ট্যাগ আর্কাইভঃ নিতাই বাবু

জীবনের গল্প-৩০ শেষ পর্ব

Image-64-1-1

জীবনের গল্প-২৯ এর শেষাংশ: রাত তখন আনুমানিক ৮ টার মতন বাজে। দিদির বাড়িতে তখনো কেউ ঘুমায়নি। সবাই ঘরে বসে টেলিভিশনে কবিগুরু রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান দেখতে ছিল।

আমার বড়দি’র বাড়িতে দুইজন ব্যাচেলর থাকতো। ওদের বাড়ি ছিলো মেদিনীপুর। ওরা বীর পাড়ায় অবস্থিত একটা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে চাকরি করতো। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ওই দুইজন ছেলের সাথে ঘুমানোর জায়গা হলো। পরদিন সকাল বেলা বড়দি আমাকে ঘুম থেকে জাগালো। বেলা তখন সকাল দশটার মতো বাজে। তখন ভাড়াটিয়া ছেলে দুটোও ঘরে ছিলো না। ওরা সকাল আটটার সাথে সাথেই ওদের কাজে চলে গিয়েছিল। দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওখানেও কি তুই এতো দেরি করে ঘুম থেকে উঠিস?’ বললাম, ‘না দিদি, অনেক রাতে ঘুমিয়েছি তো, তাই একটু দেরিতে ঘুম ভাঙলো।’ এরপর ঘুম থেকে উঠে স্নানঘর থেকে হাত-মুখ ধুলাম। চা-বিস্কুট খেয়ে বের হলাম, ভুটানের উদ্দেশ্যে।

আমার বড়দি’র বাড়ি থেকে ভুটানের গুমটু’র ভাড়া ছিলো মাত্র ৩টাকা। দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। যানবাহন বলতে ছিলো জীপগাড়ি। মনে সাহস রেখে এদিক-সেদিক না তাকিয়ে গেলাম ভুটানের গুমটু এলাকায়। বিকাল পর্যন্ত ঘুরে-ফিরে দেখে আবার দিদির বাড়ি ফিরে আসি। আবার ক’দিন পর গেলাম ভুটানেরই একটা জায়গায়। জায়গাটার নাম ফুলসিলিং। আমার বড়িদি’র বাড়ি থেকে ফুলসিলিঙের ভাড়া ২০ টাকা। দূরত্ব অনেক। আবার আরেকদিন গেলাম ভুটানের সামসি এলাকায়। মোটকথা বীরপাড়া এলাকার চারদিকে থাকা ভুটানের সব এলাকা ঘুরে-ফিরে দেখতে দেখতে একসময় আমার পকেট ফাঁকা হয়ে গেলো। শেষমেশ উপায়ন্তর না দেখে আমার মেজো ভাগনার সাথে গাড়ির গ্যারেজে হেলপার হিসেবে কাজ করতে থাকি। বেতন পেতাম প্রতি সপ্তাহে ভারতীয় টাকা মাত্র ১০০/= টাকা। সপ্তাহে এই নামমাত্র ১০০/= টাকা হাতে পেয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে ফিনিশ করে আবার পকেট শূন্য হয়ে সপ্তাহের বাকি দিনগুলো অতিবাহিত করতে হতো। এরপর আবার পকেট গরম করার জন্য আশায় থাকতাম রবিবারে অপেক্ষায়।

এভাবে থাকতে থাকতে বীর পাড়ায় কাটিয়ে দিলাম প্রায় এক বছরের মতো। একসময় দেখলাম আমার বড়দি, জামাইবাবু-সহ ভাগিনা-ভাগ্নিরাও কেমন যেন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যখন-তখনই দেখতাম তাদের চোখে-মুখে বিরক্তি ভাব। তারপর নিজে নিজেই বাংলাদেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিলাম। নন্দলাল নামে একজন লোকের সাহায্য নিয়ে বর্ডার পাড় করার দালাল খুঁজতে লাগলাম। বর্ডার পাড় করার দালালও পেয়ে গেলাম। কিন্তু আমার কাছে বাংলাদেশে আসার মতো কোনও টাকার ব্যবস্থা ছিলো না। তারপর তিনমাস পর্যন্ত পকেট খরচ কমিয়ে দিয়ে আসার খরচ জোগাড় করেছিলাম। আমি যে বিগত তিনমাস যাবত আসার প্রস্তুতি নিয়ে চলছিলাম, তা আর দিদির বাড়ির কাউকে জানতে দেইনি।

যেদিন বড়দি’র বাড়ি থেকে বাংলাদেশ চলে আসবো, তার আগের দিন রাতে বড়দি’র কাছে বলেছিলাম, ‘আগামীকালই আমি বাংলাদেশ চলে যাবো।’ আমার কথা শুনে বাড়ির সবাই হায়-হুতাশ শুরু করে দিলো। বলতে লাগলো, ‘কী ব্যাপার, কী হয়েছে, আগে বলিসনি কেন? আগামীকালই কেন যাবি? আরো কয়েকদিন থেকে যা’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি কারোর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সোজা ব্যাচেলর ছেলে দুটোর সাথে শুয়ে রইলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের যাকিছু ছিলো, সেগুলো ব্যাগের ভেতরে ভরতে লাগলাম। বড়দি সামনে এসে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললো, ‘সত্যি তুই এখনই রওনা দিচ্ছিস?’ বললাম, ‘হ্যাঁ দিদি, আমি এখনই রওনা হবো।’ জামাইবাবু থাকতে বললো, ভাগিনারা থাকতে বললো। কিন্তু না, আমি আর কারোর কথা শুনলাম না। হাতমুখ ধুয়ে জামা-প্যান্ট পরে যখন ব্যাগ কাঁধে তুললাম, তখন জামাইবাবু বললো, ‘একটু দেরি করো আমি বীরপাড়া বাজার থেকে আসছি।’ এই বলেই কামাইবাবু তাড়াতাড়ি বাইসাইকেল নিয়ে সোজা বীরপাড়া বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। আমি আর জামাইবাবু কথায় গুরুত্ব দিলাম না, আশেপাশে থাকা বাড়ির সকলের কাছ থেকে বলে-কয়ে ব্যাগ কাঁধে ফেলে সোজা মেইন রোডের দিকে হাঁটা ধরলাম। উদ্দেশ্য গ্যারেজ লাইনে গিয়ে আমাকে সাহায্যকারী নন্দলাল’র কাছে যাবো। তারপর গ্যারেজ লাইনের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা দালালের বাড়ির ঠিকানায় রওনা দিবো।

এই উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাগ কাঁধে ফেলে বড়দি’র বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম। আমার পেছনে বড়দি-সহ অনেক মহিলারা গ্যারেজ লাইন মেইন রোড পর্যন্ত আসলো। জামাইবাবুও বীরপাড়া বাজার থেকে বাড়ি এসে আমাকে না দেখে গ্যারেজ লাইনে এসে কাঁধের ব্যাগ টেনে ধরলো। জামাইবাবু নিজের হাতেই ব্যাগের ভেতরে একটা শাড়ী কাপড়, আর এক পিস জামার কাপড় ও এক পিস প্যান্টের কাপড় ভরে দিলো।

কিছুক্ষণ পর নন্দলাল আসলে দুইজনে রওনা হলাম বর্ডার এলাকায়। ভারত-বাংলাদের বর্ডার এলাকা হলো রংপুর বুড়িমারী স্থলবন্দর। ভারতের ভেতরে বর্ডার এলাকায় গিয়ে সোজা চলে গেলাম দালালের বাড়ি। দালাল ছিলো নন্দলাল’র আগে থেকে পরিচিত। আমার সাথে টাকা ছিলো ভারতীয় ২,৮০০/= টাকা। ভারতীয় দালালের সাথে কথা হলো আমাকে বর্ডার পাড় করে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেওয়া। বিনিময়ে দালালকে দিতে হবে ভারতীয় ৬০০/= টাকা। তারপর আমার কাছে থাকা ভারতীয় টাকা থেকে দালালকে ৬০০/= টাকা দিয়ে বাদবাকি ২,২০০/= টাকা ভাঙানো হলো।

এরপর নন্দলাল আমাকে দালালের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে উনি উনার গন্তব্যে চলে গেলো। আমি থেকে যাই দালালদের বাড়িতে। কথা ছিলো কিছুক্ষণ পরই বর্ডার পাড় করে আমাকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিবে। কিন্তু না, তা আর হয়নি। ওরা আরও যাত্রী সংগ্রহ করার জন্য আমাকে তাদের ঘরে একরকম বন্দি করে রাখলো। সকাল ১১টা থেকে বিকাল পর্যন্ত যখন আর কোনও যাত্রী সংগ্রহ করতে পারছিলো না, তখন আমার সাথে থাকা টাকাগুলো জোর করে কেড়ে নিয়ে গেলো। এমনকি বড়দি’র দেওয়া শাড়ি, জামার কাপড়, প্যান্টের কাপড়-সহ আমার আরও ব্যবহারিক জামা কাপড়গুলো ছিনিয়ে নিলো। এরপর রাতের আঁধারে বাংলাদেশের ভেতরে এনে একটা বাড়ির পেছনে রেখে বললো, ‘এখানে একটু দাঁড়ান, আমরা বাংলাদেশের দালালের সাথে কথা বলে আসি।’ আমি নিরুপায় হয়ে তাদের কথামতো ওই বাড়ির পেছনেই দালালদের জন্য ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু না, তারা আর আসলো না! ওরা আমাকে ওই বাড়ির পেছনে রেখেই পালিয়ে গেলো।

আমি তখন নিরুপায় হয়ে খালি ব্যাগটা হাতে নিয়ে ভয় ভয় মনে বাড়ির ভেতরে গিয়ে কেউ আছেন বলে ডাক দিলাম। আমার গলার আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে কয়েকজন নারী-পুরুষ বের হলো। আমি ছিলাম বাড়ির উঠানে দাঁড়ানো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে আপনি? এখানে এতো রাতে কী করে এলেন? কোথায় যাবেন?’ তাদের কথার জবাবে সবকিছু খুলে বললাম। কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করছিলো না। কেউ বলতে লাগলো, ‘বিডিআর খবর দিয়ে তাদের হাতে উঠিয়ে দিতে।’ ওই বাড়ির একজন মুরুব্বি বললো, ‘লোকটা দুষ্কৃতিকারী হবে।’ আবার দুইএক জন বসলো, ‘না, দুষ্কৃতিকারী হলে এভাবে এখানে আসতোই না।’ তারপর তাদের মধ্যে একজন আমার ব্যাগ সহ সারা শরীর তল্লাশি শুরু করে দিলো।

তল্লাসি করে কিছুই যখন পায়নি, তখন ওদের একটু মায়া মায়া ভাব হলো। আমাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। ভাত নেই, একমুঠো চাল ভেজে সামনে এনে দিল। খেতে পারলাম না। এক গেলাস জল পান করে বসে রইলাম রাত পোহানোর আশায়। রাত শেষে সকাল হলো। ওরা আমাকে বাংলাদেশের বুড়িমারী স্থল বন্দর নিয়ে এলো। ওরা আমাকে বুড়িমারী একটা বাস কাউন্টার দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। বিনিময়ে আমার হাতের ঘড়িটা ওরা নিয়ে গেলো। আমি ধীরেসুস্থে বাস কাউন্টারের ভেতরে প্রবেশ করলাম। বাস কাউন্টারে দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’ বললাম, ‘দাদা আমিতো যাবো ঢাকা। তবে আমি দুর্ঘটনার শিকার!’ বললেন, ‘কোথায় এবং কীভাবে?’ সবকিছু খুলে বললাম। ম্যানেজার সাহেব শুনলেন। আমাকে হোটেলে নিয়ে খাওয়ালেন। ঢাকা পর্যন্ত একটা সিট দিয়ে দিলেন। সাথে ১০০ টাকাও দিলেন। কনট্রাক্টরকে বলে দিলেন, ‘রাস্তায় কিছু খাবার কিনে দিতে।’ গাড়ি ছাড়ল সন্ধ্যার সময়। ঢাকা গাবতলি পৌঁছলাম সকাল ৮ টায়। গাবতলি থেকে আসলাম সদরঘাট। লঞ্চে চড়ে গেলাম, আমার শ্বশুরবাড়ি। যাওয়ার সময় ছেলে-মেয়েদের জন্যও কিছু কিনে নিতে পারিনি, গেলাম খালি হাতে। তবুও আমাকে দেখে আমার ছেলে-মেয়ে দুটো খুবই খুশি। বলতে লাগলো, ‘আমাদের বাবা এসেছে।’ অথচ আমি ভারত গেলাম বড় আশা করে। আর দেশে ফিরলাম নিঃস্ব হয়ে।

যাইহোক, শ্বশুরবাড়িতে দুইদিন ঘোরাফেরা করে কাটালাম। তারপর তাদের বাড়ির নিকটে সুবচনী বাজারের পাশে সান স্লিক টেক্সটাইল মিলে চাকরি নিলাম। সেখানে কিছুদিন চাকরি করে আবার চলে গেলাম নারায়ণগঞ্জ। চাকরি নিলাম আগে কাজ করা মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলে। একসময় ছেলে-মেয়ে দুটোকে স্কুলে ভর্তি করালাম। মেয়ে এসএসসি পাস করার পর ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে গোপালগঞ্জের এক ছেলের সাথে বিয়ে দিলাম। ছেলে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ২০১১ সালের ২০ মে হঠাৎ না ফেরার দেশে চলে গেলো। ছেলের রেখে যাওয়া Nokia c-3 মোবাইল দিয়ে ইন্টারনেটের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়লাম। একসময় ব্লগ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম নামে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে নোকিয়া মোবাইলে ইংরেজি অক্ষরে লিখে একটা লেখা জমা দিলাম। সময়টা তখন ২০১৫ সাল।

কিন্তু ওই ব্লগে ইংরেজি লেখা প্রকাশ করা হয় না। আমিও দীর্ঘদিন ব্লগে চুপি দিই না। অনেকদিন পর ওই ব্লগে চুপি দিয়ে দেখি আমার ইংরেজি অক্ষরের লেখা বাংলা করা হয়েছে এবং লেখার শিরোনাম বাংলায় লিখতে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু নোকিয়া মোবাইলে তো বাংলা লেখা যায় না। আমার অবস্থা তখন “কী করি ভেবে মরি” এই অবস্থার মতো। তারপর আমি যাদের কাজ করতাম, তাদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার-কর্জ করে একটা সিম্ফনি এন্ড্রয়েড মোবাইল কিনে ওই ব্লগে জমা দেওয়া লেখার শিরোনাম বাংলায় লিখলাম, “আমিও মানুষ”। এরপর লেখা প্রকাশ হলো। লেখায় অনেক ব্লগাররা মন্তব্য করলো। সেসব মন্তব্যের জবাব দিতে গিয়েই ব্লগ, ফেসবুক -সহ অনলাইন ভিত্তিক দিনলিপি গুলোতে নিয়মিত লেখালেখির সাথে মিশে গেলাম।

একসময় ২০১৭ সালে ব্লগ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকে সবার সহযোগিতায় সম্মাননাও পেয়েছিলাম। সেই থেকে আজ অবধি অভাবী সংসারের একবেলা খাবার না থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হয় আমার মোবাইলে ইন্টারনেট না থাকলে আর লেখালেখি করতে না পারলে। বর্তমানে এই লেখালেখিই যেন আমার অবশিষ্ট জীবনের নিশ্বাস। মনে হয় লেখালেখি বন্ধ হবে তো আমার নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই শত চেষ্টা করেও লেখালেখি বন্ধ করতে পারছি না। শত কষ্টের মাঝেও কিছু-না-কিছু লিখেই যাচ্ছি। কিন্তু আমার এই নগন্য লেখা কে পড়লো আর কে পড়লো না, সেদিকে আমি ফিরে তাকাই না। আমি লিখেই যাচ্ছি, আমার শহরের গল্প, দুখী মানুষের গল্প আর আমার চলিত জীবনের গল্প।
সমাপ্ত।

জীবনের গল্প-১
জীবনের গল্প-২
জীবনের গল্প-৩
জীবনের গল্প-৪
জীবনের গল্প-৫
জীবনের গল্প-৬
জীবনের গল্প-৭
জীবনের গল্প-৮
জীবনের গল্প-৯
জীবনের গল্প-১০
জীবনের গল্প-১১
জীবনের গল্প-১২
জীবনের গল্প-১৩
জীবনের গল্প-১৪
জীবনের গল্প-১৫
জীবনের গল্প-১৬
জীবনের গল্প-১৭
জীবনের গল্প-১৮
জীবনের গল্প-১৯
জীবনের গল্প-২০
জীবনের গল্প-২১
জীবনের গল্প-২২
জীবনের গল্প-২৩
জীবনের গল্প-২৪
জীবনের গল্প-২৫
জীবনের গল্প-২৬
জীবনের গল্প-২৭
জীবনের গল্প-২৮
জীবনের গল্প-২৯

জীবনের গল্প-২৯

Image-64-1

জীবনের গল্প-২৮ এর শেষাংশ: বুঝেশুঝেই দিবে। আমি বড়দি’র কথা শুনে মুচকি হেসে দিদির বাড়ির ভেতরে গেলাম। আর মনে মনে বলতে লাগলাম, ‘দিদি আমরা বাংলাদেশি লোকেরা এরকমই। খরচের কাছে আমরা কখনোই হার মানি না।’

দিদির সাথে গেলাম বাড়ির ভেতরে। সাথে দিদির বাড়ির আশেপাশে থাকা আরও কয়েকজন ছিলো। এর পরমুহূর্তেই মধ্যেই দিদির বাড়ির আশেপাশের বাড়িতে খবর পৌঁছে গেলো। রবিন্দ্র নগর কলোনি এরিয়াতে থাকা প্রত্যেক বাড়ির মহিলা-পুরুষ দিদির বাড়ি আসতে লাগলো। সবাই বলতে লাগলো, ‘এতো বছর পর বুঝি দিদির কথা মনে পড়লো?’ কেউ আবার তাদের বাংলাদেশে থাকা বাড়ি-ঘরের কথাও জিজ্ঞেস করতে লাগলো। ওখানে বসবাসকারী বেশিরভাগ বাঙালি হিন্দুদের পূর্বপুরুষদের বাড়ি একসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাশহরে ছিলো। কারোর বাড়ি ফরিদপুর, কারোর বাড়ি মুন্সিগঞ্জ, কারোর বাড়ি গোপালগঞ্জ। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে কারোর আত্মীয়স্বজনের বাড়ি নেই। তাই কেউ নারায়ণগঞ্জের কথা জিজ্ঞেস করেনি। এমনকি আমার জন্মভূমি নোয়াখালীর কথাও কেউ জিজ্ঞেস করেনি। আমি তখন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলাম, ‘এখানে থাকা কারোর বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সাইডে আছে কি-না?’ তখন আমার কথা শুনে সবাই বলছে, ‘না গো না। নারায়ণগঞ্জ নাম শুনেছি, কিন্তু কখনো সেখানে যাইনি। আমাদের কোনও আত্মীয়স্বজনও নারায়ণগঞ্জ থাকে না।’

আমার বড়দি বললেন, ‘আমার যখন বিয়ে হয়েছিল, তারও আগে থেকেই আমার বাবা, বড়দা নারায়ণগঞ্জ থাকতেন।’ বড়দির কথার শুনে আমি বললাম, ‘দিদি বাবা যেখানে চাকরি করতেন বা থাকতেন, সেই মিলের নামটা কি আপনার মনে আছে?’ আমার বড়দি বললেন, ‘নামটাতো পেটে আছে, কিন্তু মুখে নেই!’ আমি বললাম, সেই মিলের নামটা ছিল, আদর্শ কটন মিলস্। আমার কথা শুনে আমার বড়দি আবারও কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘হ্যাঁ রে হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। ঐ আদর্শ মিলে মায়ের সাথে আমিও একবার গিয়েছিলাম। বড়দাও সেখানেই চাকরি করতেন, তাইনা রে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ দিদি, দাদাও সেই মিলেই চাকরি করতেন।’

তখন আমার কথা শুনে বড়দি, জামাইবাবু, ভাগিনা-ভাগ্নি-সহ সবাই শতভাগ নিশ্চিত হতে পেরেছিল যে, এটা আমার ভাই, আর এটা আমার শালা, আর এটা আমাদের মামা। কিন্তু এর আগে আমি তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম বড়দি, আর জামাইবাবু দুইজনের মনের ভেতরে কেমন যেন একরকম সন্দেহের ভাব! সন্দেহের কারণ হলো, “ও-কি সত্যিই সেই কোলের শিশু নিতাই? নাকি অন্য কেউ?” যখন ঠিকঠাক সব বলতে পেরেছিলাম, তখনই তাদের মনের ভেতরকার সন্দেহটা দূর হয়েছিলো।

এর মধ্যে বড়দির কাছে মা-বাবা স্বর্গীয় হবার কথা বললাম। জামাইবাবু, দিদি দুইজনেই হায়-আফসোস করলেন। দিদি মা-বাবার কথা বলে কাঁদলেন। দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই কি বিয়ে করেছিস?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ দিদি। একটা গরিবের মেয়েকে বিয়ে করেছি। দুইজন বাচ্চাকাচ্চাও আছে। একজন মেয়ে, আরেকজন ছেলে।’ তারপর আমার বড়দি আমাকে দেখতে আসা সবাইকে একটা করে মিষ্টি দিলো। সবাই তখন হাসাহাসি করে বলতে লাগলো, ‘দিদি, ‘আপনার ভাই কি বাংলাদেশ থেকে মিষ্টি গুলো এনেছে নাকি?’ আমি বললাম, ‘আমি যখন বাংলাদেশি, মনে করেন মিষ্টিও বাংলাদেশি। বলতে পারি আপনাদের এখানে এমন সুস্বাদু মিষ্টি পাওয়া যাবে না, তা আমি শতভাগ নিশ্চিত। এগুলো উন্নতমানের এবং খুবই দামি মিষ্টি।’ আমার কথা শুনে সবাই হাসতে লাগলো। আবার কেউ কেউ বলতে লাগলো, ‘জয় বাংলার লোক বড় চালু।’ আমার বড়দি বললো, চালু না হলে কি আর বাংলাদেশ থেকে একা একা এখানে আসতে পেরেছে? যাক না ক’দিন, তারপর সবাই বুঝবে আমার ভাই কত চালু!’

এরপর আমি সাথে নেওয়া ব্যাগটা খুললাম। ব্যাগ খুলে দিদির জন্য কানাইর দেওয়া শাড়িটা বের করে দিদির হাতে দিলাম। দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা আবার কেন নিয়ে এসেছিস। এটা কী ভারতের? না কি বাংলাদেশি? এমনিতেই কতো কষ্ট করে বাংলাদেশ থেকে এসেছিস। এতো বছর পর যে তোকে দেখতে পেরেছি, তাতেই আমি খুশি।’ আমি বললাম, ‘দিদি এই শাড়িটা কোলকাতায় থাকা আমার বন্ধু দিয়েছে। ওর নাম কানাই। ওর সাথেই কোলকাতা এসেছিলাম। শাড়িটা আপনার পছন্দ হয়নি?’ দিদি বললেন, ‘হ্যাঁ পছন্দ তো হয়েছে রে, তো আমি এই স্লিকের শাড়ি কখনোই পড়ি না। এটা বরং তোর বড় ভাগ্নিই পড়বে।’ বললাম, ‘তা আপনার খুশি!’ এভাবে কথা বলতে বলতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে লাগলো। বড় ভাগিনা খবর পেয়ে ওর গ্যারেজ বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বাসায় এসে আমাকে প্রণাম করলো। ওর ছোট দুই ভাই তখনো নিজেদের কাজে ব্যস্ত ছিলো।

আমার তিন ভাগিনা আর এক ভাগ্নি। দুই ভাগিনা মোটেও লেখাপড়া জানে না। তার মানে হলো, ওরা কোনো সময় স্কুলেই যায়নি। আমার বড়দির বিয়ের ১৫দিন পর এই ভারতে আসা। তখন তারা থাকতো বীরপাড়া থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে, ফালাকাটা নামক স্থানে। আমার জামাইবাবু ছিলেন একজন নেশার রাজা। তাকে নেশার সম্রাটও বলা চলে। কেননা, নেশার জগতের এমন কোনও নেশা বাদ নেই, যা আমার শ্রদ্ধেয় জামাইবাবু গ্রহণ করেননি। আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম তখনো দেখেছি জামাইবাবুর সাথে অনেকরকম মাদকের নেশা জড়িয়ে আছে। কাচ্চি মদ, বিড়ি, পান, নশ্বি (যেটা নাক দিয়ে টানে- হুবহু আমাদের দেশের শাহাজাদা গুল-এর মতন দেখতে), চা, মাঝেমাঝে সিদ্ধিও (গাঁজা) টানে। এর কারণেই আগে আমার বড়দির সংসারটা ছিল একেবারে এলোমেলো। মোট কথা নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা ছিল।

ছোট ভাগিনা দুজন যখন একটু বড় হলো, তখন স্কুলের চিন্তা না করে বড়দি নিজের সংসারের চিন্তা করে ওদের গাড়ির গ্যারেজে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। এরপর আস্তে আস্তে আমার বড়দি’র সংসারের অবস্থা একটু পরিবর্তন হলো লাগলো। একসময় ছেলে দুটোর রোজগারের টাকা দিয়ে বাড়ি করেছে। বাড়িতে রড-সিমেন্টের দালান তৈরি করেছে। বাড়িতে বাসা ভাড়াও দিয়েছে। জামাইবাবু নেশার জগতের সম্রাট হলেও, নিজের তামাকের ব্যবসা তখনো ছিলো। সেখানকার প্রায় লোকেরা তামাক, বিড়ি, পান-সিগারেট, মদ-গাজার নেশা বেশিরভাগ মানুষেই কম-বেশি করে থাকে।

তবে আমার গুনধর জামাইবাবু ছিলো সবার উপরে। মানে অষ্টধাতু যাকে বলে! সেখানকার প্রায় মানুষের নেশার অভ্যাস থাকার কারণে সেখানে তামাকের ব্যবসাটা হলো রমরমা ব্যবসা। আমার জামাইবাবু তামাকের ব্যবসাটা ছিলো আদি ব্যবসা। উনি নেশা-পানি যা-ই করুক-না-কেন, তামাকের ব্যবসা ছিলো উনার নিয়মিত। আগে এমন নিয়মিত ছিলো না। একদিন মদ পান করে বেহুঁশ হলে তিনদিন আর তামাকের গাট্টি নিয়ে বাজারে যেতো না। আগে যদি ব্যবসায় এমন নিয়মিত থাকতো, তাহলে আমার ভাগিনা-ভাগ্নিদের লেখাপড়া হতো। হয়নি শুধু আমার গুণধর জামাইবাবু কারণেই। জামাইবাবু ওমন উড়াউড়ির ভাবের জন্যই বড়দি ছেলে দুটোকে স্কুলে পাঠাতে পারেনি। আজীবনের জন্য বকলমই বানিয়ে রেখেছে।

তবে আমার ভাগিনা দুটো লেখাপড়া না করলেও মনেরমত কাজ শিখেছে। কাজ হলো গাড়ির মেকারের কাজ। এমন কাজই ভাগিনা দুটো শিখেছে যে, একটা চলন্ত গাড়ির শব্দ শুনে বলে দিতে পারে গাড়িটার সমস্যার কথা। বড় ভাগিনা অনেক আগেই ওস্তাদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে, নিজেই আলাদাভাবে মিস্ত্রির কাজ করছে। মেজো ভাগিনা তখনো পরের গ্যারেজে কাজ করছিলো। বেতন হলো সপ্তাহে মাত্র ৩০০ টাকা। বেতন ছাড়াও সাথে কিছু এদিক-সেদিক ছিলো। বেতন ছাড়া এদিক-সেদিক যা পেতো, তা আর গ্যারেজ মালিক নিতো না। এদিক-সেদিকের উপার্জনের টাকা দিয়েই সারা সপ্তাহের পকেট খরচ হয়ে যেতো।

ভাগিনা দুটো লেখাপড়া জানে না, কিন্তু ভারতের সবকটি প্রদেশের ভাষা ওদের আয়ত্তে। ইংরেজিতেও কথা বলতে পারে। সবার ছোট ভাগিনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে অস্থির হয়ে গেছে। লেখাপড়া করার কষ্ট সইতে না পেরে শেষ অবধি লেখাপড়া ছেড়েই দিয়েছে। তবে বেকার নয়। রাস্তার পাশে ওদের একটা দোকান আছে। সেই দোকানটায় বসে পান-বিড়ি-সিগারেটের ব্যবসা করে। ভাগ্নির কপালেও বেশি লেখাপড়া লাগতে পারেনি। ক্লাস ফাইভ পর্যন্তই শেষ! অথচ এই ভারতের বাড়িতে প্রায় সকল মানুষেই কমবেশি শিক্ষিত। এমনও দেখেছি, মা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেও সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে শিক্ষিত করে তুলেছে। আর সেখানে আমার ভাগিনা-ভাগ্নি একেবারেই বকলম!

যাইহোক, সেদিন বড়দি’র কাছে উনার দুঃখ-সুখের কথা শুনতে শুনতে একসময় বড় ভাগিনা আমার সামনে এসে বললো, ‘মামা আমার সাথে চলো।’ ভাগিনার কথা শুনে দিদি বললো, ‘ওকে কোথায় নিয়ে যাবি? ও এসেছে অনেকক্ষণ হয়। এখনো খাওয়া-দাওয়া কিছুই করেনি। বাজারে গেলে আগে তোর মামাকে কিছু খাইয়ে দিবি।’ ভাগিনা বললো, ‘ঠিক আছে মা। এ নিয়ে তোমার মাথাব্যথার দরকার নেই। চলো মামা চলো।’ আমি ভাগিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাবে শুনি? এখান থেকে কতটুকু দূরে?’ ভাগিনা বললো, ‘এইতো মামা এখানেই। তুমি বাস থেকে যেখানে নেমেছ, সেখানেই। আমাদের বীরপাড়া বাজারে। চলো মামা, মজা হবে খুব। আজ বাজারের পাশেই একটা অনুষ্ঠান আছে। তোমাকে নিয়ে সেখানেই যাবো।’

মজার কথা শুনে ভাগিনার সাথে রওনা দিলাম। রাস্তায় দিয়ে হাঁটা অবস্থায় ভাগিনা আমাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘মামা তুমি সিগারেট টানো না-কি?’ বললাম, ‘হ্যাঁ মামা অভ্যাস আছে।’ ভাগিনা আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘মামা তুমি কী সিগারেট টানো?’ বললাম, কমদামী একটা হলেই হয়ে যায়।’ আমার বড় ভাগিনা রাস্তার পাশে দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আমার পকেটে ভরে দিল। এরপর মামা-ভাগিনা হাঁটা ধরলাম বীরপাড়া বাজারের দিকে।

হেঁটেই যাচ্ছি দুজনে। কারণ, দিদির বাড়ি থেকে বীরপাড়া বাজার অল্পকিছু দূরে। যাচ্ছি পায়ে হেঁটে। তখন সন্ধ্যা হয়েছিলো প্রায়। সেখানে সন্ধ্যার পরে বেশিক্ষণ দোকানপাট খোলা থাকে না। কারণ, সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই খেটে খাওয়া। সরকারি অফিস-আদালত তেমন নেই। আছে শুধু একটা পোস্ট অফিস, একটা পুলিশ ফাঁড়ি, আর দু-একটা বেসরকারি ব্যাংক ও বীমার অফিস। পুরো এলাকার দুই দিকেই পাহাড়। ভুটান সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকা হলেও পাকা রাস্তা। প্যাঁক-কাদা কাউকে ডিঙাতে হয় না। গাড়িঘোড়ার বেশি একটা চাপ নেই। রাস্তার পাশে লাইট পোস্ট আছে। আমাদের শহরের মতন প্রতিদিন বিকালবেলা সেখানে বাজার মেলে না। বাজার বলতে বলা যায়, স্থায়ীভাবে থাকা মার্কেট আর কিছু দোকানের টুকটাক বেঁচা-কেনা।

ভাগিনার সাথে গেলাম বীরপাড়া বাজারে। ভাগিনা বাবাজি আমাকে নিয়ে প্রথমেই ঢুকলো একটা মিষ্টির দোকানে। আমি বাস থেকে নেমে যেই দোকান থেকে মিষ্টি কিনেছিলাম, সেই দোকানেই। কিন্তু আমি সেখানে নতুন, তাই ফলো করতে পারিনি। দোকানদার আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। দোকানদারের মৃদু হাসি দেখে আমার ভাগিনা দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘হাসলেন কেন?’ দোকানদার বললো, ‘উনি কি তোমার মামা?’ ভাগিনা বললো, ‘হ্যাঁ, আপনি জানলেন কী করে?’ দোকানদার বললো, ‘আ-রে উনিতো কয়েক ঘন্টা আগে আমার দোকান থেকে মিষ্টি কিনে নিয়েছে। আমি একটা রিকশা ডেকে তোমাদের বাড়িতে পাঠিয়েছি। চিন্তায় ছিলাম, রিকশাওয়ালা ঠিকমত তোমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে কিনা। অবশ্য কিছুক্ষণ পরই রিকশাওয়ালা এসে আমার কাছে বলেছে। এখন ওনাকে দেখে খুব ভালো লাগলো, তাই হাসলাম। বসো বসো। কী খাবে তোমরা?’ দোকানদারের কথা শুনে আমার ভাগিনাও হেসে বললো, ‘ওহ্ আচ্ছা, তাই নাকি কাকা! আমিতো ভাবছিলাম আবার অন্যকিছু। জাগগে, আমাদের এক প্লেট করে রসমালাই আর দুটো করে নিমকি দিন।’

মিষ্টির দোকানের কর্মচারী আমাদের নিমকি আর রসমালাই দিলো। আমিও খেলাম, আমার ভাগিনাও খেলো। খুবই সুস্বাদু রসমালাই। যেই রসমালাইয়ের জুড়ি নেই। দোকানদারকে খাবারের দাম বুঝিয়ে দিয়ে দোকান থেকে বের হলাম। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়ে গেছে। ভাগিনার সাথে পুরো বীরপাড়া বাজারটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। খুবই সুন্দর এক বাজার। দু-একটা টিনের চালের ঘর। আর দু’একটা ইটের দালান ঘর। বাদবাকি সব ঘরই টালির চালের ঘর। সেখানে টালির চালের ঘরই বেশি। কারণ হলো, টিনের চালের ঘরে নাকি গরম লাগে। ঘর ঠাণ্ডা থাকার জন্যই, সেখানকার মানুষে টালির চালই বেশি পছন্দ করে।

বাজারের পাশেই চা বাগানীদের কোয়ার্টার। দেখতে দেখা যায় আমাদের দেশের সরকারি সুইপার কলোনির মতন। ওদের শরীরের রঙ কালো হলেও ওদের ঘরদোর খুবই পরিস্কার। প্রতিদিন ওদের কলোনির সামনেই ওরা ওদের নিজেদের তৈরিকৃত মদ কেনাবেচা করে থাকে। ওদের নিজেদের বানানো মদের নাম হাড়িয়া। দেখতে হুবহু আমাদের দেশের মাঠা’র মতো।

ভাগিনার সাথে ঘুরেফিরে দেখে চলে এলাম বীরপাড়া বাজারে। ভাগিনা বাবাজি একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেলো। ‌‌‍দোকানের ভেতরে গিয়ে বসলাম। দোকানটা মাচাংঘর। কিন্তু খুব সুন্দর! ভাগিনা দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিলো। দোকানদার হলো একজন নেপালি মেয়ে। দোকানে আবার মদও বিক্রি করে। মদের মধ্যে ভুটানি আর নেপালি মদই বেশি। সাথে আছে ওদের নিজেদের তৈরি মদ। ওখানে নেপালীরা যে মদ তৈরি করে, সেই মদ’কে ওখানকার ভাষায় বলে কাচ্চি মদ। আমরা বাংলাদেশে এগুলোকে বাংলা মদ বলে থাকি। চা পান করে দোকান থেকে বের হলাম। তবে দোকানটা চিনে রাখলাম আবার আসবো বলে।

তখন বৈশাখ মাস। এই বৈশাখ মাসের শুরুতে সেখানে নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। প্রতিটি পাড়া মহল্লায় আর রাস্তাঘাটে। পুরো ভারতের মানুষই সংস্কৃতি প্রিয়। যাত্রা, নাটক, থিয়েটার, সিনেমা এসব ওদের কাছে খুবই আনন্দের। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরাও নিজের মহল্লায় নানারকম গান-বাজনার আয়োজন করে। ভাগিনা বাবাজি বাজারের পাশে আমাকে নিয়ে গেলো। দূর থেকেই রবীন্দ্র সংগীতের আওয়াজ আমার কানে আসছিলো। ভাবলাম ভাগিনা বাবাজি মনে হয় এখানকার কথাই বলেছিল। আমার ধারণায় ঠিক তা-ই হয়েছিল।

সেখানে প্রতি বছরই বৈশাখ মাসের ২৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। তারই ধারাবাহিতায় বাজারের সব দোকানদাররা কবিগুরু স্মরণে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সেই অনুষ্ঠানেই ভাগিনা বাবাজি আমাকে নিয়ে গেল। বসার সিট নেই। ভাগিনা সহ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ রবীন্দ্র সংগীত শুনলাম। এরপর বাসায় চলে এলাম। রাত তখন আনুমানিক ৮ টার মতন বাজে। দিদির বাড়িতে তখনো কেউ ঘুমায়নি। সবাই ঘরে বসে টেলিভিশনে কবিগুরু রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান দেখতে ছিল।

চলবে…

জীবনের গল্প-৩০ শেষ পর্ব এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২৮

Image-64

জীবনের গল্প-২৭ এর শেষাংশ: তারপরও তার অভাব নেই! এই টাকা দিয়েই তার ছোট সংসার খুব সুন্দরভাবে চলছে। জানলাম রিকশাওয়ালার কাছ থেকে। প্রায় ১০ মিনিট হতে-না-হতেই রিকশাওয়ালা আমাকে বলছে, ‘ও-ই যে রবীন্দ্র নগর কলোনি দেখা যাচ্ছে, দাদা।’

রিকশা চড়ে যাচ্ছিলাম, রবীন্দ্র নগর কলোনির দিকে। রাস্তার দু’পাশে বড়বড় নানারকম পুরানো গাছ। সেখানে ইটপাটকেলের তৈরি দালানঘর খুব কম। যা দেখা যায়, তা প্রায় সবই বাঁশখুটি ও কাঠের তৈরি টিনের ঘর। মাঝে-মাঝে ভুটানিদের কাঠের টংঘর। টংঘরের নিচে শুকর, ভেড়া, মুরগির খামার। উপরে থাকে ভুটানিদের থাকার ব্যবস্থা। ঘরগুলো দেখতে খুবই সুন্দর! বাড়ির চারদিকে নানারকম ফুলগাছ লাগানো থাকে। থাকে সুপারি গাছ সহ নানারকম ফল-ফলারি গাছও। অন্যান্য গাছের মধ্যে সেখানে সুপারি গাছই বেশি। হঠাৎ রাস্তার পাশে থাকা একটা দোকানে আমার চোখ পড়লো। দোকানটি খুব সুন্দর! একটি মেয়ে দোকানে বসা। পরনে লাল জামা আর তোয়ালের মতন ঘাগরি। এই পোষাক ওদের ঐতিহ্যবাহী পোষক। একে তো সাদা চামড়ার মানুষ, তার উপর লাল জামা ঠাঁসানো। দেখে মনে হচ্ছে গোধূলি লগ্নের লাল টুকটুকে সূর্যটা। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই এই দোকানে কি সিগারেট পাওয়া যাবে?’

রিকশাওয়ালা বলল, ‘আজ্ঞে দাদা আপনার সিগারেট দরকার? সামনে আরও অনেক দোকান আছে। সেখান থেকে নাহয় নিয়ে নিবেন?’ আমি একটু জোর করেই বললাম, ‘দাদা এই মেয়েটির দোকান থেকেই নিয়ে নেন। আমার খুব সিগারেটের নেশা পেয়েছে।’ কিছুক্ষণ আগে মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি খেয়েছি তো, তাই এখন সিগারেটের দরকার। না হলে আমার বমি বমি ভাব হচ্ছে। আমার কাছে একটি সিগারেটও নেই। যদি দয়া করে এই দোকানটার সামনে একটু রাখতেন, তাহলে আমি এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিতাম।’ আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা তার রিকশা থামিয়ে বললো, ‘আচ্ছা দাদা ঠিক আছে, দোকানের সামনে যাচ্ছি।’

রিকশাওয়ালা দোকান ছড়ে একটু সামনে গেলেও, আমার কথা শুনে আবার দোকানের সামনে আসলো। দোকানে থাকা মেয়েটিকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, ‘দিদি আপকা কাছ সিগারেট হ্যায়? মেয়েটি বলল, ‘কিসকা সিগারেট চাইয়ে, ভাইয়া?’ সিগারেটকা নাম বাতাইয়ে?’ ওখানকার মানুষে ভারতের প্রায় সকল ভাষাই জানে। যখন যেই ভাষা দরকার, সেই ভাষাই তারা ব্যবহার করে। আমার যদিও হিন্দি ভাষা জানা নেই, তবু একটু আধটু বুঝি। তবে বলতে পারি না। রিকশাওয়ালা আর মেয়েটির কথা শুনে রিকশাওয়ালাকে বললাম, ‘দাদা দোকানদার মেয়েটি কি বাংলা জানে না?’ রিকশাওয়ালা বললো, ‘জানে দাদাবাবু, জানে। ওরা নেপালি। ওদের নিজস্ব ভাষা আছে। তারপরও আমাদের ইন্ডিয়ার সব ভাষাই ওদের জানা আছে। তবে দাদা ওরা বেশিরভাগ হিন্দি, নেপালি, আর ভুটানি ভাষাই ব্যবহার করে থাকে। এখন বলুন, আপনি কী সিগারেট কিনবেন?’ আমি রিকশাওয়ালাকে বললাম, ‘দাদা, এখানকার সিগারেটের নামতো আমার জানা নেই! আপনার পছন্দমতো ভাল এবং বেশি দামের এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নেন।’

তখন কিন্তু সিগারেট আমার কাছে ছিলো। সিগারেট থাকা সত্ত্বেও মেয়েটিকে একটু ভাল করে দেখার জন্য এই ভাণ করালাম। রিকশাওয়ালা আমাকে বলল, ‘আজ্ঞে দাদা, আপনি রিকশা থেকে নেমে দেখিয়ে দিন। এখানে অনেকরকম সিগারেট আছে। আপনি যেটা চাইবেন, ঠিক ওটাই আপনাকে দিবে।’ আমি রিকশাওয়ালার কথা শুনে রিকশা থেকে নেমে দোকানের সামনে গেলাম। দেখি দোকানে চায়ের ব্যবস্থাও আছে। দোকানে সাজানো আছে, ভারতি, নেপালি, আর ভুটানি মদের বোতল। তবে ওখানে ভুটানের মদ-ই বেশি চলে। সেখানে রাস্তা-ঘাটে, হাট-বাজারে সবখানে বসেই, মদপান করা যায়। এমনকি চলন্ত বাসে বসেও অনেকে মদপান করে থাকে। কেউ কাউকে কিছু বলার সাহস পায় না। তবে ওরা যতই মদ্যপ হোক না কেন, মাতলামি খুব কমই করে থাকে। আর যেকোনো পূজাপার্বণে মানুষের ফ্যামিলি বাসায়ও, সবাই মিলে-মিশে মদপান করে থাকে। কি ছেলে, কি বুড়ো। মদ যেন তাদের পূজার প্রসাদ। মদ ছাড়া ওখানকার মানুষের কোনকিছু শুদ্ধ হয় না।

নেপালী মেয়েটির দোকানে চায়ের কেতলি দেখে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা আপনার চায়ের অভ্যাস আছে?’ রিকশাওয়ালা খুশিমনে বললো, ‘হ্যা দাদাবাবু আছে! আপনি আমাকে চা খাওয়াবেন? ওখানে কেউ কাউকে সহজে এক কাপ চা, অথবা একটা পাতার বিড়িও দেয় না। নিজের পকেটে বিড়ি থাকতেও পরের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে নেয়। রিকশাওয়ালা তাই খুশিতে আমকে জিজ্ঞেস করছে, “দাদাবাবু আপনি আমাকে চা খাওয়াবেন?” আমি হেসে বললাম, ‘হ্যা, খাওয়াবো মানে? নিশ্চয় খাওয়াবো। মেয়েটিকে বলুন আমাদের দুই কাপ চা বানিয়ে দিতে।’ আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা দোকানী মেয়েটিকে বাংলায় বললো, ‘দিদি আগে আমাদের দু’কাপ চা বানিয়ে দিন। পরে নাহয় সিগারেট দিবেন।’ এবার রিকশাওয়ালা মেয়েটির সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলার তার মানে হলো, রিকশাওয়ালা আমাকে বুঝিয়ে দিল যে, মেয়েটিও বাংলা কথা বোঝে বা জানে। জবাবে মেয়েটি বলল, ‘ঠিক আছে দাদা, একটু বসেন। আমি আপনাদের চা বানিয়ে দিচ্ছি।’

আমরা দুজনেই দোকানের ভেতরে একটা টেবিলের পরে বসলাম। মেয়েটি চা বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেখানকার চা বানানোর খুব সুন্দর সিস্টেম। যা হবে তা নগদনারায়ণ। মেয়েটি একটা পাত্রে কিছু পরিমাণ তরল দুধ একটা পাত্রে ঢেলে, কেরোসিনের জ্বলন্ত স্টোভের উপরে রাখলো। অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই দুধ গরম হয়ে গেল। তারপর সেই গরম দুধে চা-পাতা আর চিনি মিশিয়ে দিল। ছাকনি দিয়ে ছেঁকে দুই কাপ চা দুইজনকে দিল। আমরা চা পান করলাম। বেশ মজাদার চা। গরুর খাটি দুধ দিয়ে তৈরি চা। তাও কাঁচা চা-পাতার তৈরি। এই চায়ের স্বাদই আলাদা। প্রতি কাপ চায়ের দান ভারতীয় ৬০ পয়সা। এক প্যাকেট সিগারেট নিলাম, দাম মাত্র ১০টাকা। সিগারেটের নাম, চার্ম। ফিল্টার কিং সিগারেট। সেখানকার লোকেরা এতো দামি সিগারেট খুবই কম মানুষেই টানে। সবাই হিসেব করে চলে। অকারণে অযথা কেউ একটি কানাকড়িও খরচ করে না। তাদের ধূমপানের মধ্যে বেশি প্রিয় হলো, শাল পাতার বিড়ি। সে হোক ধনীর দুলাল! হোক সে ফকির। বেশিরভাগ মানুষেই পাতার বিড়ি টানে। কারোর সম্মান অসম্মানের দিকে কেউ ফিরে তাকায় না। সবাই সবার নিজের ধান্ধায় মশগুল থাকে।

এরপর দোকানী নেপালী মেয়েটিকে ১১ টাকা ২০ পয়সা দাম দিয়ে, আবার ওঠলাম রিকশায়। আসার সময় দোকানদার মেয়েটি রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই আপনার রিকশায় লোকটির বাড়ি কোথায়?’
রিকশাওয়ালা জবাব দিল, ‘বাংলাদেশ দিদি বাংলাদেশ।’
নেপালী মেয়েটি মুচকি হেসে বললো, ‘হুম, বহ্যত আচ্চা। এখন যাবে কোথায়?’ রিকশাওয়ালা জবাব দিলো, ‘উনি রবীন্দ্র নগর কলোনি যাবে। ওনার বড়দিদির বাড়িতে। কোলকাতা থেকে এসেছে কেবল।’ আমি রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাংলাদেশ বললেন? আপনি কীভাবে জানেন যে, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি?’ রিকশাওয়ালা বললো, ‘দাদা, আপনার বাড়ি বাংলাদেশে তা আমি জেনেছি, ঐ মিষ্টি দোকানদারের কাছ থেকে। তিনি আমাকে বলেছে, আপনার বাড়ি বাংলাদেশ। তাই বললাম দাদাবাবু। আমি রিকশাওয়ালাকে আর বেশি কিছু বলিনি। রিকশা চলছে, মেইন রোড ছেড়ে মহল্লার আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে। যাচ্ছে রবীন্দ্র নগর কলোনির দিকে। আমার মনের ভেতরে অনেক চিন্তা। শুধুই ভাবছি, আমার দিদি, জামাইবাবু ও ভাগিনা ভাগ্নিদের নিয়ে। দিদির সামনাসামনি গিয়ে, কীভাবে পরিচয়টা দিলে ভাল হবে, সেই চিন্তাই আমার মনের ভেতরে ঘুরপাক বেশি খাচ্ছিলো।

দুপুর শেষে বিকালের আগমন। দিদি’র ঘেঁষা চা-বাগান। চা-বাগান থেকে চা-পাতা তোলার মহিলারা আসছিল সারিবদ্ধভাবে। সেখানকার মানুষে তাদের বলে বাগানী। এদের সবার পেছনে ঝুলানো আছে, চা-পাতার ঝুড়ি। চা-বাগানে চা-পাতা সংগ্রহে নিয়োজিত থাকে বিহারের আদিবাসী মানুষগুলো। সেসব জনগোষ্ঠীদের সেখানকার ভাষায় বলে, মদোসিয়া। এদের গায়ের রঙ কালো কুচকুচে কালির মতন। দেখতে হুবহু নিগ্রোদের মতন। যা দেখলাম, রিকশা দিয়ে আসার সময়। আমার চোখে তারা কালো বর্ণের হলেও, তাদের চোখে তারা খুবই সুন্দর। এই কালো বর্ণের মাঝেও নাকি সুন্দরী মেয়ে অনেক আছে। এরা বেশিভাগ সময়-ই নেশার তালে মগ্ন থাকে। পথে-ঘাটে, পূজা-পার্বণে, হাটা চলায় সবসময়, সবখানে এরা মদপান করবেই। মদ ছড়া ওদের যেন উদ্ধার নেই। এরা রাস্তার পাশ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে লাইন ধরে তাদের গন্তব্যে যাচ্ছে। আগে যাবে হয়তো তাদের কারখানায়। সারাদিনের সংগ্রহ করা চা-পাতা কারখানায় বুঝিয়ে দিয়ে, পরে হয়তো নিজেদের ঘরে যাবে। এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে গেলাম রবীন্দ্র নগর কলোনিতে।

রবীন্দ্র কলোনির মাঝখান দিয়ে রাস্তা। রিকশা যাচ্ছিল রবীন্দ্র নগর কলোনির গলি দিয়ে। পুরো রবীন্দ্র নগর কলোনিতে দুইটা গলি। গরমের দিন, কিন্তু আকাশ পরিষ্কার। বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা নেই। ভুটান সংলগ্ন এলাকা। দিদির বাড়ির সন্নিকটে ভুটানের সুউচ্চ পাহাড়। সেখানে বৃষ্টির দিনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। রবীন্দ্র নগর কলোনি বীরপাড়া বাজার থেকে সামান্য একটু দূরেই ভুটান। এই রবীন্দ্র নগর কলোনিতে আগে চা-বাগানের কিছু উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের বাসভবন ছিল। হয়তো কারোর নাম রবীন্দ্র ছিল। তাই এর নামকরণ হয়েছে রবীন্দ্র নগর কলোনি। অনেক আগে থেকেই চা-বাগানের ওইসব কর্মকর্তাদের বাসভবনের আশে-পাশে বহিরাগতের বসবাস শুরু হয়েছিল। আমি যখন বড়দি’র বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন চা-বাগানের সেসব কর্মকর্তাদের দেখা মেলেনি। দেখেছি উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষের বসবাস। আমার বড়দিদিও এখানে উড়ে আসা এক বাসিন্দা। তবে এই রবীন্দ্র নগর কলোনিতে বর্তমানে যারা বসবাস করছে, তাদের সবাই নিজস্ব জায়গার মালিক বনে গেছে। সরকারকে ট্যাক্স দিচ্ছে। পানির বিল প্রতিশোধ করছে। বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছে। নিজেদের জায়গা কেনাবেচাও করছে, এই রবীন্দ্র নগর কলোনিতে থাকা মানুষগুলো।

রবীন্দ্র নগর কলোনির পশ্চিম পাশে চা-বাগান। ঠিক আমার দিদির বাড়ি থেকে ৪০-৫০ হাত দূরে বিশাল চা-বাগান। এই চা-বাগানটির শেষ খুঁজে পাওয়া বড়ই মুশকিল। বিশাল আওতা জুড়ে এই চা-বাগানটি। পূর্বদিকে বীরপাড়া টু ভুটান (গুমটু) মেইন রোড। উত্তরে বীর পাড়া বাজার অভিমুখী পথ। দক্ষিণে শিলিগুড়ি টু মিজোরাম মেইন রোড়। এই শিলিগুড়ি টু মিজোরাম মেইন রোডের দুপাশে রয়েছে, মাইলের পর মাইল চা-বাগান। রিকশা থামলো আমার বড়দি’র বাড়ির গেইটে। গেইট তখন লাগানো ছিলো। হয়তো বাড়ির ভেতরে সবাই ঘুমিয়ে ছিলো। রিকশাওয়ালা গেইটে টোকা দিয়ে বলছে, ‘কে গো, বাড়ির গেইট খুলুন। দেখুন বাংলাদেশ থেকে আপনাদের অতিথি এসেছে।’ বাংলাদেশ বলতে দেরি, আর গেইট খুলতে দেরি নেই। গেইট খুলেছে আমার বড়দি। আমি তখনো রিকশায় বসে বসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আমার বড়দি রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘কে? কার বাড়ির অতিথি গো?’ রিকশাওয়ালা বললো, ‘আজ্ঞে দিদি, উনি বাংলাদেশ থেকে এসেছে। মনে হয় আপনার ভাই।’

আমি তখন আমার বড়দি’র দিকে তাকাইলাম। আমার মায়ের চেহারা আর আমার বড়দি’র চেহারা একইরকম। আমার মনে হচ্ছিল যে, স্বয়ং আমার মা-ই সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রিকশা থেকে নেমেই, বড় দিদিকে নমস্কার করলাম। আমার বড়দি’র নাম: রাধা রানী। সবাই রাধু রাধু বলেই ডাকতো। বড়দি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, ‘রাধু দিদি, আমি আপনার ছোটভাই নিতাই। এই কথা বলার সাথে সাথেই, দিদি আমাকে ধরে অঝোরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। মুহূর্তেই বাড়ির সামনে পিছনের সকল নারী-পুরুষ জড়ো হয়ে গেল। ঘর থেকে জামাইবাবু বাইর হয়ে আসলেন। ভাগিনা আসলো। অবিবাহিত একটিমাত্র ভাগ্নিও বের হলো। দিদি জিজ্ঞেস করলো আমার বড়দা’র কথা। বললাম, ‘বড়দা ভালো আছে দিদি। দাদাতো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একবার আপনাদের বাড়িতে এসেছিলো।’

এবার আমার বড়দিদি আমাকে পুরোপুরি ঠিকঠিক চিনতে পেরেছে। যদিও এতক্ষণ মনের ভেতরে একটু-আধটু গড়মিল ছিলো, বড়দা এখানে আসার কথা শুনে মনের গড়মিল দূর হয়ে গেলো। দিদির মনের ভেতর গড়মিলের কারণ হলো, আমার বড়দি’র যখন বিয়ে হয়, তখন আমার বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। আর আমি যখন দিদির সামনাসামনি, তখন আমি ৩০ বছরের একজন জবরদস্ত যোয়ান। আমি বুঝের হয়ে আমার বড় দিদিকে কোনও দিন দেখিনি। আর দেখবো-ই-বা কেমন করে? বড়দি’র বিয়ে হবার ১৫ দিন পরই, তারা সপরিবারে ভারত চলে আসে। এই আসাই এপর্যন্ত। আর আমি বড়দি’র সামনে এসেছি প্রায় ২৯ বছর পর।

এরপর দিদি বলছে, ‘আয়, বাড়ির ভেতরে আয়। কীভাবে আসলি, কবে আসলি তা পরে শুনবো। আগে ঘরে গিয়ে বোস। বড়দি’র বাড়ির ভেতরে যাবার আগে রিকশাওয়ালাকে ভারতের দুটো ১০ টাকার নোট হাতে দিলাম। রিকশাওয়ালা বললো, ‘সে কি দাদা! ভাড়া তো আমাকে মিষ্টির দোকান থেকে একবার দিয়েছে। আবার আপনিও দিচ্ছেন?’ আমি বললাম, ‘আ-রে দাদা, ওটা থাকুক। আমি এখন যা দিচ্ছি, তা আপনি নিয়ে নিন।’ আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা খুশি হয়ে বললো, ‘জয়বাংলার লোক গো দিদি। তাই এতো বড় আত্মা। বীরপাড়া বাজার থেকে এখানে এসে, কেউ দুই টাকার বেশি দেয় না। আর উনি আমাকে রাস্তায় চা সিগারেট খাওয়াইয়েছে। আবার কুড়ি টাকা দিয়ে দিলো। এতে আমার সারাদিনের কামাই, ওনাকে দিয়েই হয়ে গেলো।’ রিকশাওয়ালার কথা শুনে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার বড়দি বললো, ‘আমার ভাইতো এখানকার ভাড়া জানে না, তাই তোমাকে এতো টাকা দিয়েছে। ক’দিন পর যখন সব জানাশুনা হয়ে যাবে, তখন হয়ত আর দিবে না। বুঝেশুঝেই দিবে। আমি বড়দি’র কথা শুনে মুচকি হেসে দিদির বাড়ির ভেতরে গেলাম। আর মনে মনে বলতে লাগলাম, ‘দিদি আমরা বাংলাদেশি লোকেরা এরকমই। খরচের কাছে আমরা কখনোই হার মানি না।’

চলবে…

জীবনের গল্প-২৯ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২৭

Image-64

জীবনের গল্প-২৬ এর শেষাংশ: কানাই বলল, ‘ধর্মতলা যাবো জলপাইগুড়ির একটা টিকেটের জন্য।’ তখন বুঝলাম আগামীকালই আমি বাঘা যতীন ত্যাগ করছি।

আমি তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পড়ে নিলাম, কানাইতো আগেই রেডি। একটা অটো চেপে ধর্মতলা উত্তরবঙ্গের বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। কিন্তু টিকেট আর কেনা হলো না। কারণ, তখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, তাই আরও আগে থেকেই টিকেট কাউন্টার বন্ধ। টিকেট নিতে হলে সকাল ১০ টায় কাউন্টারে আসতে হবে। গাড়ি ছাড়বে দুপুর ২টায়। তা-ই হবে, টিকেট সংগ্রহ সকালেই হবে বললো, ‘কানাই।’ তারপর ধর্মতলা অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি করে রাত ১০টায় ফিরে এলাম বাঘা যতীন। সেদিন আমাদের ভাগ্যটা ভালোই ছিল। কেননা, বাংলাদেশ থেকে ভারতের বাঘা যতীন আসলাম অনেক দিন হলো। অনেক দিনের মধ্যে এই প্রথম বাড়িওয়ালার ঘরে রাতের খাবার কপালে জুটলো। সবাই একসাথে বসেই রাতের খাবার খেয়েছিলাম। খাবার শেষে বাড়িওয়ালার পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে দিলাম, আগামীকাল বোনের বাড়ি রওনা দিচ্ছি। সেই সাথে ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্যও মিনতি করেছিলাম। আমার কথা শুনে বাড়িওয়ালী খুশি হলেও, তার ছেলে-মেয়ে দুটি খুশি হয়নি। বলল, ‘দাদা সেখানে সমস্যা হলে আবার আমাদের এখানে চলে এসো’ মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে কানাই-সহ তাদের ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম।

সেদিন রাতে আর আমার ঘুম হয়নি। সারারাত শুধু ছটফট করেছিলাম, নতুন জায়গায় যাবো বলে। দিদির বাড়ি নিয়ে চিন্তার শেষ ছিলো না, আমার! ‘দিদির যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন আমার বয়স ছিলো মাত্র দেড় বছর। যা আমার মায়ের মুখে শোনা। আর এখন আমার বয়স ৩০ বছর পার হতে চলছে। দিদি আমার সামনে আসলে, আমি নিজেই দিদিকে চিনতে পারবো না। আর দিদি আমাকে চিনবে, এটাতো প্রশ্নই ওঠে না। শুনেছি আমার ভাগিনা ভাগ্নি ৪ জন। তারাও আমাকে চিনবে না। পরিচয় দেওয়ার পরও চিনবে না।’ এরকম ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ার পর কখন যে রাত ভোর হয়ে গেল, একটু টেরও পাইনি। সকাল হতে না হতেই ঘুম থেকে ওঠে হাত মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে আছি। অপেক্ষা শুধু কানাই’র জন্য। কিন্তু কানাই ঘুম থেকে উঠছে না দেখে, আমি হাত-মুখ ধুয়ে বাইরে গেলাম, চা-দোকানে। কানাই ঘুম থেকে জেগে বুঝতে পেরেছে যে, আমি কোথায় আছি। ও মুখহাত ধুয়ে সোজা চা-দোকানে উপস্থিত। আমি তখন চা পান করছিলাম। কানাই আমার সামনে এসে দোকানদারকে এককাপ চা দিতে বললো। আমাকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি করে চা শেষ কর, টিকেটের জন্য যেতে হবে।’ ওর কথা শুনে একটু তাড়াতাড়ি-ই চা শেষ করলাম। চেয়ের দাম দিয়ে রওনা হলাম, টিকেট সংগ্রহের জন্য ধর্মতলা। একটা অটো চেপে গেলাম ধর্মতলা।

উত্তরবঙ্গের সরকারি লাল বাস। এই বাসগুলোকে সবাই বলে রকেট। বিশাল বড় গাড়ি। দেখতেও খুব সুন্দর! চলেও দ্রুতগতিতে! টিকেটের মূল্য ভারতীয় ২৬০টাকা। টিকেটের দাম কানাই নিজের পকেট থেকেই দিয়েছিলো। টিকেটের দামটা ও আর আমার কাছ থেকে নেয়নি। গাড়ি ছাড়ার সময় দুপুর ২ টায়। এর আগে থেকেই গাড়ির সামনে হাজির থাকতে হবে। তখন সকাল ১১ টার মতো বাজে। তাড়াতাড়ি আবার চলে গেলাম বাঘা যতীন। বাঘা যতীন গিয়ে তাড়াতাড়ি স্নান করে রেডি হলাম। বাড়িওয়ালার ঘরে তখনও দুপুরবেলার রান্না হয়নি। বেলা ২ টার আগে আর রান্না হবার সম্ভাবনাও ছিলো না। এটা কানাইও টের পেয়েছিল। ও বুঝতে পেরেছিল আমাকে না খেয়েই রওনা দিতে হবে। তাই কানাই তাড়াতাড়ি করে একটা দোকানে গেলো। দোকান থেকে আমার জন্য একটা পাউরুটি কিনে আনলো। যাতে কিছু না খেয়ে ঘর থেকে বের না হই। তখন ঠিক দুপুর ১২টা। তাড়াতাড়ি অর্ধেকমত রুটি খেয়ে রেডি হলাম। কানাই’র দু’বোন ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছে, বিদায় জানানোর জন্য। ওদের মনটাও খুব খারাপ! তা ওদের মুখের দিকে চেয়েই বুঝতে পেরেছিলাম। সাথে আছে বাড়িওয়ালার পরিবারবর্গ।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হলাম। একটা অটো চেপে গেলাম ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ড। তখন সময় ১টা। গাড়ি তখনও বাসস্ট্যান্ডে আসেনি। আসবে ঠিক টাইম মতো। এই ফাঁকে দুইজনে গেলাম কানাই’র পরিচিত একটা দোকানে। দোকানটা হলো শাড়ি কাপড়ের দোকান। কানাই আমার দিদির জন্য একটা শাড়ি কিনে দিয়ে বলল, ‘এটা দিদিকে দিবি। হাত খালি, নাহয় জামাইবাবুর জন্যও একটা কিছু দিতাম।’ আমি আর কিছু বলিনি, চুপচাপ শাড়িখানা ব্যাগের ভেতর ভরে নিলাম। এরপর তাড়াতাড়ি করে চলে এলাম বাসস্ট্যান্ড। এ সময়ের মধ্যেই বাস রেডি হয়ে স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরেই স্ট্যান্ড ত্যাগ করার প্রস্তুতি চলছে। কানাই আমাকে নিয়ে বাসে উঠে সিটে বসিয়ে দিল। আর যাবার পথে রাস্তার করণীয় বিষয়াদি কী কী, তা বুঝিয়ে দিল। ঠিক টাইম মতোই বাস স্ট্যান্ড থেকে বীরপাড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল।

কোলকাতা শহর পার হবার পরপরই শুরু হলো জ্যাম। কী কারণে যে, এই জ্যামের সৃষ্টি তা আর বুঝতে পারিনি। আর আমি বুঝবো-ই-বা কেমন করে। আমিতো সেখানে অতিথি মাত্র। রাত ১০টায় গিয়ে পৌঁছলাম চব্বিশ পরগনা কৃষ্ণনগর বাসস্ট্যান্ড। একটা বড় হোটেলের সামনে বাস থামলো। একএক করে বাসের সব যাত্রী নামল। সাথে আমিও নামলাম। এই কৃষ্ণনগর বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীদের খাবারের হোটেল অনেক আছে। রাস্তার এপার-ওপারে অনেক রাত্রিকালীন দোকানও চোখে পড়লো। বাস থেকে নেমেই দেখাছি, সবাই যারযার মত বিভিন্ন হোটেলে ঢুকছে। আমিও একটা হোটেলে ঢুকে, আমার পছন্দমত কিছু খেলাম। সেখানে প্রায় ১ ঘণ্টা যাত্রা বিরতির পর, আবার রওনা দিল বীরপাড়ার উদ্দেশ্যে। সারারাত বাসেই বসেবসে ঝিমলাম। মাঝেমধ্যে কয়েকটা জায়গায় ভারতীয় বিএসএফ গাড়ি তল্লাসি করেছে। তবে আমি তেমন কোনও ঝামেলায় পড়িনি। আর পরবো-ই-বা কেন? আমার ভাষা তো একেবারে কোলকাতার মানুষের মতো। তাই পাসপোর্ট বিহীন হলেও, মনে সাহস ছিল অনেক বেশি।

পরদিন দুপুর ১২টার সময় পৌঁছলাম শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি হলো, দার্জিলিং জেলার একটা শহর। এই শিলিগুড়ি হয়েই দার্জিলিং, নেপাল, ভুটান যাওয়ার পথ। শিলিগুড়ি যাত্রাবিরতি হবে প্রায় ১ ঘণ্টার মতন। এতো অনেক সময়। অনেকে আবার বাসস্ট্যান্ডের সাথে থাকা মার্কেটও যাচ্ছিলো, কিছু কেনা-কাটা করার জন্য। কিন্তু সেখানকার কোনও মার্কেট আমার চেনাজানা ছিলো না বিধায়, আমি আর কোনও দিকে গেলাম না। আমি খুঁজতে ছিলাম চা’র দোকান। একটা দোকান থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে আবার বাসে উঠে বসলাম। সময়মত বাস শিলিগুড়ি থেকে ছেড়ে যাচ্ছে বীরপাড়ার উদ্দেশ্যে। তখন বাসের ভেতরে যাত্রীর সংখ্যা ছিলো আমাকে নিয়ে হবে ১০ থেকে ১২ জনের মতন। বীরপাড়া যেতে সময় লাগল প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো। বীরপাড়া পৌঁছলাম দুপুর ২টায়। বাস থেকে বীরপাড়ার মাটিতে পা রাখলাম।

বীরপাড়া হলো, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি জেলার একটা থানা এলাকা। এই জায়গাটির তিনদিকে মিশে আছে ভুটান। ভুটানের পাহাড় ঘেঁষা সমতলভূমি, আর চা-বাগানের জন্য বিখ্যাত এই বীরপাড়া। বীরপাড়া বাজারটি ভারতের হলেও, এই বাজারে বেশিরভাগ দোকানদার, আর খরিদদার হলো ভুটানি। মোট জনসংখ্যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ ভুটানি আর নেপালি। মোট কথা ওই এলাকায় এই দুই দেশের মানুষেরই রাজত্ব। বীরপাড়া এলাকায় ভারতীয় টাকা আর নেপালি, ভুটানি টাকার মান সমান সমান। ভারতীয় টাকার চাইতে ভুটানের টাকাই বেশি চলে।

বাস থেকে নেমেই এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিলাম। আমার সাথে ছিলো বাংলাদেশ থেকে নেওয়া কেবলমাত্র একটা ব্যাগ। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বীরপাড়া বাজারের ভেতরে গেলাম, কিছু মিষ্টি কেনার জন্য। জীবনে এই প্রথম বড়দি’র বাড়িতে আসা। খালি হাতে যাওয়াটা কেমন যেন ভালো দেখায় না। তাই কেজি দুএক মিষ্টির জন্য মিষ্টির দোকান খুঁজছিলাম। সাথে টাকার সংখ্যাও বেশি একটা ছিলো না! তবুও খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না বলে মনে মনে ভাবছিলাম! গেলাম একটা মিষ্টির দোকানে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রতি কেজি মিষ্টির মূল্য কত?’ দোকানদার বললো, ‘২৫ টাকা কেজি।’ মনে মনে বলছিলাম, বাঁচা গেল! আমার সাথে যেই টাকা আছে, তা দিয়ে বেশ হয়ে যাবে! দোকানদারকে বললাম, ‘চার কেজি মিষ্টি দিন।’ দোকানদার চার কেজির কথা শুনে দোকানদার একটু অবাকই হলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ্ঞে দাদা ঠিক করে বলুন তো কয় কেজি মিষ্টি নিবেন?’

দোকানদার অবাক হবার কারণ, সেখানে দুই কেজি মিষ্টি একসাথে কেউ কিনে না। আর আমি চাচ্ছিলাম চার কেজি! বিরাট ব্যাপারস্যাপার মনে হচ্ছিল দোকানদারের কাছে। তাই আমাকে ফের জিজ্ঞাসা, ‘ঠিক করে বলুন ক’কেজি নিবেন?’ আমি আবারও বললাম, ‘আমাকে ভালো দেখে চার কেজি মিষ্টি মেপে দিন। আমি আপনাকে মোট মূল্য হতে ১০টাকা কম দিব।’ আমার কথা শুনে দোকানদার হেসে বললেন, ‘তা দিবেন দাদা, তো আপনি যাবেন কোথায় শুনি?’ আমি বললাম, ‘আমি রবীন্দ্র নগর কলোনি যাবো।’ দোকানদার মিষ্টি মাপছে, আর আমকে জিজ্ঞেস করছে, ‘রবীন্দ্র নগর কলোনিতে আপনার কে থাকে দাদা?’ বললাম, ‘আমার বড়দি।’ আবারও প্রশ্ন, ‘আপনার বড়দি’র স্বামীর নাম কী দাদা?’ বললাম, ‘অমূল্য রতন পাল। আপনি কি চেনেন?’ দোকানদার জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার জামাইবাবু কী করে?’ বললাম, ‘শুনেছি তামাকের ব্যবসা করে দাদা। তাও অনেক অনেক বছর আগের কথা। এখন যে কী করে, তা আমি সঠিকভাবে বলতে পারছি না। আপনি কি চেনেন?’

দোকানদার জিজ্ঞেস করলো, ‘আজ্ঞে কী বললেন! তামাকের ব্যবসা? আপনার ভাগিনা ভাগ্নিদের নাম জানেন? জানলে বলুন।’ বললাম, ‘ওরা তিন ভাই এক বোন। ওদের নাম: উত্তম, গৌতম, অষ্টম ও অনিমা।’ দোকানদার বললো, ‘আ-রে দাদা আপনার জামাইবাবুকে তো সবাই রতন পাল নামে ডাকে। আপনার দুই ভাগিনা গ্রেজে কাজ করে। এক ভাগিনা গাড়ির বড় মিস্ত্রি। আপনার বাড়ি মনে হয় বাংলাদেশে?’ আমি আর দোকানদারের সাথে মিথ্যা বলতে পারলাম না। আমি বললাম, ‘হ্যা দাদা আমার বাড়ি বাংলাদেশ। আমি আজ থেকে ১৫ দিন আগে একটা কাজের আশায় কোলকাতা এসেছিলাম। কাজটা হয়নি। তাই দিদির বাড়ি আসা।’ দোকানদার আমার কথা শুনে বললেন, ‘বসেন দাদা, বসেন। আগে কিছু খাবার খেয়ে নিন। আমি সাথে করেই আপনাকে আপনার দিদির বাড়ি পৌঁছে দিব।’ এই বলেই দুটি মিষ্টি একটা প্লেটে করে আমার সামনে এনে দিয়ে বললেন, ‘আজ্ঞে দাদা ঝটপট খেয়ে ফেলুন। আমি রিকশা দেখছি।’

আমি তখন অচেনা জায়গায় অপরিচিত লোক হলেও, আমি খুশিতে বসে বসে মিষ্টি খাচ্ছিলাম! মনে অানন্দও পাচ্ছিলাম! আবার চিন্তাও লাগছিলো! চিন্তা শুধু একটাই। তা হলো, যদি বড়দি আমাকে না চেনে? যদি তাদের বাড়িতে জায়গা না দেয়? যদি আবার কোলকাতা ফিরে যেতে হয়? এসব বিষয় নিয়েই চিন্তা। তারপরও ভয় পাচ্ছিলাম না। কারণ, এসেছি যখন একটা বিহিত হবেই হবে। এই মনোবল নিয়েই মিষ্টি দুটি খাচ্ছিলাম জোরেশোরে। এই সময়ের মধ্যেই দোকানদার রিকশা নিয়ে দোকানের সামনে হাজির হলো। রিকশাওয়ালাও আমার জামাইবাবুর পরিচিত ছিলো। দোকানদার আমাকে বললো, ‘দাদা এই রিকশাওয়ালা আপনার জামাইবাবুর বাড়ি নিয়ে যাবে। ও খুব ভালো করে আপনার জামাইবাবুকে চেনে। পরিচিত রিকশাওয়ালা যখন পেয়েছি, সাথে আর আমার যেতে হবে না।’

আমি আমার পকেট থাকে ভারতীয় একশো টাকার একটা নোট বের করে দোকানদারের হাতে দিলাম। দোকানদার বললো, ‘এই টাকা থেকে আপনাকে আর টাকা ফেরৎ দিচ্ছি না দাদা। আপনার রিকশা ভাড়া আর দিতে হবে না। ওর ভাড়া আমি দিয়ে দিব।’ এই কথা বলেই রিকশাওয়ালাকে বললো, ‘শোন বাপু, তুমি সাবধানে রতন পালের বাড়ি যাবে। বাড়ি গিয়ে, তার স্ত্রীর কাছে এই লোকটাকে পৌঁছে দিবে। জয়বাংলার লোক। এখানে নতুন। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তুমি বাপু আমার কথা বলে দিও।’ রিকশাওয়ালা আমার কেনা চার কেজি মিষ্টি দোকান থেকে এনে, তার রিকশার উপরে রাখলো। আমি দোকান থেকে রিকশায় গিয়ে বসলাম। দোকানদার রিকশার সামনে এসে আমকে বললো, ‘সন্ধ্যার পর এখানে আসলে আমার দোকানে আসবেন দাদা। আমি খুবই খুশি হবো।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে দাদা আসবো, কথা দিলাম।’

এই বলেই রিকশাওয়ালাকে বললাম, ‘আপনি এবার আমার দিদির বাড়ির নিয়ে চলুন। রিকশাওয়ালা ট্রিং ট্রিং করতে করতে রবীন্দ্র নগর কলোনির দিকে যাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তা। গাড়ি নেই। নেই কোনও যানজট বা জ্যাম। রাস্তার দুই দ্বারে বড়বড় পুরানো গাছ। পুরো এলাকায় রিকশাও হবে হাতে গোনা কয়েকটা। রিকশাও বেশি সুন্দর না। কোনরকমভাবে তিনটে চাকা লাগানো আছে। হুকবডি নেই বললেই চলে। যেতে যেতে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তার দৈনিক ইনকাম কত?’ উত্তরে রিকশাওয়ালা বললো, ‘সারাদিনে ১৫–২০ টাকার মতো ইনকাম হয়।’ এই টাকা দিয়েই তার সংসারে চারজন খানেওয়ালার খরচ। তারপরও তার অভাব নেই! এই টাকা দিয়েই তার ছোট সংসার খুব সুন্দরভাবে চলছে। জানলাম রিকশাওয়ালার কাছ থেকে। প্রায় ১০ মিনিট হতে-না-হতেই রিকশাওয়ালা আমাকে বলছে, ‘ও-ই যে রবীন্দ্র নগর কলোনি দেখা যাচ্ছে, দাদা।’

চলবে…

জীবনের গল্প-২৮ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২৬

Image-6411

জীবনের গল্প-২৫ এর শেষাংশ: তারপর গেলাম একটা হোটেলে, কিছু খাওয়ার জন্য। কানাই সারাদিন বাইরে ছিল। ওর-ও ভাত খাওয়া হয়নি। তাই এই সন্ধ্যায় হোটেলে ঢোকা।

কানাই হোটেলে বসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খাবি?’
বললাম, ‘রাতের খাবার তো বাসাই খাবো! এখন আর কী খাওয়া যায় ভাবছি! কানাই বলল, ‘ওইসব কিছু ভাবা দরকার নেই। রাতে বাসার খাবার কপালে জোটে কিনা সন্দেহ আছে। যা খাবার এখান থেকে খেয়ে নে।’ বললাম, ‘তা জুটুক আর না জুটুক, তাতে সমস্যা নেই। এখন হাল্কা পাতলা কিছু খেলেই হবে।’ কানাই বলল, ‘তাহলে বল, কী খাবি?’ বললাম, ‘এক প্লেট ভুনাখিচুড়ি খাবো।’ কানাই বলল, ‘ঠিক আছে তা-ই হবে।’

কানাই হোটেল বয়কে দুই প্লেট ভূনাখিচুড়ি দিতে বললো। কিছুক্ষণ পরই হোটেল-বয় দুই প্লেট ভুনাখিচুড়ি আমাদের সামনে এনে রাখলো। মুগডাল দিয়ে রান্না করা ভূনাখিচুড়ি। সাথে ছোট-ছোট টুকরা করা মুরগির মাংস। হোটেলটা অনেক বড়!ধর্মতলার মধ্যে এই হোটেলটাই সবার কাছে খিচুড়ির জন্য সুপরিচিত। খিচুড়ি খেয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে দুইজনে গেলাম বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ, সব বঙ্গের বাসই ছেড়ে যায়। কানাই উত্তরবঙ্গের বাসের একজন হেলপারের সাথে আলাপ করল। জলপাইগুড়ি বীরপাড়ার ভাড়ার বিষয়ে জানলো। এখান থেকে কখন বাস ছেড়ে যায়, সে বিষয়েও খবর নিলো। এরপর আশে-পাশের অনেক জায়গায় ঘুরা হলো। এই ঘুরা-ঘুরির মধ্যেই রাত হয়ে গেল প্রায় ১০ টার মতো। এবার বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে অটো খুঁজছিলাম। কিন্তু রাত অনেক হওয়াতে শহরে অটোরিকশাও কমে গিয়েছিলো। যা দু’একটা পাচ্ছিলাম, ভাড়া দ্বিগুণ। বাধ্য হয়ে ডবল ভাড়াতেই ওটোতে চাপতে হলো।

ধর্মতলা থেকে অটোরিকশা করে গেলাম বাঘা যতীন। কানাই অটোরিকশা থেকে নেমেই একটা চা-দোকান থেকে দুইটা পাউরুটি কিনল। পাউরুটি কিনল এই কারণে যে, যদি বাড়িওয়ালার ঘর বন্ধ থাকে, তাই। বাড়ি গেলাম। বাড়ি নীরব। তখন কেউ মনে হয় সজাগ ছিলো না। সবাই ঘুমে বিভোর। দুইজনে কুয়ারপাড় গিয়ে হাত-মুখ ধুলাম। ঘরে এসে জামাকাপড় ছাড়লাম। কানাই সাথে নেওয়া পাউরুটি দুটো বিছানার উপর রেখে বললো, ‘আয় একসাথে বসে খেয়ে নিই!’ বললাম, ‘আমি এখন আর কিছুই খেতে পারবো না, তুই একটা খেয়ে আরেকটা রেখে দে। সকালে কাপড় নিয়ে মহল্লায় যাবার আগে খেয়ে যাস।’ কানাই বলল, ‘তুই খাবি না কেন? খেতে হবে! আয় শিগগির। তুই না খেলে আমিও খাব না।’ বললাম, ‘কী আর খাব রে কানাই, আমার কিছুই ভালো লাগছে না। না বুঝে, আর না শুনে হুটহাট করে তোর সাথে চলে এলাম! এখন তো দেখছি কাজের কাজ কিছুই হলো না। আমি তোর সাথে ঘুরছি, ফিরছি, খাচ্ছি। জানি না দেশে ওরা কী খাচ্ছে! কী করছে! কেমন আছে! ওদের কথা আমার বার-বার মনে পড়ছে! এখন যে কী করি! ভেবেই পাচ্ছি না। তুই আমাকে যে ভাবেই পারিস, আমার দিদির বাড়িতে পৌঁছে দে। দেখি সেখানে গিয়ে কিছু করা যায় কিনা!’

আমার কথা শুনে কানাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। আমি এক গ্লাস জল ঢালছি পান করার জন্য। তা কানাই চেয়ে-চেয়ে দেখছে, কিচুই বলছে না। আমি জল পান করে খাটে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় কানাই আমার হাত চেপে ধরে বলল, ‘দেখ তোকে নিয়ে আমিও খুব চিন্তায় আছি। রতন চক্রবর্তীর কথা শুনে কেন-ই-বা তোকে আমার সাথে আনলাম, সেই চিন্তাই করছি। তুই সাংসারিক মানুষ! এভাবে তোকে আমার সাথে এখানে আনা ঠিক হয়নি। এখন তোকে তোর দিদির বাড়ি পাঠালে, যদি তোর দিদি তোকে চিনতে না পারে? যদি তোর দিদিকে তুই চিনতে না পারিস? তা হলে তো অবস্থা আরও খারাপ হবে। এখন তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি তা-ই হবে। এখানে আমি থাকি ভাড়া। বর্তমানে সাথে এখন উপযুক্ত দুই বোন। তোকে এখন আমার সাথে রাখতেও পারছি না, আবার তাড়িয়ে দিতে পারছি না। এখন তুই বল আমি কী করবো।’

কানাইর কথা শুনে আমি বললাম, ‘আমার সাথে ৫০০ টাকার মতো অবশিষ্ট আছে। এই টাকা থাকতে থাকতে তুই আমাকে আমার দিদির বাড়ি পৌঁছে দে। দিদি, জামাইবাবু ও ভাগিনাদের সাথে বুঝে দেখি কিছু করা যায় কি-না! আমার বিশ্বাস, দিদি আমাকে ফেলে দিবে না! আর ভাগিনারাও আমাকে নিয়ে বিরক্ত হবে না। যদিও জীবনে কোনও দিন দিদির বাড়ি যাইনি, তাতে কী হয়েছে? আমাকে ওরা ফেলবে না।’ আমার কথা শুনে কানাই বলল, ‘আচ্ছা তা-ই হবে। আগামী পরশুদিন আমি তোকে জলপাইগুড়ির বাসে উঠিয়ে দিচ্ছি। তুই তোর বড়দি’র বাড়ি গিয়ে দেখ কিছু করতে পারিস কিনা।’ বললাম, ‘ঠিক আছে তা-ই কর। দিদির বাড়ি পৌঁছে আমি তোকে চিঠি দিয়ে জানাবো।’ কানাই বলল, ‘ঠিক আছে তা-ই হবে। এখন আয়, একটা রুটি খেয়ে নে।’

কানাইর কথামত একটা পাউরুটি খেলাম। কানাইও খেল।
খাওয়া শেষে কানাই আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর কাছে এখন টাকা আছে কত?’ বললাম, ‘পাঁচশো টাকা পুরো হবে না, কিছু কম হতে পারে।’ কানাই বলল, ‘এই টাকা থেকে আর একটা টাকাও খরচ করবি না। দুই চার পয়সা যা লাগে আমার কাছ থেকে চেয়ে নিবি, আমি দিবো। জলপাইগুড়ি যাওয়ার পর হঠাৎ করে কার কাছে টাকা চাইবি। ভারতের বাড়ি। নিজের কাছে না থাকলে কেউ দিবে না।’ বললাম, ‘সেই বুঝ আমার বোঝা হয়ে গেছে তোর বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার পর থেকেই। এখন আমি খুবই হুশিয়ার! অন্তত ভারতে যতদিন থাকবো, ততদিন।’ আমার কথা শুনে কানাই বলল, ‘হ্যাঁ তা হলেই এই দেশে কিছু করতে পারবি। এখানে থাকলে, এখানকার মানুষের মতোই চলতে হবে, বুঝলি?’

এরপর কথা বলতে বলতে একসময় দুজনে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল যে কখন হয়েছে তা আর আমাদের জানা নেই। কানাইর মেজো বোন দরজার কাড়া নাড়ছে, আর দাদা দাদা বলে ডাকছে। ওঠলাম ঘুম থেকে। কানাইও ওঠল। তখন সকাল ১০ টা। কানাইর বোন ডলি বলল, ‘আজ আর তোমার মহল্লায় যাওয়া হবে না দাদা।’ কানাই বলল, ‘তুই এখন যা, আমি হাতমুখ ধুয়ে রেডি হচ্ছি। মহল্লায় না গেলে আমার একটু সমস্যা হবে।’ আমি বললাম, ‘পকেটে টাকা না থাকলে-তো সমস্যা হবেই। তুই আলসেমি না করে তাড়াতাড়ি করে মহল্লায় বেরিয়ে পড়।’ ডলি বলল, ‘দাদা, কাকীমা রুটি বানিয়েছে। তোমাদের দুইজনের জন্য চারটে রুটি নিয়ে আসি?’ কানাই বলল, ‘না থাক, দরকার নেই। আমরা সামনের হোটেল থেকে কিছু খেয়ে নিবো, তুই যা।’

ডলি চলে গেল। কানাই তাড়াতাড়ি করে হাতমুখ ধুয়ে আসলো। আমি ওর আগেই হাতমুখ ধুয়ে বসে আছি। বিক্রি করার মতো কাপড়গুলো নেওয়ার জন্য ভ্যানগাড়ি আগেই রেডি থাকে। মহল্লায় যাবার আগে ভ্যানগাড়ির ড্রাইভারকে আর খুঁজতে হয় না। কাপড়গুলো ধরাধরি করে ভ্যানগাড়িতে নিয়ে ওঠালাম। কানাই মহল্লায় চলে গেল। আমি আজও সেদিনের মতো একা হয়ে গেলাম। একা একাই বাঘা যতীন এলাকাটা একটু ঘোরা-ঘুরি করলাম। দুপুরের আগেই বাসায় গেলাম, স্নান করার জন্য। এ ছাড়াও আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার। উদ্দেশ্য হলো, এখানে আসার পর বাড়িওয়ালার ঘরে কোনও দিন দুপুরে খাওয়া হয়নি, তাই। খেয়েছি হয়ত দু’একদিন সকালে।

স্নান করার জন্য পলির কাছ থেকে সাবান চেয়ে নিয়ে গেলাম লেকে। স্নান করে এলাম বাসায়। কানাইর দু’বোন আগেই বাড়িওয়ালীকে বলে রেখেছে যে, নিতাই’দা আজ দুপুরবেলা ভাত খাবে। স্নান করে বাসায় গিয়েই দেখি পলি বসে আছে আমার অপেক্ষায়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি রে, তুই এখানে বসে আছিস কেন?’ পলি বলল, ‘দাদা, এখানে এসেছ পর্যন্ত একটা দুপুরেও আমাদের সাথে বসে খাওনি। আজ আমি আর ডলি আগেই বাড়িওয়ালী কাকীকে বলে রেখেছি নিতাই’দা দুপুরে খাবে। এখন আমার সাথে আস, সবাই একসাথে বসে খাবো।’ পলির কথা শুনে মনে মনে হাসলাম! রক্তের সম্পর্ক নেই! তবুও এতো মায়া। বসে আছে একসাথে খাবে বলে। ও কে বললাম, ‘তুই যা আমি জামাকাপড় পরে এক্ষুণি আসছি।’

পলি চলে গেল বাড়িওয়ালার ঘরে। আমি জামাকাপড় পরে বাড়িওয়ালার ঘরে গেলাম খেতে। ডলি, পলি আর বাড়িওয়ালার মেয়েটা ভাতের থাল সামনে রেখে আমার অপেক্ষায় বসে আছে। আমাকে দেখেই পলি বলছে, ‘এইতো দাদা এসে গেছে। বসেন দাদা বসেন।’ বসলাম ওদের একপাশে ঠিক চোরের মতন চুপ করে। ভাত মেখে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ বাড়িওয়ালী কাকী আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবা তুমি তোমার বোনের বাড়ি কবে যাচ্ছ?’ আমি থতমত হয়ে বললাম, ‘কাকীমা কানাইর সাথে কথা হয়েছে দু’এক দিনের মধ্যেই যাবো।’ কাকীমা বললো, ‘দেখ সেখানে গিয়ে কিছু করতে পার কিনা।’ বললাম, ‘হ্যাঁ কাকীমা, দেখি সেখানে যাওয়ার পর সবকিছু বুঝা যাবে।’ লজ্জায় লজ্জায় কোনওরকমে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘর থেকে বের হলাম।

বাড়িওয়ালির কথা শুনে আমার বেশি ভালো লাগেনি। কেননা, এই ক’দিনে ভারতের হিসাব-কিতাব আমার জানা হয়ে গেছে, তাই। তারা পারে না, জোর করেই একটা অতিথিকে তাড়িয়ে দেয়! যদি সম্ভব হতো, তা হলে তা-ই করতো। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের কাছে নিজেকেই খুব ছোট মনে হচ্ছিলো! কিন্তু কিছুই করতে পারছিলাম না। পারলে তখনই বাঘা যতীন ত্যাগ করতাম। কিন্তু না, তা আর হচ্ছিলো না। মন খারাপ করেই কানাইর বাসায় এসে শুয়ে রইলাম।

একসময় বিকাল হয়ে গেলো। কানাই মহল্লা থেকে বাসায় আসলো। কিন্তু কানাই যে কখন এলো, তা আর আমি টের পাইনি। ও মহল্লা থেকে এসে হাতমুখ দুয়ে আমাকে ঘুম থেকে জাগালো। জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু খেয়েছি কিনা! আমি বললাম, ‘খেয়েছি।’ তখন সন্ধ্যা ঘোর হয়ে রাতের পালা। কানাই বলল, ‘চল ঘুরে আসি।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাবি শুনি? কানাই বলল, ‘ধর্মতলা যাবো জলপাইগুড়ির একটা টিকেটের জন্য।’ তখন বুঝলাম আগামীকালই আমি বাঘা যতীন ত্যাগ করছি।

চলবে।

জীবনের গল্প-২৭ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২৫

Image-6411

জীবনের গল্প-২৪ এর শেষাংশ: কানাই বুকিং-এ গিয়ে শিয়ালদার টিকিট নিল দুইটা। ওঠলাম ট্রেনে। রাত ১১টার সময় পৌঁছলাম শিয়ালদা স্টেশনে। এদিন বাসায় যেতে রাত হয়েছিল প্রায় ১ টা।

কানাই’র ভাড়া বাড়িতে গিয়ে দেখি বাড়িওয়ালার ঘর বন্ধ! কানাইর দু’বোন রাতে বাড়িওয়ালাদের ঘরে থাকে। কানাই’র বোনদের সমবয়সী বাড়িওয়ালার একটা মেয়ে আছে। ওর সাথেই রাতে ঘুমায়। দোতলা বাড়ি। রাত ১১টার পরপরই দোতলায় উঠার সিঁড়ি গেইটটা বন্ধ থাকে। তাই কানাই’র দু’বোনকেও ডাক দেওয়ার কায়দা নেই। আমার পেটের ক্ষুধার জান যায় যায় অবস্থা। এখন খাবো কী, সেই চিন্তায়ও শরীর অস্থির! ওমনি ফুল প্যান্টের পকেটে হাত পড়লো। দেখলাম অর্ধেক পাউরুটি প্যান্টের পকেটে। পাউরুটি ছিলো ফুলিয়া রেলস্টেশন থেকে কেনা। ট্রেনের হুইসেল শুনে তাড়াতাড়ি করার সময় আর পাউরুটি পুরোপুরি খাওয়া হয়নি। খাওয়ার বাকি যতটুকু ছিলো, তা ফুল প্যান্টের পকেটে ভরে দৌড় দিয়েছিলাম, ট্রেন ধরার জন্য। সেই অর্ধেক পাউরুটিই এখন রাতের খাবারের সম্বল। ভাগ্য ভালো ফুলিয়ার অর্ধেক পাউরুটি প্যান্টের পকেটে ছিল। না হয় আমার অবস্থা খুবই খারাপই ছিল।

যাই হোক, দুইজনে হাত-মুখ ধুলাম। কানাইকে বললাম, ‘কানাই, এখন কী খাব রে?’ কানাই বললো, ‘কী আর খাব! এখন দুইজনে কুয়ার জল খেয়ে ঘুমিয়ে থাকি। খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে দোকানে গিয়েই খাব।’ আমি হেসে বললাম, ‘শুধু জল খাব কেন? সাথে পাউরুটিও খাব!’ কানাই বলল, ‘এতো রাতে তুই পাউরুটি পাবি কোথায়? একটা দোকানও খোলা নেই! আমার একটুও মনে ছিলো না যে, বাড়িওয়ালার ঘর বন্ধ থাকবে। মনে থাকলে আসার সময়ই শিয়ালদা থেকে কিছু সাথে করে নিয়ে আসতাম। যাক, তা আর আফসোস করে লাভ নেই! জল খেয়েই শুয়ে থাকি।’ কানাইর কথা শেষ হতে না হতেই আমি পকেট থেকে অর্ধেক পাউরুটি বের করলাম। রাখলাম কানাইর সামনে বিছানার উপরে। অর্ধেক পাউরুটি দেখে কানাই বলল, ‘সে-কি-রে? ফুলিয়ার পাউরুটি? পুরোটা খাসনি? দেয় কদ্দুর, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।’ শেষতক তা-ই হলো! অর্ধেক পাউরুটি থেকে অর্ধেক-অর্ধেক করে খেয়ে, দুইজনে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালবেলা ঘুম থেকে আমি একটু দেরি করে ওঠালাম। কানাই উঠেছে আমার আগে। কানাই এখানে আসার পর ও-আর কাজে যায়নি। কানাই ভারতে মহল্লায়-মহল্লায় ফেরি করে কাপড় বিক্রি করে। অনেকদিন পর আজ মহল্লায় যাবে বলে মনস্তাপ করেছে। ও প্রতিদিন সকালে বের হয়। আসে সন্ধ্যার পর। এতক্ষণ সময় আমি কী করবো, কোথায় যাবো, এসব নিয়ে কানাই থাকে খুব চিন্তায়! আমি ঘুম থেকে ওঠেই দেখি কানাই মহল্লায় যাবার জন্য ভ্যানগাড়িতে কাপড় ওঠাচ্ছে। আমি বললাম, ‘কিরে! কোথায় যাবি?’ কানাই বলল, ‘অনেকদিন হলো মহল্লায় যাওয়ায় হয় না। তাই ভাবছি আজ মহল্লায় যাবো। না গেলেও হয় না। হাত একেবারেই খালি।’ আমি বললাম, ‘তা হলে আমাকেও সাথে নিয়ে যা। ঘুরে দেখে আসি তোর ব্যবসা আর বেচা-কেনা।’ কানাই বলল, ‘না তুই বাসায় থাক! আমি তাড়াতাড়ি করেই বাসায় ফিরে আসবো। যাচ্ছি শুধু কিছু বাকি টাকা আদায় করার জন্য।’ আমি বললাম, ‘একটু দাঁড়া, আমি হাত-মুখ ধুয়ে নিই, তারপর একসাথে বের হবো।’ তা-ই হলো। আমি হাত-মুখ ধোয়া পর্যন্ত কানাই রাস্তায় অপেক্ষা করছে। আমি সাধারণ বেশে বাসা থেকে বের হলাম। কানাই আমার অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।

সামনে যেতেই কানাই বলল, ‘চল সামনের চা-দোকান থেকে দুইজনে চা-বিস্কুট খেয়ে নিই। আবার কখন-না-কখন আসি, তার কি ঠিক আছে?’ আমি বললাম, ‘চল চা-বিস্কুট খেয়ে নিই। আর আমার তো এমনিতেই চায়ের খুব অভ্যাস।’ কানাই-সহ চা-বিস্কুক খেলাম। কানাই চা-বিস্কুটের দাম দিয়ে রওয়ানা দিল মহল্লায়। আমি এখন একা এক অচেনা দেশে কাঙাল মানুষ। এখানে এখন আর আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত কেউ নেই। কানাই মহল্লায় যাবার পর আমার এখন কিছুই ভালো লাগছে না। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। ভাবছি বাসায় না গিয়ে টাউন থেকে গিয়ে ঘুরাফেরা করি। কিন্তু টাউনের অলি-গলিও আমার কাছে অপরিচিত। আবার ভাবছি, হোক অপরিচিত, তাতে কি হয়েছে? আমি চলবো আমার মতে। যেথায় খুশি সেথায় যাবো। কিন্তু যাবো কোথায়? এখন সকাল মাত্র ১০টা বাজে। এসব ভাবতে-ভাবতে একা-একা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। এ সময় একটা অটোরিকশা (সিএনজি) এসে আমার সামনে দাঁড়াল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাবেন দাদা? ধর্মতলা যাবেন? আসেন।’

অটোরিকশার ভেতরে দুইজন যাত্রী বসা। তারাও হয়ত ধর্মতলাই যাবে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। তাই অটোরিকশার ড্রাইভার আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কি দাদা, যাবেন?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ যাবো। তো আপনি গাড়ি নিয়ে কোথায় যাবেন? আমি কিন্তু ধর্মতলাই যাবো।’ ড্রাইভার বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ দাদা, আমারও ধর্মতলা পর্যন্তই শেষ। আসেন আসেন গাড়িতে উঠুন।’ উঠলাম অটোতে। অটো চলছে। আমি অটোতে বসে মনে মনে বলছি, ‘সেদিন কানাইর সাথে গিয়েছিলাম। তাড়াহুড়োর মধ্যে ভালো করে ঘুরে দেখা হয়নি। আজ আমি একা। সাথে টাকাও আছে। আশা করি কোনও সমস্যা হবে না। মনটাও বেশি ভালো লাগছে না। দেশের কথা মনে পড়ছে। আমার বড়দিদির বাড়ি জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া। কীভাবে যেতে হয় তাও জানা নেই। এখানে যদি কাজের কোনও ব্যবস্থা না হয়, তা হলে তো বড়দিদির বাড়িতেই যাতে হবে। জলপাইগুড়ি বড়দিদির বাড়ি গেলে দিদি আমাকে চিনবে কি না? যদি না চিনে? যদি তার ওখানে আমাকে থাকতে না দেয়? তা হলে যাবো কোথায়?’

একসময় অটো ধর্মতলা পৌঁছালো। অটো থেকে নেমে ড্রাইভারকে ভাড়া দিলাম ৬ টাকা। ধর্মতলা হলো কোলকাতা শহরের এক ব্যস্ততম জায়গা। এখান থেকেই ভারতের বিভিন্ন শহরে যাবার বাস সার্ভিস। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছি। দেখছি! এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি! সামনেই একটা চা-স্টল। বসলাম সামনে থাকা একটা চেয়ারে। দোকানদার জিজ্ঞেস করল, ‘কী খাবেন দাদা? চা বানিয়ে দিবো?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ দাদা, ভালো করে এক কাপ চা বানিয়ে দিন।’ দোকানদার আমার দিকে বারবার তাকিয়ে-তাকিয়ে কি যেন ফলো করছে। কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করছে না। চা বানিয়ে সামনে এনে দিয়ে বললো, ‘দাদা বাবুর বাড়ি কোথায়? কোথা-ই-বা যাবেন?’ এরপর দোকানদার আমার সামনে এসে বসল। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চা-পান করতেই, আবার বলল, ‘কোথায় যাবেন? আমি বললাম, ‘কোথাও যাবো না দাদা। এসেছি একটু ঘুরতে।’

চায়ের দোকানে আমি ছাড়া তখন আর কোনও কাস্টমার ছিল না। দোকানদার আমাকে আবারও করলো, ‘আপনাকে দেখে ভারতের মানুষ বলে মনে হয় না। মনে হয় আপনি জয় বাংলার লোক। এখানে আপনার কে থাকে? আমিও কিন্তু জয় বাংলার লোক, দাদা। আমাদের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলায়। এখানে আমরা অনেক পুরানো। আমার জন্মও এই ভারতেই। জয় বাংলায় কোনও দিন যাওয়া হয়নি। তাই জয় বাংলার লোক দেখলেই মনটা খাঁ-খাঁ করে ওঠে দাদা।’

দোকানদারের কথা শুনে আমি বললাম, ‘আমার বাড়ি ও দেশ, দুটোই বাংলাদেশে। এখানে এসেছি আমার এক বন্ধুর সাথে। এসেছি একটা কাজের আশায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি দাদা। এবার দেশে ফিরে যাবার পালা। হয়ত দু’একদিনের মধ্যেই দেশে চলে যাব। তাই আপনাদের কোলকাতা শহরটা একটু দেখতে এসেছি।’ আমার কথা শুনে দোকানদার বলল, ‘এখানে আপনার বন্ধু ছাড়া আর কেউ নেই?’ বললাম, ‘আছে দাদা, তা তো অনেক দূরে! সেই জলপাইগুড়ি। সেখানে আমার আপন বড় বোনের বাড়ি। তবে দাদা, কীভাবে যে যেতে হয়, তাও আমার জানা নেই।’ দোকানদার বললো, ‘জলপাইগুড়ি? কীভাবে যাবেন? যেদিন যাবেন, সেদিন আমার সাথে দেখা করবেন। আমি আপনাকে জলপাইগুড়ির বাসে উঠিয়ে দিবো। এই তো জলপাইগুড়ি বাসস্ট্যান্ড দেখা যাচ্ছে। একটু সামনে গেলেই দেখবেন, উত্তরবঙ্গের সকল জেলায় যাওয়ার বাস।’

দোকানদারের কথা শুনে আমি হেসে বললাম, ‘আচ্ছা দাদা, ঠিক আছে। আমি যেদিন জলপাইগুড়ি যাবো, সেই দিন আপনার সাথে দেখা করে যাবো। এই নিন, আপনার চা-সিগারেটের দাম রাখুন।’ পাঁচ টাকার একটা নোট হাতে দিতে গেলেই দোকানদার রাগ হয়ে আমাকে বললো, ‘যান তো দাদা, জলপাইগুড়ি যেদিন যাবেন, সেদিন দিবেন। এখন এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করে যাবার সময় আবার এক কাপ চা পান করে যাবেন।’ দোকানদার চায়ের মূল্য আর নিল না, আমিও তাকে জোর করে দিতে পারলাম না!

চলে গেলাম, উত্তরবঙ্গের বাসস্ট্যান্ডের সামনে। একটা টিকিট কাউন্টারে গিয়ে জানলাম, জলপাইগুড়ি বীরপাড়ার ভাড়া কত? ভাড়া ২৬০ টাকা। বীরপাড়া যেতে সময় লাগবে ২০ ঘণ্টার মতো। এখন আর আমার ভালো লাগছে না, শুধু বড়দিদির বাড়ি যাবার চিন্তাই করছি। এদিকে দুপুর হয়ে গেছে বহু আগেই, অথচ আমার খবর নাই। এই দিন ধর্মতলার অনেক জায়গায় ঘুরা-ঘুরি করেছি। তাই কখন যে দুপুরের সময় হয়ে গেছে, একটু খেয়ালও করতে পারিনি। আবার একটা অটো করে বাঘা যতীন কানাই’র বাসার সামনে এলাম। বাসায় গিয়ে কানাইর বোন পলিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কানাই কখন আসবে রে?’

পলি বলল, ‘কখন যে আসে, তা কি ঠিক আছে? আপনি কোথায় গিয়েছিলেন দাদা? আপনাকে অনেক খুঁজেছি, মহল্লার প্রতিটা দোকানে। জিজ্ঞেসও করেছি। কেউ বলতে পারানি। আমরা আপনার জন্য খুবই চিন্তায় ছিলাম। কানাইদা কাপড় নিয়ে মহল্লায় যাবার সময় আপনার কথা বলে গিয়েছিল, আপনার দিকে লক্ষ্য রাখতে। লক্ষ্য তো দূরের কথা, আপনার পাত্তাই নেই। দুপুরে কী খেয়েছেন? মনে হয় কিছুই খাননি। এখন তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে আসেন, ভাত খাবেন।’

পলির কথা শুনে আমি বললাম, ‘আমি বাইরে থেকে খেয়ে আসেছি। তোরা খেয়েছিস তো?’ পলি বলল, ‘এখন বিকাল ৪ টা বাজতে লাগল দাদা, এখনও কি না খেয়ে থাকা যায়? আমরা আপনার বার চেয়ে-চেয়ে এই মাত্র খেলাম।’ আমি বললাম, ‘বেশ করেছিস! আরও আগে খেয়ে নিতে পারতিস। আমার জন্য শুধু-শুধু কষ্ট করলি? ডলি খেয়েছে? ও এখন কোথায়? পলি বলল, ‘ও খাওয়া-দাওয়া করে এখন ঘুমাচ্ছে।’ বললাম, ‘আমাকে তেলের শিশি আর শাবানটা একটু এনে দে, আমি স্নান করে একটু ঘুমাবো। কানাই আসলে আমাকে ডেকে দিবি।’

পলি শাবান-সহ রেলের শিশি এনে দিল। আমি লেকে গেলাম স্নান করতে। কোলকাতা শহরে বেশি একটা পুকুর নেই। আছে মহল্লায়-মহল্লায় বিশাল-বিশাল লেক। সেখানকার মানুষেরা সবাই লেকে স্নান করে। মানুষের সুবিধার্থে সিটি কর্পোরেশন এই লেকগুলো তৈরি করে দিয়েছেন। আর বেশিভাগ মানুষের বাড়িতে কিছু না থাকলেও একটা কুয়া অবশ্যই থাকে। বাসার প্রতিদিনের ধোয়া-মোছার কাজ ওই কুয়ার জলেই করে থাকে। আমি লেক থেকে স্নান করে এসে বিছানায় গিয়ে শুলাম। শরীর খুব ক্লান্ত! সারাদিন গেল দুই কাপ চায়ের উপর। না খেয়ে থেকেও বললাম, খেয়েছি। কারণ, বাড়িওয়ালি কেমন যেন বিরক্ত-বিরক্ত ভাব দেখায়, তাই। বিছানায় শরীরটাকে লেলিয়ে দেওয়ার সাথে-সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কানাই মহল্লা থেকে এসেছে সন্ধ্যাবেলা। কানাই এসেই আমাকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠাল। আমি ঘুম থেকে উঠে বললাম, ‘কখন এসেছিস?’

কানাই বলল, ‘এই-তো এলাম! তুই এতো সময় করে ঘুমাচ্ছিস যে? দুপুরে খেয়েছিস?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ খেয়েছি। তুই কোথায় খেয়েছিস? কী খেয়েছিস? কানাই বলল, ‘আমি মহল্লায় বেরুলে দুপুরে আর খাওয়া হয় না। এই সামান্য চা-বিস্কুট হলেই হয়ে যায়। এর বেশি কিছু আর লাগে না।’ কানাই ওর ব্যবসার কাপড়গুলো এক সাইট করে রেখে স্নান করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি বিছানা থেকে নেমে কুয়ায় গেলাম, হাত-মুখ ধুতে।

কানাই স্নান করে এসে জামাকাপড় পরে আমাকে বলল, ‘চল আমার সাথে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায়?’ কানাই বলল, ‘ধর্মতলা থেকে একটু ঘুরে আসি।’ আমি বললাম, আমিতো সকালে একবার ধর্মতলা গিয়েছিলাম। ঘুরেফিরে অনেককিছু দেখে এলাম। জেনেও এলাম। আমার কথা শুনে কানাই জিজ্ঞেস করল, ‘কী দেখে আসলি আর কী জেনে আসলি?’ বললাম, ‘আমার বড়দিদির বাড়ি জলপাইগুড়িতে কীভাবে যেতে হয়, তা জেনে আসলাম। কানাই বলল, ‘বেশ করেছিস, আমার সাথে চল আমি তোকে পুরো ধর্মতলা ঘুরাবো।’

জামাকাপড় পড়ে কানাই-সহ অটোতে চড়ে গেলাম ধর্মতলা। অটো থেকে নেমেই চা-দোকানদারের সাথে দেখা করলাম। কানাইকে বললাম, ‘এই লোকের বাড়ি আমাদের দেশে ফরিদপুর। সকালে চা-দোকানদারের আপ্যায়নের কথাও বললাম। তারপর গেলাম একটা হোটেলে, কিছু খাওয়ার জন্য। কানাই সারাদিন বাইরে ছিল। ওর-ও ভাত খাওয়া হয়নি। তাই এই সন্ধ্যায় হোটেলে ঢোকা।

চলবে…

জীবনকে গল্প-২৬ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২৪

Image-6411-8

জীবনের গল্প-২৩ এর শেষাংশ: কিন্তু তা আর হল না কানাইর জন্য। ও আমাকে সিনেমা দেখাবে, তাই তাড়াতাড়ি করে ট্রামে ওঠল। যাবে টালিগঞ্জ। সেখানে গিয়ে শাহরুখ খান অভিনীত “বাজিগার” ছায়াছবি দেখাবে।

যেই কথা সেই কাজ! হাওড়া থেকে ট্রামে চড়ে গেলাম ধর্মতলা। সেখান থেকে বাসে চড়ে গেলাম টালিগঞ্জ। ছায়াছবি দেখা হবে, মেনকা সিনেমা-হলে। সিনেমা দেখবো রাত্রিকালীন শো। শো আরম্ভ হবে রাত ৯ টায়, শেষ হবে রাত ১২টায়। ছায়াছবি ‘বাজিগার’ নায়ক শাহরুখ খান, নায়িকা কাজল অভিনীত। দেখলাম, ভারতের সিনেমাহলে বড় পর্দায় সিনেমা। খেয়াল করলাম, সেখানকার মানুষ খুবই সংস্কৃতি প্রিয়। অনেকেই একবেলা খাবার না খেয়েও সেই টাকা দিয়ে তারা সিনেমা দেখে। এমনও পরিবার দেখেছি, তাদের রান্না-বান্না চলে পাথর-কয়লা দিয়ে। সেই পাথর-কয়লা থেকে একটি-দুইটি করে কাঁচ-কয়লা প্রতিদিন রেখে দেয়। যখন একদিন রান্না করার মত কয়লা জমা হয়ে যায়, তখন গৃহিণী তার স্বামীর কাছ থেকে সেই টাকা আদায় করে নেয়। পরে সেই টাকা দিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রী দুইজনে গিয়ে সিনেমা দেখে। যেদিন সিনেমা দেখবে, সেদিন ঘরে ফিরে আর রান্না-বান্না করবে না। সিনেমা দেখে আসার সময় কিছু চানাচুর বা বিস্কুট সাথে নিয়ে এসে তা-ই খেয়ে থাকবে। তবু সিনেমা দেখা চাই-ই-চাই। এ ছাড়াও যেকোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলে-দলে যোগদান করে থাকে। যেমন- যাত্রাপালা, লোকনাট্য, থিয়েটার, কবিগান সহ নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। আর আমাদের দেশে বর্তমানে সিনেমা হলে তো কেউ যায়-ই না। অনেক স্থানে দর্শক সংকটে সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

যাক সে কথা। সেদিন টালিগঞ্জ মণিকা সিনেমাহলে সিনেমা দেখে বাসায় ফিরতে রাত হয়েছিল প্রায় দেড়টা। কানাই আগেই জানত যে, এত রাতে বাসায় গেলে বাড়িওয়ালার ঘর বন্ধ থাকবে। তাই সিনেমা দেখে আসার সময়ই দুইটা পাউরুটি কিনেছিল। বাসায় গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে একটা পাউরুটি খেয়ে বিছানায় গিয়ে শুলাম। কিন্তু কিছুতেই আমার ঘুম আসছে না, মনটা কেমন যেন ছটফট করছে। মনে পড়ছে স্ত্রী ও সন্তানদের কথা, আর দাদা বৌদির কথা। আবার ভাবছি নিজের পকেটের কথাও! আবার ভাবছি যেখানে যাব সেখানকার কথা। এই ঘুরা-ঘুরির মধ্যে নিজের বেশকিছু টাকা খরচও হয়ে গেল। পকেট শূন্য হয়ে গেলে কানাই যদি সহযোগিতা না করে? হয়ত করবে। তা-ও ক’দিন করবে? ওরও তো এখানে একটা সংসারের মতো আছে। যদিও বিয়েশাদী এখনও করেনি, তাতে কী হয়েছে? দুইটা বোন তো সাথে আছে! আমাকে একা বাসায় রেখে কানাইও কোনও কাজে কর্মে যেতে পারছে না। এসব কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, তা নিজেও জানিনা।

এভাবে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করতে করতে কেটে গেলো প্রায় পাঁচ দিনের মতোন। ছয় দিনের মাথায় কানাই বলল, ‘তাড়াতাড়ি জামাকাপড় নিয়ে রেডি হয়ে নে, ফুলিয়া যাবো।’ কানাইর কথা শুনে আমি জামাকাপড় ব্যাগের ভেতরে ভরে প্রস্তুত হলাম। বাড়িওয়ালার ঘরে গিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। কানাইর দু’বোনকে বললাম, ‘এক দেশ থেকে আরেক দেশে এসেছিস, ভালোভাবে চলাফেরা করবি। এমনভাবে চলবি, যাতে অন্য কেহ কোনও খারাপ মন্তব্য না করতে পারে।’ এরমধেই কানাই রেডি হয়ে আমাকে ডাকল! আমি কানাইর সামনে এসে বললাম, ‘আমি রেডি আছি, চল বাইর হই!’

কানাইর ভাড়া বাসা থেকে শিয়ালদা রেলস্টেশন অনেকদূর। এতদূর রিকশা যাবে না, তাই একটা অটোরিকশা রিজার্ভ নিলাম। তবুও শিয়ালদা যেতে বেজে গেল সকাল ১০টা। শিয়ালদা থেকে ফুলিয়া যেতে সময় লাগল, ২ ঘণ্টার মতো। ফুলিয়া হলো পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার একটা থানা এলাকা। ফুলিয়া রেলস্টেশনের একটু পূর্বদিকে গেলেই রতন চক্রবর্তীর বাড়ি। কানাই আমাকে নিয়ে গেল রতনদার বাড়িতে। আসলে রতনদার কোনও বাড়ি নেই! আছে শুধু বাড়ি করার মতো একটুখানি জায়গা। বর্তমানে যেই লোকটা রতনদার জায়গা দেখাশুনা করে তার নাম গৌরাঙ্গ। একসময় এই গৌরাঙ্গ দাদা আমার খুবই কাছের মানুষ ছিলো। আগে বাংলাদেশে থাকতে একই মহল্লায় আমরা বসবাস করতাম। তিনি যে রতনদার জায়গা দেখাশোনা করছে, তা আর আমার জানা ছিল না।

গৌরাঙ্গ দাদা আমাকে দেখেই বলল, ‘কী রে নিতাই কেমন আছিস? কীভাবে এলি। বাসার সবাই কেমন আছে।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ দাদা, আমি ভালো আছি, আর বাসার সবাই ভালো আছে। এখানে এসেছি কানাইর সাথে। তো আপনি কেমন আছেন? বৌদি কোথায়?’ গৌরাঙ্গদা বললো, সবাই ভালো আছি।’ কথা বলতে বলতে ঘর থেকে পিঁড়ি এনে দিয়ে বলল, ‘বস।’ তখন গৌরাঙ্গদা’র বউ (বৌদি) বাসায় ছিল না। বৌদি গেছে কোনও এক জায়গায় বেড়াতে। এরপর কানাই গৌরাঙ্গ দাদাকে বিস্তারিত খুলে বলল। গৌরাঙ্গ দাদা শুনলেন। কানাইর কথা শুনে গৌরাঙ্গ দাদা বললো, বেশতো, ভালো করেছিস। এবার ওকে রতনের জায়গায় একটা ঘর তৈরি করে দে, ও থাকুক।

কানাই কোনও কথা বলছে না, চুপ করে বসে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে রে? আমি তো কিছু বুঝে ওঠতে পারছি না।’ কানাই আমাকে বললো, ‘কিছু একটা তো হয়েছে রে। খেলা দেখাব, রতন না হয় রতনের বউকে।’ আমার আর বুঝতে অসুবিধা হলো না। তারপরেও আমি বললাম, ‘রতনদা’র ঘর কোনটা গৌরাঙ্গ দাদা? রতনদার ঘরে গিয়ে একটু বসি। এখানে থাকি বা না থাকি, রতনদার ঘরটা দেখেই যাই।’ গৌরাঙ্গদা বললো, ‘রতনের ঘর তো তার জমিতে পরে আছে, ঠেলে ওঠাতে হবে। কানাইকে বল ঘরখানা ওঠানোর ব্যবস্থা করতে।’ গৌরাঙ্গদা’র কথা শুনে কানাই বললো, ‘হয়েছে আর ঘর দেখতে হবে না, দেখবো এবার রতনকে।’ আমি কানাইকে বললাম, ‘কানাই তুই এখানে থাকিস, অথচ তুই কিছুই জানিস না! এটা কী বিশ্বাসযোগ্য?’ আমার কথা শুনে কানাই বললো, ‘বিশ্বাস কর আমি জানি না যে, রতন চক্রবর্তীর বাড়ি নেই। যদি জানতাম, তা হলে অন্তত আমি তোকে আমার সাথে আনতাম না।’

কানাইর কথা শুনে আমি বললাম, ‘যা হবার হয়েছে এখন তোর বাসায় চল। আগামীকাল একটু কষ্ট করে দেখবি, কোনও মিলে সিট খালি আছে কি না। যদি এখানে কোনও কাপড়ের মিলে চাকরি না পাই, তা হলে আমি চলে যাবো দিদির বাড়িতে।’ আমার কথা শুনে কানাই কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। হয়ত আমার কথায় ওর একটু লজ্জাবোধ হচ্ছিল। লজ্জা তো পাবার কথাই, কারণ ও-ই-তো আমাকে এখানে আনলো। আর রতন চক্রবর্তীর সাথে ও-ই কথা পাকাপাকি করেছিল। এখন আমার কথায় ওর একটু লজ্জা লাগা স্বাভাবিক।

কিছুক্ষণ পর কানাই আমাকে বললো, ‘শুন, কষ্ট করে যখন এখানে এসেছিস, তো একটা কিছু করতেই হবে। দরকার হয় ট্রেনে, বাসে, ট্রামে ফেরি করে বাদাম বিক্রি করবি। একটু কষ্ট আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলেই, এখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পারবি। কানাইর কথা শুনে আমি বললাম, ‘তা পরে দেখা যাবে, এখন অন্তত এখান থেকে চলে যাই।

কানাই বললো, ‘যাব, আগে তোকে নিয়ে ফুলিয়া এলাকাটা একটু দেখাই। এখানে ছোট ছোট অনেক টেক্সটাইল মিল আছে। যদি কপাল ভালো হয়, আর যদি একটা মিলে কাজ হয়ে যায় ক্ষতি কী? তাহলে রতন চক্রবর্তীর আর দরকার হবে না।’ আমি বললাম, ‘চল তাহলে। বেলা অনেক হয়েছে, আবার তো বাসায় ফিরতে হবে।’ আমার কথা শুনে কানাই বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে চল। এরপর কানাই আর আমি গৌরাঙ্গ দাদার কাছ থেকে বলে-কয়ে বিদায় নিলাম।

আসলাম ফুলিয়া রেলস্টেশন। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হবার পালা। ক্ষিদে পেয়েছিল খুব! কানাইকে কিছু না বলার আগেই, কানাই বুঝতে পেরেছে। কানাই আমাকে বললো, ‘দেখ, এটা ভারত। এখানে মানুষ খুবই হিসাব করে চলে। গৌরাঙ্গ দাদা আমাদের খুবই কাছের লোক হয়েও দুপুরের খাবারের কথা কিছু বলল না। আর আমাদের বাংলাদেশ হলে কী হতো? নিজেরা না খেয়েও অতিথিকে খেতে দিতো।’ আমি বললাম, ‘যা হবার হয়েছে, এখন চল একটা হোটেলে যাই। আগে কিছু খেয়ে নেই।’

গেলাম ফুলিয়া রেলস্টেশনের বাইরে! খাবারের কোনও হোটেল নেই। ফুলিয়া হলো মফস্বল এলাকা। এখানে বহিরাগত মানুষের বসবাস কম। হোটেলে কেউ খাবার খেতে আসে না। তাই হোটেলের ব্যবসাও কেউ করে না। অথচ এই ফুলিয়া রেলস্টেশনের একটু পশ্চিমে কোলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ যাওয়ার মেইন রোড। আছে বাসস্টপ আর অনেক বড় বাজার। তবু একটা খাবারের হোটেল নেই। আছে দুই একটা চা দোকান আর কয়টা মিষ্টির দোকান। হোটেল খুঁজে না পেয়ে একটা চা দোকানে গেলাম। চা দোকান থেকে দুইটা পাউরুটি কিনে গেলাম মিষ্টির দোকানে। মিষ্টির দোকান থেকে দুইজনে চারটে মিষ্টি নিয়ে পাউরুটি দিয়ে খেলাম।

এরপর কানাই আমাকে নিয়ে গেল একটা টেক্সটাইল মিলে। এই কাপড়ের মিলে তৈরি হয় ৬০ কাউন্টের সুতার গ্রে মার্কিন কাপড়। এই কাপড়গুলো ডাইং ও প্রিন্ট করে প্রস্তুত করা হয় শাড়ি। মিলে গিয়ে কানাই কর্তব্যরত সুপারভাইজারের সাথে আমার ব্যাপারে আলাপ করলো। সুপারভাইজার আমাকে একটা চালু তাঁতের সামনে নিয়ে গেলো। সাথে কানাইও আছে। সুপারভাইজার আমাকে বললো, ‘মেশিনটা বন্ধ করুন তো!’ আমি সাথে সাথে মেশিনের হেন্ডেল ধরে চালু মেশিনটা বন্ধ করলাম। মেশিনটা বন্ধ করে পাঁচ মিনিট পর আবার চালু করে দিলাম। মেশিন চলছে। আমার মেশিনে হেন্ডেল ধরা দেখেই সুপারভাইজার বললো, ‘এই তো দেখছি তাঁতের ওস্তাদ। আগে কোথায় কাজ করেছে?’ কানাই বললো, ‘আপনাকে তো আগেই বলেছি, ও বাংলাদেশ থেকে এসেছে। এখন আপনাদের মিলে কি কাজ করা যাবে?’ সুপারভাইজার বললো, ‘বর্তমানে আমাদের এখানে কোনও সিট খালি নেই। সিট খালি হতে আরও মাসেকখানি দেরি হতে পারে।’

আমি সুপারভাইজার বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনাদের এখানে ‘ব’ গাঁথার কোনও লোক লাগবে কি না?’ সুপারভাইজার বাবু বললো, ‘আমি আপনার কথা বুঝে উঠতে পারছি না যে, ‘ব’ গাঁথা কাকে বলে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘শানা এবং বয়ার ভেতর দিয়ে সুতা ভরার কাজটাকে আপনারা কী বলেন?’ আমার কথা শুনে সুপারভাইজার বাবু বললো, ‘ওহ! বুঝেছি বুঝেছি, ওটাকে আমরা রেসিং বলি। আর যিনি এই কাজটা করে থাকে, তাকে বলি রেসিংম্যান।’ আমি বললাম, ‘আমার এই কাজটাও জানা আছে। যদি আপনার এখানে এই কাজের লোক না থাকে, তাহলে আমাকে এই কাজটা দিতে পারেন।’

সুপারভাইজার বাবু হেসে বললো, ‘দুঃখিত! এই কাজটা এলাকার একজন লোকে করে। আর আপনি তো এই কাজ এখানে করতে পারবেন না। কেননা, আপনার তো হেলপার নেই। এই কাজ করতে হলে আগে দরকার হেলপার। কিন্তু আপনার তো তা নেই! তাহলে কাজটা করবেন কী করে?’ আমি আরও জিজ্ঞেস করলাম, ‘থাক এই কাজও আমার দরকার নেই! এখন শুনি আপনাদের এখানে তাঁতিদের মজুরি দিয়ে থাকেন কীভাবে?’ সুপারভাইজার বাবু বললো, প্রতি এক গজ কাপড় বুননকারিকে ৬০ পয়সা মজুরি দিয়ে থাকি।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘একজন তাঁতিকে কয়টা করে মেশিন চালাতে দেন?’ সুপারভাইজার বাবু বললো, ‘দুইটার বেশি মেশিন কেউ কি চালাতে পারে? আর পারলেও আমরা দেই না। কারণ, বেশি মেশিন দিলে বুননের সময় কাপড় খারাপ করে ফেলে, তাই।’ আমি সুপারভাইজার বাবুকে বললাম, আমাদের বাংলাদেশে একজন তাঁতি অন্তত ৬ থেকে ৮ টা করে মেশিন চালায়।’

আমার কথা শুনে সুপারভাইজার বাবু মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পরলো! চেয়ারে বসে বসে আমার দিকে আর কানাইর দিকে শুধু তাকাচ্ছে। এমনভাবে তাকাচ্ছে, যেন সুপারভাইজার বাবু বোবা হয়ে গেছে। সুপারভাইজার বাবুর এই অবস্থা দেখে কানাই বললো, ‘কি স্যার কিছু বলছেন না যে? আমারা তাহলে এবার আসি?’ সুপারভাইজার বাবু বললো, ‘দেখুন, আপনারা দিল্লি চলে যান। অনেক টাকা কামাতে পারবেন। ওখানে অনেক উন্নতমানের কাপড় তৈরির মেশিন আছে। সেসব মেশিন আপনাদের জন্যই দরকার। এখানে কাজ করে আপনাদের কখনোই পোষাবে না। এখানে যারা তাঁত চালায়, তাদের সকলের বাড়িই মিলের আশেপাশে। তাদের কোনরকম বাজার করার টাকা হলেই হলো। সেটা তো আপনাদের বেলায় চলবে না দাদা। আপনাদের চাই ভালো টাকা বেতনের চাকরি।’ সুপারভাইজার বাবুর কথা শুনে আমি বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, দেখি কী করা যায়!’

এরপর মিল থেকে কানাই আর আমি চলে এলাম বাইরে। তখন রাত প্রায় ৮ টার মতো বাজে। কানাই বললো, সর্বনাশ হয়েছে রে। এতো রাত হয়ে গেল, একটু টেরও পেলাম না। চল শিগগির ফুলিয়া রেলস্টেশনে। রাত ৯টায় একটা ট্রেন আছে, সেটা না ধরতে পারলে বিপদই হবে।’ এরপর কানাই আর আমি তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। আসবো কোলকাতা-টু-শিলিগুড়ি মেইন রোডে। হাইওয়ে পার হয়ে গেলাম ফুলিয়া রেলস্টেশনের সামনে। তখন রাত ৯ টা বাজতে ৩০/৩৫ মিনিট বাকি আছে। আমার খুব ক্ষিদেও পেয়েছে। কিন্তু কানাইকে কিছু বলতেও পারছি না যে, কানাই আমার ক্ষিদে পেয়েছে। আমার অবস্থা দেখে কানাই বুঝতে পেরেছে যে, আমার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। কানাই আমাকে বললো, ‘ট্রেন আসতে এখনও সময় আছে, চল কিছু খেয়ে নিই।’ কানাইর কথা শুনে আমি খুবই খুশি হয়ে বললাম, ‘আমিই তোকে বলতাম যে, আমার খুব ক্ষিদে লেগেছে! তার আগেই তুই বলে ফেললি? এখন চল একটা চা দোকানে যাই, ঝটপট কিছু খেয়ে নিই।’

গেলাম একটা চা দোকানে। আবারও নিলাম দুইটা পাউরুটি আর দুই কাপ চা। চা খেতে না খেতেই শোনা যাচ্ছে ট্রেনের হুইসেল। আমি কেবল পাউরুটিটা অর্ধেক খেয়েছিলাম। হুইসেল শোনার পর আর খেতে পারিনি। তাড়াতাড়ি করে চা টা গিলে রুটিটা পকেটে ভরলাম। দোকানদারকে চা-রুটির টাকা দিয়ে দে দৌড়। আমার মতো কানাইরও একইরকম অবস্থা ছিলো! দুইজনেই স্টেশনের দিকে দৌড়াচ্ছি। আসলাম স্টেশনে। কানাই বুকিং-এ গিয়ে শিয়ালদার টিকিট নিল দুইটা। ওঠলাম ট্রেনে। রাত ১১টার সময় পৌঁছলাম শিয়ালদা স্টেশনে। এদিন বাসায় যেতে রাত হয়েছিল প্রায় ১ টা।

চলবে…

জীবনের গল্প-২৫ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২৩

Image-6411-8

জীবনের গল্প-২২ এর শেষাংশ: চিঠিতে জানিয়ে দিলাম, আমি মঙ্গল মতো কলিকাতা পৌঁছেছি। চিঠি পাঠালাম এই কারণে যে, আমার জন্য যেন কোনও প্রকার চিন্তা না করে, তাই। তারপর ঘুরেফিরে কেটে গেল আরও বেশকিছু দিন। আমার চিন্তাও বাড়তে লাগল।

এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না। চার-পাঁচদিন পর একদিন সকালবেলা কানাই বলল, ‘চল দুইজনে টাউনে গিয়ে ঘুরে আসি।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাবি?’ কানাই বলল, ‘আজ তোকে মেট্রো ট্রেনে চড়াব। আর সময় পেলে হাওড়া, তারামণ্ডলও দেখাবো।’

এ তো খুশির খবর! কিন্তু খুশির বদলে আমার কান্না আসতে লাগল। চিন্তা শুধু একটাই, তা হলো এখানে আসলাম বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, হচ্ছে শুধু টাকা খরচ। এভাবে ঘুরে বেড়ালে কি হবে? আমার তো কিছু একটা করতে হবে। ভাবছি, কানাইর সাথে যাব কি যাব না! না গেলেও হয় না। শেষমেশ জামাকাপড় পড়ে কানাইর সাথে বের হলাম।

কানাইর বাসা থেকে একটা রিকশায় চড়ে গেলাম ধর্মতলা। এই ধর্মতলায় কোলকাতা শহরের বড় একটি বাসস্ট্যান্ডও আছে। আছে কোলকাতার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার ট্রাম ও বাস সার্ভিস। রিকশা থেকে নেমে একটা চা দোকানে গিয়ে চা-বিস্কুট খেলাম। দোকান থেকে বের হয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম। আমি সিগারেট জ্বালিয়ে টানছি আর হাঁটছি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছি। একসময় একটা রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি দুইজনে। দুইটা দোকানের মাঝখানে মাটির নিচে যাওয়ার জন্য অনেক চওড়া জায়গা। নিচে যাওয়ার সুন্দর সিঁড়িও আছে। কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নিচে কী?’ কানাই বলল, ‘এটি হচ্ছে কোলকাতা শহরের ভূগর্ভস্থ পাতাল রেলস্টেশন। যাকে বলে পাতাল রেল বা মেট্রো ট্রেন। তাই অনেকে বলে, মেট্রো ট্রেনস্টেশন।’ আমি বললাম, ‘তা হলে আমরা কি এখন এই স্টেশনেই যাচ্ছি?’ কানাই বলল, ‘হ্যাঁ, তোকে তো বাসা থেকে বাইর হবার আগেই বলেছি। চল এখন নিচে স্টেশনের ভেতরে। গেলেই বুঝতে পারবি, পাতাল রেল কাকে বলে!’ সিঁড়ি বেয়ে নিচে গেলাম। স্টেশনের ভেতরকার সৌন্দর্য দেখে অবাকও হলাম!

এই মেট্রো ট্রেন হলো, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতা পরিবহণ সেবার মধ্যে একটি। এটির পরিসেবা কোলকাতা শহরের পার্শ্ববর্তী উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা পর্যন্ত। দ্রুত পরিবহন সেবা প্রদানকারী পরিবহণ ব্যবস্থাও বলা যায়। জানা যায়, কোলকাতা মেট্রো ট্রেনের পথ ২৭.২২ কিলোমিটার। এই ২৭.২২ কিলোমিটার পথে ২৩টি মেট্রো স্টেশন রয়েছে। যার মধ্যে ১৫টি স্টেশন ভূগর্ভস্থ আর বাদবাকিগুলো ভূতলস্থ এবং উড়াল; এই তিন প্রকারেই স্টেশনই রয়েছে। এই পরিবহন সেবা চালু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে এবং এটিই ভারতের প্রথম মেট্রো রেল পরিসেবা। এরকম পাতাল রেল সার্ভিস নাকি ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও আছে।

আমরা দু’জন নিচের দিকে নামছি, যত নিচে যাচ্ছি ততই সুন্দর। ঝকঝকা আলো আর লোকে লোকারণ্য। স্টেশনের ভেতরে গার্ডের সাথে পুলিশও আছে। তাদের ডিউটি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা। কে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে এগুলো ফলো করা। মূল স্টেশনে প্রবেশ করতে হলে, চাই টিকিট। কম্পিউটারে টিকিট শো করলেই গেইট খুলবে, যাত্রী প্রবেশ করবে। এ ছাড়া আর প্রবেশ করার মতো কারোর সাধ্য নেই। কানাই কাউন্টার থেকে দুটা টিকিট কিনে আনল। আমরা যাব, ধর্মতলা থেকে টালিগঞ্জ। টিকিটের দাম নিল, ৫ টাকা করে ১০ টাকা। দুটো টিকিটই একসাথে, মানে একটা টিকিট। টিকিটের গায়ে লেখা আছে টু ম্যান। ট্রেন আসার সময় হয়েছে। হুইসেল শোনা যাচ্ছে। কানাই বলল, ‘শিগগির আয়।’

আমরা কম্পিউটার সিস্টেম গেইটের সামনে গেলাম। কানাই গেইটের পাশে থাকা বক্সে টিকিট ঢুকাল। টিকিটখানা শোঁ করে বক্সের পেছনে চলে গেল। আমরা গেইট পার হলাম, টিকিটখানা হাতে নিলাম। গেইটখানা ধরে আমি একটু ট্রাই করে দেখলাম! গেইট আর একটুও নড়ে-চড়ে না। টিকিটের গায়ে দুইজন লেখা। ঠিক দুইজন পার হওয়ার পরই গেইট বন্ধ। ট্রেন স্টেশনে এসে থামল। যাত্রিরা ট্রেন থেকে নামল। আমরা ট্রেনে ওঠার জন্য রেডি হয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।

ট্রেন থেকে মাইকে বলছে, ‘টালিগঞ্জ যাওয়ার যাত্রিগণ ট্রেনে ওঠে আসন গ্রহণ করুন।’ আমরা-সহ সব যাত্রী ট্রেনে ওঠে সিটে বসার পর ট্রেন থেকে আবার মাইকিং। বলা হচ্ছে, ‘যাত্রীদের অবগতির জন্য বলা হচ্ছে যে, আপনারা ট্রেনের দরজা ও জানালা থেকে দূরে থাকুন।’

এর পরপরই ট্রেনের সব দরজা ও জানালা একসাথে শোঁ করে লেগে গেল! বুঝলাম, দরজার সামনে যদি কেউ দাঁড়ানো থাকত, তা হলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই আগে থেকেই যাত্রিদের হুশিয়ার করে দেওয়া হয়, যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে। ট্রেন ছুটল দ্রুতগতিতে! জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ট্রেন যাচ্ছে মাটির নিচ দিয়ে। কিছু দেখা যাবে কী করে? শুধু একটু শব্দ শোনা যাচ্ছে, শোঁ শোঁ শব্দ। ১০ মিনিটের মতো বসে থাকার পর আবার মাইকিং। বলা হচ্ছে, ‘আমরা টালিগঞ্জ পৌঁছে গেছি! ট্রেন থেকে নামার জন্য প্রস্তুত হোন।’

কানাই বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল, সাথে আমিও ওঠলাম। ট্রেন থামল। ট্রেন থেকে আমরা নেমে স্টেশনের বাইরে আসলাম। কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে চা-বিস্কুট খেয়ে তৈরি হলাম, ধর্মতলা আসার জন্য। এবার ট্রামে চড়ে আসব ধর্মতলা। ট্রাম দেখা হবে আর চড়াও হবে। দেখাম ট্রাম! ট্রামে চড়লামও।

ট্রাম হলো কোলকাতা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা। এটি এ দেশের প্রথম ও একমাত্র পরিসেবা প্রদানকারী ট্রাম। জানা যায়, এটি এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিবহন ব্যবস্থা। এই ট্রাম পরিসেবা প্রথম চালু হয়েছিল, ১৮৭৩ সালে। শোনা যায়, প্রথমে ঘোড়ার সাহায্যে না-কি ট্রাম চালানো হতো। এই ট্রাম কিন্তু ঝুলন্ত ট্রাম নয়! এ হলো রোড ট্রাম। যা বাস রোডের পাশ দিয়ে চলে। এই ট্রামের চলার রাস্তা হলো রেললাইন। ট্রাম দেখতে হুবহু রেলগাড়ির মতনই। তবে ট্রেনের মতো এত চওড়া নয়, সামান্য চিকন। বগি থাকে দুইটি, ড্রাইভার একজন। কন্ট্রাক্টর একজন। এক বগি থেকে অন্য বগিতে যাওয়া যায়। যাত্রী যেখানে খুশি, সেখানেই ওঠানামা করতে পারে। এই রোড ট্রামও চলে বিদ্যুতের সাহায্যে। তবে চলে আস্তে-আস্তে।

ট্রামে চড়ে আসলাম ধর্মতলা। এবার যাব রানী ভিক্টোরিয়া পার্কে। এই ভিক্টোরিয়া পার্কটি ছিল যুক্তরাজ্য ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাণীর নামে। রানী ভিক্টোরিয়া ১ মে ১৮৭৬ সালে ভারত সম্রাজ্ঞী উপাধি ধারণ করেন। তার স্মৃতিকে ধরে রাখতেই, তার নামে ‘রানী ভিক্টোরিয়া’ পার্ক নির্মাণ করেন ভারত সরকার। পার্কটি খুবই সুন্দর! পার্কের মাঝখানে আছে রানী ভিক্টোরিয়া ভাস্কর্য। প্রতিদিন বিকালবেলা এই পার্কটিতে থাকে লোকে লোকারণ্য। পার্কের গেটের সামনে বসে হরেকরকমের দোকান। যেন আমাদের দেশের এক বৈশাখী মেলার মতো। দেখলাম ভিক্টোরিয়া পার্ক। রানী ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে বাইর হলাম সন্ধ্যার একটু আগে। এ দিন তারামণ্ডল দেখার আর সুযোগ হল না। চলে এলাম কানাইর বাসায়। কানাই বলল, ‘আজ যখন তারামণ্ডল দেখা হল না, তা হলে আগামীকাল দেখব।’

রাতের খাবার খেয়ে দুইজনে শুয়ে রইলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠলাম। তখন মনে হয় বেলা ১০ টার মতো বাজে। ঝটপট দুইজনে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া করলাম। দিনটি ছিল রবিবার। ভারতের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাড়াতাড়ি না গেলে, তারামণ্ডল আজও দেখা হবে না। কারণ, ছুটির দিনে তারামণ্ডলে লোক অনেক বেশি হয়। কানাই আমাকে নিয়ে বের হলো তারামণ্ডল দেখানোর জন্য। এটি হলো দক্ষিণ কোলকাতার জওহরলাল নেহেরু রোডে। এর পাশে আছে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। এটি হলো মহাকাশচর্চা কেন্দ্র ও প্ল্যানেটরিয়াম জাদুঘর। নাম রাখা হয়েছে, এমপি বিড়লা তারামণ্ডল। এই তারামণ্ডলটি সাঁচীর বৌদ্ধ স্তুপের আদলে নির্মিত, একটি একতলা ভবনে অবস্থিত। শোনা যায়, এই প্ল্যানেটরিয়ামটি এশিয়ার বৃহত্তম প্ল্যানেটরিয়াম। এটি ছাড়াও নাকি ভারতে আরও দুটি তারামণ্ডল আছে। একটি চেন্নাইতে, অপরটি হায়দ্রাবাদে অবস্থিত।

আমি যখন ভারতে গিয়েছিলাম, তখন তারামণ্ডলের ভেতরে যাওয়া বাবদ প্রবেশ মূলা ছিল ২টাকা। তারামণ্ডলের ভেতরে গেলাম। দেখলাম তারামণ্ডল। ভেতরে যাবার পর আমার মনে হচ্ছিল যে, আমি যেন মহাকাশে ভাসমান অবস্থায় আছি! ইউটিউবে বা টিভিতে যেভাবে মহাকাশের দৃশ্য দেখি, ঠিক সেই ভাবেই দেখছি!

তারামণ্ডল থেকে বাইর হলাম দুপুরবেলা। দুপুরের খাবারের সময় হওয়াতে গেলাম এক হোটেলে। ভাত মাছ আর মুগের ডাউল দিয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম। দুইজনের খাবারের বিল হলো, ৩০ টাকা। হোটেল থেকে বাইর হয়ে আমি কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এবার কোথায় যাবি?’ কানাই বলল, ‘জীবনে তো হাওড়া ব্রিজের অনেক কেচ্ছা-গিবত শুনেছিস! এবার বাস্তবে দেখে যা।’ বললাম, ‘চল, হাওড়া ব্রিজটা দেখি!’

সেখান থেকে ট্রামে চড়ে গেলাম, হাওড়া। হাওড়া ব্রিজের সামনে যাচ্ছি পায়ে হেঁটে। ব্রিজে ওঠতেই আমার চোখে পড়ল, ব্রিজে লাগানো একটা সাইনবোর্ডের দিকে। সাইনবের্ডের লেখা আছে, এই ব্রিজটির নির্মাণকাল ও কিছু নির্দেশনা। ব্রিজটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রক্ষার জন্যও জনগণের প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে।

জানা যায়, হাওড়া ব্রিজটি উনিশ শতকের অন্যতম নিদর্শনের একটি। এটি হুগলি নদীর উপর অবস্থিত। এটি কোলকাতা ও হুগলি শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতু। এই হাওড়া ব্রিজ ছাড়াও হুগলি নদির উপর আরও ব্রিজ আছে। সেগুলির মধ্যে এই হাওড়া ব্রিজ হলো অন্যতম। এটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে একমাত্র ভাসমান সেতু। ব্রিজটি সম্পূর্ণ লোহার এঙ্গেল ও নাট-বল্টু দ্বারা তৈরি। এর মাঝখানে কোনও পিলার বা খুঁটি নাই। দেখে মনে হয় এটি যেন মাধ্যাকর্ষণের শক্তিতে ঝুলেছে। ব্রিজটি নির্মাণের পর একবার এক স্টিমারের নোঙর ছিঁড়ে ব্রিজের সাথে সংঘর্ষ হয়। এর ফলে ব্রিজটির মাঝখানের বেশকিছু অংশ বিধ্বস্ত হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে ব্রিজটি পুনঃনির্মাণ করে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

এই হাওড়া ব্রিজটির বিজ্ঞপ্তি নোটিশে লেখা আছে, ব্রিজটি ১,৫২৮ ফুট দীর্ঘ। এর প্রশস্ত লেখা না থাকলেও বোঝা যায়, ব্রিজটি প্রশস্ত ৫০ থেকে ৬০ ফুট হবে। ব্রিজটির মাঝখানে আছে যানবাহন চলাচলের জায়গা। দুই পাশে মানুষ চলাচলের জন্য ৬ থেকে ৭ ফুট প্রশস্ত রাস্তা। আমি কানাইর সাথে যখন ভারত গিয়েছিলাম তখন ১৪০০ বঙ্গাব্দ, ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ। দেখলাম ব্রজিটিতে তখন কোনও ভারি যানবাহন চলাচল করে না। এর মূল কারণ হল, ব্রিজটি মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে তাই। এটি কোনও একসময় বিধ্বস্ত হয়ে যাবে বলে ভারতের বড় বড় প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ারদের ধারণা। তাই ভারত সরকার ব্রিজটির পাশে আরেকটি ব্রিজ তৈরি করে রাখে। সেই ব্রিজটি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামে নামকরণ করে রাখা হয়, বিদ্যাসাগর সেতু। হাওড়া ব্রিজ থেকে একটু ডানদিকে তাকালেই বিদ্যাসাগর সেতুটি দেখা যায়। কানাই বলল, ‘তোকে যদি রাতের বেলা এখানে আনতে পারতাম, তাহলে আরও ভালো লাগত। এখানে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর সেতু যেভাবে দেখছিস, রাতে আরও সুন্দর দেখায়। তখন মনে হয় না যে, আমরা ভারত আছি। মনে হয় ইউরোপের কোনও এক শহরে দাঁড়িয়ে আছি!’

দেখলাম হাওড়া ব্রিজ! পায়ে হেঁটে গেলাম ওপারে, আবার আসলামও পায়ে হেঁটে। তখন সূর্যটা ঢুববে ঢুববে মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম, আরেকটু দেরী করে রাতের সৌন্দর্যটা উপভোগ করি। কিন্তু তা আর হল না কানাইর জন্য। ও আমাকে সিনেমা দেখাবে, তাই তাড়াতাড়ি করে ট্রামে ওঠল। যাবে টালিগঞ্জ। সেখানে গিয়ে শাহরুখ খান অভিনীত “বাজিগার” ছায়াছবি দেখাবে।
চলবে…

জীবনের গল্প-২৪ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২২

Image-6411-8

জীবনের গল্প-২১ এর শেষাংশ: সব টাকা বাইর করার দরকার নেই। কোনও বাটপার দেখলে তোর পেছনে লাগবে। ভারতের বাড়ি, টাকার খুব দাম!’ আমি কানাইর কথামত কিছু টাকা সামনের পকেটে রাখলাম। আর বাদবাকি টাকা প্যান্টের ভেতরের পকেটে রাখলাম। ভগবানকে ডাকতে ডাকতে গেলাম গেইটের বাইরে।

স্টেশনের বাইরে গিয়ে চা-বিস্কুট খাচ্ছিলাম, এমন সময় ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছিলো। ট্রেনের হুইসেল শুনে আমার বুকের ভেতরে কামড়া-কামড়ি শুরু করেছিলো। কখন আমি স্টেশনের ভেতরে যাব, সেই চিন্তায় আমার চা-বিস্কুট খাওয়া শেষ। ঝট-পট দোকানদারকে চা-বিস্কুটের দাম দিয়ে দৌড়ে চলে গিয়েছিলাম স্টেশনের ভেতরে। ভেতরে যাবার পর কানাই জিজ্ঞেস করলো, ‘কী খেয়েছিস? এতো ঝট-পট চলে এলি যে?’ কানাইর কথা শুনে আমি বললাম, ‘আরে ভাই, আমিতো ট্রেনের হুইসেল শুনেই চলে এলাম। তুই না একবার বলেছিস– ইলেক্ট্রিক ট্রেন, হুইসেল দিতে দেরি ছুটতে দেরি নেই! সেই কথায় আমি কোনোরকম খেয়ে দৌড়ে চলে এলাম।’ কানাই হেসে বলল, ‘ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরিয়ে সামনে নিয়ে লাগাবে। এই জন্যই হুইসেল দিয়েছিল। ইঞ্জিন ঘুরিয়ে লাগানোর পর ট্রেন ছাড়বে। ট্রেন ছাড়ার আগে মাইকেও বলে দিবে। আর মাইকে বলা কথাগুলো বাইরে থেকেও শোনা যাবে। এখন চল, ট্রেনে ওঠে সবাই বসে পড়ি।’ আমি তখন হাঁফাতে হাঁফাতে বললাম, ‘ওহ-হো, এই খবর? আমিতো মনে করেছিলাম ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে! তাই চা-বিস্কুট ফেলে রেখে চলে এলাম। চল চল ট্রেনে উঠে বসে পড়ি।’ তারপর সবাই হাসতে হাসতে কানাইর দু’বোন-সহ ট্রেনে উঠে বসলাম। আমি এর আগেও নাম শুনেছিলাম ইলেক্ট্রিক ট্রেন। কিন্তু কোনও দিন চড়িনি। এই ট্রেন আমাদের দেশের সাধারণ ডিজেল চালিত ট্রেনের মতনই। কিন্তু বিদ্যুতের সাহায্যে চলে। যা ১৯০০ সালের প্রথমদিকে ভারতবর্ষে আবির্ভাব হয়েছিল।

এর আগে একসময় পাথর কয়লা দ্বারা এই রেলগাড়ি চালানো হতো। এতে যেমন ছিলো ব্যয়বহুল খরচ, তেমন হতো আবার পরিবেশ দূষণ। পরিবেশ দূষণের কারণ হলো, এই কয়লা চালিত রেলগাড়ি চলাচলের সময় রেলগাড়ির ইঞ্জিন থেকে প্রচুর পরিমানে সাদা-কালো ধুয়া বের হতো। এতে রেললাইনের আশে-পাশে থাকা গাছগাছালি-সহ স্থানীয় কৃষকদের ফসলী জমির ফসলের ব্যপক ক্ষতি হতো। একসময় পরিবেশবাদীরা পরিবেশ দূষণ হচ্ছে বলে রেলগাড়ির ধূয়াকে দায়ী করেছিল। তারা মতপ্রকাশ করেছিল, “পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হলে, ইঞ্জিন থেকে বাইর হওয়া ধূয়া বন্ধ করা জরুরি।” তাদের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই আবিষ্কার করা হয় ডিজেল চালিত রেল ইঞ্জিন। এতেও খরচ তেমন বাঁচাতে পারেনি! আবার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর রেলের কালো ধূয়াও তেমন বন্ধ করতে পারছিল না। এরপর অনেক বছর চেষ্টার বিনিময়ে তৈরি করা হয়, বিদ্যুৎ চালিত ট্রেন।

তবে তখনও বিশাল ভারতে বৈদ্যুতিক ট্রেনের পাশা-পাশি ডিজেল চালিত ইঞ্জিনও অনেক ছিলো। ছিলো টু-ইন-ওয়ান সিস্টেম ট্রেন ইঞ্জিন। মানে একটা ট্রেন ইঞ্জিনে ডিজেল ও বিদ্যুৎ দুটোই থাকতো। আরও সহজ করে বললে বলা যেতে পারে– একটা ট্রেন ইঞ্জিন ডিজেলেও চলতো, আবার বিদ্যুতেও চালানো যেতো। এই ইঞ্জিনগুলো দূরপাল্লায় যাতায়াতের ট্রেনগুলোতেই বেশি ব্যবহার করা হতো।

যাইহোক, আমার ওই প্রথমই বৈদ্যুতিক ট্রেনে চড়া। ট্রেনের বগিগুলো অনেক চওড়া! দুইপাশে বসার লম্বা টেবিল। মাঝখানে বেশ খানিকটা খালি জায়গা। খালি জায়গার উপরে আছে সারি সারি হাতা। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীগণ এই হাতায় ধরেই গন্তব্যে পৌঁছায়। আমরা যেই ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিলাম, এটি চিল বনগাঁ টু শিয়ালদা। তা-ও আবার ওই রুটে রাতের জন্য ছিলো শেষ ট্রেন। তাই যাত্রীও ছিলো সীমিত। পুরো বগিতে কানাইর দু’বোন-সহ আমরা যাত্রী ছিলাম, ৭/৮ জনের মতো। ট্রেনের হুইসেল যখন শোনা যাচ্ছিলো, তখন আমি ট্রেনের টেবিল সিটে বসে বসে ভাবতেছিলাম, এবার হয়ত ট্রেন ছাড়ছে! ঠিক তা-ই হয়েছিলো। হুইসেল দেওয়ার সাথে সাথে ট্রেন ছুটে চললো।

বাংলাদেশর ডিজেল ট্রেনও স্টেশন থেকে ছাড়ার আগে হুইসেল দেয়। কিন্তু ট্রেনের হুইসেল শুনেও দৌড়ে এসে ট্রেনে ওঠা সম্ভব হয়। ভারতের বৈদ্যুতিক ট্রেনের বেলায় তা-আর সম্ভব হয় না। হুইসেল দেওয়ার সাথে সাথেই শোঁ! মানে, ট্রেন আর দেখা যাবে না। ট্রেন চলছে দ্রুতগতিতে! আমি বসা কানাইর পাশে। কানাইর দু’বোন সিটের এককোণে বসা। ট্রেন অনেকক্ষণ চলার পর নাম না জানা একটা স্টেশনে থামল। ট্রেন ছাড়ার আগে আমাদের বগিতে তিনজন ফেরিওয়ালা উঠেলো। একজন বাদাম নিয়ে। আরেকজন আপেল, আরেকজন চানাচুর নিয়ে। কানাই ওর দু’বোনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই তোরা কি বাদাম খাবি? না আপেল খাবি?’ দু’বোন বললো, ‘বাদাম খাব।’ আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই কিছু খাবি?’ আমি বললাম, ‘এখন কিছু খাব না।’

ওরা তিনজনই বাদাম কিনে খাচ্ছে। মুহূর্তেই আমার মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেলো। মনটা খারাপ করেই একা একা বসে অনেককিছুই ভাবতে লাগলাম! আজ পহেলা বৈশাখ, ১৪০০ বঙ্গাব্দ। আমার বৌ বাচ্চা-কাচ্চা সবাই বাংলাদেশে। আমি কী করলাম! ওরাই-বা-কী করবে? আমার চিন্তার যেন শেষ নেই! কেন আসলাম! কোথায় যাবো! কী করবো! এমন হাজার প্রশ্ন মনের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারছি না। চিন্তায় আমার দেহ-মন দুটোই যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে। ভাবতে লাগলাম বার-বার!

ভাবনার এক ফাঁকে কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কানাই, আমরা কোথায় গিয়ে নামবো?’ কানাই বলল, ‘আমরা এখন প্রথমে দমদম যাব। ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে। তার বাসায় আজকের রাতটা থাকব। কাল সকালে আবার ট্রেনে করে যাব শিয়ালদা। এই গাড়িতে করে যদি শিয়ালদা যাই, তবে রাত হয়ে যাবে প্রায় তিনটে। এতো রাতে দু’বোনকে সাথে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। সমস্যাও হতে পারে। তাই আজ রাতটা দমদম বন্ধুর বাসাই থাকব।’ আমি বললাম, ‘এখন তো রাত ১১টার মতো বাজে। দমদম পৌঁছতে কয়টা বাজবে?’ কানাই বললো, ‘রাত ১২টার মতো বাজতে পারে।’

কানাইর কথাই ঠিক হলো। রাত ১২টা দশ মিনিটের সময় ট্রেন দমদম পৌঁছাল। দু’বোনকে নিয়ে আমরা ট্রেন থেকে নামলাম। তখন দমদম স্টেশনটা নিরব নিস্তব্ধ! কোনও মানুষজন নেই। ভারতের মানুষ এমনিতেই অনেক হিসাব করে চলে। বাইরে বেশি রাত করে না। সবাই চলে নিজের ধান্ধায়। কী করবে আর কীভাবে চলবে এসব নিয়ে তারা বেশি চিন্তা করে। বাংলাদেশের মতো অযথা রাস্তাঘাটে, হাট-বাজারে আড্ডা দেয় না। আর এখন তো রাত ১২ টারও বেশি! তাই দমদম রেলস্টেশনটা একেবারেই জনশূন্য। ট্রেন থেকে যে-কয়জন যাত্রী নামল, সেই ক’জন মানুষও ক্ষণিকের জন্য। যাত্রীরা যার-যার গন্তব্যে চলে গেলে স্টেশনে আর কোনও মানুষই থাকবে না বলে আমার মনে হচ্ছিলো।

সবাই স্টেশনের ভেতর থেকে বাইরে গেলাম। আমি এদিক-ওদিক দেখলাম, কোনও চা-দোকান আছে কি না। নেই, কোথাও কোনও চা-দোকান এতো রাতে খোলা নেই। নেই কোনও রিকশা বা ভ্যানগাড়িও। দমদম স্টেশন থেকে কানাইর বন্ধুর বাড়ির দূরত্ব প্রায়ই দুই কিলোমিটারের পথ। সাথে তিন-চারটা বড়-বড় ব্যাগ। সেই সন্ধ্যার পর থেকেই টেনশন আর হাঁটা। আমার শরীর একরকম ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু কিছু বলতেও পারছি না যে, আমি খুবই ক্লান্ত অনুভব করছি। কী আর করা! দুই কিলোমিটার পথ খুব কষ্ট করে হেঁটে, কানাইর বন্ধুর বাসায় পৌঁছালাম। ভারতের বাড়ি। হিসেবি মানুষের দেশ। ভাই আর বন্ধু, অসময়ে কেউ কারোর জন্য মাথা ঘামায় না। নিজের আপন বোনও ভাইকে দুইদিন জায়গা দিতে চায় না। কোনও লোকের বাড়িতে একবেলা খাবার যেমন-তেমন, পরের বেলাই হিসাব কষতে শুরু করে।

কানাইর বন্ধুর বাড়ির গেইটের সামনে গিয়ে সবাই দাঁড়ালাম। কানাইর বন্ধুটির নাম, প্রদীপ। কানাই বন্ধুর নাম ধরেই অনেক ডাকতে লাগলো! কারোরই সাড়াশব্দ নেই। অনেকক্ষণ ডাকার পর, বন্ধুটি চোখ মুছতে মুছতে গেইটে আসলো। গেইটে এসেই জিজ্ঞেস করলো, ‘কী-রে, এতো রাতে?’ কানাই বললো, ‘বাংলাদেশ থেকে এলাম। যেতে হবে শিয়ালদা। কিন্তু শিয়ালদা পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যাবে। তাই তোদের বাড়ি এলাম, রাতটা কাটানোর জন্য। খুব ভোরে উঠে চলে যাবো।’ প্রদীপ জিজ্ঞেস করলো, ‘সাথে ওরা কারা?’ কানাই আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘ও আমার বন্ধু। আর ওরা আমার ছোট দুই বোন।’ কথা বলতে বলতেই প্রদীপ বাড়ির গেইট খুলতে লাগলো। এমন সময় প্রদীপের বৃদ্ধ মা সামনে এসে প্রদীপকে জিজ্ঞেস করলো, ‘প্রদীপ, কে আসলো রে? এতো রাতে কোত্থেকে?’ মায়ের কথায় প্রদীপ জবাব দিল, ‘মা, আমার বন্ধু কানাই, দু’বোন নিয়ে বাংলাদেশ থেকে এসেছে। আজকের রাতটা আমাদের এখানে থাকবে ওরা। সকাল হলেই চলে যাবে।’ প্রদীপের মা বললো, ‘আয়, ওদের ভেতরে নিয়ে আয়। রাত অনেক হয়েছে। ওরা কী বাইরে থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে এসেছে? না আমার কিছু করতে হবে? আমার শরীরটাও ক’দিন যাবত বেশি একটা ভালো যাচ্ছে না। আসো আসো ভেতরে আসো শিগগির।’

প্রদীপ আগে, আমরা চারজন পেছনে পেছনে যাচ্ছি বাড়ির ভেতরে। অনেক বড়ো ঘর! পুরানো বিল্ডিং। দেয়ালের চারদিক নক্সা করা কারুকার্য। ঘরের ভেতরে সুবিশাল আয়তাকার অতিথিশালা আর চারদিক দামী চেয়ার বসানো। দেয়ালে রয়েছে নানা রঙের ছবি টানানো। আমাদের সাথে নেওয়া ব্যাগগুলো মেঝেতে রেখে সবাই বসলাম। প্রদীপের মা একটা প্লেটে করে কিছু বিস্কুট নিয়ে আসলো, অতিথিশালায়। বিস্কুটগুলো সামনে দিয়ে বললো, ‘খাও বাবা সকল। এতো রাতে আর কোনও ঝামেলা করবো না। এগুলো খেয়ে শুয়ে পড়ো। সকালের খাবার খেয়ে তোমরা যাবে।’ কানাই বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে মাসিমা, আমরা হাত মুখ ধুয়ে তারপর খাব। আর সকাল বেলাও আমাদের জন্য আপনার কিছু করতে হবে না। আমাদের খুব ভোরবেলা উঠেই রওনা দিতে হবে।’

প্রদীপের মা শোবার ঘরে চলে গেলো। প্রদীপ তখনও অতিথিশালায়। কানাইর সাথে শোফার একপাশে বসে ঝিমাচ্ছে। কানাই প্রদীপকে বললো, ‘কি হলো রে প্রদীপ? ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? আমরা কে কোথায় ঘুমাবো একটু বলে দে?’ প্রদীপ চোখ ডলতে-ডলতে সোফা থেকে ওঠে বললো, ‘ভেতরে আর জায়গা নেই যে! তোদের সবাইকে এখানেই কষ্ট করে ঘুমাতে হবে।’ এই কথা বলেই প্রদীপ আরেক ঘরে চলে গেল। অতিথিশালায় তখন আমরা চারজন ছাড়া কেউ ছিলো না। পেটের খুদায় আর ঠিক থাকতে পারছি না। খুদা নিবারণের জন্য মাসিমার দেয়া বিস্কুটগুলো সবাই মিলে-মিশে হজম করলাম। অতিথিশালায় তিনটে সোফা ছাড়া আর কোনও বিছানাপত্র ছিল না। কানাই একটায়, আমি একটায় আর দু’বোন একটা সোফায় ঘুমিয়ে পড়লো। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও আমার চোখে ঘুম ছিলো না। আমার শুধু চিন্তা! ভারতের এমন কেচ্ছা-কাহিনী আমি অনেক আগেই শুনেছিলাম। কিন্তু স্বচক্ষে দেখিনি। কানাইর সাথে যাবার পর-ই নিজ চোখে দেখার ভাগ্য হলো। যেমনটা দেখলাম, কিছুক্ষণ আগে কানাইর বন্ধু প্রদীপদের বাড়িতে আসার পর।

বাংলাদেশে একজনের বাড়িতে কোনও অতিথি আসলে, কত না সমাদর করে। অতিথির জন্য রাত আর দিন কোনও বিষয় থাকে না। অতিথিকে সমাদর করাটাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর এখানে রাত হয়েছে বলে যত যন্ত্রণা! কিছু খাও আর না খাও, সকালবেলা চলে যাও! আমি ভাবছিলাম, যার কাছে যাব, সে যদি এমন করে? তাহলে কোথায় যাব? কানাইর কাছেও ক’দিন থাকব! বড় দিদির বাড়ি গেলে, বড় দিদি যদি আমাকে দেখে বিরক্ত হয়? তাহলে যাবো কোথায়? চাকরি যদি মনোমত না হয়, তাহলে? এমন আরও অনেক অনেক প্রশ্ন নিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম! একসময় সকাল হল। সময় তখন ভোর ৫টা। সূর্য মামা তখনও উঁকি দেয়নি। আমারা অনেক রাতে ঘুমিয়েছিলাম, তাই সবাই তখনও ঘুমে বিভোর। সেসময় প্রদীপের মা এসে সবাইকে ডেকে বলছে, ‘ওঠো ওঠো গো বাবা সকল। সকাল ৫টা বাজে। তোমরা যখন শিয়ালদা যাবে, সকাল পৌনে ছয়টার সময় একটা ট্রেন আছে। তাড়াতাড়ি ওঠো। ট্রেনটা ধরতে পারলে নিরিবিলি যেতে পারবে।’ প্রদীপের মায়ের কথা শুনে আমি ওঠে কানাইকে বললাম, ‘এই কানাই, তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নে। ছয়টা বাজতে আরো ৪৫ মিনিট বাকি আছে, ট্রেনটা হয়ত ধরতে পারব।’

কানাই কুরমুড়ি দিয়ে ওঠে ওর দু’বোনকে ঘুম থেকে ওঠাল। প্রদীপদের বাড়িতে আর কিছু খাওয়া হল না। চলে আসলাম দমদম রেলস্টেশনে। স্টেশনে এসে একটা চা-দোকানে সবাই চা-বিস্কুট খেয়ে সকালের নাস্তা সারলাম। এরপর কানাই তাড়াতাড়ি করে স্টেশনের ভেতরে গিয়ে চারটে টিকেট কিনল। ট্রেন আসার পর সবাই ট্রেনে গিয়ে বসলাম। ট্রেন শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছালো সকাল ৮টায়। শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে এসে একটা অটো রিজার্ভ করলাম। অটো দিয়ে যাচ্ছি আর দেখেছি সেখানকার ১৪০০ বঙ্গাব্দ, বর্ষবরণ উৎসবে সাজানো রাস্তার আশ-পাশ। মনে হয়েছিলো, প্রতিটি রাস্তার মোড়ে-মোড়ে, মহল্লায়-মহল্লায় এখানে-সেখানেই বর্ষবরণের আয়োজন হয়েছিলো। কোথাও-কোথাও বৈশাখী লোকজ মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চও দেখা গেলো। অটো চলল প্রায় ৩০ মিনিটের মতো। নামলাম বাঘ যতীন রেলস্টেশনের বিপরীতে এক মহল্লায়। সেখান থেকে একটু পায়ে হেঁটে গেলাম কানাইর ভাড়া করা বাসায়।

এই জায়গাটার নাম বাঘা যতীন কেন হলো তা কানাইর কাছে জানতে চাইলাম। জবাবে কানাই বলল, “এই বাঘা যতীনের বাড়ি ছিল আমাদের বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। তার পিতার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম শরৎশশী। বাঘা যতীন শৈশব থেকেই শারীরিক শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। শুধুমাত্র একটি ছোরা দিয়ে তিনি একাই একটি বাঘকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল বলে, তাঁর নাম রটে যায় বাঘা যতীন। এখানে থেকেই নাকি বাঘা যতীন লেখাপড়া শিখেছিলেন। তিনি একসময় হয়ে উঠেছিলেন একজন বাঙালি ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী নেতা। ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের সম্মুখ যুদ্ধে উড়িষ্যার বালেশ্বরে তিনি গুরুতর আহত হন। কিছুদিন বালাসোর হাসপাতালে থাকার পর অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর একসময় ভারত ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাঘা যতীন স্মরণে জায়গার নাম রাখা হয় বাঘা যতীন।’ বর্তমানে বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলে সন্ধান করলেও বাঘা যতীন-এর বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।

এই বাঘা যতীন এলাকার কানাই এখন স্থায়ী বাসিন্দা। ও আরও অনেক আগে থাকেই যেই বাড়িতে থাকে, সেই বাড়িওয়ালার ঘরেই কানাই খাওয়া-দাওয়া করে। কানাই থাকে একা। কিন্তু এখন কানাইর সাথে আরও তিনজন দেখে বাড়িওয়ালার মাথায় হাত। এখন কানাইকে কিছু বলতেও পারছে না, আবার সইতেও পারছে না। আমি সেটা ভালো করে ফলো করতে লাগলাম। তাদের এমন ভাবটা বোঝা যেতো তখন, যখন খাবার খেতে যেতাম। সেখানে দুইদিন থাকার পর কানাইকে বললাম, ‘আমাকে রতন চক্রবর্তীর বাড়ি নিয়ে চল। এখানে তোর সমস্যা হচ্ছে।’ তখন কানাই বলল, ‘যাবো আরো দুইদিন পরে। আগে তোকে কোলকাতা শহরটা একটু ঘুরিয়ে দেখাই। ওখানে গেলে-তো আর সহা-শিগগির আসতে পারবি না। তাই কিছু সুন্দর-সুন্দর জায়গা দেখে যা, চিনেও যা।’ আমি বলছিলাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তা-ই হবে।’ কানাইর কথায় আর অমত করেনি। দুইদিন কানাইর সাথে শুধু ঘোরাফেরা করতে লাগলাম।

এদিকে রতন চক্রবর্তীর স্ত্রীর ভারত আসার কথা ছিলো, আমাকে সুন্দর একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু না, তিনি আর আসছে না। কানাইও তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। এই অপেক্ষার মধ্যে কেটে গেল আরও দুইদিন। এর এক ফাঁকে আমি নিকটস্থ পোস্ট অফিস থেকে একটা চিঠির খাম (এনভেলপ) কিনলাম। নিরিবিলি সময়ে একটা চিঠি লিখে পাঠালাম, আমার স্ত্রীর ঠিকানায়। চিঠিতে জানিয়ে দিলাম, আমি মঙ্গল মতো কলিকাতা পৌঁছেছি। চিঠি পাঠালাম এই কারণে যে, আমার জন্য যেন কোনও প্রকার চিন্তা না করে, তাই। এভাবে কেটে গেল আরও বেশ কয়েকদিন। আমার চিন্তাও বাড়তে লাগল।
চলবে…

জীবনকে গল্প-২৩ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২১

Image-6411-8

জীবনের গল্প-২০ এর শেষাংশ: আমি বললাম, ‘হ্যাঁ আমি পুরোপুরিভাবে রেডি আছি। ওঁদের তো শ্বশুরবাড়ি রেখে এসেছি আজ দিইদিন হলো। আর আমিতো এখন বড়দা’র বাসায়ই থাকছি।’ কানাই আমার কথা শুনে বলল, ‘ঠিক আছে, আর কোনও টেনশন নেই। এবার যাবার পালা।’

এই বলেই কানাই চলে গেলো ওদের বাসায়। আমি বড়দা’র বাসায়ই থেকে গেলাম। এর পরদিনই কানাই আমার বরদা’র বাসায় এসে ভারত যাওয়ার দিনক্ষণ জানালো। দিন-তারিখ নির্ধারণ করা হলো, ২৭ চৈত্র ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ। ১০ এপ্রিল ১৯৯৩ ইং রবিবার। রাত পোহালেই রবিবার। সকালবেলা বড়দা’র বাসায় নাস্তা সেরে জামাকাপড় পড়ে রেডি হচ্ছিলাম। জামাকাপড় পড়তেই বড়দাদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় যাবি?’ আমি বললাম, ‘আমি কানাইদের বাসায় যাচ্ছি। আজই মনে হয় রওয়ানা দিতে পারি। আমার জন্য আশীর্বাদ রাখবি।’ বড়দাদা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ‘এখনই ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিবি নাকি?’ বললাম, ‘না, যেতে যেতে হয়তো সন্ধ্যা হতে পারে। তো একটু আগেই যাচ্ছি, কানাইর সাথে কিছু কাজ আছে।’ আমার কথা শেষ হলে বড়দাদা আমার হাতে ৫০০/= টাকা দিয়ে বললো, ‘যা, ভগবানকে স্মরণে রেখে দেখে-শুনে চলবি।’

অবশ্য বড় দাদাকে এর আগেও ভারতের ব্যাপারে বিস্তারিত খুলে বলেছিলাম। তাই হয়তো বড়দাদা আগে থেকেই আমার জন্য কষ্ট করে হলেও ৫০০/= টাকা রেখে দিয়েছিল। তাই ওই ৫০০/= টাকা যাবার দিন আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। বড়দা’র কাছ থেকে ৫০০/= টাকা নিয়ে দাদার বাসা থেকে বের হলাম, কানাইদের বাসার উদ্দেশ্যে। কানাইদের বাসায় গেলাম। তখন প্রায়ই দুপুর হয়ে গিয়েছিল। কানাইদের বাসায় চলছে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব। কানাইর মা আমাকেও খেতে দিলেন। সবার সাথে বসে আমিও দু’মুঠো খেলাম।

খাওয়াদাওয়া শেষে কানাই আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘সাথে টাকাপয়সা কিছু এনেছিস?’ বললাম, ‘হ্যাঁ আছে কিছু! তা হাজার খানিক হবে।’ কানাই বলল, ‘তা চলবে। ওখানে গেলে তো আর টাকার অভাব হবে না। আমি নিজেই তোকে মাসেকখানি চালাতে পারব।’ কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রওনা দিবি কয়টা বাজে?’ কানাই বলল, ‘যেই গাড়ি করে আমরা যাবো, সেই গাড়ির সুপারভাইজার এই মহল্লারই। সুপারভাইজার আসলেই আমরা রওনা দিব।’ এরপর সন্ধ্যা হবার সাথে-সাথে কানাই-সহ ওর দুই বোন আর আমি রেডি হয়ে আছি বাসের সুপারভাইজারের অপেক্ষায়। সুপারভাইজার আসলেই রওনা দিব, সেই আশায়। সন্ধ্যার একটু পরেই বাসের সুপারভাইজার কানাইদের বাসায় আসলো। কয়জন যাবে এবং কী কী সাথে নেওয়া হবে, তার একটা বিবরণ জেনে নিলো। এর কিছুক্ষণ পর সবাই রওনা দিলাম।

প্রথমে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা-গাবতলি। সেখান থেকে উঠলাম কেয়া পরিবহনে। যাওয়া হবে বেনাপোল বাংলাদেশ-ভারত বর্ডারে। বর্ডার পার হয়ে ভারত। বেনাপোল যেতে যাতে রাত ভোর হয়ে গেলো। বাস থেকে নামলাম সকাল ৭ টায়। বাসের বেশিরভাগ যাত্রীদেরই ছিল বৈধ পাসপোর্ট। ছিল না শুধু আমাদের ক’জনের। পাসপোর্ট না থাকলেও কোনও সমস্যা নেই, সাথে আছে বিনা পাসপোর্টে ভারত পাঠানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সুপারভাইজার। বাস টার্মিনালে যাওয়ার সাথে-সাথেই বর্ডার পাড় করার দালাল রেডি। সুপারভাইজার দালালের কাছে আমাদের চারজনকে বুঝিয়ে দিলেন। দালালকে পাড় করার বিনিময়ে দিতে হবে, জনপ্রতি ২০০ টাকা। দালালের সাথে কথা পাকা-পাকি হয়ে গেল বাস কাউন্টারের ভেতরেই। এরপর সাথে নেওয়া জিনিসপত্রের ব্যাগগুলো আর আমাদের বহন করতে হয়নি; যা করার দালালের লোকজনই করেছে। দালালদের ভ্যানগাড়ি করে আমাদের নিয়ে গেল দালালদের বাড়িতে।

ভারত বর্ডার সংলগ্ন বাড়ি। মনোরম পরিবেশ আর সৌন্দর্যময় জায়গা। অন্যান্য গাছ-গাছালির মধ্যে সেখানে বাঁশ গাছই বেশি। বাসস্ট্যান্ড থেকে যাওয়ার সময় দেখা যায়, বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়েই রাস্তা। রাস্তাও বেশ সুন্দর, আঁকা-বাঁকা চিকন রাস্তায় বাইসাইকেলের ছড়াছড়ি। আমরাও চারজন চারটা সাইকেলে চড়েই যাচ্ছিলাম। বাঁশ ঝাড়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, আর এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখছি। দেখে মনে হলো এ-যেন সাইকেলের রাজত্ব। বেনাপোল বর্ডার এলাকায় যার কিছুই নেই, তার একটা বাইসাইকেল মনে হয় অবশ্যই আছে। ওখানকার দৈনন্দিন জীবন চলার একমাত্র সঙ্গী হল, বাইসাইকেল। বেনাপোল বর্ডার সংলগ্ন মানুষের হাটবাজার, মালামাল পরিবহণ-সহ সবকিছুই বাইসাইকেলের ওপর নির্ভর। সাইকেল দিয়েই নেওয়া হচ্ছে বর্ডার পারা-পারের যাত্রীদের। সময়-সময় বর্ডার নিরাপত্তায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের কড়া নজরদারিও থাকে। সেসময় পাসপোর্ট বিহীন মানুষকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। ওইরকম সমস্যায় পড়ে গেলাম আমরাও। বর্ডার ক্লিয়ার নাই, তাই। বর্ডার সংলগ্ন দালালদের বাড়িতেই বন্দি অবস্থায় থাকতে হয়েছিল তিনদিন।

তিনদিন বন্দি থাকার পর যেদিন বর্ডার পার হবো, সেদিন বিকালবেলা দালাল এসে আমাদের জানিয়ে দিল আজই বর্ডার পার করা হবে। ঠিক তা-ই হল। সন্ধ্যার সময়ই দালালদের তাড়াহুড়ো বেড়ে গেল। সেদিন ঝামেলা একটু কম হয়েছে আমাদের। কারণ, সেদিন আমরা চারজন ছাড়া ভারত যাবার যাত্রী আর কেউ ছিল না। তাই মনে হলো বর্ডারে তিনদিন বন্দী থাকার মূল কারণই ছিলো, যাত্রী সংগ্রহ করার একটা চালাকি। কিন্তু এই তিনদিনের মধ্যে একজন যাত্রীও সংগ্রহ করতে না পেরে শেষমেশ আমাদের নিয়েই রওনা দিলো। আমাদের সাথে দালালরা চারজন। ওরা আমাদের সাথে নিয়ে রাতেরবেলা পায়ে হেঁটে বাঁশ ঝড়ের চিপাচাপা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো। দালালরাও ছাঁটছে, আমরাও দালালদের সাথে হাঁটছি।

দালালরা হাঁটছে আর বলছে, এখন বর্ডার উত্তপ্ত! খুব সাবধানে হাঁটবেন। কোনও আওয়াজ করবেন না। আজকে লাল সিগনাল। বিএসএফ-এর কড়া নজরদারি। ওদের কথা শুনে বুঝতে আর অসুবিধা হলো না যে, এসব হলো ভুয়া! আমাদের ভয় দেখানোই ছিলো ওঁদের বাহানা। ওঁরা দালালরা খুবই স্বার্থবাদী। টাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না। বর্ডারে তিনদিনের কষ্টের কথা মনে পড়লেই আমার শরীর এখনও শিউরে ওঠে। তিনদিন আটকা থাকা অবস্থায়, দালালদের ঘর থেকেও আমাদের বের হতে দেয়নি। শুধু ভয় আর ভয় দেখিয়েই আমাদের বন্দিশালায় বন্দী করে রেখেছিলো। এই তিনদিনে দালালদের কোনও কথার অবাধ্য হতে পারিনি। কোনোকিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি করতে গেলেও সম্মুখে বিপদ দেখা যেতো। বর্ডারে তিনদিন খুব কষ্ট করে ছিলাম। তিনদিনের থাকা খাওয়ার খরচও দেওয়া দালালদের দিয়েছিলাম। ওদের কর্কশ ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম। শেষমেশ তিনদিন পর তাদের কথামত সেদিন সন্ধ্যার পর রাতের বেলা গেলাম একটা খালপাড়ে।

বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে যখন খালপাড় গেলাম, তখন খালে কোনও নৌকা ছিল না। রাতের জোৎস্নার আলোতেই পথ চলছি দালালদের সাথে আমরা চারজন। তখন খালের স্বচ্ছ পানিতে দেখা যায়, জোৎস্নার ঝিকিমিকি। খালের প্রস্থতা কম হলেও খালটি ছিল দেখতে খুবই সুন্দর। খালের উঁচু দুই পাড়েই গাছগাছালি ভরা। শুনেছিলাম ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারে কাটাতারের বেড়া থাকে। কিন্তু খালপাড়ে কাটা তারের বেড়া নাই। খালের ওপারেই ভারত বর্ডার সীমান্তরক্ষী বিএসএফ ক্যাম্প। রাত তখন আনুমানিক ৮টা, নিরব নিস্তব্ধ এক জনশূন্য এলাকা। দালালদের একজন মুখ দিয়ে খুব জোরে একটা শিশ দিল। শিশ দেওয়ার সাথে-সাথে দুইজন লোক-সহ একটা নৌকা আসল। দালালরা বললো, ‘তাড়াতাড়ি গিয়ে নৌকায় উঠেন। আর নৌকার মাঝিকে ২০০ টাকা দিয়ে দিবেন। ওপারে যাওয়ার পর, নৌকার মাঝিই সব ব্যবস্থা করে দিবে।’

আমরা নৌকায় গিয়ে উঠে বসলাম। মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল। নৌকা পাড়ে ভিড়তেই দেখা যায়, দুইজন লোক দাঁড়িয়ে আছে যাত্রীদের অপেক্ষায়। নৌকার মাঝি লোক দুইজনকে ভালো করে বলে-কয়ে বুঝিয়ে দিলো। যেন যাওয়ার সময় কোন প্রকার অসুবিধা না হয়। নৌকার মাঝিকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে, নৌকা থেকে নামলাম। পহেলা বৈশাখ ১৪০০ বঙ্গাব্দ ১৯৯৩ ইংরেজি ভারতের মাটি স্পর্শ করলাম। নৌকা থেকে নেমেই ভারতের দালাল ওই দুইজনের সাথে আবার হাঁটতে লাগলাম। যেই দুইজন দালালদের সাথে আমরা যাচ্ছি, তাদেরও দিতে হবে জনপ্রতি ১০০/= টাকা করে, ৪০০/= টাকা। তাদের কাজ হলো, বনগাঁ যাওয়ার গাড়ীতে উঠিয়ে দেওয়া।

হাঁটতে লাগলাম বাঁশ ঝাড় আর সবজি ক্ষেতের ভেতর দিয়ে। চারিদিকে শুধু বাঁশগাছ আর সবজি খেত। সবজি খেতের মাঝখান দিয়েই পথ। রাতের জোৎস্নার আলোতেই হাঁটতে লাগলাম, ভারতের দালালদের সাথে। বাড়িঘর খুব একটা নেই। ভারতের বর্ডার এলাকায় বেশিরভাগ জায়গাই ফসলি জমি। আছে কদ্দুর পর-পর বিএসএফ এর ক্যাম্প আর দু’একটা বাড়ি। আমার খুব ভয়-ভয় লাগছিলো, যদি বিএসএফ এর ছোঁড়া গুলি গায়ে এসে লাগে? সেই ভয়ে আমি কাঁপছি আর হাঁটছি। দালাল-সহ আমরা যাচ্ছিলাম খুব সাবধানে। প্রায় আধাঘণ্টা হাঁটার পর, শোনা যাচ্ছে গাড়ির শোঁ-শোঁ শব্দ। আমি তখন মনে মনে প্রভুকে ডাকছি, হে প্রভু! তুমি রক্ষা কর! এভাবেই একসময় একটা পাকা সড়কের সামনে সবাই এসে দাঁড়ালাম।

বনগাঁ যাবার গাড়ি আসার আগেই ভারতীয় দালালদের ৪০০/= টাকা বুঝিয়ে দিলাম। বনগাঁ যাবার গাড়ি আসতেই দালাল হাত নেড়ে সিগনাল দিল। গাড়ি থামল। দালাল দুইজন আমাদের সাথে নেওয়া ব্যাগগুলো বাসে উঠিয়ে দিল। বাস ২০ মিনিট চলার পর বনগাঁ পৌঁছে গেলো। বাস থেকে সবাই নামলাম বনগাঁ রেল স্টেশনের সামনে। আমরা যাব শিয়ালদা। ট্রেন ছাড়বে রাত ১০ টায়। রেলস্টেশনের সামনে যখন গেলাম, তখন রাত ৯ টা। শিয়ালদা যাবার ট্রেন ছাড়তে আরও একঘণ্টা বাকি। এই একঘণ্টা বনগাঁ রেলস্টেশনেই বসে থাকতে হচ্ছে। এদিকে অনেক পথ হেটে আসার পর আমার অবস্থা কাহিল! আমি পেটের ক্ষুধায় কাতর হয়ে গিয়েছিলাম। বড্ড খিদা লেগেছিলো আমার। বাস থেকে নামার পর বনগাঁ রেলস্টেশনের সামনে থাকা খাবারের দোকানগুলো দেখে আমার পেটের ক্ষুধা আরও বেড়ে গেলো। আমি কানাইকে বললাম, ‘হে রে কানাই! এখান থেকে কিছু খেয়ে নিলে হয় না? আমার খুব খিদে পেয়েছে রে!’

আমার সাথে তাল মিলিয়ে কানাইর দু’বোনও কানাইকে বলল, ‘সত্যি দাদা, খুব খিদে লেগেছে! কিছু খেয়ে নিলে ভালো হয়।’ কানাই বলল, ‘এখানে কিছু এদিক-সেদিক ব্যাপার আছে! সবাই একসাথে যাওয়া যাবে না। সবাই একসাথে গেলেই বিপদে পড়তে হবে। আর নানারকম ঝামেলাও হবে। কারণ, এখানকার মানুষ খুবই চালাক! আমাদের দেখেই বুঝে ফেলবে আমারা বাংলাদেশি। তখন হয়ত পুলিশের ঝামেলায়ও পড়তে পারি।’ কানাইর দু’বোন বলল, ‘তা-হলে কী কিছু খাওয়া যাবে না?’ কানাই বলল, ‘আগে স্টেশনের ভেতরে যাই, পরে দেখা যাবে।’ আমি বললাম, ‘তা-হলে চল, স্টেশনের ভেতরেই যাই!’ সাবাই আস্তেধীরে রেলস্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। ভেতরে গিয়ে নিরিবিলি এক জায়গায় সাথে নেওয়া ব্যাগগুলো রাখলাম। এরপর কানাই আমাকে বলল, ‘তুই ব্যাগগুলোর সামনে একটু দাঁড়া, আমি ওদের নিয়ে হোটেলে যাই। ওদের নিয়ে আসার পর, তোকে নিয়ে আবার বাইরে যাব।’ আমি বললাম, ‘যা, একটু তাড়াতাড়ি আসবি।’

কানাই স্টেশনের বাইরে যাবার আগে বলল, ‘কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বুঝে শুনে জবাব দিবি। আর কেউ যদি জিজ্ঞেস করে যে, কোথায় যাবেন? তা-হলে বলবি, শিয়ালদা যাব। যদি জিজ্ঞেস করে কোত্থেকে এসেছেন? তাহলে বলবি, বনগাঁ হাই স্কুলের পূর্বপাড় থেকে এসেছি। বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে বলবি, আপনার এতো দরকার কী? উল্টো তাকেই প্রশ্ন করবি, আপনার বাড়ি কোথায়? আপনি কোথায় যাবেন? এখানে কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তা-হলে দেখবি, প্রশ্নকারী ব্যক্তি তোর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এদেশ হল শক্তের ভক্ত, নরমের যম, বুঝলি।’

কানাই ওর দু’বোনকে নিয়ে স্টেশনের বাইরে গেল কিছু খেতে। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। সাথে নেওয়া ব্যাগগুলো আমার পাশে। আমার ভেতরটা কেমন যেন ভয়ে কাঁপছিল। আমি ভয় ভয় মনে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। স্টেশনে থাকা ট্রেনের টিটিকে দেখলেও আমার শরীর ছমছম করছিলো। কারণ, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সাথে নেই পাসপোর্ট। ধরা পড়লেই প্রথমেই আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধী! একবার ধরা খেলে আর রক্ষা নাই। যদি ধরা পড়ে যাই, দেশে রেখে আসা দুটো সন্তানের দশা কী হবে? ওদের কে দেখবে! স্ত্রীর কী গতি হবে? বিনা পাসপোর্টে কেন-ই-বা আসলাম! না আসলেও তো হতো। আমার চিন্তার শেষ নেই! কানাইও আসছে না। সিগারেটে অভ্যস্ত লোক আমি। সাথে একটা সিগারেটও ছিলো না। আমি যেন একটা মহাসাগরের মাঝখানে পড়ে আছি। কিন্তু আমার ধারেকাছে একটা লোকও ছিলো না। আমিই পুরো বনগাঁ রেলস্টেশনের ভেতরে একা বসে আছি। আর মনে মনে ভাবছি! কানাই আসছে না কেন? ওরা কি পুলিশের হাতে ধরা পড়লো নাকি!

এমন অনেককিছু ভাবতে-ভাবতে একসময় কানাই ওর দু’বোনকে নিয়ে হাজির হল। ওদের দেখে আমার যেন প্রাণ ফিরে এলো। মনের চিন্তাও দূর হলো। আমার তখন সাহস হচ্ছিল। এতক্ষণ ভয়ে আমার শরীরের সমস্ত রক্ত বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। আমাকে একা রেখে বাইরে গিয়ে কানাইও আমার কথা ভাবতেছিল, ‘যদি কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে। আর যদি আমি উল্টাপাল্টা কিছু যদি বিলে ফেলি? তাহলে তো মহা বিপদ। ভারতের পুলিশের হল রাজার হাল! তাঁদের সহজে দেখা যায় না। আবার কাউকে ধরলে আর ছুটানো যায় না। আবার ভারতে বাটপারের অভাব নেই। সব জায়গায়, সবখানে বাটপারদের রাজত্ব। যদি কোনও বাটপারের কবলে পড়ি?’ এমন চিন্তা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে কানাই চলে এলো।

কানাই এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে? ভয়ে ছিলি নাকি? আমি তো তোর জন্য খুবই চিন্তায় ছিলাম। তুই এখানে নতুন! তোর ভাষাও বাংলাদেশী। কথা বললেই ধরা খাওয়ার জোগাড়! আবার কোনও জায়গার নামও জানিস না। এসব চিন্তা করে আমি তাড়াতাড়ি চলে এলাম। এখন বল, তোকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেছে?’ আমি বললাম, ‘আরে না, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি। আর জিজ্ঞেস করলে জবাব দিতাম। তবে তোদের আসতে দেরি দেখে আমি নিজেই একটু চিন্তায় ছিলাম। ভেবেছিলাম, যদি কোনও বিপদে পড়িস, তা-হলে তো মহাবিপদ হবে। এখন তোদের দেখে একটু ভালো লাগছে। এতক্ষণ শরীরটা অস্থির লাগছিল। এবার আমাকে কিছু খাওয়া? আমার খুব খিদা পেয়েছে রে।’

আমার কথা শুনে কানাই বলল, ‘এখন-তো এখানে ওদের একা রেখে স্টেশনের বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি তোকে দেখিয়ে দিচ্ছি! তুই বরং একা গিয়েই ঝটপট কিছু খেয়ে আয়। ওখানে আটার রুটি, চা-বিস্কুট সবই আছে। তুই তাড়াতাড়ি যা। ঝটপট না করলে সমস্যা হবে। কারণ, কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন আসবে। ট্রেন আসলে আর বেশি দেরি করে না। যাত্রী উঠতে নামতে যতক্ষণ দেরি, ততক্ষণই। কারেন্টের ট্রেন। হুইসেল দিলেই ছুটলো। তুই যা তাড়াতাড়ি করে কিছু খেয়ে আয়।’ কানাইর কথা শুনে আমি প্রথমে ভয় পেয়ে ছিলাম। পরে ক্ষুধার জ্বালায় সাহস করে বললাম, ‘বাইরে যাওয়ার সময় স্টেশনের গেইটে থাকা গার্ড কিছু জিজ্ঞেস করবে?’ কানাই বলল, ‘না না, গার্ড কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। তুই তাড়াতাড়ি গিয়ে খেয়ে আয়। ট্রেন আসার সময় হয়ে গেল।’ আমি বললাম, ‘আচ্ছা যাচ্ছি!’ আমি যাওয়ার আগে কানাই জিজ্ঞেস করল, “বর্ডার থেকে যেই টাকা বদল করে দিয়েছি, সেই টাকা থেকে কিছু টাকা আলাদা করে রাখ। সব টাকা বাইর করার দরকার নেই। কোনও বাটপার দেখলে তোর পেছনে লাগবে। ভারতের বাড়ি, টাকার খুব দাম!’ আমি কানাইর কথামত কিছু টাকা সামনের পকেটে রাখলাম। আর বাদবাকি টাকা প্যান্টের ভেতরের পকেটে রাখলাম। ভগবানকে ডাকতে ডাকতে গেলাম গেইটের বাইরে।
চলবে…

জীবনের গল্প-২২ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২০

Image-6411-8

জীবনের গল্প-১৯-এর শেষাংশ: তখন কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিলো যে, ভাড়া বাড়ি থেকে প্রাণভয়ে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে মিলের ভেতরে থাকতাম। মিলের ভেতরে অন্তত তিন-চার দিন সপরিবারে অবস্থান করেছিলাম।

বাবরি মসজিদ নিয়ে সে সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা তুলে ধরলাম। ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ কিন্তু ভারতীয় উগ্রবাদী হিন্দু সম্প্রদায় ধংস করে ১৯৯০ সালে অক্টোবরের শেষদিকে। আমি তখন নারায়ণগঞ্জ গোদনাইল এলাকায় মহিউদ্দিন স্পেসালাইজড টেক্সটাইল মিলে। বাসাও ছিলো মিলের সাথেই। সেসময় ভারতের অযোদ্ধায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করায় বাংলাদেশী মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে সংগঠিত হয় দাঙ্গা। তখন বাবরি মসজিদ ভাঙার জেরে এদেশের হিন্দুদের উপর অক্টোবর থেকে শুরু করে নভেম্বরের ২-৩ তারিখ পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে দমনপীড়ন চলতে থাকে। কিন্তু আশার কথা হলো, তখন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে জ্বালাও পোড়াও ধর মার হলেও, নারায়ণগঞ্জ জেলায় ভয়াবহ তেমন কিছু ঘটেনি।

কিন্তু ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ তেমন কিছু না ঘটলেও, ওই ঘটনার সূত্র ধরেই ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জেলা শহরে হিন্দুদের উপর বিরামহীন অত্যাচার, নির্যাতন, লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণের মত জঘন্য নিষ্ঠুরতা চলতে থাকে। সেই সময়কার ঘটনায় অনেক মা বোনের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছিল। অনেক হিন্দুদের প্রাণহানিও ঘটেছিল। অনেক বোনদের ধর্মান্তর করে বিবাহ করা হয়েছিল। এই সহিংসতার সময় আমি ঢাকা সদরঘাটের নদীর ওপারে কালিগঞ্জ রশিদ স্লিক টেক্সটাইল মিলে চাকরিরত অবস্থায় ছিলাম। সেই নির্যাতনের দৃশ্য আজো চোখের সামনে ভেসে উঠে। তখন আমি আমার বাচ্ছা-কাচ্চা নিয়ে এক হিন্দু বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। আমার মিলের মালিক একজন মুসলমান হয়েও, মালিক নিজে মিলে এসে ম্যানেজারকে নির্দেশ দিলেন আমার পরিবারবর্গ নিয়ে মিলের ভিতরে আশ্রয় নিতে। তারপর সপরিবারে মিলের ভিতরে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বেঁচে যাই।

যাই হোক, রশিদ স্লিক মিলে তিন-চার দিন পর পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হলে; আবার ভাড়া বাসায় গিয়ে উঠলাম। এরপর থেকে আবার রশিদ স্লিক মিলে নিয়মিত কাজ করতে লাগলাম। কিন্তু একসময় সেই মিলেও বেশিদিন কাজ করতে পারিনি, কিছু অসাধু শ্রমিক কর্মচারীদের জ্বালায়! ওদের দাবি-দাওয়া নিয়ে ওদের সাথে থাকলেও, পরবর্তীতে মালিকের পক্ষ নিয়ে উল্টো আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করে। কিন্তু মিলের মধ্যে ওরা হলো শ্রমিক, আর আমি ছিলাম মালিকের বেতনভুক্ত কর্মচারী। তবুও আমি সবসময় শ্রমিকদের পক্ষেই কথা বলতাম। এটাই ছিলো আমার একমাত্র দোষ। এতে গা জ্বালা ধরে মালিকের আপন ভাগিনা ম্যানেজার রিপন মিয়ার। মালিক মোয়াজ্জম সাহেবের বাড়ি ছিলো বিক্রমপুর। ম্যানেজার রিপনের বাড়িও বিক্রমপুর। মিলের ডিজাইন মাস্টার ছিলেন, আমাদেরই হিন্দু ধর্মীয় একজন। নাম মৃণাল কান্তি সরকার।

তাকে আমি যেমন বাঘের মতো ভয় পেতাম, তেমন আবার পীরের মতো শ্রদ্ধা করতাম। উনার অনুপুস্থিতে মিলের ডিজাইনের টুকিটাকি কাজ আমিই চালাতাম। এতে তিনি উপরে উপরে খুবই খুশি ভাব দেখাতেন, ভেতরে ভেতরে থাকতেন রাগে গোস্বায়। কিন্তু আমি উনার মুখের হাসিটাই সবসময় দেখতাম, রাগ গোস্বা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। শেষ পর্যন্ত উনিই পীরের ভুমিকা নিয়ে নাটের গুরু সেজে মালিকের সাথে বসে থাকে।

যে কারণে আমি দোষী হয়েছিলাম– “সামনে ছিল ঈদ-উল-ফিতর। মিলে ছিলো না প্রোডাকশন। তাঁতিদের ছিলো করুণ অবস্থা। এরমধ্যে ঘোষণা আসে ঈদে কাউকে বোনাস দেওয়া হবে না। মিলের সব তাঁতিদের মাথায় ভেঙে পড়লো মহাকাশ। মিলের সব তাঁতি আমাকে খুবই মান্য করতো। ওরা আমার কাছে ওদের কথা জানালো। ওদের কথা হলো, ‘যে করেই হোক ঈদে বোনাস আদায় করতেই হবে, আপনি আমাদের সাথে থাকবেন। এতে কারের চাকরি চলে গেলেও, বোনাস আদায় করা হবে।’ আমার সম্মতি চাইলে আমি ওদের সাথে থাকবো বলে কথা দিই। একসময় ঈদ ঘনিয়ে এলে শ্রমিকদের এক কথা দুই কথায় মিল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মিল ম্যানেজার, মাস্টার আমাকে অফিসে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওদের সাথে আমি আছি কিনা?’ আমি বললাম, ‘যেখানে সবাই একসাথে মিলে-মিশে কাজ করি। সেখানে ওদের সাথে না থাকাটা হবে বেঈমানী। আমি ওদের সাথেই আছি। আমার কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে মিল থেকে চলে যেতে বললো।’ আমি সাথে সাথে মিল থেকে বেরিয়ে যাই। তারপর দেখা গেলো মিলে থেকে শুধু আমি একাই বেরুলাম, আর একজনও বের হয়নি। সবাই সামান্য কিছু ঈদ বকসিস পেয়ে দিব্বি বহাল তবিয়তে কাজ করতে থাকে।” কিন্তু আমি আর মিলের সামনেও গেলাম না।

চাকরির সন্ধানে গেলাম ইসলামপুর আমার আগের মালিক মিলন সাহেবের কাছে। তিনি আমাকে দেখে খুবই খুশি হলেন। বসতে বললেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় আছি।’ বললাম, ‘বর্তমানে বেকার। থাকি নদীর ওপার কালীগঞ্জ। ছিলাম মোয়াজ্জেম সাহেবের ভাড়া নেওয়া রশিদ স্লিকে। উনি মোয়াজ্জেম সাহেবের কথা শুনে চিনতে পেরে বললেন, ‘ওহ্, মোয়াজ্জেম? এলিগেন্ট ফেব্রিকসের মালিক?’ বললাম, ‘হ্যা স্যার!’ তখন মিলন সাহেব বললো, ‘আমিতো তোমাকেই খুঁজছিলাম। কিন্তু তোমার কোনও খোঁজ পাচ্ছিলাম না। আমি ঢাকা গুলশান এলাকায় নতুন করে একটা মিল করেছি। ২০টি তাঁত বসিয়েছি। মিল অলরেডি চালু আছে। কিন্তু ড্রয়ার করার লোকের সমস্যা। তোমাকে পেয়ে চিন্তামুক্ত হলাম। তুমি আগামীকালই গুলশান আমার মিলে চলে যাও!’ আমি মিলন সাহেবের কথা শুনে স্বর্গসুখ পেলাম। আমিও একরকম চিন্তামুক্ত হলাম।

তিনি আমাকে ৫০০/= হাতে দিয়ে উনার মিলের ঠিকানা লিখে দিলেন। আমি বাসায় আসার পথে কিছু বাজার-সদাই করে বাসায় আসলাম। পরদিন সকালবেলা মিলন সাহেবের দেয়া ঠিকানামতো চলে গেলাম ঢাকা গুলশান। সেখানে গিয়ে দেখি পরিচিত আরও দুইএক জন তাঁতি সেই মিলে কাজ করছে। তাদের দেখে খুবই ভালো লাগলো। সেদিন আর কোনও কাজ করলাম না, পরদিন কাজ করার জন্য সবকিছু ঠিকঠাক করে আবার সন্ধ্যার পর কালীগঞ্জ নিজের বাসায় ফিরে গেলাম। পরদিন সকালে গুলশান মিলে গিয়ে কাজ করা শুরু করি। আমার ফ্যামিলি বাসা থেকে যায় রশিদ স্লিকের সাথেই। বাসায় আসতাম প্রতি শুক্রবার। শনিবার সকালে আবার গুলশান মিলে চলে যেতাম।

এভাবে মিলন সাহেবের গুলশান মিলে মাসেক ছয় মাসের মতো খুব সুন্দরভাবে কাজ করেছিলাম। একসময় বর্ষাকালের আগমন ঘটে। গুলশান এলাকায় যেখানে মিলটি ছিল, সেই এলাকাটি নিচু এলাকা। এলাকাটির নিচু হওয়াতে, সামান্য বৃষ্টিতেই পুরো এলাকা বন্যার মতো হয়ে যেতো। তার উপর আবার বন্যার সিজন। একসময় ভারি বর্ষণের কারণে মিলের ডিপার্টমেন্টের ভেতরে পানি ঢুকে যায়। পানির বেড়ে যাওয়ার কারণে মিল মালিক মিলন সাহেব কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। মিলের সব শ্রমিকদের পাওনা টাকা বুঝিয়ে দিয়ে ১৫দিন ছুটি ঘোষণা করে। তখন আমি বাসায় চলে যাই। মিল থেকে যেই টাকা বেতন পেয়েছিলাম, তা ছিল খুবই সামান্য।

কয়েকদিন পরই ছিলো বাসা ভাড়া দেওয়ার তারিখ। কিন্তু হতে টাকা ছিলো খুবই কম। তখন নিজের গিন্নীর সাথে বোঝাপড়া করলাম, কী করা যায়! গিন্নী বুদ্ধি দিলো, সে কিছুদিনের জন্য ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে থাকবে। এই কিছু দিনের মধ্যে একটা ভালো চাকরি খুঁজে নিতে। গিন্নীর কথায় রাজি হয়ে তা-ই করলাম। গিন্নীকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে, চলে আসলাম নারায়ণগঞ্জে বড় দাদার বাসায়। বড় দাদার কাছে বর্তমান অবস্থা খুলে বললে, দাদা আমাকে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য ৫০০/= টাকা টাকা দেয়। এরপর সেখানে দুইদিন ঘোরাঘুরি করে আবার চলে গেলাম শ্বশুরবাড়িতে। শ্বশুরবাড়ি থেকে গিন্নীকে নিয়ে আবার চলে আসলাম কালীগঞ্জ নিজের বাসায়। কিন্তু অনেক ঘোরাঘুরি করেও কোথাও আর চাকরি ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। এভাবেই কয়েকদিন কেটে গেলো।

ক‘দিন পর হঠাৎ কানাই ভারত থেকে নারায়ণগঞ্জ আসে, ওর দুই বোনকে ভারত নিয়ে যাওয়ার জন্য। কানাই নারায়ণগঞ্জ এসেই আমার খবর সংগ্রহ করে জানতে পারল, আমি কালীগঞ্জ আছি। কানাই আমার খোঁজে চলে গেলো কালীগঞ্জ রশিদ স্লিক মিলে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলো আমি চাকরি ছড়ে গুলশান চলে গেছি। কানাই মিলের দারোয়ানের কাছে আমার বাসার ঠিকানা চাইলে, দারোয়ান কানাইকে নিয়ে আমার বাসায় রওনা হয়। পথিমধ্যে আমার সাথে দেখা। আমি বাসা থেকে চা দোকানে যাচ্ছিলাম। কানাইকে দেখে আমি অবাক! তারপর কানাইকে নিয়ে চা দোকানে গেলাম। সাথে রশিদ স্লিকের দারোয়ান চাচাও। চা-বিস্কুট খেলাম। আমার বর্তমান অবস্থা বললাম, কানাই শুনলো। এরপর কানাই বললো, ‘তুই আমার সাথে ভারত যাবি?’ আমি বললাম, ‘আগে বাসায় চল, তারপর কথা হবে।’ কানাইকে নিয়ে গেলাম বাসায়। সময়টা তখন ১৯৯৩ সালের মার্চমাস। ১৩৯৯ বাংলা চৈত্রমাস।

বাসায় যাওয়ার পর কানাইকে দেখে গিন্নী ও অবাক! কানাই আমার গিন্নী কে বললো, ‘ওকে আমি আমার সাথে ভারত নিয়ে যাবো। এখানে থেকে ও কিছুই করতে পারবেনা। তুমি বৌদি আপাতত কয়েক মাস বাপের বাড়িতে থাকবে। তারপর ওখানে ওর একটা চাকরি অথবা যেকোনো কাজ ঠিক হলে গেলেই তোমাকে ওখানে নিয়ে যাওয়া হবে। তুমি কি রাজি?’ কানাইর কথায় আমার গিন্নী কিছুই বলেনি, শুধু বললো, আচ্ছা দাদা তা পরে দেখা যাবে।’ কানাইও আর বেশিকিছু না বলে শুধু বললো, ‘আমি যা বলে গেলাম, তা তোমরা বুঝে দেখবে। আমি চললাম। এই বলেই কানাই সেদিনের মত আমার বাসা থেকে ওদের বাসায় চলে যায়।

কানাই চলে যাওয়ার পর আমি আমার গিন্নী কে বললাম, ‘কানাই যে ভারত যাওয়ার কথা বলে গেল, এখন তোমার অভিমত কী?’ আমার গিন্নী বলল, ‘তুমি যদি ভারত যাও, তবে-তো চাকরি, বাসা দুটোই ছাড়তে হবে।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ তা-তো ছাড়তেই হবে। তুমি মাসেক ছ’মাসের জন্য বাপের বাড়িতে থাকবে। ওখানে একটা ব্যবস্থা করে নিতে আমার বেশ একটা সময় লাগবে না। আমি মাসেক তিন-মাস পর এসে তোমাকে নিয়ে যাব।’ গরীবের মেয়ে স্বামীর কথায় বিশ্বাসী। তাই আর আমার কথায় অমত করেনি। আমি যে-ভাবে বলেছি, ও তা-ই মেনে নিচ্ছে। গিন্নীর সাথে কথা একরকম পাকা-পাকি হয়ে গেল।

পরদিন আবার কানাই আমার মিলে আসলো। কনাইকে নিয়ে আমি বাসায় গেলাম। কানাই আমার গিন্নী কে জিজ্ঞেস করলো, ‘বৌদি, আমি যে গতকাল বলে গিয়েছিলাম তা তোমরা কী বুঝ পরামর্শ করলে?’ আমার গিন্নী বললো, ‘কানাইদা, আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করবেন। ওখানে গিয়ে যদি ভালো একটা কাজকর্ম করতে পারে, তাহলে তো ভালোই হবে।’ কানাই বললো, ‘নিতাই তো আমার ওস্তাদ। আবার আমার বড় ভাইয়ের মতো। ওর ভালোই আমার ভালো। তোমরা শান্তিতে থাকবে, এটাই আমি চাই। এখানে তো তোমরা সারা বছর কষ্টই করে যাচ্ছ। ওখানে গেলে তোমাদের কোন কষ্ট হবে না। এব্যাপারে তুমি একশভাগ নিশ্চিত থাকতে পার! আর আমি নিতাইকে যার ওখানে নিয়ে যাবো, তার নাম রতন চক্রবর্তী। তাকে নিতাইও খুব ভালো করে চেনে জানে। সেই লোক নগর খানপুর থাকে। তার একটা বাড়ি আছে ভারত চব্বিশ পরগনা জেলায়। জায়গার নাম ফুলিয়া। সেই বাড়িতেই তোমরা থেকে বাড়ি দেখাশুনা করবে। এতে ভালোই হবে।’ এই বলেই কানাই আমার বাসা থেকে চলে গেলো ওদের বাসায়। পরদিন আমি নগর খানপুর রতন চক্রবর্তীর সাথে দেখা করে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করে ভারত যাবার প্রস্তুতি নিই।
চলবে…

জীবনের গল্প-২১ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১৯

Image-6411-8

জীবনের গল্প-১৮-এর শেষাংশ: একসময় আড়াইউল্লা নিয়ম করে কানাই, কালাম-সহ নতুন বউয়ের সাথে তার ছোট ভাইকে নিয়ে আমি চলে আসি নারায়ণগঞ্জ নন্দিপাড়া নিজের বাসায়। এর দুইদিন পরই বৌভাত অনুষ্ঠান। বউভাত অনুষ্ঠানে দুই মিলের লোক-সহ প্রায় ১০০ জন লোকের আয়োজন করা হয়। এরপর থেকে চলতে লাগলো, স্বামী-স্ত্রীর সাংসারিক জীবন।

তারপর থেকে মা আর বোন মরা ভাগ্নি-সহ স্বামী স্ত্রীর সংসার খুব সুন্দরভাবে চলতে লাগলো। আমি ওয়েল টেক্স মিল থেকে মাসে যেই টাকা বেতন পেতাম, খেয়ে-দেয়ে তা থেকে বেশকিছু টাকা আমার আয় থাকতো। নন্দিপাড়া যেই বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, সেই বাড়িতে আরও কয়েকটা ভাড়াটিয়া ছিলো। তাদের মধ্যে কয়েকজন ভাড়াটিয়া ছিলো ব্যাবসায়ী। আর কয়েকজন ছিলো আমার মতন দিনমজুর। সেসব ভাড়াটিয়াদের সেথে পাল্লা দিয়েই চলছিলো আমাদের ছোট সংসার। সংসারে কোনও কিছু নিয়ে তেমন কোন কথা কাটা-কাটিও হতো না। থাকলে খেতো, না থাকলে পেট মাটিতে চাপে শুয়ে থাকতো। কিন্তু ঝগড়াঝাটি আর নাই নাই হতো না।

সময়টা তখন ১৯৮৬ সালের শেষদিকে। সেসময় বাংলাদেশি শাটিং শ্যুটিং কাপড়ের অনেক চাহিদা ছিলো। মিলেও তেমনই ছিলো প্রচুর কাজ। কাজের এতো চাপ ছিলো যে, অনেক সময় সারারাত আমাকে মিলে ওভারটাইম করতে হতো। ওভারটাইম করতে গিয়ে সারারাত মিলেই থাকতে হতো। ওভারটাইমের টাকা পেতাম সপ্তাহে। আর মূল বেতন পেতাম মাসের ১০ তারিখে। হঠাৎ এক সময় শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে মিল মালিকের সাথে স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের মনোমালিন্য হতে থাকে। মিল মালিক নিয়াজ সাহেবের সামনে স্থানীয় নেতারা টেবিলে থাপ্পর মারে কথা বলে। এতে মিল মালিক নিয়াজ সাহেবের মন খারাপ হয়ে যায় যায়। এই মন খারাপ থেকে আস্তে আস্তে মিল মালিকের মিলের প্রতি অনীহা বাড়তে থাকে। মিলেও আসতো খুবই কম! মিলে সুতাও ঠিকমতো দিতো না। এতে তাঁতিদের যেমন পেটে পড়লো আঘাত, তার চেয়ে বেশি ব্যাঘাত সৃষ্টি হলো আমার এবং আমার সংসারের।

কয়েকমাস খুবই কষ্টে সংসার চলতে লাগলো। নতুন করে এক মিলে গিয়ে যে কাজ করবো, সেই সুযোগও পাচ্ছিলাম না; ওয়েল টেক্স মিলের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়ার করণে। এদিকে সবেমাত্র নতুন বিয়ে, নতুন বউ সংসারে। কাজকর্মের অবস্থাও বেশি ভালো যাচ্ছিল না। টেনে-টুনে সংসার চালাতে গিয়ে দেনা ঋণগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। এভাবে চলতে চলতে এক সময় মিল মালিক চূড়ান্তভাবে মিল লে – আপ ঘোষণা করলো। শ্রমিকদের দেনা পাওনা বুঝে নিতে নোটিশ টাঙিয়ে দিলো। কিন্তু আমরা কেউ দেনা পাওনার হিসাবের জন্য মাথা ঘামাচ্ছিলাম না। আমরা একজোট হলাম, মিল পুনরায় চালু করার জন্য। কিন্তু না, মিল মালিক প্রয়োজনে মিলে বিক্রি করে দিতে প্রস্তুত, কিন্তু মিল চালু করবে না। আমি পড়ে গেলাম বিপাকে।

আবার কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে ঘোরা-ফেরা করতে লাগলাম। আমার ঘোরা-ফেরা ফাইন টেক্সটাইল মিলের ম্যানেজার সাহেব ফলো করলো। আমার বড় দাদার কাছে জানলো যে, আমার কাজ নেই! ম্যানেজার সাহেব কিছু দিনের জন্য আপনাকে তাঁতের কাজ করতে বললে। তারপর সংসারের অভাব দূর করার জন্য ফাইন টেক্সটাইল মিলে তাঁতের কাজ করতে থাকি। বেশ কয়েকমাস তাঁতের কাজ করার পর ঢাকা মিরপুর চিড়িয়াখানা সংলগ্ন একটা মিল থেকে খবর এলো। খবর পাঠিয়েছিল সাত্তার ওস্তাদ। যার সাথে বিয়ের আগে একবার ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিলে গিয়েছিলাম। তিনিই আমার কাছে লোক মারফত খবর পাঠায়। মিরপুর মিলে জর্জেট সুতার ওড়না তৈরি হবে। কিন্তু মিলটি ছিল একেবারে নতুন। মেশিন সব বসানো হলেও মেশিনে কাপড় উৎপাদন শুরু হচ্ছিল না।তখন ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়।

সিদ্ধান্ত নিলাম, ফাইন টেক্সটাইল মিলের তাঁতের কাজ ছেড়ে মিরপুর সাত্তার ওস্তাদের ওখানেই চলে যাবো। বড় দাদা, মা ও নিজের স্ত্রীর সাথে আলাপ করলাম। রায় পেলাম, ‘ভালো মনে হলে যাও!’ তখন স্ত্রীকে কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়িতে থাকার জন্য পরামর্শ দিলাম। স্ত্রী আমার পরামর্শে রাজি হলো। তাকে বাপের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। সে-বছর ছোটখাট একরম বন্যাও দেশে দেখা দিয়েছিল। শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে দেখি তাদের অবস্থাও বেশি ভালো নেই। বন্যার কারণে কাজকর্মে নেই। তারপরও আমার সমস্যা দেখে আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি মেয়েকে তাদের বাড়িতে রেখে দেয়। আমি দুইদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে আসি।

এর পরদিনই মিরপুরের ঠিকানায় চলে যাই। ওখানে গিয়ে সাত্তার ওস্তাদের সাথে কাজ করতে থাকি। বেতন প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার। শুক্রবার বেতন হতে পেলেই নারায়ণগঞ্জ চলে আসতাম, মাকে বাজার সদাই করে দেওয়ার জন্য। এভাবে মিরপুর ওই মিলে দুই মাসের মত কাজ করেছিলাম। তারপর ওখানে তেমন পোষাচ্ছিল না। তাই একসময় মিরপুর মিলের কাজ ছেড়ে দিই।

মিরপুর মিলের কাজ ছেড়ে আবার নারায়ণগঞ্জ এসে ওয়েল টেক্স মিলের খবরাখবর সংগ্রহ করতে থাকি। কারণ, ওয়েল টেক্স মিলে পাওনা সার্ভিসের টাকার জন্য। তখন জানতে পারি যে, মিল মালিকের ইসলামপুর দোকানে গেলেই সার্ভিসের পাওনা টাকা দিয়ে দিবে। আমাদের সাথের অনেক শ্রমিকরা সেখান থেকে সার্ভিসের টাকা তুলেও এনেছিল। গেলাম ঢাকা ইসলামপুর ওয়েল টেক্স মালিকের দোকানে। রিজাইন দরখাস্তে সই করলাম। সার্ভিসের টাকা পেলাম ৪০০/=টাকা। এরপর মিল মালিক নিয়াজ সাহেব আমার কানের অবস্থা জানতে চাইলেন। বললাম, ‘সেই আগের মতই আছে।’ আমার কথা শুনে ওয়েল টেক্স মিলের মালিক নিয়াজ সাহেব আমাকে আরও ২০০০/=টাকা হাতে দিয়ে বললেন, ‘নিতাই আমি তোমার কাজ খুবই পছন্দ করতাম। তোমাকে আমি পাকিস্তান নিয়ে চিকিৎসা করতাম। যদি মিল চালু থাকতো। কিন্তু তা আর হলো না, তোমাদের নেতাদের কারণে।’

শ্রমিক নেতাদের ব্যাপারে আরও অনেক কথাবার্তা ও বললো। দোকান থেকে আসার সময় আবার ডেকে নিয়ে এক পিস প্যান্টের কাপড় আর এক পিস শার্টের কাপড়ও আমাকে দিয়ে দিলো। আমি সেগুলো নিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে নারায়ণগঞ্জ নিজের বাসায় ফিরে আসি। বাসায় এসে ৬০০০/= টাকা মায়ের হতে দিয়ে বললাম, ‘মা, এই টাকা আমার কপাল বিক্রির টাকা। মা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিসের টাকা?’ বললাম, ‘মিলের সার্ভিসের টাকা। মানে ওয়েল টেক্স মিলের চাকরি শেষ!’ তখন আমার মা বুঝতে পেরেছিল। এর একদিন পর আবার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে গিন্নিকে নিয়ে আসি নিজের বাসায়। এরপর নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল এলাকায় মহীউদ্দীন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলে কাজ নেই। মিল মালিক ছিলেন, শেখ আব্দুল হাকিম সাহেব। উনার বাড়ি ছিলো কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলে ছাতার কাপড় তৈরি হতো। সেই মিলে মাত্র ১,৭০০/= টাকা বেতনে কাজ নেই। তখন নারায়ণগঞ্জ নন্দি পাড়ার বাসা ছেড়ে মহিউদ্দিন স্পেসালাইজড টেক্সটাইল মিলের সাথেই বাসা ভাড়া নিলাম। বাসা ভাড়া মাত্র ১২০/= টাকা।

সময়টা তখন ১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি। কয়েক মাস কাজ করার পরই শুরু হলো সারা দেশব্যপী ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডব। বন্যার পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য আবার গিন্নীকে নিয়ে রেখে আসি শ্বশুরবাড়িতে। তখন কানাইর কাজ ছিলো না। তাই কানাই সারাদিন আমার সাথেই থাকতো। আমি মিলের সাথে যেই বাস ভাড়া করেছিলাম, সেই বাসা বন্যার পানিতে ডুবে গিয়েছিল। তখন মাকে নিয়ে উঠলাম নিকটস্থ পাঠানটুলি ভোকেশনাল টেকনিক্যাল ট্রেনিং স্কুল এ্যাণ্ড কলেজে। আমি আর কানাই সারাদিন যেখানেই থাকতাম-না-কেন, দুইজনে রাতে ভোকেশনাল স্কুলে এসে ঘুমাতাম। তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের আমল। প্রচুর রিলিফ পেতাম। আবার মিলের বেতনও পেতাম। সেই ভয়াবহ বন্যার সময় খুবই ভালোভাবে চলছিলাম। একসময় বন্যার আলামত শেষ হলো। সবকিছু স্বাভাবিক হলো। মিলের কাজকর্ম চালু হলো। কানাইও আবার ওর নিজের কাজে চলে গেলো। আমি অন্য একজন হেলপার নিয়ে কাজ করতে থাকি। সময় ১৯৮৯ সাল। আমার প্রথম মেয়ের জন্ম হলো। নাম, অনিতা রানী পাল। এর কিছুদিন পর কানাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়, ওর এক মামার কাছে।

কানাই ভারত চলে যাবার কয়েক মাস পর আমার মা-ও চলে গেলো পরপারে স্বর্গের দেশে। মা স্বর্গীয় হবার কিছুদিন পর মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলের মালিকের সাথে আমার বেতন নিয়ে লেগে গেলো হট্টগোল। তারপর চাকরি ছেড়ে গ্রাম মহল্লায় লেইস ফিতা বিক্রি করতে লাগলাম। লেইস ফিতা বিক্রি করলাম কয়েক মাস। সময় তখন ১৯৯১ সাল। আমার দ্বিতীয় ছেলে সন্তান জন্ম হলো। নাম, অনিল চন্দ্র পাল। একদিন ওয়েল টেক্স মিলের রফিক নামে একজন ঘনিষ্ঠ তাঁতি আমাকে নিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জের অদূরে মুন্সিগঞ্জ মুক্তারপুর ফেরিঘাট সংলগ্ন এক মিলে। তখন মুক্তারপুর ব্রিজ ছিলো না। ওই মিলের তাঁত মেশিন ছিলো কোরিয়ার। সেই মিল ভাড়া নিয়ে চালাতেন বিক্রমপুরের এক মালিক। মালিকের নাম মোয়াজ্জেম সাহেব। উনার দোকানের নাম ছিলো এলিগেন্ট ফেব্রিকস। দোকানের নামেই তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম এলিগেন্ট ফেব্রিকস।

সেখানে দুইমাস কাজ করার পর উনি মোয়াজ্জেম সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন ঢাকা সদরঘাটের ওপারে। জায়গাটা হলো কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকা তেলঘাট। মিলের নাম রশিদ স্লিক। সেই মিলেও কোরিয়ান মেশিন। সেই মিলে হেলপার সহ ৫,০০০/= টাকা বেতনে কাজ করতে থাকি। আবার গোদনাইল এলাকা থেকে বাসা ছেড়ে চলে গেলাম কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকায়। সেখানে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলাম। সময়টা তখন ১৯৯২ সালের শেষ দিকে। একসময় হঠাৎ ভারতের অযোধ্যায় শুরু হলো বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা। আমি তখন কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকায় রশিদ স্লিক টেক্সটাইল মিলেই কাজ করি। বাসা ছিলো মিলের সাথেই এক হিন্দু বাড়িতে। দুই তিন দিন খুবই থমথমে অবস্থা ছিলো। তখন কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিলো যে, ভাড়া বাড়ি থেকে প্রাণভয়ে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে মিলের ভেতরে থাকতাম। মিলের ভেতরে অন্তত তিন-চার দিন সপরিবারে অবস্থান করেছিলাম।
চলবে…

জীবনের গল্প-২০ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১৮

জীবনের গল্প-১৭ এর শেষাংশ: তখন ঠাকুরবাড়ির সবাইর এমনই থমথমে অবস্থা ছিলো। কিন্তু না, সেদিন তেমন কোন খারাপ পরিস্থিতিতে আমার পড়তে হয়নি। খুব সুন্দরভাবে আমি একাই নয়াবাড়ি গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে জামাই-আদরে দুইদিন থেকে নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি।

বাসায় আসার পর আমার বড় দিদি জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় গিয়েছিলি।’ সত্যি কথাই বললাম, ‘বিক্রমপুর গিয়েছিলাম।’ বড় দিদি জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন গিয়েছিলি? ওখানে কি মেয়ে পছন্দ করেছিস? মেয়ে পছন্দ হয়ে থাকলে বল, আমরা দেখতে যাবো।’ বললাম, ‘সময় হোক, পরে বলবো।’ দিদি আর কিছু বললো না। নিজের বাসায় চলে গেলো। এরপর মা বললো, ‘আমি একটা মেয়ের কথা শুনেছি। মেয়েটি নাকি সুন্দর! মেয়ে সুন্দর হলে তোর সাথে মানাবে খুব!’ মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেয়েদের বাড়ি কোথায়?’ মা বললেন, ‘মেয়েদের বাড়ি নাকি নরসিংদী। তোর জোৎস্না দিদির জামাই যেখানে আবার বিয়ে করেছে, সেখানে। মেয়ে পক্ষ থেকে বেশকিছু টাকা-পয়সাও নাকি দিতে পারবে।’ আমার ওই ভগ্নিপতির নাম সুনীল। বললাম, ‘আমার বোন মরা ভাগ্নিটাকে পূজা উপলক্ষে একটা সুতার বাট্টা দিতে পারে না, অথচ এখানে এসে আমার বিয়ের ব্যাপারে নাক গলায়? আমার সাথে দেখা হলেই হয়। তখনই মজাটা দেখাবো।’

আমার কথা শুনে আমার মা আর ভয়ে কিছুই বলেনি, চুপ হয়ে গেলো। এদিন আর নিজের কাজের জাগায় গেলাম না, সন্ধ্যার আগে চলে গেলাম কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে। কালামের সাথে দেখা করলাম। বিস্তারিত সব ঘটনা বললাম। কালাম জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘আদরযত্ন কেমন করেছে ওস্তাদ?’ বললাম, ‘ভালোই করেছে।’ আমার কথা শুনে কালাম বললো, ‘তাহলে তো এখন আর কারোর সাথে যাওয়ার দরকার হবে না। আপনি একাই যথেষ্ট,ওস্তাদ!’ কালামের সাথে দেখা করে কানাইর সাথে দেখা করলাম। দুইজনে অনেকক্ষণ ঘোরা-ফেরা করলাম। তারপর আমি চলে গেলাম নিজের বাসায়, কানাই ওর বাসায় চলে গেলো।

পরদিন সকালে আমি মিলে গেলাম। কাজ করলাম। এর দুইমাস পর ওয়েল টেক্স থেকে বাৎসরিক ছুটির ৩,০০০/= টাকা টাকা একসাথে পেলাম। ৩,০০০/=টাকা হতে পেয়ে এর দুইদিন পরই দুইদিনের ছুটির আবেদন করলাম। ছুটি পাস হলে, মাকে কিছু টাকা দিয়ে আবার চলে গেলাম নয়াবাড়ি গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে। এভাবে দুই-তিন দিনের ছুটি পেলেই একা-একা চলে যেতাম নয়াবাড়ি গ্রামে। একসময় গ্রামের অনেকেই বিয়ে ছাড়া আসা-যাওয়া দেখে ছিঃছিঃ করতে লাগলো। সবার ধারণা আমি ফাঁকিবাজ! এমনও বলতে লাগলো, ‘ছেলেটা কি সত্যিই বিয়ে করবো? নাকি শুধুই মিছে মজা করার জন্য আসা-যাওয়া আসা-যাওয়া করছে!’ মানুষের কথাগুলো আমার কানে আসলো। আমি মেয়ের বাবা মা’কে নিশ্চিত থাকতে বললাম। আমি তাদের আশস্ত করলাম, ‘লোকে যা-ই বলে বলুক তাতে আপনারা মন খারাপ করবেন না। আমি অর্চনাকে বিয়ে করবই।’

একসময় নয়াবাড়ি আসা-যাওয়ার ব্যাপারটা আমার বড় দাদার কানে গেলো। বড়দাদা মাকে জানালো। মা বড় দাদাকে তাড়াতাড়ি বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি করতে বললো। মায়ের কথায় বড়দাদা ফাইন টেক্সটাইল মিলের কালামকে বললো, ‘তুমি বাড়ি গিয়ে মেয়ের বাবাকে নারায়ণগঞ্জ আসতে বন বলবে।’ বড় দাদার কথা শুনে কালাম বাড়ি গিয়ে মেয়ের বাবাকে সবকিছু খুলে বললে, একদিন মেয়ের বাবা উনার ছোট ছেলেকে সাথে নিয়ে আমাদের বাসায় আসে। তারপর বাসায় খাওয়া-দাওয়ার পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয়, কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে; বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল করার জন্য। করণ, ফাইন টেক্সটাইল মিলের বেশিরভাগ শ্রমিকই ছিলো সুবচনী এলাকার, তাই। সন্ধ্যার পর ফাইন টেক্সটাইল মিলের ভেতরে অফিসরুমে সবাই বিয়ের আলোচনায় বসলো। মিলের ম্যানেজারও সেখানে উপস্থিত ছিলো। সবাই বসে কীভাবে সুন্দর হবে সেসব বিষয়ে আপাল আলোচনা করতে লাগলো।

আমার বড় দাদার দাবি-দাওয়ার মধ্যে সোনা-দানা কিছুই নেই, মেয়ের বাবা যা পারে তা-ই মেনে নিবে। কিন্তু বিয়ের আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ ৫,০০০/= টাকা নগদ দিতে হবে।কিন্তু এতে মেয়ের বাবা নারাজ! মেয়ের বাবা ৩,০০০/= টাকার বেশি দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। আমার বড় দাদাও ৫,০০০/= টাকার কম হবে না বলে জানিয়ে দেয়। এভাবে দর-কষাকষি করতে করতে রাত প্রায় ১২ টার মতো বেজে যায়। উভয়োপক্ষের কেউ যখন কাউকে ছাড় দিচ্ছিল না, তখন আমি লোক মারফত কালামকে বাইরে ডেকে আনলাম। কালামকে বললাম, ‘আমার বড় দাদাকে বুঝিয়ে বলতে, যাতে ৩,০০০/= টাকাই রাজি হয়। আমার কথা শুনে কালাম আমার কথা বলে বড় দাদাকে রাজি করায়। এরপর বাঁধলো বরযাত্রী নিয়ে।

আমার বড় দাদার কথা ১০০ জন বরযাত্রী যাবে এবং আসা-যাওয়ার ভাড়া পুরোটা মেয়ে পক্ষে বহন করতে হবে। এতে মেয়ের বাবা রাজি হচ্ছিল না। মেয়ের বাবার কথা, বরযাত্রী যাবে ৫০ জনের বেশি যাতে না হয়। আর আসা এবং যাওয়া কোনটার ভাড়াই দিতে পারবে না। এতে আমার দাদাও রাজি হচ্ছিল না। তারপর সবার অনুরোধে মেয়ের বাবা যাওয়া বাবদ গাড়িভাড়া ১,০০০/= দিতে পারবে বলে সম্মতি দেয়। এতেও আমার বড় দাদা যখন রাজি হচ্ছিল না, তখন আমি কালামকে আবার ডেকে আনি। কালামকে বললাম, ‘মেয়ের বাবাকে ১,৫০০/= টাকা রাজি হতে বলো। ১,০০০/= টাকা মেয়ের বাবা দিবে, আর বাকি ৫০০/=টাকা আমি গোপনে তোমার কাছে দিয়ে দিবো, তুমি মেয়ের বাবার হাতে দিয়ে দিবে। আমার কথামতো কালাম তাই করলো। মেয়ের বাবাও কলমের কথামতো রাজি হয়ে গেলো। বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হলো। এরপর বাঁধলো বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে।

আমার বড় দাদা টাউনের ভাড়া বাড়িতে কোনপ্রকার নিয়মকানুন করবে না। যা করার মেয়েদের বাড়িতেই করতে হবে। তখন সবার প্রশ্ন, তাহলে বিয়ের আগের দিন যে ছেলে পক্ষের কিছু নিয়মকানুন থাকে, সেসব নিয়মগুলো কীভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে? তখন আমার বড় দাদা বললো, ‘বিয়ের আগের দিন সকালে ছেলে মেয়ের বাড়িতে চলে যাবে, অধিবাসের নিয়ম পালনের জন্য। আর বিয়ের দিন বরযাত্রীদের নিয়ে ঠিক সময়মতো বিয়েবাড়িতে আমরা উপস্থিত হয়ে যাবে।’ এতে মেয়ের বাবা রাজি হয়ে গেলো। এবার বাঁধলো আড়াইউল্লা বা ফিরাউল্টা নিয়ে। আমার বড় দাদা বললো, ‘বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন হলে বরযাত্রীদের নিয়ে আমি চলে আসবে। আর আমার ছোট ভাই আড়াইউল্লা বা ফিরাউল্টার নিয়ম পালন করে বিয়ের দুইদিন পর নতুন বউ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ চলে আসবো।’ আমার বড় দাদার কথা মেয়ের বাবা মেনে নিলো। যৌতুক বাবদ ৩,০০০/= টাকা, আর বরযাত্রীদের গাড়িভাড়া বাবদ ১,৫০০/=টাকা মেয়ে বাবা বিয়ের দুইদিন আগে যেভাবেই হোক ফাইন টেক্সটাইল মিলেই পৌঁছে দিবে। বিয়ের কথাবার্তা পাকা-পাকি হলো। বিয়ের দিন ধার্য করা হলো, ১ আষাঢ় ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ।

কিন্তু রাত অনেক হওযাতে পাটিপত্র (সাদা কাগজে অথবা স্ট্যাম্প) করার সুযোগ ছিলো না। তাছাড়া তখন উপস্থিত সবাইর মাঝে মিষ্টি বিতরণ করার মতো উপায়ও ছিলো না। তাই সবাই সিদ্ধান্ত নিলো পরদিন একজন পুরোহিত দিয়ে পটিপত্র করে বিয়ের জোকার (উলুধ্বনি) দিতে। সবার কথামতো তা-ই করা হলো। মেয়ের বাবাকে বড়দাদা সাথে করে বাসায় নিয়ে গেলো। পরদিন সন্ধ্যাবেলা একজন পুরোহিত দ্বারা পাটিপত্র করে ভাড়া বাড়ির সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। রাতে ফাইন টেক্সটাইল মিলেও কিছু মিষ্টি বিতরণ করা হলো। এর পরদিন সকালে মেয়ের বাবাকে ফতুল্লা লঞ্চঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হলে, মেয়ের বাবা বাড়িতে চলে যায়।

এদিকে বড়দাদা আমাকে সাথে নিয়ে আমার বড় ভগ্নিপতির সাথে বিয়ের বিষয়-আশয় নিয়ে আলোচনায় বসলো। জামাইবাবু আমাকে মোটামুটি ১০,০০০/= টাকার একটা হিসাব দেখিয়ে বললো, ‘বরযাত্রীদের আসা-যাওয়া-সহ বিয়ের আগে পরে এই টাকা খরচ হতে পারে। এখন তুমি এই ১০,০০০/= টাকা যেভাবেই হোক অন্তত বিয়ের চার-পাঁচ দিন আগে বড় দাদার কাছে দিয়ে রাখবে।’ আমি জামাই বাবুকে বললাম, ‘আমাকে এক সপ্তাহ সময় দিতে হবে।’ তখন বিয়ের বাকি আছে ছিলো ১৪/১৫ দিন। আমার কথা শুনে জামাইবাবু বললো, ‘ঠিক আছে, তুমি এই ক’দিনের মধ্যে টাকা জোগাড় করো। এর বেশি যদি কিছু লাগে তা আমি দেখবো।’

পরদিন ওয়াল টেক্স মিলে গেলাম। কাজের মাঝেই মিলের শ্রমিক নেতাদের সাথে বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করলাম। টাকা লাগবে, তাও বললাম। মিলের নেতারা আমাকে বললো, ‘আপনি ১৫,০০০/=হাজার টাকা অগ্রীম চেয়ে একটা দরখাস্ত লিখে অফিসে জমা দিন, এরপর আমরা দেখছি।’ তাদের কথামতো আমি তাই করলাম। ১৫,০০০/=টাকা অগ্রীম চেয়ে একটা দরখাস্ত লিখে অফিসে জমা দিলাম। পরদিন মিলের মালিক নিয়াজ সাহেব মিলে আসলে, মিলের ম্যানেজার সহ শ্রমিক নেতারা মালিকের সাথে আমার অগ্রীম চাওয়া ১৫,০০০/=হাজার টাকার ব্যাপারে আলাপ করলো। এরপর মালিক নিয়াজ সাহেব ১০,০০০/=টাকা দিতে চাইলে, মিলের নেতারা আমাকে জানালে, আমি এতে রাজি হলাম না। আমি ১৫,০০০/= টাকার কম হবে না বলে জানিয়ে দিলাম।

শেষতক শ্রমিক নেতারা মিলের মালিক ম্যানেজারের সাথে আলাপ আলোচনা করে ১৪,০০০/=টাকা মঞ্জুর করে। এর একদিন পরেই মিল থেকে আমি ১৪,০০০/=টাকা হাতে পেয়ে, মিলের সবাইকে বিয়ের নেমন্তন্ন করলাম। মিলের মালিক নিয়াজ সাহেব ও ম্যানেজার সাহেবকেও নিমন্ত্রণ করলাম। কিন্তু মিল মালিক ম্যানেজার তাঁরা কেউ বিয়েতে যাবে না বলে আমাকে জানিয়ে দেয়। আমি তাঁদের আর বিশেষভাবে অনুরোধ না করে, বাসায় চলে গেলাম। বাসায় গিয়ে ৭,০০০/=টাকা মায়ের কাছে দিলাম, জামাইবাবুর কাছে পৌঁছে দিতে। আর বাদ-বাকি ৭,০০০/=টাকা আমার কাছে রেখে দিলাম, আমার নিজের খরচের জন্য। বিয়ের বাকি আছে আরও ১০/১২ দিন। পরদিন বিকালবেলা ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে আমার বড়দাদার সাথে বুঝলাম। ওয়েল টেক্স মিলের সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছি, তাও জানালাম। তারপর বড়দাদা ওয়েল টেক্স মিলের মতো কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলের সবাইকে নিমন্ত্রণ করলো। এতে দুই মিলের লোক হলো, ৪০-৪৫ জনের মতো। নিজেদের আত্মীয়স্বজন-সহ বরযাত্রীর সংখ্যা হয়ে গেলো ৬০ জনের মতো। বিয়ের দিন দুই-চার-পাঁচ জন এদিক-সেদিক হলেও, কোনও সমস্যা হবে মনে করে– বড়দাদা বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে যা-কিছু লাগে তা যোগাড় করতে থাকে। আমিও নিয়মিত মিলের কাজ করতে থাকি।

একসময় বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলে, ৭দিন ছুটি চেয়ে একটা দরখাস্ত লিখে মিলে জমা দিই। ৭দিন ছুটি মঞ্জুর হলো। দুইদিন পরই বিয়ে। বিয়ের একদিন আগে নিজের বাসার কিছু নিয়মকাজ সেরে কানাইকে সাথে নিয়ে মেয়েদের বাড়িতে উদ্দেশে রওনা দিলাম। লঞ্চ থেকে সুবচনী ঘাটে নেমে বাজার থেকে মিষ্টি পান সুপারি কিনে নয়াবাড়ি গ্রামে কালামদের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। কালামদের বাড়ি থেকে কালামের বড় ভাই, ভাবী, বোন-সহ আরও কয়েকজন মিলে মেয়েদের বাড়িতে গেলাম। এরপর মেয়ের বাড়ি থেকেই হিন্দু বিয়ের ছেলে পক্ষের যা নিয়ম করা দরকার, সবকিছু করা হলো। সেদিন রাতে আমি আর কানাই কালামদের বাড়িতে থাকলাম। পরদিন বিয়ের দিন ১ আষাঢ় ১৩৯৩ বাংলা। বিকাল হতে না হতেই ওয়েল টেক্স, ফাইন টেক্সটাইল মিলের লোকজন-সহ নিজেদের আত্মীয়স্বজন সবাই সুবচনী বাজারে এসে জড়ো হলো।

খবর পেয়ে মেয়ের বাড়ি থেকে লোক গিয়ে চার-পাঁচটা নৌকা করে তাদের বিয়ে বাড়িতে আনা হলো। বিয়ের বাড়ি লোকে লোকারণ্য হলো। মেয়ে পক্ষ থেকে আগত বরযাত্রীদের মিষ্টিমুখ করারানো হলো। বিয়ের লগ্ন রাত ১০.৩০ মিনিট। সময়মতো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সাতপাক ঘুরে বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন হলো। বিয়ের পরদিন বরযাত্রী-সহ আমার আত্মীয়স্বজন সবাই নারায়ণগঞ্জ চলে আসলো। মেয়ের বাড়িতে আড়াই দিনের নিয়ম পালন করার জন্য থেকে গেলাম, আমি আর কানাই। একসময় আড়াইউল্লা নিয়ম করে কানাই, কালাম-সহ নতুন বউয়ের সাথে তার ছোট ভাইকে নিয়ে আমি চলে আসি নারায়ণগঞ্জ নন্দিপাড়া নিজের বাসায়। এর দুইদিন পরই বৌভাত অনুষ্ঠান। বউভাত অনুষ্ঠানে দুই মিলের লোক-সহ প্রায় ১০০জন লোকের আয়োজন করা হয়। এরপর থেকে চলতে লাগলো, স্বামী-স্ত্রীর সংসার।
চলবে…

জীবনের গল্প-১৯ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে

জীবনের গল্প-১৭

জীবনের গল্প-১৬-এর শেষাংশ: কালাম নৌকা বেয়ে সুবচনী বাজার নিয়ে এলো। ঢাকার লঞ্চে না ওঠা পর্যন্ত লঞ্চ ঘাটেই ছিলো। একসময় লঞ্চ আসলে কানাই আর আমি লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে রওনা রওনা হলো। মাঝপথে ফতুল্লা লঞ্চঘাট নেমে নিজের বাসায় চলে গেলাম।

ঈদের ছুটি শেষ হতে একদিন বাকি। একদিন পরই মিল চালু হচ্ছে। হাত থাকা একদিন ছুটি কানাইকে সাথে নিয়েই ঘুরে-ফিরে শেষ করলাম। মিল চালু হলে মিলে গিয়ে কাজ করা শুরু করলাম। এর প্রায় দুইমাস পর কানাই আমার কাজ ছেড়ে অন্য এক জায়গায় কাজে লেগে যায়। কারণ ওর তখন সামান্য বেতনে পোষাচ্ছি না, তাই। কানাই আমার এখান থেকে আরও বেশ কিছু টাকা বেশি বেতনে নারায়ণগঞ্জ দেওভোগে থাকা একটা মিনি গার্মেন্টসে কাজ নেয়। আমি তখন একরকম একা হয়ে পাড়ি। এরপর আমি মিলের সেক্রেটারি হাসেম মিয়ার ভাতিজাকে আমার সাথে হেলপার হিসেবে রেখে দেই। নতুন হেলপার নিয়েই কোনরকমভাবে কাজ করতে থাকি।

এর কিছুদিন পর টাকা-পয়সা নিয়ে আমার বড় দাদার সাথে আমার মনোমালিন্য হয়। সেই মনোমালিন্য থেকে জেদ করে মাকে নিয়ে বড় দাদা থেকে আমি আলাদা হয়ে যাই। কিন্তু বড় দাদার বাসা আর আমার বাসা ছিলো একই মহল্লায় পাশা-পাশি বাড়ি। তখন আমার মায়ের অবস্থাও বেশি একটা ভালো ছিলো না। বসার রান্না-বান্না করতে পারছিল না। রান্না-বান্না করে দিতো আমার এক বোন। যেই বোনকে ফেনী ফুলগাজী বিয়ে দিয়েছিলাম। সেই বোন তখন একই মহল্লায় পাশা-পাশি বাড়িতে ভাড়া থাকতো। মায়ের ওই অবস্থায় আমার বড় বোনও আমাকে বলছিল, ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করতে।

কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না। ওইভাবেই চলতে লাগলো মা ছেলের ছোট সংসার। বাসা ছিলো নারায়ণগঞ্জ নন্দীপাড়া। নন্দিপাড়া ভাড়া বাসা থেকে পায়ে হেঁটে ফতুল্লা ওয়েল টেক্সটাইল মিলে গিয়ে নিয়মিত কাজ করতে থাকি। একদিন মিলে কাজ করতে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যায়! সেদিন এক তাঁত মেশিনে নতুন স্যাম্পল কাপড় তৈরির ভীম উঠানো হয়েছিল। সেই কাপড়ের পাইরে “ওয়েল টেক্স ফেব্রিকস” নাম লেখা থাকবে। ওই ভীম আমি মাস্টারের দেওয়া হিসাবমতে ড্রয়ার করে তাঁতে পাঠিয়ে দেই। তাঁতে ভীম উঠানোর পর কাপড়ের পাইরে নামের সুতাগুলো আমাকে ভরে দিতে হবে।

অবশ্য এই কাজটা কানাই থাকতে ও-ই করতো। কানাই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে ওই কাজ আমাকেই করতে হচ্ছিল। তাই তাঁতে ভীম বাঁধার পর মিস্ত্রি আমাকে নামের সুতাগুলো ভরে দিতে বললো। আমি মেশিনের সামনে গেলাম। কাপড়ের ডান পাইরের সুতাগোলে ভরছিলাম। এমন সময় দেখি ডান পাশে থাকা মেশিনের মাক্কু বা স্যাডেল আসা-যাওয়া করার সময় কেমন যেন বাউলি দিচ্ছে। আমি ওই মেশিনের তাঁতিকে মেশিনটা বন্ধ রাখতে বললাম। কিন্তু ওই মেশিনের তাঁতি আমার কথা না শুনে, আমাকে আমার কাজ করতে বলে। তারপরও আমি বললাম, ‘দেখ, মেশিনের মাক্কু কিন্তু ফ্লাইং করবে। মানে মেশিন থেকে মাক্কু বের হয়ে যাবে। আর মেশিন থেকে মাক্কু বের হলেই কারো-না-কারোর শরীরের লাগলে মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট হবে।’ কিন্তু না, আমার কথা ওই তাঁতি আমলে নিলো না। তাঁতি আমার কথা না শুনে মেশিন চালুই রেখেছিল।

আমিও পাশের মেশিনের উপরে বসে কাপড়ের পাইরের নামের সুতাগুলো ভরছিলাম। হঠাৎ পাশের চালু মেশিনের মাক্কু ফ্লাই করে আমার ডান সাইটের কানে লাগে। এরপর আমি মেশিন থেকে নিচে পড়ে গেলাম। তারপর কী হয়েছিলো তা আমি একদিন পর জানতে পারলাম। “সেদিন মেশিন থেকে পড়ে যাবার পর মিলে থাকা মালিকের টেক্সি করে সাথে সাথে আমাকে ফতুল্লা বাজারে থাকা এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার ডান কানের উপরিভাগে তিনটে সিলি দিয়ে ছেড়ে দেয়। তারপর ফতুল্লা থেকে সেই গাড়ি দিয়েই আমাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়।” কিন্তু তখনও আমার জ্ঞান ফিরছিল না। আমার জ্ঞান ফিরেছে রাতে। জ্ঞান ফেরার পর আমি মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মা আমি এখানে কীভাবে আসলাম?’ তখন আমার মা সবকিছু খুলে বললো। আমি শুনলাম!

দুইদিন বাসায় থাকার পর আমি মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলাম। দুই দিনের দিন বিকালবেলা ওয়েল টেক্স মিলের মালিক ম্যানেজার-সহ শ্রমিক নেতারাও আমার বাসায় এসে উপস্থিত হলো। মা সবাইকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করলো। ওনারাও মাকে কোনপ্রকার চিন্তা করতে বারণ করে চলে গেলো। তারপর আমার অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা মুহূর্তেই চলে গেলো কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে। তখন কালাম-সহ আরও কয়েকজন আমার বাসায় এসে শান্তনা দিয়ে গেলো। কানাইও এসেছিল। এই খবর পৌঁছে গেলো সুবচনী সংলগ্ন নয়াবাড়ি কালামদের বাড়িতে। তখন কালামের মা ভাই-ভাবী-সহ ঠাকুরবাড়ির সবাই আমার জন্য নাকি খুব দুঃখ করলো। জানলাম কালামের কাছ থেকে। এরপর তিনদিন বাসায় থাকার পর একসময় মিলে গিয়ে অসুস্থ শরীর নিয়েই কাজ করতে লাগলাম, তাঁতিদের কথা মাথায় রেখে। কারণ, ওয়েল টেক্স মিলে যেসব ডিজাইন কাপড় তৈরি হতো, সেসব কাপড়ের দক্ষ ড্রয়ার ম্যান তখন আশে-পাশে খুবই কম ছিলো।

তাই অন্যকোনো ড্রয়ার ম্যান দিয়ে সেসব ডিজাইন ভীমের ড্রয়ার তঁতিরা করাতে চাইতো না। মেশিন খালিই পড়ে থাকতো। আর মেশিন খালি থাকলে তাঁতিদের সপ্তাহিক বেতন কম হতো, মিলের প্রোডাকশনও কম হতো। সেই চিন্তা মাথায় রেখেই পুরোপুরিভাবে সুস্থ না হয়েও আমি মিলে গিয়ে কাজ করা শুরু করি। এতে মিলের মালিক ম্যানেজার হতে শুরু করে সবাই খুশি হয়ে গেলো। এর বিনিময়ে তাঁতিদের সাপ্তাহিক বেতনের দিন ম্যানেজার সব তাঁতিদের বেতনের পর আমাকে ডেকে নিয়ে বেশকিছু টাকা বকসিসও দিয়ে ছিলো। সাথে চিকিৎসা-সহ যাবতীয় খরচও মিল মালিক বহন করতে লাগলো।

একসময় আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেও, আমার ডান কানে কিছুই শুনতে পেতাম না। তারপর কানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও দেখানো হলো। ডাক্তার কানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলো যে, আমার ডান কানের মনিরগ নিস্তেজ হয়ে গেছে। শতরকম চেষ্টা করলেও তা আর ঠিক হবে না বলে ডাক্তার জানিয়ে দেয়। ডাক্তারের শেষ চেষ্টার পর মিল মালিক নিয়াজ সাহেব বলেছিল, ‘আমি সময় সুযোগ করে নিতাই’কে পাকিস্তান নিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবো। এখন ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে কাজ করতে থাকুক।’ এরপর থেকে মালিকের কথামতো নিয়মিত মিলে কাজ করতে থাকি।

একদিন মিলে কাজ করতেছিলাম। কিছুক্ষণ পরই দুপুরের খাবারের সময় মিল একঘন্টা বন্ধ থাকবে। এর কিছুক্ষণ আগে ফতুল্লা পোস্ট-অফিস থেকে ডাকপিয়ন মিলের গেইটে এসে আমাকে তালাশ করে। আমি তখন মিলের ভেতরে কাজ করছিলাম। মিলের দারোয়ান জিন্নাহ ভাই ডাকপিয়নকে মিলের গেইটের বাইরে রেখে আমাকে ডেকে আনে। আমি ডাকপিওনের সামনে আসলে আমার হতে একটা চিঠির খাম ধরিয়ে দিয়ে একটা রেজিষ্টার খাতায় সই নিয়ে চলে যায়। চিঠির খামের উপরে আমার নাম লেখা। প্রেরকের নাম ছিলো অর্চনা রানী সরকার। গ্রাম নয়াবাড়ি। তা দেখে আমি কিছুক্ষণ বিচলিত ছিলাম। সাথে সাথে চিঠির খামটা খুললাম না। চিঠি হাতে নিয়েই মিলের বাইরে চায়ের দোকানে গেলাম। চা-সিগারেটেই টানলাম। তারপর মিলে আসলাম। দারোয়ান জিন্নাহ ভাই, বারবার জিজ্ঞেস করছিলো, ‘কার চিঠি, কে দিয়েছে, কী খবর!’ আমি কিছু না বলেই সোজা আমার কাজের জায়গায় চলে গোলাম। তারপর আমি খাম ছিড়ে চিঠিটা খুললাম।

চিঠির খাম থেকে চিঠি বের করে পড়লাম। আমার অ্যাক্সিডেন্টের খবরে তাদের বাড়ির সবাই চিন্তিত। আমার সুস্বাস্থ্য কামনা-সহ আরও বিস্তারিত লেখা পড়লাম। চিঠির নিচে লেখা ছিলো, ‘আপনার ঠিকানা কালাম ভাইয়ের বড় ভাবী থেকে সংগ্রহ করা।’ কালামের বড় ভাবীকে যে ঠিকানা লিখে দিয়েছিলাম, তা ঠিক। আমি কালামদের বাড়িতে যখন বেড়াতে গিয়েছিলাম, তখন আসার দিন সকালবেলা কালামের বড় ভাবীকে একটা কাগজে ঠিকানা লিখে দিয়ে বলেছিলাম, ‘ভাবী, মেয়েটি যদি আমাকে পছন্দ করে থাকে, তাহলে এই ঠিকানায় চিঠি দিয়ে জানাতে বলবেন।’ তাই হয়তো আমার অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে ঠাকুরবাড়ির ছোট মেয়ে কালামের ভাবীর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে, স্কুলের সাথে থাকা পোস্ট-অফিস থেকে রেজিস্ট্রিকৃত চিঠি পোস্ট করে। চিটি পড়ে মনটা কেমন যেন হয়ে গেলো! মন চাচ্ছিল মিলের কাজ ফেলে রেখে পরদিনই নয়াবাড়ি গ্রামে চলে যাই। কিন্তু না, তা আর করিনি।

পরদিন বিকালবেলা কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে কালামের সাথে দেখা করলাম। চিঠির কথা জানালাম। কালাম খুশি হয়ে আমাকে বললো, ‘আর কদিন পর দুর্গাপূজা শুরু হলে, পূজা উপলক্ষে কানাইকে সাথে নিয়ে ওদের বাড়িতে যেতে।’ কালামের কথামতো আমি একদিন কাইনার কাছে গেলাম। কানাইকে বললাম, ‘পূজার বন্ধ পেলে আমার সাথে নয়াবাড়ি যেতে।’ পূজা উপলক্ষে কাজের খুব চাপ থাকায় কানাই আমার সাথে যেতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। তাই আর কানাইর আশায় থাকলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম, কালামও যদি সাথে না যায়, তাহলে পূজার ছুটি পেলে আমি একাই নয়াবাড়ি চলে যাবো। একসময় দুর্গাপূজা আরম্ভ হলো। মিল থেকে দুইদিনের ছুটি পেলাম। কালামকে আমার সাথে যেতে বললাম। কালামও যেতে পারবে না জানালে, আমি একাই চলে গোলাম সুবচনী সংলগ্ন নয়াবাড়ি গ্রামে।

নয়াবাড়ি গ্রামে গিয়ে সরাসরি ঠাকুরবাড়িতেই উঠলাম। সাথে দুইভাগে কিছু মিষ্টি, পান-সুপারিও নিলাম। একভাগ কালামদের বাড়ির জন্য, আর একভাগ ঠাকুরবাড়ির জন্য। ঠাকুরবাড়িতে একভাগ মিষ্টি পান-সুপারি রেখে আরেক ভাগ মিষ্টি পান-সুপারি কালামদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে, আমি জামাইর মতো বিছানা শরীর লেলিয়ে দিলাম। সেসময় ঠাকুরবাড়ির নারায়ণ সরকারের যেই মেয়েকে কুমিল্লা বিয়ে দিয়েছিল, সেই ময়েও বাড়িতে ছিলো। আমি সরাসরি ঠাকুরবাড়িতে ওঠার পর বাড়ির সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো। না পারে থাকতে বলতে, না পারে আমাকে তাড়িয়ে দিতে। তখন ঠাকুরবাড়ির সবাইর এমনই থমথমে অবস্থা ছিলো। কিন্তু না, সেদিন তেমন কোন খারাপ পরিস্থিতিতে আমার পড়তে হয়নি। খুব সুন্দরভাবে আমি একাই নয়াবাড়ি গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে জামাই-আদরে দুইদিন থেকে নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি।
চলবে…

জীবনের গল্প-১৮ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১৬

জীবনের গল্প-১৫-এর শেষাংশ: সত্যিই তো, মেয়েতো কয়েকবারই দেখেছি। কিন্তু ভালো করে তো দেখতে পারলাম না। আচ্ছা আবার আসুক! মনে মনে এই বলেই বেশ কিছুক্ষণ ঘাটে বসে থাকতাম, আবার দেখার আশায়। এরমধ্যেই কালাম বাজার থেকে এসে হাজির হল। কালাম পুকুর ঘাটে এসেই বললো, ‘ওস্তাদ বাড়ি চলেন খাবেন!’ কালামকে খুবই ব্যস্ত দেখাচ্ছিল।

সেসময় কালাম সত্যিই ব্যস্ত ছিলো, টেনশনও ছিলো। কালামের ব্যস্ততা আমাদের জন্যই। কারণ আমরা ওঁদের বাড়িতে উঠেছি অনেকক্ষণ হলো, অথচ এখনো আমাদের ভাত খাওয়া হচ্ছে না, তাই ওঁর যত ব্যস্ততা। তাই ও বাজার থেকে বাড়ি এসে ওঁর মা ভাবীর সাথেও কথা কাটা-কাটি করে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলছে। আমরা ওর সাথে বাড়ি গেলাম। ওকে নিয়েই একসাথে খাওয়া-দাওয়া করলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ কালামদের ঘরে বসেই দেরি করলাম। এরপর কালামকে সাথে নিয়েই ঘর থেকে বের হলাম, নিকটস্থ কোনও বাজারে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। তখন একেবারে সন্ধ্যা হয়ে চারদিক ঘুট-ঘুটে অন্ধকার। ঘর থেকে বের হয়েই কালামকে জিজ্ঞেস বললাম, ‘সামনা-সামনি কোনও হাট-বাজার আছে কিনা?’ কালাম বললো, ‘আছে ওস্তাদ! কেন, বাজারে যাবেন?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, আমাদের বাজারে নিয়ে চলো।’ যেই কথা, সেই কাজ। নৌকা চড়ে তিনজন চলে গেলাম, একটা গ্রামের পরই গ্রাম্য বাজারে। বাজার থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে আসার সময় আমার প্রয়োজন মতো সিগারেটও নিয়ে নিলাম।

ওদের বাড়ি এসে সোজা পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। তখন ঠাকুরবাড়ির নারায়ণ সরকারও ঘাটে বসা ছিলো। আমাদের দেখে কালামকে বললো, ‘তোর ওস্তাদকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে যা। বাড়িটা দেখা।’ এরপর কালাম আমার হাত ধরে টানা-টানি শুরু করলো, ঠাকুরবাড়ির ভেতরে যাওয়া জন্য। কালামের টানা-টানিতে আর থাকতে পারলাম না, ঠাকুরবাড়ির ভেতরে যেতেই হলো। ঠাকুরবাড়ির ভেতরে অনেক বড় উঠান। উঠানে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই, আমাদের বসার জন্য একটা ছোটো ছেলে দুইটা পিড়ি একটা হাতল ভাঙা চেয়ার সামনে এনে দিলো। কালাম আমাকে হাতল ভাঙা চেয়ারে বসতে বলে, ওরা দুইজন বসলো, পিড়িতে। আমি চেয়ারেই বসলাম। একটু পরই বড় এক কাঁসার বাটিতে করে কিছু পাকনা পেয়ারা আমাদের সামনে এনে দিলো। আমরা তিনজনই পেয়ারা খাচ্ছিলাম।

ঘাট থেকে বাড়ির মুরুব্বি আমাদের সামনে এসে আরেকটা পিড়িতে বসলো। আমাকে খেটে-খুটে অনেককিছুই জিজ্ঞেস করলো, আমি উনার কথার জবাব দিলাম। তারপর উনি আগামীকাল কালাম-সহ আমাদের তিনজকে ঠাকুরবাড়িতে দুপুরে খাবারের নেমন্তন্ন করলো। আমি না করে বললাম, ‘আগামীকাল সকালেই আমরা এখান থেকে বালি গাঁও চলে যাবো। বালিগাঁ থেকে সন্ধ্যার আগেই আবার নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হবো।’ কালাম আমার কথা শুনে বালি গাঁও যেতে বারণ করে বললো, বালি গাঁও যাওয়ার দরকার নেই, ‘ওস্তাদ। আগামীকাল আমাদের বাড়িতে থাকবেন।’ কালামের কথা শুনে কানাইও কেমন যেন আমতা-আমতা করতে লাগলো, কিন্তু কিছু বলছিল না। বুঝলাম, কানাইও বালি গাঁও না গিয়ে এখানেই থাকতে চাচ্ছে। তারপর আমি বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, থাকি-না-যাই তা সকালে দেখা যাবে, এখন চলো পুকুর ঘাটে গিয়ে বসি।’ পুকুর ঘাটে কিছুক্ষণ বসে কালামদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনজন একইসাথে ঘুমালাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই কানাইকে বলছি, ‘তাড়াতাড়ি করে হাতমুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নে।’ কানাই আমতা-আমতা করতে লাগলো। ওর ভাব দেখে বুঝতে পারলাম, ও আজকে এখানে বেড়াতে চাচ্ছে। কালামের মা আমার সামনে এসে বললো, ‘আজকের দিনটা এখানে থেকে যাও। কালকে আর জোর করবো না।’ কালামের ভাই ভাবীও বলতে লাগলো। কানাইও বললো ‘আজকে এখানে থাকি। কালকে চলে যাবো। বন্ধ তো হাতে আরও একদিন থাকবেই। আজকে থাকলে আর সমস্যা হবে না।’ বললাম, ‘ঠিক আছে, থাকলাম। আমার কথা শুনে কালামের মা ভাই ভাবী সবাই খুশি হলো। আমি আর কানাই মুখ ধুতে পুকুর ঘাটের দিকে রওনা দিলাম। আমাদের সাথে-সাথে কালামও ঘাটে আসলো। আমরা একটা আমগাছের ঢালা ভেঙে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। কালাম ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে নারায়ন সরকারকে বললো, ‘ওস্তাদ আজকে এখানে থাকবে।’ ওমনি ঠাকুরবাড়ি থেকে দুইটা মেয়ে হাসতে হাসতে কয়েকটা থালাবাসন হাতে নিয়ে পুকুর ঘাটে আসলো। আমি আর কানাই বসে বসে দাঁত মাজতে ছিলাম।

মেয়ে দুইটা দেখে বুঝা যাচ্ছিল না যে, কোনটা বড় আর কোনটা ছোট। দু’জনকে একই বয়সের মনে হলো। আসলে ওরা ছোট-বড় দুই বোন। কিছুক্ষণ পর কালাম ঘাটে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওস্তাদ মুখ ধুয়েছেন?’ বললাম, না, এখনও ধোয়া হয়নি।, মেয়ে দুইটা তখনও পুকুর ঘটে থালাবাসন ধুইতে ছিলো। কালাম ওদের বললো, ‘তোরা ওস্তাদকে সাইট দেয়, মুখ ধোবে।’ আমি কালামকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘ওদের কাজ ওরা করুক। আমরা পরেই ধুই।’ কালাম আমাকে বললো, ‘ওস্তাদ, ওরা দুই বোন। এইযে, ওর নাম জোসনা, ওর নাম আর্চনা। জোসনা বড়, আর অর্চনা ছোট।’ নাম জানা হলো। দেখাও হলো। কিন্তু এখনো কথা হয়নি।

মেয়ে দুইটা ওদের কাজ সেরে আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে বাড়ির ভেতরে গেলো। আমারা ঘাটে নেমে হাতমুখ ধুয়ে অস্তেধীরে কলামদের বাড়ি গেলাম। নাস্তা করলাম। এমন সময় কালাম এসে ওর মাকে বললো, ‘মা ওস্তাদ দুপুরে ঠাকুরবাড়ি খাবে। আমারও ওস্তাদের সাথে যেতে হবে।’ আমি থমকে গেলাম! জিজ্ঞেস করলাম, ঠাকুরবাড়িতে খাবো কেন?’ কালাম, হাসতে-হাসতে বললো, ‘ওস্তাদ নারায়ন সরকার খুব অনুরোধ করছে। তাই আমি বললাম।’ কালামের কথা শেষ হতে-না-হতেই কালামের মা বললো, ‘হ্যাঁ বাবা, আজ খুব ভোরবেলা নারায়ন সরকার আমাদের বাড়ি এসে আপনাকেও অনুরোধ করেছে, যাতে দুপুরবেলা তোমরা ঠাকুরবাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করো। অমত করো না বাবা। বুড়ো মানুষ বলেছে যখন, আজকে দুপুরবেলা ঠাকুরবাড়িতেই খেও।’ কালামের মায়ের কথা শুনে আমি চুপ করে ঘর থেকে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেট টানছি আর চিন্তাও করছি! খালি হাতে নেমন্তন্ন খেতে যাবো না!

কালামকে ডাকলাম। কালাম সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওস্তাদ কিছু বলবেন?’ বললাম, নৌকা রেডি আছে? কালাম বললো, ‘হ্যাঁ ওস্তাদ, নৌকা ঘটলায় বাঁধা আছে। কোথাও যাবেন?’ বললাম, বাজারে যেতে হবে। কালাম বললো, ‘ঠিক আছে যাবো। আগে নাস্তা খেয়ে নিন, তারপর।’ তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে কানাই সহ নৌকা চড়ে সুবছনী বাজারে গেলাম। বাজারে গিয়ে তিনজনে চা-বিস্কুট খেলাম। তারপর মিষ্টি দোকান থেকে দুই কেজি মিষ্টি কিনলাম। সাথে পান সূপারিও কিনলাম। কালাম রাগ হয়ে বললো, ‘এতকিছুর দরকার কী ওস্তাদ?’ বললাম, ‘দরকার আছে কালাম। নেমন্তন্ন খালি হাতে মানায় না। তাছাড়া তোমাদেরও তো মানসম্মান আছে। আমিতো তোমাদের অতিথি।’ কালাম আর কিছু বললো না, চুপ করে থাকলো।

সুবচনী বাজার থেকে কালামদের বাড়ি যেতে যেতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। কানাই মিষ্টির প্যাকেট-সহ পান সুপারি নিয়ে কালামের মায়ের হাতে দিলো। মিষ্টি দেখেই কালামের মা বুঝতে পেরেছে, মিষ্টি কেন অনা হলো! কালাম তাড়াহুড়ো করতে লাগলো, স্নান করার জন্য। গামছা সাবান নিয়ে কালাম-সহ ঠাকুরবাড়ির ঘাটে গেলাম, স্নান করার জন্য। স্নান করতে যাওয়ার সময়ই কালাম আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওস্তাদ, আপনার কাছে কোন মেয়েটা ভালো লাগে?’ আমি একরকম রাগ-রাগ ভাব নিয়েই বললাম, ‘আরে তোমাদের মাথা কি সত্যি খারাপ হয়ে গেলো নাকি? আমি কি বিয়ে করতে এসেছি? নাকি মেয়ে দেখতে এসেছি!’ কালাম মুখটা কালো করে ফেললো। তা দেখে আমি নিজেই লজ্জায় পরে গেলাম! তারপর কালামের মনটা ভোলো করার জন্য কালামকে বললাম, ‘আচ্ছা, তোমার কাছে কোনটা ভালো লাগে?’ কালাম বললো, ‘ওস্তাদ, মেয় দুইটাই তো দেখার মতো।এখন কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি?’ কালাম আবার কানাইকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কানাই ভাই, আপনার কাছে কোন মেয়েটা ভালো লাগে?’ কানাই বললো, আমার কাছে দুইটাই ভালো লাগে।’ আমি কালামকে বললাম, ‘আমার কাছে ছোটটা ভালো লাগে।’ আমার কথা শুনে কানাই আর কালাম দুইজনেই হাসলো।

পুকুর ঘাটে গেলাম। স্নান করে কালামদের বাড়ি গেলাম। জামা-প্যান্ট পরে রেডি হলাম, ঠাকুরবাড়ি যাবার জন্য। মিষ্টি পান সুপারি কালাম হাতে নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে। আমরা ওর পেছনে-পেছনে হাঁটছি। ঠাকুরবাড়ি গেলাম। কালাম মিস্টির প্যাকেট নিয়ে বড় ঘরের ভেতরে গেলো। মিষ্টি পান সুপারি দেখা আমাদের সমাদর আরও দুইগুণ বৃদ্ধি পেলো। আমরা উঠানে দাঁড়াতেই ঐ হাতল ভাঙা একটা ছেয়ার আর একটা পিড়ি এনে দিলো। কালাম ঘরে গিয়ে মিস্টির প্যাকেট আর পান-সুপারির পোটলা কারোর হাতে দিয়ে আমাদের সামনে উঠানে আসলো। বসার জন্য আরেকটা পিড়িও সাথে নিয়ে আসলো। তিনজনে বসে কথা বলতে বলতেই বড় ঘরে ডাক পড়লো। বড় ঘরে গিয়ে খাটের পর বসলাম। আমাদের সামনে তিনটা প্লেটে সাজানো কিছু মিষ্টি চলে আসলো। কালাম খেলো কানাইও খেলো। কিন্তু আমি খাইনি। কারণ মিষ্টি খেলে আর ভাত খেতে পারবো না, তাই।

কিছুক্ষন পরই ভাত খেতে দিলো। আমরা তিনজন একসাথে বসে ভাত খেলাম। ভাত খেতে বসে কালামের মনের ভাব দেখে বুঝলাম, কালাম মনে হয় মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢোকার পর আমার পছন্দের ব্যাপারটা ওদের কারো কাছে বলেছিল। এইজন্যেই মনে হয়,আমাদের খাওয়া-দাওয়ার সামনে ছোট মেয়েটা বেশি আসেনি। আমাদের খাওয়া-দাওয়া পরিবেশন করেছিল অবিবাহিত থাকা দুই বোনের মধ্যে বড় মেয়েই। খাওয়া-দাওয়া শেষে ঠাকুরবাড়ি থেকে বের হয়ে সামনে থাকা পুকুর ঘাটে গেলাম। পুকুর ঘাটে গিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন মানুষ বসে গল্প করছে। সাথে কালামের বড় ভাই সালামও আছে। তাঁদের কথাবার্তার ভাবে বুঝলাম, তাঁরা আমাদের নিয়েই আলাপ আলোচনা করছিলো।

সিঁড়ি ঘাটলার উপরে গিয়ে সালাম ভাইয়ের সাথে বসলাম। সালাম ভাই জিজ্ঞেস করলো, কী দিয়ে খাওয়া হলো?’ জবাবে যা যা খেলাম আর যেসব আয়োজন করেছিলো, সবই বললাম। পুকুর ঘাটে কিছুক্ষণ বসার পরই ঠাকুরবাড়ি থেকে ছোট একটা ছেলে অনেকগুলো পান সুপারি নিয়ে আসলো। সবাই পান খেলো, আমি কানাই আর কালাম পান খেলাম না। কিছুক্ষণ পর সালাম ভাই-সহ আমরা কালামদের বাড়ি চলে গেলাম। কালামের মা জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন খেলে বাবা?’ বললাম, ‘ভালোই খেয়েছি খালা।’ বললো, ‘গরিব হলেও আত্মা আছে লোকটার! তো মেয়ের হতে কিছু দিয়ে এসেছ নাকি?’ আমি আর কিছু বললাম না, কানাই বললো, ‘আমরা কি মেয়ে দেখতে গেছি নাকি, খালা? আমরা নেমন্তন্ন খেতে গেছি।’ কালামের মা আর কিছু বলেনি, ঘরে গিয়ে বসতে বললো। আমি আর কানাই শোবার ঘরে গিয়ে বসতেই কালামের মা একটা পানের ঢালা হতে নিয়ে আমাদের সামনে এসে বসলো। আমাদের পান খেতে বললে, আমরা না করলাম। কালামের আমাদের বিশ্রাম করতে বলে ঘর থেকে চলে গেলো। তখন শেষ বিকালের শেষ সময়। কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল। তাই বিশ্রাম আর করলাম না, কালামকে সাথে নিয়ে নৌকা চড়ে ঐ গ্রাম্য বাজারেই গেলাম। চা-বিস্কুট খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে সন্ধ্যার পর কালামদের বাড়িতে আসলাম।

কালামদের বাড়িতে এসে জামা-প্যান্ট চেঞ্জ করে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। সেদিন পুরো নয়াবাড়ি গ্রাম জানা-জানি হয়ে গিয়েছিল, নারায়ণ সরকারে মেয়েকে দেখতে এসেছে। তাই সেদিন পুকুর ঘাটে অন্যদিনের চেয়ে বেশি মানুষ লক্ষ্য করলাম। অনেক মানুষের সাথে কথা বললাম। অনেককেই সিগারেট দিলাম। কালামও পুকুর ঘাটে বসে বসে উপস্থিত থাকা সকলকে আমার কাজের গল্প শোনালো। অনেকক্ষণ পুকুর ঘাটে আড্ডা দিয়ে কালামদের বাড়ি এসে গেখি কালামে ভাবী আমাদের জন্য খাবার রেডি করে বসে আছে। আমি খাব-না-খাব না বলার পরও সবার সাথে খেতেই হলো। নামমাত্র দুমুঠো খেয়ে বাড়ির বাইরে গিয়ে সিগারেট টেনে ঘরে আসলাম। শোবার ঘরে বসে ঘুমিয়ে থাকার ভাব করছিলাম। এমন সময় কালামের মা আমাদের সামনে এসে বসলো। হাতে পানের ঢালা। আমাদের পান খেতে বললে, আমার না করলাম।

কালাম মা উনার নিজের জন্যই একটা পান বানিয়ে মুখে দিয়ে নিজে নিজেই বললো, ‘ঠাকুরবাড়ির অনেক কাহিনী আছে বাবা।’ শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে বললাম, কেমন কাহিনী, খালা? বললো, “নরায়ন সরকার যেই বাড়িতে থাকে, এটা কিন্তু তার নিজের বাড়ি না। এই বাড়িটা সত্যগুরু নামে এক ঠাকুরের বাড়ি। আর নারায়ণ সরকার হলো, সত্যগুরুর শিষ্য। নারায়ণ সরকারের বাড়ি ছিলো পদ্মার পড়। একসময় নারায়ণ সরকারের বসতভিটা পদ্মায় বিলীন হয়ে গেলে, নারায়ণ সরকার এই সত্যগুরুর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সত্যগুরু ঠাকুর জীবিত থাকতে ওই বাড়িতে কোনও চোর চুরি করতে পারেনি। চুরি করতে আসলেই সারারাত আটকা পড়ে থাকতে, যেতে পারতো না। সকালবেলা সত্যগুরু ঘুম থেকে ওঠে চোরকে শাসিয়ে ছাড়ত।’

‘আর পুকুরের ছিল এক অলৌকিক কাণ্ড! কারোর বিয়েসাদী হলে পুকুরপাড়ে এসে থালা-বাসনের কথা বললেই হতো। পরদিন ভোরবেলায় পুকুর ঘাটে থালাবাসন ওঠে থাকত। বিয়ে বা অন্যকোন ধর্মীয় কাজ ছিল মুখ্য বিষয়, এ ছাড়া অন্য কাজের জন্য নয়। কাজ শেষে থালা- বাসনগুলো ভালো করে ধুইয়ে আবার পানিতে ছড়ে দিতো। একদিন ঘটলো এক অন্যরকম ঘটনা। বিয়ের কাজ শেষে পুকুরের থালা-বাসন থেকে একটা কাঁসার থালা কেউ-না-কেউ রেখে দিয়ে, বাদবাকি থালাবাসন যখন পুকুরে দিচ্ছিল; তখন থালা- বাসনগুলো পানিতে ডুবছিলো না। তিনদিন যাবত থালা- বাসনগুলো ওইভাবেই পুকুরে ভাসমান অবস্থায় ছিল। তিনদিন পর থালা- বাসনগুলো পানিতে ডুবেছে ঠিক, কিন্তু কেউ আর কখনো কিছু চেয়ে পায়নি।’ এসব অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল সত্যগুরু জীবিত থাকতে।’

‘একসময় সত্যগুরু মারা যায়। সত্যগুরু মারা যাবার পর সত্যগুরুর ফ্যামিলি বেশ কয়েকবছর এই বাড়িতে ছিলো।হিন্দু-মুসলিম রায়টের পর একসময় সত্যগুরুর ফ্যামিলি নারায়ণ সরকারকে এই বাড়ির দায়দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ভারতে চলে যায়। সেই থেকেই নারায়ণ সরকার এই বাড়ি নিজের বাড়ির মতো করে থাকছে।” কালামের মা আমাদের ঠাকুরবাড়ির গল্প শুনিয়ে শুয়ে থাকতে বললে, আমরা আগের রাতের মতো তিনজন একসাথে শুয়ে থাকি। পরদিন সকালবেলা

পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি ঠাকুরবাড়ির ছোট মেয়েটা কালামের বড় ভাবীর সাথে বসে বসে গল্প করছে। আমাকে দেখেই চলে যাওয়া প্রস্তুতি নিতেই, কালামের বড় ভাবী ধমক দিয়ে বসতে বললো। মেয়েটিও চুপচাপ বসে থাকলো। কানাই আমার আগেই ঘুম থেকে উঠে আম পাতা মুড়িয়ে কালামদের উঠানে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছিল। আমাকে দেখেই কানাই মেয়েটির দিকে আমাকে ইশারা দিয়ে দেখালো। আমিও কানাইকে হাতে ইশারা দিয়ে কাছে ডাকলাম। কানাই আমার সামনে আসলে, আমি মেয়েটির সাথে কথা বলার জন্য কানাইকে বললাম। কানাই মেয়েটিকে কিছু না বলে আমাকেই মেয়েটির সাথে কথা বলতে বললো। আমি কানাই উপর রাগ না করে মেয়েটির সামনে গিয়ে ভাবীকে বললাম, ‘ভাবী, আমাদের জন্য কোনকিছুর আয়োজন করবেন না। কিছুক্ষণ পর তো চলেই যাচ্ছি।’ কালামের বড় ভাবী বললো, ‘সকালের নাস্তা রেডি করছি ভাই। নাস্তা না খেয়ে তো আর যেতে পারবেন না।’ বললাম, ‘ঠিক আছে ভাবী, নাস্তা খেয়েই রওনা দিবো। তো আপনার সামনে মেয়েটি কে?’ ভাবী বললো, ‘ও-তো ঠাকুরবাড়ির সরকারের ছোট মেয়ে।’ আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার নাম কি?’ মেয়েটি ওর নাম না বলে আমতা-আমতা করতে লাগলো। ভাবী ধমক দিয়ে বললো, ‘তোর নাম জিজ্ঞেস করছে, তুই তোর নাম বলছিস না কেন? নাম বলতে কি টাকা-পয়সার দরকার হয়?’ ভাবীর ধমক শুনে মিয়েটি নিজের নাম বললো। কয় ভাই-বোন বললো। লেখাপড়া কতটুকু বললো। কোন স্কুলে পড়ছে তা-ও বললো। কানাই আমার সামনেই দাঁড়িয়ে শুনছিলো। তারপর বললাম, তুমি এখন বাড়ি যাও, আবার দেখা হবে, কথাও হবে।

মেয়েটি মাথা নিচু করে বাড়িতে চলে গেলো। আমারা হাতমুখ ধুয়ে নামমাত্র কিছু খেয়ে কালামদের বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম। নৌকায় উঠার আগে ঠাকুরবাড়ি গেলাম। ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে বাড়িতে থাকা সবার কাছে বলেকয়ে নৌকায় গিয়ে উঠলাম। কালাম নৌকা বেয়ে সুবচনী বাজার নিয়ে এলো। ঢাকার লঞ্চে না ওঠা পর্যন্ত লঞ্চ ঘাটেই ছিলো। একসময় লঞ্চ আসলে কানাই আর আমি লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে রওনা রওনা হলো। মাঝপথে ফতুল্লা লঞ্চঘাট নেমে নিজের বাসায় চলে গেলাম।
চলবে…

জীবনের গল্প-১৭ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।