পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- দশম পর্ব।
তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
পাঁচখুরি হাটের এককোণে জনাপাঁচেক লোক। প্লাস্টিক আর চাটাই বিছিয়ে কিছু মুর্তি সাজিয়ে খদ্দেরের আশায় বসে আছেন। পাশাপাশি চলছে মুর্তি তৈরির কাজও। খদ্দের তেমন নেই। অথচ হাটের অন্য দোকানে চলছে জমজমাট পৌষ সংক্রান্তির বিকিকিনি। পিঠেপুলি তৈরির মাটির হাঁড়ি-সরা, বাঁশের ঝুড়ি, নতুন জামাকাপড় সবই বিকোচ্ছে দেদার। তাল কাটে শুধু টুসু মূর্তির বিক্রেতাদের কাছে।
‘‘আগের দিন আর নেইগো বাবু’’— আক্ষেপ রঞ্জন দে-র। প্রায় তিরিশ বছর ধরে পাঁচখুরির হাটে টুসু মূর্তি বিক্রি করছেন খড়্গপুরের বেনাপুরের রঞ্জন দে, বিষ্ণুপদ রাণারা। আগে মকর পরবের এই সময়ে প্রতি হাটবারে হেসেখেলে দু’শো থেকে আড়াইশো মূর্তি বিক্রি হত। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই সেই বিক্রি আর নেই। এ বার তো বাজারের হাল গতবারের থেকেও খারাপ। একশো মূর্তি গড়েও বিক্রি হবে কিনা চিন্তায় রয়েছেন শিল্পীরা। ঝাড়গ্রামের সরডিহা থেকে আসা টুসু শিল্পী গোপাল দাস জানালেন, কমবয়সীদের এতে তেমন আর উৎসাহ নেই। আর বছর বছর টুসু প্রতিমার বিক্রি কমার সেটাই কারণ।
৩০ টাকা থেকে টুসুর মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতা থাকলে ঘোড়ায় চড়া মূর্তিও কেনা যাবে। দাম ৩০০ টাকার কাছাকাছি। তবে তার খদ্দের কম। অথচ টুসুই দক্ষিণবঙ্গের পৌষ সংক্রান্তি পরবের প্রাণকেন্দ্র। সংক্রান্তির আগের সন্ধ্যায় বাড়ির মহিলারা উপোস থেকে সারা রাত ধরে গান গেয়ে টুসু বন্দনা করেন। ভোরে পুকুরে না নদীতে টুসুর বিসর্জন। টুসুর এই মৃন্ময় মূর্তি নিয়ে রয়েছে নানা মত।
মেদিনীপুর শহরের চারপাশ, বেলপাহাড়ি, ঝাড়গ্রাম, বাকুঁড়া, পুরুলিয়া এরকম নানা এলাকাতে টুসুকে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোককথা রয়েছে। কোনও গবেষকের কাছে টুসু উৎসবে গ্রাম বালিকার পুতুল খেলার প্রাধান্য বেশি, কারও মতে প্রাথমিক পর্যায়ে টুসুর কোনও মূর্তি প্রচলিত ছিল না। কালক্রমে তা চালু হয়। আবার কেউ মনে করেন টুসু নবান্ন নয়, তা আসলে আদিম জনজাতির শস্যকে পুর্নজীবন দানের উৎসব।
কোল গোষ্ঠীর টুসাউ শব্দের সঙ্গে টুসুর মিল থাকতে পারে বলে মনে করেন কেউ কেউ। টুসাউ মানে টাটকা ফুলের গোছা। আর চিরাচরিত টুসু উৎসবেও মূর্তির বিশেষ স্থান ছিল না । ছিল ফুল আর কাগজের ফুল দিয়ে তৈরী চৌদলের ব্যাবহার। চৌদল বলতে বাঁশ আর কাগজ দিয়ে তৈরী ছোট মন্দিরের মতো কাঠামো। পুরুলিয়ার দিকে এখনও এই ধরনের চৌদল ব্যবহার হয়। আবার ধান কেটে ঘরে তোলার পরে এই উতসবকে অনেকে অধিক ফলন বা সন্তান লাভের কামনা ইত্যাদি নানা উদ্দেশ্যসাধক ব্রত বলে মনে করেন। কেউ কেউ এর মধ্যে লক্ষ্মীব্রতের ও ছায়া দেখতে পান। তবে ফসল ঘরে তোলার পরে ধন্যবাদ জ্ঞাপনকারী উৎসব হিসেবে টুসুকে ব্যাখ্যা করেন অধিকাংশ গবেষক। নৃতত্ববিদ প্রবোধ কুমার ভৌমিকের মতে, “টুসু একান্তভাবে লোক উৎসব, কোন আচার বা ধর্মের অনুশাসনে আবদ্ধ নয়। টুসু আসলে জন-মানসের অনাবিল আনন্দের অভিব্যক্তি। উৎসবের প্রতীক টুসু একটি পুতুল।’’
টুসু নিয়ে নানা বিয়োগান্তক গল্প প্রচলিত রয়েছে। সব ক্ষেত্রেই টুসুর মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে স্থানীয় নদী। তাই টুসু পরবের অন্যতম অনুষঙ্গ টুসুর বিদায় বা ভাসান। এই ভাসান পরবে আগে সারা সারা রাত ধরে টুসুর গান করে মহিলারা। বেশিরভাগ গবেষকই মনে করেন, প্রাথমিক পর্যায়ে টুসুর মূর্তি বলে কিছু ছিল না। সঙ্গীত নির্ভর বিমূর্ত এই লোক উৎসব ক্রমে বির্বতিত হয়ে মূর্তি কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। টুসুর মূর্তিও সাধারণ পুতুলের মূর্তি থেকে ধীরে ধীরে লক্ষ্মী প্রতিমার রূপ নিয়েছে।
তবে এ সবই ইতিহাস। মোবাইল আর নেটের যুগে টুসুর সাবেক গান আর নতুন প্রজন্মকে টানছে না। খড়্গপুরের মোহনপুরের নিয়তি রায় টুসুর মূর্তি কিনে ফেরার পথে জানালেন এখনকার ছেলেদের মাইকে গান বাজলেই হলো। তা টুসুর গান কিনা তা নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। তাই ‘তিরিশটি দিন রাখিলাম মাগো, তিরিশটি ফুল দিয়ে গো’ বা আমার টুসু একটা বিটি, মানবাজারে শ্বশুরঘর’— বছর বছর শুনে আসা এ সব গান গেয়ে বা শুনে রাত জাগতে অনেকেই আর রাজি হচ্ছে না। পরিণাম বাজার পড়ছে টুসুর। কয়েক বছর আগেও টুসুর মূর্তি নিয়ে সংক্রান্তির এক সপ্তাহ আগে থেকে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে গান গেয়ে চাল, ফলমূল আর টাকা সংগ্রহের রেওয়াজ ছিল। তা-ও দিনকে দিন কমে আসছে।
তথ্যাসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
পৌষ সংক্রান্তি শস্যোৎসব। খেতের পাকা ধান প্রথম ঘরে ওঠা উপলক্ষে পালিত হয় এই উৎসব। পাকা ধানের শিষ এনে নির্দিষ্ট কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। দু’-তিনটি খড় এক সঙ্গে লম্বা করে পাকিয়ে তার সঙ্গে ধানের শিষ, মুলোর ফুল, সরষে ফুল, আমপাতা ইত্যাদি বেঁধে ‘চাউরী- বাউরী’ তৈরি করা হয়। এই ‘চাউরী- বাউরী’ ধানের গোলা, খড়ের চাল, ঢেঁকি, বাক্স-প্যাঁটরায় গুঁজে দেওয়া হয়।
বাংলার পাটিসাপটা।
বাংলায় পৌষপার্বণের প্রধান অঙ্গ হল পিঠে খাওয়া। এই সময়ে নতুন ধানের পাশাপাশি বাংলার গ্রামে গ্রামে খেজুর গাছে রস আসে, তৈরি হয় নতুন গুড়, খেজুর গুড়। তাই নতুন চালের গুঁড়ো, নতুন গুড়, নারকেল আর দুধ দিয়ে তৈরি করা হয় নানা ধরনের পিঠে। তাই পৌষপার্বণের আরেক নাম পিঠেপার্বণ।
অসমেও এই সময়টা নতুন ধানের। তাই ‘ভোগালি বিহু’তে যেমন আছে উপবাস, তেমনই আছে ভোজ, অবশ্যই যার প্রধান অঙ্গ নতুন ধান।
লিখেছেন- শম্ভু সেন
তথ্যসহায়তায় : Khabor online
যথাযথ শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ কবি মি. লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী।
আপনার সুন্দর মন্তব্যে আপ্লুত হলাম।
শুভাশীর্বাদ কাম্য। জয়গুরু!