সম্পর্কটা ভুল ছিলো [৪]

হঠাৎ করে নিজেকে কেমন যেনো বোকা বোকা লাগছে। ছোট বোন চারু বার বার উঁকি ঝুঁকি মারছে আমার ঘরে। আমার গতিবিধি লক্ষ করছে। হয়তো মায়ের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করতে নেমেছে। বিরক্তিকর। সুযোগ মতো পেয়ে আমি একবার চোখ কটমট করে তাকাতে ভয় পেয়ে চলে গেলো। আমি জানি সে মোটেও চলে যায়নি। শুধু একটু সাবধানী হয়েছে মাত্র। খুব চালাক প্রকৃতির মেয়ে সে।

আমাকে সে ঠিকই নজরে রাখবে। চারুর মাতৃভক্তি ও প্রবল। মায়ের কথা সে সবসময় অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। তিন ভাই বোনের মধ্যে সে ই সবচেয়ে বেশি মায়ের ভক্ত।

মন টা আজ খুবই বিক্ষিপ্ত। সকাল থেকেই যা যা ঘটেছে তাতে করে মনের মধ্যে অদ্ভুত এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। সকাল সকাল কার মুখ দেখে ঘুম ভেঙেছিলো কে জানে। দিনটাই আজ মাটি।

হঠাৎ করে মায়ের আচরণ আজকে এমন হয়ে গেলো কেন? কি এমন হয়েছে? বলা নেই কওয়া নেই দুম করে বিয়ের প্রস্তাবই বা জোগাড় করলো কোথা থেকে কে জানে? যতই ভালো প্রস্তাব হোক। ভালো করে জানা নেই শোনা নেই অমনি বিয়ে। ব্যপারটা কেমন যেন খাপ ছাড়া লাগলো আমার কাছে। মা অভাবের জ্বালায় সবকিছু নিয়ে বেশি টেনশন করে সেটা আমি জানি কিন্তু তার এই লোভী রূপ আমায় আহত করল। সমস্ত যুক্তি বোধ বুদ্ধি সব হারিয়ে ফেলেছে বলে আমার মনে হলো।

স্ত্রীর সম্পদে আমি কখনো ধনী হবার পক্ষপাতি নই। মনের মিল না হলে অধিক রুপবতী দিয়ে জীবন কাটানো যাবে কি? বিয়ে দুটি মানুষের সারাজীবনের ব্যপার। এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?

মনের মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো অনবরত। সুলেখার কথা ভাবতেই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠছে। সুলেখাও আমার সাথে এত বড় বেঈমানী কি করে করল। কি দরকার ছিলো এই ছলনার। আমি ঠিক করলাম সুলেখাকে ভুলে যাবো ।যত কষ্টই হোক না কেন, অন্তর জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় যাক, আমায় সুলেখাকে ভূলে যেতে হবে। এক সাথে দুটো সম্পর্ক কখনো ই কারো মঙ্গল ডেকে আনবে না। সবদিক বাঁচাতে আমাকে বরং নতুন জীবনেই মানিয়ে নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।নানা কথা ভাবতে ভাবতে একটু তন্দ্রা মত এসেছিলো।কাছের মসজিদে এশার আযান হচ্ছে।

ঠিক তখনই গাড়ীর হর্ণের বিকট আওয়াজে তন্দ্রা ছুটে গেলো। চারু এসে জানালো নতুন আত্নীয়রা চলে এসেছে। পোশাক পরে মা তৈরি হতে বলেছে। কিছুক্ষণ পরে এক ফাঁকে মাও এসে একটু সাজগোজ করার তাগাদা দিয়ে গেলো। মা আর বোনের ব্যস্ততা দেখে আমার হাসি পাচ্ছে। যেহেতু আমি ঘর অন্ধকার করে শুয়ে ছিলাম। উঠে আলো জ্বাললাম। মনের কষ্ট মনেই রাখতে হবে। সুলেখাকে ভূলে যেতে হবে। সুলেখার স্মৃতি ভুলে যেতে হবে। আমার ইচ্ছে না করলেও মায়ের কড়া হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্ট করলাম। কিন্তু কেন যেন বার বার সুলেখার কথা, তার ছবি,তার হাসি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। বুকের কষ্ট গুলো দলা হয়ে গলায় এসে জমা হলো। জগতের এই অবাঞ্ছিত রূপকে আমার কাছে বিষাক্ত মনে হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি মা আবারও ফিরে এলেন,
-ঘরের মধ্যে এখনো কি করছিস। তৈরি হয়ে নে।
-মা এতো ব্যস্ত হবার কি আছে? একটু সময় নাও।
-না সময় নেওয়া যাবে না। সুমিতার মামা বিদেশ থেকে এসছেন উনি ব্যস্ত মানুষ। উনার ব্যস্ততা আছে, উনি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যাবেন। তিনি চান যাবার আগে বিয়েটা হয়ে যাক। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।ওনারা অপেক্ষা করছে।
-সব তো সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছো, এখানে আমার আর কি দরকার?
-বেশি বুঝতে চেষ্টা করো না। সব তোমার ভালোর জন্য করা হচ্ছে। বাড়ি ভর্তি লোকজন আমি চাইনা তুমি এতো লোকের মধ্যে কোন নাটক করো।
-ঠিক আছে মা তুমি নিশ্চিত থাকো আমি কোন কিছু করবো না। প্রমিজ। দয়া করে এখন বিরক্ত করো না।
-মা চলে গেলেন। যাবার আগে যথারীতি তাড়া দিয়ে গেলেন।

মা যখন আমার কোন কথাই শুনবে না বলে ঠিক করেছে তখন সেই কথা ভাবতেই আমার মনের মধ্যে এক তীব্র অভিমান জমা হলো। বড় আপা নিজের ইচ্ছায় বাড়ি ছাড়লো অজানা অচেনা ছেলের হাত ধরে। আমাদের কথা একটুও ভাবলো না। নিজেরটাই শুধু ভাবলো। মা বাবা দুজনের মনেই এর জন্য কষ্ট সহ অপমান বোধের এক গভীর ক্ষত এখনো জ্বলজ্বল করছে। আমি ঠিক করলাম আমি আর তাদের দুঃখের কারণ হবো না। আজ আর নিজের কথা ভাববো না। জীবনে যা হবার হবে।

সুলেখাও ছলনার আশ্রয় নিয়ে, নিজের অবস্থান গোপন করে, আমাকে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে চরম কষ্ট দিয়েছে। নারী জাতির প্রতি মনটা কেমন যেন বিষিয়ে উঠলো্। যদিও এটা ঠিক না একজনের দোষে সমগ্র নারী জাতিকে দোষী ভাবা ঠিক না। তবুও মনের আকাশে কত কথাই না ভেসে বেড়াতে লাগলো। সুমিতাও কি এমন হবে? শুধু নিজের কথাই ভাববে ? কি হবে বিয়ে করে শুধু দুখ কষ্টের মধ্যে নিজেকে টেনে নিয়ে আমি বুঝতে পারছি মা এসে বকবে আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
তবু আবারো ঘুরে ফিরে মনের মধ্যে সুলেখার চিন্তা এলো। এমন কেন হচ্ছে বুঝতে পারছিনা। যাকে আমি ভুলতে চাচ্ছি সে কেন বারবার আমার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে?

আচ্ছা বিবাহিতা মেয়েদের দেখলে তো খানিকটা চেনা যায়। সুলেখার মধ্যে তো তেমন কোন চিহ্ণ দেখা যায়নি। গিয়েছে কি? আমার চোখে তো পড়েনি। নাকি প্রেমে আমি অন্ধ হয়ে গেছিলাম। আমি কি বোকা!
আমি তো ততটা বোকা নই, সুলেখার কোন সাজ-পোষাকে দৈহিক আচরণে তাকে বিবাহিতা মনে হয়নি। নাকি হয়েছে। সুলেখা যদি বিবাহিতা হয় তাহলে আমার প্রথম প্রেম পরকীয়ায় কলঙ্কিত হয়েছে।
ছিঃ! সুলেখা ছিঃ! আমার সাথে এমনটা কিভাবে করতে পারলো। এই নষ্ট কলঙ্কিত মেয়েটাকে আমার জীবনের ডায়েরি থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে হবে। ফেলতেই হবে।

তাছাড়া একজনের সংসার ভাঙার অধিকার আমার নেই আমি মনে মনে ঠিক করলাম সুলেখার সাথে আর দেখা বা যোগাযোগ কিছুই করবো না। সে থাকুক তার মতো। যদিও এই সিদ্ধান্ত নিতে আমার বুকটা হু হু করে উঠলো তবু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। আমি অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর সুলেখার সাথে কোন ক্রমেই যোগাযোগ করবো না।

পরের সপ্তাহে আমার বিয়েটা হয়ে গেলো। বেশি ধুমধাম নয়, সামান্য কিছু আয়োজনে। আত্মীয় স্বজন সকলে ধন্য ধন্য করতে লাগলো আমার বউকে দেখে। সারা দুপুর বিকেল সুমিতা আমার সাথে থাকলেও কথা বলার সুযোগ খুব একটা হলো না। তবে তাকে আচার আচরণে খারাপ মনে হলো না। প্রথম দেখায় যে কেউ সুমিতাকে খুব পছন্দ করবে। নিপাট নিরীহ দেখতে একটা মেয়ে সুমিতা। রূপে তেমন আহামরি না হলেও কথাবার্তায় বাচনভঙ্গীতে অত্যন্ত সাবলীল। অনেক সহজে সে যে কারো সাথে মিশে যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। নববধুরা খুব একটা কথা বলে না কিন্তু সুমিতা বেশ কথা বলছে। সুযোগ বুঝে দুএকবার সে আমাকে খোঁচা ও মেরেছে। আমি খনিকটা অবাক।

একটু রাত হতেই মা বললেন, বাবু যা ঘরে যা ঘুমিয়ে পড় গে যা। অন্যদিন হলে কিছু মনে করতাম না কিন্তু আজ বেশ লজ্জা লজ্জা লাগলো। চারু মিচমিচ করে হাসতেই আমি চোখ পাকালাম কিন্তু তাতে সে একটুও ভয় পেলো বলে মনে হলো না। খিলখিল করে হাসতে লাগলো। আমি একরকম পালিয়ে ঘরে চলে এলাম।
ঘরে ঢুকতেই সুমিতা বলল, এতো দেরী হলো যে আমি তো কতক্ষণ হলো অপেক্ষা করছি। কি করছিলে।
-না মানে গেস্ট ছিলো তো তাই ।
– ও এখন বুঝি ঘুম পেয়েছে তা্ই এসছেন? তাই তো?
-আমি এতো সকালে ঘুমাইনা।
-ও ভালো। আমিও সকাল সকাল ঘুমাইনা। যাক গল্প করা যাবে। বসুন।
এ মেয়েটি দেখছি অনেক বেশি ফটফটিয়া। নতুন বউ এত চোখে মুখে কথা বলতে পারে জানা ছিলো না। আমি বললাম,
-তোমায় কিন্তু দেখতে বেশ।
-বাহ এত ভালো করে কখন দেখলেন। আচ্ছা আপনার নাম অলক, তাই তো? অলক মানে কি?
-অলক মানে কুঞ্চিত চুল। তোমাকে বেশ লক্ষী টাইপ দেখতে!
-অতি ভক্তি কিন্তু চোরের লক্ষণ।
-আচ্ছা তুমি তো বেশ চটপটে একটা মেয়ে প্রেম ট্রেম করোনি? লাভ ম্যরেজ না করে এরেন্জ ম্যরেজ করলে যে?
-আপনিও তো লাভ ম্যারেজ না করে ……. যা হোক রাতে পানি টানি খেলে ওই ওখানে রাখা আছে।
-আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না কিন্তু?
-ছেলে দেখলে ভয় লাগে তাই প্রেম ট্রেম করিনি।
-তুমি …ছেলে দেখলে ভয়?! আমায় দেখেও কি ভয় লাগছে?
-জানি না বুঝতে পারছি না। তবে খুব লজ্জা লাগছে।
-তোমার কথাবার্তায় কিন্তু সেরকম মনে হচ্ছেনা। যাক লজ্জা পাওয়া ভালো। ভয় পেলে সমস্যা।
-কি রকম?
-এই যেমন তোমায় একটু ছুঁয়ে দিলাম যদি ভয় পাও তাহলে তো চেঁচাবে। চেঁচালে মান সম্মান আর থাকবে?
-আমি মোটেও ওরকম হ্যাবলা ভ্যাবলা টাইপ মেয়ে না।
-আমি কি তোমায় একটু স্পর্শ করতে পারি।
-আপনার কি আমায় খুব স্পর্শ করতে ইচ্ছা করছে।
-এ আবার কেমন কথা ? করছেই তো।
-তাহলে বাতি নিভিয়ে দিয়ে আসুন, এসে আমায় স্পর্শ করুন।
আমি বাতি নিভিয়ে দিলাম। ঝুম অন্ধকার। ঘরটা আমার পরিচিত কিন্তু সুমিতা কে কোথাও দেখছি না মানে ওর সাড়া শব্দ পাচ্ছি না।
-সুমিতা তুমি কোথায়?
হালকা হাসির শব্দ এলো।
-কি হলো?
-আমার একটা প্রশ্ন ছিলো?
-কি প্রশ্ন?
-আচ্ছা সুলেখাকে বিয়ে করলে না কেন?
হঠাৎ আমি থমকে গেলাম, মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, তুমি কি সুলেখাকে চেনো? কিভাবে?
হঠাৎ সব কেমন যেন চুপচাপ। কোন আওয়াজ নেই কিছুক্ষন পরে সুমিতা গম্ভীর হয়ে বলল,
-রাত অনেক হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ো। আমার ঘুম পাচ্ছে।
মনটা হঠাৎ ভার হয়ে গেলো। কি বলবো বুঝতে পারছি না। একটু বিব্রত ও লজ্জিত ও হলাম কিন্তু আরো অবাক হলাম ভেবে এই মেয়েটি সুলেখার কথা জানলো কি করে। আমাদের প্রেম তো এত ফাটাফাটি টাইপের না যে লোক জানা জানি হয়ে অন্যরকম অবস্থা। আর এসব জানার পরও এই মেয়ে তবে আমাকে বিয়েতে রাজী হলো কেন? না করে দিতেই পারতো। আবার জানলেও চেপে যেতে পারতো। অন্তত আজ এসব কথা কি তোলা খুবই জরূরী ছিলো? কি চায় মেয়েটি? সুমিতার আচরণ গুলো কেমন যেন সন্দেহ লাগলো আমার কাছে…….

3 thoughts on “সম্পর্কটা ভুল ছিলো [৪]

  1. গল্পটিতে এক কথায় মন বসে গেছে। এখন বেশ এনজয় করতে পারছি।
    শুভেচ্ছা জানবেন মি. ইসিয়াক। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. বেশ লাগল দুদিন ধরে পড়ালাম

    অনেক শুভেচ্ছা রইল কবি দা———-

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।