দুইজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু! কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারে না। কেউ কাউকে কয়েক ঘণ্টার জন্য না দেখলে অস্থির হয়ে ওঠে। কারণ ছোটবেলা থেকে ওঁরা দুইজন একই স্কুলে লেখাপড়া। একসাথে আসা-যাওয়া। একসাথে খেলা-ধুলা। একসাথে চলা-ফেরা। একসাথে ঘোরা-ফেরা। একসাথে খাওয়া-দাওয়া। একসাথে ওঠা-বসা করে বড় হয়েছে। দুইজনই সমান বয়সী। হঠাৎ এক বন্ধু চলে গেলো দেশের বাইরে। মানে বিদেশ যাকে বলে।
আরেক বন্ধু থেকে গেলো নিজের দেশেই। নিজ দেশে থেকে যাওয়া বন্ধুটির বাড়ি শীতলক্ষ্যা নদী ঘেঁষা এক এলাকায়। তাই সে সবসময়ই নদী নিয়েই বেশি ভাবে। কারণ, কোনোএক সময় এই শীতলক্ষ্যা নদীতে গোসল করতে। ছাঁকিজাল দিয়ে মাছ ধরতো। শীত মৌসুমে নদীর পাড়ে লাউয়ের চারা, কুমড়া চারা, টমেটো চারা-সহ আরও অনেক রকমের চারা রোপণ করতো। বর্তমানে নদীর পানি দূষিত হয়ে যাওয়ার কারণে সেসব আর করা হয় না। তবু সে প্রতিদিন সকাল বিকাল নদীর পাড়ে গিয়ে ঘোরাঘুরি করে। চিরচেনা নদীর বর্তমান করুণ অবস্থা দেখে মনখারাপ করে বসে থাকে।
এদিকে ৩০ বছর পর বিদেশ থেকে বন্ধুটি দেশে আসলো। দেশে এসে ছোটবেলার খেলার সাথি বন্ধুটির বাড়ি গিয়ে দেখা করে বললো, ‘কেমন আছিস দোস্ত?’
দেশি বন্ধুটি বললো, ‘ভালো আছি! তো তুই কেমন আছিস?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘আমিও বেশ আছি!’
দেশি বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলো, ‘এতদিন কোন দেশে ছিলি?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘বিশ্বের এক উন্নত দেশ আমেরিকায়।’
দেশি বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলো, ‘সে-দেশের নদীগুলোর কী অবস্থা? তা কি আমাদের দেশের নদীগুলোর মতো?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘আমি অনেক বছর পর দেশে এসেছি। শহরের আশে-পাশে থাকা নদীগুলো না দেখে কিছুই বলতে পারছি না। তবে সে-দেশের নদী এবং নদীর পানি আয়নার মতো পরিস্কার।’
দেশের বন্ধুটি বললো, ‘তাহলে চল, একদিন ঘুরে দেখে আসি শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী নদী।’
দুই বন্ধু মিলে একদিন শীতলক্ষ্যা, একদিন বুড়িগঙ্গা, একদিন তুরাগ, একদিন ধলেশ্বরী নদী ঘুরে দেখতে গেলো। চারদিন রাজধানী ঢাকার আশ-পাশে থাকা চারটি নদী ঘুরে দেখলো।
এরপর দেশি বন্ধু বিদেশি বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘দোস্ত আমাদের দেশের নদীগুলো কেমন দেখলি?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘দেখে তো এলাম রাজধানী ঢাকার আশ-পাশের নর্দমাগুলো।’
দেশি বন্ধুটি বললো, ‘কী বললি! শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী এগুলো কী নদী না?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘দেখে মনে হয় এগুলো নদী না!’
দেশি বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে এগুলো কী?’ বিদেশি বন্ধুটি বললো, এগুলো মনে হয় রাজধানী ঢাকার বড়সড় নর্দমা!’
দেশি বন্ধুটি বললো, ‘নদীকে তুই বলছিস নর্মদা? কিন্তু কেন?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘নদীর পানিতে মিশ্রিত বিষাক্ত কেমিক্যাল। এই পানি তো মনে হয় পান করা যায় না! এমনকি কোনও ফসলী জমিতেও মনে হয় দেওয়া যায় না। তাই বললাম, এগুলো নদী না। এগুলো হচ্ছে, একেকটা নদী শহরের একেকটা ঢাকনা বিহীন বিশালাকার ড্রেন। এছাড়া আর কিছুই না।’
দেশি বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা দোস্ত, বিদেশে এসব বড় বড় ঢাকনা বিহীন ড্রেনগুলো কি এভাবেই নদীর স্রোতের মতো বয়ে চলে?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘তা বলতে পারছি না। কারণ, বিদেশে এসব বড় বড় খোলা ড্রেনগুলো কারোর চোখেই পড়ে না। এসব বড় আকারের ড্রেনগুলো থাকে মাটির নিচ দিয়ে।’
দেশি বন্ধুটি আক্ষেপ করে বললো, ‘এসব নদীগুলোর এরকম অবস্থা যে কারা করলো, তা আমার মাথায় খেলছে না। তুই কি দোস্ত বলতে পারিস, আমাদের দেশের নদীগুলোকে ড্রেন বানাচ্ছে কারা?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘যাঁরা পারে তাঁরা! মানে, বড় বড় শিল্পপতিরা।
দেশি বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলো, ‘তা কীভাবে করছে?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘ক্ষতার বলে আর দাপটে। শিল্পপতিদের টাকার কাছে প্রশাসন তো সবসময়ই দিশেহারা!
দেশি বন্ধুটি আক্ষেপ করে বললো, ‘একসময় বাংলার নদীগুলোর পানি ছিল পরিস্কার টলটলা! শুনেছি বাংলাদেশের নদীর পানি দিয়ে বিদেশিরা ঔষধে ব্যবহার করতো। আর এখন সেই নদীর পানি আর স্বচ্ছ টলটলা আয়নার মতো পরিস্কার নেই! নদীর পানি এখন কালো কুচকুচে। পানের অযোগ্য। পানিতে পচা দুর্গন্ধ। পানির পচা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণেই শহরবাসী রোগে ভুগে প্রাণ হারায়! তাহলে দোস্ত এখন উপায়?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘উপায় হলো যেসব শিল্পপতিরা মনের আনন্দে নদীতে বিষাক্ত কেমিক্যালের পানি ফেলছে, সরকারের উচিৎ হবে তাঁদের কাছ থেকে লিটার প্রতি হিসাব করে জরিমানা আদায় করা। এরজন্য সরকার তাঁদেরকে লিটার প্রতি একটা দাম নির্ধারণ করে দিবে। এরপর সেসব শিল্পপতিরা যতখুশি তত বিষাক্ত পানি নদীতে ছাড়বে বা ফেলবে।
‘তারপর তাঁরা প্রতিদিন যত লিটার বিষাক্ত কেমিক্যালের পানি নদীতে ফেলবে, সরকারের কাছে তার একটা হিসাব থাকবে। প্রতি মাসে ঠিক তত লিটার পানির ন্যায্য দাম সরকারকে বুঝিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। সরকার সেই টাকা দিয়ে ভুক্তভোগী মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। যেমন: নদীতে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত পানিতে মাছ নেই। জেলেরা জাল ফেলে মাছ পাচ্ছে না। কৃষকরা নদীর পানি ফসলী জমিতে দিতে পারছে না। তাই আগের মতো জমিতে ফসল হচ্ছে না। নদীর দূষিত পানি শোধন করার পরও পানিতে দুর্গন্ধ থেকে যায়। সেই পানি পান করে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। নদীর দূষিত পানির কারণে নদী এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়ে গাছপালা মরে যায়। পানির দুর্গন্ধে নানারকম রোগব্যাধির সৃষ্টি হয়। এসব সমস্যার জন্যই সরকার শিল্পপতিদের কাছ থেকে লিটার প্রতি জরিমানা আদায় করবে। আদায়কৃত সেই অর্থ সরকার যদি এসব ভুক্তভোগীদের মাঝে খরচ করে, তাহলেই কিছুটা সমস্যার সমাধান হতে পারে। তা না হলে শত চিল্লাচিল্লি করেও কোন লাভ হবে না। শিল্পপতিরা ক্ষেপে গেলে, আরও বেশি করে বিষাক্ত কেমিক্যালের পানি নদীতে ফেলবে। তাহলে সামনে আরও বিপদ হবে।’
দেশি বন্ধুটি বললো, ‘আমাদের দেশের সরকার কি কখনো এরকম নীতিমালা তৈরি করবে? মনে হয় না, দোস্ত! তারচেয়ে বরং এবিষয়ে আর কোনও কথা না বলে, চুপচাপ থাকাই ভালো মনে করি!’
সরকার শিল্পপতিদের কাছ থেকে লিটার প্রতি জরিমানা আদায় করবে। আদায়কৃত সেই অর্থ সরকার যদি এসব ভুক্তভোগীদের মাঝে খরচ করে, তাহলেই কিছুটা সমস্যার সমাধান হতে পারে। ___ না এটাও কোন সমাধান নয়। সমাধানও আসবে না।
সমাপ্তিই ঠিক আছে। বিবেক বালিশের নিচে রেখে চুপচাপ থাকাই ভালো।
হ্যাঁ, শ্রদ্ধেয় দাদা। এসব দেখতে দেখতে এখন না দেখার ভাণ করেই থাকতে হচ্ছে। এই শীতলক্ষ্যা নিয়ে অনেক লিখেছি, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তাই এখন আর এসব নিয়ে লিখি না।
আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
নদী কোথায় !! রাজধানীর নদী বলতে আমি তো নর্দমাই বুঝি। সমস্যারও সমাধান নাই।
এ দেশের আর সব সমস্যার সমাধান হলেও, এ দেশের নদী দূষণের কোনও সমাধান হবে না বলেই মনে হয়, শ্রদ্ধেয় কবি সুমন দাদা। এ দেশ নদীমাতৃক দেশ এই নামও কোনোএক সময় থাকবে না।
মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
নদী মাতৃক বাংলাদেশে নদীর অস্তিত্ব রক্ষা করতে না পারলে একদিন আমাদের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে!!!
আমাদের অস্তিত্ব তো বিলীন হয়েছেই, শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। যেই নদীতে সকাল দুপুর মা-বোনেরা স্নান করতো, সেই নদীতে এখন কেউ পা-ও ভেজাতে চায় না। বাংলার নদীগূলো এখন বাংলার মানুষের কাছে বিষাক্ত প্রজনন এর মতো মনে হচ্ছে।
আপনার সুন্দর গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, শ্রদ্ধেয় কবি দাদা।
– যাঁরা পারে তাঁরা! মানে, বড় বড় শিল্পপতিরা।
– ‘তা কীভাবে করছে?’
-‘ক্ষতার বলে আর দাপটে। শিল্পপতিদের টাকার কাছে প্রশাসন সবসময়ই দিশেহারা!
ওইসব ঘুষখোরদের জন্যই আজ বাংলার নদীগুলোর এই করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও করুণ হবে, শ্রদ্ধেয় কবি দাদা।
দুই বন্ধুর ভাবনা। আসলে নগর কর্তারাও এসব ভালো করেই জানে যে, রাজধানী ঢাকা শহরের নদী নামের নর্দমা ধীরে ধীরে ভরাটই হবে সংস্কার হবে না। নদী স্মৃতি অতীত।
আমার কাছে শীতলক্ষ্যা নদীর আগেকার সেসব স্মৃতি শুধুই অতীত! তাই আর এখন নদীর পাড়ে বেশি যাই না। নদীর বর্তমান অবস্থা দেখে কান্না আসে।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আমার শ্রদ্ধেয় প্রিয় কবি সাজিয়া দিদিকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী। কী সুন্দর সুন্দর নাম। এই নামগুলো বিলীন বিষাক্ত হয়ে যাবে। দিনদিন হারিয়ে ফেলা সেই সৌন্দর্য্য বা ঐতিহ্য ওরা আর কখনও ফিরে পাবে না।
আমার মনে হয় রাজধানী ঢাকার আশেপাশের নদীগুলো কোনোএক সময় বালু ফেলে ভরাট করে ফেলবে। এরপর সরকার সেখানে বহুতল ভবন সহ রাস্তা নির্মাণ করবে।
মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, শ্রদ্ধেয় কবি সৌমিত্র দাদা।
ধন্যবাদ দাদা, সুন্দর একটি লিখা শুভকামনা রইল
আপনার জন্যও শুভকামনা সবসময়, শ্রদ্ধেয় কবি দিদি। আশা করি ভালো থাকবেন।
পুণ্যোতোয়া শীতলক্ষ্যা নদীর সুশীতল জলে আজ দূষিত কেন ???
বারংবার নিবেদন করেও বিফল হলেও আপনার লেখনী চলুক অব্যহত গতিতে।
হে সাধক কবি। এলাকার মানুষকে জাগ্রত করে তুলুন।
আপনার লেখনী জেগে উঠুক। কারণ লেখনী সর্বদা সত্য ও সুন্দরের প্রতীক।
প্রিয় লেখক ও কবিকে শুভেচ্ছা জানাই। জয়গুরু!
রাষ্ট্রের কিছু অসাধু ব্যক্তিদের কারণে সবার সব প্রচেষ্টাই বিফলে যাচ্ছে। দিনে দিনে তাঁরা পুরো নদীই গিলে খাচ্ছে। কিন্তু ওঁরা ছিল রাস্তার ফকির, আজ তাঁরা বিলাসবহুল বাড়ি করছে, দামী গাড়ি চড়ে ঘুরছে। ওঁদের অপকর্মের কারণের নদী পাড়ের মানুষ রোগব্যাধিতে ভুগে মরছে। সাথে পরিবেশও ধ্বংস হচ্ছে। তারপরও সবকিছুই নাকি ঠিকঠাক আছে, রাষ্ট্র বলছে!
এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষেরই মরণ হচ্ছে।