খালি হাতে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে ফেরা শ্রমিকদের দিন কাটবে কিভাবে?

সৌদি আরব সরকারের ব্যাপক ধরপাকড় অভিযানের মুখে খালি হাতে বুধবার রাতে দেশে ফিরেছেন ২১৫ জন বাংলাদেশি শ্রমিক। স্বজনদের কাছে তারা ফিরে গেছেন এক বুক হতাশা নিয়ে। জমি জমা বিক্রি করে এবং ঋণ নিয়ে তারা সৌদি আরব গিয়েছিলেন পরিবারের মুখে এক টুকরো হাসি ফোটাতে৷ অথচ সেই স্বপ্ন এখন বিরাট দুঃস্বপ্ন। এই শ্রমিকদের সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটবে তা নিয়ে তারা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ।তাদের চোখেমুখে রাজ্যের হতাশা।

বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক ও ব্রাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম জানাচ্ছে, নভেম্বর মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে ১৫৬১ জন কর্মী দেশে ফিরেছেন। আর এ বছর সৌদি আরব থেকে ২০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন । এই শ্রমিকদের বেশিরভাগেরই আকামা অর্থাৎ কাজের অনুমতিপত্র ছিল।

কাজের অনুমতি থাকা সত্ত্বেও সৌদি পুলিশ এই শ্রমিকদের গ্রেফতার করে। এরপর জেল জুলুম শেষে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।অনেকের অভিযোগ তাদের ঠিকমতো খাবারও দেয়া হয়নি। উপরন্তু মানসিক নির্যাতন করা হয়৷

ফিরে আসাদের একজন বাহার উদ্দিন। তিনি সৌদি আরবে কন্সট্রাকশনের কাজ করতেন। দীর্ঘ ২৬ বছর সেখানে ছিলেন।

এয়ারপোর্টে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “অনেক বছর সৌদি আরবে ছিলাম। জীবনে এমন পরিস্থিতি কখনো সৌদি আরবে দেখিনি। সেখানকার পুলিশ বেপরোয়া হয়ে গেছে। বৈধ-অবৈধ দেখছে না। রাস্তা থেকে ধরে সোজা জেলে। এরপর পাঠিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশে।”

ফিরে আসা শ্রমিকদের আরেকজন সিলেটের ইলিয়াস আলী। তিনি জানান,সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে সৌদি আরব যান। দালাল তাকে সেখানে ভালো কাজ পাবার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, “যে কোম্পানিতে কাজ করার কথা ছিল তাদের দেখা মেলেনি। ফলে এখানে সেখানে কাজ করেছি। আকামা হয়নি। আকামার জন্য দুই দফায় টাকা দিয়েছি ২১ হাজার রিয়াল। এরই মধ্যে মাস ছয়েক আগে ডান পা অবশ হয়ে গেল। চলাফেরা করতে পারি না। যে জায়গায় কাজ করি সেই নিয়োগকর্তা বললেন আকামা করতে ২৭ হাজার রিয়াল লাগবে। এই পা নিয়ে আমি এখানে থেকে কি করব। পরে ধরা দেই। শেষমেষ খালি হাতেই আমাকে ফিরতে হলো দেশে।”

কিশোরগঞ্জের সোহরাব পরিবারের দুঃখ দুর্দশা ঘোচাতে বছর দুয়েক আগে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে সৌদি গিয়েছিলেন।কিন্তু সাম্প্রতিক ধরপাকড়ে তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়। আসার সময় মাথায় জড়ানো মাফলার আর পরিহিত জামাকাপড় ছাড়া কিছুই সঙ্গে আনতে পারেননি। যেখানে তিনি থাকতেন সেই রুম থেকে ধরে ফেরত পাঠানো হয়।

সৌদিতে বর্তমানে এক বড় প্রতারণার নাম ফ্রি ভিসা। এর মাধ্যমে শ্রমিক বিভিন্ন সমস্যায় পড়েন এবং একসময় কূল কিনারা না পেয়ে শূন্য হাতে দেশে ফেরেন।

বছর দুয়েক আগে ফ্রি ভিসায় সৌদি আরবে গিয়েছিলেন ভোলার ফুয়াদ হোসেন। ছয় লাখ টাকা খরচ হয় তার। কিন্তু সেখানে টিকতে পারেননি। টাকার বিনিময়ে আকামার ব্যবস্থা হলেও মেয়াদ শেষে সেই অর্থ ওঠেনি। ফলে পরবর্তী আকামা হয়নি। সেখানে তিনি অবৈধ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় কাজ করতে থাকেন এবং পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ফলে খালি হাতে দেশে ফিরতে হয় তাকে।

সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ বলছেন, ফ্রি ভিসা মূলত একটা প্রতারণা। তার ভাষ্য – “আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, ফ্রি ভিসা বলতে আসলে কিছু নেই। এখানে কাজ করতে হলে আকামা থাকতে হবে এবং নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তার অধীনে কাজ করতে হবে। এর বাইরে গেলে অবৈধ হয়ে যেতে হয়। তখন মেয়াদ থাকলেও ফেরত পাঠানো হবে।”

তার মতে ফ্রি ভিসার বিষয়টি এভাবে কাজ করে – “সৌদি আরবের কোনো ছোট কোম্পানি, তাদের সক্ষমতা নেই লোক নিয়োগের, কিন্তু সে কয়েকজন লোকের চাকরির অনুমোদন নেয়। তখন তার নামে শ্রমিকদের জন্য ভিসা ইস্যু হয়। এরপর ওই ব্যক্তির কাছ থেকে আকামা নিয়ে শ্রমিকরা অন্য জায়গায় কাজ করে।”

বাংলাদেশ থেকে নতুন করে কেউ সৌদি আরব যেতে চাইলে সঠিক তথ্য জেনে বুঝে যেতে হবে,এমনটাই পরামর্শ অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস এর মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরীর ভাষ্য – শ্রমিক পাঠানোর আগে তাদের সঠিক ওরিয়েন্টেশন দরকার। ওরিয়েন্টেশনের অভাবে অনেকে ফ্রি ভিসার নামে গিয়ে বিপদে পড়ছে।

ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান এর মতে, শ্রমিকদের কাউকে যেন শূন্য হাতে ফিরতে না হয় সেজন্য যাবার পূর্বে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বিশেষ করে ফ্রি ভিসার নামে প্রতারণা বন্ধ করা উচিত।

বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনায় সৌদি আরব বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হতভাগ্য শ্রমিকরা সৌদি আরব গিয়েছিলেন নিজ সংসারের অভাব দূর করে স্ত্রী সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। অথচ তারা এখন হতাশার বৃত্তে বন্দি।

যারা হতে পারতেন আশাজাগানিয়া রেমিট্যান্স যোদ্ধা তারাই আজ জানেন না সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটবে। তাদের চোখে আজ কোন স্বপ্ন নেই,আশা নেই। যারা দেশের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হতে পারতেন তারাই এখন অন্ধকারে। সমাজ এবং সরকার তাদের পাশে দাঁড়ালে এই অন্ধকার কেটে যাবে। মানবিক দিক বিবেচনা করে চলুন তাদের পাশে দাঁড়াই। চলুন তাদের বলি,ভয় পেওনা,পাশে আছি। নতুন সকাল আসবেই।

মামুন রণবীর
১৫/১১/১৯

1 thought on “খালি হাতে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে ফেরা শ্রমিকদের দিন কাটবে কিভাবে?

  1. চলুন তাদের বলি,ভয় পেওনা,পাশে আছি। নতুন সকাল আসবেই।

     

    * নারী শ্রমিক আর পুরুষ শ্রমিক কেউই এখানে শঙ্কা মুক্ত নয়, তবু কেন এদেশের প্রতি সবার এত মোহ কেন জানিনা। এখনই সতর্ক হবার সময়।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।