পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- অষ্টম পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- অষ্টম পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
(তথ্য সহায়তা ফেসবুক থেকে)

★ টুসু পরব ★
———————
টুসু পার্বণ (টুসু পরব বা টুসু পুজো নামেও পরিচিত) গ্রাম বাংলা, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা ও আসামের এক উপজাতিক পার্বণ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া প মেদনিপুর ও বাঁকুড়া জেলা এবং পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমা এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগণা, ধানবাদ, রাঁচি ও হাজারিবাগ,সিংভূম-সেরাইকেলা জেলার, উড়িষ্যা রাজ্যের কেওয়নঝর, রাউলকেল্লা, সুন্দরগড়, ময়ূরভঞ্জ প্রভৃতি জেলা এছাড়া আসামের চা-বাগান কেন্দ্রীক কৃষিভিত্তিক উৎসব।যেখানেই কুড়মী-মাহত সেখানেই টুসু::

অগ্রহায়ণ মাসের শেষ থেকে শুরু হয়ে যায় টুসু পরবের প্রস্তুতি, টুসু কোনো দেবী নয়। নতুন ধানের তুষ দিয়ে ভরা হয় মাটির সড়া। আকন্দ ও গাদা ফুলের মালা, গারুলি আটা, বাছুরের গোবর রেখে দেওয়া হয় তুষের সাথে। প্রতি সন্ধ্যায় কথায়, সুরে, গানে বন্দনা করা হয় সরাটিকে। দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, চলমান ঘটনা নিয়ে মহিলারাই মুখে মুখে গান রচনা করেন। সমস্ত মহিলারাই তখন যেন টুসু হয়ে ওঠে। টুসু পরবের অন্যতম প্রাণশক্তি হলো টুসু গান।

★ নামকরণ ★

টুসুর নামকরণ সম্বন্ধে সর্বজনগ্রাহ্য কোন মত নেই। ডঃ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর মতে, তুষ থেকে টুসু শব্দটি এসেছে। দীনেন্দ্রনাথ সরকারের মতে তিষ্যা বা পুষ্যা নক্ষত্র থেকে অথবা উষা থেকে টুসু শব্দটি এসেছে, আবার কখনো তিনি বলেছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের প্রজনের দেবতা টেষুব থেকে টুসু শব্দটি তৈরী হয়েছে। আবার অনেকেই বলে থাকেন পুরুলিয়ার কাশিপুরের রাজার দুই মেয়ে ছিল ভাদু ও টুসু। সেই টুসুর জন্ম দিবস স্মরণ করা হয় টুসু পরবে।

★ পালনরীতি ★

টুসু উৎসব অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে পালিত হয়। ধানের ক্ষেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে পিঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো লাগিয়ে তাতে তুষ রাখেন। তারপর তুষের ওপর ধান, কাড়ুলি বাছুরের গোবরের মন্ড, দূর্বা ঘাস, আল চাল, আকন্দ, বাসক ফুল, কাচ ফুল, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে পিড়ি বা কুলুঙ্গীর ওপর রেখে স্থাপন করা হয়। পাত্রের এই পুরো ব্যবস্থা প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী হিসেবে পূজিতা হন। পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর নিকট তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সুর করে নিবেদন করেন ও দেবীর উদ্দেশ্যে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করেন।

টুসু উৎসব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ চারদিন চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত। চাঁউড়ির দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নিকিয়ে পরিস্কার করে চালের গুঁড়ো তৈরী করা হয়। বাঁউড়ির দিন অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কোণাকৃতির পিঠে তৈরী করে তাতে চাঁছি, তিল, নারকেল বা মিষ্টি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়। স্থানীয় ভাবে এই পিঠে গড়গড়্যা পিঠে বা বাঁকা পিঠে বা উধি পিঠে ও পুর পিঠা নামে পরিচিত। বাঁউড়ির রাত দশটা থেকে টুসুর জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়েরা জাগরণের ঘর পরিষ্কার করে ফুল, মালা ও আলো দিয়ে সাজায়। এই রাতে কিশোরী কুমারী মেয়েরা ছাড়াও গৃহবধূ ও বয়স্কা মহিলারাও টুসু গানে অংশগ্রহণ করেন। এই রাতে টুসু দেবীর ভোগ হিসেবে নানারকম মিষ্টান্ন, ছোলাভাজা, মটরভাজা, মুড়ি, জিলিপি ইত্যাদি নিবেদন করা হয়।

পৌষ সংক্রান্তি বা মকরের ভোরবেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে টুসু দেবীকে বাঁশ বা কাঠের তৈরী রঙিন কাগজে সজ্জিত চৌডল বা চতুর্দোলায় বসিয়ে নদী বা পুকুরে নিয়ে যান। সেখানে প্রত্যেক টুসু দল একে অপরের টুসুর প্রতি বক্রোক্তি করে গান গাইতে দেবী বিসর্জন করে থাকেন। টুসু বিসর্জনের পরে মেয়েরা নদী বা পুকুরে স্নান করে নতুন বস্ত্র পরেন। ছেলেরা খড়, কাঠ, পাটকাঠি দিয়ে ম্যাড়াঘর বানিয়ে তাতে আগুন লাগান।

★ টুসু গীত ★

টুসু উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ টুসু সঙ্গীত। এই সঙ্গীতের মূল বিষয়বস্তু লৌকিক ও দেহগত প্রেম। এই গান গায়িকার কল্পনা, দুঃখ, আনন্দ ও সামাজিক অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করে। কুমারী মেয়ে ও বিবাহিত নারীরা তাঁদের সাংসারিক সুখ দুঃখকে এই সঙ্গীতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। গানের মাধ্যমে মেয়েলি কলহ, ঈর্ষা, অভীপ্সা, দ্বেষ, ঘৃণা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করা হয়। এছাড়া সমকালীন রাজনীতির কথা ব্যাপক ভাবে এই গানে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এই সমস্ত গানে পণপ্রথা, সারক্ষরতা সম্বন্ধে সচেতনতা, বধূ নির্যাতনের বিরুদ্ধতা প্রভৃতি সামাজিক দায়িত্বের কথাও বলা হয়।

টুসু গীতকে ভনিতাযুক্ত ও ভনিতাবিহীন এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। ভনিতাবিহিন টুসু গীতকে মূল টুসু পদ এবং টুসু পদের রঙ এই দুইটি অংশে ভাগ করা যায়। টুসু পদের রঙ অংশটি কখনো মূল পদের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে রচনা করা হয়, কখনো বা স্বতন্ত্র ভাবে রচিত হয়। ভনিতাবিহীন টুসু পদ মূলত চার চরণে বাঁধা থাকে, যার মধ্যে রঙের জন্য মাত্র দুইটি চরণ নির্দিষ্ট থাকে।
পৌষ সংক্রান্তির দিন রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি চৌউল বা চতুর্দোলায় সেই তুষ ভর্তি সরাকে বসি‌য়ে মাথায় নিয়ে নতুন বস্ত্র পরিধান করে বাড়ির মহিলারা টুসু গান গাইতে গাইতে স্থানীয় কোনো নদী বা জলাশয়ে যান এবং জলে ভাসিয়ে দেন। টুসু ভাসানের দিন তাই কান পাতলেই শোনা যায় টুসু গান

****
ঝাড়খণ্ড রাজ্য ও পুরুলিয়া জেলার অধিকাংশ স্থানে পুরাতন প্রথা অনুযায়ী টুসু উৎসবে কোন মূর্তির প্রচলন নেই সাধারনত পাট কাঠিতে রংবেরঙের কাগজ, রঙিন কাগজের কারুকার্য করা হয়। কিন্তু পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ান থানা এবং বাঁকুড়া জেলার খাতড়া থানার পোরকুলের টুসু মেলায় টুসু মূর্তির প্রচলন রয়েছে।

লিখেছেন: সুদীপ মাহাত
আদিবাসি কুড়মি সমাজ

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

2 thoughts on “পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- অষ্টম পর্ব

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।