তবুও খদ্দরের আশায় রাস্তায়

স্বাধীনতার মাস তাই অরূপ সাজ। রাজধানীর বিজয় সরণি সিগনালের রূপ যেন জ্বলজ্বল করছে। রূপ ফুটেছে ওপারের সিগনালেও। লাল-নীল বেগুনী রঙের ঝাড়বাতিগুলো যেন এ আনন্দের রাতের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে আছে। সড়কের দু’ধারে সারি সারি লাল-সবুজের পতাকা পতপত করে উড়ছে। মধ্য রাতের সড়ক। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে খানিকটা বিশ্রাম নেয়ার ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ফেলছে। তবে সে নিঃশ্বাস যেন লেপ্টে দিয়ে যাচ্ছে রাতের যন্ত্রগুলো। তেমনি একটি যন্ত্র থেকে (প্রাইভেটকার) উচ্চস্বরে ভেসে এলো “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা” শিরোনামের গানের সুর।

এদিকে এমন গান আর সুরেও ওদের মন গললো না। সন্ধ্যার পর থেকেই পুলিশ তাড়া করছে। এ বেলায় যে ওরা ভারি বিরক্ত, ক্লান্ত তা চোখের তির্যক চাহনিতেই প্রকাশ পাচ্ছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে অন্যেরা চলে গেছে। তবে রঙিন বাতিগুলোর সঙ্গ নিয়ে ‘ওরা’ তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। ওদের একজন লিমা। কড়া মেকআপ আর ছলনাময়ী অঙ্গ সাজের কারসাজিতে বয়সের সঠিক সীমানা দেয়া যাচ্ছিল না। কোন বেলায় পান খেয়েছিল, তা কে জানে? তবে পানরস শুকিয়ে গেলেও ঠোঁট খানিকটা লাল রয়েছে এ বেলাতেও। পাশ দিয়ে ছুটে চলা গাড়িগুলোর হেডলাইটের আলো যখন ওর মুখে গিয়ে পড়ছে, তখন পানমাখা ঠোঁট দুটো বেশ রক্তিম হয়ে উঠছে। ঠোঁটের নিচে লেগে থাকা এক চিমটি শুকনো চুনও সুভ্রতা ছড়াচ্ছিল অমন আলোতে।

গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। খানিকটা আনমনা বটে, তবে পথচারী পুরুষেরা ওর দৃষ্টি এড়াতে পারছে না। চোখ ঢুলুঢুলু। কিছুটা লালচেও। যে গাছে ভর করে দাঁড়িয়ে লিমা, তা যে একেবারেই সরু এমনটিও নয়। তবুও আড়াল করতে পারছে না লিমা নিজেকে। শরীর থেকে তার পেট যেন বেরিয়ে আসছে।কাছে গিয়ে কথা বলতেই ওড়না দিয়ে পেট আড়াল করার চেষ্টা। কিছুটা সংযতও বটে। কিন্তু পুরো পেট ঢাকার চেষ্টা বৃথাই রইল। ওড়নার বাকি অংশ দিয়ে মাথা ঢেকে নেয় লিমা। কথা বলায় প্রথমে অস্বস্তি ছিল, তবে আলাপের সৌজন্যে মুহূর্তেই জড়তা কেটে যায ওর। এ পথে আসা আরও দশজন যৌনকর্মীর মতোই লিমার জীবন কথা। সমাজ, পরিবার থেকে নিজেকে বাঁচাতে অনেক সময় ওদের কথায় অসচ্ছতা থাকে, থাকে সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণও। হয়ত লিমাও তার ব্যতিক্রম নয়। সত্য-মিথ্যার মাপকাঠিতে ওর জীবনকথা মূল্যায়ন করা না গেলেও জীবনযুদ্ধে যে এক পরাজিত সৈনিক তা সহজেই বোঝা যাচ্ছিল। না হলে মধ্যরাতে খদ্দেরের আশায় এমন শরীরে কেউ রাস্তায় দাঁড়ায়!

কৈশোরের সীমা না পেরুতেই এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ঢাকায় আসেন অন্যের বাসায় কাজের বুয়া হিসেবে। ভালোই কাটছিল সে সময়। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বনায় সে সুখ স্থায়ী হয়নি তার। বাসার মালিক বিদেশ চলে যাওয়ার পরে ছন্দ পতন ঘটে লিমার জীবনে। পাশের বাসার আরেক বুয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়েই জীবনের স্রোত বিপরীত মুখে প্রবাহিত হয় তার। ১৪ বছর বয়স থেকেই ফার্মগেটের হোটেলে দেহ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন এ কিশোরী। প্রায় ১৩ বছর ধরে রয়েছেন এ পেশায়। আলোর পথে ফেরার চেষ্টা ছিল। তবে তা আর হয়ে ওঠেনি। রূপ আর গতরে ভাটা পড়ার পর ছাড়তে হয়েছে হোটেল আঙ্গিনা। এখন রোজ রাস্তায় দাঁড়িয়েই পুরুষের সঙ্গী হয় লিমা। দিনে ঘুমান ফার্মগেট পার্কে। আর নিশি কাটে ঢাকার ব্যস্ততম সড়কে খদ্দেরের পথ চেয়ে।

সুখ টানে নয়, সিগারেটের ধোয়ার সঙ্গে দীর্ঘ নিঃশ্বাসও ফেলেন লিমা। বলেন, ‘স্বাধীনতা নাকি কিসের দিন আইজ! আগ রাইত থেহে পুলিশে জ্বালাতন করতাছে। ভোরে ভিআইপি যাইব বলে আমাগো আর দাঁড়াইতে দিচ্ছে না। দৌড়ানি খায়া অনেকেই চলে গেছে।’ পেটের উপর অসহায়ত্বের হাত বুলিয়ে বলেন, আমি আছিই। দুটি কাজ করেছি। কন তো এমন ড্যাবড্যাবা প্যাট নিয়া কেউ রাস্তায় খাড়ায়! কি করুম? সবই কপাল। নইলে ভাতারের নেশার ট্যাকা পামু কই? দুঃখ ভুলতে নিজেও তো খাই।পেট নিয়েও লিমা রাস্তায় নিজের দেহ বিক্রি করে জীবন সচল রাখার জন্য অপর দিকে আতিয়া মহলের পাঁচ তলায় বসে হুংকার দেয় মর্জিনা।ঢাকা যেন মেক-আপ পরা নতুন বউ আর সিলেট যুদ্ধক্ষেত্র কিন্তু রাজনীতি লিমার পিছনে ছুটতেই যেন ভালবাসে।

৯৩৬ মিলিয়ন বিশ্ববাসীর জন্য পযাপ্ত খাওয়ার অভাব, ২০৮৬৪ জন প্রতিদিনই মরে খাওয়ার অভাবে। আমার দেশে মরা ও ভুগা থাকার সঠিক হিসাব আদৌ পাওয়া যাবে কি জানি না। আমি, তুমি কিংবা তোমরা সবাইতো ভালবাসি প্রাণপ্রিয় দেশটি, দোহাই তোমাদের তোমরা জঙ্গি হয়ে আমাকে হত্যা কর না তোমাদের টাকা লিমাকে দাও তার দোয়ায় তোমরা হয়তো দোজগে যাবে না।

# Manabzamin

6 thoughts on “তবুও খদ্দরের আশায় রাস্তায়

  1. জীবনের গল্প গুলো সত্যিকারার্থে ভীষণ মন খারাপ করা হয়ে থাকে। আমাদের চারপাশের অবহেলিত মানুষের দৈনন্দিন এই চিরচেনা ভাব-ভাষা-অনুভূতি একেবারে অপরিচিত নয়। এই ই তো জীবন। সব মিলিয়ে চলছে যেমন; চলবে তেমন।

    1. জীবনের প্রতিছবি না থাকলে সাহিত্য রসবোধ হয় না তাই লিখি । আপনার মন্তব্য জীবন নিয়ে লিখতে সাহস পাই। ধন্যবাদ আপনাকে

  2. আপনার লেখা পোষ্ট পড়ে মনটাই সাতসকালে কেমন যেন হয়ে গেলো। বর্তমানে ঢাকা নারায়ণগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাসমান পতিতাদের দেখলে খুবই মায়া লাগে। ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে মন চায়। কিন্তু দাঁড়াতে পারি না লোকচক্ষুর ভয়ে। কিন্তু মায়া লাগে। ওদের কথা ওদের মাঝেই থেকে যায়। কেউ জানে না ওদের বর্তমান অবস্থার কথা। সবাই শুধু ওদের ঘৃৃণার চোখেই দেখে। এমনটা করা আসলেও ঠিক নোয়! তবুও সবাই ওদের ঘৃ্নার চোখেই দেখে থাকে। 

    মহান স্রষ্টা সবার সহায় হোক।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।