এক
গত বছর ঠিক এই মার্চেই আমার অচেতন শরীর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ডঃ কল্যাণ, কার সঙ্গে জানি না, তিনদিন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ভাসিয়ে তোলেন আমায়। চতুর্থ সকালে বেডের কোনায় বসে গলাটাকে এক্সটেনশান কর্ড বানিয়ে কানের কাছে ফিসফিসানি: কী সমস্যা আপনার, খুলে বলুন তো? খামোখা বিষ খেতে গেছিলেন কেন!
আমি তো মাল্টিস্টোরিড থেকে পড়লাম: বলছেন কী ডাক্তারবাবু! বিষ খাব, পাগল হয়েছি নাকি?
পাঁচ পাটকাঠি-আঙুল নাড়িয়ে আশ্বস্ত করলেন: না না, অবসাদ-এর রোগিকে ক্লিনিক্যালি পাগল বলা যাবে না। কিন্তু বোতলের গায়ে ‘পয়জন’ লেখা দেখেও তো আপনি ওটা গলায় ঢেলেছেন?
— হ্যাঁ, ডঃ কল্যাণ, লেখা ছিল। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারিনি!
এক্সটেনশান কর্ড এবার স্প্রিংপাত্তির টান খেল: “ক্কী বলছেন! বিষ লেখা, তবুও অবিশ্…!
— কেননা আমি আমার জীবনে যখনই কাউকে বিশ্বাস করেছি, তখনই ঠকেছি।
দুই
আমাদের যত বয়েস বাড়ে, শিখতে থাকি কীভাবে অন্যের ওপর থেকে ভরসা তুলে নিতে হবে, সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়তে হবে কোন সিজিএস-এফপিএস পদ্ধতিতে। এটা আমার ভেতরে এত ছোট ছোট ডোজে চালু হয়েছিল যে শুরুতে ধরতেই পারিনি! এখন তো করার কিছু নেই, সুতরাং “অবিশ্বাস” শব্দটাকে আপগ্রেড করে আমি তার নাম দিয়েছি “অভিজ্ঞতা”। অবিশ্বাস নিয়ে আপনি কোথাও যেতে পারবেন না — না সম্পর্কে, না খেলার মাঠে। মিলন-বিচ্ছেদ সমান যন্ত্রণার মনে হবে, হার-জিত জিভে ঠেকবে দুভাবে রাঁধা একই পশুমাংস। অভিজ্ঞ সে-ই — যে হৃদয়ের সঙ্গে সব যোগাযোগ সফলভাবে ছিঁড়ে ফেলতে পেরেছে। তাকে এবার কেউ ঠকাক দেখি?
তবু মোপাসাঁর গল্পে মায়ের হৃদপিণ্ডের মতো মাঝে মাঝে মৃত্যুমুখী মনের গলা শুনতে পাই: তুমি প্রতারিত হওয়ার দায়িত্ব অন্যের কাছ থেকে কেড়ে নিজের হাতেই তুলে নিলে বুঝি!
তিন
মানুষের ‘পরে অবিশ্বাসহেতু কেমিস্ট্রির প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া মেনে আমি জিনিস-এর ওপর নিশ্চয়তা রেখেছি। এখন আমার বাড়ি, আমার ছোট্ট মারুতি জেন আর ব্যাংকের টাকাক’টাকে ভালোবাসি। আমার ধারণা, প্রত্যেকটা বাড়িই একরকম স্মৃতিসৌধ আর এও খুব শক্তভাবে বিশ্বাস করি যে জগতে শুধু স্মৃতিতোরণই অমর হওয়ার ক্ষমতা রাখে। দ্বিতীয়ত, সম্পর্কের চেয়ে গাড়ি অনেক বেশি নাইলোগ্রিপ। আর টাকা কখনও নিজের ইচ্ছেয় খরচা হয়ে যেতে পারে না। নোট তো মৃত, তাই সে সব সময় আমার মুঠোতেই থাকবে।
চার
আজকাল কোনও মেয়েকে ভালো লেগে গেলে আমি তাকে জিনিস-এ কনভার্ট করার চেষ্টা করি। মানে একটা ভূমিকা দিই, ধরা যাক, বিয়ে করে ফেলতে চাই। তাকে আমার বউয়ের চরিত্র প্রদান করলাম আর কী। প্রেমিক বা প্রেমিকার চেয়ে একজন স্ত্রী অথবা স্বামী অনেক বেশি সলিড ব্যাপার। রাষ্ট্রের আইন, কোর্ট, সবার ওপরে পুলিশ রয়েছে চরিত্রটাকে ঘনত্ব দেওয়ার জন্যে। প্রেমিক যেন অনেকখানি স্বপ্ন, তাই যেইমাত্র কেউ প্রেমে পড়ল, ওমনি বিয়ের চিন্তা মাথায় ঢুকে যায় — ভালোবাসা কী মারাত্মক ভয়ের বস্তু ভেবে দেখুন! বিয়ে হলে তবেই না আমরা একে অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার যুদ্ধে মেতে উঠব? যে সম্পর্কের কোনও নাম আছে — বাবা-ছেলে, বোন-ভাই, বন্ধু-বান্ধব, সেখানেই এই কাহিনি। কে কাকে সংজ্ঞায়িত করবে, কে কাকে কমিয়ে আনবে, কে প্রভু হবে কে দাস?
পাঁচ
এত কথা মনে পড়ছিল আজ বাসে চেপে পুরোনো হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তায়। না, “জেনেশুনে বিষপানের একবছর” পালন করতে আমাকে ডাকেননি কর্তৃপক্ষ। রুটিন চেকআপে যাচ্ছি — ছোটখাটো রক্ত পরীক্ষা, খুব তেমন বুঝলে একটা সাইকোমেট্রি।
ডঃ কল্যাণ বুকে স্টেথো বসিয়ে আচমকা চমকে দিলেন: আপনি আমার কাছে আসার আগে ডঃ সঞ্জয়কে দেখাতেন?
কোথায় সঞ্জয় মানে কেন সঞ্জয়.., ধরা পড়ে আমি ধৃতরাষ্ট্র হয়ে উঠি।
— আমাদের দুই ব্যাচমেটের মধ্যে ইন্টারেস্টিং কেসগুলো নিয়ে এখনও কথাবার্তা হয়। আপনার ব্যাপারে খুব দরকারি ইনপুট দিল, অথচ নিজে পুরোটা চেপে গেছেন!
কল্যাণ এবার স্টেথো রেখে নাকের সামনে মেটে-হাতুড়ি উঁচু করলেন: আপনার জীবনে গত কুড়ি বছর একটা স্টেডি প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে, এদিকে লোকজনকে বলে বেড়ান আমি নিঃসঙ্গতায় ভুগে ভুগে ডিপ্রেশানের শিকার হয়েছি। ছিঃ!
— যাব্বাবা! বিশ্বাস করুন, এসব গুজব একেবারেই ভিত্তিহীন।
— আপনার মুখে বিশ্বাসের কথা!
একেফর্টিসেভেন হাসি সাতচল্লিশ সেকেন্ড ব্রাশ ফায়ারিং করার পর ডাক্তার আবার গলা এগিয়ে দিলেন আমার চোখের কর্নিয়ার কাছাকাছি: আরন্ট ইউ ইন লাভ উইথ ইওর আমব্রেলা?
ছয়
— হ্যাঁ, আমি ছাতা পছন্দ করি। ওর শ্যামা রঙ আমাকে মায়ের কথা মনে পড়ায়। মা সব সময় মুখনাড়া দিত, কী ছাতামাথা লিখিস! শেষ পর্যন্ত সেই কথাটাই সত্যি হয়ে গেল, দেখুন! ও আমার জন্যে অনেক কিছু করেছে, আর আমি দুহাত পেতে নিয়েই গেলাম। আমি হারিয়ে না ফেললে ছেড়েও যায়নি কোনওদিন। আই রেসপেক্ট মাই আমব্রেলা, রোদবৃষ্টি শুধু নয়, ঝড় বা খুব গভীর জ্যোৎস্নাতেও ওর সঙ্গ ভালো লাগে আমার। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি ছাতার প্রেমে পড়েছি, প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না।
মুখ নিচু করে বসে থাকলাম। সৃষ্টি মানে কি উন্মোচন নয়, ক্রমাগত নিজেকে পর্দার আড়ালে নিয়ে যাওয়া? সত্যি থেকে সরে আসতে থাকা চাঁদের কলাক্ষয়ের মতো, আর তাই মনের অসুখ? চিকিৎসা মানে নিজেকে না-জেনেও জয়েসের উপন্যাসে স্টিফেন ডিডালাসের মতো হিমঠান্ডা স্বীকারোক্তিবাক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো! দুরারোগ্য একা…
(পুরোনো পোস্ট)
অনন্য শব্দ সম্ভারে জীবন বোধনের অসাধারণ প্রকাশ। বিশেষ শুভেচ্ছা প্রিয় কবি দা।
জীবনবোধ নিয়ে লেখা পড়ে অন্যের কথা বাদ দিয়ে শুধু নিজের কথাই ভাবছি।
শুভকামনা থাকলো।
ঈদ মোবারক প্রিয় চন্দন দা। নিরাপদ থাকুন সব সময়। শুভকামনা …