পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
প্রথম পর্ব। তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর
সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
শীত মানেই পার্বণ, শীত মানে পৌষ মেলা, শীত মানেই জমিয়ে খাওয়া দাওয়া। শীত মানেই ভ্রমণ, কুহুভাত, ডিবুভাত, বনভোজন, পিকনিক। শীতে গঙ্গাসাগর মেলা, জয়দেবের মেলা অপামর ভারতবাসীর আকর্ষণের অন্যতম কারন। বাঙালিদের নবান্ন উৎসব এই পৌষেই, মকর সংক্রান্তিতে মকর স্নান, বাড়িতে বাড়িতে লক্ষীর আরাধনা, আলপনা, পিঠে-পার্বণ- সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু কেউ মনে রাখেনা এই “পৌষ পরবের স্রষ্টা” আদিবাসী সমাজকে।
ভারতবর্ষের সবচেয়ে অনুন্নত, জঙ্গলময়, পর্বতবেষ্টিত ছোটনাগপুর মালভূমি । সরস গাঙ্গেয় সমতল থেকে পৃথক ভূপ্রকৃতি এবং নৃতাত্ত্বিক সামাজিক বিশিষ্টতা এই অঞ্চলকে যে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে সেই স্বাতন্ত্র্যই তাকে আজও আধো-চেনা করে রেখেছে। কৃপণ প্রকৃতি, বিস্তীর্ণ ঊষরতা, শীততাপের তীব্রতা – এসবের সঙ্গে অনবচ্ছিন্ন সংগ্রামে নিরত এখানকার প্রধানত কৃষিনির্ভর কুড়মি আদিবাসী জনজীবন।
সংগ্রামে যেমন ধরা দেয় লোকজীবনের দুর্দম প্রাণস্পন্দন, লোক-উত্সবে তেমনই ধরা দেয় তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণোচ্ছ্বাস। নিরন্তর সংগ্রাম আর বঞ্চনার ব্যথা শাল, মহুল, পলাশ, কুসুমের দেশের মানুষের প্রাণের সেই উচ্ছ্বাস দমন করতে পারেনি। টুসু, করম, বাঁদনা, ইঁদ, জিতা, চড়ক, পরব বা শিকার পরব – নানা উত্সব, পরবের আনন্দ দিয়ে দৈনন্দিন দুঃখগুলো মুছে ফেলতে জানে এখানকার মানুষ।
গাঙ্গেয় বঙ্গের প্রধান উৎসব দুর্গাপুজো যে উদ্বেলতা সৃষ্টি করে, সমগ্র ছোটনাগপুরে তা অনেকাংশে নিস্তেজ। যে উৎসব এখানে আরও বেশি গুরুত্ব পায়, যে উৎসবে এই ভূখণ্ডের গভীর, বর্ণময় স্বতোত্সার ধরা পড়ে সবচেয়ে বেশি তা হল টুসু পরব।
এই উত্সব পৌষালি ফসলের উৎসব, নানা লোক-উৎসবের মতোই কৃষিকেন্দ্রিক, বিদ্বজ্জনের মতে, ফার্টিলিটি রিচুয়াল অর্থাত উর্বরাশক্তির উপাসনা। এই পুজোর পুরোহিত নেই, নেই পূজন-মন্ত্র। এই পুজো মূলত মেয়েরাই করে, পূজন-মন্ত্র হল গান। গানের ভাষা শহুরে মানুষের সুমার্জিত, সুসংস্কৃত, কৃত্রিম ভাষা নয়। এ ভাষা সহজ, সরল লোকজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুখ-দুঃখ, বাৎসল্যরস, প্রেম-বিরহ, ঈর্ষা-অভি ফুটে ওঠে চাকচিক্যহীন ভাষায়। পৌষ মাস শিশির-সিক্ত নতুন ফসলের মাস। কৃষকের সেই আনন্দ উচ্ছলিত হয় টুসু উৎসবে। টুসু গাঙ্গেয় সমভূমির স্বর্গবাসিনী শ্রেণীর নন, নেহাতই ঘরের মেয়ে, গিরিরাজকন্যা মহামায়ের কাছাকাছি। অসুরদলনী, সিংহবাহিনী, দশপ্রহরণধারিণী দুর্গা থেকে শত মাইল দূরে।
এই সময় সমগ্র ছোটনাগপুর জুড়ে আকাশে বাতাসে টুসুগানের মেঠো সুর ধ্বনিত হয়, এই লোকগানের সুরে মুগ্ধ হওয়ার সেরা সময় তো এটাই। কিন্তু এর বেশি পরিচিতি নেই, চাকচিক্য নেই, শহুরে হুল্লোড় নেই- তবু মানুষগুলোর প্রানের উৎসব টুসু, এই উৎসব মাটির উৎসব। নিজগুণে এক ঘরের মেয়ে -সমগ্র নারীকুলর প্রতীক হয়ে ওঠে, টুসু মানব ও প্রকৃতির এক মিলিত বিগ্রহ। মুলতঃ টুসু আসলে কৃষিভিত্তিক আঞ্চলিক পার্বণ ।
মূল আকর্ষণ এক মাস ধরে গাওয়া টুসু গান, সন্ধ্যা নামলেই সমবেত কন্ঠে গায় পূজারিণীরা। এরপর আসে পৌষ সংক্রান্তি। পৌষের শীতল রাতে, পাড়ার মেয়ে-বউরা সুরের মূর্চ্ছনায় জাগিয়ে রাখে রুখামাটির গ্রামগুলোকে। বক্স, লাউড স্পিকারে বাজতে থাকে এসব গান। টুসু গানের কথায় ফুটে ওঠে ছোটনাগপুরের সামাজিক চিত্র, সুখ-দুখের কাহিনী। টুসু জাগরণের রাত বাঁউড়ি নামে পরিচিত।
একটা বিখ্যাত টুসু গানের কথা শুনলেই বোঝা যায় টুসু তাদের ঘরে মেয়ে।
টুসুর গান – ১ সুর- প্রচলিত
-“চল টুসু চল খেলতে যাবো, রানীগঞ্জের বটতলায় ।।
খেলতে খেলতে দেখে আসবো কয়লা খাদের জল তুলা ।
হলুদ বনের টুসু তুমি হলুদ কেন মাখো না ।।
শাশুরি-ননদির ঘরে হলুদ মাখা সাজ না ”
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
আমাদের সংস্কৃতি। পোস্টের জন্য অভিনন্দন কবি মি. ভাণ্ডারী।