকইয়ার্ডটিকে। এই ডকইয়ার্ডের সাথেই ছিল আমাদের বসবাস, সাবেক আদর্শ কটন মিলস্। বর্তমান শোহাগপুর টেক্সটাইল মিলস্। স্কুলে যাবার আগে বন্ধুদের সাথে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ভাসতে ভাসতে আসতাম এই ডকইয়ার্ডে। এসেই সবাই মিলে শুরু করে দিতাম লাফালাফি আর ডকের ভেতরে দৌড়াদৌড়ি।

এসব করার সময় ডকইয়ার্ডে কর্মরত কর্মচারীদের অনেক বকুনিও শুনেছি। আবার কোনও কোনওদিন বিকালবেলা মাছ ধরার জন্য বরশী নিয়ে চলে আসতাম ডকইয়ার্ডের সামনে। এই ডকইয়ার্ডটির চারিপাশ ছিল মাছের অভয়ারণ্য। বাংলাদেশের ছয়-ঋতুর প্রায় সব ঋতুতেই এর চারদিক মাছে থাকত ভরপুর। বরশী ফেলার সাথে সাথেই পাওয়া যেত নানারকম মাছ।

বর্তমানে শীতলক্ষ্যার পাড়ে যত্রতত্র নীট গার্মেন্টস ও ড্রাইং কারখানা গড়ে উঠেছে । সেসব ডাইং কারখানার নির্গত কেমিক্যালের পানি শীতলক্ষ্যায় মিশ্রিত হয়ে পুরো নদীর পানি এখন বিষাক্ত হয়ে গেছে। যার কারণে আর ডকইয়ার্ডের আশে-পাশে আগের মতো মাছ থাকে না। সেসব কথা না-হয় নাই-ই-বা লিখলাম। এখন ডকইয়ার্ডটির খুঁটি-নাটি নিয়ে কিছু লিখতে চাই।

জানা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান আলফেজ উইলিয়ামস এন্ড ডোভস লিমিটেড ১৯৪৫ সালে এটি নির্মাণ করে। জাহাজের ত্রুটিপূর্ণ তলদেশ মেরামত এবং দ্রুত বিকল ইঞ্জিনের ত্রুটি সারানোর কাজে এই ভাসমান ফ্লোটিং ডকইয়ার্ডের জুড়ি নেই।

এ ডকইয়ার্ডে ৫ টি পন্টুন আছে। পন্টুনগুলোর অভ্যন্তরে বৈদ্যুতিক মটরপাম্পের সাহায্যে ডকইয়ার্ডটির ভেতরে পানি ঢুকিয়ে, সম্পূর্ণ ডকইয়ার্ডটি পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। তখন ডকিংয়ে ত্রুটি সারতে আসা জাহাজটিকে আরেকটি ছোট ইঞ্জিনচালিত জাহাজে ঠেলে ডক ইয়ার্ডের ভিতরে নিয়ে যায়। তখন ত্রুটিপূর্ণ জাহাজটিকে বসানোর জন্য থাকা সমান উচ্চতায় থরে থরে সাজানো কাঠের বড় বড় স্তম্ভের উপর বসিয়ে দেয়া হয়।

এরপর পাম্পের সাহায্যে পন্টুনের পানি আবার সেঁচতে শুরু করে দেয়, ডকইয়ার্ডে এই কাজে নিয়োজিত থাকা কর্মচারিরা। পুরো ডকে পানি ঢুকিয়ে ডকইয়ার্ডটি ডুবাতে যতক্ষণ সময় লেগেছিল, তার চাইতে অধিক সময় ব্যয় করে জাহাজ সহ নিমজ্জিত ডকটি জাগিয়ে তোলা হয় আস্তে-ধীরে।

এরপর শুরু হয় ত্রুটিপূর্ণ জাহাজটির সংস্কার কাজ। মেরামতের জন্য আসা কোনও নৌযান বা জাহাজের যন্ত্রাংশ যদি তৈরি করতে হয়, তাহলে ভাসমান ডকইয়ার্ডেই করা হয়। এর সাথেই আরেকটা সুবিশাল ভাসমান বোর্ড আছে।

এই ভাসমান বোর্ডেটি হলো ওয়ার্কশপ। এটিকে অনেকে ভাসমান ওয়ার্কশপও বলে থাকে। এই ওয়ার্কশপে মেরামত বা তৈরি করা যন্ত্রাংশ দিয়েই, ত্রুটিপূর্ণ নৌযানগুলো মেরামত করা হয়। একেকটা জাহাজ মেরামত করতে অনেকদিন সময় লেগে যায়। ত্রুটি সারতে আসা কোনও কোনোও জাহাজ মাস খানেক যাবত এই ডকইয়ার্ডে থাকতে হয়। সম্পূর্ণ মেরামতের পর জাহাজটি নামাতে একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

যখন বছরের শেষ ডিসেম্বর মাসের আগমন ঘটে, তখন নদীতে এমনিতেই পানি কমে যায়। সেসময় ডকইয়ার্ডটি ডুবাতে আর জাগাতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, ডকইয়ার্ডে দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের। কারণ এই ডকইয়ার্ডটি চৌরাপাড়া গুদারাঘাট সংলগ্ন নদীর পাড় ঘেঁষা। সেই কারণে বর্ষা মৌসুম ছাড়া সেখানে পানি থাকে খুব কম। ডকইয়ার্ড ডুবাতে জাগাতে তা মাটিতে ঠেকে যায় যায় অবস্থা হয়।

শোনা যায়, কখনো কখনো মাটিতে ঠেকেও যায়। তখন সবার অপেক্ষা করতে হয় জোয়ারের জন্য। নদীতে জোয়ার না-হওয়া পর্যন্ত আর মেরামত হওয়া জাহাজটিকে ডেলিভারি দিতে পারেনা ডক কর্মচারীরা। যখন জোয়ার আসে তখন আবার শুরু হয় ডকইয়ার্ড ডুবানো জাগানোর পালা। এভাবেই চলছে এর কাজ।

আর একইভাবে নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসের ঐতিহ্যও রক্ষা করে চলছে ভাসমান ডকইয়ার্ডটি। যেভাবে ভাসমান ডকইয়ার্ডটি যুগযুগ ধরে শীতলক্ষ্যা নদীর বুকে ভেসে আছে, এভাবে যেন চিরদিন কালের সাক্ষী হয়ে শীতলক্ষ্যার বুকে ভেসে থাকে সেই কামনা করি।