বিভাগের আর্কাইভঃ সমাজ

সম্পর্ক নাকি অভিনয়

একটা সম্পর্ক সুন্দর ভাবে চিরকাল অটুট রাখার উপায় কি হতে পারে?
১. প্রতারণা ২. অভিনয় ৩. টাকা ৪. অত্যাচার ৫. বিশ্বাসঘাতকতা ৬. নির্দিষ্ট সময় শেষে পৃথককতা ৭. আর কি হতে পারে…

যা খুঁজে বেড়াচ্ছেন….
১. বিশ্বাস ২. বন্ধুত্ব ৩. ভালোবাসা ৪. সম্মান করা ৫. আস্থা রাখা

যা হয়,
রাগান্বিত বা উত্তেজিত হলে এই সবই ফুড়ুৎ।

হাজার মানুষের ভালোবাসার সম্পর্কের উক্তি দিয়েও সম্পর্ক ঠিকে না কারণ এগুলো সবাই অন্যকে দেখানোর জন্য পড়ে বা বলে কিন্তু কেউ ধারণ করে না।

আসলে সঠিক উপায় টা কি ধর্মীয় বিশ্বাস নাকি অভিনয়? যেখানে আমাদের সময়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা খুবই দরকার না হলে পৃথিবীটা দুর্গন্ধে ভরে যাবে…

আমরা মুখোশধারী

1632911392166

যে ছেলেটি মদ্যপ এবং নেশা করে তাকে সমাজ বখে গিয়েছে বলে। পরিবার কুদৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু কেন?

আপনি তো ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। আপনি জানেন কি? মিথ্যা বলা, গীবত করা, পরনিন্দা, লোভ, অহংকার এবং মানুষ ঠকানো মদপানের চেয়ে জঘণ্য ও মহাপাপ। অথচ আপনি আমি উক্ত শব্দদ্বয়গুলির সাথে বসবাস করছি। মিথ্যা বলি, গীবত করি, গুজব রটাই ইত্যাদি প্রতিনিয়ত যারা করছে তাদের কেন মুসলমান সমাজে জায়গা হবে? যদি সেই মদ্যপ ছেলেটি খারাপ বলে পরিচিত হয় তাহলে তারা কেন ভদ্রতার আসনে বসে থাকবে?

আপনি নিজেকে মুসলমান দাবী করছেন। আপনি রোহিঙ্গা ও কাশ্মীরে হামলার প্রতিবাদ করেন কিন্তু বেলুচিস্তান ও ইয়ামেনের হামলার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করেন না। কেন? আপনি ফেলানীর জন্য প্রতিবাদ করেন কিন্তু সৌদি থেকে হাজার হাজার নারী নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরছে তার প্রতিবাদ করেন না। কেন?

আপনি মুসলমান অথচ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য কাঁদেননি, কেঁদেছেন পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টোর জন্য। যে আশ্রয় দিয়েছিল সেই কর্নেল তাহেরের জন্য কাঁদেননি, কেঁদেছেন জিয়াউর রহমানের জন্য। কেন ভাই? শেখ মুজিব আর কর্নেল তাহের কি মুসলমান ছিলেন না?

কারণ আপনাদের মধ্যে আল্লাহর আনুগত্যতা নেই আছে ধর্মান্ধতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। আপনারা নিজ ধর্মের বিধিনিষেধ পালন করবেন না কিন্তু গুজব রটানোর জন্য ধর্মকে হাতিয়ার করে মায়া কান্না আর ভন্ডামি করতে ওস্তাদ। আপনারা শুধু সামাজিক যোগাযোগে নিজেকে মুসলামান দাবী করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটবেন কিন্তু গাম্বিয়ার মত আর্ন্তজাতিক আদালতে মামলা করার সাহস করবেন না। কারণ আপনাদের ঈমানী দুর্বলতা অধিক থেকে অধিকতর এবং আপনারা সুবিধাবাদী।

আপনারা সত্যিই সুবিধাবাদী। ৯০দশকেও এইদেশে টিভি দেখা হারাম ছিল। ছবি তোলা নাজায়েজ ছিল। এখন আপনাদের সুবিধার্থে ধর্মকে পরিবর্তন করে জায়েজ করে নিলেন। ইসলাম ধর্মে সকল ধরণের খেলা হারাম শুধু ঢাল-তলোয়ার খেলা ছাড়া অথচ আমরা বর্তমানের সকল ধরণের খেলাকে জায়েজ করে নিজেদের মগ্ন রাখি, আর বলি আমি মুসলমান।

আপনার ছেলে-মেয়ে পড়াশুনার নামে বাহিরে গিয়ে সবার অগোচরে প্রেম লীলায় মগ্ন অথবা আপনি অনলাইনে ফটকামী করে বেড়াচ্ছেন, যা ইসলামে পুরোপুরি নিষিদ্ধ আর সেই আপনারাই গলাবাজি করেন রোহিঙ্গা মারছে, কাশ্মীর মারছে, তসলিমাকে হঠাও। তসলিমা নাসরিনের সাথে আপনার পার্থক্য কোথায়? তসলিমা সরাসরি ধর্মকে অস্বীকার করছে আর আপনি ধর্মের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে ধর্মকে পরোক্ষভাবে অস্বীকার করছেন।

আপনি নিজেকে মুসলমান দাবী করেন কিন্তু আল্লাহকেও অস্বীকার করেন। বিশ্বাস হচ্ছে না? ঠিক আছে, একজন সুন্দরী রমনীর সাথে আপনাকে এক সপ্তাহের জন্য একটা আবদ্ধ ঘরে থাকতে দিবো। তারপর আপনি নিজেই রাসলীলায় মেতে উঠবেন আর তখনই ভুলে যাবেন আপনার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কথা।

এমন কোনো পুরুষ আছেন যারা একবারের বেশি দু’বার কোনো বেগানা নারীর দিকে দৃষ্টি দেন নাই? নাই ভাই, এমন কেউ নাই। একবারের বেশি দু’বার তাকাতে আল্লাহ আপনাকে নিষেধ করেছেন অথচ কোনো সুন্দরীকে দেখলে ধর্মের হুকুমকে উপেক্ষা করে দৃষ্টি দিয়ে চোখের যেনা করছেন। কেন? আপনি তো মুসলামান!

পিতা-মাতার হক কতজনই পালন করেন? যে ছেলেটি রাজপথে কাশ্মীরীদের জন্য স্লোগান তুলছেন সেই ছেলেটি কি তার পিতা-মাতা হোক জীবিত কি মৃত তাদের হক পালন করেছে কিংবা করে? ধর্মের নামে যখনই কোনো ঘটনা ঘটে তখন মানববন্ধন, প্রতিবাদ, কুশপুত্তলিকা পোড়ানোসহ কত কি করেন অথচ যারা আল্লাহর হুকুম অমান্য করে বৃদ্ধাশ্রমে পিতা-মাতাকে ছুঁড়ে আসে তাদের বিরুদ্ধে কখনো রাজপথে নেমেছিলেন? নামেন নি। তাহলে আপনি কিভাবে মুসলমান দাবী করেন?

ইসলাম ধর্ম একমাত্র আল্লাহর ধর্ম যা মহানবী (সঃ)’র মাধ্যমে প্রেরিত। যদি তাই বিশ্বাস করেন তাহলে ধর্মকে যেমন ইচ্ছা তেমন না সাজিয়ে নিজেকে শুধরিয়ে ঈমানকে পাক্কা করুন। আমি হলফ করে বলতে পারি আমার দেশের ৮৫% মানুষের ঈমান ঠিক নাই। অথচ নিজেকে ধার্মিক দাবী করে।

মাটিতে সিজদা দিলেই নামাজ কায়েম হয় না। মাটিতে সিজদা তো হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টানরাও দেয়। যারা জুমার দিন নামাজে যান তারা কি আল্লাহকে ভয় করে জুমার নামাজ আদায় করেন? নারে ভাই। পারিবারিক অভ্যস্ততার কারণে শুক্রবারে মসজিদে যায়। যদি আল্লাহকে ভয় করতো তাহলে মিথ্যা, গীবত, পরশ্রীকাতরতা সহ ইসলাম বিরোধী সকল নিষেধ পরিহার করে ইসলামের হুকুম-আহকামের উপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত আদায় করতো।

নামাজ কায়েম করতে হলে আগে নিজেকে বিশ্বাসী করে তুলুন, আল্লাহ ও তাঁর নবীর হুকুম আহকাম গুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তারপর নিজেকে মুসলমান দাবী করে গলাবাজি করবেন। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার না করে, ধর্মীয় শুদ্ধতা চর্চা করুন। তাহলে দেশ, জাতি ও আপনার মঙ্গল এবং আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন।

আলেম ভার্সেস আলেম

এখন ওয়াজের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে, গ্রাম-গঞ্জ, শহরের জায়গায় জায়গায় ওয়াজের নামে কিছু সুরওয়ালা গায়কের আবির্ভাব হবে, এদের বয়কটের উপযুক্ত সময় এখনই। ধর্ম সম্পর্কে জানার জন্য ওয়াজ মাহফিলে যাওয়ার আগে যার ওয়াজ শুনবেন তাকে জানুন। খোঁজ নিন তার জ্ঞানের পরিধি কতটুকু তারপর যান, অমুক তমুক নাম শুনে চিল্লা ফাল্লা শুনতে আর কমেডি দেখতে যাইয়েন না প্লিজ। আমরা এদের দাওয়াত করি আর এদের মাহফিলে ভীড় করি বলেই এরা ইসলামি জলসাকে নাটকের মঞ্চ বানিয়ে ফেলতেছেন দিনের পর দিন। ওয়াজের স্টেজে রাতভর কমেডি চলে আর এসবের কারণে ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মধু আহরণ করতে যেয়ে মগজে বিষ নিয়ে ফিরলে আপনারই বিপদ। এই যুগে মাহফিলে কী হয় সবাই জানার সুযোগ পায়, মূল ধারার মিডিয়ায় না আসলেও এসব সোশ্যাল মিডিয়ায় ঠিকই আসে, ইসলামের প্রতি অনেকের ভুল ধারণা তৈরি হয় এদের কারণেই। সাম্প্রতিক এক মুর্খের কথা শুনে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, এমন মুর্খের কিন্তু অভাব নাই। আমার আপনার দায়িত্ব এদের প্রতিহত করা।
.
অনেকদিন আগে একজন আলেম বলেছিলো যারা সাহিত্য চর্চা করে তারা নাস্তিক, উনি কথাটা যে কিছুটা আমাকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন আমি বুঝেছিলাম৷ তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “হুজুর, সাহিত্য কী আর নাস্তিক কী জিনিস…? কুরআন যে সময় অবতীর্ণ হয়েছিলো সেই যুগে কিসের প্রাধান্য ছিলো বেশি…? সুরা কাউসারের শানে নুযূল কী…? কেনইবা কুরআনের মতো আরেকটি গ্রন্থ বা কুরআনের সুরাগুলোর মতো আরেকটা সুরা অথবা একটা আয়াত তৈরির চ্যালেঞ্জ দেয়া হলো…? কুরআনের কোন গুণের উপর ভিত্তি করে…?”
উনি সঠিক কোন উত্তর দিতে পারেননি। পরে বললাম “হুজুর, কুরআন অবতীর্ণের সময় সাহিত্যের প্রভাব ছিলো বেশি ইতিহাস পড়ে জেনেছি, পৃথিবীতে আর কোন যুগে সাহিত্যের এত বড় প্রভাব ছিলোনা, সেই যুগে কুরআন নাযিল হলো আর মানুষ সেই সময়ের সাহিত্যকে ডিঙিয়ে কুরআনের কাছে নত হলো…! কুরআনের ভিতর সাহিত্যক শক্তি না থাকার কোন প্রশ্নই আসেনা, বরং সেই সময়ের বিখ্যাত কবি ইমরুল কায়েস পর্যন্ত কুরআনের ভিতর যে সর্বোচ্চ সাহিত্যিক ক্ষমতা আছে এবং এমন উচ্চ গুণ সম্পন্ন সাহিত্য চর্চা কোন মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয় সেটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সুরা কাউসারের শানে নুযূল পড়ে জেনেছি। তাহলে সাহিত্য চর্চা করলে কেউ নাস্তিক হয় কিভাবে…?” উনি গরম আচরণ করলেন তারপর তার সাথে আমার আর কোনদিন তর্ক হয়নি।
.
প্রচলিত অর্থে যাদের আলেম বলা হয় তাদের সাথে আমি কখনো তর্কে যাইনা, আমি এমন অসংখ্য প্রচলিত অর্থে বুঝানো আলেমদের সাথে কথা বলেছি, মিশেছি, যাদের ভিতর জ্ঞানের প্রচণ্ড অভাব। এরা মাদ্রাসায় কিছুদিন যাওয়া আসা করেছে, লম্বা জোব্বা-টুপি পরেছে আর কিছু মুখস্থ বিদ্যা আছে এটুকুর কারণে তাদের গর্বের শেষ নাই এরথেকে বেশি অর্জনও এদের নাই। এরা ভাবে জান্নাতে এদের এক পা আরেক পা দুনিয়াতে, এরা আপনাকে ঠাস করে জাহান্নামী বানিয়ে দিবে।
.
অথচ প্রচলিত অর্থে এদের আলেম বলা হলেও আল্লাহর ভাষায় কারা আলেম সেটা অনেকেরই অজানা। আল্লাহর ভাষায় আলেম তারাই যারা আল্লাহকে বেশি ভয় করে, আল্লাহ বলেন, “আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই কেবল তাঁকে (আল্লাহ) ভয় করে।” (সুরা ফাতির, আয়াতঃ ২৮) এটা সরল অনুবাদ, আপনি এই বাক্যের অর্থ কী বুঝলেন…? আলেমরা আল্লাহকে বেশি ভয় করে, এর মানে যাদের ভিতর আল্লাহর ভয় আছে তারাই আলেম। আল্লাহর প্রতি ভয় কখন তৈরি হবে…? যখন আপনি আল্লাহর পরিচয় পাবেন…? আল্লাহর পরিচয় আপনি কখন পাবেন…? যখন আপনি জ্ঞানার্জন করবেন ও জ্ঞানীদের সাহচর্যে থাকবেন। অথচ প্রচলিত অর্থে আলেম বলতে আমরা বুঝি যার মাদ্রাসার সনদ আছে। বিষয়টা একাধারে ভ্রান্ত এবং হাস্যকর ধারণা। এটা সমাজে এতবেশি প্রচলিত যে তা দূর করা সম্ভবপর নয়।
.
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, সূচনা লগ্ন থেকেই এক শ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিহীন বুদ্ধিজীবীরা ইসলামের সমালোচনা করে আসছে, ইসলামের আইনের ভুল ধরার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে, বারবার বলছে যে ইসলামে প্রচুর অসঙ্গতি আছে। আমাদের দাবী ইসলাম পরিপূর্ণ, এতে কোন অসঙ্গতি নেই, সাইন্টিফিক দিক থেকেও নির্ভেজাল। তবে এরা কিভাবে এসব বলে…? এর পিছনে অনেকগুলো কারণ থাকলেও অন্যতম একটি কারণ হলো ইসলামের সুমহান আদর্শ, ইসলামের মৌলিকত্ব আমরা তাদের সামনে উপস্থাপন করতে পারিনি এসব মূর্খদের কারণে বরং এরা ইসলামকে হাসির বস্তু বানিয়ে ফেলেছে।
.
আমাদের বোকামির দ্বারা আমরা ইসলামের সমালোচনাকারীদের প্রকারান্তে সহযোগিতা করতেছি। জ্ঞানার্জনের শেষ নেই, যতই আপনি সত্যের জ্ঞান আহরণ করবেন ততই আপনার মাঝে আল্লাহ ভীতি পয়দা হবে, ততই আপনি আলেম হয়ে উঠবেন। কেবল জানলেই যদি আলেম হওয়া যেতো তবে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের মাঝেও প্রচুর আলেম আছে।
.
মূল বিষয় হলো ইসলামে জ্ঞানার্জনের এত গুরুত্ব অথচ আমরা কুরআন মুখস্থ করি এটুকুই শেষ। না বোঝলাম এখানে কী বলা হলো, না বোঝলাম এর ভাবগত অর্থ না পেলাম এর ভিতরের রস। এদিকে আজীবন শুধু বলে গেলাম কুরআনে সব আছে অথচ বড় বড় উদ্ভাবন ও আবিষ্কার করতেছে অন্যরা, পরে ঠিকই বলতেছি এগুলো কুরআন থেকেই করে…!!
হাস্যকর না…???
মুসলিম জাতির উচিত জ্ঞান বিজ্ঞানের শাখা প্রশাখায় আবার বিচরণ করা, আমাদের অতীত সুন্দর ছিলো…
.
০৬/১২/২০২১

ঋতুস্রাব এবং আমাদের মস্তিষ্ক

মেয়েটির পিরিয়ডের আজ দ্বিতীয় দিন। তার আজকে পায়ে হাঁটার মতো শক্তি নেই, তার ঊরুগুলো পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। মেয়েটি পেটের ব্যথা ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে এবং সেই যন্ত্রণায় মেয়েটি কাঁদছে। মেয়েটি দাঁতের উপরে দাঁত দিয়ে প্রচন্ড ব্যথা সহ্য করে আছে। ফার্মেসি ভর্তি মানুষগুলোর নিথর চোখের মাঝেও গতকাল মেয়েটি যখন সাহস করে ফার্মেসিতে গিয়ে প্যাডের নাম ফিসফিস করে বলছিল, দোকানদার তাকে একটা কালো ব্যাগে প্যাডটি এমনভাবে মুড়িয়ে দিল যেন মেয়েটি এমন কোন কিছু চেয়েছে যা নিষিদ্ধ এবং তা সমাজ বা রাস্ট্রের জন্য ক্ষতিকর এবং মেয়েটিকে সেই প্যাড লুকিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অথচ দেদারসে বিড়ি সিগারেট মাদক প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে।

আজ মেয়েটির সমস্ত শরীরে নেশার মতো করে ব্যথা আঁকড়ে ধরে আছে। এমনকি মেয়েটি আজ তার অফিসে চেয়ারে দু’দন্ড স্থির বসে থাকতে পারেনি।

প্রতি মাসের এই পাঁচ দিনের রুটিনে মেয়েটি কখনো ছুটি নেননি শুয়ে থাকেননি। আজকে তার সহকর্মীরা তার দিকে আঁড় চোখে তাকিয়ে আছে, এবং মাঝে মাঝে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে, অন্যদের সাথে কথা বলে কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই গল্প তোলে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ গতকালের অসমাপ্ত কাজের জন্য মেয়েটিকে যাচ্ছে তাই বলে তিরস্কার করে অথচ মেয়েটি তার সকল কাজেই পারদর্শী কিন্তু গতকাল থেকে সে পিরিয়ডের ব্যাথায় কাতর।

গতকালের অসমাপ্ত কাজগুলো দ্রুত শেষ করে টেবিলে দিতে বলেন অথচ মেয়েটির গত পঁচিশ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা বেমালুম ভুলে যায়। মেয়েটিকে ধমকের সুরে বলে দিলো কাজটা দ্রুত শেষ করার জন্য। মেয়েটির মুখের ফ্যাকাশে, ক্লান্তি আর শরীরের অলসতা-দুর্বলতা চলতেই থাকে। কয়েক দিনের মধ্যে মেয়েটি কোন কাজে মন বসাতে পারেনি। মেয়েটি তার কেবিন ছেড়ে উঠতে পারেনি তার মনে ক্রমশ অস্বস্তির একটা ঢেউ উঠেছিল।
না এটা অন্য কোন উদ্বেগ ছিল না তার পোশাকের পেছনে কোনো ‘দাগ’ ছিলনা উঠতে বসতে মেয়েটি স্বস্তিতেই ছিল কারন আটটি প্যাড যে সে আশি টাকায় কিনেছে। সে এই ভেবে অস্বস্তিতে ছিল যে এখন পর্যন্ত তার পেছনে সেই নোংরা চোখগুলো পড়েছিল এবং কানাকানি করছিল আর হাসছিল।

ওহে পুরুষ! সেই মেয়েটি কি করে তোমার ভাবনায় ? পুরুষগুলো বেমালুম ভুলে যায় তার মায়ের, বোনেরও প্রতিমাসে পিরিয়ড হয় এবং তারাও অসহ্য রকম যন্ত্রণা সহ্য করে। পিরিয়ডের মতো একটা স্বাভাবিক ঘটনাই জানিয়ে দেয় আমাদের মন মানসিকতা কোন পর্যায়ে আছে।

মাসিকের ব্যথা থেকে মেয়েটি শিক্ষা নেয় এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে তাই তাকে নিয়ে হাসবেন না যখন সে এই যন্ত্রণার দ্বারা যন্ত্রণাদায়ক অবস্থায় থাকে কারণ এই ঋতুস্রাবেই কারনেই ‘ভ্রুণ’ তৈরির মাঠ তৈরি হয়।

“টিপে” এতো সমস্যা কেন?

images

গরমের নাভিশ্বাস, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রমজানের সাওম, সবকিছুকে পেছনে ফেলে গত কয়েকদিন ধরে যে বিষয়টা টক অব দ্যা কান্ট্রি তা হলো “টিপ”। টিপ দেওয়াকে কেন্দ্র করে একজন শিক্ষিকার সাথে যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে গেলো তা খুবই দুঃখজনক। এই ঘটনা আজ আমাদের মানবিকতা, ধার্মিকতা এবং অসাম্প্র্রদায়িক চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

টিপ পরাকে কেন্দ্র করে যে মৌলবাদী সুড়সুড়ি সারা দেশকে উসকে দিচ্ছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এই টিপ আজ দেশকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। তাই টিপ পরা এবং না পরা নিয়ে কোথায় কার কী সম্মতি এবং আপত্তি আছে তা আমাদের সকলের দৃষ্টিগোচর হওয়া উচিত।

শুরুতেই বলতে হচ্ছে, শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকার সাথে যা ঘটেছে তার জন্য জাতি হিসাবে আমরা লজ্জিত। তিনি একজন মা এবং একজন শিক্ষাগুরু। তাঁর সাথে এমন আচরণ কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ঐ পুলিশ যে দৃষ্টিকোণ থেকে ঐ শিক্ষিকার সাথে এমন আচরণ করেছেন, সেই আচরণের অধিকার কেউ তাকে দেয়নি। আমাদের রাষ্ট্র কিংবা ধর্ম কোনো অবস্থান থেকেই কোনো সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু কারো সাথেই এভাবে লাঞ্চিত করার কোনো অনুমতি নেই।

অভিযুক্ত পুলিশ যে দৃষ্টিভঙ্গিতে এই আচরণ করেছে, সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মুসলিম সমাজের অনেকেই পোষণ করে। যা আপাত ধর্মীয় দৃষ্টিতে অপরাধ না হলেও অযৌক্তিক জায়গায় প্রয়োগে ধর্মীয় যথেষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কেননা ইসলাম কাউকেই (হোক মুসলিম বা বিধর্মী) সরাসরি হেনস্তা করার অধিকার কাউকে দেয়নি। সুতরাং টিপ নিয়ে যা ঘটেছে তা অবশ্যই অযৌক্তিক এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

আমরা জাতিগতভাবে বাঙ্গালী। তাই আমাদের সংস্কৃতিতে বাঙ্গালিয়ানা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই সংস্কৃতির উপর কোনো বাঁধাই আমরা মেনে নিতে পারি না। যে নিজেকে বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে চায় তাকে কেউই তার সংস্কৃতি থেকে আলাদা করতে পারবে না। এমনকি ইসলামও তাকে বাঁধা দেওয়ার কথা বলে না। তাহলে এই অধিকাংশ মৌলবাদীদের সমস্যা কোথায়?

যেসব মুসলিম নিজেদের বাঙ্গালি পরিচয়ের চাইতে মুসলিম পরিচয়কে বড় করতে চায়, তাদের জন্য তখন সংস্কৃতির চাইতে ধর্মটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর তখনি মুসলিম জাতীয়তাবাদের সাথে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সংঘর্ষ বাঁধে। কেননা ইসলাম বিজাতীয় সংস্কৃতি ধারণ কারার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট আয়াতে আল্লাহ্ বলেন,

“তোমরা কাফির ও মুনাফিকদের অনুসরণ করবে না।” ( সূরা আহযাব: ৪৮)
অর্থাৎ যে নিজেকে মুমিন মুসলিম দাবি করবে সে কখনোই কাফির-মুশরিক, ইহুদী-নাছারা, বৌদ্ধ-মজুসী, বেদ্বীন-বদদ্বীন ইত্যাদি বিভিন্ন কোনো ধর্মাবলম্বীদেরই অনুসরণ করতে পারবে না। তার জন্য বিজাতীয় ধর্মীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করা হারামের অন্তর্ভুক্ত।

অনুসরণ অনুকরণ বিষয়ে হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর বাণী হলো,

হযরত ইবনে উমার রাঃ হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের অনুরূপ অবলম্বন করে,সে তাঁদেরই দলভুক্ত। (সুনানে আবূ দাঊদঃ ৪০৩১)

অর্থাৎ কেউ ইসলামের আদর্শের বাইরে গিয়ে অন্য কোনো আদর্শ বা সংস্কৃতিকে পছন্দ করে লালন করতে পারবে না। যদি কেউ এমন করে তাহলে সে ঐ দলের বা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। উপরোক্ত কুরআন এবং হাদিসের আলোকে ইসলামে কোনো মুমিন মুসলিম এমন কোনো বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ করতে পারে না। যেসব সংস্কৃতি বিধর্মীদের ধর্মীয় আচার কিংবা তাদেরকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেয়।

উপমহাদেশে টিপের ইতিহাস যদি আমরা জানার চেষ্টা করি, তাহলে জানতে পারবো যে, টিপ সনাতন ধর্মাবলম্বী তথা হিন্দুদের ধর্মীয় একটি আচার এবং প্রথা। যা বাঙ্গালী হিন্দুরা যুগ যুগ ধরে মেনে আসছে। টিপের সম্পর্ক হিন্দু নারীদের সিঁদুরের সাথে। যে সিঁদুর হিন্দু বিবাহিত নারীরা তাদের স্বামীদের মঙ্গল কামনায় কপালে ধারণ করেন। শুধু নারী নয় সনাতনী পুরুষরাও তাদের বিভিন্ন পূজার্চনায় টিপ বা তিলক পরিধান করে থাকেন। অনেক সনাতনী গোষ্ঠীর নারী পুরুষ উভয়ই লম্বা তিলক দিয়ে থাকেন। যা উপমহাদেশে ইসলাম আবির্ভাবের পূর্ব থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পালন করে আসছে।

ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশে ইসলাম আবির্ভাবের পরে যারা ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলামে প্রবেশ করে তারাও তাদের আগের সংস্কৃতি থেকে সরে আসেনি। সেই সাথে কুরআন হাদিসের সঠিক চর্চা এবং ধর্মীয় জ্ঞানের সংকীর্ণতার কারণেও অধিকাংশ মুসলমান জানতে পারেনি বিজাতীয় সংস্কৃতি ইসলামে ধারণ করা নিষিদ্ধ। যার ফলে এখনো মুসলিম বাঙ্গালীরা জানে না- টিপসহ আরও অন্যান্য যেসব সংস্কৃতি আছে, যা সরাসরি বিধর্মীদের নিদর্শন তা ইসলামে নিষিদ্ধ।

অতএব, যারা নিজেদেরকে মুসলিম ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচয় দিতে চায় তাদের জন্য ইসলামী সংস্কৃতির বাইরে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় সংস্কৃতি নিষিদ্ধ। আর যারা নিজেদের বাঙ্গালী পরিচয় দিয়ে চলতে চায়, তাদেরকে কেউ ধর্মের ধোঁয়া তুলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যাবে না। কেননা ইসলাম কখনোই কারো টুঁটি চেপে ধরার শিক্ষা দেয় না। অতএব উপরোক্ত ঘটনার মতো ইসলামকে ব্যবহার করে ধর্মকে কলঙ্কিত করা যাবে না।

যেসব মুসলমানরা এই ঘটনায় ঐ পুলিশের ইসলামী দৃষ্টিকোণ খোঁজার চেষ্টা করছেন। তাদের জন্য সত্য হলো, দ্বীন প্রচার প্রথমে নিজ ঘর থেকেই শুরু করতে হয়। যারাই আজ টিপ বিরোধী তাদের উচিত নিজ নিজ মা বোনসহ সকল মুসলিম আত্মীয়স্বজনদের সামনে টিপের ব্যাপারে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা। সেই সাথে যারাই টিপের পক্ষপাতি তাদেরকে এড়িয়ে চলা। কেননা ইসলাম জোর করে ধর্ম পালনে বাধ্য করে না। সেই সাথে কোনো বিধর্মীকে জোর করে লাঞ্চিত অপদস্থ করার অধিকার ইসলাম কখনোই কাউকে দেয় নি

আর যারা নিজেদের মুসলিম এবং বাঙ্গালী উভয়ই দাবি করতে চান। তাদের জন্য নীতি বাক্য হলো, কখনোই দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না। আপনি ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে পারেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার বাঙ্গালিয়ানা আপনার ইসলামে আঘাত না আনে। যদি বাঙ্গালিয়ানার কোনো কিছু ইসলামে আঘাত আনে তাহলে তা আপনার ঈমানে আঘাত আনবে। আর আপনার ঈমান আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া মানেই আপনি ইসলাম থেকে বেরিয়ে হয়ে যাওয়া।

সুতরাং আমাদের সকলেরই উচিত সঠিক ইসলাম জানার চেষ্টা করা। অহেতুক বিচ্ছিন্ন ঘটা ঘটিয়ে ইসলামকে কলুষিত করা কখনোই কারো উচিত নয়। সবারই উচিত আগে নিজের পরিবার পরিজনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। তারপর সুন্দর আচরণের দ্বারা অন্যান্যদেরও ইসলামের দাওআত দেওয়া। যাতে আমরা সত্যিকারের প্রকৃত মানুষ এবং মুমিন হতে পারি।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

পরিমনি: যত দোষ নন্দ ঘোষ

Sc211052_1

সম্রাট আর পরিমনিই কি শুধু দোষী! নেপথ্যে যারা, তারা কারা?

মদ হারাম। মদ পান শাস্তিমূলক অপরাধ। দণ্ডবিধিতে মদপানের শাস্তি ২৪ঘন্টা থানা হাজত অথবা ১০টাকা জরিমানা। মানলাম কিন্তু বুঝতে পারলাম না তাই জানতে চাই, বাংলাদেশে এতো মদের বার কেন? বিদেশী মদ আসে কোথায় থেকে? কে বা কারা ইমপোর্ট করে?

আমরা বেশ্যা বলি। দেহব্যবসায়ী বলি। সমাজে নষ্টা বলি। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে আমরা পুরুষরাই তাদের ভোগ করি। আমি বেশ্যাদের সম্মান করি কারণ তারা তাদের জীবিকার তাগিদে তুমি পুরুষের শয্যাশায়ী হয় কিন্তু যারা প্রেম-ভালবাসার নামে অবৈধ মেলামেশা করে তাদের কি বলবেন?

বাংলাদেশে যদি টাকার বিনিময়ে সেক্স করাকে নিকৃষ্ট মনে করা হয় তাহলে ৯৫ভাগ যুবক-যুবতী প্রেমের নামে রাসলীলায় লিপ্ত হয় তাদের যৌনাচারকে আপনারা কি বলবেন? আমার দৃষ্টিতে সবাই বেশ্যা এবং চরিত্রহীন পুরুষ।

কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা সংবিধান বর্হিভূত। কেউ যদি অপরাধ করে তাকে আদালতে অপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করবে এবং শাস্তি প্রদান করবে অথচ আমাদের দেশে পুলিশ প্রশাসনের বরাতে মিডিয়া যে কাউকে মাদক কারবারী, রাতের রানী উপাধিতে ভূষিত করেন, এইটা কি সংবিধান বর্হিভূত নয়? কোন আইন বলে বাকস্বাধীনতা হরণ করে?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কত শতাংশ নেতা-কর্মী মদ পান করে না! আমার তো মনে হয় ৯৫শতাংশই মদপান করে থাকেন। বিশ্বাস হচ্ছে না? চলেন বিভাগীয় শহরগুলোর নামী-দামী হোটেল গুলো ঘুরে আসি তাহলে দেখতে পাবেন, কে বা কারা মদ খায়। বোট ক্লাবে বসে মদ খাওয়া যাবে কিন্তু বাসায় রেখে খাওয়া যাবে না এইটা কোন ধরনের আইন?

যে সমাজ বলে পরিমনি বেশ্যা, সম্রাট ক্যাসিনো ব্যবসায়ী আমি তাদের বলি, কষ্ট করে আপনি আপনার নিজের কথা ভাবুন আপনি কতখানি সৎ, আপনার বন্ধু-বান্ধব কতজন সৎ, আপনার সমাজে কতজন সৎ? তাহলে বুঝতে পারবেন, যত দোষ নন্দ ঘোষ।

আমরা পরিবর্তন চাই, আমরা সংস্কার চাই। কিন্তু যখনই পরিবর্তনের কথা বলা হয় তখনই নাস্তিক, মাদকাসক্ত, মাদক কারবারী, বেশ্যা কলঙ্ক নিয়ে জেল হাজতে যেতে হয় কিংবা নির্বাসিত হতে হয়। তবে কেন?

রাজনৈতিক নিছক স্বার্থের জন্য আমরা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এমনকি হলুদ সাংবাদিকদের জালে আমরা বন্দি। মুক্তি চাই। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন দেশে সাধারণ নাগরিক হিসেবে সজীব নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচতে চাই।

পরিশেষে বলতে চাই, মানুষের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটানোর প্রয়োজন তাই প্রগতিশীল হওয়ার আহ্বান রইল।

বাঁশের বাশি এবং

কী দুরন্তপনায়ই না কেটেছে আমাদের শৈশব! স্পষ্ট মনে আছে, একবার বাঁশের গুলতির বায়না ধরেছিলাম বাবার কাছে। বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটা হলো, বাঁশ থেকে খাপ বানানো হলো। তিন সূতার পাটের দড়ি পাঁকানো হলো। খাপের দুই পাশে দড়ি টানিয়ে ধনুক আকৃতির গুলতি তৈরি করা হলো। অতঃপর রঙ-বেরঙের মার্বেলের গুলিতে পাখি শিকার বেড়িয়ে পড়া ! আহা কি আনন্দ!

স্কুল থেকে বাসায় যাওয়ার পথে একটা রিকসা ফ্যাক্টরী ছিলো। স্কুল ছুটি হলে এর সামনে দাঁড়িয়ে রিকসা বানানো দেখতাম। সেই বাঁশ কেটে খাপ বানানো, দড়ি টানা দিয়ে বাঁকানো খাপে হুড বানানো, হুডের ঢাকনায় রঙ করা, ব্যাকপ্লেটে নীতিবাক্য লেখা ইত্যাদি। আমার খুব ভালো লাগতো।

তখন বর্ষাকাল। আমরা প্রায় প্রতিদিন ছাতা মাথায় পায়ে হেঁটে স্কুলে যাই। একবার আমার এক সহপাঠী এঁটেল মাটির রাস্তায় পা পিছলে আলুর দম। হাড় দু’টুকরা হয়ে গেলো। আমরা তাকে কোলে করে বাড়ি নিয়ে গেলাম। কবিরাজের ডাক পরলো। তিনি এসে গাছের শিকড় প্যাচিয়ে পায়ে শক্ত ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। কিছুদিন পর হাড় জোড়া লেগে গেলো। কিন্তু হায়! সে সোজা হয়ে হাঁটতে পারলো না। শহরে বড় ডাক্তারের কাছে নেয়া হলো। এক্সরে করা হলো। দেখা গেলো, জোড়া খাপে খাপ হয়নি, হাড়ের উপর হাড় পাশাপাশি জোড়া লেগে গিয়েছিলো। ব্যাপারটা অপারেশনে গড়িয়েছিলো। তারপরও কি এই পা সেই পা হয়!

আমাদের গ্রামে প্রতি শনি ও বুধবারে হাট বসতো। হাটবারে রাস্তার পাশে একটি কুঁজো ছেলে ভিক্ষে করতো। আমরা স্কুলে যাওয়া আসার সময় দেখতাম, সে সুর করে ভিক্ষা চাইতো। একদিন পাশের গ্রামে ফুটবল খেলতে গিয়ে দেখলাম, আসলে ছেলেটি কুঁজো নয়। কিন্তু সে এই ব্যবসা চালিয়ে গেলো। আমি মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে, কলেজ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। বহুদিন আর ছেলেটির সঙ্গে দেখা নেই। হঠাত একদিন দেখি সত্যি সত্যি সে কুঁজো হয়ে গেছে …

আজ প্রায় শেষ বয়সে উপনীত হয়েছি। চাকুরী থেকে অবসরের প্রস্তুতি নিচ্ছি। হাতে সময় জমা হলে বসে বসে অতীত রোমন্থন করি আর ভাবনার সমুদ্রে হাবুডুবু খাই – টেনে বেঁধে রাখলে কেমন করে বাঁশ বাঁকা হয়ে যায়, হাড় অসমানভাবে জোড়া লাগে, অভ্যাসে পিঠ কুঁজো হয়, এমনি আরো কত কি?

আমাদের শিশুরা বড়ই অনুকরণপ্রিয়। তাদেরকে আপনি যা শিখাবেন তাই শিখবে। শিখন অভ্যাসে পরিণত হবে একদিন। আর তারা যখন পুর্ণাংগ মানব/মানবী হয়ে উঠবে তখন আর অভ্যাস বদলানো যাবে না। তাই আমাদের এখনই ভাবতে হবে, আমাদের সন্তানদের আমরা কি শেখাবো; সত্যি না মিথ্যে? অভিনয় না বিনয়? নির্বিচারে বাঁশ ঢোকানো, বাঁশের কেল্লা বানানো, নাকি বাঁশ দিয়ে বাঁশি বানানো?

আমাদের ছেলে মেয়েরা কি শিখছে ? কি অভ্যাস করছে ? ভালো কিছু শিখলে/ অভ্যাস করলে, আলহামদুলিল্লাহ্। কিন্তু আল্লাহ না করুন, নেগেটিভ কোন অভ্যাস গড়ে উঠলে, সেটা পারমানেন্ট কুঁজে পরিণত হবে – এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়: আকাঙ্ক্ষা বনাম বাস্তবতা

images-1

অনেক উচ্চ আকাঙ্খা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চান্স পাবার পর শিক্ষক হবার স্বপ্ন নিয়ে আসা ছেলেটা কোথায় যেন গিয়ে একটু খেই হারিয়ে ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে গিয়ে প্রথম দিকে প্রতিটা ক্লাস সিরিয়াসলি করা ছেলেটাও কোথাও গিয়ে যেন ভাবতে শুরু করে আমার পক্ষে এগুলো সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয় মানে স্বাধীন জায়গা। পুরো ক্যাম্পাসটাই আমার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রোগ্রামে অ্যাটেন্ড করার পর একঘেয়ে লাগতে লাগতে একসময় পুরো ক্যাম্পাসটা নিজের করে নিতে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল জগতে এসে স্বাধীনতার সুখ পেতে নিজের ডানা মেলতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার আগ পর্যন্তও যেই ছেলেটা নিয়মিত লেখাপড়ার কাজে সময় দিতো, সেই ছেলেটা ও কেন যেন একটু এলোমেলো হয়ে পড়ে… বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বন্ধু, সিনিয়র ভাই -আপু এগুলো নিয়ে এক জগৎ গড়ে ওঠে। জগতটাতে নেই কোনো বাঁধা। দেখবার, বলবার মত কেউ নেই। সারাজীবনে একটা সিগারেটে টান না দেওয়া ছেলেটাও এখানে এসে হয়ে যায় চেইন স্মোকার!

মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রতিটি মানুষই চায় নিজেকে সুপিরিয়র পজিশনে নিয়ে আসতে; যখন সে অনুভব করতে থাকে পলিটিক্যাল পার্টির দিকে গেলে অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকা যায়, ক্ষমতা দেখানো যায়, তখন সে নিজেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনে যুক্ত হয়ে যায়। দেশপ্রেমের জায়গা থেকে রাজনীতি সেটি কিন্তু নয়। স্রেফ ক্যাম্পাসে নিজের অাধিপত্য বিস্তার, নিজের বন্ধুদের ওপর ফাঁপরবাজির জন্য!

আবার আস্তে আস্তে পরিচিত হতে থাকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইদের সাথে যারা ঠিক একই পন্থায় জীবনের অর্ধেক অংশ হারিয়ে ফেলেছে কোন গন্তব্য ছাড়াই। চলতে থাকে আড্ডা,তাস ঘোরাঘুরি। পড়া বলে কিছু একটা জিনিস ছিলো সেটি মনে পড়ে পরীক্ষার আগের রাতে! কিছু ছেলে নিজেকে শাহরুখ খান, সালমান খান ভাবা শুরু করে… ঠিক এভাবেই কাটতে থাকে বছর… বছর পেরোলে তার জুনিয়র আসে জুনিয়রকে নিয়েও একই পথের দিকে এগুতে থাকে।

মুদ্রায় ওপিঠটাতেও ঘটে আরো অনেক কিছু। কোনরকমে ভর্তি পরীক্ষাতে পাশ করা ছেলেটাও ভালো করতে থাকে। অনেকক্ষেত্রে নিজ ধর্মের প্রতি অনেক বেশী মনোযোগী হয়ে যায়। নিজের পরিবারের দিকে তাকিয়ে দু তিনটে টিউশনি করিয়ে নিজের জীবনের লক্ষ্যের দিকে এগুতে থাকে। জীবন সংগ্রাম তো এদেরই।

আস্তে আস্তে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে কাজ করতে করতে কাজের এক্সপেরিয়েন্সটা অর্জন করে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হিসেবে নিজের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কাজ করে দেশ, সমাজের জন্য। জীবনে বিতর্ক না করা ছেলেটি, জীবনে কোনদিন বক্তৃতা না দেওয়া ছেলেটিও নিজের জীবন গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সকল কিছু অর্জন করে নেয় এই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে!

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা বড়ই অদ্ভুত। কেউ সেই জীবনটাকেই কাজে লাগিয়ে নিজের জীবন বদলে ফেলে। আবার কেউ কেউ আবার তার জীবনটাকে গলা টিপে হত্যা করে ফেলে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রাজনীতি চর্চা হওয়া চাই সুস্থ রাজনীতির চর্চা। নিজের দেশপ্রেমের জায়গা থেকে দেশকে ভালোবাসার জায়গা থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা আনাচে-কানাচেতে যে জ্ঞান ছড়ানো থাকে তা অন্বেষণ হওয়া উচিৎ একজন ভার্সিটির পড়ুয়া স্টুডেন্টের কাজ। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ি তাদের একটা বড় অংশই থাকি আমরা মধ্যবিত্তরা। যাদের পরিবার তাকিয়ে থাকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সন্তানটির ওপর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষে আপনি কোথায় যাবেন সেটা নির্ভর করছে আপনার ওপর।কথায় বলে না, ছুরি দিয়ে ফল কেটেও খাওয়া যায় আবার মানুষ হত্যাও করা যায়!

প্রতিবেশী কি শুধুই মুসলিম ধর্মাবলম্বী?

Scre

বিভেদ নয়, ইসলাম সম্প্রীতি ধারণ করে। এই সম্প্রীতির চমৎকার প্রমাণ প্রতিবেশীর হক আদায়ের নির্দেশনা। ইসলামে প্রতিবেশী বলতে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলকে বুঝায়। উল্লেখ্য, মুসলিম ও আত্মীয় প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর হক আদায়ের পাশাপাশি মুসলমানের প্রতি মুসলমানের আর আত্মীয়ের প্রতি আত্মীয়ের হকও আদায় করতে হবে। কিন্তু প্রতিবেশীর হকে ভিন্নধর্মাবলম্বী এবং অবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রেও পালন করতে হবে।

‘ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে।’ মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ২৬৯৯; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১১২)। প্রতিবেশী যে ধর্মেরই হোক, সে কষ্টে থাকলে তুলনামূলক স্বচ্ছল প্রতিবেশীদের কষ্ট লাঘবের দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রতিবেশীর পরিধি কতটুকু এ বিষয়েও ধারণা দেওয়া হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের ডানে-বামে, সামনে-পেছনে চল্লিশটি বাড়ি পর্যন্ত প্রতিবেশীর আওতার অন্তর্ভুক্ত। (বোখারি: /২৯০১)

প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা অভাবে আছে তাদের সম্পর্কে আমাদের জানা থাকে। তবে এমনও অনেকে আছে যারা তাদের দুরবস্থা বাইরে প্রকাশ করেনা, সঙ্কোচে কারো কাছে সহায়তাও চায় না। পবিত্র কুরআনে এদেরকে ‘মাহরূম’ অর্থাৎ বঞ্চিত হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে, “এবং তাদের সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও মাহরূমের (বঞ্চিতের) হক।” (সূরা যারিয়াত : ১৯) মাহরুম তথা বঞ্চিতদের কাছে এমন পন্থায় সহায়তা (যাকাত, দান) পৌঁছতে হবে যেনো তারা অপমানিত বোধ না করেন।

মসজিদে দান করুন, মাদ্রাসায় দান করুন কিন্তু এর আগে নিশ্চিত হোন প্রতিবেশীর হক আদায় করা হয়েছে কি না। সুরম্য মসজিদে দান করে এসির হাওয়ায় নামাজ আদায় করছেন, মাদ্রাসায় দান করেছেন আর ওই মাদ্রাসায় আপনার জন্য দোয়া হচ্ছে কিন্তু প্রতিবেশীর হক আদায় করা হয়নি- এটি সাধারণ বিবেচনাতেই নীতিগত অপরাধ, আর মুসলিম হিসেবে ধর্মের বিধিবিধানের অবমাননা। আমরা যেনো মনে রাখি কোরআন মজীদের একাধিক সুরায় সালাত আদায় না করার সাথে প্রতিবেশীর হক আদায় না করাকে যুক্ত করে শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে, আরও মনে রাখি যে, হযরত মুহম্মদ (সা:) বলেছেন, আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!!! সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, সে কে হে আল্লাহর রাসূল? রাসূ্লুল্লাহ (সা.) বললেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১৬)।

একই সাথে মনে রাখি প্রতিবেশীর হক আদায়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা অবিশ্বাসী প্রতিবেশীরাও সমানভাবে গণ্য হবেন। বাড়ির পাশের প্রথম বাড়িটি যদি হয় একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা নাস্তিকের আর সে যদি থাকে প্রচণ্ড ক্ষুধায় বা অভাবে তবে প্রতিবেশীর হক আদায়ের ক্ষেত্রে সেই অগ্রাধিকার পাবে।

ইসলামে সামাজিক সম্প্রীতিকে গভীর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, অথচ বর্তমানে সম্প্রীতির পরিবর্তে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। এক শ্রেণির আলেম (আল্লাহ তাদের হেদায়েত দান করুন) শুধু যে বিদ্বেষই ছড়ান তা নয়, তারা ওয়াজে বা আলোচনায় বসে নির্ধারণ করে দেন কে বেহশতে যাবে, কে দোজখে, কে মুমিন আর কে কাফের। ইসলামের মূল আদর্শের সাথে এদের যোজন যোজন দূরত্ব।

সামাজিক সম্প্রীতি বজায় থাক, রমজান থেকেই শুরু হোক সম্প্রীতি পালনের চর্চা।

ভাস্কর্য বনাম জ্বী হুজুর

15801820425292_S-1

দেশের সবচেয়ে আলোচিত টপিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি বা ভাস্কর্য।
এমনিতেও দেশের যেকোন ইস্যু ঘষামাজার ফলে ঘটনার চেয়ে কথা বেশ বড় হয়ে যায়…
ঠিক তেমনি ভাস্কর্য ইস্যু একশ্রেণীর মানুষের কাছে নাপাক-নাপাক হয়ে তা দ্রোহের মতো যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব তাদের আচরণে!
কিন্তু কেন?
কারণ, ভাস্কর্য তৈরী শির্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আপনি যদি চিন্তা করে দেখেন পৃথিবীতে কিভাবে শির্কের সূচনা হয় তবে দেখবেন,
এর একমাত্র কারণ হলো নেককার লোকদের নিয়ে বাড়াবাড়ি-
তাদের যা মর্যাদা তার চাইতে বেশী তাদের সম্মান করা।

শুধু কি মূর্তি বা ভাস্কর্যই শির্ক আর কিছু নেই?

আছে, কবর ও মাজারের মাধ্যমে।
কবর পূজারীদের কেউ কেউ বলতে পারে,
তোমরা আমাদের উপর বেশী বাড়াবাড়ি করছ।
আমরা তো কোন মৃতের ইবাদত করিনা,
ভাস্কর্যকে সম্মান দেখাই না-
কবরে এ সমস্ত ওলী-আউলিয়া নেককার লোক।
আল্লাহর কাছে তাদের সম্মান রয়েছে, তারা আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে পারেন!
জবাবে আমরা বলব, এটাই ছিল কুরাইশ কাফেরদের কথা তাদের মূর্তি সম্পর্কে।
পাথর পূজা আর কবর পূজার মধ্যে কি পার্থক্য আছে?
কি পার্থক্য আছে সেই ব্যাক্তির মাঝে,
যে মূর্তির কাছে নিজ প্রয়োজনের কথা বলে আর যে গলিত মাঠি মিশ্রিত হাড্ডির কাছে যায়!
কোনই পার্থক্য নেই।

”আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা এমন বস্তুর উপাসনা করে যা তাদের কোন লাভ বা ক্ষতি করতে পারে না এবং বলে এরা আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী।
তুমি বল, তোমরা কি আল্লাহর এমন বিষয়ে অবহিত করছ;
যে সম্পর্কে তিনি অবহিত নন আসমান ও যমীনের মাঝে?
তিনি পুত:পবিত্র ও মহান সে সমস্ত থেকে যাকে তোমরা শরীক করছো।”
(সূরা ইউনুস [১০]:১৮)

অতএব, শুধু ভাস্কর্য নয় একজন মুসলিম হিসেবে উচিৎ কবর বা মাজারের বিরোধিতা করা।

এখন আসা যাক বর্তমান সময়ের মূর্তি বিরোধী আলেমসমাজদের ব্যাপারে।
আলেমদের কাজ প্রথমে নিজের ধর্মের যাবতীয় অনাচার থেকে ধর্মকে সঠিক পর্যায়ে নিয়ে এসে তা অনুসারীদের কাছে সঠিক পথে পৌঁছে দেওয়া-
দেশে সেই শাহ জালাল (রহঃ) মৃত্যুর পর থেকে যে পরিমাণ শির্কের কারখানা মাজার প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা কি তারা চোখে দেখেনি?
তারা দেখেনি যে আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এর পবিত্র নামের বিকৃত জিকির করে তালে তালে ছন্দে নারী-পুরুষের অবাধ যৌন উন্মুক্ত গাঁজা খোরের নাচন!!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য হচ্ছে সম্প্রতি সময়ে,
আশার কথা হলো-
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের সামনে কেউ পূজা দেয়নি সন্তানের জন্য উনার ভাস্কর্যের নিচে গড়াগড়িও খায়নি এমনকী সন্তান লাভের প্রলোভনে কেউ খাদেম বা পীর দ্বারা ধর্ষণ হওয়ার সুযোগ নেই।
কিন্তু ইসলামের নাম ভাঁঙিয়ে দরগাহ মাজারে বড়বড় ওয়াজ ও জিকিরের আয়োজন করা শির্কবাদীদের দ্বারা ধর্মের চরম ক্ষতি হচ্ছে –
সে বিষয়ে ভাস্কর্য বিরোধী আলেমসমাজ চুপচাপ-খামোশ।
ওসব ধর্মের কথা বলে তাই না!

ফাজলামির একটা সীমা থাকা উচিৎ-
নিজের ধর্মের ভিতর শির্কের কারখানা খোলা রেখে একজন মহান নেতার তর্জনী উঁচু হাতের ভাস্কর্যের বিরোধীতা কতটা যৌক্তিক?
ভাস্কর্য বিরোধীতার ফতোয়া দেওয়ার আগে ফতোয়া দিন মাজার নামক ভন্ডদের বিরুদ্ধে।
ভাঙতে হলে প্রথমে ভাঙুন মাজার গুলো,
বুল্ডুজার চালিয়ে গুড়িয়ে দিন প্রতারক ধোঁকাবাজ বাটপার গুলোর বেহায়াপনার আর্থিক উপার্জনের আস্তানা।

কিন্তু তা না করে আপনার হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নিচে!
একটা গনতান্ত্রিক দেশে কে আপনাদের ধর্মীয় নীতিমালা প্রয়োগ করতে প্রমোট করলো?

“ভোট”এর ব্যাথা

ও ভাই আমার সরকার!
মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছাড়া কি কোন নেই কর্ম আর?
কোন সালে সেই খুলেছ বদন তোমা অতি কাল হলো,
কত গড়েছ মৃত্যু মিছিল, আজ ভোল গো মোহ ভোল!
কর্কশ শব্দে ভরেছ দেশ, যেন মম মালিক গেছে ঘুমে।
হাজার হস্ত ছেড়েছে মম, বিদায় নিছে মাতৃভূমি চুমে!
দেখ গো হেথায়, ভোটার হাঁপাই, অশান্তি মাগিছে ছুটি!
দেশে ধ্বংসের গন্ধ, কর গো বন্ধ, মোহের লোটা লুটি!

মনে নাহি পড়ে, মালিকের গড়ে,কি ছিলাম আমি ভোরে?
তুমি বুঝালে সুঝালে সিধে বাঁকা গোল লম্বা চৌকা করে!
কভু হিংসা বিদ্বেষ, কভু সম্প্রীতি শেষ, কভু বা নম নম,
কভু মিথ্যে ফুঁৎকার-এ জড়িয়ে দিলে অসচ্ছ দাপ মম।
গঞ্জে গঞ্জে, অতি রঞ্জে, উড়িয়ে পুড়িয়ে মিটালে মম সাধ।
মোহের টানে, সম্প্রীতির প্রাণে, আজ জন্মে দিলে তুমি উন্মাদ!
আমার মালিক যারা, হয়ে পাগলপারা, অহর্নিশে তারা,
মোহের ঢিপে, দিলে গলা টিপে করে তাদের আত্মহারা!

গলির কোণে, মালিকের মনে,তুমি ধরিয়ে চুলা চুলি,
ঘন ঘন ঘন, পরিবর্তনে তোমার মোহের ফুঁৎকার তুলি।
তোমার মিথ্যা ফুঁৎকারে জনের কর্ণব্যাধিতে আমি নিরুপায়!
সেই হেতু গড়ে সেতু পড়েছি তোমার গর্দানে আমি ভাই।
যা হওয়ার ন্যায় হোক না, প্রবল করিয়াছি প্রতি বাদ;
আমায় ন্যায্য মূল্যে গড়িলে ভরিয়া যাবে কত মন স্বাদ।
তোমার ওই মরা দেহেতে আজ যারা ঢেলে দিলো প্রাণ,
তাদের হারায় গেল সবকিছু, অসহায়, নেই কোন ত্রাণ!

মালিকদের অন্তঃ অন্তঃ সুঘ্রাণ দিয়ে আমি, বেঁকে বসি যদি!
দেখো কি হবে তোমার তাঁবেদারি? কোথায় রবে
তোমার গদি?
তোমার যারা শ্বাসপ্রশ্বাস, তোমার ঘরের আলোক বাতি,
তারা আজ অজানা অচেনা, তাদের পেটে প্রতি দানে লাথি!
আমার কিছু মালিক আছে তাদের জন্ম যেন কুকুরের কাছে!
না বুঝে চাতুরী, তোমার বিষ্ঠার কোন সে স্বাদে ঘুরে পাছে
পাছে?

ও ভাই আমার সরকার!
রাখিবো কাহাকে সাক্ষী? কাহার কাছে করিবো বিচার?
তুমি শয়তান দেখেও কেন দেখোনা অমৃত সব কূল?
আমি যে অমর,আমার মালিকের দ্বারা আমিই তোমার মূল!
কত শত মস্তক আর হস্তে পদে তোমায় গড়ে দিয়েছি মতি।
তুমি ছিলে কোন অচেনা আবাল, আজ তোমায় দিয়ে জ্যোতি!
তুমি না থাকিলে মোর মালিকদের কিবা হতো তাতে ক্ষতি?
কৃতজ্ঞতা কি এই পাঠাইছো হিংসা বিদ্বেষ দাঙ্গা লড়াই আর অশান্তির মারফতি?

দেশ ও দশকে তুমি, ধ্বংসের ভেলা চুমি, করিয়ে দিলে ছারখার!
মরণের পরে হায়! হবে কি উপায়? পাইবে কি তারা মম ন্যায্য অধিকার?

কন্যা সন্তান মাথার বোঝা নয়– স্বর্গের লক্ষ্মীদেবী

অনেক সময় খবরের কাগজে, আর ফেসবুক থেকে জানা যায়, কন্যা সন্তান নাকি অনেকেরই মাথার বোঝা। আবার সময় সময় শোনাও যায়। মাঝে-মাঝে স্বচক্ষে দেখাও যায় কন্যা সন্তান জন্মদানে সদ্যজাত শিশুটি মায়ের উপর কত-না অত্যাচার নেমে আসে নির্বিচারে! আবার অনেকেই বিয়ে-শাদি করার পর স্ত্রীর গর্ভে থাকা প্রথম সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে, তা নিয়েও ভাবতে থাকে; মাসের পর মাস! যাঁদের বর্তমান যুগের আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করানোর মতো সাধ্য থাকে, তাঁরা সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার আগেই জেনে নেয় ছেলে না-কি মেয়ে হবে।

আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করার পর তাঁদের ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়। আর যাদের আর্থিক দুরাবস্থা তারা মনের ভেতরে ছেলে নাকি মেয়ে, মেয়ে নাকি ছেলে জপতেই থাকে। আবার কারোর সহজ-সরল স্ত্রী পরপর দুটি মেয়ে সন্তান জন্ম দিলেই শ্বশুরালয় থেকে শুনতে হয় অনেক কটুবাক্য। আবার অনেক মেয়েদের উপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। কোনো-কোনো মেয়ে পরপর দু-তিন বার কন্যা সন্তান জন্ম দিলে স্বামী কর্তৃক, শ্বাশুড়ি কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়ে স্বামীর সংসার ছেড়ে পিত্রালয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। অনেক মেয়েরা মিথ্যে অপবাদ শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে নিজের জীবনের উপরও কষাঘাত শুরু করে স্বেচ্ছায়। অনেক মেয়েরা আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়, স্বামীর কটুকথায়।

আসলে যে সবকিছুর মালিক মহান সৃষ্টিকর্তা, তা সুস্থ মস্তিষ্কে একবার ভেবেও দেখে না, আমার মতন এমন অনেক বোকারাম পুরুষেরা। অনেক পুরুষ মানুষই সন্তান জন্মদানের সব দায়দায়িত্ব বিয়ে করা সহজ-সরল একটা মেয়ের উপরই বাতলে দেয়। তারা মনে করে সন্তান জন্মদানে স্ত্রী বা বিবাহিত নারীর ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। আসলে কিন্তু তা নয়! সন্তান দেওয়া না দেওয়া একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তার দয়ার উপরই নির্ভর করে বলে আমি মনে করি। তিনি মহান সৃষ্টিকর্তা কাউকে পরপর ৬ থেকে ৭ টি ছেলে সন্তানও দিয়ে থাকে।

যার ৬ থেকে ৭ টি ছেলে, সেই ব্যক্তি একটা কন্যা সন্তানের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে কত-না প্রার্থনা করে। কিন্তু না, মহান সৃষ্টিকর্তা যাকে যা দেবার তা-ই দিয়ে থাকে। আবার যাদের ঘরে পরপর ৬ থেকে ৭ টি মেয়ে থাকে, তারা একটা ছেলের জন্য কতরকমের চেষ্টাই না করে থাকে। কতো মাজারে মন্দিরে গিয়ে মানত করে। কিন্তু না, তাতেও কাজ হয় না। যার ভাগ্যে যা আছে, আর মহান স্রষ্টা যাকে যা দেওয়ার দরকার মনে করে তা-ই হয়ে থাকে। একসময় আমি নিজেও কন্যা সন্তান হওয়াতে অঝোরে কেঁদেছিলাম। তবে আমার স্ত্রী কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ায় তাকে একটা কটুবাক্যও উচ্চারণ করিনি। কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর আমি শুধু কেঁদেছিলাম নিজে একজন সহায়সম্বলহীন হওয়াতে।

আমি বিয়ে করেছিলাম ১৯৮৬ সালে। বাংলাবর্ষে পহেলা আষাঢ়। বিয়ে করেছিলাম একজন খেঁটে খাওয়া গরিবের মেয়েকে। তা-ও আবার গরিবের মেয়েটিকে নিজের পছন্দমতো জেনেশুনেই জীবনসঙ্গিনী করেছিলাম। ১৯৮৯ সালে আমাদের সংসারের এক নতুন অতিথির আগমণ ঘটে। তখন আমার মা জীবিত ছিলেন। কথায় আছে, “মায়ে রাখে মেয়ের খবর। বাবা রাখে ছেলের খবর!” যখন আমার সহধর্মিণীর প্রসবব্যথা উঠে, তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আমি ছিলাম আমার কাজে। আমার সহধর্মিণীর প্রসবব্যথার অবস্থা টের পেয়ে আমার মা তাড়াতাড়ি বাড়িওয়ালার স্ত্রীর কাছ থেকে ১০০/= টাকা ধার করে পুত্রবধূকে নিয়ে চলে গেলেন নারায়ণগঞ্জ পুরাতন ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে। অথচ আমি জানি না। আমি প্রতিদিনের মতো রাত ৮টায় ডিউটি শেষ করে সমবয়সী বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রাত ১১টায় বাসায় ফিরি। বাসায় গিয়ে শুনি, মা আমার সহধর্মিণীকে নিয়ে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে গেছে।

ওমনি আর দেরি না করে আমি দৌড়ে গেলাম, আমার মালিকের কাছে। উনাকে বলে-কয়ে কিছু টাকা নিয়ে চলে গেলাম ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে। গিয়ে দেখি মা আমার জন্য অপেক্ষা করে হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছে। মাকে বসা দেখেই দৌড়ে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা তুমি এখানে এভাবে বসে আছো কেনো?’ মা বললো, ‘তোর অপেক্ষায় বসে আছি বাবা। আয় ভেতরে আয়।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বউমা কোথায়?’ মা বললো, ‘ভেতরেই আছে। তোর মেয়ে হয়েছে বাবা।’

মায়ের মুখে মেয়ে হবার কথা শুনেই আমি কাঁদতে লাগলাম। আমার চোখে জল দেখে মা জিজ্ঞেস করলো, ‘ওরে অভাগা, তুই কাঁদিস কেন? এতো খুশির খবর! তোর তো হাসার কথা। তুই না হেসে কাঁদছিস?’ বললাম, ‘মা আমি কাঁদছি আগামী দিনের চিন্তা করে, মা। মেয়ে যখন বিয়ের উপযুক্ত হবে, আমি অধম মেয়ে বিয়ে দিবো কী করে, মা?’ মা বললো, ‘আরে অভাগা, তুই সেই চিন্তা করিস নে। যার চিন্তা সে-ই করবে। চল, ভেতরে চল। সন্তানের মুখ দেখে ভগবানকে ধন্যবাদ জানিয়ে মেয়ের দীর্ঘায়ু প্রার্থনা কর।’ এই বলেই মা আমার হাতে ধরে টেনে হাসপাতালে শুয়ে থাকা আমার সহধর্মিণীর কাছে নিয়ে গেলো। গিয়ে দেখি, আমার সহধর্মিণীর পাশে আমার সদ্যোজাত কন্যা সন্তানটি শুয়ে আছে। কিন্তু আমি তখনও কাঁদছিলাম।

মা আমার সদ্যোজাত মেয়েটিকে কোলে নিয়ে আমার সামনে এনে বললো, ‘নে কোলে নে! ওকে আশীর্বাদ কর।’ আমি আমার সদ্যোজাত কন্যা সন্তানটিকে কোলে নিয়ে মনে মনে মহান সৃষ্টিকর্তাকে বললাম, ‘হে প্রভু, তুমিই দিয়েছো, তুমিই একটা বিহিত করে দিও। আমি দয়াল অধম। মেয়ে বিয়ে দেবার মতো আমার কোনও সাধ্য নেই। যা করার তুমিই করবে, প্রভু।’ এই বলেই মেয়ের দু’গালে দুটো চুমু দিয়ে আবার আমার মায়ের কোলে দিয়ে দিলাম।

পরদিন সকালবেলা হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিলো। হাসপাতালের বিল হলো ২০০/= টাকা। আমার সাথে আছে মাত্র তিনশো টাকা। এই তিনশো টাকা থেকে দুইশো টাকা হাসপাতালের বিল পরিশোধ করলাম। কিন্তু নার্স ও ডাক্তারদের বকসিস দেওয়া বাদ ছিলো! তাঁরা কিছু বকসিস চাইলে তাঁদের দিয়ে দিলাম একশো টাকা। তখন আমি হয়ে গেলাম খালি! মানে পকেট শূন্য! তারপর মা’র কাছে যে কয় টাকা ছিলো, তা দিয়ে কোনরকম বাসায় ফিরে গেলাম।

মেয়ে আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো। আমার মা একসময় না ফেরার দেশে স্বর্গীয় হলো। এরপর ১৯৯১ সালে আরও এক ছেলে আমাদের সংসারের আসলো। মেয়ে এসএসসি পাস করলো। ছেলেও নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলো। আমি তখন পাবনা সিরাজগঞ্জ বেলকুচি। ফরিদপুর থেকে মেয়েকে দেখতে এলো। আমার কাছে খবর পৌঁছতেই আমি দ্রুত নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি। ছেলে পক্ষের কোনও দাবিদাওয়া ছিলো না। ছেলে পক্ষের কথা, যেভাবে পারি সেভাবেই মেয়েকে উঠিয়ে দিতে পারলেই হলো। তারপরও তো কিছু-না-কিছু লাগেই। হিন্দু বিয়ে বলে কথা। কিন্তু তখন আমার কাছে কানাকড়িও ছিলো না। সম্বলের মধ্যে ছিলো, নিজের সহধর্মিণী খেয়ে-না-খেয়ে মেয়ের জন্য আট আনা স্বর্ণের কানের দুল। সেটাই ছিলো একমাত্র সম্বল।

আমার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলো। আমি তাঁদের শরণাপন্ন হলাম। বিস্তারিত খুলে বললাম। তাঁরা কোনও প্রকার চিন্তা করতে বারণ করলেন। তারপরও কি চিন্তা দূর হয়? চিন্তায় এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকি। একসময় ব্রাক সমিতি থেকে ৪০,০০০/=টাকা কিস্তিতে ওঠালাম। আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা জোগাড় করে দিলো মেয়ের হাতের শাখা বাঁধাই করে। নিজের বড় ভগ্নিপতি দিলো হাতের পলা। ভাগ্নি জামাই দিলো মেয়ের গলার হার। দুই শালা দিলো ছেলের আঙটি। এভাবে মিল-তাল করে বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেললাম। দুইশো লোকের আয়োজনও করলাম।

তখন ছিলো বৃষ্টির মৌসুম। আমরা যেখানে ভাড়া থাকতাম, সেই জায়গাটা হলো একটা সরকারি মিলের শ্রমিকদের পরিত্যক্ত কোয়ার্টার। অনেক বড় জায়গা জুড়ে কোয়ার্টার। জায়গাটি ছিলো নিচু জায়গা। একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো। বিয়ের বাকি এক সপ্তাহ। শুরু হলো বৃষ্টি আর বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টি! তা-ও আবার একাধারে রাতে দিনে চারদিন। পুরো এলাকা হয়ে গেলো বন্যা কবলিত। বিয়ের বাকি তিনদিন। বিয়ের কেনাকাটাও প্রায় শেষপর্যায়ে। ঘরে হাঁটুপানি। তার উপর আবার বিদ্যুতের নিশ্চয়তা ছিলো না। একবার বিদ্যুৎ চলে গেলে, আবার কখন আসবে, তার নিশ্চয়তা ছিলোই না। মানে বিদ্যুৎ যখনই চলে যায়, ফিরে আর আসে না। আসে আবার চলে যায়, এ অবস্থাই চলতে থাকে। আমি আমার মহান সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে লাগলাম, “হে প্রভু তুমি আমার সহায় হও! তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই!” মহান সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই আমার ডাক শুনলেন। আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন।

রাত পোহালেই বিয়ের দিন। বৃষ্টি নেই। এমনকি আকাশে একছিটে কালো মেঘ পর্যন্ত নেই! বিদ্যুৎও আগের মতো আসে– যায় না। মানে লোডশেডিং বলতে নেই! আমার প্রতিবেশী সবাই তখন বলতে লাগলো, “নিতাই বাবু’র মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে মনেহয় জেনারেটর চালু করে রেখেছে! আর মহান সৃষ্টিকর্তা হয়তো নিজেই বৃষ্টি বন্ধ করে রেখেছে।” এসব ধারণা ছিলো আমার আশে-পাশে থাকে পরিবারগুলোর। অথচ ক’দিন আগেও অনেকে বলেছিল, ‘যেভাবে বৃষ্টি আর লোডশেডিং, এভাবে চলতে থাকলে নিতাই বাবুর মেয়ের বিয়ে পিছিয়ে যাবে।’ কিন্তু না, মহান সৃষ্টিকর্তা আমার সহায় ছিলো। তাই মহান সৃষ্টিকর্তা বিয়ের আগের দিন থেকেই আমার মেয়ের বিয়ের কার্যসম্পাদন হওয়ার জন্য সবকিছু ঠিক করে দিয়েছেন। শুধু বাদ রেখেছিলেন বাজনা। তবে বাজনাও কিন্তু মুহূর্তেই জোগাড় হয়ে গিয়েছিলো।

অনেকেরই জানা আছে যে, আমাদের হিন্দু বিয়ে বাজনা ছাড়া হয়-ই না। কিন্তু আমি কোথাও বাজনাওয়ালা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বাজনার ব্যবস্থা করতে না পেরে একপর্যায়ে বাজনা ছাড়াই মেয়ের বিয়ের কার্যসম্পাদন করার চিন্তাভাবনা করে রেখেছিলাম। হঠাৎ পরিচিত এক লোকের সাথে সাক্ষাৎ! তার কাছে বাজনার ব্যাপারে দুঃখপ্রকাশ করতেই, তিনি তার হাতে থাকা মোবাইলে কল দিয়ে বললেন, ‘আমার এক পরিচিত লোকের মেয়ের বিয়ে। যেভাবে হোক তাড়াতাড়ি চৌধুরীবাড়ি এসে দেখা করো।’ আমাকে বললো, ‘দাদা এখানেই একটু অপেক্ষা করুন, বাজনাওয়ালা আসছে।’ উনার কথামতো সামনে থাকা এক চা-দোকানে গিয়ে দু’জনে বসলাম। চা-পান করতে করতে রিকশায় চড়ে বাজনাওয়ালা আমাদের সামনে এসে হাজির হলেন। বাজনাদারকেও চা-পান করালাম। এরপর বলে-কয়ে ২,৫০০/=টাকায় বাজনা ঠিক করলাম। অধিবাসের দিন বিকালবেলা থেকে তারা আমার বাসায় আসবেন। বিয়ের বাজনা বাজিয়ে পুরো এলাকা সরগরম করে তুলবে।

বিয়ের দিন সকালবেলা বাবুর্চি আসলেন। রান্না-বান্নার কাজ শুরু করলেন। আমি গেলাম পরিচিত এক চা-দোকানে চা-পান করার জন্য। এমন সময় আমার বড়’দা আমার সামনে এসে কাঁদা কাঁদা স্বরে বললো, ‘ধুতরা গোটা (ধুতরা গাছের ফল) জোগাড় করতে পারিনি!’ হায়! হায়! বলে কী! হিন্দু বিয়ের কার্যসম্পাদন করার জন্য ৮টা ধুতরা গোটার প্রয়োজন হয়। এই ধুতরা গোটা কেটে দুভাগ করে ভেতরের বীচিগুলো ফেলে দিয়ে তা দিয়ে সরিষার তেলের প্রদীপ জ্বালানো হয়। তাই ধুতরা গোটা ছাড়া তো পুরোহিতের কাজই হবে না। মোটকথা বিয়ের কাজই অসম্পন্ন থেকে যাবে।

দাদার ব্যর্থতার কথা শুনে আমি তখন মনে মনে ভাবতে লাগলাম! এমন সময় যেই চা’র দোকানে বসে চা-পান করছিলাম, সেই দোকানের মালিকের নাম জহির মিয়া। জহির ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা জহির ভাই, ক’দিন আগেও আপনার বাসার সামনে কয়েকটা ধুতরাগাছ দেখেছিলাম। তা কি আছে?’ জহির ভাই বললো, ‘আরে দাদা, এইতো দুইদিন আগে সব ধুতরাগাছ উপরে ফেলে বাসার সামনেই ফেলে রেখেছি। আপনি একটু কষ্ট করে আমার বাসার সামনে গিয়ে দেখুন, ধুতরা গাছে গোটা আছে কিনা!’ সাথে সাথে বড়দাদা-সহ আমি গেলাম জহির ভাইয়ের বাসায় সামনে। গিয়ে দেখি কয়েকটা ধুতরাগাছ এদিক-সেদিক হয়ে পড়ে আছে। তখন গাছগুলো ওলট-পালট করে দেখি গোটা আছে। তা-ও আবার আকারে একটু বড়সড় গোটা। খুঁজতে লাগলাম! এক-এক করে ৮টা ধুতরা গোটা-ই পেলাম। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, চার-পাঁচটা গাছে মধ্যে কেবল ৮টা গোটা-ই ছিলো। আর একটা গোটাও গাছগুলোতে ছিলো না।

ভাবলাম, মহান সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমার মেয়ের বিয়ের জন্যই এই গোটাগুলো রেখে দিয়ে ছিলো। যা এখন আমি খুঁজে পেলাম। মহান সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে গোটাগুলো সাথে নিয়ে জহির মিয়ার চা-দোকানে এসে বসলাম। জহির ভাই জিজ্ঞেস করলো, ‘পেয়েছেন, দাদা?’ বললাম, ‘হ্যাঁ জহির ভাই, পেয়েছি। তা-ও আবার আমার প্রয়োজন মতোই পেয়েছি।’ জহির ভাই বললো, ‘তা ঠিক বুঝলাম না, দাদা।’ বললাম, ‘আমার মেয়ের বিয়ে কার্যসম্পাদন করার জন্য দরকার ৮টা গোটা। আপনার বাসার সামনে ফেলে রাখা গাছগুলোতে এই ৮টা গোটাই ছিলো। তা যেন মহান সৃষ্টিকর্তা নিজে আমার মেয়ের বিয়ের কার্যসম্পাদনের জন্যই রেখে দিয়েছিলেন। মহান সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

এরপর ধুতরা গাছের গোটাগুলো বাসায় নিয়ে গেলাম। রাতে বরযাত্রী আসলো। আমার ছেলে বোনের বিবাহ অনুষ্ঠানের ভিডিও করে রাখার জন্য ভিডিও ক্যামেরা আনলো। পুরোহিত আসলো। নিমন্ত্রণ দেওয়া লোকের সমাগম ঘটলো। খাওয়া-দাওয়া হলো। তারপর মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় বৃষ্টি, বিদ্যুত ও আরও অন্যান্য ঝায়-ঝামেলা ছাড়াই সুন্দরভাবে আমার মতো গরিবের মেয়ের বিয়ের কার্যসম্পাদন হয়েছিল।

কিন্তু আমি বোকারাম মেয়ে ভূমিষ্ঠ হবার পর অযথা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলাম! নিজের ঘরে আগত লক্ষ্মী দেবীকে নিজের মাথার বোঝা মনে করেছিলাম। মাথার বোঝা মনে করেছিলাম, নিজের কিছুই ছিলো না বলে। চিন্তা ছিলো শুধু একটাই! তাহলে মেয়ে বড়ো হলে বিয়ে দিবো কী করে, আর একেবারে খালি হাতে মেয়েকে পরের হাতে তুলেই বা দিবো কীভাবে! এসব চিন্তাই আমি বেশি চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু তখন একবারও ভাবার সময় আমি পাইনি যে, মহান সৃষ্টিকর্তাই তো সৃষ্টি করেছেন নারী-পুরুষ। যা করার তিনিই তো করবেন। এতে আমার মতন অধমের কী করার সাধ্য আছে? আমার কোনও সাধ্য নেই! ছেলে হোক আর মেয়েই হোক, বিয়ে হবে কি হবে না; সব মহান সৃষ্টিকর্তার হুকুমেই হয়। আমার মতন বোকারামরা শুধু-শুধু ভেবেই মরি। আসলে কন্যা সন্তান কারোর মাথার বোঝা নয়! কন্যা সন্তান স্বর্গ হতে আসা ঘরের লক্ষ্মীদেবী।

অজ্ঞতা নাকি ভন্ডামী

আমাদের ধর্ম পালন দেখে খুবই দুঃখ লাগে। নিজের সুবিধার্থে ইসলামকে আমরা ব্যবহার করছি। যেমন, জ্বিল হজ্জ মাসের প্রথম তারিখ থেকে কোরবানী ঈদ উপলক্ষ্যে অনেকে দাঁড়ি-গোঁফ কাটেনি। আমি তাদের প্রশ্ন করলাম, কেন তারা কাটেনি? উত্তরে আমি বিব্রত হই। এই সময়ে দাঁড়ি-গোঁফ কাটলে আল্লাহ নাকি গোনাহ দিবে। এই কেমন যৌক্তিরে ভাই? হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, এক মুঠো সমপরিমান দাঁড়ি রাখতে, আর যদি দাঁড়িতে ক্ষুর লাগানো হয় তাহলে নবী (সঃ) গলায় ক্ষুর বসানো সমান গোনাহ হবে। অথচ বর্তমানে ধর্ম কে নিজের মত সাজিয়ে যুক্তি দিয়ে নিজেকে মুসলমান দাবী করছে। আপনি আল্লাহর হুকুম পালনে নামাজ পড়ছেন কিন্তু হিন্দু নাপিত দিয়ে দাঁড়ি চাটাই করে উনার বন্ধু নবী করীম (সঃ) কে অপমান করছেন। এইটা কি আপনাদের অজ্ঞতা নাকি আল্লাহর সাথে ভন্ডামীর পরিচয়?

পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের মুসলমান মনে করতো না। কারণ বাঙালিদের আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি বিধর্মীদের সাথে মিল। তাই তারা পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর নির্যাতন চালিয়ে ছিল। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানীরা চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন ধর্ষণ তথা যত অপকর্ম ইসলামে নিষেধ করেছে সে সকল অপকর্মের সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল আর নিজেদের মুসলমান দাবী করে পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর নির্যাতন চালিয়েছিল। বর্তমানেও ঠিক বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ সকল অপকর্ম করবে আর তখনই তাদের মুসলমানিত্ব দেখাবে আপনি যখন যৌক্তিক প্রতিবাদ করবেন। বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রামীন সমাজে নামাজ পড়া মানুষগুলোকে আমরা ভালো মনে করি, কিন্তু অন্তরালে তার কুৎসিত চরিত্রটা আমরা দেখি না। শুধু নামাজ পড়লেই যদি সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করানো যেত তাহলে কোরআন-হাদিসে এতো বিধিনিষেধ নাজিল হতো না। আর মানুষেরও মৃত্যু হতো না।

কিছু লোক আছে যারা নামাজ পড়ে আমি ভালো হয়ে গিয়েছি প্রমাণ করার জন্য। আর কিছু লোক আছে বয়স হয়েছে আর কত! তাই। আল্লাহকে ভয় করে যদি নামাজ পড়তো তবে আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ সকল অপকর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখতো।

আপনি বা আপনারা তো নামাজ পড়েন, তাহলে কয়েকটা জিনিস থেকে আপনারা নিজেদের বিরত রাখতে পারেন কি-না দেখি। যেমন, লোভ-লালসা, হিংসা-পরশ্রীকাতরতা, গীবত-পরনিন্দা, সামাজিক অন্যায় বিচার এবং অন্যের অনিষ্ট সাধন করা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন।

স্যার আপনারা হিরো ছাত্রদের জীবনে স্মরণীয় স্মৃতি বরণীয় আজও

গোপাল স্যার আমার বাবার ক্লাসমেট এবং আমার শিক্ষক। উনি লেমুয়া বাজারের দিন অনেক লোকের সামনে আমাকে গালে চড় মেরে ছিলেন। আমি তখন (নব্বই দশকে) একটা ছাত্র সংগঠনের লেমুয়া ইউনিয়নের পদে ছিলাম। গোপাল স্যারকে এলাকায় অনেকে চিনে না কিছু লোক চিনে মরণ বাবুর ভাই হিসাবে। বাজারে রটে গেল মহীকে হিন্দু এক লোক মারছে। আমি চড় খেয়ে লজ্জায় হতবুদ্ধি হয়ে মুখে হাত দিয়ে দাড়িয়ে রয়েছি। অনেক লোক জমা হয়ে যাওয়ায় স্যারও লজ্জা পেলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে চায়ের দোকানে ভিতরে নিয়ে গেলেন। পরে সবাই জানলো উনি আমার শিক্ষক। স্যার আরেক হিন্দু নিখিল বাবুর শশুরের কাছে বেশ কিছু টাকা পাবেন। এই টাকার জন্য লেমুয়া বাজারে অনেক বৈঠক হয়েছে। যারা বৈঠক করে সব দলের প্রভাবশালী মদখোর আর জুয়াচোর। এক বছরেও সমাধান না হওয়ায় আমি কিছু ছেলে নিয়ে গিয়ে পাওনাদারকে দমক দিয়ে আসি।

সেই পাওনাদার পরের দিনই গোপাল স্যারকে ধরলেন। এবং কি বলেছে আমার আজও জানা হয়নি। তবে স্যার আমাকে টাকা নিয়ে দিতে বলেনি। আমিই নিজে বলেছি সেই লোককে। চায়ের দোকানে আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি। চা খেতে খেতে স্যার বললেন তুই আমার ছাত্র। তোকে দিয়ে টাকা আদায় করলে নিজের বিবেক মরে যাবে। স্কুলে আমি তোকে নিজের ছেলে পরিচয় দিতাম। বাবা হয়ে থাপ্পর মারলাম।

কর্ম জীবনের প্রথমেই এক লোকের মারফতে একটা সোনালী রংয়ের সিটিজেন ঘড়ি পাঠাই গোপাল স্যারের জন্য। কিছুদিন পর লোকটা ঘড়ি ফেরত দিয়ে বলে স্যার মারা গিয়েছেন। যে স্যার ক্লাস সিক্স হতে টেন পর্যন্ত প্রাইভেট পড়িয়ে একটা টাকাও নেন নাই সেই স্যার মরে গেল। কিন্তু ভালো লোক এত তাড়াতাড়ি, কেন মরবে আজও আমি বুঝি না। দুই / এক বার কিছু টাকা দিয়েছি মাত্র উনার ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য। আমার বাবা মরণ বাবুসহ গিয়ে (মরণবাবু ফালিজপুর কাদেরী হাই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক) যখন ম্যামকে টাকা দিতেন তখন নাকি ম্যামের মুখটা একটা স্বর্গ হয়ে যেত। আজ উনার সন্তানেরা বড় হয়েছে। কিন্তু একজন সৎ শিক্ষকের অকালে মরে গেলে পরিবারটা কত অসহায় হয় ভুক্তভোগী বুঝে। স্যার, বাবার যে চিঠি পড়ে আপনার মন খারাপ হয়ে ছিলো সেটা আমার কথার কারণে। আমি অংকে নাম্বার কম পেয়ে বাবাকে বলেছি স্যার পড়ায় না। আপনি কখনো কোন ছাত্রের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেনি। স্বর্গে আপনি ভালো আছেন বলে আমার প্রচণ্ড বিশ্বাস।

আমরা পরীক্ষার ভালো ফল চাই কিন্তু ভালো শিক্ষক চাই না। ঘুস নিয়ে মাস্টার বানাই। শিক্ষকদের নিশ্চিত জীবন চাই না। শিক্ষককে লাথি উষ্ঠা মারি। আরে ভাই আমি নেতা সালিশ করে, নদীর বালু বিক্রি করে, মাদকের দালালি করে, স্কুলের পরিচালক হয়ে টাকা পাই। সেই টাকায় সংসার চালাই। এইটা খেয়ে আমার পোলা কেমন করে জিপিএ পাঁচ পাবে। আমারতো নীতিই নেই আর আমি পোলারে বলি বেটা পড়াশোনা করে ভালো মানুষ হইবি। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান এখন স্কুল কলেজের সভাপতি হয়। এরা এতই প্রভাব দেখায় এদের নজর এড়িয়ে ধুলাও নড়চড় হয় না। পুরা পরিচালনা কমিটি রাজনৈতিক লোক দিয়ে করার কারণে শিক্ষকগণ জ্বী জ্বী করে উনাদেরকে (এইসব পরিচালক একই শিক্ষালয়ের ও শিক্ষকের সাবেক ছাত্র)। অবাধ্য হলে নেমে আসে অপমান অপবাদ। যার কারণে গ্রামের স্কুলে পাশের হার অত্যন্ত খারাপ। জেলা শহরে কয়েকটা স্কুল কলেজে লেখাপড়ার মান খুবই ভালো। যেমন ফেনীতে সরকারি পাইলট হাই স্কুল, সরকারি গার্লস হাই স্কুল, ফেনী ক্যাডেট স্কুল এবং কলেজ ও শাহীন একাডেমি (জামাত পরিচালিত)।

মীর স্যার আপনি মেধা সততা দিয়ে স্কুলকে আকাশের চাঁদ বানিয়ে ছিলেন। আশি নব্বই দশকে ( আমাদের সময় ) করৈয়া হাই স্কুল ফেনী জেলায় পাশের হারে শহরের স্কুলকে পিছনে ফেলে দিতো আর আজ সেই স্কুল মৃতপ্রায় হাতি। দশম শ্রেনীতে উঠে রাস্তার ঐপারের একটা হলুদ পাখি (মেয়েটা কোথায় আছে কেমন আছে জানি না ) ধরতে গিয়ে আপনার হাতে মার খেয়ে জ্বর হয়ে ছিল। ভয়ে বলি নাই আপনি মেরেছেন। প্রধান শিক্ষক হিসাবে আপনার ব্যক্তিত্ব সুনাম করৈয়ার মাটি বয়ে বেড়াবে পৃথিবীর শেষ অবধি।

ছবিঃ ফেসবুকের স্কুল গ্রুপ হতে নেওয়া। (মীর স্যার সাবেক প্রধান শিক্ষক)।

হিন্দুদের বিয়ের নিয়ম ও সাত পাক ঘোরার মাহাত্ম্য

আমি বিবাহ করেছি, ১ আষাঢ় ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি, মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদি খাঁন থানাধীন তালতলার দক্ষিণে এবং সুবচনী বাজারের পশ্চিমে নয়াবাড়ি গ্রামের এক গরিব পরিবারের মেয়ের সাথে। বিবাহ করেছি নিজের ইচ্ছেতে। প্রথমে বছর দুয়েক প্রেম প্রেম খেলা। তারপর মা এবং বড়দা’র সম্মতি ক্রমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে। বিয়ে করেছি বর্তমানে ৩৪ বছর গত হতে চললো। কিন্তু বর্তমান করোনা দুঃসময়ের কারণে এবার নিজের বিবাহবার্ষিকীর কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। নিজের মন থেকে ভুলে গেলেও মনে করিয়ে দেওয়ার জীবনসঙ্গী এখনো সাথে আছে বলেই, তিনি গত ক’দিন আগে আমাদের বিবাহবার্ষিকীর কথা মনে করিয়ে দিয়ে বললো, “পহেলা আষাঢ় কিন্তু আমাদের বিবাহবার্ষিকী।”

জীবনসঙ্গী বা সহধর্মিণীর মুখে বিবাহবার্ষিকীর কথা শুনে মনে মনে ভাবলাম যে, আমাদের হিন্দুদের বিবাহের বা বিয়ের নিয়মকানুনগুলো যদি শব্দনীড় ব্লগে লিখে সবার মাঝে শেয়ার করা যায়, তাহলে মনে হয়ে ভালোই হয়! সেই ভাবনা থেকেই আমার আজকের লেখার শিরোনাম দিলাম, “হিন্দু বিয়ের নিয়ম ও সাত পাক ঘোরার মাহাত্ম্য”। এই সাত পাক ঘোরে হিন্দু ভাই-বোনদের সবারই বিয়ে হয় ঠিকই, কিন্তু অনেকেই জানেন না এর কী মাহাত্ম্য। তাই আজ আমার লেখার শিরোনামের শেষের শব্দটাই হলো ‘মাহাত্ম্য’।

আমরা অনেকেই জানি যে, হিন্দু ধর্মের এক ছেলের সাথে এক মেয়ের বিবাহ বা বিয়ে হয়ে গেলে তা ভাঙ্গার বা অস্বীকার করার মতো ক্ষমতা কারোরই নেই। আর কেউ অস্বীকার করেও না। অনেকেই বলে, হিন্দু বিয়ে সাত পাকে বাঁধা বলেই কেউ অস্বীকার করতে পারে না; আবার কেউ অতি সহজেও বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না।

হিন্দুদের বিয়েতে শুধু সাত পাকে বাঁধা এটাই শুধু নিয়ম নয়, হিন্দুদের বিয়ের আগে পরে এমন আরও অনেক কঠিন কঠিন নিয়ম বাঁধা রয়েছে। যার কারণে খুব সহজে কেউ বিবাহ বা বিয়েকে অস্বীকার করতে পারে না। সংসার জীবনে যত দুঃখ আর যত ঝামেলাই আসুক-না-কেন, কোনমতেই ঝটপট আরেকটা বিয়ে করতে পারে না। এ হলো হিন্দু ধর্মের ছেলেদের বেলায়। আর মেয়েদের বেলায় তো আরও কঠিন নিয়মকানুনে বাঁধা থাকে। তাহলে জেনে নিন আমাদের হিন্দুদের বিবাহ বা বিয়ের আগে পরের এবং বিয়ের দিন সাত পাক ঘোরার মাহাত্ম্য কী?

এমনও তো হতে পারে যে, আর ক’দিন পরই আমাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনও-না-কোনও ভাই-বোনের শুভ বিবাহের দিন ধার্য্য করা রয়েছে। তাহলে আগে থাকতেই তো এবিষয়ে জেনে নেওয়া ভালো। কারণ, একথা স্বীকার করতে পারবেন না যে, হিন্দু বিয়ের কঠিন সব মন্ত্রের মানে আমরা অনেকেই জানি। যাঁদের জানা নেই, তাঁদের জন্যই আমার বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে আজকের এই লেখা।

বিবাহ কথাটর প্রকৃত অর্থ হলো পরিণয়। আবার পরিণয় কথার অর্থ হলো বিবাহ। মানে দুটি মনের চিরবন্ধন। তাও সাত জন্মের জন্য বাঁধ। হিন্দু বিবাহে শুধু দুটি শরীরই এক নয়, এক হয় দু-দুটো পরিবার। আবার বিয়ের সময় চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, বাতাস, জল, ফল, ধান, দূর্বা, লতা, পাতা, ফুল, চন্দনকে সাক্ষী রেখে স্বামী স্ত্রী সাত পাক ঘুরে যেই সাতটি প্রতিজ্ঞা করেন, তা তাদের দুজনকে সাত জন্মের জন্য এক করে দেয়া। বিবাহের দিন পুরোহিতের মন্ত্র দ্বারা হাতের উপর হাত রাখা, মালাবদল, অগ্নিতে খই পোড়ানো, সিঁদুরদান-সহ নানাবিধ নিয়ম পালন করার পর একটি বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন হয়।

আগেই বলে রাখা ভালো যে, হিন্দু ধর্মে থাকা বিভিন্ন জাত গোত্র ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্নরকম নিয়মে ভারত-সহ বাংলাদেশি বাঙালি হিন্দুদের বিয়ের নিয়মগুলোতে অনেকরকম অমিল দেখা যেতে পারে। তবে যে যেই নিয়মেই বিয়ের কার্যসম্পাদন করুক-না-কেন, প্রতিটি বিয়েতেই সাত পাক ঘোরার নিয়ম রয়েছে। এই সাত পাক ঘোরার নিয়ম কোনও জাত গোত্র বা কোনও সম্প্রদায় বাদ দিতে পারে না। ছেলে/মেয়েকে বা বর কনে একসাথে সাত পাক ঘুরতেই হবে।

আমি বাঙালি। তাই আমার দেশের হিন্দুদের বিয়ের নিয়মগুলো নিয়ে আলোচনা করছি। আমাদের দেশে যেকোনো হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলে/মেয়ের বিয়ে ঠিক হলে ছেলের বাড়ির নিয়ম মেনেই বিবাহ বা বিয়ের কার্যসম্পাদন শেষ হয়ে থাকে। এই নিয়মেই বেশিরভাগ হিন্দুদের বিবাহ বা বিয়ে হয়ে থাকে। তবে আমার বিবাহ বা বিয়ের কার্যসম্পাদন হয়েছে মেয়ের বাবার বিড়িতে। এর কারণ হলো, আমি তখন নারায়ণগঞ্জ শহরের নন্দিপাড়ায় মাকে নিয়ে ছোট একটা বাসা ভাড়া করে থাকতাম। ওই বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান করার তেমন কোনও জায়গা ছিল না, তাই। এবার জেনে নিন হিন্দুদের বিয়ের নিয়মগুলো।

১। পাকা দেখা বা পাটিপত্র ও আশীর্বাদ:
পাকা দেখা বা পাটিপত্র হলো, বিয়েতে ছেলে পক্ষ এবং মেয়ে পক্ষের কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা এবং আরও বেশ কয়েকজন মুরুব্বি সাক্ষী রেখে একজন পুরোহিত দ্বারা সাদা কাগজে অথবা ১০০(একশো) টাকা মূল্যের দলিলে লিপিবদ্ধ করে রাখার নামই হলো; পাটিপত্র। যাকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিয়ের কাবিননামা বলা হয়ে থাকে। এদিন পাকাকথা এবং দলিল লেখা হয়ে গেলে ছেলে পক্ষ থেকে মেয়েকে মিষ্টিমুখ করে সোনার আঙটি অথবা অন্যকোনো গয়না পরিয়ে দিয়ে মেয়েকে আশীর্বাদ করা হয়। এরপর উপস্থিত বয়ষ্ক মহিলারা উলুধ্বনি দিয়ে পাড়াপ্রতিবেশিকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, অমুকের মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে।

ছেলে পক্ষ মেয়ের বাড়িতে কথা পাকাপাকি করে ছেলের বাড়িতে এসেও একইরকম উলুধ্বনি দিয়ে ছেলে বাড়ির পাড়াপ্রতিবেশিদের জানিয়ে দেওয়া হয়। এখানেও উপস্থিত থাকা সকলে মিষ্টিমুখ করে থাকেন। তবে আমার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়েছে নারায়ণগঞ্জ আমার ভাড়া বাসায়। মেয়ের বাবা একজন পুরোহিত সাথে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ এসে আমার বাসায় বসে বিয়ের দিন-তারিখ-সহ আরও অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা করে সাদা কাগজে শর্তগুলো লিপিবদ্ধ করেন এবং আমাকে একটা সোনার আংটি দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। তারপর ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত উপস্থিত মহিলারা উলুধ্বনি দিয়ে সকলের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন।

২। আইবুড়োভাত:
আইবুড়ো অর্থাৎ এখনও অবিবাহিত বা সবার চেয়ে বড়। তাঁর হাতে রাঁধা ভাত। এই নিয়মটা আমাদের বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে অনেক জাত গোত্র ও সম্প্রদায়ের মধ্যে মানা হয়, আবার অনেকেই নিয়মটা মানেন না বা করেন না। এই নিয়মটা হলো, উভয়পক্ষের। বিয়ে পাকাপাকি হয়ে গেলে ছেলের অনেক আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব ডেকে খাওয়ানোর একটা অনুষ্ঠান। আবার মেয়ের পক্ষেও তেমনই করতে হয়। খাবারের আয়োজনে থাকে অনেক রকমের মাছের তরকারি। মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট। মাছের ঝোল বা ঝাল, মাংস, চাটনি সহ নানা পদ হয় এই আইবুড়োভাত অনুষ্ঠানে। যিনি আইবুড়ো তিনি এসব তরকারি দিয়ে ভাত মেখে প্রথম গ্রাস ছেলে অথবা মেয়েকে খাইয়ে দেন। এরপর এই মাখা ভাত খেতে উপস্থিত অনেক অবিবাহিত ছেলে/মেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এতে অনেকেই বিশ্বাস করে এই মাখা ভাত বর অথবা কনের হাতে যাকে খাওয়ায় তার বিয়েও তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। ফলে অনেকের মধ্যেই এই ভাত খাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে যায়। তবে আমার আত্মীয়স্বজনের মাঝে এমন কোনও আইবুড়ো ব্যক্তি ছিল না বিধায়, আমার মা এই নিয়মটি বাদ রাখে। বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়ের বাবার বাড়িতে ছিল একইরকম অবস্থা।

৩। শাঁখা পলা পরা:
বিয়ের ঠিক আগের দিন। যেই দিনটাকে বলে অধিবাস। এই দিন বিকালবেলা বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েকে নিয়ে তার মা বা বাড়ির বড়রা নিকটস্থ কোনও মন্দিরে যায়। তারপর মন্দিরে থাকা মাটির তৈরি দেবমূর্তি ও পুরোহিতের আশীর্বাদ নিয়ে মেয়ের মা অথবা কাকীমা, জেঠিমা বা অন্য বড় কেউ মেয়েকে শাঁখা আর লাল পলা পরিয়ে দেয়। শাঁখা হলো শাঁখ থেকে তৈরি, আর পলা হয় লাল রঙের। এই সাদা লালের জুটি হল এয়োস্ত্রী বা গৃহলক্ষ্মীর চিহ্ন। এই নিয়মটা শুধু মেয়ে পক্ষেরই নিয়ম।

৪। জল সইতে যাওয়া বা জলভরা:
বিয়ের দিন ভোরবেলা ছেলের ও মেয়ের মা এবং আরও কয়েকজন বিবাহিত মহিলা বাড়ির আশেপাশে থাকা কোনও পুকুর অথবা নিকটস্থ কোনও নদীতে জল সইতে যায়। জল সইতে যাওয়া বিবাহিত মহিলারা তামার পাত্রে বা পিতলের কলসিতে জল ভরে এনে রাখা হয়। বর্তমানে অনেকে এই নিয়মটা সকালের পরিবর্তে বিকালবেলা করে থাকে।

গায়ে হলুদ মাখার পর এই জল দিয়েই ছেলে ও মেয়ের যাঁর যাঁর বাড়িতে স্নান করানো হয়। জল সইতে বা জল ভরতে যাওয়ার সময় গান গাওয়ার রেওয়াজ আছে। বর্তমানে ব্যান্ডপার্টি ভাড়া করে এনে বাজনা বাজিয়ে বাজনার তালেতালে নেচে-গেয়ে জলভরার আয়োজন করা হয়। তবে আমার বিয়ের সময় এই নিয়মটা ছিল ঠিক ভিন্নরকম। মানে, আমি বিয়ের আগের দিন অর্থাৎ অধিবাসের দিনই আমার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে মেয়েদের বাড়িতে চলে যাই। এর কারণ ছিল, নারায়ণগঞ্জ নন্দিপাড়া ভাড়া বাসার বাড়িওয়ালা এতো ঝামেলা করতে দেয়নি বলেই, আমি বিয়ের আগের দিন মেয়ের বাড়িতে হাজির হই। আমার পক্ষ থেকে নিয়মগুলো মেয়ের বাড়ির মুরুব্বীরা সমাধান করেছিল।

৫। গায়ে হলুদের নিয়ম:
তাজা হলুদ শিলপাটায় বেটে তার সঙ্গে সরষের তেল দিয়ে মাখা হয়। প্রথমে ছেলের মা ও বিবাহিতা আত্মীয়রা এই হলুদ ছেলের বা বরের শরীরে মুখমণ্ডলে মেখে দেয়। জল সইতে বা জল ভরতে গিয়ে পুকুর থেকে অথবা নদী থেকে যে জল আনা হয়েছিল, সেই জল দিয়ে ছেলেকে স্নান করানো হয়। বেঁচে যাওয়া হলুদ কাঁসার বাটিতে করে ছেলের বাড়ির আত্মীয়স্বজনরা মেয়ের বাড়ি নিয়ে যেতে হয়। এই হলুদের সাথে মেয়ের গায়ে হলুদের সাদা লালপেড়ে শাড়ি, আর সিঁদুরের ফোটা লাগানো গোটা একটা রুই মাছ এবং অন্যান্য উপহার নিয়ে যান ছেলে পক্ষের আত্মীয়রা। এই হলো হিন্দুদের বিয়ের আগে গায়েহলুদের নিয়ম।

৬। দধি মঙ্গল:
দধি মানে দুধের তৈরি দই, আর মঙ্গল মানে শুভ। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে দইকে খুব শুভ মনে করে। অনেকেই সেইজন্য দইয়ের ফোঁটা লাগিয়ে পরীক্ষা দিতে বা যেকোনো শুভ কাজে রওনা হয়। বিয়ের দিন খুব ভোরবেলা অর্থাৎ পূর্বাকাশে সূর্য না উঠতে ছেলে ও মেয়েকে দই, চিঁড়ে, কলা ও সন্দেশ দিয়ে মেখে খেতে দেওয়া হয়। তারপর সারাদিন অর্থাৎ বিয়ের দিন তারা উভয়ই উপোস করতে হয়। বিয়ের কার্যসম্পাদন শেষ হলে তবেই তারা খেতে পারে, এর আগে আর কোনও পানাহার করা যায় না। এই নিয়মটাও আমি মেয়ের বাড়িতেই সেরেছিলাম।

৭। বৃদ্ধি পুজো:
ছেলে ও মেয়ের বাড়িতে আলাদা করে এই পুজো করা হয়। ছেলে ও মেয়ের বাবা বা পিতৃতুল্য কেউ যদি থাকে, যেমন: কাকা, জ্যাঠা, মামা, বড়দাদা এরা এই পুজো করেন। পুরোহিতের বলা সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে যার বিয়ে হচ্ছে তার সাত পুরুষের উদ্দ্যেশে এই পুজো করা হয়। এখানে স্বর্গত পূর্বপুরুষের কাছে ছেলে ও মেয়ের মানে বর ও কনের জন্য আশীর্বাদ চাওয়া হয়। এই পূজোটা বিয়ের দিন বিয়ের আগে যেকোনো সময়ই করা যায়। কিন্তু বাধ্যতামূলক করতেই হবে। আমার বিয়ের সময় বিয়ের আগে মেয়ের বাড়িতেই এই বৃদ্ধি পূজার কার্যসম্পাদন করেন আমার বড়দাদা।

৮। বরযাত্রীদের আদর আপ্যায়ন ও বরকে বরণ:
ছেলে বা বর মাকে প্রনাম করে বিয়ে করতে যায়। সাথে যাঁরা থাকেন, তাঁদের বলে বরযাত্রী। মেয়ে বা কনের বাড়িতে যাওয়ার সাথে সাথেই বরযাত্রীদের সাদর আপ্যায়ন করা হয়। মেয়ের মা অথবা মেয়ের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে থাকা বিবাহিত একজন মহিলা একটা কুলোয় হলুদ, পানের পাতা, সুপুরি ও প্রদীপ নিয়ে বরকে বরণ করে থাকে। তারপর মেয়ে পক্ষের সকল বিবাহিত অবিবাহিত মেয়েরা বাড়ির গেইটে লাল ফিতা টেনে বরযাত্রীদের আটকে রাখে। গেইটের ফিতা কাটার জন্য বর পক্ষকে কিছু অর্থদণ্ড করা হয়। তারপর বরকে মিষ্টিমুখ করিয়ে ব্যান্ডপার্টির বাজনা বাজিয়ে নেচে-গেয়ে বিয়ে আসরে নিয়ে যাওয়া হয়। বরের সাথে তো বরযাত্রীরা থাকেই।

৯। বিয়েতে ছেলে বা বরের পোশাকাদি:
বিয়ের সময় ছেলের পোশাক বলতে সাধারণত ধুতি পাঞ্জাবী হয়ে থাকে বা পরতেও হয়। ছেলে বা বরের কপালে সামান্য চন্দনের ফোটা লাগানো হয়। চন্দন মানে মঙ্গলের প্রতীক। মাথায় পরে টোপর বা মটুক। এই টোপর বা মটুক বানানো হয়, একপ্রকার জলজ উদ্ভিদ নরম গাছ দিয়ে। এসব গাছ বর্ষাকালে বাংলাদেশের অনেক গ্রামের ফসলের ক্ষেতে জন্মায়। দেখতে একরকম লম্বা ধনচা গাছের মতো। ওই গাছের ভেতরের অংশ দিয়েই হিন্দুদের বিয়ের মটুক বা টোপর বানানো হয়। এই মটুকই বর এবং কনের মাথায় পরা থাকে। তবে ছেলের মাথার মটুক বা টোপর এবং মেয়ের মাথার মটুক বা টোপর দুটোই দুরকম। এছাড়াও বরযাত্রী মেয়ের বাড়িতে আসে, তখন অনেক বরের গলায় বিভিন্নরকমের ফুলের মালা থাকে। বরের হাতে থাকে একটি পিতলের বস্তু। এটা দেখতে ছোট হাত আয়নার মতো। একে বলা হয় দর্পণ। বিয়ের সময় বরকে অবশ্যই অবশ্যই পরে আসা পোশাক পাল্টে মেয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া ধুতি পাঞ্জাবি বা পট্টবস্ত্র পরতে হয়।

১০। বিয়েতে মেয়ে বা কনের সাজগোছ:
আমাদের বাঙালি মেয়ে বা কনের সাজ খুব সুন্দর হয়। যেভাবে দুর্গা প্রতিমা একটু একটু করে সাজিয়ে তোলা হয়, ঠিক সেভাবেই বাঙালি মেয়ে বা কনেকে খুব যত্নসহকারে করে সাজানো হয়। বেশিরভাগ মেয়েরা বিয়েতে লাল বেনারসি পরে থাকে। কেউ কেউ লাল কাতান শাড়িও পরে থাকেন। বর্তমানে অনেক মেয়ের বা কনের মাথায় ওড়নাও থাকে। আর সোনা গয়নার অলঙ্কার তো থাকেই। কনের কপালে চন্দন বাটা দিয়ে অনেক কারুকার্য ও ডিজাইন করা থাকে। মেয়ে বা কনের মাথায়ও মুকুট বা টোপর পরা থাকে। বিয়েতে ছেলে বা বরের হাতে যেমন দর্পণ থাকে, তেমনি মেয়ের হাতেও থাকে একটা কাঠের বস্তু। এটাকে বলে গাছকৌটো। এই গাছকৌটার ভেতরে থাকে সিঁদুর, আর রুপোর এক টাকা। বর্তমান সময়ে রুপোর টাকা নেই, তাই এক টাকার একটা কয়েন থাকে। মেয়ের হাতে থাকা গাছকৌটা থাকার মানে হলো, মা লক্ষ্মীর হাতে থাকা একটা বস্তু।

১১। সোনা কাপড়:
এই সোনা কাপড় মানে হলো, সোনার গয়নার সাথে মেয়ের পরিধানের কাপড়-সহ স্নো, পাউডার, আলতা, সাবানসহ সাজগোজের যাবতীয় জিনিশপত্রকে সোনা কাপড় বলে। এটা ছেলে পক্ষ থেকে মেয়ে বা কনেকে দিতে হয়। এই অনুষ্ঠানটি বিয়ের ঠিক আগমুহূর্তে বিয়ের আসরেই হয়ে থাকে। কেউ কেউ ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ের আগেও সোনা কাপড় মেয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

১২। মালাবদল ও শুভ দৃষ্টি:
বিয়ের সময় ছেলের পক্ষ থেকে মেয়েকে যেমন সোনা কাপড় দেওয়া হয়, তেমনই মেয়ের পক্ষ থেকে ছেলে বা বরকে সোনা-সহ কাপড় দিতে হয়। মেয়ের পক্ষ থেকে ছেলেকে ধুতি পাঞ্জাবী ও সোনার শ্রী আংটি দেওয়া হয়। বিয়ের আসর থেকে একটু আড়ালে গিয়ে বর মেয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া ধুতি পাঞ্জাবী পরে আসে। মেয়ে পক্ষ থেকে যিনি কন্যা সম্প্রদান করবেন, তিনি আগে একটা পুজো করেন পুরোহিতের সাহায্যে। ছেলে বা কাপড় পরে এলে কনেকে পিঁড়িতে বসিয়ে নিয়ে আসা হয়, বরের সামনে। তখন মেয়ে বা কনের মুখ পান পাতা দিয়ে ঢাকা থাকে। মেয়ের পক্ষের লোকেরা মেয়েকে পিঁড়ির উপরে বসিয়ে বরের চারপাশে সাতবার মেয়েকে ঘোরানো হয়। তারপর কনেকে পিঁড়ি থেকে নামানো হয়। এরপর মেয়ে বা কনে মুখ থেকে পান পাতা সরিয়ে বরের দিকে তাকায়। একে শুভদৃষ্টি বলে। এরপর হয় মালাবদল। মানে একে অপরের গলায় মালা পরিয়ে দেয়। এসময় অনেকক্ষণ পর্যন্ত মালাবদলের পালা চলতে থাকে। সাথে বাজতে থাকে ব্যান্ডপার্টির বাজনা। বাজনার তালেতালে সবাই নাচতে থাকে সাথে ছেলে মেয়েকে মালা পরিয়ে দেয়, মেয়েও ছেলেকে মালা পরিয়ে দেয়। একেই বলে মালাবদল। এসময় উপস্থিত বিবাহিত অবিবাহিত মেয়েও মহিলারা উলুধ্বনির সাথে শাঁখ বাজিয়ে পাড়াপ্রতিবেশিদের জানিয়ে দেয়।

১৩। কন্যা সম্প্রদান:
যেখানে বিয়ের আসর করা হয়েছে, সেখানে ডেকোরেশনের কর্মী দ্বারা অনেকে সুন্দর করে একটা মঞ্চ তৈরি করা হয়। এই বিয়ের মঞ্চটাকে বলা হয় বিয়ের কুঞ্জ। বর ও কনে মুখামুখি পিঁড়িতে বসা থাকে। যিনি কন্যা দান করবেন, তিনি ছেলের হাতের উপর হাত রেখে কন্যা সম্প্রদান করবেন। যিনি সম্প্রদান করছেন, পুরোহিত একটি পবিত্র সুতো দিয়ে তাঁর হাত বেঁধে দেন।

১৪। হোম:
এরপর বর ও কনে পাশাপাশি বসে এবং পুরোহিত আগুন জ্বেলে হোমযজ্ঞ (আগুনের কুন্ডলী) করেন এবং মন্ত্র পাঠ করেন।

১৫। সপ্তপদী:
পুরোহিত কনের শাড়ি ও বরের পট্টবস্ত্রের সাথে বেঁধে দেন এবং বর-কনে ওই যজ্ঞের চারপাশে সাত পাক একসঙ্গে ঘোরে। তার সাথে সাথে পুরোহিতের মন্ত্র উচ্চারণ ও বিয়ের প্রতিজ্ঞা করেন।

১৬। কুসুমডিঙা বা খই পোড়ানো:
এরপর মেয়ে বা কনে কুলোয় করে আগুনে খই দেয় আর ছেলে বা বর কনের হাত দুটো পিছন থেকে ধরে থাকে।

১৭। সাত পাকের সাত প্রতিজ্ঞা:
১৭-১। প্রথম প্রতিজ্ঞা:
স্বামী ও স্ত্রী চান বাড়িতে কখনও খাদ্য বা ধন সম্পত্তির অভাব যেন না হয়। স্বামী স্ত্রীকে খুশি রাখার এবং স্ত্রী দায়িত্বপালনের প্রতিজ্ঞা।

১৭-২। দ্বিতীয় প্রতিজ্ঞা:
স্বামী স্ত্রী দুজনে দুজনকে সমর্থন করার এবং শরীরে মনে একাত্ম হওয়ার প্রতিজ্ঞা।

১৭-৩। তৃতীয় প্রতিজ্ঞা:
স্বামী ও স্ত্রী ধন সম্পত্তি সামলে রাখার তাকে বৃদ্ধি করার প্রতিজ্ঞা করেন। তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ই প্রতিজ্ঞা করেন সন্তানের সঠিক দেখাশোনা করার প্রতিজ্ঞা।

১৭-৪। চতুর্থ প্রতিজ্ঞা:
সদ্য বিবাহিত দম্পতি প্রতিজ্ঞা করেন তারা পরস্পরের পরিবারকে সম্মান জানাবেন। তাদের দেখাশনার দায়িত্ব নেবেন এবং তাদের মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেবেন।

১৭-৫। পঞ্চম প্রতিজ্ঞা:
তারা ঈশ্বরের কাছে সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান সন্তানের প্রার্থনা করেন। তারা প্রতিজ্ঞা করেন সন্তানের সুশিক্ষার ব্যাবস্থা তারা করবেন।

১৭-৬। ষষ্ঠ প্রতিজ্ঞা:
ষষ্ঠ প্রতিজ্ঞায় সুস্বাস্থ্য ও রোগবিহীন জীবন কামনা করেন দুজনে।

১৭-৭। সপ্তম প্রতিজ্ঞা:
সপ্তম ও শেষ প্রতিজ্ঞা হল এই সম্পর্ক যেন স্থায়ী ও মজবুত হয় তার জন্য দুজনেই সচেষ্ট থাকবেন।

১৮। সিঁদুরদান:
বর কনের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেয়। সিঁদুর পরানো হয়ে গেলেই কেউ একজন কনের মাথায় একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়। একে বলে লজ্জাবস্ত্র। সিঁদুর পরানর ক্ষেত্রে একেক বাড়িতে একেক রকম নিয়ম করা হয়। কেউ রূপোর টাকা, কেউ আংটি আর কেউ দর্পণ দিয়ে সিঁদুর পরায়। যেহেতু রুপোর টাকা এখন আর নেই, সেহেতু দর্পণ দিয়েই এই নিয়মটা বেশি করে থাকেন।

বিয়ের কার্যসম্পাদন শেষ হলে বর ও কনেকে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সাথে থাকে ছেলে বা বরের বন্ধুবান্ধব এবং মেয়ে বা কনের বান্ধবীরা। এখানে বর ও কনের জন্য কিছু পরীক্ষামূলক খেলার আয়োজন থাকে। যেমন: পাশা খেলা, চাউল ছড়ানো ও উঠানো খেলা। জলকেলি খেলা। পাশা খেলায় যে জিতবে সেই সংসার পরিচালনায় দক্ষ ও চালাক হবে। একটা ঘটে কিছু চাউল থাকে। সেই চাউলগুলো বর বিছানার উপর ছিটিয়ে দিবে। কনে সেই চাউলগুলো আস্তে আস্তে কাচিয়ে কাচিয়ে ঘটে ভরবে। এমনভাবে ভরতে হবে, যাতে কোনও শব্দ না হয়। শব্দ হলেই বুঝে নিতে হবে যে, এই মেয়ের সব কাজেই শব্দ হবে। মানে অলক্ষ্মীর ভাব। এভাবে তিন তিনবার চাউল ছিটানো হবে, তিনবার উঠানো হবে। ছেলেও তিনবার, মেয়েও তিনবার। এরপর জলকেলি খেলা।

এই খেলায় একটা পিতলের অথবা মাটির সানকির প্রয়োজন হয়। এই সানকিতে জল থাকে। জল হাত দিয়ে নেড়ে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর মেয়ের মাথার মটুক থেকে সামান্য একটু বস্তু, আর ছেলের মাথার মটুক থেকে সামান্য একটু বস্তু নিয়ে সেই ঘোরানো জলে আগে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। জল ঘুরতে থাকে, সাথে ছেলে /মেয়ের মাথার মটুকের ছেঁড়া অংশও ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে দেখা যাবে, মেয়েরটা আগে, নাকি ছেলেরটা আগে দৌড়াচ্ছে। যদি মেয়েরটার পেছনে ছেলেরটা থাকে, তাহলে সবাই বলে, “মেয়ে খুবই অভিমানী!” আর যদি ছেলেরটার পেছনে মেয়েরটা থাকে, তাহলে সবাই বলে, “ছেলে তো খুবই দেমাগি!” এভাবে একসময় দুটোই একসাথে মিলে গিয়ে জড়াজড়ি হয়ে যায়। তখন উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে আনন্দে হৈচৈ শুরু করে দেয়। এরপর শুরু হয় বর কনের খাওয়াদাওয়ার পালা। খাওয়াদাওয়ার মাঝেও ছেলের বন্ধুবান্ধব ও মেয়ের সখি ও বান্ধবীরা সাথে থাকে।

১৯। বাসর ঘর:
বিয়ে শেষ হলে বর ও কনেকে ঘুমানোর জন্য দুইজনকে আলাদা এক ঘরে দেওয়া হয়। এসময় বর ও কনের ভাই বোন ও বন্ধুরা সবাই মিলে সারা রাত বিয়ের আসরে বসে আড্ডা দেয়। গান বাজনা হয়। একে বলে বাসর ঘর। তারপর হয় বাসি বিয়ে।

২০। বাসি বিয়ে:
অনেক বাঙালি বাড়িতে নিয়ম আছে। তবে বাসরঘর থেকে আসার কারণে আর বিয়ের রাত শেষ হয়ে যাওয়ার কারণেই, এই বিয়েটাকে বাসি বিয়ে বলে থাকে। অনেক জায়গায় বাসি বিয়ের পরই সিঁদুরদান করে থাকে। এই বাসি বিয়েতে একজায়গার চারকোণায় চারটে কলাগাছ রোপণ করে রাখা হয়। এখানেও বর কনে একসাথে কনের কাপড়ের আঁচলের সাথে বরের ধুতি অথবা গায়ের চাদরের কোণা গিঁট বেঁধে কলাগাছের চারদিকে সাত পাক ঘরতে হয়। কলাগাছের চারদিকে সাত পাক ঘোরার পর এখানেও একটা মজার পরীক্ষামূলক খেলা থাকে। এটা হলো আংটি খেলা। কলাগাছের মাঝখানে একটা ছোট গর্ত করা হয়। সেই গর্তটা জল দিয়ে ভরে রাখা হবে। তারপর বর তাঁর হাতের আংটি ঐ গর্তে লুকিয়ে রাখবে, কনে সেই আংটি জল ভর্তি গর্ত থেকে খুঁজে বের করতে হবে। এভাবে উভয়ই তিনবার করে। যে তিন বারের মধ্যে একবার খুঁজে বের করতে পারলো না, সেই খেলায় হেরে গেলো। যে জিতল, সেই বুদ্ধিমানের পরিচয় দিলো।

২১। কনের শ্বশুরঘর যাত্রা:
বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন হলো। পাড়াপড়শি সবাই এসে নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করেন। বর ও বরযাত্রীরা কনেকে নিয়ে কনের বাড়ি থেকে বরের বাড়িতে নিয়ে যায়। এসময় বিদায়বেলায় মেয়ে বাড়িতে কান্নাকাটি শুরু হয়।

২২। বধূ বরণ ও কালরাত্রি:
বরের বাড়ি পৌঁছলে বরের মা কনেকে বরণ করে ঘরে তোলেন। দুধ আর আলতায় পা ডুবিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। নতুন বউকে ওথলানো দুধ দেখাতে হয়। যাতে সারাজীবন দুধভাত খেয়ে যেতে পারে। চাল ভর্তি পাত্র দেখাতে হয়। যাতে সারাজীবন সংসার চালের অভাব না হয়। এবং একটা পাত্রে থাকা জীবিত মাছ ধরতে বলা হয়। যাতে সারাজীবন এই সংসারে মাছভাত পরিপূর্ণ থাকে। সেদিন স্বামী ও স্ত্রী আলাদা আলাদা শয়ন করেন। একে বলে কালরাত্রি।

২৩। বউ ভাত ও ফুলশয্যা:
বিয়ের একদিন পরে হতে পারে বউভাত অনুষ্ঠান। এটা করা হয় যাঁর যাঁর সাধ্যমতো। এদিন বউয়ের হাতে ভাতের থালা ও কাপড় তুলে দেয় বর। বলে আজ থেকে তমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব আমিই নিলাম। এরপর নতুন বউ শ্বশুরবাড়ির সব গুরুজনদের খাওয়ার পাতে ঘি-ভাত দিতে হয়। এই অনুষ্ঠানে অনেকে অনেক ধরণের আয়োজন করে থাকে। কেউ হাজার হাজার লোকের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন। এদিন রাতে হয় ফুলশয্যা।

২৪। অষ্টমঙ্গলা বা আট নায়রি:
বিয়ের আট দিনের মাথায় বর ও কনে একসাথে মেয়ের বাড়ি যায়। নারায়ণ পুজো করে বিয়ের দিনে পুরোহিতের বেঁধে দেওয়া হাতের সুতো খুলে দেওয়া হয় এবং মেয়ের মা ওই সাত পাকের জোরের গেঁট খুলে দেয়।

সবশেষে ঘরসংসার:
এরপর থেকে চলতে থাকে সাংসারিক জীবন। কারো-কারোর বেলায় বছর দুয়েক পরই সংসারে আসে নতুন অতিথি। একসময় তাঁরা বুড়ো হয়ে যায়। নতুন আগতরা বড় হয়ে সেই সংসারের হাল ধরে। এভাবেই চলতে থাকে জীবনের পর জীবন। আমাদের জীবনও এভাবেই চলছে। সমাপ্তি।